ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব-৮+৯+১০

0
288

#ইলেকট্রিক্যাল_মন
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–8

গতানুগতিকভাবে সময় দৌঁড়াচ্ছিলো। সময় আটকে রাখার সুযোগ নেই কারো। সেকেন্ড পেরিয়ে মিনিট, এবং মিনিট পেরিয়ে ঘণ্টা পাড় হলো। সন্ধ্যার আগেই নিজের বাসার উদ্দেশ্য সমুদ্র বের হয়। তার উচিত ছিলো আরোও একঘন্টা আগে বের হওয়া কিন্তু সেটা নানান ফ্যাসাদে সম্ভব হয়নি। ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে ওলরেডি সাড়ে ছয়টা বাজতে চলেছে। বিকেল থেকেই নাকি মেহেদীর অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। তার ইতিমধ্যেই বেশ ক্লান্ত লাগছে৷ মনে হচ্ছে একটু ঘুমিয়ে নিতে পারলে বেশ আরাম বোধ করত। আহা কতোদিন ধরে শান্তিমতো ঘুমায় না সে। রোডের সম্মুখে বাঁক নিতে নিতে হতাশাভরা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে।

চোখ হঠাৎ করে জ্বালাপোড়া শুরু করে। চোখের সঙ্গে মনের কানেকশন দৃঢ়। যা মন দেখতে চায়, তা দু’চোখ খুঁজে বেড়ায়– কে জানি বলেছিলো কথাটা! সম্ভবত কোনো দার্শনিক হবে বোধহয়। তাহলে কী চোখ জ্বালাপোড়ার অর্থ মন পোড়া? সে ভাবলো, আগামীকাল তার বিয়ে। আর চব্বিশঘণ্টাও বাকি নেই। সে কী পারবে সবকিছু সামলিয়ে উঠতে?কখনো হাপিয়ে গেলে? বিয়ের করার সিদ্ধান্ত কি তবে ভুল?নতুন করে জীবন গুছাতে গিয়ে কোনোরকমে ভুল করলে এর খেসারত কীভাবে দিবে? নিজের মনের সন্দিহান ভাবনাগুলো কার সাথে শেয়ার করবে? সে নিজেই পরিবারের সবার বড়। ফোঁস করে শ্বাস ফেলতেই তার মনে হলাও, তার একসময়কার বেস্টফ্রেন্ড নীলার সঙ্গে কথা বলা যায়। কিন্তু নীলা নিজেই এখন প্রেগ্ন্যাসির লাস্ট মান্থ এ আছে। তবুও গাড়ি একসাইডে পার্ক করে নীলাকে কল লাগালো। বাসায় কারো সাথে কথা বলার ও পরিবেশ নেই, এতো হৈচৈ চলছে!

তিনবার কল হতেই নীলা ফোন ধরলো। সে ওপাশ থেকে এক্সাইটমেন্ট নিয়ে বললো, ” দোস্ত, কংগ্রাচুলেশনস। সর‍্যি রে, তোর বিয়েতে এটেন্ড করতে পারছি না। তবে তোর ভাগ্নি নিয়ে একদম নতুন বউয়ের মুখদর্শন করবো।”

সমুদ্র বেশ নিস্তেজ গলায় বলে, ” দোস্ত, আমি একদম পাজেলড হয়ে আছি রে। কি করলাম, কি করব, কেমনে মানবো কিছুই মাথায় কাজ করছে না৷ ঝোঁক-জেদের বশে, বাবা-মায়ের জন্য মায়া থেকে কীভাবে যে রাজী হয়ে গেলাম। এখন মনে হচ্ছে ভুল করছি কীনা!”

ওপ্রান্ত থেকে নীলা একপ্রকার ঝগড়াটে কণ্ঠে গা–লি দিয়ে খুব জোড়ে জোড়ে ধমক দিয়ে বলে, ” তোর মাথা ঠিক আছে? রাত পাড় হলেই তোর বিয়ে। বেয়াদব! এখন এইসব মাথায় আনছিস ক্যান?”

সমুদ্র ক্লান্ত সুরে বলে, ” হুট করে এখন মনে হচ্ছে, আমি যদি না পারি? কনফিউজড লাগছে খুব। আগের কথাও মনে পড়ছে খুব।”

নীলা আরেকটা ভয়ংকর গা–লি দিয়ে বলে, তোর সমস্যা কিরে? ভালো একটা মেয়ের সাথে বিয়ে হচ্ছে, সুখে থাকার চেষ্টা কর।”

–” নীলা দোস্ত, তুই আমার পরিস্থিতি বুঝতে পারছিস না।”

–” এক বছরের বেশি হয়ে গেছে বা৷/)ল। এখনো তুই মুভ অন করিস নাই? ছাগল নাকি!”

–” বিষয়টি মুভ অন করার সাথে সম্পর্কিত নাহ। একচুয়ালি, প্রথমে তো আমি বিয়ের জন্য রাজীই ছিলাম না। বাসায় এসব নিয়ে প্রচুর গ্যাঞ্জাম করতাম৷ পরে ওদের এনগেজমেন্টের ছবি দেখে একপ্রকার জেদ, প্রচুর ইগো কারণে বিয়েতে রাজী হয়ে যাই।”

–” তুই বলতে কী চাস?”

–” সায়নের সঙ্গে দুইদিন আগে কথা হলো। ওদের এনগেজমেন্ট ভেঙে গেছে৷”

–” ভালোই হইছে৷”

সমুদ্র ফোঁস করে দম ফেললো। নীলা তাকে বুঝবে না। ঘুরেফিরে তাকেই দোষারোপ করবে, দরকার হলে গা–লি-গালাজ করবে। সে খট করে মুখের উপর কল কেটে দেয়৷

সমুদ্র কী করবে? এতোদিন ধরে অপেক্ষায় ছিলো সে! ওর বিয়ে হলে, পরে নিজে বিয়ে করবে৷ কিন্তু ও কেন হুট করে বিয়ে ভেঙে দিলো তাও তার বিয়ের ঠিক ক’টা দিন আগেই? ওর বিয়ে ভাঙ্গন কী কোনোভাবে তার আকদ এর সঙ্গে সম্পর্কিত? নানারকম উদ্ভট চিন্তার সমাপ্তির পর সে সিদ্ধান্ত নিলো ওর সাথে একবার কথা বলা দরকার। নাহলে সে সে নিশ্বাস নিয়েও শান্তি পাবে না। সে ফোন থেকে সরাসরি নাম্বারে কল লাগায়। একবার, দুইবার, তিনবার কল হতেই ওপাশ থেকে মেয়েলি সুরে কেউ কথা বলে উঠে। এই কণ্ঠস্বর সমুদ্রের পরিচিত। অনেক বেশি পরিচিত!

সমুদ্র বলে উঠে, “কেমন আছো?”

একটু পর ওপাশ থেকে কাঙ্ক্ষীত ব্যক্তি ইংরেজিতে বললো, ” ভালো। কংগ্রাচুলেশনস।”

সমুদ্র চুপ থেকে একটা দম ফেলে বললো, ” অস্টিন স্যারের সঙ্গে সম্পর্ক ভাঙ্গলে কেন?”

মেয়েটা খুব সুন্দর স্পষ্ট উচ্চারণে বলে, ” হি ইজ নট মাই টাইপ! আমি অন্যরকম কাউকে চাই।”

–” সামওয়ান লাইক মি?”

–” মেবি, কেয়ারিং লাইক ইউ!”

–” আমি কেয়ারিং ছিলাম?”

–” ইয়েস।”

–” স্টিল আমাকেও ছেড়ে দিলে।”

–” ইউ নো দ্যা রিজন সমুদ্র।”

–” না, সেটা মেইন রিজন ছিলো না।”

–” বাদ দাও।”

–” দিলাম।”

মেয়েটা ফোন কাটতে ধরলো, তার আগেই সমুদ্র ধমকের সুরে বলে, ” আমার কথা শেষ হয়নি। ভুলেও ফোন কেটে দিবে না।”

–” আর কি বলার আছে?”

