#উত্তল_তরঙ্গ
#পর্বঃ৯
#লেখিকাঃদিশা_মনি
নেহার হাত ধরে টানতে টানতে তাকে বাইরে নিয়ে যেতে থাকেন বিপাসা চৌধুরী। নেহার ভীষণ ব্যথা হচ্ছিল তাই সে অনুনয় বিনয় করতে থাকে। কাতর স্বরে বলে,
“বড় আম্মু..দয়া করো। আমায় একবার সবটা খুলে বলতে দাও।”
“তোর এইসব নাটক অন্য কোথাও গিয়ে করিস। তোর বড় আব্বু কি বলল শুনতে পাস নি? বেরিয়ে যা এক্ষুনি।”
বলেই নেহাকে দরজার বাইরে বের করে তার মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দেন বিপাসা চৌধুরী। নেহা অসহায় হয়ে সেখানেই বসে পড়ে দরজার সামনে। দরজায় খটখট শব্দ করে বলে,
“বড় আব্বু, আরাভ ভাই তোমরা অন্তত একবার আমার কথাটা শোনো। তোমরা ছাড়া যে আমার আপন বলতে কেউ নেই। তোমরাই যদি আমায় পর করে দাও তাহলে আমি এই অবস্থায় কোথায় যাব বলো?”
কিন্তু ভেতর থেকে আর কোন সাড়া শব্দ আসে না। আজমাইন চৌধুরী, আরাভ সবাই যেন নেহার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। নেহা ক্রন্দনরত স্বরে আল্লাহর কাছে করজোড়ে প্রার্থনা করে বলে,
“কি দোষ করেছি আমি আল্লাহ? কেন আমায় এত কিছু সহ্য করতে হচ্ছে? আমি যে আর পারছি না আল্লাহ। এবার তুমিই আমায় কোন পথ দেখাও।”
এমন সময় হঠাৎ করে নেহার কোলে থাকা বাচ্চাটি কেঁদে ওঠে। নেহা নিজের মেয়েকে এভাবে কাঁদতে দেখে বলে,
“কাঁদিস না মা আমার। আজ হয়তো আমাদের পাশে কোন মানুষ নেই কিন্তু আমি নিশ্চিত আল্লাহ আমাদের পাশে আছেন। কি ভেবেছিল ঐ আহির চৌধুরী? তোকে আর আমাকে এই অসহায় পরিস্থিতিতে ফেলে ভেঙে দেবে? সেটা সে ও পারবে না। আমার মনের জোরই আমায় আজ এতদূর অব্দি নিয়ে এসেছে। আমি এত সহজে হার মানবো না। আমার নিজের পরিবারই আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, আমার কোন কথা শুনতে তারা প্রস্তুত নয়। না শুনুক, কাউকে লাগবে না আমার। তোর মাকে এত অসহায় ভাবিস না। আমি একাই তোকে সুন্দর একটা জীবন দেব। একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে, এখানে থাকলে তোকে আর আমাকে অনেক কথা শুনতে হতো। তোর শৈশবটা বিঘ্নিত হতো৷ তবে এবার আমি তোকে এসব থেকে অনেক দূরে নিয়ে যাব। যেখানে তুই একটা সুস্থ শৈশব পাবি।”
বলেই নেহা উঠে দাঁড়ায়। একটু দূর থেকে ট্রেনের শব্দ ভেসে আসছে। নেহার বড় আব্বুর বাড়ি গাজীপুর রেলওয়ে স্টেশনের কাছেই। নেহা নিজের মেয়েকে কোলে নিয়ে বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,
“এখন সম্পূর্ণ একটা নতুন শহরে আমাদের মা-মেয়ের নতুন জীবন শুরু হবে। ঐ আহির আমার থেকে সব কেড়ে নিতে চাইছিল তো, আমাকে মানসিক ভাবে ভেঙে দিতে চেয়েছিল। এবার আমি তোকে আগলে নিয়ে এমন জীবন গড়ব যে কোনদিন যদি ও আমাদের মুখোমুখি হয় তাহলে আমাদের খুশি দেখবে আর নিজের ব্যর্থতা। আর আল্লাহ যদি সুযোগ দেন, তাহলে আমি নিজের প্রতি হওয়া সব অন্যায়ের প্রতিশোধ নেব ঐ শয়তানটার থেকে। আর আমি যদি নাও পারি, তুই আছিস তো। তুই নিজের মায়ের হয়ে প্রতিশোধ নিবি৷ তাই না বল?”
নেহার ছোট্ট মেয়েটার কান্না হঠাৎ করে থেমে যায়। তার ঐ ছোট্ট চোখেই যেন প্রতিশোধের আগুন জ্বলে ওঠে।
~~~~~~~~
“কাঁদে না মামনী,,,ড্যাডি তো আছে তোমার পাশে। এভাবে কাঁদছ কেন? তোমার ড্যাডি যে কষ্ট পাচ্ছে তার প্রিন্সেসকে এভাবে কাঁদতে দেখে।”
আহির এভাবেই তার মেয়ের কান্না থামানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু মেয়েটার কান্না থামার কোন লক্ষণই নেই। এমন সময় মুমিনুল পাটোয়ারী সেখানে চলে আসেন। তিনি এসেই বলেন,
“বাচ্চাটা ওর মায়ের সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য কাঁদছে। এতটুকু একটা বাচ্চা ওর তো নিজের মায়ের সাথে থাকার কথা। মাতৃদুগ্ধ পান করার কথা। অথচ না জানি তুমি ওকে কোথা থেকে নিয়ে এসেছ।”
আহির গম্ভীর স্বরে বলে,
“আমার মেয়ের আমি ছাড়া আর কারো প্রয়োজন নেই। আমি একাই ওকে সামলাতে পারবো।”
বলেই সে মেয়ের সামনে ঝুনঝুনি বাজাতে থাকে৷ কিন্তু তবুও বাচ্চাটার কান্না থামে না। মুমিনুল পাটোয়ারী এবার ধৈর্য হারিয়ে বলে ওঠেন,
“তুমি আমার থেকে কেন সবটা লুকাতে চাইছ আহির? আমি তোমার জন্মদাতা পিতা নই জন্য কি তোমার ব্যাপারে কোন কিছু জানার অধিকার আমার নেই?”
আহির সাথে সাথেই চমকে উঠল। উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“এসব তুমি কি বলছ আব্বু? তুমি আমার নিজের আব্বু নও? অথচ মৃদুলের মৃত্যুর পর থেকে তুমি আমাকে নিজের ছেলের যায়গাটা দিয়েছ। আমিও তোমাকে নিজের বাবাই ভেবেছি।”
মৃদুলের কথা শুনতেই মুমিনুল পাটোয়ারীর চোখে জল চলে আসে। মৃদুল ছিল মুমিনুল পাটোয়ারীর একমাত্র ছেলে। মৃদুল যখন অনেক ছোট ছিল তখন তার মা মারা যায়। এরপর তিনি অনেক আদরযত্নে মৃদুলকে বড় করেন। কখনো তার গায়ে একটা আঁচ লাগতে দেন নি। স্কুল লাইফে মৃদুলের সাথে পরিচয় হয় আহিরের। মৃদুল এত ধনী পরিবারের ছেলে হলেও তার মধ্যে কোন অহংকার ছিল না। তাই তো আহিরের মতো একটা অসহায় গরীব ছেলেকে নিজের বন্ধু বানায়। তারা বন্ধু কম ভাই ছিল বেশি। আহিরকে মৃদুল ভীষণ ভরসা করত। তার সাথেই সময় কাটাত। কলেজে উঠে তাদের সাথে পরিচয় হয় নাতাশার। তিনজনের অনেক সুন্দর বন্ডিং ছিল। কিন্তু সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়, যখন মৃদুল তাদের পাশের একটি স্কুলের অষ্টম শ্রেণী পড়ুয়া একটি মেয়ের প্রেমে পড়ে। মৃদুল প্রায়শই মেয়েটির পেছনে পড়ে থাকত। তার প্রতি নিজের ভালোবাসার অনুভূতি ব্যক্ত করতে চাইত৷ কিন্তু মেয়েটি তাকে এড়িয়ে চলত। এমনই একদিন মৃদুল মেয়েটিকে স্কুলমাঠে সবার সামনে একটি মেলায় একা দেখে রেশমি চুরি কিনে নিয়ে তাকে উপহার দিতে চায়। কিন্তু মেয়েটি ভয়ে পালিয়ে যেতে নিতেই মৃদুল তার হাত টেনে ধরে। যার ফলে মেয়েটা সবার সামনে তার গালে চড় মারে। পরবর্তীতে মেয়েটার কাজিনও তার বন্ধুদের নিয়ে এসে মৃদুলকে মারধোর করে। এই ঘটনার পরেও মৃদুল মেয়েটাকে ভুলতে পারে না ও বারবার তাকে নিজের মনের কথা জানায়। আহির অবশ্য এসব বিষয়ে মাথা ঘামাত না কারণ সেই সময় তার মায়ের অসুস্থতার জন্য তাকে বেশিরভাগ সময় হাসপাতালে কাটাতে হতো।এরপর হঠাৎ একদিন আহির খবর পায় যে মৃদুল সুই*সাইড করেছে। সেদিনটা ছিল আহিরের জন্য চরম কষ্টের। কারণ সেদিনই তার মা যিনি দীর্ঘ দিন ধরে ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে না ফেরার দেশে পারি জমান।
সেদিন নিজের সবথেকে কাছের দুজন মানুষকে হারিয়ে আহির মানসিকভাবে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। মায়ের জানাজা পড়ে তার দাফন সম্পন্ন করেই প্রিয় বন্ধুর খাটিয়া কাধে নিতে হয়। পরবর্তীতে এই ঘটনার পর থেকে আহির অনেক হিংস্র হয়ে ওঠে। কলেজে এরপর একজন ছেলে তাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করায় আহির ছেলেটির মাথায় জোরে আঘাত করে যাতে ছেলেটিকে আইসিইউতে নিতে হয় এবং অনেক কষ্টে ছেলেটি বেঁচে ফেরে। আহিরকে কিশোর সংশোধনাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। এদিকে মুমিনুল পাটোয়ারী যিনি নিজের সন্তানকে হারিয়ে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিলেন তিনি আহিরকেও নিজের সন্তানের মতো দেখতেন। মৃদুলের সাথে বন্ধুত্বের খাতিরে প্রায়শই পাটোয়ারী বাড়িতে তার যাতায়াত ছিল৷ আহিরের এসকল অবস্থার কথা জেনে তিনি তাকে ছাড়িয়ে আনেন। কিন্তু আহির তখনো মানসিকভাবে অনেক হিংস্র ছিল। তাই তিনি তার চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিয়ে যান। আহিরের অবস্থা কিছুটা উন্নতি হলে আহিরকে দেশে ফিরিয়ে আনেন এবং তাকে নিজের ছেলের যায়গাটা দেন, এমনকি নিজের স্থাবর অস্থাবর সব সম্পত্তিও আহিরের নামে লিখে দেন।
কিন্তু আহিরের অবস্থার উন্নতি হলেও তার প্রতিশোধের আগুন নিভে যায়নি। সে পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, মৃদুল কোন মেয়ের জন্য সু– করেছে। মেয়েটি আর কেউ নয়, নেহা। আর এজন্য তার মনে প্রতিশোধের বাসনা জাগে।
অতীতের এসব স্মৃতি থেকে বেরিয়ে এসে আহির বলে,
“এই মেয়েটা মনে করুন, মৃদুলের আত্মার শান্তির মাধ্যম।”
“মানে?”
আহির বলে ওঠে,
“যেই মেয়ের কারণে মৃদুল মারা গেছে তারই সন্তান এই মেয়ে!”
কথাটা শুনে মুমিনুল পাটোয়ারী হতবাক স্বরে বলেন,
“কি? কি বলছ তুমি এসব? মেয়েটার সাথেও তুমি খারাপ কিছু করো নি তো? আমাকে সবটা খুলে বলো।”
আহির কিছু বলতে যাবে এমন সময় নাতাশা এসে বলে,
“আমি সবটা বলি আঙ্কেল?”
চলবে ✨