ইতি নিশীথিনী পর্ব-৪৫+৪৬

0
634

#ইতি_নিশীথিনী
#৪৫তম_পর্ব

নিশীর ফোনটি এখনো বাজছে। নিশী বিরক্ত হয়ে ফোনটি ধরতেই প্রণয়ের ব্যাগ্রকন্ঠ শোনা গেলো,
“নিশী, তুমি কোথায়?”
“আমি বাসায়?”
“নীরা কি করছে?”
“ও ড্রয়িং করছে”
“বাসায় কি কেউ এসেছে?”
“হ্যা, রফিক ভাইয়া এসেছে বাজার নিয়ে। আচ্ছা, বাজারের কি দরকার ছিলো। আমি তো করেই নিতাম”
“আমি রফিককে পাঠাই নি, আমি কোনো বাজারের কথা বলি নি তাকে। সে কি বাসার ভেতরে প্রবেশ করেছে? ওকে বাসার ভেতরে ঢুকতে দাও নি তো? নিশী আমার কথা মন দিয়ে শোনো। নীরার জন্য বিপদ অপেক্ষা করছে। সেই বিপদটা রফিক। আমি শুধু বলবো, তোমরা সাবধানে থাকো। আমি বেশি দূরে নেই। আমি চলে আসছি”

প্রণয়ের কন্ঠে ভীতি এবং আতঙ্কের ছাঁপ সুস্পষ্ট। এই প্রথম প্রণয়ের স্বরে এতোটা আতঙ্ক অনুভূতি হচ্ছে। প্রণয়ের মুখে বিপদের কথাটা শুনতেই মস্তিষ্কে ঝংকার তুললো। হুট করেই নিশীর বুকটা হুট করেই ধক করে উঠলো। শিরদাঁড়া বেয়ে উষ্ণ রক্তের স্রোত বয়ে গেলো। আড়চোখে বাহিরের ঘরের দিকে চাইলো সে। যে বিপদের থেকে সাবধান করা হচ্ছে সেই বিপদ তার বাহিরের ঘরেই অপেক্ষা করছে। রফিক ঠোঁটে দুর্বোধ্য হাসি ঝুলিয়ে অদ্ভুত চাহনীতে তাকিয়ে রয়েছে নীরার দিকে। বাচ্চা মেয়েটি তখনও তার জগতে ব্যস্ত। রফিকের সেই চাহনীর ভাষা বুঝতে পারলো না নিশী। কিন্তু তার ভয় লাগলো। গা ছমছমিয়ে উঠলো। রফিকের চাহনী, হাসিটা বড্ড অপরিচিত লাগছে। এতোদিনের পরিচিত রফিককে যেনো অন্যমানব লাগছে। ঠিক তখন ই তার চোখাচোখি হলো রফিকের সাথে। দৃষ্টি বিনিময় হতেই রফিকের হাসি প্রশস্ত হলো। সেই হাসি অপ্রকৃতস্থ, গা গুলিয়ে ওঠা এক অনুভূতি হলো নিশীর। সাথে সাথে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। প্রণয়কে কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না নিশী। মস্তিষ্ক শূন্য শূন্য লাগছে। এদিকে নিশীর সাড়া না পেয়ে অস্থির হয়ে উঠলো প্রণয়। বারবার তার নাম ধরে ডাকতে লাগলো। তার হৃদয় বসে যাচ্ছে। নিকষকালো ভয়, দুশ্চিন্তা তাকে ঘিরে ধরছে। ভবিষ্যতের অহিতের কালো ছায়া তার বুক কাপাচ্ছে। প্রণয়ের আকুল কন্ঠ কানে যাচ্ছে নিশীর। সে ছোট করে “হু” বললো। প্রণয়ের ভয় গাঢ় হলো। সে অধৈর্য্য হয়ে বললো,
“নিশী, রফিক কি তোমার আশেপাশে আছে?”
“হু”
“তুমি ঘাবড়ে যেও না। ও অনেক ধূর্ত। ও যদি বুঝে যায় তুমি ওর চাল ধরে ফেলেছো, ও তোমার ক্ষতি করবে। নীরার ক্ষতি করবে। একটু সময় অতিবাহিত করতে ট্রাই করো। আই এম অন দ্যা ওয়ে। পুলিশ ও ওখানে যাচ্ছে”

