#উন্মুক্ত_লাইব্রেরী
লেখা – আয্যাহ সূচনা
২১.
চালের দোকানের সামনে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে বর্ণ। দাঁতের পাটি বের করে মোকলেস মাতবরের পানে চেয়ে।সবসময়ের মত তার হাসির রহস্য বুঝলেন না মোকলেস মাতবর।প্রশ্ন করার ইচ্ছাটুকু নেই।এভাবে হিসাবের খাতায় মনোযোগী হন।
“আপনার পোলা কই?”
বর্ণের প্রশ্নের জবাবে মোকলেস সাহেব হলে উঠেন,
“তোর আমার পোলারে দিয়া কাম কি?”
“আপনার পোলার উপরে দুয়েকবার হাত না ঝাড়লে আমার আত্মা ঠান্ডা হয়না।সপ্তাহে দুয়েকবার পাঠাইবেন আমার কাছে।মাল যন্ত্র যেটিতে জং ধরছে ঝালাই কইরা দিমু নে।”
“আমার পোলার গায়ে আবার একটা ফুলের টোকা পড়ুক! তোরে জিন্দা গাড়ুম!”
চেঁচিয়ে উঠলেন মোকলেস সাহেব।কণ্ঠে ঝাঁঝ মিশ্রিত।চোখজোড়া রক্তবর্ণ।হুট করে এভাবে রেগে যাওয়া দেখে বর্ণ উচ্চ হাসে। শত্রুকে খেপানোর মাঝেও আলাদা বিজয়ের সুবাস মিশ্রিত।রেগে গিয়ে যত গলা উঁচু করবে,ছটফট করবে ততই প্রশান্তি মিলবে।
“আরেহ আপনিতো চেইতা গেলেন।কুল কুল!এই বয়সে এত তেজ ভালা না।”
“তুই সর চক্ষের সামনে থিকা!”
“গ্রাহকরে কেউ এমনে খেদায় দেয়?আমিতো চাইল কিনতে আইছি।এলাকার স্বনামধন্য চাইল বিক্রেতা আপনে।তাই আপনার কাছেই আইলাম।”
ব্যবসায় হেলাফেলা করা যাবেনা। ব্যক্তিগত শত্রুতা তার নিজের জায়গায়।দোকানে কর্মরত এক ছেলেকে ডেকে বললেন বর্ণের কি লাগে সেটা দিতে।বর্ণ হাসি মুখে দু কেজি চাল নিলো।নিয়ে টাকা না দিয়েই হাঁটতে শুরু করলে মোকলেস মাতবর দৌঁড়ে বেরিয়ে এলেন।গালি দিয়ে বললেন,
“এই জানোয়ার এর বাচ্চা ট্যাকা কে দিবো?”
বর্ণ কিছু পথ এগিয়েছিল।ফিরে চেয়ে প্রশ্ন করে,
“টাকা লাগবো নাকি আবার?”
“লাগবো না তাইলে?জমিদারি পাইছোস নিহি?”
“হ জমিদারি পাইছি।যেদিন জমিদারি ছাড়ুম ওইদিন আপনে পচতাইবেন সবচেয়ে বেশি।……..কি কইছি বুঝছেন না?”
অর্ধেক কথা বলে মোকলেস সাহেবকে অজানা অদৃশ্য ভয়ে ফেলে দেওয়ার স্বভাব পুরোনো বর্ণের।ছেলের হাড় ভাঙার পর এখন পর্যন্ত সোজা হয়ে হাঁটতে পারেনা সে।উল্টো থানায় জিডি করে এসেছে বর্ণ।তার কখনো কিছু হলে সমস্ত দায়ভার মোকলেস মাতবর এবং তার ছেলের।সম্পূর্ণ এলাকাবাসী জানে এই খবর।উপায় পাচ্ছে না খুঁজে তাকে এলাকা থেকে বের করার।এলাকার গন্যমান্য ব্যক্তিদের সাথে এবার আলোচনায় না বসলেই নয়।চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা দোলান মোকলেস মাতবর।বর্ণের ব্যবস্থা করতেই হবে।
বাড়ির সদর দরজায় এসে বিরক্তির চরম সীমায় বর্ণ।সামনেই ওড়নায় আঙ্গুল পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে আসছে সাদিয়া।কপালে আঙ্গুল চালিয়ে এড়িয়ে যেতে চেয়েও পারলো না।সাদিয়া ডেকে বসে।
অভিমানী গলায় সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
“হুনলাম বিয়া করছো?”
“হ”
“কামটা কি ভালো হইলো?” দুখিনীর মত প্রশ্ন করলো সাদিয়া।
“তোমারে কেঠা কইলো?”
“সাব্বিরের মা আমগো বাড়িত কাম করে।হেই কইছে।”
“ওহ আচ্ছা”
“তোমার না বলে কি সমস্যা আছে?তাইলে বিয়া করলা কেমনে?আমারে না কইরা?”
ভনিতা করে বর্ণ বলে উঠে,
“তোমারে বিয়া না করার আরো একটা কারণ আছেগো ছাদিয়া!”
“সাদিয়া আমার নাম….. কি কারণ হুনি?”
“কারণ হইলো তোমার এই চেহারা”
সাদিয়া মুখে হাত রাখে।তার চেহারার সাথে বিয়ে না করার কারণ?জানতে চেয়ে প্রশ্ন করে,
“কি হইছে আমার চেহারায়?”
বর্ণ বলে উঠলো,
“এত সুন্দর চেহারার মাইয়া যদি মা হইবার না পারে কেমন দেহায় কও?আমি কাউলা একটা পোলা।তোমার লগে মানাইবো না।আমি যেই ছেমড়িরে বিয়া করছি দেখতে এক্কেরে কটকটির মতো।ছিঃ!এত্ত বিশ্রী কি কমু। আন্ধারে বাত্তি ছাড়া দেহাই যায় না।আমার সিস্টেমে সমস্যা দেইখাই তো এই কালীরে বিয়া করছি নইলে আমি তোমারে কষ্ট দিবার পারি কও?”
এক নিঃশ্বাসে অনবরত মিথ্যে কথা বলে দম ফেললো বর্ণ।সাদিয়া বুঝতে পারছে না হাসবে নাকি মন খারাপ করবে? কাদো কাদো মুখে জানতে চাইলো,
“আমি অনেক সুন্দর না?”
“পুরাই হুরপরী!”
