ইস্ক সুফিয়ানা পর্ব-১৫ এবং শেষ পর্ব

0
793

#ইস্ক_সুফিয়ানা
#পর্ব – ১৫ [শেষ পর্ব]
#লেখনীতে : #Aloñe_Asha (ছদ্ম নাম)
#Kazi_Meherin_Nesa

“কিহহ! আমি আপনাকে নাম ধরে ডাকব? হঠাৎ এই ভুত আপনার মাথায় চাপলো কেনো শুনি?”

“তো তুমি কি ভেবেছো সারাজীবনে আমাকে স্যার স্যার বলেই ডাকবে আর আমি কিছুই বলবো না? এসব আর চলবে না..এখন থেকে তুমি করে বলবে আর আমার নাম ধরে ডাকবে”

“এটা আবার কেমন জেদ করছেন? মাঝে মাঝেই আপনার মাথায় এরকম অদ্ভুত জিনিস ভর করে কেনো বুঝিনা”

“একটা ছোট্ট জিনিস তো চাইছি, সেটাও দেবে না নাকি? আমি তোমার জন্যে এতকিছু করছি, তোমাকে এত্তো ভালোবাসি আমি তার কোনো দাম নেই নাকি হুমম? আর তুমি এইটুকু করতে পারবে না?”

“আমি করবো না তো বলিনি কিন্তু এখন..এখন আমি রেডি নই! এতদিনের অভ্যাস আমার, হুট করে চেঞ্জ করবো কিভাবে বলুনতো?”

“চাইলেই সব করা যায় সো নো এক্সকিউজ! বলো এখুনি, আরমান বলো”

“আরমান স্যার”

“আবার আরমান স্যার? সে জাস্ট আরমান! এর সাথে যদি স্যার জুড়ে দাও তাহলে আজকে কিন্তু আমি রাগ করবো”

“আমি আপনাকে এত্তো সম্মান করে স্যার বলি তাতে আপনি খুশি হন না?”

“চাইনা তোমার এইরকম সম্মান!”

উনি বাচ্চাদের মতো একটা ভাব নিয়ে কথাটা বললেন, আমি হেসে দিলাম..হেসে ওনার হাত থেকে ফুলগুলো নিতে যাচ্ছিলাম কিন্তু উনি হাত সরিয়ে ফেললেন

“এটা কি হলো? এগুলো আপনি আমার জন্যে এনেছেন না? দিন আমায়”

“এগুলো তুমি ততক্ষণ পাবে না যতক্ষণ না আমার নাম থেকে স্যার বলা বাদ দেবে, এবার আর ছাড় দেবো না তোমায়”

“আহা, রাগ কেনো করছেন! আমি বলবো না তো বলিনি তবে অভ্যাস বদলাতে তো একটু সময় লাগবে নাকি?”

“আমার কাছে অতো সময় নেই! ৫ মিনিট সময় দিলাম তোমায়..বললে বলবে এখুনি নাহলে আমি ফিরে যাবো! তারপর তুমি থেকো তোমার স্কুল আর স্টুডেন্ট নিয়ে”

বেজায় চটেছেন উনি, আমি এবার বেকায়দায় পড়ে গেলাম..এখুনি বলতে হবে? কিন্তু আমি যে সবসময় ওনাকে আরমান স্যার বলে এসেছি এখন শুধু আরমান বলতে গেলে একটু বাঁধবে না? সেটা ওনাকে বোঝাব কিভাবে? উনি ছোটো ছোটো চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন..এরপর গাড়ির দরজা খুলে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন

“তুমি বলবে নাকি আমি যাবো?”

“না না, আজকে আপনার সাথে আমি কিছুটা সময় কাটাতে চাই, আপনি চলে গেলে কিভাবে হবে?”

“হুমম! তাহলে বলো..আমি অপেক্ষা করছি”

“আচ্ছা, বলছি!”

