ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব-৫+৬+৭

0
331

#ইলেকট্রিক্যাল_মন
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–5

— ” ঠকাচ্ছো নাতো ওকে?”

সমুদ্র পরখ করে দেখলো একবার মিসেস ইভানাকে। নিজেকে যথেষ্ট বিবেচক ভাবে সে। তবুও এ প্রশ্নের উত্তর দিতে যেন সময় নেয় সে। আসলে, প্রকৃতপক্ষে, প্রতারণার সংজ্ঞা কি?

সে থেমে থেমে বলে উঠে, ” সত্য গোপন করা প্রতারণার মধ্যে পরে না। ওর অধিকার তো ক্ষুন্ন করছি না।”

–” ও কিছুই জানবে না।”

–” না। আমি একবিন্দু পরিমাণও কিচ্ছুটি বলব না।”

মিসেস ইভানা আরোও কিছু বলতেন বুঝি কিন্তু তার আগেই সমুদ্র ফোন অন করে শুধু ঘড়ি দেখে নিয়ে ভ্রু কুচকালো তবে কিছু বললো না।

–” কি হলো আব্বু?”

–” সাত মিনিট হয়ে গেলো৷ এখনো আসছে না।”

–” আসবে। ওয়াশরুমে গেছে৷”

সমুদ্র ঠাণ্ডা পানিতে চুমুক দিয়ে বলে, “ব্যবসা-বাণিজ্যিক কাজ খুবই প্যারাদায়ক। আর ভালো লাগছে না। সবদিক থেকে চাপে থাকি। ”

মিসেস ইভানা হাল্কা হেসে বলে, ” আমরা আছি তো তোমার সাথে। সবধরনের সহযোগিতা যেকোনো সময় তুমি পাবে৷ রিল্যাক্স।”

সমুদ্র উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ” একটু আসছি।”

মিসেস ইভানা প্রথমে ঠাওর করতে পারলেন না, পরবর্তীতে সমুদ্রকে রেস্তোরাঁর শেষ কোণায় যেতে দেখে মুচকি হেসে বলে, ” আটটা মিনিট মাত্র ওকে না দেখতেই অস্থির হচ্ছো! তুই ব্যাটা বউ পাগল ছেলে হবি।”

সমুদ্র আউটডোর সাইড চেক করে এসে লেডিস ওয়াশরুমের সামনে দাঁড়িয়ে উসখুস করছে৷ কি করবে সে? আয়না রেস্তোরাঁর অন্যকোথাও নেই৷ এক্সিট ডোর সমুদ্রের চক্ষুর সম্মুখে ছিল। ও যে রেস্তোরাঁ ত্যাগ করে অন্যকোথাও যায়নি এটা সিউর সে। মেয়েটা বাকি স্পটেও নেই। ফোনও টেবিলে রেখে গেছে। তাহলে ওয়াশরুম ছাড়া অন্যকোথাও তো হওয়া লজিক্যাল না। এতোক্ষণেও বের হচ্ছে না কেন? সে লেডিস ওয়াশরুমের সামনে থেকে এক কদম পেছাতেই আচানক মনে হলো, ওয়াশরুমের ভেতর থেকে কারোও দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ কানে আসছে৷ সেকেন্ডের মধ্যে মস্তিষ্ক খুব দ্রুত কিছুর আভাস পায়। সে দিক-বেদিক না ভেবে লেডিস ওয়াশরুমের ভেতর ঢুকে পড়ে৷ ওয়াশরুম সম্পূর্ণ ফাঁকা পড়ে আছে। তবে প্রথম সাড়ির দ্বিতীয় ওয়াশরুমের দরজা নড়ছে। ধাক্কানোর আওয়াজ আসছে। সে দ্রুত পায়ে হেঁটে গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলে উঠে, ” আয়না তুমি ভেতরে?”

এক সেকেন্ডের মধ্যে আয়নার কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। সে ভেতর থেকে বললো, ” স্যার, আমি ভেতর থেকে লক হয়ে গেছি। ছিটকিনিতে মনে হয় সমস্যা। কোনোভাবেই ছিটকিনি খুলা যাচ্ছে না।”

সমুদ্র যেন কিছুটা শান্ত হলো। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ও বারবার ওয়াশরুমে দেরি হওয়া নিয়ে এমন কিছুই সংকেত পাঠাচ্ছিলো। সে কিছু বলবে তার আগেই একজন রেস্টুরেন্টের ফিমেল স্টাফ ভেতরে এসে সমুদ্রকে দেখে এক প্রকার চিৎকার দিয়ে বলে, ” এক্সকিউজ মি, স্যার এটা লেডিস ওয়াশরুম। আপনি এখানে কী করছেন? প্লিজ বাইরে যান। আমাদের রেস্তোরাঁর সিস্টেম অনুযায়ী কোনো পুরুষ লেডিস ওয়াশরুমে থাকতে পারবে না। কোনোধরনের অবৈধ কাজ করা এলাউ না।বের হন। ”

সমুদ্রের যেন রাগে মেজাজ খারাপ হয়ে আসে। সে ভীষণ জোড়ে ধমক দিয়ে বলে উঠে, ” আমি ফা—– ক ইউর সিস্টেম। আমার বউ ওয়াশরুমের ভেতরে আটকা পড়েছে। আর আপনি আমাকে সিস্টেম শেখাচ্ছেন?”

কথাগুলো বলে দরজার গায়ে জোড়ে পা দিয়ে লা–থি মারে সে।

সমুদ্র এতো জোরে চিৎকার করে কথা গুলো বলছিল যে ভেতর থেকে কেবল আয়নাই নয় বরং বাইরে থেকে মানুষ সব শুনে ফেলেছে। আয়নার ভারী অদ্ভুত অনুভূতি হয়। উনি তাকে নিয়ে এতোটা কনসার্ন? এতোটা ভাবেন উনি?

মহিলাটাও বেশ ভড়কে যায়, এতো জোড়ে চিৎকারে সে ভয়ও পায় বোধহয়। চেচামেচির আওয়াজে সব স্টাফরা ভেতরে আসে।

সমুদ্র বলে, ” দ্রুত আপনাদের টেকনিক্যাল স্টাফদের ডেকে দরজা খোলার ব্যবস্থা করেন এক মিনিটের মধ্যে । নাহলে আমি পুরা রেস্টুরেন্ট ভেঙে ফেলবো।”

ইতিমধ্যেই জানাজানি হয়ে গেছে সারা রেস্তোরাঁয় যে লেডিস ওয়াশরুমের ভেতর একটা মেয়ে আটকা পড়েছে। ওনার হ্যাসবেন্ড ভীষণ প্যানিকড করছেন। দ্রুত দরজা ভেঙে খুলে দেওয়া হলো। ম্যানেজার এসে ক্ষমা ও দুঃখ প্রকাশ করলো। ওদের নাকি দরজায় ক্রুটি ছিল কিন্তু বুঝতে পারেনি জন্য এমন অসুবিধে হলো।

আয়না সমুদ্রের রাগ দেখে বেশ অবাক হয়। তাকে উদ্ধার করে বের করার পর শুধু জিজ্ঞেস করলো, ” ঠিক আছো?”

আয়না মাথা নাড়ালো। সমুদ্র এক বোতল পানি এগিয়ে দেয় তাকে। আয়না বোতলে চুমুক দিয়ে রেস্টুরেন্টের বাইরে বের হলো। তাকে ঘিরে এতো জটলা পছন্দ হচ্ছিলো না। সমুদ্র বিল মিটিয়ে ইভানার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালো।

আয়না রেস্টুরেন্টের বাইরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল। তখন কেবল বেলা ডুবছে। রাস্তায় কমলা রঙের রোদ এসে আঁছড়ে পড়ছিলো। মিহি স্নিগ্ধ বাতাস বইছে।কালো পিচঢাকা রাস্তায় সাইসাই করে প্রাইভেট কার ছুটে যাচ্ছে। সে অন্যমনস্ক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

সমুদ্র তার কাছে গিয়ে সুধালো, ” বাসায় যাবে এখন?”

আয়না অন্যমনস্কতা দূরীকরণ করে বললো, ” হ্যাঁ, দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

–” চল, তোমাকে নামিয়ে দেই।”

–” না, না আমি একা যেতে পারবো।”

সমুদ্র ওর ফোন, ওর হাতে দিয়ে, তার কথাটাকে বিন্দুমাত্র দাম না দিয়ে বললো, ” গাড়ি নিয়ে আসছি লট থেকে। দাঁড়াও এখানে।”

সমুদ্র যেতেই ইভানাও বের হয়। আয়নাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ” তোমাকে নিয়ে সমুদ্র চিন্তা করছিল। এই দুর্ঘটনা কিভাবে ঘটলো? সাবধানে থাকবে কেমন? বিয়ের আগে মেয়েদের বেশি বের না হওয়াই ভালো। খারাপ শক্তির নজর বেশি লাগে৷”

ওনার মতো স্মার্ট শিক্ষিত মহিলার মুখে এমন কুসংস্কারমূলক কথা শুনে আয়না খানিক চমকায়। পরে মনে পড়লো, বাঙ্গালী নারী স্পেসস্যুট পড়ে চাঁদে গেলেও সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরতে চাইবে! কারণ ওদের মতে, সন্ধ্যার সময় মেয়েদের অশনি শক্তি নজর দেয়।

আয়না বলে উঠে, ” আপনি বিয়েতে আসবেন কিন্তু! ”

–” তোমাদের বিয়ে নিয়ে আমি খুব এক্সাইটেড। সমুদ্রের জন্য খুব খুশি আমি। তোমার মতো একটা সুইট মেয়ে স্ত্রী হিসেবে পাওয়া পরম সৌভাগ্য। অবশ্যই আসব, মা।”

সমুদ্র গাড়ি নিয়ে আসলে আয়না ফ্রন্ট সীটে বসলো। সে তাদের মধ্যকার সম্পর্কের কোনোরুপ বিরুপ ধারণা দিতে চায় না মিসেস ইভানাকে। আয়না বসতেই সমুদ্র গাড়ি টান মারলো।

–” আপনি রেগে আছেন?”

–” না।”

–” রাগার মতো কিছু হয়নি। তাছাড়া ওয়াশরুমেই আটকা পড়েছিলাম। ক্ষতি হওয়ার মতোন কিছু ঘটেনি৷ মরতে তো আর ধরিনি।”

সমুদ্র তৎক্ষনাত গাড়ি জোরে ব্রেক কষে। আয়নার মনে হচ্ছিলো নিশ্চয়ই এক্সিডেন্ট করবে এই লোক। ওনার গাড়িতে উঠতে এইজন্য ভয় লাগে। কখন দুর্ঘটনা ঘটায়!

–” কি হলো?”

–” সীটবেল্ট পড়োনি।”

আয়নার খেয়াল হয় সে সীটবেল লাগায়নি, এজন্য এতো জোরে কেউ হার্ড ব্রেক কষে? ওনাকে কে যে লাইসেন্স দিয়েছে গাড়ি চালানোর?

