#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-১৫ ||
কানে হেডফোন গুঁজে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকলো অরুণিকা। চোখ দু’টি লাল হয়ে আছে তার। এক রাতেই চোখের অশ্রু গ্রন্থিতে থাকা সব জল শুকিয়ে গেছে। কেমন শুকনো হয়ে আছে তার মুখখানা। হাস্যজ্বল চেহারাটা এক রাতেই বিষন্নতায় ছেয়ে গেছে! কিন্তু কেন? ভাবাচ্ছে ইমানকে। অরুণিকার সাথেই বেরিয়েছিলো সে। রুদবা আজ আসবে না ক্লাসে। এক বৃষ্টিতেই জ্বর উঠে গেছে তার। তাই ইমানের সাথে এসেছে অরুণিকা। একই সাথে বাসে উঠেছিল তারা। পুরো রাস্তায় জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল অরুণিকা। ইমান বাসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু অরুণিকার শুকনো মুখখানা দেখছিল।
ক্যাম্পাসের গেট দিয়ে ঢুকতেই ইভানের মুখোমুখি হল অরুণিকা। ইভানকে দেখেও না দেখার ভান ধরে সামনে হেঁটে চলে গেল সে। ইভান অরুণিকার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল। নিজের উপরই নিজের রাগ উঠল তার। কাল আহনাফের কথায় মিথ্যে কেন বলতে গেল সে? আহনাফকে অন্তত বোঝানো উচিত ছিল। এতো বড়ও হয় নি অরুণিকা। মন-মস্তিষ্ক এখনো দুর্বল তার। এই বয়সে এমন আঘাত তার মনকে আরো ভয়ংকর রূপে দুর্বল করে দিতে পারে। মাত্র একুশে পা রেখেছে অরুণিকা। তবে বয়সের হিসেবে ওতো ছোটও নয়। কিন্তু তাদের ছ’জনের কাছে সে তো সেই ছোট্ট অরু।
হঠাৎ ইভান কাঁধে কারো স্পর্শ পেতেই পাশ ফিরে দেখল তূর্য দাঁড়িয়ে আছে। সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “কাল কী হয়েছে তোরা এখনো বলিস নি আমাদের। আন্টি টুইংকেলের সাথে এমন বিহেভ কেন করলো? ওর ব্যাপারে এমন কথা বললো কেন?”
ইভান গম্ভীরমুখে বললো, “তোর বেস্ট ফ্রেন্ডকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর।”
ইভান তার ক্লাসের দিকে চলে গেল। তূর্য কপাল ভাঁজ করে ইভানের যাওয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে নিজেও ক্লাস নিতে চলে গেল।
(***)
কিছুক্ষণ পর আহনাফের ক্লাস শুরু হবে। মনটা ভারী হয়ে আছে অরুণিকার। চারটা বছর এই মানুষটাকে কীভাবে সহ্য করবে সে? এসব ভাবছে আর আনমনে বেঞ্চে কলম দিয়ে এবড়ো-থেবড়ো আঁকাবুঁকি করছে অরুণিকা। হুট করে তার পাশে এসে বসলো তাহসিন। তাহসিনের দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসি দিতেই সে বুঝে গেলো অরুণিকার কিছু একটা হয়েছে। কপাল কুঁচকে সে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে তোমার?”
অরুণিকা মাথা নেড়ে বুঝালো কিছু হয় নি। কিন্তু মুখে কিছু বলল না। তাহসিন অরুণিকার দিকে ঝুঁকে সে বেঞ্চে কি আঁকছে তা দেখতে নেবে, তখনই আহনাফ ক্লাসে ঢুকলো। আর আহনাফের দৃষ্টি সাথে সাথেই তাহসিনের দিকে আটকাল। এদিকে ক্লাসের সবাই উঠে দাঁড়াতেই অরুণিকাও উঠে দাঁড়াল। কিন্তু সে সামনে তাকাল না। তার দৃষ্টি মেঝেতে স্থির। আহনাফ শান্ত দৃষ্টিতে অরুণিকার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে সিটে বসে সবাইকে বসতে বলল। এরপর ক্লাস নেওয়া শুরু করল।
সবাইকে আজ ‘উইন্টার নাইট’ নিয়ে প্রেজেন্টেশন দিতে হবে। প্রেজেন্টেশনে একই গ্রুপের সদস্যদের মধ্যে কথোপকথন হবে। অরুণিকা আর তাহসিন দু’জনই তাদের স্ক্রিপ্ট নিয়ে সামনে এলো। এবারও আহনাফের দিকে তাকালো না অরুণিকা। আহনাফ গম্ভীরমুখে বলল, “শুরু করো!”
তাহসিন অরুণিকার দিকে তাকাল। মৃদু হেসে ইংরেজিতে বলতে লাগলো, “অরু, লুক। হাউ কোয়াইট দা নাইট ইস! ইসেন্ট?”
অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বললো, “বাট ইটস নরমাল তাহসিন। কাম এন্ড কোয়াইটনেস আর দা কোয়ালিটি অব নাইট।”
“নো, নো, ইটস নট নরমাল। ইটস ম্যাজিক।”
অরুণিকা কৌতুহলি কন্ঠে বলল, “ম্যাজিক? হাউ?”
আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের কথোপকথনে তার শরীরটা কেমন যেন ভারী হলে এলো। সে চেয়ারে বসে অরুণিকার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো, আর তার স্মৃতিতে ভেসে উঠলো সেই শীতের রাত। যেদিন পুরো বাড়িতে ছেয়ে গিয়েছিল নীরবতা। শুধু পাশাপাশি বসে ছিল দু’টি মানুষ, অরুণিকা এবং আহনাফ।
(***)
আহনাফের বয়স তখন আঠারো। কিন্তু অরুণিকার মাত্র তেরো। বয়স কম, তাই জগতের সকল আকাঙ্খা থেকে মুক্ত সে। কিন্তু আহনাফের মনে রিক্ততার মাঝেও বিরাজ করছিল বসন্তের হাওয়া। ছোট থেকেই বেড়ে উঠা অরুণিকা আর আহনাফের। পাঁচ বছরের ব্যবধান তাদের। বড় হতে হতেই কখন যে অরুণিকার প্রতি মায়া বাড়তে লাগলো তা নিজেও বুঝে উঠতে পারে নি আহনাফ। সবেমাত্র কলেজে উঠেছিলো সে৷ আরাফ আর তাহমিদ তার কাজিন হলেও, তূর্য, ইভান আর ইমন তার বন্ধু। তারা একই মহল্লায় বড় হয়েছে। তূর্যের বাবা আর আহনাফের বাবা ঘনিষ্ঠ মিত্র। আর ইভান ও ইমনের বাবা তার বাবা-চাচাদের বিজনেস পার্টনার। সেই সূত্রে তাদের সাথেও পারিবারিক বন্ধুত্ব। কিন্তু আহনাফ যেই কলেজে ভর্তি হয়েছিল, সেই কলেজে তার বন্ধু আর কাজিন ভাইদের কেউ ভর্তি হয় নি। তাই সে কলেজেই আলাদা হয়ে গিয়েছিলো সবার থেকে। আর সেখানেই তার বন্ধুত্ব হয়েছিলো ইশমাম আর বাঁধনের সাথে। বড়লোক বাবার সন্তান হলেও আহনাফের আচার-ব্যবহার যথেষ্ট মার্জিত ছিল। কিন্তু ইশমাম আর বাঁধনের পাল্লায় পড়ে আহনাফের ব্যবহারের অনেক পরিবর্তন ঘটে।
অরুণিকার প্রতি তার ভালো লাগা অল্প বয়স থেকেই ছিল। আর সেই ভালো লাগার কথা ইশমাম আর বাঁধনকে জানালো সে। তূর্য ছাড়া যেই কথা আগে কাউকে বলে নি আহনাফ। আরাফ আর তাহমিদ অরুণিকার যথেষ্ট যত্ন নিতো। একপ্রকার ভাইয়ের মতোই। তাই আহনাফ তাদের প্রচুর ভয় পেতো। অরুণিকাকে পছন্দ করে শুনলেই যদি কিল-ঘুষি জুটে। তাই তূর্যকে অনেক ঘুষ খাইয়ে মুখ বন্ধ করিয়েছিলো আহনাফ। তবে ইশমাম আর বাঁধনের সাথে তার পারিবারিক কোনো সম্পর্ক ছিল না। সেই সূত্রে তাদের বললেও খুব একটা সমস্যা হবে না ভেবেই জানালো। কিন্তু ইশমাম আর বাঁধন প্রায়ই আহনাফকে অরুণিকার ব্যাপারে জেরা করতো। তার শুদ্ধ মনে অরুণিকাকে নিয়ে উল্টো-পালটা চিন্তা ঢুকিয়ে দেওয়া শুরু করলো তারা। আহনাফ তাদের কথায় সামনা-সামনি পাত্তা না দিলেও ইশমামের কথাগুলো প্রায়ই তার মাথায় ঘুরপাক খেতো। নিজের কু-প্রবৃত্তির সাথে যুদ্ধ করতে করতেই একদিন হেরে গেলো আহনাফ। আর সেই একদিনটা কাল হয়ে এলো অরুণিকার জীবনে।
(***)
সেই কাল রাতটি এসেছিল অরুণিকার তেরো বছর বয়সে, এক শীতের সময়। সেই রাতে আহনাফের গায়ে উঠেছিল প্রচন্ড জ্বর। আর অরুণিকা ঘুমিয়ে ছিল। বাড়ির সবাই পাশের গ্রামের কোনো এক মেয়ের মেহেদি অনুষ্ঠানে গিয়েছিল। তাদের গ্রামে সামাজিকতা খুব কঠোরভাবে পালন করা হতো। শিরিন সুলতানা তাই বাধ্য হয়ে অসুস্থ ছেলেকে একা রেখেই সেই মেহেদি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। অন্যদিকে মিসেস নীহারিকা ঘুমন্ত মেয়েকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু অরুণিকার দাদি রেহানা বেগম বললেন, “থাক, ঘুমাক ও। আহনাফের সাথেই থাকুক।”
তাদের সেই সিদ্ধান্তটা যে তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দেবে, এতোটুকু আভাস পেলে বোধহয় তারা সেদিন সামাজিকতা রক্ষা করাটাকে দ্বিতীয় স্থানেই রাখতেন।
…….
