ইতি নিশীথিনী পর্ব-৩৯+৪০

0
639

#ইতি_নিশীথিনী
#৩৯তম_পর্ব

এবার রাহেলা বেগম সময় নিলেন। তার সাক্ষ্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এখন। নিশীকে আরোও অবাক করে সে বলে উঠলো,
“নাহ, মাহাদী শেখ কখনোই তাকে বিরক্ত করে নি। বরং তাকে বিয়ে করার জন্য বাড়ি অবধি এসেছিলো সে”

রবিন তখন উৎফুল্ল কন্ঠে বললো,
“পয়েন্ট টু বি নোটেড মাই লর্ড, নিশী হকের নিজের চাচী রাহেলা হকের বক্তব্য থেকে আমরা তার চারিত্রিক বর্ণনা পেলাম। শুধু তাই নয়, এটাও জানতে পারলাম মাহাদী শেখ কখনোই তাকে উত্ত্যক্ত করতেন না। যদি উত্ত্যক্ত ই করার থাকতো তবে সে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসবে কেনো! যে ছেলে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে ঘর অবধি আসতে পারে, সে কেনো এমন ঘৃণ্য কাজ করবে? কোনোভাবেই কি যুক্তি মেলে? যদি তার নিশী হককে ধ*র্ষণ করার ই ছিলো তবে সে কেনো বিয়ের প্রস্তাব দিবে?”

বিচারক কিছু লিখলেন। টাইপরাইটার লিখছেন। প্রণয় প্রখর দৃষ্টিতে দেখছে রবিনকে। রবিন ঠিক কিভাবে কেসের মোড় ঘোরাতে চাচ্ছে তার বুঝতে বাকি রইলো না। কপালে পড়লো ক্ষীণ ভাঁজ, মুখশ্রী কঠিন। হাতের পেন্সিলটা দিয়ে খাতার উপর খুট খুট করতে লাগলো সে। রবিন সময় নষ্ট করলো না, সে রাহেলা বেগমকে শুধালো,
“এর পর কি হলো? মানে মাহাদী শেখের সাথে বিয়েটা না হবার কারণ কি?”
“কারণ কিছুই না। ভালো ঘরের ছেলে, আমাদের আপত্তি করার কারণ ছিলো না। কমিশনার সাহেবকে চিনে না এমন কেউ নেই। মাহাদীও বেশ ভদ্র ছেলে। কিন্তু আপত্তি করলো নিশী। সে বিয়ে করবে না। তাই হলো না বিয়েটা”
“আপত্তির কারণ কিছু কি বলেছিলেন?”
“নাহ! শুধু বলেছে সে স্বাধীন নাগরিক। তার ইচ্ছে বিয়ে করবে না”

রবিন এবার আবারও বললো,
“ইউর অনার, নিশী হক জানতেন মাহাদী শেখ তাকে পছন্দ করেন। সে ঠিক সেটার সুযোগ ই নিয়েছে। সে কখনোই তাকে বিয়ে করবেন না। কারণ তার ঈশান মাহমুদের সাথে সম্পর্ক ছিলো। এবং তার সো কল্ড বয়ফ্রেন্ডের জন্যই সে মাহাদী শেখের ভালোমানুষীর সুযোগ নেন। এবং ঈশান মাহমুদের চিরশত্রু মাহাদী শেখকে হ*ত্যার চেষ্টা করেন”

রবিনের বক্তব্য শেষ হবার পরই পর ই প্রণয় রাহেলা বেগমকে প্রশ্ন করতে উঠে দাঁড়ায়। তার প্রথম প্রশ্নটি ই থাকে,
“মিসেস রাহেলা হক, আপনার সাথে নিশী হকের সম্পর্কটি ঠিক কেমন ছিলো?”

রাহেলা বেগম প্রশ্নটির জন্য প্রস্তুত ছিলো না। সে খানিকটা হকচকিয়ে উঠে। আমতা আমতা করে বলেন,
“জ্বী, ভালোই ছিলো”
“কেমন ভালো?”
“যেমনটা একজন চাচীর ভাতিজীর সাথে থাকা উচিত”
“তাহলে আপনি তাকে ঘর থেকে কেনো বের করে দিয়েছিলেন?”