সমুদ্র নিজেকে ধাতস্থ করে নেয়। মন যা বলতে চাচ্ছে তা মুখে আসতেই ব্রেইন বাঁধা দিচ্ছে। কিন্তু আজ এ বিষাক্ত লগ্নে বুঝি মনের জোড় বেশি ছিলো। সে অনেকদিনের চাপা আর্তনাদপূর্ণ ইচ্ছার কথা বলে দিলো।

–” আমার কাছে ফিরে আসতে চাও? আগের সবকিছু ভুলে যেতে কোনো সমস্যা নেই আমার। যা হয়েছে সেটা অতীত। অতীত টেনে আনবো না কখনো। তুমি রাজী থাকলে সব ফেলে অস্ট্রেলিয়া চলে আসবো।”

ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে দু’দন্ড নিরবতা রইল, এরপর তাচ্ছিল্যপূর্ণ অট্টহাসির শব্দ কানে আসতেই সমুদ্রর কান গরম হতে লাগলো।

মেয়েটা বলে উঠে, ” আর ইউ ইনসেন? সমুদ্র, তুমি এখনো সেই আগের মতো ট্রিপিক্যাল রয়ে গেছো।”

তাকে আর কিছু না বলার সুযোগ দিয়ে মেয়েটা ফোন কেটে দিলো। সমুদ্র ঠায় ফোন কানে নিয়ে বসে থাকলো। আচমকা তার ফোনে নোটিফিকেশনের শব্দ ভেসে আসে। সে স্কাইপি অন করতেই একটা ছবি চোখে পড়লো। তার প্রাক্তন প্রেমিকার অন্য আরেকজনের সঙ্গে বেশ কাছাকাছি থাকা অবস্থায় ব্যক্তিগত একখানা সুন্দর ছবি। সমুদ্রের মাথায় ঠিক মাঝ বরাবর তীব্র পীড়া শুরু হলো। খুব অসহ্যনীয় লাগলো তার কাছে! হুট করে চোখের কোণে একবিন্দু জল এসে বিনা নিমন্ত্রণে উপস্থিত হলো। আর কতোভাবে নিয়তি তাকে উপহাস উপহার দিবে? আর কতো ছোটো হতে হবে তাকে? ভাগ্য কেন বারবার তার উপর হাসে!

সে সীটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। নাহ এভাবে চলবে না। তাকে শক্ত হতে হবে৷ অনেক শক্ত। এতো শক্ত মনের হতে হবে যেন কোনোকিছুতেই আর প্রভাবিত না হতে পারে! খুব করে রসায়নের দর্শক আয়ন হতে মন চাচ্ছে৷ কতো বিক্রিয়ায় চালাও না কেন, কতো তাপমাত্রা বাড়াবে বাড়াও, কতো চাপ দিবে দেও, তবুও আমি কোনোধরনের আবেগীয় কার্যধারায় অংশগ্রহন করবো নাহ। একদম ইমোশনলেস যন্ত্র হতে হবে। খোদা, মনটাকে পাথর বানিয়ে দিলে খুব ক্ষতি হতো? এতোদিন বহুবার সে মন থেকে চেয়েছে ওকে ভুলে যেতে কিন্তু সক্ষম হয়নি৷ কিন্তু আজ বুঝি সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এলো, যেদিন সমুদ্র নিজ থেকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো আর কোনোদিনও ওর কথা মাথায় আনবে না। সেন্ড করা ছবিটা দেখবার পর থেকে মাথায় কেমন পাগলা খ্যাপাটে জেদ চেপে বসে। তাকেও অন্যকারো সাথে জড়াতে হবে। সেও দেখিয়ে দিবে সে ফেলনা না। তারও লাইফে সে অন্যকোনো মেয়েকে জড়াতেই পারে। ওর সংসারের চেয়েও সুখের সংসার তার চাই!

বাসায় যখন সমুদ্র পৌঁছে তখন সাতটার বেশি বাজে৷ মিসেস রোদেলা মুরুব্বি মেহমানদের নিয়ে গল্প-আলাপে ব্যস্ত। সমুদ্র কে দেখেই তার কেমন অগোছালো, এলোমেলো লাগলো। মা সে তার! চোখ দেখেই বুঝে ছেলে-মেয়ের কিছু হয়েছে কিনা! সে উৎকণ্ঠাবোধ করতে লাগলেন৷

সমুদ্র তাকে দেখে এগিয়ে এসে, নিজেকে স্বাভাবিক রেখে এমনভাবে কথা বললো যেন একটু আগে কিছু ই হয়নি।

সে বললো, ” আম্মু এক কাপ কড়া লিকারের চা দাও। দুধ চা দিবে সাথে চিনি দুই চামচ।”

মিসেস রোদেলা চোখ বড় করে তাকালেন ছেলের দিকে। ছেলের চোখ-মুখ দেখে তার মন বলছে,নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে৷ কিন্তু কথা বলার ভঙ্গি খুব নর্মাল। আদৌ কী নর্মাল?

মিসেস রোদেলা বলে উঠে, ” মেহেদীর অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। তুই মাত্র বাসায় এলি। ওখানে যেতে হবে। দেরি হয়ে যাচ্ছে না?”

সমুদ্র খুব সুন্দর করে হাসলো, এরপরে বলে উঠে, ” মেহেদীর আয়োজন যার জন্য চলছে, সে উপস্থিত আছেই। মেয়েরা সব আছে না ওখানে? আমি পুরুষ মানুষ, আমার এমনি ওখানে কাজ নেই। লেইট হলেও সমস্যা নেই। ”

এরপর একটু ঝুঁকে মায়ের কাছটায় ছড়িয়ে থাকা ডেকোরেশনের অপ্রয়োজনীয় জিনিস সরিয়ে দিলো। মিসেস রোদেলা সামান্য নড়চড় করলেই এসব জিনিস পত্রের কোণা এসে তার গায়ে বিঁধছিলো।কিন্তু গল্পে মশগুল থাকায় ওগুলো সরান নি আর। তার ছেলে এতোকিছু দেখে কখন? দু’মিনিট ও হয়নি এখানটায় এসে দাঁড়িয়েছে। তাতেই চোখ পড়লো যে মায়ের বসতে অসুবিধা হচ্ছে। মিসেস রোদেলা না পারতে এখানটায় বসেছেন। সব গেস্টরা বসে আছে। সে বরের মা হয়ে অন্যকোথাও থাকলে ব্যাপারটা ভালো দেখায় না৷ বসার আর অতিরিক্ত জায়গাও ফাঁকা ছিলো না।

সমুদ্র রুমে এসে শাওয়ার নিলো। শাওয়ার না নিলে মাথাব্যথা যাবে না। বাসার পরিবেশ এতো বেশি তার প্রতিকূলে, ওই বাড়ি না গেলে, অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত থাকলে, এ বাসায় ঝড় যাবে। সে ঝামেলা চাচ্ছে না৷ কার জন্য ই বা ঝামেলা করবে? এখন আর এতো এনার্জিও নেই।

শাওয়ার নিয়ে খালিগায়েই একটা মেডিসিন খেয়ে নিও। খুব কাজের ঔষধ। এই মেডিসিন সেবনে নার্ভ রিলিফ থাকে। দুশ্চিন্তা কমে। আস্তে আস্তে মাথাব্যথা ও কমবে৷ তখনই মা রুমে আসলেন চা হাতে।

সমুদ্র বলে, ” ভিতরে আসো।”

মিসেস রোদেলা চা টেবিলে রেখে ছেলের চুল টাওয়াল দিয়ে মুছে দিয়ে বলে, ” বাবু, আলমারিতে পাঞ্জাবি রাখা আছে। রেডি হো তাড়াতাড়ি। আর ড্রাইভার নিয়ে যাবি। একা ড্রাইভ করে যেতে হবে না।”

–” বড় হয়ে গেলাম, বিয়ে দিয়ে দিচ্ছো তাও বাবু বলে ডাকা অফ করবে না?”

–” সারাজীবন বাবু বলেই ডাকবো। আমার নাতি-নাতনীদের সামনেও তোকে বাবু বলে ডাকব দেখিস! ”

সমুদ্র চায়ে চুমুক দিয়ে বললো, ” তাহলে নাতি-নাতনীদের কি বলে ডাকবা আম্মু?”

