উইন্টার এন্ড মাই সনেট পর্ব-৫৩ এবং বোনাস ১+২

0
1

#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব- ৫৩ ||

ছাদে উঠেই থমকে দাঁড়ালো অরুণিকা। তূর্য রুদবার গা ঘেঁষে ছাদের রেলিঙে হেলান দিয়ে হাসাহাসি করছে। পাশে উপমা কাপড় শুকাতে দিচ্ছে। পুরো ছাদ ভর্তি তূর্যের শার্ট, প্যান্ট, জিন্স, পাঞ্জাবি। অরুণিকা উপমার কাছে এসে ডাকলো, “আপু!”

উপমা সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। এতোগুলো কাপড় ধুয়ে কোমড় ধরে গেছে তার। তবুও চোখ-মুখ কুঁচকে কাপড় ঝেড়ে ঝেড়ে শুকাতে দিচ্ছে। অরুণিকা তূর্যের সামনে এসে দাঁড়াতেই রুদবা ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। অরুণিকা তূর্যের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “তোমার আর আহনাফের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। দু’জনই এক।”

তূর্য মুখ ঘুরিয়ে বলল, “আহু আর আমার মধ্যে কোনো মিল নেই। কারণ দু’জনের ভালোবাসার মানুষ আলাদা। একজনের ভালোবাসার মানুষ তাকে অন্তত কখনো ভালোবেসেছিল, আর আরেকজনেরটা তো ঠকিয়েছে।”

শেষ বাক্যটি উপমার দিকে তাকিয়ে বলল তূর্য। অরুণিকাও তূর্যের চোখ অনুসরণ করে উপমার দিকে তাকালো। উপমার চোখে অপরাধবোধ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। রুদবা তাদের নীরব চাওয়া-চাওয়ি বুঝতে না পেরে বলল, “অরু, তোর সমস্যাটা কি!”

অরুণিকা বুকে হাত গুঁজে বলল, “সমস্যা আমার না। সমস্যা তোর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটির।”

তূর্য ভ্রূ কুঁচকে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে বলল, “প্লিজ, টুইংকেল।”

অরুণিকা আঙুল তাক করে বলল, “তোমার স্বার্থের জন্য তুমি অন্য একটা মেয়ের অনুভূতি নিয়ে ঠাট্টা করবে?”

রুদবা চেঁচিয়ে বলল, “জাস্ট শাট আপ।”

“ইউ শাট আপ। আমি যেই ভুল করেছি, তুই একই ভুল করবি? এই লোকটা তোকে ভালোবাসে না, রুদবা।”

তূর্য মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, আমি ভালোবাসি না রুদবাকে। কিন্তু আমরা ভালো বন্ধু। আমার ওর সাথে সময় কাটাতে ভালো লাগে। রুদবা আমার কাছে অনেক স্পেশাল।”

রুদবা অরুণিকার হাত চেপে ধরে বলল, “তুই তোর সমস্যাটা আজ তূর্যের সামনেই আমাকে জানিয়ে দে, প্লিজ।”

অরুণিকা অসহায় দৃষ্টিতে রুদবার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই অনেক ভালো মেয়ে। আমি চাই না, আমি যেই আঘাত পেয়েছি তুই ঠিক একই আঘাত পাস। প্লিজ, তূর্যকে বিশ্বাস করিস না।”

তূর্য ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “টুইংকেল!”

অরুণিকা চেঁচিয়ে বলল, “প্লিজ, চুপ থাকো তুমি। একটা মেয়েকে ঠকিয়ে আবার আমার বেস্ট ফ্রেন্ডকে ধরেছো? তুমি আমাকে টুইংকেল বলো কোন সাহসে?”

রুদবা অরুণিকাকে জোরে ধাক্কা দিতেই সে টাল সামলাতে না পেরে পেছনে হোঁচট খেয়ে পড়তে যাবে, উপমা তাকে শক্ত করে ধরে বলল, “তুমি কী করছো?”

রুদবা চেঁচিয়ে বলল, “তুমি চুপ করো। বুয়া বুয়ার মতো থাকো।”

তূর্য দাঁতে দাঁত পিষে রুদবার দিকে তাকালো। রুদবা এবার অরুণিকাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আমি তোর বেস্ট ফ্রেন্ড না। ইনফ্যাক্ট তোর মতো ক্যারেক্টরলেস মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব করাই আমার ভুল সিদ্ধান্ত ছিল।”

তূর্য চেঁচিয়ে বলল, “ব্যস, বেশি কথা বলবে না তুমি।”

রুদবা অবাক হয়ে তূর্যের দিকে তাকালো। তূর্য রুদবার দিকে আঙুল তাক করে বলল, “যাকে যা ইচ্ছে বলো, অরুণিকার ব্যাপারে একটা বাজে কথা শুনলে কিন্তু ভালো হবে না।”

তূর্য এই বলে হনহনিয়ে চলে গেল। রুদবা ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “তুই আমাকে হাসতে দিবি না, অরু?”

অরুণিকা রুদবার হাত ধরে বলল, “আমাকে বিশ্বাস কর।”

রুদবা অরুণিকার হাত এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে বলল, “যেই মানুষটা তোর বিরুদ্ধে একটা কথা শুনতে চায় না, তুই তাকে নিয়ে যাচ্ছেতাই বলছিস?”

“কারণ আমি আর বাকিরা এক না। আমি এখানে তোর কথা বলছি। পরে কিন্তু কাঁদবি, তখন আর কাছে পাবি না কাউকে।”

“আমি তূর্যকে বিশ্বাস করি। বিকজ আই লাভ হিম।”

রুদবা অরুণিকাকে পাশ কেটে চলে গেল। অরুণিকা স্থির দৃষ্টিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। উপমা তার কাঁধে হাত রেখে বলল, “কেন ওদের এক হতে দিচ্ছো না?”

অরুণিকা চেঁচিয়ে বলল, “তুমি চুপ করো। তুমি গিয়ে তোমার প্রেমিককে আটকাও। ও তোমাকে জ্বালানোর জন্য এমন করছে। তুমি আসার আগে রুদবাকে যতোটুকু সম্ভব এড়িয়ে চলতো তূর্য। উপমা আপু, কি করেছো তুমি তূর্যের সাথে? মানুষটাকে পশু বানিয়ে দিয়েছো তুমি। ও তো আগে এমন ছিল না। তুমি কী এমন করেছো, যার দরুন ও এমন করছে, বলো?”

উপমা ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “আমি তোমার রকস্টারকে ঠকিয়েছি, অরু। ওর সাথে সম্পর্ক থাকার পরও আমি অন্য একজনের সাথে সম্পর্ক রেখেছিলাম। আমি ভালো মেয়ে না। তূর্য সব জেনে যাওয়ার পর আমাকে ছেড়ে দিয়েছিল।”

অরুণিকা অবাক দৃষ্টিতে উপমার দিকে তাকিয়ে রইল। উপমা চোখের জল মুছে অন্য দিকে ফিরলো। অরুণিকা ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “এতো সহজে বলে দিলে? তোমাকে দেখে এমন মনে হয় না আমার। তুমি কি মিথ্যে বলছো?”

“যদি সেই ভুলটা না করতাম, আজ তূর্যের মতো এতো চমৎকার একটা মানুষকে হারিয়ে ফেলতাম না। আমার ভুলের কোনো ক্ষমা নেই।”

“তাহলে তুমি গ্রামের মানুষদের কেন বলেছিলে তুমি প্রেগন্যান্ট, তোমার আর তূর্যের বিয়ে হয়েছে?”

উপমা ক্ষীণ হেসে বলল, “লোভী ছিলাম আমি। ভেবেছিলাম তূর্যের নাম নিলে গ্রামের লোকেরা আমাদের বিয়ে দিয়ে দেবে, যেমন তোমার আর আহনাফ ভাইয়ের বিয়ে দিয়েছিল। বিয়ের প্রমাণ কি আর দেখাতে পেরেছি, বলো? মিথ্যে ছিল, তাই তো প্রমাণ ছিল না।”

অরুণিকা উপমার হাত ধরে বলল, “তুমি সত্য বলছো?”

“হ্যাঁ।”

“কেন করলে এমন? আমরা সবাই ভাবতাম তূর্য তোমাকে অস্বীকার করে তোমাকে ঠকিয়েছে। কিন্তু তুমিই ওকে ঠকালে!”

উপমার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। অরুণিকা তাকে পাশ কেটে চলে যেতেই সে মেঝেতে বসে পড়লো। শব্দ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমি তোমাকে কিভাবে সত্যটা জানাবো, তূর্য! তুমি সত্যটা জানলে সবার বিরুদ্ধে গিয়ে আবার আমার হাত ধরতে চাইবে। কিন্তু আমি চাই না, তুমি আমার সাথে ঘর বাঁধো। আমার সাথে ঘর বাঁধলে, রোজ তোমার সেই ভয়ংকর দৃশ্যটি মনে পড়বে। তুমি আর সুখী হয়েও সুখী হতে পারবে না। ভালো তো আবার বাসা যায়। তুমিও ঠিক কাউকে না কাউকে আবার ভালোবাসতে পারবে। তখন আমার নোংরা অস্তিত্ব তোমাকে স্পর্শ করবে না। শুধু আমার মেয়েটার জন্যই কষ্ট হয়। ওকে যদি ওর বাবার সাথে দেখা করিয়ে দিতে পারতাম! কিন্তু মেয়েটাও তোমার নতুন জীবনের অভিশাপ। নিজেদের ভালোর জন্য এতোটা স্বার্থপর হতে পারি না আমি।”

(***)

অরুণিকা অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে জানালার পাশে। হঠাৎ রুহানি লাফিয়ে লাফিয়ে রুমে ঢুকে অরুণিকার পাশে বসে বলল, “তোকে একটা জরুরি কথা বলবো।”

রুহানির চোখে-মুখে লাজুক হাসি। অরুণিকা ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “বল না।”

“আমার তোর ভাইকে ভালো লাগে।”

অরুণিকা চমকে উঠলো। রুহানি লাজুক হেসে বলল, “আরাফ স্যারকে ভালো লাগে আমার।”

অরুণিকা রুহানির দিকে তাকিয়ে রইল এক দৃষ্টিতে। রুহানি অরুণিকার হাত ধরে বলল, “তোর ভাই কাউকে পছন্দ করে?”

“না। আমার জানামতে কেউ নেই।”

“তুই পারবি আমাদের মধ্যে সব ঠিক করে দিতে?”

অরুণিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুহানির হাত আলতোভাবে ধরে বলল, “তুই সুখে থাক, বোন। আমার মতো, রুদবার মতো ভাগ্য না হোক তোর। আল্লাহ, তোর সব ইচ্ছে পূরণ করুক। আরাফ মানুষটা তোর জন্য সবসময় ভালো মানুষ হয়ে থাকুক।”

“এভাবে বলছিস কেন? রুদবার কি হয়েছে!”

“বাদ দে। আমি আরাফের সাথে কথা বলবো। ওকে?”

“ওকে। ওয়েট, ওয়েট, আমি পছন্দ করি, সেটা বলিস না। ওভাবে বললে আমি উনার সামনে যেতেই পারবো না। সব তুই নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে করবি। আমার কথা বলবি না কিন্তু।”

“আচ্ছা!”

রুহানি জড়িয়ে ধরলো অরুণিকাকে। অরুণিকা চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলল, “ভালোবাসা শব্দটা শুনলেই অনেক ভয় হয় এখন। রুহু কষ্ট না পাক। মেয়েটা ইম্যাচিউর। বুদ্ধিশুদ্ধি কম। ও যদি আমাদের মতো ঠকে, সহ্য করতে পারবে না। আহনাফ আমাকে যেই আঘাত করেছে, আমি জানি কতোটা ভয়ংকর সেই ক্ষতের যন্ত্রণা। এই যন্ত্রণা সহ্য করার ক্ষমতা রুহানির নেই। ওর জন্য যে উপযুক্ত সেই যাতে ওর জীবনে আসে।”

(***)

“মিশন, আহনাফ রিহ্যাব থেকে ফেরার আগেই ওই শিরিন সুলতানাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে আমার দাদার বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া।”

আরাফ এই কথা বলতেই তার সাথে হাত মেলালো তাহমিদ, ইমন, ইভান আর তূর্য।

ইমন মিস্টার আজিজের কাছ থেকে সব সত্য জানার পর আরাফদের জানাতেই গত এক সপ্তাহ ধরে আরাফ, তাহমিদ আর ইভান সেই হাসপাতালে গিয়ে আবরারের জন্মের সব তথ্য বের করার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। আর আজ তাদের হাতে আবরারের সব তথ্য এসে গেছে। ডিএনএ রিপোর্টে স্পষ্ট লেখা, এই সন্তান আমির চৌধুরীর নয়। এদিকে তূর্য আর ইমন মিস্টার আজিজের বন্ধু রিয়াজুর রহমানের সাথে দেখা করলো। তিনিও সদিচ্ছায় তার গুগল ড্রাইভে সংরক্ষিত ছবি আর ভিডিওতে তূর্য আর ইমনকে এক্সেস দিয়ে দিলেন। ইমন রিয়াজুর রহমানকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “থ্যাংক ইউ, স্যার। অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, এমন জঘন্য মহিলা থেকে আমার বন্ধু আর তার পরিবারকে বাঁচানোর জন্য আমাদের সাথে এইটুকু কো-অপারেট করার জন্য।”

রিয়াজুর রহমান তূর্য আর ইমনের সাথে হাত মিলিয়ে বললেন, “আশা করবো, তোমাদের বন্ধু এই কষ্ট কাটিয়ে উঠুক। নিজের মায়ের বিরুদ্ধে এমন কথা কে সহ্য করবে, বলো? জগতের সকল নারী মিথ্যে হয়ে যায়, যদি নিজের মা মিথ্যে প্রমাণিত হয়। তোমার বন্ধুকে আল্লাহ শক্তি দিক।”

তারা পাঁচজন শক্ত প্রমাণ হাতে সন্ধ্যায় চৌধুরী ম্যানশন পৌঁছালো। পুরো পরিবারের সাথে এবার যুক্ত হয়েছে তূর্য আর ইভানদের পরিবার। সকলের সামনে সত্য উন্মোচিত হতেই শিরিন সুলতানা কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেললেন। ডিএনএ রিপোর্ট না হয় জাল বানিয়েছে বলা যায়, কিন্তু ছবি, ভিডিও, কল রেকর্ড, চ্যাট লিস্ট সব কীভাবে মিথ্যে হবে?