প্রণয়ের প্রশ্নে রাহেলা বেগমের মুখখানা শুকিয়ে যায়। বিবর্ণ হয়ে যায় তার শ্যাম মুখ। প্রণয় আবার ও বলে,
“বিগত ২১শে জুলাই, আপনি নিশী হক কে দুপুর ২ টা নাগাদ তার জিনিসপত্র সমেত বের করে দেন। হ্যা নাকি না?”
“হ্যা?”
“কারণটি ছিলো সে জেলে গিয়েছিলো। হ্যা নাকি না”
“হ্যা, কারণ আমরা সভ্য সমাজে থাকি”
“কিন্তু আপনি তো বললেন বাবা-মা হীণ মেয়ে নিশী। সেজন্য তাকে আপনারা আশ্রয় দিয়েছেন। আমার জানা মতে তার কোনো আত্নীয় শহরে নেই। তার মা-বাবার বিচ্ছেদের পর নানাবাড়ির সাথেও তো যোগাযোগ বন্ধ ছিলো। হ্যা নাকি না?”
“হ্যা”
“তাহলে ভাতিজীর বিপদের সময় তাকে কেনো বের করে দিলেন?”
“সে ন’ষ্ট মেয়ে তাই”

রাহেলা বেগমের উক্তিটি কানে গরম শ*লাকার মতো ঠেকলো। তবুও শান্তভাবেই শুনলো নিশী। চাচীর জন্য যেটুকু সম্মান ছিলো সেগুলোও যেনো উড়ে গেলো কর্পুরের ন্যায়। নিশীর ভালো লাগছে না। খুব খারাপ লাগছে। সেই খারাপটা হয়তো মাপকাঠি দিয়ে মাপা সম্ভব নয়। প্রণয় হাসলো রাহেলা বেগমের অস্থিরতায়। সে রীতিমতো ঘামছে। তার দৃষ্টি অবিন্যস্ত। কেনো যেনো শান্ত থাকতে পারছে না। প্রণয় আবারো প্রশ্নোত্তর খেলা শুরু করলো,
“একটু আগে বললেন, নিশী কখনোই আপনার সাথে তার পার্সোনাল লাইফ শেয়ার করতো না। তাহলে জানলেন কি করে মাহাদী শেখ তাকে উত্ত্যক্ত করতো না?”
“ভালো ছেলে উত্ত্যক্ত করবে কেনো?”
“ভালো ছেলেরা হুমকি দেয় বুঝি?”

প্রণয়ের কথার উত্তর খুঁজে পেলেন না রাহেলা বেগম। কপালে তার বিন্দু বিন্দু ঘাম জমলো। সে তখন ইতস্তত কন্ঠে বললো,
“আমি বুঝতে পারি নি আপনার কথা”
“বুঝিয়ে বলছি। মাহাদী শেখ নিশী হকের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসেন। আমার জানা মতে নিশী হক বেশ বাজে ভাবেই তাকে অপমান করে। অপমানের কারণটি ছিলো তার দাম্ভিকতা এবং ক্ষমতার অপপ্রয়োগ। অপমানের এক পর্যায়ে মাহাদী শেখ তাকে হু*মকিও দেন। হ্যা কি না?”
“আমার মনে নেই”
“সত্যি মনে নেই? সব মনে আছে এটুকু মনে নেই?”
“না নেই”

বেশ জোর দিয়েই রাহেলা বেগম উত্তর দেয়। প্রণয় তখন স্মিত হেসে বলে,
“আপনি যেতে পারেন”