মিসেস রোদেলা একটু ভাবুক হয়ে বললো, ” বাবু জুনিয়র।”

সমুদ্র হেসে বলে, “ফানি।”

সমুদ্র আয়েসি ভঙ্গিতে চা খাচ্ছিলো। মিসেস রোদেলার কেন যেন মনে হলো ছেলের মধ্যে তাড়া নেই যাওয়ার। দেরি কেন না গেলেও ওর মধ্যে ব্যাকুলতা নেই।

–” কিছু কি হয়েছে?”

–” ক্লান্ত লাগছে মা। খুব ঘুমাতে মন চাচ্ছে।”

–” অনুষ্ঠান থেকে ফিরে এসে ইচ্ছামতো ঘুমাস। দরকার হলে আগামীকাল দুপুর অব্দি ঘুমিয়ে তারপর বরযাত্রী নিয়ে যাস।”

সমুদ্র জানে সে যতোই টাল-বাহানা ও অযুহাত বানিয়ে ফেলুক না কেন, মা তাকে পাঠাবেই। লাভ নেই কোনোকিছু বলেও।

মিসেস রোদেলা নিজ গরজেই পাঞ্জাবি বের করলেন।
সমুদ্র বলে, ” পাঞ্জাবিও পড়তে হবে?”

–” অবশ্যই।”

অগত্যা রেডি হয়ে এসে সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল সেটিংস করলো। মা তখন রুমে কি যেন খুঁজছেন। সে পারফিউম মাখতে গিয়ে পারফিউমের ব্রান্ড ও ফ্লেভার দেখে নেয়। ওর পছন্দের পারফিউম ছিলো এটা। এরপরে প্রয়োজনের অতিরিক্ত গায়ে মেখে হাত থেকে ফেলে দেয় পারফিউমটা৷ সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে চুরমার হয়ে যায় বোতলখানা৷

মিসেস রোদেলা বলে, ” কি হলো?”

–” ভুলে হাত থেকে পরে গেছে৷ সর‍্যি।”

সে ফিরে এসে ছেলের হাতে সেদিনকার এনগেজমেন্ট রিং পরিয়ে দিলেন। সমুদ্রর একটু হাত কাঁপলো। ওইদিন বাসায় এসেই এটা খুলে রেখেছিলো। আবার পরানোর কি দরকার ছিলো? ড্রয়ারে রেখেছিল যেন কেউ না দেখে। মা তবে এটাই খুঁজছিলো!

সমুদ্র বের হয়ে গাড়িতে উঠেই সবার আগে রিংটা খুলে পকেটে ঢুকালো। এরপর ফোন হাতে নিতেই দেখে, অনেকগুলো মিসড কল এসেছে। পিউ-শ্রাবনের। অথচ সে টের পায় নি। ফোন সাইলেন্টে ছিলো বুঝি! খেয়ালও নেই তার।

অবশ্য জীবনের যে পর্যায়ে সুখ স্বয়ং সাইলেন্ট অবস্থায় আছে, সেখানে ফোন সাইলেন্ট থাকবার খোঁজ রাখা কেবলই নিজের সঙ্গে মশকরা বৈকি কিছুই নাহ!

______________

রাত সাড়ে আটটারও বেশি বাজছিলো৷ আয়নার হাতে তখন মেহেদী লাগানো হচ্ছে। হাতের তালুর দিকে মেহেদী পড়ানো প্রায় শেষের দিকে। গেস্ট মোটামুটি সবাই এসে যাচ্ছে। কিন্তু আয়না একটু অস্থির চিত্তে৷ ছাদের সদর দরজার দিকে তাকিয়ে আছে৷সমুদ্র আসছেন না কেন এখনও? দেরি কেন করছেন উনি? সে একাই চিন্তিত না। সমুদ্রের বোন পিউকেও খুব আপসেট দেখাচ্ছে। সব আত্মীয়রা প্রশ্ন করছেন কেন ছেলে এখনো আসেনি! কোনো সমস্যা কীনা! তাদের কাছে উত্তর নেই। ফোনও ধরেনি যে আপডেট পাওয়া যাবে৷

আয়নার পিউয়ের জন্য মায়া লাগলো। মেয়েটার হাবভাব এমন যে বড়ভাই দেরি করায় সব দায় যেন ওর। আয়নার মনে হয়, সমুদ্র আর পিউ নিজের ভাই-বোন না। হতেই পারে না। ইন ফ্যাক্ট, সমুদ্র এই পরিবারের ছেলেই না। ওকে নিশ্চয়ই ব্রীজের সামন থেকে কুড়িয়ে এনেছে। নাহলে এতো মিষ্টি একটা ফ্যামিলির ছেলে এতো তেতো কেন? সুইট বোনের বিটার ভাই কেন?

ঠিক তখনই শোরগোল শোনা গেলো। শোরগোলের উৎস খুঁজতে গিয়ে আয়নার সদর দরজার সামনে চোখ গেলো। সমুদ্র এসেছে৷ হাতে ফুলের তোড়া সমেত এসেছেন জনাব। কিন্তু আয়নার ওর চোখের দিকে তাকাতেই খটকা লাগে৷ কেমন নীলচে মনির চোখ দু’টো লাল লাল আভা ছড়াচ্ছে।রেগে আছেন নাকি?

তাকে ঘিরেই জটলা। আয়না চোখ ফিরিয়ে নিলো।

সমুদ্র তখন পিউ আর আলিয়ার সঙ্গে কথা বলছিলো। আলিয়া বলে, ” ভাইয়া, আপনার জন্য সেই বিকেল থেকেই অপেক্ষায় আছি।”

— “দেরি হয়ে গেলো। দুপুরে মিটিং ছিল। আসার পথে এতো জ্যাম৷ কিছু করার ছিলো না।”

আলিয়া বলে, ” বুঝতে পেরেছি ভাইয়া। ইদানীং খুব জ্যাম রাস্তায়।”

সমুদ্র এগিয়ে যায় আয়নার দিকে। ঢাকা শহরে থাকার একটা সুবিধা হলো কোথাও দেরি করলে রাস্তার জ্যামকে দায়ী করে পাড় হওয়া খুব সহজ। আয়নার পানে একবার তাকালো সে। তার কিনে দেওয়া লেহেঙ্গাটাই পড়েছে। বেশ মানিয়েছেও তাকে। দুইহাত ভর্তি মেহেদী দিয়ে বসে আছে। চোখ নিচের দিকে। সে এগিয়ে এসে ফুলের ব্যুকেটা তার সামনে রাখলো। লালচে খয়েরী গোলাপের ব্যুকে এনেছে সমুদ্র। ওখান থেকে একটা লাল গোলাপ টেনে বের করে আয়নাকে দিলো৷ আয়না হতভম্ব হয়ে তার দিকে চোখ তুলে তাকায়। সে কি ভুল দেখছে? সমুদ্র তাকে ফুল দিচ্ছে! এ আদৌও সম্ভব?

সমুদ্র বললো, ” বেশি লেইট করে ফেললাম নাকি?”

মেহেদী পড়া হাতে আয়না আলতো করে গোলাপ হাতে নেয়। মুখে কিছু বললো না।

সে পুনরায় বললো,” একটু প্রবলেমে আটকা পড়েছিলাম। হোপ সো ইউ উইল আন্ডারস্ট্যান্ড!”

মেহেদী আর্টস্ট বলে, ” ভাইয়া আপনি দেখছি দারুণ রোমান্টিক। দেরি করেছেন জন্য সর‍্যি গিফটও এনেছেন। বাহ! বাহ!”

আয়না তখন সমুদ্রের দিকে তাকালো। দুইজন দুইজনের দিকে তাকিয়ে থাকে দু’ মাইক্রো সেকেন্ড। আর্টিস্ট মেয়েটা বুঝলো মেহেদী দেওয়া হাতে ফুল ধরতে আয়নার অসুবিধা হচ্ছে।

তাই সে বলে উঠে, ” ভাইয়া এতো যত্ন করে ফুল দিয়েছে৷ আপু আপনি চুলে গুঁজে নেন গোলাপটা। দারুণ মানাবে আপনাকে। আপনার লেহেঙ্গার সঙ্গে ফুলটা যাবেও সেই রকম।”

আয়নার বাম কানের সাইডে খোপার সঙ্গে লাল গোলাপ বেঁধে দেওয়া হলো। গর্জিয়াস লেহেঙ্গার সঙ্গে আয়না একদম কোনো জুয়েলারি পরেনি। কাজেই ফুল গুঁজে দেওয়ায় যেন ষোলা আনা পূর্ণ হলো। সমুদ্র একধ্যানে তাকিয়ে থাকে।

আলিয়া সেটা দূর থেকে লক্ষ্য করে বলে উঠে, ” ভাইয়া জানি আপা অনেক সুন্দরী। তাই বলে ফুলটাইম আপার দিকে তাকিয়েই থাকা লাগবে?”

