#ইতি_নিশীথিনী (কপি করা নিষিদ্ধ)
#১৭তম_পর্ব
কাগজ হাতে নিতেই মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে যায় নিশীর। বিস্ফারিত হয়ে যায় তার নয়নজোড়া। রীতিমতো বুক কেঁপে উঠে তার। তারপর নীরার দিকে তাকায়। নীরা নির্লিপ্ত ভাবে তাকিয়ে আছে। অথচ এই ছোট মেয়েটি এই সাংঘাতিক ছবিটি একেছে। ছবিটিতে একটি নারীকে জঘন্যভাবে হ*ত্যা করা হচ্ছে। গলগলিয়ে র*ক্ত বের হচ্ছে তার মুখ থেকে। কালো একজোড়া হাত তার গ*লা চে*পে ধরে আছে। শুধু কালো হাতজোড়াই একেছে নীরা। নারীর চোখ বিস্ফারিত হয়ে আছে। তার চোখে বাঁচার আকাঙখা। এতো ছোট মেয়ে এতো ভয়ংকর কিছু এতোটা সাবলীল চিত্তে আঁকতে পারবে এ যেনো অকল্পনীয়। নিশীর কপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো ঘামরেখা। মস্তিষ্ক এখনো ঝিম ধরে আছে। কিছুই ভাবতে পারছে না সে। নিশী যখন নিজেকে জোরপূর্বক সংযত করতে ব্যাস্ত তখন ই নীরা এগিয়ে এলো তার পানে। হাত বাড়িয়ে চাইলো কাগজটি। নীরার মুখশ্রী এখনো নির্বিকার। তার মুখে ভয়ের অস্তিত্ব নেই, অথচ তার সৃষ্টি ই এতোটা ভয়ংকর। নিশী কাঁপা স্বরে বললো,
“এই ছবিটা তুমি এঁকেছো?”
নীরা ঘাড় বাঁকালো। তারপর মাথা দোলালো। নিশী কিছু সময় চুপ করে থেকে বললো,
“এই দৃশ্য কি তুমি স্বপ্ন দেখেছো?”
নীরা মাথা দুপাশে দোলালো, যার অর্থ সে স্বপ্নে দেখে নি। নিশীর ঠোঁট কাঁপছে। তার ভয় হচ্ছে। বিশ্রী, নিকষকালো ভয় তার ভেতরটাকে বারবার কাঁপিয়ে তুলছে। নীরার মতো নিষ্পাপ বাচ্চাটিকেও তার ভয় হচ্ছে। নিশী গাল ফুলিয়ে বার তিনেক নিঃশ্বাস ছাড়লো। নিজের অশান্ত মস্তিষ্ককে ঠান্ডা করার প্রচেষ্টা চালালো সে। কিন্তু ব্যর্থ হলো। কিছুতেই নিজেকে শান্ত করতে পারছে না সে। নীরার বয়স কেবল দশে। হ্যা, সে অনেক বুদ্ধিমান, সৃজনশীল। সে অত্যন্ত চমৎকার হাসে। সে কথা বলে না। নিশীর সাথে তার কথোকপথন হয় ছবি দ্বারা। এমন কি এই ঘরের প্রতিটি দেওয়ালে যে ছবি তাও নীরার ই আঁকা। সব কিছুই তার দৃশ্যতঃ এবং কল্পনার মিশ্রণ। তবে এই দৃশ্যটি কল্পনা নয়। হবার প্রশ্ন ই আসে না। প্রথমত নীরার গন্ডি এই ঘর। তাকে কখনো কার্টুন দেখতেও দেখে নি নিশী। উপরন্তু এতোটা ভয়াবহ দৃশ্য নীরাকে প্রণয় কখনোই দেখতে দিবে না। আর সবথেকে খটকার ব্যাপার দৃশ্যের কালো হাত জোড়ার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ। একটি আঙ্গুল নেই, তার বা হাতে স্বর্ণের আংটি। একটি আঙ্গুল গ*লায় ডেবে গেছে। নারীটির গলায় ও চেইন, চিকন স্বর্ণের। কোনো জিনিস কি কল্পনাতে এতোটা সূক্ষ্ম হয়! নিশীকে নিজেকে অতিকষ্টে শান্ত করলো। তারপর এক লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে বললো,
“তবে এই দৃশ্য কি তুমি নিজে সিনেমাতে দেখেছো, টিভিতে?”
নীরা মাথা দোলালো যার অর্থ সে টিভিতে দেখে নি। তখন নিশী কাঁপাস্বরে বললো,
“নিজের দেখেছো?”
এবার নীরা কিছুটা চুপ করে গেলো৷ তার দৃষ্টি কিঞ্চিত বিচলিত হলো। সে কিছু একটা লুকোতে চাইছে। কিন্তু লুকাতে অসক্ষম হচ্ছে। ঘাড় বাকিয়ে অন্যদিকে তাকালো সে। নিশী আবারো জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি কি নিজ চোখে এটা দেখেছো?”
নীরা এবারোও দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। অনেকক্ষণ এদিক ওদিক তাকিয়ে একপ্রকার ছিনিয়ে নিলো সে কাগজটি। তারপর লুকিয়ে রাখলো নিজের খাঁটের নিচে। নিশী ছুঁচালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নীরার দিকে। অস্বাভাবিক আচারণ করছে সে। সে দৃশ্যটি একেছে ঠিক, কিন্তু কাউকে বলতে চাইছে না। এতো লুকোচুরি কিসের! কৌতুহলগুলো ডানা মেললো, নীরার সত্য জানার কৌতুহল_______
সন্ধ্যে নাগাদ ফিরলো প্রণয়। অঝোর শ্রাবণে ভিজে একাকার সে। গাঢ় নীল শার্টটা চুপসে আছে শরীরে। ঘন চুলগুলো কপালে এলোমেলো হয়ে আছে, তা থেকে চুয়ে চুয়ে গড়িয়ে পড়ছে জলধারা। বাহাত দিয়ে চুলগুলো উল্টালো সে। পৃথা দরজা খোলায় তাকে শুধালো,
“নীরা কই রে?”
“নিশী ম্যাডামের সাথে”
“নিশীথিনী যান নি?”
পৃথা খানিকটা বিরক্ত হলো প্রণয়ের প্রশ্নে। পালটা প্রশ্ন ছুড়লো,
“তোমার উনার প্রতি ইন্টারেস্টটা একটু বেশি না?”
“মানে?”
“মানে উনাকে নিয়ে বড্ড বেশি বাড়াবাড়ি তোমার, সেদিন নাকি বাজার পর্যন্ত করতে গিয়েছিলে? ব্যাপারটা কিন্তু চোখে লাগছে। মা জানলে হিতে বিপরীত হবে”
পৃথার কথাটি কানে যেতেই তীর্যক দৃষ্টিতে তাকালো প্রণয়। প্রণয়ের শীতল ধাঁরালো দৃষ্টিতে কিঞ্চিত দমে গেলো পৃথা। সে আর কিছু বললো না। এর মাঝেই উপস্থিত হলো নিশী। সে পৃথার কথাগুলো না শুনতে চেয়েও শুনেছে। সে ভুল কিছু বলে নি। একজন চালচুলোহীন মেয়ের প্রতি এতোটা আহ্লাদ ভালো না। যতই হোক তারা উভয় ই সাবালক, তাদের এমন প্রশ্নবোধক মেলামেশা দৃষ্টিকটু। কিন্তু প্রণয়কে কিছু বললেই একটা দায়সারাভাব। যেনো পৃথিবী চুলোয় যাক তার কি! নিশী সামান্য গলা খাকাড়ি দিলো। তারপর বললো,
“আমি আসছি”
নিশীর কথা শুনতেই ভাইবোন সচ্চার হয়ে গেলো। প্রণয় এগিয়ে বললো,
“চলে যাচ্ছেন?”
“হ্যা, আমার সময় শেষ”
“আর একটু থাকলে হতো না?”
“বাড়ি ফিরতে হবে”
“আমি পৌছে দেই”
“প্রয়োজন নেই, আপনি ভিজে গেছেন। ফ্রেশ হয়ে নিন। নয়তো জ্বর আসবে”
প্রণয় কাতর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নিশীর দিকে। তার কেনো যেনো নিশীকে একা ছাঁড়তে কিছুতেই সাহস পাচ্ছে না প্রণয়। আজকাল মেয়েটা বড্ড টানছে তাকে। এক অবিচ্ছেদ্য মায়া যেনো। বদ্ধ হৃদয়কে চুপিসারে নিজের আয়ত্ত করে ফেলেছে। উকিলদের মন হয় না, তাদের হয় ধাঁরালো মস্তিষ্ক। প্রণয়ও খানিকটা সেই প্রকৃতির ই ছিলো। হৃদয়কে দূর্বল হবার সুযোগ সে বেশি দেয় নি। কিন্তু এই নিশীথিনী আসার পর থেকেই যেনো ক্ষণে ক্ষণে হৃদয়টা বিচলিত হয়ে উঠে। সেই প্রথম দেখা থেকেই মেয়েটির দীপ্তমান চোখের নেশা তাকে আকর্ষণ করেছিলো। নিজের জীবনের বাজি দিতেও যেনো পিছপা হয় নি সে। ধীরে ধীরে এই আকর্ষণ কখন মায়াতে পরিণত হয়েছে বুঝে উঠতে পারছে না প্রণয়। তার ভালোলাগে। ভালোলাগে যখন তপ্ত হৃদয়ের চারপাশে নিশীথিনীর বিচরণ হয়। নিশীথিনীর বিপদে অসহায় হয়ে যায় সে। নিশীথিনীকে দূর্বল দেখতে কষ্ট হয় তার। এই অনুভূতিগুলো প্রচন্ড তীব্র। তবে অনুভূতিগুলোর উৎস অজানা। নিশী যখন তাকে বিনা সংকোচে জিজ্ঞেস করে,
“কেনো করছেন এগুলো”
উত্তর খুঁজে পায় না প্রণয়। কি বলবে, তার অপরিণত, বেসামাল হৃদয়ের অযাচিত অনুভূতি! যা তার পাথরসম হৃদয়কে দূর্বল করে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত! ফলে ক্রিমি*নাল লয়ার মাহতাব হোসেন হয়ে উঠছে একজন অশান্ত, উদ্বিগ্ন মানুষ; যার চিত্তকে শান্ত করার উপায় নিশীথিনী। এমনটা কেনো হচ্ছে! কেনো নিশীথিনীকে দেখলে সমস্ত হৃদয়ের রক্তের বেগ যেনো তরান্বিত হয়। কেনো এমনটা হয়! কেনো নিশীথিনীর তপ্ত চোখে তাকিয়ে থাকতে শান্তি অনুভূত হয়। কেনো নিশীথিনীকে দূর্বল দেখলে ইচ্ছে করে মাথায় হাত দিয়ে বলি,
“আমি আছি, আমি আছি তোমার পাশে”
কেনো! কেনো! কেনো! এই কেনোর উত্তর ই যে নেই। ফলে দুম করে বলে দেয় “আমার ইচ্ছে”। ইচ্ছেই বটে, অশান্ত বেসামাল চিত্তের অযাচিত ইচ্ছে। নিশী চলে যাচ্ছে। উকিল বাবু এখনো দেখে যাচ্ছে। তার এই দৃষ্টি পৃথার চোখ এড়ালো না। ফলে তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠলো,
“তোমার কি ওই মহিলাকে ভালো লাগে? আই মিন ফ্লিং!”
পৃথার প্রশ্নে চমকে উঠলো প্রণয়। তার কি সত্যি নিশীথিনীকে ভালো লাগে!
*******
ক্লাসের শেষ বেঞ্চে বসে আছে নিশী। তার মস্তিষ্ক অস্থির হয়ে আসে। অমসৃণ কল্পনাতে নিজে পাগল পাগল লাগছে। নীরার আঁকা ছবিটা এখনো মাথায় ঘুরছে। প্রণয়কে জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলো কিন্তু ইচ্ছে করেই করে নি। লোকটির আশেপাশে থাকা বিশাল ঝুকিপূর্ণ। লেকচারে মন নেই তার। সামনে উপস্থিত জসীম স্যার বেশ সুন্দর করে “Introduction of sociology and psychology” পড়াচ্ছেন। অপর মানুষটি ঠিক কতটুকু সত্য বলছে, কতটুকু তার মস্তিষ্কে প্রবেশ করা যায় ব্যাপারটা তিনি বুঝাচ্ছেন। অথচ নিশীর মন এখনো পড়ে আছে এখনো নীরাতে। সে অন্যমনস্ক হয়ে বসে রয়েছে। জসীম স্যার কথা বলতে বলতেই এলেন নিশীর কাছে। গম্ভীর স্বরে বললেন,
“বিচলিত হতে তো যে কেউ আপনার মস্তিষ্কে ঢুকে পড়বে। তখন সত্য মিথ্যে আর যাচাই করা লাগবে না”
জসীম স্যারের কথাটি শুনতেই হকচকিয়ে উঠলো নিশী। আমতা আমতা করে বললো,
“সরি স্যার, আর হবে না”
“আমার নিজেকে ব্যার্থ কাগছে নিশী। তোমার মতো স্টুডেন্ট যদি অন্যমনস্ক থাকে তাহলে আমার পড়ানো বৃথা”
“আসলে…”
নিশী কিছু বলার পূর্বেই তার নজর থমকে গেলো। জসীম স্যারের বা হাতে একটি আংটি আছে। যা হুবহু দেখতে নীরার ছবির কালো হাতের আংটিটির মতো……..
চলবে……
#ইতি_নিশীথিনী (কপি করা নিষিদ্ধ)
#১৮তম_পর্ব
নিশী কিছু বলার পূর্বেই তার নজর থমকে গেলো। জসীম স্যারের বা হাতে একটি আংটি আছে। যা হুবহু দেখতে নীরার ছবির কালো হাতের আংটিটির মতো। একই ডিজাইন, একই প্যাটার্ণ। শুধুতাই নয়। আংটির ডিজাইনে একটা অংশে সামান্য বাকা এবং কাটা ডিজাইন। ছবিতেও এতোটাই সূক্ষ্ণ উপস্থাপন ছিলো নীরার। নিশীর মস্তিষ্ক অবশ লাগছে। চিন্তাগুলো নিথর হয়ে আছে। বাচ্চামেয়েটির মস্তিষ্কে ঠিক কি চলছে? এমন চিত্র সে কেনো আঁকলো। নীরার সাথে কি জসীম স্যারের কোনো সম্পর্ক আছে? পরমূহুর্তেই অন্যচিন্তা আসলো, নীরা যে হাতের চিত্র এঁকেছে সেখানে কালো হাতটির একটি আঙ্গুল ছিলো না, বা হাতে চারটি আঙ্গুল। অথচ জসীম স্যারের তেমনটি নয়। উনার হাতে পায়ে কোনো খুদ নেই। নিশী এখনো অপলক নয়নেই আংটির দিকে তাকিয়ে আছে। নিউরণগুলো যেনো বিশাল গণিত সমাধানে ব্যস্ত। জসীম স্যার গলা খাকারি দিলেন, শান্ত কন্ঠে বললেন,
“তোমার আংটির প্রতি আকর্ষণ আছে না কি?”
তার প্রশ্নে চট করেই ধাধার শহর থেকে বেরিয়ে এলো নিশী। স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
“না স্যার, ইউনিক বিধায় চোখ আটকে গিয়েছিলো”
নিশীর কথায় ঠিক কতোটা বিশ্বাস করলো জসীম স্যার জানা নেই। কারণ তিনি ভ্রু কুঞ্চিত করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন নিশীর দিকে। সাইকোলজিতে পিএইচডি হোল্ডার এই ব্যাক্তি বহুবছর যাবৎ এই কলেজের অধ্যাপক। শুধু তাই নয়, উনি বর্তমানে ক্রিমিনাল সাইকোলজি নিয়ে রিসার্চ করছেন। পুলিশি ব্যাপারে বেশ কিছুবার যোগদানও করেছেন। সুতরাং নিশীর মনোস্তাত্ত্বিক ব্যাপারকে বুঝতে পারা খুব কঠিন নয়। তবে লোকটি যে অত্যন্ত চালাক তার পরিচয় মিললো। তিনি খুব একটা প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। শুধু যাবার সময় বললেন,
“ক্লাস শেষে একবার দেখা করো”
জসীম স্যার সরে গেলেই বক্ষস্থলে জমে থাকা দীর্ঘশ্বাসটি অচিরেই বের হলো। নিশীর হৃদয় এখনো কম্পিত হচ্ছে, তবে মস্তিষ্কে এখনো নীরার চিত্রটির বসবাস। মেয়েটি কেনো এমন ছবি এঁকেছে? আচ্ছা এমন তো নয় যে এই দৃশ্যটি তার প্রিয় কারোর সাথেই ঘটিত। সাথে সাথেই একটি শব্দ মস্তিষ্কে হানা দিলো “মা”। নীরার সাথে নিশীর এই সাক্ষাত প্রায় একমাস। অথচ এই একমাসে কখনোই তার মার দর্শন পায় নি সে। প্রণয় বলেছিলো সে বিয়ে করে নি, অথচ নীরা তার মেয়ে। তাহলে নীরার মা কোথায়? সরাসরি আকাশ থেকে তো একটি মেয়ের আগমণ ঘটে না। অবশ্যই তার মা থাকবেই। এখন দত্তক নিলে ঘটনা ভিন্ন। এমনটা হতেই পারে নীরাকে প্রণয় দত্তক নিয়েছে। কারণ নীরার সাথে প্রণয়ের একটি ছবিও একেবারে ছোটবেলার নয়। তাই নীরা প্রণয়ের দত্তক সন্তান, এই যুক্তি একেবারে ফেলনা নয়। নিশী তাই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো প্রণয়ের সাথে কথা বলবে। এই নীরার চিত্রের রহস্য উম্মোচন করেই ছাড়বে____
নিশীর ক্লাস শেষ হলো দুপুরের দিকে। সে বাসায় ফিরতো কিন্তু জসীম স্যার দেখা করতে বলেছেন। স্যার হয়তো কিছুটা মনোক্ষুন্ন হয়েছেন। অস্বাভাবিক নয়। একজন ছাত্র কিংবা ছাত্রীকে পড়ানোর সময় সে যদি অন্যমনস্ক হয় তবে শিক্ষক হিসেবে তার মনোক্ষুন্ন হওয়াটাই যথার্থ। ব্যাপারখানা কিঞ্চিত অপমানের ও। ক্লাসে ভালো ছাত্রীর ট্যাগ পাওয়া মেয়েটি যদি এমন কাজ করে তবে তো কথাই নেই। তাই নিশী প্রথমে জসীম স্যারের রুমে যাওয়াটাই শ্রেয় ভাবলো।
“স্যার আসবো”
জসীম স্যার আলমারী থেকে একটি মোটা কালো বর্ণের বই বের করছিলেন। নিশীর কন্ঠে তিনি ঘাড় ঘোরালেন। স্মিত হেসে বললেন,
“আসো”
“সরি স্যার, তখন একটু অন্যমনস্ক ছিলাম”
“সরি বলার কিছুই নেই, তোমার জায়গায় আমি হলে আমিও এমন ই আচারণ করতাম”
“জ্বী?”
স্যারের কথায় অবাক হয় নিশী। তার হাসি কিঞ্চিত নিভে। জসীম স্যার তখন মুখের হাসি চওড়া করে বললেন,
“মাহাদী সংক্রান্ত ঝামেলাটা আমার জানা, ঈশানের থেকে জেনেছি। ও ও তো এই ঝামেলাতেই জড়িয়েছিলো”
নিশী ছোট করে একটি নিঃশ্বাস ছাড়লো। জসীম স্যারের সাথে ঈশানের সম্পর্কটা বেশ জোড়ালো। তারা কিভাবে যেনো চাচা ভাতিজা হয়। ঈশান তাকে জসীম কাকু বলেই সম্বোধন করে। তাই এই ঘটনা জানা খুব জটিল নয়। নিশী এখন দাঁড়িয়ে আছে। জসীম তাকে বললো,
“দাঁড়িয়ে থেকো না, বসো”
“জ্বী”
এবার ওই কালো মলাটের বই টি এগিয়ে দিয়ে বলল,
“বই পড়া হয়? গল্পের বই?”
“জ্বী, বই পড়তে মন্দ লাগে না। যেকোনো বই ই আমি পড়তে ভালোবাসি”
“এই বই টা পড়ো। অরিজিন, ড্যান ব্রাউনের। রহস্যের বেশ ভালো মিশ্রন আছে”
“কিছু মনে করবেন না স্যার, আপনি কি এই বইটা দিতেই ডেকেছেন?”
নিশীর প্রশ্নের উত্তরে আবারো হাসলেন জসীম স্যার। তার হাসিটা বড্ড বিচিত্র। যেনো সে বেশ মজাই পাচ্ছে নিশীর কৌতুহলী মুখশ্রী দেখে। আর এই প্রশ্ন যেনো সোনায় সোহাগা। এবার হাসি থামালেন জসীম স্যার। তারপর শান্ত গলায় শুধালেন,
“আমার আংটি দেখছিলে কেনো?”
হঠাৎ এই প্রশ্নে বেশ ভ্যাবাচেকা খেলো নিশী। চট করে উত্তর সাজালো, তারপর বলল,
“আসলে, এমন অদ্ভুত ডিজাইন দেখা যায় না তো। তাই একটু কৌতুহল ই ছিলাম”
“হ্যা, অদ্ভুত বটে। আমার স্ত্রী দিয়েছে। এই আংটি টা নাকি ওই দোকানে মাত্র তিনপিস ই ছিলো। বিবাহ বার্ষিকী উপহার”
“অহ, আমিও সেই জন্য তাকিয়েছিলাম”
“সত্যি?”
“আপনার কেনো মনে হচ্ছে আমি মিথ্যে বলছি?”
“জানি না, তবে আমার মনে হচ্ছে তুমি কৌতুহলে আংটিটি দেখো নি। চমকে দেখেছিলে। আংটিটি তোমার কাছে ইউনিক মোটেই ছিলো না। বরং তুমি যেহেতু আগেই আংটিটি দেখেছো, তাই তুমি শুধু মিলিয়ে দেখছিলেন। আর তোমার চাহনীতে আমার মনে হয় নি এই আংটির সাথে তোমার স্মৃতিটি সুখময়। বরং ভয়ংকর”
নিশী অপলক নয়নে তাকিয়ে আছে জসীম স্যারের দিকে। লোকটি কিভাবে বুঝলো? এতোটা সঠিক মানুষ হয়?
“ক্রিমিনাল সাইকোলজি নিয়ে পড়ার ফল, আমি জাদু ফাদু জানি না। শুধু সুতোর সাথে সুতো জড়াই”
“আমাকে ওই দোকানের এড্রেসটা দিবেন?”
নিশীর প্রশ্নে জসীমের ঠোঁটের হাসি প্রসারিত হলো। কি অদ্ভুত ব্যাক্তি সে!!
******
গোধূলী বিকেল; নিশী, প্রণয় এবং নীরা আজ বের হয়েছে ঘুরতে। আবদারটি অবশ্য প্রণয়ের। নিশী যখন নীরার রুমে তার সাথে পাখি বানাতে ব্যাস্ত তখন ই প্রণয়ের আগমন ঘটে। প্রণয়কে এমন সময়ে দেখে প্রথমে অবাক হলেও প্রকাশ করে না নিশী। সে নির্লিপ্ততা বজায় রেখে পাখি বানানোতে মনোনিয়োগ করেছিলো। তখন ই প্রণয় চট করে বলল,
“ঘুরতে যাবে নীরা, বাড়ির বাহিরে?”
কথাটা শুনেই চোখজোড়া চকচকে হলো নীরার। সে হা করে তাকালো প্রণয়ের দিকে। প্রণয় তখন তাকে বিশ্বাস করাতে বললো,
“সত্যি, তোমাকে আমি সুন্দর একটা জায়গায় নিয়ে যাবো। যাবে?”
নীরা তখন মাথা দোলালো। সে যাবে। তার চোখমুখ হয়ে উঠলো উজ্জ্বল। বদ্ধ ঘরের দায়ড়া থেকে বের হচ্ছে সে। খোলা আকাশ দেখবে। চোখ বন্ধ করে বাতাসের গন্ধ শুকবে। পাখির ডাক শুনবে, এই বদ্ধ ঘরে তো এই সব কিছুই কল্পনামাত্র। নিশী তখন বললো,
“তাহলে আমি বরং চলে যাই”
“কেনো? আমি চলে যেতে বলেছি?”
“থেকে কি করবো? নীরা না থাকলে তো আমার কাজ নেই”
“থাকতেও তো বলি নি, আপনি আপাদের সাথে যাচ্ছেন”
“আমি যেয়ে কি করবো?”
“বাহ রে, পড়াবেন। নীরাকে নতুন জিনিস দেখাবেন, চেনাবেন। কি নীরা, ম্যাম কে নিবো না?”
নীরাও দু বার মাথা দোলালো। যার অর্থ সে নিশীকে নিয়ে যাবে। অসহায় নিশী তপ্ত নিশ্বাস ফেললো। বাবা-মেয়ের কাছে সে হাতিয়ার নামিয়ে দিলো। যার ফলাফল এখন ঘুরতে আসা।
বটিয়াঘাটার এখানে বিশাল জায়গা নিয়ে রেস্তোরা। পাশে বিশাল পদ্মপুকুর, চিড়িয়াখানা। নীরা সবকিছু দেখছে অবাক নয়নে। জায়গাটি প্রণয়ের বন্ধুর। লোকালয় থেকে দূরে। পাশে বিশ্বরোড, তাই মানুষের যাতায়াত কম। একারণেই এখানে আসা। বিশাল সৌন্দর্য্যকে আগলে ধরা এই স্থানে। নীরার জন্য একদম উযুক্ত। নীরা চিড়িয়াখানার খরগোশের জায়গায় হাটুগেড়ে বসে আছে। চকচকে দৃষ্টিতে দেখছে খরগোশ। আর নিশী দেখছে নীরাকে। এমন সময় প্রণয়ের কন্ঠ কানে এলো। জড়তা ছাড়াই নরম কন্ঠে বললো,
“আপনার হাতটা একটু দিবেন নিশীথিনী? ধরতে ইচ্ছে করছে”………
চলবে