আয়না সীটবেল্ট টেনে আনতে ধরলে কিছু সমস্যার সম্মুখীন হলো। সমুদ্র একটু তার দিকে এগিয়ে এসে বেল্ট টেনে, লাগিয়ে দিয়ে বললো, ” মৃত্যুর কথা মুখে আনবে না আর কোনদিন।”

আয়না এবারে ওনার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। ওই যে কেমন অদ্ভুত পারফিউমটার গন্ধ নাকে এসে লাগলো। নীলচে চোখের দিকে তাকাতেই কেমন মন ব্যাকুল করা নাম না জানা অনুভুতি হতে লাগলো তার। মানসপটে ওনার রেগে চিৎকার দিয়ে ‘আমার বউ’ শব্দটা ভেসে উঠতেই ফোলা গাল দুটো টমেটোর মতো লাল হয়ে উঠে। হুট করে সবকিছুই খুব ভালো লাগতে লাগলো। এইযে সূর্য ডুবতে থাকা, আকাশের কমলা বর্ণ ধারন করা, পাখিদের আকাশে তাড়াহুড়ো করে নীড়ে ফেরার ব্যস্ততা! সবকিছুই আজ ভিন্ন লাগছে তার? তবে কি আজ বিশেষ কিছু হয়েছে? কি হয়েছে? উম্ম…. নাম না জানা, একদম অজানা, কেবল সাহিত্যে পড়া এক অন্যরকম ভাসমান অনুভূতির সঙ্গে সবে পরিচয় হলো তার! কি সেই ভাসমান অনুভূতি? নাম কি তার? আয়না এর উত্তর জানে কিন্তু মানতে চায় নাহ। কোনোভাবেই চায় না। ওমন দুঃসাহসিক অনুভূতির সম্মুখীন হওয়ার শক্তি নেই তার।

সমুদ্র আজ একদম বাসার সামনে এসে গাড়ি থামায়। আয়না নামতে চাইলে নিজে থেকে সে বলে উঠে, ” শুনো, আমাকে স্যার বলে ডাকার প্রয়োজন নেই। আজকে থেকে আরোও প্রয়োজন নেই।”

আয়না নেমে দরজা লাগাতে লাগাতে বললো, ” স্যার, আমাদের বাসায় আসেন, আপনি আসলে বাবা খুশি হবে৷ ”

সমুদ্র একটা কড়া নজর ছুঁড়লো তার দিকে। তবুও আয়না ফের বললো, ” আসি স্যার। আসসালামু আলাইকুম, স্যার।”

–” ওয়ালাইকুম আসসালাম। ”

সমুদ্র গাড়ি ঘুরাতে ঘুরাতে ভাবে, আম্মু বলে, সে নাকি ভীষণ ঘাড়ত্যাড়া। কিন্তু আয়না যে তার চেয়েও দুই ধাপ এগিয়ে ঘাড়ত্যাড়ামিতে এটা আম্মু জানে না। জানলে নিশ্চয়ই দুই ঘাড়ত্যাড়াকে একছাদের নিচে রাখার বুদ্ধি করতেন না একদম!

___________

আয়না বাসায় আসলো। আজ ওর দাদা-দাদী এসেছে বড়চাচার বাসা থেকে। দাদা-দাদী তাদের সঙ্গেই থাকেন৷ কিন্তু কয়েকমাস ধরে কি যেন হলো? বড়চাচা দাদা-দাদীকে নিজের সঙ্গে রাখছেন। এতোবছর তাদের খোঁজও নিত না, এখন হুট করে এতো দরদ যে তাদের সঙ্গে থাকতে ই দিচ্ছে না। আয়নার খটকা লাগে। হচ্ছেটা কি?

সে আসতেই বারান্দা থেকে মিউমিউ শব্দ তুলে তার আদরের বিড়াল মিলি দৌঁড়ে এসে তার পায়ে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইল। মিউমিউ শব্দ তুলে আদর চাইছে সে। আয়না তাকে কোলে তুলে নিল। তার বিড়াল খুব পছন্দ। একবার কোন কে-ড্রামা দেখে এমন বিড়ালের আবদার বাবার কাছে করেছিল, বাবাও বিষয়টা সিরিয়াসি নিয়ে নেন। এইজন্য বাবা বিদেশ থেকে, স্পেশালি ফোস্টার হোম থেকে, তাকে এই পার্সিয়ান ক্যাটটা পেট হিসেবে পালার জন্য দিয়েছে। আয়না তাদের বাসার সাহায্যকর্মী হালিমাকে ডাকে। হালিমা বুয়া অনেকদিন ধরেই তাদের বাসায় আছে৷

আয়না বলে উঠে, ” খালা, আপনি মিলির জন্য মাছ সেদ্ধ করেছেন?”

–” হ্যাঁ, আপামনি।”

–” ওকে ঠিকমতো খাইয়েছেন আজ?”

–” তিন বেলা এই ভোটকা বিড়ালটারে খাওয়াইছি আপামনি৷ দুইবার পটিও করছে। সব ধুয়ে সাফ করে রাখছি।”

–” ওর মাছটা আনেন। আমি এখন খাইয়ে দেই। আর হ্যাঁ, মিলিকে একদম ভোটকা বলবেন না। ওর নাম ধরে ডাকবেন।”

হালিমা খালা যেতে যেতে বকতে লাগলেন, ” গরীব মানুষ মাছ খাইতে পারে না, আবার বড়লোকরা বিলাইকেই তিনবেলা মাছখাওয়ায় ভোটকা বানায়!”

আয়না যখন মিলিকে মাছ খেতে দিচ্ছিলো, ওইসময় ফাহাদ সাহেব এসে মেয়ের পাশে বসলেন। এরপর বলে উঠে, ” শুধু বিড়ালকে মাছ খাওয়ালে হবে? নিজেকে ও মাছ খেতে হবে৷”

আয়না অসহায় মুখ করে বলে, ” মাছ খেতে একদম ভালো লাগে না, বাবা৷”

উনি মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ” দাদাভাই আসার সময় বড় ইলিশ এনেছে। পদ্মার ইলিশ। সরিষা দিয়ে রান্না করা হয়েছে। ইলিশের ঘ্রাণে বাসা মো মো করছে। খুব টেস্ট হবে কিন্তু। আমি খাইয়ে দিচ্ছি?”

আয়না বুঝলো বাসায় যে আশটে গন্ধ হচ্ছে ওটা ইলিশ মাছের। সে বলে উঠে, ” বাবা প্লিজ না। তুমি খাও।”

–” আমার মেয়েরা না খেলে আমার ও খেতে ইচ্ছা হয় না।”

বাবার জন্য হলেও আয়নার ইলিশ অপছন্দ হওয়া সত্তেও খেতে বসে। সবাই মিলে খেতে বসেছে৷ অনেকদিন পর বাসায় এই দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। দাদা-দাদি এসে বসলেন। আলিয়াও এসে বসেছে৷ ফাহাদ সাহেব মাছের কাঁটা বেছে আয়নার প্লেটে তুলে দিচ্ছেন। আয়না বাধ্য মেয়ের মতো খেয়ে নেয়।

আয়না-আলিয়া খাওয়া শেষ করে ভিডিও কল নিয়ে ব্যস্ত হয়৷ পিউ– সমুদ্রের বোনের সঙ্গে অনলাইন শপিং নিয়ে আলোচনা করবে। ফাহাদ সাহেবের এসবে আগ্রহ নেই। সে তার বাবা-মায়ের সাথে ড্রয়িং রুমে বসলেন। তার বাবা-মায়ের বার্ধক্য বয়স চলছে। অসুস্থতা লেগেই আছে। তবে তারা আয়নার বিয়েতে খুব খুশি।

তার বাবা বলে উঠে, ” তোমার ভাই মনে হয় বিয়েতে আসবে না।”

–” শুনেছি, আব্বা।”

আয়নার দাদা বলে উঠে, ” ওরা চাচ্ছিলো পিয়াশের সঙ্গে আয়নার বিয়ে হোক। কিন্তু বাবা তুমি তো অন্যকোথাও বিয়ে ঠিক করলে।”

ফাহাদ সাহেব বলেন, ” আমার মেয়ের জন্য সমুদ্রের মতো ছেলেই খুঁজছিলাম। বিয়ে তো সৃষ্টিকর্তার আদেশে হয়। আমাদের কারো কোনো হাত নেই এতে৷ আমরা উসিলা মাত্র। আমার মেয়ের সমুদ্রের সঙ্গে জোড়া লিখা ছিল। এইজন্য বিয়েটা হচ্ছে। পিয়াশের সঙ্গে ওর জোড়া লেখে নি জন্য পিয়াশের সঙ্গে হচ্ছে না।”

________________

সমুদ্র আজ সাতটার মধ্যে বাসায় ফিরেছে। ইদানীং দেরি করছে না। মা কড়া আদেশ জারি করেছে, বিয়ের আগ অব্দি সাতটার আগেই বাসায় ঢুকতে হবে। যথা আজ্ঞা তার মায়ের আদেশ পালন করছে। ফ্রেশ হয়ে, গোসল সেড়ে নিজের রুম থেকে বের হলো। ডাইনিং এ আসতেই মা আর ছোটবোন পিউয়ের হাসির আওয়াজে সে ড্রয়িংরুমে পা রাখে। ওদের দুইজনকে একসঙ্গে হাসতে দেখে সে শান্তি অনুভব করে। বাসার সদস্যরা হাসি-খুশি থাকলে, বোঝা কাঁধ থেকে নামে। অনুতপ্ততা কমে।

সে এগিয়ে গিয়ে বললো, আম্মু, নতুন প্রোজেক্টটা নিয়ে একটু ডিসকাশন করার ছিল। আমাকে একটু সাহায্য করো।”

মিসেস রোদেলা বকা দেওয়ার ভঙ্গিমায় তার দিকে তাকিয়ে বলে, ” ওরে আমার ব্যবসায়ী পুত্র রে! কাজ-টাজ অনেক করেছিস। আজ থেকে সব বাদ। অনেক ব্যবসা দেখেছিস। কালকে থেকে আর অফিস যাবি না।”

–” শুক্রবার আসতে অনেক দেরি। কাল তো ফরেন ক্লাইন্টদের সঙ্গে স্পেশাল মিটিং আছে।”

রোদেলা বলে, ” বস তুই বাপ। এতো কাজ করার দরকার নেই।”

সমুদ্র বসলো। তার মা বলে উঠে, ” তোর জন্য শেরওয়ানি দেখছি। দেখ কোনটা পছন্দ হয়।”

–” তুমি-ই চুজ করো। তোমার পছন্দ বেশি ভালো।”

মিসেস রোদেলা একগাল হেসে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিলেন। আজ সে অনেক খুশি। ছয়মাস পর আজকে তার স্বামী আবেগের হেলথ রিপোর্ট ভালো এসেছে। নেগেটিভ কিছু নেই রিপোর্টে।

পিউ বলে উঠে, ” ভাইয়া, ভাবীর জন্য কি দেখবো? ভাবীকে কিন্তু তুমিই বিয়ের ব্রাইডাল আউটফিট দিবে। তোমার কোনো সাজেশন আছে? এনি রিকোয়েরমেন্ট ওর ডিমান্ড ?”

সমুদ্র জীবনের কোনো এক খণ্ডাংশে কল্পনা করেছিল তার নববধূবেশে লাল শাড়ি পরিহিতা কেউ একজন থাকবে। একবার ভাবলো এই শখের কথা বলবে না। দরকার কী শখ পূরণের? এতো শখ পুষে হয়টা কি? যদি শখের মানুষই না রয়?