সমুদ্র একটু নড়েচড়ে উঠলো, এরপর বললো, ” আমি আসছিই তো তোমার বোনকে দেখতে।মেহেদী পড়ছো তোমরা। আমার আর কী কাজ আছে?”

আলিয়াসহ বাকি সবাই বললো, ” ভাইয়া আপনিও মেহেদী পড়েন তাহলে। ”

সমুদ্র মুখ বাকিয়ে বলে, ” এই হোপ, ছেলেরা আবার মেহেদী পড়ে নাকি?”

মেহেদি আর্টিস্ট বলে,” আপুর নামটা আপনার হাতে লিখে দেই ভাইয়া?”

সমুদ্র-আয়না দু’জনে পিলে চমকে উঠে। সমুদ্র মনে হয় মেহেদি পড়ার কথা শুনে ভয় পেয়ে গেলো। ওর ওমন চেহারা দেখে আয়নার হাসি পায় বেশ৷ সমুদ্র অশান্ত অবস্থায় হাতের আঙুলে মোচড়াতে লাগে৷ রিংটা খুলে ফেললেও পরে কোনো এক কারণে আবারও এ বাসায় আসার আগে পরে নিয়েছে৷

সমুদ্রকে পুনরায় জোড়াজোড়ি করা হয়। এবারে সে মুখ খুললো। বলে উঠে, ” হাতে নাম না লিখে মনে নামটা লিখে রাখলাম। প্লিজ হাতে মেহেদী না।”

আয়না তার এমন কথায় হাল্কা ভীমড়ি খায়। সমুদ্রের অবস্থা দেখে তারও মায়া হয়। বেচারা মেহেদী পড়ার ভয়ে কেমন চুপসে গেছে।

সে সমুদ্রকে ডিফেন্ড করে বলে, ” থাক তো। বাদ দাও। ওনার এসব মেয়ালি জিনিস পছন্দ না।”

মেহেদী আর্টিস্ট অনেক সময় নিয়ে আয়নার হাতে মেহেদী লাগিয়ে দিচ্ছিলো। হাতের মধ্যখানে সমুদ্র নামটাও লিখে দিলো। মেহেদী হাতে লাগানো শেষ করার নামও নেই আর্টিস্টদের মধ্যে । আয়নাও অতি আগ্রহী হয়ে বসে বসে মেহেদী লাগানো দেখছে। সমুদ্র নিজেই বিরক্ত হয়ে উঠে। সে মনে মনে ভাবে, মেয়েরা মেহেদী পড়ার সময় যতোটা ধৈর্য্যশীল থাকে, এমন ধৈর্য্যশীল হয়ে স্বামীর কথা শুনলে কোনোদিন কোনো দম্পতির মধ্যে ঝগড়াই হতো না।

এমন সময় ছাদে মিউমিউ শব্দের আওয়াজ পাওয়া যায়। বিড়ালের আওয়াজ শুনেই কান খাড়া হয়ে আসে৷ সমুদ্রের । আশেপাশে তাকাতেই দেখে তার দিকে একটা সাদা বিড়াল ছুটে আসছে। সে সঙ্গে সঙ্গে এক প্রকার লাফালাফির ভঙ্গিমায় চেয়ারে লাফ দিয়ে পা তুলে উঠে বসে বলে উঠে, ” ওহ গড! এইসব কী!”

মিউমিউ ডাক তুলে মিলি আয়নার কাছে এসে দাঁড়ায়। সমুদ্র সঙ্গে সঙ্গে বলে, ” এই! এই! না! যাও! এই বিড়াল কেন এখানে? আজব!”

আয়নাসহ মেয়ে পক্ষের সকলের মধ্যে চাপা উত্তেজনা। এই প্রথম কোনো বিয়ের ফাংশনে জামাইকে পা তুলে চেয়ারে উঠে চেচামেচি করতে দেখা যাচ্ছে৷

পিউ ছু’টে এসে বললো, ” বিড়াল কে এনেছে? ভাইয়া তো বিড়াল ভীষণ ভয় পায়। বিড়াল যেখানে ভাইয়া সেখানে যায়ই না। বিড়াল থেকে পালায় থাকে।”

চলবে৷

#ইলেকট্রিক্যাল_মন
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–9

আয়নার কোলে তখন মিলি আদুরে ভঙ্গিমায় বসে বসে লেজ নাড়াচ্ছে। মিলিকে অনুষ্ঠান উপলক্ষে একটা লাল রঙের বেবি ড্রেসও পড়ানো হয়েছে। সাদা গায়ে লাল জামায় কি অসম্ভব কিউট লাগছিলো মিলিকে৷ সবাই সুন্দর সুন্দর জামা পড়ে আসবে। মিলি কেন পড়বে না?

কিন্তু মিলিকে দৌঁড়ে আসতে দেখে, সমুদ্রের রিয়্যাকশন দেখবার মতো ছিলো। ওনার মতো ওমন রাশভারি, গাম্ভীর্যপূর্ণ মানুষটা বিড়াল দেখে এমন ভাবে লাফালাফি শুরু করবে কেউ ভাবতে পারবে কোনদিন? সমুদ্রের ভয়ে কাচুমাচু মুখ, প্লাস্টিকের চেয়ারের উপর দু’পা তুলে বসে অস্থিরচিত্তে মিলিকে দূরে যেতে বলা সবটা দেখে আয়না না হেসে পারলো না। সে খিলখিল করে হাসতে লাগলো। সমুদ্র মুখ তখন দেখার মতো হয়েছিল। মিলিটাও ভারী দুষ্টু একবার লাফ দিয়ে আয়নার কোলে আসছে, অপরদিকে আয়েসী ভঙ্গিমায় ঠিক সমুদ্রের চেয়ারের দিকে গিয়ে ঘুরে আসছে। যতোবারই মিলি ওনার দিকে আসছে,সমুদ্র পা গুটিয়ে বসে পড়ে আর মুখে বলে, ” এই বিড়ালটা এখানে কেন আসছে? যেতে বলো ওকে।আমার কাছে কেন আসছে? ”

সমুদ্রের কীর্তিকলাপ দেখে আয়নার হাসি থামে না। একটা মানুষ বিড়ালকেও ভয় পায়? হাস্যকর ব্যাপার!
একটু পর মিলিকে নিয়ে আলিয়া চলে যায়। সমুদ্রের যেন জানে পানি আসলো। সে চেয়ার থেকে পা ফ্লোরে নামিয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে, ” বিড়াল কে এনেছে এখানে?”

আয়না বললো, ” ও এখানেই থাকে।”

সমুদ্র বিড়ালটার ভাব-সাব দেখেই বুঝেছে ওটা কারো গৃহপালিত আদরের পেট। সে বললো, ” কার বিড়াল?”

