উন্মাদিনী পর্ব-০৩ এবং শেষ পর্ব

0
27

#উন্মাদিনী
#পর্বঃ৩(শেষ)
#লেখিকা_দিশা_মনি

তাজিব স্পৃহাকে নিজের পাশে বসিয়ে ভালো ভাবে বুঝিয়ে বলে,
“শোনো আম্মু তোমাকে যা বুঝিয়েছে তা ঠিক নয়। আমি তোমার স্বামী। আমি কেন অন্য কাউকে বিয়ে করতে যাব?”

“বিয়ে করলে কি অসুবিধা?”

“যদি তোমাকে আমি অন্য কারো সাথে বন্ধুত্ব করতে বলি তুমি করবে?”

“না,কেন করবো? আমার বন্ধু তো শুধু তুমি।”

“ঠিক সেভাবেই আমি অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবো না৷ কারণ আমি শুধু আর শুধু তোমাকে ভালোবাসি।”

কথাটা শুনে স্পৃহা হালকা হাসে। তাজিব স্পৃহাকে আরো অনেক কথা বুঝিয়ে বলে,
“তুমি এখন এখানে বসে থাকো। এইসব কথা যাতে তোমাকে আর শুনতে না হয় এবার আমি তার ব্যবস্থা করব।”

বলেই তাজিব বের হয় রুম থেকে। রুম থেকে বের হয়েই নিজের মা তানিয়া বেগমকে রাগী কন্ঠে বলে,
“কাজটা তুমি ভালো করো নি আম্মু। আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম আর তুমি..বাদ দাও। আমার স্ত্রীকে নিয়ে তোমার অনেক সমস্যা তাই না? আমি এবার তোমার সব সম্পর্ক দূর করে দেব।”

“কি করবি তুই?”

“আমার স্ত্রীকে নিয়ে চলে যাব। অনেক দূরে কোথাও। যেখানে গেলে আমরা একটু নিশ্চিন্তে থাকতে পারব। তোমার এই টক্সিসিটি আমাদের মাঝে থাকবে না। আমরা একটু শান্তিতে নিঃশ্বাস নিতে পারব।”

“কি বলছিস তুই? ঐ পাগলীটার জন্য তুই আমাকে ছেড়ে যাবি? নিজের মায়ের প্রতি অন্যায় করবি? এটা আল্লাহ কোনদিন সহ্য করবে না।”

“আল্লাহ তোমার এসব বাড়বাড়ন্ত সহ্য করবে না। মায়ের পায়ের তলায় নাকি সন্তানের বেহেশত কিন্তু তুমি…তোমার মতো মায়ের ক্ষেত্রে কথাটা কি যৌক্তিক? নিশ্চিত নই আমি। আমার তোমাকে শুধু ঘৃণা হচ্ছে। তবে চিন্তা করো না, তোমার টাকা পয়সার কোন অভাব হবে না। আমি টাকা পয়সা পাঠিয়ে দেব আর প্রয়োজনে কাজের লোকও ঠিক করব তোমার জন্য।”

“প্লিজ আমাকে ছেড়ে যাস না। আমি কথা দিচ্ছি আমি আর এমন কিছু করব না।”

তাজিব তার মায়ের কোন কথাই আর কানে নেয় না। তাজিব স্পৃহার হাত ধরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল। রাতের আঁধারে শহরের রাস্তাগুলো যেন তাদের জন্য এক নতুন পথের সন্ধান দিচ্ছিল। স্পৃহা তার পুতুলটা বুকে জড়িয়ে ধরে তাজিবের পাশে হাঁটছিল, মাঝে মাঝে তার দিকে তাকিয়ে হাসছিল। তাজিব জানত, এই পথ কঠিন হতে পারে, কিন্তু স্পৃহার হাত ধরে যে কোনো ঝড় সে পার করতে পারবে। তারা প্রথমে একটি ছোট হোটেলে উঠল। তাজিবের পকেটে তেমন টাকা ছিল না, তবু সে স্পৃহাকে আশ্বস্ত করল,
“চিন্তা করো না, বন্ধু। আমি সব ঠিক করে দেব।”

স্পৃহা তার নিষ্পাপ হাসি দিয়ে বলল,
“তুমি আমার বন্ধু, তুমি যা বলবে আমি তাই বিশ্বাস করি।”

পরের দিন সকালে তাজিব একটি ছোট ফ্ল্যাটের খোঁজে বের হল। শহরের একটু দূরে, নদীর কাছে একটি পুরোনো বাড়িতে তারা একটি ছোট্ট ফ্ল্যাট পেল। ফ্ল্যাটটি ছিল সাধারণ, দেওয়ালে রং খসে গেছে, জানালার পর্দা ছেঁড়া, তবু তাজিবের কাছে এটি যেন একটি প্রাসাদ। সে স্পৃহাকে নিয়ে এসে বলল,
“দেখো, এটা আমাদের নতুন বাসা। এখানে শুধু তুমি আর আমি থাকব।”

স্পৃহা ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে বলল,
“বন্ধু, এটা তো আমার পুতুলের বাসার মতো! আমরা এখানে অনেক মজা করব, তাই না?”

তাজিব হেসে তার কপালে হাত রাখল,
“হ্যাঁ, অনেক মজা করব।”

তাজিব তার চাকরি ঠিক রাখল, তবে স্পৃহার জন্য একজন ভালো ডাক্তারের খোঁজ শুরু করল। সে জানত, স্পৃহার মানসিক অবস্থা সারাতে হলে শুধু ভালোবাসা যথেষ্ট নয়, সঠিক চিকিৎসাও দরকার। একদিন সে একজন নামকরা মনোবিদের সন্ধান পেল। ডাক্তার রেহানা বেগম ছিলেন বয়স্ক, তার যথেষ্ট অভিজ্ঞতাও ছিল। তিনি স্পৃহার অবস্থা শুনে বললেন,
“তাজিব, স্পৃহার অবস্থা জটিল, কিন্তু তাকে সারিয়ে তোলা অসম্ভব নয়। তার মনের গভীরে একটা আঘাত লুকিয়ে আছে। আমাদের সেটা বের করতে হবে। তবে তোমার ভালোবাসা তার জন্য সবচেয়ে বড় ওষুধ।”

তাজিব প্রতিদিন স্পৃহাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেত। স্পৃহা প্রথমে ভয় পেত, কিন্তু তাজিব তার হাত ধরে থাকত, তাকে গল্প বলত, তার পুতুলের কথা শুনত। ডাক্তার রেহানা ধীরে ধীরে স্পৃহার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুললেন। তিনি স্পৃহাকে ছোট ছোট কাজ দিতেন। যেমন ছবি আঁকা, গল্প লেখা। স্পৃহা এসব কাজে মজা পেত। একদিন সে একটা ছবি এঁকেছিল যে একটা ছোট মেয়ে তার মায়ের কোলে বসে আছে। ছবিটা দেখে তাজিবের চোখে পানি এসে গেল। সে বুঝল, স্পৃহার মনের গভীরে তার মায়ের জন্য একটা অতৃপ্তি রয়ে গেছে। এক সন্ধ্যায়, ডাক্তার রেহানার পরামর্শে তাজিব স্পৃহাকে নিয়ে নদীর ধারে বেড়াতে গেল। স্পৃহা নদীর জলে পা ডুবিয়ে হাসছিল, তার পুতুলটা হাতে নিয়ে বলছিল,
“দেখো, আমার পুতুলও জল দেখতে চায়।”

তাজিব তার পাশে বসে বলল,
“বন্ধু, তুমি কি কখনো তোমার মাকে মিস করো?”
স্পৃহা থমকে গেল। তার চোখে একটা ছায়া পড়ল। সে চুপচাপ বলল,
“মম তো স্টার হয়ে গেছে। আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন মম আমাকে অনেক গল্প বলত। কিন্তু একদিন…”
তার কথা শেষ হল না। সে তাজিবের বুকে মুখ লুকিয়ে কেঁদে উঠল।তাজিব তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“তুমি এখন একা নও। আমি তো আছি। আর আমি কখনো তোমাকে ছেড়ে যাব না।”

স্পৃহা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“তুমি আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। আমি তোমাকে হারাতে চাই না।”
সেই রাতে তাজিব স্পৃহার পাশে বসে তাকে ঘুম পাড়ানোর গান গাইল। স্পৃহা ঘুমিয়ে পড়ল, তার মুখে একটা শান্তির হাসি। তাজিবের মনে হল, স্পৃহার মনের আঘাত ধীরে ধীরে সেরে উঠছে।

কয়েক মাস পর,
স্পৃহার অবস্থায় উন্নতি দেখা গেল। ডাক্তার রেহানার চিকিৎসা আর তাজিবের অক্লান্ত ভালোবাসার ফলে স্পৃহার মনের কুয়াশা কাটতে শুরু করল। সে আর আগের মতো শুধু পুতুল নিয়ে বসে থাকত না। সে তাজিবের সঙ্গে রান্নাঘরে গিয়ে ছোট ছোট কাজ করত, তাজিবের জন্য চা বানাত, এমনকি তাজিবের অফিসের গল্প শুনে হাসত। একদিন সে তাজিবকে বলল,
“বন্ধু, আমি একটা কেক বানাতে চাই। তুমি আমাকে শিখিয়ে দেবে?”

তাজিব অবাক হয়ে গেল। সে হেসে বলল,
“অবশ্যই, চলো, আমরা একসঙ্গে কেক বানাই।”
সেই কেকটা হয়তো পারফেক্ট ছিল না, তবু তাজিবের কাছে সেটা ছিল সবচেয়ে সুস্বাদু। তারা দুজনে মিলে কেকটা খেল, হাসল, গল্প করল। স্পৃহার হাসি দেখে তাজিবের মনে হল, তার স্পৃহা ফিরে আসছে। যে স্পৃহা একসময় তার সঙ্গে রাত জেগে গল্প করত, যে তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখত।একদিন ডাক্তার রেহানা তাজিবকে বললেন,
“তাজিব, তুমি একটা অসাধারণ কাজ করেছ। স্পৃহার অবস্থা এখন অনেক ভালো। তবে তাকে পুরোপুরি সুস্থ করতে হলে তাকে তার অতীতের সঙ্গে মুখোমুখি করতে হবে।”

তাজিব একটু চিন্তায় পড়ল। সে জানত, স্পৃহার অতীতে একটা দুর্ঘটনা আছে, যেটা তার মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করেছে। কিন্তু সে স্পৃহাকে আর কষ্ট দিতে চায় না। তবু ডাক্তারের কথা মেনে সে স্পৃহার সঙ্গে অতীত নিয়ে কথা বলতে শুরু করল।এক সন্ধ্যায়, তাজিব স্পৃহাকে নিয়ে ছাদে বসল। তারা দুজনে আকাশের তারা দেখছিল। তাজিব আলতো করে বলল,
“বন্ধু, তুমি কি মনে করতে পারো, আমাদের বিয়ের আগে তুমি কেমন ছিলে?”
স্পৃহা একটু চুপ করে রইল। তারপর বলল,
“আমি জানি, আমি আগে অনেক কিছু করতাম। কিন্তু সেই দিনটা…”

সে থেমে গেল। তাজিব তার হাত ধরে বলল,
“আমি তো আছি। তুমি বলো।”
স্পৃহা ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল। সেই দুর্ঘটনার কথা, যেদিন তার মা তার সামনে গাড়ির নিচে চলে গিয়েছিল। স্পৃহা তখন মাত্র দশ বছরের। সেই দৃশ্য তার মনে গেঁথে গিয়েছিল। সে নিজেকে দায়ী করত, ভাবত, সে যদি মাকে আরেকটু শক্ত করে ধরে রাখত, তাহলে হয়তো এটা হত না। তাজিব স্পৃহার কথা শুনে তাকে বুকে জড়িয়ে বলল,
“তুমি কোনো দোষ করো নি। এটা তোমার হাতে ছিল না।”
সেই রাতে স্পৃহা অনেক কাঁদল। কিন্তু সেই কান্না যেন তার মনের ভার হালকা করল। পরের দিন সকালে সে তাজিবকে বলল,
“বন্ধু, আমি আর পুতুল খেলতে চাই না। আমি তোমার জন্য কিছু করতে চাই।”
তাজিব হেসে বলল,”তুমি আমার জন্য সবচেয়ে বড় জিনিসটা করেছ। তুমি আমার পাশে আছ।”

কয়েক বছর পর,
স্পৃহা পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠল। সে এখন আর পুতুল নিয়ে খেলে না। সে তাজিবের সঙ্গে বাড়ির কাজ করে, বাজার করে, এমনকি একটি ছোট্ট বুটিকে কাজ শুরু করল। তার হাসি ফিরে এসেছে, তার চোখে আবার সেই পুরোনো জীবন ফিরে এসেছে। তাজিব তাকে দেখে ভাবে,
“এই তো আমার স্পৃহা।”

একদিন সন্ধ্যায়, তারা দুজনে নদীর ধারে বসে আছে। স্পৃহা তাজিবের হাত ধরে বলল,
“তুমি আমার জন্য এত কিছু করেছ তাজিব। আমি জানি না, আমি কীভাবে তোমাকে ধন্যবাদ দেব।”

তাজিব হেসে বলল,
“তোমার এই হাসিটাই আমার জন্য সবচেয়ে বড় উপহার।”

স্পৃহা তার কাঁধে মাথা রেখে বলল,
“তাজিব, আমি তোমাকে কখনো ছেড়ে যাব না।”

তারা দুজনে হাত ধরে নদীর দিকে তাকিয়ে রইল। আকাশে তারারা জ্বলছে, আর তাদের মনে শুধু ভালোবাসা আর শান্তি। তাজিব ভাবল,
“এই তো আমার সংসার। এই তো আমার সুখ।”
সমাপ্ত ✨