উইন্টার এন্ড মাই সনেট পর্ব-৫৬ এবং শেষ পর্ব

0
2

#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-৫৬ (১ম ভাগ)||

দরজা খুলতেই রুহানিকে সামনে দেখে চমকে উঠলো ইমন। ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “কিছু হয়েছে?”

রুহানি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ইমন বুকে হাত গুঁজে দরজার কাছে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। রুহানি ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “একটা বিষয় জানার জন্য এসেছি।”

“কি বিষয়?”

রুহানি তার হাতে থাকা ছবিটি ইমনের দিকে ঘোরাতেই চমকে উঠলো সে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “এই ছবি তুমি কোথায় পেয়েছো?”

“আপনি আমাকে সত্যটা বলবেন, প্লিজ? আমাকে অন্ধকারে রাখবেন না, ভাইয়া। আমি উনাকে জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছি না। যদি মন খারাপ হয় উনার!”

ইমন সেকেন্ড খানিক চুপ থেকে বলল, “আমার বাসায় কেউ নেই। নয়তো তোমাকে আসতে বলতাম। ছাদে যাবে?”

রুহানি মাথা নেড়ে বলল, “আচ্ছা।”

রুহানি ও ইমন ছাদে উঠলো। ইমন রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। বর্ষার মাস শুরু হয়ে গেছে। তবুও আকাশ পরিষ্কার। কালো মেঘের দেখা পাওয়া ভার। তবে রুহানির মনে মেঘের ঘনঘটা ভীড় করেছে। ইমন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রুহানির শুকনো মুখের দিকে তাকালো। আরাফ তার ছোটবেলার বন্ধু। রুহানির দায়িত্ব নিতে গিয়ে ছেলেটা যে নিজের সাথে অন্যায় করছে, এটা প্রতিনিয়ত আরাফকে দেখলে বোঝা যায়। ইমন চায় না, আরাফ অভিনয় করতে করতেই তার জীবন পার করুক। রুহানির সব জানা উচিত। তবেই হয়তো আরাফকে মুখোশ পরে থাকতে হবে না। ইমন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ছবির মেয়েটার নাম সায়ন্তনি। আমরা একই স্কুলে পড়তাম। ক্লাস ফাইভে প্রথম ভর্তি হয়েছিল সে। ও আরাফের প্রথম ভালোবাসা। প্রথম দেখাতেই সায়ন্তনিকে ভালো লেগে যায় ওর। খুব ছোটবেলার ভালো লাগা। আমরা খুব মজা করতাম ওকে নিয়ে। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো মেয়েটার কোনো সারনেম ছিল না। মেয়েটা চুপচাপ, একা একা থাকতো। আমার আর ওর রোল আগেপিছে ছিল। সব পরীক্ষায় আমাদের আগেপিছে সিট পড়তো। তাই আমার সাথে সায়ন্তনির আলাদা ভাব ছিল। ইভান, আরাফ, আহনাফ, তাহমিদ ওদের রোল সামনের দিকে ছিল। তূর্যও মিডিয়ামে ছিল। আমি ছিলাম ব্যাকবেঞ্চার। যাই হোক, আসল কথায় আসি। ক্লাস নাইনে আমি আর সায়ন্তনি কমার্স নিয়ে ফেলি। আমাদের রেজাল্ট ভালো হয় নি। তখন সবাই সায়েন্সে। শুধু আমাদের সেকশনের আমি আর সায়ন্তনি ছিলাম কমার্সে। তাই আমাদের মধ্যে ভাব আরো বেড়ে যায়। আমি জানতাম আরাফ সায়ন্তনিকে পছন্দ করে। কিন্তু কখনো সায়ন্তনিকে এই কথা জানাই নি। এরপর আমরা একই কলেজে ভর্তি হই। আরাফও ওই কলেজে ছিল। তখনও মেয়েটাকে আরাফ কিছুই জানায় নি। একদিন হুট করে সায়ন্তনি আমাকে ওর মনের কথা জানিয়ে বসে। ও আমাকে ভালোবাসতো। অথচ আমি ওকে জাস্ট ভালো ফ্রেন্ড ভেবেছি। আমি আমার সাইড থেকে না করে দেই। এরপর ইন্টারের পর জানলাম, সায়ন্তনি কোনো ধর্মই মানতো না। ওর বাবা মুসলিম ছিল, কিন্তু মা হিন্দু। যদিও ও ইসলাম শিক্ষা ক্লাস করেছিল আমাদের সাথে। আসলে সায়ন্তনির বাবার পরিবার ওর মাকে মেনে নেয় নি। এজন্য মেয়েটা দাদার পরিবারে অনেক সাফার করেছিল। ক্লাস সিক্সে ওর বাবা মারা যায়। দু’বছর সায়ন্তনি ওর দাদার বাড়িতে ছিল। ওর দাদা-দাদি ওর মায়ের উপর ওর দায়িত্ব দিতে চান নি। কারণ ধর্ম এখানে অনেক বড় একটা বিষয় ছিল। কিন্তু মন থেকেও সায়ন্তনিকে আগলে রাখতে পারে নি তারা। শেষমেশ সায়ন্তনি মায়ের কাছে ফিরে যায়। এরপর আবার সেই দ্বন্ধ। ইসলাম পালন করবে, না-কি হিন্দু ধর্ম। ও আমার ধর্মে আসতে চেয়েছিল। ও চেয়েছিল আমি ওকে হ্যাঁ বলি, ও বাসায় আমার কথা বলে আমাদের ধর্মে আসবে। কিন্তু আমি যখন না করে দেই, ও হিন্দুধর্মে চলে যায়। কারণ ওর মা সেটাই চাইতো। এরপর ওর বিয়ে হয়ে যায় এক হিন্দু পরিবারে।”

“তাহলে আরাফ!”

“আরাফ সায়ন্তনিকে ভালোবাসে, এটা কেউ জানতো না। আমাদের মধ্যেই ছিল কথাটা। এটা সম্ভবও না। মেয়েটা এখন বিবাহিত, অন্য ধর্মের।”

“কিন্তু উনি তো এখনো ভালোবাসে সায়ন্তনিকে!”

“ভালোবাসে। ভালোবাসা কোনো সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ থাকে না। ভালোবাসা সব সীমা ছাড়িয়ে যায়।”

“সায়ন্তনি কি আপনাকে এখনো ভালোবাসে?”

“আমি ওকে দেখি নি আর। আমি জানি না।”

“একটা মানুষ কি একসাথে দু’জনকে ভালোবাসতে পারে?”

“না।”

“উনি তো আমাকেও ভালোবাসেন। তাহলে কি সায়ন্তনি…”

ইমন রুহানিকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আরাফ তোমাকে ভালোবাসে না।”

রুহানি থমকে গেল। ইমন ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “আমি তোমাকে আঘাত করে কিছু বলতে চাই না। কিন্তু আমার কাছে তোমার চেয়ে আমার বন্ধু অনেক বেশি ইম্পোরট্যান্ট। আরাফ কিন্তু তোমার সাথে সুখে নেই। ওর সব সুখের সমাপ্তি এই বিয়েতেই হয়েছে।”

রুহানির বুক ঢিপঢিপ করছে। গলায় কথা আটকে যাচ্ছে। সে রেলিঙ শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বলল, “কি উল্টাপাল্টা বলছেন!”

“তোমার কি মনে হয়, আরাফ তোমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে?”

রুহানি এক দৃষ্টিতে ইমনের দিকে তাকিয়ে রইল। ইমন বলল, “না, রুহানি। তোমার সাথে যা হয়েছে, এরপর তুমি যেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজেকে ভেতরে ভেতরে শেষ করে দিচ্ছিলে, এর ভয়ংকর পরিণতি দেখেই আরাফ তোমাকে বিয়ে করেছে। তোমার সাথে সেই এক্সিডেন্টটা হওয়ার পর তুমি অনেক ভেঙে পড়েছিল। আশেপাশে অনেকে অনেক কথা বলছিল। যেদিন আরাফ তোমাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়, তার আগের দিন আরাফ একটা অটোপসি দেখেছিল। মেয়েটা সুইসাইড করেছিল। রেইপ কেইস। তোমার সাথে এমন কিছু হোক, আরাফ চায় নি। তাই ও নিজেই তোমাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়।”

রুহানির হাত-পা অসার হয়ে গেল ইমনের কথা শুনে। ইমন পুনরায় বলল, “ও তোমার জন্য অনেক বড় স্যাক্রিফাইস করেছে, রুহানি। তোমার বাবার সাথে আরাফের বাবার ব্যক্তিগত সমস্যা আছে। তুমি হয়তো খেয়াল করেছো, এই বাসার কেউই তোমার সাথে খুব একটা কথা বলে না।”

“এমনটা কেন?”

“তোমার মামা, মিস্টার কলিমউদ্দিন, রাইট?”

“হ্যাঁ।”

“উনি একটা জঘন্য কাজ করেছিল। আর সেই জঘন্য কাজকে তোমার বাবা সাপোর্ট করেছে। এজন্যই তোমার বাবাকে কেউ পছন্দ করে না। আরাফের মা সুইসাইড করেছিলেন। আর কলিমউদ্দিন এর জন্য দায়ী। আর তোমার বাবা তাকে বাঁচিয়ে বাইরের দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে।”

“কি করেছে, মামা?”

“বেয়াদবি করেছে তোমার মামা!”

“মানে?”

“আরেহ বোকা মেয়ে, তোমার সাথে যা হয়েছে, তাই করতে চেয়েছিল। তবে খারাপ কিছু হয় নি। তবুও সেই অপমান থেকেই আন্টি সুইসাইড করে ফেলেছিলেন। আর তোমার বাবা স্বজনপ্রীতি দেখিয়ে কলিমউদ্দিনকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে। এজন্যই কেউ তোমার বাবাকে পছন্দ করে না। নীহারিকা আন্টিও খুব সাফার করেছিলেন তোমার বাবার জন্য। অরুণিকাকেও সবাই খারাপ ভাবতে দ্বিধা করে নি। সহজেই আহনাফের কথা বিশ্বাস করে ফেলেছিল। তবে আরাফ তোমাকে বিয়ে করেছে, কারণ ও তোমাকে ওর মায়ের জায়গায় দেখতে চায় নি।”

রুহানির চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। সে দ্রুত চোখ মুছে বলল, “আমি এতোদিন ভাবতাম, আমার সাথে এতো খারাপ কেন হয়েছে? আজ উত্তর পেয়ে গেছি। হয়তো বাবা একটা অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়েছিল বলেই আমি এই শাস্তি পেয়েছি। আল্লাহ ঠিকই বিচার করেছেন। আমার বাবার পাপের প্রায়শ্চিত্ত আমি করছি। মাঝখানে আরাফ আমাকে না চাইতেও সহ্য করে যাচ্ছে। থ্যাংক ইউ, ভাইয়া। সত্যটা আমাকে জানানোর জন্য। আমি হয়তো উনাকে এই সম্পর্কে জোর করে বাঁধতে চাইছি। আমি তো উনাকে বুঝতেই পারি নি।”

রুহানি নিজের মাথায় নিজেই গাট্টা মেরে হাসলো। বলল, “আমি ভেবেছি, উনি আমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছেন। এখন তো মনে হচ্ছে আমার ছায়াটাও উনার অনুগ্রহে টিকে আছে।”

“এভাবে বলছো কেন? এখানে তোমার কোনো দোষ নেই।”

“আমার দোষ আছে। আমি শাহবাজ খানের মেয়ে এটাই আমার অপরাধ।”

এই বলে রুহানি ছাদ থেকে নেমে পড়লো। তার কেমন অনুভূতিহীন মনে হচ্ছে নিজেকে। নিজের উপর ঘৃণা জন্মাচ্ছে তার৷ পাপ না করেও অন্য কারো পাপের শাস্তি ভোগ করছে সে। রুহানি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো, তার সাথে যা হয়েছে সে তার বাবা-মাকে জানিয়ে দেবে। সে একা একা কেন দগ্ধ হবে? তার বাবাকেও জানতে হবে, কারো পাপ ঢাকার শাস্তি কতোটা ভয়ংকর হয়।

(***)

শিরিন সুলতানা ও আমির চৌধুরীর তালাকের কার্যবিধি শেষ হয়েছে আজ। শিরিন সুলতানা তবুও হাসছেন। তিনি আমির চৌধুরীর সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, “ডিয়ার এক্স হাসবেন্ড, আমাদের তো ডিভোর্স হয়ে গেছে। সাথে তোমার ছেলেও ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিয়েছে তোমার ভাইয়ের মেয়েকে।”