–” আমার বিড়াল। ওর নাম মিলি।”

সমুদ্র যেন এবারে ফের অশান্ত অনুভব করলো। বিড়ালটা ফের যদি আয়নার কাছে এসে পড়ে? আবার বেইজ্জতি সে নিতে পারবে না৷ ওদিকে বিড়াল দেখলেই তার কেমন জানি লাগে! ইতিমধ্যেই আয়নার কাছে সে হাসির পাত্র বনে গেছে।

আয়নার হাতের মেহেদী দেওয়া শেষ তখন। এখন শুকানোর পালা। সমুদ্র চুপচাপ বসেই আছে৷ তবে সচেতন আছে হুট করে যদি আবার বিড়ালটা এসে তাকে কামড় মারে। কি এক জ্বালা! আর ভালো লাগে না। সে আয়নার পানে তাকালো। মেহেদী রাঙ্গা হাত দুটো মেলে বসে আছে। একটু পর পর মুখ দিয়ে ফুঁ দিয়ে মেহেদী শুকাচ্ছে। সমুদ্র উঠে দাড়াঁলো। তখন আয়না একবার তার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়। সমুদ্র জবাব না দিয়ে দ্রুত বেগে একটু সামনে এসে ছাদে সেট করে রাখা টেবিল ফ্যানটা আয়নার দিকে ঘুরিয়ে আনলো। ফলে ফ্যানের মিহি বাতাসে আয়নার গরম ভাব কমলো। বেশ স্বস্তি লাগে তার৷

সে বলে, ” ফ্যানের বাতাসে মেহেদী শুকাও।”

আয়না কিছু বললো না। তবে ফ্যানের সম্মুখ বরাবর হাত দুটো বেশ আনন্দের সঙ্গে এগিয়ে দেয়। টেবিল ফ্যানের বাতাসে তার চুল ওড়ে, অরগ্যাঞ্জা দোপাট্টা কাঁধ বেয়ে আজও হাতে এসে কাঁচা মেহেদীর উপর পড়তে ধরবে তার আগে সমুদ্র এসে ওড়না সরিয়ে দিয়ে বলে, ” ওড়নাটাই সামলাতে পারো না ঠিকঠাক, বিয়ের পর স্বামী-সংসার কীভাবে সামলাবে?”

আয়না তার দিকে একটু উঁচু হয়ে তাকালো, সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্র সটান হয়ে দাঁড়ালো। বেশ কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকলেন উনি যার ফলে সেই পরিচিত পারফিউমের সুঘ্রাণ নাকে এসে লাগলো। আজ কি উনি অন্যদিনের চেয়ে বেশি পারফিউম গায়ে মেখেছে? এতো তীব্র কেন ঘ্রাণটা?

এমন সময় ছাদের অনুষ্ঠানে শায়লা চৌধুরী এসে দাঁড়ালেন৷ আয়নার তাকে দেখামাত্র ভ্রু কুচকে আসে। সে হতবিহ্বল হয়ে শায়লা চৌধুরীকে দেখলো। মহিলাকে আজ বেশ সুন্দর লাগছে। ঘিয়ে রঙের একটা দামী জামদানী শাড়ি পরে এসেছেন। আচ্ছা উনি এসেছেন কেন? ওনাকে কেন বাবা দাওয়াত দিলো? ধ্যাত বাবার উপর বেশ রাগ হচ্ছে আয়নার। এখন সমুদ্র ওনার সম্পর্কে কিছু জানতে চাইলে সবটা ভেঙে বলতে পারবে না সে। তবে আজ একটা বিষ্ময়কর ঘটনা ঘটলো, আয়না যখন শায়লা চৌধুরীকে সমুদ্রের সামনে কি বলে পরিচয় দিবে সেটা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলো, সেই মুহূর্তে শায়লা তাদের দিকেই এগিয়ে আসে। এবং সমুদ্র তাকে দেখে খুব খুশি হলো বলে মনে হয়।

শায়লাকে জড়িয়ে ধরে খুব সুন্দর স্পষ্ট, পটু ইংলিশ একসেন্টে বলে উঠে, ” কেমন আছো? কতোদিন পর দেখা।” আরোও কিছু কথোপকথন হলো দুইজনের মধ্যে। আয়নার কানে শুধু বেজে উঠলো সমুদ্রের বলা একটা কথা– আই মিসড ইউ সো মাচ ।”

তবে ওনারা কি পূর্বপরিচিত? সমুদ্র কোনোভাবে শায়লা চৌধুরীর সঙ্গে কানেক্টেড!

শায়লা এবারে বলে উঠে সমুদ্র কে উদ্দেশ্য করে , ” আমার মনে হয় তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে হ্যান্ডসাম গ্রুম।” এরপর আয়নার দিকে তাকিয়ে বলে, “এবং আয়ু সবচেয়ে প্রিটিয়েস্ট ব্রাইড।”

সমুদ্র তার কথায় মুচকি হাসে শুধু। আয়না একপলক সমুদ্রের দিকে তাকায় আবার অপর পলক ফেলছে শায়লা চৌধুরীকে দেখে৷ সত্যি কথা বলতে, ওনাকে এই অনুষ্ঠানে দেখে আয়নার একদম ভালো লাগেনি। অবশ্য বিয়ে বাড়িতে মেহমান হিসেবে অনেক মানুষই আসবে এটা ভেবে নিজেকে বুঝ দিয়ে শান্ত থাকলো৷ আজকের মতো স্পেশাল দিনে কোনোরকম ঝামেলা কাম্য নয়৷

সেসময় ছাদের এ প্রান্তে আলিয়া-পিউকে আসতে দেখা গেলো। আলিয়াও শায়লাকে দেখে অবাক হয় তবে অভিব্যক্তিতে প্রকাশ ঘটে না৷ পিউ তাকে দেখে হাসিমুখে কথা বলতে লাগে৷

শায়লা চৌধুরী বলে উঠে, ” তোমাদের দুই’জনকেই বেশ সুন্দর লাগছে। ”

কোনো মেয়েকে যদি এমন কথা শক্রুও বলে তাও মেয়েরা খুশিতে নেচে শক্রুকে ধন্যবাদ দিবে সেখানে শায়লা চৌধুরীর মতো স্মার্ট মহিলা প্রশংসা করায় আলিয়া খুশিই হয়। অবশ্য শায়লাকে নিয়ে আলিয়ার বিশেষ কোনো মতামত নেই৷ আপা পছন্দ করে না বিধায় সেও কম কথা বলে৷

আলিয়া জানালো, ” গেস্টরা সবাই খেয়ে নিচ্ছে। ভাইয়া আপনারাও খেয়ে নেন।”

শায়লা তখন বলেন,” সমুদ্র আয়নাকে নিয়ে যাও, গিয়ে ডিনার করো।”

এমন সময় সবার খেয়াল হলো আয়নার তো হাত ভর্তি মেহেদী দেওয়া।

আলিয়া বলে, ” আপা সেই দুপুর একটায় খেয়েছে৷ এরপর ব্যস্ততার জন্য খায়নি কিছু।”

শায়লা তখন সমুদ্রের দিকে তাকায়। সমুদ্র বেশ স্বাভাবিকভাবে বলে উঠে, ” তাহলে তো মুশকিল হলো। আগেই ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করায় দিবে না!”

আলিয়া অনুতপ্ত বোধ করে বলে, ” একদম ই খেয়াল ছিলো না ভাইয়া।”

–” এখন আর কি করবে? মেহেদী শুকিয়ে যাক৷ এরপর ডিনার করব৷ অপেক্ষা করি ততোক্ষণে। ”

শায়লা চৌধুরী প্রস্তাব দিলেন, ” এক কাজ করো সমুদ্র, তুমি খাওয়ার সময় আয়নাকেও খাইয়ে দাও। তাহলে আর না খেয়ে বসে থাকতে হচ্ছে না।”

সমুদ্রের উত্তর শোনার আশা বাদ দিয়ে আয়না নিজ থেকে বললো, ” না, না সমস্যা নেই তো। আমি চামচ দিয়ে খেতে পারব৷ আবার পরে খেলেও চলবে আমার। আই ক্যান ম্যানেজ।”

সমুদ্র বলে, ” এখানেই খাবার এনে দাও।”

আলিয়া-পিউ জলদি করে দু’টো বিরিয়ানির প্লেট আনলো, চামচসহ৷ ওরা ভেবেছে আয়না নিজ হাতে চামচ দিয়ে খাবে। যেহেতু ভাইয়া ওইসময় কিছুই বলেনি।

পিউ যখন আয়নাকে খাবার প্লেটটা ধরার জন্য এগিয়ে দেয়, আয়না কেবল হাত বাড়াচ্ছিলো, সেই ক্ষণে সমুদ্র প্লেটটা নিজের হাতে কেড়ে নিয়ে বললো, ” আমি দিচ্ছি খাইয়ে।”

আয়না ওর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো। কিন্তু সমুদ্রের দৃষ্টি ছিলো চামচ আর খাওয়ার প্লেটের দিকে। ও ব্যস্ত আয়নাকে খাইয়ে দেওয়ার আগ প্রস্তুতিতে। চামচে করে এক লোকমা মুখের সামনে ধরতেই আয়নার এতো পরিমাণ লজ্জা লাগলো। এই লজ্জা পরিমাণ করা গেলে কয়েক পাউন্ড লজ্জা পাওয়া যেত! দুই গালে লাল আভার ফুটে উঠে তার।

সমুদ্র তাড়া দিতেই আয়না ছোট করে মুখ খুলে খাবার মুখে নেয়। হবু দম্পতিকে একাকী টাইম স্পেন্ড করতে দেওয়া উচিত মনে করে শায়লা আলিয়া আর পিউকে অপরপ্রান্তে নিয়ে যান। ছাদের এ’পাশটায় সমুদ্র আয়না একদম একা হয়ে যায়। সাউন্ডবক্সটা তখন বন্ধ ছিলো। আয়নার বুকে ভীষণ জোড়ে হৃদস্পন্দনের ওঠা-নামা করা শুরু করলো৷

দুই লোকমা খাওয়ার পর আয়না সমুদ্রর প্লেটের দিকে তাকিয়ে বলে, ” একটু অল্প করে দেন। এত্তোগুলো একবারে খাওয়া যায় নাকি?”

সমুদ্র চামচে উঠানো অর্ধেক বিরিয়ানি সরিয়ে দিলো। চামচের উপর একটা কিশমিশ দেখতেই আয়না বলে উঠে, “কিশমিশ সরান৷ আমি কিশমিশ খাই না।”

সমুদ্র সঙ্গে সঙ্গে কিশমিশ সরিয়ে দিলো। এরপর আয়না বলে, ” আমি ভাজা লাল পিয়াঁজও খাই না ওটাও সরিয়ে দিন প্লিজ।”

সমুদ্র প্লেট থেকে বেরেস্তা খুঁজে বের করে সরাতে লাগলো৷

দশটার আগেই সবার ডিনার করা শেষ হয়ে গেলো। ডিনার টাইম শেষ হওয়ার পর ফাহাদ সাহেব ছাদে আসলেন। এতোক্ষণ নিচেই বসে ছিলেন। ছাদে ছোটরা হৈচৈ করছে, উনি আর আসেননি। ফাহাদ সাহেব সবার খাওয়া ঠিকমতো হলে কিনা খোঁজ নিতে এসেছেন। কিন্তু শ্রাবণ, পিউ আলিয়া সহ আরোও কয়েকজন ওদের কাজিন বায়না ধরলো, রাতে ওরা সমুদ্রের বাসার ছাদে মুভি পার্টি করবে। চিপস,চকলেট, আইসক্রিম খাবে আর মুভি দেখবে৷ কিন্তু বিয়ের আগের রাতে মেয়েকে কোনোদিন শ্বশুড়বাড়ি পার্টি করতে দেওয়ার মতো বাবা নন তিনি। তিনি আপত্তিও করলেন, রাজীও হলেন না। সমুদ্রও চায় না এসব করতে। সে সুযোগ বুঝে ফাহাদ সাহেবের সঙ্গে তাল মেলায়। ফলে সকল প্ল্যান ভেস্তে যায়৷

তবে পিউরা ভীষণ মন খারাপ করছিলো জন্য শায়লা চৌধুরী বলে উঠে, ” তোমরা এখানেই আরোও কিছুক্ষণ ইনজয় করো। ল্যাপটপ এনে মুভি দেখো। সাউন্ডবক্সও আছে। আমি পিজ্জা অর্ডার করে দিচ্ছি।”

নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো এই প্রবাদ মেনে ওরা রাজী হয়ে যায়। বড়রা সব চলে গেলে জোড়ে গান বাজানো হলো। আয়নার অবশ্য একটু অসুস্থ বোধ হতে লাগে, তবুও সে সবার সঙ্গে ছাদেই রয়ে যায়৷

সমুদ্র বলে উঠে, ” আমি নিচে গেলাম। একটা কাজ আছে।”

সমুদ্রের এসব আলগা জিনিসপত্র বেশ বিরক্ত লাগে। সে ফাহাদ সাহেবের সঙ্গে কালকের অনুষ্ঠান নিয়ে কিছু আলোচনা করবে। একা মানুষ সব সামলাচ্ছে। মেয়েগুলোও ছোট-ছোট ওরা কি বা সাহায্য করবে? ওনাকে একটু হেল্প করলে তাও যা কাজ হওয়ার হবে৷

_____________

সদর দরজা খোলার আওয়াজে সমুদ্র সিগারেট পায়ে পিষে ফেলে বারান্দা থেকে উঁকি মারলো। আয়না ছাদ থেকে এসেছে। সে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে বললো, ” ব্যাচেলর পার্টি শেষ? ”

আয়না বলে , ” আমার শরীর খারাপ লাগছে।”

তখনই পিউ, আলিয়া, শ্রাবণ এসে ঢুকলো। শ্রাবণ বলে উঠে, ” ডাক্তার ভাই দেখো, রুগী আনছি। প্লিজ ভাবীকে ঔষধ খাইয়ে সুস্থ করে দাও।”

সমুদ্র তাকে অবলোকন করে বলে, ” রুমে গিয়ে এসি ছেড়ে বসো।”

আয়না নিজের রুমে এসেই ভারী লেহেঙ্গা পালটে সুতির জামা পড়ে ফ্রেশ হতে গিয়ে একবার বমি করে দেয়। মাথা ভীষণ ব্যথা করছে। মনে হচ্ছে অজ্ঞান হয়ে যাবে সে।

পিউ-আলিয়া, শ্রাবণ ড্রয়িংরুমে অপেক্ষায় আছে। ফাহাদ সাহেব নিজের রুমের দরজা লাগিয়ে ঘুমাতে গেছেন। আর এদিকে সমুদ্র নিচে গেলো।

একটু পর ফিরে এসে ও সুধালো, ” আয়না কোথায়?”

আলিয়া উত্তর দিলো, ” আপা রুমে। ভালোই অসুস্থ। বমি করেছে। প্লিজ দেখেন আপার কি হলো!”

সমুদ্র আয়নার রুমে ঢুকে যায়৷ ওরা কেউই ঢুকলো না। বাইরেই বসে থাকলো। সবার ভেতর চাপা দুশ্চিন্তা কাজ করছে৷

আয়না নিস্তেজ-কাহিল হয়ে বেডে পা তুলে বসে আছে। সমুদ্র আসায় সে নড়েচড়ে উঠলো। এরপর বলে, “আমার প্রচুর মাথাব্যথা করছে৷ মনে হচ্ছে মাথা ব্যথাতেই ছিঁড়ে যাবে।”

–” আর কোনো সমস্যা?”

–” হিল পড়ার জন্য পাও ব্যথা।”

সমুদ্রর হাতে একটা কালো ব্যাগ ছিলো। সে দু’টো মেডিসিন বের করে বলে, ” খাও।”

আয়না বিনাবাক্য ব্যয়ে, এমনকি ঔষধের নাম অব্দি না দেখে খেয়ে ফেলে বিছানায় শুয়ে পড়লো। সমুদ্র বের হয়ে যায়। আধা ঘণ্টা পরে আবার আসবে৷

সত্যি যখন সে আধাঘন্টা পর আয়নাকে দেখার জন্য যায়, তখন সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সমুদ্র রিলিফ ফিল করে। যাক ঘুমের ঔষধ খেয়ে আরামে ঘুমাচ্ছে। ফিরে যাওয়ার আগ মুহূর্তে খেয়াল হলো ওর পা ব্যথা ছিলো। কালো ব্যাগটা থেকে একটা পেইন রিলিফ ক্রিম বের করে আয়নার সামনে এসে ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে। এরপর পায়ে মলম লাগিয়ে দিয়ে উঠে আসবার সময় দেখলো, হাতের মেহেদী শুকিয়ে ঝরে পড়ছে।

সমুদ্র হাতের উপর নকশা করা একটুখানি শুকনো মেহেদী সরিয়ে দেখলো, মেহেদী একদম রঙ হয়নি। কেমন খুব মৃদ্যু কমলা রঙের হয়েছে৷

কোথায় যেন পড়েছিলো, মেয়েদের বিয়ের মেহেদীর গাঢ় রঙ তখনই হয়, যখন স্বামী ভালোবাসে অনেক। তবে কী প্রাচীনকালীন কুসংস্কারও কখনো কখনো সঠিক বলে? কে জানে?

