#ইতি_নিশীথিনী
#৩৭তম_পর্ব
প্রণয় হাসিমুখেই কথাটা বললো। ঈশান প্রতুত্তরে তাচ্ছিল্য মাখা কন্ঠে বলল,
“উকিল মশাই এর আমাকে চাই, ব্যাপারটা অদ্ভুত না? সেদিন তো আমাকে ভাগাতে পারলেই বাঁচতেন”
“সেটা সেদিনের কথা ছিলো। আজকের কাহিনী ভিন্ন। সেদিন তো জানতাম না, আপনি আমার মক্কেলের এতো ভালো চান। তাই তো লোক দিয়ে সুহার উপর আক্রমণ করলেন, আবার তাকে বাঁচাতেও গেলেন। সবাই ভাবলো মাহাদীর কাজ। কিন্তু কাজটি আসলে আপনার”
প্রণয়ের কন্ঠে জড়তা নেই। বরং আত্মবিশ্বাসের ছলকানি অনুভূত হলো। অপরদিকে, ঈশানের দৃষ্টির প্রখরতা বাড়লো। তার মুখশ্রী কঠিন হলো। কপালে পড়লো সূক্ষ্ণ ভাজ। কন্ঠে গাম্ভীর্য এলো। কঠিন স্বরে বললো,
“ডেট এক্সপায়ার গ*ঞ্জিকা সেবন করেছেন নাকি? কি বলছেন এসব?”
“আপনিও জানেন আমি ঠিক বলছি”
প্রণয় তার ঠোঁটের কোনের হাসি অক্ষত রেখে কথাটা বললো। শার্টের হাতাটা কনুই অবধি তুলে বুকের কাছে হাত বাঁধলো সে। তারপর মাথাটা একটু হেলিয়ে ধীর কন্ঠে বললো,
“চিঠিটা আপনার হাতের লেখা, তাই না ঈশান সাহেব? কি দারুণ পরিকল্পনা। একেবারে কোন্ড ব্লা*ডেড প্লান। আপনি জানতেন, মাহাদীর প্যারালাইজড হওয়া নিশীকে বাজে ভাবে হেনস্তা করতে পারে। কিন্তু মাহাদী যে প্যারালাইজড নয় সেটার ও প্রমাণ আপনার কাছে নেই। তাই আপনি একটি পরিকল্পনা করলেন, পরিকল্পনা করলেন সুহাকে আ*ক্রমণ করার। তাই তো ছেলেটি সুহাকে আ*ঘাত তো করেছে কিন্তু সেই ক্ষত গভীর নয়। কিন্তু বৃষ্টির জন্য নিশীর বাড়ি ফিরতে দেরি হয়। ফলে সুহার র*ক্তক্ষরণ হয় বেশি। এই খবরটা পেতেই আপনি দুজন ব্লাড ডোনার নিয়ে হাজির হন। যখন আপনার সাথে আসা ছেলেটির সাথে সুহার ব্লাডগ্রুপ মিলে যায় তখন ই আমার সন্দেহ হয়েছিলো। পরে জানলাম দ্বিতীয় জনের ও ব্লাডগ্রুপ ও একই। কাকতালীয় ঘটনার ও তো একটা লিমিট থাকে। শুধু তাই নয়, আপনি বলেছিলেন আপনি দারোয়ানের কাছ থেকে জেনেছেন। অথচ পরদিন সকালে দারোয়ান পুলিশ দেখে ভিরমি খেয়েছিলো। সে জানতোই না বাসায় কাউকে আ*ক্রমণ করা হয়েছে। ব্যাপারটা কেমন না। আরোও মজার ব্যাপার, এই বাড়িটা আপনার আত্মীয়ের। অথচ এই ঘটনা সুহা কিংবা নিশী জানেও না। কাকতালীয় ঘটনা তাই না? আসলে কাকতালীয় শব্দটা এতোবার ব্যবহার হয়েছে যে আমি নিজেও ঘেটে গিয়েছিলাম। পরে মাথা ঠান্ডা করে ভাবলাম, সত্যি কাকতালীয়! নাকি কারোর মস্তিষ্কের গোছানো পরিকল্পনা। এই আ*ক্রমণ অবশ্য আপনি সুহার ক্ষতি করার জন্য করেন নি। করেছেন আমাকে সাহায্য করতে। আমি এই কাগজটা কোর্টে পেশ করবো। কোর্ট মাহাদীর আবার শারীরিক পরীক্ষার ওর্ডার দিবেন। এবার পুলিশি পর্যবেক্ষণের ভেতর হবে পরীক্ষা। ফলে মাহাদীর নাটক ধরা পড়বে। তাই না ঈশান সাহেব? ভুল থাকলে বলতে পারেন”
