#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-৪৩ ||
রুহানি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে আরাফের সামনে। আরাফ হুংকার ছেড়ে বলল, “এন্সার মি, ডেম ইট।”
রুহানি কেঁপে উঠলো আরাফের চিৎকারে। তার চোখ বেয়ে দরদর করে জল গড়িয়ে পড়ছে। আরাফ নিজের চুল নিজেই খামচে ধরলো। পরমুহূর্তে রুহানির দিকে ঝুঁকে এসে দাঁতে দাঁত পিষে বলল, “তুমি আহনাফের ফোন ধরেছো কি-না বলো!”
রুহানি না সূচক মাথা নাড়লো। আরাফ রুহানির দু’বাহু চেপে ধরে বলল, “তোমার মতো বোকা না আমি। মানুষের চোখ দেখলেই বুঝতে পারি, সে সত্য বলছে না-কি মিথ্যা।”
রুহানি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো আরাফের দিকে। আরাফ তার গাল চেপে ধরে বলল, “তুমি আহনাফের ফোন কেন নিয়েছো?”
রুহানি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। আরাফ এবার রুহানির কোমড় চেপে তাকে নিজের কাছে টেনে এনে বলল, “ওর ফোনের পাসওয়ার্ড কীভাবে জানলে তুমি?”
রুহানি কাঁপা কন্ঠে বলল, “আপনি শুধু শুধু আমাকে কেন এসব প্রশ্ন করছেন?”
“কারণ তুমিই এই কাজ করেছো। ভিডিওটা তুমি করেছো, তাই না? বলো!”
রুহানি আমতা আমতা করে বলল, “না। আমি করি নি।”
“আহনাফ ইউনিভার্সিটির লেকচারার। অরুণিকা ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট। ডিভোর্সের স্পেলিং মিস্টেক ওরা তো অন্তত করবে না। তুমি ছাড়া আর কে করবে এই কাজ?”
রুহানি চোখ বড় বড় করে আরাফের দিকে তাকিয়ে রইলো। আরাফ রুহানির চুল টেনে ধরে বলল, “এডমিট করো নয়তো আমি তোমাকে এখানেই খুন করবো।”
রুহানি শব্দ করে কেঁদে উঠলো। অরুণিকা রুমে ঢুকে এই দৃশ্য দেখে দ্রুত আরাফের হাত থেকে রুহানিকে ছাড়িয়ে নিলো। আরাফ অরুণিকার হাত চেপে ধরে বলল, “তোর বোনই আহনাফকে ফাঁসিয়েছে।”
অরুণিকার চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গেল। আরাফ পুনরায় বলল, “আহনাফের একাউন্ট থেকে যেই মেসেজ তোর ফোনে এসেছে, ওটা আরেকবার চেক কর। ডিভোর্স ওয়ার্ডটা দেখ। স্পেলিং মিস্টেক করেছে। আহনাফ এই ভুল করবে তোর মনে হয়? আহনাফ এতো বাজে টাইপিং করে না।”
অরুণিকা কপাল চেপে ধরে রুহানির দিকে তাকালো। রুহানি ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, “সরি, অরু।”
অরুণিকা রুহানির হাত ধরে তাকে আশ্বস্ত করলো। এরপর আরাফের দিকে ফিরে ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “রুহানির কোনো দোষ নেই, আরাফ। আমিই বলেছি ওকে এই কাজ করতে।”
আরাফ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো অরুণিকার দিকে। অরুণিকা পুনরায় বলল, “আহনাফের পাসওয়ার্ড দেখে নিয়েছিলাম আমি। বিয়ের সেন্টার থেকে এসে আহনাফ ওয়াশরুমে ঢুকতেই, ওর ফোনটা আমিই নিয়ে এসেছি। এরপর রুহানিকে দিয়ে ভিডিও করিয়েছি। রুহানিকেও বলে দিয়েছি কি টাইপ করতে হবে। ও ভিডিওটা আহনাফের একাউন্ট থেকে আমার একাউন্টে সেন্ড করেছিল। আর আমি যা বলে রেখেছিলাম, ও তা টাইপ করেছিল। ও যে মিস্টেক করবে এটা আমি বুঝতে পারি নি। আর এরপর আমি যখন মেসেজ দেখে কান্না করছিলাম, আহনাফ কান্নার শব্দ পেয়ে রুম থেকে বের হয়ে আসে। আর রুহানি সেই সুযোগে আবার আহনাফের রুমে গিয়ে ফোনটা রেখে আসে৷ তারপর আহনাফ নিজেই আমাকে ওর রুমে নিয়ে যায়। আমি গাড়ির হর্ন শুনতে পেয়েই বুঝেছি, বিয়ের সেন্টার থেকে কেউ না কেউ ফিরেছে। তাই চেঁচামেচি শুরু করি। বাকিটা তোমাদের সামনে।”
আরাফ কাতর কন্ঠে বলল, “কেন করেছিস এই কাজ?”
“রিভেঞ্জ নিয়েছি। আমার সাথে হওয়া অন্যায়ের জবাব দিয়েছি।”
“পাগল তুই? ভিডিওটা যদি অন্য কেউ দেখে ফেলতো?”
“আমার ভিডিও, আমার রেস্পন্সিবিলিটি। দাদির হাতে দিয়েছি আমি। উনি কি যে কাউকে দেখতে দেবে? এতোটাও বোকা না আমি।”
আরাফের চোখ ছলছল করে উঠলো। সে চশমা খুলে অরুণিকার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। রুহানি অবাক হয়ে গেল আরাফের আচরণে। সে মুখ চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইলো একপাশে। এদিকে অরুণিকা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আরাফ হাতজোড় করে বলল, “ওকে মাফ করে দে, অরু। ও তোকে ভালোবাসে।”
অরুণিকা মাথা নেড়ে বলল, “তোমার ভাই আমাকে মাফ করেছিল?”
“ও অসুস্থ। এভাবে আঘাত করিস না ওকে।”
“সিরিয়াসলি? তোমার এতো মায়া ওর প্রতি? আমিও তো তোমার বোন। আমার সাথে যা হয়েছে, তার কোনো শাস্তিই ডিজার্ভ করে না ও?”
“ও নিজের কন্ট্রোলে ছিল না তখন।”
অরুণিকা শব্দ করে হাসলো। বলল, “আমি না আসলে তোমাদের কেউ না। তুমি, তাহমিদ ওই আহনাফকেই বেশি ভালোবাসে। আমি যদি তোমার আপন বোন হতাম, তখন তুমি আমার সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে। আমি তো অনাথ। আমার তো কেউ নেই। আমার বাবা বেঁচে থাকলে পাঁচ বছর আগে আমাকে কেউ আমার বাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে কেউ বের করে দিতে পারতো না।”
আরাফ অরুণিকার হাত ধরে বলল, “তোকে আবার নিয়ে যাবো ওই বাড়ি।”
আরাফের হাত এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে অরুণিকা বলল, “জাস্ট শাট আপ। আমার জায়গায় থাকলে আমার কষ্ট বোঝার ক্ষমতা থাকতো তোমাদের। তোমরা তো সবাই স্বার্থপর।”
“আহনাফ তোকে ভালোবাসে।”
“আমার ওর ভালোবাসা লাগবেই না। ওর ভালোবাসা ওর কাছেই রাখুক ও। ও আমাকে চিট করেছে। ইভানের সামনে বলেছে, আমার চরিত্র নষ্ট। বাসার সবাই বলেছিল, আমি এতো জঘন্য যে তোমাদের দিকেও আমার খারাপ নজর আছে। আমি তো তোমাদের ভাইয়ের জায়গা দিয়েছি। আজ এসে আহনাফের সাফাই গাইছো! সেদিন আমার সাফাই তো কেউ গাও নি। মুখে তো সবার আঠা লেগে গিয়েছিল। আজ তুমি প্রমাণ করে দিয়েছো, আমি অনাথ। বাবা নেই, তাই যেদিকে ইচ্ছে নাচাবে আমাকে? কখনো না, মিস্টার আরাফ চৌধুরী। তোমাদের সামনে আর ঝুঁকবো না আমি।”
অরুণিকা কথাগুলো বলেই কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে পড়লো। আরাফ নিজেও দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে নীরবে চোখের জল ফেলছে। রুহানি এসব দেখে কাকে সান্ত্বনা দেবে বুঝতেই পারছে না। আরাফের অশ্রু সহ্য করতে পারছে না রুহানি। অরুণিকার চোখের জলও দেখতে পারছে না। রুহানি অরুণিকার হাত ধরে তার পাশে বসে পড়লো। অরুণিকা ভেজা কন্ঠে বলল, “তোর স্যারকে বল, সবাইকে সত্যটা জানিয়ে দিতে। আমি তো চরিত্রহীন। এখন সবাই জানবে নিজের হাসবেন্ডকেও ফাঁসিয়েছি আমি। এরপর কি হবে জানিস? চৌধুরী সাহেব আমাকেই ত্যাজ্য করবেন। আহনাফের বাবা আমাকে যাচ্ছেতাই শোনাবেন। মিসেস চৌধুরী আমাকে তাড়িয়ে দেবেন। এক সপ্তাহ খেতে দেই নি আমাকে এরা। আমি ষোলো বছরের মেয়ে ছিলাম। এরাই আমার চাইল্ডহুড ট্রমা। আমি একটা টক্সিক পরিবেশে বেড়ে উঠেছি শুধুমাত্র এদের জন্য। আর এরা এখন আবার আমার লাইফ আগামী পাঁচ বছরের জন্যও সিল করে দেবে। এদের টার্গেট আমিই হই। আহনাফ যাই করুক, ওর সাত খুন মাফ। কিন্তু এর চেয়ে কম ভুলের শাস্তি দিয়েছে এরা আমাকে। আমাকে বাড়ি ছাড়া করেছে। কারণ আমি মেয়ে। আমি ওদের জন্য অভিশাপ! আর আহনাফ তো ওদের জন্য রাজপুত্র। আই জাস্ট হেইট দেম। আই হেইট ইউ এলসৌ।”
শেষ বাক্যটি আরাফের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল অরুণিকা। আরাফ অরুণিকার কাছে এসে তার দু’হাত টেনে নিয়ে বলল, “আমরা তোকে অনেক ভালোবাসি, অরু। আহনাফ যা করেছিল তার জন্য চাচ্চু ওকে বকেছে। দাদাভাই এখনো ওর সাথে কথা বলে না। কিন্তু তুই তো এর চেয়ে ভয়ংকর কাজ করলি, অরু। সেদিন যা হয়েছিল, আহনাফ জাস্ট অস্বীকার করেছে যে ও তোকে ভালোবাসে। কিন্তু ডাইরেক্টলি তোকে ক্যারেক্টারলেস বলে নি। প্রতিবারই ও একই কাজ করেছিল। ভেবে দেখ, তুই তখন ওর রুমে গিয়েছিলি, ও সবাইকে বলেছে তুই এসেছিস এটা ও জানেই না। সবাইকে বলেছে, তোকে ভালোবাসে না। পরেরবারও একই কাজ করেছে। কিন্তু তুই সরাসরি ওকে ফাঁসিয়ে দিয়েছিস। তাও আবার খুব সেন্সটিভ বিষয়ে। এই কথা পাঁচ কান হলে ওর ক্যারিয়ার নষ্ট হয়ে যাবে, অরু। ওর ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাবে।”
অরুণিকা হতাশ কন্ঠে বললো, “তুমি এখনো ওকে ডিফেন্ড করছো? আ’র ইউ সিরিয়াস, আরাফ? আমার সাথে যা হয়েছে এটাকে নরমালাইজ করছো তুমি? আমার যে গত পাঁচ বছর ধরে নিজের কাছে নিজেকে ছোট মনে হয়েছে, এটার কি কোনো সমাধান নেই? তুমি এটাকেও নরমালাইজ করবে? তুমি তো বায়াসড। তুমি আহনাফের পক্ষে। শোনো, তুমি আমার ভাই না। তুমি আমার কেউ না। আমার তোমাদের কাউকে লাগবে না।”
আরাফ মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। নিজেকে শান্ত করে আরাফ বলল, “অরু, আহনাফ অসুস্থ। ও পাঁচ বছর আগে যা করেছে ওর নিজের ইচ্ছায় করে নি। চাচী ওকে বাধ্য করেছিল।”
অরুণিকা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “আমাকেও এবার আমার আত্মা বাধ্য করেছে। এন্সার পেয়েছো? যাও এখন।”
অরুণিকা আরাফকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতেই রুহানি অরুণিকার হাত ধরে বলল, “এমন করিস না, অরু। স্যার তোকে ভালোবাসে। উনি তো তোর ভালো চাইবে। একবার শোন উনি কি বলে!”
আরাফ বলল, “অরু, আহনাফ…..”
অরুণিকা কানে হাত দিয়ে বলল, “আহনাফ, আহনাফ, আহনাফ, বন্ধ করো এই আহনাফ নামটা নেওয়া। আই হেইট হিম। জাস্ট হেইট হিম। তোমার যদি আমার নাম খারাপ করার ইচ্ছা থাকে, তাহলে যাও, সবাইকে সব সত্য বলে দাও। বাট এখান থেকে বের হও অন্তত।”
আরাফকে ধাক্কা দিয়ে রুম থেকে বের করে দিল অরুণিকা। এরপর আরাফের মুখের উপর দরজা আটকে দিল। দরজা বেঁধেই অরুণিকা শব্দ করে কেঁদে উঠলো। রুহানি বলল, “স্যারের কথাটা তো শুনতি!”
