উইন্টার এন্ড মাই সনেট পর্ব-০১

0
1

#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-০১ ||

০১।
দশ তলা ভবনের ছাদের রেলিংয়ে ঝুলছে আবরার। রেলিং আঁকড়ে ধরে আছে সে। হাত ফসকে যাবে এমন অবস্থায় তার দিকে এগিয়ে এলো একটি হাত। আবরার ভীত দৃষ্টিতে তাকালো সেই হাতের দিকে। সূর্য হেলে পড়ছে পশ্চিম দিগন্তে। আকাশে রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়েছে। কোলাহলময় শহর শান্ত হবে এমন মুহূর্তেই গগনবিদারী আর্তনাদ শুনে আহনাফের হাত থেকে পড়ে গেলো একটি বাক্স। মুহূর্তেই যেন তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেলো। নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে কয়েক পা এগিয়ে যেতেই তার দু’পা অসাড় হয়ে এলো। ধপ করে মাটিতে বসে পড়লো আহনাফ। হঠাৎ-ই এক নারী কণ্ঠের আর্তনাদ তার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। আর্তনাদের সাথে ভারী হয়ে আসছে আহনাফের বুক। আশেপাশের মসজিদ থেকে ভেসে আসছে আযানের ধ্বনি। আযানের ধ্বনির সাথে সাথে বাড়ছে ভীড়ও। তখনই নারী কন্ঠটি চিৎকার করে বলে উঠল,
“আজ তোমার জন্য আবরারের এই অবস্থা। তুমি এর জন্য দায়ী।”

আহনাফ চোখ তুলে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির দিকে তাকালো। মুহূর্তেই শক্ত হয়ে এলো তার চোয়াল। হাত মুঠো করে মাটিতে সজোরে আঘাত করে চেঁচিয়ে উঠলো সে। এক অস্তগামী সূর্য মুহূর্তেই নিভিয়ে দিয়ে গেলো আহনাফের উৎফুল্ল প্রাণ।

(***)

পাঁচ বছর পর…….

ব্যস্ত রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে অরুণিকা। তীব্র হর্ণের শব্দ তুলে সাঁই সাঁই করে একের পর এক চলে যাওয়া গাড়ির গতি দেখে হাত-পা ভীষণভাবে কাঁপছে তার। চোখের সামনে আবছা আবছা ভাসছে অতীতের সেই ভয়ংকর মুহূর্তটি। আজ পাশে রুদবা নেই। ভীষণ জ্বর তার। তাই সে বেরুতে পারে নি বাসা থেকে। রুদবাকে ছাড়া অরুণিকার এক মুহূর্তও চলে না। ব্যস্ত শহরে অরুণিকার লাঠি রুদবা। প্রিয় বান্ধবীও বটে। একই সাথে তাদের স্কুল-কলেজের সমাপ্তি। এখন একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে যাচ্ছে। আজ ভর্তির শেষ তারিখ। রুদবাকে তার বাবা ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। কিন্তু অরুণিকার দায়িত্ব কে নেবে? আপন বলতে অরুণিকার তো মামায় আছে। মামাও দেশে থাকেন না। প্রবাসী মামার সংসারে অরুণিকা বড্ড অসহায়। মামী তাকে খুব একটা পছন্দ করেন না। আবার অপছন্দও করেন না। মাঝে-মধ্যে একটু-আধটু কথা শুনিয়ে দেন, সেটাই গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। কতোবার সেই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছিলো, কিন্তু যাওয়ার সব পথই তো বন্ধ হয়ে গেছে। তবে তার মানসিক শক্তি তার মামাতো বোন রুহানি। মায়ের বকুনি থেকে প্রায়ই অরুণিকাকে বাঁচায় সে।
অরুণিকার মারাত্মক ফোবিয়া আছে। একই সাথে পেডোনফোবিয়া ও ম্যাক্রোফোবিয়ায় আক্রান্ত সে। না সে একা রাস্তা পার হতে পারে, না সে চলন্ত গাড়ি দেখে নিজেরকে স্থির রাখতে পারে। বাস ছাড়া ছোট গাড়িতে যাতায়াত করতে তার ভীষণ অসুবিধা হয়। তাও পাশে পরিচিত কেউ থাকলে সেই যাত্রায় সে নিশ্চিন্তে থাকে। রুদবা আর রুহানিকে ছাড়া সে খুব একটা বের হয় না। বের হলেও গলি পর্যন্তই তার সীমাবদ্ধ যাত্রা। কিন্তু আজ সে একাই বের হয়েছে। রুহানি সাথে আসতে চেয়েছিলো, কিন্তু মামী কড়া কথা শুনিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছেন,
“গেলে তুমি একাই যাও। নয়তো পড়াশুনা ছেড়ে রুম বন্ধ করে বসে থাকো। আমার মেয়ে তোমার বডিগার্ড না যে পিছু পিছু দৌঁড়াবে। পড়াশুনার শখ বেশি হলে, যাও বের হও একা। মরে গেলেও আমাদের সমস্যা নেই। তোমার জন্য অশ্রু ফেলার কেউ এখানে বসে নেই।”

গলি ফেলে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় দশমিনিট। গাড়ি যাচ্ছে, আসছে। অরুণিকার সাহস হচ্ছে না রাস্তা পার হওয়ার। শ্বাস বন্ধ হওয়ার জোগাড়। চোখের সামনে এলোমেলো অতীতের মুহূর্ত। অরুণিকা চোখ বন্ধ করলো। পা বাড়ালো হাত মুঠো করো।

বড় সড়ক। বাসের আনাগোনা হয় এই পথে। অর্ধেক পথ গিয়েই হর্নের শব্দে চোখ খুললো অরুণিকা। পাশ ফিরে দেখলো বাস আসছে দ্রুত গতিতে। সে চাইলেই পথটা পার হতে পারে। কিন্তু বাস দেখে শরীরটাই অসার হয়ে এলো তার। আশেপাশের মানুষদের দৃষ্টি অরুণিকার দিকে আঁটকে গেলো। সবাই ভেবে নিলো, মেয়েটা হয়তো আত্মহত্যা করতেই রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। সবার চেঁচামেচিতে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে তার। মনে হচ্ছে তার শরীর এখনই ঢলে পড়বে। বাস ড্রাইভার এতোটাও গতি বাড়ান নি। অশ্রাব্য গালি-গালাজ করতে করতে গতি কমানো শুরু করেছেন। কিন্তু অরুণিকা সরে না গেলে অন্তত একটা ধাক্কা তো খাবেই। এদিকে অরুণিকা চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ সে কোমড়ে শক্ত চাপ অনুভব করলো। মুহূর্তেই কেউ একজন তাকে হেঁচকা টানে কোথাও যেন বসিয়ে দিয়েছে। অরুণিকা খামচে ধরলো শক্ত একটি বাহু। মিষ্টি পারফিউমের ঘ্রাণ নাকে এসে ঠেকলো তার। ঝাঁকুনি খেয়ে অরুণিকা চোখ খুললো। সামনে তাকিয়ে দেখলো হেলমেট পরা এক যুবক। ভীত দৃষ্টিতে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো, সে মোটরসাইকেলের উপর বসে আছে। অবাক কন্ঠে অরুণিকা হেলমেট পরা যুবকটিকে জিজ্ঞেস করলো,
“আমি তো রাস্তায় ছিলাম, বাইকে উঠলাম কীভাবে?”

হেলমেট পরা যুবকটি কোনো উত্তর দিলো না। আশেপাশের মানুষগুলো হইচই বাঁধিয়ে দিয়েছে। একটা মেয়ে আত্মহত্যা করতে গিয়েও পারে নি, এই আনন্দে তারা রাস্তা পার হয়ে অরুণিকার দিকেই আসছে সেই মেয়েটিকে ধোলাই করতে। অরুণিকা তাদের দেখে হেলমেট পরা যুবকটিকে উদ্দেশ্য করে আবার জিজ্ঞেস করলো,
“এরা আমার দিকে এভাবে তেড়ে আসছে কেন?”

হেলমেট পরা যুবকটি পেছনে তাকালো। এরপর অরুণিকার দিকে ফিরে বুকে হাত গুঁজে বসে রইলো। অরুণিকা নেমে পড়লো মোটর সাইকেল থেকে। এদিকে লোকগুলো এসে অরুণিকাকে কিছু বলতে যাবে, তখনই আরো দু’টো মোটর সাইকেল এসে থামলো লোকগুলোর সামনে। তারা কি যেন বললো লোকগুলোকে। এরপর লোকগুলো অরুণিকার দিকে তাকাতে তাকাতে চলে গেলো। অরুণিকা হাঁ করে এদের কান্ড দেখছে। লোকগুলো চলে যেতেই মোটরসাইকেল দু’টি চলে গেলো অন্য রাস্তায়। অরুণিকার কাছে তাজ্জব লাগছে এসব। সে হেলমেট পরা যুবকটিকে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি আমাকে রাস্তা পার করিয়ে দিয়েছেন, তাই থ্যাংক ইউ সো মাচ। আমি আসলে মরার জন্য দাঁড়াই নি। আমার একটু ফোবিয়া আছে।”

হেলমেট পরা যুবকটি সেই আগের ভঙ্গিতেই বুকে হাত গুঁজে বসে আছে। অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে তাকালো যুবকটির দিকে। মনে মনে ভাবলো,
“ইনি কি আমার দিকে তাকিয়ে আছে, না-কি অন্যদিকে?”

অরুণিকা হেলমেটের গ্লাসে ঠোকা দিয়ে বলল,
“শুনছেন?”

যুবকটি এবার নড়ে-চড়ে বসলো। অরুণিকা কয়েক পা পিছিয়ে গেলো। ভাবলো এবার কিছু বলবে। কিন্তু না, ছেলেটা তো কিছু না বলে মোটরসাইকেল ঘুরিয়ে চলে গেলো। অরুণিকা অবাক কন্ঠে বলল,
“তাজ্জব লোক তো! কি হলো কিছুই বুঝলাম না। লোকটা কি মাইন্ড করলো না-কি?”

অরুণিকা এবার আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আল্লাহ, তুমি তো জানো আমি ইচ্ছে করে এমন করি নি। আমার জীবন আমার কাছে অনেক প্রিয়। যেই জীবনটা বাঁচানোর জন্য আমার কাছের মানুষ আমার পাশে নেই, সেই জীবনকে আমি কি করে ফেলনা ভাবি?”

(***)

ভর্তির কাজ সেরে ক্যাম্পাসের অফিস রুম থেকে বেরুতেই থমকে দাঁড়ালো অরুণিকা। তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে কালো টি-শার্ট পরা এক ছেলে। চোখে ছাই রঙের সানগ্লাস, হাতে বেল্ট, আঙ্গুলে রূপার আংটি। অরুণিকা আপাদমস্তক ছেলেটিকে দেখে পাশ কেটে সামনে চলে গেলো। এরপর সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলো ধপধপিয়ে। ওদিকে সেই ছেলেটি তার ছাই রঙের সানগ্লাসটি হালকা নামিয়ে নাকের ডগায় রাখতেই তার ধূসর বর্ণের চোখ দু’টি দৃশ্যমান হলো। আর ঠোঁটে ফুটে উঠলো বাঁকা হাসি।

অরুণিকা ক্যাম্পাস থেকে বেরুতেই একটা রিকশা এসে থামলো তার সামনে। অরুণিকা কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই রিকশাওয়ালা বলল,
“আফা, উইঠা পড়েন।”

অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আপনি কি জানেন আমার বাসা কোথায়?”

“হ আফা, জানি তো। মুহাম্মদপুর যাইবেন আফনে।”

অরুণিকা অবাক হলো বেশ। সংশয় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি কীভাবে জানলেন?”

রিকশাওয়ালা পেছন ফিরে বলল,
“আরেহ ওদিকটাই তো ছিলো ভাইজানটা।”

“কোন ভাইজান আবার?”

“যেই ভাইজান আমারে ঠিক কইরা ভাড়া দিয়া কইলো আপনারে মুহাম্মদপুর মাজার গেট নামাইয়া দিয়া আসতে।”

অরুণিকা এদিক-ওদিক তাকিয়ে খুঁজতে লাগলো সেই মানুষটিকে। বেশ আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কে সে? আপনি দেখেছেন তাকে?”

“মোটর বাইকে বইসা ছিল। হেলমেট পরা ছিল। মুখ তো দেহি নাই। এহন উইঠা পড়েন। আপনারে নামায়, আরেক জায়গায় ভাড়া নিতে যামু।”

অরুণিকা আশেপাশে তাকালো। রাস্তায় একটাও রিকশা নেই। আছে তো সব মোড়ের মাথায়। এই মুহূর্তে মোড়ে যেতে হলে তাকে আবার রাস্তা পার হতে হবে, যা অরুণিকার কাছে দুঃসাহসিক কাজ। রিকশার সিটের দিকে তাকিয়ে শেষ বার এদিক-ওদিক চোখ বুলিয়ে নিলো সে। হুট করেই কেন যেন তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো সেই আগন্তুককে, যে রিকশাটা ঠিক করে দিয়েছে। মনে একগাদা কৌতুহল রেখেই রিকশায় উঠে বসলো অরুণিকা। ক্যাম্পাসের পথ ফেলে রিকশাও চলে গেলো অন্য রাস্তায়। তবুও এক জোড়া চোখ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাস্তার মোড়ের দিকে। রাস্তায় গাড়ির আনাগোনা আছে বেশ, শুধু দেখা যাচ্ছে না অরুণিকাকে বহন করা সেই রিকশাটি। এরপর মিনিট খানিক স্থির হয়ে থাকা সেই দৃষ্টি আড়াল হয়ে গেলো কালো হেলমেটের গ্লাসের পেছনে।

(***)

রুহানি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে অরুণিকার দিকে। বাইরে যাওয়ার পর থেকে বাসায় ঢুকা অব্ধি যা যা ঘটেছে তার পুরোটাই রুহানিকে বললো অরুণিকা। রুহানি সব শুনে গালে হাত দিয়ে অরুণিকার দিকে ঝুঁকে বলল,
“ওয়াও অরু, মনে হচ্ছে আমি সিনেমার শুটিং মিস করেছি। এমনও কি হয়?”

অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“ন্যাকামি করিস না তো। তুই নিজে বিষয়টা ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখ, সত্যিই বিষয়টা অদ্ভুত না? সকালে না হয় কেউ একজন আমাকে বাঁচিয়েছে। কিন্তু এভাবে কোনো এক আগন্তুক এসে আমার জন্য রিকশা ঠিক করে দিলো, এমনকি ভাড়াটাও দিয়ে দিলো?”

রুহানি অতি উৎসাহ নিয়ে বলতে লাগলো,
“ফাইনালি তোর জীবনে হিরো এসে গেছে। এবার তোর বিয়ে হবে। আর আমি তোর বিয়েতে সাজবো, নাচবো। আর সেখানেই কেউ আমার প্রেমে পড়ে আমাকে বিয়ে করে নেবে।”

রুহানি পা দাপিয়ে অরুণিকার হাত ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে আনন্দিত কন্ঠে বলল, “অরু, তাড়াতাড়ি বিয়ে কর, বোন।”

অরুণিকা রুহানির মাথায় গাট্টা মেরে বলল,
“এসব ক্লুলেস চিন্তা বাদ দিয়ে পড়ালেখা কর। ইন্টারে ফেইল করেছিস তুই। তোকে কে সায়েন্স নিয়ে পড়তে বলেছে, বল তো? সায়েন্স নিলে একটু সিরিয়াস হতে হয়।”

রুহানি মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“ধুর, এসব পড়ালেখা-টরালেখা আমার দ্বারা হবে না। আমি তো বিয়ে করবো। ব্যস এটাই আমার ড্রিম।”

রুহানি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,
“আর তুই চিন্তা করিস না। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা আশীর্বাদ। এবার অন্তত বিয়ে-টিয়ে করলে আম্মুর ঘ্যানঘ্যানানি থেকে মুক্তি পাবি। দেখিস কিন্তু, তোর শাউড়ী পরিবার বেশ ভালো হবে। লোকে বলে, বাপের বাড়িতে অশান্তি হলে না-কি স্বামীর বাড়িতে সুখ।”

অরুণিকা ক্ষীণ হেসে বলল,
“অশান্তির জন্য যেই বাড়ি দরকার সেটা তো আর বাপের নয়, মামার বাড়ি। তাই লোকে বলা কথা, আমার সাথে খাটবে কি-না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।”

চলবে—