ইতি নিশীথিনী পর্ব-২৩+২৪

0
704

#ইতি_নিশীথিনী (কপি করা নিষিদ্ধ)
#২৩তম_পর্ব

এর মাঝেই জসীম স্যারের আংটির কথাটা মনে পড়ে নিশীর। অধৈর্য্য হয়ে বলে,
“একটা কথা বলতেই ভুলে গেছি, এই যে দেখছেন এই আংটিটা, এই আংটির খোঁজ আমি পেয়েছি”
“মানে?”

প্রণয়ের চাহনী খানিকটা তীক্ষ্ণ হলো। কন্ঠে বিস্ময়। সে ভেবেছিলো চিত্রের এই নিঁখুত বর্ণনা কেবল কাল্পনিক। নীরার অপরিপক্ক মস্তিষ্কের সৃজনী। কিন্তু নিশীর কথাটা শুনতেই খানিকটা মস্তিষ্কটা মূহুর্তেই বিচলিত হয়ে উঠলো। বিশাল সমুদ্রসমান ধাধার নুড়িপাথর সম সূত্র এই আংটি। নিশী একটু থেমে বললো,
“আমাদের সাইকোলোজির স্যারের কাছে ঠিক হুবহু এমন একটি আংটি আছে। আমি সেটার ছবিও তুলে নিয়ে এসেছি। উনাকে এই আংটিটি উনার ওয়াইফ গিফট করেছেন। উনার থেকেই ঠিকানাটা পাওয়া। অবাককর ব্যাপার আংটিটি খুলনার একটি দোকান থেকেই কেনা৷ দোকানের নিজস্ব ডিজাইন এটা। এই ডিজাইনের শুধু তিনটে আংটি ই উনারা বানিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, খু*ন হয়েছে ঢাকায়, কিন্তু তার অলংকারটি খুলনা থেকে কেনা। তাহলে কি খু*নী খুলনার?”
“এটা মনে হবার কারণ!”
“দেখুন আমরা যখন কোথাও ঘুরতে যাই তখন পোশাক বা অলংকার কিনি কিন্তু সেটা দামে হয় কম। আংটিটি দেখে যা মনে হচ্ছে বেশ দামী। কেউ কি ঘুরতে এসে এতোটা দাম দিয়ে সোনা কিনবে!”
“কিনতেও পারে! পছন্দ হলে সে কিনতেই পারে। যুক্তিটা খাটছে না”
“কিন্তু চেষ্টা করতে তো ক্ষতি নেই, আর আংটিটি এই দোকানের নিজস্ব ডিজাইন। যেখানে সব রাস্তা বন্ধ ছিলো সেখানে তো অন্তত একটি সূক্ষ্ণ আলোর কিরণ দেখেছি। আপনার মনে হয় না, এই সূত্র ধরে আগানো উচিত?”

নিশী আকুতিভরা কন্ঠে কথাটা বললো। প্রণয় কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর ঠান্ডা স্বরে বললো,
“এই নুড়ি পাথরের মতো সূত্র নিয়ে আগানো মানে খড়ের গাদায় সুই খোঁজা। তাই বলবো, ছেড়ে দিন। এক বছরে যখন তারা ধরা পড়ে নিই, আমি আশা ছেড়ে দিয়েছি। অহেতুক হতাশ হওয়া। আমি তো কম সূত্র ধরে আগাই নি, প্রতিবার ই হতাশ হয়েছি। আর কেঁচো খুঁড়ে সাপ বের করতে চাচ্ছি না আমি। একা হলে হয়তো করতাম। কিন্তু নীরার জীবনের সাথে নো কম্প্রোমাইজ। সে আমার কাছে আমানত। আমি এই ফুলটাকে নষ্ট করতে চাই না। আর আমরা তো ভালোই আছি!”