আমি নিজেকে একটু প্রস্তুত করে নিলাম প্রথমে, উনি আমার দিকে গভীর দৃষ্টি ক্ষেপণ করে অধীর আগ্রহে চেয়ে আছেন

“ওকে! আমি তৈরি, যেকোনো একটা প্রশ্ন করুন, আমি উত্তর দিচ্ছি!”

“তুমিই না রুহি সত্যিই! জাস্ট নাম ধরে ডাকবে আমায় তার জন্যে এতকিছু করতে হবে?”

“আমি এরকমই! কেনো? আপনার সমস্যা হচ্ছে নাকি? আপনি তো শুরু থেকেই জানেন আমি একটু আলাদা সবার থেকে তাইনা?”

উনি হুট করেই নিজের মুড বদলে মুচকি হাসলেন,তারপর আমার দিকে ফুলগুলো এগিয়ে দিয়ে বললেন

“আই নো, তাই তো তোমাকে আমি নিজের পার্টনার হিসেবে চুজ করেছি, এনিওয়ে.. চলো আমরা যাই..আজকে সারাদিন একসাথে থাকবো তখন না হয় তোমার মুখ থেকে “আরমান” শুনে নেবো”

আমি ফুলগুলো হাতে নিয়ে ঠোঁট উল্টে বললাম

“কেনো কেনো? এখন কেনো নয়? একটু আগেই তো খুব জোরাজুরি করছিলেন! এখন কি হলো?”

“তোমার ভাব দেখেই বুঝে গেছি এখন যদি তোমার মুখ থেকে আমার নাম শোনার অপেক্ষায় এখানে দাড়িয়ে থাকি তাহলে আর আমাদের ঘোরা হবেনা, এন্ড আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু ওয়েস্ট টাইম! সো চলো”

আমি হেসে ফেললাম, ওনার এই স্বভাবগুলো আমার খুব ভালো লাগে..অবশ্য পুরো উনিটাই তো এত্তো ভালো! আমরা দুজনে হাত ধরে হাঁটছি! আজ তথাকথিত “ভালোবাসা দিবস”.. অনেক কাপলদের দেখলাম রাস্তায় ম্যাচিং ড্রেস পরিধান করে সেজে গুজে ঘুরে বেড়াচ্ছে..এইসব ব্যাপারগুলো কখনোই পছন্দ ছিলো না আমার, আর না এইদিনে কখনো ঘুরতে বেরিয়েছি! নেহাৎ আজকে আরমান স্যার বললো বলে এলাম

“আমরাও নেক্সট ইয়ারে এইভাবেই ম্যাচিং ড্রেস পড়ে ঘুরতে আসবো! অ্যান্ড আই উইল বি ইউর ফটোগ্রাফার ওকে?”

“বাব্বাহ! আপনি হবেন আমার ফটোগ্রাফার?”

“অফ কোর্স! ব্যাপারটা কিন্তু বেশ অন্যরকম লাগে! সবাইকে শুধু দেখেই গেলাম, ইন ফ্যাক্ট সিফাত ও তার গার্লফ্রেন্ড এর ছবি তুলবে কালকে বললো তাহলে আমি কেনো বাদ যাবো?

“ওহ! তো আপনিও আর পাঁচটা সাধারণ প্রেমিকের মতোই হতে চান? আলাদা কিছু করার ইচ্ছে নেই?”

“অবশ্যই আছে, তবে কখন কি করবো সেটা সময় সুযোগ বুঝে ঠিক করবো, এখনই তো আর বলতে পারবো না যে ফিউচারে কি করবো রাইট?”

হাসলাম আমি, এখন আমার মনে হয় জীবনে এরকম একটা প্রেমিক পুরুষ থাকলে মন্দ হয় না, ভালো থাকার জন্য এমন একজনকে দরকার, তবে একটাই তো ভয় আমার, ওনার বাবা আমাদের সম্পর্ক না মানলে আমাদের যে আলাদা হতে হবে.. কোনদিন যদি ওনাকে হারিয়ে ফেলি? কিভাবে থাকবো আমি?

“আচ্ছা, কোনোদিন যদি এমন হয় যে পরিস্থিতি আমাদের আলাদা করে দেয় তখন কি করবেন আপনি?”

আমার প্রশ্নের উনি কিছুক্ষণ চুপ রইলেন, উনি বুঝেছেন আমি কোন পরিস্থিতির কথা বলছি.. ছোট্ট এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে উনি বললেন

“এরকম সিচুয়েশন আমি আসতেই দেবো না যেখানে আমায় তোমার থেকে আলাদা হবার কথা ভাবতে হবে”

“সময় কিন্তু সবসময় আমাদের হাতে থাকে না, হতে পারে আপনাকে বেছে নিতে হলো আমার আর আপনার বাবার সিদ্ধান্তের মধ্যে কাওকে তখন কি করবেন?”

“রুহি তুমি এসব কথা কেনো বলছো? খুব দরকার আছে কি এখন এগুলো বলার? বাদ দাও না..বাবা কি বলেছে, সে আমাদের সম্পর্ক মানছে কি মানছে না তাতে আমার কিছু যায় আসেনা”

আমি ওনার কথার প্রতিউত্তর দিতে যাবো তখনই নয়নার ফোন এলো, আমি ফোন ধরতেই ও হন্তদন্ত হয়ে বলে উঠলো

“আপু কোথায় তুই? বাড়ি চলে আয় এখুনি! মনে হচ্ছে আবার বাড়িতে একটা ঝামেলা হবে”

“বাড়িতে কি হয়েছে নয়না? তুই এভাবে বলছিস কেনো?”

“আরমান ভাইয়ার বাবা এসেছে আবার, উনি বাবার সাথে কি নিয়ে যেনো কথা বলছে..তুই নিজেই এসে দেখ কি হচ্ছে এখানে”

চিন্তিত হয়ে ফোন কেটে দিলাম আমি, সেদিন আরমান স্যারের বাবা আমার সাথে কথা বলেছিলেন, আজ আবার চাচার সাথে কথা বলছেন কেনো? চিন্তায় মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে আমার

“কি হয়েছে? ইজ এভরিথিং ওকে?”

“মনে হয় না.. আপনার বাবা আমাদের বাড়িতে গেছেন! আমার চাচার সাথে নাকি কি নিয়ে কথা বলছেন! জানিনা কি হচ্ছে ওখানে এখন”

“হোয়াট? বাবা তোমাদের বাড়িতে আবার? বাবার প্রব্লেম কি বুঝতে পারিনা আমি, এই বলে তোমাকে মানবে না আবার সেই নিজেই তোমাদের বাড়িতে চলে যায়”

“এসব কথা এখন বলার সময় না, আমাকে বাড়ি যেতে হবে এখুনি..জানিনা ওখানে কি হচ্ছে এখন”

উনি তখন আমার হাত ধরে বললেন

“আমিও যাবো তোমার সাথে”

“কিন্তু”

“কোনো কিন্তু না, আমিও যাবো তোমার বাড়িতে”

আমি আর বাধা দিলাম না ওনাকে, পরে উনি নিজে এলেন আমার সাথে বাড়িতে..আমার হাত ধরেই উনি ঢুকলেন, আমি ভয়ে আছি, আল্লাহ জানে কি হবে আজকে! বাড়িতে ঢুকতেই আরমান স্যারের মা বাবা বোন সবাইকে একসাথে দেখে চমকে উঠলাম আমি, ওনারা সবাই একসাথে এখানে কি করছেন? ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম ওনার দিকে! বুঝলাম উনিও কিছুটা অবাক হয়েছেন, তবে ওনার মুখেও চিন্তার ছাপ স্পষ্ট! চাচা চাচী ও ওখানেই ছিলেন, আমাকে দেখে চাচা বলে উঠলেন

“কিরে! এতো তাড়াতাড়ি চলে এলি যে? নয়না তো একটু আগেই ফোন করলো তাইনা? কোথায় ছিলি?”

