ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব-১৭+১৮+১৯

0
268

#ইলেকট্রিক্যাল_মন
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–17

একটু আগেও তো সব’টা ঠিক ছিলো! মনে হচ্ছিলো স্বপ্নের শুভ্র স্নিগ্ধ ভেলায় ভাসছে। আবেশে লাগছিলো যেনো অন্য পৃথিবীতে বিরাজ করছে। হুট করে কী হলো? আয়না টাল সামলাতে না পেরে বিছানায় বেশ খানিকটা নুইয়ে পরে। দুইহাত দিয়ে পড়ে যাওয়া থেকে সামলায় নিজেকে। চোখ ফেটে দু’ফোটা অশ্রুমালা বর্ষন হলো। এরপর একাধারে চক্ষু জুড়ে আশ্রুপাত শুরু হয়। নিজেকে কেমন খুব ঠুনকো মনে হচ্ছে৷ কেমন যেন খুব ছোট, ক্ষুদ্র মনে হচ্ছে যার কারো কাছেই কোনো মূল্য নেই। একদম মূল্যহীন যেন! আসলেই কি সে এতোটা ঠুনকো?

আয়না আর কিছু বলতে পারেনা। কেমন নিশ্চুপ হয়ে যায়। ওনার ওই আদুরে নীলচে চোখে আয়না কোথাও নিজের জন্য ভালোবাসা খুঁজে পায় না। একটু আগেও দু’নয়নে কেবল মুগ্ধতা ছিলো এখন শুধুমাত্র ক্রোধ বিরাজমান! রুমের পিনপতন নীরবতা মনের ভেতরকার অনুভূতিগুলোকে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। এখন কিছু বলা মানেই সমুদ্রের রাগ আরো বাড়ানো, সে আর অপমানিত হতে চায় না। বিনা কোন অভিযোগে রুম ত্যাগ করে আয়না।

আয়না ড্রয়িংরুম অব্দি এসে কেমন টলতে থাকে। রুমে কেউ নেই। সব লাইট বন্ধ করে ডাইনিংরুমে কেবল একটা অল্প পাওয়ারের হলুদ বাতি জ্বলছে। আবছা আলোয় কেমন মাথা ঘুরিয়ে উঠলো৷ আয়না বাথরুমের দিকে এগুলো। তার এখুনি এই মুহূর্তে বাসায় যেতে মন চাচ্ছে। এক সেকেন্ডও এই বাসায় থাকতে ইচ্ছা হচ্ছে সে। অনেক কান্না পাচ্ছে তার। পানির কল ছেড়ে দিয়ে সে অনেকক্ষণ কান্না করে একা একা। চোখে পানির ছিঁটা দিতেই চোখ ভীষণ রকম জ্বালা করে। চোখের পানি আর কলের পানি মিশে একাকার হয়ে গেলো। এতো কাঁদার পরও তার চোখ দিয়ে অবিরতিহীন ভাবে পানি বর্ষিত হচ্ছে। আজ কেন যেন জীবনের সমীকরণের হিসাবের রাফখাতায় সবটা গড়মিল হয়ে গেলো। কোনোভাবেই সমীকরণ মিললো না। দুঃখ-বেদনার ত্রিঘাত সমীকরণ মিলানো যেন বড্ড কঠিন! তার নিজস্ব সুখময় ইচ্ছার চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে এতো বড় পার্থক্য কীভাবে হলো? আয়না আস্তেধীরে ড্রয়িং রুমে এসে বসলো। কালকে অব্দি তো সবটা ঠিক ছিল! আজ একদিনের ব্যবধানে সে জীবনের রাশিমালা থেকে অনেককিছুই হারিয়ে ফেললো। সমুদ্রের জন্য তৈরি হওয়া খুব সুন্দর অনুভূতি গুলো কেমন গুমোট বিশ্রী অনুভূতিতে পরিনত হলো! সবকিছু বিষাদময় লাগছে তার।

বাবাও নিশ্চয়ই আর আগের মতো থাকবে না। নিজের দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। ফের নতুন করে জীবন আগাবেন। অপরদিকে সমুদ্রের দেওয়া আঘাতভরা অপমান — দুইটা পরপর তীরের তীক্ষ্ম আঘাতে তার হৃদয় যেন ফালা ফালা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু চিৎকার করতে পারছে না। আত্মচিৎকার গুলো বোবা হয়ে বুকে চাপ দিচ্ছে। মনে হচ্ছে হার্টফেল হয়ে যাবে এতো ব্যথা।

আয়না দু’হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে। ভীষণ মাথাব্যথা করছে । এতো এতো বিশ্রী অনুভূতির সঙ্গে যুদ্ধে বরাবরই হেরে কুপোকাত। আর একদম সহ্য হচ্ছে না তার। মনের ভেতরকার গুমোট শীতল বিষাদময় অনুভূতিগুলোর কাছে সে আজ পরাজিত। মুখে কোনো কথা নেই যেন৷ সবটা মন আর নিজের একাকীর মধ্যে চলমান। ঘড়ির কাঁটা পাল্লা দিয়ে চলছে৷ কতোক্ষণ পাড় হয়ে যায় জানা নেই। সে সোফাতেই চিত হয়ে ঘুমে ঢুলে পড়ে। আয়না কাঁদতে পারে না। কান্না-কাটি করলেই ভীষণ শরীর দুর্বল লাগে, মাথাব্যথা করে। শ্বাস কষ্টের মতো কষ্ট হয়! দুর্বল হয়ে পড়ায় ভীষণ ঘুম পায় তার। চোখ বুঁজে আসে। আচমকা কারো হাতের শীতল স্পর্শ টের পেতেই আয়না নড়েচড়ে উঠলো। চকিতে উঠে সোফায় উঠে বসতেই পরিস্থিতি সম্পর্কে খেয়াল হলো। আয়না সামনের দিকে তাকাতেই দেখলো সমুদ্র দাঁড়িয়ে আছে৷ ওনার দিকে তাকাতেই কিছুক্ষণ আগের ঘটা বেদনাদায়ক দুর্ঘটনার কথা মনে পড়লো। ওটা দুর্ঘটনা নয় একদম! দুঃস্বপ্ন ও নাহ। কেবল ভাগ্যের নির্মম পরিনতি! আয়নার ফের চোখ ফেটে কান্না আসে। সমুদ্র সঙ্গে সঙ্গে ওর দু’গালে হাত রেখে চোখের পানি মুছে দিয়ে খুব আস্তে করে বলে, ” আয়না রুমে আসো। তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।”

–” অপেক্ষা তাও আবার আমার জন্য? হাসালেন! একটু আগেই তো নিজ থেকে বের করে দিলেন এখন আবার অপেক্ষা করছেন কেন?”

সমুদ্র মনে হয় অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। কি বলবে না বলবে ভেবে পায় না। এরপর হাটু গেঁড়ে বসে বললো, ” এভাবে রিয়্যাক্ট আমি করতে চাই নি। বাট নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারিনি।”

–” কি এমন করলাম যে আপনি আমার সাথে এতো রুড হলেন?”

–” তুমি কিছু করো নি। সব দোষ আমার।”

–” আমি বিচার চাচ্ছি না আপনার কাছ থেকে।”

সমুদ্র ফোঁস করে দম ফেলে বলে, ” অনেক বেশি কষ্ট পেয়েছো? এতো কান্নাকাটি কেন করলে? চোখের নিচটা তো ফুলে লাল আলু বনে গেছে। রুমে আসো। ঘুমাবে।”

আয়নার যেন ভীষণ রাগ লাগলো। সে একটু জোরে বলে উঠে, ” আপনি যান এখান থেকে।”

সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্র তার মুখে হাত আলতো করে চেপে ধরে বলে, ” আস্তে! আওয়াজ করে আংকেল-আন্টিকে ঘুম থেকে তুলে আনতে চাইছো? প্লিজ সিনক্রিয়েট করো না।”

আয়না নির্লিপ্ত থাকলো। সমুদ্র বলে, ” রুমে আসো প্লিজ। রাত কয়টা বাজে খেয়াল আছে?”

–” আপনার রুমে আপনি-ই যান। আমাকে ডাকছেন কেন?”

সমুদ্র আশেপাশে তাকালো একবার, এরপর হুট করে আয়নাকে পাঁজাকোলে তুলে নিলো।

আয়না বলে উঠে, ” নামান আমাকে। এসব কোন ধরনের ফাজলামো সমুদ্র? ”

–” ফাজলামো তো তুমি-ও করছো! ”

আয়না নড়াচড়া শুরু করে বলে, ” ছাড়েন আমাকে নাহলে কিন্তু ভালো হবে না।”

সমুদ্রের যেন কি হলো, সে একদম গম্ভীরমুখে বললো, ” আয়না প্লিজ! আই রিকুয়েস্ট টু ইউ, আর কোনো ঝামেলা করো না। রুমে চলো। নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যাপার নিজেরা মিটাই। অন্যকে দেখিয়ে ঝামেলা না করি?”

এরপর একটু নর্মাল লো-ভয়েজে বলে, ” তাছাড়া এতো নড়াচড়া করলে দেখা যাবে আমার কোল থেকে পড়ে যাবে ফ্লোরে। এমনি এতো ভারী তুমি। দেখে মনে হয় কাগজের মতো পাতলা! একবার নিচে পড়লে কোমড় ভেঙে গেলে আমার সাথেই বিছানায় দিন-রাত শু’য়ে থাকা লাগবে।”

আয়না কিছু বলে না। এবারো নির্লিপ্ত থাকে৷ সমুদ্র রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলে,” অভিমান নামক পাখিটাকে খাঁচাবন্দী করে রাখতে হয়। অভিমান বড্ড খারাপ। সম্পর্ক নষ্ট করে দেয়।”

–” অভিমান হচ্ছে না বরং আপনার ব্যবহারের জন্য আপনা-আপনি আপনার থেকে মন উঠে যাচ্ছে। ”

আয়নাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে সে দরজা একদম লক করে দিলো। আয়না ফের উঠে যেতে চাইলে সমুদ্র তাকে আটকে ফেলে, এরপর কাছে এসে বললো, অযথাই যুদ্ধ-যুদ্ধ কেন আমাদের মধ্যে?”

–” সেটা আপনি জানেন। সবকিছু আপনার মর্জি মতো চলে৷ আমাকে তো নিজের হাতের কাঠের পুতুল ভাবছেন। যখন যা খুশি করবেন, যা মন চায় করবেন। আমাকে সব মেনে নিয়ে চলতে হবে।”

–” এতো কথা বলো তুমি!”

–” আপনার যা ইচ্ছা তাই করবেন আর আমাকে চুপচাপ সব মেনে নিতে হবে?”

–” সেটা কখন বললাম?”

আয়না সরে এসে সমুদ্রের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে বললো, ” বিয়ে করেছেন। কিনে নেননি যে যা ইচ্ছা করবে সেটাই করবেন।”

–” আয়না এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি করছো। বললাম তো ওভাবে ওভার-রিয়্যাক্ট করা আমার ঠিক হয়নি। আসলে ওই নামে ডাকা আমার পছন্দ না।”

–” পছন্দ কী আমাকেও না? আপনি কী আদৌ ভালোবাসেন আমাকে? নাকি আপনার মনে অন্যকেউ আছে? ”

আয়নার খুব সহজ একটা প্রশ্ন ছিলো ওর কাছে৷ কিন্তু এতেই যেন সমুদ্র হাসফাস করে। খামোশ থাকে দু’দণ্ড। জবাব হীন হয়ে পড়ে৷ কোনো ভাবে কী আয়নার মনে তার উপর সন্দেহ হানা দিয়েছে?

সে নিজেকে ধাতস্থ করে বলে, ” দু’লাইন বেশি বুঝো? একবারও এ’কথা বলেছি যে তোমাকে অপছন্দ করি? লিসেন আয়না আমি এসব ভালোবাসায় বিশ্বাস করি না৷ লাভ ইজ লাইক মিথ টু মি। ভালোবাসা নিয়ে আমার চিন্তাভাবনা অন্যরকম। আমার কাছে এখন দায়িত্ব মানেই ভালোবাসা। এর বাইরে এক্সট্রা কোনো ডেফিনিশন নাই। তোমার সব ধরনের চাহিদা মেটানো আমার জন্য অত্যাবশকীয়। এখন স্বামীর দায়িত্বকে যদি ভালোবাসা মানতে চাও, সেটার তোমার উপর ডিপেন্ডেবল।”

এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে সে এরপর আয়নার দিকে তাকায়। ওর চোখ-মুখ এখনো ফুলে আছে। চোখ ভেজা।

সে আরোও বলে, ” প্লিজ কেঁদো না। এজ এ হাসবেন্ড আমি চাই না আমার ওয়াইফ কষ্ট পাক, রাতভর কাঁদুক।”

আয়না তার কথা কিঞ্চিৎ নড়ে উঠে। সম্পর্কের জটিলতা এতো তীব্র বেদনাদায়ক কেন? তার এই মুহূর্তে সবকিছুই অসহ্য লাগছে। সে চোখ ঘুরিয়ে নেয়৷

–” এই তুমি চাইলে আমাকে ওশেন বলে ডাকো। সমুদ্র নামটা কঠিন লাগলে দরকার হলে খাল-বিল ডাকো। বাট নামের ময়নাতদন্ত করো নাহ। ”

সমুদ্র রসিকতা করে পরিবেশ হাল্কা করতে চাইলো কিন্তু লাভ হলো না৷ আয়নার যেন প্রতিক্রিয়া নেই কোনো। বেশি-ই হার্ট হয়েছে কী?

আয়না সুধালো, ” কোনো নামেই আর ডাকবো না।”

–” তোমার রাগ-ক্ষোভ দেখি আমার চেয়েও বেশি। ”

আয়না বেড থেকে উঠে দাঁড়ালে সমুদ্র খপ করে ওর হাত ধরে ফেলে যেন ছেড়ে দিলেই পালিয়ে যাবে। আয়না হাত ছাড়ানোর জন্য জোড়াজুড়ি করলে সমুদ্র বলে উঠে, ” কি চাও?”

আয়না হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলে, ” আপনার থেকে দূরত্ব চাই।”

সমুদ্র কিয়ৎক্ষণ চুপ থাকলো। সে চিন্তাও করেনি আয়না এমন কিছু বলবে! বিয়ের সাতদিনের মাথায় এমন কিছু শুনতে হবে কল্পনাও করেনি। আচ্ছা সে দিনকে দিন রিলেশনশিপ ম্যানেজমেন্টে এতো বাজে হয়ে যাচ্ছে কেন? বাসায়ও আগের মতো কারো সাথে ভালো সম্পর্ক নেই। নতুন সম্পর্কটাতেও কেমন তালগোল পাকিয়ে দিলো! আগের সত্তা নিজের মধ্যে থাকলে এতোক্ষণে জোর করে হলেও কোলে তুলে কতোগুলো চু–মা খেয়ে প্রেমিকার রাগ ভাঙ্গাত। গান গেয়ে মন খারাপ দূর করে দিত! এখন আর ওসব পারে না। সবকিছুতে যান্ত্রিকতা এসে গেছে। আগের মতো মেন্টাল স্টিমিনা নাই নিজের মধ্যে! তবে জীবনের স্রোতের মাঝে পা যেহেতু ভাসিয়েছে, এখন গা ভিজলে তা সামলাতে হবেই।

সে বলে, ” তাহলে কি ধরে নিব সম্পর্ক শেষ করে দিতে চাচ্ছো?”

সম্পর্ক শেষ শব্দ দুটি আয়নার কানে বাজলো খুব জোরে। বাহ কি সহজ উনার জন্য সবকিছু! এতো অবলীলায় বলে দিলো সম্পর্ক শেষ করবে কীনা৷ আয়না চোখ বেয়ে দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে৷ সত্য বলতে আয়না ভীষণ আবেগী। ওর মনে কোনো কালো কিছু নেই৷ কখনোই কারো জন্য অশনি কিছু কামনা করি নি। নরম মনের হওয়ায় হয়তো সমুদ্র ওকে নাজুক ভাবে!

সমুদ্র তৎক্ষনাৎ ওর সামনে এসে গাল দু’টোয় আলতো করে হাত রেখে বললো, ” আমি চাই আমাদের সম্পর্ক অনেক দূর গড়াক।”

এরপর আয়নার ডান গালে নিজের ঠোঁট ছু’য়ালো। ওর চোখের পানি যেন চু–ষে নেয় সে। আয়না ফের সরে আসে। সমুদ্র ভ্রু কুচকে তাকায়। এরপর ইচ্ছাকৃতভাবে প্রসঙ্গ পাল্টাতে উদগ্রীব হয় সে। বলে উঠে, ” তোমার ডিহাইড্রেশন হয়ে যাবে। পানি খাও৷ এতো চোখের পানি ফেলেছো। প্রেশার ফল করবে৷”

আয়না দ্রুত বেগে আক্রমনাত্মক স্বরে বললো, ” সাপ হয়ে কামড়াবেন আর ওঝা হয়ে ঝাড়বেন?”

সমুদ্র এবারে ওকে টেনে এনে বেডে ফেলে দিয়ে নিজে ওর উপর এসে ঝুকে শু’লো৷

তারপর বললো, ” আমি মোটেও ওঝা না। সাপ না। ডাক্তার আমি।”

আয়না মুখ ঘুরিয়ে নিলো যেন সে একদম সমুদ্রকে দেখতে চায় না। এতে সমুদ্র ভীষণ রকম পীড়া অনুভব করে। সেই থেকে চায়না, না ঠিকমতো কথা বলছে, না প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে, এমনকি তাকাচ্ছেও না। এতোটাও অবহেলা করা ঠিক না। মানুষের অবহেলা পেতে আর ভালো লাগে না। আয়না তার থেকে সরে এসে বেডের মাঝে বালিশ দিয়ে দিলো। এরপর ও’পাশ ঘুরে শু’য়ে পড়ে। সমুদ্র বুঝে পায় না কি করা উচিত? এতোবেশি টানাহেঁচড়া করলে সম্পর্কের বাঁধন না ছিঁড়ে যায়। নিজের ইগো একপাশে রেখে সিন্ধান্ত নিলো সর‍্যি বলবে। সর‍্যি শব্দটা সে একদম মুখে আনে না। কিন্তু আজ ব্যতিক্রম।

সে বলে উঠে, ” এই ঘুমিয়ে পড়েছো?”

আয়না ও’পাশ ঘুরেই জবাব দেয়, ” হ্যাঁ। ”

–” বাহ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কথা বলো তুমি!”

এরপর বিছানার মাঝে রাখা কুশন দুটো হাত দিয়ে টেনে ফ্লোরে ফেলে দিয়ে আয়নার নিকটে অবস্থান করে বলে, ” সর‍্যি আয়না।”

আয়না কোনো প্রতিক্রিয়া এবারো দেখালো না। হতাশ হয় সমুদ্র। এটাই লাস্ট অপশন ছিলো। এরপর কি করবে সে? জানা নাই। ভেবেছিলো ইন্টি–মেসি পর্যায়ে মাধ্যমে হয়তো শেষ ধাপে পৌঁছে যাবে কিন্তু এখনো মনে হচ্ছে আরো অনেক কিছু দেখা বাকি।

সে আয়নার পাশ ঘেঁষে শু’য়ে চুলে হাত দিতেই আয়না একদম ওদিকে ঠেসে গিয়ে বললো, ” কাল ভার্সিটি আছে। ঘুমাবো আমি।”

–” এতো সুদর্শন ইয়ং হাসবেন্ড রেখে তুমি ওই দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকবে?”

আয়না জবাব দেয় না। মনে হয় ঘুমানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। ওর ঘুম প্রয়োজন। সমুদ্র সব বুঝে কিন্তু ঐ অনুযায়ী মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কার্য সাধনা করতে ব্যর্থ হয় সে বারেবারে।

সে বলে, ” আচ্ছা তোমায় আমি দূরত্ব উপহার দিলাম। আশা রাখি, আমাদের মধ্যকার দূরত্ব সম্পর্কটা ধ্বংস করবে না, যেহেতু দূরত্ব ঋনাত্মক নাহ।”

সে নিজেও সরে এসে শু’য়ে পড়ে অপরদিক ঘুরে। আসলে কাছাকাছি হওয়া মানেই কাছাকাছি থাকা না। এইতো একহাত দূরত্বে অবস্থান করেও তারা কতোটা দূরের মানুষ! তাদের মধ্যবর্তী দূরত্ব হিসেব করলে ক্যালকুলেটরে ম্যাথ ইরর আসবে। হিসেবের খাতিরে আলোকবর্ষ একক ব্যবহার করা লাগবে৷ এতোটা দূরত্ব ৷ মুহুর্তের মধ্যে দু’ হৃদয়ের মাঝে কয়েক আলোকবর্ষ পরিমাণ দূরত্ব দু’জনকেই বড্ড পীড়া দেয়।

___________________

তখন কেবল সকাল। সাতটাও বাজে নি। আয়না রুম ছেড়ে বেরিয়ে আসতেই দেখে ফাহাদ সাহেব আর শায়লা চৌধুরী নাস্তার টেবিলে বসে আছেন। চা খাচ্ছেন। আয়নার ভঙ্গুর হৃদয় যেন আরোও ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়। সে কারো দিকে না তাকিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে ধরলে শায়লা চৌধুরী জিজ্ঞেস করে, ” আয়ু এতো সকালে কই যাচ্ছো?”

ফাহাদ সাহেব ও মেয়ের দিকে তাকায়। আয়না জবাবে বলে, ” বাসায় যাচ্ছি।”

–” সেকি কথা! এতো সকালে কেন যাচ্ছো? কই কিছুই তো বললে না আগে? সমুদ্র কোথায়?”

আয়না কেবল উত্তর দেয়, ” উনি ঘুমায়। আমি একাই যাব এখন।”

শায়লা চৌধুরী বলে, ” কেন? আমাদের কিছুই বললে না?”

এতেই আয়না চটে যায়। সে বলে উঠে, ” আপনাদের পারমিশন নিতে হবে এখন? আপনি কে আমাকে জিজ্ঞেস করার?”

–” তা মিন করিনি।”

শায়লা যতোটা শান্ত থাকলো, ওতোটা শান্ত ফাহাদ সাহেব থাকলেন না। তিনি বলেন, ” আয়ু এটা কেমন ব্যবহার? ”

ওনার কথায় রাগের আভাস পাওয়া যায়। আয়না কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে আসে৷ বাবার প্রশ্নেরও উত্তর দেয় না৷

ফাহাদ সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ” আয়না থামো৷ আমি তোমাকে যেতে বলেছি?”

কতোদিন পর বাবা আয়নাকে এভাবে থমক দিলো তাও আয়না বলে ডেকে! শায়লা চৌধুরীর সামনে এমন আচারণে সে আরোও মনে মনে ক্ষুব্ধ হয়৷

শায়লা চৌধুরী ফাহাদ সাহেব কে ঠাণ্ডা হতে বললেন। এরপর আয়নাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” তোমার বাবার গাড়ি নিয়ে যাও।”

আয়না আর কোনো কথা না বলে কেটে পড়ে। ফাহাদ সাহেব ভ্রু কুচকে তাকালেন মেয়ের যাওয়ার পানে। আয়না এতো এমন না। বরং খুব শান্ত স্বভাবের।

শায়লা চৌধুরী বলে, ” ও হয়তো আমাদের বিয়ের খবর পেয়ে কিছুটা ট্রমায় আছে। এজন্য বাসায় যেতে চাচ্ছে। তোমার ওকে বকা দেওয়া ঠিক হলো না। বুঝতে হবে ওর মানসিক অবস্থা।”

ফাহাদ সাহেব থম মেরে বসলেন। মেয়ে কি কষ্ট পেলো নাকি?

চলবে।

#ইলেকট্রিক্যাল_মন
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–18

সমুদ্রের যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন আটটা তের বাজে। সে চোখ মেলে তাকাতেই দেখলো পর্দা ভেদ করে সুন্দর মিষ্টি রোদ গায়ে লাগছে। পাখির আওয়াজ কানে আসে। তবে প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে সকালটা সুন্দর হলেও তার জীবনটা এতোখানি সুন্দর নেই বোধহয়। বিছানার বাকি অংশ সম্পূর্ণ ফাঁকা। তার মনে কেমন খটকা লাগলো যেনো! আয়না কোথায় গেলো? চলে গেছে কী? সে উঠে বসে চোখ কচলায়। গতকাল ও প্রায় শেষ রাতে ঘুমিয়েছে৷ এলার্ম দেইনি জন্য জাগনা পায়নি। সারা রুম একনজরে চোখ বুলিয়ে নিয়ে, রুম ছাড়লো সে। একত’লা সুন্দর পরিপাটি বাসাটায় আজ কেমন যেন অস্থির লাগে সমুদ্রের। গতরাতের প্রতিটা ঘটনার স্মৃতিবিশেষ মস্তিষ্কে এসে জমা হলো। সে শায়লা চৌধুরীকে খুঁজতে থাকে৷ ওমনি সময় তিনি রুম থেকে বেরিয়ে এসে বলে, ” গুড মর্নিং সমুদ্র।”

সমুদ্র সরাসরি জিজ্ঞেস করলো, ” আন্টি আয়না কে দেখছেন? কোথায় ও?”

–” বাবা! ঘুম না ভাঙ্গতেই বউয়ের খোঁজ।”

সমুদ্র কিঞ্চিৎ দ্বিধাবোধ করলো। কী বলবে ওনাকে? পুনরায় বলে উঠে, ” কাল রাতে একটু ঝগড়া হয়েছিলো।”

শায়লা চৌধুরী বেশ বিস্মিত হলেন। উনি ভাবতেও পারছেন না সমুদ্র আয়নাকে নিয়ে এতো বিচলিত! ক’দিন আগেই না বলছিলো কাউকেই ভালোবাসবো না। কোনো মেয়ের প্রতিই এক্সট্রা কেয়ার নিতে পারবে না। আজ আবার ওকে নিয়ে এতো দরদ কেন?

সে চতুরতার সঙ্গে সুধাল, ” কি হয়েছে?”

সমুদ্র একবার ভাবে তাদের মধ্যকার বিষয়াদি শেয়ার করবে না। তবে শায়লা চৌধুরী একপ্রকার জোড় করলেন। পরবর্তীতে সমুদ্রের মনে হয় জানানো উচিত তাদের সম্পর্কের এমন বিশ্রী দূরত্বর কথা জানিয়ে দেখা যাক কোনো সমাধান পাওয়া যায় কীনা। তাছাড়া শায়লা আন্টি তো তার সবসময় সাহায্যই করেন৷

সে সরল মনে বেশ মার্যিতভাবে দু’জনের মনোমালিন্যর বিষয়গুলো জানালো। সমুদ্রকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে ও ভীষণ টেনশনে আছে। শায়লা সামান্য হাসলেন। দুই দুইয়ে চার মিলালেন। এরপর মুখ খুললেন৷

উনি বললেন, ” আয়ু এজন্য সকাল-সকাল ঢাকায় ব্যাক করল। ও আসলে তোমার সাথে থাকতে চাচ্ছে না।”

–” থাকতে চাচ্ছে না? এমন কিছু বলেছে?”

–” হুম। বললো তো।”

–” কি বলেছে ও?”

শায়লা চৌধুরী বেশ বিপাকে পড়লেন৷ কীভাবে সমুদ্রের ব্রেইনওয়াশ করা যায় এটাই ভাবলেন৷ যেহেতু তিনি অনেক বুদ্ধিমতী কাজেই বুদ্ধি বের করে ফেললেন৷ মুখ টা কালো করে কিছুটা নাটকীয় ভঙ্গিমায় বলে, ” কথা তো ওর আব্বুর সঙ্গে বলছিলো। যা শুনলাম তাতেই মনে হলো, আয়ু এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আই মিন সেপারেশন কিনা সিউর না। আমি নিজেও বুঝছিলাম না কিছু।”

সমুদ্র যেন কেমন মিইয়ে যায়। কপালের ভাঁজ দৃঢ় হলো। ছোট একটা ঝগড়া থেকে সোজাসাপটা বাবার সঙ্গে ডিসকাসন করে ফেললো যে সেপারেশন চাই ওর।গতরাতেও এ বিষয়ে নীরব থাকলো। আর সকালে উঠে আমাকে না জানিয়ে সিদ্ধান্ত তলব করে চলে গেলো। যাওয়ার আগে একবারও নিজের নেওয়া সিদ্ধান্ত তো আগে সমুদ্রকে জানাবে! আজব। তার ঘুম থেকে উঠার অপেক্ষাও করলো না তার আগেই এতো বড় সিদ্ধান্ত।

শায়লা আন্দাজে ঢিল মেরে বললো, ” সেপারেশন চাইছে কিনা ও এটা আমি সিউর না বাবা।”

সমুদ্র যেন মিইয়ে আসা কণ্ঠে বলে, ” সেপারেশন ই মনে হয়।”

–” হুম, তোমার সাথে কন্ট্রাক্ট ও করতে চায় না এমনটাই শুনলাম। ”

সমুদ্র চকিত উঠে বললো, ” এটাও বলে গেছে যেন আমি কল না দিই?”

–“তাই তো শুনলাম। আমি ভুলও হতে পারি। ”

সমুদ্র যেন ভীষণ আহত হয়। ঝড়ে পাখির পালক ভেঙে গেলে যেমন নড়বড়ে অবস্থা হয় ওমন দেখালো ওকে।

শায়লা চৌধুরী ওর কাঁধে হাত রেখে বললো, ” তুমি টেনশন নিও না৷ আমি আছি তো। দেখি আয়ুকে বুঝাই। এতো সহজ নাকি সবকিছু! ”

সমুদ্র কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললো, ” আমিও যাই। ভালো লাগছে না।”

–” আপসেট হও না বাবা৷ আন্টি আছেন না? সব ঠিক করে দিবো।”

সমুদ্র ভদ্রতার হাসি দিয়ে বলে, ” পরিস্থিতি ঠিক করে দিলেও ভাগ্য তো ঠিক করে দিতে পারবেন না। আমার মনে হয় বেটার হাফ ভাগ্য ভীষণ বাজে। যার সঙ্গে জড়াই সে-ই বিরক্ত হয়ে সরে যায়৷ ”

–” আয়না খুব ভালো একটা মেয়ে। সৎমেয়ে জন্য এমনটা বলছি না। মন থেকে বলছি।”

–” আপনি সত্যি খুব ভালো মনের মানুষ। এই প্রথম কোনো সৎমা কে দেখলাম নিজের স্টেপ মেয়ের গুনগান গাইতে।”

–” ও আমারই মেয়ে। তুমিও আমার ছেলের মতো। আপন মানুষ। আচ্ছা শুনো, আমাকে একটু জানাবে কি ভাবছো তুমি ভবিষ্যৎ নিয়ে। আগেই আয়নার সঙ্গে যোগাযোগ করো না৷ তোমার দশা আমার চেয়ে কে ভালো জানে? সো আমি বুঝিয়ে দিবো কোনটা সঠিক তোমাদের জন্য। নাস্তা খেয়ে তারপর যাও।”

শায়লা আন্টি অনেক সাধলেন কিন্তু সমুদ্রের কেন যেন খেতে মন চাচ্ছে না। সে দ্রুত বেরিয়ে পড়ে ঢাকার উদ্দেশ্য। বারবার ফোন চেক দিলো যদি আয়না কোনো ম্যাসেজ দেয়। কিন্তু না আয়নার নাম্বার থেকে কোনো কল বা ম্যাসেজ কিছু আসেনি। সে গাড়ি ড্রাইভ করার সময় একবার ভুলবশত সামনের গাড়িতে লাগিয়েও দিলো। সব কেমন গুমোট লাগছে৷ আয়না একচুয়ালি চাচ্ছে টা কী? সে তো দূরত্ব দিতেই চাইলো। বিষয়টা দু’জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখত। ফাহাদ সাহেবকে কেন বললো সেপারেশন চাই! হুয়াই ডিরেক সেপারেশন তাও বিয়ের এক সপ্তাহ পর-ই! কিছুদিন আরোও সময় নিতো! যাকগে, ও যা ভালো বুঝে তাই সই। সে একা একা তো এই বিয়ে চালিয়ে যেতে পারবে না।

_____________________

আয়না নিজের বাসায় ফিরে আসে সকাল সাড়ে ন’টার পর। রুমে এসেই শু’য়ে পড়ে৷ আলিয়া জেগেই ছিলো। আপার এমন করুণ দশা দেখে জিজ্ঞাসা করলো, ” কী হয়েছে আপা?”

আয়না জবাব দিতে পারে না৷ আলিয়া কে কী বলবে? ও ভীষণ কষ্ট পেতে পারে। তবুও সত্যটা জানা উচিত। দুইদিন বাদে পরের মুখে শোনার চেয়ে আজ আপনের মুখে শুনলে তা বেশি গ্রহণযোগ্য। কষ্ট পেলেও এখনই সবটা সামলে নিবে দু’বোন।

আয়না বলে উঠে, ” বাবা ঐ মহিলাকে বিয়ে করে নিয়েছে। তাও গোপনে আরোও কয়েকমাস আগেই। আমাদের না জানিয়েই।”

আলিয়া যেন আকাশ থেকে পড়ে, ক্ষণেই নিজেকে দ্রুত সামলানোর চেষ্টা করে। বিভিন্ন চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে তার৷ শায়লা চৌধুরীর সঙ্গে বাবার আরোও তিনবছর আগেই বিয়ে হতো যদি আপা ঝামেলা না করত৷ কিন্তু আপা আর সে মিলে বাবার সঙ্গে ঝগড়াঝাটি করে। তারপর অনেক কাহিনি। একসময় আপা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলো। এরপর বাবা মন পরিবর্তন করলেন। বিয়ের সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসেন৷ কিন্তু আলিয়া জানত বাবা সম্পর্কটাকে নাকচ করেননি। নিজের বাবাকে নিয়ে এসব বলতে বা ভাবতেও কেমন রাগ লাগে। গা জ্বালা দেয়৷ পূর্বাভাস পাওয়ার পরও সে মানতে পারেনা বাবার দ্বিতীয় বিবাহ। কোনো সন্তান ই চায় না সৎমা আসুক। এ’ ঘটনা যেন কিছুটা অভিশাপেরও অভিশাপ! যেন অভিশাপকেও কেউ অভিশাপ দিলো! কিন্তু তার কী বা করার আছে? বাবা কী আর তার কথামতো চলবে? বরং তাকেই বাবার আদেশ মেনে চলা লাগবে৷ বহু কষ্টে কান্না চাপিয়ে রাখে। নিজেকে শক্ত করে রাখার চেষ্টা চালায়। কিন্তু পারে না এক প্রকার ঠুকরে কেঁদে ফেলে।

সে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, ” শায়লা আন্টি কী এখানে এসে আমাদের সঙ্গে থাকবেন?”

এহেন প্রশ্নে আয়নার যেন গা জ্বালা দিয়ে উঠে৷ কোনোভাবেই এ’বাসায় ওনার উপস্থিত সহনীয় নয় তার কাছে। চোখ ফেটে কান্না আসে তার। আলিয়া ছোটবোন হওয়া সত্তেও তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, ” আপা তুমি তো দুইদিন বাদেই সমুদ্র ভাইয়ার সঙ্গে থাকবা। তোমার ওনার সাথে থাকতে হবে না।”

আয়না চোখ মুছে বলে, ” আলিয়া আমার খুব মাথাব্যথা করছে৷ আমি ঘুমাবো।”

–” আচ্ছা আমি যাই তাহলে। ”

আলিয়া রুম ছেড়ে বেরিয়ে এসে বারান্দায় বিরস মুখে বসে থাকে। ওর কিছু ই ভালো লাগে না। মন খারাপ কীনা তাও বুঝে না। সব ফাঁকা ফাঁকা লাগে। এই দিনটা আরোও তিনবছর আগেই দেখার ছিলো তবুও তিন বছর পর ঘটার পরও মানতে পারেনা। চোখে জল আসে। বাবার উপর রাগ লাগে। মনে হলো আব্বুর সঙ্গে আর কোনোদিন কথা-ই বলবে না। ক্ষণেই চমকে উঠে সে। এমন কথা আগে আপা বলত। আপা সাফ বলে দিয়েছিলো বাবা বিয়ে করলে ওনার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিবে। এইজন্য কী বাবা আপার এতো দ্রুত বিয়ে দিয়ে দিলো? তাদের ফ্যামিলিতে সবাই অর্নাস শেষ করেই বিয়ে করে। তার ফুপুই বিএ পাশ করে সেই যুগে বিয়ে করেছিলো। অথচ আপা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়েও, সেকেন্ড ইয়ারে বিয়ে দিয়ে দিলো বাবা৷ সেও যদি বিরোধিতা করে তাহলে ক’দিন বাদে তারও যদি বিয়ে ঠিক করে। মনের মধ্যে বেদনার চেয়ে ভয় বেশি কাজ করে। তার কেন যেন মনে হচ্ছে আপা ঝামেলা করত জন্য-ই আপাকে জলদি বিয়ে দিয়েছেন। এছাড়া কারণ সে দেখছে না কোনো। সে নিজের ক্ষেত্রে মোটেও এতো দ্রুত বিয়ে চায় না। তাহলে কী করবে? যতোদ্রুত সম্ভব শায়লাকে মেনে নিবে? এটাও তো ভীষণ কঠিন একটা কাজ।

সমুদ্র ফিরে এসেই মাকে জানালো আজ অফিস যাবে না। মিসেস রোদেলা ছেলের চেহারা দেখেই চমকে উঠে। একি হাল বানালো চেহারার। এমন চোখ-মুখ লাল করে রাখত যখন ইউশার সঙ্গে ওর ব্রেক আপ হয়। আজ এতোদিন পর এমন কী কষ্ট পেলো যে ওর চেহারায় আগের মতো যন্ত্রণা ফুটে উঠলো?

মিসেস রোদেলা বলে, ” কি হয়েছে বাবু?”

সমুদ্র মাকে একদম কোনো বাড়তি প্রেশার দিতে চায় না৷ এক জীবনে মা-বাবাকে কম দুঃখ দেয়নি। এখন চুপ থাকাই শ্রেয়।

সে বললো, “অসুস্থ লাগছে। কিছুক্ষণ ঘুমাবো। সেড়ে যাবে।”

সমুদ্র নিজের বিছানায় এসে গা এলিয়ে দিলো। কেমন শূন্য শূন্য লাগছে। সারাটা ক্ষণ কেবল মাথায় আয়নার কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে। আর কোনো চিন্তাই মস্তিষ্কে নেই। আচ্ছা আয়না না বললো ওইসময় ‘আই লাভ ইউ সমু।’ ভালোবাসি বলেও মাত্র একবার চলে যেতে বলায়, সে চলে গেলো? কই সমুদ্র তো যায়নি। তার প্রথম প্রেম যখন বলেছিলো ছেড়ে যাও। সে তো একবারে ছেড়ে যাই নি। তাহলে আয়না কেন এমন করলো?

তাহলে সে কী ধরে নেবে, মেয়েদের ভালোবাসা কিছুটা কচুপাতায় বৃষ্টির ফোঁটার মতো। দূর থেকে দেখতে কী অদ্ভুত সুন্দর কিন্তু একটু নাড়ালেই কেমন সহজভাবে গড়িয়ে চলে যায়।

অনেক চেষ্টা করেও সমুদ্রের ঘুম হলো না। সে উঠে বসে নীলা আর সায়নের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলার ডিসিশন নেয়৷ ওরা দু’জন ওকে অনেক ভালো বুঝে। এট লিস্ট আব্বু-আম্মুর চেয়ে ভালো বুঝে। ছোট্টবেলার বন্ধু তারা। যদিও বা সায়ন জার্মানি তে আছে৷ কিন্তু শত ব্যস্ততার পরও সমুদ্র আর নীলার কল ও ইগনোর করে না। তিন বন্ধু একসঙ্গে ভিডিও কলে আসে। নীলার মেয়ে হয়েছে। সবে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছে৷ তবু চোখ-মুখে আনন্দের ছাপ ক্লান্তি ছাপিয়ে দিচ্ছে।

ওরা সবাই কিছুক্ষণ গল্প করলো। এরপর সমুদ্র বলে, ” দোস্ত আমি তো বিরাট এক সমস্যায় পড়েছি।”

নীলা বলে, ” আবার কি করলি? এক জীবনে তোর নাটক দেখেই পাকিস্তানি ড্রামা বানানো যাবে৷”

সমুদ্র বিরক্তিতে ‘চ’ ধ্বনি প্রকাশ করে এরপর বলে, ” আয়নার সঙ্গে অনেক সমস্যা হচ্ছে। এডজাস্ট তো হলোই না। তার আগেই ও ডিভোর্স চায়।”

সায়ন বলে উঠে, ” কস কী ব্যাটা এতো দুর্যোগ পাড়ি দিয়ে বিয়ে করলি। ভাবী ভাগলো ক্যান? ইয়ার তোর মধ্যেই ঝামেলা আছে। দোস্ত ট্রিটমেন্ট নে লাগলে। এখন কতো চিকিৎসা বের হলো। তুই ডাক্তার হয়েও বিনা চিকিৎসায় সাফার করছিস।”

–” সায়ন তোরে আমি পি–টায় মে– ফেলবো। আজাইরা কথা বললে।”

–” ওই ব্যাটা বিয়ের সাতদিন পর এসব কইলে মানষে ওইসবই ভাববে৷ কই তুই জিগাবি হানিমুনের জন্য কক্সবাজার নাকি সিলেট ভালো হবে –তা না তোর এখন ডিভোর্স লইয়ার চাই!”

সমুদ্র যতোটা পারে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে। এই সায়ন এতো লেইম কথা বলে! নীলা এতোক্ষণ চুপ থাকে। এবারে ও বলে উঠে, ” ডিটেইলসে সব বল তো।”

সমুদ্র এ টু জেট বললো কিছু-ই বাদ রাখে না।

নীলা মাথায় হাত চাপড়ে বলে,” এমন করলে তোর আর কোনোদিন বউয়ের হাতের রান্না খাওয়া হবে না। সমুদ্র কোন ধাতের মানুষ রে তুই ?”

–” ও বলছে আমি নাকি রোবট!”

সায়ন বলে, ” এক্কেবারে এতো খাটি কথা বলার জন্য ভাবী উরফ এক্স ভাবী একটা নোবেল ডিজার্ভ করে। ”

নীলা বলে, ” এমন করা ঠিক হয়নি৷ কারো ফিলিংস নিয়ে খেলাটা কী অন্যায় হচ্ছে না? সত্য গোপন রেখে কতোদিন? ”

সমুদ্র মাথা নিচু করে বলে, ” আমিও ভালো থাকার-ভালো রাখার অনেক চেষ্টা করি। কিন্তু ব্যর্থ হচ্ছি।”

নীলা পরামর্শ দিলো, ” দেখ ভুলেও যোগাযোগ অফ করস না। এইটা বোকামি হবে। এট লিস্ট টাচে্ থাক। দেখা কর ওর সাথে। এভাবে দূরে থাকলে ওই ডিভোর্স ই শেষ ভরসা।”

–” ও নিজেই নাকি বলছে যোগাযোগ করতে চায় না।”

নীলা বাঁজখাই গলায় বলে, ” তোরা ছেলেরা এমন কেন রে? মানে একবার পেয়ে গেলেই ইফোর্ট একদম জিরো পার্সেন্ট। মানে একদম ফিক্সড মানুষ যাই করবি থেকে যাবে এমন মনোভাব কেন রে? এতো মিসবিহেইভ করলি, ও রেগে গিয়ে কী এমন বললো তুমি মিয়া সব ছাড়ে দিয়ে বসে আছো। মানে কথা বলার ট্রাই ও করবি, মিনিমাম ইফোর্ট ও দিবি না? ইউশার জন্য পারলে জান দিতি আর এখন কিছু ই করবি না। আয়না কী বানে ভাসে আসছে! বা–ল তুই একটা!”

সমুদ্র বলে, ” ওই মেয়েকে নিয়ে আর কিছু বলিস নাহ। ওর জন্য জীবনটাই বরবাদ।”

সায়ন বলে, ” মেয়েদের জন্য ছেলেদের জীবন ধ্বংস হয় এটায় ইতিহাস সাক্ষী আছে। আর তোরা ফেসবুকে আইসা ঢং মারাস।”

জেন্ডার রিলেটেড ইস্যু নিয়ে নীলা আর সায়নের মধ্যে ঝগড়া লেগে যায়।

সমুদ্র কেমন আনমনে হয়ে উঠে। আজ সারাটা দিন কেবল আয়নার জন্যই ভেবেছে সে। ইন ফ্যাক্ট অন্য কেউ বা অন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও ভালো লাগছে না। কি করবে সে? একবার কল দিবে ওকে? দেওয়া উচিত বোধহয় ।

ল্যাবটপ সাইডে রেখে সে ফোন হাতে নিতেই একটা ইমেইল পেল। আয়না অফিশিয়াল ইমেইলে পাঠিয়েছে। সেখানে লিখা ও রিজাইন করতে চাইছে। ইমেইল পড়ার পরই সমুদ্র ঘামতে লাগে। তাহলে শায়লা আন্টি-ই ঠিক ছিলো। আয়না আসলেই সবটা ছেড়ে দিতে চাচ্ছে। সমুদ্রর মাথার দুই সাইডে তীব্র ব্যথা অনুভব হলো। মাথায় ভোভো আওয়াজ হচ্ছে যেন।
আর কিছুদিন পরই ট্রেনিং সম্পূর্ণ হবে এরপর সার্টিফিকেট পাবে। আর মেয়ে এই মাঝপথে কেন রিজাইন চাচ্ছে? ওর ইমেইল দেখে মনটা আরোও বিষিয়ে উঠে। সে সাহস করে আয়নাকে কল দেয়। তিনবার কল হওয়ার পর আয়না রিসিভ করলো। ওর ভয়েজ শুনে কেমন যেন অনুভূতি হলো সমুদ্রের। বুকের কোথাও সূক্ষ্ম ব্যথা ফিল হয়৷

দু’জনেই চুপ থাকে। যেন চুপ থাকার প্রতিযোগিতা চলছে। আর লাভবান হচ্ছে সীম কোম্পানি।

সমুদ্র বলে, ” ডিস্টার্ব করলাম নাকি?”

–” হ্যাঁ। ”

–” ও আচ্ছা, আচ্ছা। না বেশি সময় নিবো না। মেইল দেখলাম।”

–” এপ্রুভ করে দেন।”

সমুদ্র একটু নীরব থেকে সহসাই বলে উঠে,

–” আয়না সিউর? আর ক’টা দিন আসো। ট্রেনিং শেষ হলে আমি ম্যানেজ করে সার্টিফিকেট দিয়ে দিব। অফিসে বাকি তিনমাস আসা লাগবে না।”

–” না, আমি আর আসবো না।”

–” অফিসে এ’কয়েকদিন এক্সট্রা কোনো প্যারা দিবো না। আসো। লাভই হবে। এ’সময় রিজাইন করার কী মানে?”

সে জিজ্ঞেস কর‍তে চাইছিলো সেপারেশন নিয়ে কি ভাবছে আয়না কিন্তু মুখ দিয়ে কিছু বের হয় না সমুদ্রের। কীভাবে আগাবে সে? ধ্যাত মাথায় কিছু আসে না।

আচমকা সে বলে, ” হ্যাপি ডিসটেন্স। অন্যান্য কাপলরা হ্যাপি টুগেদার সেলিব্রিট করে আমরা নাহলে ডিস্টেন্স পালন করি। ফানি!

ফোন কানে নিয়ে বসে থাকে ও। ও-প্রান্ত থেকে আয়না একদম চুপ। নিজেকে এতো পরিমাণ বলদ মনে হচ্ছে।

চলবে৷

#ইলেকট্রিক্যাল_মন
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–19

রাত আটটার দিকে আয়নার ফোন বেজে উঠে। সে অতি দুঃখে পাথর হওয়ার মতো ভারাক্রান্ত হৃদয়ে যন্ত্রণা বিছিয়ে নিজের বেডে শু’য়ে ছিলো। সারাদিন মাথাব্যথার অযুহাতে রুম ছেড়ে বের হয়নি। বিকেলের দিকে বলেছে নাকে ব্যথা হচ্ছে। সহ্য করতে কষ্ট হচ্ছে জন্য শু’য়ে আছে। যদিও শারিরীক ব্যথার চেয়ে মনের ব্যথা গুলো বেশি পীড়াদায়ক তার জন্য আজ। বাবা নিজে ফিরে এসেছে দুপুরের পর। বাসার পরিবেশ একদম থমথমে। নিস্তব্ধ। যেন কোনো নীরবপুড়ি। কিন্তু সাধারণত তারা সবাই বাসায় থাকলে অনেক হাসি-মজা, গল্প করে। আজ সবকিছুই ভিন্ন রকম৷ বাবা ইতিমধ্যে দু’বার রুমে এসেছে। কিন্তু একবার আয়না ঘুমের ভান ধরেছিলো। দ্বিতীয়বার দেখেও একদম চুপচাপ শু’য়ে ছিল। বাবা বারকয়েক ডেকেছে তাকে কিন্তু সাড়া দেয়নি। ফোন আবার বেজে উঠতেই সে বিরক্ত হলো। স্ক্রিনে সমুদ্র নাম দেখতে-ই আরো রাগ লাগে। এতোবার কল দেওয়ার কি আছে ওনার? সবটা ঢং! যখন ইচ্ছা যা মর্জি তাই করবে!

সে ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বললো, ” একটু বারান্দায় আসো তো।”

–” কেন?”

–” এতো প্রশ্ন করো কেন? আসো। গেলেই দেখতে পাবে।”

–” না। পারবো না যেতে৷”

–” আ… হ্যালো তোমার রুমের বারান্দায় যেতে বলেছি। রকেটে করে নেপচুন গ্রহে যেতে বলা হয়নি।”

–” ইচ্ছে নেই।”

–” এতো অলস কেন তুমি! আমি বসুন্ধরা থেকে মিরপুর আসলাম আর তুমি রুম ছেড়ে বারান্দায় আসতে পারবে না?”

আয়না এতোক্ষণ খুব বিরক্তি নিয়ে কথা বলছিল। যখনই কানে ভাসে উনি এসেছেন ও অবাকের শেষ পর্যায়ে চলে যায়। প্রশ্ন করে,” আপনি এসেছেন?”

–” কি মনে হয়? ”

আয়না কথা বাড়াল না। সঙ্গে সঙ্গে বারান্দায় গিয়ে উপস্থিত হলো। বারান্দার গ্রিলের ফাঁ ক দিয়ে দেখা যাচ্ছে, রাস্তার ঐ’পাশে সমুদ্র ফোন কানে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যস্ত রাস্তা, কোলাহল পূর্ণ। সেকেন্ডে তিনটে রিকশা পাড় হচ্ছে। তবুও আয়নার একটু হলেও ভালো লাগলো।

সে তবুও কঠোর গলায় বলে, ” কেন এসেছেন?”

–” অফিস থেকে ফেরার পথে তোমার বাসার সামনে গাড়ি আটকা গেল। আর ইঞ্জিন চালু হচ্ছে না।”

–” তাই নাকি? আমার বাসার সামনেই ইঞ্জিন নষ্ট হলো?”

–” হুম।”

আয়নার তখন এতো মেজাজ খারাপ হলো সেইসাথে তিরতির করে একটা ভালো লাগার আবেশ ছু’য়ে যায়। এট লিস্ট ভুজুংভাজুং বলে হলে এসেছে তো! আয়নার একবার মনে হয়েছিলো ওনার আসলেই এই সম্পর্কটা নিয়ে কিছু যায়-আসে না। নাহলে গতরাতে এতো সহজেই কেন বললো সবকিছু শেষ করতে চায় কীনা।

সমুদ্র ও’পাশ থেকে বলে, “হ্যালো!”

তখন ও রাস্তা থেকে উপরের দিকে হাত নাড়ছিলো হ্যালো বলার ভঙ্গিমায়৷ অক্টোবরে মাঝামাঝি কিন্তু খুব একটা গরমভাব নেই। একটা শান্ত ভ্যাপসাহীন আরামদায়ক বাতাস বইছে।

–” তোমার দারোয়ানকে নিয়ে একটা পার্সেল পাঠিয়েছি। নিয়ে নাও।”

–” পার্সেল কীজন্য? কিসের পার্সেল?”

আয়নার প্রশ্নে বেশ বিপাকে পড়ে সে। মেয়েটা একদম ছোট বালিকার মতো সবকিছুতেই কেন কেন করে মাথা খায়৷

সে সহজভাবে না বলে প্যাচিয়ে উত্তর দিলো, ” ডেলিভারি ম্যানের জব নিবো পার্টটাইম তাই একটু এক্সপেরিমেন্ট করলাম৷ কেমন হলো?”

আয়না ঠা-স করে ফোনের লাইন কেটে দেয়৷ এধরণের ফাজলামো ভালো লাগে না একদম।

সমুদ্র রাস্তা থেকে ইশারা করে বুঝায় কী হলো কেন ফোন কাটলে? আয়না উত্তর না দিয়ে বারান্দা থেকে ফিরে এসে দরজা লাগিয়ে দেয়।

আয়না রুমে আসতেই আলিয়া একপ্রকার হুড়োহুড়ি করে একটা বক্স হাতে রুমে ঢুকে।

এরপর বলে, ” আপা তোমার জন্য গিফট এসেছে। দেখো।”

আয়না বক্স খুলতেই অবাক। অনেকগুলো কিটক্যাট। ছোট-বড় সব সাইজের চকলেটের প্যাকেট। আর ভেতরে একটা হুয়াইট লিলির ব্যু’কে। অবশ্য নোট দেওয়া নেই কোনো। তবে আয়নার ধারণা ডাক্তার সাহেব কোনো কারণে অনুতপ্ত বা সর‍্যিবোধ করলে ফুল উপহার দেয়।

তখনই বেল বেজে উঠে। গেইট মনে হয় ফাহাদ সাহেব খুললেন। বাইরে থেকে পুরুষালি আওয়াজ ভেসে আসে। নিশ্চয়ই সমুদ্র এসেছে। আলিয়া বেরিয়ে যায় দেখার জন্য। আয়না চুপচাপ রুমেই বসে। কিন্তু ওর নিজের স্বভাবেও চঞ্চলতা আছে। সে বসে থাকতে পারলো না। বের হয়ে আসে রুম থেকে।

সমুদ্র তখন ফাহাদ সাহেবের সঙ্গে বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে কথা বলছিলো। আয়নাকে আসতে দেখে দু’জনের দৃষ্টিই ওর দিকে গেলো। ফাহাদ সাহেব সামান্য হাসলেন মেয়েকে দেখে। সারাদিনে কেবল রুম থেকে বের হলো। নিশ্চয়ই সমুদ্র এসেছে খবর পেয়েই বের হলো৷

আয়নার মনে হচ্ছে তার বের হওয়াই ঠিক হয়নি। সমুদ্র কে দেখার তো কিছু নাই! ওই ফালতু থার্ড ক্লাস ছেলেটাকে একঝলক দেখতে আসার দরকার ছিলো না। বাসার সবাই তাকে এলিয়েনের মতো ট্রিট করছে। এতো অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে কেন আছে সবাই? ওর কেমন আনইজি লাগলো।

সমুদ্র-ই কথা বলে উঠে, ” শুনলাম তোমার নাকি মাথাব্যথা ভীষণ। ঔষধ খাবে এখন?”

আয়নার এহেন প্রশ্নে মেজাজ আরোও বিগড়ে গেলো। আরে বাবা কোন ডাক্তার কী কোনোদিন রোগীকে জিজ্ঞেস করে যে মিস রোগী আপনি কী এখন মেডিসিন নিবেন? আজব তো!

আয়না ওর দিকে তাকাতেই দেখে সমুদ্র আগে থেকেই ওর পানে চেয়ে আছে। আয়না দ্রুত রুমে ফিরে আসে কিছু না বলেই। সমুদ্র একটু পর আয়নার রুমে ঢুকে। হাতে একটা কালো ব্যাগ৷ এখানে ওর কিছু প্রয়োজনীয় হেলথ্ ইকুপমেন্ট থাকে। এই ব্যাগটা ওর খুব প্রিয় একটা ব্যাগ৷ ইন্টার্ণ করার টাইমে ওর প্রিয় প্রোফেসার উপহার দিয়েছিলো এটা।

আয়না তখন রুমে বসে কেবল একটা কিটক্যাট মুখে দিয়েছে। ওমন সময় সমুদ্রের সাথে দ্বিতীয়দফায় সাক্ষাৎ ঘটে। সে দ্রুত নড়েচড়ে বসে টেবিল থেকে ওড়না নিতে ধরবে ওমন সময় সমুদ্র সুধালো, ” থাক, ওড়না না নিলেও হবে৷ আমিই তো এসেছি। আমার সামনে ওড়না নেওয়া লাগবে না।”

কথাগুলো বেশ স্পষ্ট আর কেমন অধিকারবোধ স্বরুপ বলা। বলার ধাঁচেই যা প্রকাশ পাচ্ছে। কিন্তু আয়নাও কম যায় না। সে সঙ্গে সঙ্গে টেবিল টান মেরে একটু ছামটা মেরে ওড়না গায়ে জড়ায়৷ টেবিল থেকে একঝটকায় নেওয়ার ফলে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সমুদ্রের হাতে লাগে। আয়না দেখেও যেন দেখে না। ইগনোর করে করে সমুদ্রের অন্তরের জ্বালাপোড়া আরোও বাড়াচ্ছে ও। সমুদ্র এতোদিন পড়ে এসেছে গ্যাস্ট্রিকের জন্য পেটে, বুকে জ্বালা হয়। আজ এক অভিনব গ্যাস্ট্রিক আবিষ্কার করে সে। এইটা মনো-গ্যাস্ট্রিক। মনের মধ্যে জ্বালাপোড়া শুরু করে।

তার ধ্যান ভাঙ্গে। সমুদ্রের কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে৷ এমন অনুভূতি খুব, খুব তাড়া করে। চোখ গেলো আয়নার হাতের দিকে। ওইতো এখনো তার নামের অক্ষরগুলো জ্বলজ্বল করছে আয়নার হাতের তালু। মুহুর্তের মধ্যে কেমন অজানা জেদ চাপে। খুব সেপারেশন চাই তোমার? চাইলে বুঝি খুব দিবো! আমাকে তো বলার সাহস পাচ্ছো না। সমুদ্রের কেমন আয়নার উপর বড্ড জোর খাটাতে মন চাচ্ছে। এমন উদ্ভব সব অনুভূতিকে দমিয়ে নিয়ে বলে, ” হলুদ খামটা দেখেছো?”

আয়না ভ্রু কুচকে বলে, ” কোন হলুদ খাম?”

সমুদ্র তার দেওয়া বক্স থেকে কিটক্যাট সরিয়ে একদম শেষ প্রান্ত থেকে একটা খাম বের করে দেয়। এরপর বলে, ” তোমার দেনমোহর। সেদিন দেওয়া হয়নি তো। তুমিও চাও নি।”

আয়নার হাতে ধরিয়ে দিলো। আয়না একবার ওর দিকে তাকালো। সমুদ্র আচমকা ওর নাকফুলের জায়গায় হাত রাখলো। আয়না কেঁপে উঠে কিঞ্চিৎ।

ও সুধালো, ” সয়েলিং তো হয়নি। তাহলে নাকফুল খুলে ফেলেছো কেন?”

–” এমনি।”

–” নাক ফোঁড়ানোর জায়গা বন্ধ হয়ে যাবে কিন্তু রক্তজমাট বেঁধে। তখন আর নাকফুল ঢুকবে না।”

–” না ঢুকলে নাই।”

বেশ ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে উঠে ও। সমুদ্র বুঝে কালকের রাগ সবটা ওই নাকফুলের উপর দিয়ে যাচ্ছে। ওটা সমুদ্রের দেওয়া উপহার দেওয়া ছিলো বটে। আর মেয়ে যে পরিমাণ রেগে বোম হয়ে আছে, নাকফুল পড়তে বললে বারান্দা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দিলেও দিতে পারে!

সমুদ্র ইচ্ছে করে ওকে চেতানোর জন্য বলে, ” অবশ্য নাকফুলে তোমাকে মানায়ও না তেমন। অযথাই করেছিলে। বোঝা উচিত ছিলো। বুদ্ধিমতী হলে বুঝতে।”

আয়নার এতো রাগ উঠলো। আয়না কি পড়বে, না পড়বে, কাকে কোন নামে ডাকবে এসব ওর একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। ওনার কিছু বলাই তো বেমানান সেখানে ব্যাটা উল্টাপাল্টা মতামত দেয়। আয়না ধাপ করে উঠে দাঁড়িয়ে খ্যাপাটে বাঘিনীর ন্যায় ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। একপ্রকার রাগ নিয়েই নাকফুলটা নাকে বসাতে গিয়ে বেকায়দায় ব্যথা পায় আর মুখ ফুটে অস্ফুটে আউ বলে উঠে। সমুদ্র হন্তদন্ত পায়ে এগিয়ে এসে ওর কাঁধ ধরে নিজের দিকে টেনে এনে বললো, ” আমাকে বললেই তো ঠিকঠাক মতো পড়িয়ে দিতাম৷”

আয়নার কাছে ওনার সবকিছুই, এইযে অতিরিক্ত কনসার্ন সবকিছুই যেন আলগা ঢং, লোক দেখানো পিড়িতি মনে হচ্ছে। সে মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালে, ক্ষণেই সে ওর থুতনিতে হাত রেখে এদিকে ঘুরিয়ে খুব সাবধানে নাকফুল পড়িয়ে দিয়ে সেখানটায় হাত বুলায়। এরপর বলে, ” যার উপর আগ্নেয়গিরির মতো রেগে ফুঁসছো, সে জলজ্যান্ত সামনেই আছে। পারলে তার উপর রাগ দেখাও। অন্যকিছুর উপর রাগ দেখাতে হবে না।”

এরপর টুক করে ওই জ্বলতে থাকা নাকফুলের উপর একটা আলতো করে চুমু খেলো।

এরপর বলে, ” উম, নাক বোঁচা এজন্য ঠিকঠাক আরাম করে ভারী কি–স ও দিতে পারলাম না।”

আয়নার এতো মেজাজ খারাপ হয়। সে সঙ্গে সঙ্গে বাজখাঁই গলায় বলে, ” বোঁচা নাক নিয়ে এতো সমস্যা থাকলে, বিয়ে করলেন কেন? খাড়া নাকওয়ালা মেয়ের কাছে যান। এক্ষুনি বের হন আমার রুম থেকে।”

সমুদ্র হাসি আটকাতে পারেনা। কালকে থেকে পরিস্থিতি এতো বাজে যাচ্ছিলো যে হাসার মতো পরিবেশ ছিলো না। কিন্তু এই মুহূর্তে দম ফাটানো হাসি পাচ্ছে। মানুষ নিজের বোঁচা নাক নিয়েও এতো অবসেসড হয়!

আয়নাকে আর রাগানো ঠিক হবে না ভেবে সে রুম ছেড়ে বের হলো। কিন্তু একেবারে চলে যায় না। ফাহাদ সাহেবের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে জানলো আয়না ওর বাবার উপর ও রেগে আছে৷ সমুদ্রের মনে হচ্ছে আজ বুঝি রাগ দিবস। দেখি সুযোগ পেলে ওকে ‘ হ্যাপি এংরি ডে’ উইশ করে আরোও খ্যাপাতে হবে৷

সমুদ্র মনের ভুলেও শ্বশুড়কে সেপারেশন নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। নতুন জামাই সে। এসব জিজ্ঞেস করা মানে হলো কিছুটা এমন– নিজ থেকে কুমিরের জন্য খাল কেটে সেই খালে সোফা আর এসির ব্যবস্থা করা। আগ বাড়ায় বিপদ ডাকার মতো নির্বোধ হওয়া যাবে না। এজন্য কৌশলে সেপারেশনের এন্টি দেনমোহর বুঝিয়ে দিয়ে তাদের বিয়েটার ভিত্তি আরোও মজবুত করতে উঠেপড়ে লেগেছে। নিজের কামাই করা টাকা দিয়েছে দেনমোহরে। অধিকার তো আছেই, আজ থেকে আরোও একধাপ বেশি এগিয়ে গিয়ে , আরোও বেশি অধিকারের ভাগীদার হলো।

ফাহাদ সাহেবের সঙ্গে বসে টিভি দেখতে বসে সে। একটু পর ফাহাদ সাহেব উঠে পড়লেন। মনটা বড় উসখুস করছে সমুদ্রের । আয়নাকে দেখলে এক কাপ চা বানাতে বলবে। রুমে যেতেও খানিক লজ্জা লাগছে। কিছুক্ষণ পর আয়না বের হয়৷ ওকে দেখে বোঝার উপায় নেই ওর মনে কী ঝড়টাই না গেছে। বেরিয়ে এসে দেখলো সমুদ্র টিভিতে খেলা দেখছে৷ মুখের এক্সপ্রেশন দেখেই বোঝা যাচ্ছে নিশ্চয়ই বাংলাদেশ আজ খুব বাজে খেলছে।

সমুদ্র আয়নাকে দেখামাত্র টিভি অফ করে দেয়। আয়না প্রশ্ন করে, ” অফ কেন করলেন?”

–” বউ সামনে থাকলে টিভি দেখা ঠিক হবে না।”

আয়না বিরক্ত হয়ে চলে যায়। ফাহাদ সাহেব সবকিছুতেই মাত্রাতিরিক্তভাবে বাড়াবাড়ি করেন। আজ নিজের বাসা জ্বলছে। নিজের মেয়ে রেগে আছে। তবুও মেয়ে জামাই আপ্যায়নে কমতি রাখেন না। সমুদ্রকে কল করেছিলেন তিনি। এমনি কথাবার্তার জন্য। কথার ফাকে বললেন আয়না সারাদিন মাথাব্যথার জন্য শু’য়ে আছে। এটা শুনেই সমুদ্র আসবে বলে জানায়। এরপর তিনি হামিলা বুয়াকে দিয়ে খাসির মাংস, মুরগির মাংস আর রুপচাঁদা মাছ রান্না করতে বলেন। সমুদ্রকে ডিনার করতে দিলেন৷ কিন্তু নিজে না খেয়ে রুমে ঢুকে পড়ে। সমুদ্র অল্প খেয়ে আয়নার রুমে যায়৷ আয়না তখন বেডের উপর অযথাই গোছানো কাপড় গুলোর ভাঁজ খুলো ফের গুছাচ্ছে। এসব ইচ্ছে করেই করছে যেন ব্যস্ত থাকা যায়। সমুদ্র গিয়ে একটা গুছিয়ে রাখা ওড়না হাতে নেয়। এরপর বলে, ” গুছানো জিনিস এলোমেলো করছো কেন?”

আয়না রাগান্বিত গলায় বলে, ” আমার কাপড় আমি যা ইচ্ছা করব। আপনার এতো কী?”

–” আমার বউয়ের কাপড় তাই এতোকিছু! তোমার একটা ওড়না নিয়ে যাই?”

–” ওড়না দিয়ে আপনি কী করবেন?”

–” কিছু করবো না। জাস্ট আমার আলমারিতে রেখে দিবো। আমার মতো আমার আলমারিও বিবাহিত ব্যাচেলর। মেয়ে কাপডের ছো’য়া চাই ওর। কি কান্নাকাটি করে প্রতি রাতে! জানো নাতো। সেদিন বলছিল, আমার কাঠের তাকে আর জেন্টস প্যান্ট চাই না। মেয়দের কাপড় সাজিয়ে রেখে আমাকে ক্ষ্যামা দাও। এজন্য নিয়ে যাচ্ছি তোমার ওড়না। আলমারির দুঃখে আমিও দুঃখিত। ”

আয়নার এতো পরিমাণ –হাসি আর মেজাজ গরম দুটো একসঙ্গে হলো। আচমকা সমুদ্র তার হাত টেনে ধরে নিজের সামনে দাঁড় করায়। এরপর বলে, ” আর কতো রাগ করে থাকবে?”

আয়নার সত্য বলতে সমুদ্রের উপর রাগ অনেকখানি কমে এসেছে। ওর এক্সপেক্টেশন এতো ডাউন ছিলো। ভেবেছিল সমুদ্র আর কোনোদিন আসবেই না। ফোনও দিবে না। কিন্তু ও এসেছে। এতেই খুশি আয়না। ওর লাইফে প্রথম পুরুষ হলো সমুদ্র। ওর উপর অটোমেটিক রাগ কমে আসে। কিন্তু অভিব্যক্তিতে প্রকাশ পায় না।

সমুদ্র ওড়না টান মেরে পকেটে ঢুকালো। আয়না অসন্তোষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ” আমার ওড়না ফেরত দেন!”

–” লাগবে আমার।”

আয়না মনে মনে ভাবে, এই লোকটা এতো পিকিউলিয়ার কেন? ওড়না দিয়ে তার কাজটা কী? মন চাচ্ছে এক্ষুনি চারটে ওড়না ওনার গলায় ঝুলিয়ে দিতে। যত্তসব!

কিয়ৎক্ষণ পরে সে আয়নার দিকে ঝুকে এসে ওর কোমড় আলতো করে ধরে। মুখে-চোখে ঠোঁট গোল করে ফুঁ দেয়। নিজের মুখটা একটু সামনে আগাতেই সিগারেটের বাজে গন্ধ ভেসে আসে। বিরক্ত হয় আয়না। ডাক্তার হয়েও সিগারেট খায়। তারউপর ওর একদম সিগারেটের স্মেল পছন্দ না।

–” সিগারেটের গন্ধে তো আপনার পাশে থাকা যাচ্ছে না। প্লিজ দূরে সরেন৷”

সমুদ্র বলে, ” ঘরে বউ আসলে সিগারেটের প্যাকেট ভুলেও খুলে দেখবো না। তখন তো অন্য প্যাকেট খুলতে ই টাকা যাবে। ”

–” অন্য প্যাকেট বলতে কি মিন করছেন?”

–” কাপড় আর থালাবাসন মাজার সাবানের প্যাকেট। ডাবল মিনিং নিচ্ছো কেন?”

আয়না পাগলের কথায় সাড়া দেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না৷

–” তোমার বাবা ডিনার করালো কিন্তু ডেজার্ট তো দিলো না।”

আয়না ভ্রু কুচকে তাকাতেই ওকে মুহূর্তের মধ্যে সমুদ্র নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নেয়। আয়না পিলে চমকে উঠে দূরে সরে আসতে চায়। সমুদ্র বাঁধা মানে না।

–” দরজা খোলা। আচ্ছা আপনার কী কাণ্ড-জ্ঞান নেই? কমনসেন্সের অভাব?”

সমুদ্র চোখ বুলিয়ে দেখে আসলেই দরজা অল্প একটু ফাঁকা হয়ে খোলা আছে। আফসোস হলো তার কেন লক করে আসলো না ভেতরে । ম্যাডামের রাগ অনেকটাই কমে গেছে। ভালো সুযোগ ছিলো। এটাও হাতছাড়া হলো। ধ্যাত! দরজাটার উপর এতো রাগ উঠলো। পারলে দরজা ভে_ঙে গুড়িয়ে দিতো!

সে নিজের পক্ষে সাফাই গেয়ে বলে, ” ঘরে জামাই থাকলে তোমার ফ্যামিলির কেউই আসবে না। ট্রাস্ট মি।”

–” সরেন তো।”

তারপর সে বলে, ” অন এ সিরিয়াস নোট, তুমি দুপুরে খাও নি এজন্য তোমার বাবাসহ পুরা পরিবার না খাওয়া। সবাই তোমার জন্য না খেয়ে আছে। তোমার দাদাভাইয়ের গায়ে জ্বর। কাশছে অনেক। তিনিও খান নি৷ এভাবে বেঁকে বসে থেকে ওদের কষ্ট দিও না। একসাথে সবাইকে নিয়ে ডিনার করো।”

সমুদ্র আরো টালবাহানা করতো আজ থেকে যাওয়ার জন্য। কিন্তু হঠাৎ কোথা থেকে মিলি ছাড়া পেয়েছে৷ ও
ফাকা অংশ দিয়ে আয়মার রুমে ঢুকে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্র বিড়াল দেখামাত্র চিল্লা-পাল্লা শুরু করে৷ ওকে দেখে মনে হচ্ছে কেউ সমুদ্রের লেজে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। মিলিও কেন যেন বেশ মজা পায়। সে সমুদ্রের দিকেই ছু’টে যায়। সমুদ্র দ্রুত বিছানায় উঠে পড়ে এরপর ভয়ার্ত সুরে বলে, ” বিড়ালকে বের করে দেও না প্লিজ। ওকে সরাও।”

আয়না এতোক্ষণে সমুদ্রকে শায়েস্তা করার কোনো পন্থা পায়। নাহলে এই লেজকাটা শেয়ালটাকে কোনোভাবেই যুক্তি দিয়ে হারানো যায় না।

সে মিলিকে কোলে তুলে নিয়ে বললো, ” মিলি কেন যাবে? এটা মিলির বাসা। যারা বিড়াল ভয় পায় তারা যাক।”

সমুদ্র বেড থেকে নামতে চাইলে ফের ও মিলিকে ছেড়ে দিলো। মিলির কাছে সমুদ্র কিছুটা জোকারের মতো বোধহয়। মিলি লেজ নাড়িয়ে হাঁটা দিলে ও লাফালাফি করে। খুব মজার ঘটনা। মিলি লেজ নাড়িয়ে সমুদ্রের দিকে ছু’টে। সমুদ্র দ্রুত বেডে উঠে পড়ে৷

আয়নাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” এই প্লিজ ওকে সরাও।”

–” না।মিলি এখন খেলবে৷ আপনার সমস্যা কেন এতো?”

সমুদ্র বলে, ” তুমি বিড়ালটাকে কোলে নেও। আমি যাচ্ছি। বাট ওয়ান কন্ডিশন ভুলেও ওকে ছেড়ে দিবে না।”

–” আচ্ছা৷”

সমুদ্র বেড থেকে নেমেছিলো কিন্তু আয়না মিলিকে ছেড়ে দেয়, কন্ডিশন মানে না কোনো। বেচারা সমুদ্র পায়তারা করছিল আজ বউয়ের বাড়ি রাতে থেকে যাবে, কিন্তু ভাগ্য অসহায় হলে যা হয় আরকি। এই বয়সে এসেও বিড়ালের ভয়ে আয়নার বাসা থেকে একপ্রকার ছু’টে বেরিয়ে আসে সে। বিড়ালটাও খুব পাজি। তাকে দেখেই তার পিছু ছুটে’। কেন রে ভাই? কি দোষ তার?

চলবে৷