প্রণয়ের শান্ত উক্তিতে অবাক হলো নিশী। প্রণয় বলছে ছেড়ে দিতে! প্রণয় বলছে! সে কি সত্যি সব কিছু মাটি চাপা দিতে চায়! ওই নরপিশাচরা স্বাধীন ভাবে ঘুরে বেড়াবে একটি বাচ্চার জীবনে ঘোর অন্ধকার এনে, এটা প্রণয় কিভাবে সহ্য করছেন! সে কি করে এতো তাড়াতাড়ি আশাহত হতে পারে যেখানে নিশীর আশার উৎস সে। সুপ্ত ক্ষোভ বাসা বাধলো হৃদয়ের কোনায়। নিজেকে সংযত রাখতে পারলো না নিশী। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললো,
“সত্যি কি ভালো আছেন? এতো বড় পাথরটা বুকে নিয়ে ঘুমাতে পারেন? গ্লানি হয় না! আফসোস হয় না! প্রতিনিয়ত একটা দম বন্ধ অনুভূতি কি আপনাকে তাড়া করে না! আপনি না হয় ভালো আছেন, কিন্তু নীরা? ও ভালো আছে? মেয়েটি কথা বলে না, নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে। অনুভূতিগুলো কাগজের মাঝেই সীমাবদ্ধ। ও ও ভয় পায় প্রণয় সাহেব! যা আপনি বুঝতে পারেন না। হয়তো বুঝবেন ও না”
“আমি নীরার কথা ভেবেই বলছি”
“আমার মনে হচ্ছে না”
“সেটা আপনার ব্যাপার”

শীতল কন্ঠে কথাটা বললো প্রণয়। তার চোয়াল শক্ত। চাহনী কঠিন, তীক্ষ্ণ। নিশী থেমে গেলো। তার বুঝতে বাকি রইলো না, প্রণয় তার কথা শুনতে অনিচ্ছুক। সুতরাং কথা খরচ করার মানে হয় না। নিশী উঠে দাঁড়ালো। একটা কার্ড বের করে রাখলো টেবিলের উপর। শীতল কন্ঠে বললো,
“বিন্দু বিন্দু জলে মহাসাগর হয়। সূত্রের ক্ষেত্রেও আমি এই তত্ত্বে বিশ্বাসী। জুয়েলার্স এর ঠিকানা আছে। যেহেতু আংটি মাত্র তিনটে, সুতরাং সেটা খড়ের মাঝে সুই খোঁজা মোটেই নয়। ইচ্ছে হলে খোঁজ নিবেন। না হলে ফেলে দিবেন। আপনার ইচ্ছে”

বলেই বেড়িয়ে গেলো নিশী। এখানে বসতেও বিরক্ত সে। একমূহুর্ত ও বিরক্ত লাগছে তার। প্রণয় এখনো ধারালো চাহনীতে তাকিয়ে রয়েছে তার যাবার পানে। বুকচিরে দীর্ঘশ্বাস বের হলো তার। নিশীর যুক্তিকে অগ্রাহ্য করতে চায় নি, কিন্তু নিরুপায় সে। হাত বাড়িয়ে কার্ডটি হাতে নেয়। একনজর বুলায় লাল হলুদ কার্ডের দিকে। বিড়বিড় করে বলে,
“অনুপমা জুয়েলার্স”

*****

বহমান স্রোতের মতো সময়ও কারোর অপেক্ষা করে না। নিজের মতোই বহমান সে। প্রণয়ের সাথে কথা কাটাকাটির আজ চতুর্থ দিন। সেদিনের পর আর কথা হয় নি তাদের মাঝে। নীরার জন্য ও বাড়ি যাওয়া হলেও তাদের সাক্ষাৎ হয় না, প্রণয়ের মুখোমুখি হবার ইচ্ছে নেই নিশীর। অহেতুক কেনো অন্যদের ব্যাপারে সে নাক গলাবে। প্রণয়ের ব্যাপার, নীরার ব্যাপার, নিশী তো কেবল একজন বাহিরের মানুষ। তার কথায় কি আসবে যাবে! তাই অহেতুক এই ব্যাপারে নিজেকে জড়াবে না নিশী।

ক্লাস শেষে বের হতেই অঝোর বৃষ্টির মুখোমুখি হতে হলো তাকে। প্রথমে টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছিলো, কিন্তু বৃষ্টির তেজ হুট করেই বেড়ে গেলো যেনো। এদিকে গতকাল তাড়াহুড়োতে নীরার বাসায় ই ফেলে রেখেছে ছাতাটা। এখন তার কাছে দুটো পথ, হয় একাডেকিম বিল্ডিং এ অপেক্ষা করতে হবে নয়তো ছুটে যেতে হবে বৃষ্টির মাঝে। অনেক ভাবার পর নিশী সিদ্ধান্ত নিলো একাডেমিকেই থাকবে সে। অহেতুক ভেজার মানে হয় না, বাসা বদলানোর জন্য হাত এখন মন্দায় চলছে। নতুন বাসায় কিছু নষ্ট হলেই নিজের খরচায় ঠিক করতে হয়। ফলে বেশ টাকাই নেমে গেছে। এখন ভিজে জ্বর বাঁধানো মানে আরোও বাড়তি খরচা। আর সুহাটাও জেদী, সে ডাক্তার না দেখিয়ে রক্ষে দিবে না। সুহার কথা মনে হতেই হাসে নিশী। মেয়েটা সত্যি কয়েকদিনে একটা পরিবারের মতো হয়ে গিয়েছে। তার যত্ন, তার আদিক্ষেতাগুলো খারাপ লাগে না। বরং অন্যরকম ভালো লাগে।

“বাসায় যাচ্ছো না? ছাতা নেই নাকি?”

পেছন থেকে কথাটা শুনতেই চিন্তার ঘোরে ছেদ পড়ে নিশীর। পেছনে তাকাতেই জসীম স্যারের দেখা মিলে। অমায়িক হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে রেখেছেন তিনি। এই হাসিটা বরাবরের মতোই অপরিবর্তনশীল। নিশী কিছুটা অপ্রস্তুত হলেও মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নেয়। তারপর বলে,
“জ্বর বাধানোর ইচ্ছে নেই”
“তাহলে আমাদের সাথে চলো, পৌছে দেই তোমাকে”

আমাদের কথাটা শুনতেই পাশে নজর যায় নিশীর। ঈশান রয়েছে জসীম স্যারের পাশেই। তাকে প্রথমে খেয়াল করে নি নিশী। ইতস্তততা বাড়ে, তবুও প্লাস্টিকের হাসি ঠোঁটে একে বলে,
“না না, আমার অপেক্ষা করতে আপত্তি নেই”
“কোনো কারনে কি তুমি বিব্রতবোধ করছো?”

নিশী কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। এর মাঝেই ঈশান বললো,
“ও আমার জন্য বিব্রত হচ্ছে চাচু, বাদ দাও। ও যাবে না”
“কেনো তোমাকে কি অপছন্দ করে নাকি?”

জসীম স্যারের প্রশ্নে নিশীর অস্বস্তি বাড়লো। চোখ মুখে ক্ষীণ বিরক্তি। একজন শিক্ষকের পক্ষে এমন প্রশ্ন করা সম্ভব সেটা অকল্পনীয়। জসীম স্যার অপেক্ষারত উত্তরের। তিনি অধীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে ঈশানের দিকে। ঈশান এক অপলক তাকালো নিশীর দিকে। তারপর ধীর কন্ঠে বললো,
“হয়তো”

বিষাদমাখা কন্ঠে ঈশান উত্তর দিলো। নিশী গাল ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে বলল,
“পছন্দ অপছন্দের ব্যাপার এখানে নয়, আসলে আমি অস্বস্তিবোধ করি। আর আমার মনে হয় না, ঈশান ভাই এর সাথে আমার কোনো ঘনিষ্ঠতা আছে”
“বুঝেছি”

জসীম স্যার বেশ গম্ভীর ভাবে কথাটা বললেন। তারপর হুটকরেই বললেন,
“তোমার আংটি রহস্য সলভ হয়েছে?”