তবুও বলে ফেলে, ” ওর জন্য লাল ব্রাইডাল কাতান শাড়ি দেখ পারলে । ”

পিউ ভাইয়ের মুখ এমন কথা শুনে সাথে সাথে ফোন ঘুরিয়ে সমুদ্রের সামনে আনে। সমুদ্র কোনোদিন ভাবেও নি পিউ ভিডিও কলে আয়নার সঙ্গে কানেক্টেড ছিলো। কেমন অস্বস্তি লাগলো তার। আয়না ভিডিও কলে আছে জানলে সে কোনোদিন নিজের শখখানার কথা বলত না।

পিউ মায়ের সামনেই বলতে লাগে, ” ওর জন্য কাতান লাল শাড়িইই।”

যতোই মডার্ণ কালচারে লাইফ লিড করুক না কেন, বাঙ্গালী ছেলেরা মায়ের সামনে এমন পরিস্থিতিতে পড়লে লজ্জা পায়৷ নাজুক অবস্থা হয়৷ সমুদ্র সামান্য ভ্যাবাচেকা খেয়ে এদিক-ওদিক করে চোখ নিচু করে।

পিউ বলতে থাকে, ” এই ভাইয়ায়া, আর ইউ ব্লাসিং? হু? হু?”

সমুদ্র থেমে থেমে বলে, ” ব্লাসিং? ফর হোয়াট? এন্ড হুয়াই? আয়া নট এট অল।”

পিউ তার গালের দিকে ইঙ্গিত করে বলে, ” দেখো, দেখো তোমার গাল লাল হয়ে গেছে।” এরপর আয়নাকে ইশারা করে বলে, ” তাই না ভাবী?”

মিসেস রোদেলা হাসছিলেন ওদের এসব কান্ড দেখে।

সমুদ্রের দশা নাজুক হলেও প্রকাশ না করে, তেজি গলায় বলে, ” গাল লাল হয় এলার্জি হলে। আমার মনে হয় এলার্জির সমস্যা দেখা দিচ্ছে।”

ফোনের স্ক্রিন থেকে আয়নার অট্টহাসির আওয়াজ পাওয়া গেল। সমুদ্র সব লজ্জা ভুলে সরাসরি ভিডিও কলের স্ক্রিনের দিকে তাকায়।

চলবে।

#ইলেকট্রিক্যাল_মন
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–6

সমুদ্র রুমে এসে ক্লান্ত শরীরে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। সারাদিন সবার সামনে স্বাভাবিক থাকলেও একদম মনের কোনো ক্ষুদ্রাংশেতে হলেও সে ভালো নেই৷ মনের কোথায় জানি খুব সূক্ষ্ম কিন্তু তীব্র একটা বেদনা অনুভব হয়৷ এই বেদনার কথা কাউকে বলতেও পারে না আর। তার অনুভূতি, মন সব যেন জড়পদার্থের ন্যায় হয়ে গেছে৷ মাঝেমধ্যে মনে হয়, মানুষ না হয়ে টেবিল-চেয়ার হলে ভালো হতো। নো ফিলিংস, নো ইমোশন।

সে সিগারেট ধরালো। রুমে একা থাকলে, কাজ না থাকলে সে বারান্দায় সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়েই সময় পার করে। একাকীত্বকে উপলব্ধি করে। একাকীত্বেরও একটা ভিন্ন ব্যথাতুর সুর-তাল আছে৷ সে যতোই হেলথ্ কনসার্ণ হয়ে স্যুগার, রেড মিট খাওয়া বাদ দিক, কিন্তু সিগারেট ছাড়ে না। ডায়বেটিস কন্ট্রোলে রাখার জন্য চিনি বাদ দিচ্ছে, ওন দ্যা আদার হ্যান্ড, মন কন্ট্রোলে রাখার জন্য ভালোবাসা বাদ দেওয়া লাগছে।

সিগারেটের প্যাকেট থেকে চতুর্থ সিগারেট বের করে সময় দেখলো। পৌ’নে একটা বেজে যাচ্ছে। ঘুম দরকার তার। গতকাল কেবল সাড়ে চার ঘন্টা ঘুমিয়েছে৷ কিন্তু সে জানে বিছানায় শুলে ঘুম আসবে না। সিগারেট খেতে খেতে রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইল। সে ভাবলো, ফুসফুস জ্বালানোর ব্যবস্থা আছে, কিন্তু হৃদয় জ্বালানোর কোনো ব্যবস্থা নেই কেন? আচ্ছা, ফুসফুস তো হৃদপিণ্ডের খুব কাছের সঙ্গী। কোনো ভাবে কী ফুসফুস জ্বলতে জ্বলতে হৃদয়ে দহন জ্বালাতে পারে কি?

সে আকাশের দিকে তাকিয়ে, জ্বলন্ত সিগারেট হাতে রেখে করুণ গলায় গায়,

“সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে
সেই আমি কেন তোমাকে দুঃখ দিলেম
কেমন করে এত অচেনা হলে তুমি
কীভাবে এত বদলে গেছি এই আমি। ”

আচানক মস্তিষ্কের সেরিব্রাম থেকে রেফারেন্স মেমোরি বেশ কিছু মিষ্টি স্মৃতির স্মরণ করিয়ে দেয়। সে ক্রমশ শান্ত হয়ে যায়। ভেতরটায় অশান্ত স্রোত আঁছড়ে পড়ছে। হুট করে হাতে গরম কিছু অনুভব হওয়ায়, তার হুঁশ আসে, দ্রুত হাত থেকে সিগারেট ফেলে দেয়। এরপর ব্যথায় জ্বলতে থাকা হাত দিয়েই মোবাইল ফোন বের করে গ্যালারিতে যায়। গ্যালারির বিশেষ ফাংশনে একটা মাত্র ছবি রাখা ছিলো। একটা মেয়ের ছবি। মেয়েটার মুখে খুব স্নিগ্ধ একটা হাসি। তার পাশেই সমুদ্র গিটার ধরে বসে আছে। সমুদ্রের দৃষ্টি মেয়েটার দিকে আর মেয়েটা হাসছে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে। কোমল, তরতাজা বাতাসে মেয়েটার সিল্কি চুল এসে হামি খাচ্ছে সমুদ্রের চোখে-মুখে, তবুও সমুদ্রের চোখে বিরক্তি নেই, আছে কেবল এক গুচ্ছ মুগ্ধতা! কি জীবন্ত ছবিটা! মনে হচ্ছে, এইতো! এই ছবি তোলার সময়টা মাত্র ঘটলো। আচ্ছা, সময়ের কী পুনরাবৃত্তি ঘটে? যদি ঘটে থাকে, তবে আবারও এই সময়টায় ফিরে যেতে চায়। প্রকৃতি কী পারবে এ সময়টায়, এ দিনটায় তাকে ফেরত পাঠিয়ে সময় থামিয়ে দিতে? সামান্য হাসলো সে। এতো ছেলে মানুষী ভাবনা ভাবলে কীভাবে জগত-সংসার চলবে?

সে রুমে ফিরে আসে। আজকেও একবার চেষ্টা করলো ছবিটা ডিলিট করার কিন্তু এতো সুন্দর ছবিটা ডিলিট দিতে বুক কাঁপে তার। ডিলিট দিলেই হারিয়ে যাবে! এরচেয়ে বরং মস্তিষ্কের সেরিব্রামের ধারনকৃত স্মৃতি নিপাক যাক। সে আস্তে করে বলে, ” প্রিয় স্মৃতিরা, তোমরা হারিয়ে যাও কোনো এক অতলে। ধ্বংস হও প্লিজ!”

ঘুম ঘুম চোখে শুতেই ভীষণ মাথাব্যথা অনুভব হয় তার৷ দুদিন বাদে তার বিয়ে। সম্পূর্ণ নতুন এক জীবনে যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে। এই রুমে, তার উপর, তার জীবনে, অন্যকেউ আধিপত্য স্থাপন করবে! সবটা তার ইচ্ছেতেই হচ্ছে। জীবন থামিয়ে রাখতে চায় না সে। চলমান এ মানবজীবনে আর দশটা মানুষের মতো বাঁচতে চায়। অথচ চোখ বুজলে আজোও অন্য কারো কথা মনে পড়ে। হায় রে জীবন! কাউকে ভুলে যাওয়া কখনো-সখনো খুব কঠিন ব্যাপার! কারোও জন্য আবার খুব সহজ!

___________

পরদিন সকালবেলা একদম আলো ফোটার পর সমুদ্রের ঘুম ভাঙ্গে। ক্লান্তির কারণে গভীর ঘুম হয়েছিলো। বেশ ফ্রেশ লাগছে এখন। ফোন হাতে নিতেই অফিশিয়াল সব ম্যাসেজ, ইমেইল নোটিফিকেশন পেল সে। আজকে বিয়ের আগে লাস্ট ডে অফিসে। কালকে শুধু দুপুরে ক্লাইন্টের সঙ্গে বিশেষ মোলাকাত আছে। ওটা কাজের কিছু নয় বরং বিনোদনের জন্য আমন্ত্রিত সময়সূচি। বেডে শুয়েই আয়নাকে ইমেইল ও ম্যাসেজ করে আজকে ছুটি দিয়ে দিলো সে। বিয়ের আগে আর অফিস আসার দরকার নেই ওর। তবে ইমেইলের শেষভাগে লিখে দিলো, খুব কাজ করতে মন চাইলে যেন অনলাইনে কাজ করে ও। এরপর রুম ছেড়ে বের হয়। ড্রয়িং রুমেই আম্মুকে পাওয়া গেল। নিউজপেপার পড়ছেন সে।

সমুদ্র মায়ের কাছে যেয়ে বলে, ” গুড মর্নিং আম্মু।”

–” গুড মর্নিং। নাস্তা দিবো?”

–” দেও। আব্বু কেমন আছে?”

