ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব-৩৪+৩৯+৪০

0
1

#ইলেকট্রিক্যাল_মন
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–38

আয়নাকে বিভ্রান্তিকর ও উম্মাদের মতো চিৎকার-চেচামেচি করতে দেখে সহ্য করতে পারে না সমুদ্র। একদিকে সন্তান হারানোর বেদনা, যে দুনিয়ায় আসার আগেই বাবা-মায়ের সঙ্গে অভিমান করে ফিরে গেলো, অন্যদিকে অসুস্থ স্ত্রী, যে এ’মুহূর্তে কাউকেই চিনতে পারছে না। এমনকি নিজের বাবা অথবা স্বামীকেও না।

এতো কঠিন আর জটিল পরিস্থিতির মুখে দাঁড়িয়ে সমুদ্র যেন কথা বলতে ভুলে যায়৷ আয়নার বিধ্বস্ত চেহারা ওর সহ্য হচ্ছিলো না। কেনো এমন হলো? আজকের এই মুহূর্ত তো অনেক সুন্দর হতে পারত? কি হতো যদি আজ সে ফেরার পর আয়নাকে একগুচ্ছ দোলনচাঁপা দিয়ে নতুন করে হাসতো! কেন এমন হলো! কোনোভাবে কী এটা স্বপ্ন হতে পারে না? তার চোখ ফেটে কান্নারা দলা পেকে বেরিয়ে আসতে চায়। কেবিনের ভেতর থেকে আয়নার স্বর ভেসে আসছে। ও কোনোভাবেই ঘুমের ঔষধ খাবে না। নার্স অনেক চেষ্টা করছে কিন্তু ফলাফল জিরো।

কেবিনের পাশে, করিডোরের সামনে তার শ্বশুর ফাহাদ সাহেবকে বসে থাকতে দেখা গেলো। ওনার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে লোকটার উপর দিয়ে ঝড় যাচ্ছে। একটু পরপর চশমার কাঁচ ভেদ করে হাত দিয়ে চোখের পানি মুছেন। সমুদ্র এগিয়ে গিয়ে ফাহাদ সাহেবের সামনে দাঁড়ালো। ফাহাদ সাহেব সমুদ্র কে একবার দেখে নিয়ে মাথা নিচু করে হয়তো নিজেকে সামলানোর বৃথা চেষ্টা করেন।

সমুদ্র কিছু বলতে পারে না। কি বা বলবে সে? এই মানুষটাকে কীভাবে বলবে আজ আয়নার এই দশা, ওর যতো মানসিক অসুস্থতা সবটার মূলে সে আর তার প্রিয় অবহেলা! কি বলবে আর কিভাবে ক্ষমা চাইবে?

ফাহাদ সাহেব সমুদ্রকে একবার দেখেন কিন্তু ওনারও মুখে কোনো রা নেই। থেকে থেকে কেঁপে উঠেন ওনি। সমুদ্রের মনে হচ্ছিলো সেও যদি এভাবে কাঁদতে পারে তাহলে বুঝি একটু স্বস্তি পেতো। বুকের ভেতর দুমড়েমুচড়ে আঘাতপ্রাপ্ত অনুভূতি মাটি চাপা দিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে সে। মাটি চাপা দিয়ে রাখা কান্নানুভাব যেন বীজ বেয়ে সম্পূর্ণ মনকে ঘিরে ফেলছে৷

এমন সময় হসপিটালের একজন কর্মরত ব্যক্তি অফিস-রুম থেকে এসে বলে, ” জয়নুল স্যার, পেশেন্টের ফ্যামিলি মেম্বারের সঙ্গে একটু আলাপ-আলোচনা করতে চাচ্ছেন। উনি এখন ফ্রি আছে৷ আপনারা যেতে পারেন।”

জয়নুল হোসেন এই হাসপাতালের নামকরা নিউরোসার্জন। উনি কথা বলতে চাচ্ছেন। সমুদ্র আর ফাহাদ সাহেব ডক্টরের রুমের দিকে পা বাড়ালো।

ডক্টর জয়নুল তখন লাল চা খাচ্ছিলো। ওরা প্রবেশ করার পর সামান্য হেসে আয়নার সিটি স্ক্যান রিপোর্ট আরোও কিছু রিপোর্ট খুলে বসলেন৷ খুব মনোযোগ দিয়ে দেখে নিলেন সবটা। এরপর আন্তরিক গলায় বলে, ” পেশেন্টর মাথায় বড় কোনো আঘাত তো লাগে নি। রিপোর্ট ভালো এসেছে৷ হিস্ট্রি থেকে শুনেছি মিসক্যারেজ হওয়ার সময় উনি পড়ে গিয়েছিল ফ্লোরে। এজন্য সব রকম টেস্ট রিপোর্ট চেক করলাম।”

এরপর কাপে চুমুক দিয়ে চা খেয়ে বলে, ” আমি তাহলে রোকসানা আপার কাছে প্রেফার করে দিচ্ছি। কিছু মেডিসিন দিয়েছি। আর আমি তো আছি-ই৷ ইমপ্রুভমেন্ট আসছে কিনা দেখবো।”

জয়নুল স্যার সাইক্রিয়াটিস্ট রোকসানাকে প্রেফার করে দিয়ে গেলেন। সমুদ্র নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থেকে আয়নার কেবিনের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ,দরজা অল্প খুলে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকালো। মেয়েটা শুয়ে আছে। কিন্তু চোখ খোলা। নার্সের কাছে শুনেছে ও নাকি কিছুতেই ঘুমাতে চাচ্ছে না। সে ডক্টরের সঙ্গে কথা বলার উদ্দেশ্য কেবিন ছাড়ে।

________________________

বিকেলের দিকে পিউ একাই হাসপাতালে এসেছে। উদ্দেশ্য ভাবীকে একবার হলেও দেখা। যদিও মায়ের কাছে শুনেছে ভাবী কাউকেই চিনতে পারছে না। খুব বাজে সিচ্যুয়েশন যাচ্ছে। আলিয়া সকাল থেকে হাসপাতালে ছিলো। ওকে একটু আগেই বাসায় ফিরে গেছে৷ পিউয়ের এতো পরিমাণ খারাপ লাগছে৷ ওর একটু পরপর চোখ ভিজে উঠছে৷ কেবিনের মেইন গেইটের সামনে তাকে আটকে দিলো। ওনারা জানালো ওলরেডি কেবিন নাম্বার চার’শ বারোর পেশেন্টর সঙ্গে দুইজন এটেন্ডেট আছেন। ওরা আর কাউকে এলাউ করবে না। অগত্যতা সে লবিতে ফিরে আসে। ভাবীর সব আপডেট তার কাছে আছে। তবুও চোখের দেখা দেখতে মন বড় কেমন করছে। ভাবী তার খুব প্রিয় ব্যক্তি। আর দশটা ননদের মতো মোটেও সে তার ভাবীকে হিংসা করে না। বরং ভাবীই আজকাল ভাইয়ের বেশি ক্লোজ তার। ভাবীর সঙ্গে সখ্যতা বেড়েছে সেই সুবাদেই বুঝত ভাই আর ভাবী হ্যাপি ম্যারেড কাপল না। ভাইয়া অনেক অবহেলা করে ভাবীকে! অবশ্য ভাবী কখনো অভিযোগ করেনি। ভাইয়ার উপর তার রাগ উঠে অনেক। ভাইয়ার জন্য তাদের অনেক সাফার করা লাগছে। অস্ট্রেলিয়া গিয়ে না জানি কোন মেয়ের পাল্লায় পরলো। তারপর থেকে তাদের বাসার সব শান্তি উবে গেল! ভাইয়ের বিয়ের সময় সে খুশিই ছিলো, এট লিস্ট এখন তারা আবার আগের মতো শান্তিতে থাকবে। কিন্তু ভাগ্য বুঝি অন্যকিছুই দেখাচ্ছে৷

এমন সময় হুট করে পেছনে থেকে কেউ তাকে ডেকে উঠে, ” এক্সকিউজ মি, আপনি আয়নার ননদ তাই না?”