পুরো হলরুমে নীরবতা বিরাজ করছে। চৌধুরী সাহেব শীতল কন্ঠে বললেন, “সবাই যার যার বাসায় চলে যাও। আমির তার স্ত্রীকে দেনমোহর শোধ করে দিয়েছে। আমি লয়ারের সাথে কথা বলছি। এই তালাক হতেই হবে। সম্পর্ক ভাঙা শয়তানের কাজ। কিন্তু স্বয়ং শয়তান যদি জীবন সঙ্গী হিসেবে ঘরে উঠে, ওই ঘরে ফেরেশতা আসে না। এমন সম্পর্ক ভাঙা উত্তম কাজ। এমনিতেই ছেলেকে মাদকাসক্ত বানিয়ে ঘরের শান্তি ধ্বংস করেছে এই মেয়ে। এই মেয়ের জন্য আমাদের ঘরে আল্লাহর রহমত নেই। অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি। প্রেমের বিয়ে শয়তানের কাজ ভেবে, আমি কখনো নীহারিকাকে জুবায়েরের স্ত্রী হিসেবে মন থেকে মেনে নিতে পারি নি। কিন্তু আমি নিজের পছন্দে আমার ছেলের জন্য এ কেমন জালিম পছন্দ করলাম! আল্লাহ আমাকে মাফ করবেন না। আমি একজন ব্যর্থ বাবা। আমি নিজের ছেলেকে ভালো জীবনসঙ্গী খুঁজে দিতে ব্যর্থ হয়েছি।”

মিসেস চৌধুরী স্বামীর হাত ধরে বললেন, “এভাবে বলবেন না। আপনার তো আমাদের ছেলের, আমাদের নাতির মানসিক শক্তি হয়ে পাশে থাকতে হবে। এখানে আপনার হাত নেই। ভাগ্যের লেখা খণ্ডানো যায় না।”

এবার আমির চৌধুরী শিরিন সুলতানার সামনে এসে বললেন, “কেন করলে আমাদের সাথে এমন? কি অপরাধ ছিল আমার আমার আহনাফের, আর সেই ছোট্ট বাচ্চাটার? আবরার আমার সন্তান না। তবুও সব জানলে আমি মেনে নিতাম। তুমি কেন এই পাপ করতে গেলে?”

শিরিন সুলতানা ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “পাপ! এই পাপ করে আমার জীবন তো ধ্বংস হয়ে গেছে। আমি আমার আবরারকে খুন করেছি নিজ হাতে। আজ সবাই জেনে গেছে আমি কেন আমার ছেলেকে মেরে ফেলেছি। অথচ যেই সত্য গোপন রাখার জন্য আমি একটা প্রাণ নিয়ে নিলাম, সেই সত্য আজ সবার সামনে চলে এসেছে। তাও এই ছেলেগুলোর জন্য!”

শিরিন সুলতানা কঠিন দৃষ্টিতে আরাফদের দিকে তাকালেন৷ তিনি এবার আমির চৌধুরীর পায়ের কাছে বসে বললেন, “হ্যাঁ, আমি পাপী। আমার লোভ জন্মেছিল। প্রচন্ড লোভে আমি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আমি রিয়াজকে ভালোবাসতাম, তবুও ওকে বিয়ে করি নি, কারণ ওর কাছে তখন টাকা ছিল না। আমার শখ শুধুমাত্র তোমার পক্ষেই পূরণ করা সম্ভব, আমির। তাই আমি তোমার সংসার ছাড়তে চাই নি। কিন্তু রিয়াজকে ভালোবাসতাম আমি। আবরার আমাদের ভালোবাসার চিহ্ন ছিল। কিন্তু সব তোমার জন্য হয়েছে। তুমি আবরারকে সুস্থ করার জন্য ওর টেস্ট না করালে আজ আমার ছেলে বেঁচে থাকতো। ওর টেস্ট করিয়েছো, তাই ওর ডিএনএ রিপোর্ট এসেছিল। তুমি সেই রিপোর্ট দেখে ফেললে সব শেষ হয়ে যেতো। তোমার হসপিটাল তাই আমার রিপোর্ট চেঞ্জ করার সাহস ছিল না। তাই তুমি রিপোর্ট দেখার আগেই আমি আবরারকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেই। না ও বেঁচে থাকবে, না কখনো আমার সত্য সবার সামনে আসবে। এজন্য আমি প্ল্যান করি। সিসি ক্যামেরা নষ্ট করে দেই। সুযোগ বুঝে আবরারকে ছাদে নিয়ে যাই। ভেবেছি, ও পড়ে গেলে সবাই ভাববে খেলতে গিয়ে পড়ে গেছে। দোষ হবে দারোয়ানের, কারণ ও গেট খোলা রেখেছিল। কিন্তু অরুণিকা আমাকে দেখে ফেলল। আমি চাইতাম না ওই মেয়ে আমার ছেলের বউ হয়ে থাকুক। আর আবরারের মৃত্যুতে ওকে ফাঁসাতে পারলে, আরো সহজে আমি ওকে আমার আহনাফের জীবন থেকে সরাতে পারবো। তাই হয়েছে। আজ অরুণিকা আহনাফকে দু’চোখে সহ্য করতে পারে না।”

আমির চৌধুরী সামনে তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো, “আহনাফ!”

আমির চৌধুরীর দৃষ্টি অনুসরণ করে সবাই হলরুমের দরজার দিকে তাকালো। আহনাফকে দেখে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেছে। তূর্য ভ্রূ কুঁচকে আরাফকে বলল, “আহুর তো আজ ফেরার কথা ছিল না।”

আরাফ আমির চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলল, “চাচু, আপনি জানতেন আজ আহনাফ আসবে?”

আমির চৌধুরী মলিন মুখে বললেন, “আমি জানতাম না তোমরা আমাদের কেন জড়ো করিয়েছো। আগে জানলে আহনাফকে আজ রিলিজ দিতে মানা করতাম।”

আরাফ কপাল চেপে ধরে মুখ ঘুরিয়ে নিল। তূর্য আর ইভান আহনাফের কাছে আসতেই, সে হাতের ইশারায় তাদের থামিয়ে দিল।

আজই আহনাফের রিহ্যাবে শেষ দিন ছিল। আমির চৌধুরীর তাকে আনার কথা। কিন্তু বাবাকে না দেখে সে নিজেই চলে এসেছে চৌধুরী ম্যানশনে। এসেই দেখল বাসা খালি। কাজের মেয়ে জানালো সবাই হলরুমে জমায়েত হয়েছে। আহনাফ ব্যাগ রেখেই সোজা চলে গেল হলরুমে। হলরুমটি ভবনের ছাদের সাথে লাগোয়া। এমন জায়গায় জড়ো হওয়ার নিশ্চয় বিশেষ কোনো কারণ আছে। তাই আহনাফ নিঃশব্দে ছাদে উঠে হলরুমের দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো। ভেতরে দাদার আক্ষেপ শুনে সে মোটামুটি আন্দাজ করে ফেলেছে, সমস্যা তার মাকে নিয়েই হয়েছে। তাই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। টিভির স্ক্রিনে চোখ পড়তেই স্তব্ধ হয়ে গেল আহনাফ। তূর্যের ফোনের সাথে সংযুক্ত সেই মনিটরে শিরিন সুলতানা ও তার প্রাক্তনের ঘনিষ্ঠ ছবি দৃশ্যমান। যদিও আহনাফকে কেউ খেয়াল করে নি। সবার মনোযোগ সেই মুহূর্তে শিরিন সুলতানার স্বীকারোক্তিতে। আহনাফও সবটা শুনলো। সব শুনে ভেতরটা যেন ফাঁকা হয়ে গেল তার। যে ভাইকে নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসতো, সেই ভাই তো তার আপন ভাই না। যেই মাকে সে এতো ভালোবাসতো, সেই মা তো তাকে ঠকিয়েছে। একে একে সবাইকে ঠকিয়েছে। সে তো মা না। সে তো মা হতে চায় নি। তার প্রয়োজন ছিল টাকা। আর টাকার জন্যই সে সংসার শুরু করেছে, সন্তান ধারণ করেছে।

আহনাফ শিরিন সুলতানার সামনে এসে দাঁড়ালো। শিরিন সুলতানা চোখ নামিয়ে নিলেন। আহনাফ ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “আমি তোমার কাছে ইনভেস্টমেন্ট ছিলাম? তুমি তো ভালোবেসে আমাকে পৃথিবীতে আনো নি। টাকার মায়া ধরে রাখতে আমাকে জন্ম দিয়েছো। এই মুহূর্তে আমার জীবনের প্রতি আমারই ঘৃণা জন্মে যাচ্ছে। আমি দশটা মানুষকে মুখ দেখাবো কীভাবে? বাবার সাথে তোমার না হয় আইনী সম্পর্ক। চাইলেই শেষ হয়ে যাবে। আমি নিজের অস্তিত্ব থেকে তোমাকে কীভাবে দূর করবো? মানুষ আমাকে দেখলে ছি ছি করবে। বলবে, আমি এক জঘন্য নারীর সন্তান। তুমি আমাকে ড্রাগস দিয়েছো, ফাইন। আবরারকে মেরে ফেলেছো, গুড। অরুকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছো, ফ্যান্টাসটিক। তাই বলে বিয়ের পরও এমন নোংরা কাজ করলে? তুমি আমার ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিয়েছো। আমার রক্তে তো দাগ লাগিয়ে দিয়েছো। ট্রাস্ট মি, আমার যদি একটা ক্রাইম মাফ হতো, আমি তোমাকে খুন করতাম, আর পৃথিবী থেকে তোমাকে মিটিয়ে দিয়ে গর্বের সাথে বলতাম, আমার কোনো মা নেই।”

আরাফ আহনাফের হাত ধরে তাকে একপাশে টেনে এনে বলল, “উনার সাথে কথা বলিস না। উনার সেই যোগ্যতায় নেই। তুই আমার ভাই। তুই চৌধুরী বাড়ির ছেলে। তোর পরিচয় এটা। তুই কোনো আপসোস করিস না।”

(***)

হলরুম থেকে একে একে সবাই বেরিয়ে যার যার ফ্ল্যাটে চলে গেল। আমির চৌধুরী শিরিন সুলতানার সব প্রয়োজনীয় জিনিস কাজের মেয়ের দিয়ে ঘর থেকে বের করে ফেলেছেন। দারোয়ানকে কড়াভাবে বলে দিয়েছেন, শিরিন সুলতানাকে যাতে আর গেট দিয়ে ঢুকতে না দেয়।

এই মুহূর্তে শিরিন সুলতানা গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে পুরো চৌধুরী ম্যানশনে চোখ বুলিয়ে নিলেন। আর মনে মনে বললেন, “আমি সব হারালাম। কিন্তু মিস্টার আমির চৌধুরী, তোমাকে আমি শান্তি পেতে দেবো না। তোমার একমাত্র ছেলের জীবন আমি কীভাবে ধ্বংস করি, তুমি শুধু সেটা দেখো। আর আহনাফ! তোর জীবন থেকে এমন ভাবে আমি তোর ভালোবাসা কেঁড়ে নেবো, চাইলেও ওকে আর কখনো পাবি না। এই তিনমাসে আমার ডিভোর্স হওয়ার আগেই তোর ডিভোর্সের গুঞ্জন শুরু হবে এই চৌধুরী ম্যানশনে। এমনভাবে ফাঁসাবো তোকে, তুই বাধ্য হবি তোর ভালোবাসার মানুষকে ছাড়তে। এরপরই আমি শান্ত হবো।”

(***)

বসন্ত আগমনের প্রস্তুতি নিচ্ছে প্রকৃতি। মধ্যাহ্নে বেলায় স্নিগ্ধ রোদ উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। মিষ্টি বায়ু ছড়িয়ে পড়েছে ধরায়। রুহানি গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে বুকে হাত গুঁজে। এলাকার কিশোরের দল সাইকেল প্রতিযোগিতা করছে। রুহানি তাদের মধ্যে টলু নামক এক ছেলের কাছে এসে অনুরোধের সুরে বলল, “ছোট ভাই, তোমার সাইকেলটা আমাকে চালাতে দেবে?”

টলু চোখ-মুখ কুঁচকে বলল, “দশ মিনিট একশো টাকা। এক ঘন্টা এক হাজার।”

রুহানি কোমড়ে হাত রেখে শাসনের সুরে বলল, “বড় আপুর সাথে বিজনেস? এতো টাকা দাম রাখলে কেউ আসবে না তোর কাছে। একটু ডিসকাউন্ট দে।”

“তুমি বলো!”