“কাছাকাছিই ছিলাম চাচা”

আমি বুঝতে পারছি না এখানে ঠিক কেমন পরিস্থিতি বিরাজ করছে, কারো মুখ দেখেও কিছু বোঝার উপায় নেই, চিন্তা হচ্ছে আমার, এখানে কি কথা হয়েছে কে জানে..আরমান আমার হাত ছেড়ে ওনার বাবার সামনে এসে প্রশ্ন করে বসলেন

“বাবা, তুমি আবার ওদের বাড়িতে কেনো এসেছো?”

“তুই এমন এমন কাণ্ড শুরু করেছিস যে আমি বাধ্য হয়েছি আসতে.. একটা ব্যবস্থা তো নিতে হবে এবার”

“ব্যবস্থা মানে? কিসের কথা বলছো?”

মিস্টার শাহ কোনো উত্তর দিলেন না, মিনাল তখন উঠে এসে আমার পাশে দাড়িয়ে মিষ্টি হেসে বললো

“ভাইয়া, বাবা এবার একটা ভালো কাজ করতে এখানে এসেছে, তাতে তোরই লাভ হবে বুঝলি? রাগ দেখাতে হবে না আর এখন”

মিনাল এর কথার মানে আমি বা আরমান স্যার কেউই বুজলাম না..তখনই মিস্টার শাহ উঠে দাড়ালেন, ছেলের সাথে কথা না বলে উনি সোজা আমার সামনে এসে দাড়ালেন, আমি ভেবেছিলাম উনি আবার হয়তো সেদিনের মত আমাকে প্রশ্ন করবেন কিন্তু নাহ, এবার উনি তেমন কিছুই করলেন না

“যেদিন প্রথম তোমাকে আরমানের সাথে দেখেছিলাম সেদিন থেকেই পছন্দ ছিলে না তুমি আমার কাছে, আস্তে আস্তে যখন দেখলাম আরমান তোমার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ছে তারপর তোমাকে অপছন্দ করার আরো একটা কারণ পেয়েছিলাম..কিন্তু এতকিছুর পরও ভাবিনি যে ফ্যামিলি সমেত আমি নিজেই তোমার বাড়িতে এসে হাজির হবো..তোমার পরিবারের সাথে তোমার আর আরমানের বিয়ের কথা বলবো”

মিস্টার শাহ স্বাভাবিক ভাবেই কথাগুলো বললেন তবে কথাগুলো আমার আর আরমান স্যারের কাছে শকের মতো ছিলো..যে লোকটা আমাকে নিজের ছেলের সাথে মানতে নারাজ সে নিজেই এসেছে বিয়ের কথা বলতে? আমাদের মুখ দেখে মিসেস শাহ হেসে বলে উঠলেন

“কিরে! তোদের মুখটা অমন হয়ে গেলো কেনো? যেটা এতদিন ধরে চাইছিলি তোরা সেটা তো আজ হচ্ছে! এখন থেকে সব চিন্তা দূরে রাখ”

“আরে মা, বুঝতে পারছো না..বাবার কথা শুনে দুজনেই ট্রমায় চলে গেছে..দেখো না মুখটা কেমন হয়ে গেছে দুজনের?”

“হবারই কথা, হুট করে যে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হবে সেটা তো আরমান আর রুহি ভাবতেই পারেনি! তবে আমি খুশি হয়েছি যে আপনারা সব মেনে নিয়েছেন”

“আই স্টিল কান্ট বিলিভ দিজ! বাবা তুমি সত্যি বলছো? তুমি এত সহজেই মেনে নিলে সবকিছু? মজা করছো না তো?”

