#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব- ৫৪ (১ম ভাগ) ||
ভীত দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছে রুহানি। তার চোখ বেয়ে দরদর করে জল গড়িয়ে পড়ছে। পুরো শরীর ঘামে ভিজে গেছে। মাথার চুল এলোমেলো। জবুথবু হয়ে বসে আছে সে। বুকের সাথে চেপে ধরেছে তার ট্রান্সপারেন্ট ফাইল। আজ তার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার শেষ দিন ছিল। পরীক্ষা দিয়ে বাসায় ফেরার পথে এতোদিন তার কলেজ গেটে দাঁড়িয়ে থাকা সেই বখাটেরা তাকে টেনেহিঁচড়ে একটা মাইক্রো বাসে উঠিয়ে নিয়ে চলে গেল। রাস্তায় এতো অভিভাবক, এতো মানুষ কিন্তু কেউ সাহস করে এগিয়ে আসতে পারলো না। বোর্ড পরীক্ষা ছিল বিধায় বাসা থেকে ফোন নিয়েও বের হয় নি সে। এই মুহূর্তে একটা অন্ধকার ঘরে বসে আছে রুহানি। ছিঁটেফোঁটা আলোও যেই ঘরে প্রবেশ করছে না। এদিকে রুহানির পরিচিত সহপাঠীরা দেখেছিল তাকে উঠিয়ে নিতে। তারা বাসায় এসে খবর দিতেই আতকিয়া জাহান মেঝেতে শুয়ে বিলাপ করছেন। অরুণিকার শরীরের সব শক্তি যেন উবে গেছে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে গিয়েই হোঁচট খেয়ে পড়লো। হামাগুড়ি দিয়ে দু’ধাপ উঠে, আবার দেয়াল ধরে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। তারপর উপরে উঠে বেল বাজাতে লাগলো একের পর এক। একনাগাড়ে বেল বেজে যাচ্ছে। ঘরে থাকা ছ’যুবকের মেজাজ বিগড়ে গেল। আহনাফ বিরক্তমুখে দরজা খুলে অবাক হয়ে গেল অরুণিকাকে দেখে। ব্যস্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “তুই এভাবে হাঁপাচ্ছিস কেন?”
অরুণিকা কান্নাভেজা কন্ঠে বলল, “প্লিজ হ্যাল্প করো।”
“বল, কি হয়েছে?”
বাকিরাও দরজার কাছে ছুটে এলো। এদিকে নিচ তলা থেকে কান্নার শব্দ শুনে আরাফ বেরিয়ে সিঁড়ির কাছে এসে বলল, “তোর মামী কাঁদছে কেন? কি হয়েছে?”
রুদবাও দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। অরুণিকাকে কাঁদতে দেখে বলল, “কি রে, অরু? কি হলো?”
অরুণিকা কাঁপা কন্ঠে বলল, “রুহানিকে কারা যেন তুলে নিয়ে গেছে। ওর ক্লাসমেটরা এসে বলল।”
আরাফ অবাক হয়ে সেকেন্ড খানিক তাকিয়ে রইল অরুণিকার দিকে। এরপর দ্রুত ঘরে ঢুকে ফোন আর মোটর সাইকেলের চাবি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। তার পিছু পিছু তূর্য, ইমন আর তাহমিদও বেরিয়েছে। আহনাফ অরুণিকার কাঁধে হাত রাখতে গিয়েই থেমে গেল। রুদবা ভ্রূ কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে রইল। আহনাফ ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “কিছু হবে না, অরু।”
অরুণিকা মাথা চেপে ধরে মেঝেতে বসে বলল, “কীভাবে কিছু হবে না? ও বোকা একটা মেয়ে! ও তো নিজেকে সেইভও করতে জানবে না।”
রুদবা অরুণিকাকে টেনে উঠিয়ে বলল, “চল, নিচে গিয়ে দেখি কি হয়েছে। মামীর পাশে থাকতে হবে এখন। তোর কাজিন ভাই তো গেল রুহানিকে খুঁজতে।”
রুদবা ধরে ধরে সিঁড়ি দিয়ে নামালো অরুণিকাকে। এদিকে রুহানির ক্লাসমেট দু’জন আর তাদের অভিভাবক দরজার কাছে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। আরাফ তাদের প্রশ্নের উপর প্রশ্ন করে যাচ্ছে। ইভান ও আহনাফ নিচে নেমে আসতেই আরাফ বেরিয়ে এলো রুহানিদের বাসা থেকে। বাকিরা সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে ছিল। তারা আরাফকে দেখেই প্রশ্ন করলো, “কিছু জানতে পারলি?”
আরাফ গম্ভীরমুখে বলল, “আমি জানি এটা কে করেছে।”
“কে?”
“রুহানিকে কিছু বখাটে ছেলে বিরক্ত করতো কলেজের সামনে।”
“তাই বলে তুলে নিয়ে যাবে? এতো সাহস!”
“রুহানি ওদের মধ্যে কাকে যেন চেহারা নিয়ে আজেবাজে কথা বলেছিল। রুহানি নিজেই আমাকে এই কথা বলেছিল। আমার মনে হচ্ছে এজন্যই তুলে নিয়ে গেছে।”
ইভান বলল, “পুলিশকে জানাতে হবে।”
অরুণিকাকে ইশারায় ডাকলো আহনাফ। অরুণিকা বেরিয়ে আসতেই তাহমিদ বলল, “আমার সাথে চল। তোর মামীকে রেডি হতে বল। থানায় যাবো। কেইস করতে হবে।”
অরুণিকা মাথা নেড়ে দ্রুত ঢুকে পড়লো বাসায়। আতকিয়া জাহানকে টেনে উঠালো রুদবা আর একজন মহিলা প্রতিবেশী। অরুণিকা বোরকা এনে মামীকে পরিয়ে দিল। তিনি উড়না কোনোমতে মাথায় পেঁচিয়ে ঘর থেকে বের হলেন। ঠিকমতো হাঁটতেও পারছেন না তিনি। একমাত্র মেয়ে তাদের। তার মনে কি চলছে একমাত্র তিনিই জানেন। অরুণিকা ঘরে গ্যাস, বাতি বন্ধ আছে কি-না দেখে তালা লাগিয়ে বের হলো। আতকিয়া জাহান এলোমেলো ভাবে হাঁটতে গিয়ে হুমড়ি খাবেন, এমন সময় আরাফ তার হাত ধরে ফেলল। আতকিয়া জাহান অসহায় দৃষ্টিতে আরাফের দিকে তাকালেন। আরাফ মাথা নিচু করে বলল, “আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখুন। রুহানির কিছু হবে না।”
তাহমিদ তার মোটর সাইকেল নিল না। সিএনজি ভাড়া করে অরুণিকা আর আতকিয়া জাহানকে নিয়ে চলে গেল থানার উদ্দেশ্যে। আহনাফ দ্রুত উপরে উঠে মোটর সাইকেলের চাবি নিয়ে তাহমিদের সিএনজির পিছু পিছু গেল। এদিকে আরাফও নিজের মোটর সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। তূর্যও তার পিছু পিছু গেল।
ইমন ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল, “কি হচ্ছে এসব! কুফা লাগছে মনে হচ্ছে।”
ইভান বলল, “তুই ঘরে তালা মেরে আয়। আমার বাইকের চাবিটাও নিয়ে আসিস। থানায় যাই চল।”
(***)
দু’দিন হলো রুহানির কোনো খোঁজ নেই। রুহানির বাবা শাহবাজ খান দেশে ফিরেছেন। অনেক চেষ্টা করেও মেয়েকে খুঁজে না পেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তিনি। আরাফ ও তার বন্ধুরা নিজেদের জায়গা থেকে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করছে। পুলিশের তদন্তও বাদ যায় নি। অরুণিকার অনুরোধে বড় চৌধুরী সাহেব মামলাটা বিশেষভাবে দেখার জন্য তার এক ডিআইজি বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করেছেন। সিসিটিভি ফুটেজে অপহরণকারীদের গাড়ির নম্বর, তাদের পরিচয় শনাক্ত করা গেছে। সবাই আপতত নিঁখোজ।
শাহবাজ খানের ঘরে এই মুহূর্তে শোকের ছায়া নেমেছে। অরুণিকা গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে রুহানির অপেক্ষায়৷ হঠাৎ ইমানের কন্ঠ শুনে চোখ মুছে পাশ ফিরলো সে। অরুণিকার মাথায় কাপড়। নামাজ পড়ে উঠেছে বেশ বোঝা যাচ্ছে। পবিত্র আর মায়াবী তার চাহনি। ইমান মুগ্ধ হয়ে দেখছে তাকে। অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কিছু বলার আছে আপনার?”
ইমান স্মিত হেসে বলল, “তোমার ঠোঁটে এই মলিনতা মানায় না। আমার অধিকার থাকলে আমি তোমার মন ভালো করার জন্য যা যা সম্ভব, করতাম।”
“প্লিজ, এই মুহূর্তে আপনার ঢংয়ের কথা আমাকে শোনাবেন না। আমার বোনকে পাওয়া যাচ্ছে না, আর আপনি আছেন আপনার ন্যাকামি নিয়ে।”
ইমান ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “হিমালয়ের সাথে কি এভাবে কথা বলতে পারতে তুমি?”
অরুণিকা চোখ-মুখ কুঁচকে তাকালো ইমানের দিকে। তখনই আহনাফের মোটর সাইকেল থামলো গেটের কাছে। আহনাফ হেলমেটের গ্লাস তুলে ইমানের দিকে তাকালো। ইমান সালাম দিয়ে সরে পড়লো। আহনাফ গেট খুলে নিঃশব্দে তার মোটর সাইকেল ঢুকিয়ে পিছু ফিরে দেখলো, অরুণিকা এখনো গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে শূন্য দৃষ্টিতে গলির পথের দিকে তাকিয়ে আছে। আহনাফ তার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “কারো অপেক্ষায় থাকার সময়টা বেশ দীর্ঘ হয়, আমি জানি। কিন্তু এভাবে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা কোনো সমাধান না। তুই নিজের চেহারার কি অবস্থা করেছিস দেখ!”
আহনাফের দিকে তাকালো অরুণিকা। তার চোখ ভেজা। আহনাফ আলতো হাতে তার চোখ মুছে দিয়ে বলল, “তুই অনেক ভালো একটা মেয়ে। তুই আল্লাহর কাছে যা চাইবি, সব পূরণ হবে। তোর বোন ফিরে আসবে দেখিস।”
অরুণিকার চোখের জলের ঘনত্ব আরো বাড়লো। মনে মনে বলল, “হিমালয়ের ব্যক্তিত্বের সাথে আহনাফের অনেক মিল। মানুষটা জানে কখন কী বলতে হয়৷ কি সুন্দর করে আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছে৷ আর ইমান? এমন মুহূর্তেও তার প্রেমের ডায়লগ বন্ধ হয় নি। কীভাবে সে হিমালয় হয়? কিন্তু সত্য তো এটাই যে সেই-ই হিমালয়! নয়তো হিমালয়ের সাথে আমার কি কি কথা হয়েছে সব কীভাবে জানলো ইমান? সে হিমালয় দেখেই সব জেনেছে।”
আহনাফ অরুণিকার কাঁধে হাত রেখে বলল, “তুই ভেতরে যা৷ আমি তোর হয়ে দাঁড়াই। রুহানিকে দেখলে আমি তোকে ডাক দেবো।”
অরুণিকা অবাক হয়ে আহনাফের দিকে তাকিয়ে রইল। আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “কি ভাবছিস?”
অরুণিকা হুট করে কোনো উত্তর না দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো। আর আহনাফ তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল।
(***)
অপহরণের তৃতীয় দিনের মাথায় পুলিশ অপহরণকারীদের খোঁজ পেল। মামলা করার সময় তাহমিদ আর আতকিয়া জাহানের ফোন নম্বরটি দেওয়া হয়েছিল। আতকিয়া জাহানকে ফোনে না পেয়ে তাহমিদকে ফোন করে পুলিশ সদস্য রুহানির ব্যাপারে জানালো। তাহমিদ, আরাফ আর আহনাফ চৌধুরী ম্যানশনে এসেছিল জরুরি কাজে। তারা সেখান থেকে মোটর সাইকেল নিয়ে পুলিশের বলা ঠিকানায় চলে গেল। দক্ষিণ খুলশির ভেতরের এক গলিতে তাদের দেখা গিয়েছিল। পুলিশ যেতে না যেতেই তারা উধাও। আরাফ, তাহমিদ আর আহনাফ থামলো একটি ফাঁকা দু’তলা বাড়ির সামনে। দেখে মনে হচ্ছে পরিত্যক্ত। পুলিশের সদস্য বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। এক মহিলা কন্সটেবল ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, “ভেতরে একটা মেয়ে আছে। খুব খারাপ অবস্থা। মনে হচ্ছে রেইপ হয়েছে।”
আরাফের পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে গেল। সে ধীর পায়ে হেঁটে সাহস নিয়ে দু’তলা বাড়ির ভেতর ঢুকলো। তার পা দু’টি অসার হয়ে আসছে। অজানা কারণে সে হাঁটতে পারছে না। সে ধীর পায়ে নিচতলার ঘরটির সামনে এসে দাঁড়ালো। মেয়েটির গায়ে চাদর জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আরাফ মেয়েটির চেহারা দেখতে পারছে না। মহিলা কনস্টেবল মেয়েটিকে ঘিরে বসেছে। আরাফকে দেখে একজন বললেন, “স্যার আপনি বাইরে যান।”
আরাফ মাথা নেড়ে বলল, “মেয়েটার পরিচয় পেয়েছেন?”
রুহানি আরাফের কন্ঠ শুনে চোখ বড় বড় করে তাকালো। সে দ্রুত গায়ে জড়ানোর চাদর দিয়ে তার মুখ ঢেকে নিল। হঠাৎ আরাফের চোখ গেল মেঝের ফাইলের দিকে। আরাফ সেকেন্ডের মধ্যে চোখ সরিয়ে নিল। আর দ্রুত বেরিয়ে এলো ঘরটি থেকে। তাহমিদ আরাফকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, “মেয়েটা কি রুহানি?”
আরাফ এক দৃষ্টিতে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। তাহমিদ আহনাফের দিকে তাকালো। আর আহনাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে একপাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
মিনিট দশেক পর এম্বুলেন্স এলো। রুহানিকে হাসপাতালে নিতে হবে। কিন্তু সে কোনোভাবেই যাবে না। সে মাটিতে বসে আছে জড়োসড়ো হয়ে। সে মাথা নেড়ে বারংবার বলতে লাগল, “আমি কোথাও যাবো না। আমি কারো সামনে যাবো না। প্লিজ, কাউকে আমার পরিচয় দেবেন না।”
মহিলা কন্সটেবল দু’জন অনেক বুঝিয়েও রুহানিকে স্ট্রেচারে উঠাতে পারলো না। তাদের মধ্যে একজন বাইরে এসে দায়িত্বরত অফিসারকে বললেন, “স্যার, ভিক্টিম তো আমাদের সাথে কো-অপারেট করছে না। জেদ ধরে বসে আছে। তার পরিচিত কেউ আসলে বোধহয় ভালো হবে। ইনারা তো পুরুষ।”
আহনাফ দ্রুত অরুণিকার নম্বরে ডায়াল করলো। অরুণিকা নামাজে বসে আছে। ফোন সাইলেন্ট। সে আহনাফের কল ধরতে পারলো না। এদিকে আতকিয়া জাহানের ফোন বন্ধ। তিনি কাঁদতে কাঁদতেই অস্থির। ফোন খোলা না বন্ধ সেদিকে হুঁশ নেই তার।
আহনাফ আরাফের কাছে এসে বলল, “অরু তো কল ধরছে না।”
আরাফ এবার পুলিশ অফিসারটির কাছে এসে বলল, “আমি যেতে পারবো?”
“আপনি উনার কে হোন?”
তাহমিদ বলল, “ফিয়োন্সে। ওদের এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে।”
আরাফ চমকে তাকালো তাহমিদের দিকে। আরাফের চাহনি দেখে অফিসারটি বুঝতে পারলেন তাহমিদ মিথ্যে বলেছে। তবুও সময় নষ্ট করার ইচ্ছে নেই তাদের। তাই আরাফকে দেখা করার অনুমতি দেওয়া হলো।
(***)
আরাফ ধীর পায়ে ভেতরে ঢুকলো। রুহানি চাদরের ফাঁকে আরাফকে আসতে দেখে তার মুখটা আরো ভালোভাবে ঢেকে নিল। আরাফ রুহানির পাশে হাঁটু ভাজ করে বসে বলল, “চলো, রুহানি। তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। এম্বুলেন্স এসে গেছে।”
রুহানি নিঃশব্দে না সূচক মাথা নাড়লো। আরাফ বলল, “কেন যাবে না?”
রুহানি ধরা গলায় বলল, “আমি রুহানি না।”
আরাফ চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এরপর চাদরের উপর রুহানির হাত ধরে বলল, “এটা একটা এক্সিডেন্ট।”
“না। এটা এক্সিডেন্ট না।”
“তোমার জন্য অরু, তোমার মা অপেক্ষা করছে। তোমার বাবাও দেশে ফিরেছে।”
রুহানি চমকে মুখ তুলে তাকালো। ব্যস্ত হয়ে আরাফের হাত ধরে বলল, “স্যার, বাবাকে বলবেন না আমার সাথে কি হয়েছে। প্লিজ, অরু, মা ওরাও যাতে কিচ্ছু না জানে।”
“কি বলছো তুমি?”
“না, আগে আপনি আমাকে প্রমিজ করুন বাসার কেউ জানবে না, আমার সাথে কি হয়েছে।”
“এটা কীভাবে সম্ভব? তোমার সাথে যারা এই কাজ করেছে….”
রুহানি আরাফকে থামিয়ে দিয়ে ব্যস্ত কন্ঠে বলল, “কিচ্ছু করে নি। কেউ কিছু না।”
আরাফ স্তব্ধ হয়ে গেল রুহানির আচরণে। মেয়েটার চোখ-মুখে এই প্রথম ভয়ংকর ভীতি দেখেছে সে। মহিলা কন্সটেবলটির দিকে তাকালো আরাফ। মহিলাটি বললেন, “আপনি ভিক্টিমকে স্ট্রেচারে উঠতে বলুন, স্যার।”
রুহানি বিড়বিড় করে বলল, “আমি ভিক্টিম না। আমি ভিক্টিম না।”
কাঁদো কাঁদো কন্ঠে আরাফের হাত ধরে বলল, “আমি ভিক্টিম না। আমি এটাতে উঠবো না। আমি এভাবে হেঁটে বাসায় চলে যাবো। সবাইকে বলবো, আমি ফ্রেন্ডের বাসায় ছিলাম। কেউ জানবে না, আমার সাথে কি হয়েছে। আমি কাউকে বলবো না। সবাই জানলে আমাকে ঘৃণা করবে। প্লিজ স্যার, আমার হ্যাল্প করুন। আমি আর কখনো আপনাকে বিরক্ত করবো না। আপনার সাথে বেয়াদবি করবো না। আপনি শুধু আমাকেই এইটুকু হ্যাল্প করুন।”
আরাফের চোখ লাল হয়ে গেল। সে রুহানির হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। বাইরে এসে পুলিশ অফিসারের সাথে কিছু কথা বললো। তিনি মাথা নাড়ছেন একটু পরপর। আরাফ এবার তাহমিদ আর আহনাফকে থাকতে বলে তার মোটর সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। পাশের একটা মার্কেট থেকে রুহানির সাইজ আন্দাজ করে একটি সেলোয়ার, একটি ফতুয়া আর একটি উড়না কিনে নিলো। দশ মিনিটের মধ্যে ফিরে মহিলা কন্সটেবলের হাতে প্যাকেট দিয়ে বলল, “ওকে পরিয়ে দিন।”
এদিকে আরাফের কথায় এম্বুলেন্স চলে গেল। সে মোটর সাইকেলের চাবি আহনাফকে দিয়ে একটা সিএনজি ঠিক করলো। ওদিকে রুহানি জামা পরে কন্সটেবলের হাত ধরে বেরিয়ে এলো সেই ঘর থেকে। সে হাঁটতে পারছে না ঠিকভাবে। তাহমিদ আর আহনাফকে দেখে সে মহিলা কন্সটেবলের পেছনে নিজেকে আড়াল করে নিল। আহনাফ বুঝতে পেরে তাহমিদকে নিয়ে গলির বাইরে এসে দাঁড়ালো। এদিকে আরাফ রুহানিকে নিয়ে সিএনজিতে উঠলো। উদ্দেশ্য কাছের হাসপাতাল। তাদের সাথে মহিলা কন্সটেবলটিও উঠেছে। বাকিরা তাদের পিছু আসবে না। আরাফ নিষেধ করে দিয়েছে।
(***)
হাসপাতালে পৌঁছেই রুহানির চিকিৎসা শুরু হলো। আরাফের বিশেষ অনুরোধে পুলিশ টিম রুহানির খোঁজ তার বাবা-মাকে দিলেন না। তিনদিন পর রুহানি মোটামুটি সুস্থ হলো। মহিলা কন্সটেবলটি রুহানির সাথে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করলেন। রুহানি তাকে জানালো, অপহরণকারী মোট চারজন ছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে তিনজন তাকে ধর্ষণ করেছিল। অন্য একজন প্রথম দিন এসেছিল। অপহরণে সাহায্য করা তার উদ্দেশ্য ছিল। সে ধর্ষকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চলে গিয়েছিল। আর বাকিরা টানা তিনদিন অনেক বার তাকে ধর্ষণ করেছিল।
মহিলা কন্সটেবলটি আরাফকে সব জানালো। এদিকে তিনদিন পর আরাফ তাকে দেখতে এলো। রুহানির পাশে বসলো সে। রুহানি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। আরাফ বলল, “তোমার বাবা-মাকে এখনো কিছুই জানাই নি আমি। এটা অন্যায় হচ্ছে। তুমি এখন সুস্থ হয়ে গেছো। ওদের সব জানাতে হবে।”
রুহানি উঠে বসতেই ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো। আরাফ ব্যস্ত হয়ে বলল, “তুমি শুয়ে থাকো।”
রুহানি মাথা নেড়ে বলল, “না স্যার, আমি এখন একদম সুস্থ। আপনি তো ডাক্তার হবেন। আপনি যা বলবেন, বাবা-মা ওটাই বিশ্বাস করবে। প্লিজ, ওদের বলবেন না আমার সাথে কি হয়েছে। আমি ওদের একটা মাত্র মেয়ে। ওরা মরে যাবে এসব শুনলে। আপনি বলবেন, ওরা আমাকে মেরেছিল, তাই আমি হাঁটতে পারছি না।”
“কি বলছো তুমি? যারা তোমার সাথে অন্যায় করেছে ওদের ছেড়ে দেওয়া সম্ভব না।”
“ওদের আল্লাহ শাস্তি দেবে। দেখবেন, আল্লাহই ওদের শাস্তি দেবে। কিন্তু সত্যটা সবাই জেনে গেলে এই পৃথিবীটাই আমার জন্য জাহান্নাম হয়ে যাবে। তখন ওই শয়তানগুলো শাস্তি পাক না পাক, আমি চরম শাস্তি পাবো। এমনিতেই আমার সব শেষ হয়ে গেছে। আমার বেঁচে থাকার কোনো দরকার নেই। কিন্তু আমার সাহসও নেই আত্মহত্যা করার৷”
আরাফ ধমকের সুরে বলল, “কি উল্টাপাল্টা কথা বলছো?”
“সত্যি বলছি, স্যার। আমি ভেবেছি ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। কিন্তু ওরা তো আমাকে মেরে যায় নি। এখন আমি কীভাবে বাঁচবো?”
রুহানি দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। এই কান্নার শব্দ সহ্য করতে পারছে না আরাফ৷ সে উঠে চলে গেল।
(***)
শাহবাজ খান, আতকিয়া জাহান এবং অরুণিকা রুহানিকে দেখতে এলো হাসপাতালে। রুহানি অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বাবা-মার দিকে। তারা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলেন। এদিকে আরাফের অনুরোধে দায়িত্বরত ডাক্তার রুহানির ব্যাপারে কিছুই জানালেন না তার অভিভাবককে। থানায় গিয়েও আরাফ অনুরোধ করলো ধর্ষণের ব্যাপারে যাতে শাহবাজ খান ও আতকিয়া জাহানকে জানানো না হয়। বড় চৌধুরী সাহেবের নাতি এই অনুরোধ করেছে, তাই অফিসার অনুরোধটি রাখলেন। যেখানে ভিক্টিম নিজেই ব্যাপারটা চাপাতে চাইছে, এখানে আর কার কি করার আছে? তবে মামলা বন্ধ করে নি আরাফ। রুহানির মিথ্যে বক্তব্য নেওয়া হয়েছে। চারজন তাকে অপহরণ করেছে, আর তিনজন লাঠি ও বেল্ট দিয়ে পিটিয়েছে। যদিও এই অদ্ভুত কথা কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না। একটা মেয়েকে অপহরণ করে তিন দিন আটকে রেখে শুধুই মারলো? অসম্ভব!
রুহানি বাসায় ফিরেছে এক সপ্তাহ হচ্ছে। আশেপাশের মহিলা প্রতিবেশীরা আতকিয়া জাহানকে বারংবার প্রশ্ন করছেন, “শুধুই কি মেরেছে?”
তিনি বেশ স্বস্তির সাথে উত্তর দিতে পারছেন। আর সবাইকে বলেছেন, এক বখাটে ছেলে তার মেয়েকে বিরক্ত করতো। তার মেয়ে একটু প্রতিবাদ করেছে, তাই ক্ষোভে পড়ে উঠিয়ে নিয়ে তাকে মেরেছে। তিনি মিথ্যে যে বলছেন না, তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু এই কথা নিতান্ত হাস্যকর মনে হচ্ছে অনেকের কাছে। তবে মেয়েটার যে বড় কোনো ক্ষতি হয় নি, এ নিয়ে প্রতিবেশিরা বেশ সন্তুষ্ট। রুহানির কেইস নেওয়া ডাক্তার, পুলিশ সদস্যরা আরাফের বক্তব্যই দিচ্ছে। তাই প্রতিবেশিরা আরো ভালোভাবে নিশ্চিত হয়েছে রুহানির সাথে খারাপ কিছু হয় নি। কিন্তু থেমে থাকে না নিন্দুকেরা। লোকের মুখে মুখে রটছে, “মেয়ে বেশি তিড়িংবিড়িং করে। কিছু হয় নি, তার মানে এই না যে সামনে হবে না। বখাটে ছেলেদের সাথে কথা বলতে কেন হচ্ছে তার? মার খেয়েছে তাও কি ভালো না-কি? মান-সম্মান তো ওখানেই শেষ। মেয়ের বিয়ে দিতে কষ্ট হবে। লোকে জানাবে তিন দিন, দুই রাত ঘরের বাইরে কাটিয়েছে তিনটা ছেলের সাথে। আমরা, দেখি তো মেয়ে ছাদে উঠে শাড়ি পরে তিড়িংবিড়িং করে।”
রুহানি কান চেপে ঘরে বসে আছে। এসব শোনার পর থেকে সে নিজের মনে বিড়বিড় করছে। আর একটু পর পর ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
(***)
বিকেলে অরুণিকা জোর করে রুহানিকে ছাদে নিয়ে গেল। আরাফরা তখন ছাদেই ছিল৷ দেখলো রুদবাও ছাদে আছে তার এক মেয়ে কাজিনের সাথে। রুহানি এতোগুলো মানুষ দেখে নেমে পড়তে যাবে, রুদবা এসে টেনে আনলো তাকে। রুহানি মাথা নিচু করে রেখেছে। রুদবা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “ভাই, তুই তো ফেমাস।”
রুহানি রুদবার দিকে তাকিয়ে চুপসে গেল। অরুণিকা রুদবাকে ইশারায় চুপ থাকতে বলল। রুদবা মুখ বাঁকিয়ে রুহানির হাত ধরে তাকে তাদের পাশে বসালো। এরপর রুদবা তার কাজিনকে বলল, “টুম্পা, এ হচ্ছে আমাদের এলাকার মিরাকল গার্ল। ওকে তিনদিন ধরে আটকে রেখেও মাস্তান সর্দার কিচ্ছু করে নি।”
অরুণিকা রাগী স্বরে বলল, “এটা কেমন কথা, রুদবা? তুই কি পাগল হয়ে গেছিস?”
“ভাই অরু, এটা আমার কথা না। এটা পাশের বাসার আন্টিদের কথা। রুহানি তো ফেমাস হয়ে গেছে। সবার মুখে মুখে রুহানি এন্ড রুহানি।”
আরাফের হাত মুঠো হয়ে এলো। সে দাঁতে দাঁত পিষে চাপা স্বরে বলল, “এই মেয়েটার কি মাথা ঠিক আছে? কিছু হলে বোধহয় ওরা বেশি খুশি হতো!”
এদিক রুদবা রুহানিকে বলল, “সরি রুহানি, মাইন্ড করিস না। আলহামদুলিল্লাহ তোর সাথে খারাপ কিছু হয় নি। কিন্তু মার খেলি তো! কি দরকার সব ছেলেদের জবাব দেওয়া? তোর মুখ একটু বেশি চলে। ওরা বিরক্ত করে চলে যেতো। তুই কেন বলতে গেলি, ওই মুখে কেউ পাত্তা দেবে না? এখন তোকেও তো মেরে মুখে দাগ করে দিয়েছে।”
রুহানি চমকে তাকালো রুদবার দিকে। আনমনে গালে হাত দিতেই মনে পড়লো বেল্টের আঘাত লেগেছিল তার মুখে। রুদবা পুনরায় বলল, “আমি, অরু, আমাদের কি কেউ বিরক্ত করে? আর আন্টিগুলো মিথ্যেও বলে নি। তুই প্রতি সপ্তাহে শাড়ি পরে ছাদে উঠে ঢং করিস। বৃষ্টি শুরু হলেই গা ভেজাতে চলে আসিস। ভেজা গায়ে কতো মানুষ তোকে দেখে খারাপ চিন্তা করে।”
রুহানি উঠে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে বারংবার বলতে লাগলো, “আমি আর পরবো না শাড়ি। আর কখনো পরবো না। কখনো পরবো না। কারো সাথে কথা বলবো না। চুপ থাকবো। একদম চুপ থাকবো।”
রুহানি অরুণিকার হাত ধরে কাঁপা কন্ঠে বলল, “আমি আর বৃষ্টিতেও ভিজবো না। তুই তো জানিস, আমি একটু বোকা। আমি এতোকিছু বুঝি নি। আমি আর কখনো বৃষ্টিতে ভিজবো না। বাসা থেকেও বের হবো না।”
এই বলে রুহানি দ্রুত ছাদ থেকে নেমে পড়লো। আর আরাফ নির্বাক তাকিয়ে রইল রুহানির যাওয়ার পানে। এদিকে রুদবা রুহানিকে চলে যেতে দেখে তূর্যের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি খারাপ কি বলেছি? ওকে বোঝানো আমাদের দায়িত্ব। আমরা ওর বড়। পরে যদি আবার এমন কিছু হয়?”
অরুণিকা অনেকক্ষণ সহ্য করে ছিল। কিন্তু আর পারলো না। রুদবার গালে সশব্দে চড় বসিয়ে দিল সে। রুদবা গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল সেকেন্ড খানিক৷ রুদবার কাজিন টুম্পা অরুণিকার উপর চেঁচিয়ে বলল, “এই মেয়ে, তুমি ওর গায়ে হাত তুলেছো কোন সাহসে?”
“এই মেয়েকে জিজ্ঞেস করো, কোন সাহসে আমার বোনের ব্যাপারে উল্টোপাল্টা কথা বলে।”
“তোমার বোনের সমস্যা হলে ওর কি করার আছে?”
তূর্য, আহনাফ অরুণিকাকে থামাতে আসবে, অরুণিকা তূর্যের দিকে একনজর তাকিয়ে টুম্পাকে বলল, “একটা ছেলের সাথে ছাদে দাঁড়িয়ে ঘেঁষাঘেঁষি করা, হাসাহাসি করা কি তোমাদের টিপিক্যাল আন্টিদের চোখে পড়ে না? না-কি ব্যাচেলর ঘরে গিয়ে মাতালামি করার কথা আন্টিদের জানাতে হবে?”
রুদবা চোখ বড় বড় করে অরুণিকার দিকে তাকালো। অরুণিকা তার দিকে তাকিয়ে বলল, “নিজের ক্যারেক্টার দেখে অন্য কারো ব্যাপারে কথা বলতে আসিস।”
রুদবা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “তুই তো খুব পবিত্র! শোন অরু, তোর হিস্ট্রি জানা আছে আমার। আহনাফ স্যারের সাথে কি কি করেছিস সব জানি আমি।”
আহনাফ ধমকের সুরে বলল, “এই মেয়ে, মুখ সামলে কথা বলো। ও আমার সাথে যা যা করেছে, তুমি এখানে ইন্টারফেয়ার করার কে? সি ইজ মাই ওয়াইফ। আন্ডারস্ট্যান্ড? আমি ওকে রাইট দিয়েছি আমার সাথে যা ইচ্ছে করার। হু দা হেল আর ইউ….?”
আহনাফ হঠাৎ রেগে যাওয়ায় তূর্য তাকে থামালো। আহনাফ তূর্যকে ধাক্কা মেরে বলল, “এই থার্ড ক্লাস মেয়ের সাথে কথা বলিস কীভাবে তুই? তোর রুচির অধঃপতন হয়েছে।”
রুদবা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অরুণিকা রুদবাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আমি তোর জন্য আপসোস করছিলাম এতোদিন। কিন্তু না। আমি সত্যিই হ্যাপি। ইউ ডিজার্ভ দিস পেইন। এন্ড আ’ম ওয়েটিং।”
(***)
আরাফ গম্ভীরমুখে বাতি নিভিয়ে বসে আছে নিজের ঘরে। তার চোখের সামনে ভাসছে রুহানির হাসিমাখা মুখ, কানে বাজছে তার দুষ্টু মিষ্টি কথা, আবার পরক্ষণেই সেই বিধ্বস্ত চাহনি। মনটা অস্থির হয়ে গেছে তার৷ কেন সে রুহানির এই অবস্থা মেনে নিতে পারছে না? আহনাফ তার রুমের দরজায় কড়া নাড়তেই আরাফ নিজেকে সামলে নিলো। আহনাফ রুমে ঢুকে আরাফের সামনে বসে বলল, “এই কেইসটা এভাবে মিথ্যে বানিয়ে দিলি? এখন ওদের প্রোপার শাস্তি হবে না। আদালতে অপহরণের রায় দেবে শুধু। কয়েক মাস পর আবার বেরিয়ে আসবে ওরা। মেয়েটা গাধামি করবে দেখে, তুইও করবি?”
আরাফ শক্ত কন্ঠে বলল, “তুই আর তাহমিদ ছাড়া কেউ জানে না রুহানির ব্যাপারে। তাহমিদ তো কাউকে বলবে না। তুই আল্লাহর ওয়াস্তে তূর্যকে বলতে যাবি না এসব। এই সত্য তোর আর তাহমিদের মধ্যে যাতে সারাজীবনের জন্য দাফন হয়ে যায়।”
“আমি কাউকে বলবো না। কিন্তু ওই রেপিস্টগুলো অবাধে ঘুরবে। ওদের সাহস আরো বাড়বে।”
“তোর কি মনে হয়, আমি ওদের ছাড়বো? আগে বের হোক ওরা। মামলা ঠান্ডা হোক। এদের ফাঁসি হলে কম হবে। আমি দেবো ওদের শাস্তি। এমন শাস্তি দেবো, বাপ-দাদার জন্মেও ভুলবে না।”
আহনাফ হতাশ কন্ঠে বলল, “মাঝে মেয়েটার জীবনটা তো এলোমেলো হয়ে গেল!”