কাঠগড়া থেকে রাহেলা বেগম নেমে গেলো। সোলাইমান শেখের মুখখানা থমথমে হয়ে আছে। রবিন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছে প্রণয়কে। প্রণয় এবার বিচারকের উদ্দেশ্যে বললো,
“ইউর অনার, মাহাদী শেখ রীতিমতো ছয় মাস যাবৎ নিশী হককে নানাভাবে উত্ত্যক্ত করতেন। শুধু তাই নয়, তার অমত থাকা স্বত্তেও সে প্রতিনিয়ত তাকে স্টক করতেন, তাকে বাজে প্রস্তাব দিতেন। যখন প্রস্তাবে নিশী হক একেবারে সাড়া দিলেন না, তখন তিনি তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। সেদিন ও নিশী হক তার উ’গ্র আচারণের কারণেই তাকে প্রত্যাখ্যান করেন। এই অপমানটি সহ্য হয় না মাহাদী শেখের ফলে সে পরিকল্পনা করে। নোংরা পরিকল্পনা নিজের অপমানের শোধ তোলার জন্য। ফলে আঠারো জুলাই সে নিশী হককে অপ*হর*ণ করেন, ধ*র্ষণ করার চেষ্টা করেন এবং তাকে হ*ত্যা করার ও চেষ্টা চালানো হয়। সেদিনের ঘটনার পর আরোও দু*বার নিশী হককে হ*ত্যা করার চেষ্টা করা হয়। প্রথম ১২ আগষ্ট, নিশী হকের ভাড়া থাকা নিরালার বাড়িতে। এবং দ্বিতীয় আ*ক্রমণ হয় ৮ সেপ্টেম্বর, নিশী হকের বর্তমান আবাসস্থলে। প্রথম বারের প্রত্যক্ষদর্শী আমি নিজে। আমি ১৩ তারিখ থানায় কমপ্লেইন ও করেছি। কিন্তু ঘা*তকের খোঁজ পাওয়া যায় নি। এখানে নিরালার বাসার এবং রাস্তার সিসি টিভি ফুটেজ রয়েছে। যেখানে কালো পোশাকধারী ঘা*তকের প্রবেশ এবং পালিয়ে যাবার ফুটেজ রয়েছে। এবং দ্বিতীয় বারের আক্র*মনে সৌভাগ্যবশত নিশী হকের কিছু না হলেও সুহা জামান আহাত হন। সুহা জামানের শরীরের পাশে এই নোট টি পাওয়া যায়”

বলেই প্রণয় কালো পাতাটি এবং একটি পেনড্রাইভ পেশকার কে দেয়। ভিডিও মানুষ দেখা গেলেও তার মুখ দেখা যায় না। তখন রবিন বলে উঠে,
“অবজেকশন, ইউর অনার এখানে কারোর চেহারা দেখা যাচ্ছে না। আমার মক্কেল প্যারালাইজড, তাহলে প্রমাণ কি করে হয় আমার মক্কেল ই আ*ক্রমণ করিয়েছেন”
“ইউর অনার আমার কাছে আরোও একটি প্রমাণ রয়েছে”

বলেই আরোও একটি পেনড্রাইভ এগিয়ে দেয় প্রণয়। একটি ভিডিও চলতে থাকে। যেখানে সোলাইমান শেখ এবং ইমাদকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। নিশী যখন শেখ ভিলা গিয়েছিলো সে একটি কলম নিয়ে গিয়েছিলো যা একই সাথে ভিডিও এবং অডিও রেকর্ড করে। সেই ক্লিপটাই চালানো হয়। যেখানে সোলাইমান শেখ এবং তার কথোপকথন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। সোলাইমান শেখ ভিডিও টি দেখামাত্র র*ক্তশূন্য হলেন। কারণ এখানে স্পষ্ট তার বক্তব্য ছিলো যেখানে সে নিশীকে কেস উঠাবার প্রস্তাব দেয়। ইমাদ দাঁত দিয়ে নখ কাটতে লাগলো। প্রণয় এবার বললো,
“যদি মাহাদী শেখ নির্দোষ ই থাকে তবে কেনো নিশী হক কে কেস উঠাবার প্রস্তাব দেওয়া হলো! শুধু তাই নয় ইউর অনার, নিশী হককে কোনঠাসা করতে তারা প্রথমে তার উপর আ*ক্রমণ করেন, ব্যর্থ হলে নিশী হকের চাচা জামশেদ সাহেব এবং তার পরিবারকে নানাভাবে হেনস্তা করেন। আমি সেজন্য আমার প্রথম সাক্ষী জামশেদ সাহেবকে কাঠগড়ায় ডাকতে চাই ইউর অনার”
“অনুমতি দেওয়া হলো”

