উত্তল তরঙ্গ পর্ব-০২

0
1

#উত্তল_তরঙ্গ
#পর্বঃ২
#লেখিকাঃদিশা_মনি

নেহার জ্ঞান ফিরতে সে নিজেকে একটা অন্ধকার ঘরে হাত-পা বাধা অবস্থায় আবিষ্কার করল। ভয়ে সে চিৎকার করে উঠল কিন্তু তার আর্তনাদের শব্দ যেন ঘরের চার দেয়ালেই চাপা পড়ে গেল। নেহা কাঁদতে শুরু করে দিলো। নিজের প্রতি হওয়া এই অবিচারের জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে নানা অভিযোগ দিতে লাগল। নেহা বলল,
“কেন আল্লাহ? কেন আমার সাথে এমন হলো? আমি তো কারো কোন ক্ষতি করি নি। কখনো কোন অন্যায় কাজও করি নি। তাহলে আমাকে এসব দিন কেন দেখতে হলো?”

এমন সময় হঠাৎ করে দরজা খোলার শব্দ হলো। নেহা বলে উঠল,
“কে?”

কিন্তু বিপরীত দিক থেকে কোন শব্দ হলো না। ধীরে ধীরে কেউ একজন এগিয়ে এসে নেহার সামনে বসে পড়লো। অতঃপর নিষ্ঠুর কন্ঠে বলল,
“এই খাবারটা খেয়ে নাও।”

কন্ঠটা চিনতে বেগ পেতে হলো না নেহার। এটা ঐ আহিরের কন্ঠস্বর। নেহা সাথে সাথেই চিৎকার করে উঠল। বলল,
“খাবো না আমি কিছু…পারলে আমায় বিষ এনে দিন..বিষ খেয়ে আমি নিজেকে শেষ করে দেই।”

“বিষ তো তুমি পাবে না সুইটহার্ট। কারণ তোমার জীবন বিষের থেকেও বিষাক্ত হবে। আর এখন এই খাবারটুকু তোমাকে খেতেই হবে।”

“খাবো না আমি। কি করবেন?”

আহির একটা বিদঘুটে হাসি দিয়ে নেহাকে নিজের ফোন বের করে একটা লাইভ ভিডিও
দেখায়। যেখানে নেহার বড় আব্বু আজমাইন চৌধুরী রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছেন অস্থিরচিত্তে আর তার দিকে বন্দুক তাক করে আছে আহির চৌধুরীর ঠিক করে দেয়া একটা লোক। নেহা এই দৃশ্য দেখে বলে ওঠে,
“নাহ, আমার বড় আব্বু..ওনার কোন ক্ষতি করবেন না প্লিজ।”

“যদি চাও যে, তোমার বড় আব্বুর কোন ক্ষতি না হোক তাহলে ভদ্র মেয়ের মতো এই খাবার খেয়ে নাও। আমার সব কথা মেনে চলো, তাহলে তোমার পরিবারের সবাই ভালো থাকবে। আর নাহলে..”

“বেশ, আমি খাব। তবুও আমার বড় আব্বুর কিছু করবেন না।”

“গুড গার্ল।”

বলেই আহির নেহার মুখের সামনে খাবার ধরলো। নেহা বলল,
“আমার হাতের বাঁধন খুলে দিন। আমি নিজের হাতে খেতে চাই।”

“আমাকে কি এতটাই বোকা ভেবেছ? খেতে হলে তোমায় আমার হাতেই খেতে হবে।”

“আপনার মতো একটা জঘন্য মানুষের হাতে আমি কিছুতেই খাবো না।”

“মনে হয়, তুমি নিজের বড় আব্বুর ভালো চাও না।”

নেহা চোখ বন্ধ করে দাঁত খিচে বলল,
“বেশ, খাইয়ে দিন আমায়।”

আহির নেহাকে খাইয়ে দিতে লাগল৷ নেহাও চুপচাপ খেতে লাগল। খাওয়া শেষ হতেই আহির উঠে যেতে লাগল এমন সময় নেহা অস্থির চিত্তে বললো,
“এভাবে আর কতদিন আমায় বন্দি করে রাখবেন? কেন করছেন আমার সাথে এমন?”

“যতদিন না পর্যন্ত তুমি আমার সন্তানের মা হবে ততদিন তোমায় এভাবেই থাকতে হবে। আর যদি কারণ জানতে চাও তো…সেটা তোমার না জানলেও চলবে আপাতত। সঠিক সময়ে আমি ঠিকই জানিয়ে দেব।”

“আপনি যা করেছেন তা জঘন্য অপরাধ। এর শাস্তি আপনি পাবেনই।”

বলেই নেহা কান্নায় ভেঙে পড়লো।

আহির বললো,
“শাস্তির ভয় এই আহির করে না। সে শুধু অন্যকে শাস্তি দেয়। যেমন এখন তোমাকে দেব, তোমার মাধ্যমে আরেকজনকে তার কৃতকর্মের ফল ভোগ করাবো।”

“মানে?”

আহির কোন প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে যায়।

এদিকে নেহা আবার বন্দি হয়ে পড়ে অন্ধকার চার দেয়ালের মাঝে।

★★
কয়েক মাস পর,
আজমাইন চৌধুরী হতাশ চিত্তে বসে আছেন সোফায়। বিপাসা চৌধুরী এক কাপ চা এনে তার সামনে রাখলো। আজমাইন চৌধুরী চায়ে চুমুক দিতেই তিনি বলে উঠলেন,
“তোমরা বাপ-ছেলে মিলে শুধু শুধু সময় নষ্ট করছ। যে হারিয়ে যায় তাকে খুঁজে পাওয়া যায় কিন্তু যে নিজের ইচ্ছায় লুকিয়ে থাকে তার খোঁজ তোমরা কিভাবে পাবে?”

আজমাইন চৌধুরী চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে,
“আমার নেহার সম্পর্কে কি আমার থেকেও বেশি জানো তুমি? হতে পারে ও আমার ভাইয়ের মেয়ে। কিন্তু ছোট থেকে ওকে আমি নিজের মেয়ের মতোই মানুষ করেছি। নিজের ছেলে আরাভের থেকেও বেশি ভালোবাসা দিয়েছি ওকে। আর ও নিজেও তো আমাকে নিজের বাবার যায়গাটা দিয়েছিল..”

কথা বলতে বলতেই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন আজমাইন চৌধুরী। তার গলার স্বর ভেঙে এলো। তিনি বললেন,
“তুমি তো জানতে বিপাসা আমার একটা মেয়ে বাচ্চার কত শখ ছিল। কিন্তু আল্লাহ আমাদের শুধু একটি ছেলে দিয়েছেন। তবে আমার ছোট ভাই ও তার স্ত্রীর একটা এক্সিডেন্টে মৃত্যুর পর ওদের মেয়ে নেহার দায়িত্ব নিয়ে আমার সেই মেয়ে শিশুর পিতা হবার শখ পূরণ হয়। তাই তো আমি সবসময় সবাইকে বলতাম, নেহা আমার ভাইজি নয় আমার মেয়ে..ওকে আমি নিজের থেকে এক মুহুর্ত দূরে রাখতে পারতাম না আর না ও আমার থেকে দূরে থাকত পারত। বাইরে কোথাও গিয়ে এক রাত অব্দি কাটায় নি। এমনকি বিদেশে এত ভালো স্কলারশিপ অফার পেয়েও যায়নি আমায় ছেড়ে থাকতে হবে বলে। এজন্যই তো আমি আরাভের সাথে ওর বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম যাতে ওকে নিজের কাছে রাখতে পারি সবসময়। আরাভ আর নেহাও তো একে অপরের পছন্দ করত। কত খুশি ছিল এই বিয়েটা নিয়ে। তারপর হঠাৎ করে কি থেকে কি হয়ে গেল আর..কোথায় চলে গেল আমার নেহা? দুই মাস ধরে ও আমার থেকে দূরে..যেই মেয়েটা এক মুহুর্ত আমাকে ছাড়া থাকত ও দীর্ঘ ৬০ দিন আমার পাশে নেই..এটা যেন আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না। আমি শতভাগ নিশ্চিত ও নিজে থেকে কোথাও যায়নি। ওকে আমি খুঁজে বের করবোই।”

বলেই আজমাইন চৌধুরী উঠে দাড়ান। অতঃপর আবারো বাইরে বের হন। বিপাসা চৌধুরী দীর্ঘ শ্বাস ফেলে চায়ের কাপটা নিয়ে চলে যান।

★★
নেহা ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে৷ এই দুই মাসে বন্দি থাকায় তার শরীর অনেকটাই ভেঙে পড়েছে। সুন্দর চেহারাতেও এসেছে মলীনতা। ডাক্তার তার চেকআপ করছিল৷ সামনেই ছিল আহির নামক ঐ শয়তানটা। চেকআপ শেষ হতেই আহির ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করল,
“কি হলো ডাক্তার? কি বুঝলেন?”

“কংগ্রাচুলেশনস মিস্টার আহির। অবশেষে আপনার ইচ্ছা পূরণের পথে। আপনি বাবা হতে চলেছেন। সি ইজ প্রেগন্যান্ট।”

কথাটা শুনেই আহির হেসে উঠলো। আর এদিকে নেহার গায়ে যেন বর্জ্যপাত হলো। সে চেচিয়ে উঠে বলল,
“নাহ, এটা হতে পারে না। এই জঘন্য লোকটার বাচ্চা কিছুতেই আমার মধ্যে বেড়ে উঠতে পারে না। আমি নিজেকে শেষ করে দেবো তবুও এনার বাচ্চার জন্ম দেয়ার কলঙ্কের ভাগীদার হতে পারব না..”

বলেই নেহা ফুপিয়ে উঠল। কিন্তু তার এর বেশি কিছু করার ছিল না। কারণ তাকে এখনো অব্দি বেধেই রাখা হয়েছিল। আহির ডাক্তারের দিকে একটা চেক এগিয়ে দিয়ে বলে,
“এই নিন, আমাকে এতো বড় একটা খুশির খবর দেয়ায় এটা আপনার পুরষ্কার।”

ডাক্তার খুশি মনে চেকটা নিয়ে বেরিয়ে গেল। এদিকে নেহার কান্নার গতি বাড়লো। বিগর দুই মাসে এই আহির নামক লোকটা জ্ঞানে অজ্ঞানে কতোবার যে নেহার সাথে ঘনিষ্ঠ হয়েছে তার কোন হিসাব নেই। বাচ্চা পাওয়ার জন্য এতোটাই নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছিল সে যেই এই দুইটা মাস নেহার জীবন একদম নরক বানিয়ে দিয়েছে। নেহার শরীরে থাকা বিভিন্ন আঁচড় ও কামড়ের দাগ যেন তার এই অসহায়ত্বের সাক্ষী হয়ে গেছে। নেহাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে দীর্ঘ ২ মাস যাবৎ অসংখ্যবার এই আহির নামক পুরুষের বাজে স্পর্শগুলো। তার দ্বারা ধ–র্ষিতা হবার গ্লানিগুলো!

নেহা পাগলের মতো বলতে থাকে,
“আমি কিছুতেই আপনার বাচ্চাকে জন্ম দেব না কিছুতেই না..”

কথাটা বলতে বলতেই তার সামনে ভেসে ওঠে তার প্রিয় পুরুষ আরাভ ভাইয়ের চেহারা। মনে ওঠে একসাথে কাটানো সুন্দর মুহুর্তগুলো। একে অপরকে দেয়া সব প্রতিশ্রুতি। মনে পড়ে নিজের বড় আব্বুর কথাও। নেহা বলে ওঠে,
“আর কখনো তোমাদের সামনে দাঁড়ানোর মুখ আমার রইল না..এর থেকে তো মৃত্যুও শ্রেয় ছিল!”
চলবে ✨