হঠাৎ আরাফ টেবিলের উপর থেকে মোটর সাইকেলের চাবি আর ফোন নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। আহনাফ অবাক হয়ে গেল আরাফের এমন আচরণে।
(***)
চারদিন পর।
কলিংবেলের শব্দ শুনে আতকিয়া জাহান দরজা খুলে চমকে উঠলেন। দরজার বাইরে বড় চৌধুরী সাহেব, মিসেস চৌধুরী এবং আরেফিন চৌধুরী দাঁড়িয়ে আছেন। আতকিয়া তাদের ভেতরে আসতে বলে অরুণিকাকে ডাকলেন। অরুণিকা দাদা-দাদি এবং বড় চাচাকে দেখে বেশ অবাক হলো। শাহবাজ খান বসার ঘরে এসে আরেফিন চৌধুরীকে দেখে চমকে উঠলেন। দু’জনের চোখাচোখিতে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে রহস্য। শাহবাজ খান গম্ভীরমুখে তাদের মুখোমুখি সোফায় বসলেন। আরেফিন চৌধুরী মুখ ঘুরিয়ে রেখেছেন। আতকিয়া জাহান অরুণিকাকে নাস্তার জন্য পাঠালেন। মিসেস চৌধুরী বললেন, “কিছু লাগবে না। আমরা আসলে খুব জরুরি ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি। জানি, অনেক বছর আগে আমাদের মধ্যে কিছু ঝামেলা হয়েছিল। কিন্তু আপনাদের সাথে আমাদের আত্মীয়তা অরুণিকার জন্যই রয়ে গেছে। আর এখন এই আত্মীয়তার সম্পর্ক যদি আরো পাকাপোক্ত করা যায়!”
শাহবাজ খান অবাক হয়ে বললেন, “বুঝলাম না আপনার কথা।”
অরুণিকা রান্নাঘর থেকে আঁড়িপেতে শুনছে। মিসেস চৌধুরী বললেন, “আরাফের মা নেই। ওর বাবা ছাড়া আর কেউ নেই। আরাফ আমাদের ঘরের গর্ব। সে চারদিন আগে তার পছন্দ জানিয়েছে। আপনাদের মেয়ে রুহানিকে বিয়ে করতে চায়, আমার নাতি।”
অরুণিকা গালে হাত দিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। মিনমিনিয়ে বলল, “ও মাই গড, এই বছরের বেস্ট নিউজ এটা। ইয়েস, ইয়েস, ইয়েস, মাই বেস্ট বোনু উইথ মাই বেস্ট কাজিন ব্রাদার। হোয়াট এ ম্যাচ! পারফ্যাক্ট কাপল! থু থু থু, কারো নজর না পড়ুক।”
শাহবাজ খান কিছু বলতে যাবে আতকিয়া জাহান ব্যস্ত কন্ঠে বললেন, “আমাদের কোনো আপত্তি নেই।”
শাহবাজ খান চোখ বড় বড় করে তাকালেন। আতকিয়া জাহান অরুণিকাকে ডেকে বললেন, “অরু, তুমি এখানে বসো।”
এই বলে শাহবাজ খানকে নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন তিনি। অনেক বোঝালেন, মেয়ের সাথে যা হয়েছে এর মধ্যে এই সম্বন্ধ ফেলে দেওয়ার মতো না। শাহবাজ খান স্ত্রীর যুক্তিও ফেলতে পারছেন না। তিনি এবার থমথমে মুখে রুহানির রুমে গেলেন।
ঘুমন্ত রুহানি বাবার ডাকে উঠে বসলো। শাহবাজ খান মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “তোমার সাথে কিছু কথা আছে।”
রুহানি ভীত দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকালো। দরজার কাছে মা দাঁড়ানো। সে মনে মনে ভাবছে, “ওরা কি সব জেনে গেছে?”
শাহবাজ খান বললেন, “তোমার বিয়ে নিয়ে কি ভাবনা?”
রুহানি মাথা নামিয়ে বলল, “আমার কোনো ভাবনা নেই।”
“তোমাকে যদি বিয়ে দিতে চাই তোমার অসুবিধা আছে?”
“আমাকে কেউ বিয়ে করবে কেন?”
আতকিয়া জাহান রুমে ঢুকে বললেন, “এটা কেমন কথা! তোমার জন্য সম্বন্ধ এসেছে।”
রুহানি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে। আতকিয়া জাহান মেয়ের থুতনি ধরে বললেন, “চৌধুরী বাড়ির নাতির জন্য।”
রুহানি যেন আরো চমকে উঠলো। শাহবাজ খান বললেন, “আরাফ তার অভিভাবক পাঠিয়েছে। তোমরা কি একজন আরেকজনকে পছন্দ করো?”
রুহানির মুখ দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না। সে ভাবছে, “স্যার সব জেনে আমাকে কেন বিয়ে করতে চাইছেন? মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে উনার?”
আতকিয়া জাহান স্বামীকে বললেন, “চুপ করে আছে তোমার মেয়ে। বলবে না কোনো কথা। স্যার রেখেছি, এদিকে নাকের নিচে প্রেম করে ফেলেছে। যাই করেছে, ছেলে কিন্তু খুব ভালো। তোমার ইন্টার ফেইল মেয়ের জন্য ডাক্তার প্রস্তাব এসেছে! চাট্টিখানি কথা নয়। লোকে শুনলে অবাক হবে। আমাদের মেয়ের তো কপাল ভালো।”
শাহবাজ খান মেয়ের দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে উঠে পড়লেন। রুহানির হাত-পা অবশ হয়ে যাচ্ছে। আশপাশে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো, “আমি কি স্বপ্ন দেখছি?”
চলবে-
#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-৫৪ (২য় ভাগ) ||
তূর্য, ইভান এবং ইমন আরাফকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। আহনাফ এবং তাহমিদ একপাশে বসে আছে। আরাফ বিরক্তমুখে বলল, “আমার সামনে এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? সর এখান থেকে।”
তূর্যের হাতে একটি মেডিকেল রিপোর্ট। সে রিপোর্টটি আরাফের সামনে রেখে বলল, “তোর কি মাথা ঠিক আছে, আরাফ?”
আরাফ তাকে সরিয়ে অন্যপাশে যেতেই তূর্য আহনাফের কাছে এসে বলল, “তোর ভাই কি মাতাল হয়ে গেছে? ওকে কিছু বল।”
আহনাফ ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “আমি কি বলবো?”
ইভান ভ্রূ কুঁচকে বলল, “ওয়েট, ওয়েট, তোরা দু’জন এতো শান্ত হয়ে বসে আছিস কেন? তোরা কি আগে থেকে এসব জানতি?”
তাহমিদ ও আহনাফ একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলো। ইমন বলল, “এরা তো সব জেনে এমন কাজ করছে! এই তোরা আরাফকে না বুঝিয়ে উলটো ওকে বাহবা দিচ্ছিস কেন?”
ইভান বলল, “ভাই, এখানে কি মহান হওয়ার কম্পিটিশন হচ্ছে?”
আরাফ শক্ত হয়ে বসে আছে। তূর্য বলল, “সিরিয়াসলি? এমন ইম্যাচিউর ডিসিশন আমি আরাফের কাছ থেকে আশা করি নি! এই রিপোর্টে স্পষ্ট লেখা আছে, রুহানির রেইপ হয়েছে। আর এতো বড় সত্য ওর পরিবারের কাছ থেকে হাইড করা, এটা কেমন লজিক?”
আহনাফ বলল, “রুহানি চায় না এসব কেউ জানুক।”
“আরেহ, ওই মেয়ে তো বোকা। ও কি বুঝে এসব?”
আরাফ ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “আমি যা করছি ভেবে করছি। আমার ডিসিশন, আমাকে হ্যান্ডেল করতে দে।”
“এটা কেমন ডিসিশন? কীভাবে হ্যান্ডেল করছিস তুই? রুহানিকে বিয়ে করে? তোর এখানে কি দোষ? তুই কেন মহান হতে যাচ্ছিস?”
তাহমিদ বলল, “আরাফকে তো কেউ ফোর্স করছে না। ও নিজে যা বুঝেছে, তাই করছে। এটা ওর ডিসিশন।”
ইভান বলল, “কিন্তু আরাফের একটা জীবন আছে। মহান হওয়ারও একটা লিমিট আছে।”
আহনাফ কপাল চেপে ধরে বলল, “প্লিজ, ঘ্যানঘ্যান করিস না তো। তোদের চ্যাঁ চ্যাঁ শুনে আমার মাথা ব্যথা করছে।”
“আজব, তোর ভাইকে তুই কিছুই বলছিস না!”
“আমার এখানে কিছুই বলার নেই।”
ইমন বলল, “কেন? আরাফ কেন এই কাজ করবে? মেয়েটার রেইপ হয়েছে। প্রথমত এটা সবার কাছ থেকে হাইড করেছে, আর এখন বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়ে দিয়েছে। আরেফিন আংকেল জানলে তো ঘটনা সিরিয়াস হয়ে যাবে। তূর্য আরাফের ড্রয়ারে আজ রিপোর্টটা দেখেছে বলেই জানতে পেরেছি আমরা। নয়তো এই দুইটা তো বলতোই না।”
তাহমিদ বলল, “আমাদের দু’জনকে এখানে টানিস না।”
আহনাফ বলল, “আর মেয়েটার এখানে কোনো দোষ নেই। এটা ভাগ্যেই লেখা ছিল। তাই বারবার রেইপ ওয়ার্ডটা ইউজ করিস না।”
তূর্য আরাফের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “ওকে ফাইন। রুহানির সাথে যা হয়েছে বুঝলাম। ওর কথায় তুই সত্যটা কাউকে জানতে দিলি নি। এটাও বুঝলাম। কিন্তু বিয়ে কেন করছিস ওকে?”
আরাফ ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “আমি জানিয়েছি কেন করছি।”
“তুই সিরিয়াস? তুই ওকে পছন্দ করিস? আমার এটা বিশ্বাস হচ্ছে না। তুই এখানে কেন এসেছিস? তুই তাহমিদকে নিয়ে এই বাড়িতে কেন উঠেছিস? তোর উদ্দেশ্য কি ছিল?”
আরাফ অসহায় দৃষ্টিতে তূর্যের দিকে তাকালো। ইভান বলল, “আহনাফ আমাকে আর তূর্যকে জোর করেছে বিধায় আমরা এখানে উঠেছি ওর সাথে। ওর উদ্দেশ্য অরুর আশেপাশে থাকা। তুই কেন এসেছিস এখানে? তোর উদ্দেশ্য কি?”
ইমন বলল, “আরাফ, তুই আমাকে বলেছিলি, তুই শাহবাজ খানকে ছাড়বি না। এখন লোকটার মেয়েকে বিয়ে করছিস? আমি তোকে আজ একদম চিনতে পারছি না। তুই রুহানিকে ভালোবেসেছিস কখন, আগে আমাকে সেটা বল? তুই শাহবাজ খান দেশে আসার অপেক্ষায় ছিলি। তুই উনাকে ফাঁসাতে চেয়েছিলি। উনি এখন তোর সামনে, অথচ তুই সব ভুলে উনার মেয়েকেই বিয়ে করছিস। স্ট্রেঞ্জ!”
তূর্য বলল, “তোরা সবাই চুপ কর। আরাফ, তুই ঠান্ডা মাথায় বল, তুই কেন এই ডিসিশন নিলি? মেয়েটার সাথে যা হয়েছে, এটা সাইড করে রাখলাম আমরা। কিন্তু মেয়েটাকে ঠকাচ্ছিস কেন? তুই ওকে ভালোবাসিস না। সত্যটা আমাদের বল। আন্টির মৃত্যুর পেছনে রুহানির বাবা দায়ী। তাহলে তুই কেন এই মেয়েকে বিয়ে করে নিজের জীবনটা শেষ করছিস? আর তুই তো সায়ন্তনিকে ভালোবাসতি।”
আরাফ চমকে উঠলো সায়ন্তনির নাম শুনে। আহনাফ তূর্যের সামনে এসে বলল, “মেয়েটার সাথে আরাফের কোনো ভবিষ্যৎ ছিল না। আর এতো বছর পর সায়ন্তনি এখানে কেন আসছে?”
তাহমিদ আরাফের সামনে এসে বলল, “ভাই, এতো কাহিনী না করে, তোর ডিসিশন ক্লিয়ার কর।
আরাফ বলল, “হ্যাঁ, আমি রুহানিকে ভালোবাসি না। হ্যাঁ, আমি এখনো ভুলি নি আমার প্রতিশোধ। শাহবাজ খানকে আমি কখনো ক্ষমা করবো না৷ আর সায়ন্তনির চ্যাপ্টার কখনো আমার লাইফে ওপেনই হয় নি। তাই এটা নিয়ে আমাকে আর কিছু বলিস না। এবার আসি রুহানির কথায়। শোন, ওর প্রতি আমার একটা সফট কর্নার আছে। আমি ওকে এই অবস্থায় দেখতে পারছি না। এখন যদি এটা আমার ভালো লাগা হয়, তবে তাই। আমি এটা নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করতে চাচ্ছি না। আর শাহবাজ খানের পাপের শাস্তি আমি উনার মেয়েকে দেবো না। আমি আহনাফের মতো বোকামি করবো না। রুহানি বিয়ের পর আমার স্ত্রীর মর্যাদায় থাকবে। আর ওর বাবার সাথে আমি আলাদাভাবে ডিল করবো।”
ইভান বলল, “যদি সায়ন্তনি কখনো ফিরে আসে?”
“যে আমাকে ভালোই বাসে নি। সে কখনো ফিরতে পারে না। আর ফিরলেও সে আমার হয়ে ফিরবে না।”
ইমন অসহায় দৃষ্টিতে আরাফের দিকে তাকিয়ে রইল।
(***)
অরুণিকা ও আহনাফ ছাদের গেটের পাশে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। আহনাফের দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ। অরুণিকা একটু পরপর আহনাফের দিকে তাকাচ্ছে। তারা দু’জন আরাফ ও রুহানিকে পাহারা দিতে উঠেছে। আরাফের সাথে কথা বলার জন্য রুহানি বারবার অনুরোধ করছিল অরুণিকাকে। তাই অরুণিকা আরাফকে এসে জানাতেই তারা ছাদে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিলো।
আগামীকাল যোহরের পর মসজিদে আক্দ হবে। আর এরপরই রুহানিকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে। শাহবাজ খান বড়সড় আয়োজন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আরাফ আগ্রহ দেখাচ্ছে না। সে জানিয়ে দিয়েছে, আয়োজন হলে ছেলে পক্ষ থেকে দাওয়াতের আয়োজন হবে। শেষমেশ আরাফের যুক্তির কাছে হার মানতে হলো শাহবাজ খানকে। তবে আজ ছোটখাটো মেহেদি অনুষ্ঠান হচ্ছে দু’পক্ষ থেকেই। সন্ধ্যায় চৌধুরী ম্যানশন চলে যাবে আরাফ। তার জিনিসপত্র গুছিয়ে দিয়েছে তাহমিদ আর ইভান। তারা এই বাসাটা ছেড়ে দিচ্ছে এই মাসে। আরাফ ও আহনাফের জন্যই তাদের এখানে বাসা নেওয়া। অন্যদিকে আগামী মাসেই বাসা পরিবর্তন করে অন্য এলাকায় চলে যাবেন শাহবাজ খান। নিচ তলায় বেশ অসুবিধে হয়ে যাচ্ছে তাদের।
অনেকক্ষণ নীরবতা বিরাজ করলো অরুণিকা ও আহনাফের মাঝে। নীরবতা ভেঙে অরুণিকা জিজ্ঞেস করলো, “রিহ্যাবে সময় কেমন কাটলো? কি করেছো ওখানে?”
আহনাফ মৃদু হেসে বলল, “মেডিটেশন করেছি।”
“বাহ! তবে তুমি শুকিয়ে গেছো অনেক। তোমাকে অসুস্থ মনে হচ্ছে।”
আহনাফ অরুণিকার চোখের দিকে তাকালো। ক্ষীণ স্বরে বলল, “আমার দিকে তাকাস তাহলে?”
অরুণিকা গম্ভীরমুখে বলল, “তোমার জায়গায় অন্য কেউ শুকিয়ে গেলে, আমি তাকেও জিজ্ঞেস করতাম। তোমাকে আলাদাভাবে কেন দেখবো?”
আহনাফ ক্ষীণ হেসে নীরব হয়ে গেল। তার মুখটা অন্ধকার হয়ে গেছে। অরুণিকা হাত মুঠো করে আঁড়চোখে আহনাফের দিকে তাকালো। সে কোনোভাবে আহনাফের সামনে হারতে চাইছে না। সে কেন শুধু শুধু নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করবে? আহনাফের উচিত সব ঠিক করে নেওয়া। কিন্তু আহনাফ নিজের মনেই দুঃখ পেয়ে বসে আছে। আগের মতো জোরাজুরি করছে না। কি অদ্ভুত!
এদিকে আরাফ ছাদের রেলিঙে হেলান দিয়ে রুহানির দিকে তাকিয়ে আছে। আর রুহানি কি জিজ্ঞেস করবে, সেটাই ভাবছে। নিজেকে বেশ এলোমেলো মনে হচ্ছে তার৷ সব গুলিয়ে ফেলছে সে। আরাফ অনেকক্ষণ ধরে রুহানির দিকে তাকিয়ে তার অস্থিরতা ধরতে পারলো। এরপর শান্ত সুরে বলল, “তুমি হয়তো জানতে চাচ্ছো, আমি কেন সব জেনেশুনে তোমাকে বিয়ে করতে চাইছি। এজন্যই তো আমাকে ডাকলে, তাই না?”
রুহানি আরাফের মুখের দিকে তাকালো। পরক্ষণেই চোখ নামিয়ে বলল, “জি।”
“আমি তো জানিয়েছি কারণটা।”
রুহানি চমকে তাকালো আরাফের দিকে। তার গলা কাঁপছে। কাঁপা কন্ঠে বলল, “আপনি আমাকে পছন্দ করেন?”
আরাফ মাথা নেড়ে বলল, “হুম।”
রুহানির মনে অজানা ভালো লাগা ছেয়ে গেল। তবুও সে নিজেকে প্রকাশ করলো না। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “সব জানার পরও কেন পছন্দ করছেন? আমি তো ইন্টার ফেইল। আপনি কয়েক মাস পর ডাক্তার হয়ে যাবেন। তার উপর আমার সাথে…”
আরাফ রুহানির কাছে এসে তার ঠোঁটের উপর আঙুল চেপে ধরলো। মুহূর্তেই রুহানির পুরো শরীর শিউরে উঠলো। গলা শুকিয়ে গেল। হাত-পা অসার হয়ে যাচ্ছে। মনে প্রশান্তির ঢেউ খেলা করছে। চোখ জোড়ায় ভীড় করেছে মুগ্ধতা। সে আরাফের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে৷ আরাফ হালকা হেসে বলল, “ভালোবাসায় এসব দেখে না, মেয়ে। ভালোবাসা আত্মার সম্পর্ক। দৈহিক না।”
রুহানির চোখ জোড়া ছলছল করে উঠলো। সে হুট করে আরাফকে জড়িয়ে ধরলো। আরাফ থতমত খেয়ে গেল। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে। রুহানি আরাফকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। আরাফ কাঁপা হাতে রুহানির পিঠে এক হাত রাখলো, অন্যটি তার মাথায় রেখে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “বিয়ের আগে এভাবে কেউ দেখে ফেললে কিন্তু আমাকেই বকা খেতে হবে। তুমি কি চাও আমি বকা খাই?”
রুহানি দ্রুত সরে চোখ মুছে হাসলো। আরাফ অনেকদিন পর রুহানির ঠোঁটে হাসি দেখে নির্বাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। রুহানি লাজুক হেসে মাথা নেড়ে বলল, “আমি যাই। কাল দেখা হবে।”
এই বলে রুহানি দৌঁড়ে নেমে পড়লো। অরুণিকা ও আহনাফ দু’জনই চমকে উঠলো রুহানিকে তাদের সামনে দিয়ে দ্রুত নেমে পড়তে দেখে। অরুণিকা রুহানির পিছু পিছু নামলো। আর আহনাফ আরাফের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, “কি বললি?”
আরাফ মৃদু হাসলো। তার হাসি বুঝিয়ে দিল, খারাপ কিছু হয় নি। এদিকে অরুণিকাকে জড়িয়ে ধরে আছে রুহানি। মেয়েটা ভীষণ কাঁপছে। অরুণিকা তাকে শান্ত করে বসালো। রুহানির চোখে অশ্রু৷ সে হাসছে, আবার কাঁদছেও। অরুণিকা রুহানির চোখ মুছে দিয়ে বলল, “কি হয়েছে, বল!”
রুহানি লাজুক হেসে বলল, “আরাফ স্যার আমাকে ভালোবাসে।”
অরুণিকা হেসে বলল, “আরেহ, এজন্যই তো প্রস্তাব পাঠালো।”
“আমি অনেক খুশি আজ। আমার সাথে এই ক’টা দিনে যা ঘটে গেছে, এরপর আমি এমন কিছু আশা করি নি। আল্লাহ আমাকে ঠকায় নি। আমি তো অনেক অভিমান করেছিলাম। কেন আমাকে প্রটেক্ট করি নি! হয়তো তার সব সিদ্ধান্তে বিশেষ কারণ থাকে। এভাবেই হয়তো আমার আর আরাফ স্যারের বিয়েটা লেখা ছিল।”
“হ্যাঁ, তা ঠিক। হয়তো এমন কিছু না ঘটলে আরাফ এতো সহজে তোকে বিয়ে করতো না। আর তোর বিয়ে করার স্বপ্ন আরো দীর্ঘ হতো।”
হঠাৎ রুহানির মুখটা শুকিয়ে গেল। অরুণিকাকে কি সত্যটা বলে দেওয়া উচিত? পরক্ষণেই ভাবলো, “না, না। আমার জন্য শুধু শুধু কষ্ট পাবে। আমার বিয়ে নিয়ে কতো খুশি, অরু। ওর মনটা কেন খারাপ করে দেবো? যে বিয়ে করবে সে তো সব জানে। আমার আর কোনো আক্ষেপ নেই।”
(***)
সন্ধ্যায় আরাফ ও রুহানির মেহেদি অনুষ্ঠান হলো। আর পরদিন দুপুরে আক্দের পর রুহানিকে নিয়ে গেল চৌধুরী পরিবার। আতকিয়া জাহান মেয়ের জন্য কাঁদছেন। অরুণিকা মামীকে শান্ত করতে ব্যস্ত। রুহানি যাওয়ার পর থেকে অরুণিকার ভীষণ ফাঁকা ফাঁকা লাগছে সব। মেয়েটাই তো ঘর আলো করে রাখতো। সব আলো নিয়ে চলে গেছে সে অন্য বাড়ি। অরুণিকা রুহানির রুমে বসে আছে, আর আনমনে রুহানির স্মৃতি মনে করে হাসছে।
রাত এগারোটা। মিসেস তাওসিফ রুহানিকে আরাফের ঘরে বসিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। রুহানির বেশ অস্বস্তিবোধ হচ্ছে। আহনাফ, তাহমিদ আর তূর্য ছাড়া কেউ তার সাথে একটা বাক্যও কথা বলে নি। ইভান আর ইমন তো আরাফের বিয়ে নিয়েই ব্যস্ত। কিন্তু ঘরের এতো সদস্য, আরাফের দাদা-দাদি, আরাফের বাবা, এমনকি তার চাচা-চাচিও বেশ চুপচাপ। রুহানির বেশ অস্থির লাগছে। মিনিট পাঁচেক পর আরাফ রুমে আসতেই রুহানি উঠে দাঁড়াল। আরাফ দরজা বন্ধ করতেই হাত-পা শিউরে উঠলো তার। আরাফ বলল, “তুমি শাড়ি পালটে এসো।”
“সমস্যা নেই। আমার অভ্যাস আছে।”
“শাড়ি পরে ঘুমাতে পারবে?”
“হুম, পারবো হয়তো।”
আরাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “হয়তো! দেখো, কোনো জোর নেই কিন্তু। তোমার জন্য আলমারিতে জামা রাখা আছে।”
রুহানি ড্রেসিংয়ের সামনে গিয়ে আরাফের দিকে তাকালো। সে ভেবেছিল, আরাফ এসে তার গলার সেট খুলতে তাকে সাহায্য করবে। কিন্তু আরাফ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে আছে। রুহানি অন্যমনস্ক হয়ে ভাবলো, “হয়তো এসব সিনেমায় হয়। বাস্তবে এমন হয় না৷”
রুহানি মলিন মুখে নিজেই গলার হার, কানের দুল, চুড়ি খুলতে লাগলো। এরপর আলমারির কাছে এসে বলল, “এটাতে আছে?”
“হুম।”
আরাফের গম্ভীর উত্তরে রুহানি সেকেন্ড খানিক তার দিকে তাকিয়ে রইল। এরপর আলমারি খুলে দেখলো সব মেয়েদের জামা। রুহানি ভ্রূ কুঁচকে বলল, “আপনার জামা-কাপড় নেই যে!”
আরাফ বলল, “আমার জামা-কাপড় পাশের ঘরে।”
“কেন? আপনি কি এই ঘরে থাকবেন না?”
“হ্যাঁ, থাকবো।”
“তাহলে!”
“আমার অনেক কাজ থাকে। আমি কাজের সময় পাশের ঘরে থাকবো। এমন না যে আমি অন্য রুমে ঘুমাবো।”
“এখানে কাজ করলে কি অসুবিধে হবে?”
“একটু প্রাইভেসি তো লাগে। তোমার পড়ার জন্যও বামপাশের ঘরটা খালি করবো।”
“পড়ার জন্যও আলাদা ঘর আছে?”
“হ্যাঁ, রিডিংরুম তো বেডরুম থেকে আলাদা হয়।”
রুহানি ভ্রূ কুঁচকে মনে মনে ভাবলো, “বড়লোকি ব্যাপার-স্যাপার!”
রুহানি শাড়ি পাল্টে সেলোয়ার-কামিজ পরে বেরুলো। আরাফ রুহানির দিকে সেকেন্ড খানিক তাকিয়ে বলল, “শুয়ে পড়ো।”
রুহানি চুপচাপ বিছানায় শুয়ে পড়লো। আরাফও বাতি নিভিয়ে রুহানির পাশে এসে শুয়ে পড়লো। মাঝে একটা বালিশ। রুহানি চোখ-মুখ কুঁচকে রেখেছে। তার ঘুম আসছে না। সে ভেবেছে, আরাফ তার কাছে আসতে চাইবে। কিন্তু আরাফ অন্য পাশ ফিরে ঘুমাচ্ছে। রুহানি ধীরে ধীরে আরাফের দিকে ফিরলো। আরাফের কাঁধে হাত রাখতে গিয়েই থমকে গেল সে৷ অজানা কারণেই বেশ কান্না পাচ্ছে তার। উঠে বসলো রুহানি। দু’হাটুতে মুখ গুঁজে বসলো। চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই ভয়ংকর দিনগুলো। ফুঁপিয়ে উঠলো রুহানি। আরাফ ঘুমায় নি। সে রুহানির অস্থিরতা ঠিকই অনুভব করছিল। হঠাৎ ফোঁপানোর শব্দ শুনেই উঠে বসলো আরাফ। জিজ্ঞেস করলো, “বাসার সবাইকে মিস করছো?”
রুহানি আরাফের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলল, “অরুকে এখানে নিয়ে আসা যায় না? এটা তো ওর দাদার বাড়ি।”
“অরু যদি আসতে চায়।”
“আমি বললে ও ঠিক আসবে।”
“কাল সকালে ফোন দিতে পারো। এখন ঘুমিয়ে পড়ো।”
“আমার ঘুম আসছে না।”
আরাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “জেগে থেকেও বা কি হবে?”
“মাত্র এগোরাটা।”
“বেশি রাত জাগা ভালো না।”
রুহানি আরাফের দিকে তাকালো। সে বুক বালিশটা দেখিয়ে বলল, “এটা মাঝে রেখেছেন যে!”
আরাফ ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “তোমার অসুবিধে না হওয়ার জন্য।”
“আমার অসুবিধা নেই।”
আরাফ নিঃশব্দে বুক বালিশ সরিয়ে শুয়ে পড়লো। রুহানি এবার আরাফের দিকে ফিরে শুয়ে পড়লো। আরাফ ইতস্তত ভাব নিয়ে উলটো দিকে ফিরতেই, রুহানি আরাফের কাছে এসে বলল, “স্যার!”
রুহানি আরাফের কানের কাছে ফিসফিস করতেই উঠে বসলো আরাফ। রুহানি ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “আমার দিকে ফিরে শোবেন?”
আরাফ মাথা নেড়ে রুহানির কথামতো শুয়ে পড়লো। এবার দু’জন মুখোমুখি শুয়ে আছে। রুহানি আরাফের দিকে তাকিয়ে আছে। আরাফ চোখ বন্ধ করে রাখলেও সব বুঝতে পেরে বলল, “ঘুমাও রুহানি।”
রুহানি মুখ বাঁকিয়ে বলল, “আপনি মায়ের মতো কথা বলছেন কেন? আপনি তো বর। বরের মতো কথা বলেন।”
আরাফ চমকে তাকালো রুহানির দিকে। রুহানি মৃদু হেসে বলল, “আপনি ঘুমিয়ে পড়ছেন কেন?”
“তো এতো রাতে কি করবো?”
“মাত্র এগারোটা।”
“কাল আমার ডিউটি আছে।”
“ছুটি নেন নি?”
“ছুটি কেন নেবো? বিয়ের জন্য ছুটি নিতে হয়?”
“হ্যাঁ, জানেন না? আচ্ছা, জানবেন কীভাবে? এটা তো প্রথম বিয়ে।”
“তুমি কীভাবে জানলে? তোমারও তো প্রথম।”
“সিনেমা, নাটক এসবে দেখায়। বিয়ের পর ছেলেরা অফিস থেকে ছুটি নেয়। বউয়ের সাথে সময় কাটায়।”
আরাফ রুহানির ইনিয়েবিনিয়ে বলা কথার সারাংশ বুঝতে পারলো। সে উঠে বসে বলল, “আমি অন্য রুমে যাই। তুমি এখানে বসে থাকো।”
রুহানি দ্রুত উঠে বলল, “কেন স্যার?”
“আমার ঘুম আসছে।”
রুহানি মলিন মুখে আরাফের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি কি আমার উপর রেগে আছেন?”
“কেন রাগ করবো?”
“তাহলে!”
“তাহলে কি?”
রুহানি মাথা নেড়ে বলল, “অন্য রুমে কেন যাবেন? শুয়ে পড়ুন। আমিও ঘুমাচ্ছি। আমারও ঘুম পাচ্ছে।”
আরাফ নিঃশব্দে শুয়ে পড়লো। রুহানি অভিমানী মুখে আরাফের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বুক বালিশটা টেনে আরাফের পাশে রেখে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে পড়লো। কেটে গেল বিশ মিনিট। রুহানি ভেবেছে, আরাফ বালিশ সরিয়ে তাকে অন্তত জড়িয়ে ধরে ঘুমাবে। কিন্তু সে তো গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে। রুহানি পাশ ফিরলো আবার। তার চোখ ছলছল করে উঠলো। সে ধীরে ধীরে উঠে বালিশ নিয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়লো গুটিসুটি মেরে। নিজের প্রতি ঘেন্না হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে তার শরীর থেকে এখনো সেই তিন পিশাচের গন্ধ আসছে। নিজের হাত খামচে ধরলো সে। চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই তিনটি ভয়ংকর মুখের লালসা। রুহানি চোখ-মুখ খিঁচে বালিশ জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। আরাফ কেন তাকে কাছে টেনে নিলো না? কেন ভুলিয়ে দিল না সেই ভয়ংকর দিনগুলো? আরাফ কি তাকে স্পর্শ করতে চায় না? তার শরীরের নোংরা স্পর্শে কি আরাফেরও ঘেন্না হচ্ছে? কিন্তু সেই তো সেধে বিয়ে করতে চেয়েছিল? রুহানি তো জোর করে নি তাকে। তাহলে কি সময় নিচ্ছে আরাফ? কিন্তু রুহানি তো চাইছে না সময়। সে মুখ ফুটে বলতে পারছে না, কিন্তু খুব করে চাইছে আরাফ তাকে ভালোবাসুক। তাকে জড়িয়ে ধরুক। তাকে প্রণয়ের অন্তিম স্পর্শটুকু দিয়ে অতীতের সব বিশ্রী মুহূর্ত ভুলিয়ে দিক।
(***)
আরাফের ডাকে ঘুম ভাঙলো রুহানির। সে উঠে বসতেই আরাফ বলল, “মেঝেতে কেন শুয়েছো?”
রুহানি এদিক-ওদিক তাকালো। তার মনে পড়লো বিয়ে করে ফেলেছে সে। রুহানি বালিশ নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “নতুন বেডে ঘুম হয় না আমার।”
“না-কি আমি পাশে ছিলাম তাই?”
রুহানি ব্যস্ত কন্ঠে বলল, “না, না। আমি কাল থেকে বেডেই শোবো।”
“তোমার অসুবিধে হলে আমি পাশের রুমে ঘুমাতে পারি।”
“না, না। এটা আপনার রুম। আপনি অন্য রুমে কেন যাবেন?”
“আমার অসুবিধে নেই।”
“কিন্তু আমার অসুবিধা আছে।”
আরাফ সেকেন্ড খানিক রুহানির দিকে তাকিয়ে চলে গেল ওয়াশরুমে। রুহানি মিনিটের মধ্যেই রুম গুছিয়ে নিলো। এরপর রুম থেকে বের হতেই এক মহিলা তার সামনে এসে দাঁড়ালেন। রুহানি তাকে দেখে চমকে উঠলো। তিনি বললেন, “আমি এই বাসায় কাজ করি৷ কিছু লাগলে আমাকে বলতে পারেন।”
“আমি পাশের রুম থেকে আরাফ স্যা…”
রুহানি থেমে নিজেকে শুধরে নিয়ে বলল, “আরাফ, উনার জামা নিতে চাইছি।”
মহিলাটি রুম দেখিয়ে দিলেন। রুহানি ভেতরে গিয়ে আলমারি থেকে নিজের পছন্দের একটা সেট বের করে নিলো। এরপর রুমে এসে বিছানায় রাখলো। আরাফ ওয়াশরুম থেকে বের হতেই তোয়ালে এগিয়ে দিল রুহানি। আরাফ চমকে উঠলো তার আচরণে। সে মুখ মুছতে পুরো ঘরে চোখ বুলিয়ে নিলো। রুহানি বেডের উপর রাখা সেট দেখিয়ে বলল, “আমি আপনার জন্য জামাও নিয়ে এসেছি।”
“তুমি এসব কেন করছো?”
“আমি এখন আপনার ওয়াইফ। এসব তো আমার দায়িত্ব।”
“দেখো রুহানি। তোমার এসব করতে হবে না।”
রুহানি ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “কেন?”
“আমাকে নিয়ে তোমার এতোকিছু করতে হবে না। তুমি নিজেকে সময় দাও। তোমার রেজাল্ট ভালো হলে তোমাকে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দেবো। তুমি যা পড়া দরকার, পড়ে প্রস্তুতি নাও।”
“আমার পড়তে হবে?”
“কেন পড়তে চাও না?”
রুহানি চুপ করে রইল। আরাফ শীতল কন্ঠে বলল, “দেখো, আমার খুব ইনসাল্ট হবে তুমি পড়াশুনা না করলে। আমার অনেক ব্যাচমেটদের কিন্তু আমি বিয়েতে দাওয়াত দেই নি।”
“কেন?”
“এই যে তুমি এতো পিচ্ছি। ইন্টার পাশ করো নি এখনো।”
রুহানি মলিন মুখে বলল, “আচ্ছা, আমি পড়বো।”
“গুড।”
আরাফ বিছানায় থাকা শার্ট-প্যান্ট না নিয়েই চলে গেল।
এদিকে রুহানি নাস্তার টেবিলে এসে দেখলো আরাফ অন্য শার্ট গায়ে দিয়েছে। তা দেখে রুহানির মন খারাপ হয়ে গেল। আরেফিন চৌধুরী গম্ভীরমুখে নাস্তা করছেন। রুহানি আরাফের ইশারায় তার পাশে বসলো।
দু’জন মানুষ নিঃশব্দে নাস্তা করছে, আর রুহানি এদের গাম্ভীর্য দেখে খাবার গিলতেই পারছে না। আরেফিন চৌধুরী খেয়ে উঠে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। আরাফও নিজের ব্যাগ নিলো। এপ্রোনটিও ব্যাগে ঢুকালো। এরপর রুহানিকে বলল, “আমি আসছি। তুমি টিভি দেখে সময় কাটাতে পারো।”
আরাফ চলে গেল৷ রুহানি বাকি নাস্তা না করেই নিঃশব্দে ঘরে চলে এলো। এরপর বিছানায় পড়ে থাকা আরাফের শার্টটি হাতে নিয়ে মেঝেতে বসলো। জড়িয়ে ধরলো সেই শার্ট। তার চোখ ভিজে উঠলো। মিনমিনিয়ে বলল, “হয়তো উনি আমাকে ভালোবাসেন৷ কিন্তু আমাকে মেনেও নিতে পারছেন না। সেদিন আমার সাথে সেই দুর্ঘটনা না ঘটলে স্যার হয়তো আমাকে খুব সহজে মেনে নিতে পারতেন। উনার হয়তো জড়তা কাজ করছে। আমি কী করলে স্যার আমাকে কাছে টেনে নেবেন? আমার হয়তো নিজেকে আরো সুন্দর করে সাজাতে হবে। মুখের দাগটাও এখনো যায় নি। দাগটা দেখলে তো স্যার এসব ভুলতে পারবে না। আল্লাহ, স্যার তো আমাকে ভালোবাসে। এখন আমাদের বিয়েও হয়ে গেছে। উনার মনের জড়তা দূর করে দাও। আমি তো আর ইচ্ছে করে গায়ে দাগ লাগাই নি। স্যার আমাকে ভালোবাসলে, সব পুরোনো দাগ মুছে যাবে। আল্লাহ, স্যারের মনের জড়তা দূর করে দাও, প্লিজ।”
(***)
মাস শেষ হতেই বাসা ছেড়ে দিল ছ’জন। রুদবা তূর্যকে ফোনে না পেয়ে তার সাথে দেখার করার জন্য তার অফিসে চলে এলো। তূর্য অফিসে ঢুকেই রুদবাকে দেখে বিরক্ত মুখে বলল, “তুমি এখানে কি করছো?”
“আপনার কোনো খবর পাচ্ছি না।”
“তুমি যা করেছো সেদিন, এরপর আর তোমার সাথে কথা বলার রুচি পাচ্ছি না।”
রুদবা দু’কান ধরে বলল, “সরি, আমি যা করেছি সরি। আপনি আমার সাথে অভিমান করবেন না, প্লিজ। আমি অরুর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবো।”
“ঠিক আছে।”
রুদবা ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “অরু আপনার কাছে এতো ইম্পোরট্যান্ট?”
“ও আমার লিটল স্টার৷ আমার বোন তারা পাঁচ বছর বয়সে অসুস্থ হয়ে মারা গিয়েছিল। ও মারা যাওয়ার পর অরুকে দেখলেই আমার তারার কথা মনে পড়তো৷ তাই আমি অরুণিকাকে টুইংকেল বলেই ডাকতাম। আমার কাছে আমার ছোট বোনের হার্ডকপি অরুণিকা। ওর কিছু হলে, কেউ ওকে আঘাত করলে, অপমান করলে আমি ক্ষমা করবো না।”
রুদবা মলিন মুখে বলল, “সরি, আমি আপনাকে কষ্ট দিয়েছি। কিন্তু আপনি যেভাবে ভাবছেন, হয়তো অরুণিকা আপনাকে নিয়ে ঠিক সেভাবে ভাবতে পারছে না। ও আপনাকে অন্য দৃষ্টিতে দেখছে হয়তো।”
“তোমাকে আর বোঝানোর ক্ষমতা নেই আমার। এখন এখান থেকে যাও।”
হঠাৎ উপমাকে আসতে দেখে রুদবার হাত ধরে ফেলল তূর্য। রুদবা চমকে উঠল তূর্যের ব্যবহারে। তূর্য বলে উঠলো, “আচ্ছা, যা হওয়ার হয়েছে। আমি এসব ভুলে যাচ্ছি। তুমিও আর এমন কিছু করো না। পরে কথা বলবো তোমার সাথে। আমার এখন অফিসে কাজ আছে।”
রুদবার ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। এদিকে উপমা সেকেন্ড খানিক রুদবা আর তূর্যের হাতের দিকে তাকিয়ে চলে গেল। উপমা চলে যেতেই তূর্য রুদবার হাত ছেড়ে দিল। রুদবা অবাক হয়ে গেল তূর্যের ব্যবহারে।
(***)
কেটে গেল এক সপ্তাহ। জ্যৈষ্ঠ শুরু হয়েছে। আজ ক্যাম্পাস থেকে কক্সবাজারে শিক্ষাসফরে নিচ্ছে। যদিও অরুণিকার যাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই। কিন্তু বাসায়ও তার ভালো লাগছে না। এদিকে আহনাফ, ইভান আর তূর্য পিকনিক বাসে উঠে বসেছে। তূর্যকে ক্লাবের ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব দিয়েছে ডিন। আর ক্লাব থেকেই সব আয়োজন করা হয়েছে। তাই সেও যাচ্ছে। অন্যদিকে রুদবা দু’একদিন হলো বেশ শান্তভাবে কথা বলছে অরুণিকার সাথে। অতীত ব্যবহারের জন্য ক্ষমাও চেয়েছে। তাই অরুণিকা এসব নিয়ে আর ভাবলো না। তারা দু’জনই পাশাপাশি বসেছে আজ। টুকটাক কথাও বলছে। তবে আগের মতো ঘনিষ্ঠতা নেই। উভয়ের মাঝে অনেক জড়তা ভীড় করেছে। প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মধ্যে জয়িতাও এসেছে। অন্যদিকে ইমান অরুণিকা যাচ্ছে দেখে কক্সবাজার যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর জয়িতা তাকে বলেছিল, এই ভ্রমণ অরুণিকাকে তার কাছে নিয়ে আসবে। সেও জানতে চায়, কীভাবে এটা সম্ভব।
বাস চলতে শুরু করলো। ইমান চোখ বন্ধ করে ভাবলো, “ণিকা যাতে এবার আমার অনুভূতিটা বুঝতে পারে।”
এদিকে ইভান আর তূর্য আহনাফের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা দু’জনই চায়, আহনাফ আর অরুণিকার মধ্যে যাতে সব ঠিক হয়ে যায়। অন্যদিকে জয়িতা ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো। স্ক্রিনে শিরিন সুলতানার নামটি ভেসে উঠেছে। তিনি মেসেজ দিয়েছেন জয়িতাকে। সেখানে লেখা, “তোমার হাতে এটাই শেষ সুযোগ। কোনো জাদুই আহনাফের উপর কাজ করছে না। একমাত্র তোমার দেওয়া মেডিসিন অরুণিকা আর আহনাফের জীবন পাল্টে দেবে। এরপর আহনাফ বাধ্য হবে অরুণিকাকে ছাড়তে। ঠান্ডা মাথায় সব কাজ করবে কিন্তু। ভুল যাতে না হয়৷ এটাই কিন্তু শেষ সুযোগ।”
চলবে-
#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| বোনাস পর্ব ||
উল্টো দিকে ফিরে শাড়ি পরছে রুহানি। চুলগুলো খোঁপা করে রেখেছে সে। এমন সময় আরাফ রুমে ঢুকেই থমকে দাঁড়ালো। রুহানি পেছন ফিরে আরাফকে দেখে দ্রুত কুঁচি গুঁজে গায়ে আঁচল জড়িয়ে নিল। আরাফ আমতা-আমতা করে বলল, “সরি, আমার নক করে আসা উচিত ছিল।”
রুহানি লাজুক হেসে বলল, “কি বলছেন? আপনারই রুম। নক করতে হবে কেন?”
রুহানি এই বলে দ্রুত এলোমেলো হয়ে থাকা বিছানাটি গুছাতে লাগলো। আরাফ কিছু একটা খুঁজতে এসেছিল। হঠাৎ তার চোখ আটকালো রুহানির কোমড়ে। শাড়ির আঁচল সরে যাওয়ায় দৃশ্যমান হলো সেই অংশ। আরাফ রুহানির কাছে এসে বলল, “তোমার কোমড়ে এটা কীসের দাগ?”
রুহানি চমকে তাকালো আরাফের দিকে। ব্যস্ত হয়ে কোমড় হাতড়াতে লাগলো। আরাফ তার হাত ধরে তাকে থামিয়ে আয়নার সামনে এনে দাঁড় করালো। রুহানি উল্টোদিকে ঘুরে ঘাড় ফিরিয়ে আয়নায় নিজের কোমড়ের সেই ক্ষতটি দেখে চুপসে গেল। দ্রুত শাড়ির আঁচল টেনে ইতস্ততভাব নিয়ে আরাফের দিকে তাকালো। আরাফ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রুহানির দিকে তাকিয়ে আছে। রুহানি ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “হয়তো ব্যথা লেগেছিল!”
আরাফ রুহানির হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলল, “এটা স্বাভাবিক কোনো দাগ না। ক’দিন আগের এটা?”
রুহানি আরাফের হাতের দিকে তাকিয়ে বলল, “জানি না। বাদ দেন স্যার। চলে যাবে।”
রুহানি মেঝের দিকে তাকিয়ে রইল এক দৃষ্টিতে। আরাফ তার থুতনি ধরে বলল, “সত্য বলো, মেয়ে। কি হয়েছে?”
রুহানি কাঁপা কন্ঠে বলল, “ওইদিন আমাকে যখন ধরে নিয়ে গিয়েছিল। ওরাই…”
আরাফ ছেড়ে দিল রুহানিকে। মুখ ঘুরিয়ে নিল সে৷ রুহানির চোখ ছলছল করে উঠলো। আরাফ বেরিয়ে যাবে তখনই রুহানি ব্যস্ত কন্ঠে বলল, “আপনি চলে যাচ্ছেন কেন?”
আরাফ ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “আমি আসছি।”
রুহানি হতাশ দৃষ্টিতে আরাফের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল। তার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। আয়নার সামনে দাঁড়ালো সে। নিজেকে আপদমস্তক দেখে চোখ সরিয়ে নিল। বিড়বিড় করে বলল, “আমার শরীরে তো অনেক দাগ। এমনিতেই আরাফ স্যার আমার কাছে আসতে চাইছেন না। এখন এই দাগ দেখে উনার আমার উপর নিশ্চিত ঘৃণা জন্মেছে।”
রুহানি ব্যস্ত হাতে তার কোমড়ের সেই ক্ষতটিতে ক্রিম লাগাচ্ছে। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে শাড়ির আঁচল ঠিক করে সোজা হয়ে দাঁড়ালো সে। দেখলো আরাফ আবার রুমে এসেছে। তার হাতে কি যেন একটা আছে। আরাফ রুমে ঢুকে দরজার নব ঘুরিয়ে দিল। রুহানি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আরাফ তাকে বিছানায় বসার জন্য ইশারা করলো। রুহানি ভ্রূ কুঁচকে বলল, “জি?”
আরাফ এবার জোর গলায় বলল, “বসো।”
রুহানি চুপচাপ খাটে বসলো। আরাফ তার পেছনে এসে বসতেই রুহানি হুট করে দাঁড়িয়ে গেল। আরাফ তার হাত ধরে বলল, “বসতে বললাম না?”
রুহানি মাথা নেড়ে পুনরায় বসে পড়লো। হঠাৎ আরাফ তার শাড়ির আঁচল টেনে নামাতেই রুহানি বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। আরাফ তার ক্ষতে আঙুল ছোঁয়াতেই চোখ-মুখ খিঁচে ফেললো সে। আরাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “এই মেয়ে, এখানে কি লাগিয়েছো এগুলো?”
আরাফের কিঞ্চিৎ রূঢ় কন্ঠে রুহানি ভীত স্বরে বলল, “বডি ক্রিম।”
“তোমাকে কে বলেছে বডি ক্রিম লাগাতে? কাবিলতি করো? গাধা একটা।”
এই বলে আরাফ একটি অ্যান্টি-স্কার ক্রিম লাগিয়ে দিল সেই ক্ষতে। রুহানি চুপচাপ বসে আছে। আরাফ বলল, “এই দাগ আর কোথাও আছে?”
রুহানি মাথা নেড়ে বলল, “হুম।”
“তুমি সাবান দিয়ে গোসল করেছো? তোমাকে ডাক্তার প্রেসক্রাইব করে নি কিছু?”
“করেছে। কিন্তু বাসায় ফেলে এসেছি।”
“কিন্তু এতোদিনেও দাগ কমে নি কেন?”
“ওদিকে হাত যায় না আমার। সামনেই লাগিয়েছি। পিঠে হাত পৌঁছায় না।”
“অরুকে বলো নি লাগিয়ে দিতে?”
“ও যদি বুঝে ফেলতো?”
আরাফ উঠে জানালার পর্দাগুলো টেনে দিল। রুম এবার কিছুটা আবছা হয়ে এলো। আরাফ ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “তোমার…. খুলো ওটা।”
আরাফ ইশারায় বোঝালো। মুখে কিছু বলল না। রুহানি কাঁপা হাতে তার ব্লাউজ খুলে বসলো। আরাফ একটা উড়না রুহানিকে দিয়ে বলল, “এটা সামনে ধরে রাখো। বাকিটা খুলো।”
রুহানি আরাফের দিকে তাকিয়ে রইল। আরাফ শক্ত কন্ঠে বলল, “আমার এতো সময় নেই। আমাকে বেরুতে হবে।”
রুহানি দ্রুত শাড়ি খুলে উড়নাটা বুকের উপর ধরলো। আরাফ এবার তার পেছনে বসে মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালালো। আলো রুহানির পিঠে এসে পড়তেই আরাফ স্তব্ধ হয়ে গেল। পুরো পিঠে কালচে দাগ। মাঝে কয়েক স্থানে গভীর ক্ষত। আরাফ সেকেন্ড খানিক চোখ বুজে বসে রইল। তার হাত মুঠো হয়ে এসেছে৷ সে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে ধীরে ধীরে চোখ খুলে ক্রিমটি রুহানির পিঠের সব ক’টা ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দিল। এরপর রুহানির সামনে এসে বসলো। রুহানির চোখে জল দেখে ভেতরটা হুঁ হুঁ করে উঠলো তার। রুহানির হাতে ক্রিমটি দিয়ে বলল, “এটা প্রতিদিন দু’বেলা লাগাবে। তুমি যেখানে যেখানে পারবে লাগাবে। আর না পারলে আমাকে বলবে।”
“আপনাকে?”
“থাক বলতে হবে না। আমি নিজেই তোমাকে মনে করিয়ে দেবো।”
এই বলে আরাফ উঠে দরজার কাছে গিয়ে বলল, “জামা চেঞ্জ করার সময় দরজা লক করে দিও। যে-কেউ আসতে পারে। লক সিস্টেম কেন রেখেছে দরজায়?”
এই বলে আরাফ চলে গেল। এরপর বাইরে থেকে দরজায় ঠোকা মেরে বলল, “দরজা লাগাও।”
রুহানি উঠে দরজা লাগিয়ে দিল। আরাফ চলে যেতেই রুহানি তার হাতের ক্রিমটির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দিকে তাকালো সে। এবার নিজেকে দেখে ঘৃণা হচ্ছে না তার। বেশ ভালো লাগছে। বুকটা প্রশান্তিতে ভরে উঠেছে। সে নিজের দিকে তাকিয়ে বলল, “খুব ভাগ্যবতী আমি। এমন সুপুরুষ কার ভাগ্যে জুটে? যার চোখে কোনো লোভ নেই, কিন্তু শ্রদ্ধা আছে। আমি তো রোমান্টিক বর চেয়েছি। হ্যাঁ, সে একটু আনরোমান্টিক, কিন্তু নিরামিষও না। হয়তো অনেক লাজুক। হয়তো বা বেশি ভদ্র।”
রুহানি এসব ভেবে নিজের মনেই হাসলো। আরাফকে নিয়ে সারাদিন ভেবে ভেবে পার করলেও তার একটুও একঘেয়েমি আসবে না।
(***)
কক্সবাজার এসে পৌঁছাতেই সবাই নিজেদের রুম বুঝে নিল। অরুণিকা অবাক হয়ে গেল তার চাবি পেয়ে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাতজন মেয়ে একটি করে রুম পেয়েছে। ছেলেরাও তেমনই পেয়েছে। শুধু শিক্ষকরা ব্যক্তিগত রুম পেয়েছে। অরুণিকা ভাবতে লাগলো, “তাহলে আমি সিংগেল রুম কেন পেলাম?”
তূর্য ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে ছিল। অরুণিকা তার কাছে এসে বলল, “আমি একা একটা রুম পেয়েছি।”
তূর্য ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তুমি শেষে চাবি নিয়েছো কেন? একটা রুম এক্সট্রা নেওয়া হয়েছিল।”
“অন্য রুম থেকে কাউকে আমার সাথে উঠতে বললে ভালো হয়। আমি একা থাকতে চাচ্ছি না।”
“রুদবাকে বলো তোমার সাথে উঠতে। তোমার সেকশনের তো কেউই আসে নি।”
অরুণিকা রুদবার কাছে গিয়ে তার সাথে রুম শেয়ার করার প্রস্তাব দিল। কিন্তু রুদবা তার সেকশনের মেয়েদের সাথেই থাকতে চায়। কোনো মেয়েই অরুণিকার সাথে একই রুমে উঠতে রাজি হলো না। জয়িতা এক কোণায় দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখছে, আর হাসছে।
এদিকে অরুণিকা বাধ্য হয়ে সেই রুমটিতে উঠলো। বেশ বড় সেই রুম। একপাশে একটি কিং বেড। এর পাশে অনেক বড় ড্রেসিংটেবিল। জানালার সামনে একটি ডিভান। ছোট একটা ফ্রিজও আছে। দেয়ালের সাথে লাগানো একটি টিভি। ওয়াশরুমও বেশ বড়। অরুণিকা এবার বারান্দায় গেল। হোটেলের চতুর্থ তলায় সে৷ বারান্দা থেকে সমুদ্র দেখা যায়৷ বেশ চমৎকার দৃশ্য। রুমটা বেশ পরিপাটি। কিন্তু অরুণিকার মন খারাপ। কেউ কেন তার সাথে থাকতে চাইছে না? নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে ভীষণ। রুদবা এতোটা পরিবর্তন হয়ে গেল? যেই মেয়ের হাত ধরে গত পাঁচ বছরে সেই শহরের পথঘাট চিনেছে, সেই মেয়েটা এমন বদলে গেল? এতো অপরিচিত হয়ে গেল?
(***)
রুম থেকে বেরুতেই থমকে দাঁড়ালো অরুণিকা। জয়িতা আহনাফের হাত ধরে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। দু’জনের ঘনিষ্ঠতা দেখে অরুণিকা দ্রুত সরে পড়লো। আহনাফ অরুণিকাকে দেখে জয়িতার হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, “তুমি কী শুরু করেছো?”
জয়িতা বলল, “যদি অরুণিকা মুভ অন করতে পারে, তাহলে তুমি কেন পারবে না?”
“কেউ যদি মুভ অন করতে চায়, আমার এখানে কিছু করার নেই। আমি একবার যাকে ভালোবেসেছি, তার কাছ থেকে মুভ অন করার চিন্তায় করি না। আমি জানি না, তুমি কীসের অপেক্ষায় ছিলে! কিন্তু আমি আমার সুস্থ-অসুস্থ কোনো মস্তিষ্কেই তোমাকে আস্কারা দেই নি। তুমি কেন আশা নিয়ে বসে আছো? আমি কাউকে অরুর জায়গা দেবো না।”
“অরুণিকা তোমাকে ভালোবাসে না।”
“আমি ভালোবাসি, এটাই আমার জন্য যথেষ্ট।”
“তুমি ওকে ধরে রাখতে পারবে না। ও যদি চায়, তোমার ওকে ডিভোর্স দিতে হবে।”
“আমার ভালোবাসা এতো দুর্বল না। একটা সিগনেচারে সম্পর্ক শেষ হতে পারে। ভালোবাসা শেষ হয় না।”
এদিকে অরুণিকা দেয়াল ধরে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আহনাফের কি উচিত না সব ঠিক করে নেওয়া? তা না করে জয়িতার সাথে কি করছে আহনাফ? অরুণিকা মিনমিন করে বলল, “তুমি অন্তত আরেকটা সুযোগ চাইতে পারতে, আহনাফ। কিন্তু না, তোমার যেদিকে সুবিধা, তুমি সেদিকেই যাবে।”
অরুণিকা পিছু ফিরতেই ইমানের সাথে ধাক্কা খেল। ইমান অরুণিকার কোমড় জড়িয়ে ধরে বলল, “সাবধানে হাঁটো।”
অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “আমি ঠিকই আছি। আপনি চোরের মতো আমার পেছনে এসে না দাঁড়ালো ধাক্কা খেতে হতো না। একে তো আপনি আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন, আর আমাকেই সাবধানে হাঁটতে বলছেন? আপনি এখানে না দাঁড়ালে আমি ধাক্কা খেতাম না।”
অরুণিকা ইমানের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতেই দেখলো আহনাফ দাঁড়িয়ে আছে। অরুণিকা কিছু বুঝে উঠার আগেই আহনাফ চলে গেল। অরুণিকা মিনমিনিয়ে বলল, “ভালো হয়েছে। জয়িতার সাথে ঘেঁষো আরো। ইটস রিভেঞ্জ অব ন্যাচার।”
(***)
আহনাফ নিয়মমাফিক চলাফেরা করছিল এই কয়েকদিন। কিন্তু কক্সবাজার আসায় বেশ বিঘ্ন ঘটলো তার নিয়মে। রাতের খাবার খেয়ে রুমে ফিরতেই মাথাটা বেশ ঝিমঝিম করছিল তার। রুমের দরজা খুলবে তখনই জয়িতা তার সামনে এসে দাঁড়াল। আহনাফ দেয়াল শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। জয়িতা হালকা হেসে বলল, “মাথা ঘোরাচ্ছে?”
আহনাফ চোখ-মুখ কুঁচকে বলল, “আমার মাথা ঘোরাচ্ছে তো তুমি হাসছো কেন?”
জয়িতা হঠাৎ আহনাফের শার্ট খামচে ধরে তাকে নিজের দিকে টেনে আনলো। আহনাফের অধরের স্পর্শ পেল জয়িতা। চোখ বুজে নিলো সে। আহনাফের এমনিতেই ঘুম পাচ্ছে। শরীর অসার লাগছিল। তাই জয়িতা কাছে টেনে আনতেই সে ভারসাম্য হারিয়ে ফেললো। আর সেই মুহূর্তে অরুণিকা রুম থেকে বেরিয়ে এই দৃশ্য দেখে থমকে গেল। রুদবা বারবার ফোন দেওয়ায় সে রুম থেকে বেরিয়েছিল। কিন্তু এমন কিছু দেখবে সে আশা করে নি। অরুণিকা দ্রুত রুমে ঢুকে দরজা বেঁধে দিল। এদিকে আহনাফ জয়িতার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে চোখ-মুখ কুঁচকে তার দিকে তাকালো। এরপর শার্টের হাতা দিয়ে ঠোঁট ঘষতে লাগলো। জয়িতা কিছু বলতে যাবে, আহনাফ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আর কোনো ওয়ার্নিং দিচ্ছি না তোমাকে। আরেকবার আমার আশেপাশে ঘেঁষলে তোমাকে ইউনিভার্সিটি থেকে বের করে দিতে বলবো।”
“সরি, স্যার। আর হবে না। আমার কাজ শেষ৷”
এই বলে জয়িতা চলে গেল। আহনাফ ঘুম ঘুম চোখে রুমে ঢুকে দরজা আটকে শুয়ে পড়লো।
জয়িতা সিঁড়ি বেয়ে নামতেই রুদবাকে দেখলো। রুদবা তাকে দেখে ব্যস্ত কন্ঠে বলল, “আপনার কথামতো অরুকে ফোন দিয়ে বের হতে বলেছি। ও কি দেখে ফেলেছে?”
“হ্যাঁ, যা দেখানোর ছিল, দেখে ফেলেছে। এখন অরুণিকা মনে করবে, আহনাফ ওকে না পেয়ে আমাকে সময় দিচ্ছে।”
এই বলে জয়িতা হাসলো। আর বলল, “বেচারা আহনাফ! ওর বউ জানেই না, ও কতো ইনোসেন্ট। এখন আমাদের লাস্ট প্ল্যান। আগামীকাল রাতে আমি যা যা বলেছি, তুমি তাই করবে। এরপর বাকিটা অরুণিকা নিজেই করবে।”
চলবে-