#ইলেকট্রিক্যাল_মন
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–20
গত দু’দিন ধরে আয়নাদের বাসার পরিবেশ খুব একটা অনুকূল অবস্থায় নেই৷ সময় মাফিক সব হচ্ছে কিন্তু তবুও ঝড়ে ভেঙে পড়া গাছের মতো করুণ দশা সবার। ফাহাদ সাহেবের দ্বিতীয় বিয়ের খবর বয়োজ্যেষ্ঠদের গুটিকয়েক’ জন জানতেন। তবে এখন খোলাসা হওয়ার পর ফ্যামিলির সকলে জেনে যায়। আয়নার সবচেয়ে আশ্চর্য লাগে বেশিরভাগ মানুষজনই ফাহাদ সাহেবের পক্ষ নিয়ে কথা বলে সড়ে পড়ছে। গ্রামের বাড়ি থেকে এক ফুপু কল দিয়েছিলো। ইনিয়েবিনিয়ে কিছু সৌজন্যমূলক কথা বললো। এরপর সরাসরি জিজ্ঞেসই করে ফেলে, ” শুনলাম ফাহাদ ভাইসাব আরেকটা বিয়ে করছে? মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার বয়সে নিজেই বিয়ে করলো? ”
আয়নার ওইসময় ভীষণ রাগ-কষ্ট-ক্ষোভ-বেদনায় মন বিষিয়ে উঠে। উনি অবশ্য পরে বলছিলো, বিয়ে করে নাকি ভালো করেছে। একা কতোদিন থাকা যায়? এসব কিছু ভালো সুশীল কথা বলে দ্বিতীয়দফায় খোটা মেরে জিজ্ঞেস করলো, ” তা নতুন জামাই আর নতুন বউ নিয়ে গ্রামে আসিও।নতুন মানুষদের গ্রাম ঘুরাই নিয়ে যাইও।”
আয়না হতভম্ব হয়ে পরে। মানুষ-জন এভাবে কেন তাকে খোঁচা মেরে কথা বলছে? বলবেই বা না কেন? তবে কেউ কী একবারও তাদের দু’বোনের দুঃখ বোঝার চেষ্টা করে না? আয়নার মন খুব খারাপ হয়। কেমন বিষাদে ছেয়ে যায় মন।
এতোটাও মর্ডান না যে মায়ের রিপ্লেসমেন্ট কেও সয়ে নিবে।
সকালের নাস্তার জন্য ফাহাদ সাহেব আয়নাকে ডাকতে আসলেন। গত দু’দিন ধরে দুই বোনের কেউ ঠিকঠাক মতো তার সঙ্গে কথাও বলছে না, খাওয়া-দাওয়াও করছে না।
ফাহাদ সাহেব নম্র গলায় আয়নার রুমের দরজা ধাক্কালেন। তারপর বলে উঠে, ” আয়ু, নাস্তা করতে আসো। ক্লাস আছে না আজকে?”
আয়না জবাব দেয় না ভেতর থেকে। ফাহাদ সাহেব দরজা খুলে ভেতরে উঁকি দেন। ওইসময় আয়নার একটু আগের বলা কথা গুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। আর এখন বাবাকে দেখামাত্র রাগের মাত্রা যেন ফুটন্ত তেলে পানির ছিঁটা দেওয়ার মতো। বাবার জন্য তাকে সবাই যা ইচ্ছে তাই বলছে। অপমানিত হওয়ার সুযোগ করে দিলো!
সে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠে, ” আব্বু তুমি এক্ষুনি আমার রুম থেকে যাও। তোমার চেহারা দেখতে ইচ্ছা করছে না।”
ফাহাদ সাহেব বেশ খানিকটা আহত হলেন সেই সঙ্গে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েন। আয়না স্বভাব-ত খুব শান্ত-শিষ্ট ধরনের। ঝগড়াঝাটির মধ্যে ও নেই। বরং মিষ্টি ভাষী আর হাসি-খুশি ধরনের। আয়নাকে এভাবে চিল্লাতে দেখেনি এর আগে। বরং তাদের বাসায় এমন চিল্লা-পাল্লা, অশান্তি এর আগে কখনোই হয়নি। কাজেই আয়নার চিৎকারের আওয়াজে ফাহাদ সাহেবের মা সালেহা বানুও এগিয়ে আসেন দেখার জন্য।
আয়নার চোখে তখন জল ছিলো। সে আবারো চিৎকার করে বলে, ” তুমি এখনো আমাদের বাসায় আছো কেন? যাও তোমার দ্বিতীয় স্ত্রীর কাছে যাও। এক্ষুনি যাও বাবা। আর কোনোদিন আমাদের কাছে আসবে না।”
ফাহাদ সাহেব বুঝলেন আয়না এখনো রেগে আছে। রেগে থাকাটা অস্বাভাবিক না। শায়লাও অগ্রীম জানিয়ে দিয়েছে, যেহেতু সংবাদ পাওয়া মাত্র ও সঙ্গে সঙ্গে রিয়্যাক্ট করেনি। নীরব ছিলো। কাজেই বাসায় গিয়ে পরবর্তীতে ফাহাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতে পারে। জানার পরপর বুঝে পাচ্ছিলো না কি করা উচিত। আবার অন্য কারো বাসায় ছিলো, সঙ্গে নতুন জামাই। সবটা চেপে গেছে। বাসায় যাওয়ার পর তোলপাড় শুরু হবে। শায়লার কথাই ঠিক হলো। তিনদিন ধরে বাসার পরিবেশ অস্বাভাবিক।
আয়না বাবার সামনেই দরজা লাগিয়ে দেয়৷ ফাহাদ সাহেবকে সালেহা বানু সান্ত্বনা দিয়ে বলে, ” আয়ু বুবুর মনটা খুব নরম। এজন্য কষ্ট পাচ্ছে বেশি। ওর ব্যবহারে মনে কিছু নিস না।”
–” না! মনে কিছু নেইনি। বুঝতে পারছি ওর খারাপ লাগবে।”
ফাহাদ সাহেব আলিয়াকে ডাকলেন। কিন্তু আলিয়াও ঘুমে আছে। উনি একাই নাস্তার টেবিলে বসে পড়লেন। দুই মেয়েকে নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন সে।
খাওয়ার মাঝে বলে উঠে, ” আম্মা অফিসের কাজে চিটাগং যেতে হবে। তিনদিনের জন্য। লকারে টাকা আছে। প্রয়োজন হলে খরচ করবে৷”
এরপর হামিলা বুয়াকে ডাক দিলেন। হালিমা বুয়া রান্নাঘর থেকে বের হয়ে আসেন দ্রুত৷
ফাহাদ সাহেব বলেন, ” হালিমা আপা, এই তিনদিন বাসায় মাছ রান্না করবেন না। ওদের দুই বোনের মাছ পছন্দ না। ওরা যা খেতে চায় ড্রাইভার কে দিয়ে বাজার করায় রান্না করে দিবেন।”
–” আচ্ছা ভাইসাব।”
ফাহাদ সাহেব ফের আয়নার রুমের সামনে গিয়ে বললো, ” আয়ু আমি যাচ্ছি। অফিসের কাজে তিনদিনের জন্য চিটাগং। দাদা-দাদীর যত্ন নিবে।”
বন্ধ দরজার ও’পাশ থেকে কোনো সাড়া এলো না।
আলিয়ার যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন বেলা এগারোটা। ঘুম থেকে উঠেই দেখে রুমের মধ্যে হালিমা বুয়া কাপড় ভাঁজ করছে। ওনার ইতিমধ্যে দুপুরের রান্নাবান্না শেষ বোধহয়। বারোটার পর থেকে হালিমা বুয়া টিভি দেখা শুরু করে সব কাজ শেষ করে৷
আলিয়া উঠে বসে বলে, ” আজকে নাস্তা কী? ”
হালিমা বুয়া বলে, ” ছোট আপামনি এই বেলায় কেউ নাস্তা খায়? আপনে এক্কেবারে দুপুরের ভাত খান?”
আলিয়া চোখ কচলে ফোন হাতে নিতেই সামান্য অবাক হয়। শ্রাবণ ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। শ্রাবণের ম্যাসেজ দেখতে ই একটু ভালো লাগে। পরক্ষণেই ফোন রেখে দেয়। সীন করে না। শ্রাবণ হলো আপার শ্বশুড়বাড়ি থেকে আসা গেস্টের কার যেন ছেলে। মেহেদীর দিনে একসঙ্গে অনেকক্ষণ ছিলো তারা। সেই সুবাদে পরিচয়। এরপর হুট করে ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট পাঠালো। দেন প্রায় প্রতিদিনই ম্যাসেজ দেয়৷ আলিয়ারও অবশ্য ভালোই লাগে ওর সাথে কথা বলতে। এর আগে কোনোদিন এভাবে কোনো ছেলের সঙ্গে চ্যাট করেনি। কারণ বাবার স্ট্রিক্ট বারণ আছে। কোনো ছেলের সঙ্গে প্রেম করা যাবে না। তবে বাবা নিজেই যে কাজটা করলো এরপর আলিয়ার বাবার উপর ভীষণ ক্ষোভ। সেই ক্ষোভ থেকে বাবার বানানো সব রুলস ব্রেক করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে সে। এতোদিন শ্রাবণকে খুব একটা পাত্তা দেয় নি। কিন্তু গত দু’দিন ধরে ওর সাথে ভাব জমাচ্ছে। আলিয়া ঠিক করেছে, সে হয় পালিয়ে বিয়ে করে বাবাকে শিক্ষা দিবে আর তা না পারলে বাবার পছন্দ করা ছেলেকে ডিটচ্ মেরে বিয়ের দিন সব সোনাদানা নিয়ে ভেগে যাবে। এতেও বাবার অনেক বেইজ্জতি হবে। এভাবে প্রতিশোধ নিতে চায় সে। কিন্তু পালাবে যে, কার সাথে পালাবে? লাগেজের সঙ্গে তো আর পালাবে না৷ একটা বয়ফ্রেন্ড তো লাগবেই। কই থেকে পাবে বয়ফ্রেন্ড? তখনই খেয়াল হলো শ্রাবণ তাকে কেন যেন খুব পটানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। এর আগেও একজন এমন করেছে৷ কিন্তু ওকে আলিয়া বিন্দুমাত্র পাত্তা দেয় না। একবারে ছাপড়ি টাইপ ছেলে ছিলো৷ কিন্তু শ্রাবণ এমন না। ও ইংলিশ মিডিয়ামের স্টুডেন্ট ছিলো। এখন ইকোনমিকস্ এ পড়ছে থার্ড ইয়ার তাও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে। ওকে পাত্তা দেওয়া যায়। সবদিক থেকে-ই চলনসই সে। আলিয়া যখন নাস্তা করতে রুমের বাইরে যায় ততোক্ষণে আয়না বেরিয়ে গেছে ভার্সিটির উদ্দেশ্য।
_____________
আয়নার মন-মেজাজ খুব খারাপ। এতো বিরক্ত আর ইরেটেট এর আগে কোনোদিন লাগে নি। সকাল নয়’টা দশে একটা ক্লাস ছিলো। আরেকটা হওয়ার কথা ছিল দুপুরে৷ কিন্তু হুট করে দুপুরের ক্লাস ক্যান্সেল হয়ে যায়। তার সেকশনের বাকি ফ্রেন্ডরা ক্লাস ক্যান্সেল হওয়ায় বেশ ফূর্তিতে আছে। ক্লাস ক্যান্সেল হওয়ার আনন্দ একদিকে আর সারা পৃথিবীর যতো আনন্দ তা দড়িপাল্লার আরেকদিকে। আয়নার ধারণা পোলাপান সবচেয়ে খুশি হয় ক্লাস ক্যান্সেল হলে। সে সহ আরো চার-পাঁচ জন ফ্রেন্ড টিএসসির দিকে এগিয়ে গেলো। আজ রোদ একদম মাথা বরাবর। সূর্যের তেজ আজ বেজায়। ধুধু রোদে টিএসসির সামনে একপ্রকার বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা লেবুর শরবতের গ্লাস। এমন সময় সমুদ্রের কল আসে তার নাম্বারে। রোদে চোখ-মুখ কুচকেই সে ফোন রিসিভ করে৷
–” হ্যাঁ আয়না। কোথায় তুমি? ”
আয়না একবার ভাবলো বলবে বাসায় আছে, দুপুর টাইম যদি বাসায় চলে আসে। এই ভেবে সত্যটাই বলে দেয়।
–” ভার্সিটির সামনে। টিএসসিতে।”
–” ফ্রেন্ডরা সঙ্গে আছে?”
–” হ্যাঁ তো।”
–” আমি শাহবাগের দিকে একটা কাজে এসেছি। তিন’ টা মিনিট দাও। আসছি।”
আয়না কানে ফোন নিয়ে চোখ বড় বড় করে। উনি এদিকে আবার কী করতে এলো? শাহবাগে কাজে আসলেই কী টিএসসি এসে দেখে যেতে হবে নাকি! আয়না লেবুর শরবত হাতে দাঁড়িয়ে থাকে। পাশে তার পাঁচজন ক্লাসমেটের কেউ বসে বা দাঁড়িয়ে আছে। বাবরি চুলের সুব্রত। ও কাঁধে গিটার নিয়ে বসে আছে রোদের মধ্যে। কোনো হেলদোল নেই। আয়না ভাবে ওর আসলে সিএসই নেওয়া উচিত হয়নি। চারুকলা তে যেত। সারাদিন ভাবুক হয়ে ভাবত আর ক্যানভাসে রংতুলি নিয়ে খেলতো। ওইদিকে অর্পা ও দাঁড়িয়ে ফোনে ব্যস্ত। আসলে ভার্সিটি লাইফে সবারই নিজের একটা বাউন্ডারি থাকে। যে যার মতো যাকে নিয়ে ব্যস্ত শুধু ফ্রি টাইমে বন্ধু নিয়ে আড্ডা। প্রতিবার সুব্রত, কাজল ওরা সিলেট যাওয়ার প্লান করে। ওদের ক্লাসে একজন চাকমা ফ্রেন্ড আছে। ওদের বাড়িতে ঘুরতে যাবে অথবা সুব্রতের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনা যাওয়ার পরিকল্পনা করে কিন্তু দ্বিতীয় বর্ষে এসেও তা কার্যকর হয় না।
আয়নার ঘোর কাটে যখন কেউ তাকে পিছন থেকে ডেকে উঠে, ” আয়না!”
আয়না সহ ওর বাকি ক্লাসমেটরাও ফিরে তাকালো। সে দেখলো সমুদ্র এসেছে। তার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। আজকে ও হাল্কা নীল রংয়ের একটা ফর্মাল শার্ট পড়েছে কিন্তু ইন করে নেই। নীলচে চোখের মনির সঙ্গে ওর শার্ট দারুণ ম্যাচিং হয়েছে। দূর থেকে আয়নাকে তাকাতে দেখে ও হেসে দেয়। আয়নার ওইসময় খুব ব্যাকুলতা অনুভব হয়। কেন যেনো মায়া আসে ওর প্রতি। নিজের জন্যও মায়া লাগে। কেমন অদ্ভুত অজানা একটা অনুভূতি মনের কোন খানে জানি পাখা ঝাপটায়। টের পায় কিন্তু বুঝে উঠতে পারেনা । নারী হওয়ার দুর্ভোগের মধ্যে অন্যতম হলো নিজের অনুভূতি নিজেই বিশ্লেষণ করতে না পারা। এইযে এই মুহূর্তে তার কেমন খামখেয়ালি অনুভূতি অনুভূত হচ্ছে। মনে হচ্ছে দু’হাত মেলে কোনো ভীনদেশে উড়াল দিতে৷ ওনার হাসিমুখের দিকে তাকাতেই কান্না পাচ্ছে৷
মনে হচ্ছে সামনে গিয়ে হাতটা ধরে শাসিয়ে বলতে, ” শুনুন মিষ্টার ওশেন, আজ থেকে আপনার ওই সুন্দর দু’টো চোখ অন্য মেয়েদের দেখাবেন না ভুলেও। রাস্তায় বের হওয়ার সময় চোখ বেঁধে বের হবেন। এখন উনি যদি প্রশ্ন করেন চোখ বেঁধে বের হলে তো দুর্ঘটনা ঘটবে তখন আয়নার কাছে উত্তর থাকবে না, ব্যাখা থাকবে না। কিন্তু এতো সুন্দর মিষ্টি অনুভূতির মধ্যেও বিশ্রী একটা স্মৃতি ভেসে আসে। তবুও একটা ‘কিন্তু’ রয়ে যায় কোনো এক পঠিত পাতায়।
সমুদ্র রাস্তা ক্রস করে তার সামনে এসে দাঁড়ায় এবং বললো, ” এই রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে কেন? ছায়ার নিচে যাও।”
আয়নাকে এই প্রথমবার ফ্রেন্ড ব্যতিত কোনো অপরিচিত পুরুষের সঙ্গে কথা বলতে দেখে অর্পা অবাক ই হয়। ওর খেয়াল ই ছিলো না বান্ধাবীর বিয়ে হয়েছে। অবশ্য সুব্রত আর কাজলের মনে হলো এটা নিশ্চয়ই দুলাভাই। কারণ বিয়ের ছবি দেখেনি। আন্দাজে কিছু বলাও যায় না জন্য চুপ থাকে৷
অর্পা একটু ঠোঁট কাটা স্বভাবের, বলে ফেলে, ” এই লম্বুটা কে রে দোস্ত? তোর সঙ্গে কেন কথা বলে এই লম্বু ব্যাটা?”
আয়না এতোবেশি অস্বস্তিতে পড়লো। সে সমুদ্রর পানে তাকায়। ও মিটমিটিয়ে হাসছে যেন৷
আয়না আস্তে করে বলে, ” ওনার নাম সমুদ্র। আমার হাসবেন্ড। তোদের দুলাভাই।”
কথাগুলো বলার সময় ওর নিজের গলার স্বর কেঁপে উঠে৷ লাজে কিঞ্চিৎ পরিমাণ গালের ফোলা অংশে লাল রক্তিম আভা ফুটে উঠে।
সবাই নড়েচড়ে উঠলো। এরপর সমুদ্রের সঙ্গে কথা বলা শুরু করে। অর্পা ক্ষমা প্রকাশ করলো।
ভাবুক সুব্রত গিটার বের করে এনে বলে উঠে, ” আয়না আর দুলাভাইয়ের জন্য দু’লাইন গাই! গরীবের তরফ থেকে ছোট উপহার!”
ও গিটারে টুংটাং আওয়াজ তুলে। টিএসসির মোড়ে এমন গীটারিস্ট গোয়ানীস ডিসুজা অহরহ খুজঁলে পাওয়া যায়। যে হাতে জাভা, পাইথনের কোডিং তোলার কথা, সে হাতে কি অবলীলায় গিটারে সুরে তুলে। গেয়ে উঠে,
“আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা
আর কত কাল আমি রব দিশাহারা
রব দিশাহারা।
কারা যেন ভালোবেসে আলো জ্বেলেছিল
সূর্যের আলো তাই নিভে গিয়েছিল!”
আয়নার গান শোনা মাত্র আরো একবার কী ভীষণ প্রখর এক অনুভূতি হন্ন হয়ে বুকের মাঝ বরাবর তীব্র স্রোতের ন্যায় আছড়ে পরে। আসলেই হুট করে মনে হচ্ছে আশেপাশে কোথাও ভ্যাপসা গরমভাব নাই। সূর্যের তেজ উনি আসার সঙ্গে সঙ্গে নিভে গেছে কী?
অতিরিক্ত কোলাহল, রিকশার হর্ণ, কাকের কাকা, গাড়ির বিকট শব্দ, মানুষজনের হৈচৈ উপেক্ষা করে সুব্রতের গাওয়া দু’লাইন কি দারুণ জমে যায়৷ আয়না একধ্যানে সমুদ্রের পানে তাকিয়ে থাকে। সাহিত্য এতো সুন্দর কেন? আরোও সুন্দর বোধহয় শিল্পীরা, যারা সাহিত্যকে প্রাণ দেয়। তারচেয়েও সুন্দর বোধহয় সদ্য প্রেমে পড়া কোনো তরুণীর চোখে তার সেই প্রেমিক!
দু’লাইন গাওয়ার পর সুব্রত থেমে যায়। এরপর আয়নার সব ফ্রেন্ড তাদের একমাত্র দুলাভাইকে বললো ট্রিট দিতে। সমুদ্র ও রাজী। ওরা অবশ্য বেশি কিছু চায় না। টিএসসির মোমো আর ফুচকা খায়৷ ওতেই আনন্দ যেন!
সুব্রত বলে, ” দুলাভাইকে ডিপার্টমেন্ট ঘুরিয়ে নিয়ে যা।”
আয়নার ইচ্ছা ছিলো না। তবে সমুদ্রের ইচ্ছা হলো ওর ডিপার্টমেন্ট দেখবে৷ অগত্যা বাধ্য হয়ে নিয়ে গেলো এ ইউনিটের ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট এর সিএসই শাখায়।
ওদের ক্লাসরুম আজ ফাঁকা ছিলো। ডিপার্টমেন্টর সামনে, ওখানেটায় কয়েক মিনিট পার করে ফিরে আসবার পথে আয়নার মেজর কোর্সের ফ্যাকাল্টির সাথে সাক্ষাৎ ঘটে। স্যার আয়নাকে সি আর হওয়ার সুবাদে চেনেন। স্যার অনেক রসিক লোক। মজা নিয়ে পড়ায়। ওনার ক্লাসে হাসি মাস্ট। এ জন্য আয়নার প্রিয় শিক্ষক। ওনি করিডোর বা ভার্সিটির যেকোনো জায়গায় দেখা হলে শিক্ষার্থীদের দু’টি প্রশ্ন করে। কেমন আছো আর কই যাচ্ছো।
আজও ব্যতক্রম হলো না। উনি সালামের জবাব দিয়ে প্রশ্ন করলেন আয়নাকে উদ্দেশ্য করে। এরপর সমুদ্রকে খেয়াল হলো। সমুদ্র পোশাক-আশাক দেখেই বোধকরি বুঝলেন ছাত্র না। পুনরায় জিজ্ঞেস করলো, “কে তুমি বাবা?”
সমুদ্র একবার আয়নার দিকে তাকায়। এরপর নিজ থেকে ই সুন্দর করে সালাম দিয়ে যথেষ্ট ভদ্রভাবে বলে, ” স্যার আমি আয়নার স্পাউজ।”
স্যার শুনে বেশ খুশি হলেন৷ ছাত্র-ছাত্রীদের তিনি নিজের সন্তান সমতুল্য ভাবেন। ওদের সুখী পরিবার দেখে ভালোই লাগে৷ তাদের দাম্পত্য জীবন যেন সুখময় হয় সে দুয়া দিলেন।
এরপর জিজ্ঞেস করলো, ” বাবা তুমি কিসে পড়ছো? তুমিও ইঞ্জিনিয়ার নাকি?”
–” না স্যার, আমি ম্যাককুয়ারি ইউনিভার্সিটি (Macquarie University) , সিডনি, অস্ট্রেলিয়া থেকে মেডিকেল সাইন্স নিয়ে পড়েছি।”
–” মাশাল্লাহ। তুমি তো তাহলে আমাদের সিএসই ডিপার্টমেন্টের জামাই। আবার এসো কেমন? জামাই বলে কথা।”
স্যার যেতেই সমুদ্র শব্দ করে হেসে প্রায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এরপর বলে, ” ইন্টারেস্টিং তো! ”
চলবে।
#ইলেকট্রিক্যাল_মন
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–21 (বোনাস)
পিচঢালা রাস্তার উপর দিয়ে গাড়ি শাইশাই করে এগিয়ে যাচ্ছে। সমুদ্র মনোযোগ সহকারে ড্রাইভ করছে। পাশের সীটে চুপটি করে বসে আছে আয়না। ওর মধ্যে কোনো হেলদোল নেই। বাসায় ফেরার তাড়াও নেই। বরং বাসায় ফিরতে না পারলেই স্বস্তিবোধ করবে। সমুদ্র কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সে ব্যাপারে কিছু ই জিজ্ঞেস করেনি। কোথায় বা সর্বোচ্চ নিয়ে যেতে পারবে? নরকে? ওই নরকের কারারুদ্ধ গুমোট পরিবেশ তো নিজের বাসাতেই বিরাজমান। আয়নার চোখ বুজে আসছিলো। সমুদ্র একবার ওর দিকে তাকায়। এরপর সুধালো, ” ঘুম পাচ্ছে?”
আয়না হচকচিয়ে উঠে। এরপর বলে, ” না।”
–” ভেবেছিলাম তোমাকে নিয়ে ঘুরবো কোথাও। দেন লাঞ্চ করবো। বাট মিটিং আছে। এখন কিন্তু মিটিংয়ে যাচ্ছি। মিটিং শেষ করে লাঞ্চ করে বাসায় পৌঁছে দিবো।”
আয়নার একবার বলতে মন চাইলো বাসায় যাবো না। গাড় থামান কিন্তু শরীরে জোড় পায় না। কেমন ক্লান্ত লাগছে। সমুদ্র বার কয়েক আয়নার দিকে তাকায়। যতোবারই ওকে দূর থেকে অফিসে দেখেছে, মেয়েটা এতো নিশ্চুপ স্বভাবের না। সবসময় একটা চঞ্চলতা ভাব থাকে ওর মধ্যে। অফিসে প্রায় সবার সঙ্গে ওর ভাব। সবার সঙ্গে কাজ বাদ দিয়ে খালি গল্প করে। সেই মেয়ে নিশ্চয়ই বড় আঘাত পেয়েছে বিধায় এতো নিশ্চুপ। সমুদ্রের অনুতপ্ততার মাত্রা সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। কেন সে নিজের অতীত টেনে এনে বর্তমান কে কষ্ট দিলো? কেন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি! তার একটা ভুল কাজের জন্য এখন দু’জনকেই পোহাতে হচ্ছে। অন্যকে দুঃখ দিয়ে কোনোভাবে সে সুখে থাকতে পারেনা। অন্যরা অবশ্য পারে কিন্তু সমুদ্র পারেনা। নিজের কাছে নিজেই ছোট হয় খুব। আয়নাকে ওভাবে বাজে ভাবে ট্রিট করার পর সে এতো পরিমাণ গিল্ট ছিলো, সর্যি বলেও কাজ হলো না। তাদের সম্পর্ক এখন কেমন জানি নড়বড়ে হয়ে উঠেছে। বাবুই পাখির বাসার মতো। ঝড়ে যেকোনো সময় ভেঙে যাবে কিন্তু দূর থেকে সুন্দর, পরিপাটি। এমনটা সে কোনোদিন আশা করেনি। আয়নাকে কখনো ইউশার সঙ্গে সে মনের ভুলেও তুলনা করতে চায় না। করবেও না ভবিষ্যতে। কিন্তু ওইদিন কি যে হলো সমু নামটা শুনতেই গা জ্বালা দিয়ে উঠে। তার অতীত যে বড্ড কালো। ওমন কালোকে কেউ স্মরণ করতে চায় না।
সমুদ্রের গাড়ি থামে গুলশান ১ এর একটা অফিসের সামনে। তখন চারটার বেশি বাজছিলো। আয়নাকে নিয়ে দশতলায় লিফটে উঠে পড়ে ও। আজকে রুহুল সাহেবের সঙ্গে আলোচনা করবে আপকামিং প্রোজেক্ট নিয়ে। বহুতলা ভবনের অফিসটা সম্পূর্ণ কাঁচে ঘেরাও করা। কাঁচের ভেতর গলিয়ে সূর্যের রশ্মি এসে ঝিলিক মারছে। ওই কাঁচের প্রতিবিম্বতে আয়নাকে দেখতে পায় সমুদ্র। ওকে এক প্রকার ক্লান্ত, বিধ্বস্ত লাগছে। নাকফুল টা এখনো জ্বলজ্বল করছে। কেমন মায়া কাজ করে৷ দায়িত্বের দ্বিঘাত সমীকরণের দু’টি মূলের মধ্যে তো মায়া নেই। তাহলে মায়া কেন কাজ করলো? হয়তো ওর মনে দুঃখ দিয়েছে জন্য বৈকি!
কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা যখন আলোচনার জন্য মিটিং বসায়, সেখানে লাক্সারি থাকে। সমুদ্র জানিয়ে দিয়েছিল তারা দু’জন আসছে। মিটিংয়ের গোল টেবিলে দু’টো চেয়ার বরাদ্দ। নামসহ লেখা দেওয়া আছে কে কোথায় বসবে। আয়নার চেয়ার, সমুদ্রের পাশেরটায়। সমুদ্র একদম একপ্রান্তে। আয়নার পাশে কোনো একজন যার নাম আবুল শাখাওয়াত। সমুদ্র তড়িঘড়ি করে আয়নার আগে গিয়ে ওর চেয়ারে বসে পরে। আয়না অবাকের চূড়ান্ত সীমায় অবস্থান করে বলে উঠে, ” হ্যালো, স্যার এটা আমার চেয়ার৷ আপনি কেন বসেছেন এখানে।”
সমুদ্র দ্রুত নেমপ্লেটে এক্সচেঞ্জ করে দেয়। আয়নাকে নিজের অবস্থানে বসতে দিলো।
আয়না ফের জিজ্ঞেস করলো, ” এটা কি হলো?”
সমুদ্র বিড়বিড় করে বলে, ” কোনো আবুইল্লার পাশে আমার বউকে বসাবো না!”
আয়না ধপ করে ওর পাশের চেয়ারে বসে। মিটিং চলমান অবস্থায়। সবাই ব্যস্ত ভঙ্গিতেই প্রোজেক্টরের সামনে চোখ রেখেছে। কিছুক্ষণ পর সমুদ্রের প্রেজেন্টেশন আছে। সে সব গুছিয়ে নিচ্ছে। এমন সময় দেখলো আয়না একটু পরপর পা নাড়াচ্ছে। এই অভ্যাস অনেক মানুষেরই আছে। কিন্তু কেউ পা নাড়ালে সমুদ্রের কেমন জানি লাগে৷ মাথা ঘুরায়। সে আস্তে করে ফিসফিস করে বলে, ” এই পা নাচানো বন্ধ করো।”
আয়না ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকিয়ে বলে, ” হুয়াই?”
–” আমার অসুবিধা হয়।”
–” আমার মজা লাগে। সো থামাবো না।”
–” কাউকে পা নাচাতে দেখলে আমার মাথা ঘুরে, বমি পায়।”
আয়না নিচু গলায় বলে, ” সেকি আপনি ছেলে হয়েও অন্যকে পা নাচাতে দেখলে প্রেগন্যান্ট হন? সব লক্ষণ তো ওমনই।”
সমুদ্র দাঁতে দাঁত চেপে উঠে দাঁড়ালো। টাইটা একটু লুজ করে প্রেজেন্টেশন দিতে সামনে যায়। প্রেজেন্টেশন ভালো মতোই দেয়। চলনসই। এরপর গিয়ে নিজের চেয়ারে বসে। আয়না তখনও পা নাড়াচ্ছিলো। এটা ওর একটা বদ অভ্যাস। কাজ করতে করতে আনমনে পা নাড়ায় সে। আজও ব্যতিক্রম নয়। নোটে সব টুকে নিচ্ছে আর পা নাড়াচ্ছে৷ এমন সময় ফিল হলো কেউ তার পায়ে গুতা দিলো। সঙ্গে সঙ্গে নড়েচড়ে উঠলো এবং আশেপাশে তাকায়। সমুদ্র তার পাশেই একদম নর্মাল হয়ে বসে আছে। আয়না একটু নিচু হয়ে দেখে এটা সমুদ্রের ই পা। ও চোখ গরম করে তাকায়। কিন্তু সমুদ্র অন্যদিকে তাকিয়ে তার পায়ে গুতা দিচ্ছে৷ কেমন বজ্জাত ছেলে! আয়না নিজের পা সরিয়ে নিলো। এরপর দু’মিনিট পর পুনরায় সমুদ্র তার পায়ে পা ঘঁষে এবং আস্তে করে বলে, ” পা নাড়াতে মানা করলাম আর আমাকে শেষমেশ প্রেগন্যান্ট বানিয়ে দিলে। এখন দেখি কেমনে পা নাচাও।”
সে নিজের এক পা দিয়েই আয়নার দু’ পায়ের উপর ভর দিলো যেন তার পা নাড়াতে না পারে। একটা মানুষের পাও এতো ভারী হয়। মনে হচ্ছে ইটের বস্তা পায়ের উপর রেখে দিয়েছে কেউ। আয়নাও কম যায় না৷ সে পেছন থেকে হাত বাড়িয়ে সমুদ্রের পিঠে এতো জোড়ে চিমটি কাটে। সমুদ্র এটার জন্য প্রস্তুত ছিলো না। সে ‘আইয়া’ বলে চিল্লিয়ে উঠে। সবার দৃষ্টি ওর দিকে যায়। ভীষণ ভ্যাবাচেকা খায় ও। এতো ভারী লজ্জার বিষয়বস্তু! কি বলবে ভেবে পায় না৷
আয়না ওকে সাহায্য করে। বলে উঠে, ” ওনার পায়ের রগ নড়ে গেছে এজন্য ব্যথা হচ্ছে।”
সমুদ্রও তাল তাল মিলিয়ে সম্মতি দেয়। আদৌ পায়ের রগ নড়ে যাওয়া বলে কোনো রোগ আছে কীনা খেয়াল ই আসছে না। তবে আয়না এখনো হাত দিয়ে চিমটি দিয়েই যাচ্ছে। ব্যথায় পিঠ কুচকে যাচ্ছে তার৷ একদম ম্যাসেলে চিমটি কেটেছে।
সে আস্তে করে ফিসফিস করে বলে, ” ভুলেও আর আমাকে ডিস্টার্ব করবেন না। মনে থাকে যেনো?”
–” আচ্ছা। চিমটি কাটা বন্ধ করো।”
–” অফিসের মধ্যে আর বিরক্ত করবেন না এটাও মনে রাখেন।”
–” ওকে ফাইন।”
আয়না শেষ সময় ইচ্ছা করে একটু জোরে চিমটি দিয়ে হাত সরিয়ে নেয়।
মিটিং শেষে সমুদ্র নিজের পা’জোড়ার দিকে তাকালো। পায়ের রগ গুলো ঠিক আছে কীনা দেখে নিলো। দশতলা থেকে নিচে নামার জন্য লিফটে উঠে। লিফটে তারা দুজনেই ছিলো। লিফটের দরজা বন্ধ হতেই সমুদ্র আয়নার হাত ধরে নিজের দিকে টেনে এনে ওর ডান গালে একটা চু–মা দেয়। আয়নার চোখ বড় হয়ে যায় আপনা-আপনি। সঙ্গে সঙ্গে লিফট খুলে আটতলায়। দু’জনে দু’দিকে ছিটকে পড়ে। কিন্তু লিফটের দরজার সামনে কেউ ছিলো না। সমুদ্র দ্রুত গেইট অফ হওয়ার বাটন ক্লিক করে। লিফট অফ হয়ে চলতে শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে আয়নার গায়ের সঙ্গে মিশে ওর পিছে দাঁড়িয়ে চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে, আয়নার বাম গালে আরেকবার কিস করে ওর পেছনে দাঁড়িয়ে থেকেই বলে, ” প্রেগন্যান্ট মেয়েরা হয়। বিশ্বাস না হলে, বাস্তব উদাহরণ দিয়ে দেখাতে পারি।”
ওমনি ছয়তলায় লিফট থামে। সমুদ্র ভেবে নেয়, এবারো কেউ আসবে না। তাই সরে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত দুইজন মাঝবয়েসী ভদ্রমহিলার সামনে লিফটের দরজা খুলে। দ্রুত সমুদ্র উলটা ঘুরে যায়। ভাবখানা এমন যেন খুব গম্ভীর ভঙ্গিমায় মশা মারছিলো। লিফটের দেয়াল মিরর দিয়ে বানানো। কাজেই সমুদ্রের রিয়াকশন পুরাটাই আয়না দেখে ফেলে।
সমুদ্র বলে উঠে, ” আন্টি কিছু মনে করবেন না। মশা মারছিলাম৷ ডেঙ্গুর সিজন৷ আপনাদের জন্য ই মশা মারলাম৷ কামড়ালে আপনাদেরই কামড়াবে। নাহলে নারীর জাত মশকী কে মারার ইচ্ছা ছিলো না। ”
মাঝবয়েসী মহিলা দুটি ভ্রু কুচকে লিফটে উঠে মন্তব্য করা শুরু করে, ” আজকালকার ছেলে-মেয়ে গুলো এতো বেয়াদব। কোনো ধৈর্য নাই। হায়া নাই। এ যুগের মেয়েগুলো আরোও বেশি বেহায়া৷ ”
স্পষ্টত আয়নাকে মিন করেই বললেন। সমুদ্রের রাগ হয় অনেক। কিছু বলার আগেই ওরা নেমে পড়ে৷ সে রাগে গজগজ করতে করতে বলে, ” আয়না ওদের তুমি কিছু বললে না কেন?”
–” ভুল কি বললো তারা? অভদ্রতাই তো করছিলেন।”
–” আজব, আমি জানতাম কি এনারা আসবে এই মুহূর্তে। ”
–” এখন দোষটা ওদের? লিফটে করে মানুষ উঠা-নামা করে। আপনি ফাতরামি করলেন কেন?”
সমুদ্র এবারে চৌদ্দতলার এক কফি শপে বাটন ক্লিক করে। আয়না নামতে ধরলে তাকে আটকে দেয়৷
আয়না বলে, ” চৌদ্দ তলায় যাবেন তো গ্রাউন্ড ফ্লোরে কেন আগে বাটন চাপ দিলেন? লিফট ব্যবহার করতে পারেন না? নামতেও দিচ্ছেন না। ”
— সিডনি নামক গ্রাম থেকে এসেছি তো তাই লিফট আজকেই প্রথম চোখে দেখলাম ৷ সর্যি। তাছাড়া ইঞ্জিনিয়ার ও না আমি, এইজন্য এইসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার কম বুঝি৷ ”
আয়নার জাস্ট সমুদ্রের অতিরঞ্জিত আদিখ্যেতা সহ্য হয় না। মনে চায় ওর চুল সব ছিঁড়ে টাকলা বানিয়ে দিতে। তোমার যদি এতোই দরদ থাকত তাহলে ওইদিন এতো রুড হতে না। ওইদিনের কথা কোনোদিন ভুলবে না আয়না৷
সে এবারে সমুদ্র থেকে দূরে সরে দাঁড়িয়ে বলে, ” আপনাকে জাস্ট আমার বিরক্ত লাগছে। লিফটে কেন এসব করলেন?”
–” তুমি ই তো বললে অফিসে কিছু না করতে। এজন্য লিফটে একটু রোমান্স করতে চাইলাম। পছন্দ করলে না।”
……..
সমুদ্র কফি শপে বসে একটাই কফি অর্ডার দেয় । ওয়েটারের সামনেই মেন্যু কার্ড দেখে বলে, ” একটা ভ্যানিলা ল্যাটের দাম সাড়ে পাচ’শ। এতো কেন দাম?”
–” কোয়ালিটি ভালো স্যার। ”
–” কেন ?আপনাদের গরু কী অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছে যে গরুর দুধের কোয়ালিটি বেশি ভালো?”
–” জি স্যার। অস্ট্রেলিয়ান গরুর দুধ। আমাদের খামারের গরু।”
–” একটা কফি-ই দেন।”
আয়নার তো লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। লোকে ঠিক বলে, মানুষ যতো বড়লোক হয়, ততো কৃপন হয়৷ একটা কফিই দু’জন শেষ করে উঠে পরে৷
সমুদ্রের একবার ইচ্ছা করলো আয়নার হাত ধরে তাকে সর্যি বলে নিজের অতীতের সব বলে দিতে৷ কিন্তু কোনো এক দ্বিধায় সেটা পারেনা।
________________________
আয়না বাসায় আসতেই একটা দুঃসংবাদ শুনলো। তার দাদাভাই নাকি হুট করে আরোও অসুস্থ হয়ে গেছে। কাশছে খুব। গায়ে জ্বর। সে ফ্রেশ হতে গিয়ে থেমে দাদীকে জিজ্ঞেস করলো, ” মেডিসিন নিয়েছে?”
–” হ্যাঁ, একটু আগেই খাওয়ায় দিলাম।”
দু’ঘন্টা হওয়ার পরও অবস্থার আরোও অবনতি হয়। দাদাভাই কাশতে কাশতে শ্বাস নিতে পারছে না এমন অবস্থা। কাশতে কাশতে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল একবার৷ বাসায় কোনো পুরুষ ও নেই। আয়না, আলিয়া দুজনেই একপ্রকার কেঁদে ফেলে। আয়না ওর দাদা-দাদী কে খুব ভালোবাসে। ওনাদের কিছু হলে সহ্য হয় না।
আয়না বলে উঠে, ” দাদা হাসপাতালে চলো। ”
–” না না বুবু। ঠিক হয়ে যাবে। হাসপাতালে যাবো কেন? তোমার আব্বু নাই বাসায়। ড্রাইভার ও তো নাই। ”
–” এভাবে থাকলে সারারাত কষ্ট পাবে। তার চেয়ে বরং আমি নিয়ে যাই।”
দাদাভাইয়ের এক কথা সে হাসপাতালে যাবে না। আয়না বাবাকে ফোন দিয়ে জানালো। তারা ভীষণ চিন্তায় পড়ে। বাসাতেই ফার্মেসির লোক ডেকে নেবুলাইজার দেওয়ালো। তাও শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। রাত হয়ে গেছে। কীভাবে কি করবে বুঝতে পারছে না। উবার কল দিচ্ছে। উবারও আসে না। দাদাভাইও যাবেন না বলে দিয়েছে। বাসায় কোনো পুরুষ নাই। সে এভাবে দুটো মেয়ে নিয়ে রাত বারোটার পর বের হবেন না। আয়না কান্নাকাটি করে অনেক অনুরোধ করে কিন্তু সেকালে চিন্তা-ভাবনার তোফাজ্জল সাহেব এতোরাতে বের হতে রাজী হন নি।
এমন সময় সমুদ্রের কল আসে। আয়না রিসিভ করতেই ও বলে উঠে, ” আমি তোমার বাসার গলির সামনে। বাসায় আসতে চার মিনিট ও লাগবে না। এসে দেখছি কী অবস্থা। জরুরি মনে হলে হসপিটালে শিফট করবো। টেনশন নিও না৷ ”
–” আপনি এসে কি দেখবেন আর কে বললো আপনাকে দাদাভাইয়ের কথা?”
–” বাবা ফোন দিয়ে জানালো। ”
এই প্রথম সমুদ্র ফাহাদ সাহেবকে আংকেল না বলে বাবা বলে সম্মোধন করে। আয়না বুঝি তা খেয়াল করলো না৷
আয়নার একটু হলেও স্বস্তিবোধ হয়। উনি আসছেন তবে! বাবা জানিয়েছে ওনাকে৷ আয়নাদের বিপদে রাত বারোটার পরও উনি ছু’টে আসছেন!
চলবে।
#ইলেকট্রিক্যাল_মন
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–22
সমুদ্র যখন আয়নার বাসায় পৌঁছে তখন ওলরেডি বারোটার বেশি৷ কলিং বেল দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আয়না গিয়ে ছু’টে গেইট খুলে দেয়। ওইসময় আয়নার অবস্থাও করুণ। সে ভীষণ অস্থির হচ্ছিলো। চোখ ভেজা। এমতাবস্থায় সমুদ্রকে দেখামাত্র ভীষণ শান্তি বিরাজ করে মনে। এতোদিনের মান-অভিমান, রাগ সবটা একপাশে রেখে, কিংবা প্রায় ভুলে গিয়ে, সমুদ্রকে জড়িয়ে ধরে সশব্দে ডুকরে কেঁদে উঠে।
সমুদ্র বাসার বাইরে দাঁড়িয়ে থেকেই ওকে আলতো করে জড়িয়ে নেয়। ওর খুব অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো। কেমন জানি হুহু করে উঠে বুকটা। সে নিজেকে সামলে নেয়। এরপর শুধু বললো, ” আছি-ই তো।”
আর কোনো বাক্য কিংবা শব্দ উচ্চারণ করে না। আয়নার বাহু ধরে নিজের থেকে একটু দূরে সরিয়ে মুচকি হেসে সামনে পা বাড়ায়। ওই মুচকি হাসি যেন জানান দিচ্ছিলো আমার উপর ভরসা রেখো৷ আমি আছি তো বাবা৷
এরপর তোফাজ্জল হোসেনের পাশে এসে দাঁড়ালো। ওনাকে পরখ করে দেখে নেয়। অবস্থা ভালো না। হাসপাতালে নিলে ভালো হয়। সবটা চিন্তা করে, তারপর বলে উঠে, ” দাদাভাই চলেন একটু হাসপাতাল যাই।”
তোফাজ্জল সাহেব সামান্য ভয় পেয়ে উঠে বলে, ” ডাক্তার সাহেব, হাসপাতালে যেতে হবে কেন? আমি একদম ঠিক আছি।”
–” হাসপাতালে একটু ঘুরে আসেন। ডাক্তার দেখায় আনি। আসেন। ঠিক আছেন সেটা তো জানি। আরোও ঠিক থাকার জন্য ডাক্তার দেখানো লাগবে।”
তোফাজ্জল হোসেনের কষ্ট হচ্ছিলো বেশ। কিন্তু বাড়িতে কোনো পুরুষ নেই আজ। দু’টো ছোট বয়সী নাতনি নিয়ে এতো রাতে বের হওয়া বিপদ জন্য রাজী হচ্ছিলেন না। কিন্তু নাতনী জামাই ডাক্তার। নিজে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। উনি খুব খুশি হন। এই যুগের ছেলে-মেয়ে গুলো এতো ভালো!
সমুদ্র ওনার বাহু ধরে দাঁড় করিয়ে দেয় এবং বললো, ” আমি আর আয়না যাই ওনার সাথে। আলিয়া আপু, তুমি তোমার দাদীর সাথে বাসায় থাকো।”
আলিয়া উত্তর দেয় না কোনো, নীরবে সায় দিলো। আয়নাকে সঙ্গে নিয়ে আগে যেই হাসপাতালে কাজ করতো, সেদিকে ছু’টে। নামীদামী প্রাইভেট হাসপাতাল। চব্বিশ ঘন্টাই খোলা। অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তি আর সুবিধা দেওয়া হয় রোগীদের, তবে প্রাইভেট হওয়ায় খরচ অনেক বেশির অভিযোগ প্রায় উঠে আসে শিরোনামে। হাসপাতালে ইমার্জেন্সিতে নেওয়ার পর কয়েকটা টেস্ট করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে ফুসফুসের সমস্যা দেখা গেলো। ফুসফুসে পানি জমেছে। অক্সিজেন লাগতে পারে, রিক্স হতে পারে ভেবে ভর্তি করিয়ে দেয়। সবকিছু সমুদ্রই করে। আয়না শুধু দাঁড়িয়ে ছিলো৷ কেবিনে শিফট করার পর, উনাকে ঘুমের ঔষধ দেওয়া হয়। দুর্বলতার কারণে তোফাজ্জল সাহেব ঘুমিয়ে পরে।
সমুদ্র তখন আয়নার পাশে সোফা বসে বলে, ” তুমি বাসায় যাবে?”
–” আমি বাসায় গেলে দাদার সঙ্গে থাকবে কে? একা ফেলে যাবো নাকি!”
–” না, না। আমি থাকবো তো। তুমি যাও৷ তোমাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। কান্নাকাটি করে কী হাল করেছো।”
–” আমি যাব না৷”
–” আচ্ছা তাহলে সোফায় শুয়ে রেস্ট নেও কিছুক্ষণ।”
যদিও বা ডাক্তার বলেছে চিন্তার কারন নেই। তারপরও আয়নার খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে। সে সোফায় গুটিসুটি মেরে শু’য়ে পরে। ক্লান্ত থাকায় চোখ লেগে আসে তার। কিছুক্ষণ পর চোখ মেলে তাকালো কোনোকিছুর শব্দে। তৎক্ষনাৎ উঠে বসতেই চোখের সামনে সমুদ্রকে দেখলো। দাদাভাইকে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে কিসব করছে বা বলছে। আয়না অস্থির পায়ে ছু’টে যায়।
সমুদ্র তাকে দেখামাত্র বলে উঠে, ” উঠে গেলে কেন?”
–” দাদাভাইয়ের কী হয়েছে সমুদ্র? ”
–” নিশ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছিলো। এখন ঠিক আছে।”
আয়নার এতোটুকুতেই ওভার প্যানিক এটাক শুরু হলো। আরেকদফা কান্না শুরু করে দেয়। তখনই নার্স আসলো। এসেই বললো, ” পেশেন্টের কী অবস্থা এখন ভাইয়া?”
–” বেটার। আরিফা আপা আপনি যান। আর আসা লাগবে না। আমি দেখবো বাকিটা।”
–” না। সমস্যা নাই। ডিউটিতে আছি। আমাকে ডাকবেন। ”
এরপর আয়নার দিকে তাকায়, তারপর বলে, ” ভাবী জেগে গেছেন। ভাইয়া বলছিলো কাঁদতে কাঁদতে আপনিই নাকি কালকে রোগী হয়ে ভর্তি হবেন।”
তারপর অমায়িক একগাল হেসে দেয়৷ সমুদ্র অক্সিজেন মাস্ক খুলে দিয়ে তোফাজ্জল সাহেবকে বেডে শু’ইয়ে দিয়ে বলে, ” কেমন লাগছে এখন?”
–” একটু আরাম পাইলাম ডাক্তার সাহেব। ”
–” আচ্ছা। ”
এই হাসপাতালের ডিউটিরত নার্স আরিফা আপা এসে আরো কিছু চেক করলো। প্রেশারও মাপলো৷ আগে যখন সমুদ্র ডাক্তার হিসেবে কাজ করত আরিফা আপার সঙ্গে খাতির ছিল বেশি। এখন চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। তবুও আপা কিছুক্ষণ পরপর এসে দেখে যাচ্ছেন৷
তোফাজ্জল সাহেবকে মনমরা আর খানিক ভয়ার্ত অবস্থায় দেখে নার্স বলে উঠে, ” বাবা, দ্রুত সুস্থ হতে হবে। শক্ত হন। ভয় পাওয়ার কিছু নাই। সুস্থ হয়ে কালকেই হাঁটাহাঁটি করবেন।”
তোফাজ্জল সাহেব ভারাক্রান্ত মনে বলে, ” বয়স হয়ে গেছে। আর কতোক্ষণই বা বাঁচবো। এক জীবনে সব দেখা শেষ, মা। নাতনিও দেখলাম, নাতনিজামাইকেও দেখলাম।”
নার্স বলে উঠে, ” নাতনির বাচ্চা-কাচ্চাকে স্কুলে নিয়ে যাবেন-আসবেন। কতো কাজ বাকি।”
সমুদ্র ওইসময় আয়নার পানে তাকালো। আয়না সঙ্গে সঙ্গে চোখ ফিরিয়ে নেয়। সমুদ্র নার্সের কথায় হাল্কা হাসে৷ কিন্তু কিছু বলে না।
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আয়নার দাদা গভীর ঘুমে তলিয়ে যান। তখন সমুদ্র ক্যান্টিন থেকে খাবার অর্ডার দেয়৷ খাবার আসলে জোর করে আয়নাকে বসিয়ে নিজে ওর পাশে বসে বলে, ” খেয়ে নাও। নাহলে কালকে তোমাকেও ভর্তি করাতে হবে৷”
–” খেতে ইচ্ছে করছে না৷”
সমুদ্র ওর কোনো বারণ শুনে না। ভাতের প্ল্যাটারটা তুলে নিয়ে ভাতের সঙ্গে তরকারি মাখিয়ে বলে, ” হা করো। খাইয়ে দিচ্ছি৷”
আয়না মুখ ঘুরিয়ে নেয়। ও অপর হাত দিয়ে থুতনিতে রেখে তার দিকে মুখটা এগিয়ে এনে বলে, ” আমি সেকেন্ড কোনো পেশেন্ট হ্যান্ডেল করতে পারবো না। চুপচাপ খেয়ে নেও।”
শেষের কথায় ধমকের অভাস পায় আয়না৷ এরপর একপ্রকার জোর করে খাইয়ে দেয় ওকে।
সমুদ্র বলতে থাকে, ” রোগীর সঙ্গে যারা আসে, ওদের নিজের খাওয়া ঠিক রাখতে হয়। উলটা বেশি খাওয়া দরকার, এনার্জি বেশি লাগে৷ না খাইলে এনার্জি পাবে কই?”
–” তাহলে আপনি খাচ্ছেন না কেন?”
সমুদ্র হাল্কা হেসে উত্তর দেয়, ” আমার কথায় আমাকেই ফাসাও। ”
আয়না পুনরায় বলে, ” আপনি ও খান। নাহলে আমি আর খাবো না।”
সমুদ্র উপায় না পেয়ে, প্লেট থেকে এক লোকমা তুলে, নিজের মুখে নেয়। এরপর আয়নাকে আবার খাইয়ে দেয়। তারপর বলে উঠে, ” কোথায় যেন শুনেছি, জুটা খেলে ভালোবাসা বাড়ে।”
আয়না কাঠ গলায় বলে, ” আপনার ভালোবাসা বাড়বে না।”
–” তোমার সাথে ঝগড়া করাটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো।”
আয়না উঠে যেতে ধরছিলো, সঙ্গে সঙ্গে হ্যাচকা টানে সমুদ্র ওকে বসিয়ে দিয়ে বলে উঠে, ” কপাল ভালো তোমার যে, আমার ধৈর্য্য শক্তি অসীম। ছোট থেকেই সবাই বলে আমার নাকি ধৈর্য্য অনেক। এখন বুঝতেছি তোমারে সামলানো লাগবে সারাজীবন এজন্য এতো ধৈর্য্য দিসে আল্লাহ তায়ালা।”
আয়নাকে কিছু বলার সুযোগ দিলো না। মুখে এক লোকমা ভাত পুড়ে দেয়৷ এরপর থেমে থেমে বলে, ” আমাকে রোবট বলো! নিজে কী মেয়ে? মেয়ে, তোমার মনটা পুরোপুরি যেন ই-মন।”
আয়নার ততোক্ষণে খাওয়া শেষ। সে ভ্রু কুচকে বলে উঠে, ” ই-মন আবার কী?”
–” ইলেকট্রিক্যাল মন৷ তোমার মধ্যে আদৌ মায়া-দয়া আছে? থাকলে এতোক্ষণে আমাকে ক্ষমা করে দিতে৷ ইলেকট্রিক্যাল মন যার, তার মনে মোহাব্বত-ইশক থাকবে এটা আশা করাই তো ভুল৷ ইলেকট্রিক্যাল মনে থাকবে কিছু সার্কিট আর লাল-নীল তার, তাও আবার ছেঁড়া তার। এজন্য দয়া-মায়া কিচ্ছুটি নেই তোমার মধ্যে।”
আয়না ভ্রু কুচকে বসে রইলো। একটা মানুষ এতো আজাইরা কথা কীভাবে বলতে পারে? হতভম্ব হয়ে যায় সে। ইলেকট্রিক্যাল মন বলেও কিছু আছে জানা ছিলো না। তার মন কী আসলেই ইলেকট্রিক্যাল মন!
______________________
পরের দিন ইকো টেস্টে ধরা পরলো তোফাজ্জল হোসেনের হার্টে পানি জমেছে৷ সমুদ্র নিজে যেহেতু ভবিষ্যতে কার্ডিওলজি নিয়ে স্টাডি করার পরিকল্পনা করছে সে সুবাদে হাসপাতালের বড় বড় কার্ডিওলজিস্টদের সঙ্গে সখ্যতা আছে৷ তাছাড়াও এখানকার সবাই খুব ভালো, সার্পোটিভ৷ সমুদ্র একাই ডাক্তারদের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলো দুপুরেই অটিতে নিতে। ফাহাদ সাহেব আসতে চাচ্ছেন।তবে ওনার আসতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে৷ সমুদ্র নিশ্চয়তা দিয়ে বলে সে যেহেতু আছে, অসুবিধা নেই। তবুও অটির আগ মুহূর্তে শায়লা চৌধুরী আসলেন৷ আব্বু-আম্মুও আসতে চাইছিলো। সমুদ্র মানা করেছে। বাবা নিজেও হার্টের পেশেন্ট। রিং পড়াতে হয়েছে। আরেক অটি পেশেন্ট দেখে এক্সট্রা টেনশন দেওয়ার মানে হয় না৷ এম্নিতেই আব্বু-আম্মু সরল, সাদাসিধা, নরম মনের। দুইজনের পরে ভয় পাবে। অতিরিক্ত চিন্তা করবে৷ আগে পরিবার নিয়ে এতো ভাবতো না। বিয়ের পর থেকে ফ্যামিলি নিয়ে অনেক ভাবা শুরু করেছে৷
ইন ফ্যাক্ট, আলিয়া ছোট এজন্য ওকেই আসতে দেয় নি। ওদের দাদীর নাকি অস্থিরতায় প্রেশার বেড়ে গেছে। দুইজনেই বাসায় আছে। এখানে এসে আরোও অসুস্থ হওয়ার মানে হয় না। তার উপর প্রাইভেট হসপিটালের কিছু নিয়ম আছে। পেশেন্টের সঙ্গে বড়জোর দুই-তিন জন এলাউ করে। রাতে মাত্র একজন পারবে পেশেন্টের সঙ্গে থাকতে।
সে গিয়ে শায়লা আন্টির সাথে কিছু কথা বললো। অটি করে সিসিইউ তে নেওয়া হয়। সেখানে কেউ এলাউ না। কাজেই সবাই যে যার বাসায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সমুদ্রের অফিস যেতে হবে। না গেলে হচ্ছে না। খুবই জরুরি কাজ আছে৷
তখন শায়লা আন্টি বলে, ” আমি আয়নাকে নিয়ে যাচ্ছি। তুমি অফিসের কাজ সেরে নিজে বাসায় গিয়ে লম্বা ঘুম দিবে। কী ক্লান্ত লাগছে তোমাকে। বাসায় গিয়েই সোজা ঘুম দিবে। নাহলে আমি কিন্তু অনেক বকা দিবো। ”
সমুদ্র হাল্কা হাসলো। আয়না একবার সমুদ্রের দিকে তাকায় আসলেই গতকাল রাতে সে নিজে সোফায় ঘুমিয়ে যায়। কিন্তু সমুদ্র চেয়ারেই বসে রাত কাটিয়ে দিয়েছে। আয়নার ভীষণ অনুতপ্তবোধ হলো। পুরা রাত তার ঘুমানো ঠিক হয় না। তার দাদা অসুস্থ। সে জেগে সেবা করবে। কিন্তু উলটা হলো সমুদ্রই রাত জাগলো। তবে, আয়না ক্লান্ত সুরে বলে, ” আমি একা যেতে পারবো বাসায়। সমস্যা হবে না।”
সমুদ্র সঙ্গে সঙ্গে বলে, ” না। না। একা যাওয়া যাবে না। তাহলে আমিই নামিয়ে দিয়ে অফিস যাই। লেইট হবে একটু। অসুবিধা নেই। ”
শায়লা চৌধুরী তখন আয়নাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” তোমার স্বামী তোমাকে একা ছাড়বে না। ওকে আর চাপ দিও না। ওলরেডি ও ক্লান্ত। তারচেয়ে বরং আমার সঙ্গে আসো। আমি এমনিতেও তোমাদের বাসায় যাবো। দু’জন একসাথে যাই। আসো।”
আয়না সমুদ্রের দিকে একপল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে৷ ও তার উত্তরের অপেক্ষায় আছে। আয়না মানা করলে নিশ্চয়ই ওকে ড্রাইভ করে নিয়ে যাবে৷ ওকে আর কষ্ট দিতে চায় নাহ। তাই রাজী হয়ে যায়৷ যদিও একদম ইচ্ছা ছিলো না শায়লার সঙ্গে যাওয়ার। কিন্তু মহিলা তার বাসায় কেন যেতে চায়?
গাড়িতে উঠার সময় শায়লা আন্টি আয়নার সঙ্গে গাড়ির পেছনে বসে। ড্রাইভার ড্রাইভিং করছেন৷
শায়লা চৌধুরী বলে, ” তোমার দাদা ঠিক আছে। ওই বিষয় নিয়ে আর ভাবতে হবে না। আব্বুও সন্ধ্যার মধ্যে চলে আসবে।”
আয়না কিছু বলে না। এরপর হুট করেই শায়লা চৌধুরী ওর মাথায়, চুলে হাত বুলাতে থাকে। যা আয়নার তেমন একটা পছন্দ হলো না।
সে বলে উঠে, ” সমুদ্র তোমাকে নিয়ে বেশ কনসার্ণ দেখছি। তোমার স্বামী তোমার জন্য অনেক করেছে।”
–” হুম।”
–” স্বামীভাগ্য ভালো তোমার।”
আয়না জবাব দেয় না। খানিক পরে শায়লা চৌধুরীই বলে, ” জানো মেয়েদের জীবনে কোন দু’টি জিনিসে বেশি নজর লাগে? জানো কী?”
–” নাতো।”
–” স্বামীভাগ্য আর চুলে। স্বামী বেশি ভালোবাসলে, ঢোল পিটায় বেড়াবে না। আর চুল সুন্দর হলে প্রদর্শন করবে না। বুঝেছো? এ দু’টিতে নজর লাগে খুব তাড়াতাড়ি।”
শায়লা চৌধুরীর কথায় গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না সে। বাসায় এসে সে আরোও বিরক্ত হলো। শায়লা চৌধুরী এমন ব্যবহার করছেন যেন এটা তার বাসা। দাদীর প্রেশার বেড়েছে জন্য তেঁতুল কিনে এনে, তেঁতুলের শরবত বানিয়ে খাওয়ালেন। আলিয়ার নাকি মাথাব্যথা, ওকে কোথা থেকে একটা মাথাব্যথার বাম্প এনে দিলেন। এরপর রান্নাঘরে রান্না বসালেন। এসব আদিখ্যেতা দেখে বেশ আহত হয় আয়না। বাবা ঠিকই ওনাকে জানিয়েছে কখন ফিরবে কিন্তু তাকে বলেনি কিছু। এখন থেকে নিশ্চয়ই সব তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে জানিয়েই করবেন। অবশ্য তাদের জানিয়ে আজ পর্যন্ত কিছুই করেনি। শায়লা চৌধুরী রাতের রান্না আর সন্ধ্যার জন্য নাস্তা করলেন। ওদের ফুপা-ফুপু এসেছে। ওনারা আর আলিয়া খেয়ে নেয়৷ কিন্তু আয়না কিছুই মুখে দেয় না। ওনার সামনেই সশব্দে রুমের দরজা লাগিয়ে দেয় রুমের।
রাতে ফাহাদ সাহেব ফিরলেন। উনি নাকি এয়ারপোর্টে থেকেই সোজা হাসপাতালে যান৷ সমুদ্রের রেফারেন্সে সিসিইউতে অল্প সময়ের জন্য এলাউ করেছে। বাবা ভালো আছে দেখে এসেছেন। বাসায় এসেই রাতের খাবার খেয়ে নেন। শায়লা চৌধুরীকে নিজের বাসায় দেখে সামান্য হতভম্ব হলো। আয়ু কী কোনো সিনক্রিয়েট করেছে? বাসার পরিবেশ দেখে মনে হচ্ছে না। তার বোনের সঙ্গে বেশ সুন্দর মতো গল্প করছে শায়লা। সত্য কথা বলতে শায়লাকে এ’বাসায় দেখে সে ভড়কে গেছে৷ ও যেমন মহিলা, আসার তো কথা না এ’বাসায়। ভদ্রতা রক্ষার্থে এসেছে মনে হয়। সে ছোট করে দম ফেলে আয়নাকে ডাক দিলো। ও নাকি খায়নি দুপুরের পর থেকে।
আয়না রুম ছেড়ে বেরিয়ে এসে বাবার সামনে দাঁড়ায়।
ফাহাদ সাহেব বলে, ” তুমি রাতে খাও নি মা? আসো খেতে বসো। না খেয়ে থাকলে তোমার প্রেশার লো হয়ে যাবে।”
আয়না এতোক্ষণে মুখ খুলে। আসলে সে বাবা ছাড়া আর কারো উপর রাগ-জেদ দেখায় না। ইদানীং আরেকজনের উপর দেখাচ্ছে।
সে বলে উঠে, ” তোমার দ্বিতীয় স্ত্রীর হাতের রান্না আমি মুখেও দিবো না।!
–” এটা কেমন কথা?”
–” বাবা, আমাকে রাগাবে না একদম। উনি যাচ্ছে না কেন এখনো?”
–” যাবে একটু পর। তুমি খেতে আসো। বাসায় ফুপা-ফুপু আছে। আমি ঝামেলা চাই না।”
সে নিজে আয়নাকে খাবার বেড়ে দেয়৷ আয়না অনিচ্ছা সত্ত্বেও বসে। বাসায় গত কয়েকদিন ধরে কোনো শান্তি নেই। একটার পর আরেকটা দুঃসংবাদ৷ খেতে বসে, তার খাওয়ার রুচি হয় না। প্লেটে খিচুড়ি নাড়াচাড়া করছে সে।
শায়লা চৌধুরী এসে বলে, ” তোমার ফোন বাজছিলো। তুমি তো ফোন টেবিলে রেখেই রুমের দরজা লাগিয়ে দিয়েছো। তাই রিসিভ করলাম। তোমার ভার্সিটির ফ্রেন্ড রঙ্গন কল দিয়েছিলো। তোমার সাথে কথা বলতে চায়।”
আয়নার যেন নাকে-মুখে খাবার বাজে। সে কেশে উঠে। একটু পর শুরু হলো হিচকি। এক গ্লাস পানি খেয়েও হিচকি থামে না৷
শায়লা চৌধুরী বলে, ” মনে হয় কেউ তোমাকে মনে করছে।”
আয়না চকিতে উঠে। সে ফোন হাতে রুমে চলে যায়।
রাত দশটায় শায়লা নিজের বাসার উদ্দেশ্য বের হলো। ফাহাদের বাসায় থাকতে চাইলেও এটা এখন হচ্ছে না। আরোও পরে শিফট হবে সে। আজকে কেনো যেন আয়নার জন্য তার একটুখানি মায়া-ই হচ্ছিলো। সাধারণত আয়নাকে তার একদম পছন্দ না। ছোট একটা বাচ্চা মেয়ে কিন্তু তেজ খুব। মনে পড়ে যায় তিনবছর আগের সেই ঘটনায়। তখন ও সবে এসএসসি দিয়ে কলেজে। পুচকি একটা মেয়ে। শায়লা ভাবেও নি এই মেয়ে এতো জেদী হতে পারে৷ ফাহাদের সঙ্গে বিয়ের ঘোষণা দেওয়ার পরপর হুট করে এক দুপুরে এই পুচকে মেয়ে তার বাসায় আসে। তাও কাউকে না জানিয়ে। একা একা। ওইদিন বাসায় গেস্ট ছিলো। ওদের সামনেই সে কী তেজি গলায় চিৎকার-চেচামেচি। একটা পর্যায়ে আয়না তাকে বলেছিলো, সে নাকি ডাইনি। ওদের বাবাকে ফাসিয়েছে। ছেলেমানুষী নানা ধরনের কথা। সে এসব আমলে নিতো না৷ কিন্তু আয়না যখন বললো সে ডিভোর্সি, তার চরিত্র-ব্যবহার সবকিছুই নাকি বাজে। সে খুব বাজে মহিলা। তার পরিবার নাকি খারাপ। অন্য সবকিছু বললেও সহ্য করে মেনে নিত। কিন্তু তাকে দুশ্চরিত্রা ডিভোর্সি বলায় শায়লা ভীষণ আঘাত পায়, সেইসাথে আয়নার জন্য ক্ষোভ জন্ম নেয়৷ সে কীভাবে আয়নাকে বুঝাবে, ডিভোর্স কেবল নারীর চরিত্র খারাপ হলেই কার্যকর হয় না। স্বামীভাগ্য ভালো হতে হয়। যার স্বামী ভালো না, সে নারী যতোই সতী হোক, একদিন পরিনতি খারাপের দিকে যাবেই। ক্ষোভ আরোও বৃদ্ধি পায় যখন ফাহাদ মেয়ের কথা শুনে বিয়ের সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসে। আয়নার উপর একপ্রকার রাগ-ঘৃণা কাজ করে তার। প্রতিশোধের আগুনে দ্বগ্ধ হয় সে।
এরপর অনেক পরে, প্রায় তিন বছর পর, ইচ্ছা করেই সমুদ্রের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব দেয়৷ ওর ও বোঝা উচিত নারী যতোই গুণী হোক না কেন, পুরুষ ভালো নাহলে ঘর টিকে না।
চলবে।