ঈশান কিছুক্ষণ শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো প্রণয়ের দিকে। খুব শান্ত ভাবে কথাগুলো শুনছে সে। তার মুখশ্রী এখনো কঠিন। তারপর বা হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে কপাল ঘষলো সে। ঠোঁটের কোনে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে বললো,
“আপনি অনেক বুদ্ধিমান। যতটা প্রশংসা শুনেছি তার থেকেও অধিক”
ঈশানের কথাটা শুনে প্রণয়ের হাসি প্রশস্থ হলো। হাসিটা অক্ষয় রেখে বললো,
“ধন্যবাদ”
“কিন্তু প্রণয় সাহেব এতোক্ষণ যা যা বললেন, সেটা তো কোর্টে প্রমাণ করতে পারবেন না! এমনকি নিশীর সামনেও প্রমাণ হবে না। নিশীকে যতটুকু চিনি সে কখনোই প্রমাণ ছাড়া কোনো কথায় বিশ্বাস করে না”
ঈশানের কথার সুর পাল্টালো। তীক্ষ্ণ স্বরে সে কথাটা বললো। তার ঠোঁটের কোনে বিচিত্র হাসি। চোখজোড়া অপেক্ষা করছে প্রণয়ের মলিন মুখশ্রী দেখার জন্য। কিন্তু তাকে অবাক করে প্রণয় বললো,
“প্রমাণ করতে চাচ্ছে কে? প্রমাণ করার ইচ্ছে থাকলে এই রাতে নিশ্চয়ই এখানে আসতাম না”
“তাহলে কি চান?”
“বিষে বিষে বিষক্ষয়। যে অপবাদটা নিশীকে দেওয়া হয়েছে আমি চাই আপনি সেটাকে খারিজ করে দিন। কোর্টে সাক্ষী দিন। নিশীর শুভাকাঙ্ক্ষী আপনি, প্রমাণ করবেন না”
ঈশান প্রণয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। প্রণয়ের প্রতি তার ধারণাগুলো কেমন ধোঁয়াশা লাগছে। সে প্রণয়ের আচারণে অবাক হচ্ছে। ঈশান ভেবেছিলো সুহার প্রতি আ*ক্রমণের এই ঘটনাটা প্রণয় কখনোই স্বাভাবিকভাবে নিবে না। উলটো তাকে পুলিশে দেবার চেষ্টাও করবে সে। কিন্তু তাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ করেছে সে। উল্টো সেই ঘটনাটিকেই ঢাল বানাচ্ছে এবং ঈশানকেও ব্লা*কমেইল করছে যেন ঈশান নিশীর পক্ষে সাক্ষী দেয়। প্রণয়ের এমন রুপ দেখে ঈশানের বেশ মজাই লাগলো। বিদ্রুপের স্বরে বললো,
“আপনাকে তো ফেরেস্তা ভেবেছিলাম, কিন্তু শয়তান আপনার মাঝেও বিদ্যমান”
“এ ক্ষেত্রে আমার একটি থিওরি আছে। দেখুন শয়তান যেহেতু মানুষের ভেতরে ঢুকতে পারে, তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিরাজ করতে পারে। তাই কোনো মানুষই তার প্রবণতা থেকে বাঁচতে পারে না। হ্যা, কিছু মানুষের মাঝে সেই প্রবণতা বেশি থাকে, কিছু মানুষের মাঝে কম। আর বড় বড় শিকারের ক্ষেত্রে একটু ছোটখাটো ছাগল ব*লি দিতেই হয়। এ আর নতুন কি!”