জামশেদ সাহেব সাক্ষী দিবেন ঘটনাটি বিশ্বাস হলো না রাহেলা বেগমের। অবিশ্বাস্য চোখে তিনি তাকিয়ে রইলেন তার স্বামীর দিকে। এ দিকে নিশী অবাক হলো, হবার ই কথা। চাচা তার হয়ে সাক্ষী দিবে এই ঘটনাটি কল্পনার বাহিরে ছিলো। যদিও সেদিন প্রণয় বলেছিলো। তবুও সে বিশ্বাস করে নি। একেই বুঝি বলে “বিষে বিষে বিষক্ষয়”

জামশেদ সাহেব দাঁড়ালেন কাঠগড়ায়। তিনি শপথ নিলেন। তখন প্রণয় তাকে প্রথম প্রশ্ন করলো,
“জামশেদ সাহেব নিশী হক আপনার কি হন?”
“আমার একমাত্র ভাতিজী”
“মেয়ে হিসেবে সে কেমন ছিলো? মানে তার স্বভাব, আচারণ?”
“আমি বলবো না নিশী পুতুলের মতো নরম ছিলো। তবে সে অভদ্র ছিলো না। আমার ছোট ভাইয়ের কার্বণ কপি সে। সবল না হলেও দূর্বল নয়। তর্ক করতো না ঠিক, তবে মুখ্যম জবাব দিতে জানে। শুধু তাই নয়। মুখ সহ্য করার মতো মেয়ে সে নয়। মুক্তমনা, সাহসী, নির্ভীক নিশী”
“ঠিক একারণেই কি তার আজ এই পরিণতি?”

জামশেদ সাহেব কথা বললেন না। চুপ করে রইলেন। প্রণয় আবার একই প্রশ্ন করলো,
“এজন্যই কি আজ তার চরিত্র হ*ত্যা হচ্ছে?”
“হতে পারে”

জামশেদের সাহেবের কন্ঠে বিষন্নতা। প্রণয় এর পর বললো,
“জামশেদ সাহেব আপনি আজ কোর্টকে বলুন, এতো ওয়ার্ড কমিশনার ঠিক কি করেছিলেন যখন নিশী কেস উঠাবার জন্য মাথা নত করছিলো না”
“তারা প্রথমে আমার দোকানে ভাঙ্গচুর করে, আমার বাড়ির বিদ্যুৎ লাইন কেটে দেয়। আমার মেয়েকেও ইমাদ নামক ছেলেটি বিরক্ত করে। আমি তাকে কাছে সহায়তা চেলেই নানা ভাবে হুমকি দেন। পরে যখন লাভ হয় না নিশীকে আমরা জানাই। মেয়েটি আমাদের হয়ে শেখ সাহেবের সাথে কথা বলে। তার দুদিন পর ই সব ঠিক হয়। তবে এক সপ্তাহের মাঝে সোলাইমান শেখ আমাদের বাসায় আসেন। নিশীর বিরুদ্ধে সাক্ষী দেবার জন্য বেশ কড়া টাকাই আমাদের লোভ দেখান। তাতে আমার স্ত্রী রাজী হয়ে যান”…….

