উত্তল তরঙ্গ পর্ব-০৩

0
1

#উত্তল_তরঙ্গ
#পর্বঃ৩
#লেখিকাঃদিশা_মনি

নেহার হাত-পায়ের ব্যাথা চরমে উঠেছে। দীর্ঘ ২ মাস থেকে এভাবে হাত-পা বাধা অবস্থায় জীবনযাপন করছে সে। ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে গেলেও মাঝে মাঝে এত ব্যথা অনুভূত হয় যে ইচ্ছা করে শরীর থেকে হাত পা কে*টে আলাদা করে দিতে। আজকেও যথাসময়ে নেহার শারীরিক চেকআপ ও খাবার খাওয়ানোর জন্য দরজা খোলা হলো। আহির এগিয়ে এসে নেহার পাশে বসে তার পেটে আলতো করে হাত বুলিয়ে বলল,
“আমার বাচ্চা কেমন আছ? নিজের বাবাকে মিস করছিলে?”

নেহা চরম ঘৃণা নিয়ে আহিরের দিকে তাকায়। কিন্তু কিছু বলে না। আজকাল এই লোকটার সাথে কথা বলতেও তার চরম ঘৃণা লাগে। এমন সময় আহিরের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা এক রমনী বল ওঠে,
“নিজের হবু বাচ্চার মায়ের সাথে আমার দেখা করাবি না আহির?”

আহির পিছন ফিরে তাকিয়ে হালকা হেসে বলে,
“অবশ্যই, এদিকে আয় নাতাশা। এই হলো নেহা চৌধুরী, আমার হবু বাচ্চার মা।”

নেহা এবার চকিতে তাকালো তার সামনে দাঁড়ানো এক রমনীর দিকে। পরণে ডাক্তারের পোশাক, চেহারায় আভিজাত্যের আভাস। নারীটি হেসে বললো,
“হ্যালো, মিস নেহা চৌধুরী। আমি হলাম ডাক্তার নাতাশা খান। এছাড়াও আমার আরো একটা পরিচয় আছে, আমি আহিরের বেস্টফ্রেন্ড। আপনার সাথে দেখা করে ভালো লাগল।”

এরইমধ্যে আহির নেহার মুখের সামনে খাবার ধরে বললো,
“এত কথা বলার টাইম নেই আজ আমার। এখান থেকে একটা জরুরি মিটিং এ যেতে হবে। জলদি খাবারটা খেয়ে নাও।”

নেহা আজ আর মুখ খুলল না। আহির রেগে বলল,
“রোজ রোজ তোমার এই এক নাটক আমার ভালো লাগে না নেহা। নিজের ভালো চাইলে চুপচাপ খেয়ে নাও নয়তো…”

আচমকা নাতাশা বলে উঠল,
“আহ, আহির মেয়েটার সাথে এমন ব্যবহার করছিস কেন? প্রেগন্যান্ট অবস্থায় একটা মেয়ের সাথে এমন ব্যবহার করলে তার বাচ্চার উপর খারাপ প্রভাব পড়তে পারে। তুই নিশ্চয়ই সেটা চাইবি না।”

আহির বিরক্তিতে “চ” জাতীয় শব্দ করে বলে,
“আরে..কি করবো আমি? এই মেয়েটা আমায় একটুও শান্তিতে থাকতে দেয় না। যবে থেকে এসেছে আমার মাথাটা খারাপ করে রেখে দিয়েছে। মরার খুব শখ ওর..আরে মরার হলে আমার বাচ্চাটা জন্ম দিয়ে যেখানে পারিস গিয়ে মরিস। কিন্তু যতদিন আমার বাচ্চা তোর পেটে আছে ততদিন তোকে বাঁচতে হবে।”

নাতাশা আহিরের হাত থেকে খাবারের থালাটা নিয়ে বললো,
“তুই বললি না তোর অফিসে কোন একটা জরুরি মিটিং আছে। তুই বরং সেখানে যা। ওকে আমি খাবার খাইয়ে দেব। ”

“তুই পারবি?”

“কেন? আমার ওপর ভরসা নেই তোর?”

“তোর থেকে বেশি ভরসা আমি আজ অব্দি কাউকে করেছি?”

বলেই আহির উঠে দাঁড়ায়। অতঃপর নেহার উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“আমি এখন যাচ্ছি। ফিরতে একটু দেরি হবে। এসে যদি শুনেছি তুমি আমার বান্ধবীর সাথে কোন খারাপ আচরণ করেছ বা ওর কোন কথা অমান্য করেছ তাহলে…বাকিটা পরে দেখে নেবো।”

বলেই সে বেরিয়ে যায়। আহিরের চলে যাওয়ার নিশ্চয়তা পেতেই নাতাশা ভাতের থালাটা নেহার মুখের সামনে নিয়ে এসে বলে,
“এসো,খাবারটা খেয়ে নাও।”

নেহা অশ্রুসিক্ত কন্ঠে বলে,
“খাবো না আমি। নিয়ে যান এই খাবার।”

“কেন মিছে জেদ করছ? এই জেদ করে কোন লাভ নেই। আমি আহিরকে যতোটা চিনি, তুমি যতোই জেদ করো। ওর জেদের কাছে হার মানতে হবে তোমায়।”

“আপনিও তো একজন নারী..উপরন্তু একজন ডাক্তার। আপনি অন্তত আমার দিকটা ভেবে দেখুন। কি অন্যায় করেছি আমি? কিসের জন্য আপনার বন্ধু আহির আমাকে এই নরকযন্ত্রণা দিচ্ছে? আরে ওনাকে তো আমি চিনিও না।”

নাতাশা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
“আসলে একটা কথা কি জানো, আমরা সবসময় যা ভোগ করি তা আমাদের নিজেদের কর্মফল নয়৷ অনেক সময় আমাদের আপনজনের করা কর্মের ফলও আমাদের ভোগ করতে হয়।”

“মানে?”

“Karma? শুনেছ শব্দটা। অনেকটা এমনই।”

“তার মানে কি মিস্টার আহির আমার উপর অন্য কারোর রাগ মেটাচ্ছে? কিন্তু আমি তো নির্দোষ। আমায় শাস্তি কেন দিচ্ছেন উনি?”

“লিসেন, এব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারবো না। কারণ আমাকেও আহির এই বিষয়ে কিছু বলে নি। আমি যতটুকু আন্দাজ করতে পেরেছি তাই তোমায় বললাম।”

“আপনি একজন নারী হয়ে আমার কষ্টটা বোঝার চেষ্টা করুন। ঐ আহির..উনি দীর্ঘ দিন আমায় এখানে বন্দি রেখে আমার উপর পাষবিক..উপরন্তু আমার গর্ভে ওনার নাজায়েজ সন্তান। আমি এটা মানতে পারছি না। আপনি আমায় সাহায্য করুন প্লিজ।”

“কি রকম সাহায্য চাও তুমি?”

“আমি এখান থেকে চলে যেতে চাই। ব্যস,আমায় শুধু এখান থেকে যাবার ব্যবস্থা করে দিন। আমি তাতেই খুশি।”

“তুমি একটু বেশিই আবদার করছ না?”

“আমার শুধু একটু মুক্তি চাই। জানেন, দীর্ঘ ২ মাস আমি এই ঘরের চার দেয়ালে মধ্যে বন্দি। ঠিকভাবে খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস পর্যন্ত নেই নি..”

“তোমায় এখান থেকে বাইরে পাঠিয়ে আমার তো কোন লাভ নেই উল্টে ক্ষতিই আছে। কারণ, আহির যদি জানতে পারি আমি তোমায় বাইরে পাঠিয়েছি তাহলে ও আমায়..”

“উনি কিছু জানবেন না। আপনি শুধু আমায় বাইরে বেরানোর ব্যবস্থা করে দিন।”

নাতাশা কিছু একটা ভেবে বলে,
“বেশ, আমি করব তোমায় সাহায্য তবে তোমাকেও তার জন্য আমার একটা কাজ করতে হবে।”

“কি কাজ?”

“আগে এই খাবারটুকু খেয়ে নাও তারপর বলছি।”

নেহা চুপচাপ খাবার খেয়ে নেয়। খাবারটা শেষ হতেই নেহা বলে,
“বলুন আমায় কি করতে হবে?”

“তোমার পেটের এই বাচ্চাটাকে নষ্ট করতে হবে।”

“মানে?”

“দেখো, আমি যা বলছি তোমার ভালোর জন্যই বলছি। তুমি যদি এখান থেকে বেরিয়ে যাও তাহলেও এই বাচ্চাটার কি পরিচয় দেবে? সমাজ কি বাচ্চাটাকে গ্রহণ করবে? সমাজে তো মুখই দেখাতে পারবে না।”

“কিন্তু আপনি কেন চান যে আমি বাচ্চাটা নষ্ট করি..আপনি তো আহিরের..”

“তোমায় এত কথা জানতে হবে না। তুমি পালাতে চাও কিনা বলো।”

“হ্যাঁ, চাই।”

” তাহলে আমি যা বলছি তাই করো। এখান থেকে বের হয়ে সরাসরি এই ঠিকানায় যাবে। এটা আমার একজন পরিচিত ডাক্তারের ঠিকানা। আমি ওখানে কথা বলে রাখব তুমি গিয়ে আমার নাম বললেই ওখানে ওরা তোমার এবোর্শনের ব্যবস্থা করে দেবে।”

বলেই নেহার হাতে একটা চিরকুট দিয়ে বলে,
“একটু অপেক্ষা করো, আমি তোমার পালানোর ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।”

নেহার মনে ভরসা জাগে। এবার সে পালাতে পারবে।

এদিকে নাতাশা মনে মনে বলে,
“আহির শুধু আমার..ও হয়তো আমার এই একতরফা ভালোবাসার অনুভূতি কখনো বুঝতে পারেনি, আমাকে শুধু বন্ধু ভেবেছে কিন্তু আমি ওকে সেই নজরে দেখি নি কখনো। আমি থাকতে অন্য কেউ ওর বাচ্চার মা হবে সেটা আমি হতে দেব না। তার জন্য যদি আমাকে আহিরের বিরুদ্ধে যেতে হয় তো যাবো। ছেলেদের মন বলা যায় না, যদি বাচ্চা হবার পর প্রতিশোধের নেশা ভুলে এই নেহাকে ও আপন করে নেয়..আমি বেঁচে থাকতে সেটা কিছুতেই হতে দেব না। না থাকবে এই বাচ্চা আর না থাকবে এই নেহা। আমি এমন ব্যবস্থা করে রেখেছি যে ওখানে গেলেই বাচ্চাটার সাথে সাথে ঐ নেহাকেও উনি শেষ করে দেবেন। আমার আর আহিরের মাঝে কেউ আসবে না, কেউ না।”
চলবে ✨