অরুণিকা ভেজা কন্ঠে বললো, “এরা কেমন দেখেছিস! আমার সাথে যা হয়েছে নরমালাইজ করছে। আমার চাইল্ডহুড নষ্ট করে, আমাকে স্কুল ছাড়া করে, আমাকে জেলে পাঠিয়েছে, আমাকে ক্যারেক্টরলেস বানিয়েছে, এখন এসব নরমালাইজ করছে। আমার বাবা বেঁচে থাকলে কি এদের সাহস ছিল আমাকে এই অবস্থায় আনার? আজও আমি মামীর খোঁচা শুনে ওই বাসায় পড়ে আছি। এদিকে আমার খালি ফ্ল্যাট পড়ে আছে, অথচ আমার কোনো আশ্রয় নেই। এরা আমার দায়িত্ব পর্যন্ত নেয় নি। আমাকে সেলসগার্লের কাজ করতে হচ্ছে। আহনাফের এক একটা ঘড়ির দাম হাজার হাজার টাকা। আমার এক বেলা ভাত খেতেও মামীর খোঁচা শুনতে হয়। কীভাবে আমার লাইফ নরমালাইজ করে এরা? আজ যা হয়েছে, দেখিস তুই, এরা আহনাফকে বাড়ি ছাড়া করবে না। জেলও খাটাবে না। আহনাফকে একবেলা ভাত দেওয়ার জন্য ওর ওই ষ্টুপিড মা বেঁচে আছে। আহনাফের নিজের জব আছে। নিজের টাকায় বাইক নিয়ে আরামসে শহরে ঘুরবে। এরপরও আমার ভাগ্য চেঞ্জ হবে না। কিন্তু আজ আমি সেটিস্ফাইড। আমার আত্মায় যে দিকিদিকি আগুন জ্বলেছিল, এতোদিনে সেটা নিভেছে। আমি আজ অনেক খুশি। একটা অনাথ মেয়ে যদি একদিন খুশি থাকে, ওদের এতো সমস্যা কীসের? কাল পরশু তো ওদের ছেলে ওদেরই হবে। ওদের বংশ তো আহনাফ। ওকে তো ওরা ফেলবে না। পুরুষ শাসিত সমাজ এটা। আমি মেয়ে, তাই আমার সাথে যাচ্ছেতাই করবে। দেখিস, আহনাফের কিছু হবে না। দেখে নিস তুই।”
(***)
বিছানায় হেলান দিয়ে নিশ্চল বসে আছে আহনাফ। শূন্যতা ছেয়ে গেছে তার চোখে-মুখে। শিরিন সুলতানা রুমে ঢুকে আহনাফের পাশে এসে বসলেন। আহনাফ মুখ ঘুরিয়ে নিতেই শিরিন সুলতানা বললেন, “তোকে কেউ বিশ্বাস করে নি, কিন্তু আমি জানি আমার ছেলে এমন করবে না। তুই তো মেয়েটাকে ভালোবাসতি। কিন্তু আমি মা। আমি জানি, মেয়েটা তোর জন্য ভালো না। এজন্যই তো তোকে বারবার সতর্ক করেছি। এভাবেই মেয়েটা আবরারকে মেরে তোকে ম্যানিপুলেট করেছিল। আর তুই আমাকেই প্রশ্ন করছিলি। মাকেই বিশ্বাস করতে পারছিলি না।”
আহনাফ শিরিন সুলতানার হাত ধরে অনুরোধের সুরে বলল, “আমাকে মুক্তি দাও, মা। আমি অরুকে ভালোবাসি। আমি ভালো-মন্দ বুঝি না। ও আমাকে কেন আঘাত করেছে? আমি ওর সাথে যা করেছি, ও তাই ফিরিয়ে দিয়েছে। এটাও বুঝতে পারছো না তুমি?”
“আর ও যে তোর ভাইকে মারলো?”
আহনাফ চেঁচিয়ে বলল, “আগে আমি বাঁচি। অরুকে ছাড়া তো আমিই বাঁচবো না।”
“এটা তোর মনে হচ্ছে। এজন্যই তোকে আমি মেডিসিনগুলো দিয়েছি। মেডিসিনগুলো তোর কষ্ট কমাবে, তুই আবেগী হয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিবি না।”
“আমি তো তোমার সব কথা শুনেছি। কিন্তু সেই মেডিসিন নিলে আমারই অনেক সমস্যা হয়।”
“এজন্যই তো জয়িতাকে বিয়ে করতে বলেছি। তোর সমস্যার একমাত্র সমাধান জয়িতা।”
“আমি অরুর জায়গা কাউকে দিতে পারবো না। আমার সমস্যার সমাধান কি অরু হতে পারে না?”
“ও তোকে ভালোবাসে না, বাবা।”
“আমি ওর মনে আবার জায়গা করে নেবো। অরু আমাকে আবার ভালোবাসবে।”
শিরিন সুলতানা রেগে উঠলেন। তিনি আহনাফের গালে চড় মেরে বললেন, “তুই আমার কথা শুনতে বাধ্য। আমি যা বলবো তাই শুনতে হবে তোকে।”
আহনাফ অসহায় দৃষ্টিতে শিরিন সুলতানার দিকে তাকিয়ে রইলো। শিরিন সুলতানা আহনাফের গাল চেপে ধরে বললেন, “সবাই তোকে ছি ছি করছে, তোর চাকরিটা যদি চলে যায়, তখন কীভাবে চলবি? অরু তোর কেউ না। আমি তোর মা। আমি তোর ভালো বুঝি। একবার আমার কথামতো চল। পাঁচ বছর আমার কথা মতোই চলেছিস, দম্ভের সাথে মাথা উঁচু করে ছিলি। আজ আমার কথার অমান্য তো সবার চোখে নগণ্য।”
আহনাফের চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তেই শিরিন সুলতানা আহনাফকে ছেড়ে দিয়ে মাথা চেপে ধরে বললেন, “মেয়েদের মতো জল গড়াবি না!”
আহনাফ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি অরুকে ভালোবাসি। ওকে আমার করে দাও, তারপর আমি তোমার সব কথা শুনবো। পাঁচ বছর ধরে তোমার কথা শুনেছি, তাই আমার অরু আজ আমাকে ঘৃণা করে। তোমার জন্য ও আমার হয়েও আমার নেই। তুমি আমাকে ভেঙে দিচ্ছো। ভেঙে দিচ্ছো তুমি আমাকে।”
শেষ বাক্যটি বলতে বলতেই আহনাফ উগ্র হয়ে উঠলো। আশেপাশের সব জিনিস ভাঙতে শুরু করলো। আওয়াজ শুনে সবাই একপ্রকার ছুটে এলো। আরাফ ও তাহমিদ আহনাফকে শান্ত করানোর চেষ্টা করছে। আহনাফ শিরিন সুলতানার দিকে আঙুল তাক করে বলল, “গেট লস্ট। *** চেহারাটাও আমি দেখতে চাই না।”
আহনাফ হুট করে গালি দিয়ে দেওয়ায় আমির চৌধুরী রেগে গেলেন। পাশ থেকে বেল্টটা নিয়ে আবার এগিয়ে এলেন। একপ্রকার ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে গেল বাবা-ছেলের মধ্যে। বড় চৌধুরী সাহেব মেঝেতে বসে পড়লেন এই দৃশ্য দেখে৷ মিসেস চৌধুরী স্বামীর পাশে বসে হা-হুতাশ করছেন। অরুণিকা রুম থেকে বেরিয়ে দেখলো আহনাফ তার বাবার উপর চড়াও হয়ে উঠেছে। আরাফ ও তাহমিদ কেউ তাদের থামাতে পারছে না। অরুণিকা দ্রুত তাদের মাঝে গিয়ে তাদের ছাড়িয়ে নিলো। আহনাফ অরুণিকাকে দেখে শান্ত হয়ে গেল মুহূর্তেই। আমির চৌধুরী কাতর কন্ঠে বললেন, “কেমন ছেলে জন্ম দিয়েছো, শিরিন? নিজের মাকে গালি দিয়েছে! এ তো নেশাখোরের মতো আচরণ করছে। নিজের বাবার উপর বল দেখাচ্ছে।”
আহনাফ অরুণিকার হাত ধরে তাকে কাছে টেনে নিতেই মিসেস চৌধুরী দ্রুত উঠে এসে অরুণিকাকে সরিয়ে দিয়ে বললেন, “অরুর দিকে চোখ তুলে তাকালে তোর চোখ তুলে নেবো আমি।”
আহনাফ আবার ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লো। হাতজোড় করে বলল, “সরি, বাবা। আমার হুঁশজ্ঞান ছিল না। সরি, মা। সরি।”
আরাফ আহনাফের পাশে বসে তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “ইটস ওকে।”
আহনাফ আরাফের দিকে কাতর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “আমি ভিডিওটা করি নি, আরাফ। জানি, কেউ বিশ্বাস করবি না আমাকে। আমি তো ভালোবাসি অরুকে। আমি ওর ভিডিও কীভাবে করবো বল?”
আরাফ অরুণিকার দিকে তাকালো। অরুণিকা চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, “আমাদের শহরে ফিরে যাওয়া উচিত। এখানে থাকলে শুধু শুধু আপনাদের নাক কাটবে।”
শিরিন সুলতানা রাগী স্বরে বললেন, “নাক কেটে গেছে। যা বদনাম হওয়ার হয়ে গেছে।”
“আর সেটার জন্য আপনার ছেলে দায়ী। তেরো বছর বয়সে একটা কান্ড বাঁধিয়ে বিয়ে করেছিল আমাকে। এরপর সবার সামনে আমার ক্যারেক্টারে আঙুল তুলেছিল। আর আজ!”
আহনাফ অরুণিকার দিকে কাতর দৃষ্টিতে তাকালো। অরুণিকা আহনাফের দিকে তাকিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল, “আল্লাহ বিচার করেছে। আমি যা করেছি, আজ একদিনে সব সত্য সামনে চলে এসেছে। আমার সাথে যা অন্যায় হয়েছে, তার বিচার হয়ে গেছে।”
আহনাফ শুকনো হেসে মাথা নাড়লো। অরুণিকা মিসেস চৌধুরীর সামনে এসে বলল, “আমি রুহানিকে নিয়ে চলে যাচ্ছি।”
মিসেস চৌধুরী ব্যস্ত কন্ঠে বললেন, “কিন্তু, এভাবে…”
অরুণিকা মিসেস চৌধুরীকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আমি এই পরিবেশে সেইফ ফিল করছি না। আমার বোনও এখানে সেইফ না।”
আমির চৌধুরী অরুণিকার কথায় চকিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন। অরুণিকা রুম থেকে বেরিয়ে যাবে তখনই তিনি অরুণিকার সামনে এসে হাতজোড় করে বললেন, “আমাকে ক্ষমা করে দে, মা। আমি তোকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আজ আমাদের কথা আমাদের কাছেই ফিরে এসেছে।”
অরুণিকা শুকনো হেসে বললেন, “অন্য কারো উপর আঙুল তোলা অনেক সহজ। নিজের দিকে কেউ তাকায় না। এমনিতেই আমি আপনাদের কাছ থেকে কিছুই আশা করি না। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর আমাকে আল্লাহ মানুষ চিনিয়ে দিয়েছে।”
অরুণিকার কথায় আরেফিন চৌধুরী এগিয়ে এসে বললেন, “এভাবে কেন বলছো, অরুণিকা? আমরা তোমার চাচা।”
“চাচা! বাবা তো নন। কখনো সেই জায়গা নেওয়াও সম্ভব না। আমার ভাগ্য খারাপ। আমাকে এই ভয়ংকর দুনিয়া দেখার জন্য ওরা আমাকে একা রেখে চলে গেছে।”
বড় চৌধুরী সাহেব অরুণিকাকে ডাকলেন। কিন্তু সে দাদার ডাকে সাড়া না দিয়ে চলে গেল।
(***)
অরুণিকা আর রুহানি বেরিয়ে পড়তেই তাওসিফ শাহরিয়ার তাহমিদকে বললেন, “তুই ওদের সাথে চলে যা। ওদের বাসায় নামিয়ে দিস। একা কীভাবে যাবে ওরা?”
তাহমিদও বাবার কথায় দ্রুত ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। রাত হতেই চৌধুরী বাড়ি শূন্য হয়ে গেল। রাত না হওয়া অব্ধি তারা কেউ বেরুলো না বাড়ি থেকে। গ্রামের লোকের মুখেমুখে রটে গেছে আহনাফের কুকীর্তি। তাই তারা দরজা সেঁটে বসে ছিলেন রাত না হওয়া অব্ধি। রাত হতেই তারা বেরিয়ে পড়লেন।
আরাফ আহনাফকে নিয়ে আলাদা গাড়িতে ফিরছে। আহনাফ হুটহাট খুব আক্রমণাত্মক আচরণ করছে। বড়-বুড়ো দেখছে না। আহনাফ এতোদিন নিজের মনমতো চলতে পেরেছিল, তাই তার উগ্রতা বোঝা যায় নি। আর আজ যখন তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে সব হচ্ছে, তখনই তার উগ্র আচরণ সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছে আহনাফের কোনো সমস্যা আছে। আরাফ ভাবছে, বাসায় ফিরেই সবাইকে বলে দেবে আহনাফ নেশায় আসক্ত। এভাবে আহনাফকে ছেড়ে দেওয়া কারো জন্যই ঠিক হবে না। আরাফ মনে মনে ভাবছে, “আহনাফকে দ্রুত সুস্থ করা না গেলে পরবর্তীতে ও জোর করে অরুণিকাকে নিজের করে নিতে চাইবে। তখন আরো ভয়ংকর কিছু ঘটবে। অরুকে কখনো আহনাফের সিচুয়েশন বোঝাতে পারবো না আমি। অরু আহনাফকে নেগেটিভ হিসেবে ধরে নিয়েছে। আর নেগেটিভ ক্যারেক্টর সহজে পজিটিভ হয় না।”
(***)
এক সপ্তাহ পর।
ঘড়িতে বিকেল চারটা। অরুণিকা আজ ক্যাম্পাস থেকে দেরিতে ফিরেছে। মাথা ঘোরাচ্ছে ভীষণ। ইমানের মোটর সাইকেলের পেছনে বসে এসেছে সে। বাসার সামনে নেমে শুকনো ধন্যবাদ দিয়ে গেটে ঢুকতেই শরীর অবশ হয়ে এলো তার। কয়েক পা এগুতেই ভারসাম্য হারিয়ে ভার ছেড়ে দিতেই পিঠে কারো স্পর্শ অনুভব করলো অরুণিকা। শক্ত একটা বুকে তার মাথাটা আশ্রয় পেয়েছে। নিভু নিভু দৃষ্টিতে সামনে তাকাতেই অন্ধকার নেমে এলো চোখে। চোখ খুলতেই নিজেকে আহনাফের রুমে আবিষ্কার করলো সে। পাশ ফিরে দেখলো তার হাতে স্যালাইন লাগানো। একপাশে আরাফ, অন্যপাশে ইভান বসে আছে। অরুণিকার জ্ঞান ফিরতেই আরাফ তার কপালে হাত রেখে বলল, “না খেয়ে কি অবস্থা করেছিস? তোর শরীর কতো দুর্বল জানিস?”