সাদিয়া হাসলো। মিথ্যে প্রশংসায় বেশ খুশি সে।অল্প খানিক সান্ত্বনা নিয়ে হেলেদুলে হাঁটতে শুরু করে।বর্ণ তার যাওয়ার পানে চেয়ে ধীর কণ্ঠে বলে উঠে,
“কুত্তাও পুছবো না তোরে!”
সাদিয়া পিছু ফিরে চায়। প্রশ্ন করে,
“কিছু কইলা?”
বর্ণ দ্রুত মাথা দুলিয়ে জবাব দেয়,
“না না আফসোস করতাছিলাম আরকি!”
_________
অনেক লম্বা সময় পর সকালের নাস্তা দেখে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো বর্ণ।এই প্রাণহীন আত্মায় আবেগ এলো কি করে?অন্তর কাঁপছে অবিরামভাবে।মনে পড়লো মায়ের কথা।এভাবেই সকাল বেলা পরোটা আর আলুভাজি নিয়ে হাজির হতেন।পরম যত্নে খাইয়ে দিতেন মুখে তুলে।তার কেউ ছিলো না। একমাত্র পুত্রধন ছাড়া। অন্বেষা দেখলো বর্ণের মুখপৃষ্ট।নির্জীব মূর্তির মত থমকে।বিষাদভারাতুর দৃষ্টি তুলে তাকালো অন্বেষার দিকে।
অন্বেষা বললো,
“খাচ্ছো না কেনো?”
“তুমি বানাইছো?”
“হুম”
“আটা কই পাইলা?”
অন্বেষা বললো,
“পেট চালানোর জন্য মানুষ চুরি পর্যন্ত করে।আমিতো তোমার মত না যে নিজের উপর নিজে জুলুম করবো।কষ্ট দিবো নিজেকে।সৃষ্টিকর্তার দেওয়া আত্মা,দেহ,অন্তর এর উপর জুলুম করার অধিকার আমাদের নেই।তাই আমি সবকিছুর ব্যবস্থা করা শেষে নিজের ব্যবস্থাটুকু করে রাখি।”
বর্ণ অবসন্ন হয়ে বলে উঠে,
“একটা প্রশ্ন জিগাইছি।ভাষণ দিতে কই নাই।”
অন্বেষার বলা কথাগুলো তার কাছে কোনোভাবেই অযৌক্তিক মনে হচ্ছে না।যা বলেছে বেশ বলেছে। কপট রাগ দেখিয়ে বলে উঠলো,
“আমার কথা ভালো লাগবে কেনো?ভালো লাগবে ওড়নায় আঙ্গুল পেঁচাতে থাকা ঢঙ্গি মেয়েদের কথা। দীর্ঘলাপ করলেও দোষ নেই।আমি একটা শব্দ বললে বিরাট পাপ।”
আকার ইঙ্গিতে কি এবং কার কথা বলা হচ্ছে বুঝতে ভুল হয়নি বর্ণের। ভারাক্রান্ত মনটা অদ্ভুতভাবে রেহাই পেলো। আলগোছে হাসলো বর্ণ।আরো একটু জ্বালালে মন্দ হয়না। গুরুত্বহীনভাবে খাবারে মনোযোগ দিলো।
অন্বেষা রেগে যায়।বর্ণের যে মতলব ছিলো সেটা পূর্ণ হয়েছে। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো রাগে গদগদ করতে থাকা অন্বেষার মুখ।
কোনো প্রকার কদর না পেয়ে অন্বেষা বললো,
“আমি বেরোবো একটু পর।খাবার রান্না হয়ে গেছে।ভালো মানুষের মতো খেয়ে নিবে।”
বর্ণ পরোটা মুখে হাত নাড়িয়ে বললো,
“দুর হও”
রাগ বেড়ে গিয়ে অগ্নিমানবী রূপ ধারণ করে অন্বেষা।বর্ণের সামনে থেকে খাবারের প্লেট কেড়ে নিয়ে বললো,
“খাওয়া লাগবে না তোমার। উপোস থাকো!”
“আয়হায়!এই ছেড়ি খিদা লাগছে কইলাম! ফিরত দাও”
বলে এক প্রকার অন্বেষার হাত থেকে খাবার প্লেট পূনরায় হাতিয়ে নিলো। ফুঁসতে লাগলো অন্বেষা। অতিরিক্ত রেগে গেলে মুখ ফুটে কথা বেরোয় না। ঠোঁট শক্ত করে চেপে দাঁড়িয়ে রইলো।বর্ণ হাসছে।তার বাজে স্বভাব অযথা অকারণে হাসার।আগুনে আরেকটু খানি ঘি যোগ করে ওড়না টেনে ধরলো। বিগত দুদিন যাবত তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে এটি। বল প্রয়োগে ওড়নার সাথে সাথে অন্বেষাকেও কিছুটা এগিয়ে আনলো।রাগের সাথে সাথে অসস্তি যোগ হয় অন্বেষার।চোখ নামিয়ে নিলো সাথে সাথে।মুখের চারিপাশ ভালোভাবে মুছে বর্ণ ঢেঁকুর তুলে।ওড়নার শেষভাগ অন্বেষার মুখের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বললো,
“পরিষ্কার জিনিস ময়লা করতে আমার হেব্বি মজা লাগে।”
কয়েক মিনিটে সাবাড় করা নাস্তার খালি প্লেট তুলে নেয় অন্বেষা।সকাল সকাল আফজাল মিয়ার স্ত্রীর তদারকীতে পানির নল ঠিক করেছে।প্লেট ধুয়ে ভাত বসালো অন্বেষা।বিছানায় আরাম করে আধ শোয়া হয়ে তাকে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে বর্ণ।
ভার্সিটি নেই কিন্তু কাজে যেতেই হবে।একদিন কামাই করার কারণে টাকা কাটবে নিশ্চিত।কি আর করার?ভাগ্য বলে মেনে নিলো। একদিন কাজ না করে নিজের সংসার গুছিয়ে নিয়েছে এরচেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কি হতে পারে।তবে অন্বেষার মন প্রশ্ন করলো,
“তবে এই সংসার যে বড্ড অনুভুতিহীন।”
মনের কাজই প্রতারণা করা।বিছানায় বসে অন্বেষার ফোনে বাবল শুটার গেম খেলতে থাকা বর্ণের দিকে চেয়ে মুচকি হাসলো।নিজের মনকে বুঝ দিলো,
“আমি আশাবাদী,খুব শীগ্রই অনুভূতির ধ্বনি ভেসে বেড়াবে এই চার দেয়ালে। তাড়াহুড়োর সব কাজই শয়তানের।”
নিজেকে পরিপাটি করলো অন্বেষা।চুল খোঁপা করে মাথায় ওড়না পেঁচালো সেফটিপিন দিয়ে।কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বর্ণের কাছে গিয়ে ফোন কেড়ে নেয়।বলে,
“খাবার গরম করে নিবে।আমি সন্ধ্যায় ফিরবো।”
অন্বেষা দরজার দ্বারে গিয়ে দাঁড়ালে বর্ণ অযথা বাঁধ পেতে দাঁড়ায়।উদ্দেশ্য তাকে বিরক্ত করা ভালোভাবেই বুঝেছে।সকালে সাদিয়ার সাথে কথা বলা নিয়ে ফুলে বোম হয়ে আছে অন্বেষা এটা বর্ণের অজানা নয়।
অন্বেষা চেঁচিয়ে বললো,
“কি সমস্যা?”
বর্ণ সুরেলা কণ্ঠে বলে উঠলো,
“মনে চায় তোমারে বাইন্ধা রাখি এই চাইর দেয়ালে।”
অন্বেষা নাক ফুলিয়ে বলে উঠে,
“যত্তসব ঢং!”
বুকে ধাক্কা গিয়ে বেরিয়ে গেলো। জানা আছে বেকুবের মতো হাসছে বর্ণ পিছনে দাঁড়িয়ে।তার হাসির চেয়ে কাজে যাওয়া বেশি দরকারি।
_________
সারাক্ষণ মুখে মিথ্যে হাসি টেনে রাখা বর্ণ প্রায়শই একাকী গম্ভীর হয়ে উঠে।অন্বেষার বের হওয়ার সাথে সাথে সেও বেরিয়ে পড়ে। টিউশনে যাবে।উন্মুক্ত লাইব্রেরীর দিকে যাওয়ার পথে তাকালো একবার।এখানে তার কেনো যেনো আজ মন টানছে না।বই পড়ার সঙ্গী এখন তার চিরসঙ্গী।তারই ঘরে ঘাঁটি জমিয়েছে।
স্টুডেন্ট এর মায়ের কাছে বেতন বাড়াতে বললো বর্ণ।তিন হাজার টাকায় কিছুই হয়না।যেখানে তার চাকরিও নেই।ছাত্রের মা জানিয়েছেন ভেবে দেখবেন।প্রায় দুই ঘন্টা পড়ানো শেষে বেরিয়ে পড়লো ধোলাই খালের উদ্দেশ্যে। যন্ত্রপাতি,গাড়ির পার্টস ইত্যাদির ব্যবসা এখানে।দেখতে যেমন তেমন কিন্তু ধোলাইখাল এর ব্যবসা সর্বদা জমজমাট থাকে।দোকান মালিকদের মধ্যে বেশিরভাগই বিরাট বড়লোক।আপাতত এখানে কাজ খুঁজা মুখ্য।
বর্ণ নিজেকে নিজে বলে উঠলো,
“গরীব হইছোস শালা কিন্তু আত্মসম্মান এত বেশি ক্যালা? গরীবের এত আত্মসম্মান থাকবার নাই।এসব বড়লোকের কাজ করবার।”
পুরুষ জাতির পুংভাব যেনো ঘাড় চেপে ধরলো। কিছুতেই মানতে পারছে না সম্পূর্ণ সংসারের ভার একা অন্বেষা বহন করবে।পৌরুষ গৌরব মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে।এটাই হয়তো সমাজের নিয়ম।এভাবেই বড় হয়েছে তারা।যুগের পর যুগ এই নিয়মে চলছে সর্বকুলের মানুষ। পুরুষত্বের অহংকারে দাবিয়ে রাখা হচ্ছে নারীকে।যেখানে সিংহভাগ সম্মান পাওয়ার যোগ্য নারীকূল।
_________
বর্ণের বাড়ি ফিরতে প্রায় রাত নয়টা। অন্বেষা রান্না করে পাঠিয়ে দিয়েছে জব্বার চাচার কাছে।ময়লা হয়ে থাকা আশপাশ পরিষ্কার করতে করতে অনুভব করলো কেউ তার ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে।ভয় হলো না এক বিন্দু।নিজের কাজে লেগে পড়লো।
বর্ণ অন্বেষার কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,
“সকালে যে ছেড়িটারে দেখলা না?ওর নাম সাদিয়া।বর্ণ কইতেই ফিট।আমার লেইগা পাগল বুঝলা? ওরে নিয়া একটু ঘুইরা আইলাম।”
রক্ত টগবগ করে উঠে অন্বেষার।ইচ্ছে হলো কনুই দিয়ে আঘাত করে বুকের হাড়গোড় গুড়িয়ে ফেলুক।তবে বেশি ব্যথা পেলে তারই অন্তর পুড়বে।সরে গেলো সেখান থেকে। থালা বাসন আওয়াজ করে কাজ করতে লাগলো।রাতের খাবার এনে বর্ণের সামনে শব্দ করে রেখে নিজেও খেতে বসে।
খাওয়া শেষে বারান্দায় গিয়ে মুখ ফুলিয়ে বসে অন্বেষা। মনের কোণে আশার দানা বাঁধতে শুরু করে এসে ক্ষমা চাইবে।সামান্য উঁকি দিয়ে বর্ণকে আবারো অন্বেষার ফোনে গেম খেলতে দেখে সেই আশাটাও ভেস্তে গেলো। অন্বেষাও পণ করে।সেও এখানেই থাকবে সারারাত।
কাটায় কাটায় আড়াই ঘন্টা গেম খেলে ফোনের চার্জ শেষ করেছে। ফোন বন্ধ হয়ে গেলে মনে পড়লো বর্ণের,তার একটা বউও আছে।যে অনেকক্ষণ হলো গায়েব।ফোন চার্জে রেখে বারান্দার দিকে পা বাড়ায়।গিয়ে দেখলো দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে গভীর ঘুমে মগ্ন অন্বেষা।
বর্ণ ডাকে,
“এই ছেড়ি এই!”
কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায়নি। অন্বেষার ঘুম ভারী।কেউ তুলে নিয়ে গেলেও হদিস মিলবে না।বর্ণ কয়েকদফা বাহু ঝাঁকায়।উঠলো না। উল্টো ঘুমের মাঝেও তেজ দেখিয়ে হাত ঝাড়া দিয়ে বিড়বিড় করে কিছু একটা বললো।বর্ণ সাত পাঁচ না ভেবে একটানে তুলে নেয় অন্বেষাকে।দুহাত টেনে দাঁড় করিয়ে ঝুঁকে পাঁজাকোলে তুলে নিলো। অন্বেষা ঘুমের ঘোরেও যেনো শান্তি পাচ্ছে। গলা পেঁচিয়ে ধরলো দুইহাতে।
বর্ণ বলে উঠে,
“জাতে মাতাল তালে ঠিক!”
অন্বেষাকে শুইয়ে দিলো।কিন্তু নিজে উঠতে পারলো না।সাপের মত গলা পেঁচিয়ে রেখেছে।ঠিক বর্ণের বলা কালনাগিনীর মত।নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করার পূর্বেই চোখ স্থির হয় অতি নিকটে থাকা অন্বেষার মুখপানে।মুখ ফেরাতে পারেনি তৎক্ষনাৎ।টেনে ধরে রেখেছে যেনো কোনো অদৃশ্য শক্তি। কৃষ্ণাভ মুখটা সংকীর্ণ হয়ে উঠে। অন্বেষার হাতের বাঁধন আলগা হয়ে এলেও একচুল নড়লো না বর্ণ।এক ভিন্ন চাহনি আর ভিন্ন অস্থিরতার সহিত দেখছে তাকে।ঠিক গতরাতের মত।তবে এই দেখা আর সেই দেখায় তফাৎ আছে।আলাদা টান অনুভব করে।বুঝে উঠতে পারলো না সম্পর্কের সম্মোহনে পড়ছে কি?মস্তিষ্ক তাড়না দিলো। ত্বরিতে দেহ ভার ছেড়ে গ্রিবাদেশে মুখ গলিয়ে চোখ বুঁজলো সর্বাঙ্গীণ অচৈতন্যে।
চলবে……
#উন্মুক্ত_লাইব্রেরী
লেখা – আয্যাহ সূচনা
২২.
“ঘুমের ঘোরে ছিলাম।”
অবশেষে সেই তন্দ্রা বিলাস কাটে।বুকের উপর মনে হলো কেউ পাথর চেপে রেখেছে।ঘরের লাইট জ্বলছে। চারিদিক উপদ্রবশূন্য।ঘুমে আচ্ছন্ন চোখজোড়া খুলতেই রুহ কেঁপে উঠে। কুঁকড়ে যায় অন্বেষা।বর্ণের পরনের পোশাক খামচে ধরে সরানোর চেষ্টা করলো কিছুটা।
শান্তিতে পড়ে থাকা বর্ণ নির্ঘুম তবে অর্ধজ্ঞান।এই নিথরতা প্রশান্ত করে রেখেছিলো বর্ণকে।তার এই অব্যাকুল শবে বাঁধা দেয় অন্বেষার কুণ্ঠিত কন্ঠ। কম্পিত দেহ আঁকড়ে নিলো বর্ণ অধিকারবোধ দেখিয়ে।
“হুম” কাঁধে মুখ গুঁজে রেখেই বললো বর্ণ।
“ঘুমের রেশ কেটে গেছে। সরো”
বর্ণ ঝোড়ো নিঃশ্বাস ফেলে আধো আধো কন্ঠস্বরে বলে,
“আইছি তোমার ইচ্ছায়, যামু আমার ইচ্ছায়”
“কেনো?আমার সাথে জড়িয়ে থাকার ইচ্ছে কেনো?তুমিতো আমাকে পছন্দ করো না।”
“ কথা সত্য।কিন্তু আমি হাজার হোক ব্যাটা মানুষ।একটু অল্প কাছে টানলে বেশি কাছে আইতে চাইবো”
নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো না অন্বেষা।তার লাজের চেয়ে প্রশ্ন উত্তর বেশি জরুরি।দূরে ঠেলে দেওয়ার অধিকার নেই।সে এখন আর পর পুরুষ নয়।চাইলেও কাছে আসতে পারে।বাঁধা দেওয়াতে আছে নিষেধাজ্ঞা।তবুও একটু বাজিয়ে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে।যদি তিল পরিমাণ অনুভূতির সন্ধান পায়?বর্ণের দেহ তলে চাপা পড়ে থেকেই বললো,
“কোনো প্রকার অনুভূতি না থাকা সত্বেও?”
“বিয়া করা বউ নামের কালনাগিনী যদি নিজের ইচ্ছায় বুকে জড়ায় রাখে তাইলে আমি সুযোগ মিস করুম কেন?”
“তাহলে বলতে চাইছো পুরুষ সুযোগ সন্ধানী।”
“হ এদিকে একটা জটিল অংক আছে।যদি পর নারীর লগে জড়াজড়ি করে তাইলে ঝামেলা। বিয়া কইরা গলায় ঝুইলা যাওয়া নারী হয় তাইলে দুইয়ে দুইয়ে চাইর মিলা বাচ্চাকাচ্চা পয়দা করা যায়।”
বর্ণ অনুভব করলো অন্বেষার কান আর গাল গরম হয়ে আসছে।নিঃশ্বাস আটকে আছে।কিন্তু লজ্জাটা বুঝতে দিচ্ছে না।বর্ণ বললো,
“তুমি টেনশন নিও না।আমার এহন বাচ্চা পয়দা করনের মুড নাই।…..কিন্তু হুটহাট মুড চেঞ্জ হইতে পারে।তাই তোমার সর্বদা সচেতন থাকা লাগবো”
এই অদ্ভুত মানুষকে বিয়ে করার আগে হাজারবার ভাবা উচিত ছিলো অন্বেষার।নিজেই নাচতে নাচতে আগুনে ঝাঁপ দিয়েছে।ভালো না বেসেই কি অবলীলায় দেহভার ছেড়ে আরাম ফরমাচ্ছেন। অন্বেষা নড়চড় করে উঠলো।বললো,
“নিজের জায়গায় যাও।আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।”
বর্ণ বিরক্তির ‘চ’ বর্ণ উচ্চারণ করে বলে,
“তোমার কষ্ট অসুবিধাতো আমার দেহার বিষয় না।”
অবাধ্য বর্ণ।কয়েকদফা না করার পরও তাকে নড়ানো যায়নি।অগত্যা একরাশ অস্থিরতা নিয়ে রয়ে গেলো অন্বেষা।এই নিস্পৃহ মানুষ কি করে তাকে নিবিড় পরশে জড়িয়ে?তবে কি এভাবেই তাদের জীবন ধীরে ধীরে এগোবে অভিসারে?
_______
সকাল সাড়ে ছয়টায় ঘুম ভাঙ্গলো অন্বেষার।বর্ণ মহারাজের সকালের নাস্তা আর দুপুরের খাবারের আয়োজন করে দৌঁড়াতে হবে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে। ভাগ্যিস পরীক্ষা শেষ হয়েছে নয়তো সবকিছু সামলাতে হিমশিম খেতে হতো।আড়মোড়া দিয়ে উঠে দেখলো বর্ণ নেই।গতরাতে তাকে চাপা দিয়ে শুয়ে ছিলো।সে কথা ভাবতেই আকস্মিক কান লাল হয়ে উঠলো।ঝড় নিঃশ্বাস ফেলে বিছানা থেকে নামতেই কিছু একটার সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে চাইলেও নিজেকে সমালালো।নিচে চেয়ে চক্ষু চড়কগাছ।জমিনে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে বর্ণ।
অন্বেষা নিচে বসে উদ্বেগ ভরা স্বরে ডাকলো,
“এই! তুমি মাটিতে কি করছো?….বর্ণ?”
বর্ণ নড়েচড়ে উঠলো।কপালে তিনটে ভাজ পড়েছে গাঢ়। অন্বেষা আবার বাহু ধাক্কা দিলো।বর্ণ ব্যাথাকাতর মুখ ভঙ্গি সহিত গম্ভীর গলায় বললো,
“বিয়ান বেলা কাকের মতো ক্যা ক্যা করতাছো ক্যালা?”
“তুমি মাটিতে শুয়ে আছো কেনো?”
বর্ণের হুশ ফিরলো যেনো।পুরো শরীর ব্যথা করছে।হাতের কনুইতে চিনচিনে ব্যাথা।স্বামী অধিকার খাটিয়ে জোরপূর্বক অন্বেষাকে জাপটে ঘুমিয়ে পড়া অব্দি সবই মনে আছে।সেখান থেকে জমিনে আসার রহস্যটা বুঝলো না। ম্যাজ ম্যাজ করা দেহ নিয়ে উঠে বসে। ঘাড়ে শক্ত করে হাত চেপে অন্বেষার দিকে চেয়ে বললো,
“তুমি আমারে ফালায় দিছো না?”
আশ্চর্যান্বিত হয়ে তাকায় অন্বেষা।সে কেনো ফেলতে যাবে?অন্বেষা সাফাই গেয়ে বললো,
“আমি ফেলতে যাবো কেনো?আর তোমার পাঠার মত দেহ আমার একার পক্ষে নাড়ানো সম্ভব?”
“পাঠা কইবা না!”
“কেনো?”
“ইগোতে লাগে”
বাচ্চাদের মত করে বলে বর্ণ। অন্বেষা মৃদু শব্দে হেসে উঠলো।ঘটনা কি হয়েছে বুঝতে পেরেছে সে।বর্ণ এখনও জমিনে বসা। অন্বেষাকে হাসতে দেখে জিজ্ঞাসু নয়নে চেয়ে। অন্বেষা কিছু সময় পর বললো,
“আসলে কি জানো তুমি নিজেই পড়ে গেছো!” বলে আরেকদফা হাসতে শুরু করে অন্বেষা।
এক রৌদ্রোজ্জ্বল হাসি মুখে নিষ্পলক চেয়ে থাকা যায়।অবাধ হাসি সমুদ্রে ঢেউ খেলানোর মতো।তুচ্ছ বিষয়ে।পরিচয় লগ্ন হতে এই অব্দি কখনো এই রক্তিমাভ অধরে এরূপ হাস্য রেখা ফুটেনি।নতুন এক রঙিন চিত্র যেনো এই।কারো হাসি এত মোহনীয়ভাবে চক্ষু আকর্ষক হতে পারে? এ যেনো কোনো বিভ্রান্তি,যেনো এক বিভ্রম।
কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে বিবর্ণ ব্যক্তিত্ব করাঘাত করে বাস্তবতায় ফেরায়। ভুলেভালে হারিয়ে যাচ্ছিলো আবেগে।সটাং করে দাঁড়িয়ে গেলো বর্ণ।তাকে এভাবে উঠে দাঁড়াতে দেখে অন্বেষা কিছুটা চমকে উঠে।বর্ণ টিশার্ট খুলে বাথরুম এর দিকে এগোতে এগোতে প্রশ্ন করে,
“আজকেও কি পরোটা আর আলু ভাজি করবা?নাকি একদিন লোক দেহাইনা খাতিরদারি করলা?”
“ডিম ভাজি?”
বর্ণ তুচ্ছ হেসে বলে,
“ভাঁজো!…. মাগনা খাওয়ন।চেগায়ে চেগায়ে খাওয়া ছাড়া আমারতো কিছু করার ক্ষমতা নাই।”
কণ্ঠে খেদ।চোখ এড়িয়ে বলে যাওয়া কথাগুলো কঠিন ভাবার্থ বহন করে।নিজেকে অপারক ভাবছে বর্ণ মাত্র সংসার জীবনের দুদিনের মধ্যে। অন্বেষা কি করবে বুঝতে পারছে না।সামনে অনেক পথ বাকি। চেয়েছিলো এই মানুষটাকে নিজের মতো করে গুছিয়ে নেবে।নিজের অসম্পূর্ণ ইচ্ছাগুলো দুজনে মিলে পূর্ণতা দেবে। হিতের বিপরীত না হয়ে যায়?বর্ণের মাঝে প্রতিযোগিতাপূর্ণ মনোভাব না এসে যায়
বর্ণ বেরিয়ে আসে। অন্বেষা দ্রুত এসে তাকে খাবার দিলো।বর্ণ অচেতন দৃষ্টিতে একবার অন্বেষার দিকে চেয়ে খাবার হাতে তুললো। অন্বেষা বর্ণের মুখোমুখি বসে।খাবার প্লেট নিজের দিকে এগিয়ে নিলো পূনরায়।পরোটা ছিঁড়ে বর্ণের মুখের কাছে ধরে মনের দ্বন্দ্ব কাটিয়ে।শীতল কণ্ঠে বললো,
“আমি তোমার সাথে প্রতিযোগিতা করতে আসিনি।না তোমাকে পায়ের তলানিতে দাবিয়ে রাখা আমার উদ্দেশ্য।”
বর্ণ মুখে তুলেনি এখনো খাবার।চেয়ে আছে অন্বেষার দিকে। অন্বেষাও হাত সরালো না।ধরে রাখলো।বললো,
“তোমার বাবা কেমন ছিলেন আমি জানি না। নিশ্চয়ই তোমার মা তোমাকে খুব ভালোবাসতেন?তিনি নিশ্চয়ই তোমায় মুখে তুলে খাইয়ে দিয়েছেন?তখন নিশ্চয়ই তুমি খুশি খুশি খেয়ে নিতে?চিন্তা করতে না তাই না?তখন কি মনে প্রশ্ন জাগতো এসব আমার মায়ের খাবার,মায়ের দান।কেনো খাবে এসব?প্রশ্ন জাগতো না।কারণ সেখানে আমার তোমার এর ভেদাভেদ ছিলো না।ভালোবাসা ব্যতীত কোনো অহংকার,কোনো গৌরব কিছুই ছিলো না।”
অন্বেষার হাত ব্যাথা করছে মুখের সামনে খাবার ধরে রেখে।জোর করে ঠেসে দিল বর্ণের মুখে।সে খেয়ে নিলো বিনাবাক্যে।মনোযোগী হয়ে শুনছে অন্বেষার সব কথা।
“তুমি জানো পুরুষ মানুষ নারী ব্যতীত অপূর্ণ।তার কাছে টাকা পয়সা, ধন দৌলত যতই থাকুক।সে অসম্পূর্ণ।শিশুকাল থেকে যৌবন পর্যন্ত মায়ের আঁচলে তার বাস।তারপর আসে স্ত্রী।হয়তো কাগজের তৈরি অর্থ দিতে পারেনা তারা।কিন্তু তাদের অবদান কোটি কোটি টাকা দিয়ে তুমি মূল্য আদায় করতে পারবে না।”
বুঝাচ্ছে বর্ণকে।সে বুঝতে পারছে কিনা কে জানে?মুখ অবয়ব একেবারেই স্বাভাবিক।পুরোপুরি স্থবির।চোখের পলক ফেলছে দীর্ঘক্ষণ পরপর। অন্বেষা আরেক লোকমা বর্ণের মুখে তুলে দিয়ে বললো,
“আমি সমাজের নিষ্ঠুরতা খুব কাছ থেকে দেখেছি।তাই আর লোকে কি বলবে ভাবি না।আমার সাথে কারো তেমন পরিচয় নেই।আমি কারো সাথে সখ্যতা বাড়াই না।এত এত মানুষের ভীড়ে আমি নিজেকে অচেনা মানুষ হিসেবেই রেখেছি।আর নিয়ম? যা মানতে হয় সেগুলো মানি তাছাড়া এই মানুষ সম্প্রদায়ের প্রতি আমার ক্ষণিকের মায়া থাকলেও ভালোবাসা নেই। এরা আমার বাবা মাকে কেড়ে নিয়েছে আমার কাছ থেকে।”
বর্ণ মুখ খুললো।প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,
“আমার প্রতি তোমার কি টান? মোহ?মায়া?প্রেম?নাকি খালি আফসোওওওওওস?”
সুরেলা প্রলাপে শেষ শব্দ উচ্চারণ করলো বর্ণ। অন্বেষা হেসে জবাব দেয়,
“নারীর জীবনে সে যেমন বাবার আঙ্গুল চেপে হাঁটা শিখে ঠিক তেমনি জীবনসঙ্গী হাত ধরে পাশে থাকে।…..আর তোমার প্রতি?আমার অনেক রাগ তোমার প্রতি।”
অন্বেষার আঙ্গুল কামড়ে ধরলো বর্ণ।হাসি মুখটা পীড়ার আর্তনাদে ঢেকে যায়।যত্ন করে খাইয়ে দিচ্ছিলো বর্ণের সেটি সয়নি।বাকিটুকু নিজেই খেয়ে নিক।উঠে দাঁড়ালো অন্বেষা।তৈরি হবে ভার্সিটির জন্য।
“এতো বড় বড় ভাষণ দিয়েছি তার মানে এই নয় অলসের মত ঘরে পড়ে থাকবে।নতুন চাকরি খুঁজো।আমার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে হবে।”
“যদি না করি? ঘর জামাইর মত বইয়া খাই?কি করবা?”
অন্বেষা ঝাঁঝালো কণ্ঠে জবাব দিলো,
“মাঝরাতে গলা চেপে ধরবো”
“আচ্ছা ধইরো।কোনো অসুবিধা নাই।তোমার ক্যাঙ্গারুর মত হাত আমারে ফুলের টোকা দিতে পারবো মারতে পারবো না।”
বর্ণের মতই গুরুত্ব দিলো না তার কথার।এড়িয়ে গেলো। কাপড় নিয়ে চলে গেলো বাথরুমে। মিনিট দশেক পর বেরিয়ে আসে অন্বেষা।বলে,
“ভার্সিটি যাচ্ছি।দুপুরে খেয়ে নিও।আমি একেবারে সন্ধ্যায় ফিরবো।আর হ্যাঁ কালকে আমার অফিস বন্ধ কেনাকাটা করবো”
“কিয়ের কেনাকাটা?”
“ফাজিল বর্ণ আর ভালো মেয়ে অন্বেষার নতুন সংসারের জন্য কেনাকাটা।”
বর্ণের মুখ প্যাঁচার মতো হয়ে গেলো নিমিষেই।সেও চুলে হাত বুলিয়ে চুল ঠিক করে উঠে দাঁড়ায়। অন্বেষার পিছু পিছু হেঁটে চলে। অন্বেষা প্রশ্ন করে,
“তুমি কোথায় যাচ্ছো?”
“কালনাগিনী অন্বেষার লগে অর ভার্সিটিতে ঘুরতে….”
___________
এলাকার ভিতরে বর্ণ অন্বেষা অপরিচিত মানুষের মত একে অপরের থেকে দূরে।দেখে বুঝার উপায় নেই এরা স্বামী স্ত্রী।একে অপরের সাথে একই ঘরে তাদের বসবাস।বর্ণের কঠোর আদেশেই এই পন্থা অবলম্বন করছে অন্বেষা।কয়েকবার প্রশ্ন করলেও জবাব মেলেনি।বাধ্য হয়েই নিরাপদ দুরত্ব বজায় রেখে বেরিয়ে পড়লো। টিএসসিতে পৌঁছে অন্বেষা দাঁড়ায় বর্ণের মুখোমুখি।
প্রশ্ন তুলে,
“তুমি কি এলাকায় জানতে দিতে চাও না আমাদের কথা?”
দায়সারা গোছের বর্ণ।দাঁত খোঁচাচ্ছে। অন্বেষার প্রশ্ন কর্ণপাত হতেই বললো,
“চাই না”
“কেনো?”
দাঁত খোঁচানো থামিয়ে বর্ণ উদাসীন গলায় জবাব দেয়,
“অত জটিল অংক তোমার এক ইঞ্চি সমান ঘিলুতে ঢুকবো না। চাপ নিও না।আমি যা কইছি তাই। অপরিচিত কেউ জানি আমগো বিয়ার কথা না জানে।….. না মানে না!কথা এদিকেই শেষ”
ঔৎসুক্য অন্বেষা।কারণ জানতে চায়।আরেকদফা চেষ্টা করলো প্রশ্ন করার।তার আগেই বর্ণ নিজ ঠোঁটে তর্জনী আঙ্গুল চেপে চুপ থাকতে বললো তাকে। অন্বেষার হাত টেনে রাস্তা পাড় হওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।
ভার্সিটির প্রাঙ্গণে সেই চিরচেনা অপছন্দনীয় মুখের দর্শন।বর্ণের ভাষ্যমতে এদের নাম চুন্নী মুন্নী।তাদের দেখে অন্বেষার পূর্বে বর্ণ অতি উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে গেলো ঝুমা আর রুম্পার দিকে।বিশাল হাসি নিয়ে দুজনকে প্রশ্ন করলো,
“আরেহ চুন্নী মুন্নী?কি খবর?দিন কাল ভালো?”
ঝুমা রুম্পা কেউই জবাব দিলো না।কপাল কুঁচকে অন্বেষার দিকে তাকালো।সেদিনের চড়ের ক্ষোভ এখনও কাটেনি। বর্ণ বলে উঠলো,
“ওমা!কথা কয় না দিহি? গলায় গ্যাস্ট্রিক হইছে?”
রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকালো ঝুমা আর রুম্পা।বর্ণের বিদঘুটে হাসি দেখে পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে।ততক্ষণে অন্বেষা এসে বর্ণের হাত চেপে তাকে দূরে সরিয়ে নিতে চাইলে বর্ণ গেলো না।
“এই চুন্নী মুন্নী? এহনও কূটনীগিরি করো নাকি আল্লাহ হেদায়াত দিছে?”
অন্বেষা জবাব দেয়।বলে,
“ডান গালে সেদিন মিসাইল লঞ্চ করেছি।আপাতত ওরা দুজন কয়েকমাসের জন্য বাক প্রতিবন্ধী”
বর্ণ স্ফুরিত চোখে তাকালো অন্বেষার দিকে।ব্যগ্র সুরে প্রশ্ন করে,
“বন চটকোনা মারছো নিহি?”
অন্বেষা গৌণ শব্দে জবাব দেয়, “হুম”
বর্ণ অন্বেষার পিঠ চাপড়ে দিল। অকস্মাৎ এরূপ কান্ডে অন্বেষা নিজেও হতভম্ব।বলিষ্ঠ হাতের চাপড় খেয়ে আত্মা নড়ে গেছে অন্বেষার।নিজেকে স্বাভাবিক রাখলো।বর্ণ বলে উঠে,
“শাবাশ ছেমড়ি!”
ঝুমা এবং রুমা উভয়েই স্থান ত্যাগ করে।বর্ণ আয়েশ করে সিঁড়িতে বসে পড়লো।সাথে অন্বেষাও।ক্লাস শুরু হতে আধ ঘন্টা বাকি।কিছু সময় কাটাক এই বেয়াড়া ছেলেটার সঙ্গে।বর্ণ নিশ্চুপ দু চোখ মেলে আশপাশ দেখছে।কত কিশোর কিশোরী।কাঁধে ব্যাগ নিয়ে হাঁটছে।বর্ণের মনে উদ্ভট প্রশ্ন জাগলো,বই খাতার ভার কি অনেক বেশি?যদি তাদের স্থানে সে থাকতো?তাদের মতো কি বর্ণের ঠোঁটেও শিক্ষার উজ্জ্বল হাসি থাকতো?হয়তো তাদের হাজার খানেক এর মধ্যে বর্ণ একজন শিক্ষার্থী হতো।দাপট দেখাতো শিক্ষিত হওয়ার।
কিসব ভাবছে!খারাপ লাগা গ্রাস করার পূর্বেই নিজের সর্বাঙ্গে শক্তি সঞ্চয় করে।নিজেকে নিজে বলে উঠলো,
“কিরে শালা!এসব দেইখা তোর কলিজা হাহাকার করবো কেন?তোর শিক্ষা নাই,যোগ্যতা নাই।তোর এগুলির প্রয়োজন নাই।তুই তারপরও বলবান!মজবুত! এরা একদিন দৌঁড়াইবো চাকরির পিছে।জুতার তলা ক্ষয় কইরা ভেজাল খাইবো।”
নিজেকে নত না হওয়ার সান্ত্বনা। ঐশ্বরিক শক্তি সঞ্চয় করেছে। অন্বেষা দেখছে এই ভাবুক প্রতিফলন।বুঝা যায় না দৃষ্টি আড়ালের নিগূঢ় চিন্তন।বর্ণ এক জটিল অঙ্কশাস্ত্র।সমাধান খুঁজতে হবে সাধনার মাধ্যমে।তার মতো করেই করতে হবে অর্থোদ্ধার।
পেছন থেকে কেউ একজন এসে বলে উঠলো, “অন্বেষা জামান?”
অন্বেষা ঘুরে তাকায়।বলে, “আমি….আমি অন্বেষা জামান।”
“ইতিহাস বিভাগ?”
“জ্বি?”
“আপনাকে বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ইউনুস খান ডেকেছেন”
বর্ণ অন্বেষা একে অপরের দিকে চাইলো।হঠাৎ করে ডাকার কারণ কি হতে পারে?অন্বেষা উঠে দাঁড়ালো।সাথে সাথে বর্ণও সেখানেই পা বাড়ায়। বিভাগীয় প্রধান এর রুমে এসে অন্বেষা সালাম জানিয়ে ঢুকে।
প্রফেসর ইউনুস প্রশ্ন করলেন,
“তোমার নামে এসব কি শুনি অন্বেষা?তুমি তোমার সিনিয়রদের গায়ে হাত তুলেছো?”
বুঝতে বাকি নেই ঘটনা। অন্বেষা জবাব দিলো,
“আমি আমার কাজের জন্য অত্যন্ত দুঃখিত স্যার।তবে আমার এই কাজের পেছনে যৌক্তিক কারণ ছিলো।”
“কি কারণ?”
“স্যার ঝুমা এবং রুম্পা আমার বাবাকে অপমান করে কথা বলেছিলো।সে এই পৃথিবীতে নেই।আজেবাজে ভিত্তিহীন কথাবার্তা বলেছে।তাছাড়াও তারা আমার সাথে একই মেসে থাকতো।আমার নামে মিথ্যে গুজব রটিয়ে আমার ঘর ছাড়া করে।আমি একা মেয়ে।আমার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে অত্যাচার করেছে অনেক।আমি তখন চড় দিয়েছি সেখানে আরো কয়েকজন উপস্থিত ছিলো।আপনি চাইলে তাদের জিজ্ঞেস করতে পারেন স্যার।এটা বিশ্ববিদ্যালয়।এখানে কেনো জাতপাত- ধনী গরীবের ভেদাভেদ হবে।”
প্রফেসর ইউনুস মাথা দোলালেন।উভয় পক্ষের কথা তিনি শুনেছেন।সত্যতা যাচাই করতে সেখানে উপস্থিত বাকিদের ডেকে আনতে বললেন। অন্বেষার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বর্ণকে দেখে তিনি আবার বললেন,
“তুমি নাকি ভার্সিটি ক্যাম্পাসে বহিরাগত নিয়ে চলাচল করো?তোমার সাথে বখাটে ছেলেদের উঠবস।”
“জ্বি না স্যার এগুলো মিথ্যে কথা।”
প্রফেসর ইউনুস বর্ণের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করেন,
“আপনি এখানে কি করেন?আপনাকে কে অনুমতি দিয়েছে এখানে আসার?বেরিয়ে যান।”
বর্ণ এতক্ষণ চুপ ছিলো।প্রশ্নের জবাবে বললো,
“আমি ওর গার্জিয়ান।ওর কি সমস্যা হইলো,না হইলো আমার জানার দরকার আছেতো নাকি?আর যারে বখাটে বইলা কমপ্লেইন করা হইছে ঐটা আমি। বিশ টাকা দেনমোহর ধার্য কইরা সব রীতিনীতি মাইনা তারপর ওরে বিয়া করছি।আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট এর গার্জিয়ান হিসাবে আসতেই পারি এদিকে তাই না?”
বর্ণের শুদ্ধ ভাষা বলার প্রবল চেষ্টা।এমন থমথমে পরিস্থিতিতেও হাসি আসছে অন্বেষার।প্রফেসর ইউনুস বর্ণের মুখের ভাষা শুনে কপাল কুচকালেন।শুদ্ধ ভাষা বিহীন কোনো ভাষা যেনো গ্রহণযোগ্য নয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।বর্ণ অন্বেষাকে যাওয়ার অনুমতি দিয়ে বাকিদের সাথে কথা বলছেন।
বেরিয়ে এসে হেসে ফেললো অন্বেষা।তার হাসি দেখে বর্ণ প্রশ্ন করে,
“হাসো কিল্লেগা?”
অন্বেষা ফোড়ন কেঁটে বলে,
“ইশ কি ভাষণ!শুদ্ধ ভাষা বলার ব্যর্থ চেষ্টা।তোমাকে মানায় না বুঝলে।তোমার মুখে খাস ঢাকাইয়া টানটাই মানানসই।আর চেষ্টা করবে না শুদ্ধ বলার প্লিজ”
“আমগো জাত,আমগো ভাষা!আমার কোনো শখ নাই পুতুলের মত শুদ্ধ ভাষা মারানের!”
কথা শেষ করেই সামনের দিকে তেড়ে গেলো।ঝুমা রুম্পা এক কোণে দাঁড়িয়ে।আবার না ঝামেলা বেঁধে যায়। অন্বেষাও হন্তদন্ত পায়ে এগোলো।ততক্ষণে বর্ণ তাদের দুজনের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।আঙ্গুল তুলে ক্রোধিত কণ্ঠে বললো,
“শেষবার ওয়ার্নিং দিতাছি শুধরায় যাও। গু চাটা কুত্তার দল!আরেকবার ওর পিছনে লাগলে খোদার কসম ভুইলা যামু তোমরা ছেড়ি মানুষ!কথা আর মুখ দুইটাই জানি মনে থাকে”
অন্বেষা বর্ণকে টেনে নিয়ে আসে।এখানে ঝামেলা হলে হিতের বিপরীত হবে।হাত ধরে বাহিরে নিয়ে এলো।বর্ণ বলে উঠলো,
“আজকাল আমার লগে হাতাহাতি বেশি করো কিন্তু।মুখে তুইল্যা খাওয়ায় দাও।মতলব কি? পিরিত টগবগ করতাছে?”
গতরাতে নিজেই জড়িয়ে শুয়ে ছিলো।এখন দোষ চাঁপাচ্ছে অন্বেষার ঘাড়ে।রং পরিবর্তন করতে নিপুণ বর্ণ। কৌশলে মাত দিতে পারবে।তার অর্থহীন কথায় যত কম গুরুত্ব দেয়া যায় যত ভালো।কথা ঘুরিয়ে প্রশ্ন করলো,
“আমার হয়ে লড়লে ওদের সাথে?”
অন্বেষার কথায় কিছুটা থমকে গেলেও মুখ স্বাভাবিক রাখে। অন্বেষা জবাবের আশায় দাঁড়িয়ে।আবার প্রশ্ন করতে চাইলে বর্ণ তুচ্ছ স্বরে বলে উঠে,
“তুমি আমার কিছু লাগো যে তোমার লেইগা লড়মু?তোমারে না কইছি তোমার মনের পিরিতের জোনাকি পোকাগুলিরে বোয়ামে ভইরা রাখবা।বেশি ফরফর করতাছে আজকাল।আমারে বখাটে কইছে তাই আরকি…..”
হাসলো অন্বেষা।এত সহজেই নত হবে বর্ণ? আশা করাও ভুল। অন্বেষা বলে,
“চানখাঁরপুলে আমার অফিস।সন্ধ্যা ছয়টায় আমাকে নিতে আসবে একজন দায়িত্বশীল স্বামীর মত।সাবধানে বাড়ি যাও।আমার ক্লাস শুরু হয়ে গেছে।আসি”
চলবে……