–” ভালো। তোমার বাবার শরীর ভালো । গত দুইদিন ধরে ঠিকঠাক খাচ্ছেও।”

সমুদ্রের মনটা কিছুটা হলেও ভালো হলো। নাস্তা খেতে খেতে সে বলে উঠে, ” আজকে অফিসের সব কাজ সেড়ে ফিরব। একটু লেইট হবে। প্লিজ জলদি বাসায় আসার জন্য জোড়াজুড়ি করো না।”

–” আচ্ছা। কিন্তু একবার আয়নার সঙ্গে শপিং এ যেতে হবে। ”

–” কেন? অনলাইনেই তো সব সিলেকশন করলো।”

–” না, ব্রাইডাল শাড়িটা ডিরেক গিয়ে কিনবে। একঘন্টার মধ্যে ব্লাউজ ওরাই বানিয়ে দিবে। বিকেলের দিকে ওকে নিয়ে যাবি। বনানীতেই শোরুম। ”

–” আচ্ছা।”

সমুদ্র আর কথা বাড়ায় না। বিয়ে করার সিদ্ধান্ত যখন নিয়েছেই সবপ্রকার কাজেই তাকে অংশগ্রহণ করতে হবে। ছোট করে দম ফেললো সে। সে ভাবেও নি আসলেই তার বিয়ে হয়ে যাবে এতো দ্রুত৷ ছয় মাস আগেও বাবার বিজনেজ পার্টনারের বড়লোকের সুন্দরী মেয়ের সাথে বিয়ের কথা চলছিলো। ওখানেও কথা আগাচ্ছিলো বেশ দ্রুত গতিতে। কিছু আনুষ্ঠানিকভাবে ঘটার আগেই সমুদ্র মেয়েটার একটা স্ক্যান্ডালের প্রমান পায়। তারপর মেয়েটাকে ভীষণ রকম অপমান করে৷ মেয়ের বাবা তার বাবার সঙ্গে খুব ঝামেলাও করছিলো। এতে বিন্দুমাত্র চিন্তা ছিলো না সমুদ্রের। কিন্তু এই ঘটনার পরপর বাবার হার্ট এটাক হলো। তখন থেকে সব বদলে যেতে শুরু করে। আম্মু বাবার অসুস্থতায় ভীষণ ভেঙে পড়লো। বাসার পরিবেশ বদলে গেলো। বাবার অপারেশন করতে হয়েছিলো। অপারেশন এ কোনো প্রকার সমস্যা হয় নি। সাকসেসফুলি সব হয়েছে। বাবাকে হাসপাতাল থেকে যেদিন বাসায় আনা হলো সমুদ্র সবচেয়ে খুশি ছিলো। সেদিন রাতে বাবা তাকে অফিসের সবকিছু হ্যান্ডওভার করে দেয়। বেশ কিছু কাগজ-পত্র হাতে তুলে দেয়। ওইসময় সমুদ্রের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। সে মেডিকেলে পড়েছে। ঢাকায় ব্যাক করার পর প্রাইভেট একটা হসপিটালে কাজ করছে। সে কিভাবে ব্যবসা সামলাবে? কিন্তু তার বাবা নাকি আপাতত অফিসে বসবেন না। তার রেস্ট দরকার। হাপিয়ে উঠেছেন সে। এখন কিছুদিন বাসায় পরিবারকে সময় দিতে চান। সমুদ্র ছোটবেলা থেকে বাবাকে সারাদিন কাজ করে যেতেই দেখেছে। তিলে তিলে নিজের হাতে গড়া ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানটার মালিক তার বাবা। বাবার পাশে থেকে তার মাও সবধরনের সহযোগিতা করে এসেছে৷ দুইজন মিলেই এতোদিন ব্যবসা সামলে এসেছে। যার দরুন ঢাকা শহরে তারা রাজার হালে বসবাস করছে। অভাব কাকে বলে সেটা চোখে দেখেনি। কিন্তু বাবা যখন অবসরে চলে গেলো, তার মাও অফিস যাওয়া বাদ দিলেন। মা ভীষণ স্বামীভক্ত মহিলা। স্বামী অসুস্থ এমতাবস্থায় সে অফিস যাবে না। স্বামীর সঙ্গেই থাকবেন বলে জানান দিলো। সমুদ্র বুঝলো তার মা-বাবা অবসর চাচ্ছেন। ওদিকে তাদের বিজনেজ পার্টনারের সঙ্গেও রিলেশন ভালো নেই। অফিস গিয়ে তদারকি না করলে কে জানে, দুইদিন পর ওরা বিশ্বাসঘাতকতা করবে না? এটার কোনো গ্যারান্টি নেই। না পারতে সমুদ্র ব্যবসার হাল ধরতে রাজী হয়। ওইদিন প্রায় ছ’বছর পর তার বাবা তাকে অনুরোধের স্বরে নিজ থেকে কিছু কথা বলে। একটা বিশেষ কারণে তাদের পিতা-পুত্রের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। আজোও সম্পর্কের সমীকরণে কোনো উন্নতি আসেনি।
বাবা নিজ থেকে কথা বলেছে তার সঙ্গে এতেই সমুদ্র আবেগে আপ্লূত হয়ে যায়। নইলে কোনোদিন এতো প্যারাদায়ক ব্যবসা সামলাতে রাজী হতো না। সেদিনই বাবা তাকে সাফ বলে দেয়, এ বাসায় থাকলে হলে দ্রুত বিয়ে করে সেটেল হতে হবে। মাও ভীষণ জোড়াজুড়ি করে যেন সমুদ্র আর কখনো বিয়ে নিয়ে ঝামেলা না করে। তখন কেবল বাবার অসুস্থতার কথা ভেবে বলে দিয়েছিলো, এক প্রকার ওয়াদা করেছিলো, বিয়ে করতে রাজী সে। তার বাবা-মা নেক্সটে যে মেয়েই পছন্দ করবে, তাকে বিয়ে করবে। তবে আকদ করবে আগে পারিবারিকভাবে। প্রথমেই ঘটা করে কিছু করতে ইচ্ছুক নয় সে। আগে পারিবারিকভাবে বিয়ে করে রাখবে। বাইরের কেউ এ ব্যাপারে জানবে না। পরে সময়মতো বউ বাড়িতে আনবে। বড় অনুষ্ঠান হলে হবে পরবর্তীতে। কে জানত? বাবা অসুস্থ থাকলেও তার কোন পরিচিত ভার্সিটির ফ্রেন্ডের মেয়ের সাথে বিয়ে পাকা করে ফেলবে,তাও এতো দ্রুত। সমুদ্রের সব শর্তেই মেয়ে পক্ষ রাজী।

সবই ভাগ্য! নিয়তিতে তার সঙ্গে আয়না আছে এজন্য এতো ঝড়-ঝাপটা চললেও ওর সাথেই বিয়ে হচ্ছে।

যে ভাগ্যে থাকে, তাকে এমনই সহজ ভাবে প্রাপ্তিস্বরুপ পাওন চায়, আর যারে চাই, সে যদি ভাগ্যে না থাকে, তাহলে সারা দুনিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করলেও পাওন যাইব না।

অফিসে আজ বেশ কিছু মিটিং করেছে সে। কয়েকবার আয়নার ডেস্কেও চোখ গেলো। ওর ডেস্ক ফাঁকা। সমুদ্র লাঞ্চ ব্রেকের আগে অনলাইন মিটিং এ বসলো। তার আগে শিডিউল দেখে নেয়। বিকেলের দিকে বের হতে হবে। এর আগেই কাজ সব গুছিয়ে রাখতে হবে।

____________

আয়নার আজ দেরি করে ঘুম ভাঙ্গে। এগারোটার পর উঠে সে। হুট করে অনেক ঘুম কোথা থেকে ভর করেছে চোখে। সে ঘুম থেকে উঠেই ফোন হাতে নেয়। সমুদ্র তাকে সাড়ে ছয়টায় হোয়াটসঅ্যাপে একটা ম্যাসেজ দিয়েছে আর ছয়টা পয়ত্রিশ এ একটা অফিশিয়াল ইমেইল দিয়েছে। সে ম্যাসেজ খুলতেই অবাক হলো। গুড মর্নিং উইশ করেছে তাকে। এই প্রথমবার কোনো ছেলে তাকে সকালে গুড মর্নিং উইশ করলো। তার মন ভালো হয়ে যায়। সে হেসে দিলো। আবার আফসোস হলো কেন এতো বেলা করে উঠে গুড মর্নিংটা হারিয়ে ফেললো! ইমেইল খুলে দেখলো, তাকে ছুটি দিয়ে দিয়েছে। আজ ছুটি না দিলেও সে যেত না। পরক্ষণেই তাকে বেশ চিন্তিত হতে দেখা গেলো। সে মনে মনে ভাবে, সমুদ্রের কাছ থেকে বিষয়টা লুকানো কি ঠিক হচ্ছে? ওর তো আয়নার ব্যাপারে সবটা জানার অধিকার আছে! কি করবে সে? জানিয়ে দিবে সবটা?

আয়না ফ্রেশ হয়ে রুম ছেড়ে বের হতেই মিলি দৌঁড়ে এলো, তার পায়ের কাছে ঘেঁষে দাঁড়ালো। সে মিলিকে গুড মর্নিং বললো। উত্তরে মিলি লেজ নাড়িয়ে মিউমিউ বলে। এরপর দাদা-দাদি, আলিয়া এমনকি হালিমা বুয়াকেও সে এই বেলা এগারোটায় গুড মর্নিং উইশ করে৷ আলিয়া তখন কনফ্লেক্স খাচ্ছিলো। সে এই প্রথম আপাকে সকাল বেলা উঠে এতো খুশি দেখলো। ওর আবার কি হলো? সবাইকে গুড মর্নিং বলছে। এমন আচরণ আজই প্রথম। সে আমলে নেয় না, বরং নিজের আপাকে দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আপাকে আজ অন্যরকম সুন্দরী লাগছে।

হামিলা বুয়া পরোটা আর সবজি তুলে নিয়ে বললো, ” আপামনি আপনারে একদম ঝাক্কাস রূপবতী লাগছে৷ আপনার বিয়ের ফুল ফুটে গেছে তবে!”

আয়না বলে উঠে, ” বিয়ের ফুল কীভাবে ফুটে হামিলা খালা?”

হালিমা বুয়া বেশ জ্ঞানী ভাব ধরে বলে, ” প্রত্যকটা মেয়েরই জন্মের সময় ভাগ্য নির্ধারণ করা থাকে। নির্ধারিত মানুষটা জীবনে আসলে, ভাগ্যফুল ফুটে। তখন মেয়েদের রুপ বেড়ে যায়। আপামনি, আজকে আপনারও ভাগ্যফুল ফুটছে। এজন্য দেখেন কী সুন্দর লাগছে আপনারে৷ কারো নজর না লাগুক। ”

আয়না সামান্য হাসলো। গতকাল সে আর আলিয়া পার্লার থেকে ফেশিয়াল করে এসেছে। এজন্য বুঝি ফর্সা ফর্সা লাগছে৷ নাকি আসলেই সমুদ্রের জন্য তার ভাগ্যফুল ফুটেছে?

সে লাঞ্চ ব্রেকে কল লাগায় সমুদ্রকে। প্রথমবার ধরলো না। দ্বিতীয়বার সমুদ্র কল ধরে একটু লো ভয়েজে বলে, ” হ্যাঁ আয়না বলো। কিছু বলবে?”

–” হু।”

তখন ফোনের ভেতর থেকে আয়না অন্য মানুষের আওয়াজ পেল। সমুদ্র বলে, ” মিটিং এ আছি। অফিশিয়াল কিছু বলবে? ”

–” না।”

–” ব্যক্তিগত কিছু? ”

–” হু।”

সমুদ্র লো ভয়েজে বলে উঠে, ” তাহলে বিবি সাহেবার পারসোনাল স্পেস লাগবে তাই তো? সেজন্য একটু অপেক্ষা করুন৷ আমি চারটার মধ্যে তোমার বাসার সামনে আসবো। তারপর শপিং এ যাব।”

আয়নার কেমন শিহরণ বয়ে যায়। সমুদ্র এতো সুইট ভাবে কথা বলতে পারে? তার বিশ্বাস ই হচ্ছে না । সে কল কেটে দিলো। তারপর প্রায় দু’ঘন্টা ধরে সাজুগুজু করলো। গোলাপি রঙের একটা সালোয়ার কামিজ পড়ে নেয়।

সত্যি সাড়ে চারটার মধ্যে সমুদ্র তার বাসার নিচে এসে উপস্থিত হয়। আয়না গ্যারেজে নেমে, গিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ে। সমুদ্র সোজা বনানীর উদ্দেশ্য ছু’টে৷

গাড়িতেই সমুদ্র বলে উঠে, ” কিছু বলার ছিলো নাকি?”