অরুণিকা সোজা হয়ে বসে বলল, “কি হয়েছে আমার?”
“দুর্বলতার কারণে এই অবস্থা! খাওয়া-দাওয়া করিস না?”
“ক্লাস, টিউশন, দোকান সব সামলাতে গিয়ে এই অবস্থা!”
“এতো কিছু করার কি দরকার?”
অরুণিকা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “তোমার ভাই শনি বাঁধিয়ে দিয়েছে আমার কপালে। মামী আমাকে এখন হাত খরচ দেন না। নিজের টাকা নিজেকেই জোগাড় করতে হয়।”
ইভান বলল, “আমি তোমার টিউশন ফিস দিয়ে দেবো।”
“এক্সকিউজ মি, আমার আপনাদের দয়া লাগবে না।”
“আমি তোমার ভাইয়ের মতো।”
“আমার কোনো ভাই নেই। আমি আমার জন্য যথেষ্ট।”
আহনাফ রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে অরুণিকার কথা শুনছে। সামনে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। তূর্য ইশারায় ইভান আর আরাফকে বের হতে বললো। তারা চুপচাপ বেরিয়ে যেতেই আহনাফ রুমে ঢুকলো। অরুণিকা আহনাফকে দেখে চোখ-মুখ কুঁচকে ফেললো। দরজা হালকা চাপিয়ে দিয়ে আহনাফ অরুণিকার পাশে বসলো। তার মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চোখ-মুখ শুকিয়ে গেছে। এই এক সপ্তাহ অরুণিকা ক্যাম্পাসে দেখে নি আহনাফকে। অরুণিকা ভেবেছে, আহনাফ হয়তো দেশে নেই। কারণ ক্লাসের এক মেয়ে বলেছিল, আহনাফের লম্বা ছুটি নেওয়ার সম্ভাবনা আছে। মেয়েটি না-কি এক সিনিয়রের কাছে শুনেছিল। এদিকে অরুণিকা ইমানের কাছেও শুনেছে, আশপাশ থেকে আহনাফের দেশের বাইরে ডাবল মাস্টার্স করতে যাওয়ার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। তবে এখনো নিশ্চিত হয় নি কেউ। তবে আহনাফ যেই সেমিস্টারের ক্লাস নিতো, তা এখন অন্য একজন নিচ্ছে। এজন্যই গুঞ্জন সঠিক ধরে নিয়েছিল অরুণিকা। তাই এই মুহূর্তে আহনাফকে দেখে অরুণিকা বেশ অবাক হলো, সাথে বিরক্তও। বলল, “তুমি এখনো যাও নি দেশের বাইরে? আমি তো ভেবেছি তোমার থেকে স্বাধীন হয়েছি।”
আহনাফ মলিন হেসে বলল, “তাই! তুই মিস করবি না আমাকে?”
অরুণিকা হেসে বলল, “বাঁচবো আমি। ডিভোর্সটা দিয়ে গেলে আমি আরো ভালোভাবে বাঁচতাম।”
আহনাফ শূন্য দৃষ্টিতে তাকালো অরুণিকার দিকে। অরুণিকার হাতটা স্পর্শ করতে গিয়েই থেমে গেল সে। মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “এমনটা না করলে হতো না আমার সাথে?”
“তোমাকে বোঝাতে চেয়েছি, আঘাত কাকে বলে।”
আহনাফ শুকনো হেসে বলল, “ভালোই বুঝেছি। আমি তোর সাথে ভয়ংকর অন্যায় করে ফেলেছি। তূর্য, ইভান আমাকে আগেই সর্তক করেছিল, তোকে বেশি আঘাত করলে হারিয়ে ফেলবো। আমি ওদের কথা শুনি নি। ভেবেছি, তুই আমাকে ফেলে কোথায় আর যাবি! ফর গ্রেন্টেট নিয়ে ফেলেছি তোকে। সরি। তবে সরিটাও কম হবে। কীভাবে প্রায়শ্চিত্ত করলে আমার সব পাপ মুছে যাবে? তোর সাথে সংসারটা আবার রিস্টার্ট করতে পারবো, বল! আমি তো নিজের হাতে সব শেষ করে দিয়েছি। আমি এখন একদম ফাঁকা হয়ে গেছি।”
“প্রায়শ্চিত্ত করেও লাভ নেই। আমাদের সমাপ্তি এখানেই ছিল। আমি মন থেকে তোমার সাথে সংসার করতে আগ্রহী নই। এমনকি তোমাকে ছাড়ার পর কোনো আপসোসও থাকবে না আমার। উলটো মুক্ত হবো আমি।”
আহনাফ বুকে হাত রেখে আস্তে করে শ্বাস ছাড়লো। এরপর নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল, “সমাপ্তিতে যদি বিচ্ছেদই হতো এতো মায়া বাড়ালি কেন আমার? এক মুহূর্তেই কতো সুন্দর সংসার সাজিয়ে ফেলেছি তোকে নিয়ে। সব তো ভেঙে গুঁড়ো করে দিলি। আমার ভালোবাসা না হয় আমার মতোই অপসত্ত্ব, তোর ভালোবাসা তো পবিত্র ছিল। তুই তো আমাকে ভালোবাসতি। তোর ভালোবাসার ডেফিনিশন তো অনেক সুন্দর। তাহলে আমি কী বুঝে নেবো? তোর ভালোবাসা ফুরিয়ে গেছে! এতো সহজে আমাকে ভালোবাসা ছেড়ে দিলি, অরু?”
“আমি হয়তো তোমাকে কখনোই ভালোবাসি নি। তুমি আমার চাইল্ডহুড ফেসিনেশন ছিলে। যেটা এখন কেটে গেছে।”
আহনাফের চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তেই সে দ্রুত মুছে নিয়ে বলল, “আমার তোর প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। শুধু একটা দুঃখ নিয়েই আমি মরবো, এই যে তুই আমাকে ভালোবাসলি না কখনো। এই দুঃখটা আজীবন থাকবে আমার। আমি এই জন্মে আর তোর ভালোবাসা পাবো না। এই শূন্যতা নিয়ে আমাকে বাঁচতে হবে। না-জানি কতো বছর বাঁচবো! ভাবতেই ভয় লাগছে যে তোর ঘৃণা নিয়েই আমাকে বছরগুলো পার করতে হবে। আমি এই জন্মে তোর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য ছটফট করতে করতেই দম ছাড়বো হয়তো। অনেক বড় পাপী আমি।”
আহনাফ হুট করে অরুণিকার কাছে এসে তার এক হাত ধরে বলল, “কিন্তু তুই আমাকে ছেড়ে দিস না অন্তত। আমি তোর সব দায়িত্ব নেবো। দূর থেকে তোকে ভালোবাসবো। ছেড়ে দিলে তো এই জন্মে তুই অন্য কারো হয়ে যাবি। পরজন্মেও তুই তারই হবি। এতো বড় শাস্তি দিস না আমাকে। আমি এই জন্মে তোর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিবো। উপর আল্লাহর কাছেও ক্ষমা চেয়ে নেবো। অন্তত তুই সেই জন্মে আমার হয়ে থাকিস। অন্য কাউকে ভালোবাসিস না, অরু। আমি তোর সব দায়িত্ব নেবো। যা চাস, তোকে সব দেবো। তুই বললে, তোর কাছেও আসবো না। সামনেও আসবো না। ছোঁবোও না তোকে। তুই একদম তোর মতো থাকিস। অন্তত মাফ করে দিস আমাকে। ভালোবাসার মানুষকে তো মাফ করা যায়।”
অরুণিকা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “বললাম তো, আমি তোমাকে ভালোবাসি না, আহনাফ।”
অরুণিকার কথায় কিছুক্ষণ নিরবতা বিরাজ করলো পুরো ঘরে। একটু পর জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে কাঁপা কন্ঠে আহনাফ বলল, “ঠিক আছে। সমস্যা নেই। অন্তত একবার চেষ্টা করবি আর-কি। তোর জন্য ভালো হয়ে যাবো আমি, প্রমিজ। সিগারেটও খাবো না। একটু চেষ্টা করবি শুধু।”
অরুণিকা মুখ ঘুরিয়ে নিলো। বুকে হাত দিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলো। আর মনে মনে বলল, “আমার আর ঠকার ক্ষমতা নেই। আমি মরে যাবো আবার কেউ ঠকালে। আমি আর এই রিস্ক নিবো না।”
অরুণিকা আহনাফের দিকে ফিরে বলল, “আহনাফ, আমি তোমাকে ভালোবাসি না। ভালোবাসতে চাইও না। আমাকে প্লিজ নতুন জীবন শুরু করতে দাও। আমাকে ছেড়ে দাও। আমার কিছু লাগবে না। জাস্ট সাইন করে দাও। আর তা না পারলে আমি নিজেই পড়াশুনা শেষ করে উকিল ধরে তোমার কাছ থেকে মুক্তি নেবো।”
“তুই আমাকে ছাড়া কীভাবে থাকবি?”
“আমার ভালো থাকার জন্য তোমার প্রয়োজন নেই।”
আহনাফের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। সে ব্যস্ত হয়ে বলল, “আচ্ছা, ঠিক আছে। ততোদিন অন্তত একটু চেষ্টা করবি। হয়তো আবার ভালোবেসে ফেলবি।”
রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে পাঁচ জন আহনাফ ও অরুণিকার কথোপকথন শুনছে। পাঁচ জনের চোখ লাল হয়ে গেছে। তূর্য রুমে ঢুকে আহনাফের হাত ধরে বলল, “চল তুই। এভাবে উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছিস কেন? ডাক্তার তোকে স্ট্রেস নিতে বারণ করেছে।”
আহনাফ তূর্যের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ব্যস্ত কন্ঠে বলল, “একটু কথা বলি ওর সাথে। আরেকটু কথা বাকি আছে।”
আহনাফ এবার অরুণিকার পা ধরে বসে পড়ল। অরুণিকা আহনাফের পা ছাড়ানোর জন্য উঠে দাঁড়ালো। কিন্তু আহনাফ অরুণিকার দু’পা আরো শক্ত করে ধরে বলল, “একটু চেষ্টা করিস। কথা দে আমাকে, তুই চেষ্টা করবি। মিথ্যে আশা দিয়ে অন্তত বল, চেষ্টা করবি। নয়তো আমার বেঁচে থাকাটা কষ্টকর হয়ে যাবে।”
তূর্য আহনাফের বাহু ধরে বলল, “চেষ্টা করবে ও, চেষ্টা করবে।”
আহনাফ শব্দ করে কেঁদে উঠল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল, “অরু বলুক কথাটা।”
অরুণিকার চোখ বেয়ে দরদর করে জল গড়িয়ে পড়ছে। সে দু’হাত দিয়ে চোখ মুছে বলল, “আমাকে ছাড়ো, নয়তো আমি ছাদ থেকে লাফ দিয়ে মুক্তি দেবো তোমাকে।”
আহনাফ দ্রুত ছেড়ে দিলো অরুণিকার পা। কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে কাঁপা কন্ঠে বলল, “ঠিক আছে, কিছু বলতে হবে না। এমন করিস না। আমি জানি সব ঠিক হয়ে যাবে।”
আহনাফ তূর্যের হাত ধরে বলল, “অরু এখনো রাগ করে আছে। ও আমাকে ভালোবাসে। আমি জানি, ও আমাকে ভালোবাসে।”
অরুণিকা দ্রুত রুম থেকে বেরুতেই আবার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো তার। তাহমিদ তাকে শক্ত করে ধরে বলল, “তুই ঠিক আছিস!”
“আমাকে বাসায় নিয়ে যাও। আমার এখানে দমবন্ধ হয়ে আসছে।”
আহনাফ রুম থেকে বেরিয়ে অরুণিকার শারীরিক অবনতি দেখে বলল, “আমি আর কিছু বলবো না। তাহমিদ ওকে নিয়ে যা। আমি ওকে জোর করবো না আর। একদম জোর করবো না। ও যা চাইবে, তাই হবে। অরু, তুই চিন্তা করিস না। তোর কথামতো সব হবে। রিল্যাক্স থাক।”
তাহমিদ পাঁজা কোলা করে নিয়ে গেল অরুণিকাকে। আরাফ আহনাফের কাঁধে হাত রাখলো। আহনাফ শুকনো হেসে বলল, “এটা যদি একটা গল্প হতো। সব মুছে ফেলতাম আমি। একদম ষোলো বছর বয়সী কিশোরীর কাছেই ফিরে যেতাম আমি। এবার আর সেই ভুল করতাম না। কীভাবে সব মুছে ফেলবো, বল? কীভাবে সব ভুলিয়ে দেবো অরুর স্মৃতি থেকে? আমার বুকটা তো ছারখার হয়ে যাচ্ছে। আমার তো ওকে ছাড়াই দমবন্ধ হয়ে আসছে। এখন আমি বাকী জীবন কীভাবে কাটাবো?”
চলবে-
#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| বোনাস পর্ব ||
দুই সপ্তাহ ধরে চৌধুরী বাড়ির কারো সাথে আহনাফের যোগাযোগ নেই। কেউ আহনাফের খোঁজও নেয় নি। এমনকি শিরিন সুলতানারও সেই সাহস হয় নি। আহনাফের উগ্র আচরণ দেখে তিনি ভয় পেয়ে গেছেন। যদি আহনাফ রাগের বশে মেডিসিন দেওয়ার কথা বলে দেয়! তখন ডাক্তার পরিবারের হাতে বাজেভাবে ধরাশায়ী হবেন তিনি। তাই চুপ করে আছেন। এখন জল কতোটুকু গড়ায় তা দেখার অপেক্ষা। এমনিতেই আরাফ আর তাহমিদ তার সত্য অনেকটাই জেনে গেছে। এখন কীভাবে জেনেছে, তা বুঝতে পারছেন না শিরিন সুলতানা। তবে এই মুহূর্তে তার কোনো উল্টোপাল্টা আচরণে যদি বিন্দুমাত্র সন্দেহ কারো মনে সৃষ্টি হয়, তাহলে তার কপালে শীঘ্রই শনিরদশা আসবে।
এদিকে আজ অনেকদিন হলো আহনাফের রুমের তালা ভাঙা। তাই বাড়ির মালিক লোক নিয়ে এসে আজই নতুন তালা লাগিয়ে দিয়েছেন। ওদিকে তূর্য, ইভান আর ইমন আহনাফের আলমারিতে তুলে রাখা মেডিসিন খুঁজে পেয়েছে। আহনাফ বাড়ি থেকে ফিরতেই তারা অনেক প্রশ্ন করেছিল এই নিয়ে। তবে সে কোনো উত্তর দেয় নি।
“মেডিসিনগুলো কোনো সাধারণ ওষুধ নয়, সবই নেশাদ্রব্য,” এই একটা কথা শ’খানেক বার বলেও তারা বিশ্বাস করাতে পারলো না আহনাফকে। উলটো সে জোর করেই মেডিসিনগুলো নিয়ে নিল। এমনকি এসব নিয়ে পাঁচজনের সাথে ধস্তাধস্তি পর্যন্ত হয়ে গেল তার। শেষমেশ আরাফ বাধ্য হয়ে আরেফিন চৌধুরী আর আমির চৌধুরীকে আহনাফের ব্যাপারে জানালো। আমির চৌধুরী সব শুনে একেবারে নিশ্চল হয়ে পড়েছেন। একমাত্র ছেলের এই অবস্থার জন্য নিজেকেই দায়ী করে যাচ্ছেন তিনি। কেন ছেলেকে চোখে চোখে রাখতে পারলেন না, এই আক্ষেপে বুকটা ফেঁটে যাচ্ছে তার। তবে আরেফিন চৌধুরী এখন কথাটা চাপিয়ে রাখতে বলেছেন আরাফকে। কারণ একমাস পর একটি সনামধন্য ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানের সাথে তাদের কোম্পানির অনেক বড় ডিল হবে। আহনাফকে রিহ্যাবে পাঠালে যদি জানাজানি হয়ে যায়, তখন ডিলটা ক্যান্সেল হয়ে যেতে পারে। তাই আপতত যা চলছে, তা চলুক। আরাফ বাবার এমন শর্তে বেশ অবাক হলো। বলল, “তোমাদের কাছে আহনাফের দ্রুত সুস্থতার চেয়ে বিজনেস ডিল বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে?”
আরেফিন চৌধুরী বললেন, “দেখো আরাফ, অনেক কষ্ট করে এই বিজনেস দাঁড় করিয়েছি আমরা। তুমি এসব বুঝবে না। তাই যা বলছি, তাই করো।”
“ডাক্তারি পেশায় কি কম টাকা আয় করছো তোমরা, যে এখন আবার ব্যবসায়ও কোনো ছাড় দিতে চাচ্ছো না? আমাদের তো কোনো কিছুর অভাব নেই। বাড়ি আছে, গাড়ি আছে, অনেক জায়গায় ফ্ল্যাটও কিনেছো। আর তুমি এখনো ডাক্তার। আমিও সামনে এই পেশায় যাবো। আমাদের সংসারে কোনো চাপ নেই। চাচ্চুরও একই অবস্থা! উনারও সব আছে।”
আমির চৌধুরী বললেন, “আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি, আরাফ। তুমি আমার ছেলেকে আপন ভাইয়ের মতো ভালোবাসো, তাই তুমি এই কথা বলছো। কিন্তু আহনাফ এডিক্টেট। এই কথা যদি সবাই জেনে যায়, তাহলে আমাদের ডিলটা ক্যান্সেল হয়ে যাবে। এই বিজনেস ডিলের উপর তোমাদের ভবিষ্যতও নির্ভর করছে। আপতত একমাস আহনাফকে চোখে চোখে রাখো। এমনিতেই সবাই যদি জেনে যায়, ওর চাকরিটাও চলে যাবে। পরে আর পাবে কি-না সন্দেহ।”
আরাফ হতাশ হয়ে নীরবে প্রস্থান করলো। আরাফ চলে যাওয়ার পর আমির চৌধুরী বড় ভাইকে বললেন, “আমার উপর জুবায়ের ভাইয়ের বদদোয়া লেগে গেছে। উনার মেয়েকে ঘর ছাড়া করেছি, তাই আমার ছেলের আজ এই পরিণতি।”
আরেফিন চৌধুরী বললেন, “তবে এই ডিলটা সত্যিই অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এই ডিলটা হয়ে গেলে, অরুণিকাকে ওর সব ফেরত দিয়ে দেবো। এই ডিলটা তো আমরা অরুণিকার জন্য করছি। মেয়েটার নামে তো কিছুই নেই। ওর বাবার ফ্ল্যাটটা পুরোটাই ওর নামে লিখে দেবো। আর এই বিজনেসটা একটা স্টেজে নিলে, এর প্রফিটটাও অরুণিকার নামেই যাবে। আরাফকে এখন এসব বলতে চাচ্ছি না। বললে হয়তো বুঝতো। কিন্তু কোনো কিছু এচিভ করার আগে নীরব থাকা ভালো। তাই এই কথা আপতত আমাদের দু’জনের মধ্যেই থাক।”
(***)
রহস্য ব্যান্ডের কন্সার্ট পাঁচ দিন পর। প্রতি বছর হেমন্তের শুরুতেই কনসার্টের আয়োজন করা হয়। কয়েকটা ব্যান্ডের সাথে রহস্য ব্যান্ডও সেই তালিকায় যুক্ত থাকে৷ কিন্তু এবছর সব কিছুই যেন এলোমেলো হয়ে আছে। আহনাফ অরুণিকার শোকে ভেঙে পড়েছে। দিনদিন তার মনের অস্থিরতা বেড়েই চলেছে। কণ্ঠের ভারও আর আগের মতো নেই। গান গাওয়ার মতো মানসিক অবস্থাও তার নেই।
ছ’জন সদস্যের এই রহস্য ব্যান্ড। তাদের মধ্যে একজন, তূর্য শেখ। ছোটবেলা থেকেই অসাধারণ গায়ক সে। দেশীয় সংগীত প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পরিচিতি পেয়েছিল তূর্য। আর শিশুশিল্পী হিসেবে অর্জন করেছিল বহু পুরস্কার। তার বাড়ির এক কোণে এখনো সাজানো আছে তার অর্জিত ট্রফি আর সার্টিফিকেট। বয়স বাড়ার সাথে সাথে প্রতিযোগিতাও বেড়েছে। সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারলেও, তার কণ্ঠে মুগ্ধ হয়ে বহু সনামধন্য শিল্পী তাকে তাদের এলবামে গান গাওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। কয়েকটি টেলিফিল্মের সঙ্গীত পরিচালনার অভিজ্ঞতাও হয়েছে তার। কিন্তু তূর্য কখনোই এমন বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করতে চায় নি। সে চাইতো একটা নিজস্ব পরিচয়, তার নিজের দল, যেই গানে তার পুরো স্বাধীনতা থাকবে। যেই গানের কথা তার জীবনকে স্পর্শ করবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডিতে পা রাখতেই সে নিজের গানের দল গঠন করে ফেলে। তার পাঁচ বন্ধুর গলার স্বরও বেশ ভালো। তাই তাদের নিয়েই সে রহস্য ব্যান্ড গঠন করে। নিজে সময় দিয়ে পাঁচজনকে গান শিখিয়েছিল সে। এমনকি একেক জনকে একেকটা বাদ্যযন্ত্র বাজানোও শিখিয়েছিল। তবে পাঁচ জনের কারোই নিজেদের পরিচয় প্রকাশের ইচ্ছে ছিল না। শুরুতে তারা মাস্ক পরেই ভিডিও বানাতো। তবে এখন হেলমেট পরে স্টেজে উঠে। আজও তূর্য ছাড়া বাকি পাঁচ জনকে কেউ দেখে নি। ভক্তদের প্রশ্ন এখানেই। কেন বাকি পাঁচজন নিজেদের আড়াল করে রেখেছে? তূর্য প্রতিবারই উত্তর দেয়, এটাই তাদের বিশেষত্ব। আর এজন্যই তো ব্যান্ডের নাম রহস্য রাখা হয়েছে। এরপর তাদের কয়েকটা গানের এলবাম বের হতেই তারা বেশ পরিচিতি পেয়ে যায়৷ এরপর ধীরে ধীরে আয়োজকরা তাদের কন্সার্টে অন্তর্ভুক্ত করেন।
তূর্য রহস্য ব্যান্ডের প্রধান সদস্য। এলবামের প্রায়ই গান তার লেখা। তবে কয়েকটা গান তাহমিদ আর আহনাফও লিখেছে। তূর্য বেশ কয়েকটা বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারে। এর মধ্যে তার ভায়োলিনের সুর শ্রোতার হৃদস্পর্শ করতে সক্ষম। তূর্যের ভায়োলিনের গায়ে একটা নাম খোদাই করা। যা প্রায়ই সবার চোখে পড়ে। শ্যামকন্যা। এই নামটা চাইলেও আর আড়াল করতে পারে না সে। ভক্তদের প্রশ্ন, এই শ্যামকন্যাটি কে? তূর্য হেসেই সেই প্রশ্ন উড়িয়ে দেয়৷ আর বলে, কল্পিত চরিত্র না হলে গান লেখা যায় না। আর শ্যামকন্যা তার কল্পনা। যেই কল্পনা তাকে গান লিখতে অনুপ্রাণিত করে।
তূর্য কখনো কনসার্টে ভায়োলিন বাজায় নি। এই অনুরোধ প্রতিবারই প্রত্যাখ্যান করেছিল সে। স্টেজে অ্যাকোস্টিক গিটার হাতেই সে গান করে।
ইমন খুব একটা ভালো সুর দিতে পারে না। গলা ভালো হলেও এখানে সে মোটামুটি ধরাশায়ী। তাই ব্যান্ডের ড্রামার হিসেবেই সে পরিচিত। খুব ভালো ড্রাম বাজায় সে। তাই রহস্য ব্যান্ডে তার ছদ্মনাম ড্রামশান। ইমনই এই নাম নিজের জন্য পছন্দ করেছিল। সে মনে করে, ভালো ড্রামার হতে পারা তার অনেক বড় অর্জন। এটি তার সৃজনশীলতার শান। তাই এই ছদ্মনামটি রাখা।
অন্যদিকে ইভান কীবোর্ডিস্ট। তার হাতেই থাকে ব্যান্ডের প্রাণ। খুব চমৎকার সুর তুলতে পারে সে। তূর্যের জন্যই সে এই বিষয়ে আলাদা কোর্স করেছিল। ইভানও ইমনের মতো গানে কন্ঠ দেয় নি। কোরাসে অংশ নিয়েছিল শুধু। তার ছদ্মনাম গীতভেন। ওই বয়সে ডিকশনারি ঘেঁটে ভেন শব্দটি বের করেছিল সে৷ যার অর্থ মাঝে মাঝে প্রতিনিধিত্ব করা বোঝায়। তার কাজের সাথে এই নামটি বেশ মিলবে মনে করে সে গীতভেন নামটি পছন্দ করেছিল নিজের জন্য।
অন্যদিকে আরাফকে দেখতে যতোটা শান্ত মনে হয়, সে ততোটাই আগুন ঝড়ানো গিটার বাজায়। সে ব্যান্ডের মূল ইলেক্ট্রিক গিটারিস্ট। তার গিটারের সুরে কন্সার্ট শুরু হয়। আরাফ যখন নীরবতা কাটিয়ে সুর তুলে, তখন অনেক দর্শকই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে। তাই তার ছদ্মনাম রাফ কিং রাখা হয়েছে। আরাফের ভক্তও আছে বেশ। মাঝে মাঝে গানে কন্ঠ দেয় সে। বেশ মায়াময় সেই কন্ঠস্বর। মেয়ে ভক্তরা তার চেহারা দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে।
তাহমিদ শাহরিয়ার বেস গিটারিস্ট। অনেক সৃজনশীল সে। গভীর ভাবনার মানুষ। বেশ ভালো কবিতাও লেখে। এজন্যই তার ছদ্মনাম মৃতকাব্য। মৃত শব্দটি সে নিজেই দিয়েছিল। কারণ তার জীবনটাই মৃত নদীর মতো হয়ে গেছে। অন্যদিকে আহনাফ রহস্য ব্যান্ডের আবেগপ্রবণ একজন সদস্য। বেশ ভালো গান করে সে। চমৎকার পিয়ানোবাদকও বটে। তূর্যের পর আহনাফের ভক্ত বেশি। তবে তূর্যের চেয়ে আহনাফের প্রতি আলাদা আকর্ষণ সবার। কারণ তার চেহারা এখনো কেউ দেখে নি। তবে রহস্য ব্যান্ডের ভক্তরা আহনাফকে বেশি ভালোবাসে। হেলমেট পরায় তার শারীরিক গঠন ভালোভাবেই সবার চোখে পড়ে। বাকীদের তুলনায় আহনাফ যথেষ্ট লম্বা, কাঁধ চাওড়া। কালো শার্ট পরে সে স্টেজে উঠে। মেয়েরা তাকে অনুকরণ করে কালো জামা পরে কন্সার্টে আসে। সবার হাতে থাকা প্লেকার্ডে কুয়াশ বাহ নামটিই বেশি দেখা যায়। কুয়াশ বাহ আহনাফের ছদ্মনাম। তার রিক্তশূন্য জীবনটি কুয়াশাজড়ানো স্বপ্নের মতো। অরুণিকার সাথে বিয়েটাও তার কাছে স্বপ্নের মতোই ছিল। শীত আহনাফের পছন্দের একটি ঋতু৷ এই মাসেই বিয়ে হয়েছিল আহনাফ ও অরুণিকার। এরপর অরুণিকার সাথে পাঁচ বছরের বিচ্ছেদকালে আহনাফকে সঙ্গ দিয়েছিল কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর। ভোরের শীতল বায়ুপ্রবাহের স্পর্শে তার হৃদয় দুয়ার খুলে যেতো৷ ওই মুহূর্তে ভালো গান লিখতে পারতো সে। এজন্যই সে কুয়াশ বাহ নামটি নিজের জন্য পছন্দ করেছিল। তাছাড়া তূর্যের আহনাফের প্রতি আলাদা যত্ন অনেকবারই প্রকাশিত হয়েছিল ভক্তদের সামনে। তাই তূর্য ভক্তরাও আহনাফকে বেশি পছন্দ করে। কিন্তু এ বছর কি হবে তা বোঝা যাচ্ছে না।
চলবে-