জসীম স্যারের আকস্মিক প্রশ্ন নিশী আমতা আমতা করে বলে,
“জ্বী, ধন্যবাদ”
“যাক, হলেই ভালো। তুমি কিন্তু চাইলেই যেতে পারত্ আমাদের সাথে। এখান থেকে শিরোমনি তো অনেক দূর”
“আপনি কিভাবে জানলেন আমার বাড়ি শিরোমনী?”

জসীম স্যারের কথায় তাজ্জব বনে গেলো নিশী। বিস্মিত কন্ঠে সে প্রশ্ন ছুড়লো। জসীম স্যার নির্লিপ্ত কন্ঠে বললেন,
“ঈশান বলেছে”

জসীম স্যারের কথা শোনামাত্র নিশীর নজর যায় ঈশানের দিকে। ঈশান নির্বিকার। তার মুখোভাব বদলালো না। নিশীর রাগ হচ্ছে। প্রচন্ড রাগ, মানুষটির সমস্যা কি? কেনো এমন আচারণ করে সে। ক্ষিপ্র স্বরে প্রশ্নটা তাই করেই বসে,
“আমাকে স্টক করাটা কবে ছাড়বেন ঈশান ভাই?”
“হয়তো কখোনোই না”……………

চলবে

#ইতি_নিশীথিনী (কপি করা নিষিদ্ধ)
#২৪তম_পর্ব

নিশীর রাগ হচ্ছে। প্রচন্ড রাগ, মানুষটির সমস্যা কি? কেনো এমন আচারণ করে সে। ক্ষিপ্র স্বরে প্রশ্নটা তাই করেই বসে,
“আমাকে স্টক করাটা কবে ছাড়বেন ঈশান ভাই?”
“হয়তো কখোনোই না”

লোকটির স্বগোতক্তি শুনে তাজ্জব বনে গেলো নিশী। মানে কি! কখনোই না! সে একটি মেয়েকে রীতিমতো স্টক করে যাচ্ছে আবার জোরগলায় বলছে সে এই আচারণ থামবে না। নিশীর মেজাজ খারাপ হচ্ছে, অত্যন্ত খারাপ। এতোটাই খারাপ যে ইচ্ছে করছে এখনই চ*পে*টা*ঘা*তে লোকটির উজ্জ্বল গালটি রক্তিম করে দিতে। এমন আচারণ কেনো যেনো সহ্য হয় না নিশীর। কিন্তু নিজেকে বহু কষ্টে থামালো। গাল ফুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর বললো,
“স্যার, আজ আসছি। বৃষ্টি থেমে গেছে। দাঁড়িয়ে থাকলে দেরি হবে”

ঈশান বুঝলো নিশীর বিরক্তিভরা মুখশ্রীর কারণ। কিন্তু কি করবে! বেহায়া হৃদয়ের কাছে যে সকলের হাত বাঁধা। তাই তো ঘুরে ফিরে মেয়েটির খোঁজ নেয় সে। নিশীর অগোচরেই তার বিচরণের তথ্য তার কাছে থাকে। নিশী অপেক্ষা করলো না। ঝরো বৃষ্টিতে চটের ব্যাগটি মাথায় নিয়েই হাটা শুরু করলো। জসীম স্যার হাসলেন। ঈশান তাকিয়ে রইলো নিশীর যাবার পানে। জসীম স্যার হেসে বললেন,
“যার জন্য করো চুরি, সেই বলে চোর। তুমি স্টক করছো জেনেই তো ক্ষেপে গেলো। যদি জানে বাসাটা তোমার বদৌলতেই খুঁজে পাওয়া তখন কি করবে কে জানে”

ঈশান নিঃশব্দে হাসলো, মলিন হাসি। বিষন্নতা ঘেরা আকাশের মতো মলিন। তারপর বললো,
“ও জানবে না, আমি জানি”

বলেই দীর্ঘশ্বাসটি গোপন করলো ঈশান। হ্যা, রাতবিরাতে বাড়ি ছাড়া করা মেয়েদুটো ঈশানের বদৌলতেই পেতেছিলো। দিপালী নিজ মেসে সিটের ব্যবস্থা করে দিতে পারে নি। ফলে হতাশ হতে হয়েছিলো সুহাকে। সে ফোন রেখে দেয়। কিন্তু কিছু সময় বাদে দিপালী আবারো সুহাকে ফোন দেয়। এই বাসাটির ঠিকানা দেয় সুহাকে৷ এই বাসাটি দিপালীর আত্নীয়ার নয়, বরং ঈশানের বন্ধুর। এই স্থানে নিশী একেবারে নিরাপদ থাকবে বলেই এই বাসার খোঁজ দেওয়া। জায়গাটিও শহর থেকে অনেক দূর, ইমাদদের হাতের বাহিরে। যতই হোক, ছাত্রনেতার যোগাযোগের অভাব নেই। সেই মাধ্যম গুলোই ব্যাবহার করে ঈশান। দিপালীও তার যোগাযোগের একটি মাধ্যম। বহু কষ্টে এই তাই তো তার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছে। সরাসরি না হোক, একটু ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়েই। যখন জানতে পেরেছিলো ইমাদ নিশীর বাসায় যাচ্ছে তখন ই ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো ঈশান। বুঝেছিলো তাদের বাসনা খুব একটা ভালো নয়। তাই তো দিপালীর সাথে সুহার যোগাযোগের পর পর ই ঈশানের সাথে তার যোগাযোগ হয়। যা আশঙ্কা ছিলো সেটাই হয়েছে। বাড়িছাড়া হতে হচ্ছে নিশীকে। তখন দিপালীকে এই বাড়ির খোঁজ দেয় ঈশান ই। এই ব্যাপারটি সম্পূর্ণ গোপনীয়, সুহা কিংবা নিশী কেউ ই জানে না। ঈশান শুধু আড়ালে থেকেই নিশীকে সহায়তা করতে চায়। বিপদে ঢাল হতে যায়৷ কেনো চায় সেটা কেবল সেই জানে। ঈশান কথার মোড় ঘোরাতে বলে,
“আচ্ছা, আংটি রহস্য টি কি?”
“সে তোমার না জানলেও চলবে”
“আমি তো তোমার থেকে লুকাই নি চাচু”
“আমি লুকোচ্ছি”

বলে ঠোঁটজোড়া প্রসস্থ করে হাসলেন জসীম। তারপর নিজ হাতের আংটিটির দিকে সূক্ষ্ম চাহনীতে তাকিয়ে বললো,
“বেশ জটিল রহস্য”

ঈশান বুঝলো না জসীমের কথাটা। বুঝতে চাইলো ও না। তার কথাবার্তাগুলো খাপছাড়া। তাই তো পরিবারে তার আখ্যা, পা*গল জসীম। অপরাধীদের মনোবিজ্ঞান নিয়ে পড়তে পড়তে নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছে সে। মাঝে মাঝে অপরাধীদের মতো চিন্তা করে সে। নিজেকে আখ্যা দেয় “জ্যাক দি রি*পার”, “যোডিয়াক কি*লার”। কারণ তাদের নাকি কেউ দেখে নি। তারা কে কেউ জানে না। ঈশানের কাছে অবশ্য এগুলো লাগে ভঙ্গ। অহেতুক চমকে দেবার প্রচেষ্টা। জসীমের স্ত্রীও বেশ বিরক্ত জসীমের কার্যকলাপের। ঈশান জসীমকে পাত্তা দিলো না। শুধু উদাস নয়নে তাকিয়ে রইলো বিষন্ন আকাশের পানে______

