#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-৫১ (১ম ভাগ) ||
“হৃদি,
আজ আপনাকে গল্প শুনাবো না। আজ আমার মনটা ভীষণ ভারী। ভাবছেন, আমি ভবিষ্যৎ কীভাবে বলতে পারি? জানি না। আজ বইয়ের পাতায় আপনার জন্য চমৎকার একটা কবিতা লিখেছি। পড়ে দেখুন। চাইলে নিজেকে সেই রঙে রাঙাতেও পারেন।”
অরুণিকা বইয়ের পাতা উল্টালো। সেখানে কালি কালিতে স্পষ্ট হয়ে আছে হিমালয়ের সনেট-১১।
“শুভ্র রুমালী ঢেকে দিয়াছে তার স্নিগ্ধ মুখখানা,
লাল শাড়িতে লাগিতেছে তারে ভীষণ মায়াবী।
ঘন কেশগুচ্ছ হৃদয়ে দিতাছে হানা,
তার কাজল কালো দৃষ্টি বলিতেছে, প্রাণ হারাবি।
রঙ মাখিতেছে শুভ্র হাত জোড়া- হৃদয় কাঁড়িলো আঁখি,
তার হাসিতে জুড়িয়াছে প্রাণ- মন বাঁধিলো মিষ্টি গান
নুপূর জোড়া প্রেম তুলিতেছে, দেবে কেন সে ফাঁকি?
কাঁপন ধরাইলো তার স্পর্শ, মোর নেই কোনো অভিমান।
যদি সে আমারই হয়, সে আমারই আবার হইবে,
বিষণ্ণ স্মৃতিতে জমিবে ধুলো, তবু ফিরিবে সে মোর ঘাটে
আমি কোনো আগন্তুক নই, কবে মোরে তুমি চেনা কইবে?
রঙিন হইবে আবার- ধূসর রঙ ছড়িয়াছিল যেই মাঠে।
তুমি মোর স্বপ্নে দেখা মিষ্টি গল্প- যা ছিল আড়ালে ঢাকা।
তুমিহীনা আমি হয়তো অল্প- ভেতরটা মোর পুরোটাই ফাঁকা।”
অরুণিকা বইটি বন্ধ করে ড্রয়ারে তুলে রাখলো। বাড়ি থেকে ফিরেছে আজ তিন দিন হলো। অথচ মনটা সেই গ্রামেই আটকে আছে। কেন, তার উত্তর নেই৷ হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে তার ঘোর কাটলো। পেছন ফিরে রুহানিকে দেখে বলল, ” কিছু বলবি?”
রুহানি অরুণিকার হাত ধরে বলল, “আজ কি কারো জন্মদিন?”
অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে কিছু একটা ভেবে বলল, “হ্যাঁ আজ তো আরাফের জন্মদিন।”
রুহানি মুখ বাঁকিয়ে বলল, “তুই আমাকে আগে বলবি না?”
“তোর কথা শুনেই তো মনে পড়লো।”
“কি ভাই তুই? ভাইয়ের জন্মদিন মনে রাখিস নি?”
“তোর এতো সমস্যা কীসের!”
রুহানি হালকা হেসে বলল, “আমি উনাকে একটা গিফট দেবো ভাবছি।”
“তোকে দাওয়াত করেছে?”
“হ্যাঁ, তূর্য ভাইয়া বললেন তোকে নিয়ে যেতে৷ আজ না-কি দাওয়াত। একজন স্পেশাল রাঁধুনি এসে রান্না করেছেন।”
“কি?”
“আমি জানি না। আমাকে সিঁড়িতে দেখেছিল, আর বললো আজ বাসায় জন্মদিন উপলক্ষে দাওয়াত তোকে আর আমাকে।”
“আর তোর মনে হচ্ছে আমি দাওয়াত নেবো?”
“হ্যাঁ, কেন নিবি না?”
“তুই যা, ভাই।”
“প্লিজ। আমার জন্য চল।”
“তুই এতো আগ্রহী কেন?”
“উনি আমাকে দু’দুবার ওই মাস্তান মার্কা পোলাগুলো থেকে বাঁচিয়েছে।”
অরুণিকা হেসে বলল, “এজন্য খেতে যাবি?”
রুহানি অরুণিকার হাতে হালকা চাপড় মেরে বলল, “গিফট নিয়ে যাবো।”
“তোর কাছে টাকা আছে?”
“জমানো টাকা।”
অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “ও মাই গড! এতো ইম্পোরটেন্স দিচ্ছিস!”
“প্লিজ, চল না।”
অরুণিকা না সূচক মাথা নাড়তেই রুহানি পা ধাপিয়ে বলল, “প্লিজ অরু, চল না।”
শেষমেশ রুহানির জোরাজুরিতে রাজি হলো অরুণিকা।
(***)
কলিংবেলে চাপ দিতেই দরজা খুলে দিল একটা সাদা শাড়ি পরা রমনী। রুহানি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ভ্রূ কুঁচকে বলল, “আপনি!”
অরুণিকা বিষ্ময় নিয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটি অরুণিকাকে দেখে এক গাল হেসে বলল, “টুইংকেল!”
অরুণিকা গালে হাত দিয়ে বলল, “উপমা আপু।”
অরুণিকা জড়িয়ে ধরলো উপমাকে। রুহানি অবাক দৃষ্টিতে দু’জনের আলিঙ্গন দেখছে। ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা তূর্য ভ্রূ কুঁচকে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে আছে৷ অরুণিকা উপমাকে ছেড়ে তূর্যের কাছে এসে বলল, “আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না, তুমি ভালো হয়ে গেছো।”
তূর্য চোখ-মুখ কুঁচকে বলল, “আমি কি খারাপ ছিলাম?”
“তা না, কিন্তু উপমা আপুকে বাসায় নিয়ে এসেছো তুমি। আমি অনেক হ্যাপি তোমাদের জন্য। ফাইনালি তোমার উন্নতি হয়েছে।”
তূর্য শব্দ করে হেসে উঠলো। তূর্যের হাসি দেখে উপমা মাথা নিচু করে নিলো। অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “এভাবে হাসছো কেন?”
তূর্য রুহানির দিকে হাত নাড়িয়ে বলল, “হাই রুহানি!”
রুহানি মাথা নেড়ে বলল, “হাই।”
তূর্য বলল, “তোমাকে বলেছিলাম না, আমাদের বন্ধুর জন্মদিনের দাওয়াতের আয়োজন একজন স্পেশাল রাঁধুনি করেছে।”
তূর্য উপমাকে দেখিয়ে বলল, “এই হচ্ছে সেই মেয়ে!”
অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে তূর্যের দিকে তাকিয়ে রইল। তূর্য বলল,
“এ হচ্ছে উপমা, আমাদের গ্রামের বাড়ির পাশেই থাকে৷ এখন থেকে দু’বেলা রান্না করে দেবে। আর আমার কাপড় চোপড় পরিষ্কার করে দেবে।”
রুহানি গালে হাত দিয়ে বলল, “এতো স্মার্ট বুয়া?”
অরুণিকা রুহানির দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “রুহু, উনি উপমা আপু। উনি…..”
তূর্য অরুণিকাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “উপমা আমাদের পাশের গ্রামে থাকে। ওর বাবা একজন চাষী। ওর মা এখানে গার্মেন্টসে কাজ করে। আর ও অন্যের বাড়িতে বুয়ার কাজ করে৷ একটু স্মার্ট কারণ পড়াশুনা করেছে।”
অরুণিকা বলল, “আমি ভেবেছি তুমি চেঞ্জ হয়ে গেছো!”
তাহমিদ তাদের কথা থামিয়ে দিয়ে বলল, “আজ প্লিজ চুপ থাক। আজ আরাফের জন্মদিন।”
তখনই ইমন বলে উঠলো, “আজ তো অরু আর আহনাফের ম্যারিজ এনিভার্সারি।”
ইমনের কথায় চমকে উঠলো অরুণিকা।
~ কিছু সমস্যার কারণে আমি অনিয়ম করেছি। আজকের পর্বটাও ছোট হয়েছে। আশা করবো আপনারা বুঝবেন। আমার জন্য বেশি করে দোয়া করবেন। আমি গল্প দেওয়া নিয়ে নিশ্চিত কিছু বলতে পারছি না। তবে চেষ্টা করবো গল্প দেওয়ার।
চলবে-
#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-৫১ (২য় ভাগ) ||
খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে রুহানি। হঠাৎ পিছু ফিরতেই কারো বুকের সাথে ধাক্কা খেয়ে থমকে গেল সে৷ মুহূর্তেই এক জোড়া হাত তার বাহু স্পর্শ করলো। রুহানি তার ভীত চোখ জোড়া তুলে মানুষটির দিকে তাকালো। উভয়ের চোখাচোখি হলো। রুহানি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেই পরিচিত চোখ জোড়ার দিকে। সেই দৃষ্টিও যেন রুহানির চোখের মাঝেই হারিয়ে গেছে। পেছন থেকে ভারী কন্ঠের ডাক শুনে রুহানিকে ছেড়ে দিল সেই মানুষটি। রুহানি লাজুক হেসে মাথা নুইয়ে বলল, “হ্যাপি বার্থডে, স্যার।”
আরাফ ভ্রূ কুঁচকে তাকালো রুহানির দিকে। রুহানি তার কাঁধে ঝুলানো ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করে আরাফের দিকে এগিয়ে দিল। আরাফ প্যাকেটটি হাতে নিয়ে বলল, “কি এটা?”
“আপনার জন্য উপহার।”
“তুমি টাকা কোথায় পেয়েছো? নিশ্চয় চুরি করেছো!”
রুহানি চোখ ছোট করে বলল, “এতোটাও খারাপ না আমি। পকেটমানি থেকেই দিয়েছি।”
“রিয়েলি?”
আরাফ প্যাকেট খুলে ভেতর থেকে একটা বাক্স বের করে ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কি এখানে?”
“নিজেই খুলে দেখুন।”
আরাফ চোখ-মুখ কুঁচকে বাক্সটি খুলে অবাক হয়ে সেকেন্ড খানিক রুহানির নিয়ে আসা উপহারটির দিকে তাকিয়ে মুখ চেপে হাসলো। রুহানি উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কেমন লেগেছে, স্যার? পছন্দ হয়েছে?”
আরাফকে ডাকাডাকি করেও কোনো সাড়া না পেয়ে তূর্য বারান্দায় এসে দেখলো আরাফ আর রুহানি দাঁড়িয়ে আছে মুখোমুখি। তূর্য কাছে এসে আরাফের হাতে থাকা বাক্সটি দেখে ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কোন বাচ্চার এটা?”
রুহানি চমকে তাকালো তূর্যের দিকে। আরাফের হাত থেকে রুহানির দেওয়া ঘড়িটি টেনে নিলো তূর্য। এরপর আরাফের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে বলল, “এটা কার?”
রুহানি হালকা হেসে বলল, “এটা স্যারের জন্য এনেছি আমি।”
তূর্য রুহানির কথা শুনে সেকেন্ড খানিক ঘড়িটির দিকে তাকিয়ে আরাফের দিকে তাকালো। এরপর দু’জনই শব্দ করে হেসে উঠলো। তূর্য হাসতে হাসতে ঘড়িটি নিয়ে বসার ঘরে চলে গেল। ইভান, ইমন আর তাহমিদকেও সেই ঘড়ি দেখালো। এরপর হাসতে হাসতে বলল, “আরাফের গিফট।”
ইমন ঘড়িটি হাতে নিয়ে এপাশ-ওপাশ করে বলল, “আরেহ, এটা তো বাচ্চাদের ঘড়ি। কোন ছাগল এই গিফট দিল তোকে? একটা সাতাশ বছরের বেটাকে এই গিফট! এক কাজ কর আরাফ, তোর ভবিষ্যৎ বাচ্চার জন্য রেখে দিস এটা।”
রুহানি দরজার কাছে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার চোখ জোড়া ছলছল করে উঠলো। ইভান হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলো, “আরাফ, কে দিয়েছে এটা?”
আরাফ রুহানির দিকে তাকিয়ে থমকে গেল। রুহানি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আরাফের দৃষ্টি অনুসরণ করে বাকিরাও রুহানির দিকে তাকালো। তাহমিদ ইশারায় সবাইকে চুপ করিয়ে দিল। উপমা রান্নাঘরের একপাশে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখে আনমনে বলল, “পুরুষ মানুষ বোধহয় এমনই হয়! তারা মেয়েদের আবেগ বুঝে না৷ এরা মেয়েদের অনুভূতি নিয়ে ঠাট্টা করেই মজা পায়।”
ইমন ঘড়িটি রেখে রুহানির সামনে এসে তার নিজের হাতে থাকা ঘড়িটি দেখিয়ে বলল, “আরেহ মেয়ে, এইটা দেখো। ছেলেদের ঘড়ি এমন হয়। ওগুলো তো বাচ্চারা হাতে দেয়। এতো বড় ছেলে এসব ঘড়ি পরলে কি মানায়?”
ইভান বলল, “সমস্যা নেই, আরাফ ওর ছেলের জন্য রেখে দেবে।”
রুহানি নিঃশব্দে দরজা খুলে চলে গেল। আরাফও দ্রুত পায়ে রুহানির পিছু নিলো। এদিকে রুহানি সিঁড়ি বেয়ে নামতে যাবে আরাফ তার হাত ধরে থামালো। রুহানি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। আরাফ তাকে টেনে তার সামনে দাঁড় করালো। কিন্তু রুহানির দৃষ্টি নিচের দিকে স্থির। আরাফ তার থুতনি ধরে তার মুখ উপরে তুললো। রুহানি সাথে সাথেই চোখ বন্ধ করে ফেললো। রুহানির চোখ জোড়া ভেজা৷ আরাফ আঙুল ছোঁয়ালো তার গালে। সে চোখ মেলে তাকালো। আরাফ মৃদু হেসে বলল, “আমার কিন্তু তোমার গিফট অনেক পছন্দ হয়েছে। আমার কাছে এটা ফ্যাক্ট না তুমি কি দিয়েছো। আমার কি ভালো লেগেছে জানো?”
রুহানি ঠোঁট উলটে বলল, “কি!”
“এই যে নাস্তার হিসেব রাখা মেয়েটি আমার জন্য তার পকেটমানির টাকা দিয়ে গিফট কিনেছে। ইটস ভেরি প্রেশাস, ডিয়ার স্টুডেন্ট।”
রুহানি আরাফের কথায় লাজুক হাসলো। আরাফ তাকে ছেড়ে কিছুটা দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে বলল, “চলো। কেক কাটবে না?”
রুহানি এক গাল হেসে উৎসাহ নিয়ে বলল, “হ্যাঁ।”
আরাফ ভেতরে যাওয়ার জন্য ইশারা করতেই রুহানি বাসায় ঢুকলো। আরাফ তার যাওয়ার পানে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আনমনেই হাসতে লাগলো।
(***)
বন্ধ দরজা খুলে ভেতরে পা রাখলো অরুণিকা। অন্ধকার রুম, দরজা-জানালা বন্ধ। অরুণিকা অনেকক্ষণ হলো বদ্ধ রুমটিতে ঢুকেছে। সে ধীর পায়ে হেঁটে একে একে রুমের জানালা আর বারান্দার দরজা খুলে দিল। সূর্যরশ্মি প্রবেশ করতেই অন্ধকার ঘরটি আলোকিত হয়ে উঠলো। অরুণিকা ফাঁকা ঘরটিতে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। তার বুকটা কেউ কামড়ে ধরেছে। অরুণিকা বুকে হাত রাখলো। তার চোখ জোড়া ছলছল করে উঠলো। ধীরে পায়ে হেঁটে সে পরিপাটি ফাঁকা বিছানায় এসে বসলো। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ ফিসফিসিয়ে বলল, “আমার হাতটা ধরবি, অরু। আচ্ছা, থাক ধরতে হবে না হাত। আমার সামনে বসে থাকবি প্লিজ! আমি তোকে ছোঁবো না। শুধু দেখবো।”
অরুণিকার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। খালি বিছানায় হাত বুলিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। চোখ মুছে সামনে থাকা টেবিলটির কাছে এসে দাঁড়ালো। ভাঁজে ভাঁজে ইংরেজি উপন্যাসের বই। অরুণিকা বইগুলো আলতো স্পর্শ করলো। হঠাৎ টেবিলে রাখা একটি ডায়েরিতে চোখ আটকালো তার। চেয়ার টেনে বসলো সে। ডায়েরিটিও হাতে নিল। এই ডায়েরি সে আহনাফের হাতে অনেক বার দেখেছিল। ক্যাম্পাসে নিয়ে যেতো সে। এখানেই হয়তো আহনাফ তার প্রতিদিনের শিডিউল লিখে রাখতো। ডায়েরির পাতা উল্টালো অরুণিকা। কয়েক পাতা উল্টাতেই থমকে গেল একটি পাতায় এসে। চোখ জোড়া কিঞ্চিৎ কুঁচকে গেল তার। ডায়েরিতে বড় বড় করে লেখা, মায়াবতী। এই হস্তাক্ষর তো আহনাফের নয়। আহনাফের লেখা বেশ পরিচিত অরুণিকার কাছে। অরুণিকা পরের কয়েক পাতা উল্টালো। বেশ কিছু পাতা উল্টানোর পর একটি লেখা চোখে পড়লো তার।
“ডিয়ার ভেনাস,
আমি ভালোবেসেছি যাকে তাকে ভালো কিছুই দিতে পারি নি। আমি হেরে যাওয়া এক হিমেল হাওয়া, যেই হাওয়ার স্পর্শে প্রেয়সীর হৃদয় জমে কঠিন হয়ে গেছে।”
অরুণিকা লেখাটির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। যদিও এটি আহনাফের ডায়েরি, অথচ এই পৃষ্ঠার হস্তাক্ষরও আহনাফের নয়। এমনকি আগের পাতায় দেখে আসা মায়াবতী লেখাটির সাথেও মিলছে না এই লেখা। আহনাফের ডায়েরিটা কি অন্য কেউ ব্যবহার করে? হঠাৎ রুমের দরজা খুলে গেল। অরুণিকা উঠে দাঁড়াতেই তূর্য রুমে ঢুকলো। অরুণিকা ক্ষীণ হেসে বলল, “আহনাফের বই দেখছিলাম।”
তূর্য পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, “আহু যাওয়ার পর থেকেই রুমটা বন্ধ করে রেখেছি। ও পছন্দ করে না কেউ ওর রুমে ঢুকুক।”
অরুণিকা ব্যস্ত কন্ঠে বলল, “সরি, আমি জানতাম না।”
“তুমি এসেছো জানলে অনেক খুশি হবে। তোমার স্পর্শ এই ঘরে পড়েছে শুনলে ওর চেয়ে বেশি খুশি কেউ হবে না। থাক, এসব বাদ দাও। চলো, আরাফ ডাকছে।”
অরুণিকা কৌতুহলি মনে প্রশ্ন করলো, “এই ডায়েরিটা কার!”
তূর্য অরুণিকার হাতে থাকা ডায়েরিটা দেখে বলল, “আহনাফের।”
“কিন্তু হ্যান্ড রাইটিং তো অন্য কারো।”
তূর্য ডায়েরিটা হাতে নিয়ে হাতের লেখার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। অরুণিকা অন্য পাতায় ভিন্ন হস্তাক্ষর দেখিয়ে বলল, “এই লেখাও ওর না। আহনাফের ডায়েরিতে ভিন্ন দু’টি হ্যান্ড রাইটিং!”
তূর্য হালকা হেসে বলল, “আহুরই লেখা৷ তুমি জানো না ওর হিডেন ট্যালেন্ট?”
“কেমন!”
“ও হাতের লেখা কপি করতে পারে৷ ওর লেখা তো আমরাই চিনি না মাঝে মাঝে। এক এক জায়গায় এক এক লেখা৷”
“কীভাবে?”
“জানি না। তবে রিয়েল হ্যান্ড রাইটিং যেটা দেখেছো ওটাই৷ এগুলো তো শখের বশে লেখে। এসব লিখতে অনেক সময় লাগে ওর। ও তো সারারাত বসে লেখালেখি করে। সকালে ডাস্টবিনে শুধু দুমড়েমুচড়ে রাখা পৃষ্ঠা পাওয়া যায়।”
“ও লেখালেখি করে?”
তূর্য কিছু একটা ভেবে বলল, “আরেহ, ভার্সিটির নোট রেডি করে হয়তো। চলো তো, ডাকছে আরাফ।”
অরুণিকা ডায়েরিটা রেখে দিল আগের জায়গায়। হঠাৎ টেবিলের কোণায় একটি কলমে চোখ আটকে গেল তার। কাঠের কলম। ভ্রূ কুঁচকে তাকালো সেই কলমটির দিকে। আনমনে বলল, “এই কলম আমি অন্য কোথাও দেখেছি। কিন্তু কোথায় দেখেছি?”
তূর্য তাগাদা দেওয়ায় অরুণিকা আর ঘাটলো না বিষয়টা। বেরিয়ে এলো আহনাফের রুম থেকে।
(***)
আজ মাঘ মাসের প্রথম সপ্তাহ। আরেকটি মঙ্গলবার। অরুণিকা প্রতিবারের মতো আজও ছাদে উঠলো। খাম খুলে পড়লো হিমালয়ের অষ্টম চিরকুট। যেখানে লেখা-
“প্রিয়,
আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখুন আজ। কি দেখতে পারছেন? মেঘ না-কি কুয়াশা! কুয়াশার ঘনত্ব বেড়েছে, তাই না? এখন বোধহয় আপনার ছাদে উঠতে ভীষণ কষ্ট হয়। আপনি শেষ তিনটি খাম এই সময়ে আর খুলবেন না। আপনি বাকি তিনটি খাম আপনার খুব চেনা পরিচিত তিনটি স্থানে গিয়ে খুলবেন। ভোরে না হোক, অন্য বেলায় পড়বেন। ইচ্ছে করলে রাতেও পড়তে পারেন। তবে সেদিন যেন মঙ্গলবারই হয়।”
অরুণিকা এবার বইয়ের পাতা উল্টালো। আজ হিমালয়ের দ্বাদশ সনেট পড়বে সে।
“আপনার আঁখিতে আমি দেখিলাম আকাশ,
আপনার হাসিতে পাইলাম সুখ,
আপনার কুন্তলে খুঁজিয়া নিলাম আশ্বাস,
আপনার অশ্রুতে হৃদয় মরুক।
আপনার নিঃশ্বাসে আমি ফিরিয়া পাই বিশ্বাস,
আপনার ঘ্রাণে মাতাল লোক
আপনার স্পর্শে খুঁজে ফিরি শান্তির আভাস,
আপনার প্রেমে উজাড় বুক।
আপনি না জানি কেমনে আসিবেন,
বাসিবেন আমারে ভীষণ ভালো!
আপনি না জানি কেমনে হাসিবেন
জানিলে আমার হৃদয় কালো!
তবু এই মন সাজাইলো আপনার নাম
আমি কি ফিরিয়া পাইবো আমার দাম?”
অরুণিকা বই বন্ধ করলো। মনের অজান্তে এই দুই মাসেই হিমালয়ে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে সে। তার হৃদয়ের কোণে এই অদৃশ্য মানুষটি জায়গা করে নিয়েছে। মানুষটিকে ভালোবাসার কোনো ইচ্ছে ছিল না তার। তবে ধীরে ধীরে অরুণিকার মনে হিমালয়ের জায়গা গাঢ় হতে লাগলো। হঠাৎ কীভাবে হিমালয়ের প্রেমে পড়লো সে! কখন থেকে হৃদয় উন্মুক্ত হলো তার? সেই যে অনেকদিন আগে রুহানি তাকে বলেছিল, অদেখা হিমালয়ের রূপ কল্পনা করতে। অরুণিকা সেদিন দেখেছিল এক পুরুষকে। সেই পুরুষকে হিমালয় রূপে দেখে ভীষণ মুগ্ধ হয়েছিল সে। সেদিন থেকেই অরুণিকার অবস্থা অনেকটা হিমালয়ের লেখা চরিত্র শুভ্রের মতো হয়ে গেছে। সে শুধু স্বপ্ন দেখে হিমালয়কে। স্বপ্নে কি সুন্দর প্রেমের গল্প রচনা করে তারা! অরুণিকা স্বপ্নে আসা সেই হিমালয়ের প্রেমে মুগ্ধ হয়। এই মুহূর্তে সেই মুগ্ধতা নিয়েই আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে সে। নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করছে, “আমি কি পাগল হয়ে গেছি? হিমালয় মানুষটা অন্য কেউ, অথচ আমি তাকে অন্য এক রূপে কল্পনা করছি। মানুষটা আমাকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে। আমার স্বপ্নে এসে আমার মায়া বাড়িয়ে দিচ্ছে। আমাকে ভালোবাসতে বাধ্য করছে। আমার অন্ধকারে ঘেরা পাথর মনে কীভাবে যেন ফুল হয়ে ফুটছে। অন্ধকার কেটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। আমি আলোর দেখা পাচ্ছি। কিন্তু ভয় হচ্ছে আমার। ভীষণ ভয় হচ্ছে। সে যদি আবার হারিয়ে যায়? সেই প্রেমের রঙ যদি বদলে যায়? আমি তো কখনোই আশা করি নি, তাকে ভালোবাসবো। আমি নিজের উপর যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। তাহলে কেন তার মুখখানা বারবার আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে? সে কি আসলেই হিমালয় হতে পারে?”
(***)
অফিস থেকে বের হতেই ইমনের মুখোমুখি হলো তার সিনিয়র কলিগ মিস্টার আজিজ ইসলামের সাথে। ইমনকে বেশ স্নেহ করেন তিনি। ইমনকে দেখেই তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, “কি রে জুনিয়র, কি অবস্থা?”
“স্যার, ভালোই আছি। অনেকদিন আসেন নি আপনি।”
“ছুটিতে গিয়েছিলাম। আমার এক বাল্য বন্ধুর বিয়ে।”
“বেশ তো।”
“তা কোথায় যাচ্ছো তুমি?”
“স্যার, লাঞ্চ করা হয় নি৷ সামনের রেস্টুরেন্টে যাচ্ছি।”
“আমিও তো করি নি। চলো একসাথেই বসি।”
মিস্টার আজিজের সাথে অফিসের পাশের রেস্টুরেন্টে বসলো ইমন। আজিজ সাহেব বেশ ভালো মানুষ, তবে অসম্ভব বাচাল। কোনো বিষয়ে কথা শুরু হলে তার নাড়িভুঁড়িও বাদ দেন না। এই মুহূর্তে তার আড্ডার বিষয় তার বাল্য বন্ধু রিয়াজুর রহমানকে ঘিরে। মিস্টার আজিজ বলতে লাগলেন, “বুঝেছ ইমন, মেয়ে লোক ভালোই ছলনা করতে জানে। রিয়াজ, আমার বেশ কাছের বন্ধু। আমার এক গ্রামেই থাকি। এক মেয়ের প্রেমে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল আমার বন্ধুটা। কলেজে দেখা। এরপর প্রেম। তাদের বিচ্ছেদের গল্প শুনলে তুমি অবাক হয়ে যাবে। রিয়াজের চাকরি ছিল না বিধায় অনেক বড় ঘরে বিয়ে করে ফেলে ওই মেয়ে। অনেক বছর পর আমার বন্ধুর কাছে ফিরে এসে বলে, সে না-কি স্বামীর সংসারে সুখী না। জানো কি করলো এরপর? আমার বন্ধুর সাথে আবার প্রেম শুরু করলো! কেমন বদমাশ মেয়ে দেখলে! আর আমার সেই গর্দভ বন্ধুটাও হাবার মতো ওই মেয়ের কথামতো নাচা শুরু করলো। একদিন কি হলো জানো? রিয়াজ বললো, সে না-কি বাবা হতে যাচ্ছে। আমি তো অবাক। কি রে, বিয়ে-সাদি ছাড়া এটা আবার কেমন কথা! রিয়াজ তো সেই হতাশ। মেয়ে না-কি মিথ্যে বলেছে। স্বামীর সংসারে বেশ আছে। রাজরানীর মতো থাকে। কিন্তু মেয়ের চরিত্রে সমস্যা। স্বামী না-কি ডাক্তার। বেশ নামকরা ডাক্তার। নিজস্ব হাসপাতাল আছে। মেয়ের না-কি আবার ওই ঘরে একটা ছেলেও আছে। স্বামী-সন্তান রেখে আমার বন্ধুর সাথে পরকীয়া। রিয়াজ তো বোকা! হাবা একটা ছেলে। ফেঁসে গেল। ওই মেয়ে দুই লাখ টাকা খেয়েছে রিয়াজের কাছ থেকে। বিয়ের আগে যখন প্রেম করতো, তখন তো অনেক টাকা খেয়েছিল। এসব তো বাদই দেই। আসল কথায় আসি, রিয়াজ বলেছিল সে বাবা হতে যাচ্ছে। কিন্তু সেই মেয়ে স্বামীর সংসার ছেড়ে আসবে না। এর এক বছর পর এসে বলেছিল, ছেলে হয়েছে তার। অথচ কেউ ঘুনাক্ষরেও জানলো না সন্তানটা কার। আমার বন্ধুটা সেই যে আঘাত পেল, এই দু’দিন আগে এই বয়সে এসে বিয়ে করলো। মেয়ে আবার বিধবা। তবে বেশ ভদ্র। তবে আমার সেই ডাক্তার লোকটার জন্যই খারাপ লাগে। তার বউ যে এতো বদমাশ, বেচারা বোধহয় জানেই না।”
ইমন মনোযোগ দিয়ে মিস্টার আজিজের কথা শুনছে, আর খাচ্ছে। মিস্টার আজিজ বললেন, “লোকটাকে যদি একবার জানাতে পারতাম, বেশ শান্তি পেতাম মনে।”
ইমন হেসে বলল, “কি দরকার স্যার, মানুষের জীবনে ঝামেলা বাড়ানোর?”
“আসলে লোকটাকে আমি চিনি। আমার বাবার সার্জারি করেছিল। কি যেন নাম! হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমির চৌধুরী।”
নাম শুনেই ইমনের গলায় ভাত আটকে গেল। সে কাশতে লাগল। মিস্টার আজিজ তার দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে বললেন, “আরাম করে খাও।”
ইমন ঢকঢক করে পানি খেয়ে ধপ করে গ্লাসটা রেখে মিস্টার আজিজের দিকে তাকালো। আজিজ সাহেব ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “আমার দিকে এভাবে কেন তাকিয়ে আছো? লোকটাকে তুমি চেনো না-কি?”
ইমন বলল, “আপনার বন্ধুর প্রেমিকার নাম কি যেন?”
“আরেহ, এই নাম তো আমি কখনোই ভুলবো না। শিরিন সুলতানা প্রিয়া। প্রিয়া নামে আমার বন্ধু ডাকতো।”
ইমন মাথা নিচু করে বসে রইল। মিস্টার আজিজ ভ্রূ কুঁচকে বললেন, “কি ব্যাপার, জুনিয়র? তুমি কি চেনো তাকে?”
ইমন ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “যদি কখনো না চিনতাম, বেশ ভালোই হতো। এখন তো এমন চেনা চিনলাম, বাকিদের চেনানোর ভয়ংকর দায়িত্বটা এবার আমার উপরই এসে পড়েছে!”
ইমন অন্যমনস্ক হয়ে ভাবলো, “আহনাফ, তুই আরেকটা ধাক্কা খাবি, ভাই। যখন জানবি, আবরার তোর আপন ভাই না। এই সত্য আমি বন্ধু হয়ে তোকে কীভাবে বলবো? একটা ছেলে তার মা সম্পর্কে এমন কথা কীভাবে সহ্য করবে? আল্লাহ, ছেলেটা কি এসব সহ্য করতে পারবে? কি বাজে একটা কান্ড ঘটালো এই মহিলা! নিজে তো শেষ হলোই, একটা পুরো পরিবার ধ্বংস করে দিল!”
চলবে-
#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব- ৫২ ||
আলসে ছেড়ে বালিশ থেকে মাথা তুলতেই অরুণিকা তার মুখোমুখি রুদবাকে দেখে থতমত খেয়ে গেল। রুদবার হাতে হিমালয়ের সেই কবিতার বই। অরুণিকা ফটাফট সেই বই টেনে নিয়ে বলল, “তুই এখানে!”
রুদবা বাঁকা হেসে বলল, “লেখক হিমালয় তোকে চিঠি দিচ্ছি? না-কি চিঠির মানুষটা অন্য কেউ।”
“তুই চিঠিগুলো পড়েছিস?”
“হ্যাঁ তিনটাই পড়লাম।”
অরুণিকা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রুদবার দিকে। রুদবা মৃদু হেসে বলল, “আমি ভেবেছি তুই তূর্য স্যারকে পছন্দ করিস। কিন্তু তোর তো অন্য কারো সাথে নব্বই দশকের মতো প্রেম চলছে। তুই এটা আমাকে আগে জানাতে পারতি না?”
এই কয়েক মাস রুদবার সাথে খুব একটা কথা হয় নি তার। বেশ দূরত্ব হয়ে গেছে তাদের মধ্যে। তাই অরুণিকা হিমালয়ের কথা রুদবাকে জানাতে চাচ্ছে না। শুরু থেকে বলতে গেলে কথা অনেক দীর্ঘ হবে, যা অরুণিকা চায় না। আর এখন এই ভুল বুঝাবুঝি দূর করার ইচ্ছেটাও তার নেই। অকারণেই রুদবার আগমনে বিরক্ত সে। অরুণিকা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। বইটি রেখে দিল ড্রয়ারে৷ রুদবা চিঠি তিনটি ওড়নার ফাঁকে লুকিয়ে রেখেছিল। হুট করে চিঠি খুলে জোরে জোরে পড়তে লাগলো,
“প্রিয় হৃদি,
মাঘের দ্বিতীয় সপ্তাহ চলছে। ভাবছি, আপনাকে আজ একটা গল্প শোনাবো। কুঞ্জ আর ইরাবতীর গল্প। ইরাবতী এক মানব রাজ্যের রাজকন্যা, আর কুঞ্জ একটি রাক্ষস রাজ্যের রাজপুত্র। ইরাবতীর বাবা বেশ লোভী মানুষ ছিলেন। তিনি রাজ্য দখলের নেশায় এক এক রাজ্যে হামলা চালাতেন। একদিন তিনি রাক্ষস রাজ্য আক্রমণ করে বসেন। রাক্ষসদের কাছে ছিল শক্তি। মনুষ্য কুলের মাথায় ছিল বুদ্ধি। সেই বুদ্ধির জোরে তারা ভারী ভারী অস্ত্র বানিয়ে আক্রমণ চালাতো। আর তাই রাক্ষসরা কৃত্রিম শক্তির হাতে পরাজিত হলো। রাক্ষসরাজ এই পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য একমাত্র পুত্র কুঞ্জকে মনুষ্যজাতি ধ্বংস করার জন্য পাঠালেন। সেখানে এসেই রাজকুমারী ইরাবতীর দেখা পেল রাক্ষস পুত্র কুঞ্জ। এরপর তাদের প্রণয় ঘটলো। কিন্তু সেই যে প্রতিশোধস্পৃহা নিয়ে এসেছিল! রাজকুমারীর সর্বস্ব কেঁড়ে নিল কুঞ্জ। ইরাবতীকে ঠকিয়ে চলে গেল সে। ইরাবতীর কপালে লেপ্টে দিল কলঙ্ক। এরপর রাজ্য থেকে বিতারিত হলো ইরাবতী। সে অন্য একটি রাজ্যে চলে গেল। সেই রাজ্যের সিংহাসন খালি। রাজার মৃত্যু হয়েছিল। কোনো উত্তরসূরীও নেই। ইরাবতীকে প্রজারা রাতারাতি রানী বানিয়ে দিল। এবার সে নিজের বুদ্ধি দিয়ে সেই রাজ্যের শক্তি বাড়ালো। এরপর একদিন আক্রমণ করলো রাক্ষস রাজ্য। বধ করলো সেই রাজ্যের নতুন রাজা কুঞ্জকে। সেই আবেগঘন মুহূর্তে উভয়ের চোখ অশ্রু ভীড় করেছিল। কুঞ্জের মৃত্যুর পর সেই রাজ্যের সেনাপতি ইরাবতীকে একটি পত্র দিয়েছিল, যেই পত্রে লেখা,
ওহে, মোর ইরা,
তুমি ছিলে হীরা,
পারি নাই ধরিয়া রাখিতে,
দেশপ্রেমের পিরিতে,
স্বদেশ কি সবার ঊর্ধ্বে হয় না?
তোমারে দেওয়া ব্যথা হৃদয়ে সয় না।
যা পাপ করিয়াছি আমি,
দিলাম ফিরিয়া এর চেয়ে দামি।
তোমারে এই রাজ্যের বানাইলাম রানী,
পুরান রাজার বক্ষ হানি,
তবুও পাষানী আমারেই করিলে খুন,
এই সত্য জানিলে তোমা ক্ষতে পড়িবে নুন।”
রুদবা চিঠিটি পড়ে অরুণিকার দিকে তাকালো। অনেকক্ষণ ধস্তাধস্তি করেও রুদবার হাত থেকে চিঠিটি নিতে পারে নি সে। তাই বাধ্য হয়ে রুদবার মুখে শুনতে হলো পত্রে লেখা হিমালয়ের গল্পটি। আজ মঙ্গলবার নয়। তাই ভীষণ হতাশ হলো অরুণিকা। অসময়ে পড়া হয়ে গেল সেই চিঠি। অনিচ্ছাসত্ত্বেও হিমালয়ের বিশ্বাস ভেঙে গেল। অরুণিকা একপ্রকার টেনে নিলো বাকি চিঠিগুলো। রুদবা তা দেখে বুকে হাত গুঁজে দেয়ালে হেলান দিয়ে বলল, “সত্যটা বল। চিঠির প্রেরক কে?”
অরুণিকা চোখ বন্ধ করে বলল, “হিমালয়।”
“যাহ, মিথ্যুক।”
“সত্যি।”
রুদবা চোখ বড় বড় করে বলল, “আই কান্ট বিলিভ দিস। হিমালয় অনেক বড় লেখক। ছ’বছর ধরে লেখালেখি করছেন। প্রথম বই লিখেই তিনি সবার পছন্দের লেখক হয়ে গেছেন। এতো বড় রাইটার তোকে চিঠি লিখবে? অসম্ভব।”
“আমিও জানি না। কিন্তু এটাই হচ্ছে।”
“কীভাবে বুঝলি এটা উনি?”
“উনার পারসোনাল একাউন্ট থেকে উনি আমার সাথে কথা বলেছেন।”
রুদবা হেসে বলল, “অসম্ভব।”
অরুণিকা বিরক্ত হয়ে ফোন নিয়ে রুদবাকে হিমালয়ের চ্যাট দেখিয়ে বলল, “দেখ।”
রুদবা গালে হাত দিয়ে বলল, “এই একাউন্ট তোকে কে দিয়েছে?”
“ইমান।”
“ও মাই গড। এটা তো উনার পারসোনাল একাউন্ট। আমি নিজেই এখান থেকে উনার লেখা পড়েছি। কিন্তু উনি কেন তোকে মেসেজ দেবেন? এতো বড় একজন রাইটার, সামান্য একটা মেয়েকে….”
অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে রুদবার দিকে তাকালো। রুদবা কথা থামিয়ে হালকা হেসে বলল, “আই মিন, তুই একটা সিম্পেল রিডার। তাহলে এটা কি অসম্ভব না?”
অরুণিকা চুপ করে রইল। রুদবা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “না-কি আইডি হ্যাক হয়েছে দেখ।”
“আমার কোনো আসে যায় না।”
“তুই কি উনাকে পছন্দ করিস?”
“লেখক হিসেবে ভালো লাগে।”
“তোর চোখ দেখে মনে হচ্ছে অন্য কিছু। যখন বললাম, উনার তোকে মেসেজ দেওয়া সম্ভব না, তখনই কেমন নেতিয়ে পড়লি। দেখ, আমি তোর বেস্ট ফ্রেন্ড। হয়তো কোনো একটা কারণে আমাদের মধ্যে কথা বন্ধ। কিন্তু আমি তোকে গত ছ’বছর ধরে চিনি। সত্যটা বল।”
“এটাই সত্য।”
“ওকে ফাইন। জানতে চাই না কিছু। আচ্ছা এটা বল, হিমালয় তোর সামনে এসেছে?”
“না।”
“সেটাই। উনাকে আজ পর্যন্ত কেউ দেখে নি। যদিও এটা উনার ভেরিফাইড একাউন্ট। তবুও একটু শিউর হয়ে নিস। হয়তো উনার নামে অন্য কেউ।”
অরুণিকা মুখ ঘুরিয়ে নিল। রুদবা অরুণিকার বিমর্ষ মুখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে চলে গেল। অরুণিকা তার হাতে থাকা চিঠি তিনটির দিকে তাকিয়ে ড্রয়ার খুললো। বইয়ের ফাঁকে আবার রেখে দিল সেই চিঠি ক’টা। তখনই তার চোখ আটকে গেল হিমালয়ের নতুন সনেটে।
“তোমার সাথে শৈত্যের তুলনা অসম্ভব
তুমি তার চেয়ে অধিক রহস্যময়ী
শীতলতায় যদি হৃদয়ের কাঁপন তোলা সম্ভব
তবে তুমি হতেও পারো ঝড়, খরা ও রিক্ত- ত্রয়ী।
একদিন আবার হারাবে কুয়াশা,
ফিরবে নতুন বরষা,
হারাবে নতুন কলি- ঝরবে হতাশা
সেদিনও আমার মনে- উজ্জ্বল ভরসা।
তোমার প্রতি প্রেমে পড়বে না ভাটা,
মৃত্যু এলেও তুমি অমর আমার কবিতায়
শব্দে যতোদিন পড়বে না কাটা
তুমি বেঁচে থাকবে ঋতুর গায়।
যদি কখনো বিরহ কেটে যায়, বুঝবো ত্রয়ীর আগমন
একবার ফিরে এলে পুনরায় অসম্ভব তার গমন।”
(***)
বেশ কিছুদিন হলো উপমা তার কাজ গুছিয়ে নিয়েছে। আজ তাকে কোম্পানির জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ কিনতে যেতে হবে। তবে সে একা যাচ্ছে না। তূর্যও তার সাথে যাচ্ছে। অফিস ভবনের নিচে এসে দাঁড়ালো উপমা। মিনিট দশেক পর তূর্যও নামলো। সে তার মোটর সাইকেলে বসে হেলমেট পরতে যাবে, তখনই কোথা থেকে রুদবা এসে তার সামনে এসে দাঁড়ালো। রুদবাকে দেখে তূর্য বেশ বিরক্ত হলেও উপমার সামনে তা প্রকাশ করলো না। তূর্যকে মাঝ রাস্তায় দেখে রুদবা বেশ উৎসাহ নিয়ে এটা-সেটা জিজ্ঞেস করছে। আর তূর্যও হেসে হেসে সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। রুদবা আজ বেশ অবাকই হলো। তূর্য তাকে বিন্দুমাত্রও উপেক্ষা করে নি। মিনিট পাঁচেকের কথোপকথন শেষে তূর্য সৌজন্যের সাথে তার কাজের তাড়া দেখিয়ে উপমাকে নিয়ে চলে গেল। তবে এর মধ্যে কৌতুহলি রুদবা উপমার পরিচয় নিতে ভুললো না। তূর্য অফিস সহকারী হিসেবে পরিচয় দিতেই রুদবা মনে মনে প্রশান্তির শ্বাস নিলো।
দু’দিন পর। ছাদে পা রাখতেই পিছলে পড়লো রুদবা। চোখ খিঁচে রাখলো সে। হঠাৎ পরিচিত স্বর কর্ণগোচর হতেই চোখ খুললো রুদবা। তূর্য তার হাত ধরে তাকে মাটিতে পড়া থেকে বাঁচিয়েছে। তূর্য ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তুমি কবে আছাড় খাওয়া বন্ধ করবে, বলো তো!”
রুদবা তূর্যের স্পর্শে অন্য জগতে হারিয়ে গেছে। তূর্য তাকে সোজা দাঁড় করিয়ে তার মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলল, “কোথায় হারালে!”
রুদবা মাথা নেড়ে তূর্যের চোখে চোখ রাখলো। হঠাৎ তার চোখ আটকে গেল ছাদের এক কোণায়। সে ভ্রূ কুঁচকে বলল, “আপনার অফিস সহকারী এ বাসায় থাকে?”
উপমা ব্যস্ত হাতে তূর্যের কাপড় শুকাতে দিচ্ছে। রুদবা তার সামনে এসে দাঁড়াতেই থমকে গেল উপমা। তূর্য রুদবার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “ও পাশাপাশি আমাদের বাসার কাজ করে দেয়!”
রুদবা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “মানে! অফিস সহকারী বাসায় কেন কাজ করবে?”
“ওর মা আগে কাজ করতো। উনি অসুস্থ তাই তার মেয়েকে পাঠিয়েছে। বুয়ার মেয়ে অফিস সহকারী হওয়া অসম্ভব কিছু তো না। আবার ওর বাবা আমাদের গ্রামের জমিতে চাষার কাজ করতো!”
উপমা তূর্যের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এই মানুষটা বারবার তার বাবা-মার পরিচয় প্রকাশ করে কি তাকে ছোট করতে চায়? উপমা যদিও গর্বের সাথে তার বাবা-মার পরিচয় দেয়। কিন্তু তূর্যের কথায় যথেষ্ট তাচ্ছিল্য খুঁজে পায় সে।
হঠাৎ তূর্য রুদবাকে অবাক করে দিয়ে বলল, “আমি তোমাকে ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট পাঠিয়েছি। এক্সেপ্ট করো নি?”
রুদবা ভাষা হারিয়ে ফেললো যেন৷ সে দ্রুত ফোন ঘেঁটে বলল, “কোথায়!”
“পাঠালাম তো। দেখো নি?”
“পাচ্ছি না।”
হঠাৎ রুদবা কিছু একটা ভেবে বলল, “আমিই পাঠিয়েছিলাম আপনাকে। হয়তো আপনি এক্সেপ্ট করেছেন।”
এই বলে ফ্রেন্ড লিস্ট ঘেঁটে তূর্যকে না পেয়ে বলল, “কোথায় পাঠালেন? দেখছি না আপনাকে।”
রুদবা ব্যস্ত হাতে ফোন দেখছে। তূর্যের কান গরম হয়ে যাচ্ছে। সে কিছু বলতে যাবে, রুদবা বলল, “আপনি তো এখনো আমাকে ঝুলিয়ে রেখেছেন! মিথ্যে বললেন কেন? আপনি তো আমার রিকুয়েষ্ট এক্সেপ্ট করেন নি।”
তূর্য জোরপূর্বক হেসে বলল, “আরেহ কি যে বলো! হয়তো তোমার নাম দেখে অন্য কাউকে পাঠিয়ে দিয়েছি।”
“রুদবা আকন্দ নামেই আমার একাউন্ট।”
তূর্য দাঁতে দাঁত পিষে মনে মনে বলল, “মেয়েটা তো এই টপিক ছাড়ছেই না।”
রুদবার কৌতুহল দমাতে তূর্য তার হাত এগিয়ে দিয়ে বলল, “আমরা অনলাইন বন্ধু না হয়ে বরং অফলাইন বন্ধু হই। আজ থেকে আমরা ফ্রেন্ড। কেমন?”
রুদবার যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না তূর্যের এই পরিবর্তন। মানুষটা হঠাৎ তার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছে! রুদবা শক্ত করে ধরলো তূর্যের হাত। তার চোখ জোড়াও ছলছল করে উঠলো। এই জল আনন্দের। পছন্দের মানুষের মনোযোগ পাওয়ার আনন্দ।
উপমা তূর্যের দিকে একনজর তাকিয়ে ছাদ থেকে নেমে পড়লো। উপমা চলে যেতেই তূর্য রুদবার হাত ছেড়ে দিল। রুদবা বলল, “আজ যদি আপনার সময় হয় আমরা কী বাইরে কোথাও বসতে পারি?”
তূর্য রুদবার দিকে তাকালো না। বিরক্তমাখা কন্ঠে বলল, “আমার অনেক কাজ আছে।”
এই বলে নেমে পড়লো ছাদ থেকে৷ রুদবা তার শূন্য হাতের দিকে তাকিয়ে বলল, “হঠাৎ আবার বিরক্ত হয়ে গেল কেন? আমি কি একটু বেশি বলে ফেলেছি? থাক, আজ এইটুকুই অনেক আমার জন্য।”
রুদবা নিজের হাতে নিজেই চুমু খেল। এই হাতেই তো তূর্যের স্পর্শ লেগে আছে।
(***)
আর মাত্র দু’টি সনেট। শেষ দু’টি পাতা। দু’টি শেষ খাম। অরুণিকা আর নিয়ম মানলো না। পরপর দু’টি চিঠিই পড়লো। উভয় চিঠিতেই সেই পুরোনো বিচ্ছেদের গল্প। কখনো প্রেয়সী হারিয়ে যায়, কখনো প্রেমিক পুরুষ বিচ্ছেদের যন্ত্রণায় শেষ নিঃশ্বাস ছেড়ে চলে যায় পৃথিবীর মায়া ছেড়ে। শেষ দু’টি কবিতায়ও সেই একই বিচ্ছেদের সুর। সনেট দু’টির একটিতে লেখা ছিল,
“বইয়ের পাতায় জমে আছে তীব্র অভিমান,
তোমাকেই দিলাম সেই অভিমানী রস।
হৃদয় হারিয়েছে উতালপাতাল প্রাণ,
তবুও কেন মুছতে চাই হৃদয়ে নামা ধস?
বিরহ যদি এতোই কঠিন হয়
তবে হৃদয় কেন ছিল পাথর?
সেই কঠোরতায় তো ছিল প্রেমের ক্ষয়,
সেই ক্ষয়ে আবার কি করে মাখবো আদর?
তুমি নেই পাশে, নেই আমার নাম তোমার ঠোঁটে
নিঃশ্বাসের সাথে হয়তো বেরুচ্ছে অভিশাপ,
আমি বাঁচি বা মরি কিইবা তাতে ঘটে?
তোমার অবহেলায় গুনছি আমি মৃত্যু ধাপ।
মরে গেলে একবার শুনে যেও কথা,
তুমিহীনা আমি এক তীব্র ব্যথা।”
এবার হিমালয়ের শেষ কবিতার পাতা উল্টালো অরুণিকা।
“আমি হয়তো আবার ফিরবো
আমার আগমনে কাটবে রিক্ততা
তোমার মনে আবার ঘুরবো
ভালোবাসবো ঢেলে উষ্ণতা।
আমি হয়তো আবার গাইবো,
তুমি প্রিয়া হাসতে বাধ্য,
আমি এবার খুব ভালোবাসবো,
তুমিই যে সেই প্রিয় আরাধ্য।
আমি কিন্তু আবার হাসবো,
কাঁদাতে পারবে না কিন্তু এবার,
আমি তোমার সব কথা শুনবো,
সময় তো এখন ফিরিয়ে দেবার।
আমি তো ভালোবাসি, তুমি কি ভালোবেসে যাবে?
আমার শেষ কবিতায় প্রিয় হৃদিকে তুমি বারবার পাবে।”
অরুণিকা বই বন্ধ করলো। আজ শেষ হলো হিমালয়ের লেখা কবিতার বই। পুরো ঘর জুড়ে নীরবতা বিরাজ করছে। বুকটা কেমন ফাঁকা হয়ে গেছে। বইটি বুকে জড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ কাঁদলো অরুণিকা। কাঁপা কন্ঠে বলল, “আমি কেন তোমাকে মিস করছি, আ..”
অরুণিকা নিজের ঠোঁট চেপে ধরলো হাত দিয়ে৷ চোখ বন্ধ করলো সে। এই অনুভূতির কোনো ব্যাখ্যা নেই। এই অনুভূতি একান্ত তার।
প্রেম এক অদ্ভুত সুর। কখনো বাঁশির মতো বিরহের তান টেনে আনে, আবার কখনো পিয়ানোর তালে ভালোবাসার জগতে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। সেই সুর তবলার ছন্দে হৃদয় কাঁপায়, আবার কখনো বেহালার তারে মিশে সৃষ্টি করে দৃঢ়তার ধুন।
(***)
আকাশের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আহনাফ। চুল এলোমেলো। মুখ শুকিয়ে গেছে। হাতের মুঠোয় আবদ্ধ অরুণিকার পরা সেই শাড়ি। ডান হাতে শাড়িটা পেঁচিয়ে তিনটা মাস পার করেছে সে। প্রয়োজনে খুলে রাখলেও তিন মাসে একবারও সেই শাড়ি ধুতে দেয় নি আহনাফ। তবে সে এখন অনেকটাই সুস্থ। গত তিনমাসে নেশাদ্রব্য থেকে পুরোপুরি দূরে ছিল সে। নিজের মানসিক দৃঢ়তায় তাকে আবার ছ’বছর আগের সেই আহনাফে রূপান্তর করেছে। এতোদিন তার একটাই লক্ষ্য ছিল, তার অরুর কাছে সুস্থ হয়ে ফেরা। তবে তার মনে এখনো সেই ভয় দানা বেঁধে আছে। তার অরু কি তাকে মনে রেখেছে? তাকে আবার ভালোবাসতে পেরেছে? সপ্তাহে একটা দিন কি অন্তত আহনাফের কথা মনে পড়ে নি অরুণিকার?
আহনাফ সেই শাড়িতে নাক ডুবিয়ে বলল, “আমি এই তিন মাসে বুঝে গেছি, এই জন্মে তুই আমার না হলেও, এই মনে তুই ছাড়া আর কারো জায়গা হবে না।”
(***)
কয়েকদিনে তূর্য আর রুদবার মধ্যে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে। দু’জন প্রায়ই ছাদে উঠে হাসাহাসি করে৷ তূর্য অফিসেও মাঝে মাঝে ডেকে আনে রুদবাকে৷ তারা একসাথেই দুপুরের খাবার খায়৷ রুদবা ইদানিং ক্যাম্পাসে যায় না বললেই চলে। তার মনোযোগ তূর্যতেই আটকে আছে। আজ কোম্পানির কাজে আবার উপমাকে নিয়ে বেরুতে হবে তূর্যের। তারা নিচে নামতেই রুদবা এসে হাজির৷ উপমা বেশ অবাক হলো তাকে দেখে। রুদবা উৎসাহিত কন্ঠে বলল, “তুমি ফোন করেছো, তাই ক্লাস ফেলে চলে এসেছি।”
তূর্য হাসলো। উপমাকে রিকশা ঠিক করে দিয়ে রুদবাকে তার মোটর সাইকেলের পেছনে বসতে বললো। এই কয়েক দিনেই আপনি থেকে তুমিতে সম্বোধন বদলি হয়েছে। এতো অল্প সময়ের ব্যবধানে প্রেম হয় না৷ রুদবার সাথে তূর্য একপ্রকার প্রতারণায় করছে। উপমার হৃদয় দহনের আনন্দ উপভোগের নেশায় অন্য একটি হৃদয়ে প্রেমের আশা দিয়ে যাচ্ছে।
একটি শপিংমলের সামনে রিকশা থামলো উপমার। তূর্য রুদবাকে নিয়ে আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত ছিল৷ উপমা রিকশা থেকে নামতে নামতেই খেয়াল করলো তূর্য রুদবার কপালের চুল ঠিক করে দিচ্ছে। মনে মনে কষ্ট পেলেও তূর্যের জন্য ভালোই লাগছে তার। রুদবা মেয়েটা বেশ যত্ন নেই তার প্রিয় মানুষটির। এমনই এক যত্নশীল মেয়ে তূর্যের জন্য উপযুক্ত।
তারা শপিংয়ে কিছু ফেব্রিকস কিনতে এসেছে। উপমা ভালোভাবে ঘেঁটে ঘেঁটে সব উপকরণ দেখছে। এদিকে তূর্যের হাত জড়িয়ে বকবক করে যাচ্ছে রুদবা। হঠাৎ রুদবা থেমে গেল। রুদবাকে চুপ হয়ে যেতে দেখে তূর্য তার দিকে তাকালো। দেখলো রুদবা সামনে তাকিয়ে আছে। রুদবার দৃষ্টি অনুসরণ করে তূর্যও সামনে তাকালো। দেখলো অরুণিকা দাঁড়িয়ে আছে। তূর্য রুদবার হাত ছাড়িয়ে নিলো। রুদবা ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইল তূর্যের দিকে৷ অরুণিকা রুদবা আর তূর্যের দিকে একবার তাকালো, আরেকবার উপমার দিকে। উপমা বেশ মনোযোগ দিয়ে কাপড় দেখছে। অরুণিকা বলল, “রুদবা, তুই এখানে?”
রুদবা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তোর কোনো সমস্যা?”
তূর্য রুদবাকে তাগাদা দিয়ে বলল, “আচ্ছা, চলো তোমাকে বাসায় নামিয়ে দেই।”
এই বলে রুদবাকে টেনে নিয়ে গেল তূর্য৷ যেতে যেতে উপমাকে বলল, “কাপড় সিলেক্ট করে ম্যানেজারকে ফোন দিও। আমাকে কল দিয়ে বিরক্ত করবে না।”
তূর্য চলে যেতেই অরুণিকা উপমার কাছে এসে বলল, “আপু তুমি চুপ করে আছো?”
উপমা অবাক হয়ে অরুণিকার দিকে তাকালো। অরুণিকা আবার বলল, “তুমি তূর্যকে কিছু বলছো না কেন?”
“আমি কি বলবো?”
“ও রুদবার সাথে এমন ঘুরাঘুরি কেন করছে?”
“প্রেমিকার সাথে তো ঘুরাঘুরিই করবে, তাই না?”
“তোমাকে কে বলেছে এসব?”
“আমার চোখের সামনে তো হচ্ছে।”
“তূর্য রুদবাকে ভালোবাসে না। এই কিছু সপ্তাহ আগেও তূর্য রুদবাকে পাত্তা দিতো না। তাহলে এখন এসব কেন করছে?”
“কেন?”
“তোমাকে দেখানোর জন্য। আর এসবে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাবে রুদবা। মেয়েটার কথা চিন্তা করা উচিত তূর্যের।”
“তবে মেয়েটা উনার জন্য ভালোই হবে।”
“তুমি কি বলছো এসব? তুমি তূর্যকে ভালোবাসো না?”
উপমা কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলো না৷ তার গলায় কথা আটকে গেছে। তার সাহস নেই ভালোবাসার কথা বলার। সে তো ঠকিয়েছে তূর্যকে। তূর্য সামনে অনেক ভালো জীবন পাবে। আর উপমা সেই জীবনে বাঁধা হয়ে আসতে চায় না। সে দৃঢ় কন্ঠে অরুণিকাকে বলল, “আমি ভালোবাসি না।”
চলবে-