হাসপাতালে কেউ তাকে এভাবে ডেকে উঠবে সে কল্পনাও করেনি। চোখ বড় বড় করে পেছনে তাকাতেই দর্শন হলো একজন যুবকের সাথে। শ্যামলা গায়ের রঙ, কিন্তু লম্বা বেশ। পরনে চলনসই জামা-কাপড়, অবশ্য হাসপাতালে মানুষ জামা-কাপড়ের পরোয়া করে না। যুবকের পেছনেই আরোও দুইজন দাঁড়িয়ে আছে। এরপর মেয়েটাকে পিউ চেনে। ভাবীর খুব ভালো ফ্রেন্ড৷ কিন্তু এই লম্বা ছেলেটা কে?

সে ভ্রু কুচকে তাকালো এবং বলে, ” আপনি কে? আমাকে কীভাবে চিনলেন?”

রঙ্গনের চেহারায় যেন একটা সূক্ষ্মতম সন্তষ্টির ভাব ফুটে উঠে। বরাবরই তার স্মরণ শক্তি প্রবল। নাহলে আয়নার ফেসবুক পোস্টে দেখা ছবির মেয়েটিকে বাস্তবে চেনা কারো পক্ষেই সম্ভব না৷ তারা বন্ধুরা আয়নার অসুস্থতার খবর পেয়েই হাসপাতালে এসেছে দেখা করতে কিন্তু ভিজিটিং আওয়ার না এখন বিধায় দেখা করতে দিবে না। দেখা না করতে পারলেও খোঁজ-খবর জানতে চায় তারা। কিন্তু আয়নার পরিবার বা সমুদ্র ভাইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে। মন খারাপ করে ফিরে যেতে চাইলে রঙ্গনের চোখ যায় লবিতে বসে ধ্যান করতে থাকা আয়ুর ননদের দিকে।

–” হ্যালো, কে আপনি? ”

রঙ্গন কিছুটা অস্থির চিত্তে বলে, ” আমরা আয়ুর ভার্সিটির ফ্রেন্ড। ওকে দেখতে এলাম বাট এলাউ করছে না। ও এখন কেমন আছে?”

পিউ মন খারাপ করে বলে, ” আমাকেও ঢুকতে দেয় নি। ভাবী এখন আউট অফ ডেঞ্জার। কেবিনে শিফট করেছে।”

পিউ বুঝে পাচ্ছে না এই অপরিচিত ছেলেটাকে ভাবীর মানসিক অসুস্থতার কথা জানাবে কিনা?

রঙ্গন বলে উঠে, ” আপনার ফোন নাম্বার দেওয়া যাবে?”

পিউ নিজের ফোন নাম্বার দিয়ে দিলো।

রঙ্গন গিয়ে অর্পিতা আর সুব্রত এর সাথে কথা বলে। ওরা হাসপাতাল ছেড়ে গেলেও রঙ্গন দাঁড়িয়ে থেকে পুনরায় পিউয়ের কাছে গিয়ে বলে, ” আপনি এখন বাসায় যাবেন নাকি থাকবেন? থাকলে চলুন কোথাও বসি?”

–” বাসায় যাবো। বাট উবার রাইড বারবার ক্যান্সেল করছে।”

–” আমার সঙ্গে আসতে পারেন। ড্রপ করে দেই?”

পিউ ভাবলো যে ছেলেটার সঙ্গে যাবে না। চেনা নাই জানা নেই হুট করে কারো সাথে খাতির তার পছন্দ না।সে বলে, ” আপনাকে চিনি না। কেন যাবো আপনার সঙ্গে? ”

–” এজন্য বললাম কোথাও বসি। কথা বলে পরিচিত হই। এনিওয়েজ আমি রঙ্গন। আয়ুর ব্যাচমেট।”

পিউ বসতে চাচ্ছিলো না কিন্তু রঙ্গন ওকে নিয়ে ক্যান্টিনে বসে কফি খাওয়ালো। দু’একটা কথা-বার্তা চলছিলো তাদের মাঝে। রঙ্গন বেশ স্পষ্টভাষী।

কফি খাওয়ার পর্ব শেষ হলে, রঙ্গন বলে উঠে, এখন কী আমার সঙ্গে যাওয়া যাবে? না মানে আপনার রুলস মতে, অপরিচিত কারো সাথে আপনি যাতায়াত করেন৷ কিন্তু এখন তো আমরা সেমি-পরিচিত।”

____________________

ডক্টর রোকসানার কেবিনে ফাহাদ সাহেব এবং সমুদ্র বসে আছে। শায়লা চৌধুরীও জোর করে ভেতরে এলেন।

রোকসানা ম্যাডাম পেশেন্ট একটু আগেই দেখে এসেছেন। উনি আবার সমুদ্রকে চেনে। পুরা হিস্ট্রি শোনার পর উনি বলে উঠে, ” পেশেন্ট মনে হয় অতিরিক্ত ট্রমা-ডিপ্রেশন অথবা অনেক বড় মানসিক আঘাত পেয়েছে এজন্য মিসক্যারেজের বিষয়টি ব্যাক ফায়ার করে এই অবস্থা। আপনারা ওর পরিবার। ওর ব্যাপারে সব চেয়ে ভালো আপনারা জানেন৷ কোনো ঘটনা কি ঘটেছে যেটা ও মানতে পারে নি বা কষ্ট পাচ্ছিলো?”

ফাহাদ সাহেব ও সমুদ্র দুজনেই ভীষণ আত্মগ্লানিতে ভোগা শুরু করলো। শায়লাও যেন একদম জমে যায়৷

রোকসানা ম্যাডাম নিজে থেকেই বলে, ” ওর বাবার সেকেন্ড ম্যারেজ হয়েছে যেটা নিয়ে ও আপসেট। এটা বলা হয়েছে আমাকে। এর বাইরে অন্যকিছু? ছোটো বেলার কোনো ট্রমা? ”

ফাহাদ সাহেব বলে উঠে, ” ওর আম্মু যখন মারা যায় ও সবে ক্লাস সিক্সের বাচ্চা ছিলো। ওর মা মারা যাওয়া দুই সপ্তাহ পর আমি খেয়াল করি আয়না ঠিকঠাক কথা বলে না। একদম চুপ হয়ে গেছে। আমি ভেবেছিলাম মা হারানোর শোকে ছোট মানুষ কথা বলতে চাচ্ছে না। কিন্তু আরোও এক সপ্তাহ কাটার পরও ও কথা বলত না। একদম চুপ হয়ে যায়৷ আমার মধ্যে ভয় ঢুকে যায়৷ আমি দ্রুত চাইল্ড স্পেশালিষ্ট দেখাই।”

রোকসানা ম্যাডাম বলে, ” তারপর কি হলো?”

–” ডাক্তার বললো বাচ্চাদের সময় দিতে। আশেপাশে আপনজনদের রাখতে। আমি দ্রুত ওদের নিয়ে গ্রামে যাই। ওদের দাদা-দাদী ফুপুর সঙ্গে রাখি কিছুদিন। তারপর কক্সবাজার ঘুরতে নিয়ে যাই। আস্তে আস্তে ও আবার নর্মাল হয়ে যায়৷লম্বা গ্যাপের পর স্কুলে যাওয়া শুরু করে।”

–” এই সমস্যাটা আর কখনো হয়েছিলো? হুট করে চুপ হয়ে যাওয়া?”

ফাহাদ সাহেব মাথা ঝাকিয়ে বলে, ” না, ছোটবেলায় একবারই ওর মা মারা যাওয়ার পর এমন করেছিল। এরপর আর কখনোই হয় নি।”

রোকসানা বলেন, ” ছোটবেলারও একটা ট্রমা আছে।”

এমন সময় শায়লা চৌধুরী মুখ খুললেন, উনি বলে উঠে, ” আয়ু কিছুদিন ধরে খুব চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলো। মিসক্যারেজের আগেই। একদম চুপচাপ। ফোর্স করে কথা বলাতে হচ্ছিলো। নিজে থেকে কিছু বলতো না।রুমেই থাকতে চাইত। ভার্সিটিও যেতে চাইতো না।”

রোকসানা ম্যাডাম বলে, ” হুট করে কি হলো আবার? কোনো ঘটনা ঘটেছে যেটা ও আবারও মানতে পারছিলো না?”

শায়লা-ই জবাব দেয়, ” আয়না আর সমুদ্রের মধ্যে একটু মনোমালিন্য চলছিলো বোধহয় সেজন্য।”

রোকসানা ম্যাডাম সমুদ্রের অনেক সিনিয়র হন, উনি বলে উঠে, ” তোমাদের মধ্যে সব ঠিক ছিলো না?”

সমুদ্র একদম চুপ হয়ে যায়। মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না৷

রোকসানা ম্যাডাম বলে, ” দেখো, সমুদ্র, যতোদ্রুত তোমরা নিজেরা বুঝবে ওর ট্রমার কারণ কি৷ ততোই উপকার। এখন আর লুকাছাপা করার কিছু নেই৷ আমার মনে হচ্ছে ওর কথা-বার্তা শুনে যে তোমরা ডিভোর্স নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলে। ওকে বারবার ঘুমাতে বলছি কিন্তু ও না ঘুমিয়ে থাকছে৷ কারণ জিজ্ঞাসা করলে বারবার বলছে সমুদ্র চলে যাবে৷ কিন্তু আবার তুমি সামনে গেলে তোমাকে চিনতে পারছে না।সেটা সমস্যা না। সিজোফ্রেনিয়ার প্রথম ধাপে রোগী আত্মীয়-স্বজনদের চিনে না আবার দেখলে খুব রিয়্যাক্ট করে৷ আমি আগেই সিজোফ্রেনিয়া বলে ডিকলেয়ার দিচ্ছি না। হতে পারে অতিরিক্ত মানসিক আঘাত পেয়ে এমন এবনর্মাল ব্যবহার করছে।”

সমুদ্র বলে, ” আমি মোটেও ওকে ডিভোর্স দিবো বা দিতে চাই এমন কোনো আলোচনা করি নি। বরং ও নিজ থেকে অনেক কিছু এ্যাজিউম করে নিচ্ছিলো।”

সমুদ্র শ্বশুরের সামনে আর কথা বাড়াতে চায় না। চুপ হয়ে যায়।

রোকসানা ম্যাডাম বলে, ” তোমাদের নিজেদের মধ্যে সব ক্লিয়ার করা দরকার। দেখো, তোমরা ছাড়া আয়নার কিন্তু আর কেউ নেই। বাইরের মানুষ এ’অবস্থায় ওকে দেখবে না৷ কিন্তু তোমরা ওর পরিবার তোমরা ওকে ফেলে দিতে পারবে না। আমরা ডাক্তার, ঔষধ দিবো কিন্তু ওর এই মুহূর্তে মানসিক আরাম আর শান্তি দরকার। যেটা কেবলমাত্র ওর ফ্যামিলি ইনসিউওর করতে পারবে। সাতদিনের মধ্যে ওর অবস্থার উন্নতি না হলে হাসপাতাল থেকে সরকারি মানসিক হাসপাতালে রেফার করতে হবে।”

সমুদ্র গ্লানি ভরা চাউনিতে তাকালো।

রোকসানা ম্যাডাম বলে, ” আচ্ছা আমরা পরে আলোচনা করবো৷ পেশেন্টকে একবার ভিজিট করে আসি আমি।”

রোকসানার সঙ্গে সমুদ্রও বেরিয়ে যায়। ফাহাদ সাহেব উঠে দাড়ালে শায়লা ওনার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলে ফাহাদ সাহেব বলে, ” শায়লা, আমি তোমার চেহারা দেখতেও চাইছি না। যাও আমার সামন থেকে৷”

শায়লা চৌধুরী আহত দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকালো।

সমুদ্র হাসপাতালের নার্স আর ডাক্তারের অনেক রিকুয়েষ্ট করে একটা এপ্রোন জোগাড় করে উনারা প্রথমে রাজী হচ্ছিল না। হসপিটালে এমন রুলস নাই। তবে মানসিক রোগী জন্য একটু ছাড় দিলো৷ সমুদ্র এ দয়া করার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে৷ এপ্রোন পরে ডাক্তার হয়ে আয়নার কাছে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলো।

সমুদ্র আর রোকসানা দুইজনই এপ্রোন পরে আয়নার কেবিনে গেলো। আয়না বসে ছিলো তখন। সমুদ্র এপ্রোন পরে আসায় ও বুঝে না এটা ওর পরিচিত কেউ। হয়তো সে এই মুহুর্তে এতোটা বোঝার ক্ষমতা রাখছে না। ওর সামনে ভাতের প্লেট পরে আছে। দুপুরে মেডিসিন খেয়েছে কিন্তু ভাত খায় নি। রোকসানা ম্যাডাম সব চেইক করে বেরিয়ে গেলেও সমুদ্র আর নার্স রয়ে যায়৷

নার্স বলে উঠে, ” আপু, আপনি ভাত খান। নাহলে এই ডাক্তার কিন্তু ইনজেকশন দিয়ে দিবে। ইনজেকশন দিলে হাতে এমন ব্যথা হবে তখন হাত নাড়াতে পারবেন না।”

আয়না নড়েচড়ে উঠলো এরপর বললো, না, ভুলেও আমাকে ইনজেকশন দিবেন না।”

ও অস্থিরতা করতে শুরু করলো। অনেক বেশি প্যানিক শুরু করে। বিভ্রান্তের ন্যায় এদিক-ওদিক তাকাতে থাকে। তারপর সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলে, ” ডাক্তার আমাকে প্লিজ ইনজেকশন দিবেন না। ইনজেকশন দিলে আমি ঘুমায় যাবো। ঘুমানো যাবে না।”

সমুদ্র সামনে এসে, ওর কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বলে, ” কেন ঘুমানো যাবে না?”