চলবে

#ইতি_নিশীথিনী
#৪০তম_পর্ব

“তবে এক সপ্তাহের মাঝে সোলাইমান শেখ আমাদের বাসায় আসেন। নিশীর বিরুদ্ধে সাক্ষী দেবার জন্য বেশ কড়া টাকাই আমাদের লোভ দেখান। তাতে আমার স্ত্রী রাজী হয়ে যান। যদিও আমার অমত ছিলো তবুও সে এই কাজটি করে। এতে আমাদের মাঝে অনেক কলহ ও বাঁধে কিন্তু রাহেলাকে আমি থামাতে পারি নি। অবশ্য এতে তার দোষ যে খুব আছে তাও নয়। আমাদের সোলাইমান শেখ বেশ হুমকি দিয়েছিলো। তাদের প্রস্তার গ্রহণ না করলে হয়তো নিহিতার কিছু করে দিতো। ছা-পোষা মধ্যবিত্ত মানুষ আমি। আমাদের প্রতিটি কদম ফু দিয়ে চলতে হয়। নিশীর সাথে যা হয়েছে সেটা নিহিতার সাথে হোক তা হয়তো কোনো মায়ের ই কাম্য নয়”

অবিচলিত কন্ঠে কথাগুলো বললেন। তার কন্ঠে জড়তা নেই। তার দৃষ্টি বিষন্ন। সেই দৃষ্টিতে অপরাধবোধ স্পষ্ট। নিশীর দিকে একবার মাথা তুলে দেখবার শখ হলো ছিলো। কিন্তু গ্লানির বিশ্রী পরদটা পেরিয়ে চাইতে পারলেন না। টুটুল সাহেব যখন মুমূর্ষু অবস্থায় বিছানায় শায়িত তখন বড়ভাই এর নিকট টলমলে কন্ঠে একখানাই আবদার করেছিলেন,
“ভাইজান, আমি ছাড়া আমার নিশীরানীর কেউ নেই৷ মেয়েটি যে নিষ্ঠুর দুনিয়ার কিছুই জানে না। আপনি ওর হাতটা ছেড়ে দিবেন না। মেয়েটা তাহলে এই কালগহ্বরে হারিয়ে যাবে”

জামশেদ সাহেব তার অসুস্থ ভাইকে কথা সেদিন কথা দিয়েছিলেন। অথচ সেই কথাটি রাখিতে পারেন নি। নিজের স্বার্থপরতার জন্য সে তার মুমূর্ষু ভাইকে দেওয়া কথাটিও রাখতে পারেন নি। নিজেকে আজ খুব জঘন্য মানুষ বলে মনে হচ্ছে তার। তাই তো নিশীর চোখে চোখ রাখতেও তার লজ্জা লাগছে। অপরদিকে রাহেলা বেগম বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রয়েছে জামশেদ সাহেবের দিকে। জামশেদ সাহেব তার বিরোধিতা করবে এটা যেনো স্বপ্নেও কল্পনা করেন নি তিনি। সর্বদাই জামশেদ সাহেব স্ত্রীর মতামতের প্রাধান্য দিয়েছেন। অথচ আজ সেই স্ত্রীর কুকীর্তি সকলের সামনে বলতেও তার স্বর কাঁপছে না। স্বামীর এমন পরিবর্তনে তিনি বিস্মিত, হতবিহ্বল হয়ে গেলেন। তার মুখশ্রীতে জমলো আষাঢ়ের কালো মেঘ। হতাশায় তিনি যেনো ভেঙ্গেই পড়লেন। এতোবছরের সম্পর্কটা আজ যেনো নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে। রাহেলা বেগমের মাঝে অস্থিরতা লক্ষ্য করা গেলো। মনের এক অজানা ভয় বিরাজ করলো, কোর্টে মিথ্যে সাক্ষী দেবার জন্য শাস্তি পেতে হবে না তো আবার!

