উইন্টার এন্ড মাই সনেট পর্ব-৪৬+৪৭

0
1

#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-৪৬ ||

আঁধার নেমেছে ধরায়। মৃদুমন্দ হাওয়ায় শরীর কাঁপছে অরুণিকার। আজ চাইলে সে হিমালয়ের সাথে যেতে পারতো। কিন্তু সংকোচবোধ থেকেই উঠলো না তার মোটর সাইকেলের পেছনে। এখন গাড়ি, রিকশা কোনোটাই পাচ্ছে না অরুণিকা। অনেকক্ষণ হাঁটার পর হঠাৎ একটি মোটর সাইকেল এসে থামলো তার সামনে। অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে তাকালো হেলমেট পরা মানুষটির দিকে। গ্লাস তুলে দিতেই অরুণিকা বলল, “আপনি!”

“আবার আপনি?”

“সিনিয়র বলে কথা।”

ইমান হেসে বলল, “এখানে কি করছো?”

অরুণিকা হালকা হেসে উত্তর দিল, “একটু হাঁটতে বের হয়েছিলাম।”

ইমান রহস্যের সুরে বলল, “আচ্ছা!”

অরুণিকা স্মিত হেসে বলল, “জি।”

“চলো, তোমাকে বাসায় নামিয়ে দেই।”

“না, না,” ব্যস্ত সুরে বলল অরুণিকা।

“তা কেউ আসবে না-কি?” বলেই ইমান জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো।

অরুণিকা মাথা নেড়ে বলল, “না।”

“তো?”

“দেখি গাড়ি পাই কি-না।”

“গাড়ির জন্য কেন অপেক্ষা করতে হচ্ছে, যেখানে ড্রাইভার স্বয়ং হাজির।”

অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “ফ্লার্ট করছেন আমার সাথে?”

ইমান মাথা নামিয়ে হাসলো। এরপর হাত এগিয়ে দিয়ে বলল, “চলো।”

অরুণিকা আর কথা না বাড়িয়ে মোটর সাইকেলের পেছনে উঠে বসতেই ইমান হেলমেট তুলে সামনের দর্পণে চোখ রাখলো। একটু বেঁকে আছে সেই আয়না। অরুণিকাকে ভালোভাবে দেখার জন্য আয়নাটি সোজা করে দিয়ে বলল, “তো আজ শাড়ি পরলে যে! আজ কি কোনো বিশেষ দিন?”

অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “শাড়ি পরার জন্য কি কোনো বিশেষ দিন প্রয়োজন?”

“তুমি তো ওয়েস্টার্ন খুব পছন্দ করো। প্রায়ই ওয়েস্টার্ন পরো। শাড়ি পরলে তাই ভয় পেয়ে যাই।”

অরুণিকা অবাক কন্ঠে বলল, “ভয় পাওয়ার কি আছে?”

ইমান মৃদু হেসে বলল, “বুঝবে না তুমি।”

“সিরিয়াসলি! না বুঝার কি আছে? ভয় কেন পাবেন সেটা সোজাসাপ্টা বলে ফেলুন।”

“কোনো অনুষ্ঠান ছাড়া মেয়েরা শাড়ি পরে না। আজ তো কোনো অনুষ্ঠানও নেই। আর তুমি যেখানে খুব একটা শাড়িই পরো না, সেখানে আজ অবেলায় পরেছো, দ্যাট মিনস, প্রেম-টেম করছো! তাই না?”

“মানে?”

“মানে কারো সাথে কি দেখা করতে এসেছো?”

অরুণিকা চোখ-মুখ কুঁচকে বলল, “না।”

“তবে এই শাড়ি আর টিপ পরার কারণ?”

“আমার ইচ্ছে হয়েছে, তাই। আর এটার সাথে ভয়ের কি সম্পর্ক?”

“আমি তোমাকে পটানোর আগেই যদি তুমি অন্য কারো উপর পটে যাও, মনে মনে দুঃখ তো পাবোই। তাই ভয়ে আছি।”

অরুণিকা শক্ত কন্ঠে বলল, “মজা করছেন?”

“তুমি আমার জন্য অনেক স্পেশাল। তবে এই মুহূর্তে মজা করছি না। আমি আগে তোমার ভালো বন্ধু হতে চাই। বন্ধুত্বই সকল সম্পর্ক মজবুত করে। যেখানে বন্ধুত্ব নেই, সেখানে কোনো কিছুই স্থায়ী নয়। আমি তো তোমার বন্ধু হয়েই গেছি। এবার বন্ধুত্ব না হয় আরো গাঢ় হোক। একদিন বাসায় দাওয়াত করো আমাকে। ভাবছি, মামীকে পটিয়ে বন্ধুত্বটা পারিবারিক সম্পর্কে নিয়ে যাবো।”

“আপনার ফ্লার্টিং স্টাইল দেখে আমার আপসোস হচ্ছে, কেন আপনার বন্ধুত্বে সাড়া দিয়েছি।”

“সিরিয়াসলি?”

“আপনি মানুষ ভালো। তবে এভাবে ফ্লার্ট করবেন না। ভালো মেয়েরা এমন ছেলে পছন্দ করে না।”

“ভালো মেয়েদের পটানোর জন্য কী করা যায়?”

“মেয়েদের যাদের প্রতি মন বসার, তাদের প্রতি বিনা কারণেই বসে। ভালোবাসায় কোনো কারণের প্রয়োজন নেই।”

“তোমার কি মন বসে নি?”

“আপনি যদি স্পেশাল হতেন, আপনাকে আমি অবশ্যই হিন্টস দিতাম। আপনি সিনিয়র, আমাকে অনেকবার হ্যাল্প করেছেন। আমি আপনাকে রেস্পেক্ট করি। কিন্তু আপনাকে নিয়ে আমি ওভাবে কখনোই ভাবি নি। ভাবলে আপনার বাইকের পেছনে বসে এতো সহজে কথা বলতে পারতাম না। মেয়েরা সাধারণত যাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়, তাদের সামনে এলেই মন অস্থির হয়ে উঠে। আর এই অস্থিরতা তাদের আচরণেই প্রকাশিত হয়। আপনার পাশে দাঁড়িয়ে আমি কখনো অস্থির হই নি। আমি শিউর, আমি আপনার প্রেমে কখনোই পড়বো না।”

ইমান শব্দ করে হাসলো। বলল, “তুমি মেয়ে ভালোই কথা জানো। তোমার সাথে কথায় পারি না আমি।”

এই বলে ইমান আবার সামনের দর্পণে চোখ রাখলো। ধীরে ধীরে ইমানের হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকা অভিমানী মুখটা ভেসে উঠলো। এবার চোখ সরিয়ে রাস্তায় তাকালো ইমান। হুট করেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়তেই ভারসাম্য হারিয়ে ফেললো সে। অরুণিকা ইমানের কাঁধ খামচে ধরে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল, “কি করছেন?”

মুহূর্তেই ইমানের মোটর সাইকেল সামনে থাকা পুলিশ ভ্যানের সাথে ধাক্কা খেতেই অরুণিকা চোখ-মুখ কুঁচকে বলল, “মরবেন এবার।”

(***)

পুলিশ ভ্যানটি থামতেই, ভ্যান থেকে নেমে এলো তিনজন পুলিশ। বুক পকেটে তাদের নাম স্পষ্ট পড়ে নিল অরুণিকা। সিয়াম, করিম ও শাহেদ। এদিকে ইমান চোখ-মুখ খিঁচে বসে আছে মোটর সাইকেলে। তার দুই হাত দুই পাশের হ্যান্ডেল ধরে আছে। অরুণিকা মোটর সাইকেল থেকে নেমে পাশে দাঁড়াল। করিম নামক পুলিশ সদস্যটি জিজ্ঞেস করলেন, “কোথায় যাওয়া হচ্ছে?”

ইমান হেলমেট খুলে চুপচাপ কাগজপত্র বের করে দিয়ে বলল, “দুঃখিত স্যার, আমার মাথা ব্যথা করছিল। সকাল থেকেই ক্যাম্পাসে ছিলাম। কিছু খাই নি। তাই চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছিল।”

অরুণিকা অবাক হয়ে ইমানের দিকে তাকিয়ে রইল। এবার মিস্টার সিয়াম বললেন, “মেয়েটা কে হয় তোমার?”

“বউ।”

অরুণিকা চমকে বলে উঠলো, “মানে!”

ইমান চোখ বড় বড় করে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে ইশারায় চুপ থাকতে বলল। পুলিশ সদস্য তিনজন ইমানের মিথ্যে ধরে ফেললেন। মিস্টার শাহেদ অরুণিকাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কে এই ছেলে?”

অরুণিকা অসহায় দৃষ্টিতে ইমানের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা যে ইমানের মিথ্যে ধরে ফেলেছে, তা বুঝতে পেরে অরুণিকা বলল, “উনি আমার প্রতিবেশী। আমরা একই এলাকায় থাকি। আমি একটা কাজে এসেছিলাম। উনি আমাকে লিফট দিয়েছিলেন।”

মিস্টার শাহেদ এবার ইমানের দিকে তাকিয়ে বললেন, “মিথ্যে বললে কেন?”

ইমান অরুণিকার দিকে তাকালো। অরুণিকা মাথা নিচু করে চাপা স্বরে বলল, “সত্যটা বলে দিলেই হতো।”

ইমান ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তোমাকে কে বলেছে কথা বলতে?”

“তাই বলে বউ বলবেন? আমি অন্য কারো বউ হতে পারি। আপনি এমন সম্পর্ক নিয়ে এভাবে মিথ্যে বলতে পারেন না।”

মিস্টার করিম বললেন, “এ্যাঁই, নিজেদের মধ্যে ফুসুরফুসুর বন্ধ করো। আর যাও, ভ্যানে উঠো। তোমাদের থানায় নিয়ে যাবো। ওখানে গিয়েই ইচ্ছেমতো নিজেদের মিথ্যে গল্প শোনাতে পারবে।”

অরুণিকা নির্ভীক চিত্তে উঠে বসলো ভ্যানে। ইমানও চোখ-মুখ কুঁচকে ভ্যানে উঠে অরুণিকার মুখোমুখি বসে বলল, “সত্যবাদী যুধিষ্ঠি হতে কে বলেছে তোমাকে?”

“তাই বলে আপনি আমাকে বউ বলবেন? বোকা না-কি আপনি? ক্যাম্পাসের অজুহাত দিয়ে আবার বউ! পড়াশুনা শেষ হয় নি, আবার মিথ্যে বউ বানিয়েছেন আমাকে! পুলিশ ওরা। আপনার এই মিথ্যে ধরতে দুই মিনিটও লাগতো না ওদের। সত্যটা বললে অন্তত এমন হ্যাসেল হতো না। এখন আংকেল-আন্টিকে ডাকালে কি বলবেন? আমাকে বউ বলেছেন, এটা শুনলে আপনার বাবা-মা পা ভেঙে দেবে আপনার।”

ইমান হেসে বলল, “হয়তো খুশি হয়ে আমাদের বিয়ে করিয়ে দিতে পারে।”

“প্লিজ, এখন অন্তত মশকারি বন্ধ করেন।”

“তো তোমাকে কিছু বলবে না, তোমার সেই ভয়ংকর মামী?”

“এক্সকিউজ মি, আমি মিথ্যে বলি নি। আর পরে জিজ্ঞেস করলে আমি সত্যটাই বলবো।”

(***)

ইমান আর অরুণিকা পাশাপাশি বসে আছে। সিনিয়র পুলিশ মিস্টার আব্বাস আলী তাদের ভালোভাবে পরখ করে অরুণিকাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “তোমার বাবার ফোন নম্বর দাও।”

অরুণিকা ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “আমার বাবা-মা নেই। আমি কী আমার ভাইয়ের নম্বর দিলে হবে?”

আব্বাস আলী বললেন, “কেমন ভাই?”

“কাজিন ভাই।”

আব্বাস আলী চেঁচিয়ে বললেন, “মশকরা করছো?”

অরুণিকা চুপ করে রইল। সে জানে আতকিয়া জাহানের নম্বর দিলে তাকে আজ রাত থানায় কাটাতে হবে। আর দাদার পরিবারের কারো উপরই তার বিশ্বাস নেই। অনেক ভেবে অরুণিকা একটি নম্বর দিল। আব্বাস আলী ফোন নম্বরটির দিকে তাকিয়ে ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, “এটা কার নম্বর?”

“আমার হাসবেন্ডের নম্বর।”

ইমান চমকে তাকালো অরুণিকার দিকে। সেই পুলিশ সদস্য তিনজন সেখানে উপস্থিত ছিল। তাদের মধ্যে একজন বললেন, “আবার নতুন গল্প বানাচ্ছে!”

অরুণিকা আব্বাস আলীর দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি একটা মিথ্যেও বলি নি।”

ইমানকে দেখিয়ে অরুণিকা পুনরায় বলল, “উনি আমার প্রতিবেশী। আমাকে জাস্ট লিফট দিয়েছেন। ভয় পেয়েই হয়তো উনি মিথ্যে বলে ফেলেছেন। আর আমার কোনো অভিভাবক নেই। আমার কাজিন ভাই আমার অভিভাবক। আপনি তার নম্বরটিও নিলেন না। তাই হাসবেন্ডের নম্বর দিয়েছি। বিশ্বাস না হলে উনাকে বিয়ের ডকুমেন্টস সাথে আনতে বলবেন। কিন্তু এভাবে অকারণে সত্য বলার পরও হেনস্তা করবেন না। আপনাদের ভ্যানের যা ক্ষতি হয়েছে, উনি তো বললো ক্ষতিপূরণ দেবেন।”

অরুণিকার কথায় বেশ জোর ছিল। আব্বাস আলী আঁড়চোখে তার দিকে তাকিয়ে নম্বরটিতে ডায়াল করলেন। কয়েকবার রিং হতেই ওপাশ থেকে রিসিভ হলো। তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে অন্যপাশে গিয়ে কথা বলে অরুণিকার সামনে এসে ফোন এগিয়ে দিয়ে বললেন, “হাসবেন্ড থাকতে প্রতিবেশী ছেলের বাইকে উঠতে গেলে কেন তুমি? হাসবেন্ডকে ফোন করে আসতে বলতে পারো নি? নাও, কথা বলো।”

অরুণিকা ফোন কানের কাছে আনতেই আহনাফ রাগী স্বরে বলল, “অরু, তোর সাথে কে?”

অরুণিকা ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “ইমান!”

“ও তোর সাথে কি করছে?”

অরুণিকা চুপ করে রইল। আহনাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমি আসছি।”

এই বলে কল কেটে দিল আহনাফ। অরুণিকা আব্বাস আলীর দিকে ফোন এগিয়ে দিয়ে চুপচাপ বসে রইল। ইমান ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তোমার হাসবেন্ড!”

অরুণিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “একটু পরই তাকে দেখবেন। আর দয়া করে ক্যাম্পাসে এই কথা ছড়াবেন না।”

ইমান আহত দৃষ্টিতে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে আছে। এদিকে বিশ মিনিটের মধ্যে থানায় এসে পৌঁছালো আহনাফ। আহনাফকে দেখে ইমান অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। আব্বাস আলী ভ্রূ কুঁচকে আহনাফের দিকে তাকিয়ে বললেন, “বিয়ের ডকুমেন্টস এনেছেন?”

আহনাফ বিয়ের কাবিনসহ যাবতীয় কাগজপত্র এগিয়ে দিল। অরুণিকা এতোক্ষণ এক কোণায় বসে ছিল। আহনাফকে দেখে সে ধীর পায়ে সামনে এসে দাঁড়াল। আহনাফ অরুণিকার দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এদিকে আব্বাস আলী কাগজপত্র দেখে বললেন, “মিস্টার আহনাফ চৌধুরী, আপনার ওয়াইফকে তো অন্য একজন নিজের বউ বলে পরিচয় দিয়েছে। এখানে আপনার কি কিছু বলার আছে?”

আহনাফ ইমানের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো। ইমান আহনাফের চাহনি দেখে ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “স্যার সরি, আমি ভয়ে মিথ্যে বলে ফেলেছি।”

আহনাফের চোখ-মুখ শক্ত হয়ে আছে, তবে কিছু বলল না সে। এদিকে ক্ষতিপূরণ বাবদ সব টাকা আহনাফ নিজের পকেট থেকে দিয়ে ইমান ও অরুণিকাকে নিয়ে পুলিশ স্টেশন থেকে বের হলো।

বাইরে এসে ইমান অরুণিকার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি ম্যারিড!”

অরুণিকা মাথা নেড়ে বলল, “হুম।”

ইমান ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “আগে বলো নি কেন?”

আহনাফ ইমানের প্রশ্ন শুনে চোখ-মুখ কুঁচকে বলল, “আগে বললে কি হতো?”

ইমান মাথা নামিয়ে নিলো। আহনাফ রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে বলল, “নেক্সট টাইম ক্যাম্পাস, এলাকা, কোথাও যদি তোমাকে অরুর সাথে দেখি, সোজা তোমার বাবা-মার কাছে অভিযোগ করবো। যাও, এখন বাসায়।”

শেষ বাক্যটি ধমকের সুরে বলল আহনাফ। ইমানও ধমক খেয়ে অসহায় দৃষ্টিতে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে চলে গেল। ইমান চলে যেতেই অরুণিকা ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “সরি, তোমাকে বিরক্ত করেছি। এই মুহূর্তে আরাফ বা তাহমিদকে ফোন করেও লাভ হতো না। আর মামীকে ফোন করলে উনি উলটো আমাকে আটকে রাখতে বলতেন। তাই তোমার নম্বর দিতে হয়েছে।”

আহনাফ অরুণিকার হাত শক্ত চেপে করে ধরে বলল, “সরি বলছো? আমি তোমার হাসবেন্ড, আর তোমাকে আমার পরিচয় দিতে হয়েছে তাই সরি বলছো? আর ওদিকে একটা ছেলে তোমাকে নিজের বউ বলে পরিচয় দিল, আর তুমি তাকে কিছুই বললে না?”

“দেখুন, উনি ভয় পেয়ে মিথ্যে বলেছেন।”

আহনাফ চেঁচিয়ে বলল, “শাট আপ। এখন উঠো বাইকে।”

অরুণিকা ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “আমি একা চলে যাবো।”

আহনাফ দাঁতে দাঁত পিষে বলল, “ওই ছেলেটাকে এই কথা বলতে পারো নি? ওর বাইকের পেছনে বসতে তো কোনো অজুহাত দাও নি!”

অরুণিকা চোখ ছোট করে আহনাফের দিকে তাকালো। এরপর আর কথা না বাড়িয়ে আহনাফের মোটর সাইকেলের পেছনে উঠে বসলো। আহনাফও আর কথা বাড়ালো না। সোজা চলে এলো তার ফার্ম হাউজে। অরুণিকা চোখ-মুখ কুঁচকে বলল, “এখানে কেন এনেছো?”

আহনাফ চুপচাপ হেলমেট খুলে মোটর সাইকেল থেকে নেমে চাবি নিয়ে ভেতরে চলে গেল। অরুণিকা আহনাফের পিছু পিছু এসে বলল, “এখানে কেন এসেছো? আমাকে বাসায় নামিয়ে না দিলে বাইকে উঠতে বলেছিলে কেন? এখান থেকে তো গাড়িই পাওয়া যায় না। আমি এখন একা একা কীভাবে যাবো?”

এদিকে আহনাফ নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। সে রান্নাঘরে এসে ফ্রিজের ঠান্ডা পানি দিয়ে গলা ভেজাচ্ছে একটু পরপর। অরুণিকা এবার আহনাফের সামনে এসে বলল, “আমি কিছু বলছি!”

আহনাফ হঠাৎ হাতের বোতলটি ছুঁড়ে মারলো মেঝেতে। সাথে সাথেই বোতলটি ফেঁটে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো। অরুণিকা ভীত দৃষ্টিতে তাকালো আহনাফের দিকে। সে এবার অরুণিকার বাহু চেপে ধরে বলল, “আমার বাইকে তো উঠিস না। সেদিন তোকে বলেছি আমার পাশে বসে থাকতে, আর তুই আমাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে চলে গেলি? আমি তোর অপেক্ষায় গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভেবেছিলাম, তুই বাসায় গিয়ে মামীকে জানিয়ে আবার আসবি।”

“আমি কখন বলেছি আমি আসবো? আর আমি আরাফকে বলে গিয়েছিলাম।”

“আমাকে তো বলে যাস নি। আর আরাফ তো তোকে থাকতে বলে নি। আমি বলেছি।”

“শুনো, আমাদের সম্পর্ক এক ঘরে থাকার মতো না।”

অরুণিকার কথা শুনে আহনাফের চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল। সে অরুণিকার চুল খামচে ধরে বলল, “আমি তোর হাসবেন্ড। তোকে এটা মানতে হবে।”

অরুণিকা ব্যথায় চোখ-মুখ কুঁচকে ফেললো। তবুও দৃঢ় কন্ঠে বলল, “জোর করে কিছুই হয় না।”

আহনাফ চেঁচিয়ে বলল, “আরেহ, বিয়ে হয়ে গেছে আমাদের। তুই দেখ, আজ আমার কারণেই তুই ছাড়া পেয়েছিস। কাগজেরও একটা ক্ষমতা আছে। ইমান তো তোকে ফাঁসিয়ে দিয়েছিল!”

“উনি আমাকে ফাঁসায় নি, আহনাফ।”

আহনাফ শূন্য দৃষ্টিতে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে রইল। অরুণিকা কপাল ভাঁজ করে বলল, “এভাবে কেন তাকিয়ে আছো আমার দিকে? আমি সত্যি বলছি। উনি ভয় পেয়ে আমাকে বউ….”

আহনাফ অরুণিকাকে কথা শেষ করতে দিল না। তার গাল চেপে ধরে বলল, “ইমানকে ডিফেন্ড করছিস কেন? তুই কি ওর উকিল?”

অরুণিকা আহনাফের হিংস্র চাহনি দেখে শান্ত স্বরে বলল, “হয়তো আমারই অপরাধ ছিল।”

আহনাফ এবার অরুণিকাকে ছেড়ে দিয়ে নিজের চুল খামচে ধরে মেঝেতে বসে পড়লো। অরুণিকা আহনাফের আচরণ দেখে দ্রুত অন্য রুমে চলে গেল। এদিকে আহনাফ চিৎকার করতে লাগলো। অরুণিকা কানে হাত দিয়ে বলল, “এখন তো মনে হচ্ছে, এক রাত জেল খাটা এর বেটার ছিল।”

কেটে গেল দশ মিনিট। আহনাফের চোখ-নাক বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। সে শার্টের হাতায় চোখ-মুখ মুছে অরুণিকাকে খুঁজতে লাগলো পুরো ঘরে।

“অরু, কোথায় তুই? এদিকে আয় না। এই অরু, আমি তোর হাসবেন্ড। এভাবে পালাচ্ছিস কেন? ইমানের পাশে তো খুব সুন্দর বসে ছিলি। আমার কাছে আয়, অরু। এই অরু, প্লিজ আয় না। আমি তোকে ইমানের চেয়ে বেশি ভালোবাসবো।”

আহনাফ এবার চিৎকার করে ডাকলো, “অরু।”

অরুণিকা কেঁপে উঠলো সেই চিৎকারে। আর সাথে সাথেই তার চুড়ির টুংটাং শব্দ আহনাফের কান অব্ধি পৌঁছালো। আহনাফ শব্দ অনুসরণ করে পাশের রুমে ঢুকতে গিয়ে দেখলো দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। অরুণিকাই দরজা আটকে দিয়েছে। এদিকে অরুণিকা দ্রুত ফোন বের করে আরাফের নম্বরে ডায়াল করলো। ভয়ে হাত কাঁপছে তার। আহনাফ দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা দিচ্ছে। অরুণিকা ভয়ে কেঁদেই ফেলল। এদিকে আরাফও ফোন ধরছে না। এবার তাহমিদের নম্বরে ডায়াল করলো, কিন্তু তার ফোন বন্ধ। ওদিকে আহনাফ দরজা ভেঙে ফেলার উপক্রম। অরুণিকা এবার তূর্যের নম্বর খুঁজতে যাবে, ওমনিই দরজার তালা ভেঙে গেল। আহনাফও রুমে ঢুকে তার হাতে ফোন দেখে, সেটি কেঁড়ে নিয়ে বলল, “কাকে ফোন করছিস?”

আহনাফ ফোনের স্ক্রিনে আরাফ আর তাহমিদের নাম দেখে ছলছল চোখে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার সাথে আছিস তুই। আমাকে বিশ্বাস করতে পারছিস না? ওদের কেন ফোন করছিস?”

অরুণিকা কাঁপা কন্ঠে বলল, “ফোন দাও। আমার বাসায় ফিরতে হবে, নয়তো মামী ঝামেলা করবে।”

আহনাফ অরুণিকার ফোন বন্ধ করে টেবিলের উপর রেখে বলল, “ঝামেলা করলে আমি দেখবো। এভাবে দরজা বন্ধ করে রেখেছিস কেন?”

অরুণিকা ভেজা কন্ঠে বলল, “তুমি প্লিজ এমন এগ্রেসিভ বিহেভ করো না। শান্ত হয়ে বসো।”

আহনাফ অরুণিকার হাত ধরতে যাবে, সে কয়েক পা পিছিয়ে গেল। আহনাফ নিজের শূন্য হাতের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি তোকে ছুঁতে গেলেই তুই সরে যাচ্ছিস কেন?”

“তুমি আগে শান্ত হও। উইয়ার্ড বিহেভ করছো তুমি।”

আহনাফ তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “উইয়ার্ড! আর তুই যে আমাকে ছেড়ে দিবি, ওটা উইয়ার্ড না?”

আহনাফ অরুণিকার দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে বলল, “শাড়ি কার জন্য পরেছিস?”

অরুণিকা চুপ করে রইল। আহনাফ শব্দ করে হেসে উঠলো। অরুণিকা কাঁপা কন্ঠে বলল, “এমনিতেই পরেছি।”

আহনাফ শীতল কন্ঠে বলল, “তুই ইমানকে কোথায় পেয়েছিস?”

“মানে!”

“কোথায় গিয়েছিলি তুই? ইমান কেন ছিল তোর সাথে?”

“আমি একটা কাজে বেরিয়েছিলাম। রাস্তায় ইমান আমাকে দেখে লিফট দিয়েছিল।”

“তুই ওর লিফট কেন নিলি? কেউ কি আর ছিল না তোকে লিফট দেওয়ার?”

অরুণিকা চোখ-মুখ কুঁচকে তাকিয়ে রইল আহনাফের দিকে। আহনাফ অরুণিকার হাত শক্ত করে ধরে বলল, “আমি টাচ করলে সমস্যা, আমি হাত এগিয়ে দিলে সেই হাত ধরতেও সমস্যা, আমি পাশে বসতে বললে বসিস না। অথচ ইমানকে সব ছাড় দিয়ে রেখেছিস। তুই চিট করছিস আমার সাথে?”

অরুণিকা মাথা নেড়ে বলল, “আল্লাহর কসম করে বলছি, আমার সাথে ইমানের কিচ্ছু নেই।”

“কসম করে বল, আমাকে চিট করছিস না?”

অরুণিকার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। সে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, “আমার ইমানের সাথে কিছু নেই।”

“আমাকে চিট করছিস কি-না বল?”

অরুণিকা চিৎকার করে বলল, “আমি যেখানে তোমার সাথে থাকতেই চাই না, সেখানে চিটিং শব্দটা কেন আসবে? তুমি ভালো করেই জানো, আমি মুভ অন করতে চাই।”

আহনাফ কাতর কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “তুই অন্য কাউকে ভালোবাসিস?”

অরুণিকা চুপ করে রইল। আহনাফ পুনরায় জিজ্ঞেস করলো, “ছেলেটা কি ইমান?”

“না, না, না।”

আহনাফ হেসে বলল, “তুই ভয় পাচ্ছিস, তাই না? আমি ওকে মেরে ফেলবো, তাই সত্য বলছিস না। আমি জানি, তুই ওকে বাঁচানোর জন্য কসম করে মিথ্যে বলছিস, তাই না?”

অরুণিকা চোখ ছোট করে আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলল, “কেউ আমার জীবনে থাকুক, না থাকুক, তবুও আমি তোমার মতো লোকের সাথে সংসার করতে পারবো না। একবার দেখো নিজেকে, কেমন আচরণ করছো তুমি?”

আহনাফ অরুণিকার গলা চেপে ধরে বলল, “আমি এমনই। আমাকে এভাবেই মেনে নিতে হবে।”

অরুণিকা আহনাফের হাত ধরে বলল, “মেনে নেবো না।এখন কি করবে? মেরে ফেলবে আমাকে?”

আহনাফ অরুণিকার গলা ছেড়ে তার চুল ধরে তাকে টেনে নিজের রুমে নিয়ে গেল। অরুণিকা ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো। আহনাফ ধাক্কা মেরে তাকে মেঝেতে ফেলে দিল। মেঝেতে আছড়ে পড়তেই চুড়ি ভেঙে হাতে বিঁধে গেল তার। অরুণিকা কাতর দৃষ্টিতে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে বলল, “আহনাফ, প্লিজ আমাকে মাফ করো। যেতে দাও আমাকে।”

অরুণিকা পেছন ফিরতেই অবাক হয়ে গেল। আহনাফ একটি গ্লাসে কিছু পাউডার ঢেলে তার সাথে পানি মিশিয়ে খাচ্ছে। অরুণিকা এসব দেখে ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কি এগুলো!”

আহনাফ নিজের মাথা চেপে ধরে ক্ষীণ স্বরে বলল, “মাথা ঠিক নেই আমার। পালা এখান থেকে।”

অরুণিকা কাঁপা শরীরে উঠে দাঁড়াতেই শাড়ির কুঁচির সাথে পা বেঁধে আবার মেঝেতে পড়ে গেল। অরুণিকা এবার কুঁচি গুছিয়ে উঠে দাঁড়াতেই আহনাফের মুখোমুখি হলো। অরুণিকার হাতে রক্ত দেখে আহনাফ অস্থির কন্ঠে বলল, “রক্ত! কীভাবে ব্যথা পেলি?”

অরুণিকার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। আহনাফ অরুণিকার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “কাঁদছিস কেন? সরি। বেশি বলে ফেলেছি? ব্যথা পেয়েছিস খুব। সরি, আমার মাথাটা কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে!”

অরুণিকা চুপ করে রইল। আহনাফ অরুণিকার হাতের চুড়িগুলো টেনে খুলে মেঝেতে ছুঁড়ে মারলো। অরুণিকার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। আহনাফ চেঁচিয়ে বলল, “এসব কি ফালতু জিনিস পরিস? হাত কেঁটে গেছে তোর!”

অরুণিকা আহনাফের হাত ধরে শান্ত স্বরে বলল, “আমাকে বাসায় যেতে দাও, প্লিজ। আমার প্রচুর মাথা ব্যথা করছে। আমি আর কখনো ইমানের বাইকে উঠবো না। প্রমিজ করছি। প্লিজ, আমাকে যেতে দাও।”

আহনাফ অরুণিকার দিকে তাকিয়ে রইল এক দৃষ্টিতে। হুট করে তার ঠোঁটে চুমু খেল আহনাফ। অরুণিকা স্থির হয়ে বসে রইল। আহনাফের গভীর চুম্বনে সাড়া দিল না সে। হতাশ হয়ে পড়লো আহনাফ। অরুণিকার দিকে তাকিয়ে বলল, “ইমান কি তোকে এভাবে ভালোবাসে?”

অরুণিকা চমকে উঠলো আহনাফের কথায়। সে অরুণিকার গালে হাত রেখে বলল, “তোকে এভাবে ছুঁয়ে দেয়?”

অরুণিকা শক্ত কন্ঠে বলল, “শেইম অন ইউ, আহনাফ। দ্বিতীয় বার নিজেকে আমার হাসবেন্ড বলবে না আর।”

আহনাফ অরুণিকার ঘাড় ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে এনে বলল, “তাহলে আমাকে কেন ভালোবাসিস না?”

“তুমি নিজেই জানো এর কারণ কি। আর ইমানকে আল্লাহর ওয়াস্তে এসব কথায় জড়াবে না। আমার সাথে উনার কোনো সম্পর্ক নেই। বিশ্বাস করো, প্লিজ।”

“ঠিক আছে। করলাম বিশ্বাস। করলাম। আমি বিশ্বাস করি তোকে। করলাম বিশ্বাস।”

“কথা রিপিট করা বন্ধ করো।”

আহনাফ অরুণিকার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি, তাই না?”

“তুমি কি নেশা করেছো?”

“হ্যাঁ। প্রায়ই করি। ওরা কেউ জানে না। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে নেশা করি। তোকে ভুলে থাকার ওটাই একটা অপশন। আমি কিছুদিন পর রিহ্যাবে পাঠাবে। আমি চলে গেলে, তোর কষ্ট হবে না? আমি তোকে ছাড়া কীভাবে থাকবো বল? সব ওই শিরিন সুলতানার দোষ! তুই জানিস, আমাকে ওই শিরিন সুলতানা ঠকিয়েছে! আমাকে ড্রাগস দিয়ে দিয়ে পাগল বানিয়ে ফেলেছে। এখন আমি তো এসব ছাড়তেও পারছি না।”

অরুণিকা অবাক হয়ে আহনাফের দিকে তাকিয়ে রইল। আহনাফের চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে। অরুণিকা চলে যেতে নেবে, আহনাফ দ্রুত তার হাত ধরে বলল, “আমাকে ফেলে কোথায় যাচ্ছিস? আমি কিন্তু মেরে ফেলবো তোর প্রেমিককে। মেরে ফেললে কেমন লাগবে তোর? ইমানকে মেরে ফেললে তোর আর আমার মাঝে কেউই থাকবে না।”

“তুমি বারবার একটা কথা রিপিট করছো, আহনাফ।”

আহনাফ অভিযোগের সুরে বলল, “তুই প্রায়ই বাসে করে না এসে, ওর বাইকে করে বাসায় আসিস। আমি তো দেখি সব। ওর সাথে ক্যান্টিনে বসে আইসক্রিম খাস। ওর সাথে হাসিস, গল্প করিস। আমার খুব কষ্ট হয়। জানিস, খুব কষ্ট হয় আমার।”

আহনাফ অরুণিকার হাত নিজের বুকের উপর রেখে বলল, “এখানে কেমন লাগে, তোকে বোঝাতে পারবো না। আমাকে কারো সাথে দেখলে তোর খারাপ লাগবে না?”

এই বলে অরুণিকার বুকে হাত রাখলো আহনাফ। অরুণিকা চোখ বড় বড় করে তাকালো। আহনাফ ভাবুক কন্ঠে বলল, “এখানে তোর অসহ্য ব্যথা হবে, দেখিস। আমি তো কোনো মেয়ের সাথে কথা বলি না, তাই বুঝিস না৷”

অরুণিকা আহনাফের হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, “তুমি রেস্ট নাও।”

আহনাফ হুট করে অরুণিকার হাতে অধর ছোঁয়ালো। ধীরে ধীরে সেই অধর জোড়া অরুণিকার বাহুতে, কাঁধে স্পর্শ এঁকে দিল উন্মাদের মতো। আহনাফের উষ্ণ নিঃশ্বাসের ধাক্কা গলা স্পর্শ করতেই তাকে শরীরের সব শক্তি দিয়ে সরিয়ে দিল অরুণিকা। টাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে পড়ে গেল আহনাফ। কাচের ভাঙা চুড়িগুলো পিঠে বিঁধে গেল তার। আহনাফ আর্তনাদ করে উঠতেই অরুণিকা ভীত দৃষ্টিতে তাকালো। ব্যস্ত হয়ে টেনে উঠালো আহনাফকে। সাদা শার্টে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ ভেসে উঠছে। অরুণিকা দ্রুত হাতে আহনাফের শার্টের বোতম খুলে শার্টটা বিছানায় ফেলে পিঠের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলো। চুড়ির ভাঙা অংশ চামড়ায় ঢুকে না গেলেও খোঁচা লাগায় পিঠ ছিঁড়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।

অরুণিকা নিজের কপাল চেপে ধরে বলল, “তুমি কি শুরু করলে এসব? এর চেয়ে ভালো আমি তোমার নম্বরই না দিতাম।”

আহনাফ অরুণিকার দিকে তাকিয়ে বলল, “ইমানের সাথে ওখানে থাকা এর চেয়ে বেটার ছিল, তাই না?”

অরুণিকা চেঁচিয়ে বলল, “ইমান, ইমান, ইমান, কি শুরু করলে তুমি?”

আহনাফ হুট করে অরুণিকার অধর কামড়ে ধরলো। অরুণিকা আহনাফের চুল খামচে ধরে ধাপাধাপি করতে লাগলো। আহনাফ তাকে ছেড়ে দিতেই সে উঠে আহনাফের গালে চড় বসিয়ে দিল। আহনাফ গাল ধরে স্থির দৃষ্টিতে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে রইল। অরুণিকা শাড়ির আঁচল দিয়ে ঠোঁটে চেপে ধরে বলল, “পশুর মতো আচরণ করছো তুমি।”

আহনাফ ঠাণ্ডা গলায় বলল, “আমি একটু পাশে বসলে চিড়চিড় করিস। আর ইমানের সাথে যখন হাসিস, তখন?”

অরুণিকা চিৎকার করে বলল, “ও তোমার থেকে হাজারগুণ বেটার।”

আহনাফের মেজাজ বিগড়ে গেল সাথে সাথেই। সে অরুণিকার গাল শক্ত করে চেপে ধরে বলল, “আমার চেয়ে ওই ইমান ভালো?”

“হ্যাঁ, তুমি একটা সাইকো। ইমান তোমার চেয়ে অনেক বেশি ভালো।”

আহনাফ অস্থির কন্ঠে বলল, “আমি ঠিক ধরেছি, তাই না? তুই ওকে ভালোবাসিস?”

“তুমি তো দেখছি মারাত্মক ঘাড়ত্যাড়া!”

“সত্যিটা বল।”

অরুণিকা এবার ধরা গলায় বলল, “হ্যাঁ, ভালোবাসি আমি ইমানকে।”

আহনাফ অরুণিকাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। অরুণিকা ছাড়া পেয়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়তেই আহনাফ চিৎকার করে উঠলো। আহনাফের চিৎকারে কেঁপে উঠলো অরুণিকা।এদিকে রুমের জিনিসপত্র সব ভেঙে ফেলছে আহনাফ। অরুণিকা এসব দেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। পাশের রুমে এসে নিজের ফোন আবার চালু করলো সে। ফোন চালু হতে হতেই আহনাফ ধড়ফড়িয়ে সেই রুমে ঢুকে অরুণিকাকে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। টাল সামলাতে না পেরে দু’জনই পাশের সোফায় গিয়ে পড়লো। অরুণিকার হাত থেকে তার ফোনটাও মেঝেতে পড়ে গেল।

এদিকে এলোমেলো ভাবে সোফায় বসায় অরুণিকা কোমড়ে মোচড় খেল। চোখ-মুখ খিঁচে বসে রইল সে। মুহূর্তেই রাগ উঠে গেল তার। আহনাফ ফুঁপিয়ে কাঁদছে, তা খেয়াল না করেই আহনাফের বুকে-পিঠে ইচ্ছেমতো লাথি-ঘুষি মেরে তাকে সরিয়ে দিল। আহনাফ অরুণিকাকে ছেড়ে দিয়ে নির্বাক তাকিয়ে রইল তার দিকে। এদিকে অরুণিকা কোমড় ধরে বসে আছে। অনেকক্ষণ পর ব্যথা কমলো তার। সে এবার চেঁচিয়ে বলে উঠলো, “তোমার এই পাগলামিগুলো সহ্য করার এনার্জি শেষ আমার। আমি একাই চলে যাচ্ছি।”

অরুণিকা উঠে দাঁড়াতেই আহনাফ তার হাত ধরে শীতল কন্ঠে বলল, “লাথি মারলি আমাকে? আমি তো তোকে জড়িয়ে ধরেছিলাম শুধু!”

অরুণিকা ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “আমি খেয়াল করি নি। জাস্ট নিজেকে প্রটেক্ট করেছি আমি। তুমি তো আমাকে মেরে ফেলতে চাইছো।”

আহনাফ এবার বাঁকা হেসে বলল, “এবার দেখ, কীভাবে মারি। এমন ভাবে মারবো, ইমান কেন, কোনো ছেলেই তোর দিকে তাকানোর সাহস পাবে না।”

চলবে-

#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-৪৭ ||

অরুণিকার পরণের শাড়ি দিয়েই তার হাত বেঁধে ফেললো আহনাফ। অরুণিকা চিৎকার কর‍তেই তার মুখ চেপে ধরলো সে। অরুণিকার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে আহনাফের দিকে। আহনাফের হিংস্রতা আজ মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সে অরুণিকার গলায় কামড় বসিয়ে দিয়ে ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠে বলল, “ইমান তোকে দেখলেই বুঝবে, আমাদের সম্পর্ক কেমন!”

এই বলে হাসলো আহনাফ। এবার অরুণিকার হাতে কামড় দিতেই অরুণিকা আহনাফের কানের কাছে এসে চিৎকার করে উঠলো। আহনাফ কানে হাত দিতেই অরুণিকা তার কনুই দিয়ে আহনাফের গালে ঘুসি মারলো। আহনাফ গাল ধরে অরুণিকার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো। মুহূর্তেই আরো আক্রমণাত্মক হয়ে উঠলো সে। বেল্ট খুলে অরুণিকাকে মারতে যাবে, ওমনিই সেই বেল্ট শক্ত করে ধরে ফেলল অরুণিকা। আহনাফ বেল্ট ছেড়ে অরুণিকার চুল ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে এনে বলল, “বল, আমাকে ভালোবাসিস, বল।”

অরুণিকা ফোঁপাতে ফোঁপাতে মাথা নেড়ে বলল, “আমি ভালোবাসি তোমাকে।”

অরুণিকার মুখ থেকে এমন কথা শুনে আহনাফের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। সে অরুণিকাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আমিও ভালোবাসি তোকে। খুব খুব ভালোবাসি।”

অরুণিকা সুযোগ বুঝে পাশে থাকা কাঠের ফুলদানি দিয়ে আহনাফের পিঠে আঘাত করতেই, ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো সে। সাথে সাথেই ছেড়ে দিল অরুণিকাকে। ছাড়া পেয়ে অরুণিকা তার ফোন নিয়ে দৌঁড়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। নিজের দিকে একনজর তাকালো সে। শাড়ি ছাড়া গেট দিয়ে বের হবে কীভাবে? নিজেকে প্রচন্ড অসহায় মনে হচ্ছে তার। কার সাহায্য চেয়েছিল সে? কেন আহনাফকে আসতে বলেছিল থানায়? অরুণিকা মাথায় হাত দিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছে। কীভাবে সবাই তাকে এই মানুষটার সাথে সংসার করতে বলেছে? কীভাবে থাকবে সে এই মানুষটার সাথে? এদিকে আহনাফ কয়েক পা এগিয়ে মেঝেতে বসে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। বলল, “অরু, আমাকে রেখে যাস না। আমাকেও নিয়ে যা।”

অরুণিকা আহনাফের কন্ঠ শুনে আঁতকে উঠলো। দ্রুত বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। গেটের কাছে এসেই লজ্জায় বেরুতে পারছে না সে। কিন্তু ভেতরে থাকা মানুষটি যদি আবার তার উপর আক্রমণ করে বসে? সে এখন নিজের সম্মানের চিন্তা করবে, না-কি জীবন বাঁচাবে? অরুণিকা শূন্য দৃষ্টিতে বুকে হাত রেখে ফুঁপিয়ে বলল, “আল্লাহ আমাকে বাঁচাও। আমাকে বাঁচাও প্লিজ।”

আহনাফ দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই অরুণিকা গেট দিয়ে বেরিয়ে পড়লো, আর তখনই থমকে গেল সে। তূর্য আর ইভানের মোটর সাইকেল এসে থামলো গেটের কাছে। অরুণিকাকে এমন অবস্থায় দেখে তূর্য আর ইভান আঁতকে উঠলো। তূর্য দ্রুত অরুণিকার কাছে আসতেই অরুণিকা ফুঁপিয়ে বলে উঠলো, “তূর্য, বাঁচাও আমাকে।”

তূর্য তার জ্যাকেট খুলে অরুণিকার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে তার মাথায় হাত বুলাতে লাগল। এদিকে আহনাফ হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে তূর্য আর ইভানকে দেখে চমকে উঠলো। তূর্য অরুণিকাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে দেখে মেজাজ বিগড়ে গেল আহনাফের। অরুণিকার হাত শক্ত করে ধরে বলল, “আমার কাছে আয়, অরু।”

ইভান আহনাফের হাত ধরে শক্ত কন্ঠে বলল, “কি করছিস, আহু?”

“ওকে বল, আমার কাছে আসতে।”

“তুই ওকে মেরেছিস?”

“আমি ওকে মারি নি। ও উলটো আমাকে মেরেছে। ও আমাকে লাথি মেরেছে। আর কি বলেছে জানিস? ও না-কি ইমানকে ভালোবাসে! আমি ওর হাসবেন্ড, ও আরেকজনকে কেন ভালোবাসবে?”

অরুণিকা তূর্যের পেছনে নিজেকে আড়াল করে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, “ও আমাকে বাধ্য করেছে বলতে। আমি একশো বার বলেছি, আমি ইমানকে ভালোবাসি না। তবুও একই প্রশ্ন করছে। ও একটা পাগল। পাগল ও।”

আহনাফ হাত এগিয়ে দিয়ে বলল, “অরু, দেখ, আ’ম সরি। তুই আমার কাছে আয়।”

তূর্য আহনাফকে ধাক্কা মেরে বলল, “তুই আবার ড্রাগস নিয়েছিস!”

আহনাফ অরুণিকার দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান আহনাফকে ধরে বলল, “ভেতরে চল।”

আহনাফ ইভানকে ধাক্কা মেরে বলল, “সর। অরু আমার কাছে আসছে না, অথচ তূর্যের কাছে গেল? কেন? আমি ভালোবাসি ওকে। ওকে বল, আমার কাছে আসতে। ও না এলে, আমি ড্রাগস নেওয়া ছাড়বো না।”

“তুই না তোর বাপ ছাড়বে,” এই বলে ইভান আহনাফকে টেনে ভেতরে নিয়ে গেল। আহনাফ চেঁচিয়ে বলতে লাগলো, “ও একটা ***!”

ইভান আহনাফকে ছেড়ে তার গালে চড় বসিয়ে দিল। তূর্য ভেতরে এসে আহনাফের অবস্থা দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল। অরুণিকা কানে হাত দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়লো। আহনাফ ইভানের কলার ধরে বলল, “তুই আমার গায়ে হাত তুলছিস? এই হাত তোর ইমানের জন্য উঠছে না? ওই ছেলে আমার বউকে চুরি করে ফেলেছে। ওকে বল, আমার জিনিস আমাকে ফেরত দিতে। অরু আমাকে ভালোবাসে না, ওই ছেলের সাথে **** ***”

তূর্য আহনাফের নাক বরাবর ঘুষি মেরে চিৎকার করে বলল, “মুখ সামলে কথা বল। নয়তো মেরে ফেলবো তোকে আমি।”

মুহূর্তেই আহনাফ আর তূর্যের মধ্যে ভয়ংকর ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে গেল। ইভান তাদের আটকাতে গেলে ইভানকেও ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল আহনাফ। অরুণিকা ভেতরে ঢুকেই এই দৃশ্য দেখে তূর্যকে আহনাফের কাছ থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো। এক পর্যায়ে বাগানে থাকা চেয়ার উঠিয়ে আহনাফের পিঠ বরাবর ছুঁড়ে মারলো সে। আহনাফ আঘাত পেয়ে সাথে সাথেই তূর্যকে ছেড়ে দিল। এরপর হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়ল। দুই হাত দিয়ে নিজের পিঠ আঁকড়ে ধরে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে সে। অরুণিকা গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তূর্য কয়েক পা পিছিয়ে নিজের শরীরের ভার ছেড়ে দিল। ইভান সাথে সাথে তূর্যকে ধরে ফেললো।

এদিকে আহনাফ কাতরাতে কাতরাতে বলছে, “অরু, আমাকে ফেলে কোথাও যাবি না তুই। অরু, আমার কাছে আয়। আমি তোকে সেইফ রাখবো। আমাকে বিশ্বাস করে, আমার কাছে আয়। আমি তোকে অনেক ভালোবাসি।”

অরুণিকা আহনাফের কথা শুনে ধপ করে মাটিতে বসে পড়লো। ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমাকে একটু শান্তি দাও, আল্লাহ। প্লিজ। প্লিজ আমাকে শান্তি দাও। আমাকে বাঁচাও। আ….আ….আ।”

অরুণিকা চিৎকার করে উঠলো। অরুণিকার চিৎকার শুনে শান্ত হয়ে গেল আহনাফ। নিজের মুখ চেপে ধরে উঠে বসলো। তূর্যের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাত এগিয়ে দিল। তূর্য দ্রুত এসে তার হাত ধরতেই আহনাফ বলল, “দেখ না ওর কি হয়েছে! কীভাবে চিৎকার করছে! ওর কাছে যা। ও তোকে বিশ্বাস করে। আমার কাছে তো আসতেই চায় না। আমি ভেতরে যাচ্ছি, ওকে নিয়ে আয় বাসায়। এভাবে বাইরে থাকলে ঠান্ডা লাগবে ওর। তুই জানিস না, অল্পতেই ঠান্ডা বাঁধিয়ে ফেলে ও!”

তূর্য আহনাফের হাত ধরে তাকে টেনে উঠিয়ে বলল, “আগে তুই চল, আমি ওকে পরে আনবো।”

আহনাফ মাথা নেড়ে বলল, “আগে ওকে যেতে বল। ও যদি আবার আমাকে ফেলে চলে যায়? ওকে বল না, আমার কাছে থাকতে। ও তোর কথা শুনবে। আমি ওকে ছাড়া থাকতেই পারছি না, তূর্য। ওকে বল, আমার চোখের সামনে বসে থাকতে। আমি ওকে একদম ছোঁবো না। শুধু দেখে থাকবো।”

তূর্য আর ইভান এবার জোর করে ভেতরে নিয়ে গেল আহনাফকে। আহনাফ উন্মাদের মতো বলতে লাগলো, “বল না ওকে।আসতে। ওকে বল না! ও যদি ইমানের কাছে চলে যায়, কি করবো আমি?”

তূর্য ভেতরে ঢুকে ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লো। আহনাফ তূর্যের হাত ঝাঁকিয়ে পুনরায় একই কথা বললো। তূর্য মাথায় হাত দিয়ে কাঁপা কন্ঠে ইভানকে বলল, “যা, ওকে নিয়ে আয়।”

ইভান এবার বাইরে এসে অরুণিকাকে ভেতরে নিয়ে যেতে চাইলে অরুণিকা পরিষ্কার জানিয়ে দিল, সে ভেতরে যাবে না। গেলে বাসায় যাবে, নয়তো এখানেই বসে থাকবে। ইভান তাই বাধ্য হয়ে অরুণিকাকে নিয়ে মোহাম্মদপুর চলে গেল। এদিকে আহনাফ অস্থির দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। তূর্য মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে এখনো। আহনাফ তূর্যের কাছে এসে বলল, “অরুকে আনছে না কেন? ও ইভানকেও হয়তো বিশ্বাস করছে না। তোকে তো বিশ্বাস করে। তুই নিয়ে আয়।”

তূর্য আহনাফের জোরাজোরিতে বাধ্য হয়ে বাইরে এসে দেখলো কেউ নেই। গেটের কাছে এসে দেখলো ইভানের মোটর সাইকেলও নেই। ভেতরে আসতেই আহনাফ বলল, “কোথায় ও?”

“ইভান হয়তো ওকে বাসায় দিয়ে আসবে।”

“কোথায়!”

“মোহাম্মদপুর নিয়ে গেছে হয়তো!”

আহনাফ ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “ইভানের বাইকে বসেছে! জানিস, ও আজ ইমানের বাইকেও বসেছে। প্রায়ই বসে। আমি দেখেছি ওদের একসাথে। কিন্তু ও আমার বাইকে বসতে চাই না। আজ তোকে বিশ্বাস করে, তোর কাছে এসেছে। আরাফ, তাহমিদ ওদেরও বিশ্বাস করে। শুধু আমাকেই বিশ্বাস করে না। আমি কাছে আসলেই ও ভয় পেয়ে সরে যায়। আমি তো ভালোবাসি ওকে। ও আমার ভালোবাসা বুঝতে পারছে না কেন? আমি কি ভালোবাসতে পারছি না? আমি কি হেরে গেছি? আমি কি অরুকে ভালো রাখতে পারি নি?”

আহনাফ এসব বলতে বলতেই মেঝেতে বসে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। তূর্য আহনাফের কাঁধে হাত রাখতেই ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো সে। তূর্য ব্যস্ত কন্ঠে বলল, “চল তোকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়! কি অবস্থা করেছিস?”

“পিঠে কি যেন জোরে এসে লাগলো? কি ছিল ওটা?”

“কিছু না।”

“না, তুই তো দেখেছিস। তোর উপর রেগে গিয়েছিলাম তখন। কি যেন লাগলো! ব্যথা করছে অনেক।”

“তোর পিঠে রক্ত কেন?”

“ভাঙা চুড়ি বিঁধে গিয়েছিল। অরুর কোনো দোষ নেই। আমিই চুড়িগুলো ওখানে ফেলেছিলাম। এরপর হঠাৎ পা পিছলে পড়ে সব চুড়ি পিঠে বিঁধে গিয়েছিল। কিন্তু জানিস, অরু আমাকে এখনো ভালোবাসে। ও-ই আমাকে টেনে তুলেছিল।”

এই বলে আহনাফ হাসতে লাগলো। তূর্য স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আহনাফের দিকে। পরমুহূর্তেই আহনাফ বিমর্ষ মুখে বলল, “বুকে লাথি মেরেছে। আমার বুকে লাথি মেরেছে ও।”

তূর্য আহনাফের কাঁধে হাত রাখতেই সে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল, “কিন্তু ইচ্ছে করে মারে নি ও। আমি হুট করে কাছে এসে গিয়েছিলাম, তাই ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ওমনই আমাকে সরাতে গিয়ে পা লেগে গেছে। ও তো ভালোবাসে আমাকে।”

এই বলতে বলতে আহনাফের মুখটা আবার অন্ধকার হয়ে গেল। সে পুনরায় বলল, “জানিস, আজ আমি যখন ওকে জড়িয়ে ধরেছিলাম, অনেক শান্তি লেগেছিল। এতোদিন একটুও শান্তি লাগে নি। কিন্তু হঠাৎ পিঠে কি একটা দিয়ে যে মারলো, ব্যথা করছে ভীষণ।”

পরমুহূর্তে সে তূর্যের হাত ধরে আবার বলল, “কিন্তু ও ইচ্ছে করে করেনি। আমি হয়তো শক্ত করে ধরেছিলাম। ওতো এখনো নরম। ব্যথা লেগেছে হয়তো।”

তূর্য হঠাৎ জড়িয়ে ধরলো আহনাফকে। আহনাফ তূর্যের কাঁধে মাথা রেখে বলল, “ভাই, ওকে আমার কাছে নিয়ে আসবি? আমার ওকে ছাড়া কেমন খালি খালি লাগে!”

“তুই এসব না ছাড়লে ও কখনো তোর কাছে আসবে না। তুই এসব খেয়ে খেয়ে ওর সাথে বাজে ব্যবহার করছিস। একটু আগে কি উল্টোপাল্টা কথা বলেছিস তোর খেয়াল আছে?”

আহনাফ তূর্যকে ছেড়ে অসহায় কন্ঠে বলল, “আমি কী বলেছি?”

“তুই জানিস না?”

“মনে পড়ছে না। কী বলেছি আমি?”

“বাদ দে। তোকে কাল-পরশুই রিহ্যাবে পাঠাবো। ওখানে গেলে তুই সুস্থ হয়ে যাবি। দেখিস, এরপর তোর অরু তোর কাছে ফিরে আসবে।”

আহনাফ স্মিত হাসলো। আহনাফের এই হাসিটা দেখেই তূর্যের বুক ফেঁটে যাচ্ছে। সে নিজ হাতে আহনাফের রুম পরিষ্কার করে তাকে রুমে শুইয়ে দিল। এদিকে আহনাফ অরুণিকার শাড়িটা নিজের হাতের সাথে পেঁচিয়ে রাখলো। তূর্য তা দেখে শুকনো মুখে বেরিয়ে পড়লো রুম থেকে।

(***)

অরুণিকার সামনে বসে আছে আরাফ, ইমন, ইভান আর তাহমিদ। কাল রাতের ঘটনা শুনে আরাফ বলল, “আমি কাল মেডিকেলে ছিলাম। স্যার এসেছিল, তাই ফোন ধরতে পারি নি।”

তাহমিদ বলল, “আমার তো ফোনে চার্জই ছিল না।”

ইভান অরুণিকার দিকে তাকিয়ে গম্ভীরমুখে বলল, “অরুণিকা, তোমাকে তো আমরা আহনাফের ব্যাপারে সব জানালাম। তোমার এখন কি কিছু বলার নেই?”

অরুণিকা ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল, “কাল রাতে যা হয়েছে এসব দেখার পর আমার তো ওর সাথে এক ঘন্টাও নিজেকে সেইফ মনে হচ্ছে না। আর তুমি বলছো আমাকে সংসার টিকিয়ে রাখতে?”

ইমন বলল, “আহু তোকে ভালোবাসে, অরু। তুই ওর পাশে থাকলে ও সুস্থ হয়ে যাবে। জাস্ট ওকে মানসিক শক্তিটা দে। এরপর ও পুরোপুরি ঠিক হয়ে গেলে, আবার নিজের উপর কন্ট্রোল করতে শিখে গেলে, তুই তোর ডিসিশন ওকে জানিয়ে দিস। কিন্তু এখন না।”

আরাফ অরুণিকার কাছে এসে বলল, “তুই আমার বোন। আমি কখনো চাইবো না, যেখানে তোর মন নেই, সেখানে জোর করে সংসার কর। অন্তত আহনাফের দিকটা ভেবে এডজাস্ট কর। অন্তত মিথ্যে আশা হলেও দে। ছেলেটা এক্কেবারে ভেঙে গেছে।”

অরুণিকা মাথা নেড়ে বলল, “সব শুনে আমার ওর জন্য মায়া লাগছে। কিন্তু আমি মিথ্যে আশা দিতে পারবো না। পরে আশা ভেঙে গেলে যদি ও আবার এডিক্টেট হয়ে যায়? তখন তো সবাই আমাকেই দোষ দেবে। তোমরা বরং ওকে রিহ্যাবে পাঠাও।”

তাহমিদ বলল, “অবশ্যই পাঠাবো। দু’দিন জাস্ট ওর পাশে থাক। ও ভরসা পেলে নিজেকে ওখান থেকে বের করে আনতে পারবে।”

“আমি দু’দিন কেন দু’মিনিটও ওর পাশে একা থাকতে পারবো না। ও আমাকে সন্দেহ করে মুখে যা আসে, তাই বলছে। আমাকে বেল্ট দিয়ে মারতে চেয়েছিল। আমি বেল্টটা ধরে ফেলায়, বেঁচে গেছি।”

অরুণিকা এবার গলায় কামড়ের চিহ্ন দেখিয়ে বলল, “এখানে দেখছো? কীভাবে জানোয়ারের মতো কামড়ে দিয়েছে! আরো বলে কি ইমান বা অন্য ছেলে এই দাগ দেখলে না-কি বুঝবে ওর সাথে আমার কেমন সম্পর্ক!”

তাহমিদ চোখ নামিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। ইমন বলল, “ও অনেক বড় অন্যায় করেছে। তুই ওকে পুলিশে দিস। কিন্তু অন্তত এখন ওকে ওই নেশার জগত থেকে বের করে আনতে আমাদের একটু সাহায্য কর।”

“আমি কি করবো বলো? ওর সাথে কথা বলবো? ওকে ভরসা দেবো? দিলাম না হয়৷ কিন্তু প্লিজ আমাকে ওর সাথে এক ঘরে থাকার রিকুয়েষ্ট করো না। আমি জানি, ও এটাই চায়। আমি ওর চোখের সামনে বসে থাকি, এটাই চায় ও। আমি পারবো না ওর সাথে থাকতে। আর এটাই আমার ফাইনাল ডিসিশন।”

“তুই কি একটুও ভালোবাসিস না ওকে?”

অরুণিকা মাথা নেড়ে বলল, “না, আমার মন উঠে গেছে।”

আরাফ ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “তাহলে তুই কি সত্যিই ইমানকে…..!”

অরুণিকা চোখ ছোট করে আরাফের দিকে তাকালো। আরাফ শুকনো হেসে বলল, “না, ইভান বললো, আহনাফ কাল বারবার ইমানের কথা বলছিল, তাই জানতে চাইছি।”

“হ্যাঁ, আমি ভালোবাসি ইমানকে। ইনফ্যাক্ট আমাদের সম্পর্কও চলছে।”

অরুণিকার কথা শুনে চোয়াল শক্ত হয়ে গেল চার জনের। তারা আর কিছু না বলে চুপচাপ উঠে চলে গেল। তারা চলে যেতেই অরুণিকা দরজা বেঁধে পেছন ফিরতেই রুহানি পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে বলল, “মিথ্যে বললি কেন? ইমানকে তো ভালোবাসিস না তুই।”

“অন্তত এবার আমাকে জোর করে আহনাফের কাছে পাঠানো বন্ধ করবে ওরা।”

“তুই সব জেনেও এমন করছিস!”

“হ্যাঁ, কারণ আই হেইট দেম। আমি চৌধুরী বাড়ির সাথে কোনো সম্পর্কই রাখতে চাই না।”

“আহনাফ স্যারের জন্য একটুও মায়া লাগছে না তোর? উনার মা উনাকে ড্রাগস দিয়েছে। উনি কেমন উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে তোর জন্য!”

“ওর শাস্তি হয়েছে। আমাকে পাঁচ বছর কষ্ট দিয়েছে ও।”

“অরু, সব তো উনার মায়ের দোষ।”

অরুণিকা চেঁচিয়ে বলল, “রুহানি, চুপ কর।”

রুহানি গম্ভীর কন্ঠে বলল, “এসব তুই হিমালয়ের জন্য করছিস, তাই না? ভালোবেসে ফেলেছিস হিমালয়কে?”

অরুণিকা থমকে গেল। রুহানির হাত ধরে বলল, “এই কথা কাউকে বলিস না, প্লিজ। শুধু শুধু উনার ইমেজ নষ্ট হবে। আমি হিমালয়কে ভালোবাসি না। কিন্তু উনার প্রতি অদ্ভুত মায়া কাজ করে আমার। উনার ব্যক্তিত্বের মায়ায় পড়ে যাচ্ছি আমি। অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে আটকাতে পারছি না। আমি যেই ভালোবাসা, যেই সম্মান আহনাফের কাছে আশা করেছি, সব হিমালয় আমাকে দিয়েছেন। কিন্তু তুই চিন্তা করিস না, আমি সীমালঙ্ঘন করবো না। আমি উনাকে ভালোবাসবো না। এটা শুধুই ভালো লাগা থাকবে। আর কিছু না।”

অরুণিকা এই বলে দ্রুত নিজের রুমে ঢুকে পড়লো। রুমে ঢুকতেই আহনাফের কন্ঠ বারবার তার কানে বাজছে, “অরু, আমার কাছে আয়।”

অরুণিকা কানে হাত দিয়ে মেঝেতে বসে পড়লো। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সে। রুহানিও পিছু পিছু এসে অরুণিকার পাশে বসলো। অরুণিকার কাঁধে হাত রেখে বলল, “শান্ত হো।”

অরুণিকা কাঁপা কন্ঠে বলল, “সব কেমন কম্পলিকেটেড হয়ে যাচ্ছে! আহনাফের হাত ছেড়ে দিলে, ওর প্রতি অন্যায় হবে। সমাজের মানুষের কাছ থেকে আমি স্বার্থপর ট্যাগ পাবো। কিন্তু এসবের ভীড়ে আমি কোথায়? আমার কি কোনো স্বপ্ন নেই? আমার কি নিজেকে ফার্স্ট প্রায়োরিটি দেওয়ার কোনো অধিকার নেই? আমি তো সুস্থ জীবন চাই। আহনাফের সাথে থাকলে আমার লাইফটা কম্পলিকেটেড হয়ে যাবে।”

“তুই তো উনাকে ভালোবাসতি। তুই কয়েক মাস আগেও উনার সাথে সংসার করতে চেয়েছিলি। লুকিয়ে লুকিয়ে উনার গান শুনতি। কুয়াশ বাহ তো উনিই, তাই না? আমি তোর ডায়েরির নোট পড়ে জেনেছি সব। তাহলে হঠাৎ এমন অনুভূতিহীন হয়ে গেলি!”

অরুণিকা শক্ত করে রুহানির হাত ধরে বলল, “ধোঁকার যন্ত্রণা কেমন ভয়ংকর, যে ঠকে যায়, সেই জানে। ওর উপর আমার বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই। তার উপর ওর মা! শিরিন সুলতানা। ভয়ংকর মহিলা। উনি নিজের ছেলেকে ছাদ থেকে ফেলে দিয়েছে। আবার এখন আহনাফকে ড্রাগ এডিক্টেট বানিয়ে ফেলেছে। তোর মনে হয়, আমাকে ওই মহিলা আস্ত রাখবে? উনি আমাকে মেরে ফেলবে। আমাকে প্রতিদিন ওই শিরিন সুলতানাকে ফেইস করতে হবে। একটা অসুস্থ সংসারে, আমার কোনো ভবিষ্যৎ নেই। প্রতিদিন আমাকে হোম পলিটিক্স করতে হবে উনার সাথে। ওই বাড়িতে আমি আমার ভবিষ্যৎ দেখছি না। রুহু বিশ্বাস কর, উনার ধূর্ত চিন্তা ভাবনার সাথে প্রতিদিন যুদ্ধ করার মতো আমার শরীরে, আমার মস্তিষ্কে একটুও শক্তি নেই। আমি উনার সাথে এসব হোম পলিটিক্স করতে পারবো না। আমি অনেক সিম্পেল। আমাকে উনি আবার ভিলেন বানিয়ে দেবে। তখন সবাই আবার আমাকে ভুল বুঝবে। না, না, আমি ওখানে যাবো না।”

“কিন্তু তোর চাচ্চু তো ডিভোর্স দেবে বলল!”

“আগে দিক, তারপর। তোর মনে হয় দেবে? এই বয়সে এসে ডিভোর্স দেবে? আর‍ যেখানে ওই মহিলা ব্ল্যাক ম্যাজিক করে, নিজের ছেলেকেও বাদ রাখে নি, সে যদি আমার উপর করে আমাকেও পাগল বানিয়ে দেয়? আমার দুনিয়া তো শেষ হয়ে যাবে।”

“আর আহনাফ স্যার!”

“আমার আহনাফের প্রতি সেই ভালোবাসা নেই, যেই ভালোবাসার টানে আমি সব ঝামেলা ফেইস করতে পারবো। আমার মন আমাকে ওদিকে টানছে না। জাস্ট কাগজের একটা সম্পর্কে বেঁধে আছি আমরা। আমার আহনাফের এই ব্যক্তিত্ব, এই স্বভাব পছন্দ না। আগে তো বাচ্চা ছিলাম। ভালোবাসা কি বুঝতাম না। এখন সব বুঝি। এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আমি নিজেকে ভালোবাসি। আর একটা মেয়ে তো একটা পুরুষের ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়ে। আহনাফের কোনো পারসোনালিটিই নেই। আর ওর আউটলুক দিয়ে কি হবে? মানুষ তো স্বভাব, চরিত্র এসবের প্রেমে পড়ে। কি হবে আহনাফের স্মার্টনেস দিয়ে? আমি ওর চেহারা, স্মার্টনেস ধুয়ে ধুয়ে পানি খাবো? ওর ব্যবহারই ভালো না, ও আমাকে যেখানে-সেখানে অপমান করে। আর আমি ওর ওই চাঁদ মুখের দিকে তাকিয়ে সব ভুলে যাবো? নট এট অল। এসব আমাকে শান্তি দেবে না। আমাকে শান্তি দেবে একটা মানুষের ব্যক্তিত্ব, তার আচার-ব্যবহার, তার স্বভাব, তার চরিত্র। আর আহনাফ সবদিকেই ফেইল।”

অরুণিকা কিছুক্ষণ থেমে পুনরায় বলল, “আমি হিমালয়ের মতো একজনকে চাই। একজন শান্ত, ধীরস্থির, বিচক্ষণ মানুষ চাই। যার কাছে সম্মান আশা করা যাবে। আমি শুধু সেই সম্মানটাই চাই। উন্মাদ ভালোবাসা লাগবে না আমার। একটুখানি ভালোবাসলেই হবে। কিন্তু অজস্র সম্মান, অনেক বেশি যত্নশীল হতে হবে। আহনাফের ভালোবাসায় উন্মাদনা আছে ঠিকই, কিন্তু কোনো যত্ন নেই, কোনো সম্মান নেই। আমি ওভার পজেজিভ কাউকে চাই না আমার জীবনে। দায়িত্বশীল মানুষ চাই। এটা আমার বেসিক রাইট। এমন লাইফ পার্টনার চাওয়া আমার অধিকার। এটা আমার হক। তাহলে আমি কেন ভুল হবো? কেন স্বার্থপর হবো? আসলে এই সমাজটাই স্বার্থপর। তারা মেয়েদের উপর নিজেদের মতো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়। কিন্তু আমি এই সমাজ মানি না। আমার কাছে আমি আগে। আগে আমি বাঁচি, তারপর অন্য কারো চিন্তা করবো।”

রুহানি আপসোসের সুরে বলল, “তোর কথা ঠিক। কিন্তু আহনাফ স্যার যদি ভালো হয়ে যায়?”

অরুণিকা চোখ মুছে দৃঢ় কন্ঠে বলল, “আমি ওকে ভালোবাসি না। পারিবারিক সম্পর্কগুলোতে শুরুতে ভালোবাসা থাকে না। বিয়ের পর ভালোবাসা হয়। কিন্তু আমি তো বিশ্বাসও হারিয়ে ফেলেছি। ও এরপর ভালো হবে কি হবে না, আল্লাহই ভালো জানেন। কিন্তু কি হবে সেটার উপর ভিত্তি করে আমি এখন কোনো স্টেটমেন্ট দিতে পারবো না। মানুষের মনের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। একটা মানুষ বাই বর্ন খিটখিটে মেজাজের। তার উপর এখন সে এডিক্টেটও হয়ে গেছে। সামনে কিছু হলে আমার গায়ে হাত তুলবে না, এটা আমি বিশ্বাস করবো কীভাবে? আমি না হয় এই সো কল্ড সমাজের কথা ভেবে মেনে নিলাম আহনাফকে। এরপর আমার কি বাচ্চা-কাচ্চা হবে না? ওদের ভবিষ্যৎ কি? শোন, আমার বাবা আমার মাকে চোখে হারাতো। আমি এসব দেখে বড় হয়েছি। এটা অনেক বড় আশীর্বাদ। এসব না দেখলে আমি তো ভালোবাসার আসল সংজ্ঞায় জানতাম না। তোর কথায় ইনফ্লুয়েন্স হয়ে, সুড়সুড় করে আবার আহনাফের কাছে চলে যেতাম।”

অরুণিকার কথায় আর কিছুই বলার সাহস পেল না রুহানি। কীভাবে পাবে? অরুণিকা তো ভুল বলছে না। কিন্তু অন্যদিকে আহনাফের কথা ভেবেও বেশ মায়া লাগছে তার। রুহানি উঠে চলে যেতে যেতে বলল, “তোর লাইফ, তোর সিদ্ধান্ত। কিন্তু বেশ কঠিন হৃদয়ের মানুষ হয়ে গেলে, পরে শুনেছি আপসোস করতে হয়। কেন একটু নরম হই নি, সেই আপসোস!”

(***)

ভেজা চুল মুছতে মুছতে জানালার কাছে এসে দাঁড়ালো অরুণিকা। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ পেতেই পিছু না ফিরে বলল, “রুহু, এক কাপ চা খাওয়াতে পারবি? আমার ভীষণ মাথা ধরেছে।”

অরুণিকা খেয়াল করলো তার ঠিক পেছনে এসে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। চোখ কুঁচকে পিছু ফিরতে আহনাফকে দেখে চমকে উঠলো সে। আহনাফ ক্ষীণ হেসে বলল, “কেমন আছিস?”

অরুণিকা ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল, “তুমি এখানে কি করছো?”

আহনাফ ব্যস্ত কন্ঠে বলল, “রিল্যাক্স। চলে যাবো আমি। তোকে একটু দেখতে এসেছি।”

অরুণিকা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল আহনাফকে। আহনাফ টাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে বসে পড়লো আর খাটের কোণার সাথে তার পিঠের ঘষা লাগলো। আহনাফ চোখ-মুখ কুঁচকে বসে রইল কিছুক্ষণ। এখনো বেশ ব্যথা সেই পিঠে। আহনাফ এখনো জানেই না অরুণিকা গতকাল রাতে তার পিঠে চেয়ার ছুঁড়ে দিয়েছিল। অরুণিকা চেঁচিয়ে বলল, “তুমি এখানে ঢুকেছো, তার মানে রুহানি, মামী, আরাফ সবাই জানে। ওরাও আমাকে তোমার সাথে আটকে দিতে চাচ্ছে, তাই না?”

আহনাফ কাতর কন্ঠে বলল, “তুই ভুল বুঝছিস। রুহানি আমাকে ভেতরে আসতে দিতে চায় নি। আমি তো চলে যাবো, তাই একটু দেখা করার অনুমতি দিয়েছে। আমাকে কি একটু বিদায় দিবি না?”

আহনাফ অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “কাল থেকে পিঠে অনেক ব্যথা। নড়াচড়াও করতে পারছি না। নিঃশ্বাস ফেলতেও কষ্ট হচ্ছে। যাক গে, এসব কথা বাদ দেই। আমি তো বিদায় নিতে এসেছি। আজই রিহ্যাবে চলে যাবো। শুনলাম, ওখানে ফোনও ধরা যায় না। অনেক কঠোর নিয়ম। তোর সাথে যোগাযোগও করতে পারবো না। আমি না-কি কোনো ছবিও সাথে রাখতে পারবো না৷ একদম শূন্য হাতে যেতে হবে। তোকে মিস করবো অনেক।”

অরুণিকার মায়া হলো বেশ। সে আহনাফের কাছে এসে তার হাত ধরে বলল, “তোমার জন্য সবাই অনেক চিন্তা করছে। প্লিজ, ফিরলে কিন্তু এসব ছেড়ে ফিরতে হবে। কোনো ভাবেই আর ওদিকে নিজেকে জড়াতে পারবে না।”

আহনাফ অরুণিকার হাতে অধর ছুঁয়ে বলল, “আমি প্রমিজ করছি, আমি চেষ্টা করবো। নিজেকে ফিরিয়ে আনবো। তুই আমার অপেক্ষায় থাকবি তো!”

অরুণিকা চুপ করে রইল। অরুণিকার নীরবতায় সায় দিল আহনাফ। মাথা নেড়ে বলল, “সমস্যা নেই। আমি সারা জীবন আশায় থাকবো। তোকে ভীষণ ভালোবাসি, অরু। যাওয়ার আগে তোর কাছে মাফ চেয়ে নিচ্ছি। অতীতে যা করেছি, আমাকে মাফ করে দে। আমাকে ভালোবাসতে হবে না। আমি আর জোর করবো না তোকে। অন্তত ঘৃণা করিস না। আমার না কপালটাই খারাপ। আমি তোকে ভালো রাখতে পারি নি। খুব মন্দ কপাল আমার! ভালোবাসা পেয়ে হারিয়ে ফেলেছি। তুই যাকে ভালোবাসিস, মানুষটা অনেক ভাগ্যবান। তোর মতো লক্ষী একটা মেয়ে যার কপালে আছে, সে আসলেই ভাগ্যবান। এখন অনেক ম্যাচিউওর হয়ে গেছিস তুই। অনেক সুন্দর সুন্দর কথা বলিস। শুধু আমার সাথেই বলিস না। আমিও অবশ্য ভালো ব্যবহার আশা করি না। রিভেঞ্জ অব ন্যাচার বলেও একটা কথা আছে। তোর সাথে যা করেছি, এই শাস্তি বোধহয় অনেক কম। একটা ছোট্ট মেয়ের মন ভেঙেছি আমি। আমৃত্যু আমি এর প্রায়শ্চিত্ত করবো। আল্লাহ যদি আমাকে এই দহন থেকে মুক্তি দেয়, তখন আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। তবে আমার বিশ্বাস কি জানিস? আমি একদিন ঠিকই মুক্তি পাবো। অনেক দীর্ঘ পথ হোক, একদিন না একদিন আবার এক শীতের রাতে তোর হাত ধরে কুয়াশা জড়ানো গ্রামে বসে নতুন স্বপ্ন দেখবো।”

অরুণিকা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সরে দাঁড়ালো। আহনাফ তার শূন্য হাতের দিকে তাকিয়ে শুকনো হেসে বলল, “মিথ্যে হলেও আশা রাখা ভালো। যদি মিথ্যে আশা নিয়েও একবছর বেশি বাঁচি ক্ষতি কি?”

আহনাফ আবার অরুণিকার কাছে এসে বলল, “একটু জড়িয়ে ধরতে দিবি? আমি প্রমিজ করছি, আর কখনো এমন আবদার করবো না। শেষবার অন্তত জড়িয়ে ধর।”

অরুণিকা নিজেই এবার আহনাফকে জড়িয়ে ধরলো। আহনাফও সম্মতি পেয়ে শক্ত করে তাকে আঁকড়ে ধরলো। অরুণিকার চোখ বেয়ে নিঃশব্দে জল গড়িয়ে পড়ছে। আর আহনাফ তার কাঁধে মুখ ঘষছে। আহনাফের শরীরের অস্থির কম্পন, দেহের অস্বাভাবিক উষ্ণতা বুঝিয়ে দিচ্ছে এই মানুষটা শারীরিক, মানসিক দুই দিক দিয়েই কতোটা ক্লান্ত, কতোটা অসহায়।

বেশ কিছুক্ষণ পর আহনাফকে ছেড়ে দিল অরুণিকা। অরুণিকা সরে পড়তেই মনটা কেমন অস্থির হয়ে উঠলো তার। হাত কাঁপছে। তার কাঁপা হাতটি অরুণিকার গাল স্পর্শ করলো। অরুণিকা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আহনাফের দিকে। আহনাফের চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে। চোখ ভেজা। আহনাফ এবার কাঁপা কন্ঠে বলল, “মাফ করে দিস আমাকে।”

এই বলে অরুণিকার হাতে চুমু খেল আহনাফ। গলায় লাল হয়ে যাওয়া দাগটিতে আঙুল ছুঁয়ে বলল, “আসলে আমি একটা জানোয়ার। তোর মতো ফুলের পাশে আমাকে মানায় না। ভালো থাকিস। নিজের খেয়াল রাখিস। আমি যাই।”

এই বলে আহনাফ চলে গেল। অরুণিকা ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। অজানা কারণেই তার খুব কষ্ট হচ্ছে। আর সে জানে, এই কষ্টের কোনো ভিত্তি নেই।

চলবে-