আমির চৌধুরী কিছু না বলে চলে গেলেন। শিরিন সুলতানা রাস্তায় গাড়ির জন্য দাঁড়ালেন। হঠাৎ তার সামনে একটা সিএনজি থামলো। তিনি বাসা অব্ধি ভাড়া করে সিএনজিতে উঠে পড়লেন। ড্রাইভার আঁড়চোখে তাকে দেখছে। কিছুদূর যেতেই ড্রাইভার অন্য রাস্তা ধরলো। শিরিন সুলতানা চেঁচিয়ে বললেন, “এই কোথায় যাচ্ছেন আপনি? এদিকে তো যায় না।”

পরক্ষণেই সিএনজি থেমে গেল। মাঝ রাস্তা থেকে তিনজন মুখোশ পরা আগন্তুক সিএনজিতে উঠে বসলো। শিরিন সুলতানা তাদের দেখে চেঁচাতে লাগলেন। কিন্তু হঠাৎ তার মাথা ভারী হয়ে এলো। চোখ-মুখ অন্ধকার হয়ে আসছে তার। পরমুহূর্তেই মাথাটা হেলিয়ে দিলেন তিনি।

(***)

অরুণিকার সামনে শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছে ইমান। তার হাতে একটি ব্যাগ। অরুণিকা ব্যাগটির দিকে তাকিয়ে রইল। সে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ইমান বলল, “সরি, ণিকা। আই এম রিয়েলি ভেরি সরি। আমি তোমাকে নিজের অজান্তেই আঘাত দিয়ে ফেলেছি। যাওয়ার আগে তোমাকে সরি বলে যাওয়াটা খুব দরকার।”

অরুণিকা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “কোথায় যাচ্ছেন?”

“বাসা ছেড়ে দিচ্ছি আমরা। তবে ভার্সিটিতে দেখা হবে আমাদের।”

মাথা নিচু করে নিলো ইমান। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অরুণিকার দিকে তাকালো। বলল, “যাওয়ার আগে আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই।”

অরুণিকা অন্যদিকে ফিরে বলল, “হুম।”

“আমি তোমাকে মিথ্যে বলেছি।”

অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে তাকালো ইমানের দিকে। ইমান পুনরায় বলল, “আমি সেই হিমালয় না, যাকে তুমি ভালোবাসো।”

অরুণিকা স্তব্ধ হয়ে ইমানের দিকে তাকিয়ে রইল। ইমান ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “আমার খুব গিল্ট হচ্ছে, ণিকা। তোমার অনুভূতি নিয়ে তামাশা করেছি আমি। আমাকে ক্ষমা করে দিও। কিন্তু আমি যা করেছি, তোমাকে ভালোবাসি বলেই করেছি। তোমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য করি নি। তোমাকে অ
পাওয়ার জন্য করেছি। আমি ভেবেছি, তুমি আমার হবে। হিমালয় তো কখনো নিজের পরিচয় দেবে না। সেই সুযোগটা না হয় আমিই নিয়ে নিলাম।”

অরুণিকা শক্ত কন্ঠে বলল, “আর এটা আপনি কীভাবে ভাবলেন যে আপনি হিমালয় হলে আমি আপনাকে মেনে নেবো?”

“আসলে রুদবা আমাকে বলেছিল তোমাকে মিথ্যে কথাটা বলতে। ও হিমালয়ের চিঠি পড়েছিল। একদিন না-কি তোমার বাসায় ছিল তোমার সাথে?”

“হ্যাঁ। মাতাল হয়ে এসেছিল।”

ইমান ভ্রূ কুঁচকে তাকালো অরুণিকার দিকে। পরক্ষণেই বলল, “ওদিন তুমি ঘুমানোর পর তোমার ফোনে হিমালয়ের চ্যাট পড়ে স্ক্রিনশট নিয়ে ও নিজের ইনবক্সে পাঠিয়েছিল। পরে ও আমাকে সব সেন্ড করেছিল। তাই আমি জানতাম, তোমার আর হিমালয়ের মধ্যে কি কি কথা হয়েছে।”

অরুণিকা ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “এসব করে কি লাভটা হয়েছে একটু বলবেন?”

ইমান চুপ করে রইল। মিনিট খানিক পর বলল, “সরি। আমি তোমাকে সরি বললেও কম হবে। যাই হোক, আমি আর কখনো তোমাকে বিরক্ত করবো না।”

এই বলে ইমান বেরিয়ে পড়লো গেট দিয়ে। সেই প্রথম দেখায় অরুণিকার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল সে। তার ধূসর চোখ জোড়া আঁটকা পড়েছিল অরুণিকাতে। গলায় চেইন, হাতে বেল্ট পরে আসতো সে ক্যাম্পাসে। অরুণিকা প্রথম দেখায় কেমন তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল তার দিকে। ব্যস, ইমান নিজেকে পরিবর্তন করে ফেললো। কিন্তু এতো পরিবর্তন করেও সে শূন্য হাতেই ফিরেছে। আসলে ভালোবাসা যার কপালে থাকে, তারা সেই ভালোবাসা পেয়েও হারায়। আর যার কপালে নেই, সে শত চেষ্টা করেও পায় না।

এদিকে ইমান চলে যেতেই অরুণিকা মুখে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে রইল। সে মনে মনে ভাবছে, “তাহলে তো আমার সন্দেহ মিথ্যে ছিল না। হয়তো আমি ঠিকই ধরেছি। আহনাফই হিমালয়।”

চলবে-

#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-৫৬ (২য় ভাগ)||

রুদবার ফোনের স্ক্রিনে একটি ছেলের বায়োডাটা। ছেলের নাম নাহিদ ইকবাল। উচ্চতা পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি। পড়াশুনা ঢাকার একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বাবার ব্যবসা দেখাশুনা করছে সে। যথেষ্ট সুদর্শন দেখতে। চট্টগ্রামে বেশ কয়েকটা ফ্ল্যাট আছে তাদের। ছেলের বাবা বেশ নামকরা ব্যবসায়ী। নাম আসিফ ইকবাল। রুদবা ফোন বিছানায় ছুঁড়ে মেরে বলল, “আমি বিয়ে করবো না।”

রুদবার মা রাগী দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এতো ভালো প্রস্তাব ভেস্তে দেবো? কখনো না। শিল্পপতি ঘরের বউ হওয়া চাট্টিখানি কথা না।”

“আমি তূর্যকে ভালোবাসি, মা।”

মেয়ের গালে সজোড়ে চড় বসিয়ে দিলেন মিসেস খাদিজা। রুদবা অশ্রুসিক্ত চোখে মায়ের দিকে তাকালো। মিসেস খাদিজা বললেন, “স্টেজে উঠে গান গাওয়া ছেলেকে আমরা মেয়ে দেবো? কখনো না। তোর বড় আব্বা এই প্রস্তাব এনেছে। তোর বাবা কখনো উনাকে ফিরিয়ে দেবেন না। তুই জানিস না, তোর বাবা কেমন অন্ধভক্ত তোর বড় আব্বার? ভালোই ভালোই রাজি হয়ে যা। তোর বাবা তূর্য আর তোর ব্যাপারে সব জেনে গেছে। পাশের বিল্ডিং থেকে কেউ তো তোর প্রেমলীলা দেখে ফেলেছে। তারপর তোর বাবাকে জানিয়েছে। অনেক আগেই তোর বাবা এসব জেনে গিয়েছিল। কিন্তু ভালো প্রস্তাবের অপেক্ষায় ছিল। এখন ভালো প্রস্তাব এসেছে, ব্যস এটাই আমাদের শেষ সিদ্ধান্ত।”

রুদবা হাতজোড় করে মায়ের সামনে বসে বলল, “প্লিজ, মা। আমি অন্য কাউকে বিয়ে করবো না।”

বাইরে থেকে আমানুল্লাহ ইসলাম চেঁচিয়ে বললেন, “তোমার মেয়েকে বলে দাও, বিয়েতে রাজী না হলে ওই ছেলের সাথে চলে যেতে। আমার ঘরের দরজা খোলা আছে। হয় আজই রাজী হবে। নয়তো এখুনি বাসা থেকে বেরিয়ে যাবে।”

রুদবা বাবার কথা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। তার সামনে এই বিয়েতে হ্যাঁ বলা ছাড়া আর কোনো পথই খোলা নেই। তূর্য তো তাকে ভালোই বাসে না। সে ভেবেছিল, আবার তূর্যের মন জয় করে নেবে। কিন্তু তার বাবা-মা তো সেই সময়টাও তাকে দিচ্ছে না। এখন তো তূর্যের ভরসায় বাসা ছেড়ে যাওয়ারও উপায় নেই। রুদবার নীরব আর্তনাদ চার দেয়ালেই আটকা পড়ে গেল। হাতজোড় করে কাঁদতে লাগলো সে। সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজের পাপের জন্য ক্ষমা চাইতে লাগলো। কিন্তু সময়টা এখন প্রায়শ্চিত্তের। শেষমেশ বাধ্য হয়ে রাজী হতেই হলো রুদবাকে।

(***)

কলিংবেলের শব্দ শুনে দরজা খুললো অরুণিকা। দরজার ওপাড়ে রুদবাকে দেখে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো সে। রুদবা মাথা নিচু করে বলল, “অরু, তোর সাথে আমার কিছু কথা ছিল।”

অরুণিকা রাগী স্বরে বলল, “আমার অনুভূতির তামাশা বানিয়ে এখন তুই কথা বলতে এসেছিস?”

রুদবা চমকে তাকালো অরুণিকার দিকে। অরুণিকা বলল, “ইমান আমাকে সব বলেছে। তুই হিমালয়ের চিঠি পড়ে সব উনাকে বলেছিস। আবার আমার ফোন থেকে চ্যাট চুরি করেছিস। ছি!”

“এতোটুকুই জানলি?”

“কেন? আরো কিছু করেছিস না-কি?”

“আহনাফ স্যারকে ভুল বুঝেছিস তুই।”

অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। রুদবা অরুণিকার হাত ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো, “সরি, আই এম রিয়েলি সরি। আমি জয়িতা আপুর কথায় তোর আর আহনাফ স্যারের সম্পর্কে ঝামেলা করেছি। আহনাফ স্যার তোকে অনেক ভালোবাসে। আমি দু’জন ভালোবাসার মানুষকে আলাদা করেছি। জয়িতা আপুর কথায় সেদিন আমিই তোর হোটেল রুমের চাবি নিয়ে ক্যামেরা সেট করেছিলাম। তূর্যের ফোন থেকে জয়িতা আপুর কথামতো আহনাফ স্যারের ফোনে মেসেজ পাঠিয়েছিলাম। আহনাফ স্যার তোকে ড্রাগস দেন নি৷ জয়িতা আপু ইচ্ছে করে ড্রিংক্স পার্টির আয়োজন করেছে। উনি জানতো আহনাফ স্যার তোর জন্য গ্লাস নিয়ে যাবে। আর তুই মনে করবি সব স্যারের প্ল্যান। পিকনিকে যাওয়ার আগে ইমান ভাইয়া তোকে প্রপোজ করেছিল। আমিই তাই আমার সেকশনের মেয়েদের বলেছি, তোর সাথে কথা না বলতে। যাতে তুই কারো পাত্তা না পেয়ে ইমান ভাইয়ার সাথে কথা বলিস। সরি, অরু। আহনাফ স্যার তো সেদিন আমাকে বলেছিল, তোকে রুমে নিয়ে যেতে। কিন্তু আমিই যাই নি। আহনাফ স্যার আর তোর ভিডিও বানিয়েছিল জয়িতা আপু। স্যার হয়তো এজন্যই তোকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়েছেন। উনার প্ল্যান এটাই ছিল। উনি ভিডিও ভাইরাল করবে বলে ব্ল্যাকমেইল করার জন্যই তো ভিডিওটা বানিয়েছিল।”

রুদবা অরুণিকার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল, “আমি তূর্যকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি। তুই আমাকে এতো বারণ করার পরও আমি তোকে বিশ্বাস করি নি। আমি শুধু উনাকে বিশ্বাস করেছি। আর উনি আমাকে চরম ভাবে ঠকিয়েছেন। আল্লাহ আমাকে কেমন কষ্ট দিচ্ছে, অরু। আমার বুকটা ফেঁটে যাচ্ছে। আমি যে মানুষটাকে খুব করে চাই।”

অরুণিকার চোখে অশ্রু ভীড় করলো। নিজের হাতের দিকে তাকালো সে। এই হাতেই আহনাফের গালে চড় মেরেছিল সে। আহনাফের শুকনো মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠতেই কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার। রুদবার দিকে ঘৃণার চোখে তাকালো অরুণিকা। টেনে উঠালো তাকে। দাঁতে দাঁত পিষে বলল, “আই হেইট ইউ। আমি দোয়া করবো তোর জীবনে ঠিক একই অবস্থা হোক। তোর সংসার হোক, কিন্তু সেই সংসারে শান্তি না থাকুক। আমার জীবনে একটু শান্তির আলো এসেছিল, তুই সেটাও নিভিয়ে দিলি? তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড! নো, তোর মতো মেয়ে বেস্ট না এনিমি হয়। আমার ফ্রেন্ডশিপ থেকে বিশ্বাস উঠে গেছে আজ। তূর্য তোর জীবনে ক’দিনের মানুষ ছিল? আহনাফের সাথে আমার সম্পর্ক জন্মের পর থেকে। তুই তোর দু’দিনের প্রেমের মোহে আমার অনেক বছরের সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছিস। তোকে আমি কখনো ক্ষমা করবো না।”

রুদবার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিল অরুণিকা। এদিকে রুদবা এখনো ফুঁপিয়ে কাঁদছে। নিজেকে নিকৃষ্ট মনে হচ্ছে তার। কীভাবে করবে সে এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত?

(***)

ছাদের এক কোণে চোখ বুজে চুপচাপ বসে আছে আহনাফ। কাঁধে কারো স্পর্শ পেতেই চোখ খুলে দেখলো তূর্য তার সামনে এসে বসেছে। তার হাতে গিটার। আহনাফ সৌজন্যমূলক হাসি ফেরত দিল। বাকিরাও ছাদে উঠেছে। তারা আহনাফকে ঘিরে বসলো। তূর্য জিজ্ঞেস করলো, “আমাকে কি এখনো ভুল বুঝছিস?”

আহনাফ শুকনো হেসে বলল, “তোর তো এখানে কোনো দোষ নেই। সব তো জয়িতা আর রুদবা করেছে।”

“রুদবা আমার কারণেই তো এতো সাহস পেয়েছে।”

“থাক, যা হওয়ার হয়ে গেছে। এসব আর মনে রাখতে চাই না আমি।”

তাহমিদ বলল, “আজ সেকেন্ড লেটার পাঠিয়েছিস শুনলাম।”

আহনাফ চুপ করে রইল। আরাফ বলল, “সমস্যার সমাধান করা যায়, আহু। যা হয়েছে…”

আহনাফ আরাফকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “অরু কখনো আমাকে ভালোবাসে নি। ও আমাকে নিজের যোগ্যই মনে করে না। আমার সবচেয়ে বড় উইক পয়েন্ট আমার জন্ম পরিচয়। আমি না ওটা পরিবর্তন করতে পারবো, না পারবো ওর যোগ্য হতে। আমি তো শুধু শুধু ওকে আটকে রেখেছি এই সম্পর্কে।”

ইভান বলল, “একবার ডিভোর্স হয়ে গেলে, সম্পর্কটা চাইলেও আর জোড়া লাগানো সম্ভব না।”

ইমন বলল, “হ্যাঁ, কাল মা আর বাবা তোদের ব্যাপারে আলাপ করছিল। শুনলাম তখন না-কি অনেক কাহিনী করা লাগে। ওটাও না-কি সঠিক না। গুনাহ বেশি হয় তখন৷ হারাম হয়ে গেলে, ভালোবাসতেও বাঁধা আসবে। তার চেয়ে আলাদা থাক, এট লিস্ট সময় দে নিজেদের।”

আহনাফ ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “আমি অরুর ভবিষ্যৎ থামিয়ে রেখেছি। আমি ওকে মুক্তি দেবো। ও যদি আমাকে ভালোবাসতো, আমি না হয় ভেবে দেখতাম। ও তো ভালোইবাসে না। ইমানকে ওর যোগ্য মনে করছে।”

তাহমিদ বলল, “তোরা কি শুরু করলি?”

আহনাফ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি মানুষ তো। আমিও আঘাত পাই। ওর কথা আমাকে ভেতর থেকে মেরে ফেলেছে। আমি তাই আমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে চাই না।”

আহনাফ এই বলে ছাদ থেকে নেমে পড়লো। বাকিরা চুপচাপ বসে আছে। তূর্য এরইমধ্যে গিটারে সুর তুললো। নীরবতার মাঝে তূর্যের গিটারের সুর বিষন্নতা ছড়িয়ে দিয়েছে। ইভান আর ইমন একবার একবার তাকালো তূর্য, তাহমিদ আর আরাফের দিকে। এরপর দু’জন উঠে দাঁড়ালো। ইমন বলল, “তোরা বিরহে মর, আর আমরা তোদের অশ্রু দিয়ে গোসল করি।”

ইভান বলল, “এলার্জি হবে। চুলকানি হবে আমাদের। চল যাই গা। এসব কাহিনী দেখার চেয়ে ঘুমানো ভালো।”

তূর্য গিটার পাশে রেখে বলল, “যেদিন তোর জীবনে ঝড় উঠবে, দেখিস আমরা সবাই হাসবো।”

ইভান চোখ ছোট করে তাকালো তূর্যের দিকে। ইমন বলল, “আমাকে বদদোয়া দিস না। আমি এসব ঝামেলায় জড়াতে চাই না। সোজা বাবা-মার পছন্দে বিয়ে করে লাইফ সেট করবো। প্যারা-ট্যারা নাই আর।”

(***)

আজ নতুন বাসায় উঠেছে শাহবাজ খান ও আতকিয়া জাহান। অরুণিকা নিজের ঘর পরিষ্কার করছে। অনেকক্ষণ হলো দরজায় কেউ কড়া নাড়ছে। কিন্তু কারো কান অব্ধি যাচ্ছে না সেই আওয়াজ। যদিও এখনো বেল বসানো হয় নি।

এবার কড়া নাড়ার শব্দ আরো ভারী হলো। শব্দ শুনে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ছুটে এলেন আতকিয়া জাহান। দরজা খুলতেই রুহানিকে দেখে তার মুখে হাসি ফুটলো। জড়িয়ে ধরার জন্য এগিয়ে এলেন তিনি। রুহানি মায়ের সামনে হাত থামিয়ে বলল, “ছুঁবে না আমাকে। পঁচা গন্ধ আসছে আমার শরীর থেকে।”

আতকিয়া জাহান অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন। রুহানি ভাবলেশহীন মুখে ঘরে ঢুকলো। শাহবাজ খান ঘর গোছাতে স্ত্রীকে সাহায্য করছিলেন। তিনি মেয়েকে দেখে এগিয়ে এলেন। রুহানি মলিন মুখে বাবার দিকে তাকিয়ে রইল। শাহবাজ খান ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, “কি হলো, রুহু?”

রুহানি ক্ষীণ গলায় বলল, “তুমি কি কখনো শুনেছো, যদি কেউ পাপ করে তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত যতোক্ষণ সে নিজে না করে, সেই পাপের ভার নামে না?”

“মানে?”

“মানে? পরের প্রজন্ম সেই পাপের বোঝা বয়ে নিয়ে যায়। যেমন আজ তোমার পাপ আমি বইছি!”

আতকিয়া জাহান মেয়ের বাহু চেপে ধরে বললেন, “মাথা ঠিক আছে তোর?”

রুহানি ক্ষীণ হেসে বলল, “মাথা তো ঠিক নেই। আমার মাথা যে বিগড়েছে, এখন আর ঠিক হবে না।”

শাহবাজ খান বিরক্তমুখে বললেন, “মশকরা করার সময় নেই এখন। অনেক কাজ আছে।”

“আমার জীবনটা যে অন্ধকার করে দিয়েছো, তার সমাধান করে তারপর কাজে নেমো।”

“আমি কি করেছি?”

“কলিমউদ্দিনকে বাঁচিয়ে আমাকে মেরে ফেলেছো তুমি।”

শাহবাজ খান ও আতকিয়া জাহান অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। রুহানি অপহরণের পর তার সাথে কি কি ঘটেছে সব বাবা-মাকে জানালো। আতকিয়া জাহান সব শুনে ধপ করে সোফায় বসে পড়লেন। শাহবাজ খান স্থির দৃষ্টিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলেন। রুহানি ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “আরাফের মায়ের সাথে তোমার কি সমস্যা ছিল বাবা? কলিম মামা উনার সাথে খারাপ কিছু করতে চেয়েছিল, আর তুমি তাকে প্রশ্রয় দিলে? আজ মামা বাইরের দেশে সেটেল্ড। বউ বাচ্চা নিয়ে সুখেই আছে। কিন্তু অপমানিত হয়েছে আরাফের মা। নিজের শ্বশুর বাড়িতে মুখ দেখানোর সাহস টুকুও উনার ছিল না। তাই সুইসাইড করে ফেলেছেন। তুমি তো দম্ভের সাথে চলছো। আজ তোমার শ্যালক প্রীতি তোমার উপরই ভারী পড়েছে। অন্যায়ের প্রশ্রয় দিয়েছো বলেই আজ আরাফের মায়ের অভিশাপে তোমার মেয়েও সেই ট্যাগ পেয়েছে। তুমি কোন মুখে আরাফের সামনে দাঁড়াবে, বাবা? তোমার মেয়েকে তো বিয়ে করে বাঁচিয়েছে ও! তুমি আমাকে এমন পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছো, আমি কোন মুখে মানুষটার সামনে গিয়ে দাঁড়াবো। আমার বাবা তো তার মায়ের অপরাধী!”

শাহবাজ খান শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি মেয়ের দিকে তাকাতে পারছেন না। রুহানি উত্তর না পেয়ে ভেতরে চলে গেল। এদিকে আতকিয়া জাহান ভেজা দৃষ্টিতে শাহবাজ খানের দিকে তাকালেন। শাহবাজ খান ক্ষীণ কন্ঠে বললেন, “আল্লাহ বিচার করে ফেলেছে, আতকিয়া। আমাদের পাপের শাস্তি আমাদের মেয়েকেই দিয়েছে।”

আতকিয়া জাহান বুক চেপে ধরে কাঁদছেন। এই হাহাকার তাদের মনেই আটকা পড়ে গেছে। বিবাহিত কন্যার জীবনের ভয়ংকর সত্য মেনে নিয়ে বেঁচে থাকাটা যে কতোটা যন্ত্রণার, তা একমাত্র শাহবাজ খান ও আতকিয়া জাহানই অনুভব করতে পারছেন।

(***)

অরুণিকার রুমে এসে স্তব্ধ হয়ে গেল রুহানি। মেঝেতে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে অরুণিকা। রুহানি দ্রুত তার কাছে এসে তাকে টেনে তুললো। অরুণিকা অসার হয়ে বসে আছে। রুহানি তার গালে হাত রেখে ব্যস্ত কন্ঠে বলল, “কি হয়েছে, অরু?”

অরুণিকা ভেজা দৃষ্টিতে রুহানির দিকে তাকিয়ে বলল, “আহনাফ আমাকে সেকেন্ড লেটার পাঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমি আগেরটা সাইন করতে পারলেও এটা পারছি না।”

“তো করিস না। তুই বল, তুই ডিভোর্স চাস না।”

“আমি বলবো না।”

রুহানি ভ্রূ কুঁচকে বলল, “না বললে কাঁদছিস কেন?”

অরুণিকা চেঁচিয়ে বলল, “কাঁদতে ইচ্ছে করছে, তাই কাঁদছি।”

“কি অদ্ভুত মেয়ে তুই!”

“আমার জীবনটাই তো অদ্ভুত।”

রুহানি অরুণিকার দু’হাত আলতো করে নিজের হাতে আবদ্ধ করে বলল, “ভালোবাসিস আহনাফ ভাইকে?”

অরুণিকা শূন্য দৃষ্টিতে রুহানির দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি আহনাফকে ভালোবাসতাম। কিন্তু এখন হিমালয়কে ভালোবাসি।”

রুহানি ভ্রূ কুঁচকে বললো, “কি উল্টাপাল্টা বলছিস?”

“আমি হিমালয়কেই ভালোবাসি, রুহু।”

রুহানি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল অরুণিকার দিকে। অরুণিকা রুহানির হাত আঁকড়ে ধরে বলল, “আমার একটা কাজ করবি, রুহু?”

রুহানি ব্যস্ত কন্ঠে বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ বল।”

“চৌধুরী বাড়ি গিয়ে বল, অরুণিকা হিমালয়কে ভালোবাসে৷ আহনাফকে গিয়ে বলতে পারবি এই কথা? ওকে গিয়ে বলিস প্লিজ। বলিস যে হিমালয়কে ভালোবেসে ফেলেছে অরুণিকা। এই ভালোবাসার অধিকারটা হারিয়ে ফেলতে চায় না সে।”

রুহানি ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “আহনাফ ভাইকে এই কথা কেন বলবো আমি? উনি তোকে ভালোবাসে, অরু। এসব শুনলে উনি আরো কষ্ট পাবে।”

“আমার এইটুকু হ্যাল্প কর, রুহু। অনেকদিন ধরে এই কথা মনের ভেতর দাফন করে রেখেছি। আজ সাহস করে বলছি। বলতে দে। সবাইকে জানাতে দে। ওকে বল, আমি ভালোবাসি হিমালয়কে।”

রুহানি তাকে আশ্বস্ত করে বলল, “আমি বলবো।”

অরুণিকা স্বস্তির শ্বাস ফেলে মনে মনে বলল, “তুমি এবার নিশ্চিত এই ডিভোর্স ক্যান্সেল করবে, আহনাফ। তুমি যখন জানতে পারবে আমি দ্বিতীয়বারও সেই তোমারই প্রেমে পড়েছি, তুমি আমাকে ছেড়ে দিতে পারবে না। তুমি আমার কাছে ফিরে আসবে আবার। আমাকে নিজের পরিচয় দেবে। আমি তোমার অপেক্ষায় আছি, আহনাফ। আমি অপেক্ষায় আছি তোমার।”

(***)

জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে অন্ধকার ঘরে আবিষ্কার করে ভয় পেয়ে গেলেন শিরিন সুলতানা। গলা ফাঁটিয়ে চিৎকার করলেন বেশ খানিকক্ষণ। কারো সাড়াশব্দ না পেয়ে থমকে গেলেন তিনি। বাসায় ফেরার জন্য সিএনজি ঠিক করেছিলেন। এরপর মাঝ পথে কয়েকজন আগন্তুক গাড়িতে উঠে বসলো। এরপরই তিনি জ্ঞান হারিয়েছেন। এখন এই অন্ধকার ঘরে নিজেকে আবিষ্কার করলেন। শিরিন সুলতানার শরীর বেশ দুর্বল। তবুও তিনি উঠে দাঁড়ালেন। আশেপাশ হাতড়ালেন। মোটামুটি সাত ফুটের একটি ছোট্ট ঘরে তিনি আবদ্ধ। দেয়াল হাতড়ে বুঝলেন, কোনো জানালা নেই এই ঘরে। পুরোটাই ইটের দেয়াল। তাহলে এই ঘরে ঢুকলেন কীভাবে তিনি? এতোটা অন্ধকার এই ছোট্ট ঘরটিতে যে নিজেকেও দেখতে পারছেন না তিনি। দমবন্ধ হয়ে আসছে শিরিন সুলতানার। ভীষণ গরম ঘরটিতে। মাথা ভারী ভারী লাগছে তার। নিজের শরীর হাতড়ালেন তিনি। পরণে আগের সেই জামা। কিন্তু ঘামে ভিজে গেছে। শিরিন সুলতানা এবার জোরে জোরে শ্বাস ছাড়লেন। ঘাম বেয়ে বেয়ে মেঝেতে পড়ছে। বুকে হাত চেপে মেঝেতে বসে পড়লেন তিনি। ভয়ে আল্লাহকে ডাকতে লাগলেন। প্রায় মিনিট খানিক পর অস্থিরতা কাটাতে না পেরে মেঝে হাতড়াতে লাগলেন। হাতড়াতে হাতড়াতে দেয়াল সামনে পড়তেই থেমে গেলেন। এরপর পিছিয়ে আবার মেঝে হাতড়াতে লাগলেন। এভাবে মিনিট বিশেক কেটে গেল। তিনি এবার মেঝেতে শুয়ে পড়লেন। ঘেমে-নেয়ে একাকার তিনি। এবার পরণের জামাটাও খুলে ফেললেন। ওভাবেই শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করছেন। দমবন্ধ হয়ে আসছে তার। মনে হচ্ছে এখুনি তার প্রাণ চলে যাবে। তিনি অস্ফুটস্বরে বলতে লাগলেন, “আল্লাহ, আমি কোথায় এসেছি। আমাকে বের করো, আল্লাহ। আমি পারছি না আর। আমার জান চলে যাচ্ছে। আমার শ্বাস আঁটকে যাচ্ছে।”

তার অস্ফুট আর্তনাদের কোনো সাড়া এলো না। সাত ফুটের ঘরে আবদ্ধ হয়ে রইল সেই ছটফটানি।

(***)

চোখ ছোট করে সামনের ইট-সিমেন্ট দিয়ে তিন মাসে তৈরী করা সাত ফুটের আবদ্ধ ঘরটির দিকে তাকিয়ে আছে আরাফ, তাহমিদ, তূর্য, ইভান এবং ইমন। গত তিনমাস ধরে এই দিনটির অপেক্ষায় ছিল তারা। আমির চৌধুরীর সাথে শিরিন সুলতানার ডিভোর্সের অপেক্ষা। নিজ হাতে এই আবদ্ধ ঘর বানিয়েছে তারা। একের পর এক ইট দিয়ে, নিজের হাতে সিমেন্ট লাগিয়ে। সাত ফুট দৈর্ঘ্য, পাঁচ ফুট প্রস্থ, আট ফুট উচ্চতার কি ভয়ংকর জীবন্ত কবরস্থান! অপহরণের পর শিরিন সুলতানাকে উচ্চ মাত্রায় ঘুমের ওষুধ দিয়েছিল আরাফ। সিএনজি ড্রাইভারকে কোর্ট বিল্ডিংয়ের সামনে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিল তূর্য আর ইভান। অপহরণকারী ভাড়া করেছিল ইমন ও তাহমিদ। তারা শিরিন সুলতানাকে পাঁচজনের হাতে দিয়ে চলে যেতেই আরাফ আর তাহমিদ শিরিন সুলতানাকে সেই আবদ্ধ করে রেখে এলো। এরপর পাঁচজন মিলে বাকি খোলা স্থানে ইট বসিয়ে সিমেন্ট লাগিয়ে দিল। এই ইট ভেঙে বের হওয়া শিরিন সুলতানার পক্ষে কখনো সম্ভব না।

আরাফ হাত ঝেড়ে বলল, “এখানে আসা কারো পক্ষেই সম্ভব না। আসলেও ততোদিনে শিরিন সুলতানার নাম মুছে যাবে পৃথিবীর পাতা থেকে।”

ইভান বলল, “এই মহিলা আহনাফকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। আহনাফ এর জন্যই ছটফটিয়ে কেঁদেছে। এবার এই মহিলা ছটফট করতে কর‍তে মরবে। এটাই এর শাস্তি।”

তূর্য বলল, “আবরারের সাথে এবার ন্যায় বিচার হয়েছে। আমির আংকেল, রিয়াজ আংকেল, আহনাফ, টুইংকেল সবার সাথে ন্যায় হয়েছে এবার।”

তাহমিদ বলল, “আইনের চোখে কুফরিকারীদের কোনো শাস্তি নেই। আল্লাহর আইনে এর শাস্তি ভয়ংকর। এই মহিলা বেঁচে থাকলে আহনাফের জীবনে কখনো শান্তি আসবে না। এর মৃত্যুই আমাদের নিশ্চিন্তে বাঁচতে দেবে।”

আরাফ বলল, “আল্লাহ এমন ভয়ংকর মা কাউকে না দিক। আজ সে বুঝবে, কারো জীবন অন্ধকার করতে চাইলে কতোটা অন্ধকার নিজেকে ঘিরে ধরে। যতোক্ষণ মৃত্যুর ফেরেশতা আসবে না, শিরিন সুলতানা ততোক্ষণ মৃত্যুর জন্য ছটফট করবে। আর একবার মরলে, সোজা তার আসল ঠিকানায়। পৃথিবীর আদালতে হয়তো আমরা পাঁচজন আজ থেকে খুনী। কিন্তু মনের আদালতে ইনসাফ করেছি। আমার ভাইকে মুক্তি দিয়েছি। আই হ্যাভ নো রিগ্রেট।”

পাঁচজন নিজেদের মোটর সাইকেলে উঠে বসলো। একনজর আবদ্ধ ঘরটির দিকে তাকিয়ে হেলমেট পরলো। মিনিট খানিকের মধ্যেই বেরিয়ে পড়লো একটি জঙ্গল থেকে। তাদের চোখ জোড়া আজ উজ্জ্বল হয়ে আছে। ওদিকে যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলেন এক নিকৃষ্ট জীব। যে তার একটি মাত্র জীবনেই নারী, মা, স্ত্রী, বউ, মানুষ এমনকি বান্দা হিসেবেও ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছেন।

(***)

দু’দিন পর ছ’জন একত্রে ছাদে বসলো। তাদের কথোপকথনের মাঝে রুহানি এলো। আরাফ রুহানিকে দেখে চুপ হয়ে গেল। এই কয়েকদিন বেশ চুপচাপ ছিল রুহানি। কিছুদিনের জন্য বাবার বাড়িতে গিয়েছিল থাকতে। তিনদিন থেকেই চলে এসেছে আজ। আরাফ ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “কিছু বলবে?”

রুহানি ছ’জনের সামনে এসে দাঁড়ালো। সবাই এবার রুহানির দিকে তাকালো। তূর্য বলল, “কিছু হয়েছে?”

রুহানি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “অরুর সাথে কথা হয়েছিল আমার।”

অরুর নাম শুনে চমকে রুহানির দিকে তাকালো আহনাফ। রুহানি আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলল, “আসলে ও আমাকে একটা কথা বলেছে, যেটা জানানো উচিত।”

ইভান বলল, “কি!”

রুহানি আরাফের দিকে তাকিয়ে বলল, “অরু ইমানকে ভালোবাসে না। ও হিমালয়কে ভালোবাসে। লেখক হিমালয়কে। ইমান এতোদিন হিমালয় সেজে অভিনয় করেছিল। রুদবাই না-কি এসব করতে বলেছিল। কিন্তু অরু ইমানকে কখনোই ভালোবাসে নি। ও হিমালয়কেই ভালোবাসে।”

আহনাফ চোখ নামিয়ে মেঝেতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। বাকি পাঁচজন আহনাফের দিকে তাকিয়ে রইল। রুহানি পুনরায় বলল, “অরুর দ্বিতীয় ভালোবাসা হিমালয়। ও আমাকে বলেছিল, কথাটা আহনাফ ভাইকে জানাতে।”

আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে তাকালো রুহানির দিকে। আরাফ আহনাফের কাঁধে হাত রেখে বলল, “তুই.. ”

আহনাফ আরাফকে থামিয়ে দিয়ে উঠে চলে গেল। রুহানি মলিন মুখে বলল, “আমি ভাইয়াকে কষ্ট দিতে চাই নি। এমনিতেই ডিভোর্স লেটার পাঠিয়েছেন উনি। কিন্তু অরু আমাকে জোর দিয়ে বলেছে এটা ভাইয়াকে জানাতে।”

তাহমিদ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তাহলে অরু কি জানে হিমালয় কে?”

এদিকে আহনাফ ঘরে ঢুকে মেঝেতে বসে পড়লো। বুকে হাত চেপে ধরলো। ভীষণ হাত কাঁপছে তার। হঠাৎ চার দেয়াল থেকে ভেসে আসতে লাগলো অরুণিকার ঝাঁঝালো স্বর।

“তুমি হিমালয় হওয়ার যোগ্য না। তোমার মা যেমন, তুমিও তেমন।”

আহনাফের চোখ ভিজে উঠলো। ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “তুই যদি কখনো জানতে পারিস, হিমালয় কে, তখন কীভাবে ভালোবাসবি তাকে? তুই আবার ঠকে যাবি, অরু। আমি তোকে আবার ঠকাতে পারবো না। আমি আবার তোর মন ভাঙতে চাই না।”

(***)

পুরো এলাকায় মরিচ বাতি জ্বলছে। কিন্তু বিয়ের কনে নিঁখোজ। পুরো বাড়িতে উত্তেজনা বিরাজ করছে। অস্থিরতা ফুটে উঠেছে রুদবার বাবা-মার চোখেমুখে। এদিকে তূর্যের অফিসের সামনে বধূ বেশে দাঁড়িয়ে আছে রুদবা। তার চোখ ভর্তি জল। দু’হাত জোড় করে সে আকুল গলায় তূর্যকে বলল, “আমি আপনাকে না পাওয়ার যন্ত্রণা সহ্য কর‍তে পারছি না। আমার কি যে কষ্ট হচ্ছে, তূর্য। আমাকে একবার ক্ষমা করে, আমার হাতটা ধরুন। আপনি যদি অন্য কাউকে ভালোবাসেন, আমার কোনো সমস্যা নেই। আমি সব মেনে নেবো। আমাকে অন্তত আপনার স্ত্রীর অধিকারটা দেবেন প্লিজ।”

উপমা তূর্যের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। রুদবার আকুল আবেদন শুনে তার চোখে জল ভীড় করতে লাগলো। তূর্য এবারও খালি হাতে ফিরিয়ে দিল রুদবাকে। রুদবা বলল, “আমার বিয়ে এ দেশের সনামধন্য ব্যবসায়ীর পুত্রের সাথে হচ্ছে। আমি যদি অনেক ক্ষমতা পাই, আপনাকে ছিনিয়ে নেবো। শখের মানুষকে কেঁড়ে নেওয়ার মধ্যেও শান্তি আছে।”

উপমা আর রুদবার চোখাচোখি হলো। রুদবা চোখ মুছে বলল, “আমি খুব শীঘ্রই মিস্টার আসিফ ইকবালের পুত্রবধূ হতে যাচ্ছি। এরপর কিন্তু আমার ক্ষমতার কাছে তূর্য শেখের প্রভাবও ঠিকবে না।”

আসিফ ইকবাল নামটা শুনেই চমকে উঠলো উপমা। রুদবা গাড়ি নিয়ে চলে গেল। উপমা ক্ষীণ কন্ঠে তূর্যকে বলল, “আপনার ওকে আটকানো উচিত। মেয়েটা আপনার সাথেই ভালো থাকবে।”

তখনই ম্যানেজারের হাত ধরে তূর্ণা চলে এলো। একটু আগে আইসক্রিমের বায়না ধরেছিল সে। ম্যানেজারকে পাঠিয়ে দিয়েছে আইসক্রিম আনতে। সেও আইসক্রিম ফ্লেভার পছন্দ করবে তাই চলে গেল। তূর্ণাকে দেখেই তূর্য তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল, “তূর্য শেখের ভালো থাকা তার মেয়েতেই সীমাবদ্ধ। আমি খুব ভালোবাসি আমার তূর্ণাকে।”

তূর্ণা তূর্যের গালে চুমু খেয়ে বলল, “আমি বাবাকে অনেক ভালোবাসি।”

উপমার চোখ ভিজে উঠলো। দু’তিনবার মাশাল্লাহ বলে ফেললো সে। তূর্য তূর্ণাকে কোলে নিয়ে উপমার দিকে তাকালো। দু’জনের মনের পথ সমান্তরাল গতিতে চলছে। অথচ আকর্ষণ সেই আগের মতোই। তূর্য উপমার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, “তূর্ণার মাকে ভালোবাসি আমি। সেও যদি আমার মতো করে ভালোবাসতো, আমার কোনো দুঃখই থাকতো না।”

উপমা চোখ বন্ধ করে ভাবলো, “যদি সব বাঁধা কাটিয়ে আগলে রাখতে পারতাম সেই ভালোবাসা, কতোটা ভাগ্যবতী হতাম আমি।”

চলবে-

#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-৫৬ (শেষ ভাগ)|| #অন্তিম_পর্ব

জানালার দ্বারে দাঁড়িয়ে আছে রুহানি। দরজা খোলার শব্দেই কেঁপে উঠলো সে। দ্রুত চোখ মুছে পেছন ফিরে তাকালো। আরাফকে দেখে ভেতরটা হুঁহুঁ করে উঠলো তার। আরাফ নিঃশব্দে ঘরে ঢুকলো। মনোযোগ দিয়ে হাত ঘড়িটা খুলে বেডসাইড টেবিলে রাখলো। চশমাটাও খুলে রাখলো সেখানে। দৃষ্টি নামিয়ে রেখেছে সে। বিছানায় বসে বাতি নিভিয়ে দিল আরাফ। রুহানি এখনো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। আরাফ বাতি নিভিয়ে দিতেই সে বিছানায় এসে বসলো। দু’জন দু’দিক ঘুরে বসে আছে। উভয়ের মুখে কোনো কথা নেই। এসি বাড়িয়ে শুয়ে পড়লো আরাফ। বারান্দার বাতি জ্বালিয়ে দিয়েছিল সে। পর্দা টেনে রাখা, তবুও হালকা আলো রুমে প্রবেশ করছে। সেই আলোয় আরাফকে মনোযোগ দিয়ে দেখছে রুহানি। বেশ কিছুক্ষণ পর আরাফ বলল, “আমি কি ঘুমিয়ে যাবো?”

রুহানি বেশ বুঝলো আরাফের প্রশ্নের মর্মার্থ। সে নিঃশব্দে শুয়ে পড়লো আরাফের পাশে। প্রতি রাতের মতোই আরাফ রুহানির দিকে ফিরলো। দ্বিধা নিয়ে রুহানির হাতে হাত রাখলো। কিন্তু রুহানি আজ চোখ বন্ধ করে সেই স্পর্শ অনুভব করতে চাইছে না। সে চোখ খোলা রেখেছে। আরাফ কাছে ঘেঁষতেই রুহানি শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে। আরাফ থতমত খেয়ে গেল। বেশ খানিকক্ষণ পর রুহানি তাকে ছেড়ে তার কপালে অধর ছোঁয়ালো। আরাফের ইতস্ততভাব বেশ বুঝতে পারলো সে। শুকনো হাসলো রুহানি। আরাফ সেই হাসিটা দেখলো না। সে রুহানির রোজকার আবদার পূরণ করার জন্য প্রস্তুত। আবারও সেই যান্ত্রিক স্পর্শ পাচ্ছে রুহানি, যেই স্পর্শে ভালোবাসা নেই, উষ্ণতা নেই। দ্বিধার অদৃশ্য দেয়াল দাঁড়িয়ে আছে আরাফের সামনে। রুহানি আরাফকে সরিয়ে দিল। হালকা ঝুঁকে বেড সাইড বাতিটি জ্বালিয়ে দিল। রুহানির দিকে তাকালো না আরাফ৷ চোখ সরিয়ে নিল। বেশ আঘাত লাগলো রুহানির মনে। নিজেকে গুছিয়ে আরাফের চোখের চশমাটা টেবিল থেকে নিয়ে যত্নের সাথে উড়না দিয়ে মুছে আরাফের চোখে পরিয়ে দিল। আরাফ এবার তাকালো রুহানির দিকে। আরাফের দু’হাত নিজের হাতে আবদ্ধ করলো সে। আরাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কিছু হয়েছে?”

রুহানি না সূচক মাথা নেড়ে বলল, “আজ কিছু মিনিট গল্প করবো আপনার সাথে। আজই না হয় এই ঘরে আমাদের শেষ গল্প হোক।”

“মানে?”

রুহানি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমার না বিয়ে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। বউ সাজা, ধুমধাম করে বিয়ে করা, বিয়ের পর স্বামীর সাথে ঘুরতে যাওয়া, পাক্কা গিন্নী হওয়া, স্বামীকে মজার মজার রান্না করে খাওয়ানো, একসাথে বৃষ্টিতে ভেজা, একসাথে প্রতি রাতে গল্প করা। একটা হ্যাপি এন্ডিং সংসার চেয়েছিলাম আমি। পড়াশুনা নিয়ে আমার ওতো আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ সবার জীবন আর নিজের জীবনের বাস্তবতা দেখে মনে হচ্ছে আমরা নিজেদের নিয়ে রূপকথার গল্প সাজাই। কিন্তু সেই রূপকথার গল্প বাস্তবায়িত হয় না। স্বপ্ন পূরণ করা অনেক কঠিন। আমরা যা চাই, তা পাই না৷ পেয়ে গেলে হয়তো এই পৃথিবীটা পরীক্ষা ক্ষেত্র হতো না। কিছু না কিছু অপূর্ণতা থেকেই যায়। যেমন অরু, আহনাফ ভাইয়া, তূর্য ভাইয়া সবার লাইফে কোনো না কোনো সমস্যা। আমাদেরটাও তো আর রূপকথার গল্পের মতো হবে না। অপূর্ণতা তো থাকবেই।”

আরাফ চুপ করে রইল। রুহানি আরাফকে নীরব দেখে বলল, “আমি আপনাকে জোর করবো না। অনেক হয়েছে, আরাফ। আমি এতোটাও স্বার্থপর নই। আপনি অনেক ভালো। আমার জীবন বাঁচানোর জন্য এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যেই সিদ্ধান্তে প্রতিনিয়ত আপনাকেই মরতে হচ্ছে। আমি আপনাকে প্রমিজ করছি, আমি আমার জীবনকে খুব ভালোবাসবো। আমার অতীতে যা হয়েছে, তার জন্য কখনো নিজের ক্ষতি করবো না। নিজেকে ভালোবাসবো। তবুও আপনি নিজেকে অন্তত শেষ করে দেবেন না। আপনার আমাকে মনের বিরুদ্ধে গিয়ে মেনে নিতে হবে না।”

আরাফ অবাক হয়ে রুহানির দিকে তাকিয়ে রইল। তাদের চোখাচোখি হতেই রুহানি বলল, “আমি সব সত্য জেনে গেছি। কীভাবে জেনেছি এটা বিষয় না। আমার বাবা আপনার মায়ের সাথে অনেক অন্যায় করেছে। আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন না, প্লিজ। আমাকে দেখলে আপনার অবশ্যই ঘেন্না লাগা উচিত। আমি আপনার জায়গায় হলে আপনার সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করতাম। আরাফ, আপনি অবশ্যই আপনার মাকে ইনসাফ দেবেন। আমি আপনাকে সাহায্য করবো। যে এই কাজ করেছে, সে শান্তিতে কেন থাকবে? আর আপনি কেন ভেতরে ভেতরে কষ্ট পাবেন?”

আরাফ চোখ নামিয়ে নিল। দু’হাত দিয়ে শক্ত করে নিজের হাঁটু চেপে ধরলো। দাঁতে দাঁত চেপে রাখলো সে। কপালের রগ ভেসে উঠেছে তার। রুহানি গালে হাত রাখতেই নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করলো আরাফ। রুহানি হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, “আপনি আমাকে ভালোবাসেন না। এতে আমার কোনো সমস্যা নেই৷ কিন্তু আমি তো ভালোবাসি। বিয়ের পর ভালোবাসা হয়ে যায়। টান চলে আসে সংসারের প্রতি। কিন্তু সব সত্য জানার পর আমি আপনাকে জোর করতে পারবো না। আমরা না হয় এভাবেই থাকি। আপনি আমার স্যার হয়েই থাকবেন। আমার নতুন অভিভাবকের মতো আমার জন্য কী ভালো, কী মন্দ এসব বলবেন। আমিও কিছু শুনবো, কিছু শুনবো না।”

এই বলে রুহানি দুষ্টু হাসি দিল। আরাফ রুহানির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। রুহানি হাসি থামিয়ে বলল, “আমাদের সম্পর্কটা গুরু শিষ্যের মতো হবে। আপনাকে অনেক জ্বালাবো আমি। কিন্তু কখনো জোর করবো না। আপনার এই সম্পর্কে যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আমি মেনে নেবো। আপনি যদি আমাকে ছেড়ে দিতে চান, রাখতে চান, ভালোবাসতে চান, সব আপনার ইচ্ছা।”

আরাফ উঠে দাঁড়ালো। রুহানিও দ্রুত উঠে দাঁড়ালো। অজানা কারণেই তার বুক ঢিপঢিপ করছে। কথাগুলো বলে কি ভুল করে ফেলেছে সে? মনে ভয় ঝেঁকে ধরেছে। রুহানি কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কি চান?”

আরাফ ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “তোমাকে থ্যাংক্স আমাকে বোঝার জন্য। তুমি এতোটা ম্যাচিউর কথা বলবে আমি আশা করি নি।”

রুহানি উড়না আঁকড়ে ধরলো। চোখ বন্ধ করে বারংবার আল্লাহর কাছে চাইতে লাগল, আরাফ যাতে অন্তত সম্পর্ক শেষ করার কথা না বলে।

আরাফ স্বস্তির শ্বাস ফেলে রুহানির দিকে ফিরলো। রুহানি আরাফের মুখোমুখি হতেই জোরপূর্বক হাসলো। আরাফ বলল, “তুমি মনে কষ্ট নিও না। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে আমি একটুও আপসোস করছি না। আমার এমনিতেই বিয়ে করতে হতো। বাবা আমার ইন্টার্ন শেষ হলেই হয়তো মেয়ে খোঁজা শুরু করতো। তাই বিয়ে নিয়ে আমার কোনো আপসোস নেই। কিন্তু আমি তোমার স্বপ্নটা পূরণ করতে পারছি না।”

রুহানি ব্যস্ত কন্ঠে বলল, “আমার কোনো সমস্যা নেই।”

“কিন্তু আমি আমার দায়িত্ব পালন করবো। তোমার যা যা প্রয়োজন আমি তোমাকে সব দেবো। কোথাও ঘুরতে যেতে চাইলে নিয়ে যাবো। তুমি আমাকে সব বলতে পারো।”

“আপনার যা ইচ্ছে। আপনার যতোটুকু সাধ্য হয়। আমার কোনো অভিযোগ থাকবে না।”

“তুমি কি তাহলে এই রুমে একা থাকতে পারবে? আমি পাশের রুমে থাকি!”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, কোনো সমস্যা নেই। আমি তো বাসায় একাই থাকতাম। উলটো কেউ পাশে থাকলেই আমার ঘুম আসতো না।”

কথাটি বলেই রুহানি হাসলো। আরাফ শুকনো হেসে বলল, “থ্যাংক ইউ। আমি আমার জিনিসপত্র পাশের রুমে নিয়ে যাই?”

রুহানি হালকা হেসে বলল, “হ্যাঁ!”

আরাফ মুচকি হেসে তার ঘড়িটা নিয়ে নিল। রুহানি কাঁপা কন্ঠে বলল, “আপনার বাবা কিছু মনে করবেন?”

“না।”

“আপনি কি এখন থেকে পাশের ঘরেই থাকবেন?”

“হ্যাঁ, তোমার তো সমস্যা নেই, তাই না?”

“না, আমার তো সমস্যা নেই। কিন্তু এটা তো আপনার রুম ছিল। আপনি বললে আমি না হয় অন্য রুমে চলে যায়।”

“না, না। সমস্যা নেই আমার।”

“আচ্ছা, আরেকটা প্রশ্ন করি?”

“হ্যাঁ করো।”

“কোনো গেস্ট আসলে তখন কি আপনার আমার সাথে থাকতে হবে?”

“না, কেউ আসে না এই বাসায়। আমি আর বাবা থাকি। কেউ কিছু মনে করবে না। বাবাও কোনো প্রশ্ন করবে না। উনি চুপচাপই থাকেন।”

“তাহলে আজই আমাদের এই ঘরে শেষ রাত ছিল!”

আরাফ রুহানির দিকে তাকালো। রুহানি মুচকি হেসে বলল, “একটা সেল্ফি তুলি?”

আরাফ হেসে বলল, “ওকে!”

রুহানি ফোন বের করে আরাফের পাশে এসে দাঁড়ালো। আরাফের গায়ের ঘ্রাণ শেষবার অনুভব করলো। এরপর ছবি তুলে আরাফের দিকে তাকালো। আরাফও নিঃশব্দে চলে গেল।যাওয়ার আগে দরজাটাও বন্ধ করে দিয়ে গেল। রুহানি স্থির দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকিয়ে রইল। এরপর ধীর পায়ে দরজার কাছে এসে ভেতর থেকে দরজাটি লাগিয়ে দিল। কি মনে করে দরজায় কান লাগালো সে। পাশের রুমে দরজা লাগানোর শব্দ হলো। আরাফ কি তবে একটুও দরজার কাছে দাঁড়ায় নি? এই দেড় মাসের সম্পর্ক বিচ্ছেদে কি একটুও কষ্ট হচ্ছে না তার?

রুহানি ফোনের স্ক্রিনে থাকা আরাফের ছবিটিতে চুমু খেল। ধীর পায়ে বিছানার কাছে এলো। আরাফ যেই পাশে ঘুমায়, সেই পাশে চুপচাপ শুয়ে পড়লো। আরাফের বালিশে নাক ডোবাল। অস্ফুটস্বরে বলতে লাগলো, “আমার খুব কষ্ট হচ্ছে! কেমন হাহাকার চারপাশে। কেমন শূন্যতা! কেমন একাকিত্ব! কি ভয়ংকর এই বর্ষার রাত! বাইরে বৃষ্টি, অথচ আমি একা। ‘বৃষ্টি আর সে’ এই ক্যাপশনে আমার ছবি দেওয়া হলো না আর৷ আমার স্বপ্ন, আমার ক্যাপশন আমার রূপকথার রাজ্যে হারিয়ে গেল। পৃথিবীতে সেই গল্প রচনা করা হলো না।”

রুহানি আরাফের বালিশ বুকে নিয়ে বলল, “আপনি যদি আমাকে ভালোবাসতেন, আরাফ। কতো সুন্দর একটা রূপকথার গল্প হতো আমাদের। আমি তো অনেক ভালোবাসি আপনাকে। কিন্তু এখন আপনার ভালোবাসা পাওয়ার গর্ব আমার আর করা হবে না। সব ওই সায়ন্তনি মেয়েটার কপালে চলে গেছে। থাক, সে শুধু ভালোবাসায় তো পেয়েছে। আরাফ হয়তো মেয়েটাকে পেলে খুব সুখী হতেন। কিন্তু আমি না এলেও কি তিনি মেয়েটাকে পেতেন? পেতেন না। তাই এখানে আমার কোনো দোষ নেই।”

রুহানি বালিশটা আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, “আমার খুব ইচ্ছে করে আপনার ভালোবাসা পাওয়ার।”

রুহানি ফুঁপিয়ে উঠলো। শব্দ বাইরে না যাওয়ার জন্য ফ্যান চালু করে দিল। মুখে উড়না চেপে আরাফের বালিশটা বুকে জড়িয়ে শুয়ে পড়লো। অনেকক্ষণ কাঁদলো সে। একটু পর পর দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো। আরাফ যদি দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়? যদি রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে বলে, “দরজা খুলো, রুহানি। আমার তোমাকে ছাড়া ঘুম আসছে না। তুমি আমার অভ্যাস হয়ে গেছো।”

কিন্তু না। এমন কিছুই হলো না৷ সারারাত অনর্থক অপেক্ষা করলো রুহানি। ভোর হতেই দরজা খোলার শব্দ হলো। রুহানি এলোমেলো পায়ে দরজায় কান রাখলো। আরাফ নামাজের জন্য বেরিয়েছে। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো সে। বারান্দা থেকে আরাফকে মসজিদে যেতে দেখছে সে। রুহানি নিজেকে আড়াল করে রেখেছে। সে ভেবেছে, আরাফ তার কথা ভেবে একনজর পেছন ফিরে বারান্দার দিকে তাকাবে। কিন্তু তাও হলো না। রুহানি ঘরে চলে এলো। অরুণিকার বলা কথাটি তার মাথায় ঘুরছে। ভালোবাসা প্রচুর যন্ত্রণাদায়ক। যে ভালোবেসেছে, তার ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণা ভয়ংকর। মস্তিষ্কে চাপ, বুকে অদৃশ্য ভার, গলায় কাঁটা বিঁধে থাকা, হাত-পা অসার হয়ে আসা৷ অনিশ্চিত অপেক্ষায় বোধহয় দিন পার করবে রুহানি। কখন শেষ হবে এই অপেক্ষা সে নিজেও জানে না।

(***)

মাঝপথে মোটর সাইকেলে ব্রেক কষলো তাহমিদ। বাড়তে লাগলো তার হৃদস্পন্দন। মোটর সাইকেল থেকে নেমে হেলমেট খুললো। তার চোখ জোড়া স্থির হয়ে আছে একটি মার্কেটের সামনে। বুকে হাত রাখলো সে। চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে এলো তার। দূর থেকে যেন ভেসে এলো একটি পরিচিত স্বর।

“ও মিষ্টিমশাই! কি খবর তোমার?”

তাহমিদ ঠোঁট চেপে ধরলো। সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার চন্দ্রিমা। উভয়ের চোখাচোখি হলো। তাহমিদ নীরবে দাঁড়িয়ে রইল। তাহমিদের চন্দ্রিমার পরণে দামি পোশাক। সে তাকিয়ে আছে তার মিষ্টিমশাইয়ের দিকে। কিন্তু সেই দৃষ্টি বেশ অপরিচিত।

ড্রাইভার কিছু একটা বলতেই শতাব্দীর হুঁশ ফিরলো। সে তাহমিদের দিকে একনজর তাকিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। মিনিট খানিক পর গাড়িটা চলে গেল। তাহমিদ মলিন হাসলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কি আমাকে চিনতে পারো নি? চন্দ্রিমা হয়েই তো এসেছো। আজ হঠাৎ মনের আকাশে তোমার দেখা পেলাম। তুমি হয়তো আমার থেকে দূরে আছো। কিন্তু আমার হৃদয়ে তো চলছে তোমার শাসন। আর তোমার মুছে যাওয়া স্মৃতিতে আমার শাসন। আমার চন্দ্রিমা! প্রিয় চন্দ্রিমা। আবারও হারিয়ে ফেললাম তোমায়। তবুও যেই দেখা দিয়েছো, এতেই আমার এক বছরে স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।”

তাহমিদ এক দৃষ্টিতে শূন্য পথের দিকে তাকিয়ে রইল। ওদিকে গাড়ির কাচ নামিয়ে দিল শতাব্দী। হঠাৎ মাথায় এসে ঠেকলো একটি প্রশ্ন। কে সে? মানুষটা কে ছিল? পথ চলতে কতো মানুষের দেখা পায় সে। কখনো তো এমন অস্থির লাগে নি তার। তাহলে কেন এমন অনুভূত হচ্ছে? মাথাটা আবার টনটন করছে তার। ড্রাইভার সামনের আয়নায় শতাব্দীকে দেখে বলল, “ম্যাম, আপনার কি সমস্যা হচ্ছে?”

শতাব্দী মাথা নেড়ে বলল, “না। ঠিক আছি আমি।”

শতাব্দী এই বলে জানালার বাইরে তাকালো। হঠাৎ ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠলো একটি নাম। বিরাজ খান। শতাব্দী ফোনটা ব্যাগে ঢুকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। কীসের আক্ষেপ! কেন এই হতাশা, তা হয়তো শতাব্দীরও অজানা।

অন্যদিকে তাহমিদ এখনো দাঁড়িয়ে আছে আগের জায়গায়। কার অপেক্ষায় আছে সে? কীসের আশায় আছে, তা জানে না তাহমিদ। তবুও মানুষ তো আশায় বাঁচে। আর সেই আশায় তাহমিদও বেঁচে আছে।

(***)

মাথা চেপে ধরে মেঝেতে শুয়ে চিৎকার করে কাঁদছেন শিরিন সুলতানা। অস্থিরতা তাকে আঁকড়ে ধরেছে। দুর্বল শরীরে দেয়াল হাতড়াতে লাগলেন তিনি। আবদ্ধ ঘরে অক্সিজেন প্রবেশের জায়গাও নেই। নিজেকে কেমন উন্মাদ মনে হচ্ছে তার। পাগলের মতো চিৎকার কর‍তে করতে আবার মেঝেতে বসে পড়লেন তিনি। দু’হাত জোড় করে বললেন, “আল্লাহ, ওহ আল্লাহ, মাফ করে দাও আমাকে। আমাকে বের করো এখান থেকে। আমাকে বাঁচাও। আল্লাহ, বাঁচাও, আল্লাহ!”

এবার মেঝেতে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লেন তিনি। জোরে জোরে শ্বাস ছাড়তে লাগলেন। হঠাৎ তার চোখের সামনে আহনাফের অসহায় মুখটা ভেসে উঠলো। আহনাফের রাতভর অস্থির জেগে থাকা, অরুণিকাকে আঘাত করে রুম বন্ধ করে ছটফট করা, ড্রাগস নিয়ে উন্মাদের মতো আচরণ করা, আহনাফের চোখে অসহায়ত্ব। হঠাৎ তার ক্লান্ত স্বর ভেসে এলো দূর থেকে, “মা, কেন এমন করলে তুমি আমার সাথে?”

শিরিন সুলতানার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। হাত-পা কাঁপছে তার। চোখ বড় বড় হয়ে এলো। ধড়ফড় করতে করতেই হঠাৎ নিস্তেজ হয়ে পড়লেন তিনি। অন্ধকার ঘরটি থেকে এখন আর নিঃশ্বাসের শব্দও ভেসে আসছে না।

(***)

দিদার নামক মানুষটির সাথে জোরপূর্বক সংসার করে যাচ্ছে জয়িতা। ঘরের বাইরে যাওয়ার সুযোগটাও নেই তার। সারাদিন রান্নাঘরে টুকটাক কাজ করে রাতে দিদারের শারীরিক চাহিদা মেটানোই যেন তার দায়িত্ব। সামান্য একটা মধ্যবিত্ত লোকের এতো দাপট! আহনাফের কারণেই তো হয়েছে সব। জয়িতা মেঝেতে বসে কাঁদছে। বাবার সাথে সম্পর্ক শেষ তার। দিদারকে বিয়ে করার পর জয়িতার বাবা মেয়েকে ত্যাজ্য করে দিয়েছেন। জয়িতা বাবাকে অনেক বুঝিয়েছে, বিয়েটা জোরপূর্বক করিয়েছে আহনাফ। কিন্তু তিনি এসব বিশ্বাস করেন নি। উলটো স্ত্রী জাহানারা ইসলামকেও ঘর থেকে বের করে দিয়েছেন।

জয়িতার বাবা মানুষ হিসেবে যথেষ্ট ভদ্র৷ কিন্তু স্ত্রী-কন্যা এমন চরিত্রের হওয়ায় বেশ হতাশ তিনি। আহনাফকে তিনি কখনোও জয়িতার যোগ্য মনে করেন নি৷ কারণ আহনাফ বিবাহিত যুবক। একজন বিবাহিত ছেলের সাথে কেন তিনি মেয়ের বিয়ে দেবেন? কিন্তু জাহানারা ইসলাম চৌধুরী সম্পত্তির লোভে পড়ে জয়িতাকে আহনাফের দিকেই ঝুঁকিয়ে দিয়েছিলেন। যার পরিণতি আজ এতোটা ভয়ংকর হলো। বয়ষ্ক এক লোকের সাথে বিয়ে হয়েছে জয়িতার। চাইলেও ডিভোর্স দিতে পারছে না। কারণ দিদার সাহেব স্ত্রীর দেখানো পথেই চলেছেন। জয়িতার ব্যক্তিগত ভিডিও বানিয়ে তাকে জোরপূর্বক সংসার করতে বাধ্য করছেন। জয়িতা পালানোর সুযোগ খুঁজছে। কিন্তু পারছে না। বাবাও তাকে সাহায্য করছেন না। এদিকে জাহানারা ইসলাম বাবার বাড়ি ফিরে গেছেন। মেয়ের জন্য দিন-রাত কাঁদেন। মেয়েকে একবার ফিরে পেলেই যেন শান্তি পাবেন তিনি। হয়তো দেশ ছেড়ে চলে যাবেন। জয়িতার পাসপোর্ট হাতে রেখেছেন। জয়িতাও সেই সুযোগ খুঁজছে। হয়তো একদিন সে সুযোগ পাবে পালানোর। তখন আর বাংলাদেশে তাকে দেখা যাবে না। এই জীবনে চরম শিক্ষা হয়ে গেছে তার। আর কখনো কোনো পুরুষের পেছনে ছুটবে না সে।

(***)

ডিভোর্স ক্যান্সেল করেছে আহনাফ। কোর্টে গিয়ে উকিলকে বলেছে সে অরুণিকাকে ছাড়বে না। অরুণিকা এই খবর পেয়ে বেশ খুশি হয়েছিল। দু’সপ্তাহ আহনাফের অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু আহনাফ তাকে নিতে আসে নি। তাই আজ নিজেই চৌধুরী ম্যানশন ফিরলো সে। গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে আহনাফের মোটর সাইকেল গ্যারেজে দেখে মুচকি হাসলো। তাহলে তো আহনাফ বাসায় আছে। লিফটের কাছে আসতেই গ্যারেজের পেছনে চোখ পড়লো তার। অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে সেদিকে গিয়ে চমকে উঠলো। সাদা মোটর সাইকেল, সাদা হেলমেট। অরুণিকা মোটর সাইকেলটি আলতো স্পর্শ করে বলল, “হিমালয়ের বাইক।”

তূর্যের কন্ঠে চমকে উঠলো অরুণিকা। তূর্য বলল, “টুইংকেল, তুমি এখানে?”

অরুণিকা মোটর সাইকেলের দিকে তাকিয়ে বলল, “এটা কার!”

“আহনাফের।”

“এটা তো হিমালয়ের।”

তূর্য চুপ করে রইল। অরুণিকা বলল, “আমি জানতাম সব। ও এমন কেন করেছে, তূর্য? আমাকে কি সত্যটা বলতে পারতো না?”

“ওর তো বাইকের শখ ছিল। তুমি তো জানোই।”

“তাই বলে এটাও ওর হবে, সেটা আমি কি করে বুঝবো?”

তূর্য আবার চুপ হয়ে গেল। অরুণিকা বলল, “ও কেমন ভয়ংকর, দেখেছো? হিমালয় সেজে আমার সাথে চ্যাট করেছে। আমাকে ইমপ্রেস করতে চেয়েছে। ও এমনকি নিজেকে নিজে মার খাইয়েছে। কি ভয়ংকর ও!”

“তোমাকে ভালোবাসে আহনাফ। ভীষণ ভালোবাসে।”

“মুখে বলা যায় না?”

“তুমি একবারও বুঝেছো?”

“আমার মানসিক অবস্থা কেমন ছিল, তুমি জানো? আমার সাহস নেই ওকে ভালোবাসি বলার। আবার যদি ঠকায়? ওকে ভয় পাই আমি।”

তূর্য কিছু বলল না। অরুণিকা বলল, “আমি ওর সাথে কথা বলে আসি।”

“ও তো বাসায় নেই।”

“কোথায়?”

“এক সপ্তাহ হচ্ছে বাড়িতে গেছে।”

“তোমরা যাও নি?”

“না। যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ও একা থাকবে বলল। আমরা আর জোর করি নি।”

“বাসায় কেউ নেই?”

“আমির আংকেল ডিভোর্সের পর ঢাকা চলে গেছেন। আহনাফ ঘরের চাবি আরাফকে দিয়ে গিয়েছিল। তুমি যাবে ওই বাসায়?”

অরুণিকা মাথা নাড়লো। তূর্য আরাফের কাছ থেকে চাবি নিয়ে অরুণিকাকে দিল। অরুণিকা চাবি ঘুরিয়ে ভেতরে ঢুকলো। ঘরের ভেতরে পা রাখতেই অরুণিকার শরীর অসার হয়ে এলো। চারদিকে কেমন শূন্যতা বিরাজ করছে। অরুণিকা কয়েক পা এগিয়েই থমকে গেল ডায়নিংয়ে রাখা বক্সটি দেখে। বক্সের উপরে লেখা, “আরাফ খুলিস।”

অরুণিকার কেন যেন বেশ ভয় হচ্ছে। আরাফকে ডাকলো না আর। সে নিজেই বক্সটি খুললো। দেখলো বক্সটিতে পাঁচটি খাম স্তরে স্তরে সাজানো। প্রতিটি খামে এক একটি নাম। ইভান, ইমন, আরাফ, তূর্য আর তাহমিদের নাম। খামগুলোর উপর আহনাফের ব্যবহৃত ফোন রাখা। অরুণিকা দৌঁড়ে ঘর থেকে বের হয়ে তূর্যের নাম ধরে ডাকলো। তূর্য অরুণিকার ডাক শুনে আহনাফদের ফ্ল্যাটে এলো। অরুণিকা ব্যস্ত কন্ঠে বলল, “তুমি এই এক সপ্তাহ আহনাফকে কল দাও নি?”

তূর্য অবাক হয়ে বলল, “দিয়েছি। কিন্তু ওর ফোন বন্ধ ছিল।”

“কি বলছো তুমি? এক সপ্তাহ ওর খোঁজ না নিয়ে তোমরা বসে আছো?”

“খোঁজ নেবো না কেন? নিয়েছি তো। ওর ফোন বন্ধ তাই বাড়ির দারোয়ান চাচাকে ফোন দিয়েছিলাম। উনি বললেন আহনাফ ভালো আছে। কথা বলতে চেয়েছি। ও না-কি একা থাকতে চাইছে। তাই আর বিরক্ত করি নি।”

অরুণিকা বক্সটির দিকে তাকিয়ে বলল, “তাহলে ওর ফোন বক্সে কি করছে? ওতো ফোনই নিয়ে যায় নি।”

“মানে?”

তূর্য বক্সটির কাছে এসে চমকে উঠলো। বক্সে রাখা খামগুলো হাতে নিল। ব্যস্ত হাতে ফোন বের করে গ্রুপ কল দিল। বাকিদের আহনাফের ফ্ল্যাটে আসতে বলল। মিনিট দশেকের মধ্যে সবাই ফ্ল্যাটে এসে হাজির। ততোক্ষণে তূর্য তার নাম লেখা খামটি খুলে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে।

সেখানে লেখা ছিল,

“তূর্য, অনেক সাপোর্ট করেছিস আমাকে। তোর মতো বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু আমি চলে যাচ্ছি তোদের ফেলে। সরি, তোর কুয়াশ বাহ হয়ে থাকতে পারলাম না। আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে এখানে। এই ঘর, এই এলাকা, এই দেশ কোথাও আমি শান্তি পাচ্ছি না। দারোয়ান চাচাকে আমিই শিখিয়ে দিয়েছিলাম, মিথ্যে বলতে। আমি চাই না তোরা কেউ আমাকে থামাতে আসিস। বাবা জানে আমি কোথায় চাচ্ছি। প্লিজ বাবাকে জোর করিস না। উনাকে একটু দেখে রাখিস। সাথে তোর টুইংকেলকেও। আমি দুইটা আমানত রেখে গেলাম।”

ইভান তার নামযুক্ত খামটি হাতে নিল। সেখানে লেখা,

“ইভান, আমি তোকে না বলে রিজাইন দিয়ে এসেছি। তুই জানলে আমাকে আটকাতি। তূর্যকে সামলে রাখিস। আমাকে নিয়ে ভাবতে বারণ করিস। এই মুহূর্তে ওর তূর্ণাকেই সময় দেওয়া উচিত।”

ইমনের হাতেও একটি চিঠি। সেখানে লেখা,

“ইমন, অনেক খোঁচা মেরেছি তোকে। কিন্তু তুই অনেক ভালো। অরুর খেয়াল রাখিস।”

তাহমিদের হাতে থাকা চিঠিতে লেখা,

“মিষ্টিমশাই, তোর কবিতার বেশ প্রশংসা করতো আমার অরু। তাই তোর কাছ থেকে একটা গুণ চুরি করেছি। বিনিময়ে হারানো ভালোবাসা পেয়েছি। খারাপ কি বল!”

আরাফ চিঠিটির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সেখানে লেখা,

“তোর উপর অনেক বিশ্বাস আমার। আমার বাবার খেয়াল রাখিস ভাই। আমার অরুর খেয়াল রাখিস। আমি ওর চোখে ভালোবাসা দেখতে চেয়েছি। ওর চোখে ঘৃণা দেখতে চাই না। ও হিমালয়কে ভালোবাসে। ওকে ভালোবাসতে দে। ওকে বলিস না আমিই তার হিমালয়। অরু আমাকে ভালোবাসে না। আমি ওর যোগ্য হতে পারি নি। কখনো পারবোও না। আরাফ, আমি তোদের ছাড়া ভালো থাকবো না। আর এখানে থাকলে অরুর কষ্ট হবে। ওকে ভালোবাসার অধিকার দিয়েছি আমি। ও হিমালয়কে ভালোবাসুক। প্লিজ ওর খেয়াল রাখিস। আর কিছু চাইবো না আমি। ওর ফ্ল্যাট ওকে বুঝিস দিস। আমার বিশ্বাস তুই আমার চেয়ে ভালো দায়িত্ব নিবি ওর।”

আরাফ মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। অরুণিকা সবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে অসহায় দৃষ্টিতে। বক্সটিতে অনেক কিছুই আছে। অরুণিকার দেখার সাহস নেই। তূর্য অরুণিকার দিকে তাকালো। অরুণিকা হাতজোড় করে বলল, “ও ঠিক আছে তো! খারাপ কিছু করে নি তো!”

থুতনি কাঁপছে অরুণিকার। আরাফ অরুণিকার সামনে বসে বলল, “বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিস তুই। আগেই বলেছি, একটু বোঝার চেষ্টা কর। দুর্বল জিনিসে আঘাত করলে ঠিক হয় না, আরো ভেঙে যায়। এখন কি শুনতে চাচ্ছিস তুই? হ্যাঁ, বেঁচে আছে আহনাফ। কিন্তু ওকে আর পাবি না। তোর যন্ত্রণায় দেশ ছেড়ে চলে গেছে ও।”

অরুণিকা বক্সটি নিয়ে ধপ করে বসে পড়লো মেঝেতে। ভেতরে আরেকটি খাম অরুণিকার নামে। সাথে বেশ কয়েকটা বই। সব হিমালয়ের লেখা। একটা ছবির এলবামও আছে। অরুণিকা আর আহনাফের ছোট থেকে বড় হওয়ার ছবি। অরুণিকা কাঁপা হাতে চিঠিটি খুললো। চিঠি পড়ার আগেই এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো চোখ বেয়ে। চিঠিতে লেখা,

“অরু,
তোকে ছাড়তে পারলাম না। আমার সেই সাহস নেই। আমাকে ক্ষমা করে দিস। আমি তোকে ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি। কিন্তু আর আসবো না সেই ভালোবাসার বোঝা নিয়ে। তোকে মুক্তি দিতে না পারার অপারগতার জন্য ক্ষমা করিস আমাকে। তুই হিমালয়কে ভালোবাসিস তো। তুই ওকে ভালোবাস। আমি তোকে আটকাবো না। কিন্তু এই আহনাফকেও তো ভালোবাসার অধিকার দে। আমিও তোকে ভালোবাসতে চাই। তোর জন্য হিমালয়ের বই রেখে গেলাম। তুই তো ভালোবাসিস তাকে। ভালোবাসিস। খুব ভালোবাসিস। আমাকে ছাড়া সবাইকে ভালোবাসিস। অন্তত ঘৃণা করিস না আমাকে। আমার মা ভালো না আমি জানি। উনি তোকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। উনার কথায় আমি তোকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আমি তোকে অনেক অপমান করেছি। তোকে অবিশ্বাস করেছি। আমার কোনো ক্ষমা নেই। কিন্তু তোকে ওভাবে স্পর্শ করতে চাই নি আমি। তোর সম্মতিতেই সব হয়েছিল। আমি জানি, তুই আমাকে ভুল বুঝেছিস। একদিন তোর ভুল ভাঙবে। কিন্তু তোর মনের মধ্যে যে দ্বিধা আছে সেটা তো কখনো যাবে না। আমি ড্রাগ এডিক্টেট ছিলাম, আমার জন্মদাত্রী একজন খুনী, চরিত্রহীন নারী। এগুলো আমি কখনো তোর মন থেকে মুছে দিতে পারবো না। এই সত্য কখনো ভুল প্রমাণিত হবে না। এই দ্বিধা নিয়ে আমাদের চলতে ভীষণ কষ্ট হতো। তুই দ্বিধার সংসারে ভালো থাকতি না। অরু, এই ড্রাগ এডিক্টেট ছেলেটাই তোকে ভালোবাসতো। আমি শুধু তোর জন্য নিজেকে পরিবর্তন করেছি। যদি আবার তোর সামনে আসি, তুই আমাকে আর আগের মতো দেখবি না। অনেক পরিবর্তন হয়ে ফিরবো। তখন আমাকে অসহ্য লাগবে না তোর। তোর ঘৃণা হয়তো কেটে যাবে। তোর চোখে ভালোবাসা না থাকুক, অন্তত ঘৃণা তো দেখবো না। ভালো থাকিস। পড়াশুনা শেষ করিস। চাকরি করিস। তোর ফ্ল্যাট তোর মনমতো গুছিয়ে দিয়েছি আমি। আমার শখের নারী তুই। আমি তোর পছন্দে তোর ঘর সাজিয়েছি।
তোর আহুনাফ।”

অরুণিকা চিঠিটা রেখে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। বুক চেপে ধরে বলল, “ওকে নিয়ে আসো। ওকে ফিরে আসতে বলো।”

আরাফের হাত ঝাঁকিয়ে বলল, “ও কোথায় গেছে চাচ্চু জানে। উনাকে জিজ্ঞেস করো গিয়ে৷ আসতে বলো ওকে। পাগল না-কি ও। আমি রুহানিকে কেন বলেছি বলতে? কারণ আমার বিশ্বাস ওই হিমালয়। ও সোজাটা বুঝলো না। বাঁকাটাই বুঝলো। ও পাগল। পাগল ও।”

অরুণিকা পা ধাপিয়ে কাঁদছে। তূর্য, ইভান, ইমন আর আরাফ ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এলো। আমির চৌধুরীকে ফোন করলো। তিনি জানালেন না। আরাফ আরেফিন চৌধুরীকে দিয়ে ফোন করালো। দাদাকে বলেও ফোন করালো। তবুও আমির চৌধুরী কিছুই বললেন না। অরুণিকা নিজেও ফোন করলো চাচ্চুকে। তিনি তবুও চুপ করে রইলেন।

(***)

অরুণিকা নিজের ফ্ল্যাটে গেল। পুরো ঘরে নতুন রং করিয়েছে আহনাফ। অরুণিকার পছন্দের গাছ লাগিয়েছে বারান্দায়। পর্দা লাগিয়েছে ধূসর বেগুনি রঙের। ঘরে নতুন ইন্টরিয়র করিয়েছে। দক্ষিণে পড়ার টেবিল, পাশে বুক সেল্ফে আহনাফের পড়া সব ইংরেজি উপন্যাসের বই। একপাশে কবিতার বই। আরেক পাশে হিমালয়ের দু’একটা বই।

অরুণিকা মেঝেতে বসে পড়লো। তাহমিদ অরুণিকার সাথেই ছিল। সে অরুণিকার পাশে বসে বলল, “সবার ভাগ্যে ভালোবাসা থাকে না। আর যারা পায়, তারা কদর করতে জানে না। তোরা সবাই একই পথে চলছিস। তূর্যও ভালোবাসে উপমাকে। কিন্তু নিজের গোঁ ধরে বসে আছে। সব থেকে অভাগা তো তোরা দুই জন। ভালোবাসিস, কিন্তু ভালোবাসতে জানিস না। মনে রাখিস, যেই সম্পর্কে ভালোবাসার চেয়ে ঊর্ধ্বে অবিশ্বাসের জায়গা হয়, সেখানে ভালোবাসা দুর্বল হয়ে পড়ে। অন্ধবিশ্বাস করলে মানুষ না-কি ঠকে। আরেহ, ঠকলে ঠকে যাক। কিন্তু অন্ধবিশ্বাস না থাকলে ভালোবাসা কীসের? ভালোবেসে ঠকে যাওয়াতে কোনো আপসোস নেই, যদি সেই ভালোবাসায় কোনো খাত না থাকে। তুই কাঁদছিস কোন আক্কেলে? তুই তো তোর ভালোবাসাকে অপমান করেছিস। তোর কাছে ভালোবাসার চেয়ে ইগো বেশি বড় হয়ে গেছে। ইনিয়ে-বিনিয়ে কিসের ভালোবাসার প্রকাশ? ভালোবাসার মানুষকে ভালোবাসার কথা বলতে কীসের ভয়? কীসের আত্মসম্মান? পৃথিবীর চোখে বেহায়া হয়েও যদি তোর ভালোবাসার মানুষ তোর থাকে, এখানে কারো কিছুই আসে যায় না। তোর মানুষ তোর থাকবে। তুই ধনী হবি। তুই সুখী হবি। এখন ইগো, অবিশ্বাসের কাছে হেরে গেল তো তোদের ভালোবাসা! তোদের শাস্তি হয়েছে। তোদের শাস্তিটা পাওয়া উচিত। শিক্ষা নেওয়া উচিত। এই শিক্ষা ভালোবাসাকে অপমান করার। তুই এই যন্ত্রণা নিয়ে বাঁচবি, আর নিজের কাছেই জবাব দিস কেন অন্য একটা ছেলের সামনে তোর ভালোবাসার মানুষকে অপমান করেছিস।”

(***)

নতুন দেশের এক নতুন অতিথি আহনাফ। খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আছে সে। চোখ বুজে দু’হাত প্রসারিত করে বলল, “তুই কখনো জানবি না আমিই সেই হিমালয় যে তোর বিচ্ছেদে নতুন পরিচয়ে জন্ম নিয়েছিলাম। সাড়ে ছ’বছর আগে যখন তোকে অপমান করে বের করে দিয়েছিলাম, সেদিনই আমি লিখতে বসেছি। তোর জন্য আমার প্রতিটি লেখা উৎসর্গ করেছি। প্রতিটি লেখায় তোকে হারানোর সেই ছাপ রেখেছি। বিচ্ছেদের উপন্যাস লিখে আমি পরিচিতি পেয়েছি। সাথে তোকেও পেয়েছি। আমি তোকে দূর থেকে ভালোবাসবো। তুই তো আমার জীবনের সেই স্পেশাল মানুষ। আমার হৃদি। কোনো এক শীতে তোকে আমার বউ করে পেয়েছি। আবার তোকে হারিয়ে কতো উপন্যাস, কতো কবিতা, কতো গান লিখেছি। কতো সুর বেঁধেছি। অরু, তুইই তো হিমালয়ের লেখা সনেটের সেই নায়িকা। তুই আমার সনেট।”

অরুণিকা বারান্দায় বসে আছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে সে বলল, “আমার ভাগের প্রায়শ্চিত্ত করবো আমি। তোমাকে অবহেলার প্রায়শ্চিত্ত করবো। তুমি আমাকে ভালোবাসা ভুলো না শুধু। আমি তোমার অপেক্ষায় আছি, আহনাফ। আমার ডাবল স্ট্যান্ডার্ড বিহেভিয়ারের জন্য আজ আমি হারিয়ে ফেলেছি তোমাকে। আমি তোমার গল্পের সেই নায়িকা যে তার নায়ককে প্রতিবার খুন করে গেছে।”

(***)

সূর্যোদয় দেখছে আহনাফ। তার দু’হাত পকেটে। ঠোঁট কাঁপছে তার। নিজের মনে কবিতা সাজানোর চেষ্টা করছে সে। এই কবিতাটাও হয়তো তার হৃদিকে উৎসর্গ করবে আহনাফ।

“নিস্তব্ধ বেলা আর সেই শীতল সুর
তার চোখে ছিল ভীষণ মায়া
কুয়াশায় ঢাকা তার স্নিগ্ধ কায়া
পথ চলতে হারিয়েছি তাকে বহুদূর।
কতো কথা জমে ছিল মনে
বেলা ফুরিয়ে যায়, সন্ধ্যে নামে
বলার সুযোগ হয় নি সেই ক্ষণে
আজ শুধু স্মৃতিরাই এসে থামে।
আমি হিমালয় হয়ে বেঁধেছি গান
বড় আশা নিয়ে বেসেছি ভালো
ছুঁয়ে দিয়েছি তার কঠিন প্রাণ
তবুও হারিয়েছি মনের আলো।
ও ডিয়ার, লাভিং ইউ ইজ মাই চয়েজ, এন্ড আই উইল নেভার রিগ্রেট।
লেট মি নাউ রাইট সামথিং ফর ইউ, নেইমড উইন্টার এন্ড মাই সনেট।

#সমাপ্তি