প্রণয়ের প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ হতেই রবিনের পালা এলো। রবিন নানাভাবে জামশেদ সাহেবকে কোনঠাসা করার চেষ্টা শুরু করলো। যেমন তার প্রথম প্রশ্ন ই ছিলো,
“আপনি যদি জানতেন আপনার স্ত্রী নিশীর বিরুদ্ধে সাক্ষী দেবার জন্য রাজি হয়েছেন তবে আপনি তাকে আটকালেন না কেনো?”
“আমার স্ত্রী একজন আলাদা ব্যক্তিত্ব। তাকে আমি বাঁধা দিতে পারি, বোঝাতে পারি, কিন্তু জোর করতে পারি না। এটার অনুমতি হয়তো আমাকে আইন দিবে না। সে স্বাধীন মানুষ। এটা তার ব্যক্তিগত মতামত সে কার হয়ে সাক্ষী দিবে না দিবে”

বেশ শীতল কন্ঠেই কথাটা বললেন জামশেদ সাহেব। রবিন তার কন্ঠের দৃঢ়তা বাড়ালো। সে জোর দিয়ে বললো,
“তাহলে আপনি বোঝাতে চাইছেন আপনি রাহেলা বেগমকে বুঝিয়েছিলেন অথচ তিনি আপনার কথা শোনেন নি, হ্যা নাকি না?”
“হ্যা”
“আপনার কাছে কি প্রমাণ রয়েছে রাহেলা বেগম টাকা নিয়েছে বিধায় মিথ্যে সাক্ষী দিয়েছেন? হ্যা নাকি না?”
“আমি প্রত্যক্ষদর্শী। আপনি যদি আমার স্ত্রীর ব্যাংক একাউন্টের স্টেটমেন্ট তুলেন তাহলে বেশ মোটা অংকের টাকা দেখবেন। কিন্তু আমি তো মধ্যবিত্ত দোকানী। আমার কাছে এতো টাকা আসা সম্ভব ই না। আমার সম্পত্তি কিংবা ব্যাংক স্টেটমেন্ট দেখুন”

সাথে সাথেই রফিক একটি কাগজ পেশ করলো, রাহেলা বেগমের ব্যাংকের স্টেটমেন্ট। যেখানে দেখা যাচ্ছে এক সপ্তাহ পূর্বেই তার একাউন্টে দশ লক্ষ টাকা জমা করা হয়েছে। রবিন তখন কোর্টে বললো,
“এ থেকে প্রমাণ হয় আমার মক্কেল বা তার বাবা এই টাকা তাকে দিয়েছেন। কারণ জমাকারী রাহেলা বেগম নিজে”
“আমার পক্ষে কি এতো টাকা জমা রাখা সম্ভব?”
“সেই উত্তর না হয় রাহেলা বেগন থেকেই নেওয়া যাবে! আমাকে আপনি এটা বলুন যখন আমার মক্কেল আপনাদের হু*মকি দিচ্ছিলেন প্রতি নিয়ন আপনি আইনের শরণাপন্ন হয়েছিলেন? হ্যা নাকি না”
“না”
“কেনো?”
“ভয় পেয়েছিলাম”
“কিসের ভয়?”
“আমার মেয়ের যদি ক্ষতি করে! নিশীকে যেমন আ*ক্রমণ করা হয়েছে, ক্ষতি করার চেষ্টা করা হয়েছিলো সেই একই ঘটনা যদি আমার মেয়ের সাথে হয়”
“আইন আপনাকে প্রটেকশন দিতো, আপনি কি আইনের উপর সন্দেহ করছেন! বলছেন আইন আপনার সাথে পক্ষপাতীত্ব করতো?”
“অবজেকশন ইউর অনার। আমার উকিলবন্ধু অহেতুক ব্যাপারটাকে জলঘোলা করছেন”

প্রণয় সাথে সাথেই দৃঢ় স্বরে বলে উঠেন। তখন রবিন বিচারকের দিকে তাকিয়ে বলে,
“ইউর অনার এটা কেস রিলেটেড”
“অবজেকশন ওভাররুলড”