বলেই উঠে দাঁড়ায় প্রণয়। ঘড়িতে বড় কাটাটা নয়টার ঘরে এসে ভিড়েছে। এখন বাড়ি ফিরতে হবে। তাই হাসিমুখে বললো,
“আপনি প্রস্তুত থাকবেন। আমাদের দেখা হবে”
বলেই বেড়িয়ে যেয়ে নিলে পেছন থেকে ঈশান বলে উঠে,
“নিশী জানলে কষ্ট পাবে, আপনি সত্যকে এভাবে আড়াল করে দিচ্ছেন। ভয় হচ্ছে না, হয়তো সে আপনাকে ক্ষমা নাও করতে পারে”
কথাটা শুনে ক্ষীণ সময় তাদের মাঝে শান্ত দৃষ্টি বিনিময় হলো। তারপর অদ্ভুত একটা হাসি ঠোঁটে একে প্রণয় বললো,
“আমায় নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমার নিশীথিনী অবুজ নয়”
কথাটা বলেই বেরিয়ে গেলো সে। ঈশান ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। ভেতরটায় অসহনীয় যন্ত্রণায় ছেয়ে গেছে। তীক্ত যন্ত্রণাগুলো ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই যন্ত্রণা নোনাজল রুপে ঠায় নিলো চোখের কোনে। পুরুষদের নাকি কাঁদতে নেই। কিন্তু সেই দাম্ভিকতার মুখোশ ছিড়ে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। অনুরাগের নীল গরল যে সেও পান করেছিলো। সেই কথা যে ভোলার নয়_____
*******
বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাসায় ফিরলো প্রণয়। মাঝরাস্তায় গাড়ির তেল ফুরিয়ে যাওয়ায় বেশ বিপাকেই পড়তে হলো তাকে। এর মাঝেই আকাশ কাঁপিয়ে নামলো ঝড়ো বৃষ্টি। অনাকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টিতে পুরোদস্তুর ভিজতে হলো তাকে। তাও ভাগ্য ভালো ছিলো রিপিয়ারিং দোকান কাছেই ছিলো। নয়তো গাড়িটাকে মাঝরাস্তায় রেখে তার মাঝেই রাত কাটাতে হতো। ক্লান্ত, ভেজা শরীরে বাসায় প্রবেশ করলো প্রণয়। দরজা খুললো পৃথা। তার মুখশ্রী থমথমে। প্রণয় পাত্তা দিলো না। সে ঘরের দিকে এগুতে নিলেই শেফালী বেগমের কন্ঠ কানে এলো তার,
“প্রণয়, একটু আমার ঘরে এসো। কথা আছে”
মায়ের কন্ঠে অপ্রসন্ন ভাব, সুপ্ত রাগ প্রকাশ পাচ্ছে। সেকারণে অনিচ্ছা স্বত্তেও সে এগিয়ে গেলো মায়ের রুমে। একটা টিস্যু দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বললো,
“হঠাৎ কি জরুরি কথা?”
“তুমি কি নিশী মেয়েটার প্রতি সিরিয়াস?”
“আমার ভাবসাবে কি ব্যাপারটা প্রকাশ পাচ্ছে না?”
প্রণয় দায়সাড়াভাবেই বললো কথাটা। ফলে শেফালী বেগমের রাগ যেনো বাড়লো। তিনি তীব্র স্বরে বলে উঠলেন,
“একটা জেল ফেরত আসামীকে আমি এই ঘরের সদস্য হিসেবে কখনোই মেনে নিবো না প্রণয়”
শেফালী বেগম ক্ষীন কাঁপছেন। তার মুখশ্রী রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। কপালে বা পাশের শিরা ফুলে উঠেছে। প্রণয় তার রাগার কারণটিকে অগ্রাহ্য করলো না। কিন্তু তাকে এখন বোঝাবার মতো সময় বা শক্তি কোনোটি ই তার মাঝে নেই। প্রণয় তাই স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
“আমি জানি না তুমি কি বোঝাচ্ছো, তবে নিশীকে যা ভাবছো তেমনটা নয়। ব্যাপারটা অজান্তে ঘটেছিলো। নিশীর স্থানে যদি পৃথা থাকতো, তবে সেও হয়তো এমনটাই করতো। সম্মান সবার উপরে। যাক গে, নিশীর কোনোকিছুতে আমার আপত্তি নেই। সে যেমন আমি তাকে ঠিক সেভাবেই ভালোবাসি”
“আমার মতামতের কি দাম নেই?”
“নেই বলবো না। তবে আমার মতামতের দামটাকে প্রাধান্য দিচ্ছি। আর তোমার ওর প্রতি ধারণা একপাক্ষিক করো না। সবদিক ভেবে, বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নাও”
প্রণয় কথাটা বলেই বেরিয়ে গেলো। শেফালী বেগমের রাগ মাত্রা ছাড়ালো। তিনি নিশীকে নিয়ে অকথ্য ভাষায় অনেককিছুই বলতে লাগলেন, যা প্রণয় শুনেই না শোনার ভান করলো। এদিকে এককোনায় গুটিসুটি হয়ে দাঁড়ানো নীরা ভয়ার্ত চোখে দেখছে শেফালী বেগমকে। শেফালী বেগম তাকে দেখতেই খেঁকিয়ে উঠলেন,
“কি দেখো, যাও নিজের ঘরে”
তার ধমকে কেঁপে উঠলো নীরা। দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। গুটি গুটি পায়ে প্রণয়ের ঘরে চলে গেলো সে।
****
নোটিশবোর্ডে পরীক্ষার ডেট দিয়েছে। নিশী একনজর সেটায় চোখ বুলালো। তার এবার প্রস্তুতি খুব একটা ভালো নয়। সে কিঞ্চিত সন্দিহান ফলাফল নিয়ে। কিন্তু পরীক্ষা দেবার আগেই ভীত হয়ে যাওয়া তার স্বভাবে নেই। সে মনে মনে স্থির করলো পড়াশোনায় বেশ মনোযোগী হবে। নীরার কাছ থেকে এক সপ্তাহ ছুটি নিবে। অবশ্য তখন ই মনে পড়লো। আগামীকাল তার কেসের ডেট। ভাবতেই মনটি বসে গেলো তার। এক দুশ্চিন্তা মনে বাসা বাঁধলো, আদৌ পরীক্ষা দেওয়া হবে তো! হতাশ নিঃশ্বাস ছাড়লো সে। বিষন্ন মনে এগিয়ে গেলো কলেজ গেটের কাছে। তখনই খেয়াল করলো কলেজের বাহিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে শেফালী বেগম এবং মায়া। মায়া তাকে দেখে হাত নাড়ালো। নিশী বেশ অবাক ই হলো। নিশী তাদের দিকে এগিয়ে গেলো। সৌজন্যতার খাতিরে বললো,
“আপনারা কি কোনো কারণে এসেছেন?”
“তোমার কাছে জরুরি কথা ছিলো। সময় হবে?”………
চলবে
#ইতি_নিশীথিনী
#৩৮তম_পর্ব
কলেজের গেটে পৌছাতেই খেয়াল করলো কলেজের বাহিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে শেফালী বেগম এবং মায়া। মায়া তাকে দেখে হাত নাড়ালো। নিশী বেশ অবাক ই হলো। নিশী তাদের দিকে এগিয়ে গেলো। সৌজন্যতার খাতিরে বললো,
“আপনারা কি কোনো কারণে এসেছেন?”
“তোমার সাথে জরুরি কথা ছিলো। সময় হবে?”
শেফালী বেগমের কথায় বেশ ভালোভাবেই ঝটকা খেলো নিশী। যে মানুষের সোজা মুখে তার সাথে কথা বলতে আপত্তি, সে কি না তার সাথে জরুরি কথা বলতে কলেজ অবধি এসেছে। কি এমন জরুরি কথা যার জন্য এতোটা উৎসুকভাব! একেবারে কলেজ খুঁজে চলে আসা! নিশীর ব্যাপারটা বোধগম্য হচ্ছে না। তাই শান্ত কন্ঠেই বললো,
“আমার মনে হয় না আমার সাথে আপনাদের কোনো জরুরি কথা আছে। আমি কোনো মহান ব্যক্তি তো নই, আবার আপনাদের পরিবারের কেউ ও নই। আমি শুধুমাত্র নীরার শিক্ষক। কিন্তু আমার মনে হয় না আপনি নীরার ব্যাপারে কথা বলতে এসেছেন। কি ভুল বললাম?”
নিশীর আচারণটিকে অভদ্রতা বলা যায় না। কিন্তু এই আচারণে যে শেফালী বেগম প্রসন্ন হলেন না তা বেশ ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে। তার মুখখানায় আষাঢ়ের মেঘমেদুর জমলো। তিনি কিছুসময় চুপ করে রইলেন। প্রখর দৃষ্টিতে কিছুসময় নিশীর মুখপানে চেয়ে৷ রইলেন। তারপর মুখে বিদ্রুপাত্মক হাসি এঁকে বললেন,
“ভালোই তো কথা বলো! তা আমার ছেলেটাকেও বুঝি এভাবেই বশ করলে! তাইতো বলি যে ছেলে আমার আসা’মীদের নাম বললেই চটে যেতো, সেই ছেলে কি না এখন একজন আসা’মীকে ভালোবাসার দাবী করে! গুণ আছে বলতে হবে”
শেফালী বেগমের তাচ্ছিল্যেভরা কথাটা শান্তভাবেই শুনলো নিশী। তার খারাপ লাগার কথা ছিলো, তাকে মানসিকভাবে আঘাত করতেই তিনি যে এই কথাটা বলেছেন তা বুঝতে বাকি রইলো না। কিন্তু অবাক ব্যাপার নিশীর খারাপ লাগলো না। সে স্মিত হেসে বললো,
“আপনার বোঝার ভুল আছে। আমি যতদূর জানি প্রণয় সাহেব একজন প্রখ্যাত উকিল। আমার থেকে বয়সেও তিনি অনেক বড়। তাই উনাকে বশ করার মতো মেধা বা অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই আমার থাকার কথা নয়। আর যদি সেটা থাকে তবে বলতে হয় আমি সত্যি ই গুনী। তা আপনি কি এখানে আমার গুন নিয়ে আলোচনা করতেই এসেছেন? এটাই জরুরি কথা?”
নিশীর কথায় রাগ বাড়লো বই কমলো না শেফালী বেগমের। নিশী বরাবর ই তার নিকট একজন অভদ্র, বে’য়াদ’ব মেয়ে। তবে তার চামড়া এতোটা পুরু হবে কল্পনা করেন নি তিনি। তিনি ভেবেছিলেন মেয়েটিকে আজ ইচ্ছেমতো অপমান করবে, অপমান করে তাকে বুঝিয়ে দিবে তার স্থান। কিন্তু উলটো তার নিকট ই অপমানিত হতে হচ্ছে তাকে। শেফালী বেগম কঠিন কন্ঠে দাঁতে দাঁত পিষে বললেন,
“তুমি তো বেশ নির্লজ্জ, তুমি কি ভেবেছো আমার ছেলেকে বিয়ে করলে আমি তোমাকে মেনে নিবো? আদোপি না। আমি কখনোই মেনে নিবো না”
“সেটা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে এগুলো আমাকে শুনিয়ে কি হবে আমি বুঝতে পারছি না। যদিও প্রণয় সাহেবের সাথে আমার সম্পর্কটা এখনো ধোঁয়াশা। আমাদের আগাম ভবিষ্যত দিয়ে দুজন ই বেশ সন্দিহান। তবুও আমি যতদূর জানি, আপনি নীরাকে মেনে নেন নি। আপনার পরিবারের সামনে তাকে পরিচয় দিতেও আপনি কার্পণ্য করেন। অথচ নীরা প্রণয় সাহেবের মেয়ে হিসেবেই বেড়ে উঠছে। আমিও নাহয় সেভাবেই থাকলাম। আমার বেলাতেও তা নয় চোখজোড়া বুজেই থাকবেন। মায়ার উপস্থিতিতে যেহেতু প্রণয় সাহেব আপত্তি করেন না, সেহেতু মা হিসেবে সন্তানের জন্য এতোটুকু তো করতেই পারেন। আর সত্যি বলতে আমার তার প্রতি অনুভূতিগুলো যতটা গাঢ়, তার অনুরাগের গাঢ়ত্ব এর চেয়ে অনেক গুন বেশি। আটকাতে হলে আপনার ছেলেকে আটকান। আমার চামড়া অনেক পুরু। এই সামান্য অপমানে এখন আর যায় আসে না”
নিশীথিনী হাসিতে মোড়ানো কথাগুলো তীরের ন্যায় লাগলো যেনো। শেফালী বেগম অনেক হাতড়েও তার বিতর্কটি চালিয়ে যেতে পারলেন না। মায়াও বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। এখানে নিশীর কথাগুলোর যুক্তি রয়েছে। অযৌক্তিক কিছুই সে বলে নি। নিশীকে যদি প্রণয়ের জীবন থেকে সরিয়েও দেওয়া হয় তবুও প্রণয় তার জীবনে অন্য নারীর প্রবেশের অনুমতি দিবে না। তাই ফুফুর কাজের ফলাফল পরিশেষে শূন্য। শেফালী বেগম আর দাঁড়াবেন না। এক মূহুর্ত মেয়েটিকে সহ্য হচ্ছে না। অবশ্য লক্ষুলজ্জার একটি ব্যাপার ও এখানে আছে। হাটুর বয়সী মেয়ে তাকে বাকযুদ্ধে হারিয়ে ফেলছে ব্যাপারটা কি সহনীয়! অবশ্যই নয়। মায়া এবং শেফালী বেগম চলে যাচ্ছে। নিশী তাদের যাবার পানে চেয়ে রয়েছে। প্রণয় এবং শেফালী বেগম মা এবং ছেলে। মাঝে মাঝে এই ব্যাপারটি যেনো বিশ্বাস ই হয় না নিশীর। একই রক্ত থাকা স্বত্তেও এতো অমিল! আচ্ছা মার সাথে সন্তানদের কি এতোটা অমিল থাকে! নিশীর মার সাথেও কি তার অমিল ছিলো! কে জানে! হয়তো ছিলো। তাই তো ছোট মেয়েটিকে ছেড়ে চলে যেতেও তার হৃদয় কাপে নি। নিশীর বুকে আটকানো তপ্ত নিঃশ্বাসটি এতো সময় পর বের হলো। আকাশের দিকে মুখ তুলে চাইলো। সাদা তুলোর ন্যায় মেঘগুলো উড়ছে বিশাল নীলাম্বরে। মাঝে মাঝে মুক্ত বিহঙ্গী হলে মন্দ হতো না। উড়ার জন্য বিশাল আকাশটি তো পাওয়া যেতো!
******
কোর্টে আজ কেস চলছে। মাহাদী শেখ বনাম নিশী হক। এখানে দুটি কেস, একটি নিশীর হকের বিরুদ্ধে। যেখানে তার উপর এটেম্প টু মা*র্ডারের চার্জ লাগানো হয়েছে। অন্য টি মাহাদীর বিরুদ্ধে, যেখানে একজন নারীকে অ*পহর*ণ, ধ*র্ষ*ণ এবং খু*ন করার চেষ্টা করার জন্য তার বিরুদ্ধে চার্জ লাগানো হয়েছে। আজ কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নেই নিশী। সে একটি কাঠের বেঞ্চে বসে আছে। সে একা নয়, সুহাও তার পাশেই বসে রয়েছে। জসীম এবং ঈশানও এসেছে। তাদের দেখে খুব একটা অবাক হয় নি নিশী। ঈশানের সাথে সৌজন্যতার খাতিরে কথাও বলেছে নিশী। প্রণয় কেসের পূর্বে সাধারণত মক্কেলের সাথে কথা বলে না। তবে এইবারটি ভিন্ন। তার মক্কেল যে নিশীথিনী। আজকের কেসটি যেমন নিশীর জন্য জরুরি তেমন তার জন্য ও। তাই তো সকলের অগোচরে নিপুন ভাবে একটি সাদা চিরকুট গুজে দিলো নিশীর ঈষৎ কম্পিত হাতে। নিশী অবাক নয়নে চাইলো। কিন্তু প্রণয় কিছু না বলেই রফিকের সাথে কেস সাজানোতে ব্যস্ত হয়ে গেলো। নিশী কৌতুহলবশত খুললো চিরকুট টি। গোটা গোটা করে লেখা তাতে কিছু পঙক্তি।
“নিশীথিনী!
হৃদয়ে নিভৃতে তোমায় পুষি।
তুমি শরৎ আকাশের পেজোতুলো মেঘ,
তুমি বর্ষা দিনের স্নিগ্ধ বিকেল।
তুমি হাঁসি, পূর্ণিমা চাদের,
তুমি নিশীথিনী হৃদ কুঠরির।
তোমায় রাখবো আগলে ধরে,
নিশীথিনী, নিরব প্রণয়ের!” (জান্নাতুল মিতু)
এতোসময়ে বুকে জড়ো হওয়া বিশ্রী ভয়ের প্রলেপটা ধীরে ধীরে সরতে লাগলো। ঠোঁটের কোনে ঠায় পেলো কুসুম প্রভা। নিশী সামনে তাকালো নতুন প্রভার আশায়।
আজ সোলাইমান শেখ কে দেখা গেলো কোর্টে। ইমাদ ও এসেছে। তাদের সাথে দৃষ্টি বিনিময় হলো নিশীর সাথে। কোর্টে বিচারক মহাদয় আসতেই কেসের কার্যক্রম শুরু হলো। মাহাদীর কেসের উকিল পরিবর্তিত হয়েছে৷ বেশ চতুর ক্রিমিনাল লয়ার সে। নাজমুল করিম রবিন নাম। তবে ক্রিমিনাল লয়ার কথাটি তার জন্য প্রযোজ্য কারণ তার অধিকাংশ মক্কেল ই বেশ গভীর জলের মাছেরা। প্রণয় এই ব্যাপারটা জানতো। তাই সেভাবেই প্রস্তুতি নিয়েছে সে। রবিন কেস শুরু করলো। সে তার প্রথম সাক্ষীকে কাঠগড়ায় ডাকার অনুমতি চাইলো। সবাইকে অবাক করে কাঠগড়ায় উঠলেন নিশীর চাচী রাহেলা বেগম। তাকে সাক্ষী হিসেবেই দেখেই বিস্মিত হলো নিশী। এবার বুঝলো নিহিতা কেনো বলছিলো সে চায় না রাহেলা তার সাক্ষী হবার ব্যাপারটি জানুক। মনে মনে কিঞ্চিত আহত ও হলো নিশী। সম্পর্কচ্যুত করে এতোটা নিষ্ঠুর হবার কি আদৌও প্রয়োজন ছিলো। হয়তো ছিলো কে জানে!
রবিন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলো। প্রথম প্রশ্ন ছিলো,
“নিশী ম্যাডাম তো আপনার এখানেই মানুষ, তাই না?”
“হ্যা, ওর বয়স তখন তেরো। বাবা-মাহীন মেয়েটিকে আমরাই আশ্রয় দেই”
“আচ্ছা, আপনি একটু তার স্বভাব, বৈশিষ্ট্য গুলো কি একটু বলতে পারবেন? মানে মানুষটি কেমন?”
রাহেলা একনজর তাকালো নিশীর দিকে। তারপর স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
“একেবারে মায়ের মতো, উগ্র, বে’য়া’দ’ব। মুখে মুখে তর্ক করা ওর স্বভাব। আমার কথা অগ্রাহ্য করা নিত্যদিনের কাজ। তবুও দাঁত কামড়ে বসে থাকতাম। এতিম মেয়ে যাবে কোথায়? পড়বে পড়বে করে মাথা খারাপ করে দিলো। ওর চাচা ওকে পড়াতে কার্পন্য করে নি। তবুও সে নাকি কামাই করবে। টিউশনের বাহানা দিতো বার বার। রাত রাত বাহিরে থাকতো। এটাই বৈশিষ্ট্য ছিলো”
“ছেলেদের সাথে সম্পর্ক? ছিলো?”
রবিনের প্রশ্নের সাথে সাথেই প্রণয় বলে উঠলো,
“অবজেকশন”
“সাসটেইনড”
জজের কথায় রবিন সাথে সাথেই প্রশ্ন পাল্টালো। তারপর স্পষ্ট কন্ঠে বললো,
“তার পার্সোনাল লাইফ সম্পর্কে একটু বলুন”
“এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। অহেতুক প্রশ্ন করে লাভ নেই। ওর নিজস্ব জীবন কখনো আমাদের সাথে শেয়ার করতো না। আমরা কারোর সাথে বিয়ের কথা বললেই তার বাক্য, ‘আমাদের কথায় বিয়ে করবে না’। অপমানিত হবার চেয়ে চুপ থাকা শ্রেয় তাই আমরা চুপ থাকতাম”
রবিন হাসলো। নিশী অবাক চোখে চাচীকে দেখছে। মহিলার সাথে তার বনিবনা ভালো ছিলো না। কারণ নিশী তার তাচ্ছিল্য, বিদ্রুপ, কটুক্তিতে মোড়ানো কথাগুলো হজম করতো না। হ্যা, সে মাহাদীর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলো। কারণ তাকে সে ঘৃ*ণা করতো। অথচ তাই বলে কখনো তার সাথে উচ্চবাচ্য কিংবা অভদ্রতা সে করে নি। আশ্রিতা ছিলো বটে তবে সে কখনোই মান মর্যাদার দায়ড়া ভঙ্গ করে নি। আত্মীয়ের মানুষগুলোর এমন আচারণ তাকে আজ আশাহত ই করলো। এর মাঝে রবিন তীক্ষ্ণ কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
“গত আঠারো জুলাই নিশী হক বাড়ি ফিরেন নি। উনিশ তারিখ দুপুর নাগাদ সে বাড়ি ফিরেছিলো।সে আহত ছিলো। মেডিকেল রিপোর্ট অনুযায়ী তাকে ধ*র্ষ*ণের চেষ্টা করা হলেও হতে পারে। উনি এইজন্য মাহাদী শেখ কে দায় করেছেন। ইনফ্যাক্ট উনার ভাষ্য অনুযায়ী তাকে আ*ঘা*ত ও তিনি এজন্যই করেছেন। আমার প্রশ্ন, তাকে কি কখনো মাহাদী শেখ বিরক্ত করতেন? বা নোংরা প্রস্তাব দিতেন? সাধারণত মেয়েরা এমন পরিস্থিতির স্বীকার হলে বাসায় ই জানায়। আপনি কি জানতেন”
এবার রাহেলা বেগম সময় নিলেন। তার সাক্ষ্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এখন। নিশীকে আরোও অবাক করে সে বলে উঠলো,
“নাহ, মাহাদী শেখ কখনোই তাকে বিরক্ত করে নি। বরং তাকে বিয়ে করার জন্য বাড়ি অবধি এসেছিলো সে”…….
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি