#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-৫৫ (১ম ভাগ) || (১৮+ সতর্কতা)
কক্সবাজারে তিন দিন কেটে গেল। আজ শেষ রাত। আগামীকাল সকালেই চট্টগ্রাম ফিরবে সবাই। তাই রাতে ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা বারবিকিউ পার্টির আয়োজন করেছে। রিসোর্টের বাইরে খোলা জায়গায় সবাই গোল হয়ে বসেছে। যে যার কাজ ভাগ করে নিয়েছে। কেউ কেউ গানের প্লে-লিস্ট তৈরী করছে। শিক্ষকবৃন্দ বসে বসে শিক্ষার্থীদের কাজ দেখছে। আহনাফও বসে আছে, আর এদিক-ওদিক অরুণিকাকে খুঁজছে। সকাল থেকেই সে খেয়াল করেছে অরুণিকা কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে আছে। ঠোঁটে হাসি নেই। অনেকক্ষণ অরুণিকাকে আশেপাশে না দেখে তাকে খোঁজার জন্য উঠে দাঁড়াতেই থমকে গেল আহনাফ। অরুণিকা সবেমাত্র রিসোর্টের বাইরে বেরিয়ে এলো। পরণে হলুদ শাড়ি। ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছে তাকে। খোলা চুলগুলো হাওয়ার তালে উড়ছে। অরুণিকা বেরুতেই গান বেজে উঠলো কুয়াশ বাহের ‘তার ফিরে আসা অজানা, তার চলে যাওয়া অচেনা’ গানটি। আহনাফ চমকে উঠলো সেই গান শুনে। সে অরুণিকাকে নিয়েই লিখেছিল সেই গান। আহনাফ ধপ করে বসতেই ইভান আর তূর্য তার দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। তারা আহনাফকে এক দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে থাকতে দেখে তার দৃষ্টি অনুসরণ করলো। এরপর অরুণিকাকে দেখে একে অপরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি ফেরত দিল।
তূর্য আহনাফের পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, “সামলা, সামলা, নিজেকে সামলা ভাই। সামনে কিন্তু বউ না, স্টুডেন্ট দাঁড়িয়ে আছে।”
আহনাফ নিজেকে স্বাভাবিক করে চোখ সরিয়ে নিতেই দেখলো ইমান অরুণিকার দিকে তাকিয়ে আছে। হাত মুঠো হয়ে এলো আহনাফের। তবুও চোখ বুজে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলো সে। এদিকে অরুণিকা নিচে এসে সবার সাথে বসলো। কিন্তু কোনো শান্তি পাচ্ছে না সে। কেউ তার সাথে কথা বলছে না। কিন্তু কেন? তার সেকশনের কোনো মেয়েই আসে নি। তবে বাধ্যতামূলক নয় যে শিক্ষাসফরে আসতেই হবে। তার ক্লাসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু তাহসিন এসেছে শুধু। কিন্তু ক্লাসের আরো অনেক ছেলে থাকায়, তাহসিন তাদের নিয়েই ব্যস্ত ছিল। রুদবার সেকশনের অনেক মেয়েই এসেছে। এদের মধ্যে কয়েকজনের সাথে ক্যাম্পাসে বেশ আড্ডা জমে অরুণিকার। কিন্তু কক্সবাজার আসার পর থেকে এরা যেন অরুণিকাকে দেখেও দেখছে না। এদের এই উপেক্ষার কারণ সে কোনোভাবেই বুঝতে পারছে না। এতোগুলো সিনিয়র জুনিয়রের মধ্যে সে একা একটি মেয়ে এক কোণায় বসে আছে। এই মুহূর্তে তার সাথে কথা বলার জন্য উদগ্রীব ইমানই একমাত্র অবশিষ্ট মানুষ। কিন্তু অরুণিকা তাকে দেখলেই বিরক্ত হয়, বিধায় ইমান তার কাছে আসার সাহস পাচ্ছে না।
ক্যাম্পাসে জয়িতা ও তার ব্যাচমেটদের এই বছরই শেষ বছর। তাই তারা নিজেদের উদ্যোগে, নিজেদের খরচে ভিন্ন আয়োজন করেছে। বিভিন্ন প্রকারের পানীয়ের আয়োজন করেছে তারা। কোনটা গোলাপ ও রেউচিনির মিশ্রণে, কোনটা গোলাপ, লেবু ও পুদিনার মিশ্রণে, আবার কোনটা আনারস ও নারকেল পানির মিশ্রণে তৈরী। আরো বিভিন্ন প্রকারের ককটেল ভর্তি জার রাখা আছে টেবিলে। যেগুলো সিডার, বিভিন্ন ফল, আয়ুর্বেদিক পাতার রস দিয়ে তৈরী। জয়িতা নিজ হাতে জার থেকে সোডা গ্লাসে ঢেলে সবার হাতে হাতে দিচ্ছে। অরুণিকা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তার ইচ্ছে করছে সব ক’টা নিতে। কিন্তু জয়িতা যেন তাকে দেখেও দেখছে না। জয়িতার এই হাবভাব কারোই দৃষ্টি এড়াচ্ছে না। কিন্তু অরুণিকার জন্য কেউ এগিয়েও আসছে না। এমনকি রুদবাও এলো না। সে অন্তত জয়িতার কাছ থেকে অরুণিকার জন্য ককটেল নিয়ে আসতে পারতো। কিন্তু যায় নি। অন্যদিকে ইমান যেতে চাইলে রুদবা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “এতো দরদ আপাতত দেখাতে হবে না। আপনার জন্যই সব করছি।”
ইমান ভ্রূ কুঁচকে বলল, “এখানে আমার জন্য কি করছো বুঝলাম না। শুধু শুধু ণিকাকে কষ্ট দিচ্ছো তোমরা। তোমাদের প্ল্যান কি সেটা তো আমাকে বলোই নি।”
“আপনি চুপ থাকেন। বেশি কথা বলতে হবে না আপনাকে। নিজের জায়গায় গিয়ে চুপচাপ বসে থাকেন।”
এই বলে রুদবা ইমানকে পাঠিয়ে দিল। এদিকে অরুণিকা ভাবছে, তাহসিনকে পাঠাবে। কিন্তু তাহসিন তো ছেলেদের আড্ডায় মশগুল। তাহসিনকে ডাকার জন্য ওদিকটাই যেতে বেশ ইতস্ততবোধ করছে অরুণিকা। শেষমেশ সে বিড়বিড় করে বলল, “থাক, রিজিকেই নেই।”
এই বলে বসে পড়লো সে। এদিকে আহনাফ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জয়িতার দিকে তাকিয়ে আছে। অরুণিকার সাথে এমন শীতল ব্যবহারের জন্য বেশ চটে আছে সে জয়িতার উপর। যদিও জয়িতা এসে তাকে এক গ্লাস নিজ হাতেই এগিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আহনাফ নেয় নি। তবে অরুণিকার শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে পারলো না আহনাফ। জয়িতার কাছে এসে সব ক’টা ককটেল আলাদা ট্রে-তে সাজিয়ে দিতে বলল। জয়িতা বাঁকা হেসে ককটেল সাজাতে লাগলো। আর আহনাফ টেবিলে হেলান দিয়ে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে আছে। জয়িতা ট্রে সাজিয়ে উপরে উঠিয়ে দিতেই আহনাফ ট্রে নিয়ে রিসোর্টের ভেতরে চলে গেল।
রুদবা জয়িতার কাছে এসে বলল, “আপু, কাজ হয়েছে?”
জয়িতা গানের তালে শরীর দুলাতে দুলাতে বলল, “শিকার নিজেই ফাঁদে ধরা দিয়েছে।”
“স্যার যদি বুঝতে পারে, তোমাকে মেরে ফেলবে।”
“আগে এই ট্রমা কাটিয়ে উঠুক। আজ যেই ধাক্কা খাবে, কয়েক সপ্তাহ সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না৷ আমি জানি, আহনাফ চৌধুরী অরুণিকার ব্যাপারে কতোটা দুর্বল।”
“কিন্তু আমরা যা ভাবছি, তা যদি না হয়? অরু যদি সব মেনে নেয়?”
“এজন্যই তো পরবর্তী কাজ তোমার।”
“আমার ভীষণ ভয় লাগছে। তূর্য যদি বুঝে ফেলে, আমার কি হবে?”
“এতো কিছু ভাবতে হবে না। আমি সব ঠিক করে দেবো।”
এদিকে অরুণিকা এখনো বসে আছে বাইরে। হঠাৎ রুদবা তার পাশে এসে বসলো। অরুণিকা ক্ষীণ হেসে বলল, “এতোক্ষণ পর!”
“তোর একটা হ্যাল্প লাগবে।”
“হ্যাল্প লাগবে তাই এসেছিস?”
“তোর রুমের চাবিটা দিবি?”
“কেন?”
“আমার ওয়াশরুমে যেতে হবে।”
“তোদেরটা কোথায়?”
“আমার কাছে ছিল, কিন্তু হারিয়ে ফেলেছি। এখন ওদের বললে, সবার মজা নষ্ট হবে। পরে খুঁজে নেবো রুমে ঢুকার আগে। না পেলে রিসিপশন থেকে একটা নিয়ে নেবো। এখন তোরটা দে।”
অরুণিকা চাবি দিতেই রুদবা চলে গেল। এদিকে তূর্য অরুণিকার সামনে এসে বলল, “তোমাকে একটু ভেতরে যেতে হবে।”
অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কেন?”
“যাও না!”
এই বলে তূর্য চলে গেল। অরুণিকা কৌতুহলি মনে রিসোর্টে ঢুকতেই দেখলো আহনাফ ট্রে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অরুণিকা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই সে ইশারায় একপাশে আসতে বলল। ট্রে দেখেই অরুণিকার মনে একরাশ ভালো লাগা ভীড় করলো। তারা দ্বিতীয় তলার রিসোর্টের বারান্দায় এসে বসল। আহনাফ বেঞ্চে ট্রে-টি রেখে বুকে হাত গুঁজে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো। আর বলল, “জয়িতা তোকে ভীষণ জ্বালাচ্ছে, তাই না?”
অরুণিকা ককটেল হাতে নিয়ে বলল, “তুমি খেয়াল করেছো?”
“সারাদিন তো খেয়ালই করি।”
“হুম?”
আহনাফ অরুণিকার দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ হেসে বলল, “কিছু না।”
“কাল রাতে দেখলাম বেশ এগিয়ে গেছো।”
আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “মানে?”
“জয়িতা আপুকে কিস করছিলে।”
আহনাফ চমকে উঠলো অরুণিকার কথায়। সে অরুণিকার দিকে ঝুঁকে বসে বলল, “ভুল বুঝিস না আমাকে। জানি না, তখন আমার মাথা ভীষণ ভারী হয়ে এসেছিল। মেয়েটাই জোর করে এমন করেছে।”
“ও তোমাকে ভালোবাসে এখনো।”
“হ্যাঁ, সবাই তো ভালোবাসে। কিন্তু যার ভালোবাসা চাই, তার কোনো খবর নেই।”
অরুণিকা এক গ্লাস ককটেল শেষ করে বলল, “তুমি জিজ্ঞেস করতে পারো।”
“কি!”
“সে তোমাকে ভালোবাসে কি-না!”
“তুই জানিস আমি কার কথা বলছি?”
অরুণিকা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে হালকা হাসলো। সে চায় না আহনাফ তাকে হাসতে দেখুক। অরুণিকা নিজেকে স্বাভাবিক করে প্রসঙ্গ পালটে বলল, “সব আমার জন্যই এনেছো? তুমি নেবে না?”
“না। তোর সব টেস্ট করার ইচ্ছে ছিল, তাই তোর জন্য এনেছি।”
“তুমি কীভাবে বুঝলে?”
“আমি তোকে বুঝবো না?”
“যখন বোঝা উচিত ছিল, তখন তো বোঝো নি।”
আহনাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আর কতোবার ক্ষমা চাইলে, ক্ষমা করবি?”
“যা হয়েছে, আমি ভুলে গেছি। তোমার সাথে যা হয়েছে, আমার নিজেরই খারাপ লেগেছে সব শুনে। ইমন বলেছিল আমাকে। তোমার মা…”
আহনাফ অরুণিকাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “সে আমার মা নয়।”
“হুম। ডিভোর্স কি হয়ে গেছে?”
“আর মাত্র কয়েক সপ্তাহ। লাস্ট পেপার রেডি করছে বাবা। এরপর আমার ছোট্ট সংসারটা মুক্তি পাবে তার নজর থেকে।”
“এরপর?”
“এরপর কি?”
অরুণিকা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “তুমি কি সত্যিই হিমালয় না?”
আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কেন বারবার এই প্রশ্ন করছিস? আগেও একদিন করেছিলি।”
“আমার মনে হচ্ছে, হিমালয় আর তুমি একই মানুষ।”
“কেন?”
অরুণিকা আহনাফের চোখের দিকে তাকালো। আর মাত্র এক গ্লাস বাকি। অরুণিকা অল্প খেয়ে রেখে দিয়েছিল। আহনাফ বাকিটুকু খেয়ে নিল। অরুণিকা মুচকি হেসে আহনাফের কাছে আসতে যাবে, সে দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ক্যাম্পাস থেকে এসেছি আমরা। কি করছিস, অরু?”
অরুণিকা আহনাফকে হুট করে জড়িয়ে ধরলো। আহনাফ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অরুণিকা তার বুকে নাক ঘষতে লাগলো। আহনাফ তাকে সরিয়ে দিয়ে বলল, “অরু, কেউ দেখলে তোরই সমস্যা হবে।”
অরুণিকার মাতাল চাহনি আহনাফের বুকে তোলপাড় সৃষ্টি করার জন্য যথেষ্ট। আহনাফ নিজেকে বহু কষ্টে স্বাভাবিক করে অরুণিকাকে চেয়ারে বসিয়ে দিল। সে খেয়াল করলো অরুণিকার আচরণ বেশ পরিবর্তন হয়ে গেছে। ফাঁকা গ্লাসগুলোর দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো আহনাফ। এরপর অরুণিকাকে বসিয়ে রুদবাকে ডাকার জন্য গেল। দেখল সে এদিকেই আসছে। আহনাফকে দেখে সে অরুণিকার রুমের চাবি আহনাফের হাতে দিয়ে বলল, “স্যার, অরুকে পাচ্ছি না। এটা ওর রুমের চাবি।”
“অরু এখানেই আছে। ওর শরীর মনে হয় ভালো না। অদ্ভুত আচরণ করছে। ওকে একটু রুমে নিয়ে যাও।”
রুদবা অরুণিকাকে দেখার জন্য এগিয়ে এলো। অরুণিকা চেয়ারে বসে আছে। সে আহনাফকে দেখে উঠে আসতেই আহনাফ তার হাত ধরে আটকালো। ইশারায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে বলল। কিন্তু অরুণিকা শুনলো না। সে উল্টো আহনাফের বুকের উপর হাত রেখে বলল, “আহুনাফ!”
রুদবা ভ্রূ কুঁচকে অরুণিকার দিকে তাকালো। আহনাফ বলল, “ওকে নিয়ে যাও।”
“স্যার, আমি জানি ও আপনার ওয়াইফ। আপনিই নিয়ে যান ওকে। সবাই তো নিচে। কেউ দেখবে না।”
এই বলে রুদবা দৌঁড়ে চলে গেল। আহনাফ অরুণিকাকে সোজা দাঁড় করিয়ে বলল, “এই তুই এমন করছিস কেন? সোডাও যদি খেতে না পারিস? সোডা খেয়ে মাতাল হতে প্রথম তোকেই দেখলাম।”
অরুণিকা আহনাফের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “আমার মনে হচ্ছে, আমি আকাশে ভাসছি।”
“সিরিয়াসলি?”
“আমার সামনে অনেক আলো।”
“এখন রাত!”
“কিন্তু অনেক আলো।”
“আচ্ছা! তারপর?”
“আহুনাফ, এই আহুনাফ আমার বেশি গরম লাগছে।”
“গরম পড়ছে, তাই গরম লাগছে।”
অরুণিকা আহনাফের বুকে ঘুষি মেরে বলল, “যাহ দুষ্টু।”
আহনাফ মুখ চেপে হেসে বলল, “দুষ্টুমি তো আমি করছি না।”
অরুণিকা আহনাফের ঠোঁটে হাত রেখে বলল, “জয়িতা ফজ্জাতিকে চুমু খেয়েছিলে না? আমাকে তো খাচ্ছো না!”
আহনাফ চোখ বড় বড় করে তাকালো। অরুণিকা অভিমানী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আহনাফের দিকে৷ আহনাফ অরুণিকাকে কোলে নিয়ে বলল, “বেশি দেরি হলে আমাকেই আস্ত খেয়ে ফেলবি তুই। চল, তোকে তোর ঘরে দিয়ে আসি৷ ওখানে একা একা লাফাতে পারবি।”
এই বলে উপরে উঠে গেল আহনাফ। অরুণিকার রুমের সামনে এসে চাবি দিয়ে দরজা খুলে রুমে ঢুকলো। আহনাফ অরুণিকাকে বিছানায় শুইয়ে দিতেই অরুণিকা আবার তার কাছে এসে অনুরোধের সুরে বলল, “আমার কাছে থাকো না, আহুনাফ!”
“তুই চুপচাপ শুয়ে থাক।”
“আহুনাফ!”
“আহুনাফ আবার কি!”
“আমার জন্য তুমি তো সেই আহুনাফ।”
“তোর ছোটবেলার অভ্যাস আর যায় নি, না?”
অরুণিকা মাথা ঘুরিয়ে বলল, “উহুম।”
আহনাফ খেয়াল করলো অরুণিকার গলা, গাল লাল হয়ে আসছে। সে কাছে আসতেই অরুণিকা তাকে টেনে বিছানায় শুয়ে পড়লো। আহনাফ ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে বলল, “তোর এখন মাথা ঠিক নেই।”
অরুণিকা আহনাফের হাত ধরে বলল, “প্লিজ!”
“কি প্লিজ?”
“আমার সাথে থাকো। তোমার স্মেলটা বেশি ভালো লাগে আমার।”
এই বলে আহনাফের হাত ধরে উঠে দাঁড়িয়ে তার শার্টে নাক ডুবিয়ে দিল। আহনাফ মিনিট খানিক স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অরুণিকা আহনাফের কাঁধে ভর দিয়ে পা উঁচু করে তার অধর ছুঁয়ে দিতেই তার হুঁশ ফিরলো। আহনাফও এবার অরুণিকার কোমড় জড়িয়ে ধরলো। সেকেন্ড খানিক পর নিজ থেকেই অরুণিকাকে সরিয়ে দিয়ে বলল, “কন্ট্রোল, অরু। কন্ট্রোল।”
এই বলে দরজার কাছে আসতেই অরুণিকা শাড়ির আঁচল ঘুরিয়ে বলল, “আমাকে সুন্দর লাগছে না, বলো?”
আহনাফ পিছু ফিরে অরুণিকার দিকে তাকালো। অরুণিকা দু’হাত পেছনে এনে বলল, “আমাকে তোমার জয়িতা বেইবির থেকে বেশি সুন্দর লাগছে না?”
আহনাফ মুখ চেপে হেসে চাবি ভেতরে ঢুকিয়ে দরজা আটকে দিল। অরুণিকা আহনাফের কাছে এসে তার দু’কাঁধে হাত রেখে ফিসফিস করে বলল, “আস্তে করে বলো। জয়িতা বেইবি রাগ করবে নয়তো!”
আহনাফ হেসে বলল, “এসব কি বলছিস তুই!”
“ভালো লাগছে না আমাকে?”
“আমার চোখে তুই সবসময় সুন্দর।”
“আর ওই পেত্নীটা?”
“ওটা পেত্নীই।”
“ফোনে রেকর্ড করে রাখো৷”
“আমার মনে রেকর্ড করা আছে।”
“ভুলে যাবে না তো?”
“উহুম।”
আহনাফ অরুণিকার হাত ধরে তাকে টেনে বিছানায় বসালো। অরুণিকা তার গলায় মুখ ডুবিয়ে দিতেই আহনাফ তাকে আটকাতে যাবে, হুট করে অরুণিকার স্পর্শকাতর অঙ্গে হাত লাগলো। আহনাফ দ্রুত হাত সরিয়ে নিল। অরুণিকাকে সরাতে যাবে, মেয়েটা আরো উন্মাদ হয়ে পড়লো।
গলায় অরুণিকার উন্মাদ স্পর্শ পড়তেই আহনাফ বুঝলো, ককটেলে কিছু মেশানো হয়েছিল। নয়তো নিচে কারো সাথেই এমন হয় নি, অরুণিকার সাথে কেন এমন হচ্ছে। সে অরুণিকাকে সরিয়ে দিয়ে উঠতে যাবে, অরুণিকা পেছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরলো তাকে। কাঁপা কন্ঠে বলল, “প্লিজ, আহুনাফ। আমার কাছে থাকো।”
আহনাফ অরুণিকার দিকে ফিরে বলল, “তুমি ভালো মেয়ে না? একটু বসো, আমি আসছি।”
অরুণিকা আহনাফের শার্টের কলার ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে আনলো। অরুণিকার উষ্ণ স্পর্শে আহনাফ নিজের নিয়ন্ত্রণ হারাতে লাগলো। কেমন যেন সব ঘোলাটে মনে হচ্ছিল তার। মনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে হেরে গেল আহনাফ। অরুণিকাকে জড়িয়ে ধরলো সে। অনেক বছর পর উভয়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা দেয়াল ভেঙে গেল। কেটে গেল জড়তা। অদৃশ্য মায়ায় বাঁধা পড়লো দু’টি দেহ।
(***)
জানালার পর্দা টানা হয় নি রাতে। রোদ উঠতেই পুরো ঘরে আলো ছড়িয়ে পড়লো। নরম বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছে অরুণিকা। ঘুমের মধ্যেই তার মনে হচ্ছে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। জানালার দিকে মুখ ঘুরাতেই চোখে রোদ লাগায় দ্রুত চোখ খুললো সে। উঠে বসতেই নিজের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে দ্রুত চাদর জড়িয়ে নিলো গায়ে। ভয়ে ভয়ে পাশ ফিরে আহনাফকে দেখে স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো। আহনাফের হাতের উপর শুয়ে বুকে হাত দিয়ে ভীত স্বরে বলল, “আমি কি না কি ভেবে ফেলেছি।”
পরক্ষণেই অরুণিকা উঠে বসলো। ভালোভাবে নিজেকে খেয়াল করে আহনাফের হাতে হালকা একটা ঘুষি মেরে বলল, “বাত্তেমিজ ছেলে। খুব তো ন্যাকামো করছিলে। না, অরু, না। হুহ। এখন তো শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। কতোদিন পর শখ মিটেছে ছেলেটার! থাক, তুমি মিয়া ঘুমাও।”
হঠাৎ আহনাফের ফোনে টুংটাং শব্দ হলো। হয়তো কেউ মেসেজ দিয়েছে। অরুণিকা গায়ে ভালোভাবে চাদর জড়িয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়লো। এরপর মেঝে থেকে আহনাফের শার্ট তুলে পরে নিলো। আর চাদরটি রেখে দিল বিছানায়। আবার ফোন বেজে উঠলো। আহনাফের প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখলো তূর্যের কল এসেছিল। হঠাৎ অরুণিকার চোখ দু’টি স্থির হয়ে গেল শেষ মেসেজটি দেখে৷ সেটা ছিল তূর্যের মেসেজ। অরুণিকা ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লো। তার মনে হচ্ছে কান দিয়ে গরম হাওয়া বের হচ্ছে। এদিক-ওদিক ভীত দৃষ্টিতে তাকালো সে৷ এরপর চাদরটি বিছানা থেকে নিয়ে আবার নিজেকে ঢেকে ফেললো। ধীরে ধীরে চোখ ঝাপসা হয়ে এলো তার৷ পরক্ষণেই দ্রুত চোখ মুছে আবার মেসেজটি দেখলো। হয়তো তার কোনো ভুল হয়েছে মেসেজ দেখতে৷ তাকে এতো বড় ধোঁকা দেবে আহনাফ? অরুণিকা মেসেজটি আবার পড়লো। সেখানে লেখা,
“তুই ইঞ্জয় কর। অরুর রুমে ক্যামেরা সেট করে রেখেছি। সব ভিডিও….”
ফোনে পাসওয়ার্ড থাকায় বাকিটুকু পড়া যাচ্ছে না।
অরুণিকা অনেক আগে বাড়িতে আহনাফের পাসকোর্ড দেখে নিয়েছিল। যদিও এটা আহনাফের নতুন ফোন। তবুও সেই কোর্ডটি লিখতেই ফোনের লক খুলে গেল। অরুণিকা এবার তূর্যের ইনবক্সে ঢুকলো। সেখানে লেখা,
“তুই ইঞ্জয় কর। অরুর রুমে ক্যামেরা সেট করে রেখেছি। সব ভিডিও সেইভ হয়ে গেছে। এখন চাইলেও ও তোকে ছাড়তে পারবে না। ভিডিও দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে ওকে নিজের কাছে রাখতে পারবি। ও জানতেই পারলো না, ওকে ফাঁদে ফেলার জন্য আবার কতো বড় অভিনয় করেছিস তুই।”
অরুণিকা মিনিট খানিক শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এরপর ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে মেরে ব্যস্ত হয়ে ক্যামেরা খুঁজতে লাগলো। ক্যামেরা খুঁজতে খুঁজতে জিনিসপত্র মেঝেতে ছুঁড়ে মারতে লাগলো সে। শব্দ শুনে আহনাফের ঘুম ভেঙে গেল। সে উঠে অরুণিকার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। মাথাটা ভারী ভারী লাগছে তার। অরুণিকাকে এভাবে ব্যস্ত হয়ে কিছু খুঁজতে দেখে জিজ্ঞেস করলো, “কি খুঁজছিস?”
অরুণিকা ভয়ংকর দৃষ্টিতে আহনাফের দিকে তাকালো। আহনাফ তাড়াতাড়ি উঠে অরুণিকার কাছে এসে বলল, “ডোন্ট সে তোর কিছু মনে নেই!”
অরুণিকা ঘৃণা ভরা দৃষ্টিতে আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলল, “কাল রাতে কি হয়েছে সব মনে আছে। কিন্তু তোমার আসল চেহারা, যেটা আমাকে অনেক বছর আগে দেখিয়েছিলে, ওটা ভুলে গিয়েছিলাম। এখন সেটা আবার মনে পড়ে গেছে।”
আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “হোয়াট?”
অরুণিকা বিছানা থেকে আহনাফের ফোন খুঁজে নিয়ে তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “তোমার বন্ধুর মেসেজ দেখে ফেলেছি আমি।”
আহনাফ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অরুণিকার দিকে। এদিকে অরুণিকা ব্যস্ত হয়ে সেই ক্যামেরা খুঁজছে। আহনাফ ফোনের স্ক্রিন খুলতেই তূর্যের মেসেজ দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল। সে অরুণিকাকে কিছু বলতে যাবে, তখনই ক্যামেরাটা টিভির পাশ থেকে বের করলো অরুণিকা। আহনাফের হাত থেকে ফোন পড়ে গেল। চুল খামচে ধরে ক্যামেরাটা অরুণিকার হাত থেকে কেঁড়ে নিলো সে। অরুণিকা ধপ করে মাটিতে বসে পড়লো। আহনাফ কাঁপা কন্ঠে বলল, “কে করেছে এই কাজ? তূর্য এমন মেসেজ কেন দিল?”
অরুণিকা শব্দ করে কাঁদতে লাগলো। আহনাফ অরুণিকার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল, “বিলিভ মি, অরু। আমি কেন এই কাজ করবো? তুই আমার বউ। আমি এতোটা গায়রতহীন না, অরু। আমার বউয়ের ভিডিও করবো আমি? তাও আবার ফ্রেন্ডকে বলে? এতোটা জঘন্য ভাবিস না আমাকে।”
অরুণিকা সশব্দে আহনাফের গালে চড় বসিয়ে দিয়ে বলল, “তোকে বিশ্বাস করবো? তুই আমাকে কতোবার ঠকিয়েছিস, মনে আছে? আমি তোর বউ? তোর তো গায়রতই নেই। গায়রত থাকলে তোর বন্ধু, আত্মীয়দের সামনে আমাকে ক্যারেক্টরলেস প্রমাণ করতি না। তোর মা যখন আমাকে নষ্ট মেয়ে বলছিল, তখন কাপুরুষের মতো দাঁড়িয়ে তামাশা দেখতি না। তোকে জঘন্য না ভাবতাম? তোর মতো জঘন্য পুরুষ, আমি আমার বাপের জন্মেও দেখি নি।”
আহনাফ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। অরুণিকা আহনাফকে জোরে ধাক্কা মেরে বলল, “তুই চেঞ্জ হবি না। তুই কখনো চেঞ্জ হবি না। তুইই নিশ্চয় ককটেলে কিছু মিশিয়েছিলি, তাই না? আমার এজন্যই তো কাল নিজের উপর কন্ট্রোল ছিল না। তুই নিজে একটা এডিক্টেট, এখন আমাকেও এডিক্টেট বানাবি?”
আহনাফ মেঝেতে বসে বলল, “আমি তোর সাথে আগে অনেক খারাপ করেছি। কিন্তু আজ তোর সাথে আমি কিছু করি নি। আমার সাথে এভাবে কথা বলিস না, অরু।”
অরুণিকা উঠে দাঁড়াতেই আহনাফও উঠে দাঁড়িয়ে অরুণিকার হাত ধরে বলল, “আমাকে একটু সময় দে। আমি তূর্যকে জিজ্ঞেস করছি।”
আহনাফকে আবার ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল অরুণিকা। বলল, “আবারও নতুন কোনো প্ল্যান! তুই আমার ভিডিও ভাইরাল করে দিতে চাস? করে দে৷ আমি ফ্যানের সাথে ঝুলে যাবো, তবুও তোর মতো ইবলিশের সাথে সংসার করবো না।”
আহনাফের চোখ ছলছল করে উঠলো। অরুণিকা আহনাফের বুকে আঙুল তাক করে বলল, “তোকে আমি হিমালয় ভেবেছিলাম। কিন্তু না। অসম্ভব। তোর মতো জঘন্য মানুষ হিমালয় হওয়ার যোগ্য না। তুই রাস্তার লোক। তোর মা যেমন, তুইও তেমন।”
আহনাফ শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো অরুণিকাকে। অরুণিকা নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ধস্তাধস্তি করতে লাগলো। আহনাফ কান্নাভেজা কন্ঠে বলল, “এভাবে বলিস না, অরু। আমাকে কথায় মারিস না, প্লিজ। আমাকে একটু সময় দে৷ আমাকে বিশ্বাস কর।”
অরুণিকা আহনাফের বাহুতে দাঁত বসিয়ে দিল। আহনাফ তৎক্ষণাৎ অরুণিকাকে ছেড়ে দিতেই অরুণিকা তাকে ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে দিল। এরপর নিজের রাগ ধরে রাখতে না পেরে আহনাফকে মারতে যাবে, আহনাফ তার পা ধরে শীতল কন্ঠে বলল, “বেয়াদবি করবি না।”
“তুই শ্রদ্ধার মানুষ না।”
“আমি যদি তোর কথায় মরে যাই, আমাকে খুঁজেও পাবি না আর।”
“তুই চলে যা। আমার জীবন থেকে যা তুই। তোর *** বেড়ে গেছে তাই আমাকে নেশা করিয়ে নিজের শখ মিটিয়েছিস।”
“মাইন্ড ইউর ল্যাঙ্গুয়েজ।”
“তুই রেইপ করেছিস আমার। কি খাইয়েছিস বল!”
আহনাফ উঠে অরুণিকাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে নিজের শার্ট ধরে বলল, “আমার শার্ট খুলে দে।”
অরুণিকা শার্ট খুলে আহনাফের মুখের উপর ছুঁড়ে মারলো। এরপর ব্যাগ থেকে জামা-কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। আহনাফও কিছু না বলে শার্ট-প্যান্ট পরে এলোমেলো ভাবে রুম থেকে বেরিয়ে এলো।
করিডোরে হাঁটছে তূর্য৷ আহনাফকে আসতে দেখে সে বলল, “তোকে ফোন দিয়েছিলা….”
আহনাফ এসেই তূর্যের নাক বরাবর ঘুষি মারলো। তূর্য ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লো। সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই আহনাফ ইচ্ছেমতো মারলো তাকে। মারামারির শব্দ শুনে অনেকেই রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে। ইভানও বেরিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে। তূর্য একাধারে মার খেয়েই যাচ্ছে। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। আহনাফকে অনেকে মিলে ধরে শান্ত করানোর চেষ্টা করছে। ইভান তূর্যকে টেনে তুলে চেঁচিয়ে বলল, “পাগল হয়ে গেছিস?”
আহনাফ তার ফোন ছুঁড়ে মেরে বলল, “আমার জীবনটা ধ্বংস করে দিয়েছে এই *** বাচ্চা।”
তূর্য চেঁচিয়ে বলল, “আমার বাপ ধরে গালি দিবি না। খুন করে ফেলবো তোকে।”
“খুন কর তুই। আমার বেঁচে থাকার কিছুই বাকি রাখিস নি আর।”
আহনাফ মেঝেতে ধপ করে বসে পড়লো। রুদবা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সে আশেপাশে জয়িতাকে খুঁজছে। তার মনে অজানা ভয় ভীড় করতে লাগলো। সে কি জয়িতার কথায় অনেক বড় একটা ভুল করে বসেছে?
আহনাফকে ধরে কয়েকজন ছেলে রুমে নিয়ে গেল। তূর্যের মাথা ঘোরাচ্ছে। সে ধপ করে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো। ইমানসহ কয়েকজন তাকে ধরে উঠালো। ইমান ইভানকে বলল, “স্যার, তূর্য স্যারকে হাসপাতালে নিতে হবে।”
ইভানের মাথা কাজ করছে না। সে আহনাফের ফোন উঠিয়ে বলল, “তোমরা ওকে নিয়ে যাও। আমি আসছি।”
আহনাফের ফোনের স্ক্রিন বন্ধ। লক থাকায় ঢুকতে পারলো না ইভান। সে নিজের মনেই ভাবছে, “কি এমন হলো, যে আহনাফ কথা নেই বার্তা নেই কোনো পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা না করেই তূর্যকে এভাবে মারলো! একটা সমস্যা শেষ না হতেই আরেকটা শুরু। ব্ল্যাকম্যাজিকের কারণেই কি শান্তি আসছে না আহনাফের জীবনে? কখনো অরুকে নিয়ে ঝামেলা, কখনো একে নিয়ে, আবার কখনো ওকে নিয়ে। এখন তো সোজা তূর্যের সাথে!”
চলবে-
#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-৫৫ (২য় ভাগ) ||
জয়িতার রুমে এসে রুদবা অবাক হয়ে গেল। একটু আগেই না-কি ব্যাগপত্র গুছিয়ে চলে গেছে সে। রুদবার কপালে এবার বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে। জয়িতা তাকে এ কোন বিপদে ফেলে চলে গেছে! জয়িতার কথায় কাল সে অরুণিকার রুমে ক্যামেরা লাগিয়ে এসেছিল। সারারাত জয়িতা নজর রেখেছিল আহনাফ ও অরুণিকার উপর। রুদবা তার পাশে এসে যখন ল্যাপটপ স্ক্রিনে এই দৃশ্য দেখলো, দ্বিধা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “আপু, আপনি কেন এসব দেখছেন?”
জয়িতা বাঁকা হেসে উত্তর দিল, “না দেখলে তোমাকে কখন কি করতে হবে, সেটা কীভাবে জানাবো? আর এই ভিডিও আমি সেইভ করে রাখবো৷ এরপরই তো আহনাফ চৌধুরীকে ইচ্ছেমতো নাচাতে পারবো আমি। এই ভিডিও ভাইরাল হলে ওর সাথে ওর বউয়ের মান-সম্মানও যাবে। এবার তো বাধ্য হয়ে ডিভোর্স দেবে।”
রুদবা মনে মনে ভাবছে, “কেমন ধূর্ত প্ল্যান! আমার মাথা থেকে এমন আজগুবি আইডিয়া কখনোই বের হতো না।”
জয়িতা সারারাত জেগে ছিল। রুদবা তার সাথেই ঘুমিয়েছিল রাতে। জয়িতা যখন দেখলো অরুণিকারই আগে ঘুম ভেঙেছে, সে রুদবাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে শেষ কাজটি করে ফেলতে বলল। রুদবাও দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে তূর্যের রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো। বার কয়েক রুমের দরজায় কড়া নাড়তেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো তূর্য। রুদবাকে দেখে ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কি সমস্যা?”
“তূর্য, আমার ফোনটা বন্ধ হয়ে গেছে। আমি আপনার ফোন থেকে একটা কল করতে পারবো?”
তূর্য রাগী স্বরে বলল, “তুমি এজন্য আমাকে ডেকেছো? আজিব তো। তোমার আশেপাশে সবার ফোন বন্ধ না-কি?”
“আসলে বাবা-মাকে ফোনে পাচ্ছি না। বাসার একটা নম্বর আছে। ওই নম্বর আমার মনে নেই। আপনাকে আমি কল দিয়েছিলাম সেই নম্বর থেকে। যদি প্রিভিয়াস কল চেক করি, নিশ্চয় ওই নম্বরটা পাবো।”
তূর্য রুদবাকে ফোন দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। রুদবা দ্রুত আহনাফের নম্বর খুঁজে সেই মেসেজটি পাঠালো, যেটি অরুণিকা দেখেছিল। এরপর তূর্যের দিক থেকে মেসেজটি ডিলিট করে দিল। তূর্যকে ফোন ফেরত দিয়ে চুপচাপ জয়িতাকে এসে জানালো সব। জয়িতা তাকে রুমে গিয়ে আরাম করতে বলল। কিন্তু এখন মেয়েটা যে রুদবাকে বিরাট ঝামেলায় ফাঁসিয়ে দিয়ে পালিয়ে গেছে, এটা বুঝতে পেরে আপসোস করছে সে।
এদিকে ইভান আহনাফের রুমে এসে দরজা আটকে দিল। আহনাফ মেঝেতে বসে আছে। কেমন এলোমেলো লাগছে তাকে। ইভান আহনাফের মুখোমুখি বসে বলল, “সমস্যা কি সেটা বলবি?”
আহনাফ ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “আমার ফোন কোথায়?”
ইভান ফোনটা এগিয়ে দিল। আহনাফ ফোন ঘেঁটে তূর্যের মেসেজটি বের করে ইভানকে দেখালো। ইভান স্তব্ধ হয়ে মেসেজটির দিকে তাকিয়ে রইল। আহনাফ হতাশ কন্ঠে বলল, “ও যদি এটা মশকরা করে থাকে, তাহলে ওকে বলে দিস, এই মশকরা আমার জীবনটা শেষ করে দিয়েছে।”
“এটা তূর্য কেন পাঠাবে? ওর সাইডটাও তো শুনতে হবে না-কি।”
আহনাফ বুকে হাত রেখে বলল, “অরু, আমার বুকটা ঝাঁঝরা করে দিয়েছে, ইভান। আজ আমি কোনো অপরাধ না করে অপরাধী হয়েছি। ক্যামেরা কিন্তু ঠিকই ছিল আমাদের রুমে। তূর্য যদি মশকরা করেও এই ভিডিও করে থাকে আমি ভুলে যাবো, ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল।”
“তোর মনে হয় ও এমন করবে? তুই থাক রুমে। সবার সামনে কাহিনী একটা করে ফেলেছিস তো! এখন সবাই আমাকে জিজ্ঞেস করছে কি হয়েছে। তূর্যকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে ইমান। আমি ওখানে যাচ্ছি। ওকে এসব জিজ্ঞেস করা দরকার। আমি এক সাইড শুনে কোনো কথা বলবো না। তোরা দুই জনই আমার ফ্রেন্ড৷ এন্ড আমি তোদের দু’জনকেই চিনি। তূর্য কখনো এমন করবে না।”
আহনাফ চেঁচিয়ে বলল, “তাহলে মেসেজটা কি জ্বিনে পাঠিয়েছে?”
“আমি ওর সাথে কথা বলি আগে।”
(***)
রুম বন্ধ করে বসে আছে অরুণিকা। নাস্তার টেবিল আজ ফাঁকা। রুদবার গলা দিয়ে খাবার নামছে না। নিজেকে নিজেই বকছে সে। কাজটা করার আগে ভাবা উচিত ছিল তার। এদিকে অরুণিকা রুম থেকে বেরুতেই ইমানের মুখোমুখি হলো। অরুণিকার চোখ-মুখ ফুলে আছে। সে রুম বন্ধ করে উন্মাদের মতো কেঁদেছিল এতোক্ষণ৷ ইমান অরুণিকার দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই ভয়ংকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সে। ইমান হাত গুটিয়ে নিয়ে বলল, “কি হয়েছে তোমার? মন খারাপ?”
অরুণিকা কিছু বলতে যাবে আহনাফ রুম থেকে বেরুলো। অরুণিকা আর ইমানকে একসাথে দেখে সে এগিয়ে এসে অরুণিকাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আমার তোর সাথে কথা আছে। একটু এদিকে আয়।”
অরুণিকা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “তোমার মতো থার্ড ক্লাস মানুষের সাথে আমার কথা বলার কোনো রুচি নেই।”
আহনাফ রাগী দৃষ্টিতে অরুণিকার দিকে তাকালো। ইমান দু’জনের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। আহনাফ অরুণিকার হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে যাবে, ইমান তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “স্যার, আপনি ওকে এভাবে জোর করতে পারেন না।”
“ও আমার ওয়াইফ। তুমি আমাদের মাঝখানে কথা বলার কে?”
অরুণিকা আহনাফের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ইমানের হাত ধরে বলল, “আমি ইমানকে পছন্দ করি। ওকে কথার বলার অধিকার আমি দিয়েছি। তোমার মতো ছেলে থেকে হাজার গুন ভালো ইমান। তোমার মতো মদখোর না এই ছেলে। তোমার মতো নেশা করে মেয়েদের সাথে জোরাজুরি করে না। তোমার মতো মেয়েদের ক্যারেক্টরে আঙুল তুলে না। তোমার ফ্যামিলি থেকে ফার বেটার ওর ফ্যামিলি। ভালোবাসা আছে ওদের মধ্যে। হোম পলিটিক্স করে সম্পর্ক নষ্ট করে না। ওদের বন্ডিং অনেক ভালো। ইনফ্যাক্ট ওর বাবা-মা অনেক ভালো।”
আহনাফ অরুণিকার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। অরুণিকা পুনরায় বলল, “মিস্টার আহনাফ চৌধুরী, তুমি তোমার স্ট্যাটাসের মেয়ে ডিজার্ভ করো। হয়তো তোমার বাবার অনেক টাকা আছে। বাট ম্যান্টালিটির দিক থেকে তুমি একটা ভিখারী। যার মা খুনি, অবৈধ সম্পর্কে জড়ায়, তার ছেলে কী করে ভালো হয়। তুমি একটা এডিক্টেট। তোমার মতো ছেলের সাথে কোনো ভবিষ্যৎ নেই আমার।”
আহনাফ ইমানের দিকে তাকাতে পারলো না আর। সে শুকনো হেসে চলে গেল। আহনাফ চলে যেতেই ইমান অরুণিকার হাত ধরে বলল, “তুমি আমাকে পছন্দ করো?”
ইমানকে সরিয়ে দিয়ে অরুণিকা বলল, “আমি জীবনে দু’দুবার ভালোবাসেছি। একবার এই আহনাফ চৌধুরীকে। যেটাকে অবশ্য আমি ভালোবাসা বলবো না। আমার আবেগ ছিল। কিন্তু আমি এই মানুষটিকেই দ্বিতীয় বার হিমালয় ভেবে ভালোবেসেছি। আর দুই বারই আমি ঠকেছি। কারণ আপনিই সেই হিমালয়। কিন্তু আই এম রিয়েলি সরি। আমি আপনাকে ভালোবাসতে পারছি না। আমার মন আর কখনো কোথাও আটকাবে না। আমি সিল মেরে দেবো এই মনে।”
ইমান হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অরুণিকার দিকে। আর অরুণিকা কথাগুলো বলেই হনহনিয়ে চলে গেল।
(***)
তূর্য হাসপাতাল থেকে ফিরে সোজা আহনাফের রুমে ঢুকলো। ইভানও ঢুকলো সেই রুমে। আহনাফ মেঝেতে বসে আছে। তূর্য আহনাফের কাঁধে হাত রাখতে সে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। তূর্য বলল, “এভাবে না মেরে আমাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করতে পারতি। মাড়ি ফুলে গেছে আমার। যাই হোক, ইভান সব বলেছে আমাকে। আমি কসম করে বলছি, আমি তোকে মেসেজটা দেই নি। মেসেজটা ভালোভাবে দেখ। আমি অরুণিকাকে অরু বলে কখনো ডেকেছি, বল? টুইংকেল বলেই ডাকি আমি। টুইংকেল না বললে একদম অরুণিকা বলেই ডেকেছি যতোবার ডেকেছিলাম। অরু বলে তো আরাফ, তাহমিদ, তুই আর ইমন ডাকিস।”
আহনাফ চুপ করে রইল। তূর্য বলল, “যেই সময়ে তোর কাছে মেসেজটা গিয়েছিল, আমি রুদবাকে আমার ফোন দিয়েছিলাম। মেয়েটা এমন একটা কাজ করবে আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না।”
আহনাফ হঠাৎ নড়েচড়ে বসলো। ভ্রূ কুঁচকে বলল, “রুদবা! ও কাল রাতে আমাকে অরুর রুমের চাবি দিয়েছিল। আর সকালে ক্যামেরাটা রুমেই ছিল।”
ইভান বলল, “মেয়েটা তো মারাত্মক! একে তো আমি শান্ত ভেবেছিলাম।”
তূর্য বলল, “এটা ও করেছে আমি শিউর। তুই বিশ্বাস না করলেও সমস্যা নেই। আমি ডেফিনেটলি শিউর এটা ওই করেছে। আমি আর কাউকে আমার ফোন দেই নি। তোরা জাস্ট দেখ, আমি কি করি ওই মেয়েটার সাথে।”
আহনাফ ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “যে যাই করুক। আমি তো বুঝে গেছি, আমার যোগ্যতা। আমি যাকে ভালোবাসি, হয়তো আমি তার যোগ্যই না।”
“কি বলছিস তুই? টুইংকেলকে সব সত্য বললে ও বুঝবে।”
“সত্য জেনে কি হবে? আমি এডিক্টেট ছিলাম, আমার মা খুনী, আমার মায়ের অবৈধ সম্পর্ক ছিল, আমার থার্ড ক্লাস ম্যান্টালিটি এসব তো পাল্টানো সম্ভব না। আমি আসলেই এডিক্টেট। আমার মধ্যে কিছু না কিছু সমস্যা এখনো আছে। অরুর সাথে থাকলে ওর জীবনেও ঝামেলা লেগে থাকবে। ইমান ছেলেটা ভালোবাসে, আমার অরুকে। ছেলেটার ফ্যামিলি ভালো। ছেলের মা ভালো। তাদের পরিবারে এতো ঝামেলা হয় না৷ সুখী পরিবার। অরুকে অনেক ভালো রাখবে ইমান। মেয়েটা সুখ ডিজার্ভ করে। আমার সাথে আটকে রেখে আমি ওর সাথে ভীষণ অন্যায় করছি।”
ইভান আর তূর্য অবাক হয়ে আহনাফের দিকে তাকিয়ে আছে। আহনাফ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমার অনেক আগেই এই ডিসিশন নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু দেরিতে হলেও এট লিস্ট কেউ তো ভালো থাকবে। ও ভালো থাকলে, আমিও ভালো থাকবো।”
ইভান বলল, “ছাগলের মতো কথা বলিস না তো!”
আহনাফ নিজের ব্যাগ আগেই গুছিয়ে রেখেছিল। সে চাবি তূর্যের হাতে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, “আমি আলাদা যাচ্ছি। আমি অরুর মুখোমুখি হতে চাই না আর। আমাকে দেখলে ও শুধু শুধু বিরক্ত হবে। আমার পিছু পিছু আসিস না।”
(***)
কক্সবাজার থেকে ফিরেই রুদবার সাথে দেখা করতে এলো তূর্য। তূর্যকে দেখে রুদবা রীতিমতো কাঁপছে। তূর্য ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “আমার সাথে চলো।”
রুদবা কাঁপা কন্ঠে বলল, “বাসায় আব্বু আম্মু আছে।”
তূর্য রাগী স্বরে বলল, “বের হবে না-কি আমাকে ঢুকতে হবে।”
তূর্যের কথায় ভয়ে বেরিয়ে এলো রুদবা। তূর্য তার হাত ধরে নিচে নেমে পড়লো। এরপর মোটর সাইকেলে উঠে বসে বলল, “বাইকে উঠো।”
“কোথায় যাচ্ছি আমরা?”
“আগে উঠো। তারপর বলছি।”
তূর্যের কথাবার্তা বেশ গম্ভীর। রুদবা মোটর সাইকেলে উঠতেই তূর্য তাকে নিয়ে সোজা তার অফিসে চলে এলো। অফিসের সামনে আসতেই রুদবা নেমে পড়লো মোটর সাইকেল থেকে। তূর্য মোটর সাইকেল পার্কিংয়ে রেখে রুদবার হাত ধরে তাকে টেনে নিজের কেবিনে নিয়ে এলো। কেবিনে ঢুকে সামনের চেয়ারে বসতে বলল রুদবাকে। রুদবার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। তূর্য শীতল কন্ঠে বলল, “বসো।”
তূর্যও মুখোমুখি চেয়ার টেনে বসলো। রুদবাও বসলো। আর কাঁপা কন্ঠে বলল, “আপনি এমন করছেন কেন?”
তূর্য বলল, “আমার ফোন থেকে আহনাফকে তুমি মেসেজ দিয়েছো?”
“না।”
ধারালো কাচি হাতে নিলো তূর্য। রুদবার চোখে অশ্রু ভীড় করতে লাগলো। তূর্য ঠোঁট কামড়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। রুদবা কাঁপা কন্ঠে বলল, “আমাকে যেতে দিন।”
“কাচিটা দিয়ে তোমার জামা কুচি কুচি করে ঠিক একইভাবে ভিডিও বানাবো। এরপর তোমাকে ব্ল্যাকমেইল করে আমার যা ইচ্ছে তাই করবো। কিন্তু তোমাকে বিয়ে করবো না। কেমন লাগবে তখন?”
রুদবা ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তূর্য বলল, “আমি ঠিক কতোটা জঘন্য, তুমি সেটা কল্পনাও করতে পারবে না।”
“আমি আপনাকে ভালোবাসি, তূর্য।”
“ভালোবাসো, কিন্তু তোমার মধ্যে ভালোবাসার কি আছে? তোমাকে আমি কেন ভালোবাসবো?”
রুদবা হাত জোড় করে বলল, “আমি জয়িতা আপুর কথায় সব করেছি। উনি আমাকে বলেছিল এসব করতে।”
“কেন? তুমি জয়িতার কথা শুনবে কেন? ও কি কোনো ক্রিমিনাল? তোমার বাবা-মাকে জিম্মি করে তোমাকে এই কাজ করতে বলেছিল? না-কি ওর থেকে টাকা খেয়েছো। কাজের বিনিময়ে টাকা দিয়েছে ও তোমাকে! কোনটা করেছে ও?”
“আমি অরুকে একটা উচিত শিক্ষা দিতে চেয়েছি। ও বার বার আপনার আর আমার মধ্যে আসতে চাইছে। আপনাকে যা ইচ্ছে তাই বলছে। আর উলটো আপনি ওকে ডিফেন্ড করছেন? আহনাফ স্যারের সাথে সম্পর্ক থাকার পরও হিমালয়ের সাথে প্রেম করছে ও। ওদের চিঠি আদান-প্রদান চলে। আমি অরুর ফোনে হিমালয়ের সাথে সব চ্যাট দেখেছি। আহনাফ স্যারকে জয়িতা আপু ভালোবাসে। আমি ভেবেছি, জয়িতা আপুকে হ্যাল্প করলে আহনাফ স্যারও ওর হাত থেকে বাঁচবে। আপনিও অন্তত ওর আসল চেহারাটা দেখতে পারবেন।”
“অরুণিকা তোমার কী ক্ষতি করেছে, আমাকে সেটাই বলো।”
“আমাদের মাঝে আসছে বারবার।”
তূর্য ইশারায় বলল, “কি আছে আমাদের মধ্যে যে ও আসছে!”
“আমি ভালোবাসি আপনাকে। আপনিও তো আমাকে পছন্দ করেন। আপনি বলেছিলেন, আমি আপনার কাছে অনেক স্পেশাল। আমাদের একসাথে ভালো ফিউচার আছে।”
তূর্য শীতল কন্ঠে বলল, “আমি ম্যারিড।”
রুদবা চোখ বড় বড় করে তাকালো তূর্যের দিকে। তূর্য বলল, “অরুণিকা তোমাকে ওয়ার্ন করেছে, কারণ ও আমার ব্যাপারে সব জানে।”
রুদবা ভীত স্বরে বলল, “মিথ্যা কথা। ও আপনার বিয়ের ব্যাপারে আমাকে কিছুই বলে নি।”
“বিকজ ও জানে না আমি ম্যারিড। শুধু আমি জানি, আমি বিয়ে করেছি। অরুণিকা জাস্ট এইটুকু জানে, আমি যাকে ভালোবেসেছি, তার সাথে টাইম পাস করে তাকে ছেড়ে দিয়েছি। ও বিয়ের ব্যাপারে কিছুই জানে না। জাস্ট সম্পর্ক আছে সেটাই জানতো।”
রুদবা বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। তূর্য ক্ষীণ স্বরে বলল, “মেয়েদের সাথে এভাবেই টাইম পাস করি আমি। অরুণিকা ছাড়া সব মেয়ে আমার চোখে জাস্ট গারবেজ। কারণ তুমিই এর জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ। আমার টুইংকেলের মতো হওয়ার জন্য তোমাকে একশো বার জন্ম নিতে হবে। ও আমার চোখে আমার স্টার। মাই লিটল সিস্টার। আর আমার বন্ধু, আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের প্রিয় মানুষ ও। তুমি তো মারাত্মক জায়গায় হাত দিয়েছো।”
রুদবা তূর্যের পায়ের কাছে বসে বলল, “সরি, সরি, আমি অরুর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবো। কিন্তু আমাকে এটা বলবেন না যে আপনার অনুভূতি টাইম পাস ছিল। আপনি নিজেই আমাকে বলেছেন, আপনি আমাকে পছন্দ করেন।”
“কার সামনে বলেছি?”
রুদবা তূর্যের হাত চেপে ধরে বলল, “টাইম পাস হলে আপনি আমাকে যখন-তখন জড়িয়ে ধরতেন না। আপনি আমার কাছে এসেছিলেন। আপনি আমাকে বুঝিয়েছিলেন, আপনার অনুভূতি আমাকে নিয়ে ভিন্ন।”
তূর্য হেসে বলল, “এটা তো সবার বেলার হয়। কোনো প্রমাণ আছে আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরেছি, তোমার কাছে এসেছি? তোমার পক্ষে কে সাক্ষী দেবে? ফিজিক্যাল তো কিছু করি নি।”
রুদবা চোখ-মুখ কুঁচকে বলল, “ছি! কি বলছেন আপনি এসব? আমাদের সম্পর্কটাকে এভাবে নোংরা করবেন।”
“আসছে আমার সম্পর্ক বিশারদ।”
রুদবা হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে বলল, “হ্যাঁ, আমার কাছে সাক্ষী আছে। ওই মেয়েটা, আপনার অফিসের সেই এসিস্ট্যান্ট। যে আপনার বাসায় বুয়ার কাজ করতো। ও সব দেখেছে। আপনি খালি ঘরে আমাকে ডেকে এনে আমাকে টাচ করেছিলেন। ও সব দেখেছে। ও আমার হয়ে কথা বলবে।”
তূর্য হেসে বলল, “শ্যাম কন্যার কথা বলছো?”
রুদবা তূর্যের কথা শুনে থমকে গেল। তূর্য হেসে বলল, “তুমি কী বোকা? একটা গ্রেজুয়েট করা মেয়ে বুয়ার কাজ করে কখনো? হ্যাঁ, আমি বলেছি তার মায়ের কাজ সে নিয়েছে। কিন্তু তোমার মাথায় কোনো গিলু নেই। এই অফিস থেকে ত্রিশ হাজার টাকা স্যালারি পেয়ে মাকে বুয়ার কাজ করতে দেবে কেউ? আর ধরলাম করে৷ তবুও একটা বুয়া ছাদ ভর্তি করে আমার এতোগুলো শার্ট-প্যান্ট বিনা অভিযোগে ধুয়ে দেবে, বলো? কাপড় ধুয়ে কোমড় ধরে যাওয়ার পরও শুকনো মুখে বাড়ির সব কাজ করবে, বলো? সে তো কাজই ছেড়ে দেবে। পরদিন থেকে আর আসবেই না। ধরলাম তাও করে। কিন্তু আমার পা পর্যন্ত টিপে দেয়, ভেবে দেখেছো তুমি এটা? আমার বন্ধুরা কিন্তু কোনো কাজ দেয় না ওকে। আমার বাসায় তো তুমি প্রায়ই আসতে। আরাফ, তাহমিদ, ইভান, ইমন, আহনাফ কেউই কি কখনো কাজ দিয়েছে ওই মেয়েকে? তোমার সামনে আমিই ওকে দিয়ে সব কাজ করিয়েছি। কারণ অর্ডার দেওয়ার অধিকার শুধু আমার আছে। আরেহ, বোকা মেয়ে। বোকা বউ লাগে ও আমার। আমার ওয়ান এন্ড অনলি বউ, উপমা করিম শেখ। আর ওকে জ্বালানোর জন্যই তোমার সাথে কিছুদিন হাসলাম, তোমাকে টাচ করলাম। আর তুমি ওমনি পটে গেলে?”
তূর্য হাসতে লাগলো কথাগুলো বলে। রুদবা স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। তূর্য উঠে দাঁড়াতেই রুদবা পেছন দিক থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে। কাঁপা কন্ঠে বলল, “আই লাভ ইউ, তূর্য। আপনি আমাকে এভাবে ঠকাতে পারেন না। আমি আপনাকে ভালোবাসি।”
“আমাকে তো অনেকেই ভালোবাসে। তাই বলে আমিও কি সবাইকে আই লাভ ইউ টু বলে বেড়াবো?”
“প্লিজ, এমন করবেন না। যা হয়েছে, আমি অরুকে সব সত্য বলে দেবো।”
“ওকে গৌ। যা ইচ্ছে করো। বাট আমার সত্য এটাই। তুমি আমার কাছে জাস্ট একটা গারবেজ।”
এই বলে তূর্য রুদবাকে কেবিন থেকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল। আর রুদবা হুমড়ি খেয়ে উপমার সাথে ধাক্কা খেল। উপমাকে দেখে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সে। কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি তূর্যের ওয়াইফ?”
উপমা চমকে উঠলো রুদবার প্রশ্নে। রুদবা ঘৃণার চোখে তাকিয়ে বলল, “আমি আপনার চেয়ে বেশি সুন্দর। আপনি তো কুচকুচে কালো। তাহলে ও আমাকে কেন টাইম পাস বলবে? ও ইচ্ছে করে আমাকে মিথ্যে বলেছে। আমি অরুর সাথে যা করেছি, তার শাস্তি দেওয়ার জন্য এমন করেছে। আমি জানি, ও মিথ্যে বলছে।”
রুদবা নিজের মনে বিড়বিড় করতে করতে চলে গেল। উপমা অবাক হয়ে ভাবছে, “তূর্য আমাদের ব্যাপারে রুদবাকে জানিয়ে দিয়েছে? কিন্তু কেন? সে তো মুভ অন করতে চাইছিল। তাহলে টাইম পাস কেন বলবে রুদবাকে?”
চলবে-
#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-৫৫ (৩য় ভাগ) ||
ঘুমন্ত আরাফকে দেখছে রুহানি। কাল সারারাত পড়াশুনা করেছে ছেলেটা। মানুষ এতো পড়তে পারে, আরাফকে না দেখলে বিশ্বাসই হতো না তার৷ রুহানি আরাফের পাশে বসে মনোযোগ দিয়ে তাকে দেখছে। হঠাৎ ঘুমের ঘোরে রুহানিকে জড়িয়ে ধরলো আরাফ। রুহানি বেশ লজ্জা পেল। তবে তারও খুব হচ্ছে আরাফের স্পর্শ পেতে। সে আরাফের বাহুতে মাথা রেখে তার কাছে এসে শুয়ে পড়লো। আরাফ যেন উষ্ণ স্পর্শই খুঁজছিল। রুহানিকে কাছে পেয়ে তাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো সে। প্রায়।ঘন্টা খানেক রুহানি এভাবেই আরাফের পাশে শুয়ে ছিল। ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যাচ্ছে, অথচ একটুও বিরক্ত হচ্ছে না সে। একপাশে মাথা হেলিয়ে রাখতে রাখতে ঘাড় ব্যথা হয়ে গেছে তার। তবুও বিন্দুমাত্র নড়াচড়া করে নি সে।
ঘুম ভাঙতেই রুহানিকে এতোটা কাছে দেখে থমকে গেল আরাফ। এক ঝটকায় সরিয়ে দিল রুহানিকে। উঠে দাঁড়িয়ে ইতস্তত ভাব নিয়ে বলল, “সরি, আমি খেয়াল করি নি তোমাকে।”
রুহানি শাড়ি ঠিক করে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। বলল, “সমস্যা নেই!”
আরাফ শীতল কন্ঠে বলল, “কিন্তু আমার সমস্যা আছে।”
রুহানির ঠোঁটের লাজুক হাসিটা মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল। চোখ নামিয়ে ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “কি সমস্যা!”
“সম্পর্কটা আমার কারণেই শুরু হয়েছে। আমার তোমাকে সময় দেওয়া উচিত। এভাবে ঘুমের ঘোরে তোমার পাশে চলে এসেছি আমি! সরি। যদিও আমি সবাইকে বলেছি, আমরা একজন আরেকজনকে পছন্দ করি। কিন্তু সত্য তো এটাই যে তুমি…”
রুহানি আরাফকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আমিও আপনাকে পছন্দ করি।”
আরাফ থমকে গেল। রুহানি আরাফের কাছে এসে তার হাত ধরে বলল, “আমি আপনাকে শুধু পছন্দ করি না। আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি।”
আরাফ স্তব্ধ হয়ে গেল রুহানির কথায়। রুহানি আরাফের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। সে বারংবার পায়ের আঙুল মেঝেতে ঘষছে, আর আরাফের প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায় আছে। আরাফ রুহানিকে অবাক করে দিয়ে তার হাত ছেড়ে গম্ভীরমুখে বলল, “ভালোবাসা কী, সেটা বুঝো তুমি? হুট করে কি ভালোবেসে ফেলা যায়?”
রুহানি ব্যস্ত কন্ঠে বলল, “কেন যাবে না?”
“দেখো, তোমাকে সময় দিচ্ছি আমি।”
“না, আমার সময় লাগবে না। আমি আপনাকে ভালোবাসি, আরাফ।”
“কিন্তু আমি চাই, তুমি সময় নাও।”
“কেন? আপনি তো আমাকে পছন্দ করেন। তাহলে কেন সময় নিতে হচ্ছে? আমার তো কোনো আপত্তি নেই।”
“তুমি ভালোবাসার মানেই বুঝো না। ভালোবাসা হুট করে হয় না। ভালোবাসা ধীরস্থির ভাবে হয়। তোমারটা আবেগ। এটা ভালোবাসা না।”
“আমারটা ভালোবাসা কেন মনে হচ্ছে না আপনার? আমি আপনার ওয়াইফ। সেই হিসেবে আমার ভালোবাসা তো পিউর।”
আরাফ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। থমথমে কন্ঠে বলল, “কি চাও তুমি?”
রুহানি লাজুক হেসে বলল, “বিয়ে যেহেতু হয়ে গেছে। আমাদের সংসারটাও শুরু হয়ে যাক।”
আরাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “সংসার বলতে তুমি কি বুঝাতে চাইছো?”
“আপনি এভাবে দূরে দূরে থাকছেন!”
আরাফ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। এরপর বলল, “কারণ আমি এখনো ইন্টার্ন শেষ করি নি। ইন্টার্ন শেষ হোক, তারপর।”
“কিন্তু এর সাথে ইন্টার্নের কি সম্পর্ক?”
আরাফ এবার ধমকের সুরে বলল, “বেশি কথা বলছো তুমি। আগে নিজের ক্যারিয়ারে ফোকাস করো। ইন্টারের রেজাল্ট বের হলে তোমাকে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দেবো। পড়াশুনায় ফোকাস করতে হবে তোমাকে।”
“পড়াশুনার সাথে সংসারের কি সম্পর্ক?”
“তুমি হয়তো একটু বেশি ভেবে ফেলছো!”
রুহানি মাথা নিচু করে বলল, “আমি স্ত্রী হিসেবে আপনার কাছে এইটুকু আবদার করতে পারি না?”
আরাফ স্থির দৃষ্টিতে রুহানির দিকে তাকিয়ে রইল। রুহানি পুনরায় বলল, “বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রীর কাছাকাছি থাকা ভালো। আপনার রিজিকেও বরকত আসবে।”
আরাফ শীতল কন্ঠে বলল, “তোমার সব আবদার পূরণ করার সামর্থ আমার হয় নি। তবে তুমি যদি পারো, আমার একটা আবদার রাখতে পারো।”
“বলুন না!”
“আমাদের সম্পর্কটাকে আমি এখন শুধু বন্ধুত্বের নাম দিতে চাই। আমি বেশি কিছু আবদার করবো না। আমি শুধু চাইবো, তুমি সেই সীমাটা লঙ্ঘন করবে না।”
“আপনি কি চান না আমাদের মধ্যে সব স্বাভাবিক হোক?”
“এখন কি সব স্বাভাবিক নেই?”
রুহানি অস্থির হয়ে বলল, “না, নেই। আপনি দূরে দূরে থাকতে চাইছেন। এক বিছানায় ঘুমাতে চাইছেন না। আলমারি আলাদা করে রেখেছেন। পড়াশুনা পাশের রুমে করছেন।”
“আমি এসবের এক্সপ্লেনেশন দিয়েছি তোমাকে।”
“কিন্তু আমি অন্য কারো সম্পর্কে এমন কিছু দেখি নি।”
“অন্যদের সম্পর্ক আর আমাদের সম্পর্ক আলাদা। অন্যদের সাথে আমাদের কেন মেলাতে চাইছো তুমি?”
রুহানি চমকে উঠলো আরাফের কথায়। মুহূর্তেই তার মুখটা রাঙা হয়ে গেল। চোখের সামনে ভেসে উঠলো অতীতের সেই ভয়ংকর দিনগুলোর কথা। আরাফ কী এজন্য তার কাছে আসতে চাইছে না? রুহানি বেশ অধৈর্য হয়ে উঠলো। সে আজ উত্তর নিয়েই যেন শান্ত হবে। সে আরাফের কাছে এসে ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “বারবার কেন বলছেন এই কথা? আপনি নিজেই বলেছেন, আপনি আমাকে পছন্দ করেন। আমার অতীত জেনেই আমাকে বিয়ে করেছেন। তাহলে কেন আলাদা ভাবছেন আমাকে?”
আরাফ চুল খামচে ধরে মুখ ঘুরিয়ে নিল। রুহানি আরাফের কাঁধে হাত রেখে বলল, “আমার অতীতের কারণেই কি আপনার আমার কাছে আসতে সংকোচ হচ্ছে?”
আরাফ রুহানির দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকালো। ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “তোমার কি এটাই মনে হচ্ছে?”
“তাছাড়া আলাদা কেন ভাবছেন আমাকে?”
“ঠিক আছে। তুমি যা চাও, তাই হবে।”
রুহানি আরাফের দিকে তাকালো। আরাফ রুহানির হাত ধরে তাকে বিছানায় বসালো। বিনা অনুমতিতেই রুহানির কাছে এলো সে। আরাফের স্পর্শে কোনো অনুভূতি পাচ্ছে না রুহানি। কিন্তু আরাফ তাকে কথা বলার কোনো সুযোগটাও আর দিল না। রুহানির অধর ছুঁয়ে দিল সে। রুহানি স্তব্ধ হয়ে গেল। তার চোখ ছলছল করে উঠলো। আরাফের স্পর্শে কোনো ভালোবাসা নেই। মনে হচ্ছে যন্ত্রের ন্যায় বাধ্য হয়ে রুহানির কাছে এসেছে আরাফ। রুহানির চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গেল। তবে আরাফকে বাঁধা দিল না সে৷ সুযোগ দিল অতীত ভুলিয়ে দেওয়ার। কিন্তু আরাফের যান্ত্রিক স্পর্শ যেন অতীতের ক্ষতটা আরো বাড়িয়ে দিল। মানুষটার চোখে-মুখে কোনো ভালোবাসায় দেখতে পায় নি রুহানি। সে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আরাফকে। আরাফের ঘাড়ে চুমু খেল। ভাবলো এই আহ্বানে অন্তত সাড়া দেবে তার প্রিয় মানুষটি। কিন্তু রুহানি তো আজ নতুন করে একজন প্রাণহীন পুরুষকে আবিষ্কার করেছে। আরাফ এমন আচরণ কেন করছে? সে যদি নির্জীব হতো তবে রুহানি অবাক হতো না। কিন্তু আরাফ তো বেশ চমৎকার মানুষ। হাসিখুশি থাকে। চমৎকার ভাবে যত্ন নিতে জানে। তবে রুহানির প্রতি এমন উদাসীন কেন?
আরাফ রুহানিকে ছেড়ে সোজা ওয়াশরুমে চলে গেল। রুহানি অন্যপাশ ফিরে মুখ চেপে বেশ কিছুক্ষণ কাঁদলো। নিঃশব্দ এই কান্না। অশ্রুগুলো বেশ ভারী৷ কারণ স্বামী তার স্ত্রীর আবদার বুঝতে পারে নি। যদিও আরাফের স্পর্শে কোনো হিংস্রতা ছিল না। তবে ভালোবাসাও খুঁজে পায় নি রুহানি।
রুহানিকে এখন প্রায়ই কাঁদতে দেখা যায়। বিশেষ করে মাঝরাতে। যদিও প্রতি রাতেই আরাফ তার আবদার পূরণ করে যাচ্ছে। তাকে স্পর্শ করছে। কিন্তু ভালোবাসছে না। খুব যত্ন নিচ্ছে। যা প্রয়োজন সব এনে দিচ্ছে। কিন্তু ভালোবেসে জড়িয়ে ধরছে না। খুব প্রয়োজনীয় বিষয়ে টুকটাক কথা বলছে৷ কিন্তু মিষ্টি করে দু’চারটা প্রেমের কথা বলছে না। প্রতিবারই রুহানির পক্ষে কথা বলছে। রুহানির জন্য কারো বিরুদ্ধে যেতে হলে, তাও যাচ্ছে। কিন্তু রুহানিকে হৃদয়ে বাঁধতে পারছে না। রুহানি তো এখন ধরেই নিয়েছে, এটাই হয়তো ভালোবাসা। সংসার বোধহয় এমনই হয়। নাটক-সিনামায় হয়তো বেশি মশলাযুক্ত ভালোবাসা দেখায়। স্ক্রিনে এসব ভালোবাসা দেখেই তো এক বুক আশা নিয়ে আরাফের কাছে আবদার করেছিল সে। কিন্তু হতাশ হয়েছে রুহানি।
(***)
মোটর সাইকেল নিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বেরুতেই ছয়-সাত বছরের একটি মেয়ে তূর্যের চাকার সামনে চলে এলো। তূর্য তড়িঘড়ি করে মোটর সাইকেল ঘুরাতে গিয়ে উলটে পড়ে গেল। ইভান তার পাশেই ছিল। সে নিজের মোটর সাইকেল থেকে নেমে তূর্যকে ধরে উঠালো। ততক্ষণে আশেপাশের অনেকেই ভীড় জমিয়ে ফেলেছে। বাচ্চা মেয়েটিকে টেনে তুলে সবাই জিজ্ঞেস করতে লাগলো, সে ঠিক আছে কি-না। তূর্যও উঠে মেয়েটির দিকে একনজর তাকালো। মেয়েটির চোখেমুখে ভীতি। চুল এলোমেলো হয়ে গেছে। ইভান টেনে দাঁড় করালো তূর্যকে। জিজ্ঞেস করলো, “ব্যথা-ট্যথা পেয়েছিস?”
তূর্য মাথা নেড়ে বলল, “না।”
বলেই খোঁড়াতে খোঁড়াতে মেয়েটির কাছে গেল। বাচ্চাটির চোখে অশ্রু টলমল করছে। তূর্য তার হাত ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে এনে বলল, “মা, তুমি বেশি ব্যথা পেয়েছো? আমি তো তোমাকে খেয়াল করি নি। এভাবে কি কেউ রাস্তায় দৌঁড়াদৌঁড়ি করে, বলো?”
মেয়েটি এখনো ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তূর্য এবার মেয়েটিকে কোলে তুলে নিল। ইভান মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “তূর্য, মেয়েটা দেখতে কেমন তোর মতো না!”
তূর্য চোখ ছোট করে ইভানের দিকে তাকালো। তবে ইভান মিথ্যে বলে নি। মেয়েটির চোখ, নাক, মুখের গঠন অনেকটাই তূর্যের সাথে মিল খায়। ইভান হেসে বলল, “তোর ফিমেইল ভার্সন পাওয়া গেছে। তুই মেয়ে হলে নিশ্চিত, এমনই হতি।”
মেয়েটির গলা শুকিয়ে গেছে। সে ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “আংকেল, আমাকে একটু পানি খাওয়াবে?”
তূর্য বলল, “ওমা, কেন খাওয়াবো না?”
ইভান ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে এগিয়ে দিয়ে বলল, “কি ভদ্র বাচ্চা!”
“বিয়ে করে এরকম একটা নিয়ে আয়। আমরাও একটু আংকেল হই।”
“আমাকে এসব কুবুদ্ধি দিস না। বিবাহিত দুই পুরুষের জীবন দেখে আমার বিয়ের স্বাদ মিটে গেছে।”
মেয়েটি পানি খেয়ে ইভানকে বোতল এগিয়ে দিয়ে বলল, “থ্যাংক ইউ।”
ইভান বুকে হাত দিয়ে বলল, “ওরেহ, কি কিউট বাচ্চা! ম্যানার্স আছে।”
তূর্য বলল, “তুই ম্যানারলেস দেখে কি পৃথিবীর সব বাচ্চা ম্যানারলেস হবে?”
তূর্য এবার মেয়েটিকে বলল, “তোমার নাম কি মা?”
“তূর্ণা করিম।”
“ওয়াও, কি কিউট নাম। তোমার বাবা-মা কোথায়?”
“বাবা তো নেই। কিন্তু মাকে পাচ্ছি না।”
“কেন?”
“জানি না। আমি হাঁটতে হাঁটতে মা হারিয়ে গেছে। আংকেল, আমার মা অনেক কান্না করবে আমাকে না পেলে।”
“তাই? তুমি কাঁদবে না?”
“না, আমি তো ব্রেইভ গার্ল।”
ইভান ও তূর্য একে অপরের দিকে তাকিয়ে বলল, “পণ্ডিত।”
তূর্য তূর্ণাকে কোল থেকে নামিয়ে তার মোটর সাইকেল ভালোভাবে দেখে বলল, “ঠিকই আছে।”
এই বলে মোটর সাইকেলে উঠে বসলো সে, সাথে তূর্ণাকেও বসালো। তূর্ণা বলল, “আংকেল, এটা আপনার বাইক?”
“হ্যাঁ।”
“আমি আগে কখনো বাইকে বসি না। মায়ের ফোনে গেইমস খেলেছি। ওখানে আমি পয়েন্ট দিয়ে দু’টো বাইক কিনেছি। একটা লাল, আরেকটা নীল।”
“আচ্ছা! ভালো তো। তোমার তো দেখছি তাহলে দু’টো বাইক। আর আমার মাত্র একটা।”
তূর্ণার সাথে কথা বলতে বলতে তূর্য চৌধুরী ম্যানশন চলে এলো। রাস্তায় অবশ্য যেখানে যেখানে তূর্ণার মাকে পাওয়া যেতে পারে, তূর্ণার কথামতো সেসব জায়গা দিয়েই মোটর সাইকেল ঘুরিয়ে এনেছিল তূর্য। তবে শেষমেশ বাসায় নিয়ে আসতে হলো মেয়েটিকে। তূর্ণার না-কি বেশ ক্ষিধে পেয়েছে। মেয়েটা বেশ মায়া নিয়েই বলছিল, সকালে নাস্তা না করেই বেরিয়েছে সে। আজ না-কি স্কুলে যায় নি। মায়ের সাথে নতুন জামা কেনার বায়না ধরেছিল সে। জামা না কিনে দিলে, সে না-কি নাস্তা করবে না। মা প্রতিদিন তাকে কথা দিয়েও কথা রাখতে পারে না। তাই সে এই জেদ করে বসে। কিন্তু এখন তো একদম মাকেই হারিয়ে ফেলেছে। তবে এবার পেটের ক্ষুধায় আর জেদ ধরে থাকতে পারলো না তূর্ণা। তূর্য আর ইভান ভাবলো, মেয়েটিকে একটু খাওয়া-দাওয়া করিয়ে বিকেলে থানায় নিয়ে যাবে।
এদিকে তূর্য মেয়েটিকে নিজের বাসায় নিয়ে এলো। তূর্যদের বিশাল ফ্ল্যাটে তার বাবা হায়াত শেখ ও মা মিসেস তসলিমা খান থাকেন। তূর্যের ছোট একটা বোন ছিল। নাম ছিল তারা শেখ। সে অসুস্থ হয়ে অল্প বয়সে মারা গিয়েছিল।
এই ফ্ল্যাটটা হায়াত শেখের একার। নিস্তব্ধ ঘরে হায়াত শেখের ব্যবসায়িক কাগজপত্র হাওয়ার সাথে উড়তে থাকে, আর সেই শব্দ সৃষ্টি করে হাহাকার।
তসলিমা খান পাক্কা রাঁধুনি। বাসায় খাওয়ার কেউ নেই। তবুও তিনি রাঁধেন। রেঁধে তার বান্ধবীদের খাওয়ান। বান্ধবী অবশ্য মিসেস তাওসিফ এবং ইভান-ইমনের মা, মিসেস রিক্তা। তারাই আয়েশ করে খান। হায়াত শেখের ডায়বেটিস। নিয়ম করে খেতে হয় থাকে। স্ত্রীর রান্না করা লোভনীয় খাবার যখন-তখন খেতে পারেন না। অন্যদিকে তূর্য এতোদিন মুহাম্মদপুর ছিল বিধায় ঘরটা আরো মৃত হয়ে পড়েছিল। তবে সে ফেরার পর থেকেই টুংটাং গিটারের শব্দে ঘরের নিস্তব্ধতা অনেকখানি কেটে গেছে৷
বাবার সাথে তূর্যের সম্পর্ক ওতো ভালো চলছে না। টুকটাক কথাবার্তার বেশি কথা হয় না তাদের। তূর্যের বেপরোয়া জীবনে বাঁধা দেওয়ায় তাদের সম্পর্কের এই অবনতি। সে পড়াশুনা করে একটা চাকরি না ধরে, কেন গান নিয়ে ব্যস্ত থাকে এই অভিযোগ নিয়ে বসে আছেন হায়াত শেখ। তাই তূর্য বাবা থেকে কোনো খরচই নেয় না। এখন তো নিজের ব্যবসা দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে সে।
তবে আজ হায়াত শেখের মৃত ঘরটি যেন প্রাণ ফিরে পেল তূর্ণা নামক ছোট্ট অতিথির আগমনে। তসলিমা খান তূর্ণাকে দেখেই বলে ফেললেন, “আরেহ এটা তো একদম আমার তারার মতো। এটা কার বাচ্চা এনেছিস?”
ইভান বলল, “আন্টি, আমি তো বলছিলামই তূর্যকে৷ আমার তো একদম তূর্যের মতো মনে হচ্ছে৷”
তূর্য পুরো ঘটনা তসলিমা খানকে বলতেই তিনি ছেলেকে শাসনের সুরে বললেন, “চোখ কপালে রেখে বাইক চালাতে হয়!”
এরপর তসলিমা খান যত্নের সাথে তূর্ণা কোথাও ব্যথা পেয়েছে কি-না দেখতে লাগলো। তূর্ণার ক্ষিধে পেয়েছে শুনে প্রবল উৎসাহের সাথে রান্নাঘরে ঢুকে পড়লেন তসলিমা খান। তিনি রাঁধছেন, আর তূর্ণা তার পাশে বসে পা দুলিয়ে গল্প করছে। হায়াত শেখও বেশ মনোযোগ দিয়ে তাদের গল্প শুনছে। তূর্য বসার ঘরে বসে আছে। তূর্ণা একটু পরপর শব্দ করে হাসছে। বাচ্চাদের হাসি যেমন ঝংকার তুলে, ঠিক তেমনই ঝংকার ছড়িয়ে পড়েছে পুরো ঘরে। অজানা কারণেই তূর্যের মন ভারী হয়ে এলো। আনমনেই ভাবলো, “এমন একটা মিষ্টি মেয়ে যদি তার হতো! সে রাজ্যের সব সুখ এনে দিতো তার রাজকন্যার কাছে।”
(***)
বিকেলে আরাফ, তাহমিদ আর ইমনের সাথে দেখা হয়ে গেল তূর্ণার৷ আরাফ তূর্ণার গাল টেনে বলল, “মনে হচ্ছে, তোরই বাচ্চা। একদম তোর মতো। একই চেহারার মানুষ থাকে, এটা আজ দেখেও নিলাম।”
তূর্য বলল, “আমিও মেয়েটাকে দেখে বেশ অবাক হয়েছিলাম।”
ইমন বলল, “মেয়েটার বাবা-মাকে দেখলে ভালো হতো। দেখা যাবে তোর মেলায় হারিয়ে যাওয়া ভাই অথবা বোনের মেয়ে।”
“মাকে জিজ্ঞেস করতে হবে। না-জানি আমার জমজ কোনো ভাই-টাই ছিল কি-না।”
তাহমিদ বলল, “ভাই, তুই ভাইরাল। জমজ এক পিস থাকলে এতোদিনে তোর সাথে যোগাযোগ করতে আসতো।”
ইমন বলল, “তাহমিদ, তুই সিরিয়াস কথা বলছিস কেন? আমরা তো মজা করছিলাম।”
তাহমিদ চোখ ছোট করে তাকালো ইমনের দিকে। এদিকে তূর্য থানায় গিয়ে তূর্ণার ব্যাপারে জানাতেই তারা জানালো, দু’এক ঘন্টা আগে মিসিং রিপোর্ট আর একটা ছবি দিয়ে গেছে এক মধ্যবয়সী নারী। তূর্য ছবি দেখে বলল, “হ্যাঁ, এটাই সেই বাচ্চা। তূর্ণা করিম। বাইরে আছে।”
তূর্ণার মাকে ফোন করা হলো থানা থেকে। বাতাসের বেগে ছুটে এলো সেই নারী। তূর্য বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল তূর্ণাকে নিয়ে। উপমাকে তার দিকে আসতে দেখে ভ্রূ কুঁচকালো সে। উপমা হয়তো তাকে খেয়াল করে নি। হঠাৎ তূর্ণা তূর্যের হাত ছেড়ে সামনে ছুটে গেল। জড়িয়ে ধরলো তার মাকে। মা-মেয়ের মধুর আলিঙ্গনে তূর্য স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তাহমিদ আর ইভানও বড়সড় ধাক্কা খেল। উপমা তূর্ণাকে কোলে নিয়ে সামনে তাকাতেই তূর্যকে দেখে চমকে উঠলো। তূর্য উপমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শীতল কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “তূর্ণার বাবা কে?”
উপমা চুপ করে রইল। ইভান আর তাহমিদ একে অপরের মুখের দিকে তাকালো। ইভান মিনমিনিয়ে বলল, “এমন তাজ্জব ঘটনা আমার বন্ধুদের সাথেই কেন ঘটে?”
তাহমিদ হতাশ কন্ঠে বলল, “তুই হয়তো কুফা। তোর বন্ধু হয়ে আজ আমাদের কপালে এই শনির দশা।”
(***)
তূর্য ও উপমা একটি রেস্টুরেন্টে মুখোমুখি বসে আছে। উপমা মলিন দৃষ্টিতে তূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে। তূর্য টেবিলের দিকে চোখ জোড়া স্থির রেখেছে। পাশের টেবিলে তূর্ণাকে নিয়ে তাহমিদ আর ইভান বসে আছে। তারা খাবার অর্ডার করে গোগ্রাসে গিলছে। তূর্ণা আজ প্রথম এতো মজার মজার খাবার খাচ্ছে। তূর্ণার দিকে তাকালো তূর্য। ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “আমি সেদিন তোমার কথা বিশ্বাস করি নি।”
উপমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “এখন হঠাৎ!”
“ও দেখতে আমার মতো হয়েছে।”
“এজন্যই?”
তূর্য তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “যেই নারী একসাথে দুই দুইটা মানুষের সাথে শুয়ে…”
উপমা তূর্যকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “হয়েছে। আপনি থামুন।”
“আমি তবুও ডিএনএ টেস্ট করবো।”
“কেন করতে চাচ্ছেন টেস্ট? বিশ্বাসে যদি এতোই ফাঁক থাকে, ফিরে যান। আমি আমার মেয়েকে নিয়ে ভালোই আছি।”
“দেখো, আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না। তোমার নষ্টামির ফল বয়ে বেড়ানোর কোনো শখ নেই আমার। কিন্তু ও যদি আমার মেয়ে হয়, তাহলে আমি তোমার মতো মেয়ের সাথে ওকে থাকতে দেবো না। আমার মেয়ে এমন পরিবেশে কখনো বড় হবে না।”
উপমা ছলছল চোখে তূর্যের দিকে তাকালো। তূর্য উঠে তূর্ণার হাত ধরে বলল, “তোমাকে আমার সাথে যেতে হবে, মা।”
তাহমিদ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কোথায় যাচ্ছিস!”
“ডিএনএ টেস্ট করাবো।”
“মাথা ঠিক আছে তোর?”
“আমার মাথা ঠিকই আছে। তুই যা জানিস না আমাকে তা জিজ্ঞেস করিস না। আমি এই ছলনাময়ীকে হারে হারে চিনি।”
তূর্য তূর্ণাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। তাহমিদ উপমাকে বলল, “তুমি ওকে ধমকালে না কেন?”
উপমা ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “তূর্য উনার জায়গায় ঠিকই আছেন। উনার জানতে হবে বাচ্চাটা উনার না-কি অন্য কারো। আমি চাই না, কোনো সন্দেহ নিয়ে বাবা-মেয়ের সম্পর্ক শুরু হোক। আমি সত্যিই চাই, তূর্ণা তার বাবার সাথেই থাকুক। তূর্ণাকে আমি সেই জীবন দিতে পারবো না, তার বাবা তাকে যেটা দিতে পারবে। আমি আমার মেয়েকে ভালো স্কুলে পড়াতে পারছি না। ভালো খাওয়াতে পারছি না। অসুস্থ হলে টাকা জোগাড় করতে করতেই আরো অসুস্থ হয়ে যায় আমার মেয়েটা।”
“কিন্তু ও তোমাকে সন্দেহ করে এই কথা বলেছে।”
“ওর সন্দেহ ঠিক। আমি তূর্যকে ঠকিয়েছি। তাই ও আমাকে ছেড়ে দিয়েছিল।”
এই বলে উপমা বেরিয়ে গেল। আর তাহমিদ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ইভান এতোক্ষণ বসে বসে তাদের কথা শুনছিল। উপমা চলে যেতেই সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “এতো ড্রামা একটা মুভিতেও হয় না, যা তোদের সাথে হচ্ছে। তোদের লাইফ নিয়ে সিনেমা বানালে সেই সিনেমা দেখে সবাই তাওবা তাওবা করে বলবে, জীবনে প্রেমের ফাঁদে ভুল করেও পা মাড়িয়ে যাবো না। বলা তো যায় না, কখন কি এডবেঞ্চার করিয়ে দেয়।”
চলবে-
#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| বোনাস পর্ব-০১||
রুম অন্ধকার করে বসে আছে আহনাফ। মেঝেতে সিগারেটের প্যাকেট ছড়ানো ছিটানো। আহনাফ সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে শূন্যতা ছেয়ে গেছে। নিজের ভাগ্যের লিখন মনে করে বিস্তর হাসলে সে। হাসতে হাসতে সিগারেট ধরিয়ে বলল, “আমি চাইলেও তোর যোগ্য হতে পারবো না, অরু। কিন্তু তোকে কিছু তো একটা দিতে পারবো। আমার পক্ষ থেকে তোর জন্য ছোট্ট এই উপহার।
আমার হৃদয় দুয়ারে নামুক আঁধার,
তুই থাকিস দুধে-ভাতে!
আমার মন ভেঙে যাক, কি আসে যায় তাতে? ”
তোর কখনো সময় না হোক আমাকে ভাবার।
তোর স্মৃতিতে আমি ছাই হলে, হই,
তোর চোখে না জমুক জল
আমি আলো হই আর আঁধার,
তুই আমার ছিলি কই?
আজ ধরায় বেশ তো জ্বলছে আলো,
আমাকেই ঢেকে রেখেছে রাত- নিকষ কালো
প্রেয়সীই যেখানে স্বপ্ন-
আমি কাকে করছি প্রশ্ন?
যেই পথ তোর বাড়ি যায়,
আমি যদি সেই পথ খুঁজেই না পাই,
দোষটা আমি দেবো কার?
সেই উদাসীন প্রেমিকার না-কি আমার?
আমার ভালোবাসা বুঝবি আর কোথায়!
হয়তো আমারই ফাঁক ছিল খুব
কিন্তু আমি যে মরেছি তোর কথায়,
পাবি না আমাকে হারিয়ে একটুখানিও সুখ।
কে পেরেছে সুখী হতে ভালোবাসা হারিয়ে?
তবুও আমি চাইবো সব সুখ তোর কপালে নামুক
আমার বুকে পা মারিয়ে।”
আহনাফের হাসির শব্দ ছড়িয়ে পড়লো পুরো ঘরে। এক ভয়ংকর যন্ত্রণাদায়ক হাসি! চার দেয়ালেই আটকে গেল সেই আক্ষেপ।
(***)
কলিংবেলের শব্দ শুনে রুম থেকে বেরিয়ে এলো অরুণিকা। শাহবাজ খান দরজা খুলেছেন। তাকে একটি বাদামি খাম এগিয়ে দিয়ে চলে গেল একজন আগন্তুক। শাহবাজ খান খামটি হাতে নিয়ে অরুণিকার দিকে তাকালো। অরুণিকার পা কাঁপছে। শাহবাজ খান বললেন, “তোমার জন্য এসেছে।”
অরুণিকা খামটি হাতে নিল। গলা শুকিয়ে গেছে তার। অজানা কারণেই অশ্রু ভীড় করতে লাগলো চোখে। যেই খাম আসার কারণই তার অজানা, সেই খামটি দেখেই এতো বিষন্নতা কেন পুরো হৃদয়ে ছড়িয়ে পড়েছে? অরুণিকা যা ভেবেছিল, তাই হয়েছে। আহনাফ ডিভোর্স লেটার পাঠিয়েছে। অরুণিকা শাহবাজ খানের দিকে এক নজর তাকিয়ে চলে গেল রুমে। দরজা আটকে কাগজটির দিকে আবার তাকালো। বুকটা ভারী ভারী লাগছে তার। মেঝেতে বসে পড়লো সে। বুকে হাত দিয়ে কাঁপা কন্ঠে বলল, “আমি তো ভালো নেই, আহনাফ। আমি তো সুখী হতে পারি নি। আমি তো কোনো শান্তি পাচ্ছি না। এইটা সেই সুখ ছিল না৷ আমি নিজেই জানি না আমি কি চাই! কিন্তু এটা তো চাই নি।”
অরুণিকা পরক্ষণেই নিজের চোখ মুছে বলল, “এটাই তো চেয়েছিলাম আমি। এতো দিন এইটাই তো চেয়েছি। তবুও শান্তি পাচ্ছি না। আমি একটুও শান্তি পাচ্ছি না।”
অরুণিকা কাগজটি দুমড়েমুচড়ে দূরে ফেলে দিল। কাগজটি ঢিল খেয়ে দেয়ালের সাথে ধাক্কা খেয়ে মাটিতে আছড়ে পড়লো। অরুণিকা বুকে হাত রেখে মেঝেতে শুয়ে কাঁদতে লাগলো। আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল, “আমার মন গড়ার দায়িত্ব নিয়ে কেউ আসে নি। আমাকে এতো আঘাত করার পর, কেউ আসে নি আমাকে একটু সান্ত্বনা দিতে৷ আমি অভাগী। এতো আলোর মাঝে থেকেও ভেতরটা বিরান, শূন্য, অন্ধকার। সুখী হওয়া তো স্বপ্ন ছিল৷ স্বপ্ন কেন বলছি? সেটা তো দুঃস্বপ্ন ছিল। আমি যাকেই ভালোবাসি, সেই আমাকে ঠকায়। ভালোবাসা ছাড়া কি কেউ বাঁচে না? আমি তো বেঁচে আছি। শ্বাস নিচ্ছি, অথচ মনে হচ্ছে সেই শ্বাসটাই বেশ ভারী। বেরিয়েও আসতে চাইছে না। আবার আটকানোও অসম্ভব। হৃদপিণ্ড চলছে, রক্ত চলাচল করছে। অথচ আমার বুকে অসহ্য ব্যথা। মনে হচ্ছে ঘাড়-কপালে যেন সব ছিঁড়ে যাচ্ছে। সব দেখছি, সব শুনছি, তবুও সব ঝাপসা লাগছে, কেমন ভাসা ভাসা হয়ে আসছে সব। ভালোবাসাহীন বেঁচে থাকাটা তো এমনই হয়। হ্যাঁ, এমনি হয়।”
(***)
টেস্ট রিপোর্ট হাতে নিয়ে বসে আছে তূর্য। তার জীবনের গতি পথ হুট করেই পালটে গেল যেন। কপাল শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছে সে। উপমা তূর্ণার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তূর্য উঠে তূর্ণার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো। তার চোখে অশ্রু ভীড় করেছে। তূর্ণা ভাবুক কন্ঠে বলল, “কাঁদছো কেন আংকেল?”
তূর্য তূর্ণার দুই হাত নিজের হাতে আবদ্ধ করে তাতে চুমু খেয়ে বলল, “আই এম সরি, মা। আমি তোমাকে এতো বছর নিজের কাছ থেকে দূরে রেখেছি। আমি তোমার অস্তিত্বকে সন্দেহ করেছি। সরি। মা, আমিই তোমার বাবা।”
তূর্ণা উপমার দিকে তাকালো। উপমার চোখে জল। তূর্ণা হাত ঝাঁকিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করলো, “মা, উনিই কি আমার বাবা?”
উপমা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। তূর্ণা এবার তূর্যের দিকে তাকালো। তূর্ণা হাত এগিয়ে তূর্যের গাল ছুঁয়ে বলল, “মা বলেছে আমার বাবা স্টার। তুমিই কি সেই স্টার?”
তূর্য তূর্ণাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “তোমার বাবা তো স্টার। রকস্টার।”
তূর্যের হঠাৎ মনে পড়ে গেল উপমা কন্সার্টে তার মেয়ের জন্য এসেছিল। নিজের প্রতিই রাগ জন্মেছে তূর্যের মনে। ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো সে। বিড়বিড় করে বলল, “আমি অনেক খারাপ বাবা। আই এম সরি, মাই গার্ল। আমি তোমাকে খুঁজে নেই নি। আই এম সরি।”
আরাফ তূর্যের কাঁধে হাত রেখে তাকে সান্ত্বনা দিতে লাগলো। তূর্য চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো। ইভানকে ইশারায় বলল, তূর্ণাকে নিয়ে যেতে। ইভান তূর্ণাকে নিয়ে অন্যদিকে চলে গেল।
তূর্ণা চলে যেতেই আরাফ তূর্যের কাঁধে হাত রেখে বলল, “এটা এতোটাও সহজ ব্যাপার না, তূর্য। তুই নিজেকে শক্ত কর৷ আন্টি-আংকেলকে কীভাবে ম্যানেজ করবি? তুই উপমাকে বিয়ে করেছিস, সেটা তো আজই আমরা জানলাম! দুই গ্রামের রেষারেষিটা আরো বাড়িয়ে দিবি তুই। তখন লাঠি নিয়ে নামবে সবাই।”
উপমা ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “না, আমার জন্য তূর্যকে কোনো ঝামেলার মুখোমুখি হতে হবে না।”
তূর্য ভ্রূ কুঁচকে উপমার দিকে তাকালো। এরপর তেড়ে গেল উপমার দিকে। তার বাহু চেপে ধরে বলল, “আমার বাচ্চা পেটে নিয়ে নোংরামি করার সাহস পেলি কীভাবে তুই?”
উপমা মাথা নিচু করে বলল, “আপনার মেয়ের উপর কোনো নোংরা স্পর্শ লাগে নি। আমি কসম করে বলছি।”
তূর্য ছেড়ে দিল উপমাকে। উপমা হতাশ কন্ঠে বলল, “যা হয়েছিল, আমি কন্সিভ করার অনেক আগে হয়েছিল।”
আরাফ ভ্রূ কুঁচকে উপমার দিকে তাকালো। তাহমিদ, ইমনও দাঁড়িয়ে আছে পাশে। ইমন জিজ্ঞেস করলো, “তোমাদের মধ্যে কি হয়েছে!”
তূর্য শক্ত কন্ঠে বলল, “কিছু হয় নি।”
“তাহলে এসবের মানে কি তূর্য?”
“এটা আমার একান্ত পারসোনাল মেটার। আমি তোদের কাউকে এসব বলতে চাই না। এমনকি আমি নিজেই সেই মুহূর্তটা ভুলে থাকতে চাই।”
(***)
সাল ২০১৪। যেই বছর আহনাফ অরুণিকার বিয়ে হয়েছিল। ন’বছর আগের কথা। অরুণিকার সাথে খুব ভাব জমেছিল তূর্যের। সে প্রায়ই অরুণিকাকে নিয়ে দিঘির পাড়ে চলে যেতো উপমাকে দেখার জন্য। শ্যামকন্যাকে তখন থেকেই ভীষণ ভালোবাসতো সে। উপমাও মনে মনে তূর্যকে পছন্দ করতো। বয়সে তাদের এক বছরের ব্যবধান। উপমার সতেরো। আর তূর্যের আঠারো। বয়ঃসন্ধিকালের দু’জনেরই প্রথম প্রেম। আহনাফ ভেবেছিল, তূর্য অরুণিকাকে পছন্দ করে। নয়তো কি তার ছোট্ট প্রেয়সীকে নিয়ে যখন তখন দিঘি পাড়ে যাওয়ার বাহানা খুঁজতো? তাই সেই বছর শীতে ইস্ক্রুপের প্যাঁচ লাগিয়ে সে বিয়ের করে ফেলে অরুণিকাকে। আর সেটা খানিকটা বন্ধুমহলেও নাড়া দিয়েছিল। তূর্যও তাই পরের বছর ২০১৫ সালে ভালোবাসার কথা সরাসরি জানিয়ে দেয় উপমাকে। আর সেই বছরই রানী গ্রামের এক হুজুরের কাছে দু’জন সাক্ষী নিয়ে হাজির হয়৷ সাক্ষী দু’জন সেই হুজুরেরই শিক্ষার্থী ছিল। তূর্য ঠিক কি কারণে বিয়েটা করেছে, তা সে নিজেও জানে না। দু’জনই ফ্যান্টাসিতে ছিল সেই সময়। তবে উপমার ব্যাপারে যথেষ্ট নিশ্চিত ছিল তূর্য। সে বাবা-মাকে রাজি করিয়ে তার শ্যামকন্যাকে বাড়ি তুলবে, সেই সিদ্ধান্তে অটল। বিয়ের দু’বছর বেশ ভালোই কেটেছিল। দু’জনের ঘনিষ্ঠতা আড়ালে থাকলেও ভালোবাসা সবারই চোখে পড়তো। এসব মাতবরদের চোখে পড়তেই গ্রামে আবার এক দ্বন্ধ হবে, এটা নিয়ে নিশ্চিত হলো দুই গ্রাম। তবে এবার তো এটা মারাত্মক দ্বন্ধ। শিক্ষিত পরিবার এবং নামকরা ব্যবসায়ী হায়াত শেখের একমাত্র পুত্রের সাথে না-কি গ্রামের প্রান্তিক চাষা করিম মিয়ার কন্যার প্রেম! এ তো কুরুক্ষেত্র কান্ড ঘটার অশনিসংকেত। তবে তসলিমা খান ইনিয়েবিনিয়ে ছেলেকে বুঝিয়ে দিলেন ওই গ্রামে যাতে আসা যাওয়া না হয়। ওদিকে তাহমিদ ওই গ্রামের জমিদারের নাতনি শতাব্দীর প্রেমে প্রায়ই মত্ত ছিল সেই সময়। এদিকে রাজা গ্রামের স্থানীয়রা চৌধুরী সাহেবকে সতর্ক করে দেয়। যদি গ্রামের শিক্ষিত পরিবারের কেউ সেই রানী গ্রামের মেয়ে বিয়ে করে আনে, নাক ডুবে যাবে তাদের। তাহমিদ তার মনের কথা শতাব্দীকে জানানোর সাহসটাও আর পেল না। ভাবলো, চাকরি নিয়ে তবেই প্রস্তাব পাঠাবে। কিন্তু দুই গ্রামের আদায় কাঁচকলায় সম্পর্ক তূর্য-উপমার কারণে আরো আড়াআড়ি হয়ে উঠে।
সাল ২০১৬। তূর্য তার প্রথম গান লিখলো তার শ্যামকন্যার জন্য। উপমার জন্মদিনে তা গেয়ে শুনবে, তাই গিটার নিয়ে অসময়ে হাজির হলো উপমার বাড়ি। ভেতর থেকে দরজা আটকানো। মাটির ঘর। দরজাগুলো বেশ দুর্বল। তূর্য দরজা হালকা ফাঁক করতেই যা দেখলো, তাতেই পুরো মাথা ফাঁকা হয়ে গেল তার। এক মধ্যবয়স্ক পুরুষ তার শ্যামকন্যাকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তূর্য প্রথম দেখায় বিশ্বাস করতে পারে নি। কীভাবে সম্ভব এটা? শ্যামকন্যা ভীষণ ভালোবাসে তাকে। তাই আবার ফিরে তাকালো। যেই নারীর শরীরে একমাত্র তার অধিকার ছিল, সেই নারী কীভাবে অন্য পুরুষের স্পর্শে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে? কোনো প্রতিবাদ নেই, কোনো বিরক্তি নেই তার চোখে-মুখে। ভাবলেশহীন চাহনিতেই তাকিয়ে আছে সেই মানুষটির দিকে৷ তূর্য পিছিয়ে গেল। কিছুদূর গিয়ে থেমে গেল। বিশ্বাস হচ্ছে না তার। মিনমিনিয়ে বলল, “উপমা আমাকে ঠকাবে না। হয়তো আমারই কোথাও ভুল হচ্ছে।”
তূর্য আবার ফিরে গেল। উপমাকে জিজ্ঞেস করবে সে৷ মাঝেই উপমার চাচীর মুখোমুখি হলো সে। তিনি তূর্যকে দেখে ভ্রূ কুঁচকে বললেন, “এদিকে কেন এসেছো? তোমাদের গ্রামের কেউ দেখলে আমাদেরই ক্ষতি হবে।”
“উপমা আছে?”
“শহুরে বাবু এসেছেন। তুমি এখন যাও।”
“কে সে?”
“তুমি চিনবে না। তোমার বাবার চেয়ে ধনী। অনেক বড় ব্যবসায়ী, আসিফ ইকবাল। তোমরা আমাদের ছোট করেছিলে না? দেখো, কেমন আমাদের মেয়ে পটিয়ে নিল এক শহুরে বাবু! তোমার বাবারই তো সব আছে। তোমার তো কিছুই নেই।”
তূর্যের চোখ ভিজে উঠলো। সে শার্টের হাতায় চোখ মুছে ফিরে এলো বাড়ি। দিঘি পাড়ে ভাসিয়ে দিল শ্যামকন্যার জন্য লেখা প্রথম গান। তূর্যের সামনে ডুবে গেল সেই কাগজ ও তার গান। বেশ কয়েক রাত ঘুমাতে পারে নি সে। একটা লোক উপমার শরীরে হাত দিচ্ছে, কিন্তু একটুও প্রতিবাদ করলো না সেই মেয়ে?
এরপর তূর্য অনেকদিন দেখা করলো না উপমার সাথে৷ এবার উপমা খবর পাঠালো তূর্যের কাছে। তূর্যকে সন্তান আগমনের খবর দিল। তূর্য অস্বীকার করলো তাদের সম্পর্ক। উপমা বেশ কান্নাকাটি করলো। পায়েও ধরলো। সবটাই অরুণিকার সামনেই ঘটেছিল। কিন্তু তূর্য সেই সম্পর্কে পা মাড়িয়ে চলে এলো।
এর বেশ কিছুদিন পর রানী গ্রামে জানাজানি হয়ে গেল উপমার সন্তানসম্ভবা হওয়ার কথা। উপমার চাচী রাজা গ্রামের উপর অভিযোগ দিলেন। তূর্যের পক্ষে দাঁড়িয়ে গেল তার পুরো গ্রাম। তূর্যও অস্বীকার করলো সব। সে উপমার মুখের উপর বলল, “চাষার মেয়ের এতো স্পর্ধা? যার হাত ছুঁতেই আমার ঘেন্না পায়, সে আমাকে বলছে আমি না-কি তার সন্তানের বাবা! তাকে বিয়ে করবো আমি? হাউ ফানি!”
উপমা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল সেদিন তূর্যের দিকে। আর আজ এতো বছর পর আবার সেই শূন্যতা উপমার চোখে স্পষ্ট। তূর্য বলল, “আমি তূর্ণার সব দায়িত্ব নিবো। আমি হয়তো ওকে দেখতে আসবো। কিন্তু পরিস্থিতি এমন, আমি এই মুহূর্তে ওকে আমার সাথে নিয়ে যেতে পারছি না। কিন্তু আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি, ওকে আমি তোমার সাথেই রাখবো না। আমি আমার মেয়েকে নিয়ে আসবো। তূর্ণা আমার সাথে থাকবে। আর এরপর আমি অফিসিয়ালি তোমাকে মুক্তি দেবো।”
উপমা ক্ষীণ হেসে বলল, “আপনি যা চান, তাই হবে। আমার কোনো আপত্তি নেই।”
উপমার এমন শক্ত কথায় তূর্য মনে মনে আবার ভেঙে গেল। কোনো অপরাধবোধ নেই এই মেয়ের চোখে। অথচ এই শ্যামকন্যা তাকে বছর ধরে তিলে তিলে মারছে!
তূর্য চলে যেতেই উপমা ফুঁপিয়ে উঠলো। দেয়ালে হেলান দিয়ে তূর্যের যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি কীভাবে বলি, আমি আপনাকে ঠকাতে চাই নি। আপনার শ্যামকন্যা এখনো আপনাকে ভালোবাসে। এমনকি কখনো ভালোবাসা ছাড়ে নি। কিন্তু ভাগ্যটাই এমন ছিল! আমি আপনার একার হয়ে থাকতে পারি নি। আমি নিজেকে আপনার জন্য আগলে রাখতে পারি নি। আমি নিজেকে রক্ষা করতে পারি নি। লোভ, হিংসা, প্রভাব আমার ভালোবাসাকে হারিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমি আপনাকে হারতে দেবো না। আপনি অনেক দূর যাবেন। আপনার অনেক উন্নতি হবে। আমার দোয়া কবুল হবে কি-না জানি না। কিন্তু আমি সবসময় আপনার ভালো চাই।”
(***)
লাল জরজেট শাড়ি পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে জয়িতা। ঠোঁটে গাঢ় লাল ওষ্ঠরঞ্জন মাখছে সে। এরপর ঠোঁট দু’টি হালকা ঘষে খানিকটা উঁচু করে আয়নার প্রতিবম্বটির দিকে তাকিয়ে ফ্লাইয়িং কিস ছুঁড়ে দিল। আয়নার প্রতিবিম্বটি হালকা হাসলো। জয়িতা পেছন ফিরে মানুষটির সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি জানতাম, তুমি আমার কাছে নত স্বীকার করবেই। আফটার অল, আমার কাছেই আসল অস্ত্র।”
আহনাফ শব্দ করে হাসলো। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, “আমি অরুকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিয়েছি। তুমি আমাকে বাধ্য না করলেও ওর সাথে থাকা আমার পক্ষে আর সম্ভব ছিল না।”
জয়িতা আহনাফের বসা চেয়ারটির দু’হাতলে হাত রেখে তার দিকে ঝুঁকে বলল, “আচ্ছা?”
“অরুণিকা চৌধুরী আমার মন ভেঙে দিয়েছে। তবে তুমি রুদবাকে দিয়ে কি কি করিয়েছো, ও তূর্যকে সব জানিয়ে দিয়েছে। আমাদের পারসোনাল ভিডিও করে তুমি সাংঘাতিক অন্যায় করেছো।”
“আমি কিন্তু সব দেখেছি। তুমি এতোটা চমৎকার…”
আহনাফ জয়িতার চুল ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে এনে বলল, “আমাকে ভিডিওগুলো পাঠাও, নয়তো!”
“নয়তো কি!”
আহনাফ জয়িতার কোমড় ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে এনে বলল, “এমন কিছু হবে, যার জন্য আপসোস করেও লাভ হবে না।”
“তুমি আমার সাথে যাই করো, আমার আপসোস হবে না।”
আহনাফ জয়িতাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। বাঁকা হেসে বলল, “সিরিয়াসলি? পরে কিন্তু বলতে পারবে না, আমি বেশ দুষ্টু।”
জয়িতা মৃদু হেসে বলল, “মোটেও না।”
আহনাফ জয়িতার বাহু ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে আনলো। এরপর তার কোমড়ে হাত রাখলো। জয়িতা চোখ বুজে আহনাফের স্পর্শ অনুভব করতে লাগলো। আহনাফ এবার তাকে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দিল। জয়িতা কামুক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আহনাফ তার শার্টের বোতাম খুলতে লাগলো। হঠাৎ থেমে গেল সে। জয়িতা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “থামলে কেন?”
আহনাফ নিঃশব্দে হাসলো। জয়িতা বলল, “হাসছো কেন?”
“ডিয়ার জয়িতা, ফিল্ডে নামার আগে প্রতিদ্বন্ধী সম্পর্কে একটু কি জেনে আসা উচিত ছিল না?”
“মানে?”
“মানে টানে এতো কিছু জিজ্ঞেস করে আর লাভ নেই। শিকার নিজেই ফাঁদে ধরে পড়েছে। এখন বাঁচার উপায় নেই।”
আহনাফ তুড়ি বাজাতেই বাইরে থেকে এক মধ্যবয়স্ক লোক ভেতরে ঢুকলো। জয়িতা লোকটাকে দেখেই তাড়াতাড়ি উঠে নিজের শাড়ির আঁচল ঠিক করে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল, “এটা কেমন অভদ্রতা! নক করে আসা উচিত না?”
আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “নক? কি যে বলছো, ডিয়ার জয়ি! হবু স্ত্রীর সামনে কিসের ইতস্ততবোধ!”
জয়িতা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কি যা তা বলছো?”
আহনাফ দু’হাতে শব্দ করতেই রুমের ভেতর আরো আটজন ছেলে প্রবেশ করলো। জয়িতা ভয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেল। আহনাফ বাঁকা হেসে বলল, “এই মাঠ আমার। এখানে শুধু আহনাফ চৌধুরীর খেলা জমে। আমিই আমার প্রতিদ্বন্ধী। খেলায় হারবোও আমি, একই সাথে জয়ও আমার হবে। কীভাবে? ওয়েট, একটা ডেমো দেখাই।”
এই বলে পেছনে টিভি স্ক্রিনে একটা ভিডিও চালু করলো আহনাফ। জয়িতা টিভির স্ক্রিনে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল, “এটা কি!”
“এটা শুটিং। আমার সিনেমার শুটিং। যেই সিনেমার প্রডিউসার, ডিরেক্টর, স্ক্রিপ্ট রাইটার আহনাফ চৌধুরী। আর নায়িকা জয়িতা।”
“কি বলছো, আহনাফ!”
আহনাফ চেয়ারে আয়েশ করে বসে বলল, “আচ্ছা, ক্লিয়ার করছি। টিভি স্ক্রিনে যা দেখেছো, সব শুটিং ছিল। তোমাকে এক্টিং স্কিল শেখাচ্ছি। কারণ একটু পর যা যা হয়েছে, তা বাস্তবে হবে।”
“মানে?”
“আবার মানে? আজ কোনো প্রশ্ন না। আজ প্রশ্ন আমি করবো। আর প্রশ্নের উত্তরও আমি দেবো। এখন বলো, টিভি স্ক্রিনে কি দেখছো?”
জয়িতা চুপ করে রইল। আহনাফ বলল, “একটি মেয়েকে আটজন ছেলে ঘিরে ধরেছে। এখনই তার রেইপ হবে। আটজনের সাথে পেরে উঠেছে না সেই মেয়ে। এখন মেয়েটা কি করবে?”
জয়িতা ভীত কন্ঠে বলল, “তুমি আমার সাথে কি করতে চাইছো, আহনাফ?”
“সিম্পেল। তুমি তোমার তৈরি স্ক্রিপ্টে আমার আর আমার ওয়াইফের প্রাইভেট ভিডিও রেকর্ড করেছো। কিন্তু মুভিটা ব্লকবাস্টার হয় নি। এবার আমি আমার স্ক্রিপ্টের জন্য আটজন সুদর্শন যুবক খুঁজে এনেছি। যারা তোমার স্পর্শ পাওয়ার অপেক্ষায় বসে আছে।”
আহনাফ ছেলেগুলোকে জিজ্ঞেস করলো, “রেডি তো!”
ছেলেগুলো একসাথে বলে উঠলো, “ইয়েস।”
জয়িতা ছেলেগুলোর আগ্রহ দেখে ভয় পেয়ে গেল। আহনাফ বাঁকা চোখে তাকালো জয়িতার দিকে। জয়িতা ভীত কন্ঠে বলল, “আহনাফ, প্লিজ এমন করো না। আমার এতো বড় ক্ষতি করো না।”
“আমার কতো বড় ক্ষতি করেছো তুমি! আমাকে এই ক্ষতিপূরণ কীভাবে দেবে?”
“আমি তোমাকে ভিডিওগুলো সেন্ড করে দিচ্ছি।”
“নো, নো, নো। আমাকে পাঠাতে হবে না। তুমি তোমার ফোনটা দাও। আমিই সব ডিলিট করে দেই।”
জয়িতা তার ফোন এগিয়ে দিতেই আহনাফ তার ফোনটা রিসেট করে দিল। আর মুহূর্তেই ফোনের যাবতীয় ফাইল, ছবি সব ডিলিট হয়ে গেল। ড্রাইভের যতো ফাইল আছে সব ডিলিট করে দিল আহনাফ। জয়িতা এবার ফোন হাতে নিয়ে যখন দেখলো, ফোনে কিছুই নেই, সে চেঁচিয়ে বলল, “তুমি আমার প্রয়োজনীয় ফাইলগুলোও ডিলিট করে দিয়েছো?”
আহনাফ ভাবলেশহীন স্বরে বলল, “আমার ক্ষতিপূরণে এটা সামান্য মাত্র। আমি তো আমার জীবনের সবচেয়ে দামি জিনিসটা হারিয়ে ফেলেছি। আমি তোমার সামান্য ফাইলও ডিলিট করতে পারবো না?”
জয়িতা হতাশ দৃষ্টিতে আহনাফের দিকে তাকিয়ে রইল। আহনাফ মধ্যবয়ষ্ক লোকটিকে জিজ্ঞেস করলো, “কি নাম?”
“দিদার।”
জয়িতার দিকে ইশারা করে বলল, “মেয়ে পছন্দ হয়েছে?”
দিদার হেসে মাথা নাড়লো। আহনাফ বাইরে থেকে একজন হুজুর ডেকে আনলো। জয়িতা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কি করছো এটা? আমাকে যেতে দাও এখন।”
আহনাফ জিভ কেটে বলল, “বিয়ে না দিয়ে তোমাকে ছাড়তে পারছি না। আমার দায়িত্ব তোমার শরীরের গরম কমানো। এভাবে সিংগেল ছাড়া যাবে না তোমাকে। না-জানি আবার কার বরের উপর জাদু বিদ্যা প্রয়োগ করে বসো।”
জয়িতা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তুমি আমাকে বিয়ে করবে?”
আহনাফ তাচ্ছিল্যের সুরে হাসলো। বলল, “আমার রুচি এতোটাও খারাপ না।”
হুজুরকে বসিয়ে আহনাফ বলল, “বসুন কাজি সাহেব। কনের নাম জয়িতা, আর বরের নাম দিদার। তাড়াতাড়ি এদের বিয়ের ব্যবস্থা করুন। নয়তো সমাজে পাপাচার বেড়ে যাবে। এদের পক্ষে এক মিনিটও ঠান্ডা থাকা সম্ভব না।”
জয়িতা আহনাফের দিকে তেড়ে এসে বলল, “তুমি আমার সাথে এমন করতে পারবে না। তোমাকে পুলিশে দেবো আমি।”
“প্রমাণ কি? তোমার কাছে কোনো প্রমাণ নেই। কল রেকর্ড, ফোনের মেসেজ সব দেখলে পুলিশ উলটো তোমাকে ধরবে। তুমিই আমাকে মেসেজ করেছো। স্পষ্ট প্রমাণ আছে, আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছিলে তুমি।”
“ভিডিও ডিলিট করে দিয়েছি আমি।”
“আমার কাছে মেসেজ তো আছে। অনুরোধ করে ডিলিট করিয়েছো বললে না হয়। আরেহ, একটু তো শক্তপোক্ত একটা গেইম প্ল্যান করতে পারতে। এসব কি! বাচ্চাদের আইডিয়া। মজা পেলাম না। খেলা তো জমেই নি। খেলা তো এবার জমবে। তোমার আর দিদার সাহেবের বিয়ে হলেই খেলা হবে।”
জয়িতা অনুরোধের সুরে বলল, “প্লিজ, আমাকে যেতে দাও। তুমি আমাকে বসিয়ে রাখলেও আমি বিয়ের জন্য রাজি হবো না।”
“সমস্যা নেই। তোমার হাতে দুইটা অপশন। এক, সম্মানের সাথে দিদার সাহেবকে বিয়ে করে নাও। দুই, আটজনকে আহ্বান করো, আমি একশেন বলবো।”
জয়িতা অনেক অনুনয় বিনয় করে আহনাফের মন গলাতে পারলো না। এই মুহূর্তে পালানোরও কোনো পথ নেই। আহনাফ যে এমন কিছু করবে, তা মাথায় আসে নি। জয়িতা বিয়ের আগ মুহূর্ত বলল, “বিয়েটা হবে না। জোর করে বিয়ে হয় না।”
আহনাফ বলল, “বিয়ে হওয়া না হওয়া আমার কাছে জরুরি না। তোমার বিয়ের সার্টিফিকেট বের হওয়া আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তোমার মতো মেয়েদের বিয়েও লাগে না। যা ইচ্ছে হয়, বিয়ের আগে পরে, সব সময় পসিবল। সো প্যারা নেই, বেইব।”
জয়িতা একপ্রকার বাধ্য হয়ে দিদারকে বিয়ে করলো। কাজি সাহবে চলে যেতেই আহনাফ তার ফোনে দিদার আর জয়িতার বিয়ের মুহূর্ত ধারণ করা ভিডিও স্যোশাল মিডিয়ায় ছেড়ে দিল। মুহূর্তেই বাকি পাঁচজন তাদের পরিচিতি প্ল্যাটফর্ম থেকে ভিডিওটা ছেড়ে জয়িতাকে ভাইরাল করে দিল।
জয়িতা স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। তার ফোনেও একই দৃশ্য দেখছে সে। আহনাফ জয়িতার সামনে এসে বলল, “খেলায় কিন্তু আমি জিতেছি। বলেছি না, আমার মাঠে অন্য প্রতিদ্বন্ধীরা দাঁড়াতে পারে না। স্ক্রিপ্ট কেমন ছিল? আমার ডিরেকশনও বেস্ট ছিল, তাই না? কিন্তু তোমার এক্টিং আমার পছন্দ হয় নি। আরেকটু কাকুতিমিনতি করা যেতো৷ আর যাই হোক, তবুও আমার ক্ষতিপূরণ এখনো হয় নি। তুমি ডায়মন্ড চুরি করে আমাকে গোল্ড ফিরিয়ে দিতে পারবে না। লিসেন, দিদারের সাথে যোগাযোগ থাকবে আমার। ওর সাথে মনোযোগ দিয়ে সংসার করো। ওর সাথে ঝামেলা করলে তোমাকে আমি এমনভাবে ফাঁসাবো, তখন কোনো ঘাটেই তরী ঠেকাতে পারবে না।
চলবে-
#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| বোনাস পর্ব-০২ ||
রুমের একপাশে ঝুলন্ত কঙ্কালের সামনে দাঁড়িয়ে আছে রুহানি। আঙুলের হাড়টি হালকা স্পর্শ করতেই নিজে নিজে কেঁপে উঠলো সে। বুকে দু’বার ফুঁ দিয়ে কঙ্কালের গালের হাড়ে দু’হাত রাখলো। স্ট্যান্ডটি রুহানির শরীরের ভারে পিছিয়ে পড়তেই সে ভয় পেয়ে গেল। কয়েক পা পিছিয়ে কঙ্কালটির দিকে তাকিয়ে বলল, “সরি মামা, আমি তো একটু আদর করছিলাম আপনাকে। থাক, আপনি ঘুমান। বিরক্ত করবো না আর।”
এই বলে স্ট্যান্ডের উপর পর্দা উঠিয়ে দিল সে। কঙ্কালটির উপরের অংশ পর্দার আড়াল হতেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো রুহানি। এবার সে টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালো৷ রুহানি ও আরাফের বিয়ের দুই মাস পূর্ণ হলো। অথচ আজই প্রথম আরাফের পড়ার ঘরে ঢুকলো সে। আরাফ প্রায়ই এই রুমে সময় কাটায়। শুধু রাতেই বেডরুমে আসে। তাই রুহানি বেশ কৌতুহল নিয়ে এই ঘরে এসেছে আজ। এতোদিন কাজের লোক ঘরে ছিল। তবে আজ সে ছুটিতে আছে। বাসায়ও কেউ নেই। সেই সুযোগে আরাফের ঘরে কি আছে, তা দেখার জন্য এলো সে। টেবিলে মোটা মোটা বই দেখে রুহানি বিড়বিড় করে বলল, “পড়তে পড়তে রোমান্টিকতা ছুটে গেছে আমার বরের। কবে যে এই পড়াশুনা শেষ হবে! মেয়েদের শত্রু না-কি মেয়ে হয়। কিন্তু আমার বেলায় সব উলটো। এই কঙ্কাল আর এই মোটা মোটা বই আমার স্বামীকে পরকীয়ার জন্য উস্কে দিচ্ছে।”
এই বলে রুহানি কঙ্কালটির দিকে তাকালো। হালকা হাওয়ায় পর্দা দুলছে। পর্দাটি কঙ্কালের মুখের অংশে আটকে থাকায়, তার মনে হচ্ছে কঙ্কালটি নড়াচড়া করছে। রুহানি চোখ-মুখ কুঁচকে বলল, “সরি মামা, আমি আপনাকে কিছু বলছি না। আমি তো আরাফকে বকা দিচ্ছে। আপনার মুখের উপর বাতি জ্বালিয়ে রাখে সারাদিন। আপনাকে একটু ঘুমাতে দেওয়া উচিত না? এখন বাতি জ্বালিয়ে রাখলে আপনারই ঘুমের সমস্যা হবে! দেহ নেই বলে কি ঘুমানো নিষেধ?”
এই বলে রুহানি মুখ সরিয়ে বলল, “কি ভয়ংকর! আরাফ এখানে সারাদিন কীভাবে থাকে? আমার তো জানটা হাতে চলে আসছে।”
রুহানি রুম থেকে বেরিয়ে আসার জন্য পা বাড়াবে, তখনই ডিভানের দিকে চোখ পড়লো তার। কুশনের নিচে কিছু একটা দেখে চোখ-মুখ কুঁচকে সেদিকে গেল। ডিভানে পা ঝুলিয়ে বসে কুশন সরাতেই একটি এলবাম চোখে পড়লো তার। রুহানি কৌতুহলি হাতে এলবামটি নিল। মনে মনে ভাবলো, “এখানে কার ছবি থাকবে? নিশ্চয় আরাফের ছোটবেলার ছবি হবে!”
ভাবতে ভাবতেই এলবাম উল্টালো রুহানি। এলবামের শুরুর কয়েকটা পাতায় কোনো ছবি নেই। কয়েক পাতা পর আরাফের স্কুল-কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বন্ধুদের সাথে তোলা ছবিই আছে। বেশ কয়েকটা স্থান খালি। দেখে মনে হচ্ছে, আগে ছবি ছিল, কিন্তু এখন সরিয়ে ফেলে হয়েছে। ভাঁজ পড়ে গেছে সেই স্থানে। এলবামটি পাশের টেবিলে রাখতেই দেখল টেবিলের নিচে একটি ছবি উল্টে আছে। সেখানে কিছু একটা লেখা। রুহানি ছবিটি তুলে চমকে উলটো লেখাটি পড়ে। সেখানে লেখা,
“সেদিন ছিল তোমার আমার প্রথম ক্লাসপার্টি। তখন আমরা ক্লাস এইটে। তোমার ছবি উঠিয়েছিলাম বাবার ক্যামারায়। আমি প্রায়ই সেই ছবি দেখতাম। এখনো দেখি। অভ্যাসটা যাচ্ছে না। হয়তো কখনো যাবেও না।”
রুহানির হাত কাঁপছে। আরাফেরই হাতের লেখা। তারিখটা দু’বছর আগের দেওয়া। আরাফ হয়তো তখন রুহানিকে চেনেই না। তাদের পরিচয় হয়েছে তো মাত্র এক বছরের একটু বেশি সময় হচ্ছে। রুহানি ছবিটা উল্টালো। একটি মেয়ের ছবি। মেয়েটি কেক খাচ্ছে। ক্লাসপার্টিতে আনা কেক। রুহানির মুহূর্তেই হাত-পা শিউরে উঠলো। বুকটা ঢিপঢিপ করছে তার। ছবিটা এলবামের ফাঁকে রেখে দিল সে৷ এরপর রুম থেকে বের হতে গিয়েই থমকে গেল। কি মনে করে টেবিলের ড্রয়ারটি খুললো। ড্রয়ার খুলতেই স্তব্ধ হয়ে গেল সে। অনেকগুলো ছবি সেই ড্রয়ারে। রুহানি ব্যস্ত হাতে ছবিগুলো বের করলো। কয়েকটা তো মাটিতে পড়ে গেছে। রুহানি সব ছবি দেখতে লাগলো উন্মাদের মতো। সব ছবিতেই সেই মেয়ে। আর প্রতিটি ছবির পেছনে কিছু না কিছু লেখা। একটিতে লেখা,
“সেদিন সময়টা ছিল শরৎ। আমরা ক্লাস নাইনে। তুমি কমার্স নিয়েছিলে। আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। তোমার সাথে এক কক্ষে ক্লাস করা হবে না আর। তোমাকে আর ভালোভাবে দেখাও হবে না।”
আরেকটিতে লেখা,
“আজ আমাদের বিদায়। আমি খুব করে চাইবো আমাদের কলেজ যাতে একই হয়। আমার তো ইচ্ছা চট্টগ্রাম কলেজে পড়ার। তুমিও যদি সেখানে কমার্সে আসো, বেশ ভালো হবে। আমি খুব দোয়া করি জানো?”
অন্যটিতে লেখা,
“তোমাকে ওরিয়েন্টেশনে দেখে চমকে উঠলাম। আমার দোয়া কবুল হলো। আমরা আজ একই কলেজে।”
অন্য আরেকটিতে লেখা,
“প্রায়ই কোনো না কোনো অনু্ষ্ঠানে তোমার ছবি তুলি। এই ছবি অলিম্পিয়াডে তুলেছিলাম। তুমি দেখছি ভালোই ভলান্টিয়ার! যা বকাবকি করো। ভয় পেয়েছিলাম সেদিন।”
রুহানির চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। একটি ছবির পেছনে লেখা,
“সেদিন ছবিটা তোলার পর জানলাম, তুমি তো কখনো আমাকে ভালোই বাসো নি। আমি তো তোমার দৃষ্টিতে ইমনের বন্ধু মাত্র। আমি তো খেয়ালই করলাম না, আমাদের হাই, হ্যালোর বেশি কথা হয় নি কখনো। আমার ভালো লাগা নীরবেই দম ছাড়লো। তুমি আর কখনোই জানবে না, আরাফ নামক একটি ছেলে তোমাকে কতোটা ভালোবাসতো।”
রুহানি চোখ মুছে সব ক’টা ছবি কাঁপা হাতে মাটি থেকে কুঁড়িয়ে নিয়ে ড্রয়ারে রেখে দিল। হঠাৎ একটি ছবি দেখে গলা শুকিয়ে গেল তার। ছবিটির লেখার নিচে তারিখটি এক সপ্তাহ আগের। সেখানে লেখা, “তুমি এখনো এক অদৃশ্য মায়ায় বেঁধে রেখেছো আমাকে। আজ অনেক বছর পর তোমাকে মেডিকেলের সামনে দেখলাম। চিন্তিত মুখ। মনে হচ্ছে ভীষণ কষ্টে আছো। আমি আজ ডিউটিতে মন বসাতে পারবো না। বাসায় ফিরে এসেছিলাম তাই।”
ছবিটি উলটে দেখল রুহানি। ছবিটিতে আরাফের মেডিকেলের সামনে সেই মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। পরনে হলুদ শাড়ি। রুহানি ছবিটি দ্রুত রেখে দিল ড্রয়ারে। চোখ মুছে হাসলো। মনে মনে বলল, “না, হয়তো মেয়েটাকে উনি আগে ভালোবাসতো। এখন তো আমাকে ভালোবাসে, তাই না? আমি তো উনার বউ। আমাকে ভালোবাসে দেখেই তো বিয়ে করেছিলেন।”
রুহানি দ্রুত আরাফের পড়ার রুম থেকে বেরিয়ে বেডরুমে ঢুকলো। নিজের ফোন খুঁজে অরুণিকাকে ফোন করলো। ওপাশ থেকে অরুণিকার শুকনো স্বর ভেসে এলো। রুহানি ব্যস্ত কন্ঠে বলল, “তোর ভাইয়া কি কাউকে ভালোবাসতো?”
অরুণিকা ক্ষীণ কন্ঠে উত্তর দিল, “না!”
“তুই শিউর?”
“হ্যাঁ।”
“ইমন ভাইয়া কিসে পড়তো?”
“আমাদের ইউনিভার্সিটিতে পড়েছিল।”
“না, না কোন কলেজে!”
“চিটাগাং কলেজে।”
“কমার্সে?”
“হ্যাঁ। কেন?”
“উনার কোনো মেয়ে ফ্রেন্ড আছে, যাকে আরাফও চেনে?”
“জানি না।”
“একটু জেনে নিবি? মেয়েটার নাম, পরিচয়! আমি তোকে ছবি পাঠাবো?”
অরুণিকার চোখ-মুখ ফুলে আছে। সে মাথায় হাত দিয়ে বলল, “রুহানি, তুই ইমনকে জিজ্ঞেস কর। আমার ভীষণ খারাপ লাগছে। প্লিজ, আমাকে এখন কল দিস না।”
“তোর কি হয়েছে? তোর গলার স্বর এমন কেন শোনাচ্ছে?”
“কিছু হয় নি।”
“বল না! সব ঠিক আছে?”
অরুণিকা কল কেটে দিল। কোনো উত্তর দিল না সে। এদিকে রুহানি হতাশ চোখে তাকিয়ে রইল ফোনের দিকে।
(***)
রুদবা দাঁড়িয়ে আছে তূর্যের অফিসের সামনে। তূর্যকে দেখে তার কাছে দৌঁড়ে এলো সে। তূর্য চোখ-মুখ কুঁচকে বলল, “সমস্যা কি তোমার?”
রুদবা কিছু বলতে যাবে, ইভান তূর্ণাকে কোলে নিয়ে অফিস থেকে বের হলো। ইভান রুদবাকে দেখে ভ্রূ কুঁচকে বলল, “এই মেয়ে এখানে কি করছে?”
রুদবা হাত জোড় করে তূর্যের দিকে ভেজা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “আমি সত্যিই ভালোবাসি আপনাকে। আমার আপনাকে ছাড়া কিচ্ছু ভালো লাগছে না। আমি অনেক চেষ্টা করেছি সব ভুলে যেতে। কিন্তু ভীষণ অসহ্য লাগছে। আমি আপনাকে সত্যিই ভালোবাসি। আমার প্রথম ভালোবাসা আপনি। আমি থাকতে পারছি না আপনাকে ছাড়া। তাই আজ এতোটা বেহায়া হয়ে আপনার কাছে এসেছি। আমাকে ছেড়ে যাবেন না। আমাকে একটা সুযোগ দেবেন প্লিজ? আমি অরুকে সব সত্য বলবো। আহনাফ স্যার আর ওর মধ্যে সব ঠিক করে দেবো।”
তূর্য বুকে হাত গুঁজে বলল, “এক্সকিউজ মি, আমি তোমাকে ভালোবাসি না। তোমার মতো মেয়ের সাথে আমি তূর্য শেখ! হুহ, নিজের চেহারা দেখে আসো আয়নায়। আর তুমি কি বললে? বেহায়া? ইটস ট্রু। এই ওয়ার্ডটা তোমাকে বেশি স্যুট করে। আর তুমি এখনো টুইংকেলকে কিছু বলো নি? তুমি কি আমার হ্যাঁ বলার অপেক্ষায় আছো? এখানেও নিজের স্বার্থ দেখছো, না! তোমার না কিছুই বলতে হবে না। তুমি মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে বসে থেকো!”
“আমি আজই সব বলবো। প্রমিজ।”
তূর্ণা হঠাৎ হাওয়ায় মিঠাই দেখে বলল, “বাবা, ওটা খাবো আমি।”
রুদবা থমকে গেল। সে অবাক হয়ে তূর্ণার দিকে তাকালো। পরক্ষণেই তূর্যকে জিজ্ঞেস করলো, “মেয়েটা আপনাকে বাবা বলে ডাকলো কেন?”
তূর্য বলল, “ও আমার মেয়ে তাই।”
“মজা করছেন আমার সাথে?”
ইভান বলল, “ওর কি বাইক্কা টাইম আছে যে তোমার সাথে মজা করবে? এখান থেকে যাও তো।”
“যাবো না।”
তূর্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমি তোমাকে কখনো ভালোবাসি নি। ইনফ্যাক্ট, কাউকে কখনো ভালোবাসতে পারবো না। আমার ভালোবাসার জায়গাটা আমার মেয়ের মায়ের জন্যই ছিল। যেটা পুরোটা দখল হয়ে গেছে। সেখানে অন্য কারো জায়গা হবে না। আমি তোমার সাথে জাস্ট টাইম পাস করেছি। আমি তোমাকে এট এনি কস্ট এক্সেপ্ট করতে পারছি না, আই এম সরি।”
রুদবা কাতর কন্ঠে বলল, “আমি ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি আপনাকে।”
তূর্য তূর্ণাকে মোটর সাইকেলে বসিয়ে হেলমেট পরে বলল, “ভালোবাসার রচনা লিখে ফেলো বাসায় গিয়ে। তবে ইংরেজিতে লিখতে পারো। রাইটিং স্কিল ডেভেলপ হবে।”
এই বলে তূর্য মোটর সাইকেল নিয়ে চলে গেল। ইভানও চলে গেল তার পিছু পিছু। আর রুদবা সেখানে বসেই ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। নিজেকে কেমন শূন্য শূন্য লাগছে তার। নিজের গালে নিজেই চড় মারলো সে৷ রাস্তার মানুষ বোধহয় তাকে বদ্ধ পাগল ভাবছে। সে তো পাগলই হয়ে গেছে। এই কেমন যন্ত্রণা হচ্ছে তার! যাকে ভালোবেসেছে, সে তো ভালোইবাসে নি তাকে। ভয়ংকর কষ্ট হচ্ছে তার। এতো অস্বাভাবিক লাগছে, ইচ্ছে করছে গাড়ির নিচে ঝাঁপিয়ে পড়তে। আবার সাহসেরও অভাব। দ্বিধায় ভুগছে সে। আকাশের দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো রুদবা। চোখের সামনে অরুণিকার অশ্রুসিক্ত চোখ জোড়া ভেসে উঠলো। হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল, কবি মিষ্টিমশাইয়ের একটি কবিতার লাইন।
“অন্যে দুঃখ দিয়া কে হাসিয়েছিল কবে?
স্রষ্টার বিচার হইবেই, হোক দেরিতে কিন্তু হইবে।
তোমা মিথ্যে সত্তা একদিন খুব করে কাঁদিবে,
সেদিন তুমি আর পারিবে না সেই মিথ্যে মুছিতে,
অন্যে দুঃখ দিয়া কে হাসিয়েছিল কবে?
তুমি পারিবে না তোমার পাপ ফিরাইতে।
যারে দিয়াছো আঘাত,
তুমি তার কাছেই ফিরিবে খালি হাত
যদি সে ফিরিয়া দেয়,
তোমা জগতে আর সুখ নেই
ওহে মনুষ্যজাতি,
অন্যে দুঃখ দিয়া কে হাসিয়েছিল কবে?”
চলবে-