–” হ্যাঁ।”

–” বলো?”

–” আমি আসলে আপনার থেকে কিছু হাইড করতে চাই না।”

–” বয়ফ্রেন্ড আছে নাকি? থাকলে মিট করায় দাও। ট্রিট নেই জামাই-ইন-ল থেকে।”

আয়না বিষ্ফোরিত চোখে তার দিকে তাকায়। কারো হবু স্বামী এ বিষয়টা এতো সহজ ভাবে নিবে বলে মনে হয় না তার৷

সমুদ্র গাড়ি চালাতে চালাতে বললো,” কি হলো? কি ভাবছো? বয়ফ্রেন্ড আবার আবেগে হাত কেটে ফেলেছে নাকি?”

আয়না বুঝলো নিশ্চয়ই মজা নিচ্ছে ও। কিন্তু আয়না মন খারাপ করে মাথা নিচু করে ফেলে৷

সমুদ্র যেন এবারে সিরিয়াস হলো। সে বলে উঠে, ” কি হয়েছে?”

–” আসলে….

–” আসলে-নকলে যা বলার বলে ফেলো। নকলেই কী প্রেমিক আছে কোনো?”

–” সমুদ্র! ”

সমুদ্র একটু হতভম্ব হলো। এই প্রথম মেয়েটা তাকে তার নাম ধরে ডাকলো। নিজের নামটা তার এমনিতেই খুব পছন্দ। আজকে আরোও বেশি পছন্দ হওয়ার একটা কারণ পেলো৷

সে বলে, ” বলো।”

–” আমার একটা অসুখ আছে।”

–” সবারই অসুখ থাকে। অসুখ আছে জন্য ই আমরা ডাক্তারি পড়ি।”

–” কিন্তু অসুখটার জন্য ভবিষ্যতে ইমপ্যাক্ট পড়লে?”

–” পড়লে পড়বে।”

–” উফ, আপনি বুঝছেন না কিছুই।”

সমুদ্র গাড়ি থামিয়ে পার্ক করলো রোডের এক সাইডে। এরপর বলে, ” অসুস্থতা নিয়ে এতো আপসেট হচ্ছো কেন?”

আয়না মাথা নিচু করে বলে উঠে, ” আমার পিসিওএস (PCOS) এর সমস্যা আছে। যদি আমি কখনো মা না হতে পারি? তখন তো আপনাকে ঠকানো হবে। এজন্য আপসেট হচ্ছি। আমি চাই না, আমার অসুখ লুকিয়ে আপনার সঙ্গে প্রতারণা করতে।”

সমুদ্র তাকে অবলোকন করলো দুবার। তবে কিছু বললো না। আয়না তাকে চুপ থাকতে দেখে বেশ ভয় পায়, আবার হতাশাও কাজ করে। কেন যে তার এই সমস্যা দেখা দিলো? আর বাকি মেয়েদের মতো স্বাভাবিক হলে কি সমস্যা হতো?

সে হতাশাগ্রস্ত গলায় বলে, ” আপনি চাইলে বিয়ে ভেঙে দিতে পারেন। আমি আপত্তি করবো না।”

সমুদ্র এবারে বলে উঠে, ” রোগ-বালাইয়ের ক্ষেত্রে ডাক্তারের চেয়ে শিক্ষক বেশি পণ্ডিতি করলে তো মুশকিল। ”

আয়না তার কথা কিছুই বুঝে না। তাও সুধালো, ” আপনি এই অসুখ সম্পর্কে জানেন নিশ্চয়ই? ”

–” তোমার চেয়ে ভালো জানি।”

এরপর আয়নাকে অবাক করে দিয়ে সমুদ্র খুব সুন্দর একটা হাসি উপহার দিয়ে বলে, ” অসুস্থতার জন্য গিল্ট ফিল করছো কেন? অসুস্থতা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত৷ কারো হাতে কিছু করার নেই। তবে সৃষ্টিকর্তা মানুষের উছিলাতেই অসুস্থতার আরোগ্য লাভ করার সমাধান দিয়েছেন। আমরা ডাক্তাররা তো আছিই সমাধান দেওয়ার জন্য। তাছাড়া পিসিওএস খুব কমন একটা রোগ। সারা বিশ্বেই এই সমস্যা ফেস করছে মেয়েরা। প্রোপার ট্রিটমেন্ট, হেলথি লাইফস্টাইল অনুসরণ করলে অসুবিধা সেড়ে যায়।”

–” আপনার তাহলে আমার অসুখ নিয়ে কোনো সমস্যা নেই?”

–” অসুখ নিয়ে সমস্যা থাকলে ডাক্তারি কেন পড়তাম?”

আয়না সামান্য হাসলো। সে বেশ রিলিফ ফিল করে। এখন আর কোনো চিন্তা নেই তার৷

সমুদ্র বলে উঠে, ” নামো। শোরুম সামনেই।”

আয়না গাড়ি থেকে নেমে শোরুমে ঢূকে পড়ে৷ গতকাল রাতে সমুদ্রের রেফারেন্স অনুযায়ী একটা লাল গোল্ডেন পাড়ের কাতান শাড়িই সিলেক্ট করে রাখা হয়েছিলো।

সেলসম্যান সমুদ্রের সামনেই আয়নাকে জিজ্ঞেস করলো, ” ম্যাম, আপনার ব্লাউজ ফিটিংস এর জন্য কোন সাইজ ব্যবহার করবো?”

আয়নার তখন ভীষণ লজ্জা লাগলো। আস্তে করে করে,” মিডিয়াম।”

–” ওকে। আধা ঘন্টা অপেক্ষা করুন ম্যাম।”

আধা ঘণ্টা কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না তারা।এজন্য আয়না দোকানের বাকি কালেকশন দেখতে থাকে। তার চোখ গিয়ে আটকে একটা সেমি ব্রাইডাল খয়েরী লেহেঙ্গার দিকে। তার ইচ্ছা ছিলো পাকিস্তানি ব্রাইডদের মতো লেহেঙ্গা পড়ার কিন্তু তার আগেই সমুদ্র শাড়ি পড়তে বললো। অবশ্য সমুদ্রের ইচ্ছা অনুযায়ী বিয়ের দিন সাজবে এতেই খুশি সে।

সেলসম্যান আয়নার মনোভাব বুঝি ধরে ফেলে। সে বললো, ” ম্যাম, এই লেহেঙ্গাটা আমাদের বেস্ট কালেকশন। আপনি চাইলে দেখতে পারেন।”

সমুদ্র পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। আয়না দ্রুত বলে, ” না। না। দরকার নেই।”

–” আপনাকে খুব মানাবে ম্যাম। ট্রায়াল দিয়ে দেখেন৷”

–” না। না। লাগবে না।”

তখন সমুদ্র বললো, ” ট্রায়াল দিয়ে দেখো।”

সেলসম্যানকে আর পায় কে? সঙ্গে সঙ্গে লেহেঙ্গা আয়নার হাতে দিয়ে দিলো। ট্রায়াল রুমের পথ ও দেখিয়ে দেয়৷

শোরুমটায় ব্রাইডাল,সেমি-ব্রাইডাল কালেকশন থাকে। বেশ নামী-দামী ব্রান্ডের শোরুম। এখানকার সব আউটফিট বেশ এক্সপেন্সিভ। এজন্য কাস্টমারও হাতেগোনা। সমুদ্র তাকে ট্রায়াল রুমে পাঠিয়ে দিয়ে, একদম ট্রায়াল রুমের বাইরে অপেক্ষায় থাকে৷ একটু পর আয়না বের হয়ে আসলো।

সমুদ্র তখন ফোন চালাচ্ছিলো। আয়নাকে বের হতে দেখে ওর দিকে চোখ তুলে তাকালো। এরপর আস্তে করে বলে, ” মাশাল্লাহ খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে।”

আয়না একটু উৎকন্ঠাবোধ করে। ভীষণ রকম লজ্জা লাগলো। ইদানীং কি যেন হয়েছে তার, সমুদ্র সামনে আসলেই লজ্জা লাগছে।

সমুদ্র তার সামনে এসে দাঁড়ালো। তখনই ভারী দোপাট্টাটা কাঁধ থেকে পড়ে যেতে ধরলে, খপ করে ধরে ফেলে সেটা সমুদ্র। বাহুতে পুরুষালি স্পর্শ লাগায় বেশ খানিক কেঁপে উঠে আয়না। সমুদ্র দোপাট্টা কাঁধে তুলে দিয়ে, সম্পূর্ণ ওড়না পেছন থেকে, ঘুরিয়ে এনে ডান হাতে পাড়টা গুঁজে দিলো। আয়না চোখ নিচু রেখে দাঁড়িয়ে ছিলো।

সমুদ্র বলে, ” লেহেঙ্গা পড়েই থাকবে?”

আয়না দ্রুত ট্রায়াল রুমের দিকে ছুটে দরজা লাগিয়ে দেয়। সমুদ্রের হাসি পেল বেজায়।

দু’মিনিট না যেতেই আয়না ভেতর থেকে বলে, ” আছেন আপনি? ”

–” আবার আটকে গেছো নাকি?”

–” আরে না। আসলে আই নিড হেল্প। আপনি কাউকে ডেকে আনতে পারবেন, কোনো ফিমেল স্টাফকে?”

–” দরজা খোলো।”

আয়না দরজা খুলে দিতেই সমুদ্র ট্রায়াল রুমের ভিতর ঢুকে পড়ে৷ ছোটো রুমটার দরজা অটো লেগে যেতে ধরে৷ আয়না হচকচিয়ে উঠে বলে, আপনি কেন আসলেন?”

–” হেল্প করতে।”

আয়না কিছু না বলে অসহায় মুখে তাকিয়ে থাকে। এর অর্থ হলো প্লিজ যান এখান থেকে । মুখে বলে উঠে, ” কেউ দেখলে খারাপ ভাববে।”

সমুদ্র সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে দেয়। সে আয়নার দিকে তাকায়। ট্রায়াল রুমের হলদে আলোয় ওকে আরোও বেশি সুন্দর লাগছে। মিররের দিকে তাকিয়ে ওর প্রতিবিম্ব দেখলো। হুকের সঙ্গে চুল আটকে গেছে। নিশ্চয়ই হুক থেকে চুল মুক্ত করতে পারছে না৷

সে বিড়বিড় করে বলে,” মেয়ে মানুষের এতো ঝামেলা!”

এরপর মিররের দিকে তাকিয়েই নিজের হাতটা ওর পিঠের দিকে নিয়ে গিয়ে হুক থেকে চুল মুক্ত করে দিলো। মুখে কেবল ” এক্সকিউজ মি” বলল। আয়না সঙ্গে সঙ্গে চোখ খিঁচে বন্ধ করে, নিশ্বাস এক প্রকার বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকলো। সমুদ্র কাজ শেষ করে রুম ছেড়ে বের হয়৷ আয়নাও চেঞ্জ করে ফিরে আসে। ততোক্ষণে ব্লাউজ মেকিংয়ের কাজও শেষ।

সেলসম্যান জিজ্ঞেস করলো, ” ম্যাম লেহেঙ্গা টা সঙ্গে এড করবো?”