আয়না এবার সর্তক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে, খুব লো ভয়েজে কেমন শিউরি উঠবার ন্যায় আওয়াজে বলে, ” আমি ঘুমায় গেলে সমুদ্র চলে যাবে। এজন্য জেগে আছি। জেগে জেগে ওকে পাহাড়া দিচ্ছি।”

সমুদ্র ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, ” যাবে না। তুমি আরাম করে ঘুমাও।”

আয়না আবার অস্থির হয়ে বলে, ” না। না। কোনোভাবেই ঘুমাবো না আমি। আমাকে কোনো মেডিসিন দিবেন না ডাক্তার। আমি তাহলে মারা যাবো।”

সমুদ্র ওকে আলতো করে ধরে বলে, ” মেডিসিন খেলে তুমি সুস্থ হয়ে যাবে। প্লিজ খাও৷ খেয়ে আরাম করে ঘুমাও। কেউ কোথাও যাবে না।”

আয়না আগুন চোখে তাকিয়ে বলে, ” যাবে! আমি ঘুমায় গেলেই সমুদ্র চলে যাবে।”

নার্স জিজ্ঞেস করে, ” সমুদ্র কোথায় যাবে আপু? গেলে যাক। আমরা ঘুমাই। সমস্যা নেই তো।”

আয়না ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে, ‘ সমুদ্র ইউশার কাছে যাবে। ওখানে গেলে ও আর আমার কাছে আসবে না। এজন্য আমি ঘুমাবো না।”

কালকে থেকে একই কথাই বলে যাচ্ছে ও। নার্স চলে যায়। কেবিনে একা সমুদ্র থাকলো। ও আয়নাকে বলে উঠে, “তুমি ভাত খাও প্লিজ৷”

তারপর আয়নার মাথায় হাত বুলায় দিলো। আয়না বলে উঠে, ” আপনি আমার গায়ে হাত দিবেন না।”

সমুদ্র একটু সরে এসে বলে, ” ভাত খাও। নাহলে ইনজেকশন পুশ করবো।”

আয়না ঔষধ আর ইঞ্জেকশনকে খুব ভয় পাচ্ছে। তার উপর ডাক্তার এসেছে ইঞ্জেকশন দিতে এতে ও আরোও ভয় পেয়ে যায়। দ্রুত ভাতের প্লেটে থাবা বসায়।

ডান-বাম দুইহাত দিয়ে খাচ্ছে, খাবার ফেলছে। মুখ থেকে উগলে ফেলে দিচ্ছে। কোনো কিছুর ঠিক নেই। সমুদ্র খুব যত্ন করে ওকে ভাত মাখিয়ে হাতে তুলে দিতে থাকে। আয়না কিছু বলে না। ওর মধ্যে এখন কোনো কিছু বোঝার ক্ষমতা নেই৷ অবুঝের মতো এখন ও। খাওয়া-দাওয়া করিয়ে দিয়ে ওয়াশরুমে নিয়ে যাবে, তার আগেই আয়নার মনে হয় কোনো একটা সেন্স কাজ করছে না। ও বুঝতে পারছে না যে ওর চাপ আসছে কিনা, ক্ষুধা পেয়েছে কীনা। ওয়াশরুম যাওয়ার আগেই ও জামা-কাপড় নোংরা করে ফেলে। তখন সমুদ্রের পরিচিত নার্স আরিফা আপু আসেন দেখা করতে। দু’জন মিলে আয়নাকে ক্লিন করে দিয়ে বেডে বসায়। আয়না একদম চুপ হয়ে গিয়েছিলো। সমুদ্র আরিফা আপার কাছ থেকে চিরুনি নিয়ে ওর চুল আছড়ালো তারপর ঝুটি করে দিলো। আয়নাকে কড়া ডোজের ঘুমের ঔষধ দেওয়া হয়েছে তবুও ও চোখ মেলে তাকিয়ে আছে৷ ঘুমের জন্য ও টলছে, তবুও চোখ খোলা। একা একা বিড়বিড় করছে। কিসব বলছে অসংলগ্ন কথা-বার্তা৷ একা একাই চিল্লালো। একা একাই তারপর হাসলো। তারপর ফের চুপ হয়ে যায়। একটু পর আবার কাঁদা শুরু করল, কাঁদতে কাঁদতেই হেসে ফেলে।

যেকেউ নিজের আপনজনকে এমন অবস্থায় দেখলে নিজেই পাগল হয়ে যাবে৷ সমুদ্রের মনে হচ্ছিলো ওর নাড়ি-ভূড়ি উলটে বমি হয়ে যাবে। সে নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে হাউমাউ করে কেঁদে দেয়। নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। মনের সব চাপা কষ্ট চোখ বেয়ে গড়িয়ে যায়৷ শব্দ করে কেদে উঠলো। সে জীবনেও এভাবে এতোটাও ভেঙে পড়েনি। আজ যেন তার সমস্ত দুনিয়া উলোটপালোট হয়ে গেছে।

আয়না উঠে এসে তাকে একবার দেখে। এরপর বেড থেকে নেমে সমুদ্রের কাছে যায়। এপ্রোন পরা সমুদ্রের মাথায় হাত বুলালো। একটু আগে সমুদ্র যেভাবে ওকে আদর করে দিচ্ছিলো, ঠিক সেইভাবে। হয়তো স্মৃতিতে এখন এইটুকু মেমোরিই আছে ওর। যত্নের বদলে যত্ন ফিরিয়ে দিচ্ছে কী ও?

সমুদ্র চোখ তুলে তাকালে ও জিজ্ঞেস করলো, ” ডক্টর, আপনি কেন কাঁদছেন?”

সমুদ্রর প্রশ্নটা শোনামাত্র যেন বুকটা হুহু করে উঠে৷ ওর কাছে উত্তর নেই কোনো। কি বলবে সে মেয়েটাকে?তাকে কষ্ট দিয়ে এখন সেও কষ্ট পাচ্ছে?

আয়না পুনরায় জিজ্ঞেস করে, ” আপনার অনেক কষ্ট হচ্ছে? আমারও অনেক কষ্ট। আমিও কাঁদবো।”

সমুদ্র আয়নাকে ধরে বলে, ” তোমার কোনো কষ্ট নেই আয়না। তোমার কোনো কষ্ট নেই।”

তারপর আস্তে করে বলে, ” আজ থেকে আমি তোমার খুব যত্ন নিবো। আবার আগের মতো সুস্থ হয়ে যাবে তুমি, আমার সোনা। তুমি আবারও সুস্থ হয়ে যাবে খুব দ্রুত। আমি সবরকম চেষ্টা করবো। যত্নের কোনো কমতি রাখবো না সোনা। আর কোনোদিন কষ্ট দিবো না। আমায় ক্ষমা করে দাও আয়না। আমি তোমার ঠিকমতো যত্ম করতে পারি নি। টেক এজ গ্রান্ডেট হিসেবে নিয়ে নিয়েছিলাম। সর‍্যি আয়না। আমাকে ক্ষমা করো। আমি তোমাকে সুখে রাখতে পারি নি। সর‍্যি। আর কোনোদিন অবহেলা করবো। হৃদয়ের সবটা নিঙড়িয়ে তোমাকে ভালোবাসবো। কেবল তোমার যত্ন নিবো।”

চলবে৷

#ইলেকট্রিক্যাল_মন
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–39

–“ডাক্তার সাহেব আপনি কষ্ট পায়েন না। কেউ কষ্ট পেলে আমারও কষ্ট লাগে।”

আয়নার কথায় ঘোর কাটে সমুদ্রের। সে নিষ্পলক চোখে তাকায় ওর পানে। যার দেওয়া আঘাত সহ্য করতে না পেরে আজ তোমার এই দশা, তাকেই সান্ত্বনা দিচ্ছো,মেয়ে। আয়না তুমি খুব ভালো মনের৷ তোমাকে এতো সহজে পেয়ে গিয়ে তোমায় মূল্যায়ন করতে পারি নি। জানি না, তুমি সুস্থ হওয়ার পর কীভাবে তোমার সামনে মুখ দেখাবো। আমৃত্যু তোমার কাছে অনুতপ্ত থাকবো। আমায় ক্ষমা করো না! আমি ক্ষমার যোগ্য নই– মনে মনে আওড়ায় সমুদ্র।

আয়না তার সামনে দাঁড়িয়েই ছিলো। একদম শান্ত, স্বাভাবিক। কিন্তু ক্ষণেই সে কীসব চিন্তা করে পুনরায় চেচামেচি শুরু করে। হাতের কাছটায় একটা সাইড টেবিল আছে। সাইড টেবিলের উপর ঔষধের বক্সটা রাখা। আয়না ঔষধের বক্সটা ছুড়ে ফেলে দেয়। কেমন হিংস্রতর আচরণ করে ও। চোখ-মুখ শক্ত করে ফেলে নিজের৷ নিজেই নিজের মাথার চুল টানতে থাকে।

সমুদ্র ঠায় এক পল তাকিয়ে থেকে ওকে চুপ করানোর জন্য সামনে আগায়৷ কিন্তু আয়না ভায়োলেন্স হচ্ছিলো বেশি৷ বেডকভার টেনে ফেলে দিয়ে চেচাতে থাকে। আপাতত ও এখানে থাকতে চাচ্ছে না। বাসায় যাবে নাকি তাও এই মুহুর্তেই ওর বাসা যাওয়া চাই। ওকে নাকি এখানে মে৷ রে ফেলার জন্য আনা হয়েছে। সাদা রঙের জামা পরা ডাক্তার-নার্স ওকে মারছে নাকি!

ওর হৈচৈ শুনে নার্স-ডাক্তার ছু’টে আসে। এটা একটা প্রাইভেট হাসপাতাল। এখানে মানসিক রুগী খুব কমই আসে। আশেপাশের কেবিনে অন্য রুগী এমন হৈচৈ তে ডিস্টার্ব হবে। ওরা এমন ভায়োলেন্স ক্রিকেট করতে দিবে না। সমুদ্র আয়নাকে থামাতে গেলে আয়না ওর গালে চ ড় বসায়, খাম৷ চি মারে। নার্স এসে আটকাতে গেলে নার্সের চুল ধরে টানে। এদিকে ডক্টর রোকসানা ওয়ার্ডে গেছেন। উনি নাকি ইঞ্জেকশন পুশ করতে মানা করেছে আরও চব্বিশ ঘন্টা অবজারভেশনে রাখতে চায়। কিন্তু আয়নার অবস্থা ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। ও স্বাভাবিক অবস্থায় কোনোভাবেই ঘুমাবে না। ঘুমের ঔষধ ও নিচ্ছে না। এখন ইঞ্জেকশন পুশ করিয়ে ঘুমের কড়া ডোজের মেডিসিন দেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই৷ রোকসানা ম্যাডাম আসার আগেই জয়নুল স্যারের সঙ্গে পরামর্শ করে ইঞ্জেকশন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। আয়না ক্রমশ আরোও হিংস্র হচ্ছে। সমুদ্রের গা লে খামচে র ক্ত বের করে দিয়েছে৷ ওর ধারণা ডাক্তার ওকে মারবে। এজন্য আত্মরক্ষা করছে৷ কাছে ঘেষতে দিচ্ছে না।

দুইজন নার্স এসে ওকে দুইদিক থেকে ধরে। ওইসময় আয়না আরোও উত্তেজিত হয়ে যায়। সে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ছোটাছুটি করে। ব্যথা পাচ্ছে হাতে নিজের দোষে। পেটেও চাপ পড়ছে। ব্লিডিংও হচ্ছে কীনা জানা নেই। কিন্তু সেসব বোঝার শক্তি লোপ পেয়েছে তার৷ সমুদ্রের ওর দিকে চেয়ে কি যে মায়া হলো৷

সে নার্সকে বলে উঠে, ” আপা, একটু আস্তে ধরেন ওকে। ও ব্যথা পাচ্ছে৷”

নার্স ভদ্রতার সঙ্গে বলে, ” উনি এখন অনেক হাইপার হয়ে আছে। আমরা ধরে না রাখলে নিজেই নিজের আরোও ক্ষতি করতে পারে। ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড।”

আয়নাকে একপ্রকার ধরে-বেঁধে ইঞ্জেকশন পুশ করে দেওয়া হয়৷ ইঞ্জেকশন পুশ করার পর আয়না অনেক জোরে কান্না শুরু করে। কিসব বিলাপ বকে। ও একদম অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। টেনেও ওকে বেডে বসানো যাচ্ছে না। উপায় না পেয়ে সমুদ্র দ্রুত ওকে কোলে তুলে বেডে শুইয়ে দিয়ে বলে, ” আয়না, একটু ঘুমাও ফ্রেশ লাগবে। প্লিজ ঘুমাও সোনা।”

আয়না চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে থাকে। কিছু বলে না৷

নার্স জানালো, অনেক কড়া ডোজের ঘুমের ঔষধ দেওয়া হয়েছে, স্বাভাবিক অবস্থায় কেউ এই ঔষধ খেলে পাক্কা পনের-ষোল ঘণ্টা ঘুমাবে৷ সমুদ্র ভাবে আয়নাও যদি এত্তো লম্বা ক্ষণ ঘুমায় তাহলে অনেক ইমপ্রুভমেন্ট আসবে ওর। কিন্তু সমস্যা হলো ও তো ঘুমাতেই চায় না৷ মানসিক রোগীর বেশিরভাগই ঘুমাতে চায় না। ঘুমালে তো ন্যাচারালি নার্ভ রিল্যাক্সড হবে। এজন্য ঘুমায় না, ফলেই মানসিক রুগী। আয়নাকে চুপচাপ সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে খুব মায়া লাগে সমুদ্রের। খুব কষ্ট হয়। সারা শরীরে বেদনার নীল রাঙ্গা বিষ ছেয়ে যায়।

নার্স বলে, ” হাল্কা কিছু খাইয়ে দিয়ে ঘুমাতে বলুন ওনাকে।”

সমুদ্র বিস্কুট এনে ওর মুখের সামনে ধরে। আয়না ইশারা করে জানান দেয় যে, সে খাবে না৷

সমুদ্র বলে, ” অল্প একটু খাও। মজা অনেক বিস্কুটটা। দেখি একটু হা করো৷ আমি খাইয়ে দিচ্ছি।”

আয়নার মুখে বিস্কুট দিলে ও খাবার উগলে ফেলে দিলো। কোনো ভাবেই কিছু খাবে না এখন। সমুদ্র পাশে দাঁড়িয়ে থেকে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে৷ একটু পর পায়ের পাতা মালিশ করে দেয়। যেন ঘুম এসে পড়ে ওর। বিশ-ত্রিশ মিনিট পর, আয়না চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়ে।

সমুদ্র স্বস্তি পায় যেন। সাইডে বসার চেয়ারে বসে থাকে। নিজের একবার ওয়াশরুম যাওয়ার দরকার। সে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেলে, মনে হলো পেছনে থেকে কোনো আওয়াজ আসে। কিন্তু আমলে নেয় না। ভাবে বাইরে থেকে শব্দ আসছে। ওয়াশরুমে ঢুকে পরে৷

ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে বেডে চোখ যেতেই ওর মুখ ভয়ে শুকিয়ে যায়। বেড ফাঁকা। আয়না বেডে শু’য়ে নেই, এমন কি রুমের কোথাও ওর অবস্থান নেই। সমুদ্র ভয়ে ঘামা শুরু করে।

______________________

ফাহাদ সাহেব বাসায় এলেন আজ দুইদিন পর। একটানা দুইদিন সে মেয়ের কেবিনের পাশে বসে থেকেছেন। এমনকি রাতেও সরেন নি। মেয়ের এই দুর্দশা দেখে সে নিজেই যেন মানসিক আঘাত পাচ্ছেন।কয়েক দিন এভাবে গেলে সে নিজেও পাগল হয় কীনা কে জানে। তার চোখ লাল হয়ে আছে। সে ঘুমের ঔষধ খেয়ে বসে আছে। ঘুম নেই চোখে। সমুদ্রের ব্যাপারে শায়লার থেকে একটা ভয়ংকর তথ্য শুনেছে। শায়লা অবশ্য মুখ ফসকে বলে দিয়েছে৷ অনিচ্ছায় বলে ফেলেছে। সমুদ্রর বিয়ের আগে অস্ট্রেলিয়ায় মেডিকেলে পড়ার সময়কালে একটা ই হুদি মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিলো। ওই মেয়েকে নাকি বিয়েও করার কথা ছিলো। কোনো কারণে বিচ্ছেদ হয়, তারপর দেশে এসে তার মেয়েকে বিয়ে করে। এতোবড় তথ্য তার জানা ছিলো না। তার কাছ থেকে শায়লা বিষয়টা গোপন করেছে। সে যদি জানতো ছেলের এমন আগে সম্পর্ক আছে, কোনোদিন মেয়ে দিতো না৷ প্রতারণা করে, ছলনা করেছে তাও সে যাকে উনি অন্ধের মতো বিশ্বাস করে৷ একাকীত্বে ভরা এই জীবনটায় সবচেয়ে বেশি সে শায়লাকেই ভরসা করে এসেছে৷ অথচ শায়লা এতোবড় কথা গোপন রেখে সমুদ্রের জন্য আয়নার প্রস্তাব আনে। শায়লা কেন এমন করলো? কী লাভ হলো তার মেয়েকে এভাবে ঠকিয়ে? ফাহাদ সাহেব নিজে যেমন সম্মানিত, ধনী ব্যক্তি চাইলে ভালো জায়গায় মেয়ের বিয়ে দিতে ক্ষমতা রাখে তাহলে কেন অন্যকারো সাথে জড়িয়ে থাকা ছেলের প্রস্তাব আনে শায়লা?

শায়লার উপর তিনি ভীষণ ক্ষিপ্ত। কোনোদিন মাফ করবে না সে শায়লাকে। আজকে তার মেয়ে হাসপাতালের বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছে। বাবা হয়ে নিজের প্রতি ঘৃণা জমছে তার। শায়লা তাকে বিশাল বিপদ থেকে রক্ষা করেছিলো জন্য ধরেই নিয়েছে শায়লা সর্বদা তার ভালো চায়। তার মেয়ে দুটোকেও আদর করে। শায়লার মুখে সমুদ্রের কথা শুনে সে দ্বিতীয় চিন্তা মাথায় আনে নি। রাজী হয়ে যায়।

তখনই শায়লা চৌধুরী রুমে প্রবেশ করে। ওনাকেও ক্লান্ত দেখাচ্ছে। কেউ কোনোদিন ভাবে নি আয়নার সঙ্গে এতো বাজে কিছু হবে। কেউ বিষয়টি মানতে পারেনি।

শায়লা নম্রসুরে বলে, ” খেতে আসো, ফাহাদ।”

শায়লার দিকে আক্রোশ ভরা চাউনিতে তাকিয়ে উনি বলে উঠে, ” আমি খাবো এখন এটা ভাবলে কীভাবে? আমার মেয়ে অসুস্থ শায়লা। তাও আমার জন্য! আমার ভুলের জন্য। আমি বাবা হয়ে আমার মেয়েটাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি।”

–” ফাহাদ, ও সুস্থ হয়ে যাবে। ডাক্তার বলেছে তো। মেডিসিন নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।”

— শায়লা কেন তুমি এমন করলে?”

শায়লা ভয়ে সামান্য কেঁপে উঠে। ফাহাদকে কয়েক বছর ধরেই চেনে। সরকারি বড় কর্মকর্তা হওয়ার পরও ওর মধ্যে রাগ করার স্বভাব নেই। কিন্তু আজ ওনার চোখে ক্রোধ দেখতে পাচ্ছে শায়লা।

–” কেনো আমাদের সাথে প্রতারণা করলে? আমার বাচ্চা মেয়েটার সঙ্গে কিসের এতো শত্রুতা? শায়লা, তুমি আমার ভরসার পাত্র ছিলে। তোমাকে এতো বিশ্বাস করতাম কিন্তু তুমি পেছন থেকে পীঠে চা কু বসালে। আমি আমার মেয়েক কী জবাব দিবো? কী।বললো ওকে? ওর বাবার কাছে ওর চেয়ে অন্যকেউ আপন বেশি? কেন তুমি আমাকে এতোবড় আঘাত দিলে? কী ক্ষতি করেছিলাম আমি?”

শায়লা আস্তে করে বলে, ” ফাহাদ আমিও অনুতপ্ত……”

কিন্তু ফাহাদ সাহেব শুনেন না ওনার কথা স্পষ্ট ভাষায় বলে দেয়, ” তোমাকে এই বাসায় আর দেখতে চাই না।”

___________________________

আয়না নিশ্চয়ই ঘুমানোর ভান ধরে ছিলো, সমুদ্র সরতেই এখন এখান থেকে পালানোর চেষ্টা করছে। হাসপাতাল থেকে বের হওয়া সম্ভব না ওর পক্ষে। কিন্তু এই অবস্থায় ও গেলো কোথায়? যদি লুকিয়ে হাসপাতাল বাউন্ডারি ক্রস করে? এই মেন্টাল সিচুয়েশনে নিজের বাসার ঠিকানা নাম্বার কিছু ই তো বলতে পারবে না। সমুদ্রের গা বেয়ে হীম শীতল ভয় বয়ে যায়। সে ঢোক গিলে কেবিন ছেড়ে বের হয়। কোথায় যাবে ও? সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে বলবে? এতো অল্প সময়ের মধ্যে কোথায় যেতে পারে ও?

সমুদ্র কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে ডান দিকে ঘুরে পুরা কলিডোর খুঁজে দেখে। কোথাও নেই আয়না। পেশেন্ট গাউন দেখে ওকে অবশ্যই থামানোর কথা৷ কলিডোর থেকে বেরিয়ে সামনে যাবে ওমন সময় আয়নার কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। সমুদ্র পেছনে ঘুরতেই দেখলো বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে ও। পাশেই একজন নার্স৷

সমুদ্র ছু’টে যায় ওর কাছে। আয়না ওকে দেখে মুচকি হাসি দিলো। ওর ওই হাসি দেখলে কে বলবে ওর অসুখ? কী মিষ্টি হাসি হাসে তার আয়না! তাকে কেন লক্ষ্য করে নি সে!

আয়না বলে, ” ডাক্তার সাহেব, আপনি এখানে?”

সমুদ্রের ওকে দেখে অন্তর অব্দি ঠান্ডা হয়ে আসে। সে বলে, ” তোমার চেক আপ করতে হবে। আসো। আসো জলদি আসো।”

হাঁটার সময় আয়না টলছিলো। ওকে ধরে ধরে নিয়ে যায় কেবিনে। এরপর বেডে শুইয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলায়। আয়না এবারে সত্যি ঘুমায় যায়। টানা তিনদিন পর আজ ও ঘুমালো। ওর ভারী নিশ্বাসের শব্দে সমুদ্র আরাম পায় বেশ। রাত বাড়ে, আয়নার ঘুম গভীর হয়। বারোটার পর সমুদ্রের চোখ বুজে আসে। সোফাতই হেলান দিয়ে ও চোখ বন্ধ করে। কখন ঘুমিয়ে গিয়েছিল কে জানে৷ কিসের যেনো আওয়াজে ওর ঘুম ভাঙ্গে। ঘুম ছুটতেই তার চোখের সামনে ভয়ংকর দৃশ্য!

আয়না ক্যানোলা লাগা হাতটায় ফল কাটা ছু ড়ি দিয়ে নিজের হাতে আঘাত দিচ্ছে। র,,, ক্ত ও বেরিয়ে গড়ে পরদ যাচ্ছে। সমুদ্র দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে আয়নার দিকে ছুটে। চা কু ফেলে দিয়ে চিৎকার দিয়ে বলে, ” আয়না, তুমি এসব কি করছো? ব্যথা পাচ্ছো না?”

আয়না হাত দিয়েই ক্ষত প্রাপ্ত স্থান খুঁটে বলে, ” চুলকাচ্ছে।”

ব্যান্ডেজ টেনে খুলতে ধরলে সমুদ্র বাধা দিয়ে খুব যত্ন করে নতুন ব্যান্ডেজ এনে লাগিয়ে দেয়। ক্ষ ত স্থানে মলম-স্যাভলন দিয়ে পরিষ্কার করে, তুলা দিয়ে আস্তে করে ক্ষত স্থানের আশেপাশে মালিশ করে যেন ইচিং না করে। একটু চোখ বুজে এসেছিলো, তাতেই কি হতে যাচ্ছিলো। সে জাগ্রত নাহলে বুঝি আরোও কি দুর্ঘটনা ঘটতো।

সমুদ্র চিন্তায় মগ্ন ছিলো এমন সময় আয়না ওর হাত দিয়ে সমুদ্রের গ লা চেপে ধরে। সমুদ্র স্তদ্ধ হয়ে যায়। নিশ্বাস আটকে আসতে থাকে।

–” তোমাকে আমি মে৷ রে ফেলবো।”

চলবে৷

#ইলেকট্রিক্যাল_মন
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–40

আয়নার করা আক্রমণের তোপ সামলাতে না পেরে ব্যালেন্স হারা হয়ে একটু কাত হয়ে সোফায় পরে সমুদ্র। দুইজন মানুষের ভর একসাথে সোফায় পরতেই বিকট আওয়াজ হয়। আয়না ওর গলা চেপে রেখেছে। তবে এখন এতো শক্তি প্রয়োগ করেনি। চোখ-মুখ লাল হয়ে আসছে মেয়েটার। সমুদ্রের সময় লাগে না ওর হাত সরিয়ে নিতে কিন্তু আয়না ধস্তাধস্তি করে। ওকে নিয়েই সোফায় কাত হয়ে শুয়ে পরে। আয়নার আক্রমণত্মক আচরণ লাঘব পেলো যেনো, হয়তো নার্ভ রিল্যাক্সশন মেডিসিন কাজ করছে। ও চুপটি করে সমুদ্রের গায়ের সঙ্গে লেগে থাকে। নিজ থেকেই চোখ বুজে ফেলে। সমুদ্র নড়ে না একদম। ওকে বুকে নিয়ে কাত হয়ে থাকে। দু’দণ্ড সেভাবে থাকতেই কোমড় লেগে যায় তাও অভিযোগ নেই তার। এভাবে যদি আয়না চুপটি করে ঘুমায়, সে সারারাত কাত হয়ে থাকতেও রাজী। সারা শরীর টান-টান লাগায়, সমুদ্র সামান্য নড়তেই আয়না চোখ খুলে ফেলে। ও হাল্কা হাসলে, আয়না বলে, ” সমুদ্র কোথায়? ও কী চলে গেছে?”

সমুদ্রের প্রশ্নটা শোনামাত্র খুব যন্ত্রণা হলো। নিজের জন্য করুণা হলো বেজায়৷

সে বলে, ” তুমি ঘুমাও। তুমি ঘুমালেই সমুদ্র সকালে আসবে। আর না ঘুমালে, ওকে আমরা এখানে আসতে দিবো না।”

আয়না হচকচিয়ে উঠে বলে, ” কেনো আসতে দিবেন না। ওকে এক্ষুনি আসতে বলুন। আর কতো বাইরে থাকবে?”

–” তুমি ঘুমাও, আয়না। তুমি ঘুমাও। ও সকালেই চলে আসবে।”

সে আয়নাকে নিজের বুকের মধ্যেই নিয়ে শুয়ে থাকে। বেশি একটা নড়ে না। নড়লেই আয়না চোখ খুলে তাকিয়ে থাকছে। সারা শরীর ব্যথায় জমে আসলেও, সে নড়চড় করে না। আয়নার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় না। এখন সত্যি আয়না ঘুমাচ্ছে। তাকে পরখ করছে সমুদ্র। হয়তো সারারাতই আয়নাকে এভাবে চোখের সামনে পরখ করতে থাকবে সে। আয়নার নাক ডাকার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। সমুদ্রের নিজেরও খুব ক্লান্ত লাগে। ঘুমাতে মন চায়। কিন্তু চোখ বন্ধ করে শান্তি মেলে না। দু’টো চোখের পাতা এক সেকেন্ডের জন্যও বন্ধ করে না সে।

আয়না একটানা প্রায় অনেক ক্ষণ সমুদ্রের বুকে মাথা রেখে ঘুমায়। সকালের দিকে আয়নাকে বেডের উপর আস্তে করে শুইয়ে দেয় ও। বেডে শুইয়ে দেওয়ার দশ মিনিটের মধ্যে ওর ঘুম ভাঙ্গে। তখন সকাল সাতটা বাজছিলো। সমুদ্রের চেহারা দেখে যে’কারো মায়া হবে। নির্ঘুম রজনী পাড় করে ও যেন একদিনেই কাহিল হয়ে গেছে৷

আয়না চোখ খুলে ওর দিকে তাকালো এরপর রিনরিনে সুরে বলে, ” সমুদ্র, আপনি এপ্রোন পরে আছেন কেনো?”

আয়নাকে এহেন কথা বলতে শুনে সমুদ্র আনন্দে আত্মহারা হয়৷ নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না। নিজের অনুভূতি সামলে, ধাতস্থ হতে সময় নেয়৷

আয়না পুনরায় প্রশ্ন করে, ” আপনি কেনো এপ্রোন পরে আছেন?”

সমুদ্র সঙ্গে সঙ্গে এপ্রোন খুলে ফেলে দিয়ে ওর সামনে এসে দাঁড়ালো। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। আয়না সত্যি তাকে চিনতে পারছে! নাকি সে ভুল দেখছে। আয়না তবে সুস্থ হয়ে গেলো। তার চোখে জল এসে চিকচিক করতে থাকে। সে চোখের জল মুছতে থাকে। সে চুপ করে কেবল আয়নাকেই দেখে যায়। আয়না পুনরায় চোখ বন্ধ করে।

কিন্তু একটু পরেই যখন নার্স এলো। নার্সকেই দেখেই আয়না আবার আগের মতো চিল্লাপাল্লা শুরু করে দেয়। রুদ্রমূর্তি ধারণ করে। পারলে নার্সকে এটাক করবে। ও বারবার বলতে থাকে, আমার কি হয়েছে কেন নার্স আসবে? সে সুস্থ থাকলে নার্স কেনো?

সমুদ্র ওকে ধরে রেখে শান্ত করার চেষ্টা চালায়। মেয়েটা রেগে গেছে। নাকের ডগায় ঘাম জমে যাচ্ছে। সমুদ্র ওর ঘাম মুছে দিয়ে বলে, ” তুমি একটু অসুস্থ। এজন্য হাসপাতালে এসেছি। নার্স ঔষধ দিতে এসেছে। তুমি এমন করো না আয়না। নার্সকে ওনার কাজ করতে দাও।”

কিন্তু আয়নার কেনো যেন এখন নার্সকে সহ্য হচ্ছে না। কোনোভাবেই চাচ্ছে না নার্স এখানে থাকুক। ভদ্রমহিলা দ্রুত ঔষধ রেখে প্রস্থান করেন। উনি যাওয়ার পর নাস্তা দিয়ে যাওয়া হয়৷

সমুদ্র কোমল সুরে বলে, ” আয়না, আসো, খেয়ে নাও।”

আয়না ভ্রু কুচকে বলে, ” আমাকে আয়না বলে ডাকছেন কেনো?”

এহেন প্রশ্নে সমুদ্রের চেহারার রঙ পালটে যায়। ভয় পাওয়া গলায় বলে, ” তোমার নাম আয়না তাই।”

আয়না মাথা নেড়ে জানান দিলো তার নাম আয়না না। সে বলে উঠে, ” সবাই আমাকে আয়ু বলে ডাকে। আপনিও আয়ু ডাকবেন।”

সমুদ্রের কলিজা ঠাণ্ডা হলো। আসলেই তাই সে বাদে আয়নাকে সবাই আয়ু-ই ডাকে। আশ্চর্য এতোদিনেও সে বউকে আদর করে একবারও আয়ু ডাকে নি!

আজ বিবাহের তিন মাস পর সে খুব স্নিগ্ধ গলায় বলে, ” আয়ু, এসো নাস্তা খাবে এখন।”

আয়না কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ করলো না। সমুদ্র গিয়ে ওকে উঠে বসালো। এরপর আস্তে করে নামিয়ে বাথরুমে নিয়ে যায়। নিজেই ওকে ব্রাশ করে দিয়ে ফ্রেশ করিয়ে দেয়। তারপর চুল চিরুনি দিয়ে আছড়ে দেয়। চুল গুলো সুন্দর করে গুছিয়ে রাখলো। এই সুন্দর মায়া-মমতায় ভরা চেহারার মেয়েটাকে দেখলে কে বলবে ও মানসিক ভাবে অসুস্থ এই মুহূর্তে?

আয়নাকে খেতে দিলে ও কোনোকিছুই মুখে তুলে খায় না। চুপচাপ বসে আশেপাশে তাকিয়ে থাকে। সমুদ্র উঠে ওর পাশে বসে রুটি ছিঁড়ে দিয়ে সবজির সঙ্গে মাখিয়ে মুখে তুলে খাইয়ে দেয়৷

খেতে খেতে আয়না সুধালো, ” সমুদ্র, আমি কী পাগল হয়ে গেছি? এজন্য হাসপাতালে এসেছি?”

–” এসব কি বলছো? কে বলেছে তোমাকে এসব কথা?”

–” ডাক্তার বলেছে।”

সমুদ্র বলে, ” না, সোনা। তোমার পেটে ব্যথা এজন্য হাসপাতালে এসেছি।”

–” ও।”

আয়না সমুদ্রের হাতে বাকি খাবার টুকু খায়। চেচামেচিও করে না। সমুদ্র ঔষধ খেতে বললে সেটাও খেয়ে নেয়। এরপর নিজ থেকেই বলে, ” আমি ঘুমাবো।”

ডাক্তার রোকসানা বলেছিলে, আয়না এখন যত ঘুমাবে, ততো বেশি ইম্প্রুভমেন্ট আসবে ওর। আয়না বেডে নিজ থেকে গিয়ে শোয়া’মাত্র সমুদ্রকে খুঁজে। ওকে ডেকে উঠে। কেনো সমুদ্র তার পাশে নেই এজন্য প্যানিক করা শুরু করল।

হয়তো ওর অবচেতন মন সমুদ্রের সঙ্গ চাইতো কিন্তু সমুদ্রের সময় থাকত না ওর জন্য! এখন সবটা ব্যাক ফায়ার করছে। প্রতি মুহূর্তে সমুদ্রের উপস্থিতি চাই ওর।

রোকসানা ম্যাডাম এসে আরেকবার মর্নিং ভিজিটিংয়ে চেক করে যান। তখনো ও রোকসানা ম্যাডামের উপর চিল্লাচ্ছে। আয়না একদম অন্যকারো উপস্থিতি চায় না।

উনি বলে উঠে, ” তুমি কার সঙ্গে থাকতে চাও?”

–” সমুদ্র ছাড়া আর কারো সাথে থাকবো না। তুমি যাও এখান থেকে। ”

রোকসানা ম্যাডাম হেসে বলে, ” আচ্ছা মা। তুমি সমুদ্রের সঙ্গে থাকো। আমি যাচ্ছি। আবার একটু পর এসে অল্প একটু দেখেই চলে যাবো।”

আয়না কিছু বললো না। সত্যি পরবর্তীতে আয়না এক মুহুর্তের জন্যও সমুদ্রকে কোথাও যেতে দিলো না। ওর ধারণা সমুদ্র চোখের আড়াল হলেই ওকে রেখে চলে যাবে। ও বেডে শুয়ে চোখ বুজে দু’মিনিট পর চোখ খুলেই সমুদ্রকে খোঁজে। সমুদ্র বেচারা প্রত্যকবারই ধৈর্য্যর চরম পরীক্ষা দেয়। প্রতিবারই ওকে আদুরে গলায় বলে, ” আমি আছি, আয়ু সোনা, এবার একটু ঘুমাও।”

আয়না ওর শার্ট খামচে ধরে রাখে এমন করে চব্বিশ বার আয়না চোখ খুলে ওকে হন্ন হয়ে খুঁজে। চব্বিশ বারই সমুদ্র ওকে আদর করে বুঝায় ও আছে এবং থাকবে৷ তখন বেলা বারোটা বাজছিলো। সমুদ্র সকাল থেকে কিছু ই খায় নি। ক্ষুধায় পেট জ্বলে যাচ্ছে। তবুও চেয়ার ছেড়ে উঠে না। আয়নাকে একা ছাড়ে না। ওকে সুস্থ করতে যা যা করতে হবে, সে সব করবে। হয়তো এটাই তার অপরাধের সামান্য প্রায়শ্চিত্ত হবে!

আয়না বলে উঠে, ” আমি শায়লা আন্টির হাতের কচুর ভর্তা দিয়ে ভাত খাবো।”

সমুদ্র হতভম্ব হয়ে যায়, আয়না কেনো শায়লা চৌধুরীর হাতের রান্না কেনো খেতে চাচ্ছে? এ’অবস্থায় কেনো এর উত্তর খুঁজা বোকামি। সে বিচলিত বোধ করে। কোথা থেকে কচু ভর্তা আনবে সে?

বলে উঠে, ” পিজ্জা বা রামেন খাবে?”

আয়না মাথা নাড়িয়ে না বোধক অর্থ প্রকাশ করে বলে, ” না। আমি দুপুরে শায়লা আন্টির হাতের কচু ভর্তা দিয়ে ভাত খাবো।

চলবে।