******

নিশীর মেজাজ খারাপ। ভিজতে ভিজতে পৌছালো সে নিজ বাসায়। রাস্তায় মহেন্দ্র ওয়ালার সাথে এক চোট বেঁধেছিলো ভাড়া নিয়ে। মা*তালের ন্যায় সে গাড়ি চালাচ্ছিলো। একবার তো অন্য এক গাড়ির সাথে বাঁধিয়েও দিয়েছিলো। একে ঈশানের কর্মকান্ড, তারপর রাস্তার ঝাল সব মিলে বিরক্ত নিশী। ঘরে প্রবেশ করতেই টুপ করে কারেন্ট চলে গেলো। অবশ্য এখন লোডশেডিং যেনো রোজকার ঘটনা। মনে হচ্ছে সেই ২০০৮ সালে ফেরত চলে গেছি আমরা। নিশী একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো। বৃষ্টির জন্য ঘর একেবারে অন্ধকার হয়ে আছে। কোনো মতে নিজ ঘরে গেলো সে। সুহা কাজে গেছে। নতুন একটা চাকরি খুঁজে নিয়েছে সে। প্রতি*বন্ধী বাচ্চাদের স্কুলে সে চাকরি করে। ভালোই বেতন। সুহার এ বাড়ি মোটেই ভালো লাগছে না। তাই ভালো টাকা পেলেই বাড়ি খুজবে। সকালে উঠে যদি দেখা হয় বাথরুমে পানি নেই ঠিক কেমনটি লাগে! নিশী অবশ্য কোনো অভিযোগ নেই। থাকবে কেন! আশ্রয় মিলছে এই তো ঢের। ব্যাগটা রেখেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলো সে। ভেজা কাপড় ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। চোখজোড়া ক্লান্ত। নিশী আজকাল ঘুমোতে পারে না। ঘুম আসে কিছু গভীর হয় না। ক্লান্ত অবসন্ন চোখজোড়া মেলে তাকিয়ে থাকে ঘুরন্ত ফ্যানের দিকে। আবার কখনো জোর করে চোখ বুজে রাখে লাভ হয় না। ঘুম যেনো তার সাথে আড়ি নিয়েছে। তাই এখন একটু ঘুমোতে চায় নিশী। কিন্তু ইচ্ছের মাঝে পানি পড়ে গেলো। মোবাইল ফোনটা হুক্কাহুয়া করতে লাগলো। বিরক্তির মাত্রা বাড়লো। না চেক করেই ফোন রিসিভ করলো সে। ভীষণ বিরক্তি নিয়ে বললো,
“জ্বী বলুন”
“ডিসটার্ব করলাম?”

কন্ঠটি শুনতেই খানিকটা থমকালো নিশী। অবাক চাহনীতে তাকালো ফোনের দিকে। “প্রণয় সাহেব” নামটি উজ্জ্বল বর্ণে দেখা যাচ্ছে। নিশী কিছুটা থেমে বললো,
“না, বলুন শুনছি”

প্রণয় কিছুসময় চুপ করে ধীর কন্ঠে বললো,
“সরি”

প্রণয়ের কথাটি শুনে আরোও অবাক হলো নিশী। বিস্মিত কন্ঠে বললো,
“কেনো?”
“সেদিন অনেক রুক্ষ্ণ আচারণ করেছিলাম তাই”
“আমি কিছু মনে করি নি। আর কিছু বলবেন?”
“খুব ক্লান্ত নাকি? ঘুম হয় নি রাতে?”
“কিভাবে বুঝলেন”
“আপনি আমার জন্য একটি খোলা কিতাব। বোঝাটা খুব কঠিন নয়”

প্রণয়ের কথায় স্তব্ধ হয়ে যায় নিশী। এই কদিনের মলিনতাটা যেনো হুট করেই কেটে গেলো। অশান্ত হৃদয়টা কিছুটা হলেও যেনো শান্ত হলো। লোকটির কথাগুলো কেমন যেনো বিচিত্র। ঘোরলাগা, মায়ামাখা। নিশীর কঠিন হৃদয়ে চুপিসারে এসে কড়া নাড়ে। এক অব্যক্ত ভালোলাগা কাজ করে তখন। মস্তিষ্ক যতই জোর দিক, হৃদয় শুনতে চায় না। এক অনুভূতর ঢেউ উঠে মনসাগরে। নিশীকে চুপ থাকতে দেখে প্রণয় ধীর কন্ঠে বলে,
“খেয়েছেন?”
“এখনো খাওয়া হয় নি”
“আমাদের সাথে খেতে পারেন, আমি আর নীরা এখনো খাই নি। নীরাও আপনাকে পেলে না খাওয়ার বায়না করবে না”

নিশী চুপ করে রইলো। প্রণয় অপেক্ষা করলো তার উত্তরের।

*******

নীরার মন বিষন্ন। সকাল থেকে একটি বার ও পেন্সিল হাতে নেয় নি সে। শুধু উদাস নয়নে তাকিয়ে আছে কালচে আকাশের দিকে। খাওয়া দাওয়া তার যেনো সব সিকে তোলা। মনখারাপের কারণটি বুঝতে পারছে না প্রণয়। নিশী অবশেষে আসলো বাসায়। বেশ ক বার মানা করেছে। কিন্তু নীরার মন খারাপের কথাটি শুনতেই তার নিজেকে আটকাতে পারলো না। নিশীকে দেখে নীরা এগিয়ে এলো। তার ওড়নাটা মুঠোবন্দি করে দাঁড়িয়ে রইলো বেশ কিছুক্ষণ। নিশী আদুরে গলায় বললো,
“মনটা কি বেশ খারাপ?”

নীরা উত্তর দিলো না। শুধু মেঝেতে তাকয়ে রইলো। নিশী আবার শুধালো,
“আমাকেও বলবে না?”

নীরা তখন একটা পেন্সিল নিয়ে কিছু আঁকালো, চিত্রটি দেখতেই হেসে ফেললো নিশী। তারপর মৃদু স্বরে বললো,
“তোমার খরগোশ বন্ধুটি তোমাকে ছেড়ে পালিয়ে গেছে বলে খারাপ লাগছে?”

নীরা উত্তর দিলো না। শুধু ঈষৎ মাথা দোলালো। নিশী আবারো হাসলো। মেয়েটি তার ভালো লাগা, মন্দ লাগাগুলো ধীরে ধীরে প্রকাশ করছে। হয়তো সাধারণ মানুষের মতো তীব্র নয়, ধীরে ধীরে। শিথিল গতিতে সে এগোচ্ছে অনুভূতির দিকে। নিশী মৃদু স্বরে বললো,
“নীরা, বন্ধুকে জোর করতে নেই। সে চলে গেছে ঠিক ই তবে যদি সে তোমার বন্ধু হয় তবে ঠিক ফিরে আসবে। আমার কথাগুলো কঠিন। কিন্তু একটা সময় ঠিক বুঝবে। জোর করে আটকে রাখলে সেই ভালোবাসাটা ঠিক ভালোবাসা হয় না। হয় যন্ত্রণা। যাকে তোমার ভালোলাগে তাকে মুক্ত করে দাও। একদিন সে ফিরবেই। চলো আমি তোমাকে খাইয়ে দিচ্ছি”

নীরা কি বুঝলো জানা নেই। তবে সে নিশীকে ফেরালো না। শান্ত মেয়ের মতো খেয়ে নিলো। প্রণয় মুগ্ধ নয়নে দেখলো তাদের কাজ। খাওয়া শেষে নীরাকে ঘুম পাড়িয়ে যখন তার ঘর থেকে বের হলো নিশী, তখন প্রণয়কে দেখাগেলো দরজার অয়াশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। ক্যাজুয়াল টিশার্টে লোকটিকে মন্দ লাগছে না। ট্রাওজারে বা হাত গুজে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে নিশীর পানে। নিশী মৃদু স্বরে বললো,
“নীরা ঘুমিয়ে গেছে”
“আমি না খুব চিন্তিত নিশীথিনী”
“কি নিয়ে?”
“নিজেকে নিয়ে। আমি ধীরে ধীরে আপনাতে আসক্ত হচ্ছি। আপনার প্রয়োজনীয়তা যেনো বাড়ছে। আগে শুধু আমার ছিলো, এখন নীরাও আসক্ত হলো। কিন্তু আপনি ই বললেন যাকে ভালোবাসো তাকে মুক্ত করে দিতে হয়। যদি তোমার হয় ফিরে আসবে। আচ্ছা, আপনাকে মুক্ত করে দিলে যদি আপনি ফিরে না আসেন। কি করবো তখন? আমি যে আপনাকে ভালোবাসি, নিশীথিনী”………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি