#উন্মুক্ত_লাইব্রেরী
লেখা – আয্যাহ সূচনা
২৫.
শুক্রবার সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে বর্ণ আবিষ্কার করলো অন্বেষা তাকে জড়িয়ে গভীর নিদ্রায় মশগুল। আঠার মতো লেগে আছে বর্ণের চওড়া বুকে।বর্ণের হাতটিও তার মাথার নিচে বালিশ রূপে পাতা।
বর্ণ মুখ নামায়।অন্বেষার মুখ বরাবর এনে চেয়ে দেখলো তার ঘুমন্ত মুখ।চাইলো নিজের মস্তিষ্ককে সচল করতে।আজকাল চোখজোড়া বিশেষভাবে আকর্ষিত হয় তার দিকে।এড়িয়ে যাওয়া মুশকিল হয়ে উঠছে।কাছে এলেই বুকের মাঝে উত্তাল ঝড় উঠে। অবসন্ন,নিস্তেজ নিঃশ্বাস ফেলে বর্ণ।কত লুকাবে?
আনমনে বিড়বিড় করতে লাগলো,
“আমি যেটা চাই নাই ওইটাই হইতাছে!আমারে একজন কইছিলো পোলা মানুষের জীবনে দুই ধরনের টান থাকে নাড়ির টান আরেকটা নারীর টান।এই দুই টান থিকা মুখ ফিরানি মুশকিল।……আমি চাই নাই কেউ আমার জীবনে দখলদারিত্ব করুক।কেউ আমার লগে থাকুক।আমি কি করতাছি এহন?নিজেই সুযোগ কইরা দিতাছি।এটাতো আমার জীবনের লক্ষ্য না!আমি চাইছি চিন্তা ছাড়া মুসাফির এর মত ঘুইরা বেরামু।একদিন মইরা যামু।……কি হইতাছে আমার জীবনে?আমি এই মাইয়ার দিকে কেন ঝুঁকতাছি?আমার এই কয়লা অন্তরে প্রেমের ফুল ফুটবো এবার?…..আমার এই ছেড়ির কাছাকাছি থাকবার ভাল্লাগতে শুরু করছে!….আমি নিজের অধঃপতন নিজেই ডাইকা আনছি”
ভাবনার মাঝে ডুবে অন্বেষার কপালে কপাল ঠেকিয়েছে বর্ণ।একে অপরের নাকের ডগা প্রায় ছুঁই ছুঁই। দপদপ করছে মাথাটা।এলোমেলো ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে মস্তিষ্ক জুড়ে।অস্থির মনোভাব বিচলিত করে তুললো।নিজের কাছে নিজেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়,কেনো এতো বিভ্রান্ত তার মন?কেনোই এত জটিলতা?অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পূর্ণ ব্যয়িত জীবন।স্বাভাবিক সবকিছুই যেনো অস্বাভাবিক লাগে।
অন্বেষাকে চেপে ধরলো বাহুডোরে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করে।এই দমবন্ধ পরিস্থিতিতে অন্বেষার ঘুম ভেঙে যায়।নড়েচড়ে বলে উঠলো,
“চাপা দিয়ে মেরে ফেলবে নাকি?”
বর্ণ আচমকা অন্বেষার শুষ্ক ঠোঁটে তর্জনী আঙুল চেপে বললো,
“পাঁচ মিনিট পর ছাইড়া দিমু।আমি একটা জিনিস ভাবতাছি।চুপচাপ থাকো।বেশি তিড়িং বিড়িং করলে খাট থেকা ফালায় দিমু”
অন্বেষা বর্ণের কণ্ঠের গভীরতা বুঝলো,লালাভ চোখের অর্থ বুঝতে অক্ষম।এই বর্ণ খুব ভাবায়।বড্ড ভাবায় তাকে।জানতে হবে হয়তো কিছু অজানা রহস্য।যা বর্ণের বুক পকেটে সযতনে লুকানো।
অবাধ্য মুখ তারপরও চলে উঠে, “কি ভাবছো?”
ক্ষুদ্র চোখজোড়া অতর্কিতে আগুনের গোলার রূপ ধারণ করে।নাকের পাটা ফুলেফেঁপে উঠছে।বর্ণ কঠিন গলায় বলে উঠে,
“তোমার বুঝা উচিত কোন সময় আমি মজার মুডে থাকি আর কোন সময় সিরিয়াস।….আপাতত আমি ফাত্রামির মুডে নাই।কথার অবাধ্য হইবা না একদম!”
অন্বেষার বুদ্ধিতে কিছুই ধরছে না।কণ্ঠের তেজ বলছে আসলেই সিরিয়াস মুডে।বাহুতে শক্ত একজোড়া হাতের চাপ পড়ে। হৃদপিণ্ডের উঠানামা খুব কাছ থেকেই অনুভব করছে। অন্বেষার ঢোক গিলে।চুপচাপ ঠোঁট কামড়ে শুয়ে রয় যথাস্থানে।
আধ ঘন্টা যাবত এভাবেই দুনিয়া জাহানের সমস্ত এলোমেলো চিন্তায় নিজেকে মাতিয়ে রেখেছে বর্ণ।বাধ্য মেয়ের মত তাকে সহায়তা করা অন্বেষা একটু নড়চড় করলো।বর্ণ ফোস করে শ্বাস ছাড়লো। বললো,
“হুম! এহন তোমার মোটরের মতো মুখ চালু দিতে পারো”
অন্বেষা যেনো এই অপেক্ষাই ছিলো।দ্রুত প্রশ্ন করলো,
“কি ভাবছিলে?”
বর্ণ অন্বেষার নেত্রদ্বয়ে দৃষ্টি রেখে জবাব দিলো,
“তোমার জানার দরকার নাই”
“আমার সবকিছু জানার দরকার আছে”
বর্ণ একইভাবে চেয়ে জবাব দিলো, “উহু”
“আচ্ছা তোমার সাথে জনি ছেলেটার কিসের এত শত্রুতা?”
বর্ণ নিষ্পলক। কাঠিন্য মুখ অবয়ব।কোনো এক অজানা ঘোরে মজে শুধুই শুনছে প্রশ্নগুলো।জবাব দিতে অপরাগ।তারপরও নিজের বিরুদ্ধে গিয়ে বললো,
“পোলা মাইনষের বন্ধুত্ব করতে কোনো কারণ লাগে না, শত্রু বানাইতেও লাগে না”
“আর ভালোবাসতে?”
বিব্রত বোধ ছাড়াই বর্ণ জবাব দেয়,
“তুমি নিজে পুড়বা,আমারেও পুড়াইবা….”