আয়না বলে, না, লাগবে না৷ ”

সে সামনে এগিয়ে গেলো। সোফায় বসে সমুদ্রের আসার অপেক্ষা করতে থাকে।

ক্যাশ কাউন্টারে সমুদ্র দাঁড়িয়ে বলে উঠে, ” শাড়ির সঙ্গে লেহেঙ্গাটাও দিয়ে দেন।”

ক্যাশ কাউন্টারের মহিলাটা বললো, ” ম্যামকে লেহেঙ্গায় মানাবে অনেক।”

–” হ্যাঁ, এজন্য ই তো নিচ্ছি। ওর পছন্দও হয়েছে খুব।”

–” স্যার, আপনি ম্যামের অনেক কেয়ার করেন দেখছি। সি ইজ ভেরি লাকি।”

সমুদ্র উত্তরে কেবল মুচকি হাসে।

আয়না জানলোও না সমুদ্র শাড়ির সঙ্গে লেহেঙ্গাটাও তাকে কিনে দিয়েছে। প্যাকেট হাতে বেরিয়ে আসে দু’জনে৷

চলবে।

#ইলেকট্রিক্যাল_মন
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–7

পূর্নিমা রাত। আকাশে থালার মতো সোনালী রঙের বিশাল বড় চাঁদ উঠেছে। আজকের আকাশ একদম পরিষ্কার। আয়না যখন বাসার সামনে নামলো, সমুদ্র প্যাকেট হাতে তুলে দিয়ে বলে, ” কাল দেখা হবে।”

আয়না অকস্মাৎ একটু চমকে। আগামীকাল তাদের দুইজনের আলাদাভাবে গায়ে হলুদের ঘরোয়া আয়োজন হবে দুপুরে। এরপর সন্ধ্যায় মেহেদী উৎসব। ওইসময় সমুদ্রও আসবে৷ আয়না আগামীকালের অনুষ্ঠানের কথা ভাবতেই একটা ফাঁকা ঢোক গিললো। সমুদ্র তখনো গাড়ির ভেতরে বসে ছিলো। ওকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সুধালো, ” তুমি আজ থেকেই আমার সঙ্গে থাকতে চাচ্ছো নাকি?”

আয়না তখন অন্য চিন্তায় বিভোর ছিলো। শুনেনি ঠিকঠাক। আয়নার মুদ্রাদোষ হলো কোনো কথা ঠিকমতো না শুনলেও, কথা ঠিকই বলে ফেলে। আজও ব্যতিক্রম হলো না৷

সে বলে উঠে, ” হু।”

সমুদ্র খানিক হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে। এরপর আস্তে করে বলে, ” মেয়ে তো পুরাই তারছিড়া দেখছি!” তারপর বললো, “গাড়িতে উঠে পড়ো তাহলে। মা কিছু জিজ্ঞেস করলে, বলে দিবো, বউমা বিয়ের আগে থেকেই শ্বশুড়বাড়ি যেতে চায়। বাপের বাড়িতে আর মন বসছে না।”

আয়না ভড়কে গিয়ে সামান্য দূরে সরে এসে বলে, ” আয়া, মজা করছিলাম আমি। আসি।”

–” গুড নাইট।”

আয়না সঙ্গে সঙ্গে একবার তার দিকে তাকালো। সে গাড়ি টান মেরে চলে গেলো।

সে বাড়ি ফিরতেই আলিয়া বেশ উৎসাহ নিয়ে প্যাকেট কেড়ে নিলো। বিয়ের শাড়ি দেখার জন্য সকাল থেকেই মনে মনে এক্সাইটেড সে। আয়না সরাসরি বাবার কাছে গেলো। বাবা বাসায় থাকলে, বাইরে থেকে ফিরে এসেই বাবাকে জানায় যে ঠিকমতো ফিরে এসেছে আর বাবা বাসায় না থাকলে ফোন দিয়ে জানায়। আয়না যখন বাবার সঙ্গে কালকের অনুষ্ঠান নিয়ে আলাপ করছিলো, তখন আলিয়া ফিরে এসে বললো, ” আপা দুইটা আউটফিটই দারুণ হয়েছে। ”

আয়না বাবার সঙ্গে কথা বলা বাদ দিয়ে বলে, ” দুইটা আউটফিট কই পেলি? একটাই তো নিলাম!”

আলিয়া মাথা ঝাকিয়ে না বোধহয় অর্থ প্রকাশ করে বলে, ” না। একটা শাড়ি, অন্যটা লেহেঙ্গা।”

লেহেঙ্গা শব্দটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আয়নার ভ্রু কুচকে যায়। সে দ্রুত বেগে নিজের রুমে দিকে ছু’টে৷ আলিয়া একবার বাবাকে দেখলো, পরক্ষণেই বড় আপার যাওয়ার পানে তাকালো।

ফাহাদ সাহেব জিজ্ঞেস করলো, ” কি হলো তোমাদের দুই বোনের?”

আলিয়া উত্তর দিলো হাসিমুখে, ” বাবা, আপার বিয়ের শাড়ি আনপ্যাক করেছি৷ খুব সুন্দর। ওটা নিয়েই ব্যস্ত আমরা।” বলে আপার কাছে যেতে লাগলো।

ফাহাদ সাহেবও খুশি হলো। বিয়ের অনুষ্ঠান নিয়ে তার দুই মেয়ে আজকে সকাল থেকেই খুব খুশি। সে গতকাল থেকেই ছুটি নিয়েছেন। বাসায় আয়োজনের সব তদারকি করা লাগছে। ভাবলেন শায়লাকে ফোন দেওয়া উচিত একবার।

আয়না নিজের বিছানায় ট্রায়াল দেওয়া খয়েরী রঙের লেহেঙ্গাটা দেখে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রয়। নিজের হাত দিয়ে লেহেঙ্গাটা ছু’য়েও অবাক লাগছে যে আসলেই এটা তার বাসায়! কীভাবে সম্ভব? সে তো না করে দিয়েছিলো। সেলসম্যান ভুলে দিয়ে দিলো নাকি? সঙ্গে সঙ্গে সে শপিং ব্যাগ থেকে ক্যাশম্যামো তুলে নেয়। পেমেন্ট রিসিটে দুইটা আউটফিটের প্রাইজই দেওয়া। লেহেঙ্গাটার দাম আড়াই লাখ টাকা দেখে তার চোখ কপালে। সমুদ্র এতো দাম দিয়ে তাকে কিনে দিলো? শুধুমাত্র তার পছন্দ হয়েছে বলে? আয়নার এটা ভাবতেই খুব খুশি লাগলো। মনের মধ্যিখানে কেমন হিমেল হাওয়া বয়ে যায়৷ চারপাশে রঙিন প্রজাপতি উড়তে লাগে বোধহয়!

আলিয়া তার পাশে এসে দাঁড়ায় এবং বলে, ” আপা এই লেহেঙ্গা মেহেদীর অনুষ্ঠানে পড়ো। একদম হানিয়া আমীরকে ঝাঁপিয়ে যাবে!”

আয়না মৃদ্যু হাসে এরপর বলল, ” পাগল তুই!”

আলিয়া কি হলো কে জানে আপার হাত জড়িয়ে নিয়ে কাঁধে মাথা রেখে বললো, ” আপা, আমার কান্না পাচ্ছে। তোমার বিয়ে হয়ে গেলে আমরা বাসায় একা কীভাবে থাকবো?”

শতশত আয়োজন যেন মুহুর্তের মধ্যে বৃথা যায়। একহাতে নতুন সম্পর্কের আহ্বানের চিহ্ন, অন্যহাতে পুরাতন সম্পর্কের বাঁধন ছেঁড়ার ব্যথা। আয়না আলিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলে, ” আমি তো এখনই যাচ্ছি না। পরেরটা পরে দেখা যাবে।”

আলিয়া মুখ ভোতা করে বলে, ” তোমাকে যাইতেই দিব না। ভাইয়াকে বলবো উনি যেন এখানে আসেন থাকতে। তোমরা আমাদের সাথে থাকবে।”

আয়না বেশ শব্দ করে হাসে। আগামীকালের প্রস্তুতি নিয়ে দুই’বোন ব্যস্ত হয়ে যায়। সমসাময়িককালে বাঙ্গালী ইয়ং মেয়েদের মধ্যে পাকিস্তানি ড্রামা, ওদের সাজগোছ বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। মেয়েরা পাকিস্তানি জামা, মেকাপ নায়ক-নায়িকা সহ–সবকিছুর ফ্যান হয়ে গেছে৷ আয়না-আলিয়া ও ব্যতিক্রম নয়৷ ওরা মেহেদী অনুষ্ঠানে পাকিস্তানি ড্রামার নায়িকার মতো সাজবে বলে পরিকল্পনা করেছে৷

ফাহাদ সাহেব বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন। আগামীকাল বাসায় ছোট একটা অনুষ্ঠান করবেন৷ পড়শু বড় করে অনুষ্ঠান। আকদের অনুষ্ঠান পড়শুদিন। পড়শুদিনের অনুষ্ঠানের আয়োজন নিয়ে বেশ বিচলিত সে। সব ঠিকঠাক হবে তো? একাকী বোধ করতে লাগলেন সে। আয়নার মা, আয়না যখন সিক্স গ্রেডে পড়ে তখন মৃত্যুবরণ করে। দুইটা ছোট ছোট বাচ্চা মেয়ে নিয়ে সে বেশ বিপদে পড়ে যান৷ আলিয়া তখন থ্রিতে পড়ত। এতো ছোট বাচ্চা মেয়ে নিয়ে সে যেন সর্বহারা হয়ে পড়েন। গ্রাম থেকে বাবা-মা আসলেন বাচ্চা দু’টোকে দেখার জন্য। তখন থেকেই আব্বা-আম্মা তার বাসায়ই থেকে আসছেন। তার মা-বাবাও আয়না-আলিয়া কে চোখে হারায়। বিপত্নীক পুরুষ সে। উঠতি বয়সী, টীনএইজ মেয়ে দু’টোকে নিয়ে আত্মীয়-স্বজনরা বেশ বাঁকা কথা বলত। তারই আপন ভাই বলেছিলো, মেয়ে দুটা বিগড়ে যাবে৷ মা মরা মেয়ে, নষ্ট, উচ্ছশৃখল হবে। কিন্তু নাহ, তার মেয়ে দুটো বেশ ভদ্র-নম্র। বড় হওয়ার পর যারাই ওদের দেখে সবাই প্রশংসা করে, বলে, মেয়ে দুইটা এতো মিষ্টি! বাবা হিসেবে তখন দুশ্চিন্তামুক্ত লাগে। পড়ালেখায় ও ভালো দুই’বোন। ফাহাদ সাহেব নিজেও মেধাবী ছিলেন ছাত্রজীবনে। বিসিএস দিয়ে সরকারি কর্মকর্তা হন। এখন বেশ উচ্চ পদে আছেন। ক্ষমতা, সম্মান অনেক আছে তার। সম্পদ-টাকাও আছে ভালো পরিমাণে৷ সৎ পথে উপার্জন করেন বিধায় খুব সম্পদ নেই, তবে আপার মিডেল ক্লাস যাকে বলে সেরকম লাইফ লিড করছেন৷

সে শায়লাকে কল লাগালো। সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ হলো।

ফাহাদ সাহেব বলে, ” তোমাকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ।”

–” ধন্যবাদ কেন?”