“আধা ঘন্টা পঞ্চাশ টাকা।”

“পঞ্চাশ মানি না। কোনো লাভ নাই। পুরোটাই লস।”

রুহানি টলুর মাথায় গাট্টা মেরে বলল, “আগে শুন। সাথে পাবি বিরিয়ানির দাওয়াত। কাল মা, বিরিয়ানি রান্না করবে। আমি তোর জন্য এক বক্স পাঠাবো। গরুর মাংস দেবো ঠাসা ঠাসা। ওকে?”

“আচ্ছা!”

রুহানি টলুর গাল টেনে দিয়ে বলল, “লক্ষী বাচ্চা। এখন সর।”

এই বলে টলুকে সরিয়ে সাইকেলে উঠে বসলো রুহানি। টলু বলল, “তুমি চালাতে পারো তো?”

রুহানি চোখের ইশারায় বোঝালো, তার অনেক দিনের অভিজ্ঞতা। রুহানি সাইকেলে উঠে বসে কোনোভাবে ভারসাম্য রাখতে পারছে না। টলু বলল, “খাইছে রে! তুমি তো সাইকেল উঠাইতেই পারো না। চালাবে কোন অভিজ্ঞতায়?”

“তুই উইমেন পাওয়ার সম্পর্কে কিছু জানিস?”

“না!”

“ওই পাওয়ারে চালাবো। দেখ তুই।”

এই বলে সাইকেলে উঠে চালানো শুরু করলো রুহানি। ঢালু থেকে চালিয়ে নিচে নামতে লাগলো সে। হঠাৎ সে খেয়াল করলো সাইকেল থামাতে পারছে না সে। টলু অনেক লম্বা হওয়ায় সাইকেলের সিট অনেকটা উপরে তুলে দিয়েছিল। রুহানি সেই সিট নামাতে ভুলে গেছে। এখন রাস্তা অব্ধি তার পা পৌঁছাচ্ছে না। টলু গালে হাত দিয়ে বলল, “হায় হায়! খাইছে আমার সাইকেল। সিট নামালাম কোন দুঃখে!”

টলুর বন্ধু তার কাঁধে হাত রেখে বলল, “ক’মিনিট পর তোর সাইকেলের জানাজা, আমাকে বলিস। চলে আসবো শোক সমারোহে। এরপর আমিও খাবো বিরিয়ানি।”

“আব্বা আমাকে সোজা উপরে পাঠায় দেবে।”

এদিকে রুহানি পা দু’টি সামনে উঠিয়ে রেখেছে। সাইকেলের ভারসাম্য ধরে রাখার জন্য সামনে তাকিয়ে দুই পাশের হাতল ধরে রেখেছে সে। হঠাৎ দেখলো সামনে আরাফ হাঁটছে। রুহানি চেঁচিয়ে বলল, “স্যার, সরেন।”

তূর্য, ইভান আর আরাফ এলাকার দোকান থেকে চা খেয়ে সবেমাত্র বেরিয়েছে। আরাফ রুহানির কন্ঠ শুনে পিছু ফিরতেই দেখলো রুহানি সাইকেল নিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে। রুহানি চোখ বন্ধ করে রেখেছে। আরাফ সাইকেলের সামনে এসে দুই হাতলের ব্রেকে চাপ দিয়ে শক্ত করে সাইকেলটি ধরে ফেললো। ব্রেক করতেই রুহানি সামনে ঝুঁকে পড়তেই আরাফের কপালের সাথে তার কপালে এসে ঠেকলো। রুহানি চোখ বুজে রেখেছে। সে বুঝতে পারলো, সাইকেল থেমে গেছে। ধীরে ধীরে চোখ খুললো সে। আরাফের কপাল এখনো তার কপালে ঠেকানো। দু’জনের চোখাচোখি হলো। রুহানি চোখ সরিয়ে হাতলের দিকে তাকালো। আরাফের দুই হাত তার দুই হাতের উপর। শক্ত করে ধরে রেখেছে সে রুহানির হাত। এলাকার কিশোরের দল ভীড় করে এই দৃশ্য দেখছে। তূর্য ছেলেগুলোকে ধাওয়া দিতেই তারা হৈহৈ করতে করতে চলে গেল। আরাফ সোজা হয়ে দাঁড়ালো। রুহানি এখনো আরাফের দিকে তাকিয়ে আছে। আরাফ হাতল ধরে এপাশ-ওপাশ ঘোরাতেই রুহানি চেঁচিয়ে বলল, “স্যার, আমি পড়ে যাবো তো।”

আরাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তো নামো!”

রুহানি নামতে গিয়ে সাইকেলসহ কাত হয়ে গেল। আরাফ সঙ্গে সঙ্গে রুহানির কোমড় জড়িয়ে ধরে বলল, “তুমি আসলে কি!”

রুহানি ঠোঁট প্রসারিত করে বলল, “রুহানি।”

আরাফ টেনে নামালো তাকে। এদিকে টলু তূর্যের দিকে আঁড়চোখে তাকাতে তাকাতে পা বাড়ালো। তূর্য ভ্রূ কুঁচকে টলুর দিকে তাকাতেই সে চোখ খিঁচে তার সাইকেল দেখিয়ে বলল, “আমার সাইকেল।”

তূর্য ধমকের সুরে বলল, “নিয়ে ভাগ!”

রুহানির কাছ থেকে সাইকেল নিয়ে টলু বলল, “বিরিয়ানি কিন্তু এবার দুই বক্স। আমার আত্মা বের করে দেওয়ার জন্য এক বক্স প্যানাল্টি।”

ইভান ধাওয়া দেবে তার আগেই সাইকেল নিয়ে পালালো টলু৷ এদিকে রুহানি মাথা নামিয়ে বলল, “সরি, স্যার। আরেকটু হলে আপনার এক্সিডেন্ট হয়ে যেতো, আর পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে যেতো। দেখুন, আপনি কিন্তু রাগ দেখাবেন না। আপনার চেয়ে বেশি ক্ষতি আমার হতো। জেলখানায় থাকলে আমি এবার পরীক্ষায় না বসেই ফেইল করতাম। দু’দু বার ফেইল। তখন তো আরো এক পর বছর বিয়ে!”

আরাফ তার নিজের কপালে নিজেই চাপড় মারলো। রুহানি চাপড়ের শব্দ শুনে আরাফের দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ স্বরে সরি বলে দৌঁড়ে পালিয়ে গেল। আরাফ ভ্রূ কুঁচকে তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল। এদিকে রুহানি গেট দিয়ে ঢুকে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “ধুর, ক্রাশকে ইম্প্রেস করার জায়গায় তার সামনে বাঁশ খেয়ে বসে থাকি আমি। স্যারকে কে বললো অসময়ে টপকাতে? ধুর ভাল্লাগে না। লোকে শুনলে কি বলবে? পরীক্ষায়ও ফেইল। প্রেমেও ফেইল। একটাতে তো এ প্লাস পাওয়া উচিত আমার। পড়ালেখাও কোনো কাজে আসে নি। স্কুল থেকে পড়ে আসলাম হাউ টু মেইক চা, পানি, খাবার-দাবার, কিন্তু হাউ টু ইম্প্রেস স্যার এটা আর পড়ায় নি। এখন নতুন করে গুগল সার্চ দিতে হবে।”

চলবে-

#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| বোনাস পর্ব-০১ ||

হিমালয়ের বই হাতে ক্যাম্পাস উদ্যানে বসে আছে অরুণিকা। বসন্তের হাওয়া তার কায়া স্পর্শ করে যাচ্ছে। ঠোঁটে প্রসারিত হাসি জানিয়ে দিচ্ছে আজ তার মন ভালো। অরুণিকা বইটির দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বলল, “হিমালয়, আমি জানি না তুমি কে? কি তোমার পরিচয়! কিন্তু তুমি আমার হৃদয়ে সৃষ্টি হওয়া সেই কল্পনা, যাকে ভাবতেই আমার ভীষণ ভালো লাগছে। তুমি আমার পরিচিত নও, তবুও পরিচিত। কেমন গোলমেলে কথা বলছি, তাই না? ইদানীং আমার তোমাকে ভীষণ ভালো লাগে। আমি হয়তো আবার কাউকে পছন্দ করা শুরু করেছি। তুমি আমার কাছে আরো স্পেশাল হয়ে গেছো, হিমালয়।”

অরুণিকা আনমনে হেসে পুনরায় বলল, “তবে তোমার বুদ্ধি কাজ করেছে। মান-অভিমান সবার মাঝে থাকে। কিন্তু অভিমান ভাঙানোর এই অভিনব কৌশলের প্রেমে পড়েছি আমি। আমিও দেখতে চাই, কখন তুমি আমার সামনে এসে দাঁড়াও। আমি অপেক্ষা করছি তোমার। এবার অন্তত আমার মন ভাঙবে না জানি। থ্যাংক ইউ সো মাচ, আমাকে এতো স্পেশাল ফিল করানোর জন্য। আমি সবসময় এটাই চেয়েছি। কেউ আমাকে স্পেশাল ট্রিট করুক। মেয়েরা তো তার প্রিয় পুরুষের কাছ থেকে এটাই আশা করে।”

কেউ একজন গলা খাঁকারি দিতেই অরুণিকা চমকে উঠলো। পাশ ফিরে দেখলো ইমান। অরুণিকা দ্রুত হাতে বইটি তার ব্যাগে ঢুকানোর প্রস্তুতি নিতে লাগলো। ইমান তার পাশে বসে বইটি টেনে নিয়ে বলল, “এটা কার লেখা?”

অরুণিকা হালকা হেসে বলল, “হিমালয়ের।”

“তুমি তাকে ভালোবাসো?”

অরুণিকা বইটি টেনে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আপনি এটা কেমন প্রশ্ন করছেন?”

“যদি হিমালয় তোমার সামনে আসে?”

“মানে?”

“হিমালয় তোমার প্রেমে পড়ার অপেক্ষায় ছিল। তুমি যেদিন তার প্রেমে পড়বে, সে তোমার সামনে এসে দাঁড়াবে।”

অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “আপনাকে এসব কে বলেছে?”

“বাদ দাও। আমি যদি বলি, আমি হিমালয়কে চিনি।”

অরুণিকা বিরক্তমুখে বলল, “অসম্ভব। উনাকে কেউই চেনে না।”

“আমি চিনি।”

অরুণিকা ভীত দৃষ্টিতে ইমানের দিকে তাকিয়ে রইল। ইমান বলল, “কিন্তু আমি তার পরিচয় তোমাকে জানাবো না। কখনো জানাবো না।”

অরুণিকা ইমানের কথা না শুনে দ্রুত পায়ে সামনে চলে গেল। ইমান অবাক হয়ে অরুণিকার যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে। এদিকে অরুণিকা সামনে হাঁটতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লো ডিপার্টমেন্টের সিঁড়িতে। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে সে। মনে অজানা ভয় ভীড় করেছে তার। কিসের ভয় একমাত্র সেই ভালো জানে। কাঁপা শরীরে সিঁড়ি থেকে উঠে হাত ঝাড়তে ঝাড়তে সামনে তাকাতেই থমকে গেল অরুণিকা। তার চোখ স্থির হয়ে আছে। মুখভঙ্গিতে ফুটে উঠেছে বিষ্ময়। মুহূর্তেই হাত-পা শিউরে উঠলো তার। সিঁড়ির উপরের ধাপে দাঁড়িয়ে আছে আহনাফ। অরুণিকা এখনো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আহনাফ সিঁড়ি বেয়ে নেমে তাকে পাশ কেটে চলে গেল। আহনাফ চলে যেতেই অরুণিকার ঠোঁটে অদৃশ্য হাসি ফুটে উঠলো। সে নিজেও জানে না, এই প্রশান্তির কারণ কি। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে সে ধীর পায়ে হেঁটে ক্লাসে চলে গেল।

(***)

ঘড়িতে রাত আটটা। অরুণিকার ফোনের স্ক্রিনে আরাফের নম্বর ভেসে উঠেছে। সে ব্যস্ত হাতে ফোন ধরতেই আরাফ ওপাশ থেকে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো, “তোর বান্ধবীকে এখান থেকে নিয়ে যা।”

“মানে?”

“উপরে আয় আগে। তারপর এসেই না হয় দেখ।”

রুহানি আরাফের নম্বর দেখেই কৌতুহলি দৃষ্টিতে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে ছিল। কল কেটে যেতেই বলল, “কি বললো তোর ভাই?”

“বুঝলাম না। উপরে গেলে বুঝবো৷ আমার সাথে আয় তো।”

অরুণিকা আরাফদের ফ্ল্যাটে বেল দিতেই আহনাফ এসে দরজা খুলে দিল। আহনাফকে দেখেই মিনিট খানিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল অরুণিকা। রুহানি উভয়ের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। আরাফ পেছন থেকে এসে বলল, “ভেতরে আয়।”

অরুণিকা ভেতরে ঢুকে সবার দিকে একবার করে তাকালো। ইভান সোফায় বসে আছে থম মেরে। ইমন দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাহমিদ ডায়নিংয়ের চেয়ার টেনে বসে আছে। আরাফ আর আহনাফ দাঁড়িয়ে আছে গম্ভীরমুখে। রুহানি পুরো ঘরের অবস্থা দেখে বলল, “বাসা এতো এলোমেলো কেন? ঘরে কি ডাকাতি হয়েছে?”

তখনই রান্নাঘর থেকে উপমা বেরিয়ে এলো। উপমা অরুণিকাকে দেখে ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “তোমার বান্ধবী তূর্যের ঘরে।”

অরুণিকা আর রুহানি ভ্রূ কুঁচকে উপমার দিকে তাকালো। রুহানি বলল, “রুদবা?”

“হ্যাঁ।”

অরুণিকা আরাফের দিকে তাকিয়ে বলল, “ও রাত আটটায় এখানে কি করছে?”

আরাফ বলল, “ভেতরে গিয়ে দেখ।”

(***)

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো অরুণিকা। তূর্য আর রুদবা দু’জনই মাতাল হয়ে আছে। অরুণিকা গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। এরপর ব্যস্ত হয়ে তাদের দিকে যেতেই তূর্য রুদবার হাত ধরে বলল, “লেটস ডান্স।”

রুদবাও মাথা নেড়ে সায় দিল। উপমা দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো। তূর্য রুদবার কোমড় জড়িয়ে মাতাল কন্ঠে সুর দিয়ে শরীর দোলাচ্ছে। এরপর রুদবাকে কোলে নিয়ে বসার ঘরে চলে এলো সে। উপমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই এখন দেখ, আমি তোর সামনে কীভাবে অন্য কাউকে আদর করি।”

এই বলে রুদবার কাছে আসতেই অরুণিকা তূর্যকে সরিয়ে দিল। হঠাৎ রুদবা অরুণিকার চুল টেনে ধরলো। অরুণিকা ব্যথায় কুঁকড়ে উঠতেই আহনাফ আর রুহানি এসে রুদবার হাতের মুঠো থেকে অরুণিকার চুল ছাড়িয়ে নিলো। রুদবা মাতাল কন্ঠে বলল, “তুই আমার আর তূর্যের লাইফের সবচেয়ে বড় বাঁধা। তুই আমার কাছ থেকে কেঁড়ে নিতে পারবি না তূর্যকে।”

আরাফ বলল, “রুদবার বাসায় কেউ নেই। ওরা না-কি রাতে ফিরবে। এই বলে তোর বান্ধবী আমাদের ঘরে ঢুকেছে। এরপর তূর্য নিজেও খেয়েছে, মেয়েটাকে এসব খাইয়েছে। তাড়াতাড়ি ওকে নিয়ে যা। কেউ জানলে আমাদের মান-সম্মান শেষ।”

রুহানি গালে হাত দিয়ে আরাফকে জিজ্ঞেস করলো, “স্যার, আপনিও কি এসব খান?”

আরাফ ভ্রূ কুঁচকে রুহানির দিকে তাকালো। রুহানি আমতা-আমতা করে বলল, “ইয়ে মানে, আহনাফ স্যার খেয়ে রিহ্যাবে গিয়েছিলেন। এখন তূর্য ভাইয়াও খাচ্ছেন এসব। আপনি তো ডাক্তার। আপনিও খেলে আমরা কীভাবে আপনার কাছে ট্রিটমেন্ট করাতে আসবো!”

আরাফ চেঁচিয়ে বলল, “এখন এসব প্রশ্ন করার সময়? মেয়েটাকে নিয়ে এখান থেকে বের হও। বাড়ির মালিক জানলে আমাদের ঘর থেকে বের করে দেবে। উপমাও এই মেয়েটার জন্য নিজের বাসায় যেতে পারছে না। একলা একটা মেয়ে ব্যাচেলর ঘরে উঠলে এলাকায় বদনাম হবে আমাদের।”

রুহানি মুখ বাঁকিয়ে বলল, “এভাবে চেঁচিয়ে বলতে হয়? ধীরে বললেও শুনতে পারতাম।”

আরাফ কোমড়ে হাত দিয়ে রাগী দৃষ্টিতে তাকাতেই রুহানি দ্রুত দরজার বাইরে এসে বলল, “অরু তাড়াতাড়ি চলে আয়।”

উপমা আর অরুণিকা রুদবাকে টেনে টেনে কেউ না দেখে মতো নিচ তলায় নিয়ে এলো। এরপর অরুণিকার রুমে শুইয়ে দিল রুদবাকে। উপমা রুদবাকে রেখে চলে যাবে তখনই অরুণিকা তার হাত ধরে বলল, “তুমি প্লিজ তূর্যের সাথে কথা বলো। ও তোমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য রুদবার অনুভূতি নিয়ে খেলছে। প্লিজ, এমন করতে বারণ করো ওকে। রুদবার বাবা-মা জানলে অনেক কষ্ট পাবে। ওদের অনেক আদরের মেয়ে রুদবা। কোনো কিছুর অভাব নেই ওর। অনেক সম্মানী তারা। তাদের মেয়ে একটা ছেলের সাথে ড্রিংক্স করে মাতাল হয়ে আছে, এটা শুনলে সহ্য করতে পারবে না। আমার ভাই আর তার বন্ধুদের নিয়ত ভালো না হলে আজ রুদবার কপালে শনির দশা আসতো। প্লিজ, তূর্যকে বোঝাও। ও তোমাকে এখনো ভালোবাসে। তুমি দেখছো না, তোমার জন্যই তো ও এসব করছে। আমি জানি না তুমি কীভাবে কাকে ঠকিয়েছো। কিন্তু তোমার চুপ থাকা অনেকের জীবন ধ্বংস করে দেবে। তূর্য যদি স্বেচ্ছায় রুদবার সাথে মুভ অন কর‍তো, আমি এপ্রেশিয়াট করতাম। কিন্তু আমি জানি যেই ছেলে এখনো তার ভায়োলিন থেকে শ্যামকন্যার নাম মুছে দিতে পারি নি, তার হৃদয় থেকে সে কীভাবে সেই নাম মুছে দেবে? যার গানের প্রতিটি কথা তার শ্যামকন্যাকে নিয়ে, সে কীভাবে আবার ভালোবাসবে? তোমাদের নিজেদের সমস্যার কারণে আমার বান্ধবীটার জীবন ধ্বংস করো না, প্লিজ।”

উপমা মাথা নিচু করে চলে গেল। রুহানি অরুণিকার হাত ধরে বলল, “উপমা মেয়েটা কে?”

“তূর্যের প্রথম ভালোবাসা।”

(***)

খোলা চুলে ছাদে দাঁড়িয়ে আছে অরুণিকা। পিঠ ছুঁয়েছে তার চুল। অরুণিকা চোখ বন্ধ করে ফাগুন ভোরের শীতল হাওয়া গায়ে মাখছে। সূর্য পুরোপুরি উঠে নি। আকাশে লালচে আভা ছড়িয়ে পড়েছে। হঠাৎ ছাদে কারো উপস্থিতি অনুভব করে অরুণিকার ঠোঁট মৃদু প্রসারিত হলো। অস্তিত্বটি এবার ঠিক তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। অরুণিকা চোখ খুলে পাশ ফিরলো। তার ধারণা ভুল ছিল না। তার পাশে আহনাফ দাঁড়িয়ে আছে। আহনাফের দৃষ্টি আকাশের দিকে। আর অরুণিকা তাকে দেখছে শান্ত দৃষ্টিতে। আহনাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “বইটই অনেক পড়িস মনে হয়!”

অরুণিকা সামনে তাকিয়ে বলল, “হঠাৎ এই প্রশ্ন?”

“আমার টেবিল থেকে বই নিয়ে গেলি দেখলাম।”

অরুণিকা আহনাফের দিকে ফিরে ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তুমি কীভাবে দেখেছো?”

“বই খুঁজে না পেয়ে জিজ্ঞেস করতেই জানলাম, তুই আমার রুমে গিয়েছিলি।”

“হুম। পড়া শেষ। সুন্দর ছিল বইটি। দ্য আলকেমিস্ট, সেন্টিয়াগো’স স্টোরি। তোমার আরেকটা বই নিয়েছি।”

“কোনটা?”

“টু দা লাইটহাউজ।”

“আচ্ছা।”

“তুমি ইংলিশ বুক বেশি পড়ো?”

“পড়তে তো হয়। তোদের পড়াতে হবে না? সিলেবাসের বাইরে তো তোরা কিছুই পড়িস না। আমাদের তো অনেক পড়তে হবে। তবে এসব বই অনেক আগে পড়েছি আমি। নতুন বইগুলো সব চৌধুরী ম্যানশনে।”

“এগুলো রেখে দিয়েছো কেন?”

“কুয়েশ্চন রেডি করার জন্য।”

“নেক্সট সেমিস্টারে আলকেমিস্ট আমাদের সিলেবাসে আছে।”

“হুম, ইভান পাবে সেই কোর্সটা।”

“তুমি পাবে না?”

আহনাফ অরুণিকার প্রশ্নে তার দিকে তাকালো। অরুণিকা চোখ সরিয়ে নিতেই আহনাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সরি।”

“সরি কেন?”

“আমি গত ছ’বছর তোর জীবনের অভিশাপ হয়েছিলাম।”

অরুণিকা কোনো উত্তর না দিয়ে নিঃশব্দে সামনে হাঁটতে লাগলো। আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে অরুণিকার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল। অরুণিকা হঠাৎ থেমে গেল। মৃদু হেসে বলল, “আমি যেই আহনাফ চৌধুরীকে চিনতাম, তাকে সেই বয়সে অনেক ভালোবাসতাম। কিন্তু এখন সেই মানুষটা আমার কাছে ছোটবেলার আবেগ মাত্র। আমি এখন আর সেই আহনাফকে ভালোবাসি না।”

আহনাফ শক্ত করে ছাদের রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে রইল। অরুণিকা বুকে হাত রেখে বলল, “আমি আবার প্রেমে পড়েছি। আর এটাই সেই প্রেম, যেই প্রেমকে জগতের ভাষায় ভালোবাসা বলে। আবেগ বলে না। এই প্রেমে মায়া আছে, অনুভূতি আছে। অদ্ভুত এক আকর্ষণ আছে।”

আহনাফ মলিন দৃষ্টিতে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি তোর জন্য অনেক খুশি।”

অরুণিকা আহনাফের দিকে তাকালো। আহনাফ তার কাছে এসে বলল, “কেউ ভালো থাকতে চাইলে, আমার অধিকার তাদের ভালো থাকতে দেওয়া।”

“তুমি জানতে চাইবে না সে কে?”

আহনাফ মাথা নেড়ে বলল, “না। আমাকে দিস না তার পরিচয়। আমি তাকে কখনোই চিনতে চাই না।”

“কেন?”

আহনাফ মনে মনে বলল, “যেই মানুষটি আমার প্রেয়সীকে কেঁড়ে নিয়ে তার হৃদয় থেকে আমার নাম মুছে দিয়ে নিজে জায়গা করে নিয়েছে, তাকে চোখের সামনে দেখলে আমার দমবন্ধ হয়ে আসবে। আমার কাছে ধোঁয়াশা থাক সে। যদিও আমি আন্দাজ করে নিয়েছি সে কে। তবুও মনে সে স্পষ্ট না হোক।”

অরুণিকা বলল, “কিছু বলছো না যে!”

আহনাফ ক্ষীণ হেসে অরুণিকার মাথায় হাত রেখে বলল, “বাদ দে। তুই ভালো থাকিস।”

অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। আহনাফ চলে গেল নিঃশব্দে। অরুণিকা তাকে থামাতে চেয়েও পারলো না। অদ্ভুত এক জড়তা ভীড় করলো তার মনে। কেন সে আটকাতে পারছে না আহনাফকে? কেন এই দেয়াল সৃষ্টি হয়েছে তার হৃদয়ে?”

(***)

নিঃশব্দে সকালের নাস্তা করছে আহনাফ। রিহ্যাব থেকে ফেরার পর থেকেই সে বেশ শান্ত। গম্ভীর তার চলাফেরা। বন্ধুদের ভীড়েও অন্যমনস্ক। আরাফ বলল, “আহনাফ, চুপচাপ কেন তুই?”

আহনাফ হালকা হেসে বলল, “বল না!”

“বলবো তো! আগে বল তুই এতো চুপচাপ কেন?”

তাহমিদ বলল, “মনে কিছু থাকলে আমাদের জানা।”

আহনাফ মাথা নেড়ে বলল, “না, কিছু নেই।”

ইমন ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তুই এতো কম শব্দে উত্তর দিচ্ছিস! হ্যাঁ, না এসবের বাইরে একটাও কথা বলছিস নি। এই তিন মাস কেমন কাটলো, আমাদের কিছু বলবি না?”

তূর্য সোফা থেকে উঠে ডায়নিংয়ে বসলো। কাল রাতের ঘটনার পর কেউ তার সাথে কথা বলছে না। এদিকে উপমাও আজ আসে নি। ভীষণ মাথা ধরেছে তূর্যের। কেউ তাকে সাহায্যও করছে না। বাধ্য হয়ে কপালে বাম ঘষে নিজেই চা বানালো। এখন অব্ধি দু’কাপ চা খেয়েও তার মাথা ব্যথা কমে নি। শেষমেশ কপালে শক্ত করে মাফলার বেঁধে রেখেছে সে। তূর্য আহনাফের পাশে বসে তার কাঁধে হাত রেখে বলল, “টুইংকেলের সাথে কথা বলেছিস?”

আহনাফ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। ইভান কৌতুহলি কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “এখন ডিসিশন কি তোদের?”

আহনাফ ক্ষীণ হেসে বলল, “ওর পছন্দ আছে।”

“আরেহ ধুর, মিথ্যুক একটা। এখনো ট্যারামি করছে মেয়েটা।”

“ও সত্য বলছে।”

আরাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তুই কীভাবে বুঝলি?”

“আমি ছাড়া আর কে বুঝবে? আমি জানি, ও সত্য বলছে। ওর মধ্যে অনেক পরিবর্তন খেয়াল করলাম। ক্যাম্পাসে আনমনে হাসে। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি জানি, ও এবার সত্য বলছে। প্রেমে পড়লে যা যা অনুভূত হয়, সবটাই অনুভব করছে।”

ইভান ভ্রূ কুঁচকে বলল, “ছেলেটা কি তাহলে ইমান?”

“আমি জানি না। হয়তো ইমান বা অন্যকেউ। আমি জানতে চাই না।”

“এখন তুই কি করবি?”

“অরু যা ভালো মনে করবে, আমি তাই করবো। ও যদি আলাদা হতে চায়, আমি ওকে আটকাবো না। আমি আর জোর করে ওকে আমার সাথে বেঁধে রাখতে চাই না।”

“যদি ও থাকতে চায়?”

“থাকতে চাইলে কেন ছেড়ে দেবো? আমি তো চাই না ও চলে যাক। কিন্তু আমার ইচ্ছায় সব কেন হবে? অন্যের ইচ্ছের গুরুত্বও দিতে হবে আমার।”

আহনাফের কথায় বাকিরা চুপ হয়ে গেল। আরাফ মনে মনে বলল, “এতো চেঞ্জ! আমাদের আহু কি তাহলে রিকোভার করে ফেলেছে পুরোপুরি? ওর মধ্যে সেই এগ্রেসিভ ভাবটাও নেই! আই হৌপ, এখন সব ঠিক হয়ে যাবে। শুধু শিরিন সুলতানার সাথে চাচুর ডিভোর্সটা হয়ে যাক। তারপর ওই মহিলার সাথে আমি ডিল করবো। তাকে খোলা ছাড়া উচিত হবে না। না জানি কখন কি করে বসে। জাস্ট তিনটা মাস। এরপর ওই শিরিন সুলতানার নাম এই পৃথিবী থেকেই মুছে যাবে।”

(***)

আজ ক্যাম্পাসে শেষ বর্ষের বিদায় উপলক্ষে রং উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। ক্যাম্পাসে জয়িতার এই বছরই শেষ বছর। সে সাদা শাড়ি পরে এসেছে আজ। চোখে সানগ্লাস। বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে রং উৎসবে মত্ত সে। হঠাৎ আহনাফকে দেখে থমকে গেল জয়িতা। শেষ বর্ষের ক্লাস শেষ হয়ে যাওয়ায় এতোদিন ক্যাম্পাসে আসে নি সে। তাই তিন মাস পর আহনাফকে আজই প্রথম দেখছে। সে ভীড় ঠেলে বের হয়ে দৌঁড়ে আহনাফের কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো। আহনাফ স্তব্ধ হয়ে গেল জয়িতার আকষ্মিক আচরণে। সে জয়িতার হাত ছাড়াতে যাবে, তূর্য আহনাফের হাত ধরে জয়িতার পিঠে রাখলো। আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে তূর্যের দিকে তাকালো। তূর্য আর ইভান মুখ চেপে হাসছে। হঠাৎ সামনে অরুণিকাকে দেখে বিষ্মিত হলো আহনাফ। অরুণিকা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আহনাফের দিকে তাকিয়ে আছে। আহনাফ দ্রুত জয়িতাকে সরিয়ে দিল। তূর্য কপালে হালকা চাপড় মেরে বলল, “বেকুব একটা!”

জয়িতা আহনাফের গালে হাত রেখে বলল, “আহনাফ, আমি তিনমাস তোমার অপেক্ষা করেছি।”

আহনাফ জয়িতাকে সরিয়ে কিছুটা দূরত্ব রেখে বলল, “এটা ক্যাম্পাস।”

“তো? শীঘ্রই আমাদের বিয়ে হবে।”

“তোমাকে কে বলেছে?”

“আন্টি আমার মাকে কথা দিয়েছে।”

“তোমার আন্টির কোনো অধিকার নেই আমার লাইফের সিদ্ধান্ত নেওয়ার।”

“কি বলছো এসব?”

“আমি তোমার স্যার।”

“আমি বের হয়ে যাচ্ছি ক্যাম্পাস থেকে। তুমি এখন আর আমার স্যার নও।”

“এখনো পরীক্ষায় বসো নি তুমি। বেশি তেড়িবেড়ি করলে রিটেক দিয়ে দেবো। যাও এখান থেকে।”

জয়িতা অভিমানী মুখে বলল, “আমি ভালোবাসি তোমাকে।”

“আল্লাহর ওয়াস্তে, এখানে সিনক্রিয়েট করো না।”

“ওকে, ফাইন। এট লিস্ট প্রোগ্রাম শেষে দেখা করো!”

“না।”

তূর্য বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ অবশ্যই দেখা করবে।”

আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে তূর্যের দিকে তাকালো। জয়িতা বলল, “ক্যাম্পাসের বাইরে যে রেস্টুরেন্ট আছে আমি ওখানে থাকবো।”

এই বলে জয়িতা চলে গেল। আহনাফ তূর্যের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “কি বললি ওকে?”

“তোর লাইফ সেট করে দিচ্ছি ভাই।”

“তুই আগে নিজের লাইফ সেট কর। আমার লাইফে এমনিতেই ঝামেলার অভাব নেই যে এই আপদটাকেও আমার পেছনে লাগিয়ে দিচ্ছিস।”

“আরেহ বেকুব, তোর অরুণিকাকে জ্বালানোর জন্য।”

“আমার কাউকে জ্বালানোর কোনো ইচ্ছে নেই। ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। আমি আর জিরো পারসেন্ট এফোর্ডও দেবো না।”

ইভান বলল, “লাস্ট ট্রাই করে দেখ।”

আহনাফ শক্ত কন্ঠে বলল, “নো।”

এই বলে আহনাফ চলে গেল। অরুণিকা এক দৃষ্টিতে আহনাফের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, “আমি যা ভাবছি, তা কি ভুল? যদি ভুল হয়, আমি তো আবার ঠকবো। নিজের মন মতো আমি সেই ফ্যাক্টটা ধরে আগাচ্ছি কেন? নিশ্চিত না হয়ে কি আমার কোনো স্টেপ নেওয়া উচিত হচ্ছে?”

(***)

অরুণিকা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিনিয়রদের রং উৎসব দেখছে। হঠাৎ দু’টি হাত তার দু’গাল ছুঁয়ে দিতেই চমকে উঠলো সে। পেছন ফিরতেই বাতাসের সাথে ইমানের হাতে থাকা রঙ অরুণিকার চোখ ঢুকে গেল। সে ব্যস্ত হয়ে তার চোখ কচলাতে লাগলো। ইমান দ্রুত হাত ঝেড়ে শার্টে তার হাত মুছে অরুণিকার চোখ দেখার জন্য তার দিকে এগিয়ে আসতেই অরুণিকা বিরক্ত মুখে বলল, “আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে? আপনি আমার অনুমতি না নিয়ে আমার মুখ রঙ লাগিয়েছেন কেন?”

ইমান মুখ ছোট করে বলল, “সরি।”

অরুণিকা চোখ চুলকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ইমান অরুণিকার হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, “আমি দেখছি।”

এই বলে ফুঁ দিতে লাগলো অরুণিকার চোখে। অরুণিকা বিরক্তমুখে বলল, “সিনেমার শুটিং চলছে? এভাবে চোখের ময়লা যায় না।”

এদিকে ডিপার্টমেন্টের তিনতলা থেকে ক্যাম্পাসের মাঠে অরুণিকা আর ইমানকে একসাথে দেখে আহনাফের হাত মুঠো হয়ে এলো। সে ধীর পায়ে হেঁটে নিজের কেবিনে ঢুকে দরজা আঁটকে দিল। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল মিনিট খানিক। তার চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে। ধপ করে হাঁটুর উপর ভর দিয়ে মেঝেতে বসে পড়লো আহনাফ। মাথা ঝুঁকিয়ে রেখেছে সে। নিঃশব্দে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো মেঝেতে। আহনাফ সেই অশ্রু কণার দিকে তাকিয়ে শার্টের হাতায় চোখ মুছে নিল। সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে মেঝেতে সেই ভেজা উষ্ণ পানির বিন্দুর উপর জুতা ঘষে মিশিয়ে দিল ধুলোর সাথে। এরপর ওয়াশরুমে গিয়ে ভালোভাবে চোখ-মুখ ধুয়ে জোরে শ্বাস ছাড়লো।

ওদিকে অরুণিকা ইমানের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “আপনাকে আমি ভালো মানুষ ভেবেছিলাম। কিন্তু আপনার মতো অসভ্য আমি দ্বিতীয়টা দেখি নি।”

“কি বলছো, ণিকা!”

“কি বলছি মানে? আপনি বিনা অনুমতিতে আমাকে কোন সাহসে টাচ করেছেন?”

“আমি জাস্ট রং লাগিয়েছি।”

“আমি আপনাকে বলেছি লাগাতে?”

“আমি তোমাকে ভালোবাসি, ণিকা।”

“স্ট্রেঞ্জ ভাই, আমি ভালোবাসি না আপনাকে।”

“তুমি শিউর?”

অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে তাকালো ইমানের দিকে। ইমান বলল, “তুমি ভালোবাসো না আমাকে?”

“নো ওয়ে।”

“কিন্তু আমি যতোদূর জানি, তুমি আমাকে ভালোবাসো।”

“মাথা গেছে আপনার?”

“সরি, ণিকা। কিন্তু তুমি যে আমাকে ভালোবাসো, এতে কোনো সন্দেহ নেই।”

“ধোঁয়াশা করছেন কেন?”

“কারণ আমি ভালোবাসি ধোঁয়াশা কর‍তে।”

অরুণিকা ইমানের দিকে তাকিয়ে আছে। ইমান হালকা হেসে বলল, “সেদিন আমাদের সেই বাগানে দেখা হয়েছিল মনে আছে? এরপর পুলিশ ভ্যানে ধাক্কা লেগেছিল!”

অরুণিকা কপাল ভাঁজ করে বলল, “মানে!”

“আমি সেদিন ওখানে কেন গিয়েছিলাম?”

“আমি কি করে বলবো?”

ইমান হালকা হেসে নিঃশব্দে চলে গেল। অরুণিকা ইমানের যাওয়ার পানে তাকিয়ে মনে মনে বলল, “পাগল না-কি!”

(***)

তাহসিনের সাথে রেস্টুরেন্টে এসে আহনাফ আর জয়িতাকে একসাথে দেখে চমকে উঠলো অরুণিকা। তাহসিন আহনাফকে দেখে অরুণিকার হাতে গুঁতো মেরে বলল, “দেখেছো, ক্লাসের সবাই দেখছি মিথ্যে বলে নি৷ আহনাফ স্যার জয়িতা আপুকে ডেট করছেন।”

তূর্য জানে অরুণিকা ক্লাস শেষে তাহসিনের সাথে এই রেস্টুরেন্টে এসে খাওয়া-দাওয়া করে। তাই ইচ্ছে করে জয়িতার সাথে দেখা করার জন্য জোর করে পাঠালো আহনাফকে। এদিকে আহনাফ অরুণিকাকে দেখে চুপ হয়ে গেল। জয়িতা আহনাফের চোখ অনুসরণ করে অরুণিকাকে দেখে রেগে উঠলো। এরপর আহনাফের গা ঘেঁষে বসে বলল, “দেখো, আই লাভ ইউ, আহনাফ। আমি তোমার অপেক্ষায় আজ পর্যন্ত কোনো রিলেশনে যাই নি।”

“আমি কি নিষেধ করেছি তোমাকে?”

আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে কথাটি বলল। এদিকে অরুণিকা চুপচাপ বসে আছে। তাহসিন বলল, “তোমার মুখ এমন শুকিয়ে গেছে কেন?”

অরুণিকা চেঁচিয়ে বলল, “আ’ম ফাইন।”

তাহসিন অবাক হয়ে তাকালো অরুণিকার দিকে। এদিকে আহনাফ অরুণিকার দিকে একটু পরপরই তাকাচ্ছে। জয়িতা বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালো। বলল, “চলো অন্য কোথাও যাই।”

আহনাফ মানিব্যাগ বের করে বিল দিয়ে বলল, “আমার খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই আমি আবার অন্য কোথাও যাবো।”

এই বলে বেরিয়ে পড়লো আহনাফ। আহনাফ চলে যেতেই জয়িতা হনহনিয়ে অরুণিকার কাছে এসে বলল, “সমস্যা কি তোমার?”

তাহসিন বিষ্ময় নিয়ে জয়িতার দিকে তাকালো। অরুণিকা মুখে পানি পুরে এপাশ-ওপাশ করছে। জয়িতা তার হাত ঝাঁকাতেই অরুণিকার মুখের সব পানি জয়িতার গায়ে এসে পড়লো। জয়িতা শক্ত মুখে দাঁড়িয়ে রইল। তাহসিন পানির দাম দিয়ে অরুণিকার হাত ধরে দ্রুত বেরিয়ে এলো রেস্টুরেন্টের বাইরে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “স্যারের ফিয়োন্সের সাথে এমন কাজ করলে তুমি? তোমার রিটেক শিউর!”

অরুণিকা মুখ বাঁকিয়ে বলল, “আমি একটা খেলে এই ষ্টুপিড মেয়ে দুইটা খাবে। প্যারা নাই চিল।”

চলবে-

#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| বোনাস পর্ব- ০২||

আমির চৌধুরী আহনাফের কথায় ফোন দিলেন জাহানারা ইসলামকে। তুলে নিলেন শিরিন সুলতানার দেওয়া বিয়ের প্রতিশ্রুতি। জয়িতা মায়ের কাছে সব শোনার পর থেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। জাহানারা ইসলাম মেয়ের অবস্থা বেগতিক দেখে শিরিন সুলতানাকে ফোন করে সব জানালেন। শিরিন সুলতানা ক্ষীণ কন্ঠে বললেন, “ক্ষমা করিস আমাকে। আমার হাতে আর কিছুই নেই। জয়িতার বিয়ে তো আমি চাইলেই আর আহনাফের সাথে দিতে পারছি না। আমার আর আমিরের সম্পর্কই যেখানে আর নেই! তবে আমি আহনাফকেও শান্তিতে বাঁচতে দেবো না। ওই ছেলের জন্যই আমি সব হারিয়েছি। না ওর মতো শয়তানকে জন্ম দিতাম, না আমার সংসার ভাঙতো।”

জাহানারা ইসলাম ফোন রেখে জয়িতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “আহনাফকে ভুলে যা, মা।”

জয়িতা চেঁচিয়ে বলল, “না। আমাকে মিথ্যে স্বপ্ন দেখিয়েছো কেন? তুমি আর আন্টি বলেছিলে আমাদের বিয়ে হবে। তাহলে এখন কেন এই কথা বলছো?”

জয়িতা মায়ের হাত থেকে ফোন কেঁড়ে নিয়ে বলল, “আমি নিজেই আন্টির সাথে কথা বলবো। তোমার হ্যাল্প লাগবে না আমার।”

জয়িতা এই বলে শিরিন সুলতানাকে কল করলো। ওপাশ থেকে তার কন্ঠ শুনেই জয়িতা কান্না জড়ানো কন্ঠে বলল, “আন্টি, আমাকে মিথ্যে স্বপ্ন কেন দেখালেন?”

শিরিন সুলতানা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, “তোমার জন্য ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার। কিন্তু তুমি মন খারাপ করো না। আমি কোনো উপায় বের করছি।”

“আর কী উপায় আছে?”

শিরিন সুলতানা কিছু একটা ভেবে বললেন, “তোমার প্রেমে পড়ার জন্য আহনাফের উপর যদি আমার কালো যাদু করতেও হয়, আমি তাই করবো।”

জয়িতা ভীত দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকালো। জাহানারা ইসলাম ইশারায় জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে? জয়িতা লাউডস্পিকার দিতেই শিরিন সুলতানা বললেন, “আমি এক পীরের সাথে কথা বলেছি। উনি আমাকে আশ্বাস দিয়েছেন, সব ঠিক করে দেবেন।”

জাহানারা ইসলাম বললেন, “শিরিন, আহনাফের সমস্যা হবে না তো? এর আগে সেই ব্ল্যাক ম্যাজিকের কারণে তোর ছেলে অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল। শেষমেশ ওটা আবার কাটাতে হয়েছে আমাদের।”

“না, কিছু হবে না।”

জয়িতা বলল, “আন্টি, যা করার অরুণিকার সাথে করুন। আহনাফের সাথে কেন?”

“আরেহ, অরুণিকা তো সমস্যা না। সমস্যা আহনাফ। তবে অরুণিকার সাথেও কিছু একটা করা যায়। আমার একটা প্ল্যান আছে। তুমি আমার কথামতো কাজ করলে ওদের শীঘ্রই আলাদা করানো যাবে।”

“আমি আপনার সব কথা শুনতে রাজি। শুধু আহনাফ আমার হয়ে যাক, আর কিছু চাই না আমি।”

(***)

অরুণিকা এক দৃষ্টিতে হিমালয়ের ইনবক্সের দিকে তাকিয়ে আছে। আজ এতো মাস হলো মানুষটা অনলাইনে আসে নি, না কোনো পোস্ট করেছে। কেন এভাবে হারিয়ে গেল সে?

অরুণিকা হতাশ কন্ঠে বলল, “আমি যদি আগে জানতাম, তাহলে কি এমন করতাম তোমার সাথে? কেন আসছো না অনলাইনে? ফিরেও কেন ফিরছো না? আমি কি তোমাকে চিনতে পারি নি ভাবছো? আমি জানি তুমিই সেই, যে আমার এককালের আবেগ ছিলে। যার প্রতি আমার ঘৃণা, রাগ, এক বুক অভিমান জন্মেছিল। কিন্তু কেন? কারণ আমি ভেবেছি, তুমি সম্মান দিতে জানো না। কিন্তু তোমার ভালোবাসা এতো চমৎকার হতে পারে, তা আমাকে আগে কেন দেখাও নি? আমার মন বলছে, তুমিই সেই। তোমার টেবিলে আমি সেই কাঠের কলমটি দেখেছি, যেই কলম হিমালয়ের বইয়ের উপর ছিল। সে পোস্ট করেছিল সেই ছবিটি। তুমি তো অনেক ভাবে লিখতে জানো। তাই তোমার আর হিমালয়ের হস্তাক্ষরে কোনো মিল ছিল না। কিন্তু তোমার লেখা গানে, তোমার প্রতিটি সনেটে, তোমার বিচ্ছেদের গল্পে আমিই তো ছিলাম। আহনাফ, একবার আমার সামনে এসে প্রকাশ করতে তোমার শুদ্ধ প্রেম! কোনো নারী, কোনো প্রেয়সী এতো চমৎকার প্রেম প্রত্যাখ্যান করতে পারবে না। হ্যাঁ, তুমি আমাকে আঘাত দিয়েছো। ধরলাম, নেশা করেই এই কাজ করেছো। তবুও আমি সম্মান চেয়েছি। যেই সম্মান, যেই প্রেম, যেই ভালোবাসা হিমালয় হয়ে আমাকে দিয়েছো, কেন আহনাফ হয়ে দাও নি? তোমার লেখায় প্রকাশিত প্রতিটি নারী চরিত্রের মাধ্যমে তুমি আমাকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছো। তাহলে আমার কাছে এসে কেন আমাকে বলো নি, আমিই তোমার সেই হৃদি, তোমার মায়াবতী! কেন আমাকে এতো অপমান করেছিলে? কেন এতো কাঁদিয়েছিলে? এখন আবার কেন চুপ হয়ে গেছো? এমন ভাব করছো যে তুমি হিমালয় নও। আমি তো ভালোবেসে ফেলেছি হিমালয়কে। আমার কল্পনায় সেই সাদা হেলমেটের পেছনে তুমিই তো ছিলে। প্লিজ, এবার হিমালয় হয়ে না, আহনাফ চৌধুরী হয়ে ফিরে আসো। হিমালয় তোমার সেই লুকায়িত সত্তা। প্রকাশ করো সেই পরিচয়। কেন নিজেকে দানবের বেশে আমার সামনে নিয়ে আসছো? পুরুষ তো প্রেয়সীর সামনে সবচেয়ে বেশি নরম হয়, কোমল হয়। তুমি কেন এতো শক্ত খোলসে আবদ্ধ হয়ে আছো। আমি ভেবেছি, কখনো তোমার কাছে ফিরবো না। কিন্তু এই ভালোবাসা পেয়েও কি হারিয়ে ফেলা যায়? মানছি, আমার ইগো অনেক বেশি। তাই তোমার কাছে যাবো না আমি। আমার তো কোনো অপরাধ ছিল না। তুমিই ঠকিয়েছিলে আমাকে। এবার তুমিই আসবে আমার কাছে। নিজের পরিচয় দেবে। এরপর সব ঠিক হয়ে যাবে। সব।”

(***)

দেড় মাস পর দ্বিতীয় সেমিস্টারের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলো। আজ শেষ পরীক্ষা। এই ক্যাম্পাসে এক বছর কেটে গেছে অরুণিকার। ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টেছে। ২০২৩ সাল শুরু হয়েছে তিন মাস হলো। বসন্ত বিদায় জানিয়েছে নিঃশব্দে। এই এক বছরে কতো উত্থান-পতন ঘটেছে অরুণিকার জীবনে। তবে বছর শেষে সে ঠকে নি। শীত তার বিদায় বেলায় অরুণিকার জীবনে এক বসন্ত পুরুষকে নিয়ে এসেছে। ইদানীং বেশ খুশি অরুণিকা। এই বসন্তকেই তো সে তার জীবনে চেয়েছিল। এমন বসন্ত বারবার আসুক।

অরুণিকা ডিপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে মাঠের সামনে এসেই থমকে গেল। মাঠের মাঝখানে বেলুনের ঝাঁক। অরুণিকা কাছে যেতেই দেখলো ইমান দাঁড়িয়ে আছে। সবাই ইমানকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। অরুণিকা সামনে যেতেই রুদবা তার হাত ধরে হুট করে তাকে টেনে ইমানের মুখোমুখি দাঁড় করালো। অরুণিকা চোখ-মুখ কুঁচকে রুদবার দিকে তাকালো। রুদবা এক গাল হেসে বলল, “কংগ্রাচুলেশনস।”

রুদবা এই বলে চলে গেল। জয়িতাও পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়েছে। সে মাঠের দৃশ্য দেখে বাঁকা হেসে আহনাফের দিকে তাকালো। আহনাফ শীতল দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে আছে। পাশেই ইভান, তূর্যসহ আরো কয়েকজন শিক্ষক দাঁড়িয়ে আছেন। তারা বলাবলি করছেন, “ক্যাম্পাসেই কেন এসব করতে হয় এদের?”

আরেকজন বললেন, “হয়তো বিয়ের প্রস্তাব দেবে। বড় বড় বাচ্চাদের আর কি বলা যায়!”

আহনাফ চোখ বুজে ফেললো। ইভান আর তূর্য অসহায় দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আহনাফ এবার চোখ খুলে সেই মাঠের দিকে একনজর তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেল। এদিকে জয়িতা আহনাফকে চলে যেতে দেখে হালকা হেসে সামনে তাকালো। রুদবাও পিছু ফিরে জয়িতার দিকে তাকালো। দু’জনের চোখাচোখিতেই এক অদ্ভুত রহস্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

এদিকে ইমান অরুণিকার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো। বলল, “আপনাকে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছি আমি, হৃদি।”

অরুণিকার হাত থেকে তার ব্যাগটা পড়ে গেল মাটিতে। মনে হচ্ছে, তার শরীর থেকে আত্মাটাও বেরিয়ে গেছে। সে স্তব্ধ হয়ে ইমানের দিকে তাকিয়ে রইল। ইমান হালকা হেসে বলল, “বলেছিলাম, আপনি আমার প্রেমে পড়তে বাধ্য হবেন। আমিই আপনার সেই হিমালয়, যাকে আপনি ভালোবেসেছেন।”

অরুণিকার চোখ জোড়া স্থির হয়ে গেল। ইমান একটি বই এগিয়ে দিয়ে বলল, “আপনার জন্য।”

অরুণিকা বইটির দিকে তাকিয়ে রইল। এই বই হিমালয়ের লেখা। অরুণিকা বইটি পড়েছিল। সে অন্যমনস্ক হয়ে হাতে নিলো সেই বইটি। রুদবা সাথে সাথেই হাততালি দিতে লাগলো। ইমান বেলুনের ঝাঁক আকাশে উড়িয়ে দিল। আহনাফ থেমে গেল ক্যাম্পাসের হৈহৈ শব্দ শুনে। পেছন ফিরে আকাশে উড়ন্ত বেলুনের ঝাঁক দেখে স্মিত হাসলো। সেই স্মিত হাসির পেছনে স্পষ্ট ফুটে উঠেছিল বিষাদ। তার চোখ দু’টি ছলছল করছে। আহনাফ দ্রুত বাসে উঠে বসলো।

ওদিকে অরুণিকা বইটির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ইমান তার কাছে আসতেই সে কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে বলল, “আপনি হিমালয় নন।”

ইমান ভ্রূ কুঁচকে বলল, “আমিই হিমালয়।”

অরুণিকা মাথা নেড়ে বলল, “মিথ্যে বলছেন।”

“তোমার এটা কেন মনে হচ্ছে?”

“প্রমাণ করতে পারবেন?”

“হ্যাঁ।”

“আপনার হাতের লেখার সাথে মিল নেই হিমালয়ের লেখা।”

ইমান চমকে তাকালো অরুণিকার দিকে। অরুণিকা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার দিকে। ইমান ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “আমি চিঠিগুলো নিজের হাতে লিখি নি। আমার এক কাজিনের দিয়ে লিখিয়েছি।”

“মিথ্যে কথা। কোথায় সেই কাজিন?”

“সে দেশের বাইরে চলে যাবে, তাই একসাথে এতোগুলো চিঠি লিখিয়ে নিয়েছিলাম। এজন্যই তোমাকে একসাথে পড়তে নিষেধ করেছি।”

অরুণিকার হাত থেকে বইটি পড়ে গেল। সে তার ব্যাগ নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়লো ক্যাম্পাস থেকে। ইমান অবাক দৃষ্টিতে অরুণিকার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল।

রুদবা এসে বইটি তুলে ইমানের হাতে দিয়ে বলল, “চিন্তা করবেন না। আমি আপনাকে ওয়াদা করেছি, তা আংশিক পূরণ হয়ে গেছে। বাকিটাও আমার উপর ছেড়ে দিন।”

“কি করবে তুমি?”

রুদবা জয়িতার দিকে তাকালো। জয়িতা ইমানের কাছে এসে বলল, “সামনে ক্যাম্পাস থেকে ট্যুরে কক্সবাজার নিচ্ছে। আমাদের ডিপার্টমেন্টের সব স্টুডেন্ট সেখানে যাবে। আমি, রুদবা, তুমিও যাচ্ছো। সাথে অরুণিকাও। দেখো, এই ট্যুর সবার জীবন পাল্টে দেবে।”

“আপনি কেন আমাকে হ্যাল্প করছেন?”

“কারণ তোমার ণিকা আমার আহনাফের মাথা খারাপ করে রেখেছে। মেয়েটার জন্য মুভ অন করতে পারছে না আহনাফ।”

রুদবা বলল, “ইয়েস, তূর্য স্যারও মনে হয় ভালোবাসে অরুকে। ওদের মধ্যে নিশ্চিত কোনো লাভ ট্রায়াংগেল চলছে। আপনার আর অরুর সব সেট তো আমরা সবাই হ্যাপি।”

ইমান বলল, “তূর্য স্যারের সাথে ণিকার কিছু নেই।”

“কিছু না থেকেও আমার আর তূর্যের মাঝখানে নাক গলায় ও। বেটার হয়, ও তার হিমালয়ের সাথে থাকুক। আপনিই অরুর সেই হিমালয়, যাকে অরু ভালোবাসে।”

(***)

বাসায় আসার পর থেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে অরুণিকা। রুহানি কয়েক বার জিজ্ঞেস করেও তার মুখ থেকে কথা বের করতে পারছে না। সে শুধু ফোঁপাচ্ছে। তার শ্বাস আটকে গেছে। রুহানি পানি খাওয়ালো অরুণিকাকে। হঠাৎ রুহানিকে জড়িয়ে ধরলো সে। কাঁপা কন্ঠে বলল, “সব শেষ আমার। আমাকে এই প্রকৃতি আবার ঠকিয়েছে। আমি আবার ভালোবাসতে চেয়েছি, কিন্তু সব শেষ। আমি যাকে হিমালয় ভেবে ভালোবেসেছি, সে হিমালয় না। ইমানই সেই হিমালয়।”

অরুণিকা রুহানিকে ছেড়ে দিয়ে নিজের চুল খামচে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। রুহানি ভীত কন্ঠে বলল, “প্লিজ এমন করিস না। আমার ভয় হচ্ছে ভীষণ৷”

অরুণিকা মেঝেতে বসে বলল, “আহনাফ কেন আমাকে সেভাবে ভালোবাসলো না? কেন? আমি কেন আবার ভালোবাসতে গেলাম? কেন? আ….আ।”

অরুণিকার চিৎকারে আতকিয়া জাহান রুমে চলে এলেন। ভীত কন্ঠে বললেন, “কি হলো ওর?”

রুহানি আতকিয়া জাহানকে বের করে দিয়ে বলল, “মা, তুমি যাও। আমি দেখছি। হয়তো পরীক্ষা ভালো হয় নি।”

“পরীক্ষা ভালো না হলে এভাবে কাঁদবে কেন? ওর বরের সাথে নতুন কিছু হয়েছে নিশ্চয়।”

রুহানি দরজা বন্ধ করে দিল। এদিকে অরুণিকা কাঁপা হাতে ড্রয়ার খুলে সনেটের বইটি বের করলো। খুললো একের পর এক পৃষ্ঠা। রুহানিকে উন্মাদের মতো কবিতাগুলো পড়ে শুনাতে লাগলো। রুহানি গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অরুণিকা বলল, “দেখ, রুহানি। সব কবিতায় হাহাকার। মনে হচ্ছে সব আমার জন্য লেখা। এসব কে লিখবে বল? আহনাফই তো লিখবে, তাই না? আমার বাকিদের মতোই হিমালয়ের লেখা ভালো লাগতো। কিন্তু কেন যেন ওর প্রতি শুরু থেকে মায়া ছিল আমার মনে। এক অদ্ভুত টান ছিল। আমি তবুও নিজেকে বুঝতে দেই নি। কিন্তু ইমান? ওর সাথে আমার কিছু নেই। ও আমার আশেপাশে আসলেও আমার কিচ্ছু অনুভূত হয় না। ও কীভাবে হিমালয় হয়? কীভাবে?”

অরুণিকার চুলগুলো ওর মুখের সাথে লেপ্টে গেছে ঘামে। রুহানি ফ্যানের গতি বাড়িয়ে দিল। অরুণিকা হাতের পিঠ দিয়ে চোখ-মুখ মুছে ড্রয়ার থেকে চিঠিগুলো বের করে মেঝেতে ফেললো। তার চোখ-মুখ ভয়ংকর লাল হয়ে গেছে। ড্রয়ার টেনে আনতেই সেটি খুলে তার পায়ের উপর পড়লো। রুহানি দ্রুত সেই ড্রয়ার সরিয়ে বলল, “অরু, এমন করছিস কেন?”

অরুণিকা ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে মেঝেতে শুয়ে পড়লো। এরপর ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “আমার মনে যে ঝড় উঠেছে, আমি কাউকে বোঝাতে পারবো না। এক সেকেন্ডে আমার সব স্বপ্ন ভেঙে গেছে। আমি নিশ্চিত না হয়ে কেন ভালোবেসেছি হিমালয়কে?”

অরুণিকা হঠাৎ উঠে বসে মেঝে থেকে হাতড়ে হাতড়ে চিঠিগুলো তুলে নিয়ে বলল, “এই দেখ, ইরাবতী আর কুঞ্জের গল্প। ইরাবতীকে প্রতিশোধের নেশায় আঘাত করেছিল কুঞ্জ। এরপর ইরাও একই কাজ করে। দেখেছিস? আমাদের সাথে কেমন মিল না, বল? একদম মিল। দেখছিস না? এরপরেরটা দেখাচ্ছি দাঁড়া।”

রুহানি অসহায় দৃষ্টিতে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে রইল। অরুণিকা পরের চিঠি খুলে দেখালো। বলল, “এই.. এই.. এইটা দেখ।”

অরুণিকার গলা কাঁপছে। রুহানি তার মাথায় হাত বোলাতে লাগলো। সে রুহানির হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, “আমাকে মিথ্যে সান্ত্বনা না দিয়ে, দেখ এই চিঠিতে কি আছে। শুভ্রের গল্পটা পড়েছিস? পড়লে অনেক মিল পাবি আমাদের জীবনের সাথে।”

অরুণিকা সেই চিঠি টেনে আরেকটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, “এই রিক্ত আর পূর্ণতার গল্পটা পড়। এখানে পূর্ণতা নদীতে পড়ে গিয়েছিল, আর রিক্ত তাকে বাঁচাতে গিয়ে নদীতে ডুবে মারা যায়। তুই জানিস, আমি যখন ছোট ছিলাম, এভাবেই নদীতে পড়ে গিয়েছিলাম। আমাকে কে বাঁচিয়েছিল জানিস? আহনাফ। এমন কাকতালীয় ঘটনা কীভাবে ঘটে? এরপর দেখ পরের গল্প। বাদল আর রোদেলার গল্পটা দেখ। আমি তোকে বলেছিলাম না, চৌধুরী ম্যানশনের ছাদে আমার লাগানো সব গাছ ফেলে দিয়েছিল আহনাফ? আমিও তো প্রতিশোধ নিতে ওর সব গাছ উপড়ে ফেলে এসেছিলাম। তুই জানিস, এই এক মাস আগেই তূর্য আমাকে বলেছিল আহনাফ এমন কেন করেছে। কেন করেছিল জানিস? গাছ লাগাতে গিয়ে আমার হাতে একটা কাটা বিঁধে গিয়েছিল। ওইটার জন্য আমার আঙুল ফুলে গিয়েছিল। তাই রাগ করে সব গাছ ফেলে দিয়েছিল ও। কিন্তু মানুষটা কেমন একরোখা দেখ। আমাকে এসব কিচ্ছু বলে নি। আমি তাকে ভুল বুঝে গেলাম, তো গেলাম। সব মিল আমার আর আহনাফের সাথে। তাহলে ইমান কেন এলো আমাদের মাঝে? কেন ও হিমালয় হলো? কেন আমার সব আশা, সব স্বপ্ন ভেঙে দিল?”

অরুণিকা ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। রুহানি আমতা আমতা করে বলল, “যদি হিমালয় ইমান হয়, তাহলে কি তুই ইমানকে ভালোবাসিস?”

“নো ওয়ে। আমার লাস্ট চয়েজও হবে না ইমান। দরকার হলে সারাজীবন একা থাকবো। ইমানকে কখনো আমি আমার জীবনে চাই না। ও আমাকে প্রেমে ফাঁসানোর জন্য আমাকেই ঠকিয়েছে।”

“তাহলে আহনাফ স্যার!”

“আমি যেদিন ওর ঘরে গিয়ে কাঠের কলমটি দেখেছি, ভেবেছি ও হিমালয়। এরপর একেক লেখার ধরণ দেখে ভেবেছিলাম হয়তো আমি লেখা চিনতে না পারার জন্য ও হস্তাক্ষর পরিবর্তন করে লিখেছে। আর এজন্যই আমি সব সনেট আবার পড়েছি। চ্যাটগুলোও সব পড়েছি। এরপর চিঠিগুলোর সাথে নিজেকে রিলেট করতে পেরেছি।”

“হয়তো তোর ভুল হয়েছিল। ইমানই তো তোকে সেই একাউন্ট দিয়েছিল।”

“আরেহ, ওর এতো বড় রাইটার হওয়ার যোগ্যতা আছে? আহনাফ তো ইউনিভার্সিটির লেকচারার।”

“কিন্তু আজকাল সবাই লেখালেখি করে পরিচিতি পেয়ে যায়। হয়তো তুই ভুল বুঝেছিস।”

অরুণিকা একের পর এক সব চিঠি ছিঁড়ে ফেলে দিল। চেঁচিয়ে বলল, “আমি আবার ঠকেছি। এবার ভাগ্য আমাকে ঠকিয়েছি। বাঁশ খেয়েছি আমি। ভেবেছি, আহনাফই আমার জীবনের সেই স্পেশাল মানুষ, যাকে আমি চাই।”

“কিন্তু ইমান…”

“ইমান, ইমান, ইমান। হ্যাঁ, আমার হিমালয়কে ভালো লাগতো৷ আমি দুর্বল ছিলাম উনার প্রতি। কিন্তু ভালোবাসার কোনো ইচ্ছে ছিল না। জাস্ট মায়া ছিল। কিন্তু যখন ভেবেছি হিমালয় আহনাফ হতে পারে, তখনই হৃদয় উজাড় করে স্বপ্ন দেখেছি। ভালোবেসে ফেলেছিলাম হিমালয়কে। কিন্তু এখন আর না। আমি হিমালয়, ইমান কাউকেই চাই না। আমার কাউকে লাগবে না। আমার জন্য ভালোবাসা আসেই নি।”

“কি বলবো আমি তোকে? আমি নিজেই কনফিউজড।”

অরুণিকা হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কাঁদছে। রুহানি বলল, “একবার আহনাফ স্যারকে জিজ্ঞেস করে দেখ।”

অরুণিকা দ্রুত চোখ মুছে বলল, “ঠিক বলেছিস। হয়তো ইমান মিথ্যে বলছে। আমার আহনাফকে জিজ্ঞেস করা উচিত।”

এই বলে অরুণিকা মুখ ধুয়ে কাপড় পালটে উপরে চলে গেল। বেল দিতেই দরজা খুললো ইমন। অরুণিকা সোজা ঘরে ঢুকে এদিক-ওদিক খুঁজতে লাগলো আহনাফকে। ইমন ব্যস্ত কন্ঠে বলল, “কি রে, অরু? কাকে খুঁজছিস?”

“আহনাফ কোথায়?”

“কিছু হয়েছে?”

“না। ও কোথায়?”

“রুমে।”

অরুণিকা আহনাফের রুমের দরজায় ধাক্কা দিতে লাগলো। শব্দ শুনে তূর্য আর ইভান বেরিয়ে এলো৷ আরাফ আর তাহমিদ বাসায় ছিল না তখন। আহনাফ দরজা খুলতেই অরুণিকাকে দেখে চমকে উঠলো। অরুণিকা ভেতরে ঢুকে বলল, “একটা কথা জিজ্ঞেস করতে এসেছি। এরপর চলে যাবো। আর কখনো কিছুই জানতে চাইবো না।”

“কি কথা!”

“তুমিই কি সেই হিমালয়?”

আহনাফ চমকে উঠলো অরুণিকার কথায়। এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল, “কি অদ্ভুত প্রশ্ন!”

“আমার দিকে তাকাচ্ছো না কেন?”

আহনাফ অরুণিকার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি কেন হিমালয় হতে যাবো?”

“তুমি সেই রাইটার হিমালয় নও?”

“না।”

“সত্য বলো প্লিজ।”

“না।”

“তাহলে তোমার কাছে সেই কাঠের কলম কীভাবে এলো?”

“কাঠের কলম দোকানেই পাওয়া যায়।”

“আমি তো কখনো দেখি না। তুমি কিছু লুকাচ্ছো না তো!”

আহনাফ বিরক্তির সুরে বলল, “কি সমস্যা তোর?”

অরুণিকা স্থির দৃষ্টিতে আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমিই ভুল ছিলাম। আমি ভেবেছি তুমি হিমালয়।”

“কেন ভেবেছিস?”

“জানি না।”

আহনাফ কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “আমি হিমালয় হলে কি.. কি করবি?”

অরুণিকা চোখ ছোট করে বলল, “খুন করবো।”

আহনাফ হেসে বলল, “পুলিশ ধরবে তোকে। সে অনেক বড় লেখক।”

“তুমি তো সেই মানুষ নও। তাহলে পুলিশ ধরবে কেন?”

“আমি হিমালয় হলে আমাকে খুন করতি?”

অরুণিকা দাঁত কটমট করে বলল, “হ্যাঁ।”

“হিমালয় বেঁচে গেছে তাহলে। কিন্তু তুই হঠাৎ এমন প্রশ্ন করলি কেন?”

“এমনি। আর তোমার মতো মানুষের কাছে এমনিতেও কিছু আশা করা যায় না।”

আহনাফ মলিন মুখে বলল, “হুম, সরি। আমি কি তোকে আবার কোনো কষ্ট দিয়েছি? আমি কিন্তু চেষ্টা করছি তোকে ভালো রাখার।”

“তোমার আমাকে ভালো রাখতে হবে না। আমার ভালো থাকার জন্য কোনো পুরুষ মানুষেরই দরকার নেই।”

“ইমান তোকে ভালোবাসে হয়তো।”

“আমি ভালোবাসার দেবী না যে সবাইকে ভালোবাসা বিলিয়ে যাবো।”

এই বলে অরুণিকা হনহনিয়ে চলে গেল। অরুণিকা চলে যেতেই তূর্য রুমে ঢুকে জিজ্ঞেস করলো, “কি বলতে এলো?”

“হিমালয় কে জিজ্ঞেস করেছে।”

“তুই কি বলেছিস?”

“বললাম, জানি না।”

তূর্য ভ্রূ কুঁচকে বলল, “গাঁধা একটা।”

“থ্যাংক ইউ।”

(***)

মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল আহনাফের। অনেক কষ্ট করে বালিশ থেকে মাথা তুলে বসলো সে। চোখ-মুখ কুঁচকে রেখেছে আহনাফ। ধীর পায়ে বিছানা থেকে নামতে গিয়ে মেঝেতে পড়ে গেল সে। বুকে হাত দিয়ে কাতরাতে লাগলো। শব্দ শুনে পাশের রুম থেকে আরাফ আর তূর্য ছুটে এলো। আহনাফের রুমে ঢুকে দেখলো সে মেঝেতে শুয়ে ছটফট করছে। আরাফ তাকে টেনে উঠালো। তূর্য ব্যস্ত হয়ে বাকীদের ডেকে আনলো। তারা দ্রুত ঘরে এসে দেখলো আহনাফ জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। তাহমিদ এসির তাপমাত্রা কমিয়ে দিল। আহনাফ ঘামাচ্ছে অনর্থক। আরাফ তার পিঠে মালিশ করছে। ইভান দ্রুত পানি নিয়ে এলো। আহনাফ সরিয়ে দিল সেই গ্লাস। সে দু’হাতে ভর দিয়ে বসে আছে। চোখ বন্ধ করে রেখেছে সে। ইমন বলল, “কেমন লাগছে তোর?”

আহনাফ গলা ধরে রেখেছে। তার চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে। সে অনেক কষ্ট করেও মুখ থেকে শব্দ বের করতে পারলো না। ইশারায় বলতে লাগলো, তার ভালো লাগছে না। আহনাফ নিজের চুল খামচে ধরে রেখেছে। আরাফ কিছু বুঝতে না পেরে তার সিনিয়র ডাক্তারকে কল করলো। তিনি জানালেন, টেস্ট না করে কিছুই বলা যাবে।

প্রায় বিশ মিনিট ধরে ছটফট করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়লো আহনাফ। বাকি পাঁচজন সারারাত তার পাশেই বসে ছিল।

সকালে আহনাফকে নিয়ে তাহমিদ আর আরাফ চলে গেল টেস্ট করাতে। যাবতীয় সব টেস্ট করানো শেষে তাহমিদ আহনাফকে নিয়ে বাসায় ফিরলো। ইমন অর্ধবেলা অফিস করে চলে এসেছে। ইভানও ক্যাম্পাস থেকে ছুটি নিয়েছে। তূর্য আজ অফিস, স্টুডিও, ক্যাম্পাস কোথাও যায় নি। উপমাকেও ঘরের বাইরে থেকে বিদায় করে দিয়েছে সে।

রাত দশটায় আরাফ সব ক’টা রিপোর্ট নিয়েই ফিরলো। সবাই চিন্তিত মুখে বসে আছে। আরাফ ঢুকতেই তারা প্রশ্ন করতে লাগলো, “কি সমস্যা? কি হয়েছিল?”

আরাফ শান্ত স্বরে বলল, “সব রিপোর্ট নরমাল। কোনো সমস্যা নেই।”

তূর্য ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তাহলে ও এমন করলো কেন?”

তাহমিদ হঠাৎ ফোন নিয়ে বারান্দায় চলে গেল। মিনিট দশেক পর বসার করে এসে সোফায় বসে বলল, “আমার যা মনে হচ্ছে, যদি সেটাই হয়?”

সবাই ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কি!”

“ওর উপর কি কোনো ব্ল্যাক ম্যাজিক করা হয়েছে?”

তূর্য বলল, “শিরিন সুলতানা!”

ইভান বলল, “এক সপ্তাহ আগেই তো প্রথম তালাক হয়ে গেছে। আরো দু’মাস বাকি। আমি তো এসবে বিশ্বাসই করতাম না। বাট ওই মহিলার পক্ষে এসব করা অসম্ভব কিছু না। কি করবি এখন?”

ইমন গুগল সার্চ করে বলল, “ভাই, এসবের সাইড ইফেক্টে মানুষ মরেই যায়। আহনাফের কিছু হয়ে গেলে?”

আরাফ বলল, “দাদার একজন বন্ধু আছে। উনার এসবের নলেজ ভালো। আমি এক্ষুণি গিয়ে দাদাকে এসব জানাবো। তাহমিদ, চল আমার সাথে। তোরা থাক আহুর সাথে। আমরা একদিনও সময় নষ্ট করতে পারবো না।”

(***)

টিউশন থেকে ফেরার পথেই ইমানের মুখোমুখি হলো অরুণিকা। ইমানকে দেখেই পাশ কেটে যাওয়ার সময় ইমান তার হাত ধরে বলল, “আমাকে ইগ্নোর করছো কেন?”

অরুণিকা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল, “তো আপনাকে মাথায় তুলে নাচবো?”

“তুমি তো এমন ছিলে না!”

অরুণিকা ধরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কাঠের কলমটি কোথায় পেয়েছেন?”

ইমান ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কাঠের কলম!”

অরুণিকা ফোন ঘেঁটে হিমালয়ের ইন্সটাগ্রাম থেকে সেই কলমের ছবি বের করে বলল, “এটা!”

“এটা কাস্টমাইজ করে বানিয়েছি আমি।”

“দেখাতে পারবেন?”

“পারবো। কিন্তু এই মুহূর্তে হাতে নেই। আগামীকাল নিয়ে আসবো।”

অরুণিকা ইমানের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি আপনাকে পছন্দ করি না।”

“কিন্তু তুমি হিমালয়কে ভালোবাসো।”

“আমি ভেবেছি, সে অন্য কেউ।”

“কাকে হিমালয় ভেবেছিলে?”

“আহনাফকে!”

ইমান ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তুমি কীভাবে ওই মানুষটাকে হিমালয় ভেবেছো, যে তোমাকে এতো আঘাত করেছে?”

“আপনাকে কে বলেছে?”

“তুমিই আমাকে বলেছো। এজন্যই তো আমি লোক পাঠিয়ে আহনাফকে মার খাওয়ালাম।”

অরুণিকা স্তব্ধ হয়ে ইমানের দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখ ছলছল করে উঠলো। ইমান অরুণিকার হাত ধরতেই সে এক ঝটকায় তার হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, “আমি আপনাকে ভালোবাসি না। আমি যদি জানতাম, আপনি হিমালয়, আমি কখনো আপনার সাথে কথা বলতাম না। আমি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি।”

“এভাবে কেন বলছো?”

“আমার মধ্যে কি হচ্ছে আপনাকে বোঝাতে পারবো না আমি। যখন থেকে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হয়, আহনাফ সেই প্রথম মানুষ যাকে আমি ভালোবেসেছিলাম। পরিস্থিতির কারণে আমাদের বিয়ে হয়েছিল ঠিকই কিন্তু আমার কাছে আহনাফ অনেক স্পেশাল, অনেক শখের মানুষ হয়ে গিয়েছিল। একদিন আমার ষোলো বছর বয়সের প্রথম প্রেম আহনাফ চৌধুরী হঠাৎ বিনা নোটিশে আমার মন ভেঙে দেয়। আমি তবুও তার মায়া কাটাতে পারি না। অভিমান ছিল মনে। তবে তখনও আমার আত্মসম্মানবোধ জন্মে নি। অল্প বয়সী আমি আত্মসম্মানের আ ও জানতাম না। বুঝতাম না অপমানিত হলে মুখ উঠিয়ে কাছে যেতে নেই। আমি আবার তাকে বিশ্বাস করতে চেয়েছি। কিন্তু সে আমাকে আবার ঠকিয়েছি। এরপর আমি মন থেকে কঠিন হয়ে যাই। আমার আত্মসম্মানবোধ আমার ভালোবাসার উপরে জয় লাভ করে। আমার ইগো আমার কাছে সবকিছুর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। আর তখনই আমার এলোমেলো জীবনে হিমালয় এমন এক অদৃশ্য মানুষ হয়ে এসেছিল, যার লেখায় আমি কেন যেন নিজেকেই খুঁজে পেতাম। আমি ধীরে ধীরে তার লেখার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ি। তার প্রতি অদৃশ্য টান কাজ করা শুরু করে আমার। ভালো লাগার জায়গাটা ধরে নেয় সে। কিন্তু যখন আহনাফের চেহারা চোখের সামনে আসে, আমি থামিয়ে দেই নিজেকে। একটা মানুষ কি একসাথে দু’জনকে ভালোবাসতে পারে? না, পারে না। এটা অসম্ভব। একদম অসম্ভব। তাই আমি নিজের মনকে শান্ত করার জন্য আহনাফকে ঠিক একই আঘাত করেছি। কিন্তু তবুও ক্ষণিকের প্রশান্তিই পেয়েছি। রাত বাড়লে আবার সেই পুরোনো মায়া আমাকে দুর্বল করে দেয়। আহনাফ আমার ছোটবেলার আবেগ ছিল। আমার ভালোবাসা ছিল না। ভালো তো আমি বেসেছি যখন হিমালয় চিঠি লিখে হারিয়ে গিয়েছিল। আর আহনাফ তিন মাসের জন্য আমার চোখের সামনে থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল। আমি অনুভব করেছি, হিমালয়ের লেখায় আমি আহনাফকে খুঁজে পাচ্ছি। আমাদের সম্পর্কের অবনতির ধাপগুলোর আক্ষেপ, যন্ত্রণা, তার প্রতিটি সনেটে আমাকে ব্যাখ্যা করা, আমি এসবে আহনাফকে দেখেছি। এ কেমন ভালোবেসেছি আমি? যেখানে মানুষ একজন, কিন্তু আমি কল্পনা করেছি অন্য আরেকজনকে। আমি ফ্যান্টাসিতে ছিলাম। আমি আহনাফকে হিমালয় রূপে চেয়েছি। অন্য কাউকে হিমালয় হিসেবে চাই নি। দু’জনের ব্যক্তিত্ব আলাদা৷ অথচ আমি বোকার মতো আহনাফকে হিমালয় ভেবে বসে আছি।”

ইমান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তুমি হিমালয়কে ভালোবাসো নি। তুমি হিমালয়ের ব্যক্তিত্ব, তার ব্যবহার, তার মানবিক সত্তাটাকে ভালোবেসেছো। আর আহনাফ স্যারের ব্যক্তিত্ব, আচরণ, সত্তাকে তুমি ভালোবাসতে পারো নি। তুমি শুধু তাকে চেয়েছো। আহনাফ স্যার তোমার অভ্যাস। অভ্যাস ভালোও হতে পারে, খারাপও হতে পারে। তাই হয়তো তুমি চাইলেও মন থেকে মুভ অন কর‍তে পারবে না। আর হিমালয় তোমার প্রশান্তিময় অনুভূতি। আর তুমি অভ্যাস ছেড়ে প্রশান্তিকেও ধরতে পারছো না।”

“আমাকে মাফ করবেন। আমার অনুরোধ, আপনি কখনো আমার সাথে যোগাযোগ করবেন না। আমাদের পরিচয় শুধুই ক্যাম্পাসের সিনিয়র জুনিয়র হিসেবে। এর বেশি আমার মনে আপনি কোথাও নেই। আমি ভেবে নেবো, হিমালয় এবছরের রিক্ততার সাথে হারিয়ে গেছে। আর পুরোটাই স্বপ্ন ছিল।”

“তুমি সত্যিই ভালো থাকবে?”

“এই যে আপনি বললেন, হিমালয় আমার প্রশান্তি! প্রশান্তি ছাড়া থাকা যায়। কিন্তু অভ্যাস ছেড়ে থাকা যায় না। অভ্যাস ছাড়লে তো শান্তিই পাওয়া যায় না। আমার ভাগ্যে শান্তিই নেই।”

“এখন তুমি কি আহনাফ স্যারের সাথে সব ঠিক করে ফেলতে চাও?”

“না। তবে ভেবেছিলাম, সব ঠিক করে নেবো। কিন্তু এখন আর না। সেই মানুষটা আমাকে এতো আঘাত করার পরও একটু ঠিকভাবে আগলে নিতে জানলো না। সে হিমালয় হলে ভাবতাম, সে পেরেছে। আবার আমাকে মায়ায় বাঁধতে পেরেছে। কিন্তু সে তো আহনাফই। তাকে আবার বিশ্বাস করার মতো কোনো স্ট্রং রিজন তো সে আমাকে দিতে পারে নি। আমি চতুর্থ বার ঠকতে চাই না। ভাগ্য আমাকে তৃতীয় বার ঠকিয়েছে। এই পৃথিবীতে আমার মতো ভয়ংকরভাবে কেউ হয়তো ঠকে নি।”

এই বলে অরুণিকা চলে গেল। ইমান অসহায় দৃষ্টিতে অরুণিকার যাওয়ার পানে তাকিয়ে বলল, “আমি কি এটা ঠিক করেছি? নিজের স্বার্থের জন্য আমি একটা মিষ্টি অনুভূতি ধ্বংস করে দিয়েছি।”

চলবে-