ভয়হীন চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করার সাহস আর অবশিষ্ট রইলো না অন্বেষার। জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে গেলো।চুল বাঁধতে বাঁধতে এগিয়ে যাচ্ছে।
হুট করেই বর্ণের মনে ধরলো দৃশ্যটা। অন্বেষার এদিক ওদিক চলনের সাথেসাথে নড়ছে তার নেত্রমণি।
“বিছানার চাদরের নিচে টাকা আর লিস্ট আছে। বাজারে গিয়ে একটু পর কিনে আনবে।আজ তোমার পছন্দের কালা ভুনা আর ভুনা খিচুড়ি রান্না হবে।” বলে হাসলো অন্বেষা।
বর্ণ জবাব দিলো,
“বেশি বেশি হইয়া যাইতাছে না?গরুর গোস অনেক দাম।আমার লেইগা এত দ….”
অন্বেষা রেগে বলে উঠলো,
“দয়া শব্দটা কখনো উচ্চারণ করবে না আর।আপন মানুষের জন্য কিছু করাকে দয়া বলে না।”
বর্ণ একলাফে উঠে আসলো।বড় কদম ফেলে অন্বেষার তিন চার ইঞ্চি দূরে এসে দাঁড়িয়েছে।জানতে চাইলো,
“আমি তোমার আপন?”
অন্বেষা চোখ নামিয়ে জবাব দেয়,
“পরওতো না”
“বর্ণ কারো আপন না।”
“তোমার আসল রূপ আমার সামনে ধীরেধীরে স্পষ্ট হচ্ছে।আমার সাথে অভিনয় না”
বর্ণ কোনো জবাব দিলো না।ব্রাশ নিয়ে হাত মুখ ধুতে চলে যায়।
_______
নিজের ঘরে চিৎকার চেঁচামেচি করছে জনি।ভাংচুর করছে জিনিসপত্র।মা দিলারা ছেলের হিংস্র রূপে এক কোণে দাঁড়িয়ে।এগিয়ে যাওয়ার সাহস নেই।থামানোর চেষ্টায় ব্যর্থ তিনি।উপায় না পেয়ে স্বামীকে কল করেছেন।গতরাত থেকেই ছেলের মাঝে এক চাপা রাগের আভাস পাচ্ছিলেন।আজ সেটি ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছেন।
দ্রুত দোকান বন্ধ করে এসেছেন মোকলেস মাতবর।বয়সের কারণে স্বল্প হেঁটে এবং সিঁড়ি বেয়ে ক্লান্ত।ঘরের নাজেহাল অবস্থায় তার কপালের রগও ফুটে উঠলো।তেড়ে গিয়ে ছেলের শার্টের কলার চেপে মুখোমুখি আনেন।
“কিরে কুত্তার ছাও! জিদ্দের ঠেলায় যে ঘরের জিনিসপাতি ভাঙতাছোস!এডি কি তোর ট্যাকায় কিনা রে মাদারী?”
জনি ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বাবার দিকে চায়।ছিটকে সরে যায় বাবার বাঁধন থেকে।চিৎকার করে বলে,
“বর্ণ আমার জিতা গেছে আব্বা! এলাকাতো এলাকা আমার প্রিয় জিনিসও কাইড়া লইছে”
বর্ণের সাথে আবার কিছু হয়েছে।এটা বুঝতে পেরে আরো রেগে যান মোকলেস সাহেব।ছেলের চুল মুঠ করে ধরে বললেন,
“এই জানোয়ার তাকা আমার দিকে!কিয়ের প্রিয় জিনিস? হ্যাঁ! জনি!আমি কইলাম জানি তুই নিজে থিকা যাস বর্ণের লগে গ্যাঞ্জাম করতে….”
দিলারা বানু বলে উঠলেন,
“হ আপনিতো আমার পোলার দোষই দেখবেন সবসময়।ওই হারামজাদার কোনো দোষ আপনার চোখে ঠেকে না।”
ছেলের পক্ষ হয়ে কথা বলায় মোকলেস সাহেব স্ত্রীর দিকে রাগী দৃষ্টি ছুঁড়ে বললেন,
“চুপ!একদম চুপ থাক। তোর লাই পায়া জইন্নার এই অবস্থা।ভালা শিক্ষা দিতে পারোস না?”
পরপর চাইলেন অগ্নিমূর্তি হয়ে চেয়ে থাকা জনির দিকে।বললেন,
“এই ব্যাটা এই!তোর কিয়ের প্রিয় জিনিস ক। আইজকা যদি তোর কথায় তোর যুক্তিতে ওজন না থাকে তোরে আমি আর এই বাড়িতে রাখুম না।”
জনি জবাব দেয়,
“আমি যেই মাইয়ারে পছন করছি ওই মাইয়ারে বর্ণ বিয়া কইরা লাইছে আব্বা।”
মোকলেস সাহেব এর চোখ রসগোল্লার ন্যায় হয়ে গেলো ছেলের কথা শুনে। ধিক্কারের সুরে বললো,
“ছিঃ ছিঃ ছিঃ! বাপের সামনে ওর পিরিত জাহির করে।লজ্জা শরমের মাথা খাইয়া বইছে!বাল পাইকা গেছে তোমার?”
“আব্বা!”
“কি আব্বা! হ্যাঁ? কি আব্বা? বর্ণ আর ওই মাইয়া বিয়া করছে এটা ওগো ব্যাপার।আমারে একটা কথা ক ওই মাইয়া তোরে কোনোদিন কইছে ওয় তোরে পছন করে?”
“না”
জনির গালে চড় দিয়ে মোকলেস সাহেব বললেন,
“তাইলে তুই ক্যাঠা প্রেমের জ্বালায় ঘর জ্বালানির?কোন মজনু তুই?”
“আব্বা আমার ওই মাইয়ারে লাগবো।”
সাথেসাথে গলা চেপে ধরলো ছেলের।বললো,
“খবরদার! মাইয়া কেলেংকারীরে জড়াবি তোরে আমি ত্যাজ্য করুম!”
জনিকে ছেড়ে সোফায় ধপ করে বসলেন মোকলেস সাহেব।আর ধৈর্যে কুলায় না তার।বয়স বাড়ছে।সাথে অস্থিরতা।হয়রান হয়ে গেছেন চেঁচিয়ে।দিলারা বানু পানি এগিয়ে দিতেই হাত ঝাড়া দিয়ে পানির গ্লাস ফেলে দিলেন। ভীত হয়ে উঠেন দিলারা বানু।সরে যান সাথেসাথে।
মোকলেস সাহেব উঠে গেলেন জনির ঘরে।ওর আলমারি খুলে একাডেমিক কাগজপত্র বের করে গোছাতে শুরু করেন দ্রুত হাতে।সবশেষে তিনি বলেন,
“এই এলাকায় থাকলে হয়তো ওয় কারো মার্ডার এর খুনি হইবো নইলে নিজে মরবো।আমি শান্তি চাই।এই বয়সে আমার এতো অশান্তি ভাল্লাগে না।”
“এগুলি কি করতাছেন আব্বা!”
“তোরে সুমন এর কাছে দুবাই পাঠামু।তোর পাসপোর্ট করতে যামু কালকেই। কামলা খাইটা ট্যাকা কামাবি তুই জানোয়ার। তোর শিক্ষা হওয়া উচিত।”
দিলারা বানু এসে পায়ে পড়ে গেলেন স্বামীর।ইতিমধ্যে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। জনি বলে উঠে,
“আপনি ওই রাস্তার পোলার লেইগা আমারে দূর করবেন”
কথাটি শুনে নিষ্পলক চাইলেন তার ছেলের দিকে। বিমূঢ় রইলেন কিছুক্ষন।সময় নিয়ে জবাব দিলেন,
“তোর ভালার লেইগা করমু”
“আপনি কামটা ভালো করতাছেন না আব্বাজান।”
“আরেহ রাখ তোর ভালো খারাপ!আর তোর মায় যদি বাঁধা দেয় ওরে আজীবনের লেইগা বাপের বাড়ি পাঠায় এই জায়গা সম্পত্তি জ্বালায় পুড়ায় ছাই করমু।মনে থাকে জানি কথাটা!”
________
বাজার সদাই সম্পর্কে বর্ণের ধারণা নেই বললেই চলে।শূন্যের কোঠায় সেই জ্ঞান। অন্বেষা তাকে তোতা পাখির মতো শিখিয়ে পড়িয়ে পাঠিয়েছে। পইপই করে বলে দিয়েছে সবকিছুর দাম।লিখেও দিয়েছে অতিরিক্ত নিরাপত্তার জন্য।তারপরও বর্ণের মাথায় যেনো বিশাল বোঝা।গরুর গোশতের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আহাম্মকের মত।
মনে মনে অগণিতবার উচ্চারণ করেছে,
“শালা”
পকেট থেকে কাগজ বের করলো।দেখলো গরু গোশত কতটুকু আনতে হবে।কত টাকা দাম।পাশে ছোটছোট অক্ষরে লেখা,
“শুনো আমার অকর্মার ঢেঁকি সোয়ামি।আমাদের ঘরে ফ্রিজ নেই।যতটুকু বলেছি ততটুকু আনবে। হাড় যেনো বেশি না থাকে।ভালো মতো চেক করে আনবে”
বর্ণের রাগ হলো প্রথমে।পরপর অজান্তেই হেসে ফেলে কথার ধরনে। দোকানদারকে বললো,
“দেহি ভাই আপনার চাপাতিতে কেমন ধার?”
দোকানি কপাল কুঁচকে ফেলে।কেনো দিবে তার মনে প্রশ্ন।তার চোখ ফাঁকি দিয়ে চাপাতি হাতে তুলে বর্ণ বলতে লাগলো,
“হুনেন মিয়া ভাই!প্রথমবার সদাই করতে আইছি।মক্কেল ভাইবা যদি গোশতের জায়গায় হাড্ডি দেন?তাইলে আমিও পুরান ঢাকাইয়া পোলা দরকারে কসাই হইয়া যামু।মানুষের গোশতের।”
দোকানি ভড়কে উঠে।কথা নেই বার্তা নেই হুমকি শুরু।ডাইরেক্ট একশন!দোকানি বর্ণের হাত থেকে চাপাতি ছিনিয়ে নিতে চাইলে বললো,
“উহু!এটা আপাতত আমার।আরেকটা আছে না?গোশত কাটা শুরু করেন জলদি।এই যে টাকা” পকেট থেকে টাকা বের করে দিলো।
দোকানি গোশত কাটা শুরু করে।রাগে গজগজ করছেন তিনি।আবার ভয়ও আছে আহত হওয়ার। গোশত কেটে দ্রুত বিদায় করলো বর্ণকে।বর্ণ দাঁতের পাটি বের করে হেসে সালাম জানিয়ে চলে যায়।এরপর একে একে সবকিছু কিনে প্রায় দুই ঘন্টা পর হাজির হলো। অন্বেষার মেজাজ তুঙ্গে।
রাগী সুরে বলে,
“এই একটু বাজার করতে এতক্ষণ লাগলো?আমি আধ ঘন্টার মধ্যে করে ফেলতাম।”
“আমার তোমার মত ফড়ফড় করার স্বভাব নাই।”
অন্বেষা কপাল কুঁচকে বললো,
“এখন পেটে ক্ষিদে নিয়ে বসে থাকো।রাঁধতে সময় লাগবে।”
“বেশি ক্ষিদা লাগলে তুমি আছো না?মশলা পাতি মিশায় চাবায় চাবায় খামু।”
বলে চোখ টিপ দিয়ে হাসে বর্ণ।অন্বেষা এরূপ কথা শুনে এক মুহূর্ত সেখানে দাঁড়ায়নি।কথা বলার ভঙ্গি আর মুখের ভাব পুরোপুরি অসভ্যের মত।বর্ণ আরো সুযোগ পায়।এগিয়ে এসে অন্বেষার হাত কষে চেপে ধরে।নিজের দিকে টেনে এনে বললো,
“উম হাতগুলি মোটামুটি নরম! চাবাইতে সমস্যা হইবো না।”
“বর্ণ!”
আচমকা অন্বেষার কোমরে দুহাত পেঁচিয়ে কাছে টেনে বর্ণ বলে উঠে,
“কি হইছে সোনা?রাগ করছো?কি লাগবো তোমার কও?আদর?”
চোখ জোড়া কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম।ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে,
“অসভ্য!ইতর!”
“আমি তোমারে চুমা দিলে দোষ?তুমি দিলে সোয়াব?”
দুইয়ে দুইয়ে চার হিসাব মিলেছে মস্তিষ্কে।বর্ণ কোন বিষয়ে কথা বলছে বুঝতে এক সেকেন্ড সময় লাগলো না।গতরাতে কপালে চুমু খেয়েছিলো।কান লাল হয়ে উঠলো অন্বেষার।লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে।বর্ণ খুব কাছ থেকে রক্তিম সূর্যের ন্যায় মুখখানা দেখে।বর্ণ হুট করেই অনুভব করলো এক আবেশিত ভালো লাগা ছুঁয়েছে অন্তর গভীরে।তার অন্তর ধূসর থেকে রঙিন হচ্ছে।অন্বেষার বদনে সেই বিভ্রম চিত্র সচক্ষে দেখছে।এইতো হুটহাট হারিয়ে যায় নিজের উদ্ভট চিন্তায়। আজ এই উদ্ভট চিন্তারা পরিতৃপ্তি দিচ্ছে।
বর্ণ অন্বেষার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে উঠে,
“খাওয়ন মজা না হইলে তোমারে আমি ব্যাকাপ হিসেবে গিলমু।”
“নির্লজ্জ!”
“তুমি আমার কথার ভুলভাল মিনিং বাইর করো ক্যালা?আমি তোমারে কাছে লইয়া আদর সোহাগ করমু? ছ্যাহ!তোমারে জবাই দিমু তারপর, পিস পিস করমু।মশলা মিশায়া ভুনা কইরা খামু।আজকে কসাই এর থিকা সব শিখা আইছি।জামাইর সোহাগ পাওয়ার আশা বাদ দাও।”
চোখ খিঁচে বন্ধ করে রেখেছে অন্বেষা।মুখ কুচকে।কান বন্ধ করে নিলো দুইহাতে।কিচ্ছু শুনতে চায় না।নাই বর্ণের মুখ দেখতে চায়।অস্থির লাগছে এমন বুকের সাথে লেপ্টে থাকতে।ছাড়া পেলেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।তার আগে বর্ণই ছেড়ে দিলো। অন্বেষা এক প্রকার দৌঁড়ে রান্নায় নিজেকে মনোযোগী করলো।
মিনিট খানেক পর বর্ণ আবার ফিরে আসে। অন্বেষার পাশে পা গুটিয়ে বসে বলতে লাগলো,
“অনেকদিন তো হইলো বিয়ার।যদিও তুমি দেখতে সুন্দর না।তোমার প্রতি আমার কোনো রুচি নাই।কিন্তু….”
অন্বেষা গরম খুন্তি হাতে তুলে চোখ পাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
“কিন্তু কি?”
“মানে একবার বাসর করার পর যদি তোমারে জবাই দিতাম তাইলে ভালো হইতো না?”
অন্বেষা ঝড় নিঃশ্বাস ফেললো। চুলোয় পানি ফুটছে। থমথমে গলায় বললো,
“এই গরম পানি দেখছো?ছুঁড়ে দিবো তোমার মুখে।যদি এই মুখ বন্ধ না করো।”
“বাসর করার পর উড়ায় মাইরো?”
“বর্ণর বাচ্চা!আরেকটা কথা না!যাও এখান থেকে”
“বাচ্চা লাগবো তোমার সোনা? এহনতো দিনের বেলা।খারাপ দেহাইবো।রাইতে দেখতাছি ব্যাপারটা।”
চলবে…..
#উন্মুক্ত_লাইব্রেরী
লেখা – আয্যাহ সূচনা
২৬.
দুপুরের অবশিষ্ট খাবার রাতের জন্য রেখে দিয়েছিলো অন্বেষা। প্রিয় খাবার পেয়ে শিশুর ন্যায় উৎফুল্ল মুখটা লুকানোর চেষ্টা করেছে বর্ণ অজস্রবার।পেরেছে অনেকাংশে হয়তো।তবে অন্বেষার চোখ ফাঁকি দিতে পারেনি।প্লেট চেটেপুটে খেতে খেতে বললো,
“চিন্তা কইরো না ছেমড়ি!নতুন একটা চাকরি পাইলে তোমার সব ঋণ আস্তে আস্তে শোধ কইরা দিমু।ওকে?”
অন্বেষা মুখ ভার করে প্রশ্ন করলো, “শোধ চেয়েছি আমি?”
“না ঐটা চাও নাই।কিন্তু খোটা দাও যদি? ওই ডরে….”
“বর্ণ… তুমি মাঝেমধ্যে এসব বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি করে ফেলো”
খুব শীতল স্বরে কথাটি বলে সরে গেলো অন্বেষা।বর্ণ কিছু বলতে যাচ্ছিলো।থেমে গেলো অন্বেষার শুকনো মুখটা দেখে। থালা বাসন ধুয়ে নিজের স্থানে রাখছে অন্বেষা।বর্ণ রাজার মত বসে বিছানায়।দেখছে মলিন হয়ে যাওয়া মুখটা।কয়েক মিনিটের ব্যবধানে এমন রূপ বদল?আকস্মিক চোখ পড়ে বাহিরে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে।এই সময়ের বৃষ্টির দিকে একবার মুখ তুলে চাইলো অন্বেষাও।কি যেনো ভাবলো আনমনে।বর্ণের দু চোখে আবদ্ধ আছে তার সব চালচলন।এমন নীরব পরিবেশ এড়াতে বললো,
“এই ছেড়ি?কালকে সকালে নাস্তা কি খাওয়াইবা?”
হাতের কাজ থামিয়ে অন্বেষা ধীমা সুরে জবাব দেয়,
“তোমার যেটা ইচ্ছে হয় সেটাই”
“আমারতো সকাল সকাল গরুর পায়া খাইবার ইচ্ছা করে রে ছেমড়ি”
অন্বেষা অবলীলায় জবাব দেয়, “নতুন চাকরি পেলে কিনে খেও”
বর্ণ দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে উঠে আসলো।হাঁটু মুড়িয়ে জমিনে বসে প্রশ্ন করে,
“কেন?তুমি খাওয়াইলে কি সমস্যা?তুমি আমার বউ না?”
“বিরাট সমস্যা।আমার টাকায় খেলে মানুষের জাত যাবে।তাই!”
“আহারে!”
বলে অন্বেষার গাল টানতে হাত বাড়ালে অন্বেষা সরে যায়। উঠে বারান্দায় গেলো কাপড় আনতে।ভিজে যাচ্ছিল এই স্বল্প বৃষ্টিতে।বর্ণ ঠোঁট কামড়ে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে আবার দেখছে রেগে বোম হয়ে থাকা অন্বেষাকে। বর্নকে এড়াতে অপ্রয়োজনীয় কাজ করে যাচ্ছে।আঘাত পায় ছোট ছোট বিষয়ে।
ঘন্টা খানেক পেরিয়ে গেলো। অন্বেষা শুতে আসেনি। বর্ণও এক জায়গায় টিকে নেই।কখনো বসছে আবার কখনও শুয়ে পর্যবেক্ষণ করছে অন্বেষার কর্মকাণ্ড।প্রথমবারের মতো হয়তো অন্য কারো মুখের মলিনতা ভাবাচ্ছে তাকে।বুঝতে চেষ্টা করছে এই রাগ কি সত্যিই?নাকি মিছেমিছি?মাথাটা কাজ করলো না।লটকে থাকা মুখের সামনে তার বাচাল মুখটাও নিঃশব্দ।
“ছাদে যাইবা?”
বর্ণকে গিরগিটির উপাধিতে ভূষিত করা বোধহয় ভুল সিদ্ধান্ত হবেনা।তার নরম সুর শুধুই একটা নাটক মাত্র।এটি ভেবে মুখ তুলে তাকালো।বর্ণ হেসে বললো,
“ছাদে যাইতে একটা ছোটোখাটো যুদ্ধ করা লাগবো।কিন্তু আমি আছি তোমারে কান্ধে কইরা নিমু লাগলে।যাইবা?”
অন্বেষা জবাব না দিয়ে কাপড় ভাঁজ করতে লাগলো।বর্ণ আবারো শীতল সুরে প্রশ্ন করে,
“হুম?”
অন্বেষা বললো, “আমি জানি বর্ণ এসবই তোমার ঢং!আমি যত যাই করিনা কেনো তোমার জন্য তুমি আমাকে গিল্টি ফিল করাতে এক সেকেন্ড সময় নাও না।”
গুরুত্বহীন ভঙ্গিতে নিঃশ্বাস ফেলে বর্ণ।এসব কথা শুনার মুড নেই।হাত থেকে কাপড় ছিনিয়ে পাশে রেখে দিলো। অন্বেষা কোনো প্রতিক্রিয়া দেওয়ার পূর্বে হুট করে পাজাকোলে তুলে নেয়।বলে,
“আমার লগে তিড়িং বিড়িং করবা না।এত তেল মাখাইতে ভাল্লাগে না।”
এই ভাঙ্গাচুরা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এসেছে বর্ণ। অন্বেষার আত্মা গলায় এসে আটকে ছিলো প্রায়। ছাদে এনে ধপ করে নামিয়ে দিলো।অন্বেষার মেজাজ আরো বিগড়ে যাচ্ছে।স্ত্রী জাতির ন্যায় মনে আসা জাগছে যে বর্ণ তার রাগ ভাঙাবে।এই আশা পূর্ণ হবার নয় সেটা জানা আছে। ছিটেফোঁটা বৃষ্টিতে মুখ ঘুড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।বর্ণ অন্বেষার দিকে ফিরে বললো,
“লাভ নাই।আমি তোমার রাগ ভাঙামু না”
তাচ্ছিল্য করে হেসে অন্বেষা বললো, “আমি আশাও করিনা।”
“কি আশা করো তাইলে?”
“কিছুই আশা করিনা।রাগ তারা ভাঙায় যাদের মনে অন্যের প্রতি ভালোবাসা থাকে।ভালোবাসা দূরে থাকুক।একটু মায়াও যার মনে নেই সে আবার ভাঙাবে রাগ!”
বর্ণ মুখ ঘুরিয়ে হাসলো।বারবার কপালে হাত রেখে বৃষ্টির পানি মুছা অন্বেষার দিকে ফিরে তাকালো।হাত ধরতে চাইলে অন্বেষা হাত ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে ফেললো তৎক্ষনাৎ।
“তোমার কষ্টের কামানো টাকা পয়সা।সারাদিন খাটনি করো।আমার মত আকাইম্মার উপরে ছিটাইতে বুক কাঁপে না?”
অভিমানী সুরে অন্বেষা জবাব দেয়, “আর কেউ আছে আমার?”
“আমি আছি নিহি?আমিতো তোমারে ভালোওবাসি না।তাইলে?”
অন্বেষার মুখটা আরো মিয়ে আসলো।তার কষ্টের কদর করা হচ্ছে না।তার প্রচেষ্টার মূল্য দেওয়া হচ্ছে না।ভালোবাসা অনেক দূরের বিষয় বর্ণের ক্ষেত্রে। আরেকদফা হাত ধরার চেষ্টায় ব্যর্থ বর্ণ।বললো,
“হাতটা ধরি?এমন করো কিল্লিগা?”
“গিয়ে ওই মেয়ের হাত ধরো যার সাথে দরজায় দাঁড়িয়ে সেদিন কথা বলছিলে”
বর্ণ হেসে জবাব দেয়, “ওয়তো খালি হাত না দেহ, মন দুইটাই দিবার রাজি। এলাকার একমাত্র আগুন পোলা বইলা কথা।”
“এই আগুনটা আমাকে পোড়াচ্ছে।”
বর্ণ অন্বেষার দিকে ঝুঁকে এসে কানে কানে বললো,
“পুড়ানি শুরুই করলাম না….”
অন্বেষার মুখ সম্মুখে নতমস্তকে চেয়ে আছে বর্ণ। মৃদু হাসির ছাপ মুখে। অন্বেষা একদফা তাকালো।ফের চোখ নত করে অবিলম্বে।চঞ্চল বর্ণকে চোখ রাঙানোর সাহস আছে কিন্তু শান্ত স্থির নেত্র গভীরে চেয়ে থাকার সাহস নেই।এড়ানোর ভঙ্গিতে অন্যপাশে দৃষ্টিপাত করে।
রাশভারী কন্ঠ ভেসে এলো, “তোমারে জ্বালাইতে আমার ভাল্লাগে….”
“জ্বালাও!বেশি করে জ্বালাও!জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলো”
বর্ণের এই জায়গাটা শান্তির স্থান।যেখানে এসে সে প্রায় থাকে নীরব।এক অন্য সত্তা জেগে উঠে তার মাঝে।অনেকক্ষণ যাবত বৃষ্টি হচ্ছে।বর্ণ অন্বেষা উভয়েই নির্বাক।অন্বেষার মুখ চোখ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে নজর গেলো মুখে ঘাড়ে লেপ্টে থাকা ভেজা চুলগুলোর উপর।আকস্মিক অবাধ্য হয়ে উঠে ইচ্ছেরা। অন্বেষাকে নিজের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে নির্বিঘ্নে।বুঝে উঠার পূর্বেই রেলিংয়ের দুদিকে হাত রেখে আবদ্ধ করে নিলো তাকে।ক্ষুদ্র নেত্রযুগলের বিস্মৃত মোহগ্রস্ত দৃষ্টিতে অন্বেষার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসে।বুকে হাত রেখে সরিয়ে দেওয়ার প্রয়াস করে বলে উঠে,
“বৃষ্টি হচ্ছে…..নিচে চলে যাই এবার ঠান্ডা লাগবে নাহয়।”
আরো বেশ খানিক দুরত্ব ঘুচিয়ে বর্ণ বললো,
“আগুনের কাছে থাকলে ঠান্ডা লাগেনা।”
ডান হাতে একপাশে লেপ্টে থাকা চুলগুলো সরিয়ে সিক্ত ঘাড়ে মুখ ডোবায় বর্ণ।দুহাতে পেঁচিয়ে ধরতেও সময় নেয়নি বেশিক্ষণ।নিঃশ্বাস আটকে আছে অন্বেষার।বর্ণের নিজেকে মাদকাসক্ত মনে হলো।কোনো দ্রব্যের নেশা নয় স্বয়ং এক মহীয়সী নারীর নেশা।স্থির দাঁড়িয়ে থাকা অন্বেষা বাকশক্তি হারানো এক মানবী।কাছে আসা উপভোগ করছে।পাশাপাশি শূন্যে ভাসাচ্ছে।সম্পূর্ণ জ্ঞান শূন্য। দুহাতে পেঁচিয়ে রাখা অন্বেষাকে ছাড়লো না বর্ণ। দাঁড়িয়ে কিয়ৎক্ষণ তপ্ত নিঃশ্বাস উজাড় করতে থাকলো গর্দনে।নিজের সমস্ত ব্যাকুলতা উজাড় করে মাথা তোলে।ডান হাতে চুল ঝাড়া দিয়ে বললো,
“নাহ!এত রোমান্টিকতা আমার সিস্টেম হজম করতে পারতাছে না।আজকের লেইগা এই পর্যন্তই”
রাগে শরীর রিরি করে উঠলো অন্বেষার।সাত পাঁচ না ভেবে সজোড়ে ঘুষি দিলো বর্ণের বাহুতে।মনে মনে ‘শালা’ বলে গালি দিয়েই যাচ্ছে। বর্ণ মার খেয়ে বললো,
“মাইয়া মানুষ হাত চালাও কেন?…. আদর লাগলে কও সিস্টেমের লগে যোগাযোগ কইরা তার বিরুদ্ধে যাইতে পারি কিনা দেহি।”
অন্বেষা বুকে বর্ণের বুকে ধাক্কা দিয়ে চলে গেলো।চুল ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে নিজের।সাথে বর্ণের।একটা সীমা থাকে সবকিছুর। সীমারও সীমা অতিক্রম করে গেছে সে।মানুষের পর্যায়ে আর ফেলা যাচ্ছে না তাকে। আস্ত একটা অমানুষ!বর্বর!
বর্ণ অন্বেষার যাওয়ার পানে অবাক হওয়ার ভঙ করে বললো, “ওমা!কি করলাম আমি?”
__________
পরদিন,
স্তব্ধ হয়ে জমিনে বসে আছে অন্বেষা। সম্পূর্ন জ্ঞান শূন্য।পায়ের হাঁটুতে হাত বেঁধে নির্বিকার চেয়ে।টলমল করছে চোখ।তবে অশ্রু ঝড়া বারণ।নিষ্পলক অক্ষি।
বর্ণ গুনগুন করতে করতে ঘরে ঢুকলো। অন্বেষাকে দেখে মুখের হাসি নিমিষেই গায়েব।পুরো দেহে তার রং মাখা। মূর্তির ন্যায় জমিনে বসে।বর্ণ ঝড়ের গতিতে এগিয়ে আসে।ধপ করে জমিনে বসে প্রশ্ন করলো,
“এই! এই অবস্থা কেন তোমার?”
অন্বেষার কানে যেনো কোনো কথাই প্রবেশ করেনি। শ্রবণ ইন্দ্রিয় নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে।বর্ণের চোখজোড়া বিশাল হয়। অন্বেষার বাহু চেপে প্রশ্ন করে,
“কি হইছে তোমার!”
নিরুত্তর রয়ে যায় এবারও।এক প্রাণহীন স্তম্ভ যেনো সে।বর্ণের উদ্দীপনা বাড়লো।বুকের মধ্যে হৃদপিণ্ড জোরে উঠানামা শুরু করেছে। অন্বেষার এই রূপ?বর্ণ অন্বেষার মুখোমুখি আসে। থুতনিতে আলতো করে হাত চেপে প্রশ্ন করলো গম্ভীর গলায়,
“কি হইছে?শেষবার জিগাইতাছি।তোমার শরীরে রং কেন?কই গেছিলা?”
কম্পিত নিঃশ্বাস নেয় অন্বেষা।চোখ তুলে চাইলো বর্ণের উত্তপ্ত হতে থাকা মুখে।চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। ঝাঁপিয়ে পড়ে বুকে। চেঁচিয়ে বলে,
“ওরা আমার গায়ে রং দেওয়ার চেষ্টা করেছে বর্ণ।রাস্তায়,সবার সামনে।রং খেলার বাহানায় আমাকে উত্যক্ত করতে…..”
ধপ করে জ্বলে উঠলো মস্তিষ্কসহ সর্বাঙ্গ।অন্বেষার মাথা তুলে আবার মুখোমুখি এনে প্রশ্ন করে অগ্নিমূর্তি হয়ে,
“কারা!নাম কও। আমার উপর আজকা আজরাইল ভর করবো।নাম কও!”
“ওই ছেলে জনি আর ওর সাথে কিছু ছেলে ছিলো।ওরা সবাইকে রং দিচ্ছিলো।আমাকেও…এলাকার কেউ কিচ্ছু বলেনি।”
বলে আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে অন্বেষা। অগ্নিশর্মা হয়ে উঠে বর্ণ।উঠে গেলো।পুরো ঘর তন্ন তন্ন করে বের করলো একটি মাঝারি আকৃতির রড। অন্বেষার কাছে এসে দাঁড়িয়ে হাত এগিয়ে দিয়ে বললো,
“উঠ!আমার লগে থাকলে কান্দার সুযোগ নাই।আমি আজকা ওর ঘর জ্বালামু।চল!”
বলে অন্বেষার হাত টেনে তুলে দ্রুত।নতুন একটি ওড়না খুঁজে এনে গায়ে মাথায় পেঁচিয়ে দিলো। অন্বেষা ভীত হয়ে বলে উঠে,
“থাক বর্ণ!বাদ”
বর্ণ আঙ্গুল তুলে গর্জন তুলে বললো,
“চুপ! আমার লগে ওর যাই হোক! ওয় জানে না আজকে ওই কই হাত দিছে।হাত দুইটা আজকে থাকবো না।”
অন্বেষা বর্ণকে থামানোর চেষ্টায় বলে উঠে,
“বর্ণ খুনাখুনি করে কি লাভ?আমাদের কথা কেউ শুনবে না।উল্টো তোমাকে জেলে নিয়ে যাবে।এসব করো না।একটা বিচারের ব্যবস্থা করো।”
“আমার হকের উপর ওর খাঁচড়া হাত দিছে।ওর বিচার করার হকও আমার।চলো!”
টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে লাগলো বর্ণ অন্বেষাকে। হাতজোড় করেও থামানো যায়নি। অন্বেষার বুক কেঁপে উঠছে ক্ষণেক্ষণে।আরো একটা ভুল করে ফেললো জানিয়ে। অজানাতো ছিলো না তার সম্পর্কে।আসতে আসতে জনিদের বাড়ির সামনে এসে হাজির হয়। মোকলেস মাতবরের দোকান টপকে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যেতে লাগলো উপরে।
রহমান ডাকে চেঁচিয়ে,
“মোকলেস চাচা!বর্ণ আপনার ঘরে ঢুকছে রড লইয়া”
আত্মা নড়ে উঠলো মোকলেস মাতবরের।লুঙ্গি চেপে দৌঁড়ে গেলেন বাড়িতে। ইতিমধ্যে বর্ণ এলোপাথাড়ি লাথি চালাচ্ছে দরজায়। উগ্রস্বরে গর্জন তুললো,
“দরজা খোল মাঙ্গের নাতি! বাপের ব্যাটা হইলে দরজা খোল।”
শরীরে যেনো এক ঐশ্বরিক শক্তি ভর করেছে।দরজা আলগা হয়ে এসেছে অনেকটা। অনবরত ধাক্কা আর লাথিতে ভেঙে যাবে প্রায়। মোকলেস মাতবরের স্ত্রী ভয়ে দুআ পড়তে শুরু করলো।এরই মাঝে জনি হকি স্টিক নিয়ে দরজা খুলে দিলো।ছেলের এই দুঃসাহসিকতায় জনির মা তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেলেন।আকুতি করে বর্ণের কাছে বললেন,
“মাফ কইরা দে। ওরে মারতে আহিস না।”
জনি চেঁচিয়ে বলে, “আম্মা সরো”
“চুপ থাক কুত্তার বাচ্চা।”
বর্ণ তেরছা হাসে।চেয়ে দেখলো আশপাশ ঘরের। অন্বেষাকে একপাশে সরিয়ে রড দিয়ে তান্ডব চালানো শুরু করে ঘরে।টিভি, শো কেস ভাঙতে লাগলো।ইতিমধ্যে মোকলেস সাহেব এসেছেন লোক নিয়ে। জনিকে আটকে ফেললো তারা।বর্ণের কাছে এগিয়ে যেতে চেয়েও পারছে না।তার এই আগ্রাসী রূপে সাহস করতে পারছে না কেউ।
মোকলেস সাহেব চিৎকার করলেন।বললেন,
“কেন করতাছোস এগুলি বর্ণ!কি হইছে?কি করছে জনি আবার?”
রক্তিম চোখজোড়া।হাত কেটে রক্ত ঝরছে।বুক কাপছে অন্বেষার।সেও পারছে না এগিয়ে যেতে। টি টেবিলের কাপড় টেনে তুলে হাতে পেঁচিয়ে নেয় বর্ণ।আয়েশ করে বসলো সোফায়।পায়ের উপর পা তুলে বললো,
“আপনার পোলায় আমার বউয়ের গায়ে হাত দিছে। কন ওরে কোন টাইপের মরণ দেওয়া যায়? রাস্তায় লেংটা কইরা মারুম?নাকি আপনাগো সামনে আপনার কলিজার ধনের বুকে রড ঢুকামু?”
মোকলেস মাতবরের চোখ গেলো অন্বেষার দিকে।ভয়ে তটস্থ হয়ে এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে।গায়ে রং।বুঝতে বাকি রইলো না ঘটনা।ঘুরে তাকালেন ছেলের দিকে।এগিয়ে গিয়ে ঠাটিয়ে চড় দিলেন গালে।বললেন,
“না করছিলাম তোরে শুয়োরের বাচ্চা!তুই একটা মাইয়ার গায়ে হাত দিছোস!ছিঃ”
বর্ণ উঠে এলো। জনির হাতে লাথি দিয়ে হকি স্টিক ফেলে দিয়ে ঘাড় চেপে ধরলো।বললো,
“এসব নীতি নৈতিকতা দেহায় লাভ নাই।আজ মরবো।যে বাঁচাইতে আইবো ওয়ও মরবো।”
জনির চেলাপেলাদের দিকে চেয়ে বর্ণ বলে উঠে,
“মরার ডর আছে না?….থাকলে যা এলাকার সব আমলারে ডাক।আজকা কেয়ামত করুম।বিচার করুম।শেষ করুম।”
বর্ণের দেহ শক্তির কাছে নিতান্তই বাচ্চা জনি।চুল টেনে হিঁচড়ে নিচে নেমে এলো।ইতিমধ্যে নিচে জড়ো হয়েছে এলাকার গণমান্য ব্যক্তি।আগেই খবর দেওয়া হয়েছে তাদের।বর্ণ তোয়াক্কা করলো না।জমিনে ফেলে দিলো জনিকে।সবাই এগিয়ে আসে। বর্ণের গায়ে হাত রেখে বুঝানোর ভঙ্গিতে বলে,
“এই! থাম! খুন করবি নাকি?কি হইছে ক আমরা বিচার করমু।”
বর্ণ চিৎকার করে বলে উঠলো,
“আরেহ রাখেন আপনাগো বিচার! জনির বেলায় বিচার?বর্ণের বেলায় এলাকার ছাড়?আমার পিছনে কম গেম খেলেন নাইক্কা আপনারা?আমারে এলাকার থিকা আউট করার লেইগা।পারলেন?পারছেন?পারেন নাই!কারণ আমি এই এলাকার পোলা।আপনাগো টাকা! আপনাগো ক্ষমতার উপরে মুতি আমি!ক্ষমতা ধুচার সময় নাইতো বর্ণের।তোরা আমার আর আমার মত মানুষগুলির জীবন নরক বানাইছোস। দেখ!এই নরকে সুখ খুঁইজা লইছি।”
গণমান্য সকলেই নীরব।আর বাকিরা অনেকেই নিরীহ।বর্ণ এগিয়ে গেলো অন্বেষার দিকে।আলতো করে হাত চেপে নিয়ে এলো সবার সামনে। বললো,
“আমার ঘরের ইজ্জত লইয়া খেলতে চাইছে এই কুলাঙ্গার।রং খেলার নামে!এমন হয় বড়লোক ঘরের আলালের ঘরের দুলালরা?এই শিক্ষা দেন বুঝি? তাইলেতো আমরা বাইনচোদ অশিক্ষিত বস্তিই ভালা।অন্তত এলাকার ছেড়িগো দিকে কুনজর দেই না। আমার পা ধুইয়া পানি খাবি তিনবেলা।তোরা যারা এই মহল্লায় মানবতার মুকুট পিন্দা ঘুরতাছোস তারা সবটি কুত্তার ছাও।”
অন্বেষা চুপচাপ মাথা নুইয়ে রাখলো।কিছু বলার মত শব্দ খুঁজে পাচ্ছেনা।বর্ণ রড হাতে এগিয়ে যায়।জনিকে টেনে এনে অন্বেষার পায়ের কাছে ফেলে দিলো। ঘাড়ের পিছনে রডের কোণ ঠেকিয়ে বললো,
“পা ধর মাফ চা। ক আমার ভুল হইয়া গেছে।আমারে মাফ কইরা দেন।তাইলে আজকা জান ভিক্ষা পাবি।”
আশপাশে চেয়ে জনির চেলাপেলাদের বললো,
“এই নেড়ি কুত্তার দল ভিডিও শুরু কর।আমার বউয়ের মুখ নিবি না।এই জনি কুত্তার মুখ ভালোভাবে নিবি।”
কিছুতেই ক্ষমা চাইবে না জনি।বয়সের তাজা রক্ত টগবগ করছে।উঠে আসতে চাইলো।বর্ণ কোনো রহম করলো না।আবার করলো বটে।বুঝে শুনে আঘাত করলো পিঠে। মোকলেস মাতবর এসে বর্ণের হাত ধরেন।বলেন,
“ওয় মাফ চাইবো,চাইবো মাফ।মারিস না। রডের বারি খাইলে বাঁচবো না।”
বর্ণ থামলো সময় নিয়ে। আশপাশে চেয়ে বললো,
“আপনাগো লাগাম আমার হাতে। ওয় আজকে মাফ না চাইলে….
”
হুট করে সবার মধ্যে একজন ভদ্রলোক বলে উঠেন,
“ওয় যেহেতু ভুল করছে মাফ চাইবো।এই জনি মাফ চা। মাইয়া মাইনষেরে অসম্মান করিস না।”
বর্ণ উচ্চ হেসে তাদের তাচ্ছিল্য করে।বলে,
“হায়রে নাটকবাজ রে!”
পরপর জনিকে পায়ের চাপে জমিনে ফেলে বললো,
“এই শুয়োর! মাফ চা”
জনি বরাবরের মতই হার মানে।বলে মিনমিন করে,
“আমারে মাফ কইরা দাও।”
বর্ণ জনিকে ঘাড় ধরে তুলল। গালে থাপ্পড় দিয়ে বললো,
“দাও কি হ্যাঁ!দাও কি? ক দেন।”
জনি বাবার দিকে চায়।সাথে আশপাশের এলাকার গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গদের দিকে।লাভ হলো না।সকলে নিশ্চুপ।বাধ্য হয়ে বলে উঠে,
“আমারে মাফ কইরা দেন।”
বর্ণের যেনো স্বাদ মেটে নি।বুকে ধাক্কা দিয়ে পিছনে সরায়। এলোপাথাড়ি চড় থাপ্পড় দিতে থাকে গালে।আবারো মোকলেস সাহেবসহ বাকিরা এগিয়ে আসে।বর্ণ হুংকার ছুঁড়ছে।থামানোর চেষ্টা করছে। অন্বেষা এবার এগিয়ে গেলো।বর্ণের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
“হয়েছেতো! ক্ষমা চেয়েছে।ওকে অনেক মেরেছো।এবার চলো।প্লিজ চলো।”
“আমার কলিজা ঠান্ডা হয় নাই।”
অন্বেষা বর্ণের গালে একহাত রাখে।অন্যহাতে বুকে আলতো করে ধাক্কা দিয়ে পেছনে নিতে চেষ্টা করতে করতে বললো,
“বর্ণ আমার ভীষণ অসস্তি লাগছে এদের মধ্যে চলো।”
বর্ণ থামলো। অন্বেষার মুখের দিকে চাইলো অবিচল চোখে। ঘেমে নেয়ে একাকার শরীর।উত্তপ্ত বুক। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বর্ণ প্রশ্ন করে,
“তুমি খুশি হইছো?শান্তি হইছো?নাকি আরো এক চোট দিমু ওরে?”
“না আমি সন্তুষ্ট।পুরো এলাকার সামনে পায়ে পড়ে মাফ চেয়েছে।আমার আর কিছু লাগবে না।চলো প্লিজ।এত রাগ করো না।”
বর্ণ চোখ বুঁজে মাথা ঝুঁকায়।নিজেকে শান্ত করার প্রয়াস করছে। অন্বেষা তার সামনে দাঁড়িয়ে।এক মিনিট পর মাথা তুলে হাত ধরলো অন্বেষার। মোকলেস মাতবর, জনি এবং বাকিদের উদ্দেশ্যে বললো,
“ওর দিকে এলাকার কেউ চোখ তুইল্যা তাকাইবো। এই রড গরম কইরা ওর চোখে ঢুকামু।…..আর আমার বিরুদ্ধে পলিটিক্স খেলার আগে নিজের আগাম কবর খুঁইড়া লইস।একটার পর একটা লাশ বিছামু রাস্তায়।কুত্তার দল!”
________
ফার্মেসি থেকে ঔষধ কিনে এনেছে অন্বেষা।বাড়ি ফেরার পর থেকেই চুপ। খাটে পা ভাঁজ করে শক্ত মুখে বসে আছে।এখনও কপালের রগ ভাসছে কপালে।নিঃশ্বাসের গতি থমথমে। দহন থামেনি হয়তো।ঝড় চলছে অভ্যন্তরে। অন্বেষা হাতে ব্যান্ডেজ পেঁচিয়ে দিলো।
দুহাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নরম সুরে বললো,
“চুপ যে?”
ভরাট গলায় জবাব আসে,
“আজকা যা হইছে ভালো হয় নাই।”
অন্বেষা এগিয়ে বসলো।হাত ছেড়ে বর্ণের গালে নরম দুহাত রেখে বললো,
“আজ তুমি আমার জন্য সবার সাথে লড়ে গেছো।আমার সম্মান বাঁচানোর জন্য?এর চেয়ে বড় পাওয়া আমার কাছে কিছুই নেই।ওই বিশ্রী রঙের দাগ উঠে গেছে আমার শরীর থেকে।যখন ছেলেটা আমার পায়ে পড়ে ছিলো।”
বর্ণ অনিমেষ চোখে চায় অন্বেষার পানে।খুশিতে তার চোখজোড়া জ্বলজ্বল করছে।কি যেনো কি পেয়ে বসেছে সে।এত খুশি হওয়ার কিছু আছে নাকি?মেয়েগুলো অল্পতে বেশি খুশি হয়ে পড়ে।বর্ণ এগিয়ে আসে।দুহাতে কোমর জড়িয়ে মাথা রাখলো বাহুডোরে। অন্বেষা চমকে উঠে ক্ষণিকের জন্য।কেমন শিশুর ন্যায় বুকে লেপ্টে আছে।যেনো নিঃশব্দে স্বস্তি চাইছে। সান্নিধ্যের অস্থিরতাকে পাশে ফেলে হাত ডুবায় বর্ণের এলোমেলো চুল গভীরে। অপর হাতে আকড়ে নিলো সুবিশাল দেহকে।চোখ বুঁজে অনুভব করলো এই নতুন পরিণয়।কি সুখময় ব্যাকুলতা।যেনো কোনো স্বর্গানুভূতি।
“আমার অনেক একলা লাগে অন্বেষা।অস্থির লাগে।আনচান করতে থাকি খালি….”
চলবে…..