–” তুমি না হলে আয়ুর এতো ভালো ঘরে বিয়ে দিতে পারতাম কিনা সন্দেহ৷ এখন নিজেকে খুব দায়মুক্ত লাগছে। আমি মারা গেলেও আর চিন্তা থাকবে না। আমার মেয়ের দায়িত্বে এখন আরেকজন ভাগীদার। আর আয়ুর কাঁধে শক্ত হাত থাকলে, আলিয়া কে নিয়ে ভাবতে হবে না। আয়ু ঠিকই ছোট বোনকে আগলে রাখবে।”

–” মেঘ, এসব কি ভাবছো? তুমি নাতি-নাতনীদের নিয়ে স্কুল যাবে, বুঝলে? উল্টা-পাল্টা ভাবনা বাদ দেও। তুমি এখনো ইয়ং ম্যানই আছো।”

–” সৃষ্টিকর্তার যা ইচ্ছা। যাইহোক, তোমার কথা অনুযায়ী ওদের দুইবোনকে গতকাল বাইরে ঘুরতে নিয়ে গিয়েছিলাম। কালকে থেকে দুইজন ই খুব খুশি।”

–” কি করছে ওরা এখন?”

–” বিয়ের জামাকাপড় নিয়ে কিসব করছে, কি সব বলে কিছুই বুঝি না। গতকাল দুইঘন্টা ধরে পার্লারে কি জানি করলো। এসব মাথার উপর দিয়ে যায় আমার।”

— ” এই জেনারেশনের বাচ্চা-কাচ্চাদের বোঝা খুব কঠিন।”

–” আগামীকাল দাওয়াত থাকলো। সন্ধ্যার মধ্যে আসবে৷”

–” আয়না যদি কিছু মনে করে? রিয়্যাক্ট করলে?

–” না, করবে না। তাছাড়া তোমার থেকে কিছু সাহায্যও দরকার। আসা লাগবে তোমাকে।”

–” আচ্ছা। আসবো।

ফাহাদ সাহেব ফোন রাখলেন৷ ফাহাদ ইসলাম তার সার্টিফিকেট নাম। কিন্তু মেঘ বলে গুটিকয়েক মানুষ তাকে ডাকে।

_________________

সমুদ্র সকাল থেকেই সামান্য বিরক্ত। সাদা-আসমানী মিশেল রঙের পাঞ্জাবি পড়ে বর সেজে বসে আছে। তাকে ঘিরে আত্মীয়দের এতো শোরগোল আর ভালো লাগছে না। সে চাচ্ছে এইসব হলুদ-সবুজ যা করবে তাড়াতাড়ি করুক। দুপুরে তাকে বেরোতে হবে৷বিশেষ মিটিং এ ক্লাইন্টের কোনোরকম মনোরঞ্জনে ঘাটতি থাকলে চতুর্থ প্রোজেক্ট হাত ছাড়া হয়ে যাবে। কিন্তু তার বাড়ির লোকদের এতে কোনো মাথাব্যথা নেই। তারা নিজেদের মতো ব্যস্ত। সে বাসার ড্রয়িংরুমে বসে আছে। একটু পর তাকে হলুদ লাগাবে। সে ঘড়ি দেখলো। বারোটার বেশি বাজে। দু’টোর আগেই পৌঁছাতে হবে৷

মিসেস রোদেলা এসে বলে, ” মুখটা গোমড়া করে রেখেছিস কেন?”

–” যা করার জলদি করো। দুইটার আগে আমাকে প্লিজ মাফ করে দিও।”

মিসেস রোদেলা হাসলেন। মা আজকে খুব পরিপাটি করে সবুজ রঙের শাড়ি জড়িয়েছেন গায়ে। তার বাবাকেও সবুজ পাঞ্জাবিতে দেখা হলো। বাবা-মা ম্যাচিং জামা পড়েছে! নিশ্চয়ই পিউয়ের বুদ্ধি এসব! একটু পর পিউকেও দেখা গেলো। সে অবশ্য হলুদ রঙের শাড়ি পড়েছে। বোনকে দেখে অবাক হলো সে। শাড়ি পড়ার জন্য ওকে বেশ বড় বড় লাগছে! বিশ্বাসই হচ্ছে না এটা তার ছোট্ট বোন।

হলুদের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। সমুদ্রকে ড্রয়িংরুমের মাঝে বসানো হয়েছে। ফ্লোরিং করে সুন্দর করে বসার ব্যবস্থা। পেছনে গাদা ফুল দিয়ে সাজানো স্টেজের মতোন করে ডেকোরেশন করা। সামনে একগাদা খাবার৷ সবার আগে হলুদ লাগাতে তার মা-বাবা আসলো। মিসেস রোদেলা অল্প হলুদ হাতে নিয়ে তার আদরের পুত্রের কপালে হলুদ ছোঁয়ালেন। দু’সেকেন্ডের ব্যবধানে মিসেস রোদেলার চোখ টলমল করে উঠে। সে আঁচলে মুখ ঢেকে একটু কাঁদলেন।

ইশরাক রহমান বলে উঠে, ” ছেলের বিয়ে দিচ্ছো, কাঁদার কি হলো? ছেলেকে তো আর ঘরজামাই পাঠাচ্ছো না যে তোমাকে রেখে শ্বশুড়বাড়ি যাবে৷”

মিসেস রোদেলা কান্নাভেজা গলায় বলে, ” আবেগ, তুমি ওসব বুঝবে না। তোমার ডাকনাম টাই কেবল আবেগ, মনের ভিতরে আসলে তোমার কোনো আবেগই নাই। তুমি একটা নিরাবেগ মানুষ!”

ইশরাক রহমান বুঝে পেলেন না সে আসলে কি এমন ভুল বললো? কিন্তু স্ত্রীর সঙ্গে তর্কে গেলেন না। বুদ্ধিমান মানুষ স্ত্রীর সঙ্গে তর্কে যায় না। সে যথেষ্ট বুদ্ধিমান।

ইশরাক রহমান ছেলের গালে হলুদ লাগিয়ে দিয়ে, সামনে থাকা বাহারি রকমের খাবার থেকে ছেলের সবচেয়ে পছন্দ লাড্ডু, সেটা মুখে তুলে দিলেন৷ ছেলেটা ছোট থেকেই লাড্ডু আর কালোজাম মিষ্টি পছন্দ করে।

বাবা যখন লাড্ডু হাতে তুলে তাকে খাইয়ে দিলো, সমুদ্র বেশ খানিকটা অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকে বাবার দিকে। বাবার তাহলে খেয়াল আছে তার লাড্ডূ প্রিয়! তার বাবা সরে আসতে চাইলে, সে আলতো করে হাত এগিয়ে বলে, ” আব্বু?”

ইশরাক রহমান থেমে গিয়ে বলে, “কি?”

সমুদ্র সামনের ট্রে থেকে একটা কালোজাম মিষ্টি তার বাবার মুখে তুলে দিলো। মিসেস রোদেলা পিতা-পুত্রের এমন সুন্দর মুহূর্ত দেখে খুশিতে আপ্লূত হলো! সে সমুদ্রের কপালে দু’টো চুমু খেয়ে বললো, ” অনেক সুখী হো”

সমুদ্র বলে, ” দোয়া করো।”

ইশরাক রহমান বলে উঠে, ” দুয়া সবসময়ই করি যেন তোমরা খুশি থাকো।”

বাবার সঙ্গে সে উঠে দাঁড়িয়ে কোলাকুলি করলো। কতোদিন পর সে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো তা আর মনে করতে পারলো না। ছেলে ও মেয়েরা বড় হওয়ার পর, মেয়ে ও ছেলের দুই জাতির ক্ষেত্রে, বাবার সাথে সম্পর্ক ভিন্ন দু’রকমের হয়৷ মেয়েরা বাবাদের সঙ্গে ঝগড়া করে, আবার একটু পর বাবা বাবা বলে ডেকে আবদার করে। বাবারাও মেয়েদের প্রতি বেশি নরম থাকে। কিন্তু ব্রাউন ফ্যামিলিতে ছেলেদের একটা সময় পর বাবার সঙ্গে একটা দূরত্ব চলে আসে। যদি আবার তাদের মধ্যে ইগো রিলেটেড কোনো ঝামেলা থাকে, তাহলে কতদিন পরপর কথা বলে নিজেরাই ভুলে যায়।

সমুদ্রর বেশ ভালো লাগছে। বাবা-মা সরে যাওয়ার পর মিসেস ইভানা আসলেন। সঙ্গে তার ছেলে শ্রাবণ ও ছিলো। ইভানা সমুদ্রের গালে হলুদ লাগিয়ে মোটা হলুদ খামে টাকা গিফট দিতে গিয়ে বলে, ” না করবি না একদম। ”

সমুদ্র উপহার গ্রহণ করে বলে, ” এটারই তো দরকার। ”

শ্রাবণ বলে উঠে, ” ভাইয়া তোমার তো সেই ইনকাম হচ্ছে। ”

সমুদ্র বলে উঠে, ” তুইও বিয়ে কর, তোরও ইনকাম হবে তাহলে।”

শ্রাবণ বলে, ” আগে তো বিয়ের কথা মুখেই নিতা না, আজ আমাকে বিয়ে দেওয়ার অফার দিচ্ছো!”

–” আমি একা কেন ফাঁসবো? সঙ্গে তোকে নিয়েই ফাঁসি।”

শ্রাবণ হাসতে হাসতে বলে, ” ভাই এরকমভাবে আমিও ফাঁসতে চাই। ভাই, তোমার কোনো শালী আছে? থাকলে লাইন সেট করে দেও?”

ইভানা ছেলের কান টেনে ধরে বলে, ” পড়াশোনা নাই আবার বিয়ে করবেন উনি! সিজিপিএ দেখছিস নিজের? এই সিজিপিএ দেখলে মেয়ের বাপ ভুলেও বিয়ে দিবে না।”

শ্রাবণ বলে উঠে, ” আম্মু, বিয়ে দেও, বিয়ে দিলে পড়াশোনায় মনোযোগ আসবে।”

সমুদ্র সহ উপস্থিত সকলে হেসে ফেলে। না হেসে উপায়ও নেই শ্রাবণ ছেলেটা এতো বেশি সারকাজম করতে পারে!

বড়রা হলুদ মাখিয়ে দিয়ে ডাইনিং এ দুপুরে খেতে যায়। তখন ড্রয়িংরুমে কেবল ছোটরা উপস্থিত ছিলো। শ্রাবণ, পিউ আর তাদের কিছু কাজিন এসে দাঁড়ালো সমুদ্রকে ঘিরে।সমুদ্র ভ্রু কুচকে বলে, ‘কি?’

শ্রাবণ বলে, ” ভাইয়া বলো তো, চিকেন ফ্রাই করার আগে মুরগীকে হলুদ-মশলা দিয়ে মাখানো হয় কেন?”

সমুদ্র ভ্রু কুচকে রেখেই বলে, ” আমি কীভাবে জানবো?”