নিশী ঘামছে। তার শরীর ঈষৎ কাঁপছে। গলা শুকিয়ে আসছে। ভয় হচ্ছে তার। মস্তিষ্ক কাজ করছে না। রফিকের চাহনী ভয়ংকর, অপ্রকৃতস্থ। হয়তো একা হলে ভয় হতো না। কিন্তু এখানে নীরা জড়িত। তাই ভয়ের মাত্রা বেশি। নিশী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর বললো,
“রাখছি”
“নাহ, ফোন কেটো না। আমি লাইনে থাকবো”
“আচ্ছা”

নিশী ফোন কাটলো না। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার যথার্থ চেষ্টা করলো সে। সে স্বাভাবিক ভাবেই বসার ঘরে যাবে। সুহা সামনের মোড়ে মুদির দোকানে গিয়েছে। আসতে সর্বোচ্চ পনেরো মিনিট লাগবে। এই সুহা চলে আসলে রফিক কিছুই করতে পারবে না। ক্রিমিনাল সাইকোলজি অনুযায়ী, এই ধরনের ধূর্ত খুনিরা লোকের সম্মুখে নিজেদের জাহির করতে চায় না। চাইলে অনেকপূর্বেই সে তেমনটা করতো। নিজেকে শান্ত রেখে পেছনে ঘুরতেই চমকে উঠলো নিশী। তার ঠিক পেছনেই রফিক দাঁড়ানো। রফিকের ঠোঁটের কোনে এখনো অপ্রকৃতস্থ হাসি। সে হাসি অক্ষত রেখেই বললো,
“ভয় পেলেন নাকি নিশী ম্যাডাম?”

নিশী নিজেকে নিপুন ভাবে সামলে বললো,
“ভয় পাবো কেন?”
“পান নি?”
“নাহ! চমকে গিয়েছিলাম। আসলে হুট করে আপনাকে পেছনে দেখবো ভাবি নি”
“স্যার ফোন করেছিলো নাকি?”
“হ্যা”
“কি বললো?”

নিশীর বুক কাঁপছে। হৃদস্পন্দন বাড়ছে। কন্ঠ শুকিয়ে আসছে। রফিকের পৈশাচিক, ভয়ংকর চাহনীর সামনে মস্তিষ্ক কাজ করছে না। তবুও নিজেকে সামলে বললো,
“সে ফিরে আসছে”
“এতো তাড়াতাড়ি! নুশরাত ম্যাডামের খু*নীকে খুঁজে পেলো নাকি”

কথাটা বলেই তার হাসি প্রশস্থ হল। অন্যদিকে ফোনের অপর পাশে সব কথোপকথন ই শুনছে প্রণয়। সে গাড়ির বেগ বাড়ালো। রুপসা ব্রীজের কাছাকাছি চলে এসেছে সে। দূরত্ব খুব একোতা বেশি নয়। তবুও এই সামান্য পথটুকু যেনো ক্রোশের মতো লাগছে। প্রণয় ঘামছে। বারবার ঠোঁট ভেজাচ্ছে। পুলিশকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে বহুপূর্বেই। কিন্তু পুলিশ এখনো কেনো সেখানে যায় নি বুঝে উঠতে পারছে না প্রণয়।

এদিকে নিশী স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
“তেমন কিছু জানায় নি”

নিশীর দিকে কিছুসময় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রফিক। তারপর বলতে থাকলো,
“কেনো মিথ্যে বলছেন, স্যার আপনাকে সাবধান করতে ফোন করেছিলো। তাই না ম্যাডাম”
“কা…কার থেকে সাবধান”
“মির্জা হাফিজের থেকে”

ফিসফিসিয়ে কথাটা বললো রফিক। নিশীর চোখ বিস্ফারিত হলো। ভয়ার্ত কন্ঠে বললো,
“সে কোথায়?”
“আপনার সামনে”

