ইতি নিশীথিনী পর্ব-৩৩+৩৪

0
668

#ইতি_নিশীথিনী
#৩৩তম_পর্ব

আধ ঘন্টা পর কেবিন থেকে থমথমে মুখে বের হলো মোস্তাক এবং নিশী। প্রণয় বেশ আগ্রহের সাথে বললো,
“এনি প্রগ্রেস অফিসার?”
“ঘা*তক মাহাদী শেখ নন”

মোস্তাকের কথায় বেশ অবাক হয় প্রণয়। বিস্মিত কন্ঠে শুধায়,
“তাহলে ওই কাগজ?”

মোস্তাক একটু সময় নেয়। তারপর খানিকটা গম্ভীর কন্ঠে বলে,
“যিনি আ*ক্রমণ করেছে তিনি মাহাদী শেখ নন। নিশী ম্যাডাম ছবি দেখালে সুহা অস্বীকার করেন। এমন কি লোকটিকে সে পূর্বে দেখেছে বলেও মনে হয় না। আমরা স্কেচ আর্টিস্ট পাঠাবো। উনার বর্ণনা অনুযায়ী সে স্কেচ আঁকবে। দেখি কি ফলাফল বের হয়। তবে মাহাদী শেখ কে সন্দেহের তালিকা থেকে ঝেড়ে ফেলছি না। সে নিজে আক্র*মণ না করলেও অন্যকে দিয়ে করাতেই পারেন। আর সেই কাগজটিকে মোট পাঁচটি হাতের ছাপ পাওয়া গেছে। একটি আপনার, একটি নিশী ম্যাডামের, একটি আমাদের অফিসারের আর বাকি দুটো আননোন। আমরা ক্রস চেক করছি। দেখি কোনো ক্রিমিনালের সাথে মিলে কি না। টেনশন নিবেন না, আমরা ঘা*তককে ছেড়ে দিবো না। আসছি”

মোস্তাকের কথা শুনে বেশ চিন্তায় পড়ে গেলো প্রণয়। মাহাদীকে সন্দেহ থেকে ছাড়াও যাচ্ছে না। আবার একেবারে সন্দেহ করাও যাচ্ছে না। তবুও চিন্তাগুলো গোপন করে অফিসারদের বিদায় দিলো সে। এদিকে নিশীর থমথমে মুখখানাও নজর এড়ালো না তার। নিশী চিন্তিত, চিন্তিত এটা ভেবে ঘা*তকটি কে! যদি মাহাদী বা সোলাইমান শেখ না হয় তবে কি অন্য কোনো শত্রু! নিশীর অস্থির লাগছে। কেমন যেনো অশান্তি অশান্তি একটা ভাব। প্রণয় তার অবিন্যস্ত চাহনী লক্ষ্য করলো। তারপর ধীর কন্ঠে বললো,
“আইনের উপর একটু বিশ্বাস রাখুন। আমার ভরসা উনারা ঠিক খুঁজে বের করবেন দোষী কে!”

নিশী উত্তর দিলো না। আইনকে যে ভরসা করতে পারছে না সে। এই আইনের মা*রপ্যাঁ*চেই আজ তার জীবন দূর্বিষহ। ছোটবেলায় বাবা বলতেন,
“বুঝলি নিশু, আইন খুব জটিল বিষয়। সাধারণ মানুষ আইনের কাছে অসহায়। আর আইন ক্ষমতাবানের কাছে অসহায়”

তখন বাবার কথাগুলো পাথরের মতো লাগতো, দুর্বোধ্য কথাগুলো তখন না বুঝতেও এখন ঠিক ই বোঝে নিশী। আইন সত্যি ক্ষমতাবানদের কাছে অসহায়। নিশীকে চুপ করে থাকতে দেখে প্রণয় ধীর কন্ঠে বলে,
“কি ভাবছেন?”
“একটা সময় আইনের পথে চলার খুব ইচ্ছে ছিলো। ইচ্ছে ছিলো একজন ভালো সৎ উকিল হবো। এখন যে ইচ্ছে টা নেই তা নয়। তবে এখন আর ইচ্ছের মাত্রাটা তীব্র নয়। আইনের ন্যায় বিচার কথাটা এখন কাল্পনিক মনে হয়। মনে হয় আইনের সেই কালো কাপড় বাধা মহিলাটি ই এখন তার বাস্তবতা। সে সত্যি অন্ধ। তাই তো যে যেমন ভাবে ইচ্ছে তাকে ব্যবহার করে”
“একটা কথা আছে, ‘সত্য কখনো চাপা থাকে না’। কথাটা কিন্তু চিরন্তন সত্য নিশীথিনী। সত্য প্রকাশ পাবেই। সময় লাগবে, কিন্তু সে উম্মোচিত হবে। হতেই হবে”

প্রণয়ের কন্ঠে আত্নবিশ্বাসের ছলকানি। নিশী মুগ্ধ নয়নে লোকটাকে দেখলো। মাঝে মাঝে লোকটার কথায় বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। বেহায়া মনটা দুঃসাহস দেখাতে চায়। নিশী স্মিত হাসলো। পাতলা ঠোঁটের এই স্নিগ্ধ হাসিটা বহুদিন দেখে নি প্রণয়। গাঢ় চোখজোড়ার মুগ্ধতা মাদকতার রুপ নিলো। ঘোরলাগা চোখে দেখতে লাগলো তার নিশীথিনীকে। মেয়েটির সাধারণ সৌন্দর্য্য ও তাকে কাবু করে। হৃদয়ে দোলা দিয়ে উঠে নিষিদ্ধ ইচ্ছেগুলো। হৃদয়ের প্রকোষ্ঠে তখন আগলে রাখতে ইচ্ছে হয় মেয়েটিকে। এই অনুভূতি গুলো খুব বেসামাল। কোনো দায়ড়া মানতে চায় না। চায় শুধু পরিণতি। অবাধ্য পরিণতি। যেখানে হৃদয়ের আক্ষেপ থাকবে না, প্রণয়ের রক্তিম ফুলের সুভাসে হবে মুখরিত মনকানন। ঘোরলাগা কন্ঠে বললো,
“আপনার হাসিটা খুব স্নিগ্ধ নিশীথিনী, আপনাকে হাস্যোজ্জ্বল মুখেই মানায়”

হুট করে এমন কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলো না নিশী। তার চোখজোড়া বড় বড় হয়ে গেলো। কোমল গালজোড়া হয়ে উঠলো মূহুর্তেই রক্তিম। বুকের ভেতরকে অনন্য শিহরণে কেঁপে উঠলো। ভারী লজ্জা পেলো নিশী। এমন লজ্জা শেষ কবে পেয়েছে জানা নেই। তবে আজ লজ্জা পেতেও লজ্জা হচ্ছে না। হয়তো প্রিয় মানুষটির প্রশংসাও ভালো লাগে। তার প্রতিটি কথাই লাগে সুমধুর। নিশীর আজ দুঃসাহসী হতে ইচ্ছে করছে। ভবিষ্যতের অজানা ভয়কে পরাজিত করে প্রণয়কে বলতে ইচ্ছে করছে সুপ্ত অনুভূতির অনুনয় গুলো। খুব ইচ্ছে হচ্ছে তার এই বেসামাল ভালোবাসার তরীতে পাড়ি দিতে। কিন্তু একদিন তো সেই সবকিছুকে অস্বীকার করেছিলো। একদিন সেই ফিরিয়ে দিয়েছিলো তার আকুল প্রেম নিবেদন। ভাবতেই জড়তা ভর করলো। ইচ্ছেগুলো গুটিসুটি মেরে মনে ভেতর ই বসে রইলো। রক্তিম মুখশ্রী মিয়ে গেলো। প্রণয় নিশীর পাংশুটে মুখশ্রী দেখে বললো,
“ক্ষমা করবেন। আসলে লাগামছাড়া অনুভূতি আরোর নিষেধাজ্ঞা মানে না। এভাবে বলাটা আমার উচিত হয় নি”
“আমি কিছু মনে করি নি”
“তাহলে মুখ কালো করে ফেললেন যে?”
“নিজের বোকামিতে হাসি পাচ্ছে”
“আপনি বোকামিও করেন?”
“করেছি, খুব বড়সড় বোকামি বলতে পারেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আমি কি সেই বোকামিটা শুধরে নিতে পারবো? বড্ড অস্বস্তিও লাগছে”
“সময় থাকতে শুধরে নিন। বলা তো যায় না কখন কি হয়!”