চলবে৷

#ইলেকট্রিক্যাল_মন
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–10

বিয়ের দিন সকাল দশটার পর আয়নার ঘুম ভাঙ্গে। ঘুম থেকে উঠে তার বেশ সতেজ অনুভূত হলো। মাথাব্যথা, খারাপ লাগা এমনকি পা ব্যথা কোনোকিছুরই অস্তিত্ব খুঁজে পায় না শরীরে। বরং অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশি ফ্রেশ লাগছে। সে আড়মোড়া ভেঙে ফোন হাতে নিয়ে দেখে সকাল সাড়ে সাত’টার দিকে সমুদ্রের একটা মিসড কল। তার গতকাল রাতের কথা মনে পড়ে যায়৷ সমুদ্র বোধহয় মেডিসিন দেওয়ার পরও কিয়ৎক্ষণ পর আরেকবার এসেছিলো রুমে৷ ওইসময় আয়নার চোখ ভর্তি ঘুম থাকলেও হাল্কা জাগ্রত ছিলো সে। সমুদ্র যে তার পায়ে মলম লাগিয়ে দিয়েছিলো সে খেয়াল আছে তার। আয়নার বিয়ের দিনের সকালটা বেশ ভালো গেলো। ঘুম থেকে উঠে সে বাবার কাছে গেলো। বাবা তুমুল ব্যস্ত থাকার পরও তাকে নিয়ে ব্রেকফাস্ট করতে বসলেন। আয়না বাবার সঙ্গে নাস্তা করলো৷ আলিয়া এসে তার পাশে দাঁড়িয়ে বলে, ” আপা তোমার মেহেদী দেখি।”

আয়না নিজের দুইহাতের দিকে তাকালো। মেহেদী সারা রাত ধরে লাগানোই ছিলো। এতো ঘুমে ছিলো যে তোলা অব্দি হয়নি রাতে৷ আয়নার হাতভর্তি মেহেদীতে লালচে রঙ এসেছে ৷ তবে সময়ের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে আরোও গাঢ় হবে মেহেদীর রঙ৷

সে খাওয়া ছেড়ে উঠে হাতে সরিষার তেল মাখলো, এতে করে নাকি আরোও রঙ গাঢ় হয়। বারোটার মধ্যে আয়নাদের বাসার পরিস্থিতিতে ওভার উৎসব ভাব চলে এলো। তার বাবার যেন সবকিছুতে এলাহি কারবার করার ইচ্ছা জেগেছে। একটা গরু, একটা খাসি জবাই করা হলো। গ্যারেজেই বাবুর্চি এসে রান্নার আয়োজন করছে। ছাদে খাওয়ার ব্যবস্থা করা আছে। ঘরে ইভেন্ট প্ল্যানারা এসে ফুল দিয়ে বাসা-ঘর সাজাচ্ছে। বিল্ডিং এ মরিচ বাতি ঝুলিয়ে দেওয়া হলো। হুলুস্থুল কাণ্ড যেন!

আয়না অবাক হয়, বাবা আকদতেই এই অবস্থা করে ফেলেছেন, বিয়ের মেইন অনুষ্ঠান আসলে কি করবে? আচ্ছা এতো এতো আয়োজনের মধ্যে সমুদ্রকে কি যৌতুক ও দিতে হবে? এ’ব্যাপারে উনি আদৌ কিছু বলেছেন? হয়তোবা বাবার কাছে যৌতুক চেয়েছে! তার বাবার উপর আর কতো চাপ দিবে? যৌতুক শব্দটা মাথায় আসার পর কেবল ওইটাই ঘুরঘুর করতে লাগলো। মাথা থেকে কিছুতেই সরাতে পারছে না। সে দ্রুত সমুদ্রের নাম্বারে ডায়াল করে৷ কোনো কিছু নিয়ে জিজ্ঞাসা থাকলে সরাসরি কথা বলাই উত্তম।

____________________

সমুদ্র একদম সকাল ছ’টার দিকে উঠে প্রোটিন শেক পান করে রাস্তায় কিছুক্ষণ জগিং করেছে। এরপর বাসায় ফিরে বিশ মিনিট ফ্রি হ্যান্ড এক্সসারসাইজ করে নাস্তা করে দেখে বাসায় কেউই ঘুম থেকে উঠেই নি। সে ফের রুমে ফিরে গিয়ে কিছুক্ষণ ল্যাবটবে সব ইমেইল চেক করে৷ তবুও সময় কাটেনি জন্য পুনরায় ঘুমাতে যায়। বাংলাদেশে আসার পর ঘুমানোর সময় বেশি পাচ্ছে৷

ফোনের আওয়াজে তার তীব্র অসময়ের তন্দ্রা সামান্য ছু’টে যায়। সে হাতড়ে ফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখে। আয়না ইজ কলিং দেখে প্রায় ঘুমন্ত অবস্থায় ফোন রিসিভ করে। তার মনে হচ্ছিলো ফোন কানে নিয়েই সে ঘুমিয়ে যাবে৷

আয়না ওপাশ থেকে কিসব বললো। কেন যেন মাথায় কিছুই ঢুকলো না সমুদ্রের। তবে ও যখন বলে, ” আপনি কি যৌতুক চান?” সমুদ্র ঘুমের ঘোরে টলতে থেকে বললো, ” হু। দাও।”

— ” কিভাবে দিবো আপনাকে?”

সারাদিন অফিস সংক্রান্ত কর্ম মাথায় ঘুরে, সে না বুঝেই বলে, ” ইমেইল পাঠাও। নাহলে ড্রাইভে সেন্ড করতো। দেখছি।”

আয়না একটু জোরে করে হতভম্ব হয়ে চেচিয়ে উঠে বললো, ” যৌতুক ও আপনাকে ইমেইল পাঠিয়ে দিতে হয়?”

সমুদ্রের তখন সবে ঘুম ছ’টে, ব্রেইন অবসর থেকে কাজে নামলো। সে চোখ কচলিয়ে বললো, ” কি বলছো? আবার বলো। ঘুমে ছিলাম বুঝতে পারি নাই।”

আয়না কাচুমাচু করে বলে, ” আপনি কি বিয়ে করার সময় যৌতুক নিচ্ছেন?”

সমুদ্র ফোনের এ’প্রান্ত থেকে বলে, ” যৌতুক আবার কী?” এরপরে এক সেকেন্ড থেমে বলে, ” সারাদিন মাথায় এসব উদ্ভট জিনিস ঘুরে কেন?”

আয়না দৃঢ়তার সঙ্গে বলে, ” উদ্ভট কেন হতে যাবে? সমাজে এসব হচ্ছে না?”

সমুদ্র বলে, ” সমাজে তো দেনমোহর ব্যবসাও হচ্ছে। আমি কি বলেছি নাকি তুমি দেনমোহর নিয়ে ব্যবসা করছো?”

–” আপনি আমাকে দেনমোহরও দিবেন?”

সমুদ্র ফোন কানে নিয়েই চিত হয়ে শুয়ে বলে, ” তোমার কি মনে হয় আমাদের বিয়েটা খেলা-খেলা বিয়ে? টয় ম্যারেজ?”

–” তা নয় তবে আপনি তো কিছুই বলেননি আমাকে। ”

–” তোমার বাবা সরাসরি আলাপ করে নিয়েছে৷ তাছাড়া ছোট মানুষ তুমি, এজন্য তোমার সাথে আলোচনা করিনি।”

–” আমি ছোট মানুষ হলে, ছোট মানুষকে বিয়ে কেন করছেন?”

সমুদ্র দু’পল ভাবলো এরপর উত্তর দিলো, ” ছোটকে বিয়ে করা যায় কিন্তু টাকা-পয়সার আলাপ করা যায় না।”

আয়না আরোও কিছু বলতে চাচ্ছিলো তার আগেই সমুদ্র বলে উঠে, “একটু পর তোমার বাসার উদ্দেশ্যই বের হবো। তখন যা বলার বলবে।”

আয়নার তখন বউ সাজা প্রায় শেষ। ঘোমটার সেটিং করানো হয়ে গেছে৷ লাল শাড়িতে তাকে সত্যিকারের বউদের মতোই লাগছে। সে বারবার নিজেকে মিররে দেখছে। বিশ্বাস ই হচ্ছে এই বউটা সে নিজে!