কথাটা শুনতেই থমকে গেলো নিশী। ফোনের ওপারে থাকা প্রণয়ের বুক ধক করে উঠলো। আগামীতে কি হতে চলেছে বুঝতে বাকি রইলো না। সাথে সাথেই তীব্র আর্তনাদ শুনতে পেলো প্রণয়। নিশীর তীব্র আর্তনাদে চিৎকার করে উঠলো সে। তখন একটা পুরুষালী কন্ঠ কানে এলো প্রণয়ের,
“স্যার, আমার সালাম দিবেন। দোয়া করবেন যেনো আর সাক্ষাত না হয়। আপনার সাথে কাজ করতে পারা আমার ভাগ্য”
“রফিক…. না হাফিজ আমার কথা শোনো। ওদের কোনো ক্ষতি করো না”

কিন্তু অপরপাশের মানুষটি কিছুই শুনলো না। সে ফোন কেটে দিলো। প্রণয় গাড়ির বেগ বাড়ালো। তার হৃদয় কাঁপছে। দৃষ্টি ক্রমশ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। তাহলে কি চিরতা রে হারিয়ে ফেলবে সে তার নিশীথিনীকে। সুন্দর, নির্মল পরিবারের স্বপ্নটা কি স্বপ্ন ই থাকবে!

******

নিগূঢ় রাত। পূর্ণচন্দ্রিমার রুপালী আলো এবং বাহিরের টিমটিমে আলো জানালা গলিয়ে আছড়ে পড়ছে নিশীর শুভ্র মুখশ্রীতে। চুলগুলো অবিন্যস্ত। হাতজোড়া নাইলনের দড়িতে চেয়ারের সাথে বাঁধা। পাজোড়া নগ্ন। শীতল সমীর গায়ে লাগছে। নিশীর জ্ঞান ফিরলো ধীরে ধীরে। চোখ খুলতেই মাথায় তীব্র যন্ত্রণা অনুভূত হলো তার। চোখ বুজে সেই যন্ত্রণা সহ্য করলো সে। চোখ খুলতেই একটি অপরিচিত ঘরে নিজেকে আবিষ্কার করলো নিশী। অন্ধকার ঘরটিতে বাহিরের আলো প্রবেশ করায় খানিকটা হলেও আলোকিত হয়েছে। সেই ক্ষীন আলোতে দেখতে পারলো তার সম্মুখে অচেতন নীরা লুটিয়ে আছে মাটিতে। নীরার মাথায় জমে থাকা রক্ত কালো হয়ে গিয়েছে। বুক কেঁপে উঠলো নিশীর। বুঝতে বাকি রইলো না, এই কাজটিও রফিকের।কাঁপা স্বরে বারবার ডাকলো নীরাকে। কিন্তু বাচ্চা মেয়েটি সাড়া দিলো না। রফিক যে অতর্কিতে আক্রমণ করবে সেটা কল্পনাও করে নি সে। নিশীর হৃদয় বসে যাচ্ছে। তার ভয় হচ্ছে। অস্থির হয়ে উঠলো সে। বাঁধা অবস্থাতেই বারবার নীরাকে ডাকতে থাকলো। ঠিক তখন ই দরজা ঠেলে ঘরে প্রবেশ করলো রফিক। নিশী তবুও নিজের বাঁধন খোলার চেষ্টা থামালো না। নিশীর অস্থিরতা দেখে সশব্দে হাসলো সে। তারপর বললো,
“লাভ নেই ম্যাডাম। আমি একদম শক্ত দড়ি কিনেছি”
“নীরার সাড়া দিচ্ছ না কেনো! কি করেছেন ওর সাথে?”

নিশীর প্রশ্নকে উপেক্ষা করলো রফিক। সে মেঝেতেই নীরার পাশে বসলো। নীরাকে একনজর দেখলো সে। তারপর ধীর স্বরে বললো,
“বেঁচে আছে, তবে বেশিক্ষণ বেঁচে থাকবে না”………

চলবে

#ইতি_নিশীথিনী
#৪৬তম_পর্ব

“নীরার সাড়া দিচ্ছ না কেনো! কি করেছেন ওর সাথে?”

নিশীর প্রশ্নকে উপেক্ষা করলো রফিক। সে মেঝেতেই নীরার পাশে বসলো। নীরাকে একনজর দেখলো সে। তারপর ধীর স্বরে বললো,
“বেঁচে আছে, তবে বেশিক্ষণ বেঁচে থাকবে না”

কথাটা শুনতেই নিশীর মুখশ্রী রক্তশূন্য হয়ে গেলো। তার চোখজোড়া বিস্ফারিত হয়ে। বুক কেঁপে উঠলো অজানা ভয়ে। শিরদাঁড়া বেয়ে যেনো রক্তের স্রোত নেমে গেলো। নিশী ভয়ার্ত কন্ঠে বললো,
“কিন্তু ও আপনার কি ক্ষতি করেছে? একটা বাচ্চা মেয়ের সাথে কি শত্রুতা আপনার?”
“শত্রুতা নেই? বাহ রে! আমার এতোদিনের সাজানো নাটকে পানি ঢেলে দিলো আর বলছেন ওর সাথে শত্রুতা নেই? আমার কৃতকাজের একমাত্র সাক্ষী সে! আমি আবার কখনো ফাঁকফোকর রাখি না জানেন তো! পুরোনো ভুল থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা। তাহলে জ্যান্ত সাক্ষী রাখি করে! আজ এই পিদ্দি মেয়ের জন্য আমার ফাঁ*সিতে ঝোলার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বুঝলাম না এই মেয়েটা সেদিন ছিলো কোথায়! শুধু আমার থেকে লুকায় নি, সে এখন সাক্ষীও দিবে”

ফ্যাসফ্যাসে গলায় কথাগুলো বললো রফিক। তার চোখমুখে হিংস্রতা ফুটে উঠছে। ক্ষিপ্র প*শুর মতো লাগছে তাকে। হিংস্রতার সাথে এক অদ্ভুত পাগলামিও লক্ষ্য করলো নিশী। এতোদিনের গোছানো রফিক ছিলো তার ভনীতা, মেকি খোলস। আজ সেই খোলস ভেঙ্গে হিংস্র মানুষটি বেরিয়ে এসেছে। নিশী হাতের বাঁধন খোলার জন্য ছটফট করছে। তার ছটফটানি দেখে রফিক স্বশব্দে হাসলো। তার হাসি গায়ে কাটা ধরিয়ে দিলো নিশীর। রফিক হাসতে হাসতে বললো,
“আপনি আর স্যার এতো অস্থির কেনো ম্যাডাম? আমি আপনার বাঁধন খুলে দেবো। চিন্তা করবেন না, আমি আপনাকে মুক্তি দিবো। শুধু একটাই সমস্যা আমি যদি আপনাকে ছেড়ে দেই তাহলে সবাই জেনে যাবে আমি খু*নী। আমার পেছনে পুলিশ পড়বে। অবশ্য স্যারকে যতটা চিনি, সে আমাকে চিরুনি তল্লাশী করছেন। তাই চান্স নিবো না। প্রথমে এই হাফটিকিটকে ওর উপরে পাঠাই, তারপর আপনার জন্য ফুল টিকিট কাটবো।”
“প্লিজ নীরার কোনো ক্ষতি করবেন না। ও নিরীহ, ও কোনো সাক্ষী দিবে না। আরে ও তো কথাই বলতে পারে না৷ আর যদি কথা বলতেও পারে তাহলে কোর্ট ওর সাক্ষী ই নিবে না। ও স্পেশাল চাইল্ড। প্লিজ ওকে ছেঁড়ে দিন। ও কিছুই দেখে নি। কিছুই জানে না। প্লিজ ওকে ছেড়ে দিন”

নিশী অধৈর্য্য হয়ে উঠলো। রফিকের কাছ থেকে নীরাকে বাঁচানোটা এখন বেশি জরুরি। রফিক নিশীর কথাটা বিশ্বাস করলো কি না বোঝা গেলো না। কিন্তু তাকে এলোমেলো ঠেকলো। তার সুসজ্জিত চিন্তাধারাগুলো যেনো হুট করেই বিক্ষিপ্ত হয়ে গেলো। বিভ্রান্ত হয়ে বললো,
“কিন্তু স্যার যে বললো! উনি আমাকে মিথ্যে বললো! এই সব চাল ছিলো। আমাকে ফাঁদে ফেলানোর চাল! আর আমি বোকার মতো সেই চালে পা দিলাম। আমার এতোদিনের সাজানো মহল নিজ হাতেই গুড়িয়ে দিলাম। কত কি করলাম! কত কিছু করে আমার পরিচয় গোপন করলাম! দেশে আসার আগে নিজেকে সম্পূর্ণ পরিচয় দিলাম। মির্জা হাফিজ হলো রফিকুল ইসলাম। নকল সার্টিফিকেট, নকল ভোটার আইডি, নকল পাসপোর্ট। পুরো প্লাস্টিক সার্জারি করলাম যেনো বায়োমেট্রিক টেস্টেও আমি ধরা না পরি। চোখের লেন্স অবধি পাল্টেছি। তাই তো কেউ জানতেই পারলো না আমি ই মির্জা হাফিজ। কারণ মির্জা হাফিজ তো দেশেই ফিরে নি। আমার অস্তিত্বই নষ্ট করে দিলাম। তাই তো নুশরাতের খু*ন করেও আমি মুক্ত পাখির মতো ঘুরছি। নুশরাতের খুনটা করতাম না। কিন্তু ওর জন্য আমার বাবাকে ফাঁ*সিতে ঝুলতে হলো। অবশ্য বাবার প্রতি খুব একটা স্নেহ আমার ছিলো না। আমার রাগ হলো ওর জন্য আমি সব হারিয়েছি, আমার বিত্ত, আমার ক্ষমতা। কোর্ট বাবার সব ব্যাবসায় সিল দিয়ে দিয়েছিলো। আমার টাকা, আমার বাড়ি সব নিয়ে নিয়েছিলো। তাই তো ওই মহিলাকে উপরে পাঠালাম। ও ম*রেও শান্তি দিলো না। এই প্রণয়টা হাত ধুয়ে পেছনে পড়েছিলো। তাই তো ওর আন্ডারে জুনিয়র হিসেবে ঢুকলাম। বাহিরে যেয়ে ল নিয়ে পড়েছিলাম। আমার সিভি দেখে প্রণয় ব্যাটাও খুশি। ও আমাকে যেনো চিনতে না পারে সেজন্য আমার আঙ্গুলেও সার্জারি করলাম। এই, এই যে আঙ্গুলটা দেখছেন এটায় রড দেওয়া। এটা বাঁকায় না। অথচ সব নষ্ট হয়ে গেলো। সব। আমি নিজেই সব নষ্ট করলাম। ও তো ঢোপ মারছিলো। আমি সত্যি মেনে নিলাম।”

কথা বলতে বলতেই উঠে জোরে লাথি মারলো নিশীর চেয়ারে। চেয়ার উলটে পড়লো। ফলে কাঁধে প্রচন্ড আঘাত পেলো নিশী। ব্যাথায় নীল হয়ে উঠলো তার মুখ। কিন্তু এতে ভ্রুক্ষেপ হলো না রফিকের। তার চোখজোড়া রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। নিশীর চুল টেনে ধরলো সে। ব্যাথায় কুঁকিয়ে উঠলো নিশী। অপ্রকৃতস্থ মানুষের মতো বললো,
“তোর নাগড় আমার সাথে এতো বড় ছলনা করলো। আর আমি ভাবলাম সত্যি ওর কাছে সাক্ষী আছে। কি বোকা আমি! কি বোকা আমি! ওর পাতা ফাঁদে পা দিলাম। ছাড়বো না। কাউকে ছাড়বো না। ও যেমন করেছে ওর সেই শাস্তি পেতে হবে। সেই শাস্তি তুই পাবি। বল তো কয় টু*ক*রো করা যায় তোকে! কয় টু*ক*রো করে প্রণয়ের কাছে তোর লা*শ গেলে ওর আহত মুখটা দেখতে পাবো! তোকে কিভাবে মারলে আমার বুকটা শান্ত হবে!”

নিশী কিছুই বলতে পারলো না। তার মনে হলো সে কোনো মানুষকে দেখছে না। এক বদ্ধ উ**ন্মাদ কে দেখছে সে। রফিক গলা টিপে ধরলো নিশীর। নিশীর দ*ম আটকে আসলো। রফিকের হাতের জোরের সাথে পেরে উঠলো না সে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। দৃষ্টি ক্ষীণ হতে লাগলো। ঝাপসা হয়ে গেলো নোনা জলে। নিশীর মনে হলো এই ক্ষণটি ই তার শেষ। আর হয়তো ফিরা হবে না। আর হয়তো প্রণয়ের দেখা পাবে না সে। আর নীরাকে জড়িয়ে ধরা হবে না। সংসার বাঁধার স্বপ্নটা স্বপ্ন ই রয়ে গেলো। প্রণয়কে “ভালোবাসি” কথাটা বলা হয়ে উঠলো না। মানুষটার ভালোবাসা উপভোগ করা হলো না। নিশীর চোখ উল্টে গেলো। ছটফটানি কমতে লাগলো। তখন ই একটা গু*লির আওয়াজ পাওয়া গেলো। গু*লিটি এসে লাগলো ঠিক রফিকের কপাল বরাবর। র*ক্ত ছিটকে পড়লো নিশীর মুখে। লুটিয়ে পড়লো রফিকের নিথর শরীর। নিশীর মনে হলো কেউ তাকে ডাকছে,
“নিশীথিনী, আমি চলে এসেছি। নিশীথিনী”

কিন্তু উত্তর দেওয়া হলো না। ঝাপসা নয়ন জোড়া ডুবে গেলো ঘোর অন্ধকারে।

******

সাদা দেওয়াল, সাদা সিলিং। ফ্যানটা ক্ষীন গতিতে ঘুরছে। এসি ছাড়া বারন। কারণ সারাদিন ভাদ্রের ঝিমুনি বৃষ্টি। সূর্যের তেজ নেই। বিকেল হয়েছে না সন্ধ্যে বোঝার উপায় নেই। থাই গ্লাসে লেপ্টে আছে বিন্দু বিন্দু শীতল বারিকণা। নিশীর ঠান্ডা লাগছে। কাঁথাটা টেনে দিলে ভালো হতো। চোখ বুজেও কপাল খিঁচে রইলো সে। বা হাতে চিনচিনে ব্যাথা, গলায় ও ব্যাথা। কাঁধটা নাড়ানো যাচ্ছে না। কেউ যদি একটু কাঁথা টেনে দিতো। তখন ই মনে হলো কেউ বুঝি কাঁথা টেনে দিয়েছে। অনেক কষ্টে চোখ মেলে তাকালো সে। চোখ মেলতেই একটা স্নিগ্ধ হাসি দেখতে পেলো। নমনীয় কন্ঠে বললো,
“কেমন লাগছে এখন?”

নিশী অপলক নয়নে তাকিয়ে দেখলো প্রণয়কে। লোকটিকে এলোমেলো লাগছে। চোখের নিচে পড়েছে বিশ্রী কালো দাগ। চোখজোড়া ক্লান্ত লাগছে, মুখখানাও শুষ্ক। ম*রার পর কি প্রিয় মানুষটিকে দেখা যায়। হয়তো দেখা যায়। সে হয়তো কবরেই স্বপ্ন দেখছে। প্রণয় আবার শুধালো,
“কষ্ট হচ্ছে?”
“আমি কি বেঁচে আছি?”
“আমি যেহেতু স্বাভাবিক আছি তার মানে বেঁচে আছো। ম*রে গেলে এই প্রণয় পাগল হয়ে যেতো”

প্রণয়ের কন্ঠে বিষাদের ছাপ ছিলো। সেই সাথে এক অজানা ভয়ের রেশ। নিশীর সময় লাগলো। ধীরে ধীরে মনে পড়লো গত রাতের ঘটনা। গতরাতে সে মৃত্যুর দেখা পেয়েছিলো। তার মনে হচ্ছিলো সেই ক্ষণটি অন্তিম ক্ষণ। হঠাৎ করেই মনে পড়লো, নীরার কথা। অধৈর্য হয়ে বললো,
“নীরা কোথায়?”
“ও পাশের কেবিনে আছে। ভালো আছে। অনেক ভয় পেয়েছে সে। আসলে ছোট একটা মানুষ”
“আমি ওকে দেখবো”
“এখন ঘুমোচ্ছে। উঠুক, নিয়ে যাবো”

নিশী আর বায়না করলো না। কিছু একটা ভেবে বললো,
“রফিকের কি অবস্থা?”
“মা*রা গেছে, ক্রস ফায়ার।”
“আপনি আমাদের খুঁজলেন কি করে?”
“আশ্চর্যের ব্যাপার জানো তো। আমি তো ভেবেছিলাম আমি বা পুলিশ তোমাকে খুঁজেই পাবো না। পরে জসীম সাহেব এগিয়ে এলেন। উনার জন্যই তোমাকে খুঁজে পেলাম……..

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি