#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-৪৪ (১ম ভাগ)||
ক্যাম্পাস থেকে বের হওয়ার আগ মুহূর্তেই তূর্য পথ রোধ করে দাঁড়াল অরুণিকার। তূর্যকে সামনে দন্ডায়মান দেখে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো সে। জিজ্ঞেস করল, “কিছু বলবে?”
তূর্য ক্ষীণ হেসে বলল, “অনেক দূরে সরিয়ে দিচ্ছো আমাদের।”
অরুণিকা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “পথ চলতে গিয়ে অনেক সম্পর্ক পেছনে পড়ে যায়। পিছু ফিরে তাদের নিয়ে আসার সময় আর থাকে না।”
তূর্য স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অরুণিকার দিকে। অরুণিকা তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নেবে, তখনই তূর্য বলল, “যদি সেই ছেলেবেলা আবার ফিরে আসতো।”
অরুণিকা থেমে গেল। তূর্য পুনরায় তার সামনে এসে দাঁড়াল। অরুণিকাকে আপদমস্তক দেখে বলল, “টুইংকেল, তুমি ফিরে আসো আমাদের জীবনে। আমি তোমাকে প্রমিজ করছি, তোমাকে এবার একটুও নিরাশ করবো না।”
“বিশ্বাস ভেঙে গেলে, আর ফিরে আসে না।”
“তুমি তোমার জায়গায় ঠিকই আছো। কিন্তু আহনাফ সম্পর্কে হয়তো তোমার অনেক কিছুই অজানা।”
অরুণিকা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “অজানা! তাকে অনেক ভালোভাবে চিনেছি আমি।”
“যাই হোক। আহনাফ অসুস্থ। ওর হার্টে সমস্যা আছে।”
অরুণিকা চমকে তাকালো তূর্যের দিকে। তূর্য বলল, “আমরা ওকে হারাতে চাই না। ও তোমার সাথে অন্যায় করেছে, তাই বলে কি তুমি চাও ও আমাদের মাঝেই না থাকুক।”
অরুণিকার গলা কাঁপছে তূর্যের কথা শুনে। ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “আমি কখনো চাই না ওর এমন কিছু হোক। ও ওর মতো ভালো থাকুক।”
“তোমাকে ছাড়া ভালো নেই আহনাফ।”
“আমি ওর পাশে থাকলে কম্ফোর্ট জোনে থাকি না।”
“কাউকে ভালোবাসো?”
অরুণিকা চোখ বড় বড় করে তাকালো তূর্যের দিকে। বারংবার হিমালয় নামটি তার মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে। দুই সপ্তাহ মানুষটির কোনো হদিস নেই। অনলাইনেও আসে নি। অরুণিকা নিজেও জানে না, সে হিমালয়ের প্রতি এতো দুর্বল হয়ে পড়ছে কেন? তূর্য হালকা হেসে বলল, “তোমার চোখ দেখেই উত্তর পেয়ে গেছি আমি। আমরা তোমার অধিকার কেঁড়ে নেবো না। তোমারও ভালোবাসার অধিকার আছে। তোমার জীবনে হয়তো এমন কেউ এসেছে, যাকে তুমি বিশ্বাস করতে পারছো। যার সাথে কম্ফোর্ট জোনে আছো। যাকে ভালোবাসতে পারছো। যাই হোক, আহনাফের জন্য দোয়া করবে। ও যাতে তোমাকে ভুলতে পারে।”
অরুণিকা মুখ ঘুরিয়ে নিল। মনে তীব্র আঘাত অনুভব করলো সে। আহনাফ এতোটা অসহায় হয়ে গেছে! সে তো পেরেছো ভালোবাসতে, কিন্তু আহনাফ পারছে না! আহনাফ অন্যায় করেছে তার সাথে, তার শাস্তিও দেওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু অরুণিকা এতোটা নিষ্ঠুর হয় নি যে কোনো মানুষের কষ্টে দুঃখ পাবে না। তূর্য অরুণিকার কাঁধে হাত রাখতেই সে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল, “আহনাফ আমাকে ছেড়ে দিলে, সহজে মুভ অন করতে পারতো। জয়িতা আপু ভালোবাসে তাকে। আমার মনে হয় দে আ’র মেইড ফর ইচ আদার।”
তূর্য শুকনো হেসে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এরপর প্রসঙ্গ পালটে হাত এগিয়ে দিয়ে বলল, “আমার হাতটা ধরো।”
অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কেন?”
“আগে ধরো।”
অরুণিকা তূর্যের হাত ধরতেই সেই হাতে দু’টি কন্সার্টের টিকেট ধরিয়ে দিল তূর্য। অরুণিকা টিকেট দু’টির দিকে তাকিয়ে রইলো। তূর্য বলল, “প্রতিবছরই তো স্টুডিওর সামনে এসে টিকেট নিয়ে যাও, এবার এলে না!”
অরুণিকা ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “কারণটা আর নেই তাই।”
“শুধুই কি কুয়াশ বাহ! আমি, তোমার রাফ কিং, মৃতকাব্য ওদের কি দেখতে চাও না?”
অরুণিকা চুপ করে রইলো। তূর্য পুনরায় বলল, “রুহানিকে নিয়ে এসো। তুমি এলে আমাদের ভালো লাগবে।”
“তুমি টিকেট দু’টো অন্য কাউকে দিয়ে দিও।”
“কেন?”
“আমি জানি না।”
“প্লিজ, টুইংকেল। হয়তো এটা আহনাফের লাস্ট কন্সার্ট।”
“লাস্ট কেন?”
“ওর শারীরিক অবস্থা ভালো না। আর দেশের বাইরে চলে যাবে ও। অন্তত আমাদের জন্যে এসো।”
অরুণিকা মাথা নেড়ে বলল, “চেষ্টা করব।”
এই বলে চলে গেল অরুণিকা। অরুণিকা চলে যেতেই ইভান তূর্যের পাশে এসে বলল, “দিয়েছিস?”
“হুম। তাহমিদের সন্দেহ ঠিক।”
“মানে?”
“টুইংকেল সরাসরি তো কিছু বলে নি, কিন্তু মনে হচ্ছে ও অন্য কোথাও ইনভলভড আছে। হয়তো কাউকে পছন্দ করে।”
ইভান স্তব্ধ হয়ে গেল তূর্যের কথায়। মিনিট খানিক নীরবতা বিরাজ করলো তাদের মধ্যে। এরপর ইভান বলল, “আহনাফের কি হবে এখন!”
“জানি না।”
“ও শুনলে সহ্য করতে পারবে না।”
তূর্যের হাত মুঠো হয়ে গেল। শক্ত কন্ঠে বলল, “সব ওই শিরিন সুলতানার কারণে হয়েছে। একটা সাজানো সংসার ভেঙে দিয়েছে ওই মহিলা। আহনাফকে দেওয়া প্রতিটা আঘাতের শোধ নেব ওই মহিলা থেকে। খুব শীঘ্রই মৃত্যু যন্ত্রণা অনুভব করবে ওই শিরিন সুলতানা।”
(***)
অরুণিকা গেট দিয়ে ঢুকতেই রুদবাকে সামনে দেখতে পেল। রুদবাকে দেখেই তার দিকে এগিয়ে এসে বলল, “কি রে! কোনো খবর নেই তোর। ক্যাম্পাসে যাস, অথচ দেখিই না। একই বিল্ডিংয়ে থেকেও দেখা হয় না আমাদের।”
“বাস তো আছে এখন। প্যারা কীসের? রাস্তা পার করে দেওয়ার ঝামেলা তো নেই।”
অরুণিকা মলিন মুখে বলল, “আমাকে রাস্তা পার করে দেওয়াটা ঝামেলা ছিল?”
রুদবা চুপ করে রইলো। অরুণিকা পুনরায় বলল, “তোকে আজকাল দেখি না, তাই বললাম। নতুন বান্ধবী পেয়ে গেছিস হয়তো!”
“তোর তো তাহসিন বন্ধু আছে।”
“কি যে বলিস!”
“আচ্ছা এসব কথা বাদ দে। আমি এখানে তোর জন্যই দাঁড়িয়ে ছিলাম।”
“তাই? আগের বাসটাতে এসেছিলি না-কি?”
“হ্যাঁ।”
“দাঁড়িয়ে কেন ছিলি? বাসায় গিয়ে বসতি।”
“নিচতলায় দমবন্ধ হয়ে আসে আমার। কীভাবে থাকিস ওখানে? বাসা দেখ। আর কতোদিন নিচতলায় থাকবি?”
“রুহানির পরীক্ষা শেষ হলে চেঞ্জ করবে হয়তো।”
“আচ্ছা ভালো। আরো কয়েকমাস আছে তাহলে।”
“হ্যাঁ। তা কি জন্য দাঁড়িয়েছিলি?”
রুদবা শক্ত স্বরে বলল, “একটা প্রশ্ন ছিল!”
“এভাবে বলছিস কেন? তুই আমার ফ্রেন্ড।”
“এসব কথা রাখ, আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দে।”
“কি প্রশ্ন?”
“তূর্য স্যারের সাথে তোর কি সম্পর্ক?”
অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তুই তো জানিস।”
“আবার একটু ক্লিয়ার করে বলতো। ভুলে গেছি।”
“আমার কাজিনের ফ্রেন্ড।”
“তোর কাজিন কারা?”
“আরাফ, তাহমিদ ওরাই আমার কাজিন।”
“ডাক্তারি পড়ছে উনিই তো আরাফ, না-কি?”
“হ্যাঁ।”
“আর তাহমিদ কোনটা?”
“ফর্সা করে যে আছে ওটা।”
“আচ্ছা, ইভান আর আহনাফ স্যারকে তো চিনি। আর ইভান স্যারের মতো দেখতে ওটা উনার ভাই?”
“হ্যাঁ, ইমন।”
“আচ্ছা, ইভান স্যার তোর কি হয়?”
“তূর্যের মতোই। ওরাও কাজিনের ফ্রেন্ড।”
“বুঝলাম। কিন্তু কাজিনের ফ্রেন্ডের সাথে তোর এতো সখ্যতা কেন?”
অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে তাকালো রুদবার দিকে। রুদবা শক্ত কন্ঠে বলল, “তূর্য স্যার তোকে এতো প্রায়োরিটি দেন কেন?”
“আমরা ছোটবেলা থেকেই একসাথে বড় হয়েছি। ওরা শুধু কাজিন ফ্রেন্ড না। ফ্যামিলি ফ্রেন্ডও।”
“বাট তূর্য স্যার তোর সাথে একটু বেশি কথা বলে। বাকিরা তো বলে না।”
“তুই হয়তো দেখিস নি। বা তোর তূর্যের দিকে নজর ছিল, তাই ওটাই দেখেছিস। আমাকে এভাবে এসব ব্যাপারে পয়েন্ট করিস না।”
“দেখ, অরু। আমার তূর্যকে ভালো লাগে।”
“তূর্যকে অনেকেই পছন্দ করে। কিন্তু ও কাউকে পছন্দ করে না।”
“তুই কি ইনডাইরেক্টলি আমাকে তূর্যের কাছ থেকে দূরে সরাতে চাইছিস?”
“তূর্যের লাইফে কিছু প্রাইভেসি আছে। নয়তো আমি তোকে সব বলতাম। আমি ওর ফ্যামিলির সব জানি। তোর ভালো লাগার কোনো সমাধান নেই। রুদবা, তূর্যের চেয়ে বেটার কাউকে তুই ডিজার্ভ করিস।”
“আমাকে মিথ্যে সান্ত্বনা দিয়ে ওর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিজের জায়গাটা নিয়ে ফেলছিস?”
অরুণিকা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রুদবার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। কিন্তু একটা ছেলের জন্য তুই আমাকে পয়েন্ট করছিস? আমাদের ফ্রেন্ডশিপকে অপমান করছিস?”
“যেই ফ্রেন্ড কোনো কাজে আসে না, তার সাথে ফ্রেন্ডশিপ রাখার কোনো দরকার নেই।”
কথাটি বলতে বলতেই রুদবা কেঁদে উঠলো। অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “ওকে। তোর সাইড থেকেই সব শেষ হয়েছে। আমি বন্ধুত্বের অপমান করি নি।”
রুদবা চোখ মুছে বলল, “আমি তোকে অনেক ভালোবাসতাম। কিন্তু আমি এখন তূর্যকে ভালোবাসি। তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। কিন্তু আমি তোকে চোখের বালি বানাতে চাই না। তুই বিনোদিনী হওয়ার আগেই আমি তোকে আমার জীবন থেকে বের করে দিচ্ছি। তূর্য যেদিন পুরোপুরি আমার হবে, আমি তোর সাথে আবার কথা বলবো।”
অরুণিকা হেসে বলল, “তুই ক্রেজি হয়ে গেছিস। উপন্যাস পড়তে পড়তে ফ্যান্টাসির জগতে বাস করছিস। শোন, তূর্যের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমাকে বোনের চোখে দেখে ও। তাই আমাকে অনেক রেস্পেক্ট করে। কিন্তু সবাইকে তো বোন মনে করে না ও। তাই তুই ওর জন্য পারফেক্ট না। তুই তাহমিদ বা ইমনকে পছন্দ করতি। আমি অবশ্যই তোকে এপ্রেশিয়েট করতাম। ওরা অনেক ভালো। কিন্তু ইভান অনেক বদমেজাজি, আর তূর্য অনেক মেয়ের সাথেই ফ্লার্ট করে।”
“আমার সাথে তো করে নি। তুই মিথ্যে বলছিস। উনি আমাকে ইগ্নোর করেছে। বাজে ছেলে হলে অবশ্যই সুযোগ নিতো।”
“কারণ তুই আমার ফ্রেন্ড।”
“তাহলে তো ভালোই। আমাকে সম্মান করবে। আমাকে ভালোবাসবে।”
“তুই ওর লাইফ স্টাইল হ্যান্ডেল করতে পারবি না। তুই অনেক পজিজিভ একটা মেয়ে। তোরা পারফেক্ট না।”
“শাট আপ।”
রুদবা অরুণিকার হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলল, “আমি তূর্যকে ভালোবাসি। দেখিস, ও আমাকে ভালোবাসতে বাধ্য।”
এই বলে রুদবা হনহনিয়ে চলে গেল। অরুণিকা অবাক হয়ে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে বলল, “মেয়েটা তো আহনাফের ফিমেল ভার্সন হয়ে গেছে। এতো এগ্রেসিভ কখন হলো ও!”
(***)
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল বাঁধছে অরুণিকা, তখনই পেছন থেকে তাকে ঝাপটে ধরলো রুহানি। অরুণিকা আঁতকে উঠল। আয়নায় রুহানির দিকে তাকিয়ে বলল, “জানটাই হাতে চলে এসেছিল আমার! এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়!”
রুহানি পা ধাপিয়ে উৎসুক কন্ঠে বলল, “আমরা কন্সার্টে যাচ্ছি?”
অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তোকে কে বলেছে?”
রুহানি টিকেট এগিয়ে দিয়ে বলল, “তোর টেবিলে দেখলাম।”
অরুণিকা শীতল কন্ঠে বলল, “আমি যাচ্ছি না।”
“তাহলে এই টিকেট!”
“তূর্য দিয়েছে।”
রুহানি গালে হাত দিয়ে বলল, “ও মাই গড। স্টার নিজে দিয়েছে, আর তুই ভাব দেখাচ্ছিস?”
অরুণিকা নিঃশব্দে রুহানিকে সরিয়ে দিয়ে নিজের কাজে মনোযোগ দিল। রুহানি টিকেটের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলল, “কিন্তু দু’টো কেন দিল?”
“তোর জন্য সহ।”
রুহানি এই কথা শুনে চেঁচিয়ে বলল, “ওয়াও! আমার জন্য টিকেট! আমি তোর মতো ভাব-টাব দেখাতে পারব না। আমি তো যাব।”
“গেলে একাই যা।”
“ওমা, এতো বছর আমাকে ফেলে একাই গিয়েছিলি। এখন দুইটা টিকেট দিয়েছে, আর যাচ্ছিসই না!”
অরুণিকা চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলল, “আমি তো আহনাফের জন্য যেতাম। কিন্তু এখন তো সেই কারণটাই আমার জীবনে নেই।”
রুহানি অরুণিকার সামনে এসে দাঁড়াল। ভালোভাবে অরুণিকাকে পরখ করে বলল, “বাকি পাঁচজনকে চিনিস তুই?”
“না।”
“বল না! আরাফ স্যার কি ওই ব্যান্ডে আছে?”
“জানি না।”
“তুই তো অবশ্যই জানিস। ইচ্ছে করে আমাকে বলছিস না। ওরাও ছ’জন, ব্যান্ডেও ছ’জন। কেমন মিল না! গাধাও বলে দেবে ওরাই এরা। কচুর রহস্য। এমন দুর্বল রহস্যেও মানুষ সত্য জানতে পারছে না। সবাই আমাকে গাধা বলে! আমার আশেপাশের মানুষ তো এক একটা আস্ত গাধা।”
“তূর্যের এই ছ’জন বন্ধু আছে, কারাই বা জানে?”
“এই বিল্ডিংয়ের সবাই তো জানে।”
“কিন্তু তূর্যকে ঘিরে কোনো জটলা দেখেছিস?”
“না!”
“কারণ সবাই গান শুনে না। রহস্য ব্যান্ডের গান আমাদের জেনারেশনের হাতেগোনা কয়েকজন শুনে। ওরা ইউটিউবেই ফেমাস। গান ভালো লাগলে ভিউস বাড়ে। ব্যস, এইটুকুই। তাহসান খান, মিনার উনাদের মতো সেলেব্রিটি না তূর্য। গান করে পরিচিত পেয়েছে ব্যস এইটুকুই। যারা রহস্য ব্যান্ডের ভক্ত, তারা ছাড়া এসব নিয়ে কেউ রিসার্চও করে না।”
রুহানি মুখ বাঁকিয়ে বলল, “হুহ! হাতেগোনা কয়েক জন! একটা সময় কানে হেডফোন গুঁজে ওদের গানই শুনতি।”
“একটা বয়স ছিল গান শোনার। এখন সেই বয়স নেই।”
“বুড়ি হয়ে গেছিস?”
“জানি না।”
রুহানি মুখ ছোট করে অরুণিকার হাত ঝাঁকিয়ে বলল, “ভাই অরু, চল না, প্লিজ। আমার জন্য অন্তত চল। আমি কখনো কন্সার্টে যাই নি, প্লিজ।”
ন্যাকা কান্না জুড়ে দিয়েছে রুহানি। অরুণিকা ব্যস্ত কন্ঠে বলল, “ওকে ফাইন। যাব।”
রুহানি অরুণিকাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “থ্যাংক ইউ।”
এই বলে সে ধিনধিন করে চলে গেল। এদিকে অরুণিকা ফোন হাতে নিল। আজও হিমালয়ের মেসেজ আসে নি। কেমন অসহায় লাগছে তার। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসছে। এই হিমালয় নামক মানুষটার প্রতি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে না তো সে!
(***)
আজ রহস্য ব্যান্ডের কন্সার্ট। রুহানি দু’দিন আগেই আতকিয়া জাহান থেকে অনুমতি নিয়ে নিয়েছে। এদিকে এক সপ্তাহ আরাফ তাকে পড়াতে আসে নি। আহনাফও বাড়ি থেকে ফেরার পর থেকেই আসছে না। আতকিয়া জাহান একদিন আরাফকে সিঁড়ি বেয়ে নামতে দেখেই জিজ্ঞেস করেছিলেন এই নিয়ে। আরাফ বলল, “তূর্যের কন্সার্টে ওকে সাহায্য করতে হচ্ছে।”
আতকিয়া জাহান আরাফের মতো দায়িত্ববান ছেলেকে কন্সার্টে ব্যস্ত থাকতে দেখে ভাবলেন, হয়তো খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আর তাই সেই কন্সার্টে যাওয়ার অনুমতি পেতে অসুবিধে হয় নি রুহানির।
আজ কালো শাড়ি পরেছে রুহানি। কালো টিপ পরতে গিয়েই থমকে গেল সে। আরাফের বলা কথাটি মনে পড়তেই রেখে দিল টিপের পাতা। নিজের দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসলো। আসলেই তো, টিপ ছাড়া নারী একটু বেশিই সুন্দর। রুহানি পরক্ষণেই বলল, “থু, থু, থু, নজর না পড়ুক আমার উপর। মাশাল্লাহ।”
অরুণিকা রুহানিকে ডাকতে এসে থমকে গেল। আপদমস্তক রুহানিকে দেখে বলল, “শাড়ি পরে কন্সার্টে?”
“কেমন লাগছে!”
“অনেক ভীড় হবে।”
“সমস্যা নেই। কেমন লাগছে বল?”
“মাশাল্লাহ।”
রুহানি এবার অরুণিকার দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকালো। সাদা টি-শার্টের সাথে কালো জিন্স। কাঁধে ঝুলছে ব্যাগ। ঠোঁটে গাঢ় লাল ওষ্ঠরঞ্জন। অরুণিকা বলল, “কি দেখছিস এভাবে?”
“প্রতিবারই তো ব্ল্যাক পরে বের হতি। আমিও তো আজ ব্ল্যাক পরলাম। আর তুই কি-না হোয়াট পরেই রেডি!”
“প্রতিবছর আর এ বছর এক না।”
“কেন?”
“বাদ দে। তুই বুঝবি না।”
“ধুর, তোর এসব কঠিন কথাবার্তা বুঝতেও চাই না। চল তাড়াতাড়ি, মায়ের মন পাল্টানোর আগেই বেরিয়ে যাই চল।”
দু’জনই গেট দিয়ে বের হতেই আহনাফকে দেখে থমকে গেল। আহনাফকে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল অরুণিকা। আহনাফের চুল বেশ এলোমেলো। চোখ দু’টি লালচে হয়ে আছে। আরাফ তখনই সিঁড়ি বেয়ে নামলো। রুহানি আরাফকে দেখে উৎসাহ নিয়ে বলল, “স্যার, আপনিও কন্সার্টে যাচ্ছেন?”
আরাফ কোনো উত্তর দিল না। আরাফ মৌন থাকায় বেশ দুঃখ পেল রুহানি।
এদিকে আহনাফ অরুণিকাকে একনজর দেখে নিজের মোটর সাইকেলে উঠে বসলো। অরুণিকাও রুহানির হাত ধরে বেরিয়ে পড়ল। অরুণিকা চলে যেতেই আহনাফ বুকে হাত রাখল। জোরে জোরে শ্বাস নিল বার কয়েক। হাত দিয়ে চেপে ধরলো বুক। আরাফ আহনাফের কাঁধে হাত রাখতেই আহনাফ ইশারায় বুঝল সে ঠিক আছে। এরপর চাবি ঘুরিয়ে মোটর সাইকেল স্টার্ট দিল।
(***)
দুইটা মোটরসাইকেল রুহানি ও অরুণিকাকে পাশ কেটে সাঁইসাঁই করে চলে গেল। অরুণিকা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আহনাফের মোটর সাইকেলটির দিকে। মানুষটার চোখ-মুখ কেমন বিধ্বস্ত হয়ে গেছে! চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে এলো তার। রুহানি অরুণিকার দিকে তাকিয়ে বলল, “কি হলো! চোখে জল কেন তোর?”
অরুণিকা চোখের কোণা মুছে বলল, “ধুলো ঢুকেছে।”
রুহানি ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “আমি বুঝি। আহনাফ স্যারের চেহারা দেখেই তোর চেহারা পাল্টে গেছে। আসলে কি জানিস, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক এমনই হয়। যেভাবেই হোক, বিয়ে তো হয়ে গেছে। আর যতোদিন এই সম্পর্ক থাকবে, অদৃশ্য মায়া থাকবেই। আমি জানি, তুই উনাকে ঘৃণা করিস। কিন্তু এই অদৃশ্য মায়ায় বরাবরই বাঁধা পড়ে যাবি তুই। হ্যাঁ, তোদের বিয়েটা খুব বাজেভাবে হয়েছিল। কিন্তু একবার আল্লাহর ইচ্ছায় বাঁধা পড়া দুইটা মানুষের বিচ্ছেদ, এতো সহজ না। দেখ, বিচ্ছেদ মানেই শয়তানের খেলা। শয়তানই তো বিচ্ছেদ চায়। এজন্যই কখনো তোর জল্লাদ শাশুড়ী ভেজাল করে, কখনো আহনাফ স্যারের ভেতর লুকিয়ে থাকা সেই ইবলিশটা জেগে উঠে। কিন্তু ভালো মানুষ বিচ্ছেদ ঘটায় না।”
“কি বলতে চাচ্ছিস তুই?”
“আমি আসলে কি বলবো? আমার ভালো লাগে না বিচ্ছেদ। আমি প্রতিদিন নামাজ পড়ে দোয়া করি, আহনাফ স্যার যাতে ভালো হয়ে যায়। কারণ আমি কারো বিচ্ছেদ চায় না। তোদের বিয়ে না হলে, আমি কখনোই এমন দোয়া করতাম না। কিন্তু বিয়ে অনেক দৃঢ় একটা সম্পর্ক।”
অরুণিকা রুহানির হাত ধরে বলল, “প্লিজ, আমাকে ম্যানিপুলেট করিস না। মানুষ অনেক স্বার্থপর। সবাই নিজেরটাই দেখে। আমিও অনেক কষ্টে স্বার্থপর হয়েছি। এই পৃথিবীতে বেশি ভালো হয়ে থাকার কোনো মূল্য নেই। আমিও তাই ভালো হয়ে থাকতে চাই না। আমাকে এভাবেই থাকতে দে। বিচ্ছেদ হবে কি হবে না, এটা সময় বলে দেবে। যদি হয়, মনে করবি এটাও আল্লাহর ইচ্ছা। না হলেও আল্লাহর ইচ্ছা। অন্তত তুই কিছু বলিস না।”
চলবে-
#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-৪৪ (২য় ভাগ)||
চট্টগ্রাম এম.এ.আজিজ স্টেডিয়াম থেকে ভেসে আসছে হাজারো মানুষের চিৎকার। বিভিন্ন রঙের স্পটলাইটের আলোয় আলোকিত স্টেডিয়াম। কয়েকটি ব্যান্ড গান গেয়ে নেমে পড়েছে স্টেজ থেকে। সবার শেষে গান গাইবে দেশের অনেক বড় শিল্পী। তবে সেই শিল্পীর আগমনের পূর্বে স্টেজ কাঁপাতে আসবে রহস্য ব্যান্ড। মাইক্রোফোনে জানানো হলো এই বার্তা। হাজারো ভক্তের মাঝে রহস্য ব্যান্ডের ভক্তদের হর্ষধ্বনিতে কেঁপে উঠলো স্টেডিয়াম। এই উল্লাসধ্বনি স্টেজের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা তূর্যের কান অব্ধি পৌঁছাতেই মুহূর্তেই বাকরুদ্ধ হয়ে গেল সে। ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা মিস্টার কামাল উদ্দীনের সহকারী তূর্যের কাঁধে হাত রেখে বললেন, “দেখছো, তোমাদের ভক্ত কিন্তু অনেক। আমার মেয়েও তোমাদের গান শুনে। আমার মনে হয়, তোমরাও খুব শীঘ্রই আকাঙ্ক্ষিত শিল্পীদের তালিকায় নাম লেখাবে। দেখা যাবে তোমাদের প্রধান করেই কন্সার্ট আয়োজন করা হচ্ছে।”
তূর্য ক্ষীণ হেসে আহনাফের দিকে তাকালো। আহনাফ চুপচাপ বসে আছে এককোণে। মুখ মাস্ক, চোখ লাল হয়ে আছে। আহনাফকে দেখে শরীরের সব শক্তি হারিয়ে যাচ্ছে তূর্যের। কীভাবে গান গাইবে ছেলেটা?
(***)
হেমন্তের সাঁঝবেলা। হঠাৎই স্পটলাইট সব একে একে নিভে গেল। দর্শকদের মাঝে সৃষ্টি হলো কৌতূহল। তারা তাকিয়ে আছে স্টেজের দিকে। মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে রেখেছে অনেকে। সেই আলোয় দূর থেকে মনে হচ্ছে জোনাকি পোকারা অধীর আগ্রহে ছ’টি ঝিঁঝিঁপোকার অপেক্ষায় বসে আছে। মিনিট খানিক নিরবতা বিরাজ করল স্টেডিয়ামে। দর্শকেরাও সেই মৌন পরিবেশটিকে সায় দিল। হঠাৎ একটি স্পটলাইট জ্বলে উঠলো। স্পটলাইটের আলো একটি সাদা পর্দার উপর এসে পড়েছে, যার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে এক মানব ছায়া। তার হাতে একটি বেহালা, সামনে স্পিকার। ছায়া মানবকে দেখেই দর্শক সারি থেকে ভেসে এলো শিষ আর করতালির শব্দ। তখনই মানব ছায়াটি বেহালায় সুর দিল, আর মুহূর্তেই নিস্তব্ধ হয়ে গেল পুরো স্টেডিয়াম। প্রায়ই ত্রিশ সেকেন্ডের বেহালার সুরে বিষন্ন আবহ সৃষ্টি হতেই স্পটলাইট পড়লো কীবোর্ডিস্ট গীতভেনের উপর। কীবোর্ডে মিশ্র সুর তুললো সে। পরমুহূর্তেই স্পটলাইট পড়লো রাফ কিংয়ের উপর। গিটারের শব্দ ছড়িয়ে পড়ল বাতাবরণে। এবার স্পটলাইট পড়লো পুরো স্টেজে। তূর্য শেখের পেছনে ড্রামশান তার ড্রামে হালকা সুর তুলছে। পাশেই মৃতকাব্য গিটারে সুর দিচ্ছে। কিন্তু কুয়াশ বাহ সেখানে নেই। সবাই থমকে গেল স্টেজে পাঁচ সদস্যকে দেখে। কিন্তু তূর্য শেখ কন্ঠে সুর দিতেই দর্শকের মনোযোগ সেদিকেই গেল। তূর্য গান ধরলো কন্ঠে। তার লেখা গান, তুমি সত্য নও শ্যামা।
“তুমি গোধূলীর চাঁদে ঝরে পড়া আলো।
চুপিচুপি বলেছিলে, আমায় বাসো ভালো।
তুমি ছিলে মৌনতার- আড়ালে থাকা গান।
আমার চোখে ছিলে চিরায়ত-
আমাকে ফেলে কি মায়ায়!
এই আমি সেই যার মন ভেঙেছিল
যেই মনে ছুঁয়ে দেয় না রোদ,
যেই মন বাঁধে না আশা!
.
দিঘির পাড়ে, ফুলের ভীড়ে
ছেয়ে গিয়েছিল কাঁটা।
তোমার হাসি, বুঝিনি আমি
আলোয় ঘেরা এক আঁধার,
আমার চোখে ছিলে চিরায়ত-
আমাকে ফেলে কি মায়ায়!
এই আমি সেই যার মন ভেঙেছিল
যেই মনে ছুঁয়ে দেয় না রোদ,
যেই মন বাঁধে না আশা!
.
আষাঢ় গেল, প্রেমের কবি
আজও বিষণ্ন এই গীতি!
চোখেরই জলে, দিঘির পাড়ে
জেগে আছে শত স্মৃতি।
আমার চোখে ছিলে চিরায়ত-
আমাকে ফেলে কি মায়ায়!
এই আমি সেই যার মন ভেঙেছিল
যেই মনে ছুঁয়ে দেয় না রোদ,
যেই মন বাঁধে না আশা!
.
তুমি সবুজের ভীড়ে উদিত একটি ভুল
তুমি আমার হৃদয়ে গাঁথা অগ্নিশূল।
তুমি আমার শ্যামা নও, নও সত্য ভুবনে,
তুমি ছিলে এক গল্প, করেছো কি এক ছলনা-
এই গান লিখে তোমাকে দিয়েছি-
এক রাশ ঘৃণা উপহার।
এক রাশ ঘৃণা উপহার।”
গান শেষ হলো ড্রামশানের তীব্র আলোড়নে। তূর্য পেছন ফিরে ছলছল চোখ জোড়া সবার দৃষ্টির আড়ালে মুছে নিল। এরপর সামনে ফিরে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বলল, “গুড ইভিনিং চিটাগং। আরো এক হেমন্তে সুরে হয়ে ফিরে এসেছি এই চেনা শহরে, চেনা-অচেনা মানুষের ভীড়ে।”
দর্শকেরা চিৎকার করে সাড়া দিচ্ছে তূর্যের কথায়। এই প্রথম বেহালা বাজিয়েছে তূর্য। ভক্তরা বেশ আনন্দিত। দ্বিতীয়বার বেহালা বাজাতে বলল তারা। তূর্য উলটো দিকে ফিরে ইশারায় বোঝাল, আর হবে না।
দর্শক সারিতে দাঁড়িয়ে আছে উপমা। তার চোখে জল। ভীড় ঠেলে পেছন থেকে সামনে এসেছে অনেকটা। খুব ইচ্ছে, এবার অন্তত তূর্যকে কাছ থেকে গান গাইতে দেখবে। প্রতিবারই পেছনে পড়ে যায় সে৷ সামনে আসতে পারে না। কিন্তু আজ দেখতে চায়। তূর্ণার খুব আগ্রহ কন্সার্ট দেখার। উপমার এতো টাকা নেই যে প্রতি কন্সার্টের টিকেট কিনবে। কিন্তু নিজের প্রিয় মানুষের কন্সার্টের টাকাটা যেন না খেয়েই জমিয়ে ফেলতে পেরেছিল সে। অদৃশ্য এই আত্মিক টানের কাছে অন্য সব চাহিদা মূল্যহীন।
তূর্য এবার মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বলল, “এখন আমি একটা গান কাভার করবো। আপনাদের সবার পছন্দের গান। আমারও খুব পছন্দের। এই গানটি কাভার করেই আমি আমার প্রথম ভিডিও সোশাল মিডিয়াতে ছেড়েছিলাম।”
ভক্তরা তূর্যের কথা শুনেই বুঝে গেল, সে কোন গানটি গাইবে। এবার তূর্যের ইশারায় গীতভেন আর রাফ কিং গানের সুর তুললো। যোগ হলো ড্রামশানের মৃদু আলোড়ন। তূর্য চোখ বন্ধ করে কন্ঠে গান ধরলো। গাইলো তার পছন্দের গান।
“কারণে অকারণে, নিষেধে বা বারণে
তোমার নামেই যত জোছনা নিলাম।
ভেতরে বাহিরে, দহণে বা ধারণে
আমায় নিখোঁজ ভাবো- বাঁপাশেই ছিলাম
চোখে জল নোনা কি নিয়ে গেলো জোনাকি
কেনো- আমি পথে একা দাঁড়িয়ে!
আলোদের পিয়নে সোডিয়াম নিয়নে
যেনো- সবই কোথায় হারিয়ে
আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি, তোমার দ্বিধায় পুড়ে যাই।
এমন দ্বিধার পৃথিবীতে তোমায় চেয়েছি পুরোটাই।
আমি তোমার স্বপ্নে বাঁচি, তোমার স্বপ্নে পুড়ে যাই
এমন সাধের পৃথিবীতে তোমায় চেয়েছি পুরোটাই।”
গানটি শেষ হতেই নিজের লেখা আরো কয়েকটা গান গেয়ে ফেললো তূর্য। মৃতকাব্যের লেখা একটি গানে সুর দিল রাফ কিং। অনেকক্ষণ চললো রহস্য ব্যান্ডের গান। কিন্তু এবার ভক্তদের মাঝে বিরাজ করছে অস্থিরতা। এতো গান গেয়ে নিলো, কিন্তু কুয়াশ বাহের কোনো দেখা নেই! প্লেকার্ড হাতে ভক্তরা কুয়াশ বাহের নাম ধরে চিৎকার করছে। অরুণিকা আশেপাশে ভক্তদের চিৎকার শুনে চমকে উঠলো। রুহানি বলল, “কুয়াশ বাহটা আবার কে!”
“ওদেরই একজন।”
“কেমন নাম রে, বাবা। উচ্চারণ করতেই দাঁত ভেঙে যাচ্ছে, আর এই ভক্তরা কীভাবে চেঁচাচ্ছে এই নাম ধরে। ওই কুয়া-মুয়াটা আসছে না কেন?”
অরুণিকা নিজেও স্টেজে আহনাফকে না দেখে অবাক হয়েছিল। দু’একদিন আগেই তূর্য বলেছিল, আহনাফ হৃদরোগে ভুগছে। এজন্যই কি আসে নি? উচ্চশব্দ হৃদরোগীরা সহ্য করতে পারে না। আহনাফ কি সত্যিই খুব অসুস্থ? অরুণিকার বেশ অস্থির লাগছে।
হঠাৎ স্পটলাইট সব নিভে গেল। স্পিকারও বন্ধ। স্টেজের পেছনে আহনাফকে দেখতে এলো বাকি পাঁচজন। আরাফ হেলমেট খুলে আহনাফের কান থেকে হেডফোন খুলে নিয়ে বলল, “ঠিক আছিস?”
আহনাফের কান অব্ধি উচ্চশব্দ না পৌঁছানোর জন্য হেডফোন ব্যবহার করেছে সে। তবুও ড্রামের শব্দে বুক ধড়ফড় করছে তার। যদিও অনেক দূরে বসেছিল সে। আহনাফ এবার তূর্যের দিকে তাকিয়ে বলল, “সরি, দোস্ত।”
তূর্য আহনাফের পাশে বসে বলল, “তুই না পারলে এমনিতেই সবাইকে হাই বলে আয়। তুই অসুস্থ এটা শুনলে কেউ তোকে ফোর্স করবে না। মানুষ এতোটাও নিষ্ঠুর না।”
আহনাফ আরাফের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “অরু এসেছে?”
“হ্যাঁ।”
“আমি অবশ্যই গান গাইবো। ওর জন্য গাইতে হবে আমার। ওকে অনেক কথা বলা বাকি। গানে গানে যদি আমার কথা ওর হৃদস্পর্শ করে। আমাকে যদি এবার ক্ষমা করতে পারে।”
পাঁচজন শূন্য দৃষ্টিতে এক অপসত্ত্ব হৃদয়ের হাহাকার শুনছে।
মিনিট পাঁচেক পর আবার স্পিকার চালু করা হলো। ব্যান্ড সদস্যদের প্রস্তুতির মৃদু শব্দ ভেসে আসছে সাউন্ড বক্স গলে। এবার ড্রামশানের উপর স্পটলাইট পড়লো। ড্রামে হালকা শব্দ তুললো সে। পরমুহূর্তেই স্পটলাইট পড়লো কুয়াশ বাহের উপর। পিয়ানোর সুর ছড়িয়ে পড়লো পুরো স্টেডিয়ামে। আবার হর্ষধ্বনিতে মুখরিত দর্শক সারি। পিয়ানোর সুর গাঢ় হতেই নীরবতা ছেয়ে গেল পুরো স্টেডিয়ামে। সবাই মনোযোগ দিয়ে কুয়াশ বাহের সুর শুনতে ব্যস্ত। সেকেন্ড খানিক পর সুর তুলে সে যোগ করলো তার কন্ঠ। সাথে সাথেই স্পটলাইট পুরো স্টেজে ছড়িয়ে পড়লো। এবারের বাদ্যযন্ত্রে নিচু তান ধরেছে প্রতিটি সদস্য।
(***)
কুয়াশ বাহ বসে আছে তার চেয়ারে৷ সামনে পিয়ানো। কন্ঠে ধরলো, তার লেখা গান, ভালোবেসে যাই।
“আমি কি তোমার জীবনের সেই শব্দদূষণ,
যেই দূষণ তোমাকে করেছে বিষন্ন ভীষণ।
আমি কি তোমার জীবনের সেই অপ্রিয় ভুল,
যেই ভুলের মাশুল দিতে গিয়ে এই হৃদয় ব্যাকুল।
আমি কি সেই কালো ছায়া,
যেই ছায়ার ভীড়ে লুকিয়ে আছে ঘৃণার কায়া।
আ আ আ……….
তুমি আজও বুঝোনি, বুঝবে না কখনো,
দূর থেকেও আমি তোমায় ভালোবেসে যাই এখনো।
.
তোমার হাসিতে আমার শব্দরা যেন ফিরে পাই প্রাণ,
তোমার অভিমানে আমার কষ্টরা মিলেমিশে ঐকতান,
তোমার স্পর্শে আমার স্বপ্নরা ডানা মেলে গাই গান।
তুমি একটু ফিরে চাইলে আমি ভুলে যাবো মিথ্যে অভিমান।
ও ও ও…..
তবে তুমি আজও বুঝোনি, বুঝবে না কখনো,
দূর থেকেও আমি তোমায় ভালোবেসে যাই এখনো।
.
তুমি আজও জানো নি, সেই কবিতারা তোমায় খুঁজে।
তুমি আজও জানো নি, সেই ভোর তোমায় দেখে হাসে।
হিসেবে-বিহিসেবে, দীর্ঘ অন্ধকার রাতে
আমি স্বপ্ন বুনি নিজ হাতে।
তুমি দূরে সরে যেও না,
তুমিহীনা আমি এই জীবনে কিছু না।
না না না………”
অরুণিকা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কালো হেলমেট পরা কুয়াশ বাহ ওরফের আহনাফের দিকে। অজান্তেই চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল তার। অরুণিকা চোখ মুছতেই রুহানির বলা কথাটি মাথায় ঘুরতে লাগলো, “স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে অদৃশ্য এক মায়া থাকে।”
অরুণিকা নিজেকে স্বাভাবিক করতে নেবে তখনই গান শেষ হলো আহনাফের। সে এবার মাইক্রোফোন হাতে উঠে দাঁড়ালো। ইশারায় থামিয়ে দিল সব বাদ্যের শব্দ। মিনিট খানিক স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। দর্শক মহলে উত্তেজনা। হেলমেটের আড়ালে চোখ জোড়া কোথায় স্থির হয়েছে? অরুণিকা জানে আহনাফ তাকেই দেখছে। সে চোখ নামিয়ে অন্য এক দর্শকের ভীড়ে নিজেকে আড়াল করে নিলো। আহনাফ তা দেখে ক্ষীণ হেসে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে খালি গলায় গান ধরলো,
“তোমার আকাশ ধরার শখ,
আমার সমুদ্দুরে চোখ,
আমি কী আর দেবো বলো?
তোমার শুধুই ভালো হোক।
তোমার ভোলা-ভালা হাসি,
আমার বুকের ভেতর ঝড়,
তুমি চলতি ট্রেনের হাওয়া-
আমি কাঁপি থর থর।
তোমার নানান বাহানায়, আমার জায়গাটা কোথায়?
আমি কী একঘোরে থাকি?
ছিল কত কথা বাকি।
তোমার গোপন সবই রয়,
আমার আপন মনে হয়,
আমি ভোরের ঝড়া পাতা,
আমার মরার কীসের ভয়?”
আহনাফের ইশারায় গীতভেন আর ড্রামশান সুর তুললো যন্ত্রে। আহনাফ আবার গাইলো,
“তোমার নরম কাতর হাত,
আমার দিনের মত রাত,
তুমি ঝিনুক কুঁড়াও- যদি আমি হবো শান্ত নদী
আমার আসার সময় হলে, তুমি হাত ফস্কে গেলে
তোমার যাওয়ার পায় তারা, আমি হই যে দিশেহারা,
তুমি অন্য গ্রহের চাঁদ, আমার একলা থাকার ছাদ।
তোমার ফেরার সম্ভাবনা, অমাবস্যায় জোছনা
তোমার গোপন সবই রয়, আমার আপন মনে হয়
আমি ভোরের ঝড়া পাতা, আমার মরার কীসের ভয়?”
গান শেষ হতেই কুয়াশ বাহ ভক্তদের উদ্দেশ্য করে হাত নাড়লো। ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “দুঃখিত, একটু অসুস্থ হওয়ায় শুরু থেকে ছিলাম না। আমার লেখা শেষ গানটি দিয়েই আজ আমাদের পারফরম্যান্স এখানেই শেষ হবে।”
কুয়াশ বাহের ইশারায় বাকি সদস্যরা নিজ নিজ বাদ্যে সুর দিল। কুয়াশ বাহ নিজের আসনে বসে কন্ঠে গান ধরলো। ভক্তরা গানের সুরে সুরে ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে ফোন শূন্যে দোলাতে লাগলো।
“যা দিচ্ছে আমায় শাস্তি, তার শেষটা অজানা,
আমি গুমরে কেঁদে মরছি এই ধরায়।
তুমি বলেছিলে আসবে, আমায় খুব ভালোবাসবে।
এই মন নুতন সূর্যের অপেক্ষায়
তার ফিরে আসা, অজানা।
তার চলে যাওয়া, অচেনা।
তার ফিরে আসা, অজানা।
তার চলে যাওয়া, অচেনা।
আ আ আ…. ও ও ও………”
পিয়ানোর শব্দে যুক্ত হলো বেশ বিষন্ন তান। গলার উঁচু-নিচু সুরের সাথে প্রকৃতিতে বিরহী আত্মার আক্ষেপ ছড়িয়ে পড়ল। কুয়াশ বাহ আবার গাইলো,
“আমি রোজ বসে আছি, তার ফেরার অপেক্ষায়।
এক নীলচে আলো আঁকড়ে ধরেছে,
আমার এইটুকু বিশ্বাস, তুমি আবার প্রেমে পড়বে,
তখন ছাড়বে কেমন করে এই আমায়?
তার ফিরে আসা, অজানা।
তার চলে যাওয়া, অচেনা।
তার ফিরে আসা, অজানা।
তার চলে যাওয়া, অচেনা।
আ আ আ…. ও ও ও………”
কুয়াশ বাহ উঠে দাঁড়ালো। তার বুকে অসহ্য ব্যথা। তবুও বুকে হাত রেখে গাইতে লাগলো,
“আমি এক তিক্ত অতীত, যার নেই কোনো আশ্রয়।
তবু ফিরছি খুঁজে আমার পরিচয়
এই কেমন ভাগ্য লিখছি, যার হচ্ছে না সমাপ্তি
চাইছি ফিরতে তোমারই ছায়ায়।
.
একদিন তুমি বুঝবে-
আমি তোমায় ছাড়া অসহায়।
তোমার ফিরে আসা
তোমার চলে যাওয়া
আমার জীবনে–
আমার জীবনে অচেনা এক অধ্যায়।”
গানের মাঝেই আহনাফের চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। সে গভীরভাবে ডুবে গিয়েছিল সেই সুরে। ভক্তদের চোখেও জল। তবে হেলমেটের আড়ালে আহনাফের অশ্রুভেজা চোখ কেউ দেখে নি৷ শুধু অরুণিকা বুঝলো সেই আক্ষেপ। তার চোখ জোড়াও ভিজে উঠলো। আহনাফের দৃষ্টি এখনো অরুণিকার দিকে। দু’জনের চোখাচোখি হলো, শুধু হেলমেটের বাঁধা সেই চোখাচোখি ধরতে পারলো না।
(***)
রহস্য ব্যান্ডের গান শেষ হলো। এবার ভক্তদের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার পালা। রুদবা অনেক চেষ্টা করেও সামনে আসতে পারে নি। সে তূর্যকে বোঝাতে চায়, সে কন্সার্টে এসেছে। তাই ভীড় ঠেলে সামনে আসার চেষ্টা করছে। এদিকে স্টেজ থেকে নামার আগ মুহূর্তেই ভক্তদের সারিতে চোখ পড়লো তূর্যের। আর মুহূর্তেই থমকে গেল তার পুরো পৃথিবী। উপমা দাঁড়িয়ে আছে লাল শাড়িতে। সে আজ তূর্যের পছন্দে সেজেছে। তূর্য একদিন বলেছিল, “লাল শাড়িতে মায়াবী লাগে আমার শ্যামকন্যাকে।”
ওদিকে তূর্যের ভিডিও ধারণ করে বেশ খুশি উপমা। সেবাজ মেয়েকে তার বাবার ভিডিও দেখাবে। বেশ খুশি হবে তূর্ণা। মেয়ের খুশির কথা ভেবেই চোখে জল এসে গেল উপমার। উপমা সামনে তাকাতেই চোখাচোখি হলো দু’জনের। তূর্যকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দ্রুত এগিয়ে এলো সে। তখনই রুদবা তূর্যের দিকে ফোন এগিয়ে দিয়ে বলল, “প্রিয় স্টার, একটা সেলফি!”
রুদবাকে চিনতে অসুবিধে হয় নি উপমার। সেদিনের সেই ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি। মেয়েটি কি তূর্যের আপন কেউ? অস্থির প্রশ্নটি হৃদয়ে তুমুলভাবে আন্দোলিত হতে লাগল। উপমা মেয়েটির পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। তূর্যের মুখোমুখি দাঁড়ানো উপমা আর রুদবা পাশাপাশি। তূর্যের চোখ অন্যদিকে আটকে আছে দেখে রুদবা তূর্যের চোখ অনুসরণ করে পাশ ফিরে তাকাতেই উপমাকে দেখলো। বেশ চেনা চেনা লাগছে এই মুখ। কিন্তু কোথায় দেখেছে মনে করতে পারছে না। উপমা তার ফোন এগিয়ে দিয়ে ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “আমার মেয়ের জন্য একটা ছবি তুলে দেবেন? মেয়েটা খুশি হবে অনেক।”
রুদবা উৎসুক কন্ঠে বলল, “আচ্ছা স্টার, আপনি না হয় উনার সাথে আগে তুলে ফেলুন। আমি বাসায় ফিরে তো আপনার সাথে ছাদে অনেক ছবি উঠাতে পারবো।”
কথাটি শুনেই চমকে উঠলো উপমা। তূর্যও ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। উপমার এগিয়ে দেওয়া হাতে কাঁপন ধরলো, যা তূর্যের দৃষ্টি এড়ালো না। তূর্য কিছু একটা ভেবে রুদবার হাত থেকে ফোন নিয়ে কয়েকটা ছবি উঠালো রুদবার সাথে। রুদবা তো সেই খুশি। তূর্য ফোনটি রুদবাকে ফেরত দিয়ে উপমার দিকে তাকিয়ে ঠাট্টার সুরে বলল, “এই অন্ধকারে আঁধার জড়ানো চেহারায় লাল রঙ বেশ বেমানান। ছবি ভালো আসবে না। পরের হেমন্তে ভেবে দেখবো।”
তূর্যের কথা শুনে উপমার হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেল। সে দ্রুত বসে ফোনটা কুঁড়িয়ে নিয়ে চোখ তুলে একনজর তূর্যের দিকে তাকালো। রুদবার সামনে বেশ অপমানিত হলো সে। চোখ ভিজে উঠার আগেই উপমা উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত চলে গেল। উপমা চলে যেতেই রুদবা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “এভাবে কেন বললেন উনাকে? এভাবে কাউকে কষ্ট দেওয়া কি ঠিক হয়েছে?”
তূর্য রুদবার হাত থেকে ফোনটা কেঁড়ে নিয়ে একটু আগে তোলা ছবিগুলো ডিলিট করে দিয়ে বলল, “আমার জন্য কি ঠিক, সেটা আমি বুঝবো!”
রুদবা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “ছবিগুলো ডিলিট করে দিলেন কেন?”
তূর্য উত্তর না দিয়ে চলে গেল। রুদবা চেঁচিয়ে বলল, “ডোন্ট ওয়ারি। রিসাইকেল বিনে জমা হবে।”
তূর্য পেছন ফিরে রুদবার দিকে তাকাল। রুদবাও চোখ টিপ মেরে চলে গেল।
(***)
উপমা এলোমেলো ভাবে রাস্তায় হাঁটছে। তার কান ঝাঁ ঝাঁ করছে। একটু আগে তূর্যের বলা ধারালো কথাগুলো তার বেঁচে থাকার ইচ্ছে কয়েকগুণ কমিয়ে দিয়েছে। কিছু দূর গিয়ে থমকে দাঁড়াল উপমা। আকাশের দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ কন্ঠে অভিযোগ করলো, “দেখেছো আল্লাহ, কীভাবে অপমান করলো আমাকে? তুমিই তো আমাকে এই রঙ দিয়েছো। আমার তো কোনো অভিযোগ নেই তাতে। একটা সময় ওই মানুষটারও তো কোনো অভিযোগ ছিল না। কিন্তু আজ সে আমার হৃদয়ে আঘাত করলো। ভালো তো বাসতোই না আমাকে। সব মিথ্যে আশা দিয়েছিল। আর আজ মানুষ হিসেবে অন্তত সম্মান দেখাতে পারতো। বাকীদের সাথে কতো সুন্দর করে কথা বলে! অথচ আমি! ও আমাকে কেন এতো অবহেলা করে? আমি তো অধিকার খুঁজতেও যাই নি। একটা ছবি চেয়েছিলাম। তাও আবার ওর মেয়ের জন্য। মেয়ের কথা শুনেও একটু নরম হলো না!”
উপমা চোখ মুছে ফুটপাতে বসে পড়ল। ফোনের তূর্যের ভিডিও দেখতে দেখতে নীরবে চোখের জল ফেললো সে। ভিডিও দেখা শেষে তূর্যের কয়েকটা সদ্য তোলা জীবন্ত ছবিতে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে উপমা আপনমনে বলল, “এভাবে কেন অস্বীকার করলে আমাদের? তুমি কি অন্তত একবার বাচ্চা মেয়েটার কথা চিন্তা করে আমাকে মেনে নিতে পারতে না? মানছি, তোমাদের শেখ বংশ। অনেক বড় ঘরের ছেলে তুমি। এখন তো অনেক বড় রকস্টার হয়ে গেছো। ফিরেও দেখছো না আমাকে। এখন তো আমি খুব বেমানান তোমার দৃষ্টিতে। কিন্তু একটুখানি ভালো তো নিশ্চয় বেসেছিল। এতো সূক্ষ্ম অভিনয় তো কেউ করতে পারে না। হ্যাঁ, নিশ্চয় একটুখানি হলেও ভালোবেসেছিলে। সেই দোহাই দিয়ে অন্তত আমার মেয়েটাকে আশ্রয় দিতে পারতে। অন্তত ওর দায়িত্ব নিতে পারতে। মেয়েটাকে ভালো স্কুলে পড়াতে পারি না। আমি সামান্য একটা গ্রামের মেয়ে। শহরে এসে একাই আমাদের যুদ্ধ করতে হচ্ছে এই সমাজের সাথে। তুমি একটু দয়া দেখালেই তো পারতে। খুব অসহায় হয়ে পড়েছি আমি। তোমাকে ভালোবাসি বলে হয়তো তোমাকে ঘৃণা করতে পারি না। নয়তো তুমি আমাকে যেই অজুহাতে, যেই পরিস্থিতিতে ছেড়ে চলে গিয়েছিলে, আমি কঠিন হৃদয়ের হলে তোমাকে খুব ঘৃণা করতাম। খুব।”
উপমা চোখ মুছে ছবিটির দিকে তাকিয়ে পুনরায় বলল, “তুমি তো জানতে, আমার বাবা কৃষি কাজ করতো। কিন্তু সব জেনেই তো ভালোবেসেছিলে এই গরিবের মেয়েকে। তাহলে এভাবে কেন ঠকালে আমাকে? তুমি মাশাল্লাহ খুব স্মার্ট ছেলে, আর আমি কালো, কুৎসিত। কিন্তু তুমিই তো ভালোবেসে শ্যামকন্যা বলে ডাকতে আমাকে! আমার গায়ের রঙে এতোই যদি ঘেন্না হতো, তাহলে কেন ছুঁয়ে দিলে এই শ্যামকন্যাকে? কেন বলেছিল, লাল শাড়িতে আমাকে মানায়? আজ তোমার জন্যই তো সেজেছি আমি। অন্তত আঘাত না করলেও পারতে। আমি জানি, আমি তোমার যোগ্য না। কিন্তু সেই বয়সে এতো কিছু কি বুঝতাম? বুদ্ধিশুদ্ধি থাকলে তখনই সরে যেতাম। বলে দিতাম, আমাদের একসাথে মানায় না। কিন্তু আমি বুঝি নি। তোমার কথাটাই বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম। ভেবেছি, আমি যেই হই, তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না। কিন্তু ঠকালে তো আমাকে! তুমি জানো না তূর্য, তুমি ছেড়ে যাওয়ার পর অনেক কলঙ্ক নিয়েই কলেজ পরীক্ষাটা দিয়েছিলাম। আমার শনির দশা সহ্য করতে না পেরে বাবাও আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। মাকে অনেক কষ্টে বুঝিয়ে তোমার সন্তানকে পৃথিবীতে এনেছি। আর তুমি তো অস্বীকার করলে বিয়েটা। সবার সামনে বললে, আমি তোমাকে ফাঁসাতে চাইছি। সবাইকে বললে, বাচ্চাটা তোমার না। অন্তত এই বাচ্চাকে স্বীকার করে নিলে এতো কষ্ট হতো না আমার। অন্তত সত্যটা স্বীকার করে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিলেই অনেক শান্তি পেতাম আমি। কিন্তু তাও তো করলে না। আমাকে এখনো ঝুলিয়ে রাখলে এই সম্পর্কে। আমার মা অনেক কষ্ট করেছে আমার জন্য। গ্রাম ছাড়া হয়েছে। লোকে বলে, মা আমাকে মানুষ করতে পারে নি। তাই আমার চারিত্রিক অধঃপতন হয়েছে। আমার মা পড়াশুনা করে নি। কিন্তু শহরে এসে আমাকে ঠিকই পড়িয়েছে। নিজে গার্মেন্টসে কাজ করে আমাকে অনার্স করিয়েছে। জানো, একটা অল্প বেতনের চাকরি নিয়েছি আমি। মেয়েটার তার বাবার মতো শখ। আমার মেয়েটা খুব কষ্ট পাই, জানো? ওকে কিছু কিনে দিতে পারি না। তুমি কতো বিলাসিতায় আছো। একটু দয়া করে অন্তত তোমার মেয়ের দায়িত্ব নিতে পারতে! কিন্তু তুমি তো মেয়েটাকে ভালোই বাসো না। আর এদিকে আমার বাচ্চাটা ‘বাবা, বাবা’ করে মুখে ফেনা তুলে। আমি ওকে কীভাবে বুঝাই, তার বাবা তাকে চায় না।”
উপমার ফোঁপানো কান্নার শব্দ আটকে রইলো তার মনের মাঝেই। একটি ছবি শুধু দেখলো সেই জল, যেই ছবির মানুষটি এই আকাশের নিচে জীবন্ত থেকেও আজ নিষ্প্রাণ।
চলবে-