উত্তল তরঙ্গ পর্ব-০৬

0
1

#উত্তল_তরঙ্গ
#পর্বঃ৬
#লেখিকাঃদিশা_মনি

নেহার শ্বাস যেন ক্ষীণ হয়ে আসছিল। চোখের সামনে বারবার ভেসে আসছিল জীবনের সুন্দর মুহুর্তগুলো। পেটটা যেন তীব্র যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছিল। নেহা এই কষ্ট আর বেশি সময় সহ্য করতে পারল না। কিছু সময় পর জোরে একটা চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল। আধার নেমে এলো তার চোখে।

এদিকে চিৎকারের শব্দ শুনে আহির ছুটে আসে রুমে। নাতাশা আহিরকে দেখে অবাক হয়৷ সে ভেবেছিল এই সুযোগে নেহা ও তার বাচ্চাদের শেষ করে দিয়ে বলবে দূর্ঘটনার কারণে এমনটা হয়েছে কিন্তু সেটা তো আর হবার নয়। আহির এসে বলে,
“কি অবস্থা ওর? আমার বাচ্চারা ঠিক আছে তো?”

নাতাশা বলে,
“আমি চেষ্টা করছি। কিন্তু বাচ্চাদের বাচানো যাবে কিনা বলা যাচ্ছে না।”

আহির রেগে এবার নাতাশার দিকে রক্তিম চোখে তাকিয়ে বলে,
“যদি আমার বাচ্চারা না বাঁচে তাহলে তুইও আর বাঁচবি না!”

“আহির? কি বলছিস তুই এসব?”

“হ্যাঁ, ঠিক বলছি। তুই জানিস না, এই বাচ্চারা আমার জন্য কত জরুরি। ওদের মাধ্যমেই তো আমি নিজের প্রতিশোধ পূরণ করব। আর আজ শুধু তোর ভুলের জন্য ওরা মরতে বসেছে। এটা আমি হতে দেব না। আমি কিচ্ছু জানতে চাই না, আমার বাচ্চা আর নেহা সবাইকে তোকে বাচাতে হবে নাহলে..”

বলেই একটা বন্দুক তাক করে নাতাশার দিকে তাক করে আহির৷ তার চোখ দিয়ে যেন আগুন বের হচ্ছিল। নাতাশা ভয় পেয়ে যায়। এতক্ষণ সে নেহাকে মারতে চাইছিল কিন্তু এখন নিজেকে বাঁচানোর জন্য নিজের জানপ্রাণ লাগিয়ে দেয় নেহা ও তার বাচ্চাদের রক্ষা করতে। আহির ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে।

নাতাশা ও তার মেডিকেল টিম নিজেদের কাজ চালিয়ে যায়। আহির মাঝে মাঝেই তাদের হুমকি দিয়ে বলে,
“যদি ওদের কিছু হয়ে যায় তাহলে এখান থেকে সবার লাশ বের হবে।”

ভয়ে তটস্থ হয়ে মন দিয়ে সবাই কাজ করতে থাকে। এভাবেই কিছু সময় কেটে যায়। নাতাশা বলে,
“আমাদের সিজার করতেই হবে। নরমালি এই বাচ্চাদের বাঁচানো যাবে না।”

আহির বলে,
“যা করা দরকার তাই কর শুধু আমার বাচ্চাদের আর নেহাকে বাঁচা।”

নাতাশা তার টিমকে সিজারের প্রস্তুতি নিতে বলে৷ অতঃপর ঐ বন্ধ ঘরের মাঝেই অপারেশনের সব জিনিসপত্র এনে জোগাড় করা হয় মুহুর্তেই আহিরের আদেশে।

সময় যেন থমকে গেছিল। আহিরের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ বাড়ছিল৷ কিছু সময় এভাবেই কেটে তারপর হঠাৎ,,,

বাচ্চার কান্নার আওয়াজ কানে এলো আহিরের। আহির ছুটে এলো নেহার বেডের কাছে। নাতাশা বিষন্ন মনেও যযথাসম্ভব স্বাভাবিক থেকে আহিরের কোলে একটা বাচ্চাকে তুলে দিয়ে বলল,
“তোর একটা মেয়ে হয়েছে..আরেকটা বাচ্চাকে এখনো পেট থেকে বের করা হয়নি একটু অপেক্ষা কর..”

আহির কাপা কাপা হাতে বাচ্চা মেয়েটিকে নিজের কোলে তুলে নেয়। বাচ্চাটার কান্নার আওয়াজ তাকে বিরক্ত করলেও কোলে নেয়ার সাথে সাথে সে এক অন্য অনুভূতির স্বাদ পায় পিতৃত্বের স্বাদ! আহির বাচ্চা মেয়েটির কান্না থামাতে তৎপর হয়ে ওঠে। মেয়েটিকে নিজের মুখের কাছাকাছি আনে। মেয়েটির ছোট ছোট হাত যখন তার গাল ছুয়ে দেয় তখন আহির এক অন্যরকম অনুভূতিতে ভেসে যায়। বাচ্চাটির কপালে চুমু খেয়ে বলে,
“আমার মেয়ে!”

মেয়েটিকে নিয়েই আনন্দে মেতে ওঠে সে। একটু পর নাতাশা বলে,
“তোর আরো একটি মেয়ে হয়েছে। ওরা যমজ বাট নন-আইডেন্টিকাল টুইনস মানে যমজ হলেও দেখতে আলাদা। প্রথম মেয়েটি অনেক পুষ্ট ও সুস্থ হলেও এই দ্বিতীয় মেয়েটিকে ভীষণ ছোট ও রোগা লাগছে।”

আহির সেদিকে বেশি পাত্তা দিলো না। সে তো নিজের বড় মেয়েকে নিয়েই ব্যস্ত। নাতাশা বলে,
“এখন কি করবো?”

“তুই যা করেছিস তাই অনেক। এখন আর তোকে কিছু করতে হবে না। এখন যা করার আমিই করবো।”

“ওহ, এখন তাহলে তুই নিশ্চয়ই নিজের পরিকল্পনা নিয়ে নেহা ও তার দুই মেয়েকে এখান থেকে বের করে দিবি। যাতে করে ও সমাজে কি অপদস্ত হয় আর তোর প্রতিশোধ সম্পন্ন হয়।”

অনেক আশা নিয়ে কথাটা বলে নাতাশা। কারণ এখন তার পরিকল্পনা, নেহা এখান থেকে বের হতেই তাকে আর তার বাচ্চাদের শেষ করে দেবে। কিন্তু আহির নাতাশার আশায় পানি ঢেলে দিয়ে বলে,
“না।”

নাতাশা উত্তেজিত হয়ে বলে,
“না, মানে? তুই কি বাচ্চাদের পেয়ে নিজের প্রতিশোধের প্রতিজ্ঞা ভুলে গেলি আহির? মনে আছে তোর প্রতিশোধের…”

আহির রেগে নাতাশার দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমার সাথে যা কিছু হয়েছিল তার প্রতিশোধ তো আমি নেবোই। সেটা তোকে আমায় মনে করাতে হবে না।”

“কিন্তু নেহা আর ওর বাচ্চাদের যদি তুই এখান থেকে না তাড়াস তাহলে প্রতিশোধ নিবি কিভাবে?”

“কে বলেছে যে নেহাকে আমি এখানে রাখব? ওকে তো আমি এখান থেকে বের করবোই।”

নাতাশা কিছুটা স্বস্তি পায়।

আহির বলে,
“তবে ওর থেকে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য একটা বাচ্চাই যথেষ্ট দুটো নয়।”

বলেই সে নিজের কোলে থাকা মেয়েটির দিকে তাকায়। বাচ্চাটির কান্না যেন থেমে গেছে।

আহির বলে,
“এই মেয়েটি আমার কাছে থাকবে আর পরে যেই মেয়েটি জন্ম নিয়েছে তাকে আর নেহাকে আমি এখান থেকে বের করার ব্যবস্থা করছি।”

নাতাশা মিনমিন স্বরে বলে,
“এই বাচ্চাটাকে তোর কাছে রাখার কি দরকার? তুই কিভাবে বাচ্চাটাকে মানুষ করবি। একটা সদ্যোজাত বাচ্চার তো মায়ের প্রয়োজন..”

আহির রক্তিম চোখে তাকাতেই নাতাশা বলে,
“না,,মানে বাচ্চাটা এখনো ছোট ওকে মায়ের দুধ খেতে হবে,,আর এই রকম নবজাতকরা তো মায়ের কাছেই থাকে।”

“আচ্ছা, যেসব বাচ্চার মা মরে যায় তারা কিভাবে থাকে?”

নাতাশা এবার চুপ হয়ে যায়। আহির নাতাশাকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,
“আমার মেয়েকে আমি কিভাবে সামলাবো সেটা আমি বুঝে নেব। তোকে সেই নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলবে। তোর কাজ হয়ে গেছে এখন তুই আসতে পারিস। জাস্ট গো এওয়ে। আমি আমার মেয়ের সাথে একা সময় কাটাতে চাই।”

নাতাশা অপমানবোধ করে বিদায় নিলো। যেতে যেতে আহির ও তার কোলে থাকা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলে,
“এই আপদটা থেকেই গেল! বুঝলাম না, আহিরের হঠাৎ এই বাচ্চার প্রতি এত মায়া কিভাবে জাগল। অথচ আরেকটা বাচ্চার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না!”

আহির এবার নিজের বড় মেয়েকে আদর করছিল এর মাঝেই তার চোখ যায় বিছানায় নিথর হয়ে শুয়ে থাকা নেহা ও তার পাশে কান্নারত বাচ্চাটির দিকে। আহির শীতল চোখে তাকিয়ে বলে,
“এখন থেকেই আমার প্রতিশোধের আসল খেলা শুরু হবে।”

বলেই সে নিজের কোলে থাকা মেয়েটির কপালে চুমু খেয়ে তাকে নিয়ে রুম থেকে বের হয়।

★★
৩ দিন পর,
চোখে সূর্যের আলো এসে পড়তেই নেহা পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। চোখ মেলতেই সে অবাক হয়ে যায় কারণ সে আর কোন বন্দি ঘরে ছিল না। সে ছিল একদম খোলা আকাশের নিচে। মাথায় হাত দিয়ে সে মনে করতে থাকে শেষ মুহুর্তের কথা। এতদিন তার কোন জ্ঞানই ছিল না। নেহার পেটে ভীষণ ব্যথা অনুভূত হচ্ছিল তখন। এরমধ্যেই হঠাৎ করে একটি বাচ্চার কান্নার আওয়াজ তার কানে ভেসে ওঠে।

নেহা নিজের পেটে হাত দিয়ে কোনরকমে উঠে বসে। নিজের পাশে ছোট্ট একটি নবজাতক শিশুকে দেখেই তার শ্বাস রোধ হয়ে আসে। নেহা বলে ওঠে,
‘এই তাহলে আমার জীবনের সেই অভিশাপ!’

নেহা বাচ্চাটিকে ভীষণ নির্মমভাবে কোলে নিয়ে বলে,
“কি ভেবেছিল ঐ আহির? আমি এই অভিশাপকে বরণ করে নেব? কিছুতেই না।”

নেহা আশেপাশে তাকায়। তার চোখ যায় কিছুটা দূরে পড়ে থাকা একটি ডাস্টবিনের দিকে। নেহা অনেক কষ্টে বাচ্চাটিকে নিয়ে গিয়ে নির্দয়ভাবে সেই ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে বলে,
“এই বাচ্চাটা ঐ পাপী আহিরের চিহ্ন! এতগুলো দিন ধরে হওয়া আমার সাথে হওয়া সব অবিচারের চিহ্ন। আমি ওকে কিছুতেই বরণ করে নেব না।”

বলেই সে বাচ্চাটিকে ওভাবেই ডাস্টবিনে ফেলে রেখে নিজের মতো সামনে এগোতে থাকে।

চলবে ✨