তার উত্তর শোনার আগেই সব কাজিন হলুদ নিয়ে তার উপর হামলে পড়ে৷ মুখে, হাতে, পায়ে, মাথায় এমন কোনো জায়গা নাই যেখানে হলুদ মাখায়নি তারা।এতো দ্রুত এমন আক্রমণে সমুদ্রর তাল ছু’টে যায়। সে তটস্থ হতে পারে না। তাকে হলুদ দিয়ে পুরা মাখামাখি করে ফেলার পর শ্রাবণ জবাব দিলো, ” হলুদ দিয়ে ম্যারিনেট করলে স্বাদ বাড়ে বুঝলে ভাই, খাওয়ার সময় টেস্ট বেশি লাগে। এইজন্য তোমাকে হলুদ দিয়ে ম্যারিনেট করে দিলাম। যেন তোমারও টে–স্ট বাড়ে।”

সমুদ্র শ্রাবণের কাঁধে কিল মেরর বলে, ” বেয়াদব কোথাকার! ”

এবার শ্রাবণ বলে, ” ভাইয়া কিছু দাও আমাদের। তোমার বিয়ে বলে কথা। মজা করবো না আমরা?”

–” আমি কিছু দিতে পারবো নাহ। ”

শ্রাবণ আর পিউ একসঙ্গে বলে উঠে, ” ভাইয়া আজকে রাতে ব্যাচেলর পার্টি করি ছাদে প্লিজ? প্লিজ?”

সমুদ্র এ,” নো, নো নেভার।এইসব হবে না।”

পিউ খুব নম্র সুরে বলে উঠে, ” ভাইয়া আলিয়াও রাজী। আমরা অনেক এক্সাইটেড।”

শ্রাবণ প্রশ্ন করে, ” আলিয়া কে রে? ”

পিউ বলে, ” কোনো মেয়ের নাম শুনলেই ডিটেইলস জানা লাগবে?”

শ্রাবণ বলে, ” কতো বললাম তোর একটা বান্ধবীকে পটায় দে। দিলি না। গার্লফ্রেন্ড থাকলে মোটেও অন্য মেয়েদের পাত্তা দিতাম না।”

পিউ সমুদ্রেকে বলে, ” ভাবীরও সমস্যা নেই যদি তুমি রাজী থাকো। ”

সমুদ্র বুঝলো ওরা আগে থেকেই প্লান করে রেখেছে। সে রাজী হলো না। কিন্তু তার কাজিন-বোন সবগুলো খুব নাটকবাজ। কানের সামনে ঘ্যানঘ্যান করতেই থাকলো। ওদের এক কথা, ভাইয়া রাজী নাহলে আজ ভাইয়াকে শাওয়ার নিতে রুমে যেতেই দিবে না। এভাবেই রাখবে। মিসেস রোদেলা আসলেন একবার। সমুদ্র সঙ্গে সঙ্গে অভিযোগ করে বলে, ” আম্মু দেখো! ওরা এসব কি করছে আমার সঙ্গে? এখন আবার পার্টি চায়। নাহলে ছাড়বে না আমাকে।”

মিসেস রোদেলা বলে, ” আমি এসবে নাই। তোদের যা ইচ্ছা কর। আমার একমাত্র ছেলের বিয়ে। আমার কোনো কিছু তেই বাঁধা নেই।”

সমুদ্রের আম্মুর এমন কথায় ওরা আরোও লাই পায়৷
আসলেই তাই সমুদ্রকে উঠতে দেয় না। এদিকে এতো বেশি হলুদ গায়ে মাখিয়েছে যে পুরা শরীর কুটকুট করছে৷ এমনকি মুখেও কাঁচা হলুদের স্বাদ পাচ্ছে সে। উপায় না পেয়ে রাজী হয়ে যায় সে। এরপর শাওয়ার করতে প্রায় দৌঁড়ে রুমে ঢুকে সমুদ্র। রুমের দরজা ভেতর থেকে লাগিয়ে দেয়। তিনবার শ্যাম্পু-সাবান লাগিয়ে গোসল সেড়ে সাদা ফর্মাল শার্ট পড়ে বের হয় সে। তিনবার সাবান মাখার পরও মনে হচ্ছে, তার গা দিয়ে হলুদের গন্ধ এখনো যায়নি। মিররে নিজের চেহারা দেখে মনে হলো গালে-কপালে এখনো হলদে ভাবটা যায় নি৷ কি একটা অবস্থা!

সে না খেয়েই মিটিংয়ের উদ্দেশ্য বের হলো। মিটিং শব্দটা দিয়ে আসলে অসভ্যতাকে ঢেকে দিচ্ছে সে। আসলে কিছু বড় পার্টির নেতা, বিজনেজ ম্যানকে নিয়ে একটা ছোট-খাটো বিনোদন আসরের ব্যবহার করেছে। এই পার্টিতে সে ডকুমেন্টস নিয়ে যাচ্ছে। তবে আজকেই চতুর্থতম প্রোজেক্টের ডিলে সাইন করায় আনবে। পার্টি অবশ্য দুপুর থেকে সারারাত চলবে। সে সন্ধ্যায় চলে আসবে। সমুদ্র গুলশানের একটা বাসার ভেতরে ঢুকলো। বাসার ভেতরে প্রবেশ করতেই কেমন ঝাঁঝালো তেতো গন্ধ নাকে আসে বাড়ি খায়। এই গন্ধের সঙ্গে সমুদ্র পরিচিত। পার্টি শুরু হয়ে গেছে৷ সে এগিয়ে এসে বলে, ” কেমন আছেন রুহুল ভাই?”

–” ভালো।”

–” খেয়েছেন ঠিকঠাক? ”

রুহুল সাহেব বলে, ” এতো আয়োজন করেছো তোমরা? অনেক খেলাম৷ আমি আর খেতে পারবো না।”

সমুদ্র হেসে বলে, ” আসল আয়োজন তো বাকিই আছে। রাতের জন্য অপেক্ষা করুন।”

বিজনেজ ম্যানস ও নেতা সহ সাত-আট জন মানুষ বসে আছে। সমুদ্র সহ আরোও তিনজন কোম্পানির মালিক এই পার্টির আয়োজক৷ লাখের বেশি খরচ করেছে সমুদ্র এদের পিছে। শুধুমাত্র এদের মন রাখার জন্য। যেন কাজে কোনো ঝামেলা না করে। ওনারা খুশি থাকলে দু’টো-তিনটে প্রোজেক্ট ভবিষ্যতে আরোও পাবে৷ ইদানীং প্রায়ই ওনাদের গিফট দেওয়া হচ্ছে৷

সমুদ্র রুহুল সাহেবের পাশে বসে বললো, ” সাইনটা এখনই করে ফেলেন?”

–” আরেকটু দেখি। কেমন আয়োজন করেছো তোমরা।”

–” আয়োজন পছন্দ নাহলে ডিল সাইন করবেন না?”

উনি ভারী জোরে হাসলো। সমুদ্র বিরক্ত হলেও প্রকাশ করলো না। পরক্ষণেই মনে হলো সে তো পাকাপোক্ত ভাবে ব্যবসায়ী হয়ে যাচ্ছে। ম– দের নেশার চেয়েও তার কাছে ডিল-প্রোজেক্ট, টাকা বেশি ম্যাটার করে।

ওই মুহূর্তে ফ্ল্যাটের ভেতর ছয়জন সুন্দরী নারী প্রবেশ করে। উপস্থিত সবার মুখে হাসি ফুটে উঠেছে ওদেরকে প্রবেশ করতে দেখে। সমুদ্র তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে রুহুল সাহেবের দিকে তাকায়। রুহুল সাহেব খুব বিশ্রীভাবে হেসে বলে, ” এখন সিগনেচার দেওয়াই যায়।”

মেয়েগুলোর রুপ আছে বলাই যায়। সমুদ্রও একবার তাকালো। সুশীল ভদ্র সমাজ এ ওদের ডাকা হয় আই//টেম গা– র্ল আর বাংলা পরিশুদ্ধ ভাষায় হয়তোবা নর্ত & কী বা আরোও অন্যকিছু! দুপুরে বেশ জমপেশ খাওয়া-দাওয়া হলো। সমুদ্রও খেলো। খাবেই বা না কেন? কয়েক লাখ টাকা ব্যয় করেছে এসবের পিছে। বিকেলের দিক থেকে একটা মেয়ে বারবার তাকে অফার দিচ্ছে। সে বুঝতে পারছে এই আড্ডায় সবচেয়ে সুদর্শন সে-ই বোধহয়। পার্টি তখন বেশ জমজমাট। নে%শা কঠিন হতে লাগে৷ গানের ভলিউম বাড়তে থাকে। তার হাতেও ড্রিংকস এর গ্লাস।

সমুদ্রের মাথাব্যথা করতে শুরু করলো হঠাৎ। সে উঠে বারান্দায় যেতে লাগলে, একজন রমণীর সঙ্গে ধাক্কা লেগে শার্টে ম%দ্যপা–নীয় গায়ে এসে লাগে। সে ভীষণ রেগে উঠে কটমট করে তাকায়৷

রমণী বললো, “পরিষ্কার করে দিই নিজ হাতে?”

–” দিন।”

রমণী নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে সমুদ্রের শার্টে ঘষামাজা শুরু করে। ওর কেমন জানি লাগলো। নিশ্বাস গরম হতে লাগলো। মেয়েটা আবেদনময়ী, লাস্যময়ী হয়ে তার দিকে অগ্রসর হতে থাকে৷ বেশ খানিকটা নিকটে এসে দাঁড়ায়। চোখে-মুখে অন্যকিছু, অপবিত্র ইচ্ছা খেলে যাচ্ছে মেয়েটার নজরে। সমুদ্র দাঁড়িয়ে থাকে৷ মেয়েটার হাত আস্তে আস্তে ওর শার্টের বোতামের আশেপাশে ঘুরাঘুরি করে, তবুও থামায় না সে। তবে যখন একটা শার্টের বোতাম খুলে নেয়, সে এক ঝটকায় মেয়েটার হাত সরিয়ে দিয়ে ধাক্কা দেয় মেয়েটাকে। তাদের দিকে কারো নজর নেই। যে যার মতো ব্যস্ত। সমুদ্র বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। ফোনে তখনই নোটিফিকেশন এসে ভীড় জমালো। সে ফোন অন করতেই দেখলো আয়নার ছবি তাকে পাঠানো হয়েছে৷ আয়নার পরনে কাঁচা হলুদ রঙের শাড়ি। গালে হলুদ লাগানো। একটু আগের ছবি নিশ্চয়ই। সমুদ্রের হলুদ ছোঁয়া শেষ হওয়ার পর কণের হলুদ ছোঁয়া শুরু হয়েছে। দুটো ছবি দেওয়া হয়েছে। সে একদৃষ্টিতে ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। তখনই পেছনে থেকে খুব নরম একটা ছোঁয়া অনুভব করে সে। সঙ্গে সঙ্গে শিরদাঁড়া দাঁড়িয়ে যায় তার। মেরুদণ্ড অব্দি কম্পিত হয়। সে ফোনের ছবিটার দিকে তাকিয়ে থেকে নির্জীব কণ্ঠে বলে, ” একটু আগেই আমার গায়ে হলুদ ছোঁয়ানো হয়েছে। এখন এই শরীরে কেবল আমার স্ত্রীর অধিকার থাকবে। ও ছাড়া আর কেউ আমাকে ভুল করেও ছু’য়ে দেখুক আমি তা চাই না।”

চলবে।