নিশী হাসলো। হাসি অক্ষত রেখেই বললো,
“এবার যদি জে*লমুখো না হতে হয় তবে শুধরে নিবো। জানি ভবিষ্যত অন্ধকার। তবুও একবার স্বপ্ন দেখতে ক্ষতি কি। অন্তত দলাপাকানো কথাগুলো বুকে জমাট বেঁধে পাথর হবে না। আফসোস হবে না”
“তাহলে নিশ্চিন্ত থাকুন, আর বোকামি শুধরানোর প্রস্তুতি নিন। ইনশাআল্লাহ আমি আপনাকে জে*লমুখো হতে দিচ্ছি না”
“পারবেন ওদের শাস্তি দিতে?”
“ইনশাআল্লাহ, সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো”

প্রণয়ের কন্ঠে জড়তা নেই। সে যেভাবেই হোক শেষ চেষ্টা করবেই। নিশীথিনী ছাড়া যে তার জগৎ ধু ধু মরুভূমি ছাড়া কিছুই নয়। কত মানুষকে তো বাঁচালো, নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে বাঁচাতে পারবে না। তাহলে কিসের ভালোবাসা!

****

প্রণয়ের অগোছালো টেবিলে কাগজের মেলা। সামনে অর্ধখাওয়া কফির মগ পড়ে রয়েছে। এই দিয়ে আট কাপ কফি খেয়েছে সে। নিশীর ডেট সম্মুখে। কোনো ভুলের অবকাশ রাখবে না সে। বারবার সাক্ষীদের সাক্ষ্য রিভাইস দিচ্ছে সে। শুধু তাই নয়, কি কি প্রমাণ সে প্রস্তুত করবে সবকিছু প্রস্তুত করছে। নিশীর আগের বাড়ির দারোয়ানকেও বেশ টাকা দিয়েছে যেনো নিশীর উপর হওয়া আ*ক্রমণের সাক্ষী দেয়। রফিক কাজের ফাঁকে ফাঁকে প্রণয়কে দেখছে। চুলগুলো অবিন্যস্ত হয়ে আছে। আজ সকাল থেকে কফি ব্যতীত কিছুই খায় নি সে। আজ চেম্বার ও বন্ধ করে রেখেছে। সকল ক্লাইন্টদের আসতে নিষেধ করেছে। এমন সাধারণত প্রণয় করে না। তবে আজ করছে। শুধু আজ নয়। এই কদিন যাবৎ ই সে এমন করছে। রফিক ঠোঁট ভেজালো। কিছু বলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু সাহস হচ্ছে না। প্রণয় মাথা না তুলেই বললো,
“বলে ফেলো কি বলবে?”
“বলবো স্যার”

বেশ ইনিয়ে বিনিয়ে বললো রফিক। এবার মুখ তুললো প্রণয়। ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“গাইগুই যখন করছো, বলেই দাও”
“না আসলে ব্যাস্ত তো আপনি তাই”
“তাহলে সময় নষ্ট না করে বলে ফেলো”

প্রণয়ের গম্ভীরতা বাড়লো। রফিক আবার ঠোঁট ভেজালো। তারপর বললো,
“স্যার, সুহা ম্যাডামের আ*ক্রমণ টা আমরা কোর্টে ইউজ করতে পারি না? ওই লেখাটা তো আছেই”
“কিহ?”
“না মানে, যদি আপনি চান। আসলে এটা এখানে তো নিশী ম্যাডামকেই টার্গেট করা হয়েছে। এটাকে বেনেফিট হিসেবে ব্যাবহার করাই যায়”
“ফিঙ্গারপ্রিন্ট না মিললে?”
“সেটাও ভেবে রেখেছি স্যার। এখনো যেহেতু কে করেছে প্রমাণ পাওয়া যায় নি। তাই আমরা ঘা*তককে মাহাদীর লোক বলেই প্রমাণ করতে পারি। আর ফিঙ্গারপ্রিন্ট যদি ওদের কারোর সাথে না মিলে, এবং ঘা*তক ধরা পড়ে তাকে রাজসাক্ষী বানিয়ে দিবো। সাজা কম হবার লোভে সেই মাহাদীর বিরুদ্ধে কথা বলবে”
“মানে মিথ্যের আশ্রয় নিবো?”

প্রণয়ের কন্ঠে রাগের আভাস পেলো রফিক। সাথে সাথেই মাথানত করে ফেললো সে। অপরাধীর ন্যায় বললো,
“মাঝে মাঝে দৈ*ত্যকে কলসে ভরতেও মিথ্যে বলতে হয় স্যার”

রফিকের যুক্তিতে বাঁকা হাসলো প্রণয়। হাসিটার মর্মার্থ ঠিক বুঝলো না রফিক। তবে তার গা কেঁপে উঠলো। প্রণয় তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
“ভালো যুক্তি দিয়েছো, ভালো লেগেছে। আচ্ছা আরেক দৈ*ত্যের খবর পেয়েছো?”
“কি খবর স্যার?”
“মির্জা হাফিজ?”
“জ্বী স্যার, আপনার ধারণা ঠিক। কারণ ব্যাতীত তাকে দেশের বাহিরে পাঠানো হয় নি। ও লেভেল এক্সামের দু সপ্তাহ আগে তাকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়। কারণ একটি ছেলেকে পেন্সিল বক্স দিয়ে পি*টিয়ে আধম*রা বানিয়ে ফেলেছিলো। পুলিশ কেস ও হয়েছিলো। পত্রিকায় লেখালিখি হয়। ছেলের এই ক্লেম থামাতেই বেশ অর্থ ব্যয় করে বিদেশ পাঠানো। এই ব্যাপারটা মির্জা হাফিজের ভালো লাগে নি। তাই বাবার সাথে এতো ঝামেলা!”
“বাহ! ভালো তো! তাহলে ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে। সুতরাং যদি বাহিরে যেয়ে নাম পরিবর্তন করে অন্য পাসপোর্ট দিয়ে দেশে প্রবেশ করে তবে কেউ জানবে না। থ্যাংক ইউ রফিক”
“কিন্তু স্যার বললেন না যে, এসব জানতে চাইছিলেন? আর কে উইটনেস?”

প্রণয় কিছু বলার পূর্বেই প্রণয়ের ফোন বেজে উঠলো। বাসা থেকে ফোন করা হচ্ছে। বাসা থেকে সাধারণত ফোন আসে না। কিন্তু এখন ফোন আসাতে বেশ অবাক হলো। বেশ কিছুসময় ভেবেই ফোনটা ধরলো সে,
“হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম”

অপর প্রান্ত থেকে আওয়াজ আসলো না। প্রণয় আবার হ্যালো বলতেই খানিকটা গোঙ্গানির আওয়াজ পেলো। প্রণয়ের কুঞ্চিত ভ্রু ঠিক হয়ে গেলো। অকৃত্রিম হাসি হেসে বললো,
“বলো নীরা, কেনো ফোন দিয়েছো”

নীরা গোঙ্গালো। গলা থেকে আওয়াজ দিলো বেশ কিছু সময়। অনেক ভেবে প্রণয় বললো,
“তুমি কি নিশী আন্টির সাথে দেখা করতে চাও?”

আবার গোঙ্গালো নীরা। প্রণয় ঠিক বুঝলো না। হ্যা নাকি না। তাই সে বললো,
“তুমি তাহলে টেবিলে দুটো টোকা দাও। আমি বুঝবো তুমি হাসপাতালে যেতে চাও”

নীরা তার কথামতো তাই করলো। প্রণয় এবার সশব্দে হাসলো। তারপর বললো,
“আসছি আমি থাকো”

*******

হাসপাতাল নীরা ভালো লাগে না। বড্ড অপছন্দের জায়গা এটা। তবুও আজ হাসপাতালে এসেছে সে। নিজ ইচ্ছায় এসেছে। কারণ তার নিশী ম্যাডাম বহুদিন বাড়ি যায় না। তাই তার মন ভালো নেই। নিশীও নীরাকে দেখে অনেক অবাক হলো। প্রণয়কে শুধালো,
“ওকে এখানে আনলেন যে?”
“ও যে আসতে চাইছিলো। তাই বাধ্য হলাম”

নিশী আর কথা বাড়ালো না। সুহার সাথে খুব ভালো বন্ধুত্ব হলো না নীরার। তবে বৈরীভাব ও দেখা গেল না। সুহা তাকে কিছু জিজ্ঞেস করলে সে শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো। নিশী দুজনকে আপেল কেটে দিলো। নীরা অপছন্দ স্বত্তেও তা খেলো। এদিকে প্রণয় নিশীকে বলল,
“একটু বারান্দায় আসবেন। কথা আছে?”
“কি কথা?”
“আংটি রহস্য”

কথাটা শুনতেই পিলে চমকালো নিশীর। বিনাবাক্যে সে বারান্দায় গেলো। থাই গ্লাস টা দিয়ে বললো,
“আপনি খোঁজ নিয়েছেন?”
“হ্যা, অনেকটুকু খোঁজ নিয়েছি”
“কে আসল অপরাধী?”
“মির্জা হাফিজ, সে আপাতত পলাতক। ছোট বয়সে দেশ ছেড়েছে। ফেরত আসার প্রমাণ নেই। যদি কেউ ফিরেও আসে তাকে চেনার উপায় নেই। খুব কাছে এসেও যেনো আটকে গেছি। এতো মানূশ দেশে ফিরে, কোন ফ্লাইটে কোন রুপে মির্জা হাফিজ আসবে সেটা কে জানে বলুন!”

প্রণয়ের কন্ঠে বেশ হতাশার বহিঃপ্রকাশ পেলো। নিশীও বেশ হতাশ হলো। ভেবেছিলো নুশরাতের দোষী ধরা পড়বে। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। কিন্তু হুট করেই কিছু একটা মনে পড়লো নিশীর। দেরি না করেই বললো,
“ঘা*তকের হাতে চারটা আঙ্গুল। একবছরে চার আঙ্গুল বিশিষ্ট কারা কারা আসবে সেটা তো খোঁজ নিতেই পারেন”

কথাটা শুনতেই বিস্মিত হলো প্রণয়। সে এতোবড় ক্লুটা ভুলেই গিয়েছিলো। সাথে সাথেই ফোন দিলো সে রফিক কে। ব্যাস্ত কন্ঠে বলল,
“রফিক, মির্জা হাফিজের কি কোনো আঙ্গুলে সমস্যা ছিলো?”
“কেনো স্যার?”
“বলই না?”
“জ্বী স্যার, ওর একটা আংগুলের হাড় ভাঙ্গা ছিলো। ফলে সেটা সোজা করতে পারতো না সে”………..

চলবে

#ইতি_নিশীথিনী
#৩৪তম_পর্ব

নিশীর কথাটা শুনতেই বিস্মিত হলো প্রণয়। সে এতোবড় ক্লুটা ভুলেই গিয়েছিলো। সাথে সাথেই ফোন দিলো সে রফিক কে। ব্যাস্ত কন্ঠে বলল,
“রফিক, মির্জা হাফিজের কি কোনো আঙ্গুলে সমস্যা ছিলো?”
“কেনো স্যার?”
“বলই না?”
“জ্বী স্যার, ওর একটা আংগুলের হাড় ভাঙ্গা ছিলো। ফলে সেটা সোজা করতে পারতো না সে। স্কুলে ওকে এই ব্যাপারটা নিয়ে চ্যাতানো হতো। সেই কারণেই সে ওই ছেলেটাকে মে*রেছিলো”

প্রণয় কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো তারপর বললো,
“আমাকে একবার ঢাকা যেতে হবে বুঝলে রফিক। খুব জরুরি কাজ আছে”

প্রণয়ের কথার মর্মার্থ বুঝতে সময় লাগলো না রফিকের। একবছর কাজ করার এটাই সুবিধা। সে প্রণয়কে বুঝতে পারে। খুব ভালো করে বুঝতে পারে। তবে সে প্রণয়ের এমন কাজে বেশ বিরক্ত। প্রণয় খড়ের গুদামে সুই খুঁজছে। পুলিশ কি চেষ্টা করে নি নুশরাত হ*ত্যার সুরাহা করার। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। ব্যর্থ হয়েছে প্রমাণের অভাবে। কোনো সাক্ষী নেই, প্রমাণ নেই। কিসের ভিত্তিতে প্রণয় ছুটছে সেটাই বুঝতে পারছে না রফিক। সে তাই দেরি না করেই বলে উঠলো,
“স্যার একটি প্রশ্ন করি?”
“কি?”
“আপনার মনে হচ্ছে না আপনি খড়ের গাদায় সুই খুঁজছেন। আমি বুঝতে পারছি আপনি কি করার চিন্তা করছেন। কিন্তু যদি আপনি তাকে খুঁজেও পান প্রমাণ করবেন কি করে সেই খু*নী? আমাদের কাছে প্রমাণ নেই স্যার”
“আছে, আমার কাছে সাক্ষী আছে”
“কে সেই সাক্ষী?”
“নীরা, নীরা সাক্ষী”

রফিক কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। ওপাশের মৌনতা অনুভব করে প্রণয় খানিকটা নরম গলায় বললো,
“আমি জানি তুমি কি ভাবছো! নীরা কিভাবে সেখানে উপস্থিত ছিলো? অনেক লম্বা কাহিনী। কখনো অবসরে বলবো। শুধু এটুকু জানো, ওখানে নীরার উপস্থিতি ছিলো। আমি জানি নীরা দশ বছরের বাচ্চা, উপরন্তু সে প্রতি*বন্ধী। তার সাক্ষ্য কখনোই কোর্ট গ্রহণ করবে না। কিন্তু একটি শেষ চেষ্টা করতে কি ক্ষতি!”
“নীরা কি ঘা*তকের মুখ দেখেছে?”
“নিশ্চিত নয়”
“তাহলে?”
“একজন বলেছিলো, কঠিন ঠিক ই অসম্ভব নয়। তাই শেষ চেষ্টা করতে চাচ্ছি। আমি যে মেয়েটির কাছে ঋণী”

রফিক গাল ফুলিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর বললো,
“বুঝেছি স্যার৷ কবে যাচ্ছেন?”
“দেখি, এখানেও তো গুছিয়ে নিতে হবে”
“যেমন আপনার ইচ্ছে। রাখছি স্যার”

রফিক ফোন কেটে দিলো। নিশী এখনো প্রণয়ের দিকে চেয়ে রয়েছে। সে তখন থেকে প্রণয়কেই দেখছে। শরতের ঝিরি হাওয়ায় তার কপালের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। সেই চুলে প্রশস্থ কপাল ঢেকে আছে। নিশীর এই চাহনী নজর এড়ালো না প্রণয়ের। সে মৃদু হেসে বললো,
“আমার রুপ গজিয়েছে?”
“নাহ”
“তাহলে কি দেখছেন?”
“দেখছি একজন বাবাকে। সম্পর্ক ছাড়াও যে সম্পর্ক হয়। সেই সম্পর্কগুলো আবার আগলেও রাখা হয়। আমার কাছে ব্যাপারগুলো খুব বিরল কি না”
“আপনিও তো তাই করছেন”

তারপর ভেতরে তাকালো প্রণয়। নীরা একটা দড়িকে হাতে পেঁচিয়ে খেলছে। আর সুহা একটা বই এর পাতা উল্টাচ্ছে। প্রণয় এই দুজনের দিকে তাকিয়ে বললো,
“ওই যে দেখুন দুটো মানুষ। আপনার তো তাদের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। তবুও আপনি তাদের কথা ভাবতে কৃপনতা করেন নি। নীরার জ্বর হোক, ঠান্ডা লাগুক সবসময় আপনাকে পেয়েছে সে। আর সুহার যত্নে কি কোনো কমতি রেখেছেন। রক্তের সম্পর্ক তো তাদের সাথেও নেই আপনার। অথচ আত্মার কি চমৎকার মিল। তাহলে আমি আপনার থেকে আলাদা কিভাবে?”

প্রণয়ের যুক্তি সত্যি অনবদ্য। নিশী হাসলো। তারপর মৃদু কন্ঠে বলল,
“আপনি খুব সুন্দর গুছিয়ে কথা বলেন”
“ওকালতি করার ফল, যেদিন উকিল হবেন সেদিন আপনিও পারবেন”
“হু, ভেবেছি পাশ করার পর আপনার আন্ডারেই কাজ করবো। তারপর আপনাকেও ছাপিয়ে যাবো। তখন আপনার সব ঋণ শোধ করে দিবো”
“অপেক্ষায় থাকলাম। আমিও চাই আপনি আমার থেকেও এগিয়ে যান”

প্রণয় হেসে কথা কথাটা শুনে কোথায় যেনো শান্তি লাগলো। নিশী নিজেও জানে না তার ভবিষ্যত কোথায়। কিন্তু প্রণয়ের কথাগুলো তাকে নতুন ভোরের আশ্বাস দেয়। আবার স্বপ্ন দেখার আশ্বাস দেয়।

নীরা না যাবার জন্য জেদ করছে। জেদ বললে ভুল হবে, সে সুন্দর, স্নিগ্ধ বায়না করছে। নিশীর ওড়না শক্ত করে মুঠোবন্দি করে রেখেছে। সেটা ছাড়ছেই না। যার অর্থ সে নিশীর কাছেই থাকবে। প্রণয় বেশ বিপাকেই পড়লো। সে কোনো ভাবেই সেই শক্ত মুঠো খুলতে পারছে না। বেশ জোর ও দিতে পারছে না পাশে মেয়ে ব্যাথা পায়। নিশীও বেশ চিন্তিত নীরার আচারণে। হাসপাতাল বাচ্চাদের থাকার স্থান নয়। নীরাও হাসপাতাল অপছন্দ করে। তবুও সে আজ নিশীকে ছেড়ে যাবে না। এই হাসপাতালেই থাকবে সে। প্রণয় এক পর্যায়ে কড়া কন্ঠে বললো,
“এমন তো আমাদের মাঝে কথা ছিলো না নীরা? আমি তোমাকে এখানে এনেছি অল্প সময়ের জন্য। এখন তুমি তোমার ম্যাডামকে বিরক্ত করছো। তুমি এখানে থাকবে কি করে? চলো বাসায়”

প্রণয়ের কড়াকড়িতেও লাভ হলো না। সে এখনো নিশীর ওড়না আকড়েই দাঁড়িয়ে আছে। সে যাবে না। প্রণয় বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে ঘষলো কপাল। নীরা প্রথমবার জেদ করছে কিন্তু জেদটা ভুল স্থানে। এই জেদ পুরণ করবে না প্রণয়। একেই সুহা এখনো সম্পূর্ণ সুস্থ নয়। নিশী তার যত্ন নিতে নিতে ক্লান্ত। সেখানে নীরাকে এখানে রেখে যাওয়া শুধুমাত্র তার উপর ঝামেলা ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রণয় এবার তার কন্ঠে কাঠিন্য বাড়ালো,
“তুমি সত্যি যাবে না?”

নীরা মুখ তুলে চাইলো। তার চোখে ভীতির ছাপ। প্রণয়ের এমন আচারণ তার জন্য এই প্রথম। এর পূর্বে কখনো এমন ধমক খায় নি সে। ফলে ছোট মুখখানায় ক্ষীন বিষন্নতার ছাপ পড়লো। শুভ মুখখানা ঈষৎ কালো হলো। হাতের বাধন খানিকটা আলগাও হলো। আজকাল নীরার মাঝেও অনুভূতির প্রকাশ হয়। তীব্র নয় সেই প্রকাশ, বেশ ক্ষীন প্রকাশ। কিন্তু হয়। তার মুখশ্রী উজ্জ্বল হয়। মাঝে মাঝে তার মুখ নিভে যায়। ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়ালো না প্রণয় বা নিশীর। নিশী প্রণয়কে বাধা দিলো। বললো,
“আপনি বাহিরে যান। আমি দেখছি”

প্রণয় বুঝলো এতোটা কড়াকড়ি করা ঠিক হয় নি। নীরা হয়তো কষ্ট পেয়েছে। সেই কষ্টগুলো সে অন্য বাচ্চাদের মতো কেঁদে প্রকাশ করে না। তার বিষাদ গুলো থাকে অদৃশ্য তবে সেই বিষাদেরা বেশ কড়া প্রভাব বিস্তার করে তার মস্তিষ্কে। প্রণয় কিছু বললো না। মাথা নিচু করে চলে গেলো রুমের বাহিরে। তার বাহিরে যাবার মিনিট দশেকের মধ্যে নীরা এবং নিশী বের হলো। নীরা বাসায় যাবে। প্রণয় অবাক কন্ঠে বলল,
“ওকে রাজী করালেন কিভাবে?”
“না রেগে”

প্রণয় বুঝলো নিশী তাকেই শোনাচ্ছে। ফলে সে আর কথা বাড়ালো না। নীরাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো।

প্রণয় গাড়ি চালাচ্ছে। নীরা তার পাশের সিটে বসা। সে একটা দড়ি দিয়ে খেলছে। তার মুখখানা নির্বিকার। স্বভাবগত সে কথাও বলে না। সর্বদা চুপচাপ। তাই ঠিক বোঝা যাচ্ছে না সে রাগ করেছে কি না। প্রণয় আড়চোখে তাকে দেখছে। তখন এমন আচারণ করা উচিত হয় নি। এখন মেয়ের সুপ্ত রাগ ভাঙ্গানোটা জরুরি। নয়তো দেখা যাবে সে তার সাথেও যোগাযোগ করা ছেড়ে দিবে। তাই রাস্তার এক দোকান দেখে গাড়ি থামালো প্রণয়। প্রণয়ের গাড়ি থামানোতে ভ্রুক্ষেপ হলো না নীরার। সে দড়ির সাথে খেলতে ব্যস্ত। প্রণয় ছুটে যেয়ে বেশ কিছু চকলেট কিনে আনলো। তারপর গাড়িতে বসে নীরার দিকে চকলেট এগিয়ে বললো,
“নীরা কি এখনো আমার উপর রেগে আছে?”

নীরা মাথা তুললো না। সে মন দিয়ে দড়ির সাথে খেলছে। প্রণয় আবার বললো,
“নীরা কি এখনো আমার উপর রেগে আছে? আমি সরি বলছি। তখন হুট করে রেগে গেছিলাম। আসলে কথা দিয়ে কথা রাখতে হয়। এখানে যেমন আমার দোষ আছে, নীরার ও আছে। ম্যাডাম তো একা মানুষ। তার বান্ধবী অসুস্থ। ম্যাডাম একসাথে দুজনকে কিভাবে সামলাতো। ম্যাডামের কষ্ট হতো না বলো? তবুও আমার রাগা উচিত হয় নি। নীরা কি আমাকে ক্ষমা করবে? আবার বন্ধু হবে?”

এবার নীরা নড়েচড়ে বসল। খেলা থামিয়ে ড্যাবড্যাব করে চাইলো প্রণয়ের দিকে। প্রণয় চকলেটটা আরেকটু এগিয়ে বললো,
“প্লিজ? আর হবে না। প্রমিস। আমি কিন্তু প্রমিস রাখি”

নীরা কিছু একটা ভাবলো। তারপর একটা চকলেট নিলো। তারপর সেটা এবড়োখেবড়ো করে খুললো। তারপর ছোট ছোট কামড় দিয়ে খেতে লাগলো। প্রণয় নীরার এমন কাজ দেখে হাসলো। তারপর মৃদু কন্ঠে বললো,
“তোমার ম্যাডামকে খুব পছন্দ তাই না?”

নীরা মাথা দোলালো ধীরগতিতে। প্রণয়ের হাসির মাত্রা বাড়লো। তারপর ধীর কন্ঠে বলল,
“কেমন হবে বলতো, যদি ম্যাডাম সারাজীবন আমাদের কাছে থেকে যায়। একান্ত আমাদের হয়ে?”

নীরা হতভম্বের মতো চেয়ে রইলো। ছোট বাচ্চাটার কাছে প্রণয়ের কথাটা বেশ জটিল। সে বুঝতে পারছে না এই লোকটি কি বলছে। প্রণয় এবার সশব্দে হাসলো। নীরার চুল এলোমেলো করে আদর করে দিলো। তারপর বলল,
“আমার মনে হয় আমার বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে বুঝলে। নিশীথিনী আমার হবে। তবে তখন সে তোমার ম্যাডাম থাকবে না। সম্পর্ক বদলে যাবে। তবে সব মিলিয়ে খুব একটা খারাপ লাগবে না। আমরা তিনজনের সুখী পরিবার হবো। আমি, তুমি আর নিশীথিনী”

নীরা এখনো ফ্যালফ্যালিয়ে চেয়ে আছে। তার মস্তিষ্কে সব ই খুব কঠিন লাগছে। প্রণয় তার কথা বাড়ালো না। গাড়ি স্টার্ট দিলো। পিচের রাস্তা চিরে গাড়ি চললো নিজ গন্তব্যে_______

*******

একটা ক্যাফেতে বসে রয়েছে নিশী। নিশী বসে আছে একেবারে কর্ণারে। এখান থেকে রাস্তা দেখা যায়। থাই গ্লাসে ঘেরা এই ক্যাফেতে তার এই প্রথম বার আসা। এতো দামী জায়গায় আগে আসে নি সে। তার কাছে মনে হয় শুধু শুধু টাকা নষ্ট। খাবারের দামের পুরোটাই থাকে সাজসজ্জার জন্য। স্বাদ মোটেই থাকে না। এর চেয়ে নরমাল দোকান গুলোতেই ভালো খাবার পাওয়া যায়। কিন্তু এখানে আসার কারণ প্রণয়। কলেজ থেকে বের হবার সময় ই সে তাকে এখানে আসতে বলেছে। কেস সংক্রান্ত আলোচনা রয়েছে। কিন্তু এখানে কেনো সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না সে। সাধারণত বাসা কিংবা চেম্বারেই এসব ব্যাপার নিয়ে আলোচনা হয়ে তাদের মাঝে তাহলে এখানেই কেনো! থাই গ্লাস ভেদ করে তীর্যক রশ্নি তার চোখে এসে পড়ছে। বিকালের রোদের তেজ প্রচন্ড। তাই বাহিরের দিকে তাকাতে পারছে না নিশী। সে একবার ঘড়ি দেখলো। আধাঘন্টা হতে চললো। প্রণয় এখনো আসে নি। কিঞ্চিত বিরক্ত হলো নিশী। তাই ফোন বের করে প্রণয়ের নাম্বারে কল করলো। ফোন বাজছে, কেউ ধরছে না। নিশীর বিরক্তি বাড়লো। সে কপাল কুচকে ক্যাফের দরজার দিকে তাকালো। ঠিক তখন ই দেখতে পেলো চির পরিচিত মুখ। মুখখানা দেখে ভেতরটায় ক্ষীন ব্যাথা অনুভূত হলো। অজান্তেই চোখ টলমল করে উঠলো। নিশী নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করলো। কিন্তু তার পূর্বেই মানুষটি তার নিকট এগিয়ে এলো। মলিন হাসি হেসে বলল,
“কেমন আছো নিশীপু?”…….

চলবে