#ইতি_নিশীথিনী (কপি করা নিষিদ্ধ)
#১৯তম_পর্ব
এমন সময় প্রণয়ের কন্ঠ কানে এলো। জড়তা ছাড়াই নরম কন্ঠে বললো,
“আপনার হাতটা একটু দিবেন নিশীথিনী? ধরতে ইচ্ছে করছে”
প্রণয়ের কথাটা মস্তিষ্কে ঝংকার তুললো। বিস্মিত নয়নে তাকালো প্রণয়ের পানে। প্রণয়ের মাঝে জড়তা নেই। সে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিশীর দিকে। তার চোখ গুলো শান্ত দিঘীর মতো লাগছে। নিশীর মনে হলো এখন ই বুঝি তলিয়ে গেলো সে। তার কন্ঠ এক অদ্ভুত অনুনয়। নিশী বেশিসময় তাকালো না। দৃষ্টি সরিয়ে নিলো নীরার দিকে। নীরা এখনো চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে আছে খরগোশটির দিকে। সফেদ খরগোশটি কিভাবে খাচ্ছে তাই যেনো তার আগ্রহের মুখ্যম বিষয়। প্রণয় এখনো তাকিয়ে আছে সেটা বুঝতে কষ্ট হলো না নিশীর। প্রণয় নিশীর উত্তর না পেয়ে পুনরায় শুধালো,
“হাতটা কি দেওয়া যায়?”
“আপনার সাথে এরুপ আচারণ বড্ড বেমানান”
নির্লিপ্ত কন্ঠে কথা বললো নিশী। প্রণয়ের শান্ত মুখশ্রীতে সামান্য পরিবর্তন হলো। ভ্রু কুচকালো সামান্য। তারপর অকপটে প্রশ্ন ছুড়লো,
“কেমন আচারণ?”
“অশোভন আচারণ। পেশার সাথে এমন অশোভন আচারণ কি যায়?”
“কোনটা অশোভন?”
“এই যে অকপটে একটা মেয়ের হাত ধরতে চাওয়া! এটা কি শোভন?”
প্রণয় এবার চুপ করে রইলো। মাথা নিচু করে রইলো মিনিট দুয়েক। তারপর ভনিতা ছাড়া বললো,
“আমি কিন্তু এই প্রথম কোনো নারীর হাত ধরতে চাইছি। তাও অনুমতি নিয়ে। এখন সেটাকে প্রত্যাখ্যান আপনি করতেই পারেন”
প্রণয়ের কথাটা আমলে নিলো না নিশী। উলটো কাঠ কাঠ গলায় বললো,
“ভুলে যাচ্ছেন আপনি কিন্তু এক সন্তানের বাবা”
“বাবা হলে কি কোনো নারীকে চাওয়া ব্যান হয়ে যায়! ১৪৪ ধারা জারি হয় নাকি আবেগের উপর?”
প্রণয়ের কথায় ঈষৎ বিরক্ত হলো নিশী। চোখ গরম করে তাকালো। তবে লাভ হলো না। সে বান্দা এখনো তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তার চাহনী ভীষণ ভয়ংকর, কালো চোখজোড়ায় মহাসাগর সম আবেগ সেই চাহনীতে। পুরুষদের এমন চাহনী এই প্রথম লক্ষ করলো নিশী। শান্ত, আবেগী, ঘোরলাগা দৃষ্টি। ক্ষীন জিজ্ঞাসা, ক্ষীন আফসোস। বড্ড অস্বস্তি লাগছে নিশীর। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস গোপন করলো সে। লম্বাটে শ্যাম মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে শীতল কন্ঠে বললো,
“কেনো ধরবেন আমার হাত?”
“ইচ্ছে করছে”
“ইচ্ছের উৎস কি?”
প্রণয় একটু চুপ করে রইলো। প্রণয়কে নিঃচুপ দেখে তাচ্ছিল্য মেশানো কন্ঠে নিশী বলল,
“পুরুষ মানুষ সব ই একই। তাদের অবাধ্য ইচ্ছেগুলো এক না এক সময় বের হয় ই”
“অবাধ্যই বটে। আমার অবাধ্য ইচ্ছের উৎস আপনি। আমার সবটা জুড়ে আপনাকে চাই। হোক তা প্রেমিকা রুপে, প্রেয়সী রুপে কিংবা স্ত্রী। তবে আপনার বিচরণ যে আমার প্রয়োজন। অনেক তো অগোছালো থাকলাম, এবার গুছিয়ে নিতে চাই”
“এই চাইবার কারণ কি শুধু আমার রক্ত মাংসের শরীরখানা?”
“উহু, মাহতাব হোসেনের দেহের নেশা যে কখনোই ছিলো না। আমি নেশায় ডুবেছি ঠিক ই তবে সেটা দৈহিক সৌন্দর্য্যের নয়; আপনার ঔ দীপ্তমান চোখের নেশায় নিজেকে হারিয়েছি, আপনার ধাঁরালো ব্যক্তিত্ব আমাকে ঘা*য়েল করেছে। আমি জানি না ভালোবাসা সত্য নাকি মিথ্যে! সেটার।অস্তত্ব আছে কি না। শুধু এটুকু জানি, আপনাকে আমার চাই, খুব করে চাই নিশীথিনী”
প্রণয় সাবলীল ভাষায় কথাটা বললো, তার এই আবেগঘন আবদার যেনো কড়া নাড়ছে নিশীর কঠিন, শীতল হৃদয়ে। সে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। বেসামাল চিনচিনে ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে। মস্তিষ্ক এবং হৃদয়ের মাঝে এক অঘোষিত যু*দ্ধ শুরু হয়েছে। প্রণয়ের প্রতি তার অনুভূতি গুলো কেবল ই কৃতজ্ঞতা অবধি রাখতে চায় মস্তিষ্ক। অথচ হৃদয় ব্যাকুল হয়ে যাচ্ছে, প্রণয়ের কাতর দৃষ্টি আ*ঘাত করছে বারে বারে। নিশীকে চুপ থাকতে দেখে পকেটে হাত গুজলো প্রণয়। ধীর গলায় বললো,
“আপনাকে অপ্রস্তুত করে দিলাম! আসলে কথাগুলো না বললে বুকটা ভারী লাগছিলো। অযাচিত আচারণগুলো আপনাকে বিরক্ত করছে জেনেও করছিলাম। তবে আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমি এতোটাও অধৈর্য্য হই না। ওকালতি করতে করতে ধৈর্য্যশীল হয়ে গেছি। আমি অপেক্ষায় থাকবো নিশীথিনী, শুধু আপনার জন্য”
প্রণয়ের কন্ঠ খানিকটা হতাশ শোনালো। নিশীও উত্তর দিলো না। তার কাছে উত্তর নেই। মিথ্যে আশা সে দিতে চাইছে না। আজকাল নিজেকে বড্ড পাথর লাগে নিশীর। মনআকাশটা খুব বেরং লাগে। সব রঙ্গ যেনো হারিয়ে গেছে তার। স্বপ্ন দেখতে ভয় হয়। মনে হয় মূহুর্তেই সব মিথ্যে হয়ে যাবে। যেখানে জীবনের ই কোনো নিশ্চয়তা নেই সেখানে এই স্বপ্নগুলো বড্ড বিলাসিতা লাগে। শুধু দিন কাটানোর মতো বেঁচে আছে সে। এই বেঁচে থাকাটাই যে গলার কাঁটার মতো বিধে। এই বেরং জীবনে প্রণয় তার জন্য এক সজীব বৃক্ষরাজি। আবেগের জোয়ারে এই বৃক্ষরাজিটিকে হারাতে চায় না। প্রণয়ের এই আবদারগুলো ক্ষণিকের মোহ অথবা সহানুভূতি মাত্র। হয়তো উজ্জ্বল কারোর দেখা পেলে এই আবেগ ও হারিয়ে যাবে৷ মানুষ আলোকে ভালোবাসে, আঁধারকে ভয় পায়। আর নিশী তো আঁধার এর ই অপর নাম। নিশী তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো। তখন একটা ছেলে এসে বললো,
“স্যার, খাবার রেডি”
প্রণয় ধীর গলায় বললো,
“আসছি”
নীরা এখনো অপলকভাবেই তাকিয়ে আছে খরগোশটির দিকে। প্রণয় এগিয়ে এসে তার পাশে বসলো। তার চুলগুলো হালকা অগোছালো করে বললো,
“পছন্দ হয়েছে?”
নীরা মাথা দোলালো৷ প্রণয় হেসে বললো,
“একটা কিনে দিবো, এখন খেতে চলো”
নীরা উঠতে না। সে বসে রইলো। তার অনুভূতি প্রকাশের ক্ষমতা ক্ষীন। তবে মাঝে মাঝে বেশ প্রখর ভাবেই নিজের অভিমত প্রকাশ করে সে। নিশী এগিয়ে এলো, নীরার পাশে বসে বললো,
“তোমার বন্ধুর তো খাওয়া শেষ, দেখো ও খেলছে। তুমি যদি না খাও ও তোমার সাথে খেলবে না”
নিশীর কথাটা শুনে সে ফ্যালফ্যাল করে চাইলো। তার চোখে এই অদ্ভুত বিস্ময় ধরা দিলো। নিশী হাসলো। তারপর বললো,
“খেলতে চাও না তোমার বন্ধুর সাথে?”
নীরা একটু সময় নিলো। সে আবার তাকালো খরগোশটির দিকে। সাদা খরগোশটি ছুটে চলে গেলো অন্য খরগোশের কাছে। নীরা যেনো ব্যাপারটা কিঞ্চিত দুঃখ পেলো। নিশী তখন বললো,
“যাহ, তোমার বন্ধুটি তো চলে গেলো”
নীরা এবার উঠে দাঁড়ালো। তার মুখশ্রী আষাঢ়ের কালো মেঘের মতো অন্ধকার। নিশী তখন বললো,
“যাহ, চলে গেলো। দেখলে না খাবার কুফল। চলো আমরা খেয়ে নেই। দেখবে ও আবার আসবে”
কথাটা শুনেই চোখজোড়া চকচক করে উঠলো সে। নিশী হাত বাড়িয়ে বললো,
“চলো তাহলে?”
নীরা তার হাতটা ধরলো। পা বাড়ালো রেস্টুরেন্টের ভেতরের দিকে। প্রণয় মুগ্ধ নয়নে দেখতে লাগলো দুজনকে। তার ঠোঁটে স্মিত হাসি। সেই সাথে নিশী নামক বই এর প্রতিটি পাতাকে অনুধাবন করার অবাধ্য ইচ্ছে হৃদয়কে অস্থির করছে। মেয়েটিকে যত দেখে ততই যেনো ঘোর বাড়ে, অদ্ভুত মায়া গ্রাস করে প্রণয়কে। কবি সাহিত্যিকরা কি এই অনুভূতিকেই প্রণয় আখ্যা দিয়েছে? কে জানে?
******
নিশীর কোলে ঘুমিয়ে আছে নীরা। বড্ড ক্লান্ত সে। বাহিরে বের হওয়া তার হয় না। ডাক্তারের কেবিন গুলোই যেনো তার ঘোরার স্থান। তাই আজ মুক্ত আকাশে ক্লান্ত হয়ে গেছে সে। নিশীর তার মাথায় বিলী কেটে দিচ্ছে। তাদের সখ্যতা এখন বেশ। প্রণয় গাড়ি চালাচ্ছে। একটু পর পর লুকিং গ্লাসে পেছনে দেখছে৷ ব্যাপারটা খেয়াল করলো নিশী। বিরক্তিমাখা কন্ঠে বলল,
“সামনে দেখে গাড়ি চালান, এক্সিডেন্ট হবে”
“একটু পেছনে হাত দিবেন। কিছু আছে, আপনার জন্য”
“কি?”
“আরেহ একটু সিটের পেছনে দেখুন না!”
নিশী ঘাড় ঘুরিয়ে বা হাত দিয়ে হাতড়ালো। নরম, তুলতুলে কিছু পেয়েও গেলো। হাতের স্পর্শেই অনুভূত হলো এগুলো ফুল। হাত দিয়ে সামনে আনতেই দেখলো, টকটকে লাল, গোলাপী শাপলা। ডাটা কাটা ফুটন্ত শাপলা। নিশী অবাক নয়নে তাকালো প্রণয়ের দিকে। প্রণয় তখন বললো,
“আমার বড্ড ভালো লাগে শাপলা। তাই তুলে আনলাম। ভাববেন না নিজে তুলেছি। একটা ছেলেকে বলায় ও তুলে দিয়েছে। আসলে প্রেম নিবেদন ফাঁকা হাতে করলে মেয়েরা নাকি গ্রহণ করে না। তাই সামান্য ফুলের বন্দোবস্ত”
“প্রেম নিবেদনের এতো বেহাল দশা হলে মেয়ে আর জুটবে না”
“আমার তো হাজারো মেয়ের প্রয়োজন নেই। একজন নিশীথিনী হলেই হবে”
প্রণয়ের সাবলীল কথায় থমকে যায় নিশী। লোকটি এতো বেহায়া কেনো! বিনা লাজে হুটহাট আবদা করে বসে। স্বভাব এতো খারাপ জানলে তার আশেপাশেই ঘেষতো না নিশী। প্রণয় নিঃশব্দে হাসলো। আড়চোখে নিশীর কপালের ভাঁজযুক্ত বিরক্ত মুখখানা দেখতে মন্দ লাগছে না_________
*****
বাসায় পৌছালো বেশ দেরিতে। নীরাকে আগে বাড়ি রেখে এসেছে তারা। রাত বিধায় নিশীকে বাসা অবধি প্রণয় ই এগিয়ে দিলো। যাবার সময় পিছু ডেকে বললো,
“বিরক্ত হচ্ছেন জানি, তবুও নিজেকে দমাতে পারছি না। তাই এই অসহ্য লোকটাকে সহ্য করতে হবে। যদি ছাড়া পেতেই হয় তবে আমার সাথে দেনা পাওনাটা মিটিয়ে দিবেন। তবে যেভাবে আষ্টেপৃষ্টে ধরেছি, ইহজীবনে ছাড়া পাওয়া হবে না”
“থ্রে*ট দিচ্ছেন?”
“নাহ, সেই জো আর নেই”
নিশী উত্তর না দিয়েই ভেতরে চলে গেল। প্রণয় তখন ও গাড়ি থামিয়ে অপলক নয়নে তাকিয়ে রইলো নিশীর যাবার পানে। অবশষে প্রণয়ের প্রণয়ের কাব্যে হাতেখড়ি হলো________
কলিংবেল দিতে হলো না নিশীর৷ দরজা খোলা। বাড়িওয়ালি বের হচ্ছে ঘর থেকে। নিশীকে দেখেই তার মুখখানা শক্ত হয়ে গেলো। কিছু না বলেই প্রস্থান করলেন ভদ্রমহিলা। নিশী সালাম দিলেও উত্তর দিলেন না তিনি। নিশী ভেতরে ঢুকেই সুহাকে বললো,
“আন্টি আসছিলো কেনো?”
সুহা তার প্রশ্নের উত্তর দিলো না। তার মুখখানা থমথমে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাইলো সে নিশীর দিকে। তারপর গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“তুই যে জেলে গিয়েছিলি, আমাকে বলিস নি কেনো?”…………
চলবে
#ইতি_নিশীথিনী (কপি করা নিষিদ্ধ)
#২০তম_পর্ব
সুহা তার প্রশ্নের উত্তর দিলো না। তার মুখখানা থমথমে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাইলো সে নিশীর দিকে। তারপর গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“তুই যে জেলে গিয়েছিলি, আমাকে বলিস নি কেনো?”
সুহার প্রশ্নটির জন্য প্রস্তুত ছিলো না নিশী। ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায় সে। সুহার কাছ থেকে সম্পূর্ণভাবেই ব্যাপারখানা গোপন করেছিলো সে। প্রত্যুষীর কাছ থেকে পাওইয়া আঘাতটি দ্বিতীয়বার পেতে চায় নি সে, কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হলো না। পুরোনো ক্ষত শুকাবার পূর্বেই নতুন আঘাত তাকে ক্ষত বিক্ষত করতে প্রস্তুত। বুক চিরে বেরিয়ে আসা তপ্ত নিঃশ্বাসটা গোপন করে নিলো নিশী। তারপর ধীর গলায় বললো,
“প্রয়োজনবোধ করি নি”
“তোমার এই ঢং এর জন্য ঐ মুটকি বেটি আমাকে কতো কথা শুনাইছে জানিস? উনি না বললে তো তুই ব্যাপারটা পুরোই চেপে যাইতি। তুই যদি আগে বলে দিতি এটলিস্ট উনার সামনে তো আমাকে হোদল সাজতে হতো না। আমি হা করে চেয়েছিলাম”
“এখন কি করতে হবে?”
সুহার কথাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করেই প্রশ্ন করলো নিশী। সুহা চেয়ারে ধপ করে বসলো। গা এলিয়ে দিলো। মাথার চুল টানতে টানতে বললো,
“মুটকি বেটি, কালকে বারোটার মধ্যে ঘর ছাড়তে বলছে। পাষন্ড মহিলা, আবার বলে কিনা, ‘মেয়ে মানুষ বলে দয়া করলাম। রাতের মধ্যে বের হতে বলছি না যে তোমাদের সাত পুরুষের ভাগ্য’। এবার বল তো, কাহিনীটা কি?”
“বললে কি বিশ্বাস করবি? যতই হোক তো জেল ফেরত আসামী”
নিশীর কন্ঠে তাচ্ছিল্যভাব। তার মুখে ম্লান হাসি। চোখ জোড়া বিষন্নতায় ঘেরা। তবুও কন্ঠে জড়তা নেই। আক্ষেপ নেই। আছে কেবল ই একরাশ তাচ্ছিল্য এবং ক্ষীণ অভিমান। অভিমান সমাজের দৃষ্টিকোনের প্রতি। কাঠামোগত সমাজের ধুলোপড়া, জংধরা বিবেকের উপর। যারা শুধু বিচার করে, ভালো মন্দের। অথচ একটিবার ও তারা কিছুর অন্তস্থলে যেতে চায় না। ভালো, মন্দের বাহিরেও অনেক কিছু থাকে যা আমাদের অগোচরে। নিশীর চাহনী কিছুটা হলেও বুঝলো সুহা। তাই খানিকটা গম্ভীর হয়েই বললো,
“বিশ্বাস করার না থাকলে এখন তোমার সামনে বসে জিজ্ঞেস করতাম না, এবার কি বলবা কাহিনী কি?”
নিশী একটু দম নিলো। ধীর কন্ঠে বর্ণনা করতে লাগলো সেই রাতের ঘটনা, বিশ্রী কালো রাতের ঘটনা। পূর্ণিমা রাতটি তার জীবনে আমাবস্যা বয়ে এনেছিলো। বর্ণনার মূহুর্তে বিশ্রী স্মৃতিগুলো আবারো মস্তিষ্ককে ঘিরে ধরছিলো। গলার কাছে দলা পাকাচ্ছে জমাট বাধা কষ্টগুলো। সেই ক্ষতগুলো পুনরায় যন্ত্রণা দিচ্ছিলো নিশীকে। চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিলো। সময়ের সাথে সাথে কন্ঠও কাঁপতে লাগলো। নিঃশ্বাস নিতেও যেনো কষ্ট হচ্ছিলো। ঘটনা শেষে ছোট করে বলল,
“মৃত্যুভয় কতোটা ভয়ংকর আমি সেই রাতে টের পেয়েছিলাম। আর জীবন কতোটা নিষ্ঠুর সেটা জেলে বসে অনুধাবন করেছি”
সুহা এখনো তাকিয়ে আছে নিশীর দিকে। তার চোখ ঝাপসা, গাল ভিজে আছে। ধরা গলায় ধীরে ধীরে বললো,
“তোর চাচা-চাচী একটি বার ও আসলো না? ভাতিজী হিসেবে না হোক, মানুষের মতো আচারণ করা গেলো না?”
“আমাকে এতোদিন আশ্রয় দিয়েছেন এই কত!”
সুহা গাল ফুলিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো, চোখ মুছে নিলো নিশীর অগোচরে। তারপর কঠিন স্বরে বললো,
“জিনিসপত্র গুছায়ে নে। কালকে দশটার মধ্যে বের হয়ে যাবো”
“যাবো টা কই?”
“এই টা একটা সমস্যা, শুধু সমস্যা না মহা সমস্যা। আমার এক খালাতো বোন আছে কিন্তু ওই মহিলাকে আত্মীয় না বলে ঘষেটি বেগম আখ্যা দেওয়া উচিত, সারাটাজীবন আমাকে জ্বা*লিয়েছে। বিয়ে করে দু বাচ্চার মা হবার পর ও আমার পিছনে লাগা ছাড়ে নি। যেনো এটাই তার জীবনের মুখ্যম কাজ। আমি যদি এখন তার বাড়ি যাই, সারা যশোর জানবে সুহাকে ঘর থেকে বাড়ি ওয়ালি নামিয়ে দিয়েছে”
“ক্ষমা করে দে, আমার জন্য তোকেও বিপদে পড়তে হলো”
“থা*পড়া খাইছোস?”
“সেটা কি?”
“উলটো হাতের থা*প্পড়। খাইলেই তোর মাথাটা ঠিক হয়ে যাবি, মাথায় জমা শুয়োপোকাগুলো দেখবি প্রজাপতি হয়ে কান থেকে বের হচ্ছে। আর একটা কথা শুনে রাখ এই সুহা বলছে তোকে, যা করছিস ঠিক করছিস। আমি হলে তো জানেই রাখতাম না, এমন নরপিশাচদের বাঁচা উচিত না। আল্লাহ ঠিক করছেন, প্যারালাইজড হয়ে আছে। আরোও কঠিন শাস্তি দরকার ছিলো”
শেষের কথাগুলো বিড়বিড় করতে করতে রান্নাঘরে চলে গেলো সুহা। ছোট টুল দিয়ে কার্টুন নামাচ্ছে সে। একে একে সব জিনিস গুলো কার্টুনে ঢোকালো। নিশী এখনো অবাক দৃষ্টিতেই তাকিয়ে রইলো সুহার দিকে। বন্ধুত্বগুলো বুঝি এমনও হয়! যেখানে একে অপরের ঢাল হয়ে থাকে, যেখানে চোখ বুঝে ভরসা করা যায় একে অপরের উপর। বিপদে দুকথা শুনালেও হাত ছাড়ে না। নিশীর মনে হলো, তার ভাগ্যটি খুব একটা নিষ্ঠুর নয়। তাই তো এমন একটা বন্ধু জুটেছে, অগোছালো, উড়াধুড়া একটা মানুষ। অথচ মনটা যেনো সকল গোছানো মানুষের চেয়েও উদার। তবে একটা প্রশ্ন ঠিক ই মনে কাঁটার মতো বিধছে, বাড়িওয়ালিকে এই ঘটনাটা কে জানালো। নিশীর জেল যাবার ঘটনা কোনো সংবাদপত্রের হেডলাইন নয়, তাহলে এই ঘটনাটা বাড়িওয়ালি জানলেন কি করে!
****
নিশী কার্টুন গোছাচ্ছে। সুহার ছোট সংসারেও জিনিস কম নয়। অগোছালো মেয়েটির শখের লিস্ট অনেক লম্বা। জিনিসপত্র গোছাতে গোছাতে দুটো কার্টুন হয়ে গিয়েছে। এখনো জিনিসপত্র শেষ হচ্ছে না, আজকের রান্নাগুলো বক্স বক্স এ রেখে ফ্রিজে উঠাতে যাবে তখন ই সুহা বললো,
“ওগুলো রাখিস না, পাশের বস্তিতে দিয়ে দিবো। শুধু শুধু নষ্ট হবার চেয়ে কারোর অন্ন হওয়া ভালো”
নিশীও মাথা নাড়ালো। এই নিয়ে পাঁচজনকে ফোন করেছে সুহা। প্রত্যেকের কাছে আশ্রয়ের সাহায্য চাইছে কিন্তু সবাই ফিরিয়ে দিচ্ছে। এখন দিপালী দিদিকে ফোন দিবে, সেও ফিরিয়ে দিলে ঠিক কোথায় আশ্রয় হবে কে জানে। চারবারের মাথায় দিপালী দিদি ফোন তুললেন,
“এতো রাতে? কিছু হয়েছে কি সুহা?”
“দিদি, একটা সাহায্য লাগবে”
“কি সাহায্য?”
“তোমাদের মেসে কি দুটো সিট ফাঁকা হবে? আমার একটা হলেও হবে। আমরা দুজন এডজাস্ট করে নিবো”
“তোমার বাসার কি হলো?”
“আর বইলো না, মুটকি বাড়িওয়ালির সাথে ঝগড়া লাগছে। সে ক্ষেপে রাতের মধ্যে নেমে যাইতে বলছে। আমি তোমাকে তো বলতাম ই উনি বেশ প্যারা দেয়। হবে দিদি?”
মিনিট পাঁচেক বাদে ফোন রেখে দিলো সুহা। তার মুখটা শুকনো। নিশী বুঝলো এবারো হতাশাই জুটলো। নিজেকে খুব স্বার্থপর মনে হচ্ছে। আজ নিজের অতীতের জন্য সুহাকে হেনস্তা হতে হচ্ছে। কিন্তু তার পক্ষেও যে করার কিছুই নেই। বান্ধবী বা পরিচিত তো এই একজন ই আছে। আর একজন আছে বটে, তবে তার নিবেদন প্রত্যাখ্যান করে সাহায্যের হাত পাতাটা ছোটলোকি ছাড়া আর কোনোভাবেই আখ্যা দেওয়া যায় না। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বের হলো নিশীর। তখন ই সুহা বললো,
“তোর কাছে টাকা হবে? এই ধর হাজার পাঁচেক?”
“কেনো?”
“একটা জায়গা পেয়েছি”
*****
গতকাল পড়াতে আসে নি নিশী। নীরা সারাটা বিকেল সদর দরজার কাছে বসে ছিলো। প্রতীক্ষায় ছিলো ম্যাডামের। প্রণয় তাকে একটা সাদা খরগোশ কিনে দিয়েছে। তাই খরগোশটাকে নিশীকে দেখানোর জন্যই মেয়েটির এতো আগ্রহ, কিন্তু নিশী আসে নি। নীরা গতকাল ভালো করে খায় ও নি। ঘুমানোর সময় ও বেশ বেগ পেতে হয়েছে প্রণয়ের। প্রণয় রাতে ফোন করেছিলো নিশীকে কিন্তু তার ফোন বন্ধ। ফলে তার ঘুমটাও কেঁচে গেছে। ক্লান্ত চোখ জোড়া একটি মূহুর্তের জন্য ও বিশ্রাম নেয় নি। অনবরত ফোন করেছে চেনা নম্বর এ। কিন্তু সংযোগ দেওয়া গেলো না। পায়চারী করেই রাতটা কাটলো প্রণয়ের। অসংখ্য চিন্তারা মস্তিষ্ককে বিচলিত করে তুলছিলো। নিশী কি তার প্রেম নিবেদনের কারণেই এমন একটা কাজ করলো! সত্যি ই তো তখন এভাবে ছ্যাচরা রোডসাইড রোমিও এর মতো আচারণ না করলেই হতো। নিজের উপর চরম বিরক্ত হলো প্রণয়। ভাবগাম্ভীর্য সম্পন্ন মানুষ যদি এমন আচারণ করে তবে কোন নারীর ই পছন্দ নয়। এই আজগবি চিন্তায় কাটলো রাত, নির্ঘুম চোখজোড়া ক্লান্ত হয়ে আছে অথচ নিশীথিনীর চিন্তায় বুজতে চাইছে না। একবার মনে হলো এখন ই বেরিয়ে পড়বে সে, চলে যাবে নিশীর বাসায়। সরাসরি শুধাবে তাকে। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে দমালো। রাত বিরাতে আবারো অসভ্যের মতো আচারণ করতে চায় না সে। তাই অপেক্ষা করলো প্রভাতের। সকালের প্রথম কিরণ ফুটতেই অস্থির প্রণয় ছুটলো নিশীর খোঁজে। পৌছালো তার বাসার সামনে। দারোয়ান তখন ঘুমে কাঁদা। প্রণয় তাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বললো,
“চাচা, ও চাচা”
ঘুমটা ভাঙতেই বৃদ্ধ বিরক্তিভরা কন্ঠে বললো,
“কি হইছে? চান কি?”
“নিশী হকের সাথে দেখা করতে চাই! দেখা করা যাবে?”
“কোন নিশী হক? এখানে কোনো নিশী হক থাকে না”
“কি বলেন? দোতালায় না থাকতো দুজন মেয়ে, তাদের একজনের নাম ই তো নিশী”
“আরেহ ভাই, নেশা করছেন সকাল সকাল? কইলাই তো এখানে কেউ থাকে না। যাদের কথা কচ্ছেন তারা কালকে এই বাড়ি ছাইড়ে চলে গেছে”
লোকটির কথাটা শুনতেই বিস্মিত নজরে তাকিয়ে থাকলো প্রণয়। কথাটা মস্তিষ্কে ধারন করতে যেনো সময় লাগলো। ঠিক তখন ই ফোন বেজে উঠলো তার, স্ক্রিনে ভেসে উঠলো পরিচিত নাম “নিশীথিনী”………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি