ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব-৩২+৩৩+৩৪

0
276

#ইলেকট্রিক্যাল_মন
#Arishan_Nur ( ছদ্মনাম)
Part–32

আই ডোন্ট লাইক কিন্ডস ইটস ট্রু– সারাটা রাত এই একটা কথাই ঘুরপাক খেতে লাগে আয়নার মস্তিষ্কে। ওর রাতে ঘুম হয় না। কেনো জানি চোখ গড়িয়ে ফোঁটায়-ফোঁটায় পানি গড়াতে থাকে খানিক বাদে। তবে সমুদ্র ও’পাশে ফিরে আরামের ঘুম ঘুমাচ্ছিলো। নিস্তব্ধ রজনীতে নিজেকে বড় অসহায় লাগে। জীবনের সমীকরণ মেলাতে গিয়ে কোথায় জানি আটকা পরে৷ কোথা’কার কোন সুতোর টান যেন আলগা! সে হিসাব মেলাতে পারে না, ফলাফল একটা নির্ঘুম রাত কাটিয়ে দিলো।

সকালের দিকে চোখ বুজে আসলে, সমুদ্রর নড়চড় এর আওয়াজ কানে আসে৷ একটু পর নিজের চুলে কারো হাতের স্পর্শ পায় সে। চোখ বন্ধ করেই রাখে। ও বুঝি মিনিট পাঁচেক চুলে হাত বোলায়। আয়নার আরাম লাগে, বিষাদের তেতো স্বাদ একটু কমে। এরপর উনি উঠে চলে যান। সঙ্গে সঙ্গে আয়নাও উঠে বসলো। চোখ ফোলা তার।

সমুদ্র ওয়াশরুম থেকে বের হতেই দৃষ্টি নিবন্ধ হলো আয়নার উপর। আয়নাকে দেখে সে বলে, ” আজ এতো দ্রুত উঠে গেলে যে?”

আয়না উত্তর দিলো না, তবে নিজের মনের খারাপ লাগাও বুঝতে দেয় না৷ ও উঠে রান্নাঘরের দিকে যেতে থাকে। সমুদ্র অনেক সকালে ব্রেকফাস্ট করে। ময়নার মা এতো আগে আসে না৷ ওর জন্য প্রোটিন শেক বানিয়ে রুমে ফিরলে সমুদ্র ওর হাত ধরে টেনে নিজের কাছে বসিয়ে নিয়ে বলে, ” কি হয়েছে তোমার? মুখ এমন ফোলা কেন? রাতে ঘুম হয়নি?”

আয়না সংক্ষেপে বলে, ” কিছু না।”
ও জানে সমুদ্রকে নিজের মন্দ লাগা বলে লাভ নেই। উলটা নানান যুক্তি দিবে৷ ওর যুক্তি না, যত্ন চাই! মেয়েরা যতোই বিজ্ঞানী কিংবা প্রকৌশলী হোক না কেন! তাও যুক্তির চেয়ে মন ভোলানো আদুরে যত্ন আর কথা পছন্দ করে। ছোট্ট করে বলে, ” মাথাব্যথা ছিলো।”

সমুদ্র শার্ট পরতে পরতে বলে, “নাপা খেতে পারো। শোন, সন্ধ্যায় একটা পার্টি আছে। আমি ছয়টায় এসে তোমাকে নিয়ে যাব।”

–” আমার যাওয়া খুব দরকার?”

–” মিস্টার এন্ড মিসেস ইনভাইটেশন। আমাদের প্রোজেক্টের সাকসেস পার্টি।”

–” আমার ক্লাস আছে, ক্লান্ত হয়ে যাবো।”

–“আজকে তো বৃহস্পতিবার। তোমার ক্লাস তিনটায় শেষ। জলদি বাসায় ফিরবে৷ কুইজ আছে কোনো?”

–” না৷”

সমুদ্র আর কিছু শুনেও না, জিজ্ঞেস ও করেনা, মেডিসিন টেবিলে রেখে, শুধু গেলাম বলে চলে গেলো। আয়নার এমন ছক বাঁধা জীবনটা কেমন অগোছালো লাগে। না পারে কারো সাথে শেয়ার করতে, আর না পারে মন খুলে নিজের খারাপ লাগা গুলো বলতে।

সমুদ্রের সময় হয় না ওর সাথে বসে সারা বিকাল কথা বলার! আয়নার একাকী লাগে ভারী। বাবার বাড়ির কথা মনে পরে অনেক। কিন্তু শায়লা চৌধুরী ও’বসায় শিফট হওয়ার পর সে যায়নি বাবার বাসায় একবারও। আলিয়া ও দাদা-দাদীর সাথে ফোনে, ভিডিওকলে কথা বলে শুধু। ওর কেনো জানি দু’চোখ ভরে উঠে। এতো পাওয়ার মাঝেও কী জানি না পাওয়া তার।

এমন অ-সুখী, বে-রঙিন, অ-গোছালো জীবনের উপর সে ক্লান্ত হয়ে পরছে ভারী।

_____________________

সমুদ্র কেবিনে বসে ফাইল দেখছিলো এমন সময় নক করার আওয়াজ ভেসে আসে। সে আসার অনুমতি দিতেই নাজিয়া এলো ভেতরে। হাসি-হাসি মুখে, অতিরিক্ত সাজ-সরঞ্জাম করে, যা একান্তই অবান্তর। সমুদ্র চোখ ফিরিয়ে নিলো। সজল ভাই সাতজন ক্যান্ডিডেট এর মধ্যে থেকে নাজিয়া কে সিলেকশন করেছে। মেয়েটা কোয়ালিফাইড কিন্তু স্বভাব কেমন জানো লাগে সমুদ্রের। কেমন একটু গা-পরা কিংবা অতিমাত্রায় বন্ধুত্বপূর্ণ লাগে। ক’টা দিনই গেলো এতেই ওর উপর একটা নেতিবাচক ইমপ্রেশন ক্রিয়েট হচ্ছে যদিও বা সেটা কেবল সমুদ্রের ভ্রান্ত ধারণা বৈকি!

নাজিয়া ফাইল নিয়ে এসে বলে, ” স্যার, আজ দুপুর দু’টোয় মিটিং শিডিউল ফিক্সড করবো?”

–” হ্যাঁ, করো।”

নাজিয়া ফাইল নিয়ে তার সামনে ঝুঁকে দাঁড়াতেই ওর ফিমেল শার্টের তিনটে বোতাম খোলা থাকায় কিছু অস্বস্তিকর, অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে পরে সমুদ্র। সে দ্রুত সাইন করে বলে, ” আচ্ছা, এখন যান৷”

–” স্যার, একটা হেল্প লাগতো?”

–” কী?”

–” আমাকে এখনো পিক আপ স্যাটেলের জন্য ব্যবস্থা করে দেয়নি। আজকে একটু ড্রপ করা যাবে? ”

সমুদ্র একবার ভাবলো হেল্প করবে না, না বলে দিবে, পরবর্তীতে বলে উঠে, ” আমি পাঁচটায় বের হবো। আপনি তখন আমার অফিসের গাড়িতে উঠে পড়বেন।”

–” থ্যাংকস, স্যার৷”

নাজিয়া চলে যায়, তবে ওর কড়া পারফিউমের সুঘ্রাণ কেবিনে রয়ে যায়।

দুপুরে খাওয়া সেরেই সে আয়নাকে রিমাইন্ডার দেওয়ার জন্য ফোন দিয়ে মনে করিয়ে দিলো পার্টির কথা। আয়না তখন কেবল ভার্সিটি থেকে ফিরে এসেছে৷ আয়নার ইদানীং কী হয়েছে কে জানে, একদম বাইরে যেতে ইচ্ছা করে না। সে গোসল করেই ভেজা চুলে ঘুমিয়ে পড়লো৷ এদিকে সমুদ্র মিটিং শেষ করে অল্প কিছু খেয়ে বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্য বেরিয়ে পরতেই খেয়াল হলো নাজিয়াকে ড্রপ করার কথা। সে কল দেয় নাজিয়াকে। তারপর গাড়িতে গিয়ে বসে। মেয়েটা পার্কিং লটে এসে দাঁড়ায়, হেঁটে এসে পেছনের দিকে তার পাশে বসে পরে। সমুদ্র চকিতে উঠে। সবসময়ই অফিসের কেউ বসলে সামনের সীটেই বসে। সমুদ্রের পাশে, পেছনে কেউ বসে না। অঘোষিত নিয়ম যেন সেটা। নতুন হওয়ার সুবাদে নাজিয়া বোধহয় এ’নিয়ম জানে না৷ সে বলতেও পারছে না নেমে পড়ার কথা। গাড়ি চলা আরম্ভ করেছে। ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে৷

নাজিয়ার বাসার কাছাকাছি আসতেই ও বলে উঠে, ” স্যার, বাসায় আসেন। চা-কফি খেয়ে যান। আমি অবশ্য একা-ই থাকি।”

–” না, না। আজ নয়৷ অন্যসময়।”

ওর বাসার গলির সামনে ঢুকতে রাস্তা একটু খারাপ বিধায় গাড়ি ঝাঁকি খায়। নাজিয়া একদম সমুদ্রের গায়ে ঢলে পরে৷ গায়ের সঙ্গে লেগে যায়। কেমন চাউনিতে নাজিয়া ওর দিকে তাকায়। খুব বিরক্ত লাগে সমুদ্রের। সে দ্রুত সরে এসে বসলো এবং বলে, ” নামুন এখানেই। বাকিটা হেঁটে যান।”

–” স্যার, আসেন না আমার বাসায়।”

–” না, আমার ওয়াইফ অপেক্ষা করছে।”

নাজিয়া একটু চমকালো যেন স্যারের ওয়াইফ বিষয়টা হজম করতে পারছে না। বলেই বসে, ” আপনি বিবাহিত?”

–” বিবাহিত নাহলে ওয়াইফ পাবো কোথা থেকে? সিংগেল থাকলে কী ওয়াইফ থাকে নাকি?”

নাজিয়া নেমে আগ বাড়িয়ে নিজের বাসা দেখিয়ে আরোও কিছু বলতে চাচ্ছিলো কিন্তু তার আগেই সমুদ্রের আদেশে ড্রাইভার গাড়ি সামনে নিয়ে যায়৷

_________________________

মামনির ডাকে আয়নার ঘুম ভাঙ্গে। উনি ডেকেই চলেছেন। ঘুমের ঘোরে পরিষ্কার ভাবে কিছু শুনতে পায়না।

আয়না উঠে বসতেই মিসেস রোদেলা বলে, ” সমুদ্র কল দিয়েই যাচ্ছে। তুমি ফোন ধরছো না জন্য আমাকে কল দিয়ে জ্বালিয়ে মারছে। তুমি রেডি হলেই ও শান্তি পাবে। তোমাকে রেডি করানোর দায়িত্ব আমাকে দিয়েছে সমুদ্র।”

আয়নার খেয়াল হলো আজ ওদের পার্টিতে যাওয়ার কথা। তাকে মামনি নিজের দামী আর সুন্দর একটা কালো শাড়ি পরিয়ে দিলো। পিউ আবার ওর ভেজা চুল দেখে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে শুকিয়ে চুল স্ট্রেইট ও করে দেয়।আবার সুন্দর করে মেক আপ ও করে দিলো। নিজেকে দেখে সে নিজেই অবাক হলো৷ অন্যরকম লাগছে দেখতে। পিউ ভাবীকে দেখে বলেই ফেলে, ” ভাবীমনি, তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে। তোমর রুপ দেখে ভাইয়া নিশ্চয়ই আজ পাগল হয়ে যাবে।”

আয়না লজ্জা মিশ্রিত হাসি হাসে। একটু পর, সমুদ্র রুমে আসলে পিউ বেরিয়ে যায়৷

সমুদ্র আয়নাকে সাজুগুজু করে বসে থাকতে দেখে বলে, ” আমি ভেবেছি তুমি আরোও ঘণ্টা খানেক অপেক্ষা করাবে, আমার সৌভাগ্য অপেক্ষায় থাকতে হলো না। ব্লাক পরেছো! তাহলে আমিও ব্লাক পরি। ম্যাচিং হবে৷”

ও ওয়াশরুমে চলে যায়। আয়না চুপচাপ বসে থাকে। সমুদ্রের মধ্যে সবার সামনে, পাবলিক্যালি পার্ফেক্ট কাপল হওয়ার খুব শখ৷ দুনিয়ার মানুষের কাছে তারা বেস্ট কাপল। অথচ আসার পর একবারও বললো অব্দি না, আয়না কেমন আছে! ওর মন খারাপ কেনো? কিন্তু ওনার তো সেদিকে তাকা’বার জো নেই। সুন্দর করে সাজলেই সুন্দর থাকা হয় না, মিষ্টার ওশেন।”

সমুদ্র সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট পরে বেরিয়ে আসে। আলমারি থেকে ব্লাক স্যুট বের করে বলে, ” লেবুর শরবত দাও।”

এ’বাসায় আসার পর থেকে প্রতিদিন আয়না ওনার জন্য শরবত বানিয়ে রাখে৷ অফিস থেকে এলে ওয়েলকাম ড্রিংক হিসেবে সার্ভ করে। আয়নার বানানো লেবুর শরবত সমুদ্রের খুব পছন্দ। গ্লাসে করে শরবত এনে দিলে ও খেয়ে নিয়ে গ্লাস টেবিলে রেখে, খুব অভিজ্ঞ পুরুষের ন্যায় আয়নার কোমড় জড়িয়ে ধরে। আয়না সরে আসতে চায় কিন্তু সমুদ্র বাঁধা দেয়। দু’জনের মধ্যে হাতাহাতি চলে। একটা পর্যায়ে আয়না বলে, ” আমার সুন্দর করে পরা শাড়ির ভাঁজ নষ্ট করছেন।”

সমুদ্র কথার ফাঁকে ওকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে এবং সুযোগের সঠিক ব্যবহার করে। নিজের বাম হাত আয়নার শাড়ির ভাঁজে কোমড় থেকে আরও সামনে অগ্রসর করে। এরপর কানের সামনে মুখ নিয়ে এসে বলে, ” সমস্যা নাই। শাড়ি খুলে গেলে আমি আবার পরায় দিবো। আফটার অল, শাড়ি পরাতে আমি এক্সপার্ট।”

আয়না নড়েচড়ে উঠে, তবে সমুদ্র পকেট থেকে একটা বক্স বের করে, ডায়মন্ডের একটা চেইন বের করে, পেছনে লেপ্টে থাকা চুল আস্তে আস্তে সরিয়ে দেয়। ওনার শীতল স্পর্শ নিজের ঘাড়ে পড়তেই কিঞ্চিৎ কাঁপে আয়না। চেইন গলায় পরিয়ে দিয়ে অনেক চেষ্টা করেও সমুদ্র আর হুক লাগাতে পারে না৷ বহু কষ্টে হুক লাগিয়ে দুজনেই ড্রেসিং টেবিলে লাগানো মিররের দিকে তাকায়। আয়নার গলায় হীরার সিম্পেল চেইনটা মানিয়েছে বেশ। সমুদ্র নিজেও মোহ আবিষ্ট নজরে তাকিয়ে থেকে আরেকটু আয়নাতে বিভোর হয়ে বলে, ” থাক, আজ আর না যাই। বাসায় থাকি।”

এরপর গলার ওই প্রিয় জায়গায় ঠোঁট ছু’ইয়ে কানের লতিতে কা মড় বসায়। আরোও একটু কাছাকাছি আসবে, তখন বিকট শব্দ তুলে সমুদ্রের ফোন বেজে উঠে। তবে ফোন ধরে মুড আর টাইম ওয়েস্ট করার ইচ্ছা বুঝি ওর ছিলো না। আয়নাকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নেয়। আয়নাও একদম চুপটি করে ওর বুকে নেতিয়ে পড়ে। কপালে ছোট্ট একখানা চুমু দেয়। দু’জন দু’জনের দিকে তাকায়, সমুদ্রর দৃষ্টি ওর গোলাপি ঠোঁট দু’টির দিকে। এগিয়ে এসে নিজের হাতের অনামিকা আঙুল আলতো করে ওর ঠোঁটে ছো’য়ায়। ও আবেশে চোখ বুজে ফেলে। সমুদ্র নিজের আঙুলে লিপস্টিকের অস্তিত্ব খুঁজে পায়। নিজেও আয়নার দিকে ঝুকে, নাকে নাক ঘঁ ষে। হাতে হাত, আঙুলে আঙুল ছন্দ তোলে।

আয়নাকে একদম নিজের সঙ্গে মিশে ফেলে, নিজের পায়ের পাতার উপর দাঁড় করায়। আয়নাও ওর কলার খা মচে ধরে। কেবল দু’জনে দু’জনকে অনুভব করছিলো। একে অপরের ঠোঁটে গরম উষ্ণতার মৌসুম শুরুর পূর্বাভাসের আগেই, আবারও ফোন বাজে। বিকট শব্দে বিরক্ত হয় দু’জনেই। সমুদ্র সরে এসে ফোন হাতে নিয়ে বলে, ” সর‍্যি।”

আয়না বিড়বিড়িয়ে আওড়ালো, ” আপনি বাসায় থাকলেও মন অন্যকোথাও রাখেন। বাসায় থেকেও লাভ কি? ফোনে কথা বলেই পাড় করেন।”

ফোনে কথা বলা শেষ করেই দু’জন বেরিয়ে পড়ে। আয়না থাকলে সে নিজেই ড্রাইভিং করে। আজও ব্যতিক্রম নয়। বনানীর পাঁচ তারকা হোটেলে এসে পৌঁছে গন্তব্যে চলে যায় তারা। অনুষ্ঠান চলছে। বিশাল আয়োজন। আয়নাকে অনেকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় সমুদ্র।

লাইভ মিউজিক চলছিলো। অনেক কাপল আবার ডান্সও করছে। শুধুমাত্র এডাল্টরা থাকায় ওপেনলি অনেক কিছুই হচ্ছে। তারা দু’জন পাশাপাশি বসে লাইভ মিউজিক উপভোগ করছে। দু’জন ব্ল্যাক পরায় মানাচ্ছিল বেশ। ফটোগ্রাফার এসে ছবিও তুলে ওদের। ওইসময় সমুদ্র হাসি-হাসি মুখ করে ওর কোমড়ে হাত রেখে কী অমায়িক পোস দেয়।

এক ভদ্রমহিলা, সমুদ্রের পরিচিত কেউ হবে হয়তো, উনি এসে বলে, ” এই যে লাভবার্ডস, তোমরা যাও রোমান্টিক ড্যান্স কর। বসে আছো কেন?”

সমুদ্র ওনার কথায় হেসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে আয়নাকে প্রশ্ন করে, ” মে আই, ম্যাডাম?”

আয়না একটু হতভম্ব হয়, তবে অদ্ভুত এক ভালোলাগা খেলে যায়। সে হাত এগিয়ে দিতেই, উনি ধরে ফেলে, এগিয়ে নিয়ে চলে, লাইভ মিউজিক এর স্টেজের সামনে। ওদের দিকে ফোকাস লাইট জ্বলে। গায়ক গান পরিবর্তন করে, নতুন করে গিটারে সুর তুলে গায়,

“I would never fall in love again until I found her.”

মিষ্টি সুর ভেসে আসে। সমুদ্র ওর কোমড় ধরে, আয়নার একটা হাত নিজের কাঁধে রেখে, আরেকটা হাত নিজের অন্য হাতে হাত রেখে, একটু দুলে। আয়না নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু সমুদ্র ওকেই দেখে যায়।

“I would never fall unless it’s you I fall into”
I was lost within the darkness, but then I found her, I found you.”

লাইন দু’টো শেষ হওয়ার আগে আকষ্মিক সমুদ্র ওকে হেলিয়ে নিয়ে ধরে নিজে একটু হেলে দাঁড়ায়। দু’জন অতি নিকটে চলে যায়। তবে, একজন আরেকজনের হৃদয়ের খবর শুনতে পায় না৷

কে জানে? কবে ঠিক ততোখানি দূরত্বে পৌঁছাবে তারা, যেখানে পৌঁছালে একে অপরের হৃদয়ের খবর বিনা চিঠি লিখেই পড়ে ফেলা যায়৷

হাত তালির আওতাজে ওরা সোজা হয়ে দাঁড়ালো। স্টেজ থেকে ফিরে, টেবিলে বসে টুকটাক কথা বলছিলো। সারাদিনে মাত্র একটু হাসলো আয়না। টেবিলে খাবার পরিবেশন করার আগ মুহূর্তে, সমুদ্রের ফোনে একটানা কল আসতে থাকে। আয়না বিরক্ত হয়ে যায়। এরপর বলে, ” রিসিভ করে কথা বলুন।”

লাইভ মিউজিক চলছিলো বিধায় সে সরে করিডোরে চলে যায়৷ এদিকে ফুড সার্ভ করা হচ্ছিলো।

সমুদ্র একটু পর বিরস মুখে এসে বলে, ” আয়না, আমাকে একটু অফিস যেতে হবে। খুব দরকার।”

আয়না হতবিহ্বল হয়ে তার পানে তাকালে, উনি চেহারায় অনুতপ্ততা এনে বলে, ” জানতাম না এমন হবে। আসলে ঝামেলা বলে-কয়ে তো আসে না। এম স’র‍্যি।”

আয়নার প্লেটে একগাদা খাবার তুলে দিয়ে বলে, ” তুমি খাও। শায়লা আন্টি আর বাবা রাস্তায়।ওনারা আসছেন। এই টেবিলেই বসবে। আমি তাহলে যাই।”

সমুদ্র হনহনিয়ে বেরিয়ে যায় অনুষ্ঠান থেকে। ও একবারও পিছনে ফিরে আয়নার বিষাদ ভরা চেহারা দেখেনি।

আধ ঘণ্টা বাদে অবশ্য ফাহাদ সাহেব এলেন শায়লাকে নিয়ে। ওরা একই টেবিলে বসে। কিন্তু আয়না একদম চুপচাপ, কেমন উদাসীন থাকে। খাবারও খায় না। পার্টি শেষ করে ফাহাদ সাহেবের গাড়ি করে আয়নাকে বাসায় নামাতে যায়। শায়লা আর আয়না পিছনে বসে। ওর ফোনে বারবার সমুদ্রের কল আসে কিন্তু রিসিভ করেনা। পরবর্তীতে শায়লা চৌধুরীর ফোনে কল আসে সমুদ্র।

ফাহাদ সাহেব জিজ্ঞেস করলো, ” আয়ু মা, কি হয়েছে তোমার? ”

আয়না জবাব দেয় না। ঠায় জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল।

শায়লা নিজ থেকে আয়নার কানে নিজের ফোন গুঁজে দেয় এবং বলে, ” যার জন্য উদাস হয়ে মুখ ফুলিয়ে বসে আছো। সে লাইনে আছে৷ কথা বলো।”

সমুদ্র লাইনের ও’প্রান্ত থেকে একটানা অনেককিছুই বলে কিন্তু আয়না প্রত্যত্তর করে না।

সোয়া বারোটায় সমুদ্রের বাসার গেইটে নামিয়ে দিয়ে, ফাহাদ সাহেব লিফট অব্দি আয়নাকে উঠিয়ে দিলেন। উনি অনেক চেষ্টা করে কথা বলার কিন্তু আয়নার বাবার উপর তীব্র রাগের তোপে সে হেরে যায়৷

বাসায় ফিরে আসতেই দেখে সমুদ্রও অফিস থেকে মাত্র এসে ডিভানে বসেছে। আয়নার ভীষণ রাগ-ক্ষোভ জমে ছিলো। সে গটগট করে রুমে ঢুকে পড়ে। সমুদ্র কিছু বলছিল ওকে, যা শোনার প্রয়োজন বোধ করলো না।

রুমে এসেই সর্বপ্রথম আয়না তার হ্যান্ডব্যাগ ছু’ড়ে মারে, তখনই সমুদ্র রুমে আসে। এরপর একটা খুব বাজে ঘটনা ঘটায় আয়না, যেটা সমুদ্রের মনে রিরুপ প্রভাব ফেলে। ও রাগের বশে আজকের গিফট দেওয়া ডায়মণ্ডের চেইনটা ছু্ঁ’ড়ে ফেলে দেয় সমুদ্রের পায়ের তলায়।

সে অদ্ভুত চোখে আয়নার এ’রুপ দেখে। ওরও রাগ উঠলো। সারাদিন এতো প্রেশারে থেকেও গিফট এনেছে।

বলে উঠে, ” কি করলে এটা?”

–” আপনার জিনিস আমার লাগবে না। আপনি প্লিজ অফিসে যান।”

–” ফালতু বকো না।”

আয়না তেজি কর্কশ গলায় বলে, ” সমুদ্র, আপনার আসলে আমার জন্য, আমাদের সম্পর্কের জন্য পার্সোনাল কোনো সময় নেই। অবসর পেলে আসেন, সময় কাটাতে। আমি নিশ্চয়ই আপনার অবসর নই।”

সমুদ্র ভ্রু কুচকে বলে, ” রেগে আছো! স’র‍্যি বলছি তো।”

কিন্তু আয়না দমে থাকে না। চিল্লাতে থাকে। ঝগড়া শুরু হয় তাদের মধ্যে। কথার পীঠে কথা দিয়ে একে-অপরকে দমাতে চাইছিলো।

আয়না বলে, ” এই সম্পর্কের আসলে কোনো নাম নেই।পুরুষ মানুষ এর চেয়ে বেশি র–ক্ষিতাকেও সময় দেয়। আপনার কোথাও আমি নেই। আপনার জীবনে আমার কোনো ইম্পোর্টেন্স নেই। আগাছার মতো আমি।”

সমুদ্রর কপালের রগ ফুলে উঠে রাগে। সে চেচিয়ে উঠে বলে, ” শাট আপ, আয়না।”

ভীষণ জোড়ে চিৎকার দিয়ে কথাটা বলায় ভয়ে কেপে উঠে ডুকরে কেঁদে ফেলে ও। তবে সমুদ্র তোয়াক্কা করে না। শুধু বলে, ” নিজের দোষে অশান্তি বাড়াচ্ছো। সামান্য ম্যাটারে এতো রিয়্যাক্ট কেন করছো? মানুষের কাজ পড়ে যেতেই পারে।”

আয়না কঠোর গলায় বলে, ” অফিস আওয়ারের পর কীসের কাজ আপনার? তাও প্রতিদিন! ”

–” আই ডোন্ট নো, তুমি কী মিনিং করে কি না কি বলছো? তুমি আমাকে অবিশ্বাস করছো?”

–” হ্যাঁ।”

–” দ্যাটস ক্রেজি।”

–” আপনি আসলে আমাকে ভালোবাসেন না তাই না?”

–” এখানে ভালোবাসা কোথা থেকে আসলো?”

–” বিশ্বাসের সঙ্গেই ভালোবাসা জড়িত।”

আয়না উঠে এসে ওর কলার চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ” শুধু শুধু বিয়ে করে আমাকে এতো মানসিক কষ্ট কেন দিচ্ছেন? এরচেয়ে শারীরিক আ ঘাতেও কম কষ্ট। আমার সঙ্গে বনিবনা নাহলে ছেড়ে দিলেই পারেন।”

সমুদ্র অগ্নিচক্ষু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, ” তুমি তো বিয়ের সাত দিন পর থেকেই তালাক চাও। সাত দিন না যাইতেই বাবার কাছে তালাক নিয়ে আলোচনা করো। তুমি পারবেও না সংসার করতে। স্বামী-সংসারে পবিত্র থাকার মনোভাবই তোমার নাই। তোমার মধ্যেই দোষ আছে। নিশ্চয়ই ভার্সিটির কোনো ছেলের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক আছে, তাই না? রঙ্গন আহমেদ ওর সাথে রিলেশন ছিলো না? তোমার কি মনে হয় আমি কোনোকিছুরই খোঁজ রাখি না? তুমি নিজে ঠিক নাই, আমাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাও। তোমরা, সব মেয়ে ছলনাময়ী। নারী স্পর্শ-ই জীবনের যতো অশান্তির মূল।”

আয়না দু’কদম পিছিয়ে গিয়ে বলে, ” আপনি নিজেকে নির্দোষ রাখতে মিথ্যাও বলা শুরু করলেন?”

–” ডিভোর্স তোমার চাই, আয়না। তাও বিয়ের সাত দিনের মাথায়। এ সম্পর্ক কেবল আমার জোড়েই টিকে আছে। তুমি তো কবেই বাঁধন আলগা করে চলে গেছো।”

আয়নার চোখের কান্নার বাঁধ ভাঙ্গে। ওর চরিত্র নিয়ে, অন্যকারো সাথে জড়িয়ে অপবাদ দেওয়ায় ও সহ্য করতে পারে না। ফ্লোরে বসে কেঁদে ফেলে। সবকিছু অসহ্য লাগে তার। সমুদ্রের কী ওর প্রতি একবিন্দু মায়া হয় না?

চলবে।

#ইলেকট্রিক্যাল_মন
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–33

আজকের আকাশ নক্ষত্রবিহীন, হয়তো চন্দ্রবিহীন ও।নিকষ কালো তমসা পূর্ণ রাত। অমাবস্যা চলে বুঝি। হ্যাঁ! অমাবস্যা-ই তো। সমুদ্র-আয়নার মনেতে আজ ঘোর অমানিশা। নিশ্ছিদ্র কালো, আঁধার রাত যেন মনের ভেতরের দুঃখি বিষাদকে আরোও দ্বিগুণ হারে বাড়িয়ে দিচ্ছে। আয়না নির্জীব নিথর শরীরে হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসে হয়তো কাঁদছে। সমুদ্র বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ফুঁকছে। কোথায় জানি কি পুড়ছে৷ পোড়ার অদগ্ধ কষ্ট সারা অঙ্গময় ছড়িয়ে যাচ্ছে। এ’ভাবে, এ’মন পরিস্থিতিতে কী আদৌ শ্বাস নেওয়া যায়?

প্রবল ঘূর্নিঝড়ের পরপর প্রকৃতি কেমন নিশ্চুপ থাকে, তাদের রুমের অবস্থাও তেমন। একদম নিরব। খামোশ। সে কাঁচের স্লাইডের ভেতর দিয়ে আয়নার পানে তাকালো। মাথা নিচু করে আছে ও। থেকে থেকে কাঁপছে। হিচকি উঠে গেছে বোধহয়। সে রুমের দিকে পা বাড়ায়, গ্লাসে পানি ঢেলে আয়নার সামনে ফ্লোরে রেখে দেয়। কিন্তু মুখে কিছু বলে না। ওর হাঁটার শব্দ পেয়ে আয়না মুখ তুলে তাকায়। রুম জুড়ে তখন নিভু ড্রিম লাইট জ্বলছে। ওর চোখে পানি দেখে মায়া হলো সমুদ্রের। মায়া এক বড় কঠিন জিনিস। দু’মিনিট আগেও মেয়েটাকে সে প্রতিদ্বন্দী ভাবছিল অথচ এখন মনে হচ্ছে নিজে হেরে গেলেই ভালো ছিলো।

সমুদ্র টেবিল থেকে গাড়ির চাবি হাতে নিয়ে বলে, ” বলছিলে না? আমার সঙ্গে থাকবে না। দেখো, যাচ্ছি আমি। সবচেয়ে ভালো হয়, যদি আজ এক্সি ডেন্ট করে মরি৷ ইউ নো, জীবনের এ’পর্যায়ে এসে মনে হচ্ছে মরনেই শান্তি। এছাড়া এই জীবনে শান্তি খোঁজা ভুল।”

আয়না বসে থাকা অবস্থাতেই ওর কথায় চমকে উঠে। তবে সমুদ্র বলে যায়, ” তোমার চিন্তাভাবনা এতো জটিল কেন আয়না? রাতের বেলা অফিস গেলে কেন খারাপ ইঙ্গিতে নিলে? আমার যাওয়া পছন্দ নাহলে ওইখানেই বাঁধা দিতে, কেনো এতো অশান্তি করলে? এমন টক্সিক রিলেশনশিপ বহন করা খুব পীড়াদায়ক। আর তুমি এই অবস্থায় বাচ্চা চাও! আহ! বাচ্চাকে কোন পরিবেশ দিবে? মা হিসেবেও ব্যর্থ হবে তখন।”

আয়না নিজের দুই কানে হাত চাপ দিয়ে ধরে বলে, ” আপনার কোনো কথা আমি শুনতে চাই না।”

সমুদ্র থামে । গটগট করে রুম ছেড়ে বেরিয়ে যায়। ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আয়না পাথর হয়ে বসে থাকে।নির্জীব দৃষ্টি মেলে। সমুদ্র বুঝেও বুঝলো না এই মুহূর্তে আয়নার আসলে একটা স্নিগ্ধ ভালোবাসার ছায়াময় স্পর্শ দরকার ছিল, দরকার ছিলো একখানা আদর টুকরো।

কথার বিপরীতে, ওকে বিপক্ষদল বানিয়ে জিতে যাওয়াই কী আসল বিজয়, সমুদ্র? কি সুন্দর কেবল নিজেরা দিকের কথা বলে জিতে যাও, বিপরীতে থাকা ব্যক্তিকে একদম বুঝো না। সে তো তোমার শক্রু নয়।

রাত বেশ গভীর হচ্ছিলো। দেড়’টা থেকে ঘড়ির কাঁটা দু’টোয় পৌঁছে। আয়না ঠায় ফ্লোরেই বসে আছে। চোখের পানির বর্ষণ থেমেছে। অশ্রুমালা গালেই শুকিয়ে কাঠ। ঘড়ির কাঁটার শব্দেও ছমছমে ভাব। আয়নার চিন্তা হতে থাকে৷ সমুদ্রের ফিরে আসার কোনো লক্ষন নেই৷ কপালে সূক্ষ্ম চিন্তার রশ্মি পড়ে। উনি যাওয়ার আগে কিসব কুলক্ষণা কথা-বার্তা বলছি। এক্সিডেন্ট হওয়ার! এতো ঝগড়ার মাঝেও কেবল ভালোবাসা আছে বিধায় ওনার জন্য ভীষণ ভাবনা আয়নার। আশেপাশে চোখ বুলালো। কতোক্ষণ কেটে যায় খেয়াল নেই, তবে জোরে ফোন রিং হওয়ায় ওর অন্তর কেঁপে উঠে। কেমন ভয় কাজ করে। ফোন কানে নিলে ও’পাশ থেকে অপরচিত গলায় কেউ বলে, আপনি সাদবিন রহমানের কে হন?”

আয়না ভয় পাওয়া গলায় বলে, ” কেন? কে আপনি?”

–” আমি °°°°°° ক্লাব, বনানীর ম্যানেজার। উনি প্রায় অচেতন অবস্থায় আছে। প্রচুর ড্রিংক করেছে। এই অবস্থায় একাই ড্রাইভিং করতে চাচ্ছে কিন্তু মাতাল অবস্থায় ড্রাইভিং করলে দুর্ঘটনা হবে৷ আপনি ওনার কে হন?”

আয়না খুব মিইয়ে আসা গলায় বলে, ” ওয়াইফ৷ ”

–” ওনাকে এসে নিয়ে যান, ম্যাম। ক্লাব ক্লোজ করতে হবে। আপনি না আসলে উনি একাই চলে যাবে।”

–” ওকে অপেক্ষা করতে বলেন৷ আমি আসছি ”

আয়না কালো শাড়ি পড়েই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায়। যেতে সময় কম লাগে। রাস্তা একদম নির্জন, ফাঁকা। নিজস্ব গাড়ি হওয়ায় নিরাপদে বনানী পৌঁছে সে৷ ক্লাবের সামনে যেতেই দেখলো, ক্লাবের আয়োজন এখনো জমজমাট। রাস্তায় মানুষ না থাকলেও ক্লাবে অনেক মানুষই উপস্থিত। গানও বাজছে। খুব লাউন্ড ভাবে। আয়না চোখ-মুখ খিঁচে ভেতরে প্রবেশ করে। জীবনে কোনদিন এমন পরিবেশে যায় নি। ভেতরে ঢুকে সে অবাক হলো। পরিবেশ দেখে বোঝার উপায় নেই এখন মধ্য রাত। তার উপর তার বয়সী অনেক মেয়েও আছে। সে ভাবত ক্লাবে কেবল ছেলেরাই যায়। ক্লাবটা খুব বেশি বড় না। প্রবেশ গেইটে এসে দাড়াতেই সমুদ্রকে একদম শেষ প্রান্তে একটা টেবিলে বসে ওয়েটারের সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেলো। ওয়েটারের হাতে হরেক রকম ড্রিংক। ও চোখের পলকে এক পে গ গিলে নিলো। আয়না হেঁটে এসে ওনার সামনে গিয়ে দাড়িয়ে বলে, ” সমুদ্র!”

মা তাল থাকা অবস্থাতেও সমুদ্র আয়নার কণ্ঠস্বর চিনে ফেলে ও পিছনে ফিরে বলে, ” আয়না! তুমি এসেছো!”

এরপর ওয়েটারকে বলে, ” আমার ওয়াইফ আয়না। ও আসায় সেলিব্রেশন হওয়া উচিত।” ও ফের আরেক পে৷ গ নিয়ে গিলে এক ঢোকে।

আয়না একদম সামনে এসে দাঁড়ায় এবং ওয়েটারকে ধমক দিয়ে বলে, ” দেখছেন না ওনার অবস্থা। তাও কেন দিচ্ছেন একটার পর একটা ড্রিংক।”

ওয়েটার ঝারি খেয়ে কাচুমাচু করে বলে, ” আমার কাজই তো সার্ভ করা। স্যারের অর্ডার ছিলো।”

–” আপনি অর্ডার করা ড্রিংক নিয়ে চলে যান।”

ওয়েটার চলে গেলে সমুদ্র মন খারাপ করে বলে, ” খাওয়ার পর খুব আরাম লাগে। কোনো অশান্তি থাকে না। তুমি আলম ভাইকে যাইতে কেন বল্লা?”

আয়নাকে কিছু বলতে না দিয়ে ওর আয়নার গায়ে ঢুলে পরে বলে, ” সামটাইমস নিজেই খুব ফেড আপ হয়ে যাই।”

আয়না বলে, ” কষ্ট দিলেন আমাকে, কথার আ ঘাতে টুকরো টুকরো করে শেষ করে দিলেন, অথচ এখন নিজেই ভিক্টিম রোল প্লে করছেন!”

–” আয়না, আমারও অনেক কষ্ট আছে। তোমাকে বলি না। লুকাই তোমার থেকে।”

ওনি পুরোপুরিভাবে মা তাল অবস্থায়, এমনকি বসে থাকতেও দুলছে, তবুও কী করুণ সুরে মাতলামো কথাবার্তা বললো যেন সবটা সত্য!

আয়না হাসে ওর কথা আর বলে, ” যে কষ্ট দেয়, তারও কষ্ট থাকে নাকি?”

–” তোমার কথা কিছু বুঝি না।”

বলেই উঠে দাঁড়িয়ে বা রের দিকে গিয়ে আরেকটা বোতল হাতে নিয়ে বলে, ” বিলে এড করে দিয়েন।”

চুমুক দেওয়ার আগেই আয়না ওর হাত থেকে বোতল নিয়ে বলে, ” মাতাল হয়ে আর কতো মাতলামি করবেন? নিজে যে একজন ডাক্তার সেটা মনে আছে?”

সমুদ্র একটু ভ্রু কুচকে মুখ কেমন করে এরপর বলে, ” না, ভুলে গেছিলাম। এখন মনে পড়লো। আবার বোতল দেও।”

–” প্লিজ বাসায় চলেন। আপনার অবস্থা ভালো নান।এতো ড্রিংক কেউ করে? বাসায় মা-বাবাকে কি জবাব দিবেন? লজ্জা শরম কিছু ই আর বাকি নেই আপনার। মাতাল অবস্থায় আছেন।”

সমুদ্র পিটপিট করে তাকিয়ে বলে, ” নো নো। আমি মাতাল না, বুঝছো? আমি একদম নর্মাল আছি। বিশ্বাস
তো তুমি আমায় করো না। তাই প্রমাণ দেই।”

এরপর থেমে বলে, ” আমাদের হৃদপিণ্ড বুঝছো চার প্রকোষ্ঠ বিশিষ্ট। সিস্টোল-ডায়াস্টোল মিলে হৃদস্পন্দন।”

–” আচ্ছা চুপ করুন। বাসায় যাবো।চলুন।”

–” না। আমি আর বাসায় যাবো না। তুমি আমার কথা শুনো।”

এরপর সমুদ্র আয়নার গলার কাছটার বো’নে হাত দিয়ে বলে, ” এটাকে ক্লাভিকেল বলে।”

মাতাল সমুদ্রের মনে হয় পুরাতন পড়াশোনার খেয়াল আসছিলো। আয়নার গলা থেকে আরেকটু হাত নামিয়ে বলে, “এ জায়গায় স্ক্যাপুলা থাকে।”

আয়না হাত দিয়ে ওনার হাত সরাতে চাইলে সমুদ্র ওর হাত ধরে ফেলে বলে, ” তোমার হাতের আঙুল গুলোর নাম কিন্তু ফ্যালাঞ্জেস।”

তারপর আচমকা নিচে নেমে আয়নার পা নিজের ভাজ করা হাটুর উপর রেখে পায়ের আঙুল ছু’য়ে দেয় এরপর বলে, ” এগুলোও।”

–” সমুদ্র আপনি হুশে নেই। বাসায় চলুন।”

–” নাহ, আমি আর বাসায় ফিরছি না। আই উইল লিভ সুন।”

আয়না ওকে সামলাতে পারেনা। সমুদ্র আরোও দু’ পে গ খেয়ে একদম বাজে অবস্থা করে ফেলে। উপায় না পেয়ে ক্লাবের স্পেশাল নাইট স্টে প্যাকেজ থেকে রুম বুক করে। সমুদ্রকে রুমে নিয়ে যায় ও। কিছুক্ষণ আগের তাদের দুইজনের’ বিশ্রী ঝগড়ার কথা চাপা পড়ে যায় সমুদ্রের মাতলামিতে। আয়না ঠিকই ওর দুর্দশার কথা শোনামাত্র ছুটে’ এলো কারণ ওর দিক দিয়ে সমুদ্র স্রেফ দায়িত্ব ছিলো না। ভালোবাসাও বটে।

সমুদ্র বিছানায় চিত হয়ে শু’য়ে বলে, ” আমার বুক ব্যথা করছে, আয়না৷ কিন্তু এই বুক ব্যথা সেই বুক ব্যথা নয়।”

আয়না ওর পাশে গিয়ে বললো, ” জুতো-মুজা খুলে ঘুম দেন।”

সমুদ্র শুনে না ও আপনা-আপনি বলে উঠে, ” আমাকে শুধু কষ্ট ই দেও তোমরা।”

আয়না ওর কথা তেমন শুনছিলো না। নিজ থেকে জুতো খুলে দিলো।

সমুদ্র যখন মাতাল দশায় ইউশার নাম নিচ্ছিলো আয়না চকিতে উঠে ওর দিকে তাকালো।

সমুদ্র বলে, ” ইউশা কী কম আ ঘাত দিসে নাকি? ওর আ ঘাত সহ্য করতে গিয়েই হৃদয়ের বারোটা বাজলো। আমি এমন ছিলাম না ট্রাস্ট মি! আমাকে ইন্টার্ণ করার টাইমে এক অস্টেলিয়ান বৃদ্ধ বলছিলো, রোগীর নাকি আমার হাসিমুখ দেখেই অর্ধেক অসুখ সেড়ে যাবে।”

আয়না ওর সামনে এসে বসে বলে, ” ইউশা কে?”

এরপর শ্রীমঙ্গলে সাক্ষাৎ হওয়া ইউশার কথা স্মরণ হতেই জিজ্ঞেস করলো, ” ডক্টর ইউশা? কি করেছে উনি? ”

সমুদ্র ওকে টান মেরে নিজের দিকে টেনে এনে বলে, ” আমার জীবনের সব সুখ খেয়ে নিসে। ও আমাকে অনেক কষ্ট দিসে। আমি সহ্য করতে পারতাম না আয়না। আমার এখনো কষ্ট আছে। সেই কষ্টে তুমি আরোও ঘি ঢালো। কতোখানি কষ্ট সহ্য করবো?বারো আউন্সের ছোট্ট হ্রদপিণ্ডে কতোটুকু যন্ত্রণা ধারণ করা সম্ভব? আমি পারি না, বারবার সব সামলাতে গিয়ে ব্যর্থ হচ্ছি। দায়িত্বের জাঁতাকলে পিষে হাপিত্যেশ অবস্থা। মুভ অন করার পরও তো সুখ পেলাম না। তোমার কষ্ট, কষ্ট কারন তুমি কাঁদতে পারো, আর আমার কষ্ট পানি কারন আমি কাঁদি না। দ্যাটস নট ফেয়ার।”

সমুদ্রের মুখে মুভ অন শব্দটা শোনা মাত্র আয়না বিষ্ফোরিত চোখে তাকালো। নিজেকে ধাতস্থ করতে সময় নিলে, ওইটুকু সময়ে সমুদ্র ঘুমে তলিয়ে যেতে থাকে।

আয়না সুধালো, ” ইউশাকে ভালোবাসেন আপনি? ”

প্রশ্নটার মাঝেই যেন এক সমুদ্র বেদনা ভরা ছিলো।

সমুদ্র ঘুমের ঘোরে থাকে। আয়না ঝাঁকালে বিরক্ত হয়ে বলে, ” হু।”

আয়না দাড়িয়ে থাকে এরপর না চাইতেও সমুদ্রের ফোন হাতায়। পাসওয়ার্ড জানলেও কোনোদিন কিছু চেক করেনি এতোটাই বিশ্বাস ছিলো ওর প্রতি। ফোনের গুগল ফটোস এর একটা ফাইলে ইউশার সঙ্গে সমুদ্রের ছবি দেখে। ওর যেন দুনিয়া থমকে যায়। কেমন অবশ হয়ে আসে। সবকিছু অন্ধকার দেখে। তার সমুদ্র অন্যকাউকে ভালোবাসে।দূর থেকে কেউ বলে উঠে, ” ও তোমার সমুদ্র না বোকা মেয়ে।”

আয়না ভাবে তবে ওদের সংসার সেটা কিসের ভিত্তিতে টিকে আছে? হয়তো তাসের ঘরের মতোন। হাওয়া দিলে উড়ে যাবে। নিজের সংসার জীবন, সুখ সব ঘোলাটে হয়ে আসে। সমুদ্র অন্যকারো! এজন্য তার প্রতি এতো বিতৃষ্ণা।

বিয়ের আগেরদিনের ম্যাসেজটাও দেখে ও। তবে ইউশার দেওয়া ছবিটা ডাউনলোড হচ্ছিলো না। কিন্তু সমুদ্রের পাঠানো ম্যাসেজ দেখামাত্র ওর হাত থেকে ফোন পড়ে যায়।

এতো বিষাদ কেন তার ভাগ্যে? আদৌ ভাগ্যের দোষ নাকি তার দোষ? সে কেন ভালোবাসায় এতো অভাগী!কেন অগাছা সে? কেন সমুদ্র? আপনার হৃদয়েএ রানী হতে পারলাম? কেন আপনার হৃদে অন্যকারো বসবাস?

_________________________

দুপুরের দিকে আয়না একটা কফিশপে বসে আছে। তার বিপরীতে চটপটে স্বভাবের চঞ্চল ইউশা অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে। আয়নাকে ওর নাম্বার দিয়েছিল কখনো ভাবেও নি তাদের আবারো দেখা হবে। ইউশা পৈতৃক সূত্রে পাওয়া জমির জন্য কেইস ফাইল করেছে। এজন্য দুই-তিন মাস অন্তর এসে কেইসের ডেইটে হাজিরা দিতে হচ্ছে বিধায় আজ সে আয়নাকে স্বশরীরে দেখা দিতে পারলো। তবে ইউশা জীবনেও ভাবে সমুদ্রের স্ত্রী তাকে কল দিয়ে দেখা করতে চাইবে৷

আয়নাই বলে, ” আপনি সমুদ্রের ব্যাচমেট ছিলেন?”

–” হ্যাঁ।”

আয়না একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কি বলবে ভেবে পায় না। সে মরা গলায় বলে, “আপনাদের সম্পর্ক ছিলো?”

ইউশা বেশ অস্বস্তিতে পড়লো। কিন্তু মুখে কিছু বলে না।
আয়না এক গ্লাস পানি টেবিল থেকে নিয়ে পান করে বলে, ” আমার মনে হয় আপনি সমুদ্রর ভালোবাসা। প্রথম ভালোবাসা। আর আমি কেবল দায়িত্ব। আমি ওর ভালোবাসার অধ্যায়ে কোথাও নেই। অথচ আপনাকে নিয়ে উপন্যাস অব্দি রচিত আছে ওর মনে কোণে। উনি আপনাকে এখনো ভুলতে পারেনি জন্য আমাকে মানতে পারেনা। উনি এখনো আপনাকেই চায়। এখনও!”

ইউশা বলে উঠে, ” কি বলছো এসব? তুমি নিজের হাসব্যান্ড নিয়ে এসব বলছো?”

আয়নার চোখে পানি চিকচিক করে। সে বলে, ” বিশ্বাস নাহলে, ওনাকেই জিজ্ঞেস করে দেখেন।”

ইউশার এখনো সমুদ্রর বলা কঠিন কথা গুলো ইয়াদ আছে, তবুও ভাগ্য এতো সহায় যে আরেকবার সমুদ্রকে পাওয়ার লোভ সামলাতে পারে না। তবুও বলে, ” আমি সমুদ্রকে খুব ভালো করে চিনি। ও তোমাকে বিয়ে যখন করেছে, দায়িত্ব পালন করে যাবে।”

–” আমি চাই উনি সুখে থাকুক, দায়িত্বর খাতিরে সুখ বিকিয়ে দিক এটা চাই না। হয়তো আমার কাণ্ড দেখলে মানুষ বলবে আমি পাগল৷ কিন্তু ট্রাস্ট মি, আমি চাই আমার সমুদ্র সবসময় ভালো থাকুক। সুখী হোক।”

–” এখন এসব বলে লাভ আছে? আমি আসি আয়না।”

–” না, বসুন।”

প্রাক্তনের স্ত্রীর কান্ড ইউশার কাছে সুবিধার লাগে না৷ মেয়েটাকে স্টেবেল লাগছে না। মেন্টালি উইক লাগছে। কেমন এলোমেলো কথা বলছে৷

ইউশা বলে, ” কি চাচ্ছো তুমি? ”

–” আপনি সমুদ্রের সঙ্গে কথা বলুন। আমি ফোন দিয়ে ডাকছি ওনাকে।”

আয়না কল লাগায়। দুপুরের দিকে ওকে জেগে গেছে এতোক্ষণে। দু’বার রিং হতেই সমুদ্র কল রিসিভ করে বলে, ” আয়না, আই এম সর‍্যি। কালকে আমি খুব খারাপ করেছি…….. ”

–” এক জায়গায় আসতে বললে আসতে পারবেন এখন?”

–” হ্যাঁ। তুমি লোকেশন দাও। আমি এক্ষুনি আসছি।”

এরপরের প্রহর গুলো আয়নার ভারী লাগে। নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। সমুদ্র খুব দ্রুত এসে পৌঁছে। আয়নার সঙ্গে ইউশাকে দেখে সে ঘাবড়ে যায়৷ নিজের স্ত্রী আর প্রাক্তন কে একসাথে দেখে যে-কেউ হতভম্ব হবে। আয়নার মনে কি চলছে ও জানে না।

প্রশ্ন করে, ” ও এখানে কি করছে।”

আয়না উঠে দাঁড়িয়ে চোখের পানি মুছে। ওর চেহারা ই বলে দিচ্ছে ওর কিছু একটা হয়েছে। স্বাভাবিক অবস্থায় নেই ও। কেমন বিধ্বস্ত। আনস্টেবেল। টলছেও বুঝি।

আয়না বলে, ” সমুদ্র, বারো আউন্সের হৃদয়ে আর দুঃখ পুষতে হবে না। আপনারা কথা বলে নিজের মধ্যে ভুল বুঝা-বুঝি ঠিক করে নিন। আমি তো থার্ড পার্সন। আমি সরে যাবো। অনেক সুখী হন, সমুদ্র।”

কথাটা বলার সাথে সাথে সমুদ্র আয়নার গালে চ৷ ড় বসায়। ক্যাফেতে উপস্থিতি সবাই ওদের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো।

চলবে।

#ইলেকট্রিক্যাল_মন
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–34

সমস্ত ডমেস্টিক ভা য়োলেন্সের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করে সমুদ্র অভাবনীয় কাজ করে। এতে আয়না ও ইউশা দু’জনেই অদ্ভুত চোখে তাকায় ওর দিকে।কিন্তু বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই তার। তার মতে, আয়নাও ভায়োলেন্স ক্রিয়েট করেছে। ওর কি দরকার ছিলো পাকনামি করে ইউশা ডেকে আনার। লজিক-যুক্তি কিছুই রাগের বশে সমুদ্রের পোষ মানলো না।

সে কাটকাট গলায় সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলে, ” বাহ! আয়না, তুমি দেখি অতিমাত্রায় মহান। এতো জনদরদী যে স্বামীর ভাগ অন্যকে বুঝিয়ে দিতে চাইছো?”

কথাগুলো শ্রবণ মাত্র আয়নার চোখ বেয়ে পানি পরে। সমুদ্র ভ্রুক্ষেপ না বলে, ” এতো ছিঁচকাঁদুনে স্বভাবের হয়েও ভালোই সাহস দেখাচ্ছো!”

আয়নার সবটা গুলিয়ে যাচ্ছে। মনে-মস্তিষ্কে অনেক কথা সাজিয়ে, নিজেকে সারারাত ধরে বুঝিয়ে এই সিন্ধান্তে উপনীত হয়েছে সে। সমুদ্রের সুখের জন্য সে এই ভয়াবহ পদক্ষেপ নিতেও রাজী হয়ে গেছে কেবল ওর চোখের পানি দেখে। ওনার চোখের পানি আয়নাকে এতো পরিমাণ পীড়া দিচ্ছিলো যা একত্রিত করলে একটা নদী হয়ে যাবে৷ কারো উপস্থিতি যদি কাউকে কাঁদায়, তবে দূরে সরে যাওয়াই ভালো।

–” কী হলো? আন্সার মি, আয়না? এখানে এসব কী হচ্ছে? নাটক চলছে এখানে? এই মেয়ে তোমার সাথে কি করছে?”

সমুদ্র যে প্রচণ্ড রেগে আছে তা ওর ব্যবহার আর চেহারায় প্রকাশ পাচ্ছে যেটা ওর অতীত ও বর্তমান দু’জনই টের পাচ্ছে। ওর রাগের সামনে দুজনেই ঘাবড়ে কাচুমাচু হয়ে পড়ে৷ আয়না প্রচণ্ড অপমানিত বোধ করে। থা প্পড় খাওয়ার পর সে চোখ আঁধার দেখছে। জীবনে প্রথম কেউ তার গায়ে হাত তুললো তাও কে সে? যাকে ভালোবেসে, সুখ ত্যাগ করে সে দেউলিয়া হতে চলেছে!

সমুদ্র উত্তরের আশায় না থেকে ইউশার দিকে তাকিয়ে বলে, ” তোমার এখানে কাজ কী? কেন এসেছো?”

ইউশা কিছুটা তেজি আওয়াজে বলে, ” আমার কোনো কাজ নাই। তোমার ওয়াইফেরই কাজ ছিলো। এক প্রকার অনুরোধ করে এখানে আনিয়েছে আমাকে। সমুদ্র আমি তোমাকে আগেও একবার বলেছি, আরেকবার ভাবো আমাদের নিয়ে।”

–” শাট আপ! ভাবার আর আছে কী ইউশা? সব ঘাটের জল খেয়ে পুরাতন ঘাটে ফিরতে লজ্জা লাগে নি? অস্টিনের সঙ্গে থেকেও তৃপ্তি মিললো না? আবার কোন মুখ নিয়ে আমার কাছে ব্যাক করবে তুমি?”

ওর চোখ-মুখ শক্ত হয় লজ্জায় অপমানে চোখ নিচে নামিয়ে ফেলে বলে, ” আয়নার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক ভালো না। তোমার ওর সাথে সংসার করতে কষ্ট হচ্ছে কজ ইউ লাভ মি, সমু।”

সমুদ্র কথাগুলো শোনামাত্র বিকট গমগমে আওয়াজে চিল্লিয়ে উঠে বলে, ” আমি জাস্ট হেইট ইউ! এইকথা গুলো চিট করার দিনই বলা দরকার ছিলো। ইউশা, আমি আর জীবনেও তোমার চেহারা দেখতে চাই না৷”

ইউশা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, ” তোমার ওয়াইফ তো পারলে হাতে-পায়ে ধরে আমাকে তোমার লাইফে আনার ট্রাই করছে। অথচ আমার উপর ক্ষেপছো তুমি !”

সমুদ্র এতোক্ষণে আয়নার দিকে মনোযোগী হয়। ইউশার উপস্থিতিও তাকে আর ভাবায় না। কিন্তু ততোক্ষণে আয়না ক্যাফে ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। সে হতাশার নিশ্বাস ফেলে, নিজেকে সামলায়৷

কি থেকে কি হচ্ছে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। কাল অব্দি যেখানে সব ঠিক ছিলো আজ আয়না এতো অবুঝের মতো ব্যবহার কেন করছে? সে ইউশার সঙ্গে কথা বাড়ালো না, আসলে সময় নেই হাতে। আয়নাকে অনুসরণ করে।

আয়না তখন মাঝ রাস্তায়। এলোমেলো পায়ে হাঁটছে। দুপুরের সূর্য মাথায় খাড়াভাবে কিরণ ছড়াচ্ছে। শীতের শেষে সূর্যের আরাম রোদ গায়ে লাগছে। সে পা ফেলতে পারছে না। মাথা ভারী লাগছে। চারদিক থেকে হর্ণের শব্দে বুদ্ধি লোপ পায়। হাঁটা থামিয়ে দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো বেজায়। চারপাশে এতো আওয়াজ কিছুই কানে ঢুকছে না। কেবল কানে ঝনঝন করে বাজছে সমু নামটা! ওহ তার মানে, ইউশা তবে সমুদ্রকে সমু বলে ডাকতো। এতো আদুরে নামে ডাকা সম্পর্কে নিশ্চয়ই বোঝাপড়াও বেশ! এজন্য আয়নার মুখে ওই নাম শুনে বিয়ের পর প্রথম কাছে আসা-আসিতে এতো রিয়্যাক্ট করেছিল? করবেই বা না কেন! নিজের ভালোবাসার মানুষের দেওয়া নামে অন্য কেউ ডাকলে রাগ তো উঠবেই। সে তো সমুদ্রের জীবনে অন্যকেউ-ই! আপনজন হলো আর কই! তার চোখের সামনেই তো সবটা ঘটছিলো, সে আগে কেন বুঝে নি? ওই যে একবার স্যার বলেছি আয়ু তুমি একটা গাধা, স্যার একদম ঠিক বলতেন। সে আসলেই গাধা, নাহলে, কেন সমুদ্রের দায়িত্ব হয়ে এতোদিন অবহেলা সহ্য করলো।

আচমকা মনে হলো আশেপাশে থেকে অনেকেই একাধারে চিল্লাচ্ছে। কার উপর চিল্লাচ্ছে ওটা মাথায় ঢোকে না তার, চোখ মেলে তাকালোও না। তবে কেউ একজন খুব জোরে তার বাহু পাকড়াও করে টেনে মাঝ রাস্তা থেকে ফুটপাতে এনে দাঁড় করালো। আয়না চোখ মেলে তাকাতেই আক্রোশ ও ভয়ার্ত নীলচে চোখে দু’টির সম্মুখীন হলো।

সমুদ্র চেচিয়ে চেচিয়ে বলছে, ” পাগল হয়ে গেছো নাকি তুমি? মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়েছো? এক্ষুনি গাড়ি এসে মেরে দিতে ধরছিলো। আমি ঠিক সময় না আসলে কে তোমাকে রিস্ক নিয়ে বাঁচাতো? এতোগুলা মানুষ যে চিৎকার দিয়ে বলছে সরেন, কানে যায় না সেগুলো?”

–” ” গাড়ি এসে ধাক্কা দিলেই ভালো ছিলো।”

–” আরেকটা থা প্পড় খাওয়ার শখ জেগেছে?”

আয়না তোয়াক্কা করে না। ওর বাহু থেকে সমুদ্রর হাত সরিয়ে দিয়ে বলে, ” মায়ের কাছে চলে গেলেই ভালো হবে। এ’দুনিয়ায় মা ছাড়া আর কেউ আপন না। তা ভালো মতোই বুঝিয়ে দিয়েছেন।”

সমুদ্র এবারে নরম হয়। সব রাগ কই যেনো পালানো। সে আস্তে ওর দু’গাল আলতো করে হাত রেখে বলে,
” তুমি আমাকে ভুল বুঝছো! পুরাটাই মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং।”

কিন্তু আয়না শুনতে পায় না। তার আগেই চোখ-মুখ বাকিয়ে বমি করে দেয়। সমুদ্র দ্রুত ওকে ধরে, ওর মাথায় হাত বুলায়৷ পাশের দোকানের লোকটা এক বোতল পানি এনে দেয়৷ ও সামান্য সুস্থ বোধ করতেই সমুদ্র বলে, ” বাসায় চলো। প্লিজ, তোমার রেস্ট দরকার। ”

–” উহু, আমি আপনার সঙ্গে ফিরছি না।”

–” হুয়াট!”

–” আমার এবারে সত্যি স্পেস দরকার, সমুদ্র। আপনি দায়িত্ব নিতে গিয়ে হাপিয়ে গেছেন, আপনার হাপিয়ে উঠা আমাকে তিলে তিলে শেষ করে দিলো। আপনার দায়িত্ব হয়ে থাকতে চাই না আর। ভালোবাসতে পারলে, তবেই ফিরবো।”

–” তুমি আমার স্ত্রী, আয়না।”

–” স্ত্রী হয়েও লাভ কী হলো? সে-ই মনে অন্যকারো বসবাস!”

–” ওহ গড! প্লিজ ফর গড সেক, চুপ করো। আমাকে না জানিয়ে, সবটা না শুনে কেন এভাবে ওলওয়েজ পাকনামি করো?” ইউশাকে ডেকে এনে আমাকে ওর সামনে অসম্মানিত করার আগে, একবার অন্তত কথা বলবে তো আমার সাথে? আমাদের অতীত সম্পর্কে জানোই বা কতটুকু?”

–” না কিছু জানতে চাই আর না আপনাদের মধ্যে দেয়াল হতে চাই। ছেড়ে দিয়েছি তো আপনার উপর সব অধিকার। আপনি মুক্ত।”

–“মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে এসব আলোচনা না করে চলো বাসায় চল।”

–” আমি আমার বাসায় যেতে চাই।”

সমুদ্র অবাক হয়। তিন মাসে সে অনেকবার আয়নাকে ও’বাসায় যেতে বলেছে কিন্তু ও ইচ্ছুক নয়। জোড়াজুড়ি করলেও যায়নি। আজ নিজ থেকে যেচে পড়ে যেতে চাচ্ছে। আসলে সে নিজেই আয়নার আচরণে খুব সন্দিহান! কাল রাতের ঘটনার পর আয়নার আচার-আচরণে অস্পষ্টতা ফুটে উঠছে৷ তার ভাবনার মধ্যেই আয়না একটা রিকশা নিয়ে নেয়। সমুদ্র একদণ্ড ভাবে কী করবে।

তারপর কী যে হলো! এক দৌঁড়ে চলন্ত রিকশায় উঠে বসে। হাঁটুতে লাগে, মনে হয় ছিঁলে গেছে। রিকশাওয়ালা অবাক হল। সমুদ্র তোয়াক্কা করে না ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে থাকে আয়নার পানে।

তারপর আয়নাকে সুধালো, ” একবারও জিজ্ঞেস করেছো আমি মুক্তি চাই কীনা? সি ইজ মাই পাস্ট।”

–” পাস্ট হলে ওর ছবি আপনার ফোনে কেনো?”

–” আমার ফোন চেক করলে কবে? ”

–” যা জিজ্ঞেস করছি সেটার উত্তর দিলেন না যে?”

রিকশা ভাঙ্গা রাস্তার উপর দিয়ে যাওয়ার সময় বেশ খানিকটা ঝাঁকি খায়। দ্রুত সমুদ্র ওকে ধরে যেন অসুস্থ শরীরে পরে না যায় । এরপর বলে, ” ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, সিমে সব জায়গায় ওর স্থান ব্লকলিস্টে। ছবিও তো ডিলিট করেছি তাও কীভাবে দেখলে জানি না। ”

আয়না বিষাদময় হাসি হেসে বলে, ” নাম্বার ব্লকলিস্টে রেখে হচ্ছেই বা কী? মন থেকে তো ব্লক করতে পারেন নি।”

সমুদ্র পালটা কঠিন প্রশ্ন রোদের উত্তাপে জ্বলে যায়। সত্যি বলছে আয়না। ওর আসলেই দায়িত্ব সামলাতে গিয়ে হাপিয়ে গেছে। ওর শান্তি দরকার। ভালোবাসা দরকার। পৃথিবীর কোন কোণে গেলে ভালোবাসা আর শান্তি মিলবে? আদৌ সংসার জীবনে শান্তি মিলে? আয়নাকে এই মুহূর্তে কিছু বলেও লাভ নেই। ও নিজের মতো উত্তর খুঁজে নিচ্ছে। সমুদ্রের দেওয়া কোনো উত্তর-ই এইমুহূর্তে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।

রিকশা এসে থামে, আয়নার মিরপুরের বাসার সামনে। ছয়’তলা বিল্ডিংয়ের সামনে আসতেই সমুদ্র ভাড়া দেওয়ার জন্য ওয়ালেট বের করে। ওয়ালেটের ট্রান্সপারেন্ট স্থানে তার আর আয়নার ছবি প্রিন্ট করে রাখা। কোনোদিন ওয়ালেট চেক করলো না ও, তবে ঠিকই ফোন ঘেটে কুৎসিত অতীত টেনে বের করলো। তারও দোষ আছে। আয়নার তার সমন্ধে জানার সব অধিকার আছে। কিন্তু তবুও গোপক করেছে নিজের অতীত!

রিকশাওয়ালা মামার ডাকে ধ্যান ভেঙ্গে যায় তার৷ ওনি বলে, ” দুইজন ভাড়া দিচ্ছেন কেন?”

সমুদ্র দেখলো আয়না ভাড়া দিয়েছে, অথচ সে আগে টাকা বের করলো। সে বলে, ” আয়না, টাকা ব্যাগে রাখো। আমি দিচ্ছি না।”

–” আপনার দয়া আমার লাগবে না।”

রিকশাওয়ালা মামাকে টাকা দিয়ে ও গেইট খুলে ভেতরে ঢুকে। রিকশাওয়ালা মামা বলে, ” ভাইজান, ভাবীর সঙ্গে মনে হয় বিশাল কাইজা বাজছে।”

সমুদ্র টেনশন ভরা মুখে বলে, ” বিশাল তো অনেক ছোট মান, আমার মনে হয়, মহাকাশ সম কাইজা রে ভাই!”

মামা বলে, ” মাইয়া মানুষের জিদ বেশি। আমার বউটাও খালি কাইজা করে বাপের বাড়ি যাইতো। হে একবার আর আইবো-ই না বাপের বাড়ি থিকা।”

সমুদ্র উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ” তারপর কি হলো?”

–” পরে আর হইবো? তিন বাচ্চার মা হইয়া এখনো রাগ করে যায় গা।”

সমুদ্র আয়নার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সি গারেট ধরায়। গতকালকের হ্যাংওভার কাটতে না কাটতেই ছুটে’ কফিশপে গিয়েছিলো এখন মাথাব্যথায় মনে হচ্ছে মাথা ছিঁড়ে যাবে।

________________________

শায়লা চৌধুরী আজ অফিসে যান নি। বাসায় ছিলেন। দুপুরে খাওয়া এখনো হয়নি তার। আজ বাসায় কেউ নেই। আয়নার দাদা-দাদী ওনাদের বড় ছেলের বাসায় গেছেন। আলিয়া ভার্সিটিতে আর ফাহাদ অফিসে গেছে৷ একাই ছিলো বাসায়। বাসায় থাকলে ঘর গুছাতে তার ভালো লাগে। তিনমাসে এ’বাসার প্রতিটা আনাচে-কানাচেতে সে যত্ন করে সাজিয়েছেন৷ অনেক কিছু পরিবর্তন করেছেন। অনেক সুন্দর করে সাজানো হয়েছে বাসাটা। সে ভাবেও নি জীবনের কোনো এক অধ্যায়ে এমন ভরা সংসার তার কপালে জুটবে। অনেক সুখেই আছে সে। আলিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক খুব একটা আগাইনি। ও সারাদিন ব্যস্ত থাকে। রাতে ফিরে সবাই একসঙ্গে খায়। তবে এ’বাসার প্রতিটা সদস্যের প্রাণ হলো আয়না। ফাহাদ তো সবসময়ই আয়নাকে নিয়ে মন খারাপ করে থাকে। প্রায় জিজ্ঞেস করে, শায়লা, আমি কী খুব খারাপ বাবা নাকি? শায়লার খারাপ লাগে বেশ। এ’বাসার সবার জন্য তার একদম খাঁটি একটা মায়া জন্মেছে। এমনকি তার আয়ুকেও এখন ভালো লাগে৷ ওর অনুপস্থিতিতে ওর জন্য মায়া কাজ করে৷ মন চায় নিজে কল দিয়ে ও এবাসায় নিয়ে আসতে।

এমন সময় কলিং বেল বাজে। সে শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুঁজে দরজা খুলতেই হতভম্ব ও হতবুদ্ধি হয়ে যায়। চোখের সামনে কাকে দেখলো সে? আয়ু! আয়ু দাঁড়িয়ে আছে।

আয়না ভেতরে প্রবেশ করে। ওকে কেমন টায়ার্ড লাগছে। শায়লা চৌধুরী জিজ্ঞেস করলো, ” কেমন আছো, আয়ু মামনি?

আয়না জবাব দেয় না। শায়লা চৌধুরী বলে, ” কতোদিন পর এলে! এ’বাসার প্রতি আর মায়া কাজ করে না তোমার? বাবার কথা মনে পড়ে না?”

আয়না নিজের বাসাটাকে একবার দেখে নেয়। আসলেই তো! এই বাসাটা তার। বাসার প্রতি প্রান্ত আয়না-আলিয়া তাদের দু’বোনের স্মৃতি বাহক।

শায়লা বলে উঠে, ” বাবা হচ্ছে বটগাছ, বুঝেছো? বাবার ছায়া যার আছে সে সবচেয়ে শক্তিশালী। আমার ছিলো না সে’ছায়া তাই আমি বুঝি। আব্বুর সঙ্গে রাগ করে না। তোমার বাবা এসবের দুশ্চিন্তায় অসুস্থ হচ্ছে।”

আয়না বলে, ” আমি এখন ঘুমাবো। উনি আসলে ওনাকে বাসায় ঢুকতে দিবেন না।”

শায়লা বলে, ” ঝগড়া হয়েছে নাকি তোমাদের? ”

আয়না ওর রুমে চলে যায়। শায়লা চৌধুরী দ্রুত ফাহাদ সাহেবকে কল দিয়ে বলে, ” তোমার বড় মেয়ে এসেছে। আজ অফিস ছুটি নিয়ে বাসায় আসো। আমি ওর পছন্দের সব ডিশ রান্না করছি। আর সমুদ্রকে বলো আসতে।”

ফাহাদ সাহেব সত্যি চারটার আগেই এলেন বাড়িতে। শায়লার হাসি মুখ দেখে তার মন ভালো হয়ে গেলো। সে মেয়ের রুমের সামনে গিয়ে থেমে যায়। শায়লা চৌধুরী বলে, ” গিয়ে দেখো। কি করছে ও!”

ফাহাদ সাহেব দরজা অল্প ফাঁক করে দেখেন মেয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। উনি আর ডিস্টার্ব করলেন না৷ বাসায় শায়লা আয়নার পছন্দের চিকেন রোস্ট করলেন। সমুদ্রের পছন্দের খাসির রেজালা৷ বিকেলের দিকে আয়নার ঘুম ভাঙ্গে। একটু পর শায়লা চৌধুরী এক কাপ চা এনে দিলেন। আর দরজা খুলে দিতেই মিলি লেজ গুটিয়ে এসে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। আয়নার মন সামান্য ভালো হলো। নিজের কম্ফোর্ট জোনে এসে একটু হলে শান্তি পায়। মিলি আগের চেয়ে মোটা আর একটু বড় হয়ে গেছে৷ শায়লা চৌধুরী তার মাথায় হাত দিয়ে বলে, ” আয়ু৷ তুমি এসেছো দেখে আমি আজ অনেক বেশি খুশি।”

আজ শায়লার চোখে সে কোনো প্রকার ছলনা খুজে পায় না। খুব বিশুদ্ধ ছিলো হাসিটা। সেজন্য সেও হাল্কা হাসি উপহার দিলো।

সমুদ্র সারাদিন উদাসীন হয়ে বাইরে ই ছিলো। অফিয়া অব্দি যায় নি। বাবা রাতে দাওয়াত দিয়েছেন। বিকেল্বে দিকে সে তার প্রোফেসারের থেকে একটা ইমেইল পেলো। তার মেডিকেল কলেজে একটা সেমিনার হবে। তাকে ইনভাইটেশন দিয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল সেমিনার। অনেক দেশের বড় ডাক্তাররা এখানে জয়েন করবে। ওতোবড় সেমিনারে তাকে তার মেডিক্যাল কলেজের পক্ষ থেকে রিপ্রেজেন্টেশন করার জন্য মেইল দিয়েছে। তবে খুব দ্রুত সেমিনার শুরু হবে। আগামী সপ্তাহে। প্রোফেফার বোধহয় জানেন না, সমুদ্র এখন বাংলাদেশে। তবে টিকিট পাইলে অবশ্যই যাবে। এতোবড় সু্যোগ হাত ছাড়া করা যাবে না৷

সন্ধ্যায় আয়নার বাসায় গেলো সে। আয়নার দাদা-দাদী ও এসেছেন। সবাইকে খুশির সংবাদ দিলো সে। তবে মাদার তেরেসাকে এখনো বলার সুযোগ পায়নি। আয়না একবারও রুম ছেড়ে বের হয়নি। খাওয়ার সময় সে বলে উঠে তার রুচি নেই খাওয়ার। তাও শায়লা চৌধুরী রোস্ট আর পোলাও তুলে দিলো একপ্রকার জোর করে।খাওয়ার সময়েই ওদের দু’জনের ঝগড়াঝাটির পর মুখোমুখি হলো। বাসার সবাই বুঝতে পারছে কোনো গণ্ডগোল তো হয়েছেই। সমুদ্র মন দিয়ে খাওয়া-দাওয়া করছে।

আয়না অনিচ্ছায় এক লোকমা খেতেই কেমন গা গুলিয়ে আসে, সে দ্রুত বাথরুমে চলে যায়।ডাইনিং টেবিলে বসা সবাই হা হয়ে যায়।

বাথরুমে পৌঁছেই আয়না হড়বড় করে বমি করে ফেলে। বেসিন ধরে দাঁড়িয়ে পরে৷ মনে হচ্ছে সেন্সলেস হয়ে পড়ে যাবে৷

চলবে৷