বিচারকের কথাটা শুনেই বাঁকা হাসি হেসে প্রণয়ের দিকে তাকালো রবিন। দুজনের মাঝে চোখাচোখি হলো। রবিনের হাসিতে তাচ্ছিল্য ছিলো। প্রণয়ের চাহনীর তীক্ষ্ণতা বাড়লো। রবিন তা উপেক্ষা করে বললো,
“বলুন, আপনি কি বলতে চাচ্ছেন আইন আপনার সাথে পক্ষপাতীত্ব করতো?”
“ক্ষমতা, আর বিত্ত এমন জিনিস যা সত্য কে মিথ্যে আর মিথ্যে কে সত্য বানিয়ে দেয়। আমার লাইসেন্স, রোড পারমিশন, সিটি কর্পোরেশনের কাগজপত্র থাকা স্বত্তেও বানোয়াট রোডের কাগজ দেখিয়ে আমার দোকান ভাঙ্গা হয়েছিলো। তারপর নিশী যখন তাদের সাথে কথা বললো, তখন সেটা দু দিন বাদে বদলে গেলো। সুতরাং আইন বানাতে বা ভাঙ্গতে সময় লাগে না। আমার বাড়িকে উপরিকল্পিত বলে বিদ্যুৎ লাইন কেটে দেওয়া হলো। কিসের আইনের কথা বলছেন আপনি। এজন্য আমি যাই নি। আর কিসের প্রটেকশন? কোর্ট থেকে নিশীকেও প্রটেকশন দেওয়া হয়েছিলো। অথচ ওর উপর দুবার আক্র*মণ হয়েছে। ঘাতক পলাতক। কিসের প্রটেকশন দিতো আমাকে আইন। আমার মেয়ে প্রতিনিয়ত টিউশনে যায়। সন্ধ্যা হয় ফিরতে। এর মাঝে ওর ক্ষতি যে হবে না কি গ্যারেন্টি?”

রবিন হাসলো। জামশেদ সাহেবের কথাটাকে রীতিমতো উড়িয়ে দিলো সে। উলটো জোরালো কন্ঠে বলল,
“মিথ্যে, মিথ্যে বলছেন আপনি। আসলে আপনার স্ত্রী মিথ্যে সাক্ষী দিচ্ছে না। দিচ্ছেন আপনি। তাও নিজের ভাতিজীকে বাঁচানোর জন্য! আপনি আপনার ভাতিজীকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন না? বলুন আপনি আপনার ভাতিজীকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন কি না? হ্যা নাকি না?”
“হ্যা”
“তাহলে আপনি স্বীকার করছেন আপনি আপনার ভাতিজীকে বাঁচানোর জন্য মিথ্যে সাক্ষী দিচ্ছেন”
“কিন্তু..”
“আপনি কোর্টকে মনগড়া কাহিনীতে ফাঁসাচ্ছেন। যেখানে আপনার কাছে প্রমাণ নেই”

রবিনের কন্ঠের প্রখরতা বাড়লো। জামশেদ সাহেব কিছুতা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। তিনি কিছু বলার পূর্বেই রবিনের চাপ বাড়তে লাগলো। সে বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। কি বলবেন তিনি সাজাতে পারছেন না। ফলে সাথে সাথেই প্রণয় বলে উঠে,
“অবজেকশন, আমার উকিল বন্ধু নিজের কথাগুলো জামশেদ সাহেবের মুখে বসাতে চাচ্ছেন। তিনি সত্য কে জোর করে মিথ্যে বানানোর চেষ্টায় আছেন। তিনি জামশেদ সাহেবকে বিভ্রান্ত করতে চাচ্ছেন।”

রবিনের জেরার মাত্রা বাড়লেই প্রণয় বাধ্য হয়ে আপত্তি জানায়। বিচারক তখন বললেন,
“অবজেকশন সাসটেইনড”

জামশেদ সাহেব কাঠগড়া থেকে থেমে গেলেন। রবিন নিজের জায়গায় বসলো। আদালতে কিছু সময়ের বিরতি ঘোষণা করা হলো। প্রণয় এবং রফিক বেড়িয়ে গেলো কোর্টরুম থেকে। নিশী সেখানেই বসে রইলো। সুহা তার ঘাড়ে হাত রেখে বললো,
“চিন্তা করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে”

এর মাঝেই জামশেদ সাহেব এগিয়ে এলেন তার কাছে। অপরাধী কন্ঠে বললেন,
“নিশী, ভালো আছো?”