সেই রাতে বাড়ির সবাই বেরুতেই অরুণিকার ঘুম ভাঙল। সে আঁখি মেলতেই আহনাফকে তার পাশে দেখে উঠে বসল। চোখ কচলে জিজ্ঞেস করল, “মা কোথায়?”
আহনাফ জ্বরের ঘোরেও মুগ্ধ হয়ে অরুণিকাকে দেখছিল। অরুণিকা কি বলল, সেটা খেয়াল করে নি সে। উল্টো জিজ্ঞেস করলো, “দেখছিস অরু, রাতটা কেমন নিস্তব্ধ, তাই না?”
অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে তাকালো আহনাফের দিকে। আর বলল, “রাত তো নিস্তব্ধই হয়। পাখি তো ডাকে না রাতে। এখন ক’টা বাজে, বলো তো? ঘুম পায় নি তোমার?”
আহনাফ অরুণিকাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “পেয়েছে অরু, খুব ঘুম পেয়েছে। আমার মাথার চুলগুলো টেনে দে তো।”
অরুণিকা আহনাফকে সরিয়ে দিয়ে বলল, “তোমার হাতটা অনেক গরম হয়ে গেছে।”
“কিন্তু আমার তো খুব ঠান্ডা লাগছে, অরু।”
“তো আমি কি করবো?”
আহনাফ হুট করেই অরুণিকার অধর ছুঁয়ে দিল। আচমকা আহনাফের এমন আচরণে অরুণিকা সরে বসল। হাত দিয়ে ঠোঁট ঘষতে ঘষতে বলল, “তুমি এটা কেন করলে? আমি কিন্তু চাচীকে বলে তোমাকে মার খাওয়াবো!”
আহনাফ কাঁপা কন্ঠে বলল, “তোকে ভালোবাসি আমি।”
“কিন্তু আমি ভালোবাসি না তোমাকে। তুমি পঁচা ছেলে।”
অরুণিকা আহনাফের সামনে থেকে চলে গেল। সে অন্য রুমে গিয়ে বাড়ির সবাইকে খুঁজতে লাগল। এদিকে আহনাফের কানের বাজতে লাগল ইশমামের বলা কথা,
“তুই ওকে ভালোবাসলে, নিজের করে নে। ওর কাছে এসে বোঝা, তুই ওকে ভালোবাসিস। নয়তো বুঝবে কিভাবে?”
জ্বরের ঘোরে আহনাফের জ্ঞানবুদ্ধি লোপ পেল যেন। সে কাঁপা শরীরে উঠে দাঁড়াল, আর এলোমেলো পায়ে অরুণিকার পিছু পিছু গেল। অরুণিকা আহনাফের দিকে ফিরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কি হলো?”
আহনাফের শরীরের শক্তিটুকু যেন হারিয়ে যাচ্ছে। সে ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ল। অরুণিকা ব্যস্ত হয়ে তার কাছে এসে বলল, “কি রে তোমার কি হলো? বসে পড়লে কেন?”
আহনাফের মাথা ঝিমঝিম করছে। সে ঘোরের মধ্যেই অরুণিকার কোমড় জড়িয়ে ধরল। এরপর অরুণিকাকে নিজের কাছে টেনে আনলো সে। বয়স কম অরুণিকার। আহনাফের এতো কাছে এসেও অরুণিকার কোনো অনুভূতি হল না। একসাথেই বেড়ে উঠা, তাই তাদের মধ্যে জড়তার কোনো দেয়াল ছিল না। যেখানে বৃষ্টির দিনে অরুণিকা কর্দমাক্ত পথ পার করতো আহনাফের কোলে চড়ে, সেখানে এতোটুকু কাছে আসাটা অন্য কারো দৃষ্টিতে অস্বাভাবিক হলেও অরুণিকা আর আহনাফের কাছে একদম স্বাভাবিক। যৌথ পরিবারে বড় হওয়ায় তাদের হাসাহাসিতে পারিবারিক বাঁধা আসে নি, কাছে আসাটাও কখনো কারো নজরে পড়ে নি। তাই সেই রাতে এতোটা দুঃসাহস দু’জনে করতে পারলো।
……..
আহনাফ হুট করে অরুণিকার নরম গালে চুমু খেয়ে বলল, “তুই আমাকে ভালোবাসিস না, অরু?”
অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বললো, “না। কিন্তু তুমি এভাবে কথা বলছো কেন?”
অরুণিকার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আহনাফ মলিন মুখে বলল, “আমাকে কষ্ট দিচ্ছিস কেন? আমাকে ভালোবাসিস না কেন বলছিস? বল না আমাকে ভালোবাসিস! বল না, অরু। এই অরু, বল না। শরীরটা ভালো না আমার। বল না, প্লিজ।”
অরুণিকা উঠে দাঁড়িয়ে আহনাফকে টেনে উঠালো। আহনাফ দেয়াল ধরে উঠে দাঁড়াল। অরুণিকা তাকে রুমে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলল, “তুমি এভাবে ভূতের মতো কথা বলে আমাকে ভয় দেখাতে চাচ্ছো, তাই না?”
আহনাফ মৃদু হেসে বলল, “তুই ভয় পাচ্ছিস?”
অরুণিকা মুখ ছোট করে বলল, “উঁহুম।”
আহনাফ অরুণিকার হাত ধরে তাকে আবার নিজের কাছে টেনে আনলো। অরুণিকার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল, “মাথাটা ভীষণ ব্যথা করছে। তুই জানিস, তোর কপাল ছুঁলেই সব ব্যথা চুমান্তার চু হয়ে যায়।”
“কীভাবে?”
“ম্যাজিক!”
“ম্যাজিক?”
“হ্যাঁ, তুই আমার জীবনে আসা একটা ম্যাজিক।”
“কি আবোল-তাবোল বলছো তুমি?”
“বিশ্বাস করিস না? দাঁড়া তোকে সেই ম্যাজিকটা দেখাচ্ছি।”
আহনাফ অরুণিকার হাত ধরে তার হাতের তালুতে অধর ছোঁয়ালো। অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। আহনাফ মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল, “ম্যাজিক দেখেছিস?”
অরুণিকা মুখ ছোট করে বলল, “তুমি আর তোমার কচুর ম্যাজিক তুমি একাই দেখো।”
অরুণিকা অবাধ্য মেয়ের মতো আহনাফকে সরিয়ে উঠে দাঁড়াল। কিন্তু আহনাফ তার হাত ধরে তাকে আবার নিজের কোলে বসিয়ে দিয়ে শুকনো মুখে বলল, “তুই আমাকে ভালোবাসলে, আমি তোকে সব এনে দেবো। যা বলবি সব?”
অরুণিকা ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, “তুমি কচু আনবে!”
আহনাফ বিরক্ত মুখে বলল, “কি কচু কচু লাগিয়ে রেখেছিস!”
পেছন দিক থেকে অরুণিকার কোমড় জড়িয়ে তার কাঁধে থুতনি রাখল আহনাফ। নিজের ক্লান্ত শরীরে ভার ছেড়ে দিলো অরুণিকার পিঠে। অরুণিকা কুঁজো হয়ে গেল আহনাফের ভারে। সে আর নড়াচড়া করতে পারছে না। ঠেলেও সরাতে পারছে না আহনাফকে। তাই কনুই দিয়ে আহনাফের বুকের উপর এলোপাতাড়ি আঘাত করতে লাগল। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো আহনাফ। অরুণিকাকে ছেড়ে তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে এনে বলল, “তুই আমাকে মারছিস? তোর কষ্ট হচ্ছে না আমাকে মারতে?”
অরুণিকা ভাবলেশহীন মুখে বলল, “তুমি আমাকে কি ঠেলাগাড়ি পেয়েছো? তোমার বস্তা মার্কা শরীরটা আমার পিঠে চড়িয়ে দিচ্ছো! যাও এখান থেকে। সরো।”
আহনাফের রাগ উঠলো। সে অরুণিকার দু’হাত শক্ত করে চেপে তার গালে কামড় বসিয়ে দিল। অরুণিকা চিৎকার উঠল ব্যথায়। আহনাফ সাথে সাথেই অরুণিকাকে ছেড়ে দিল। ব্যস্ত হয়ে অরুণিকার গালে হাত ঢলতে ঢলতে বলল, “সরি, অরু। কিছুই দেখছি না চোখে!”
অরুণিকা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল, “চাচীকে বলে দেবো আমি। তোমার গালে কামড় বসিয়ে দেবে এভাবেই। আমার সাথে শয়তানি করছো! সরো তো। ভালো লাগছে না তোমাকে। মিথ্যুক একটা। বলে কি চোখে দেখছে না! মিথ্যা কথাও বলতে জানে না। লাইট আছে, চোখ আছে, চোখে কেন দেখবে না?”
আহনাফ অরুণিকার লাল হয়ে যাওয়া গালে তার অধর ছোঁয়ালো। এরপর অরুণিকার চোখের দিকে তাকাল। সেই চোখে আহনাফ ভালোবাসা খুঁজে পেল না। উল্টো অভিমান দেখতে পেল। এতো স্পর্শ করার পরও তো অরুণিকা তার ভালোবাসা বুঝলো না। তাহলে ইশমাম কেন বলল, অরুণিকার কাছে আসলেই সে তার ভালোবাসা বুঝবে?
আহনাফ নিজের কপাল চেপে ধরলো। অরুণিকা ধীর পায়ে বিছানা থেকে নেমে পড়তেই হুট করে আহনাফ তাকে টেনে আবার তার মুখোমুখি বসিয়ে দিল। বেশ কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অরুণিকার দিকে। আহনাফের এমন চাহনিতে বেশ ভয় পেল অরুণিকা। সে নিজেকে অল্প অল্প করে আহনাফের কাছ থেকে দূরে সরাতে লাগলো। আহনাফ দূরত্ব ঘুচিয়ে হুট করে অরুণিকাকে জড়িয়ে ধরে তার উপর শরীরের ভার ছেড়ে দিল। জ্বরের তেজ বাড়লো তার। ক্লান্ত শরীরটা অরুণিকার ছোট্ট শরীরে সুখ খুঁজতে লাগল ব্যস্ত হয়ে। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল আহনাফ। আহনাফের অধরের স্পর্শ পেতে লাগলো অরুণিকার অধর, গাল আর গলা। অরুণিকা বেশ কিছুক্ষণ হাতাহাতি করে, এক সময় শান্ত হয়ে গেল। তবে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটলো না। তার আগেই তাদের রুমের বাইরে এসে দাঁড়ালো তাদের বাড়ির কাজের লোক। সেই গ্রামেরই মেয়ে সে। তারা বাড়িতে এলেই মেয়েটা কাজ করতে আসে। সে রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে ভেতর থেকে শব্দ শুনে দরজা খুলে দেখলো আহনাফ অরুণিকার অধর ছুঁয়ে দিচ্ছে। মেয়েটা এমন দৃশ্য দেখে চেঁচিয়ে উঠলো। অরুণিকা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো মেয়েটির দিকে। মেয়েটি মুহূর্তেই চেচামেচি করে পুরো গ্রাম মাথায় তুললো। চৌধুরী পরিবারের ছেলে-মেয়ে রুম বন্ধ করে কি না কি করছে, এমন অপ্রীতিকর কথা মোটেও শোভাজনক ছিলো না বড়দের কাছে। অরুণিকা মায়ের হাতে চড় খেলো বেশ কয়েকটা। আহনাফকে বাবা-চাচারা মিলে পিটিয়েই শান্ত হলো। শিরিন সুলতানা সবাইকে শান্ত স্বরে বুঝালেন, ছেলের জ্বর উঠেছে। তার ছেলের কোনো হুঁশ জ্ঞান নেই। সব দোষ অরুণিকার। কিন্তু অরুণিকার বয়স কম হওয়ায় সবাই আহনাফের উপরই দোষটা চাপিয়ে দিচ্ছে। তবে মূল অপরাধী তো বাড়ির বড়রা। তাদের ভুলটা কেউ চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল না।
যদিও তাদের মধ্যে বাড়াবাড়ি কিছুই হতে হতেও হয় নি, তবুও পুরো গ্রামে এ ঘটনা যতোটুকু ছড়িয়েছে, তা মারাত্মক বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলো। তারা সবাই পরদিন সকালেই গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে যেতো, কিন্তু গ্রামে রাতারাতি এই মিথ্যে গুজব ছড়িয়ে পড়েছে যে অরুণিকা আর আহনাফের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে, যা চৌধুরী পরিবারের জন্য অনেক লজ্জাজনক ঘটনা। শেষমেশ এলাকার প্রবীণরা দু’জনের বিয়ের ব্যবস্থা করার পরামর্শ দিলেন, নয়তো এই পাপের জন্য চৌধুরী পরিবারের সাথে সামাজিক যোগাযোগ ছিন্ন করতে বাধ্য হবে তারা। ব্যস, সেই শীতের রাতের এমন উদ্ভট ঘটনার কারণে আঠারো বছরের আহনাফের সাথে তেরো বছরের অরুণিকার ধর্মীয় রীতিনীতিতে সেদিন বিকেলেই বিয়ে হয়ে গেল। যদিও পুরো পরিবার বাধ্য হয়ে এই বিয়েতে সম্মতি দিয়েছিল, কিন্তু আহনাফ মন থেকে এই বিয়ে মেনে নিয়েছিল। অন্যদিকে বিয়েটা অরুণিকার মাথার উপর দিয়েই গেল। সে বুঝলোই না, তার জীবনে কি থেকে কি হয়ে গেল! তবে কাল রাতের অপরাধের জন্য যে সে পরিবারের সবার সামনে মায়ের হাতে চড় খেয়েছে, তার জন্য আহনাফের উপর খুব রেগে আছে অরুণিকা। এদিকে এই ঘটনার পর আহনাফের মা, শিরিন সুলতানার সাথে আহনাফের দাদার পরিবারের সম্পর্ক শিথিল হয়ে পড়ে। তিনি আহনাফ আর অরুণিকার বিয়েটা কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারেন নি। বিয়েটা ভাঙার জন্য প্রায়ই স্বামীর সাথে ঝগড়াঝাঁটি করতে থাকেন। অরুণিকার কাছ থেকে আহনাফকে দূরে সরানোর জন্য পরিবারের সাথে তার সম্পর্ক ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়। শেষমেশ অরুণিকার দাদা, নওয়াজ চৌধুরী তাদের যৌথ পরিবার ভেঙে দেন। তার নিজস্ব দশতলা ভবনটিতে সন্তানদের আলাদা ফ্ল্যাট দিয়ে দেন। এরপর যে যার মতো পৃথক হয়ে যায়। কিন্তু তবুও আহনাফকে কেউ আটকাতে পারলো না। হুটহাট অরুণিকার সাথে দেখা করতে চাচার বাসায় চলে যায় সে। কেউ কিছু বললেই চেঁচিয়ে বলে, “আমার বউ, আমি দেখা করতে এসেছি। তোমাদের কি সমস্যা?”
আহনাফের এমন ব্যবহারে অরুণিকার বাবা-মাও যথেষ্ট বিরক্ত ছিলেন। কিন্তু বিয়ে তো হয়েই গেছে। তাদের কি করার আছে! এদিকে আহনাফও সীমালঙ্ঘন করে নি আর। সেই রাতের জন্য অরুণিকার কাছে ক্ষমা চেয়েছিলো অনেকবার। তবে অরুণিকা মাস পেরুতেই সব ভুলে গেলেও, আহনাফ সেই শীতের রাত তাকে আর ভুলতে দেয় নি। বারংবার মনে করিয়ে দিয়ে ক্ষমা চাইতো, আবার একটুখানি ছুঁয়ে দিয়ে পুনরায় ক্ষমা চেয়ে নিতো। আহনাফের এমন দু’ মুখো আচরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল অরুণিকা। ধীরে ধীরে সেই অভ্যস্তের প্রতিই মায়া জমে গেল তার। ওদিকে ইশমাম আর বাঁধনের প্ররোচনায় এমন বিদঘুটে একটা কাজ করে বসেছিল আহনাফ। তাদের কথায় আজ তার ভালোবাসায় কলঙ্ক লেগে গেছে। এখন তো সেই গ্রামে তাদের ভালো চোখে কেউই দেখবে না। ভালোবেসে সবার চোখে সারাজীবনের জন্য মাথা হেঁট হয়ে গেছে তার। তাই ইশমাম আর বাঁধনের সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দিল সে। এরপর সিদ্ধান্ত নিল দায়িত্ববান পুরুষ হয়ে তার ছোট্ট বউকে নিয়ে আলাদা সংসার করবে। কিন্তু হুট করেই তার জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেল।
(***)
তাহসিনের কন্ঠে ঘোর কাটলো আহনাফের। অতীতের স্মৃতি থেকে বেরিয়ে এলো সে। এরপর অরুণিকার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, “তুই আমার সাথে এমনটা কেন করলি, অরু? আমাকে একটু সময় দিতি। আমি তো তোর জন্য নিজেকে গড়া শুরু করেছিলাম। তুই কেন আমার জীবনটা এলোমেলো করে দিলি? আমাকে সেই শীতের রাতের শাস্তিটাই দিয়েছিলি, তাই না? আমিও তোকে ছাড়বো না।যেই কলঙ্ক ঘুচে দেওয়ার জন্য আমি সব চেষ্টা করতে চেয়েছিলাম, সেই কলঙ্ক দিয়েই তোর সব হিংসে আমি গুঁড়িয়ে দেবো। আমার কাছের মানুষকে আমার কাছ থেকে কেঁড়ে নেওয়ার শাস্তি আমি তোকে দেবোই। আমি তোকে কখনো মাফ করবো না, অরু।”
চলবে–
#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-১৬ ||
শূন্য দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে তাহমিদ। হাতে একটা নীল ডায়েরি। ডায়েরির পৃষ্ঠা ফাঁকা। হাতে থাকা কলমে কালি নেই। তবুও সে একটু পর পর শূন্য দৃষ্টি ডায়েরিতে নামিয়ে সাদা পৃষ্ঠায় খালি কলম দিয়ে কি যেন লিখছে। কালি না থাকায় সাদা পৃষ্ঠায় কোনো দাগ পড়ছে না। তূর্য ছাদে উঠে তাহমিদের এমন উদ্ভট কর্মকান্ড দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তাহমিদ পাশে কারো উপস্থিতি পেয়ে ডায়েরিটা বন্ধ করলো। তূর্য বুকে হাত গুঁজে বলল, “কিছুই তো লিখলি না।”
তাহমিদ মৃদু হেসে বলল, “যার দেখার, সে তো দেখছে।”
তূর্য তাহমিদের কাঁধে হাত রেখে বলল, “মুভ অন করা উচিত তোর। যা সম্ভব না, তাতে নিজেকে আটকে রেখে লাভ নেই।”
তাহমিদ তূর্যের দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ হাসলো। তূর্যের সেই হাসি সহ্য হলো না। মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, “তোদের লাইফের ট্রাজেডি দেখলে আপসোস হয় খুব। কেন যে তোদের সাথে বন্ধুত্ব হলো! তোদের জ্বালায় নিজেও শান্তি পাচ্ছি না। এদিকে তুই কার জন্য বসে আছিস, নিজেও জানিস না। ওদিকে আরাফ প্রতিশোধের নেশায় নিজেকেই চেঞ্জ করে ফেলেছে। ও নিজেও জানে না ও কি ছিল, এখন কি হয়ে গেছে। আর এদিকে আহনাফ, ওর অবস্থাও আরাফের মতো। টুইংকেলের সাথে ওর আচরণ আমার মোটেও ভালো লাগছে না। যেই ইন্সিডেন্ট নিয়ে ও টুইংকেলের সাথে রেষারেষি করছে, ওটাও অনেক ভাবার বিষয়। আর ইভান তো অন্ধের মতো আহনাফকে সাপোর্ট করছে। আমার ক্লোজ ফ্রেন্ড, তাই আমিও ওর পক্ষ নিচ্ছি। কিন্তু ইদানীং আমার টুইংকেলকে দেখলেই মায়া লাগে। মেয়েটার সাইড তো কখনো শুনলামই না আমরা। এমনও তো হতে পারে ও সব সত্য বলছে। কেউ একজন আছে, যে সেই ইন্সিডেন্টটা ঘুরিয়ে দিয়েছে।”
“আহনাফ কখনোই এমন করবে না। অরুকে পাগলের মতো ভালোবাসতো ও। অরু আর ওর সম্পর্ক কেউ মেনে নেবে না, তাই কেমন বিশ্রী একটা কান্ড বাঁধিয়ে বিয়ে করেছিল অরুকে। কিন্তু পাঁচ বছর আগের সেই ইন্সিডেন্টের পর হুট করে আহনাফ চেঞ্জ হয়ে গেল? এখন তো ওকে দেখলে মনেই হয় না ও অরুকে ভালোবাসে। শিরিন চাচী ওদিন কতো কথা শোনালো অরুকে। কিন্তু আহনাফের একটুও খারাপ লাগলো না। কি অদ্ভুত ছেলেটা!”
“আমি চাই, অন্তত সব আগের মতো হয়ে যাক। ওদের ডিভোর্স হোক, এটা আমি চাই না। টুইংকেল চৌধুরী ম্যানশনে ফিরে আসুক, এটাই চাই।”
“কিন্তু এটা তো তোর চাওয়ার কথা না। তোরা তো আর অরুকে পছন্দ করিস না।”
“কারণ টুইংকেল যেটা করেছে, সেটা অনেক বড় অপরাধ ছিল। এর চেয়ে বড় অপরাধ আহনাফের সাথে করেছে ও। এতোটুকু একটা মেয়ে এমন জঘন্য কাজ কীভাবে করতে পারলো? ক্লাস নাইনে পড়তো ও। এতোটুকু একটা বাচ্চা মেয়ের মাথায় এমন চিন্তা আসেও বা কীভাবে?”
তাহমিদ উঠে দাঁড়িয়ে বিরক্তির সুরে বলল, “তোর বেস্ট ফ্রেন্ডকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর। ইঁচড়েপাকা তো ও বানিয়েছিল অরুকে। সঙ্গ দোষেরও একটা প্রভাব আছে। তোর বন্ধুর মাথায় যে শয়তানি, আমার তো মনে হয় সব ফাতরামি ওরই ছিল। আই প্রমিজ, যদি কখনো জানতে পারি, অরুকে সেদিন ও ফাঁসিয়েছিল, তোর বন্ধুর চেহারা পালটে দেবো একদম।”
তূর্য ভ্রূ কুঁচকে তাকাল তাহমিদের দিকে। তাহমিদও হনহনিয়ে ছাদ থেকে নেমে পড়ল।
(***)
কালো টি-শার্টের সাথে হাফ-প্যান্ট পরে ঘরে ঘরে হাঁটছে রুদবা। আজ বাসায় কেউ নেই। রহস্য ব্যান্ডের গান জোরে চালিয়ে দিয়েছে সে। ছাদ থেকে নেমে ঘরে ঢুকতেই তূর্য থমকে গেল। পাশের ফ্ল্যাট থেকে ভেসে আসছে নিজের গাওয়া গান। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বেল চাপলো সে৷ রুদবা গানের তালে তালে লাফাচ্ছে, আর ঘর পরিষ্কার করছে। বেলের শব্দ শুনেই কাজ ফেলে লাফাতে লাফাতেই দরজার কাছে গিয়ে পীপহোলে তাকাল। দেখলো, তূর্য দাঁড়িয়ে আছে। খুশিতে আধখানা হয়ে দরজা খুলে দিল সে। তূর্যকে দেখে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে ভুলেই গিয়েছিল সে একটা হাফ-প্যান্ট পরেছে। তূর্য রুদবার দিকে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো। রুদবা মৃদু হেসে মাথা নিচু করতেই নিজের পায়ের দিকে চোখ পড়লো তার। নিজেকে দেখে লজ্জায় গাল লাল হয়ে গেল রুদবার। তূর্যের মুখের উপর ধড়াম করে দরজাটা লাগিয়ে, বন্ধ দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে নিজের গালে নিজেই চড় মারলো সে। চোখ-মুখ খিঁচে বিড়বিড় করে বলল, “ছি! লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে ফেলেছি আমি।”
এদিকে তূর্য নিঃশব্দে হাসল। মনে মনে বলল, “মেয়েটার মাথায় নিশ্চিত সমস্যা আছে। আমাকে দেখলেই হুঁশ-জ্ঞান থাকে না। বাট ইটস নট মাই ফল্ট, আমি যদি স্মার্ট হয়ে মেয়েদের ক্রাশ হই, এটা তো আমার সমস্যা না। ওদের ছ্যাঁকা খাওয়ার শখ হলে আমার কি করার আছে!”
(***)
রাস্তার ফুটপাত দিয়ে হনহনিয়ে হাঁটছে রুহানি। হাঁটতে হাঁটতে যারাই সামনে পড়ছে, তাদের বিরক্ত মুখে বলছে, “অন্ধ না-কি? সুন্দর মেয়ে দেখলেই ধাক্কা দিতে ইচ্ছে করে, তাই না?”
অথচ রুহানিই এক ধুনে হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে আবার ধাক্কা লাগায় এবার হুমড়ি খেয়ে সে পিছিয়ে পড়তেই কারো বুকের সাথে ধাক্কা খেল। সামনে তাকিয়ে দেখলো বিদ্যুতের খুঁটির সাথে ধাক্কা লেগেছে। খুঁটিটার সাথে তো যুদ্ধ করা সম্ভব নয়, তাই পেছন ফিরে যেই মানুষটা তাকে ধরেছে তার সাথেই ঝগড়া করতে হবে। রুহানি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কোমড়ে হাত রেখে পেছন ফিরে চেঁচাতে যাবে, ওমনি আরাফের রাগী মুখের দিকে তাকিয়ে চুপসে গেল। আরাফ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রুহানির দিকে তাকিয়ে বলল, “অন্ধের মতো হাঁটছো কেন?”
রুহানি কি বিষয়ে ঝগড়া করবে, আরাফের রাগী চেহারা দেখেই তা ভুলে গেছে। সে ভাবতে লাগলো, কেন তার মেজাজ খারাপ ছিল। এদিকে রুহানিকে অন্যমনস্ক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আরাফ চেঁচিয়ে বলল, “যা ইচ্ছে করো, কিন্তু রাস্তা থেকে সরো। খাম্বার মতো আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
রুহানি কেঁপে উঠলো আরাফের চিৎকারে। বুকে ফুঁ দিয়ে বলল, “আপনি তো মিল্লুর চেয়েও চিল্লু।”
আরাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কি?”
রুহানি আমতা-আমতা করে বলল, “মিল্লু, আই মিন মিলান স্যার। আমাদের কলেজের স্যার, মিলান। উনার চেহারাটা দেখলে আপনি নিজেই বুঝবেন। সারাদিন মুখটা কৃমির মতো করে রাখবে। ওয়াক থু।”
রুহানি নাক সিঁটকে এমন ভান ধরলো যেন সে এখনি বমি করে দেবে। আরাফ এখনো রুহানির দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রুহানি বলল, “সেই মিলান স্যার অনেক চেঁচায়। তাই আমরা উনাকে মিল্লু ইজ ইকুয়েল টু চিল্লু বলে ডাকি। এদিকে আপনি তো মিল্লু প্রো-ম্যাক্স।”
“হোয়াট!”
রুহানি আরাফকে শান্ত করিয়ে বলল, “সরি, সরি। আপনি তো আমার শ্রদ্ধেয় কাজিন ভ্রাতা।”
“হোয়াট!”
“মানে অরুণিকার ভাই। আমার কাজিন ভ্রাতা।”
“এই উদ্ভট শব্দগুলো তুমি বানিয়েছো?”
রুহানি এক গাল হেসে মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, সুন্দর না? আমাকে তো বাংলা একাডেমি থেকে পুরষ্কার দেওয়া উচিত, তাই না?”
“হাউ ফানি!”
“ইটস নট ফানি! আমি সিরিয়াস।”
আরাফ চোখ ছোট করে বলল, “রাস্তা ছাড়ো।”
রুহানি পেছন ফিরে এদিক-ওদিক তাকালো। এরপর আরাফের দিকে চোখ ছোট করে তাকিয়ে বলল, “আপনার কথার মানেটা কি?”
“মানেটা কি মানে?”
“রাস্তা ছাড়ো বললেন যে?”
“বাংলা একাডেমি থেকে পুরষ্কার নেওয়ার স্বপ্ন অথচ বাংলা ভাষায় বুঝো না?”
“অবশ্যই বুঝি। কিন্তু আপনার কথাটা মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। আমাকে কি আপনার মোটা মনে হচ্ছে? যেভাবে বলছেন, মনে হচ্ছে আমি রাস্তায় গোল কিপারের মতো দাঁড়িয়ে আছি, আর আপনি বল, গেলেই আটকাবো। পাশে এতো বড় রাস্তা, ওদিক দিয়ে যেতে পারছেন না?”
আরাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুহানিকে পাশ কাটিয়ে সামনে চলে গেল। রুহানি জোর গলায় বলল, “আসলে এটা মেয়েদের সাথে কথা বলার টেকনিক। কি বলবে মাথায় আসছে না, তাই আমাকে সরতে বলছে। আমি কি বোকা? সিক্সথ সেন্স খুব ভালো আমার।”
আরাফ পেছন ফিরে রুহানির দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকাতেই রুহানি মুখ ঘুরিয়ে নিলো। এমন ভাব দেখাচ্ছে, যেন সে আরাফকে চেনেই না। আরাফ দাঁত কটমট করে বলল, “ইডিয়ট।”
বলেই চলে গেল। রুহানি আরাফের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলল, “বাঘের মুখ থেকে বেঁচে ফিরেছি। এতো বড় মিশন কমপ্লিট করেছি। আসলেই একটা জিনিয়াস আমি। শুধু শুধু স্যারটা বললো আমি গাধা। গাধা হলে কি এমন ডাক্তারি পরা ছেলেকে টপকে দেই? কথায় তো আমার সাথে ডাক্তারও ফেইল। যেখানে আমার সামনে একটা আধা ডাক্তার ফেইল, সেখানে আমি কিভাবে গাধা হই? পড়ালেখা করলে আমিও পাশ করবো। পড়ি না আর-কি। পড়ালেখা ভালো লাগে না। কিন্তু এখন মাকে কি বলবো? ফিজিক্সে আবার ফেইল করেছি। স্যার তো আমাকে টেস্ট পরীক্ষা দিতেই দেবে না আর। ধুর, বাবা আমাকে বিয়েটা দিয়ে এই নিউটন-আইনস্টাইনের হাত থেকে বাঁচাতো! এসব ছ্যাঁচড়া বিজ্ঞানীগুলো যে আমাকে এভাবে উত্যক্ত করছে, একটা কেইসও করতে পারছি না ওদের বিরুদ্ধে। দুর্বলদের কথা কে শুনে! বেচারি আমি।”
(***)
রুদবার কিছু নোট নিয়েছিল অরুণিকা। সেগুলো ফেরত দিতেই তার বাসায় গেল সে। নোট দিয়ে সন্ধ্যায় বেরুতেই সিঁড়িতে আহনাফের মুখোমুখি হল। অরুণিকা আহনাফকে পাশ কাটিয়ে নিচে নামতে যাবে, আহনাফ তার সামনে এসে দাঁড়াল। অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “আমাকে নিজেই নিজের ঘরে টেনে নিয়ে, আমার উপর খুব সহজে মিথ্যে অপবাদ লাগিয়েছো তুমি। আর এখন আমার সামনে আমার রাস্তা ধরে রেখেছো?”
“রাগ করেছিস?”
অরুণিকা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “রাগ? তোমার উপর কোনো রাগ নেই আমার। উল্টো তোমাকে দেখলেই এখন আমার গা ঘিনঘিন করে। বমি আসে। করে দেবো?”
আহনাফ গম্ভীরমুখে বলল, “তোকে শাস্তি দিয়েছি আমি। আমাকে যেই আঘাত দিয়েছিস, তার শাস্তি।”
“ওহ প্লিজ, তুমি নিজে নিজে আঘাত পেয়ে বসে থাকলে আমার কিছুই করার নেই। এন্ড তুমি তোমার মাকে কি বলেছো? আমি তোমার রুমে গিয়ে তোমার কাছে চলে এসেছি? আ’র ইউ ক্রেজি? আমার তো মনে হচ্ছে, আমার এতো আঘাত দেওয়ার পরও তুমিই আমাকে ভুলতে পারছো না। তাই তো চট্টগ্রামে নিজেদের বাড়ি থাকার পরও আমি যেই এলাকায় থাকি, ওখানে ভাড়া নিয়েছো। এতো ইম্পোরটেন্স দাও আমাকে। আমার কাছ থেকে পাত্তা পাচ্ছো না, তাই বানিয়ে বানিয়ে গল্প তৈরি করে তোমার মা’কে শোনাচ্ছ। এমনিতেই বোঝা যাচ্ছে, তুমি আমাকে নিয়ে কতোটা ওবসেসড। নয়তো এতো মেয়ে থাকতে আমাকে সিআর বানিয়েছো, যাতে কাজের বাহানায় আমাকে নিজের রুমে ঢেকে এনে নিজের মানসিক তৃষ্ণা মেটাতে পারো।”
“শাট আপ, অরু।”
“ইউ শাট আপ। তোমার মতো ছেলেকে ভালোবেসেছিলাম আমি। ছি! নিজের চয়েজে নিজেরই ঘেন্না লাগছে। এতো ভালো ভালো ছেলে থাকতে, তোমার মতো ছ্যাঁচোর ছেলের প্রেমে পড়েছি আমি।”
“তুই একটু বেশি বলছিস মনে হয়!”
“শিক্ষা। তুমি আমাকে চমৎকার শিক্ষা দিয়েছো। তাই একটু শিক্ষিত মানুষের মতো কথা বলছি। এতোদিন তো অশিক্ষিত ছিলাম।”
আহনাফ অরুণিকার কোমড় জড়িয়ে ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে আনলো। অরুণিকা আহনাফের হাত সাথে সাথেই সরিয়ে দিয়ে বলল, “আমি মামাকে ফোন দিয়েছি। পঁচিশ বছর হওয়ার অপেক্ষা করতে হবে না। আমি এই বছরই ডিভোর্স নিচ্ছি।”
আহনাফের মুখ লাল হয়ে এলো। সে অরুণিকার হাত মুড়ে ধরে বলল, “আমাকে চিনিস না তুই। আমি তোকে ডিভোর্স দিচ্ছি না।”
“আমি একাই ফাইল করবো। তোমার কিচ্ছু লাগবে না৷ ইভেন, আমার বাবার ফ্ল্যাটটাও ভিক্ষা দিলাম তোমাদের।”
“বেশি কথা বলিস না। আমি তোকে ছাড়ছি না। এমন কিছু করতে গেলে আমি তোর সাথে আরো খারাপ কিছু করবো।”
“হ্যাঁ, করবেই তো। এবার রেইপ করবে আমি জানি। তারপর তোমার মায়ের আঁচল ধরে বলবে, মা আমি ঘুমিয়ে ছিলাম, অরুণিকা আমার গায়ে চড়ে বসেছে। রাইট?”
আহনাফ অরুণিকার হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, “আমাকে এতো খারাপ মনে করিস তুই?”
“তুমি ভালো? ওহ আই এম সরি, আমি জানতাম না চৌধুরী পরিবারে আহনাফ নামের কোনো ভদ্র ছেলে আছে।”
আহনাফ ক্ষীণ হেসে বলল, “তুই আমার কাছের মানুষটাকে কেঁড়ে নিয়েছিস। তোকে এমনি এমনি ছেড়ে দেবো আমি?”
অরুণিকা স্থির দৃষ্টিতে আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলল, “যদি আমাকে সেই ঘটনার জন্য দায়ী মনে হয়, আমাকে মেরে তোমার প্রতিশোধ নিয়ে নাও। কিন্তু আমাকে যদি জিজ্ঞেস করো, তাহলে আমি একটাই কথা বলবো, আমি সেই কাজ করি নি।”
“তুই ছাড়া ওখানে আর কে ছিল?”
“আমি যা জানি, তা তুমি কখনো বিশ্বাসই করবে না। ইনফ্যাক্ট কেউই বিশ্বাস করবে না। যেই মানুষটাকে হারানোর ক্ষোভ নিয়ে বেঁচে আছো, তাকে যদি ফিরিয়ে আনা যেতো, আমার কথাটা বিশ্বাস করানো সহজ হতো।”
“আমাকে বল, আমি বিশ্বাস করবো।”
“কখনো না। তোমাকে ভালোই চেনা আছে আমার। তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে না। উলটো আমি সত্য বললে, আমাকে মেরে ফেলবে। আমার বেঁচে থাকার ইচ্ছা আছে। আমার বাবা-মা আমার জন্য নিজেদের লাইফ সেক্রিফাইজ করেছে। আমি ওদের সেক্রিফাইজ এমনি এমনি নষ্ট করবো না। তাও আবার তোমার মতো উগ্র মানুষের জন্য।”
চলবে–
#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-১৭ ||
লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে অরুণিকা। লিফটের দরজা খুলতেই ইমানের মুখোমুখি হলো সে। ক্যাম্পাসের লাইব্রেরি থেকে নামছে ইমান। অরুণিকা এখন লাইব্রেরিতে যাবে। ইমান একপাশে দাঁড়াতেই অরুণিকা লিফটে উঠলো। হালকা ঝুঁকে ইমান জিজ্ঞেস করলো, “লাইব্রেরিতে যাচ্ছো, তাই না?”
অরুণিকা ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “হুম।”
ইমান না নেমে লাইব্রেরিতে যাওয়ার জন্য লিফটের বাটনে চাপ দিল। অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে তাকালো ইমানের দিকে। ইমান হালকা হেসে বলল, “কাজ ছিল আরেকটা।”
লিফট লাইব্রেরিতে এসে থামলো। অরুণিকা নেমে পড়লো লিফট থেকে। ইমানও তার পিছু পিছু নেমে এলো। অরুণিকা লাইব্রেরিতে ঢুকে বাংলা সাহিত্যের সেকশনে চলে গেল। ইমানও সেদিকেই গেল। অরুণিকা থেমে পেছন ফিরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো ইমানের দিকে। ইমান মাথা চুলকে হেসে বলল, “তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।”
অরুণিকা কোনো উত্তর না দিয়ে সাহিত্যের সেকশনে হাঁটতে লাগলো। ইমান তার পিছু পিছু হাঁটছে। অরুণিকা ধীরস্থির ভঙ্গিতে বই দেখছে। অনেকক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করে একটা বই হাতে নিলো সে। বই নিয়ে পাশ ফিরতেই ইমানের মুখোমুখি হতেই বলল, “কিছু বলবেন?”
ইমান পাশের বেঞ্চ দেখিয়ে বলল, “বসে বলি?”
অরুণিকা বই নিয়ে একটা বেঞ্চে বসে পড়লো। ইমানও তার পাশে এসে বসলো। কিছুক্ষণ দু’জনের মাঝেই নীরবতা বিরাজ করলো। নীরবতা কাটিয়ে ইমান প্রশ্ন করলো, “আজ ক্লাস নেই?”
“ক্লাবের প্রোগ্রামের জন্য কয়েকটা ক্লাস ক্যান্সেল করেছে।”
“হ্যাঁ, সামার ফেস্ট, তাই হয়তো। তুমি আসবে না ফেস্টে?”
“আপনি আসবেন?”
“আমি তো সেক্রেটারি। আমার উপরই তো সব দায়িত্ব।”
“ভালোই।”
“তোমার কাজিন, আহনাফ স্যার, এত্তো বড় দায়িত্ব দিয়ে আমাকে তো ব্যস্তই করে দিয়েছেন।”
অরুণিকা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ইমান বেঞ্চে মাথা রেখে অরুণিকার দিকে ফিরে বসলো। ইমানকে এভাবে মাথা ফেলে তার দিকে তাকাতে দেখে অরুণিকা ইতস্ততবোধ করতে লাগলো। সে ঠোঁট কামড়ে বইটা খুললো। ইমান অরুণিকার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, “নার্ভাস?”
অরুণিকা চকিত দৃষ্টিতে তাকালো ইমানের দিকে। ইমান এবার মাথা তুলে গালে হাত দিয়ে অরুণিকার দিকে ঝুঁকে বসলো। অরুণিকা ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “এভাবে বসবেন না প্লিজ। এটা লাইব্রেরি।”
ইমান তৎক্ষণাৎ সোজা হয়ে বসে বলল, “সরি।”
অরুণিকা আবার বইয়ের পাতা উল্টালো। ইমান বুকে হাত গুঁজে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বলল, “ওদিন তুমি আহনাফ স্যারের বাসা থেকে কেঁদে কেঁদে ফিরেছিল কেন? বারবার বলছিলে ঠকে গেছি। কেন বলছিলে?”
অরুণিকা চোখ বন্ধ করলো। সে জানতো ইমান তাকে এই ব্যাপারে প্রশ্ন করবেই। রুদবাও করেছিল। কিন্তু রুদবাকে ভংচং বুঝিয়ে দিয়েছে সে। কিন্তু সে ইমানকে ভালোমতো চেনে না। কীভাবে বোঝালে যে তার কৌতূহল কাটবে সে নিজেও বুঝতে পারছে না। ইমান পুনরায় জিজ্ঞেস করলো, “বলবে না?”
অরুণিকা কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ইমানের দিকে। তারপর বলল, “ফ্যামিলি মেটার। আমার ওই ফ্যামিলির সাথে সম্পর্ক ভালো না। আমার বাবার ফ্ল্যাট আছে। আমার কোনো ভাইও নেই। তাই আমি ফ্ল্যাটটা পুরোপুরি পাচ্ছি না। ভাই না থাকায়, আমার চাচাতো ভাইদের হাতেই সব চলে যাবে। ওরা আমাকে কিছু টাকা দিয়ে বিদায় করতে চাচ্ছে। এজন্য ভুলিয়ে-ভালিয়ে আমার উপর নিজেদের মতামত চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে।”
ইমান অবাক হয়ে বলল, “স্যারকে যথেষ্ট ভালো মনে করেছিলাম। কিন্তু এমন শিক্ষিত মানুষের যদি এই অবস্থা হয়!”
অরুণিকা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে বলল, “এটাকেও তাহলে ভংচং বুঝিয়ে দিতে পেরেছি।”
ইমান অরুণিকার দিকে ঘুরে বসে বলল, “তুমি কী করবে এখন?”
অরুণিকা মুখ ছোট করে বলল, “জানি না।”
“আরেহ, ওদের মুখের উপর ফ্ল্যাটটা ছুঁড়ে মারো।”
অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে ইমানের দিকে তাকিয়ে বলল, “এতো বড় ফ্ল্যাট আলগাবো কীভাবে? ছুঁড়ে মারা তো স্বপ্ন!”
“আরেহ, কথার কথা। বুঝোও না দেখি। বলছি, দিয়ে দাও ওসব লোভীদের ওই ফ্ল্যাট। আর চ্যাপ্টারটাও ক্লোজ করে দাও।”
অরুণিকা ক্ষীণ হেসে বলল, “দেখি, কি হয়।”
(***)
আহনাফ ক্লাসে ঢুকতেই পুরো ক্লাসে চোখ বুলিয়ে নিলো। কোথাও অরুণিকাকে না দেখে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, “ক্লাসের সিআর কি ক্লাবে জয়েন করেছে? সিআর কোথায়?”
তাহসিন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “স্যার।”
“তোমার গ্রুপ মেম্বার কোথায়?”
“স্যার ও লাইব্রেরিতে গিয়েছিল।”
অরুণিকা তখনই ক্লাসের বাইরে এসে দাঁড়ালো। আহনাফ চোখ ছোট করে তাকালো অরুণিকার দিকে। এরপর মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে ইশারায় ক্লাসে ঢুকতে বলল। অরুণিকা ক্লাসে ঢুকে তাহসিনের পাশে বসে পড়লো। আহনাফও ক্লাস নেওয়া শুরু করলো। আজ সে সাদা শার্ট পরেছে, সাথে কালো ফরমাল প্যান্ট। ইন করে নি আজ। তবুও খুব সুপুরুষ লাগছে দেখতে। উজ্জ্বল শ্যামলা তার গায়ের রঙ। গরমে গাল লাল হয়ে যায়। সচারাচর ছেলেদের শ্মশ্রু কালো হয়। কিন্তু আহনাফের বাদামি। দেখলে মনে হবে মেহেদি লাগিয়েছে। কিন্তু এটা তার প্রাকৃতিক ভাবেই হয়েছে। চুলগুলোও বাদামি বর্ণের। আজ খুব গম্ভীরভাবে ক্লাস নিচ্ছে সে। মাঝে একটু-আধটু অরুণিকার দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু অরুণিকার দৃষ্টি বরাবরই বইয়ের দিকে নিবদ্ধ। অরুণিকার চোখাচোখি হতে না পারায় আহত হচ্ছে সে। সেদিন কি একটু বেশি বেশি করে ফেলেছে? ইভান তো বলেছিল, বেশি করলে অরুণিকাকেই হারিয়ে ফেলবে সে। সত্যি কি হারিয়ে ফেলবে? কিন্তু অরুণিকা তো তার বউ। এতো সহজে কি তাকে ছেড়ে যেতে পারবে অরুণিকা? আহনাফ ক্লাসের ফাঁকে এসবও ভাবছে। এদিকে আহনাফের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যতি। সে গালে হাত দিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছে আহনাফকে। আনমনে ভাবছে, “আহনাফ স্যার এতো স্মার্ট! উনাকে দেখার পর থেকেই মনে অদ্ভুত একটা ভালো লাগা কাজ করছে। জানি, উনি স্যার। এটা কখনো সম্ভব না। কিন্তু এই ভালো লাগার কি কোনো মানে আছে? তবুও বেশি ভালো লাগে আমার উনাকে। স্যারকে যদি বলতে পারতাম, আমি প্রায়ই উনাকে স্বপ্নে দেখি! অনেক সুন্দর সেই স্বপ্নগুলো। স্যার তো এখনো বিয়ে করেন নি। কিন্তু উনার পছন্দ তো থাকতেই পারে! ধুর, কি যা-তা ভাবছি।”
(***)
তূর্য গান শেখাচ্ছে। অনেকেই ভীড় করেছে তার ক্লাসের বাইরে। রুদবাও তাদের মধ্যে একজন। ক্লাসের ফাঁকে তূর্যের চোখ আটকালো রুদবার দিকে। চোখাচোখি হতেই রুদবা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে সরে পড়লো। নিজের গালে নিজেই চড় খেয়ে বলল, “নিজের মান-সম্মান কীভাবে ডোবাচ্ছি আমি? স্যার হয়তো বুঝে গেছেন, আমি তাকে দেখার জন্য এসেছি।”
রুদবা ধীর পায়ে হেঁটে কলা ভবনের একপাশে এসে দাঁড়ালো। হঠাৎ পাশে কারো উপস্থিতি পেয়ে চমকে উঠলো সে। পাশ ফিরে তূর্যকে দেখে অবাক হলো। তূর্য বুকে হাত গুঁজে বলল, “আমাকে দেখলে এমন নার্ভাস হয়ে যাও কেন?”
রুদবা কি বলবে বুঝতে পারছে না। সে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো অনেক মেয়েই তূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে। রুদবা নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল, “স্বাভাবিক, আপনি একজন সেলেব্রিটি। তাই হয়তো নার্ভাস লাগছে।”
তূর্য মৃদু হেসে বলল, “আমি কিন্তু তোমার প্রতিবেশিও।”
রুদবা তূর্যের দিকে তাকালো। তূর্য রুদবার চোখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ চোখ সরিয়ে নিলো। মুহূর্তেই তূর্যের মুখটা বিষন্নতায় ছেয়ে যেতে দেখে রুদবা বিচলিত স্বরে বলল, “কি হলো, স্যার?”
তূর্য পকেটে হাত গুঁজে সামনে তাকিয়ে বলল, “আমার ক্লাসের বাইরে এভাবে উঁকিঝুঁকি দেওয়া উচিত হচ্ছে না তোমার। তুমি টুইংকেলের ফ্রেন্ড, তাই তোমাকে বলে রাখছি।”
রুদবার মুখে ভীড় করলো মেঘের ঘনঘটা। সে ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “টুইংকেল কে?”
“ওহ, সরি। অরুণিকা। ওকে আমি একসময় টুইংকেল বলেই ডাকতাম।”
রুদবার মুখটা কালো হয়ে গেলো। সে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। তূর্য আর কিছু না বলে নিঃশব্দে হেঁটে চলে গেলো। এদিকে রুদবা ধীরে ধীরে তার আহত চোখ জোড়া উঠিয়ে তূর্যের যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে রইলো।
(***)
ক্লাস শেষ হতেই অরুণিকা কেন্টিনে রুদবার পাশে এসে বসলো। রুদবার মুখটা মলিন হয়ে আছে। অরুণিকা তার ব্যাগটা বেঞ্চে রেখে রুদবার দিকে হালকা ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলো, “কি-রে মুখটা অন্ধকার করে রেখেছিস কেন? বকা খেয়েছিস না-কি ইভান স্যারের?”
রুদবা অরুণিকার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই তো জানিস আমার প্রচুর বই পড়ার শখ।”
“হ্যাঁ!”
“কিন্তু তুই যখন থেকে রহস্য ব্যান্ডের গান শুনতে বললি, বইয়ে আর মন বসে না। সারাদিন আমি ওদের কন্সার্টের ভিডিও দেখি।”
“তো?”
“ওই ব্যান্ডের মেইন ভোকালিস্ট তূর্য শেখ..”
রুদবা এইটুকু বলে থামলো। ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে খেয়ে নিলো। অরুণিকা রুদবার হাত ধরে বলল, “কি হয়েছে?”
রুদবা চোখ-মুখ খিঁচে বলল, “আমার তূর্য স্যারকে ভালো লাগে।”
অরুণিকা চমকে উঠলো রুদবার কথায়। রুদবা অরুণিকার হাত ধরে বলল, “স্যার তোর পরিচিত, আমি জানি। তোর কাজিনের বন্ধু। প্লিজ তোর কাজিনকে বলে আমার সাথে একটু সেট করিয়ে দে।”
অরুণিকা রুদবার হাত এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে বলল, “অসম্ভব। তুই আমাকে এসব কথা বলছিস?”
“এসব কথা বলছি মানে?”
“সেট করিয়ে দে মানে কি? তুই এসব সেট-মেট নিয়ে কখন থেকে পড়ে আছিস! তুই শুধু ক্রাশ খেয়েই যদি এমন কথা বলিস!”
“তুই চাস না আমাদের মধ্যে কিছু হোক? তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, অরু।”
“তূর্য শেখকে তুই ভালোভাবে চিনিস না। আমি তোর বেস্ট ফ্রেন্ড, তাই তোকে বলছি উনার কাছ থেকে দূরে থাক।”
রুদবা হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অরুণিকার দিকে। অরুণিকা বলল, “উনাকে দেখে যতোটা সুইট মনে হচ্ছে, উনি ওরকম সুইট না।”
“তুই কীভাবে জানলি?”
“আমার কাজিনের বন্ধু। আমি চিনবো না? ছোটবেলা থেকে একই এলাকায় ছিলাম, একসাথে বড় হয়েছি।”
“আচ্ছা, কেমন উনি?”
“প্লে বয়। ব্যস, এর বাইরে আর কিছুই বলার নেই।”
“উনার গান কেন শুনতি তাহলে?”
“ভালো লাগতো, তাই শুনতাম।”
“প্লে বয়ের গান কেউ শুনে?”
অরুণিকা কপাল চেপে ধরে মনে মনে বলল, “আরেহ, তোকে কীভাবে বুঝাই, আমি তূর্যের জন্য সেই ব্যান্ডের গান শুনতাম না। ওদের আরো ভোকালিস্ট আছে। যাদের কেউ চেনে না, কিন্তু আমি জানি তারা কারা।”
রুদবা অরুণিকার হাত ঝাঁকিয়ে বলল, “বল!”
“পৃথিবীতে কতো সেলেব্রিটি আছে, যাদের মুভি দেখি আমরা। কিন্তু ওদের নামে কতো কেইস। তাই বলে কি মুভি দেখা বাদ দেই? দেই না তো! তো এসব কেমন প্রশ্ন, রুদবা? গান ভালো গায়, তাই বলে কি মানুষটাও ভালো হবে?”
রুদবা ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “তোকে টুইংকেল কেন ডাকে উনি?”
অরুণিকা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো রুদবার দিকে। টুইংকেল নামটা শুনে বুকটা কেঁপে উঠেছিল তার। অতীতের এলোমেলো স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল মুহূর্তেই। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে অরুণিকা বলল, “ছোট বয়সে কতোজন কতো নাম দিতো! ওরকম একটা নাম ছিল টুইংকেল। অনেকেই ওই নামে ডাকতো আমাকে।”
রুদবা হতাশ হয়ে বলল, “উনাকে যে আমার প্লে বয় মনে হয় নি! কিন্তু তুই যেহেতু বলছিস, তাহলে হয়তো হবে।”
অরুণিকা চুপ করে রইলো। রুদবা বলল, “উনাকে কি চেঞ্জ করা সম্ভব না?”
অরুণিকা রুদবার হাত ধরে বলল, “না। শুধু শুধু কি দরকার? ওদের ফ্যামিলিও অন্যরকম। তুই উনাকে ভুলে যা। ওখানে এডজাস্ট করা তোর পক্ষে সম্ভব না।”
“কেমন ফ্যামিলি!”
“আমি শুধু শুধু এসব বলতে চাচ্ছি না। কাউকে নিয়ে সমালোচনা করা ভালো না। এইটুকু বলবো, উনি তোর জন্য ভালো হবে না।”
রুদবা বিষণ্ণ মুখে বসে আছে। অরুণিকা রুদবার মুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো আর মনে মনে বলল, “তূর্য শেখ, আমার রকস্টার। মানুষটা অনেক ভালো রে, রুদবা। কিন্তু শুধু আমার জন্য। মানুষটাকে আমি চিনি। অনেক ভালো করে চিনি। তোকে কখনো ভালোবাসবে না তূর্য। তোকে আমি কখনো বলতে পারবো না তূর্যের অতীত। আপন মানুষদের সমালোচনা করা যায় না। তাদের দোষ ধরা যায় না। কিন্তু আমার হিরো, অন্য কারো জীবনে ভিলেন হয়ে এসেছিল। তোর জীবনে আবার সে ভিলেন হয়ে আসুক, আমি চাই না। তুই অনেক ভালো কাউকে ডিজার্ভ করিস।”
চলবে–