উত্তল তরঙ্গ পর্ব-০৪

0
1

#উত্তল_তরঙ্গ
#পর্বঃ৪
#লেখিকাঃদিশা_মনি

নেহা অসহায় চিত্তে রাস্তা ধরে হাটতে লাগল। এতদিন পর বাইরের আলোর সংস্পর্শে এলো সে। নেহা ভাবল, আর দেরি করা যাবে না এখনই তাকে হাসপাতালে যেতে হবে আর নিজের পরিবারের সাথেও যোগাযোগ করতে হবে। নেহা দ্রুতগতিতে পা চালাতে লাগল। এতদিন বন্দি থাকায় ঠিকভাবে হাটতেও পারছিল না। রাস্তায় হোচট খেয়ে পড়ছিল বারংবার। তবুও মনের সাহস নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল। চোখ বন্ধ করে নিজেই নিজের সাথে শপথ করে বলে,
“তোকে পারতেই হবে নেহা। নিজের জন্য এটা তোকে করতেই হবে।”

বলেই সে নতুন উদ্যমে উঠে দাঁড়িয়ে হাসপাতালে পৌঁছে যায়। হাসপাতালে পৌঁছে ডাক্তারের কেবিনের কাছাকাছি যায়। নাতাশার নাম বলতেই বাইরে থাকা ডাক্তারের সহকর্মী বলে ওঠেন,
“একটু অপেক্ষা করুন।”

নেহা বলে ওঠে,
“আপনার ফোনটা একটু দেবেন? আমার বাড়িতে যোগাযোগ করব।”

তিনি ফোনটা দেন। নেহা নিজের বড় আব্বুর নাম্বারে ডায়াল করে কিন্তু রিং হলেও ফোনটা রিসিভ হয় না। কিছু সময় পর রিসিভ হতেই আজমাইন চৌধুরী বলে ওঠেন,
‘হ্যালো কে?’

নেহা এতদিন পর নিজের বড় আব্বুর গলা শুনে আবেগে আপ্লূত হয়ে৷ কিন্তু সে কিছু বলতে যাবে তার আগেই হঠাৎ কেউ তার মুখ চেপে ধরে। নেহার কানে ফিসফিস করে বলে,
“পালানোর খুব শখ না তোর? তোর সব শখ এবার আমি বের করবো।”

★★

নেহার চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে তাকে নিয়ে এসে ফ্লোরে ফেলল আহির। ফুসে উঠে বলল,
“তোর সাহস কি করে হলো পালানোর চেষ্টা করার।”

নেহা নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল। সে তো এই জীবন থেকে মুক্ত হয়ে হাসপাতাল অব্দি পৌঁছেই গিয়েছিল৷ কিন্তু আহির কোনভাবে তার খোঁজ পেয়ে উপস্থিত হয় হাসপাতালে। আর তারপর তাকে আবার টানতে টানতে এই নরকে নিয়ে আসে। আহির নেহার কাছে এসে তার চুলের মুঠি আরো শক্ত করে ধরে বলে,
“শুধুমাত্র আমার বাচ্চা তোর পেটে জন্য তোর সাথে বেশি কিছু করতে পারছি না। নাহলে দেখিয়ে দিতাম আহিরের সাথে পাঙ্গা নেয়ার ফল কি হয়।”

এমন সময় নাতাশা সেখানে চলে আসে। শুকনো ঢোক গিলে বলে,
“আহির আসলে,,,”

আহির তেতে উঠে বলে,
“তুই তো কোন কথাই বলিস না। তোকে তো বিশ্বাস করেছিলাম আমি আর তুই..সেই বিশ্বাসের কি মান রাখলি? আমি তোর উপর ভরসা করে নেহাকে এখানে রেখে গেছিলাম আর ও কিভাবে তোর চোখে ফাকি দিয়ে পালাল?”

নাতাশা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ভাবে,
“যাক, আহির ভাবছে নেহা আমার চোখে ফাকি দিয়ে পালিয়েছে। এবার যে করেই হোক, আমায় ওর রাগটা কমাতে হবে যাতে সত্যটা ওর সামনে না আসে।”

নাতাশা বলে ওঠে,
“এই মেয়ে কতটা ধুরন্দর সেটা তুই জানিস না আহির৷ আমার চোখে ফাঁকি দিয়ে কখন যে পালিয়ে গেল আমি টেরই পেলাম না!”

নেহা নাতাশার দিকে তাকায়। নাতাশার দৃষ্টি একদম স্বাভাবিক। আহির বলে,
“এবার থেকে আমি এখানে নজরদারি আরো বাড়িয়ে দেব। দেখি ও কিভাবে পালায়..”

বলেই আহির বেরিয়ে যায়। নাতাশা নেহার দিকে তাকিয়ে বলে,
“খবরদার আহিরকে সত্যটা বলবে না। আমি তোমাকে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম কিন্তু তুমি সেই সাহায্য কাজে লাগাতে পারো নি। তবে আমার বিষয়টা যেন প্রকাশিত না হয়।”

“আপনি ভাববেন না। আমি আমার উপকারীর ক্ষতি চাইবো না।”

নাতাশা মনে মনে বলে,
“উপকারী না ছাই! তোকে দুনিয়া থেকে মিটিয়ে না দেয়া পর্যন্ত আমার শান্তি নেই। কিন্তু এখন তো আমার কিছু করারও নেই।”

★★
আজমাইন চৌধুরী দীর্ঘ শ্বাস ফেলে এসে বসলেন আরাভের পাশে। আরাভ নিজের বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
“নেহা হঠাৎ করে এভাবে কোথায় চলে গেল আব্বু? এভাবে কেউ কিভাবে হারিয়ে যেতে পারে?”

“জানি না..আমি কিচ্ছু জানি না। আমার আর কিছুই ভালো লাগছে না।”

“এই কয়েক মাসে একবারও আমাদের সাথে যোগাযোগও করল না।”

“যোগাযোগ বলতে মনে পড়ল আজ সকালে আমার ফোনে একটা কল এসেছিল…আমি অনেকক্ষণ হ্যালো হ্যালো করলাম কিন্তু বিপরীত দিক থেকে কোন উত্তর এলো না। তারপর ফোনটা কেটে গেল।”

“তুমি আর ঐ নাম্বারে ফোন দাও নি?”

“দিয়েছিলাম কিন্তু ফোন সুইচ স্টপ বলছিল।”

“হায় আল্লাহ! তুমি এই কথা আমাকে আগে কেন বলো নি আব্বু? এমনো তো হতে পারে যে নেহা কোন ভাবে আমাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিল। হয়তো ও কোথাও ভীষণ খারাপ অবস্থায় আছে।”

“তাই তো..আমি তো এটা ভেবে দেখি নি।”

“আব্বু..তুমি আমাকে ঐ ফোন নাম্বারটা দাও। আমি খোঁজ লাগিয়ে দেখছি।”

“আচ্ছা, ০১৮*********”

“আমার এক বন্ধু সিম কোম্পানিতে জব করে ওর মাধ্যমে দেখি যদি কোন খোঁজ পাই। প্রয়োজনে পুলিশকেও জানাবো।”

“দেখ কি করা যায়। ভালোয় ভালোয় মেয়েটাকে যদি ফেরত পাই তাহলেই হয়।”

এমন সময় বিপাসা চৌধুরী এসে বলেন,
“ঐ মেয়েকে ফেরত পাও আর যাই পাও, ওর স্থান কিন্তু এই বাড়িতে আর হবে না।”

আরাভ রেগে বলে,
“আম্মু..তুমি এমন কথা কেন বলছ?”

“তুই চুপ কর। ঐ মেয়েকে নিয়ে তোদের বাবা-মেয়ের অনেক আহ্লাদি আমি সহ্য করেছি আর না। ঐ মেয়েকে যদি তোরা এই বাড়িতে ফিরিয়ে আনার চিন্তা করিস তাহলে কিন্তু আমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।”

বলেই বিপাসা চৌধুরী চলে যান। এদিকে আরাভ নেহার সাথে কাটানো সুন্দর মুহুর্ত গুলো মনে করে। নেহাকে সেই ছোটবেলা থেকেই পছন্দ করত সে। প্রপোজও করেছিল। গোপনে তাদের কত দিনের সম্পর্ক ছিল। কত দিন তারা একত্রে সুন্দর মুহুর্ত কাটিয়েছে। একসাথে কত স্বপ্ন দেখেছিল বিয়ের পর একটা সুন্দর সংসার সাজাবে। এসব মনে করে সে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
“তুমি কি আমার জীবনে আর কখনো ফিরবে না নেহা? কেন আমায় ছেড়ে চলে গেলে? তুমি তো আমায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আজীবন আমার পাশে থাকবে। একে অপরের হাত ধরে হাজারটা বসন্ত কাটানোর স্বপ্ন দেখেছিলাম আমরা। তাহলে কোথা থেকে এসব কি হয়ে গেল?”

★★
“নেহা আমি এসে গেছি নেহা। আমি এখন তোকে এই বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে নিয়ে যাব।”

আরাভের মুখে এই কথাটা শুনে নেহা হাসিমুখে বলে,
” আমি জানতাম আরাভ ভাই, তুমি আমাকে নিতে আসবেই।”

“আমি তোকে বলেছিলাম না, তোর সব বিপদে আমি ঢাল হয়ে দাড়াবো। সেই কথা কিভাবে ফেলি কিভাবে?”

“আমাকে এই নরক থেকে নিয়ে চলো আরাভ ভাই।”

বারংবার এই কথাটা বিড়বিড় করে বলতে থাকে সে। এমন সময় আহির তার পাশে বসে বলে,
“স্বপ্ন দেখা শেষ হলে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠো।”

নেহা উঠে বসে। চারিদিকে তাকিয়ে সেই অন্ধকার দেখে বলে,
“তাহলে এটা স্বপ্ন ছিল..আরাভ ভাই আসে নি..”

আহির পিশাচের মতো হাসি দিয়ে বলে,
“এসব সুন্দর স্বপ্ন দেখা বন্ধ করো। তোমার জীবন আর কখনো সুন্দর হবে না।”

নেহা লক্ষ্য করে তার হাত-পায়ে কোন বন্ধন নেই আজ। সে আহিরের গলা চেপে ধরে আর বলে,
“কেন? কেন এমন করলি আমার সাথে?”

আহির দ্রুত নেহাকে চেপে ধরে আবারো শক্ত করে তার হাত বেধে দিয়ে বলে,
“ভেবেছিলাম একটু মুক্ত রাখবো। সেটাও তোর ভাগ্যে নেই।”

অতঃপর সে নাতাশাকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,
“সকল যন্ত্রপাতি নিয়ে এসেছিস তো? চেকিং করে দেখ আমার বাচ্চা ঠিক আছে নাকি।”

নাতাশা বিভিন্ন মেডিকেল যন্ত্রপাতি দিয়ে চেক করে। আহির জিজ্ঞেস করে,
“কেমন আছে আমার বাচ্চা?”

নাতাশা বলে,
“বাচ্চা নয় বল বাচ্চারা। আমি দুটি হার্টবিট শুনতে পাচ্ছি। মনে হয় ওর পেটে যমজ বাচ্চা আছে।”

“কি বলছিস?”

“ওয়েট, আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্ট হলে নিশ্চিত হতে পারব। ”

আহির ভীষণ খুশি হয়। এদিকে নেহা হতাশ হয়ে ভাবে,
“একটি নয় দুটি পাপ বহন করছি আমি!”
চলবে ✨