“মজা করার হলে আমি এখানে আসতাম বলে তোর মনে হয় আরমান? এই মেয়েটাকে আমি আর পাঁচটা সাধারণ লোভী মেয়ের মতোই ভেবেছিলাম, তারপর ওকে আস্তে আস্তে পরখ করতে শুরু করলাম.. সেদিন কিছু প্রশ্ন করেছিলাম আর তাতে ও যা উত্তর দিয়েছে তাতেই বুঝে গেছি যে আমি ভুল ছিলাম”

আরমান স্যার অবাক চোখে নিজের বাবার দিকে তাকিয়ে আছেন..এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না যে ব্যাপারটা!

“বাবা, সত্যিই তুমি আমার আর রুহির সম্পর্কটা মেনে নিলে? আর ওকে নিয়ে প্রব্লেম নেই তোমার?”

মিস্টার শাহ ছেলের কাছে হাত রেখে সরু হাসলেন

“তোর পছন্দে বরাবর আমার গর্ব হতো, রুহিকে তুই যখন পছন্দ করলি তখন ভেবেছিলাম এবার ঠকে গেছিস কিন্তু নাহ! তোর পছন্দ সবসময়ের মতো এবারও বেস্ট.. বাড়ির বউ আর তোর স্ত্রী হবার জন্যে রুহি একদম পারফেক্ট”

বাবার কথা শুনে চওড়া একটা হাসির রেখা ফুটে উঠলো আরমান স্যারের মুখে, খুশিতে বাবাকে জড়িয়ে ধরলেন উনি..আমার চোখে কেনো যেনো পানি চলে এসেছে কথাগুলো শুনে, বিষয়টা সত্যিই অবিশ্বাস্য ছিলো আমার কাছে.. ভাবিনি এভাবে উনি মেনে নেবেন সবটা, আমি তো আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম..ভেবেই বসেছিলাম যে আরমান স্যারকে আমি আর কোনোদিন পাবো না, চোখ নিচু করে আছি আমি, টপটপ পানি পড়ছে চোখ থেকে..কিন্তু এ পানি যে সুখের, বহু সাধনার পর কিছু পাওয়ার আনন্দ..মিনাল আমার চোখের পানি মুছে দিলো

“কি গো ভাবী? এখন থেকেই চোখের পানি ফেলতে শুরু করলে? তাহলে ভাইয়া যখন তোমাকে নিতে আসবে তখন কিন্তু কান্না করতে পারবে না”

কান্নার মাঝেও মুখে হাসি চলে এলো আমার, এখন থেকেই ভাবী বলতে শুরু করেছে ও আমায়..আরমান স্যারের বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন

“জানো আমি কেনো মেনেছি তোমায়? ভেবেছিলাম আমার পছন্দ অপছন্দের দাম তুমি দেবে না যেমন আজকালকের মেয়েরা দেয় না, আমার অপছন্দ জানা সত্ত্বেও তুমি ভালোবাসার দোহাই দিয়ে আরমানকে বিয়ে করে আমার বাড়িতে উঠবে কিন্তু তুমি সেটা করনি, আমার অনুমতির অপেক্ষায় ছিলে, আরমান তোমায় এত ভালবাসে, তোমার জন্যে কষ্ট পাচ্ছে জেনেও নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলে…ভালোবাসার ক্ষেত্রে তোমার মতো এরকম ধৈর্য্য কিন্তু সবাই ধরতে পারে না, তুমি আমাকে আরমানের থেকেও উর্ধ্বে রেখেছো তাই আজ থেকে আমার ফ্যাভরেট লিস্টে ছেলের থেকেও তোমাকে উর্ধ্বে জায়গা দিলাম”

প্রথমবার আজ মিস্টার শাহ আমার সাথে এতো ভালোভাবে কথা বলছেন, তাও এতো গভীর কথাগুলো বললেন, আমি তো এটাই চেয়েছিলাম যে একদিন নিজেই উনি আমায় মেনে নিক, আমাদের ভালোবাসাটা মেনে নিক! অবশেষে সেই দিক আজ এসেই গেলো.. আরমান স্যারের মা উঠে আমার কাছে আসলেন

“তুই আর আরমান অনেক অপেক্ষা করেছিস! এবার সব অপেক্ষার অবসান হবে, খুশি তো এবার?”

