উত্তল তরঙ্গ পর্ব-০৫

0
1

#উত্তল_তরঙ্গ
#পর্বঃ৫
#লেখিকাঃদিশা_মনি

নেহার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে আরাভ ও তার বড় আব্বু। নেহা আবেগাপ্লুত। দৌড়ে গিয়ে সে নিজের বড় আব্বুকে জড়িয়ে ধরে। আজমাইন চৌধুরী নেহার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
“তুই একদম চিন্তা করিস না নেহা। আমরা এসে গেছি। আমরা এখান থেকে তোকে উদ্ধার করে নিয়ে যাব।”

নেহা আবেগপ্রবণ স্বরে বলে,
“তোমরা এসেছ..জানো এখন ঐ লোকটা…ঐ আহির এতদিন আমার উপর কত নিপীড়ন করেছে।”

আরাভ নেহার কাধে হাত রেখে বলে,
“এসব কিছুর জন্য এবার সে উচিৎ শিক্ষা পাবে। আমরা তোকে উদ্ধার করে নিয়ে যাব এখন।”

নেহার মন খুশিতে নেচে ওঠে। তার করা কলের সূত্র ধরেই হয়তো তারা দুজন আজ এখানে এসে পড়েছে। নেহা অবশেষে এই নরক থেকে মুক্তি পাবে!

হঠাৎ করে কারো ডাকে নেহার ঘুম ভেঙে যায়। নেহা চোখ খুলে আবারো সেই অন্ধকারের রাজ্যে আবিষ্কার করে নিজেকে। তার বুক চিরে বের হয় আরো একটি করুণ দীর্ঘ শ্বাস। আহির এগিয়ে এসে বলে,
“এই যে খাবারটা চুপচাপ খেয়ে নাও।”

নেহা নিজের পেটের দিকে তাকায়। পেটটা আগের থেকে অনেক ফুলে উঠেছে। আর ফুলবে না-ই বা কেন? এখন সে আট মাসের গর্ভবতী! এরইমধ্যে আরো ৬ মাস যে কিভাবে পেরিয়ে গেল চোখের পলকে নেহার কাছে তা বোধগম্য হলো না। নেহা শুধুই একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। চুপচাপ আহিরের হাতে খেতে লাগল। আজকাল আহিরের মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে। সে আর আগের মতো নেহার উপর রাগ করে না। হয়তো নেহার এই সেন্সেটিভ অবস্থার জন্যই। নেহাও আগের মতো আর অতিরিক্ত জেদ দেখায় না। আহির চুপচাপ নেহাকে খাইয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“আজ নাতাশা তোমার চেকআপ করতে আসবে। ভদ্র মেয়ের মতো ওর সব কথা মেনে চলবা।”

নেহা মাথা নাড়ায়। আহির খাবারের বাটিটা নিয়ে রুম থেকে বের হয়। নেহা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
“মুক্তির স্বপ্নটা আমার কাছে কেবল স্বপ্ন হয়েই রয়ে গেল। জানিনা, আদৌ কখনো এখান থেকে মুক্তি পাবো কিনা।”

কথাটা বলেই আবার সে কোনরকমে শুয়ে পড়লো বিছানায়। আজকাল তার কিছুই ভালো লাগে না। এই উচু পেট নিয়ে যেন আরো বেশি বিড়ম্বনায় পড়েছে।

★★
আরাভ ও আজমাইন চৌধুরী দুজনেই বিষন্ন মনে রুমে বসে আছে। আরাভ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
“৮ মাস..দীর্ঘ ৮ মাস পেরিয়ে গেল অথচ এখনো আমরা নেহার কোন খোঁজ পেলাম না!”

আজমাইন চৌধুরী বলেন,
“ঐ ফোনকলটা যদিও একটা আশা জুগিয়েছিল কিন্তু…”

আরাভ হতাশার দৃষ্টিতে তাকায়। মনে করে ৬ মাস আগের কথা। যখন তারা যেই সিম থেকে কল এসেছিল তার মালিকের নাম, ঠিকানা জেনে দেখা করতে যায়। এটি ছিল একজন মহিলার যিনি মেডিকেলে কাজ করেন। তারা দুজন সেই মহিলার সাথে দেখা করতে গিয়ে জানতে পারেন সেই মহিলা এখানে কাজ ছেড়ে দিয়ে অন্য কোথাও চলে গেছে। অনেক খুঁজেও সেই মহিলার আর কোন সন্ধান পাওয়া যায় নি। তাই তাদের শেষ আশার প্রদীপদাও যেন নিভে যায়। কথাটা ভেবেই আরাভ বলে,
“আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যদি কোনভাবে ঐ মহিলার সন্ধান পেতাম তাহলে হয়তো নেহার ব্যাপারে আমরা কোন না কোন তথ্য হাতে পেতাম।”

এমন সময় বিপাসা চৌধুরী সেখানে এসে বলেন,
“তোমাদের বাবা-ছেলের নেহা বন্দনা শেষ হলে একটু খেয়ে আমায় উদ্ধার করো।”

“আম্মু তুমি এভাবে কেন বলছ? নেহার জন্য কি তোমার একটুও খারাপ লাগে না?”

”না, লাগে না। আমি নিশ্চিত ঐ মেয়ে কোন বিপদে পড়েনি নিজের ইচ্ছাতেই কোথাও একটা গেছে। তাই ওর জন্য ওরা কেদে ভাসাতে পারিস আমি পারব না। আর আরাভ, আমি ঘটকের সাথে কথা বলেছি, তোর জন্য একটা ভালো মেয়ে..”

“আম্মু প্লিজ। এই বিষয়ে আর কোন কথা না।”

“তো কি করবি? ঐ নেহার অপেক্ষায় দেবদাস হয়ে বসে থাকবি?”

“প্রয়োজনে তাই করব। নেহা ছাড়া অন্য কাউকে নিয়ে আমি নতুন জীবন শুরু করতে পারব না। তাই তোমাকে আমি অনুরোধ করছি, এমন কিছু করো না।”

বিপাসা চৌধুরী নিজের স্বামী আজমাইন চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলেন,
“তুমি অন্তত ছেলেটাকে কিছু বোঝাও..”

“আমি কি বোঝাব বিপাসা? আমি নিজেই তো কিছু বুঝতে পারছি না। রোজ রোজ আর এই এক নাটক নিতে পারছি না। জানি না আল্লাহ আমায় এ কোন পাপের শাস্তি দিচ্ছেন।”

বলে তিনি বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ান।

★★
নেহার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে নাতাশা খান। তার চোখে বিরক্তি ফুটে উঠছে। শুধুমাত্র আহিরের কথামতোই নেহার চেকআপ করছে সে। কোনরকমে নেহার চেকআপ করে বলে,
“তোমার দুটো বাচ্চাই তো বেশ ভালো আছে।আহির শুধু শুধুই এত চিন্তা করে।”

নেহা উত্তরে কিছু বলে না। এই বাচ্চাদের প্রতি তার কোন মায়া নেই। তার কাছে এরা শুধু একটা অভিশাপ, তার দূর্ভাগ্যের প্রতীক। নেহাকে এত চুপচাপ দেখে নাতাশা বলে,
“তো কি ভাবলে এই বাচ্চা দুটোকে পৃথিবীতে আনবে?”

নেহা বলে,
“মানে?”

নাতাশার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে যায়। সে আশেপাশে সন্তপর্ণে তাকায়। কেউ নেই নিশ্চিত হয়ে নেহার হাতে চুপ করে একটা ওষুধ দিয়ে বলে,
“আর কেউ না বুঝলেও আমি বুঝি তুমি কি চাও। এই অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি চাও তুমি তাই তো? এমনিতেও তোমার জীবনে আর কিছু বাকি আছে। নিজের সবকিছুই তুমি হারিয়ে ফেলেছ। এখন আহির যা পরিকল্পনা করেছে তাতে সামনে তোমার জীবন আরো কঠিন হয়ে উঠতে চলেছে। তাই আমি তোমার ভালোর কথা ভেবেই এই ওষুধটা তোমায় দিচ্ছি। এটা এমন একটা মেডিসিন যা স্লো পয়জেনিং এর কাজ করবে। আজকে যদি তুমি এটা খাও তাহলে ধীরে ধীরে এটা তোমার শরীরে খারাপ প্রভাব ফেলবে। এক থেকে দেড় মাসে তোমার ইমিউনিটি সিস্টেম একদম ধ্বংস করে দেবে। তারপর তোমার মৃত্যু হবে আর সকলে ভাববে এটা সাধারণ মৃত্যু।”

নেহা হতবাক চোখে ওষুধটার দিকে তাকিয়ে থাকে। নাতাশা বলে,
“কি ভাবছ? এত কিছু ভাবার সময় নেই। তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও এই ওষুধ আর মুক্তি পাও এই নরকযন্ত্রণা থেকে।”

নেহা বিগত ৮ মাসে তার নারকীয় জীবন ভাবতে থাকে। সে ভাবে,
“উনি তো ঠিকই বলছেন। আমার এই জীবনের আর কোন আশা নেই। এটাই ভালো হবে যদি আমি নিজেকে শেষ করে দেই।”

কথাটা ভেবেই সে ওষুধটা খেয়ে নিতে যাবে এমন সময় হঠাৎ করে আহির সেখানে চলে আসে। যার ফলে নেহা দ্রুতগতিতে ওষুধটা ফেলে দেয় দূরে। আহির এসে নাতাশাকে জিজ্ঞেস করে,
“সবকিছু ঠিক তো?”

আহিরের আগমনে নাতাশা যারপরনাই বিরক্ত হয়ে বলে,
“আহির আর আসার সময় পেল না, আরেকটু হলেই এই আপদকে বিদায় করার ব্যবস্থা হয়ে যেত সাথে এর পেটের বাচ্চাদেরও।”

তবে আহিরের সামনে সে হালকা হেসে বলে,
“হ্যাঁ, তোর বাচ্চারা একদম ঠিক আছে।”

আহির নিশ্চিত হয়। নাতাশা নেহার পেটের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে,
“কিন্তু ওদের আমি ঠিক থাকতে দেব না। তোর সন্তানের মা শুধু আমি ভাবো, আমি আর আমার সন্তান পাবে তোর সমস্ত ভালোবাসা। অন্য কেউ না।”

এরমধ্যে নেহা হঠাৎ করে কাশতে থাকে। নাতাশা কিছু একটা ভেবে নিজের কাছে থাকা একটা পানির বোতল এনে নেহাকে পানি খাইয়ে দিতে থাকে। আর কৌশলে অনেক পানি মেঝেতেও ফেলে। কিন্তু অন্ধকার থাকায় তা বোঝা যায়না। নেহা পানি খেয়ে সামনের দিকে এগোতে যাবে এমন সময় হঠাৎ পানিতে পা পিছলে খুব জোরালোভাবে ফ্লোরে পড়ে গিয়ে আর্তনাদ করে ওঠে। আহির ছুটে এসে বলে,
“কি হয়েছে?”

নাতাশা বলে,
“আমি নেহাকে পানি খেতে দিয়েছিলাম হয়তো তখন পানি ফ্লোরে পড়েছিল আর সেই পানিতেই ও পিছলে গেছে..”

আহির দ্রুত নেহাকে টেনে তুলে রাগী কন্ঠে বলে,
“ঠিকভাবে খাওয়াতে পারিস নি? নেহা, তুমি ঠিক আছ তো?”

নেহা বলে ওঠে,
“আমার পেটে খুব ব্যথা করছে। আহ..”

এরইমধ্যে আহির একটা ভয়ংকর জিনিস লক্ষ্য করে। নেহার ব্লিডিং হচ্ছে..রক্ত পড়ছে দ্রুতগতিতে। সে নাতাশার উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“নাতাশা জলদি তোর মেডিকেল টিমকে ডাক। অবস্থা ক্রিটিকাল!”
চলবে ✨