আলিয়া একটু পর পর রুমে আসছে৷ আকদ হওয়ায় বাসাতেই সাজানো হয়েছে তাকে। খুব বেশি সাজেনি। সিম্পেল সাজ যাকে বলে। আলিয়া এসেই বললো, ” আপা সুন্দর করে হাসো।”

আয়না হাসি দিতেই সে ছবি তুলে ফেলে বললো,”
দুলাভাইকে তোমার ছবি পাঠাবো।”

আয়না ঠোঁট বাকিয়ে বলে, ” ওনার সময় আছে নাকি ছবি দেখার?”

আলিয়া এক মিনিট পর হাসি দিয়ে বলে, ” দুলাভাই তোমাকে দেখার জন্য উদগ্রীব! দেখো মুহূর্তের মধ্যে সীন করে, তোমার আরোও ছবি দেখতে চাচ্ছে!”

আয়না ছোঁ মেরে ফোনটা তার হাতে নিয়ে দেখে আসলেই ম্যাসেঞ্জারে সমুদ্রের সঙ্গে আলিয়ার চ্যাটিং হয়েছে৷ সমুদ্র তার ছবিতে লাভ রিয়্যাক্টও দিয়েছে। আবার আলিয়াকে উদ্দেশ্য করে ম্যাসেজ দিয়েছে, অনেক সুন্দর লাগছে। আরোও ছবি তুলে এখনি পাঠাও।

আয়না মনে মনে বলে, ” বজ্জাত ব্যাটা অন্যদের সামনে ভাব এমন ধরে যেন কতো দরদ তার, অথচ ফাঁকা বাশ ভেতর ভেতর।”

আলিয়া ভয়েজ ম্যাসেজ দিলো, ” ভাইয়া, এভাবে তো ফ্রিতে বউ দেখা যাবে না। বোনাস গিফট দিলে আমি ভেবে দেখতে পারি।”

আয়না ভাবেনি এটারও রিপ্লে উনি দিবেন। প্রয়োজনীয় ইমেইল ছাড়া যে একটা বাড়তি টেক্সট দেয় না তার এতো আজাইরা সময়ও হবে! কিন্তু সমুদ্র রিপ্লে দিলো। আয়নাও পড়লো কি লিখেছে৷ সে টেক্সট দিয়েছে কিছুটা এমন, ” নিজের বউকে দেখতেও বোনাস গিফট দিতে হয়? আপু, তুমি তো আমার চেয়েও বড় ব্যবসায়ী! ঠিক আছে দিবো গিফট তোমাকে। এবার ছবি পাঠাও।”

আয়না টাস্কি খেল টেক্সটটা পড়ে৷ আলিয়া কিছুক্ষণ জোরে জোরে হেসে আয়নার আর একটামাত্র ছবি তুলে পাঠালো। ওটাও সঙ্গে সঙ্গে সীন হলো। আয়না আর দেখলো না। সে বউ সেজে সারাবাড়ি ঘুরে বেড়ালো। উপস্থিত আত্নীয়দের সঙ্গে আন্তরিক ভাবে ছবি তুললো। বাবার সাথে ছবি তুলে৷ মিলিকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করে ছবি তুললো। আজ সে কেন যেন বেশ খুশি। অথচ এক সপ্তাহ আগেও পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে এই দুশ্চিন্তায় সে অসুস্থ বোধ করছিলো৷ কিন্তু একটু পর যে তার বিয়ে এতে তার কোনো কষ্ট হচ্ছে না। বরং সমুদ্রের জন্য অচেতন মূলকভাবে হলেও অপেক্ষায় আছে৷

জামাইবাবু বিড়াল হয় ভয় জন্য মিলিকে বারান্দায় রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ বরযাত্রী এলো ঠিক ছয়টার দিকে। একদম ঘড়ি ধরা সময়ে এলো তারা। আয়না তখন রুমে বসেছিলো।

সমুদ্রের জন্য দরজায় ফিতা দিয়ে গেইট ধরা হলো। টাকা না দিলে মেয়েপক্ষরা বরকে ভেতরে যেতে দিবে না। সমুদ্র এমনিতেই ঘাউড়া, সে মোটেও টাকা দিতে রাজী নয়। পিউ-শ্রাবনকে জানায় দিলো, ওদের বলতে যে বর কোনো টাকা দিবে না৷ এমনি গেইটের ফিতা খুলে দিতে। কিন্তু ওরা দুইজন সমুদ্রের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলো।

ফিতার ভেতর দিয়ে টপকে ওদিকে গিয়ে আলিয়ার সঙ্গ দিয়ে বললো, ” ভাইয়া, জলদি ভাবীর ননদ, বোন আর দেবরকে বিয়ের গেইট ধরা বাজেট দাও। আফটার ওল ভাইয়ার বউয়ের জন্যই তো বাজেট পেশ করছি!”

সমুদ্র নিজের দলের মন্ত্রী-সৈন্যকে বিপক্ষ দলে ভীড়তে দেখে হতাশ হয়ে পকেট থেকে টাকা বের করে দেয়। সে বুঝেই গেছে ওর সবদিকই লস আজ।

টাকা দেওয়ার পর আলিয়া ফিতা খুলে দিয়ে, শরবত আর মিষ্টি খাওয়ালো। সোফায় বসার পর সমুদ্র বারবার আয়নাকে খুঁজতে থাকে। আয়নাকে দেখতে না পেয়ে সে আলিয়াকে জিজ্ঞেস করে, ” তোমার আপু কোথায়?”

আলিয়া হাসিমুখে জবাব দেয়, ” আপা রুমে। কাজী সাহেব ডাকলে, বিয়ে পড়ানোর সময় এসে বসবে। ভাইয়া কি আপুকে বেশি মিস করছেন?”

সমুদ্র কী বলবে ভেবে পেল না। সে দেখলো তার ফোনে ফ্রেন্ডরা কল দিচ্ছে৷ নিশ্চয়ই তাকে অভিনন্দন জানানোর জন্য। সে রিসিভ করতে পারছে না। তবে নীলার ফোন ধরলো সে। নীলার কন্ঠস্বর কেমন কঠোর লাগলো ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে। ও বলে উঠে, ” দোস্ত, যতো ঝড়ই আসুক না কেন আজ তুই আয়ানকেই বিয়ে করবি। প্রমিজ কর আমাকে।”

সমুদ্র করে বলে, ” বিয়ে করতেই এসেছি ওকে।”

নীলা বলে, ” তোর ভাগ্যে আয়নাই আছে। এজন্য ওকে পেতে যাচ্ছিস তুই। তোরা সুখী হো। বাকি সব কিছু ছলনা, কেবল আয়নাই তোর জন্য সত্য।”

সমুদ্র বুঝে পায় না নীলার এসব কথা বলার অর্থ কি? সে ফোন রেখে কাজী আসার অপেক্ষায় থাকে। ঠিক সাতটার দিকে যখন কাজী আসলো। মেয়েকে নিয়ে আসার পালা এখন। ওমন সময় সমুদ্রের ফোন বেজে উঠে৷ আয়নাকে তখন ড্রয়িংরুমে আনা হচ্ছে। লাল শাড়ি পড়ে বউ সাজে আয়না উপস্থিত হলো যখন, ওই সময় সমুদ্রের ফোন ভাইব্রেট হচ্ছিলো। সে স্ক্রিনে তাকাতেই ভুত দেখার মতো পিলে চমকে উঠে। স্ক্রিনে ভেসে উঠা নামটা বহু প্রতিক্ষিত একটা নাম। বহুবার চেয়েছে এই নাম্বার থেকে একটামাত্র কল আসুক। সে বিড়বিড় করে “ইউশা” নামটা উচ্চারণ করে। চারপাশ অন্ধকার দেখলো সে। ও কেন কল দিচ্ছে? আর কি চাই সমুদ্রের কাছে? আরোও বেশি করে ওকে ভেতর থেকে ভেঙে দিতে কল করেছে? নাকি ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলবে?

চলবে৷