আমি মাথা নাড়লাম..আজকের থেকে এত বেশি খুশি হয়তো জীবনে কোনোদিন হইনি..আমি আরমান স্যারের দিকে তাকালাম, উনি ইশারায় আমাকে স্মাইল করতে বললেন..আমিও মুচকি হাসলাম, ভেবেই কেমন এক আনন্দ হচ্ছে যে খুব শীঘ্রই “আরমান শাহ” একান্তই আমার হয়ে যাবো আর আমি ওনার..এরপর আমাদের বিয়ের কথা বলা শুরু হলো, সবাই আলোচনা করলেন কিছুক্ষন তারপর আমার চাচা বললেন

“মিস্টার শাহ, তাহলে আপনাদের যখন কোনো সমস্যাই নেই তাহলে আর বিলম্ব করে লাভ কি, বিয়েটা দিয়েই দেওয়া যাক দুজনের? অনেক তো অপেক্ষা করেছে ওরা”

“জ্বি অবশ্যই! বিয়ে তো হবেই, এখন আর দেরি করার দরকার নেই..সামনের সপ্তাহে আমার একটু কাজ আছে তো দু সপ্তাহ পর যদি বিয়ের তারিখ ঠিক করি সমস্যা হবেনা তো?”

“না না সমস্যার কি আছে? আপনারা যখন বলবেন তখনই হবে”

সেদিনই আমাদের বিয়ের পাকা কথা হয়ে গেলো..দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষার অবসান হওয়ার পর এবার আমি আর আরমান স্যার বিয়ের দিন গুনছিলাম! যতো বিয়ের দিন এগোচ্ছিল উনি যেনো ততো বেশি ছটফটে হয়ে উঠছিলেন..কিছুটা নার্ভাসনেস, অপেক্ষা আর মিষ্টি কিছু খুনসুটি মিলিয়ে সেই দুই সপ্তাহ সময়টা ও বেশ সুন্দরভাবে কেটেছে আমাদের

পছন্দের ফুলগুলো দ্বারা সজ্জিত বিছানায় বধূবেশে বসে আছি আমি, দু ঘন্টা আগেই আমাদের বিয়ে হয়েছে.. হ্যা আজ আমার আর আরমান স্যারের ভালোবাসা পূর্ণতা পেয়েছে, পার্মানেন্টলি একসাথে থাকার লাইসেন্স আজ পেয়ে গেছি আমরা..এখন আর ওনাকে রাতের বেলা ঘুম নষ্ট করে আমার বাড়ি যেতে হবে না, কথাটা ভেবেই হাসি পেলো আমার..ঈশ! কতো কষ্ট করেছেন উনি এতদিন এখন আর কোনো কষ্ট করতে হবে না ওনাকে আমায় দেখার জন্যে..অনেকক্ষণ ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে বসেছিলাম কিন্তু আমার বর মহাশয়ের তো দেখাই পাচ্ছি না, কোথায় গেলো? ওড়নাটা এবার উঠিয়ে শুধু মাথায় দিলাম, তারপর বিছানা থেকে নেমে দরজার কাছে আসতেই যাচ্ছিলাম তখনই ওনার আগমন ঘটলো..চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ দেখে আমি প্রশ্ন করলাম

“কি হয়েছে?”

“কি আবার হবে? আমার জল্লাদ বোন, দশ হাজার টাকা মেরে নিয়েছে আমার থেকে..টাকা দেইনি বলে এতক্ষণ আমাকে আমার রুমেই আসতে দিচ্ছিল না”

“এইটুকু বিষয়ের জন্যে আজকের দিনেও চোখমুখ এরকম করে আছো? কোনো মানে হয় নাকি? তাছাড়া ও তো ছোটো, মজা করে নিয়েছে তো কি হয়েছে?”

“বাহ! এখন থেকেই ননদের তরফদারি করছো? এটাই বাকি ছিলো শুধু”

বাচ্চাদের মতো মুখ ফুলিয়ে ফেললেন উনি! আমি হেসে ওনার গাল দু হাতে টেনে বললাম

“আচ্ছা সরি! আজ অন্তত রাগ করো না প্লিজ! জানো আমি কখন থেকে তোমার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম?”

উনি তাকালেন আমার দিকে, পা থেকে মাথা অব্দি আমাকে দেখলেন, আমিও দেখছি ওনাকে..সাদা রঙের শেরওয়ানিতে কি দারুন লাগছে ওনাকে! আহা..! এই না হলে আমার হাসবেন্ড! আমাকে এখনও ব্রাইডাল ড্রেসে দেখে উনি ভ্রু কুচকে বলে উঠলেন

“এখনও এগুলো পড়ে আছো কেনো? যাও চেঞ্জ করে এসো, একটু রিল্যাক্স হয়ে বসো আগে”

“হ্যা? এগুলো এখন চেঞ্জ করবো কেনো? এখন তো চেঞ্জ করার কথা না”

আমি তো স্বাভাবিকভাবেই বলেছিলাম কথাটা, কিন্তু উনি দুষ্টু হেসে চোখ মেরে বললেন

“কেনো? তর সইছে না নাকি আর হুমম? এখুনি তাহলে বাসর শুরু করবো নাকি?”

লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম আমি, আর উনি তো আরো মজা নিচ্ছেন! সুযোগ পেয়েছেন না আমাকে জ্বালানোর?

“উফফ! বেহায়া একটা! যাচ্ছি চেঞ্জ করতে”

“তুমি চাইলে আমি হেল্প করতেই পারি”

“কোনো দরকার নেই! চুপচাপ এখানে দাড়িয়ে থাকো, একদম স্ট্যাচু হয়ে থাকো! আসছি আমি!”

“আরে রুহি শোনো”

“কি?”

উনি আমার গালে ছোট্ট চুমু দিলেন, সঙ্গে সঙ্গে আমি ছুটে চলে গেলাম চেঞ্জ করতে, উনি তো হাসছিলেন আমার কান্ড দেখে..দুজনেই চেঞ্জ করে নিয়েছি, বারান্দায় বসেছি একসাথে..উনি তখন আমার হাতে সেই ডায়রিটা দিলেন যেটা আমি ওনাকে ওনার জন্মদিনে দিয়েছিলাম, ডায়রি খুলে অবাক হয়ে গেলাম আমি..দেখলাম অনেকগুলো পাতায় লিখা!

“তুমি তো বলেছিলে ডায়রি লেখো না, তাহলে এটাতে লিখেছ?

“হুমম! কারণ এটা তুমি দিয়েছিলে! বলেছিলাম না তোমার গিফট ওয়েস্ট হতে দেবো না? দেখো! পুরো সদ্ব্যবহার করেছি..দেখো!”

অনেক আগ্রহ নিয়ে আমি ডায়রির প্রথম পাতায় চোখ বুলালাম, সেখানে কালারিং পেন দিয়ে ডিজাইনিং হ্যান্ড রাইটিং এ করে বড় করে লিখা “আরমানের রুহ”… লিখাটা দেখে বুকটা কেমন কেপে উঠলো আমার, লিখাটায় হাত বুলালাম আমি

“আরমানের রুহ..?” আমি..!!”

“তুমি ছাড়া আর কে হবে? জানো রুহি, এখানে শুরু থেকে সব লিখেছি আমি..তোমাকে যেদিন থেকে ভালোবাসতে শুরু করেছি, যেদিন থেকে সময় কাটিয়েছি তোমার সাথে..সবকিছু, তোমাকে প্রেজেন্ট হিসেবে দিতে চেয়েছিলাম পরে ভাবলাম এটা না হয় বিয়ের পর দেবো..তোমার ওয়েডিং প্রেজেন্ট আমার তরফ থেকে..ভালো লেগেছে তো?”

আমি আর উনি মুখোমুখি বসেছিলাম, সঙ্গে সঙ্গে উঠে ওনাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম আমি

“থ্যাংক ইউ আরমান..আমার কাছে এটাই সেরা উপহার, থ্যাংক আমার জীবনে আসার জন্যে! আমাকে ভালবাসার জন্যে!”

আরমান ও আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে নিলেন নিজের সাথে

“ধন্যবাদ তো তোমাকে আমি দেবো! তোমার মতো একটা পাগলী যদি আমার লাইফে না আসতো তাহলে তো ভালোবাসার মানেই বুঝতাম না, তারপর বাবা আমাকে ধরে যেইসেই মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে দিতো”

“দিলেই বা কি হতো? আমার মত তোমাকে কোনো মেয়ে সামলাতে পারতো না বুঝলে?”

“তাই নাকি? কিন্তু তুমি তো আমাকে এখনও সামলানো শুরুই করলে না, তার আগেই এতো কনফিডেন্স? আমাকে সত্যিই সামলাতে পারবে তো?”

ওনার কথায় দুষ্টুমির মাত্রা বুঝে আস্তে করে দুটো কিল মারলাম ওনার পিঠের ওপর, লোকটা এত্তো বেহায়া কেনো? হঠাৎ একটা আওয়াজ হলো,তাকিয়ে দেখলাম আমাদের সহ সামনের সব বাড়িঘর অন্ধকার হয়ে গেছে

“একি! কারেন্ট চলে গেলো নাকি?”

আরমান উঠে দাড়িয়ে ভালোভাবে সামনে দেখলেন, তারপর হুট করেই আমাকে কোলে তুলে নিলেন

“কি হলো?”

“হয়নি, এবার হবে..কারেন্ট চলে গেছে দেখছো না? ইটস আ সাইন! আমাদের বাসর তো আজকে! তাই কারেন্ট নিজেই চলে গেলো.. আর কষ্ট করে লাইট বন্ধ করতে হবে না”

লজ্জা পেয়ে ওনার বুকে মুখ লুকালাম আমি, এতদিন ধরে ওনার সাথে সম্পর্ক তবে লজ্জাটা যে এখনও কাটিয়ে উঠতে পারিনি আমি এখনও! হয়তো কোনোদিন পারবো ও না..উনি আমায় বিছানায় নিয়ে এলেন, রুমটা একদম অন্ধকার নয়, নীল রঙের ড্রিম লাইট আছে ওনার রুমে, সেগুলো অন্ধকার ঘরে জ্বলন্ত বলেই মনে হচ্ছে..উনি আমার ওপর ঝুঁকে আমার কপালে নিজের ঠোঁটজোড়া ছুঁইয়ে দিলেন, হাল্কা কেপে উঠলাম আমি, চোখ বন্ধ করে নিলাম..উনি ফিসফিসিয়ে বলে উঠলেন

“শোনো, ফার্স্ট ম্যারেজ অ্যানিভার্সারিতে আমার একটা ছোট্ট রুহি চাই, দেবে..?”

চোখ বন্ধ অবস্থাতেই মুচকি হেসে হ্যা সূচক মাথা নাড়লাম আমি, সঙ্গে সঙ্গে নিজের ঠোঁটে ওনার ঠোঁটের গভীর ছোঁয়া পেলাম, বুঝলাম এবার উনি আমার ছাড় নেই..আলতো করে আমিও ওনার গলা জড়িয়ে ধরলাম..একটু একটু করে দুজনেই ডুব দিলাম ভালোবাসাময় পূর্ণতার গভীর সাগরে..!!

____ সমাপ্ত ____