#উন্মুক্ত_লাইব্রেরী
লেখা – আয্যাহ সূচনা
১৭.
বিগত রাত্রী কেঁটেছে তন্দ্রাহীন।খোলা চোখ আর মস্তিষ্ক বোঝাই করা চিন্তা।আবার কিছু অলীক কল্পনা।যার বিশেষ কোনো ভাবার্থ নেই। তবে অন্বেষা নিজেকে বুঝিয়েছে।কারো উপর জোর খাটানো কি আদৌ ঠিক?কেউ তাকে জীবনে গ্রহণ করতে চায় না সেটি তার একান্ত ব্যাপার।জোর করে তার কাছে থেকে যাওয়ার কোনো মানে নেই।চাপিয়ে দিতে পারেনা সে নিজের ইচ্ছে এবং স্বয়ং নিজেকে।এমন কি অনুভুতি আছে তার মাঝে?অনুরাগের গভীরতা অত্যন্ত অর্বাচীন।তবে কিছু পেতে চেয়ে সেটি হারিয়ে ফেলার ভোগান্তি ব্যাপক।এর আগেও হয়েছে তার সাথে এমন।হাত বাড়িয়ে কিছু চেয়েও পায়নি।শূন্য হস্তে ফিরে আসতে হয়েছে। বারবার ভাগ্য বলেছে,
“সব ভালো তোর জন্য নয়”
নিদ্রাহীন হীনবল কায়া নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।চিত্ত সংকুচিত।কিন্তু কাজ কি আর থেমে থাকবে?পরশুদিন থেকে পরীক্ষা।হয়তো পড়ালেখায় ডুবে ভুলে থাকা যাবে না পাওয়ার ঝাপসা মর্মবেদনা।
তৈরি হয়ে বেরিয়েছে অন্বেষা।আরো একটা দিন এর সিংহভাগ দিয়ে দিতে হবে এখানে।মাথায় কাপড় টেনে হাঁটা শুরু করেছে আপন মনে।প্রতিদিনের ন্যায় বর্ণ চায়ের দোকানে।মাথা নুয়ে চা খেতে দেখলো তাকে। তড়িঘড়ি করে এগিয়ে গেলো অন্বেষা।দরকার নেই কোনো চোখাচোখি হওয়ার। বর্ণও ঠিক সেই সময় মুখ তুলে চাইলো।চিনতে ভুল করলো না অন্বেষার চলন। ত্বরিত কপালে মৃদু ভাঁজ পড়ে।
পাশে থাকা সাব্বির বলে উঠলো,
“আজকে আপা আপনার লগে ঝগড়া করলো না?গেলো গা দিহি।”
বর্ণও কিছুটা অবাক।সাব্বিরের প্রশ্নে তার দিকে চেয়ে বললো,
“কি জানি”
নীরবতার স্তব্ধতা ভাঙবে না অন্বেষা।নিজের উপর যে লজ্জাবোধ হচ্ছে সেটি দমাতে পারবে একমাত্র তার নির্লিপ্ততা।অবাধ্য স্বপ্নের তোরণ বন্ধ রেখেই চলবে।আজকাল স্বপ্নদল উড়ন্ত অবস্থায় ছিলো।সাহস সঞ্চয় করে দৃঢ় প্রত্যয়ে।
এমন এড়ানো ইচ্ছেকৃত নাকি অনিচ্ছাকৃত?প্রশ্নটি একবার বর্ণের মাথায় আসলেও টিকেনি বেশিক্ষণ। এড়িয়ে যাওয়া তার জন্যই মঙ্গল।হাত ভর্তি রং নিয়ে এসেছিলো মরিচা ধরা বর্ণ সত্ত্বায় মাখাবে বলে। সেটি বর্ণ হতে দেয়নি।নিজেকে উজাড় করার ইচ্ছা নেই যে একেবারেই।তার স্ব জীবনাঙ্গনে সাদা কালো রংই বরং বেশি শোভা পায়।
____
বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে পা রেখেছে অন্বেষা।মুখ অবয়ব ফ্যাকাশে।সব সময় এভাবেই চলাফেরা করে সে। প্রতিক্রিয়া শূন্য হয়ে। কারো সাথে তেমন মিশতে ইচ্ছে হয়না। মিশলেও কিছুদিন পর শুরু হয় মত বিরোধ।কি প্রয়োজন প্রয়োজন ছাড়া কাউকে অপছন্দের তালিকায় ফেলার।
ফ্যাকাল্টির সিঁড়িতে পা রাখতেই পথ এক প্রকার রুখে দাঁড়ালো ঝুমা আর রুম্পা।অনেকদিন পর তাদের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাত। স্বাভাবিকভাবেই এড়িয়ে যেতে চাইলে ঝুমা বলে উঠে,
“আমরা তোমার সিনিয়র।আদব কায়দা কি সব ভুলে গেছো?”
ম্লান দৃষ্টিতে চায় অন্বেষা। গুরুত্বহীন ভঙ্গিমা।জবাব দিলো,
“ভুলিনি আপু।”
রুম্পা ঝুমার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বললো, “সালাম আদাব কিছুইতো পেলাম না।”
অন্বেষা বাঁকা হেসে বললো, “সম্মান পাওয়ার মতো কিছু করলে অবশ্যই সালাম দিতাম আর সম্মান করতাম।”
গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার মতো শোনায় অন্বেষার বাক্য।তেমন কোনো জটিল সমস্যা নেই তাদের মধ্যে।শুধু উচুঁ আর নিচু জাতের ফারাক।এই তফাৎকে অহংকারের কেন্দ্র বিন্দু বানিয়ে জুলুম চালাতে চায় ঝুমা এবং রুম্পা।তাদের মতে অন্বেষার মতো সর্বহারা মানুষগুলো পৃথিবীতে এসেছে তাদের হাতের পুতুল হতে।একই বাড়িতে থাকাকালীন তাদের বেশিরভাগ কাজই করেছে অন্বেষা।করতে না চাইলে বাধ্য করা হয়েছে। বাড়ি ছাড়া করিয়েও যেনো মস্তিষ্ক ঠান্ডা হয়নি তাদের।
“ক্যাম্পাস এর বাহিরে নাহয় বডিগার্ড নিয়া ঘুরো। ক্যাম্পাসের ভিতরে কি করবে?”
অন্বেষা আবার হাসে।গা জ্বালানো হাসি।বললো,
“ক্যাম্পাসের ভিতরে আমাদের শিক্ষকগণ আছেন।”
বলে এড়িয়ে গেলো অন্বেষা।দুয়েক সিঁড়ি উপরে উঠতেই রুম্পা হলো,
“তোমার পাস্ট হিস্ট্রি সব জানছি! কুলাঙ্গার বাটপার জাত! কপটচারীর মেয়ে।এই পরিচয় নিয়ে এত তেজ?”
অন্বেষার পা জোড়া কেঁপে উঠে।সাথে সর্বাঙ্গ।কিছু মুহূর্তের জন্য টালমাটাল হয়ে পড়ছিলো।দেয়ালে হাত রেখে ধাতস্ত করলো নিজেকে।থরথর কাপতে থাকা শরীর।পেছনে এগিয়ে গেলো।কষিয়ে চড় বসিয়ে দেয় রুম্পার গালে।বলে,
“আমার বাবা নির্দোষ ছিলেন!এটা প্রমাণিত হয়েছে।সব প্রমাণ আছে আমার কাছে।আগামীবার আমার বাবার সম্পর্কে কিছু বলার আগে একশোবার ভাববি।আর কুলাঙ্গার তুই!তোরা!যারা নিজে কিছুই করতে পারিস না জীবনে। অন্যের পেছনে লেগে….না পায়ে ধরে ঝুলে থাকাই তোদের কাজ।দুআ করি আজীবন এভাবেই আমার পায়ের নিচে পড়ে থাক।আমাকে টেনে নামানোর চেষ্টা কর!আর আমি আরো উপরে উঠি।”
সিঁড়ি এবং করিডোর কেঁপে উঠেছে অন্বেষার কণ্ঠের ভয়াবহতায়।চুপচাপ থাকা মেয়েটির এমন রূপে বিস্মিত অনেকেই।ক্লাসে গেলো না অন্বেষা।কান্না পাচ্ছে তার।তাদের সামনে কাঁদলে নির্ঘাত তাকে দুর্বল বলে আখ্যায়িত করবে।
উন্মুক্ত লাইব্রেরীতে একাকী বসে আছে বর্ণ।এদিক ওদিক পাখির ন্যায় ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে।যেনো কোনো অপেক্ষায়।বাটন ফোনের বোতাম চেপে দেখলো দুপুর দুইটা বাজতে অল্প কিছু সময় বাকি।অবাক হলো অনেকটা।সময় তো অনেকখানি পেরিয়ে।তবে?সবুজ বেঞ্চির পাশের খালি সিটের দিকে একবার চেয়ে সেও উঠে দাঁড়ায়।চাকরির ঠিক ঠিকানা নেই। টিউশন বাঁচাতে হবে।
___
অসময়ের বৃষ্টি ভারী বিরক্ত করে। বর্ণকেও করছে। জানতো না এভাবেই পরবর্তী নয় দিন পাশের সিটটা খালিই থেকে যাবে।বিকেলের আলো ম্লান।বর্ষ পেরিয়ে বর্ণের অন্তরে যেন এক অজানা শূন্যতা নেমে এলো। প্রতিটি দিন কাটে ঠিক আগের মতই নিরবতায়। কোথা থেকে যেন সাব্বির এসে হাজির হলো।হাতে ঘুড়ি।বর্ণের চুপচাপ সরু গলির পানে চেয়ে থাকতে দেখে প্রশ্ন করলো,
“কি ভাবতাছেন ভাইজান?”
বর্ণ সাব্বিরের দিকে দৃষ্টিপাত করে ঠান্ডা গলায় বলে,
“অন্বেষারে দেখছিলি?”
“হ ভাইজান দেখছিলাম অনেকদিন আগে।দুপুর বেলা বাড়ির দিকে যাইতাছিলো।চোখ মুখ ফুইলা আছিলো। কাঁনছে মনে হয়।আমি জিগাইলাম কোনো উত্তর না দিয়া গেলো গা চোখ মুখ মুছতে মুছতে।”
“কবে?”
“ঐযে যেদিন সকালে আপনার লগে ঝগড়া না কইরাই গেলো গা?ওইদিন”
“দুপুরে?”
অতি ক্ষুদ্র মাত্রায় উদ্বেগপূর্ণ দেখা গেলো বর্ণকে
দুপুরে বাড়ি ফেরার কথা না অন্বেষা।সেদিন লাইব্রেরীতেও দেখা মেলেনি।কোনো ফোন আসেনি এই অব্দি তার তরফ থেকে। ভাবাচ্ছে বর্ণকে বিষয়টা।সময় অতিবাহিত করে সম্পূর্ণ চেহারার ভঙ্গি পাল্টে বলে উঠে বিরক্তির সুরে,
“মাইয়া মানুষের যত ঢং!সন্ন্যাস নিছে…তামাশা করে…রং লাগছে মনে…পিরিতের রং!” শেষ শব্দজোড়া সাব্বিরের কর্ন গোচর হয়নি।অত্যন্ত ধীর আওয়াজে বলেছে বর্ণ।
____
সাব্বিরের সাথে আলাপের পর আরো দুটো দিন কেঁটেছে।এই দুটোদিন ছিলো একেবারে ভিন্ন।এলোমেলো ভাবনার সমারোহ ছিলো সর্বক্ষণ।তাকেই বড্ড ভাবাচ্ছে অনুভূতিহীন বর্ণের এমন পরিবর্তন। তার মনে এক অজানা আশঙ্কা,এক অদ্ভুত চিন্তা।নিষ্প্রাণ সত্ত্বাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।যার হেঁয়ালি চালচলন।এই অভিযানে খুঁজে পেলো বর্ণের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অনুভূতির আভাস।তার মধ্যে মায়া আছে। এতো জানতো না।মস্তিষ্ক তাড়না দিচ্ছে।জানতে চাইছে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যাওয়া মেয়েটা ঠিক আছেতো?নাকি ভারী অভিমানের পাহাড় তুলে রেখেছে মধ্য বরাবর।
দূরে এক ব্যক্তি দেয়ালে ছোটখাটো আয়না টানিয়ে রেখেছেন।তার পাশেই চেয়ার।আর যাবতীয় প্রয়োজনীয় সামগ্রী।এটা তার ছোটখাটো সেলুন।সেই ভেজা আয়নায় মুখখানা স্পষ্ট বর্ণের। ধীর গতিতে পলক ফেলে।এক দৃষ্টিতে চেয়ে রয়ে নিজেকে ভীষণ অচেনা মনে হলো।
“কি সমস্যা কি তোমার? পিরিতের বাত্তি নিভাইতে কইছি।নিজের সুইচ অফ কইরা বইয়া থাকতে কই নাই।”
ঠান্ডায় নাক টানছে অন্বেষা।সাথে কান্নার প্রভাব।গতকাল বাবা মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী ছিলো তার।এতটাই মনে পড়ছিলো যে চোখ ভেঙে কেঁদেছে সারারাত্রি। ফোনে বর্ণের এমন কর্কশ আওয়াজ শুনে উঠে বসলো।রাত নয়টা বাজে।
অন্বেষার অনুত্তরিত ভাবসাব তরতর করে বর্ণের মেজাজকে তুঙ্গে চড়িয়ে দেয়।বর্ণ বলে,
“ ঠেঁটামি করো? ভেংসা ধরছো?তোমারে খুঁইজা পাওয়ন যায় না। লাইব্রেরীতে যাও না।আমারে দেখলে দেমাগ দেহায় পিঠ ঘুরায় যাওগা।কি সমস্যা কি?তুমি ভাবতাছো এগুলি কইরা আমার মন পাইবা?”
“উহু”
“আবার উহু মারায়!চেহারা নকশা ভস্কায় দিমু মাইরা।”
এরপর আর কিছু বলার থাকে?হুট করে চিৎকারের আওয়াজে বুক কেঁপে উঠেছে অন্বেষার। জবাবহীন নাক টানতে শুরু করলো বারবার।
“কাঁন্দো কেন?”
“কাঁদি না।একটু সর্দি এই আরকি।”
বর্ণ কোমরে একহাত এবং অন্য হাতে ফোন কানে চেপে দাঁড়িয়ে আছে।গলার কঠোরতা বজায় রেখে বললো,
“কালকে কই গেছিলা?সাব্বির খবর দিলো!রাস্তায় রাস্তায় গুড়াগাড়া পোলাপাইন এর লগে কি?”
“বাবা মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী ছিলো।বাচ্চাদের খাইয়েছি। সাব্বিরওতো ছিলো।এটা বলেনি?”
বর্ণ কোনো ভাবনা চিন্তা ব্যতীত বললো, “বাইর হও কাম আছে।”
অন্বেষা পথ খুঁজলো পালাবার।কিছুতেই বর্ণের মুখোমুখি হবে না।ভীষণ লজ্জা হয় তার।বিদ্যুতের বেগে জবাব দিলো,
“আমার ঘুম আসছে। ঘুমাবো।”
বলে মুখের উপর ফোন কেটে দিলো।অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে ফোন সাইলেন্ট করে ফেলে।
_____
গলিতে কুকুর ডাকছে।বর্ণকে নির্জন আঁধারে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যেনো শাসানোর চেষ্টায়। তবে নির্লিপ্ত বর্ণ।তার চেঁচামেচিতে কান দিলো না।দোতলা বাড়ির সামনে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে কোমরে হাত রেখে।মস্তিষ্ক তুখোড় পরিকল্পনায় মগ্ন।হুট করে দেখলো সামনের বাড়ি থেকে একজন বেরিয়ে এলো।মধ্য বয়স্ক লোক তিনি।
পেছনে দুহাত বেঁধে এগিয়ে এলেন বর্ণের দিকে।তাকে দেখে কুকুরটা চেচানো বন্ধ করে দিলো।হয়তো পরিচিত মুখ দেখে।তিনি সোজা বর্ণের সামনে দাঁড়িয়ে কাটকাট গলায় বলে উঠেন,
“এই ছেলে এই!তোমাকে অনেকক্ষন যাবত দেখছি এখানে দাঁড়িয়ে আছো।তোমার লক্ষণ ভালো লাগছে না আমার। উদ্দেশ্য কি বলোতো? মুখটাও সন্দেহজনক।”
বর্ণ নিমেষহীন চেয়ে প্রশ্ন করলো,
“এই বাড়িটা কি আপনার চাচা?”
“হ্যাঁ আমি মালিক।”
“এই রাস্তাটা আপনার?”
বাড়ির মালিক বিরক্তির সুরে বললেন, “রাস্তা আমার হবে কেনো?”
“ঠিক।রাস্তা জনগণের।যেহেতু আপনার ব্যক্তিগত মালিকানা নাই এদিকে তাইলে আমার দাঁড়ায় থাকায় আপনার সমস্যা হওনের কথা না”
“তুমি আমার বাড়ির দিকে চেয়ে আছো।কি মতলব বলোতো!আমি কিন্তু পুলিশে কল করবো?”
“আপনার চোখ দিয়া তাকাইছি।আমার আপনা মালিকানা আমার চোখ।ঐটা দিয়া তাকায় আছি।”
“বড্ড বেয়াদবতো ছেলে তুমি!এক্ষুনি যাও এখান থেকে।নাহয় হাজতে ভরবো তোমাকে।আমাকে চেনো?এলাকার প্রায় সব মানুষ আমাকে ভয় পায়”
“আর আপনি আমারে!”
“মানে?”
“ডরাইতাছেন আমারে।চোর ডাকাত ছিনতাইকারী ভাইবা।”
বিপরীতে থতমত খেয়ে যান বাড়ির মালিক।অপমানিত বোধ করলো।এই ছেলের সাথে কথা বাড়ানো মানে সময় অপচয়।বাহিরে সিসিটিভি লাগানো আছে।বাড়ি গিয়ে এক নজরে রাখা যাবে।তাই কথা না বাড়িয়ে চলে গেলো।
পেছন থেকে স্বর উচু করে বলে উঠলো, “আপনার বাড়িটা আমার পছন্দ হইছে চাচা।কিন্তু টাকা নাই। মাগনা দিবেন?”
বাড়ি ওয়ালা চলে যাওয়ার পর বর্ণ বাম দিকে চাইলো। উচুঁ দেয়াল।দেয়াল থেকে সোজাসুজি একটা খোলা বারান্দা।ব্যয়াম করার ভঙ্গিতে হাত তুললো।শরীরে একটা ভাব এসেছে এবার।সৃষ্টিকর্তার নাম নিয়ে উঠে যায় একলাফে দেয়ালের উপর।
অদ্ভুত আওয়াজে ঘুম হালকা হয় অন্বেষার।আড়মোড়া দিয়ে উঠে চোখ কচলে আলগোছে প্রশ্ন করে,
“কে?দিদি এসেছেন?”
বারান্দা আর ঘরের মাঝে কোনো দরজা নেই।একটা টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে বিছানার পাশে। অন্বেষা চোখ কচলাতে কচলাতে মাথা ঝুঁকিয়ে নিলো। মাঝেমধ্যেই সুদীপ্তার মেয়ে আসে।হুটহাট না বলে।ঘুমের ঘোর পুরোপুরি কাঁটার পূর্বেই মনে হলো ডান পাশে থাকা টেবিল ল্যাম্প তার খুব সন্নিকটে।ভারী আওয়াজ ভেসে এলো।মুখের সামনে ছোট্টো ছুরি ধরে বললো,
“এই ছেমড়ি এই! পাখনা গজাইছে না?আমারে এড়ায় যাও!এইযে চাক্কু দেখতাছো?আমার লগে এক্ষণ না আইলে এটা ডাইরেক্ট তোমার গলায় হান্দায় দিমু। বাঁচতে চাইলে জলদি উঠো!আজকা তোমার কিসমতের একটা পৃষ্ঠা আমি উল্টামু।অনেক উজাইছো না? চলো !”
চলবে…..
#উন্মুক্ত_লাইব্রেরী
লেখা – আয্যাহ সূচনা
১৮.
“যা করার তাড়াতাড়ি করেন। বাড়িতে গিয়া ঘুমামু”
রাত প্রায় এগারোটা।তারপরও পুরান ঢাকার অলিগলি এখনও জ্বলজ্বল করছে।জমজমাট মানুষ আর দোকানিদের মধ্যে। অন্বেষা নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছে।একদম শান্ত।চোখের পলক ফেলছে না পারতে।সাধ্য থাকলে নিষ্পলক চেয়ে থাকতো। পাশের চেয়ারে বর্ণ।চারজন উপস্থিত এখানে।সাব্বির এবং তার বাবা মা।ঘুম ঘুম চোখে কপাল কুচকে রাখা বয়স্ক লোকটা রেজিস্ট্রির খাতা খুলে বসেছেন।তার পেছনের সবুজ ক্যাটক্যাটে রঙের দেয়ালে লাল কালিতে বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘কাজী অফিস’।কাজী সাহেব ভারী বিরক্ত তার উপর।বলে বসলেন,
“বিয়াটা কালকে করা যাইতো না?এই রাইত এর এগারোটা বাজে কে বিয়া করে?”
কাজী অফিসের পাশেই তার থাকার ঘর। দরজায় দানবের মত করাঘাত করে লোকটিকে তুলেছে।সাক্ষী হিসেবে এনেছে সাব্বির আর তার বাবা মাকে। অন্বেষাকে নিয়ে আসা ছিলো আরো ভয়ংকর।গলায় ছোট আকারের ছু রি ধরে।রুহ কেঁপে উঠলো অন্বেষার সেই কিছুক্ষন আগের কথা ভেবে।
“দেনমোহর ধার্য করেন দশ বিশ টাকা”
কাজী প্রশ্ন করেন,
“উনি কি রাজি হবে সেটায়?”
বর্ণ ফিকে হেসে বলে উঠে,
“ওরে কিছু না দিলেও ওয় রাজি। উল্টা আমার ওর থিকা দেনমোহর নেওয়ার কাম!যেই দিকদারি করছে আমারে এতোদিন”
কাজী সব রেডি করে অন্বেষার দিকে চেয়ে বললো কবুল বলতে।কথাটি কর্ণপাত হয় আবছা।বুঝবার অবস্থায় নেই সে।মূর্তির মত বসে।বর্ণ আলতো হাতে অন্বেষার মাথায় চাপড় মেরে বললো,
“জলদি কবুল কও ফাস্ট!”
অন্বেষা বড় বড় চোখে বর্ণের দিকে ফিরে যায়।বিশ্বাস হচ্ছে না ঘটে যাওয়া কোনকিছুই।কাজী সাহেব ক্ষেপে উঠলেন বললেন,
“এই তুমি বিয়ের আগেই ওর গায়ে হাত তুলতাছো কেন?আমারতো বিয়ে পড়াতে ভয় লাগতেছে।”
“বেশি কথা কইয়েন না মোল্লা চাচা।এটা আমার আর ওর ব্যাপার।আপনি আপনার কাম শুরু করেন।”
কাজী সাহেব আবারো নিজের কাজে লেগে পড়েন। বর্ণ একপাশের ভ্রু উচু করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাইলো অন্বেষার দিকে।হাতে থাকা ছোট চাকু আড়ালে তাক করে ফিসফিস করে বললো,
“তোমার পিরিতের স্বাদ মিটামু আমি।এক সেকেন্ডে কবুল কইবা।”
“আমি…”
“চুউউউপ!”
কাজী সাহেব বর্ণকে বিশ মিনিট অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয়।সাক্ষী হিসেবে আসা সাব্বির আর তার বাবা মাকেও। অধীর আগ্রহে তারা দাঁড়িয়ে।সবচেয়ে বেশি খুশি সাব্বির। ঠোঁটে চওড়া হাসি নিয়ে অন্বেষার হতভম্ব মুখপানে চেয়ে।বর্ণের ধমকে কেঁপে উঠলো হুট করে।কাজী সাহেব খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠলেন।চোখ রাঙিয়ে এবারো থামিয়েছে।
অন্বেষা আরো কিছুক্ষন সময় নিয়ে তিনবার বলে উঠলো, “কবুল”
বর্ণের পালায় সে বলতে গিয়েও থমকে গেলো।শুষ্ক মরুভূমির ন্যায় ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে নিলো নির্লিপ্ততায়।ঢোক গিলে আর সময় নেয়নি। জানে না এই সিদ্ধান্তের পরিণতি।ভাবেনি এখনও।
তার পুরুষালি রাশভারী কন্ঠ ভেদ করে পরপর তিনবার “ কবুল” ধ্বনি উচ্চারিত হয়।
অন্বেষার শরীর ভার ছেড়ে দিয়েছে পুরোটা। অনুভুতিগুলো বাকহীন।সত্যিই বিয়ে হয়ে গেলো?তার আর বর্ণের বিয়ে হয়ে গেলো?তোপের মুখে ফেলে তাকে এভাবে বিয়ে করা কল্পনার কল্পনাতেও কি ভাবনীয় ছিলো? হাতের আঙুল কাপছে অন্বেষার। সাইন করলো।বর্ণ নিজের দিকে টেনে নেয় কলম।দ্রুত হাতে সাইন করে লম্বা এক নিঃশ্বাস ফেলে পিঠ এলিয়ে দেয় পেছনে।
সময় পেরোলো কিছু।বেরিয়ে আসে বর্ণ অন্বেষা।সাথে সাব্বির ও তার বাবা মা।তারা তেমন কোনো কথা বললেন না তাদের দুজনের মাঝে দুজনকে রেখে চলে গেলেন।অনেক সময় পর মুখ খুলে অন্বেষা।টলমল চোখ জোড়ায় প্রশ্ন।মুখ ফুটে জিজ্ঞাসা করে ফেললো বেখেয়ালি বর্ণকে,
“কেনো করলে?”
বরাবরের মতই গুরুত্বহীন মুখভঙ্গি।অবিচল দৃষ্টি।জবাব তবে ভারী গলায় আসে,
“দয়ার বদলে দয়া”
“দয়া দেখিয়ে নিজের ইচ্ছের বাইরে আমাকে বিয়ে করার মত ছেলে নয় বর্ণ”
বর্ণ শব্দ করে ছলনাচ্ছলে হেসে বললো,
“তোমারে কে কইছে আমি আমার ইচ্ছার বাইরে তোমারে বিয়া করছি?”
“করেছো!”
“তুমি তোমার চাওয়া পূরণ করলা”
বর্ণ পকেটে হাত গুঁজে অন্বেষার মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। দুর্বোধ্য দৃঢ় চাহনি।এই দৃষ্টি বোঝার উপায় ক্ষীণ।বললো,
“তুমি জিতলা,আমি হারলাম….একটা কথা মনে আছে?আমি কইছিলাম আমি হাইরা গিয়াও বিজয়ী হওয়া মানুষ?…. মানে তুমি হারছো আর আমি?”
“জিতলে”
ব্যাঙ্গাত্মক হেসে বর্ণ জবাব দেয়,
“অনেক বুদ্ধি তোমার মাথায়।এবার বাড়িতে যাও।”
বলে অন্বেষার বাহুতে মৃদু ধাক্কা দিয়ে তাকে গলির ভিতরে এগিয়ে দিলো। অন্বেষার মাথায় খেলেনি বিষয়টি।বিয়ে হলে মানুষ তার স্বামীর সাথে থাকে।বর্ণ তাকে ধাক্কা দিয়ে আগের বাড়িতে পাঠাচ্ছে।
অবোধ মস্তিষ্ক কয়েক সেকেন্ডে সামলে যায়।সে প্রস্তুত না বর্ণের সাথে থাকার জন্য।হয়তো বর্ণের ক্ষেত্রেও একই।একবার ফিরে তাকালো বর্ণের দিকে। অপরিচিত থেকে স্বামী হওয়ার পথ অদ্ভুত ছিলো।মাথা নামিয়ে চলে গেলো।বর্ণ দাঁড়িয়ে আছে।
অন্বেষা গেটের দ্বারে পৌঁছে আবারো ফিরে চাইলো।এখনও সেখানেই পকেটে হাত গুঁজে উপস্থিত লোকটি।পরপর চলে গেলো নিজের ঘরে।বর্ণ দম ফেলে।আকস্মিক স্বল্প বল প্রয়োগে ঘুষি দিলো দেয়ালে।
_____
চিত্তের বর্ণহীন অনুভূতি যেন এক বিষণ্ণ রাগিণী বাজিয়ে চলেছে।কালো সুতোয় মোড়ানো হৃদপিণ্ড কাপছে।অন্বেষার সাথে বিয়ে করে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করলো বটে, কিন্তু অনিশ্চয়তার আঁধার যেন প্রতিটি পদক্ষেপে তাকে ঘিরে ফেলছে।চিত্তের কোণে কোণে প্রশ্নের বুদবুদ উঠছে,কি হবে এরপর? কোন ধারায় ভেসে যাবে জীবনের প্রত্যেকটা দিন?’ আলোছায়ায় মন যেন দোল খাচ্ছে। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হলেও, অজানা ভবিষ্যতের দ্বারে দাঁড়িয়ে সে ভাবছে – ‘অন্বেষা কি সত্যিই তার জীবনের সমাধান হবে, নাকি আরও নতুন জটিলতার সৃষ্টি করবে?’।এই অনিশ্চিত পথে বিরাগ অনুভূতি যেন প্রতিধ্বনি তুলছে বারবার।হয়তো উত্তর খুঁজতে হবে সময়ের হাত ধরে।
নিঃশব্দে ছাদের রেলিং ঘেঁষে বসে বর্ণ। পায়ে নেই কোনো জুতো।একটি হাঁটু উচুঁ করে ভাজ করেছে সেখানে হাত রেখেছে।অন্যটি জমিনে সোজাসুজিভাবে রাখা।আকাশপানে তুলে রয় মুখ।একের পর এক সিগারেট শেষ করছে।নিজের টাকায় কিনেছে এবারে।আজ সেই ভার এই মস্তিষ্কে সেটি সামান্য কমানোর আশায়।রঙ বদলায় তার দৃষ্টি।বাতাসে মিশে যায় সে বর্ণের অশান্ত অনুভবেরা।বক্ষ গহ্বরে নাম না জানা ঝড়।জীবনের মেলায় যেনো হারিয়ে যায় গানের সুর।সেখানে কেবলই নিস্তব্ধতা।এই নিস্তব্ধতার ভাগীদার জুটালো আজ?
“কি করলাম!কেন করলাম!”
ফটাফট সোজা হয়ে যায় বর্ণ।কেমন যেনো ছটফটে অনুভুতি হলো তার মাঝে।পাগল পাগল লাগতে শুরু করলো নিজেকে।চুল খামচে ধরলো দ্রুত গতিতে শ্বাস প্রশ্বাস ফেলতে ফেলতে।মুখ খামচে নিজের মধ্যে অবস্থানরত অজানা দুর্বলতার উপর জয় পেতে চাইলো।বুক কেঁপে কেঁপে উঠছে।
নিজেকে নিজেই নিষ্প্রতিভ সুরে প্রশ্ন করে,
“এরপর কি?ভাবলাম না!চিন্তা করলাম না!কি করমু!সংসার?”
একে একে সব কিছু বদলে যায়।অনুভূতির রঙ, হাসির ছন্দ।কিন্তু তার মনে রয়ে যায় একটাই প্রশ্ন।এই পরিবর্তনের সংজ্ঞা কি?শূন্যতা নাকি পরিপূর্ণতা? কোনোদিক বিবেচনা করে এরূপ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
“আমার অন্তর যে পোড়া কয়লা ওয় কি জানে?”
বিভোর বর্ণ।এভাবেই রাত কাটাচ্ছে ছাদে।বুক ধড়ফড় করছে তার।জনির চোখ পড়েছিলো অন্বেষার উপর। কানাকানিতে শুনেছে বিয়ে করতে চায় তাকে।ঠিক তখনই এই মগজ উল্টোপাল্টা তাড়না দেওয়া শুরু করে।চিন্তা চেতনার এলোমেলো সঞ্চারণ।কি থেকে কি করবে বুঝতে পারছিলো না বর্ণ। উদগ্রীব হয়ে উঠে।উন্মত্ত হয়ে বিয়ে করেই নিলো।
“ভবিষ্যত কি এই সম্পর্কের?”
ভাঙা দুটো কাঠের টুকরো ছাদে।বর্ণের চোখ গেলো সেখানে।আপনাআপনি হাতজোড়া এগোয় সেদিকে। ভগ্ন দুইজোড়া কাঠকে একত্রিত করে। ভাঙা দাগ রয়ে গেছে।তবে একত্রিত।অসম্পূর্ণ কাঠের পৃথক টুকরো যেনো একগঙ্গা।
পকেটে গুঁজে নেয় বর্ণ কিছুটা ভঙ্গুর তবে সম্পূর্ণ কাঠের টুকরোকে।দেহ ছেড়ে দিলো ময়লামাখা ছাদ জমিনে।হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে দেখছে।উঠানামা করছে বুক। নেত্রযুগল ক্ষুদ্রায়তন।দর্শনে সেই নিকষ কালো আঁধার।
__________
ভোরের আলো থেকে গোধূলির রাঙা আকাশ।জীবনের কাহিনীগুলো নানান রঙের পরশ দিয়ে যায়। সাদা পাতায় আঁকা কালি, দিনান্তে হল রঙিন।এই জগতে চলমান পথিকের অজানা যাত্রা।অজানার পথে চলতে চলতে হলো পরিচয় বিবর্ণ রঙের সাথেও। অবশেষে এই পরিচয়ে যোগ হয়েছে মাত্রা।সুপ্ত ভালোবাসার স্রোতে ভাসা এক নীরব চিত্ত।একটি নিরব সন্ধ্যার কোলে ছিলো নির্লিপ্ত। কি থেকে কি হয়ে গেলো?সময়ের সাথে মিলিয়ে গেলো সব পরিকল্পনারা।জীবনের প্রতিটি পর্বের শুরু বড্ড নাটকীয়। এই পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে প্রতিটি চরিত্র অভিনেতা। অন্বেষারও ঠিক একই প্রশ্ন।এরপর কি হবে?
“এতো রাতে কোথায় গিয়েছিলে?”
“বিয়ে করতে”
সুদীপ্তা চমকে উঠে। অন্বেষা বসে আছে হ্যাবলার মত।প্রশ্নের জবাব দিয়েছে।তবে এই জবাবের জন্য সুদীপ্তা মোটেও প্রস্তুত ছিলো না।
এগিয়ে এসে পাশে বসলো অন্বেষার।মুখে চোখ বুলিয়ে প্রশ্ন করে,
“মানে?”
অন্বেষা মুখ তুলে চায়।সুদীপ্তার বিষম খাওয়া মুখ দেখে কি বলবে বুঝতে পারছে না।এই বিষয়টি বুঝিয়ে বলার মত নয়।একবাক্যে শেষ করার মতোও নয়।নিজেই এখন পর্যন্ত বিষয়টি মস্তিষ্কে ধারণ করতে পারছে না।সংকট নিজস্ব শব্দভাণ্ডারে।
“দিদি আমি ঘুমাই?এখন কিছুই বুঝিয়ে বলার মত অবস্থা আমার নেই।তবে আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।নতুন জীবন শুরু হয়েছে আমার…..”
________
শীতের আগমনী ছুঁয়ে যাচ্ছে নগরীর পথ।হিমেল হাওয়ায় দুলছে সব।মিশে গেছে গোধূলির রথ।কুয়াশার চাদরে ঢাকতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে।ক্লান্ত দুপুরের শেষ ভাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় চায়ের দোকানের ধোঁয়া ওঠছে।সুরময় হতে শুরু করেছে নতুন কলরব।বিলবোর্ডের আলো ঝলমলে সন্ধ্যার শহরবাতি।
বেঞ্চি খচখচ আওয়াজে বিশ টাকার একটি পুরোনো নোট অন্বেষার দিকে এগিয়ে এলো।আশপাশে মানুষের কন্ঠধ্বনি ও রিকশার ক্রিং ক্রিং বেলের আওয়াজ আসলেও অন্বেষা ও বর্ণের মাঝে শুনশান নীরবতা।অবিরাম তোলপাড় চলছে উভয় চিত্তে।আজ বর্ণ নীরব।উন্মুক্ত লাইব্রেরীর সেই চিরচেনা সবুজ বেঞ্চিতে বসে।বর্ণকে দেখে তার ভেতর দুর্বোধ্য ব্যাকুলতা কাজ করছে।মনস্থির করতে করতে সে স্বাভাবিক হতে চাইল।ধীরস্থিরভাবে সে প্রশ্ন রাখল,
“আজ বর্ণ কেনো বিবর্ণ?”
এরূপ মোলায়েম মৃদু গুঞ্জন কর্ণপাত হতেই বর্ণ নড়েচড়ে উঠে।বোধোদয় হলো যেনো তার।নাহয় গতরাত থেকে বিবিধ কল্পনারা বাসা বেঁধেছে মগজে।বর্ণ তার প্রশ্নটি উপেক্ষা করে গেলো। ঘাড় পাশে দুলিয়ে বলে,
“তোমার মোহরানা আমি বিশ টাকা ধরছি জানো?”
নীরব হাসে অন্বেষা।বলে,
“জানার মত পরিস্থিতিতে বিয়ে করেছিলে?গলায় ছুরি ধরে বিয়ে করেছো!আমি জীবন নিয়ে শঙ্কায় ছিলাম।আবার মোহরানা!”
বর্ণ তেরছা চোখে তাকায়।বোঝার চেষ্টা করলো মজা করছে নাকি সিরিয়াস।আজ তার মেজাজটা গম্ভীর। বললো,
“টাকা দিছি দেখছো?”
বেঞ্চিতে রাখা টাকার দিকে চাইলো অন্বেষা। ইচ্ছেকৃত ঘাড়ত্যাড়ামো করলো।নিলো না টাকাটা।বললো,
“যেদিন নিজের ঘরে নিবে সেদিন নিবো…আর আমি স্বল্প মোহরানাতে রাজি না।তোমাকে ভরসা করা যায় না। কবে যেনো বলে ফেলো ‘তোমাকে আমার আর ভালো লাগছে না ছেমড়ি,চলে যাও’।রিস্ক নিবো না একদম”
দুহাত বেঞ্চিতে ছড়িয়ে পায়ের উপর পা তুলে জবাব দিলো,
“ভালোতো এহনও লাগে না।আর ঘর?আমার কোনো ঘর নাই”
অন্বেষা চকিত হয়ে প্রশ্ন করলো,
“তাহলে?এই বিয়ে?কি এসব!তুমি কি আমার সাথে মজা করলে?”
বর্ণ অন্বেষার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
“অস্থির হইতাছো কেন ছেড়ি? মাইয়া মানুষের এই বেশি বুঝার স্বভাব আমার বিষ এর মতো লাগে।আমি জানি আমি কি করছি!আর আমি এটাও জানি আমি সামনে কি করমু!”
“কি করবে?” বিপন্ন কণ্ঠে জানতে চাইলো অন্বেষা।
“আমি কি করমু ঐটা তোমার ছোট খুপড়ির মত ঘিলুতে ঢুকবো না কিন্তু তুমি কি করবা আমি তোমার জানায় দিতাছি…..কেউ তোমারে জিগাইলে কি কইবা?”
অন্বেষা বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন করলো, “কি বলবো?”
“কইবা তুমি বিবাহিত!….বিশেষ কইরা মহল্লার কেউ জিগাইলে।”
অন্বেষা দৃষ্টি নামায়।সেটা আর বলতে?সে বিবাহিত এটা তার মস্তিষ্ক ক্ষণে ক্ষণে স্মৃতি রোমন্থন করে মনে করিয়ে দেয়। বাকহীন রইলো অন্বেষা।বর্ণ ঘাড় বেঁকিয়ে কপাল কুঁচকে তাকালো।আদেশ করার ভঙ্গিতে বললো,
“কথা কানে ঢুকছে?”
অন্বেষা দৃষ্টি তুলে।বলে,
“থ্রেট দিচ্ছো?আর কিসের ভিত্তিতে বলবো?যে আমাকে বিয়ে করে ধাক্কা দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে তার কথা আমি কেনো শুনবো? এটা কোনো বিয়ে হলো?”
“কত শখ তোমার!”
“অনেক”
“আসল কথা কও! বিয়া কইরা নিয়তে খোট হইছে। আমার লগে থাকতে চাও।আমার কাছে আয়া ঘেষাঘেষি করতে চাও। বন্দী এক ঘরে,আমার বিছা….”
নিচ থেকে হুট করে ইট তুলে নিলো অন্বেষা। মারবে বলে ভয় দেখিয়ে বললো,
“একদম চোপায় উড়িয়ে মারবো আজেবাজে নোংরা কথা বললে!”
রাগে রাগে কাটাকাটি করলো বর্ণ। অন্বেষা হুট করে রেগে যাওয়ায় সেও চাপা বিক্ষুব্ধ স্বরে বলে উঠে কিছুটা এগিয়ে,
“কলিজা বড় হইয়া গেছে? টান দিয়া বাইর কইরা ফালামু!”
অন্বেষাও যেনো নির্ভীক। অগ্নিচক্ষু প্রদর্শন করে বলে উঠে,
“তোমার এসব থ্রেট আমি ভয় পাই না।আর নিবো যা কোনো মোহরানার টাকা।নিয়ে যাও।সিগারেট কিনে খাবে”
গভীর নিঃশ্বাস ত্যাগ করে নিজেকে প্রশান্ত করলো বর্ণ।মেজাজ খারাপ করতেও ইচ্ছে হচ্ছে না তার।অদ্ভুত ইচ্ছে হচ্ছে। কোথাও কোনো কোলাহলে একাকী বসে থাকতে। থম মেরে।কেউ কোনো কথা বলবে না,প্রশ্ন করবে না।সে ভাববে অযথা ভাবনা।
“তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে তুমি বিয়ে করে বিষন্ন।কই?কে যেনো বলেছিলো সে খারাপের মাঝে ভালো থাকতে জানে? হেরে গিয়েও জিতে যায়?”
“ব্যাটা মানুষের মেলে থাকবা?আমি ব্যাচেলর থাকি।আমার লগে আরো তিনটা জুয়ান পোলা থাকে।ওগো মধ্যে তোমারে রাখুম হ্যাঁ! বালের আবেগী প্যাঁচাল পারলেই হয়না।আমারে এক তারিখ থিকা গার্মেন্টসে যাইতে না করছে। কাম নাই কাজ নাই।সকালে,দুপুরে,রাইতে কি গিলবা?আমারে গিলবা?”
বলে অন্বেষার ব্যাগটা ছো মেরে নিয়ে নিলো বর্ণ।ব্যাগের চেইন খুলে বিশ টাকা রেখে আবার ব্যাগ স্বল্প বল প্রয়োগ করে ছুঁড়ে দেয় অন্বেষার দিকে।বলে,
“এমনেই আমার মাথাটা খাইছো। কোন জন্মের পাপ পোহাইতাছি আল্লাহ জানে।”
অন্বেষা কিছুটা এগিয়ে এসে বসলো। বাঁকা চোখে বর্ণ দেখলো সেটি।তবে তাদের মধ্যে দূরত্ব আছে। নরম কন্ঠ এবং বুঝানোর ভঙ্গিতে অন্বেষা বললো,
“দুইজনের খাওয়া দাওয়াতে আর কতই খরচ যায় বলো?ম্যানেজ করে নিবো।তুমি ততদিনে আরেকটা কাজ খুঁজে পাবে।ভালোই হয়েছে।সারারাত জেগে কাজ করা এমনিতেও ঠিক না।আর বাড়ি?তুমি অন্য একটা ঘর দেখো?আশপাশে।নাহয় আমি যেখানে থাকি…..”
অন্বেষার কথা সম্পূর্ণ হতে না দিয়ে বর্ণ বলে উঠে,
“নাহ!আমি ওদিকে থাকমু না।আর তোমার এত তাড়া কিয়ের ভাই?ধৈর্য ধরতে পারো না?”
বর্ণের মুখে ভেসে বেড়াচ্ছে অনেক চিন্তার গল্প।স্বীকার করছে না।সংযত রেখেছে নিজেকে। দুর্ভাবনায় জর্জরিত মুখাবয়ব দৃষ্টিগোচর হয় অন্বেষার।ব্যাগ থেকে ঠান্ডা পানির বোতল বের করে এগিয়ে দিলো তার দিকে।বর্ণ অন্যদিকে চেয়েই হাতে নেয়।গটগট করে গিলে শেষ করে।বোতল মুচড়ে ফেললো একহাতে। অন্বেষা হিম পবনের ন্যায় শীতল গলায় বলে বসে,
“আমার একটা সাদামাটা সুখের সংসার চাই বর্ণ।যেখানে কি তোমার?কি আমার?সব আমাদের।”
চলবে…..