জামশেদের সাহেবের প্রশ্নটি অনাকাঙ্ক্ষিত ছিলো। শক্ত, কঠিন নিশী হুট করেই যেনো দূর্বল হয়ে গেলো। তার বুকখানা কেঁপে উঠলো। টলমলে চোখে বহুসময় তাকিয়ে রইল সে জামশেদ সাহেবের দিকে। কিছু বলার আগেই জামশেদ সাহেব অপরাধী কন্ঠে বললেন,
“আমাকে ক্ষমা করে দিস মা”

***
কোর্টের বাহিরে মুখোমুখি হলো প্রণয় এবং রবিন। প্রণয় চা ব্লাক কফি খাচ্ছিলো। তার মেজাজ খারাপ। অত্যন্ত খারাপ। রবিনের সাক্ষী বিভ্রান্ত করার টেকনিকটা পছন্দ হয় নি। সে নিশ্চিত নিহিতাকেও বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হবে। নিহিতা মেয়েটির বয়স কম। রবিনের মুখোমুখি হলে সে ঘাবড়ে যাবে। তাই নিহিতাকে কাঠগড়ায় তোলাটা বুদ্ধিমানের হবে না। প্রণয়ের মস্তিষ্কের কোষগুলো এখন রেষারেষি করতে ব্যস্ত। তখন ই রবিনের সাথে তার সাক্ষাৎ হলো। প্রথমে তাকে এড়িয়ে যেতে নিলো প্রণয়। কিন্তু পারলো না। তার পূর্বেই রবিন বললো,
“প্রখ্যাত উকিলের বোধ হয় এটা প্রথম কেস হবে যেখানে সে আমার কাছে হেরে যাবে”
“এতোটা আত্মবিশ্বাসী হওয়া ভালো না। সাক্ষীকে বিভ্রান্ত করে তার স্টেটমেন্ট বদলানোর চেষ্টা করলেই কেস জেতা যায় না”
“সবার নিজস্ব পদ্ধতি থাকে। এটা সময় আসলেই বুঝবেন”

বলেই রবিন ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো। সেই হাসির মর্মার্থটা বুঝতে বাকি সময় লাগলো না। রবিন এখন নিশীর চরিত্র হ*ত্যা করবে। দ্বিতীয়বারের মতো নিশীকে অপদস্ত করার প্রচেষ্টা চালাবে। কিন্তু কিভাবে! প্রণয় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রবিনকে দেখতে লাগলো। রবিন কোর্ট রুমে চলে গেলো। পেছনে তাকালে হয়তো প্রণয়ের অগ্নিদৃষ্টির আভাস পেতো।

কোর্টের কার্যক্রম শুরু হলো। বিচারক আসন গ্রহণ করলেন। নিশী কিছুটা বিষন্ন দৃষ্টিতেই সামনে থাকা বিচারক কে দেখতে লাগলো। এদিকে রবিন উঠে দাঁড়ালো। সে একটি পেনড্রাইভ এগিয়ে দিলো পেশকারের কাছে। তারপর শান্ত কন্ঠে বললো,
“ইউর অনার, বারবার কোর্টে একটা বিষয় প্রমাণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে নিশী হকের ঈশান মাহমুদের সাথে কোনো সম্পর্ক ছিলো না। আমার মক্কেল তাকে ইভ*টি*জিং করতেন। এই পেনড্রাইভে কিছু এমন প্রমাণ রয়েছে যা প্রমাণ করে দিবে নিশী হকের সাথে ঈশান মাহমুদের সম্পর্ক ছিলো। এবং এখনো আছে”

পেনড্রাইভের ফোল্ডার ওপেন করা হলো। সেখানে রয়েছে কিছু ছবি। যা ঈশান এবং নিশীর। ছবিগুলো লুকিয়ে তোলা হয়েছে………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি