#উন্মুক্ত_লাইব্রেরী
লেখা – আয্যাহ সূচনা
২৯.
আদিমকালের ঘরটায় মোটা দেয়ালের গায়ে লেগে আছে কালচে দাগ।যেখানে নিস্তব্ধতা আর স্নিগ্ধতার মিশ্রণে গাঁথা হয়েছে নতুন একটি সুখের মুহূর্ত। পুরনো কাঠের জানালা দিয়ে আসা হিমেল বাতাসের মৃদু প্রবাহে প্রয়োজনের প্রয়োজনে টাঙানো কমদামী পর্দার নাচন।সূর্যের মৃদু কিরণ সোনালি আভায় ভাসিয়ে দিয়েছে গোটা ঘর।
“ধ্যাত!”
শব্দ উচ্চারণ করলো বর্ণ।দুপুর একটা বাজতে চলেছে।চায়ের তলব সেই সকাল থেকে।কম্বল মুড়িয়ে ঘুমানো অন্বেষার দিকে চেয়েও তাকে জাগাতে ইচ্ছে হয়নি।আনমনে হেসেছে।এখন বিরক্ত হচ্ছে।বিড়বিড় করে বললো,
“শালার কি দিন আইলো আমার? বউ ঘুমায় আর আমি চা বানানের লেইগা কসরত করতাছি। শ্যাহ্!”
এক প্রকার যুদ্ধ করে চা বানিয়েছে কোনো রকম।হাতে নিয়ে দাঁড়ালো ধোঁয়া ওঠা চায়ের পেয়ালা।একবার দৃষ্টি দিলো বিড়াল ছানার মত গুটিয়ে শুয়ে থাকা অন্বেষার দিকে।ঠোঁট প্রসারিত হলো আরেকদফা হাসিতে।উষ্ণ কোমল স্পর্শে রূপ পেয়েছে তাদের সম্পর্কের অলিখিত অধ্যায়।ধীরে ধীরে রচনা হচ্ছে এক অসীম সুখের কাব্য।
বিশ্রী স্বাদের চা গিলে অন্বেষার পাশে গিয়ে বসলো বর্ণ। ঝুঁকে ডাকার চেষ্টা করে বললো,
“এই ছেমড়ি এই উঠো!”
তড়িৎ গতিতে কপাল কুঁচকে ফেলে অন্বেষা।হাত ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিলো।
“এই ছেড়ি দুপুর বাজে একটা!তুমি দিন দুনিয়া আন্ধার কইরা ঘুমাইতাছো? রানবো কে?”
ভারী ঘুম ঘুম কণ্ঠে অন্বেষা জবাব দেয়,
“বিরক্ত করো নাতো।”
আশ্চর্যের সপ্তম আসমানে চলে গেলো যেনো বর্ণ। একটু বেশিই অবাক হয়ে বললো,
“আমি বিরক্ত করতাছি?”
কাঁদো স্বরে অন্বেষা বলে উঠে,
“মাথাটা ব্যথা করছে…ঘুম পুরো হয়নি….”
“হ সররাইত তুমি একলা কুস্তি খেলছো।আমি আম্পায়ার আছিলাম না?….তোমার ঘুম ঘুম।আমার ঘুম ঘুম না?আমিওতো ঘুমাই নাই ঠিকমতো।”
বর্ণের হাত আবার ঝাড়া দিয়ে ফেলে দেয় অন্বেষা।চরম বিরক্ত সে।মাথা কাজ করছে না ঘুমের ঘোরে।কম্বল আরো ভালোভাবে টেনে বিড়বিড় করে গালি দিতে লাগলো,
“নোংরা!… নোংরা লোক”
“ক্ষিদা লাগছে কইলাম!”
কে শুনে কার কথা। অন্বেষাও নাছোড়বান্দা। উঠবে না সে কোনোভাবেই। ভঙ্গুর অবস্থা তার।আরো কয়েক ঘণ্টা না ঘুমোলে শক্তি পাবে না কোনো রূপেই।
দুপুর তিনটে,
সদ্য জাগ্রত অন্বেষা।ঘুমঘোর কেটে উঠে এলো বেলা করে।চোখ খুলতেই বর্ণকে ঠিক তার পাশে আধ শোয়া থাকতে দেখা গেলো।হাতের পিঠ কপালে ঠেকিয়ে আছে।আকস্মিক একে অপরের চোখে চোখ পড়তেই মুখমণ্ডলে লাজুক রক্তিমার আভা ছড়িয়ে পড়লো অন্বেষার। তার সেই লজ্জার আভাস যেন প্রকৃতির নিকষিত রত্ন।মুহূর্তের মাঝেই বর্ণের চোখে অদ্ভুত এক জাদুময় রূপ ধারণ করলো। বর্ণ এমন অভূতপূর্ব সৌন্দর্যের সম্মুখীন আগে কখনও হয়নি; হৃদয়ের অন্তস্থলে যেন তুফান শুরু হলো,এক অমোঘ আবেগের ঘূর্ণি।
ঝুঁকে এসে কপালে চুমু খেয়ে বললো অদ্ভুত এক বাক্য,
“ঘুম হইছে মহারানী?”
উত্তরের বিনিময়ে চোখ বুঁজে ফেলে অন্বেষা।বর্ণের দৃষ্টি স্থির হয়ে গেলো তার মুখশ্রীর প্রতি।যেখানে লালিত্য আর কোমলতার এক অপার্থিব মেলবন্ধনের দেখা মেলে।তার লাজুক মুখখানি যেন প্রভাতের প্রথম সূর্যরশ্মির মতোই উজ্জ্বল।কাঁপিয়ে দিলো বর্ণের হৃদয়ের অন্তরতম কোণ।
“উঠবা নাকি আরো আদর সোহাগ লাগবো?”
বর্ণের কথাগুলো যেনো হৃদয়ে বয়ে আনল এক প্রলয়ংকরী বায়ুপ্রবাহ। বুকের ভিতরে সেই আবেগের ঝড় যেন সমস্ত অস্তিত্বকে দোলা দিয়ে উঠে।যেন এক দহনজ্বালায় পুড়তে লাগল তার হৃদয়। প্রতিটি ধ্বনি প্রতিটি নিঃশ্বাসে অনুভব করল সেই অজানা আকর্ষণের তীব্রতা।
একলাফে উঠে দৌঁড় লাগায় অন্বেষা গোসলখানার দিকে।বর্ণ চেঁচিয়ে বললো,
“কাপড় নিয়া যাও নাই।চাইলেও আমি দিমু না”
অন্বেষার হুশ ফিরলো।জ্বিভ কামড়ে ধরলো। গোসল সেরে পড়বে কি?কাপড় গামছা কোনোটাই আনা হয়নি।যেই একটা লোক বাহিরে আছে সে দিবে বলেও মনে হয়না।তারপরও একবার চেষ্টা করলো। উঁকি দিয়ে বললো,
“গামছা আর কাপড় দিবে?”
বর্ণ সরাসরি জবাব দেয়, “জ্বি নাহ”
অন্বেষা অসহায় সুরে বললো,
“দেখো অনেক ঠান্ডা।দাও না?প্লিজ….”
মায়া হলো বর্ণের।অন্তত এই বিষয়ে বাড়াবাড়ি করা উচিত হবেনা।কোনো রকম কাপড় নিয়ে দিলো।দুষ্টু হেসে প্রশ্ন করলো,
“আমি আহি?”
অন্বেষা কাপড় কেড়ে নেয়।তেজি গলায় বলে উঠে,
“থাপ্পড় দিবো!”
বলেই মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলো।
আধ ঘন্টা পর বেরিয়েছে অন্বেষা।অন্বেষা শীতের বরফবর্ণ তাপমাত্রায় কাঁপছে।শরীর জুড়ে শীতের অবিরাম খচখচ।তাছাড়াও লাজের আবরণে মুড়ানো তার সমগ্র অস্তিত্ব।মুখে অদ্ভুত স্নিগ্ধ মেঘের আচ্ছাদন। বর্ণের চোখে চাহনি নেওয়ার মতো সাহস নেই।লজ্জার শীতল দোলায় দোদুল্যমান।
বর্ণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে।কোনো বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেললো না তাকে।এগিয়ে এসে টেনে নিয়ে গেলো বিছানার দিকে।কম্পিত সত্তাকে মোটা কম্বলে পেঁচিয়ে দিলো। বললো,
“হোটেল থিকা ভাত আর সবজি আনছি।”
অন্বেষার জিজ্ঞাসু চোখ বর্ণের দিকে তুলে দিলো।বর্ণ ভ্রু নাচিয়ে বলে,
“কি?তুমি কি আশা করছো মরার মত ঘুমাইবা আমি রানমু?…..ওই কপাল নিয়া দুনিয়াতে আহো নাই।”
মুখ নুয়ে ফেললো অন্বেষা। পেটে ক্ষুদার জ্বালা।বলতেও বাঁধা প্রদান করছে অন্তরের দ্বিধা। বর্ণ নিজেই উঠে গেলো।অদ্ভুত ভঙ্গিতে প্লেটে খাবার তুলে নিয়ে এসে অন্বেষার সামনে এসে বসলো।
“খাইতে পারবা না খাওয়ায় দিতে হইবো?”
অন্বেষা মিনমিনে সুরে জবাব দেয়, “পারবো।”
বলে হাত এগিয়ে দেয় প্লেট তোলার উদ্দেশ্যে।হাত কাপছে।বলহীন মনে হচ্ছে সম্পূর্ণ দেহ।বর্ণ হতাশায় মাথা দোলায় দুদিকে। কেড়ে নিলো প্লেটটি।বললো,
“হইসে!বুঝছি।”
বর্ণের মুখে তুলে খাইয়ে দেওয়ার বিষয়টা অন্বেষার মনে ধরেছে।কল্পনা রাজ্যে ডুবুরি হয়ে ভাসমান।শুরু থেকে শুরু করলো সবটা। এই বর্ণ আর সেই বর্ণে তুমুল তফাৎ।সে কি নিজেকে পরিবর্তন করেছে?করেছে এবং করেনি।এই দুইয়ে ব্যাপক সংঘাত।তার সুখী সংসার পাওয়ার সেই অভিলাষ পূরণের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে নিজেকে মনে হলো রাজ্যের সুখী নারী।আবার কান্নারা এলো চোখের কোল জুড়ে।
______
দুটোদিন কিছুটা অসস্তিতে কেঁটেছে অন্বেষার।অদ্ভুত শঙ্কা আর লাজে জর্জরিত ছিলো।অন্যদিকে বর্ণ ছিলো ততটাই স্বাভাবিক।তার মাঝে তেমন কোনো পরিবর্তনের রেশ দেখা যায়নি।কিছুটা সাহায্য করেছে অন্বেষাকে।আড়ালে থেকে।তাকে অসস্তিতে পড়তে দেয়নি একেবারেই।
আজকাল তার প্রিয় কাজ ফোনে গেম খেলা। আগামীমাস থেকে কাজে যোগ দিবে। অন্বেষা ধীর গতিতে পাশে এসে বসলো।কিছুসময় নীরব রইলো মাথা নুইয়ে।
হুট করে বর্ণ বলে উঠে,
“কি কইতে চাও?কইয়া ফালাও”
অন্বেষা বিছানার লালচে রঙের চাদরে আঙ্গুল চালাচ্ছে মাথা নুইয়ে।বারবার ভাবছে বলতে।বর্ণ ফোন থেকে মনোযোগ সরিয়ে অন্বেষার সামনে এসে বসে।কপালে তর্জনী আঙ্গুল চেপে মাথা সোজা করে বললো,
“সমস্যা কি?”
অন্বেষা কুণ্ঠিত স্বরে জবাব দিলো, “একটা কথা বলতাম….. মানে একটা আবদার করতাম আরকি?”
“আবার আবদার?শাড়ি না কিনা দিলাম?” খানিক বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করে বর্ণ।
অন্বেষা মুখ তুলে বলে, “না শাড়ি না।এবার অন্যকিছু…”
“জিবলা বড় হইয়া যাইতাছে তোমার বুঝলা!”
ম্লান মুখে অন্বেষা বলে উঠে, “এমন করো কেনো?আমি একটা দরকারি বিষয়ে কথা বলতে চাইছিলাম।তোমার বিষয়েই।”
বর্ণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে।এই সংসার আর অন্বেষা তার অদ্ভুত অনুভূতি।কখনো ফুলের ন্যায় সুবাসিত।আবার কখনও অসস্তিকর।মেনে নিয়েছে।মানতে সায় দিচ্ছে মন।ঠান্ডা মাথায় জানতে চেয়ে প্রশ্ন করে,
“কি আমার বিষয়ে?কও?”
অন্বেষা লম্বাটে নিঃশ্বাস ফেলে।চোখে চোখ রেখে বলতে লাগলো,
“সেদিন দেখেছি।কত আগ্রহ নিয়ে চেয়ে ছিলে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টদের দিকে।আমি আগে ভাবতাম মুখের ভঙ্গি আর চোখ দেখে কি মানুষের অন্তরে ঝেঁকে দেখা যায়? অবিশ্বাস করতাম কথাটাকে।কিন্তু আমি ভুল।আমি তোমার মধ্যে ওই হাহাকার দেখেছি বর্ণ।”
বর্ণ উদ্ভট হেসে উঠলো।মাথা দুলিয়ে হাসলো কয়েক সেকেন্ড। অন্বেষার মাথায় চাপড় মারলো আলতো করে।বললো,
“এই পিশাচিনী!আবার জ্ঞান বিতরণ ভান্ডার খুইলা বইছো। কেঠা শিখাইছে তোমারে এত কথা?”
“চুপ!ভালো কথা বলি গায়ে লাগেনা।এসব জ্ঞান না।আমার অনুভব।”
বর্ণের মস্তিষ্কে শয়তানি বুদ্ধি খেলে গেল। একহাতের আঙুলের সাহায্যে অন্বেষার গাল চেপে ধরে বললো,
“তাইলে কও ওইদিন যে আদর করলাম?ওই বিষয়ে তোমার অনুভূতি কি?”
গাল ছাড়িয়ে কপাল কুঁচকে তাকায় অন্বেষা।রাগী সুরে বললো,
“অসভ্যের মত কথা বলে টপিক চেঞ্জ করবে না।”
“ওইটাও একটা ইম্পর্ট্যান্ট টপিক। বউ জামাইর মধ্যে আদর সোহাগ তাগো মধ্যে একটা ভেরি গুরুত্বপূর্ণ টপিক।’
কপালে হাত রেখে মাথা ঝুঁকিয়ে নেয় অন্বেষা।এতে করে ফালতু কথা শুনে লজ্জাটাও আড়াল করা সম্ভব।এক ঢিলে দুই পাখি।
বর্ণ সেটি হতে দেয়নি।তার বাহু দুহাতে ঝাঁকিয়ে বিরক্ত করছে তাকে। অন্বেষা আবার ঘাড় তোলে।বলে,
“আমার কথাটা শুনো প্লিজ।”
অপ্রত্যাশিতভাবে অন্বেষার দুহাত ধরে কোলে টেনে নিলো বর্ণ।এত দ্রুত ঘটেছে ঘটনাটি সে কোনো প্রতিক্রিয়া দেওয়ার সুযোগটুকু পায়নি। অন্বেষার কোমরে দুহাত পেঁচিয়ে বললো,
“এবার কও সব কথা হুনমু।”
“এসব ফাত্রামির মানে কি?”
“কেন সোনা তুমি জানো না? একবার কাছে আইয়া পড়ছি এহন দূরে থাকাটা মুশকিল।পোলা মানুষের এইতো দুর্বলতা।”
বর্ণের এরূপ আচরনে হতাশার চরম সীমায় চলে যায় অন্বেষা মধ্যে মধ্যেই।আবার ফিরে আসে তারই দেখানো অদ্ভুত মায়ার টানে।এভাবেই থাকতে বাধ্য।অসহায় হয়ে বলে উঠে,
“আমি চাই তুমি পড়ালেখা করো।ভার্সিটিতে ভর্তি হও।”
আরেকদফা বিকট হাসে বর্ণ।প্রশ্ন করে,
“তাই নাকি?এই বুইড়া কালানে আমারে কেঠা ভর্তি নিবো?”
“উন্মুক্ত লাইব্রেরীর মত উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ও আছে।সেখানে যেকোনো বয়স আর পেশার মানুষ পড়তে পারে।সময়ের ধরা বাঁধা নিয়ম নেই। পরীক্ষা ঠিকঠাকমতো এট্যান্ড করলেই চলে যাবে।বেশি খরচ হবে বলে মনে হয়না। স্টাডি সেন্টারে চলে যাবে যেদিন ক্লাস থাকবে।আমি সব খবর নিয়েছি।তোমার কাজেও তেমন প্রভাব পড়বে না।”
অনর্গল কথা বলে থামলো অন্বেষা।নিজেকে বেশি সময় দিলো না। আহ্লাদী চোখে বর্ণের দিকে চেয়ে বললো,
“বলো রাখবে আমার এই কথা?প্লিজ না করো না।আমি প্রমিজ আর তোমার কাছে কোনো আবদার করবো না।”
বর্ণ মনোযোগ সহকারে শুনলো বটে।তবে জবাব দেয় নিজের মতো করে,
“তোমার মাথায় এসব আজাইরা আজাইরা বুদ্ধি কেন আহে কওতো? হেইদিন লম্বা স্পিচ দিলা আমার দায়িত্ব নিবা।আজকে আবার কও পড়ালেখা করতে। মানে জীবন ভালোমত চলতাছে তোমার ভাল্লাগে না?”
“না লাগেনা।আমি তোমাকে তোমার ইচ্ছা পূরণ করতে দেখতে চাই…..তাছাড়াও আমি ইন্টার পাশ জামাই নিয়ে সন্তুষ্ট না।আমি চাই সেও আমার মতই শিক্ষিত হোক।মানি না!মানবো না!” বলে হাসি আটকাতে ঠোঁট কামড়ে ধরলো অন্বেষা।
এক শান্ত নীরব চাহনি ছুঁড়ে বর্ণ। অন্বেষার মুখের দিকে চেয়ে ভাবছে।সবকিছুর অন্তে মায়ের কথা মনে পড়ে।কতই বা বয়স ছিলো তার?এভাবেই না বলা কথাগুলো বুঝে যেতো মা।একহাত বুকে অন্যহাত মাথায় রেখে চাওয়া পাওয়াগুলো বুঝে ফেলতো।
বর্ণকে চমকে দিয়ে অন্বেষা বলে উঠে,
“মায়ের কথা মনে পড়ছে?”
বর্ণ আচমকাই কপাল কুঁচকে ফেলে।আশ্চর্য গিয়ে তাকিয়ে রইলো অন্বেষার মুখপানে। অন্বেষা যেনো মন পড়তে জানে।আরো অনেকটা অবাক করে বর্ণের কপালে চুমু খেয়ে বুকে মাথা ঠেকালো অন্বেষা। বললো,
“দেখো চারিদিকে কত পরিপূর্ণতা।সেখানে অতীতের মিষ্টি অনুভুতি থাকুক। পোড়া কোনো স্মৃতি যেনো ধরা না দেয়।”
বর্ণ অবলীলায় জবাব দিলো, “পোড়া স্মৃতিই বেশি ধরা দেয়।”
“তুমি অনেক স্ট্রং বর্ণ।তুমি ভালোবাসা নামক পবিত্র অনুভুতি,কষ্ট নামক যন্ত্রণাদায়ক অনুভুতিকে নিজের থেকে দূরে ঠেলে রেখেছো বছরের পর বছর।এটা পারবে না?তুমি মনে করো তোমার মা শুধু তোমার মা ছিলেন না।তোমার বাবাও ছিলেন।ভুলে যাও মোকলেস মাতবর নামক লোকটাকে।তার সাথে তোমার কোনো সম্পর্ক নেই।না ওই খারাপ জনির সাথে।তোমার সম্পর্ক শুধু তোমার মায়ের সাথে।তোমার মায়ের পবিত্র রক্ত বইছে তোমার শরীরে।”
বর্ণ হুটহাট চুপ হয়ে যায়।এই তীব্র ঠান্ডায় দেহ গরম তার।অনুভব করছে অন্বেষা। অন্যকে সান্ত্বনা দিতে দিতে তার নিজেরই যে বাবা মায়ের কথা মনে পড়ছে।বর্ণ প্রশ্ন করে,
“আর তোমার লগে?”
অন্বেষা স্মিত হেসে বললো, “আত্মার গভীর সম্পর্ক।”
“হুম”
“আমিও আমার বাবা মাকে মিস করি।কিন্তু তোমার সাথে থাকলে ভালো অনুভব করি।শান্তি লাগে।কষ্ট আসতে চেয়েও পারে না।”
বর্ণ জবাবে বলে,
“আমিতো ভালো পোলা না।তারপরও?”
“উম!হতে পারো সবার জন্য খারাপ আমার জন্য না।আমার ইচ্ছে ছিলো পড়ালেখা শেষ করে বাবা মায়ের দায়িত্ব নিবো।তাদের রাজার হালে রাখবো।সেটা হলো কই আর?এখন তুমি একান্ত তুমিই আছো।তোমার সব শখ আহ্লাদ পূরণ করি নাহয়।”
“তুমি পারোও আল্লাহর বান্দি!”
“তোমারও পারতে হবে।আমার ইচ্ছে পূরণ না করে যদি মরে যাই তাহলে আমার সারাজীবনের অপূর্ণ ইচ্ছের দায় কিন্তু তোমার বিবর্ণ।”
বর্ণ ক্লান্ত নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
“পুরাপুরি ফাঁসায় ফালাইছো আমারে।”
বর্ণের এলোমেলো কথাও বিশেষ ভাবার্থ বহন করে। উদ্ভট শব্দ ব্যবহার করে জাহির করে নিজেকে।ভাবে হয়তো তার শব্দের এই ধোঁকা অন্বেষা বুঝে না।সে ঠিকই বুঝে।জোর করেনা তাকে।লজ্জায় ফেলেনা প্রকাশ করে।যদি বর্ণের এই চরিত্র হারিয়ে যায়?ভয় হয় তার খুব।
“ফাঁসাই নি।”
বর্ণ শান্ত কন্ঠেই বললো,
“ছেড়ি মানুষ নিজের দোষ স্বীকার যায় না।”
অন্বেষা নত চোখে জবাব দেয়,
“এই ঠেলাগাড়ি ঠেলতে ঠেলতে আমি একটা দ্বারপ্রান্তে নিয়ে দাঁড় করাবো।”
বর্ণ বুঝতে অক্ষম।নির্বোধ এর মত প্রশ্ন করলো,
“মতলব?”
“মানে হচ্ছে তোমাকে তোমার সঠিক স্থানে নিয়ে দাঁড় করিয়ে আমি আরামের ঘুম দিবো”
নীরবে আতঙ্কিত হয়ে উঠে বর্ণ।চোখে মুখে একরাশ বিস্ময়।অজানা ভয় বুকে চাপ সৃষ্টি করছে।কেমন অদ্ভুত যেনো এই শিহরণ।সীমিত বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করে,
“ঘুমাইবা মানে?কাব্যিক কথা বুঝি নাতো আমি।”
অন্বেষা স্বাভাবিক সুরে জবাব দেয়, “ছুটি নিবো।”
বর্ণের কণ্ঠের বিচলন যেনো বৃদ্ধি পায়।বলে উঠে,
“তুমি কি আমারে ফালায় থুইয়া যাওয়ার প্ল্যান করতাছো?”
বর্ণের প্রশ্ন অন্বেষা বিমূঢ় খানিক।তার কথার অর্থ এমন ছিলো না।ভুল বুঝে নিয়েছে বর্ণ। অন্বেষা মাথা দোলায় দুদিকে।জবাবে বলে,
“ছেড়ে যাবো কেনো?”
গলার স্বর কিছুটা উচ্চ হয় বর্ণের।চেপে ধরে আছে অন্বেষাকে।বললো,
“আম্মাও যাওয়ার আগে কইছিলো তোর একটা গতি কইরা আমি শান্তির ঘুম দিমু।তুমিও কি একই ফাইজলামি শুরু করলা!আমি কোনো উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হমু না।এত লায়েক আমি হইতে চাই না। নাটকবাজ বেডি জাতি!”
“তুমি উত্তেজিত হচ্ছো কেনো আশ্চর্য!আমি কোথাও যাবো না”
অন্বেষাকে ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে ফেললো বর্ণ।সরে গেলো তার কাছ থেকে।অন্বেষা গোলগোল চোখে চেয়ে আছে।মুহূর্তেই রেগে গেছে। অন্বেষা এগিয়ে আসে।বর্ণের বাহু চেপে বললো,
“আমি কথার কথা বলেছি বর্ণ….ভুল বুঝছো!”
“আমি ঠিকই বুঝছি….তোমার মতলব খারাপ!”
“বোকা ছেলে তুমি।ছেড়ে যাওয়ার হলে তোমার জন্য এতকিছু করতাম?”
বর্ণ রেগে গেছে। অন্বেষার হাত সরানোর চেষ্টা করে জবাব দেয়,
“তোমরা সবাই এক। ধান্দাবাজ!”
অন্বেষা বর্ণের দুহাত চেপে ধরে শক্ত করে।অস্থির দেখাচ্ছে তাকে।চোখে মুখে বেজায় আঁধার তার।শান্ত করার উদ্দেশ্যে বলে,
“ঠান্ডা হও।আমি কোথাও যাবো না তোমাকে ছেড়ে।কক্ষনো না।”
“সরো”
“তুমি একটা পাগল।আমি বলতে চেয়েছি তোমার জীবনের সব অপূর্ণতা কেটে গেলে আমি শান্তি।তারপর তুমি স্বামীর দায়িত্ব পালন করবে।আমি বসে বসে খাবো।…. বর্ণ?তুমি এতটা নির্বোধ?”
শান্ত হলো সময় নিয়ে।নিজের মতো করেই।মুখ থমথমে থাকে কিছু মুহূর্ত।ধীরেধীরে স্বাভাবিক হয় বর্ণ।ঠোঁট চেপে মাথা নুয়ে আছে। অন্বেষা হেসে প্রশ্ন করে,
“ভাত দিবো?”
“দাও”
________
মোকলেস মাতবর এর দোকান থেকে কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে অন্বেষা।পরনে বর্ণের দেওয়া কালো বোরকা। কাঁধে ব্যাগ চেপে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে।বর্ণ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে।আলাপ করছে মোকলেস মাতবর এর সাথে। অন্বেষার উপর কঠোর আদেশ কোনোভাবেই সীমানা পেরিয়ে দোকানের সামনে দাঁড়াতে পারবে না।
অন্যদিকে বর্ণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মোকলেস মাতবরের দিকে চেয়ে বললো,
“দক্ষিণের ঘরের স্টিলের আলমারির ড্রয়ারে আমার সার্টিফিকেটসহ দরকারি কাগজপত্র আছে।বাইর কইরা আইন্না দেন”
এক আদেশপূর্ণ কন্ঠ। মোকলেস সাহেব নমনীয় দৃষ্টিতে তাকান।ঠান্ডা সুরেই প্রশ্ন করলেন,
“ঐটি দিয়া কি করবি?”
বর্ণ স্পষ্ট গলায় জানায়,
“এত কৈফিয়ততো দিতে পারুম না”
মোকলেস মাতবর চোখ নামান।এক লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।আবার প্রশ্ন করেন,
“কেন লাগবো হুনি?”
বর্ণ কপাল কুঁচকে বিরক্তির ভঙ্গিতে বলে উঠে,
“শ্মশানে নিয়া জ্বালামু।শান্তি?জলদি করেন হাতে সময় নাই।”
মোকলেস সাহেব উঠে আসলেন দোকানের বাহিরে।এক পলক বর্ণের দিকে তাকিয়ে আবার অন্বেষাকেও চেয়ে দেখলেন। চাবির গোছা নিয়ে চলে গেলেন উপরে।
পুরোনো আলমারি।পুরোনো ঘর।তেমন কিছুই নেই সেখানে। স্টোর রুম বলে গণ্য সেটা।বর্ণের মায়ের সেলাই মেশিনটাও পড়ে পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে।স্মৃতি বলতে কিছুই রাখেনি মোকলেস সাহেবের দ্বিতীয় স্ত্রী।পুরোনো কাগজের ভিড়ে বর্ণের জন্ম থেকে উচ্চ মাধ্যমিক অব্দি সব কাগজ অক্ষত।ফাইল ঝেড়ে নিয়ে নিচে নামলেন।বর্ণের দিকে এগিয়ে দিতে সে ছো মেরে নিলো।কোনো রকম কোনো কথা না বলে উল্টো ঘুরে হাঁটতে শুরু করে।
অন্বেষা প্রশ্ন করে, “দিলো?”
দুজনে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বর্ণ জবাব দেয়,
“দিবো না কেন?না দিলে আবার কেয়ামত ঘটায় দিতাম।হেয় আমারে ডরায় বুঝলা!”
বলে হাসে বর্ণ।ফাইলের ময়লা ঝাড়ছে নিজ হাতে।তার হাসিতে অন্বেষাও স্মিত হাসলো।হুট করে মন বললো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্তগুলো কাটাচ্ছে তারা একে অপরের সাথে।
ভর্তি কার্যক্রম শেষ করতে তেমন বেগ পেতে হয়নি। অন্বেষা কাজের পাশাপাশি বর্ণের মুখপানে চেয়েছিলো বারবার।একটা সুখী মুখ।যেনো আড়ালে নিজের খুশি উৎযাপন করেছে।কখনো একটু টেনশনে,কখনো নিস্তব্ধ থাকতেও দেখা গেছে তাকে।আশপাশের মানুষগুলোর দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে ছিলো।কাজ শেষ করতে করতে বিকেল পেরোলো।
হুট করে বর্ণ বলে উঠলো,
“আহো ফুচকা খাই।”
ঠোঁট প্রসারিত করে হাসে অন্বেষা।কোনো কথা না বলেই সম্মতি জানালো তার সাথে।ফুচকার স্টলে পাশাপাশি বসে দুজনে।দুজনার জন্যেই বেশি ঝাল দিয়ে ফুচকা অর্ডার করেছে।বর্ণ সামনে বসে হাত ঘষতে ঘষতে বললো,
“আজকে বাড়িত গিয়া হিসাব করমু বুঝছো। আমারতো সামনের মাস থিকা কাম শুরু।আবার বই খাতা কিনা লাগবো।হাতে কিছু ট্যাকা আছে।হইয়া যাইবো।তারপর ঐ ভার্সিটির বেতনের লেইগা টাকা রাখতে হইবো।ঘরের খরচা পাতি আছে না?একটা হিসাব করলে মাস শেষে আর ঝামেলায় পড়তে হইবো না।”
ছোট্ট একটি ছেলে এসে ফুচকা দিয়ে গেছে ইতিমধ্যে। অন্বেষা একটি ফুচকা নিয়ে বর্ণের মুখে পুড়ে দিলো হুট করে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় বর্ণের চোখ বিশাল আকৃতি ধারণ করে মুহূর্তেই। অন্বেষা হেসে বললো,
“হয়েছে হিসাবী পুরুষ!আপনি এবার থামুন।সামনে যা হবে আমরা দুজনে মিলে সামলে নিবো।আপনি অস্থির হবেন না।”
কোলাহলপূর্ণ এক শীতের সন্ধ্যা নামছে শহরে।মাথার উপরে হলুদ রঙের ল্যাম্পপোস্ট প্রজ্জ্বলিত।মুখ আলোকিত করে রেখেছে বর্ণ অন্বেষা উভয়ের।চারিদিকে যানবাহনের আনাগোনা।মানুষ এবং গাড়ির হর্নে ব্যস্ততা।
কোনরকম ফুচকা গিললো বর্ণ।বললো,
“আমি আমার বাপের জন্মেও ভাবি নাই আমি বর্ণ এসব করমু।এত চিন্তা করমু। সব তোমার দোষ।”
অন্বেষা অবাক সুরে প্রশ্ন করে, “দোষ?আমি যে এই ছন্নছাড়া বাউন্ডুলে ছেলেটাকে মানুষ করেছি সেটা বলো।”
“ওই জীবন বহুত ভালো আছিলো।”
“ওহ!তাই নাকি?”
ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করলো অন্বেষা।সরাসরি বর্ণের চোখে চোখ রেখে।বর্ণ ঠোঁট কামড়ে চোখ নামায়।মিথ্যে বললেই ধরা পড়ে যাবে। অন্বেষাকে এড়িয়ে ফুচকার দিকে মনোযোগ দিয়ে বলতে লাগলো,
“এরপর কফি খামু নে।ট্যাকা থাকলে খালি উড়াইবার মন চায়।”
অন্বেষা কানেই তুললো না তার এই কথা। সে বর্ণের দিকে চেয়ে বললো,
“গতরাতে আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় তোমাকে ঘিরে ধরেছিলো তাই না?”
প্রশ্নটি মস্তিষ্কে গিয়ে লাগে তৎক্ষনাৎ।দুচোখ তুলে তাকায় অন্বেষার সুশ্রী মুখমন্ডলের দিকে।এখানে এক রাজ্যের সুখ খুঁজে নিয়েছে বর্ণ। অথচ অন্বেষাকে আচ করতে দেয়নি।
আকস্মিক বর্ণ মুখ তুলে অন্বেষার দিকে এগিয়ে আসে।স্থান,পরিস্থিতি তোয়াক্কা করলো না। সরাসরি কানের কাছে উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
“কি ঠাডা পড়া নসিব আমার!তোমার পিরিতের জালে আটকা পইড়া আমিও এহন প্রেমে ডুব দিবার শুরু করছি….”
চলবে…..
#উন্মুক্ত_লাইব্রেরী
লেখা – আয্যাহ সূচনা
৩০.
সময় মানুষ বদলায়,বদলায় আত্মার বর্ণ।ছন্নছাড়া ছেলেটি আজ মনোযোগে গঠন।পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা পাঠ করে সে নিঃশব্দে।আগ্রহে চরম।যেনো যেনো নতুন জগতে ভাসমান।বইয়ের পৃষ্ঠাগুলি চোখের কাছে তুলে ধরে রাখে।অন্ধকারের মাঝেও আলো খোঁজে প্রতিনিয়ত।কঠিন শব্দের ভাঁজে নতুন কিছু খোঁজে।কালো অক্ষরে লেখা প্রতিটি অক্ষর তার প্রিয় হয়ে উঠেছে।
“মশাই আমাকে হলুদের কৌটা দেওয়া যাবে?”
মেয়েলি কন্ঠ কর্নে এলো।তবে মস্তিষ্কে ঢুকলো না।বর্ণ এখন জ্ঞানের সঞ্চয়কূপ।ছন্নছাড়া থেকে নব্য গঠন। প্রাথমিক সমাজ বিজ্ঞানের বই মুখের কাছে নিয়ে বিছানায় বসে ছিলো। অন্বেষার কথার বিপরীতে অস্ফুট স্বরে বললো,
“হুম?…. হুউউউউম”
অন্বেষা গলা উঁচু করে বলে, “কি হুউউউউম?হলুদের কৌটা এগিয়ে দাও।রান্নায় দেরি হচ্ছে।”
বর্ণ অমনোযোগী ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ায়।বইয়ে মুখ গুঁজে হাঁটতে লাগলো তাকের দিকে।হাতড়ে হাতড়ে বোয়াম খুঁজছে।তবে দৃষ্টি সেখানে নেই। অন্বেষা নীরবে দেখছে তার কার্যকলাপ।হুট করে হাতে একটি বোয়াম তুলে নিয়ে অন্বেষার দিকে এগিয়ে দিলো।
বললো,
“উমমম…লও।”
অন্বেষা চেয়ে রইলো বর্ণের হাতের বোয়ামের দিকে।নিলো না।বর্ণ বিরক্ত হয়।বলে,
“লও না মিয়া”
অবশেষে অন্বেষা বোয়াম বর্ণের হাত থেকে নিয়ে জবাব বললো,
“আজ হলুদের পরিবর্তে চিনি দিয়ে তরকারি রান্না হবে।কি ভয়ানক মজার ব্যাপার।….যাক বাবা নতুন টেস্ট পাবো।”
কলম কামড়ে বর্ণ অপরিষ্কার স্বরে জবাব দেয়,
“হুম ভালো হইবো…”
অন্বেষা তড়াক করে উঠে দাঁড়ায়।ধ্যান হারিয়ে থাকা বর্ণকে টপকে নিজেই তাক থেকে হলুদের কৌটা নিয়ে আসে। তরকারিতে অল্প আঁচে বসিয়ে আবারো উঠে দাঁড়ালো।বর্ণের হাত থেকে বই কেড়ে নেয় তৎক্ষনাৎ। ক্ষুধার্ত বাঘের মত কলমটা চিবিয়ে খাচ্ছে।সেটিও অন্যহাতে সরিয়ে নিলো।
কপট তেরছা সুরে বললো,
“বর্ণ চন্দ্রবিদ্যাসাগর আপনি এবার থামুন।এমন চলতে থাকলে সংসার আর বউ দুটোই বানের জলে ভেসে যাবে।”
এবারে হুশ ফিরে বর্ণের।চরম বিরক্ত বই কেড়ে নেওয়ায়।সাথে কলমটাও।যেনো সবকিছু লুট করেছে কেউ তার।জবাব দিলো,
“তোমারে লইয়া আমার এমনেও মাথা ব্যাথা নাই।আপন সুখে ভাইসা যাইতে পারো।”
“ওহ তাই না? জ্ঞানের আলো ফুটার আগেই বউকে টাটা বায় বায়? নাহ!তোমাকে পড়ালেখা করানো যাবে না।”
“নিজের গর্ত নিজে খুঁড়ছো”
অন্বেষা বুঝতে পারছে না কি করবে?বর্ণকে পড়ালেখার দিকে আগ্রহী দেখে খুশি হবে নাকি অতি আগ্রহী বর্ণকে দেখে কপাল চাপড়াবে?বই নিজের কাছেই রেখে বসে পড়লো রান্না করতে।বললো,
“সব দোষ আমারই”
বর্ণও অন্বেষার পাশে বসে একটি বিস্কিটের প্যাকেট নিয়ে।হালকা পাতলা ভোজন করতে করতে বললো,
“পরশু ক্লাসে গেলাম না?ওদিকে একটা সুন্দরী ম্যাডাম দেখছি। পুরা মাক্ষনের মত।আমিতো এক দেহায় ফিট হইয়া গেলাম রে ছেমড়ি”
আচমকাই হাতে গরম অনুভব করে বর্ণ।সাথে অন্বেষার অগ্নিচক্ষু।হাতের দিকে চেয়ে দেখলো খুন্তির কিছুটা উপরের অংশ তার হাতে চেপে ধরেছে অন্বেষা।আঘাত করেছে সেটিও বুঝে শুনে।থমথমে গলায় বর্ণকে শাসিয়ে বলে উঠলো,
“আবার এসব বাজে কথা শুনলে হাত পোড়াতে দ্বিধাবোধ করবো না।”
বর্ণ আরো সুযোগ পেয়ে বসে।হাত এগিয়ে অন্বেষার মুখ টেনে আনে নিজের দিকে।ডান গালে শক্ত চুমু খেয়ে বললো,
“আদর তোমারে করতে চাই কিন্তু দিল ফাল পারে ওই ম্যাডামের লেইগা।কি করতাম?”
হাতের সাহায্যে নিজের গাল মুছতে মুছতে অন্বেষা চরম বিরক্তি আর হিংসা নিয়ে বললো,
“মনটা বের করে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়ে এসো।”
“এহনি যামু?”
অন্বেষা চোখ পাকিয়ে চেয়ে জবাব দিলো, “যাও!”
বর্ণ তোয়াক্কাহীন। আস্ত দুটো বিস্কিট মুখে পুরে বললো,
“থাক কালকেই যামুনে।ভালো মতো পানিতে ধুইয়া ভাসায় দিমু।”
তর্কে জড়ানো বেকার।বুদ্ধিমতী স্ত্রীর মতো চুপ করে গেলো।বর্ণ বাহানা খোঁজে তাকে জ্বালাতন করার।খুব আনন্দ পায় সেই কাজে।তার আনন্দ মাঝ পথে ধূলিসাৎ করে আবার আনন্দ পায় অন্বেষা।
বর্ণ বললো,
“কথা কও বউ।আমি কি ওই ম্যাডামরে বিয়ার প্রস্তাব দিমু?”
“দাও!তারপর তোমাকে গণধোলাই দেওয়ার ব্যবস্থা আমি করবো।”
বর্ণ হেসে ফেলে।রূপ বদল হয় তড়িৎ গতিতে।মাথায় হাত রাখলো পরম যত্নে।এক বুক ভরে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
“এমনি থাইকো সবসময়।”
উজ্জ্বল দৃষ্টি ছুঁড়ে অন্বেষা জবাব দিলো,
“বর্ণের বহুরূপ।প্রতি রূপে আমার জীবনে আসা লোকটা সেরা।তুমিও সবসময় এমনি থেকো”
_______
“আমি ওই বর্ণরে সারাজীবন একটা কামের ছেড়া হিসাবেই দেখছি আমাগো বাড়িতে। ওরে ভাই বইলা দাম দিমু?অসম্ভব!”
মোটা ফ্রেমের কাঁচের চশমা মুছতে মুছতে হাত জোড়া থামে মোকলেস মাতবরের।আর কতই বা রাগ দেখাবেন?কত চেঁচামেচি করবেন তার এই সন্তানের সাথে?ক্লান্ত তিনি।
অনিমেষ চেয়ে বললেন, “মুখ দিয়া ভালা কথা বাইর না করবার পারলে খারাপ কথাও বাইর করবি না।দরকার পড়লে মুখে তালা মাইরা রাখ।”
বাবাকে তাচ্ছিল্য করে হাসলো জনি।বললো,
“আপনি এসব কথা কন?আপনের মুখে এসব মানায় না আব্বা।নিজে জুলুম করছেন।আবার নিজেই ভালো সাঁজেন।দুই মুইখা সাপ আপনে নিজে।”
মলিন মুখ রাগান্বিত হয়ে উঠে মোকলেস মাতবরের।ভারী গলায় বললেন,
“তুই আমারে কইবি আমি কেমন মানুষ?”
জনি যেনো নির্ভয়।সরাসরি বাবার সামনে এসে বসলো।উচ্ছন্নে গেছে বহু আগেই।বেয়াদবি তার চরম সীমায়।বললো,
“বর্ণ আমগো বাড়িতে একটা কামের পোলাই আছিলো।আমি,আম্মা, আপনে ওরে কামের পোলার মতই রাখছেন।খাওয়ার সময় খাওয়া দেন নাই।টাকা দেন নাই।আপনার থিকাই শিখছি।”
রুহ কেমন কেঁপে উঠে মোকলেস মাতবরের।তারপরও মানুষের মনের জেদ।জিততেই হবে যেকোনো রূপে। জনির কথার বিপরীতে বলে উঠলো,
“ওর পরীক্ষার আগে যে তুই ওর বই ছিঁড়া লাইতি?তোর মা ওরে খাওয়ন দিতে চাইতো না।আমি না।আমার ওরে শাস্তি দেওয়ার হইলে আমি ওর খাওয়া বন্ধ করতাম।”
জনি আবার হাসে।জবাব দেয়, “আপনারা কন না?বাপ মা থিকা পোলাপান শিখে।আমিও ছোটবেলা থিকা যা দেখছি যা হুনছি তাই করছি।”
“এতই যেহেতু বুঝোস তাইলে তো তোর ওর প্রতি মায়া হওয়ার কথা।জিদ কেন?”
“কারণ আপনার মনে ওর লেইগা এহনও মায়া। হাহ!প্রথম পোলা।প্রথম রক্ত! লুকায় ছাপায় রাখেন দরদ।ওয় ভুল করলে ওর ভুল আমার উপরে চাপান।এলাকার মাথারা জানে বর্ণ আপনার পোলা।এই কারণে কেউ সাহস পায় না ওরে কিছু কওয়ার।আমার উপরে থাকে ওয় সবসময়।আমি কেন ওর কাছে ঝুঁকমু?আমারও বরাবর হক! উল্টা আমার ওর চেয়ে বেশি ক্ষমতা।ওয় একটা বাটপার।ওর ত্যাজ্য করছেন আপনে।ওর এহনও এত কিয়ের দাপট?এই এলাকায় মোকলেস মাতবরের আসল পোলা জনির দাপট থাকবো।”
চোখ মুখ কঠিন রূপ ধারণ করেছে জনির।এক ঝাঁক আক্রোশ তার মধ্যে।কণ্ঠে চরম বিদ্বেষ। মোকলেস সাহেব কিছু সময় চেয়ে রইলেন এই অহংকারের অগ্নিমূর্তির দিকে।ঠান্ডা স্বরে প্রশ্ন করলেন,
“বর্ণ আমার নকল পোলা?”
জনি তৎক্ষনাৎ উত্তর দেয়, “বর্ণ বাতিল পোলা!”
“বর্ণ তোর আগে এই দুনিয়াতে আইছে।তোর মায়রে আমি লুকায় বিয়া করছি। কারো সম্মতি ছাড়া।কেউরে জানানি ছাড়া।তোর জন্মের খবর কেউ জানতো না।বর্ণের মায়রে আমি বিয়া করছি এলাকার মানুষরে জানাইয়া, খাওয়াইয়া।বর্ণের জন্মের সময় এলাকার একটা ফকিরও নাই যে মিষ্টি খাওয়া থিকা বাদ পড়ছে।”
জনি বাবার এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো শুনে চুপ হয়ে গেলো।একেবারেই নিস্তব্ধ।শুধু নিঃশ্বাস চলছে।এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে মোকলেস সাহেবের দিকে।
“বুঝছোস কি বুঝাইছি।”
সময় নিয়েছে জনি জবাব দেওয়ার জন্য।লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে।বলে উঠে,
“এই বুঝানের কোনো লাভ লোকসান আমি দেখতাছি না আব্বাজান।আমি দোষী হইলে আপনে পাপী।হিংসা আপনারা শিখাইছেন।জিদ আপনার।অহংকার আপনার।”
“আর তোর মায়ের?”
“আমার মায়ের দোষ!আপনার মত একটা ব্যাটার প্রেমে পইড়া বিয়া করছে।”
“আচ্ছা?তোর মা যে বর্ণরে খাওয়ার কষ্ট দিসে?মারছে?”
“আপন পেটের পোলা আপনাই হয়।এটা দুনিয়ার রীতি।পরের পোলা হয় বোঝা।আমার মায়ের দোষ থাকলেও নাই।”
মোকলেস মাতবরের শুষ্ক ঠোঁট ঘিরে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। মাথা দুলিয়ে বললেন,
“এই ঘর পাপীগো ঘর।পবিত্র আছিলো বর্ণের মা,আমার মা আর বর্ণ।আজকা আমার মা থাকলে তোর মা আর তুই এই বাড়ির ত্রিসীমানায় পাড়া দিতে পারতি না।”
জনি উঠে দাঁড়ায়।অহংকারে টইটুম্বুর হয়ে বললো,
“ভালা হইছে আপনার মা আর বর্ণের মা মইরা ভূত হইয়া গেছে।”
____
আফজাল মিয়ার কোমরে প্রচণ্ড ব্যথা।সাব্বিরকে পাঠিয়েছেন আফজাল মিয়ার স্ত্রী মালিশের জন্য তেল আনতে।সদর দরজায় হুট করে মোকলেস মাতবরকে দেখে কপাল কুঁচকে ফেললেন।
মোকলেস মাতবর একটি অসস্তি নিয়েই এগিয়ে আসেন।হেসে সালাম দিলেন রোকেয়া বেগমকে,
“আসসালামু আলাইকুম আপা”
রোকেয়া বেগম কিছুটা বিস্মিত হয়ে জবাব দেন,
“ওয়ালাইকুম আসসালাম।”
“ভালো আছেন নিহি?”
“আমিতো ভালা আছি।আইজ আপনি হঠাত আমার আঙিনায়?”
সরাসরি এমন প্রশ্নে বিব্রত বোধ করেন মোকলেস মাতবর।দৃষ্টি তুলে বাড়ির দিকে তাকালেন একবার।রোকেয়া বেগম তাকে দেখে আবার প্রশ্ন করেন,
“কি হইছে ভাইজান?কেউরে খুঁজেন?”
মোকলেস মাতবর আমতা আমতা করে প্রশ্ন করেন,
“আপা…বর্ণ কি বাইত আছে?”
রোকেয়া বেগমের কপালের ভাঁজ আরো দৃঢ় হয়।তিনি এবং আফজাল মিয়া সবটাই জানেন বর্ণ আর তার অতীতের ব্যাপারে।এলাকায় কিছুই তেমন লুকায়িত নয়।মৃদু কঠিন স্বরে বললেন,
“না কামে গেছে।…..আর থাকলেও…”
রোকেয়া বেগমকে থামিয়ে মোকলেস সাহেব প্রশ্ন করেন,
“ওর বউ আছেনি?”
অন্বেষা বারান্দায় কাপড় শুকাতে দিচ্ছে।নিচে চোখ যেতেই মোকলেস সাহেবকে চিনতে এক বিন্দু ভুল করেনি।অবাক হলো তাকে দেখে।সে এখানে কি করছে সেই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।কাপড় দড়িতে টানাতে শুরু করলো দ্রুত হাতে।উদ্দেশ্য নিচে যাবে।
অন্যদিকে রোকেয়া বেগম বললেন,
“আছে”
খানিক রূঢ় কণ্ঠে মোকলেস সাহেবের উদ্দেশ্যে রোকেয়া বেগম বললেন,
“দেহা করন যাইবো না।বর্ণ জানলে সমস্যা হইবো।বউয়ের কারো লগে দেহা করা নিষেধ।”
মোকলেস মাতবর ব্যাপারটি যদিও আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন।তারপরও এসেছেন।সে নিজেও জানেন না কিসের টানে?আফজাল মিয়ার সাথে তার পরিচয় অনেকদিনেরই।দেখা সাক্ষাৎ হতো প্রতি জুম্মায়।কিন্তু বর্ণকে আশ্রয় দেওয়ার পর সেটিও কমে এসেছে।নীরব দূরত্ব হয়েছে আরো অনেকের সাথেই।চুপচাপ দাঁড়িয়ে মোকলেস সাহেব।হুট করে মেয়েলি কণ্ঠে কেউ এসে বললো,
“আসসালামু আলাইকুম।আপনি এখানে?”
মোকলেস সাহেব মুখ তুলে তাকান।মাথায় কাপড় টেনে দাঁড়িয়ে আছে অন্বেষা।নিচে নেমে এসেছে সে। রোকেয়া বেগম অন্বেষার উদ্দেশ্যে বললেন,
“এই বউ! ভরা সন্ধ্যায় বাইরে আইছো কেন?তোমার জামাই জানলে চেতবো।”
অন্বেষা ম্লান হেসে জবাব দেয়, “কোনো সমস্যা নেই চাচী।”
বলে মোকলেস সাহেবের দিকে চাইলেন।এতক্ষণ সুযোগ পাচ্ছিলেন না।অবশেষে সালামের জবাব নেন,
“ওয়ালাইকুম আসসালাম।আমি…. একটু কথা কইবার আইছিলাম আরকি।তোমার কি সময় হইবো?”
অন্বেষা চোখ নামিয়ে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে।জবাবে বলে,
“আসুন ঘরে আসুন।”
মোকলেস সাহেব একাধারে হাত নাড়িয়ে বারণ করার ভঙ্গিতে বলেন,
“না না।ঘরে আমু না।আমি এদিকেই ঠিক আছি।”
“আপনি মুরুব্বী।দরজায় দাঁড়িয়ে থাকবেন?খারাপ দেখায় সেটা।”
দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগে অন্বেষার আবদারে অবশেষে আসলেন ঘরে মোকলেস সাহেব।আজ অন্বেষা ছুটি নিয়েছিলো অফিস থেকে।এসাইনমেন্ট সাবমিট করতে হবে ইয়ার ফাইনাল এর আগে আগে।বর্ণ ফিরবে রাতে।
মোকলেস সাহেব ঘরে এসেই আশপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলেন।পুরোনো ঘরটায় একটা শান্তি শান্তি ভাব।বর্ণের দুয়েকটা শার্ট ঝুলে আছে একদিকে।অন্যদিকে রান্নার সামগ্রী।চা করাই ছিলো। অন্বেষা দ্রুত এক কাপ এগিয়ে দিলো মোকলেস সাহেবের দিকে।তিনি বললেন,
“এত তামঝাম করার দরকার নাই।আমি কয়টা কথা কইয়া যামু গা”
অন্বেষা খাটের এক কোণে দাঁড়িয়ে স্মিত হেসে বললো,
“আমাদের ঘরে আপনি প্রথমবার এসেছেন।খালি মুখে কিভাবে ফিরিয়ে দেই?”
অন্বেষার হাসি নিষ্প্রাণ।বুঝতে অসুবিধে হলো না মোকলেস সাহেবের।প্রশ্ন করে বসলেন,
“তুমিতো মনে হয় সব জানো।তারপরও এতো সুন্দর ব্যবহার?”
“আমি একতরফা শুনেছি।তাই বিচার করছি না আপনাকে।”
মোকলেস সাহেব হাসলেন।চায়ের কাপ তুলে নিলেন।এক চুমুক দিয়ে বললেন,
“এক তরফা যাই হুনছো সত্যিই হুনছো।কোনো ভুল নাই।”
“হয়তো আপনাদের মধ্যকার অনেককিছুই আমার অজানা।”
মাথার টুপি খুলে হাতে নিলেন মোকলেস মাতবর।আরেক চুমুক দিলেন চায়ে।দুর্বল হচ্ছেন ধীরেধীরে। বয়সের সাথে সাথে মলিন হয়ে আসছে সবটাই।
“মাগো! ব্যাটালোকের শরীরে যতদিন শক্তি থাকে ততদিন তারা নিজেগো রাজা ভাবে।যা ইচ্ছা তাই কইরা যায়। মরার দিন ঘনায় আইলে নতুন, পুরান পাপের কথা মনে কইরা দুর্বল হইতে থাকে।আমিও হইছি। হইতাছি।এর লেইগাই আজকা এহানে আইলাম।”
অন্বেষা এর বিপরীতে কি জবাব দিবে বুঝে উঠতে পারলো না।মুখ অবয়ব প্রতিক্রিয়াহীন।নীরবতা কি বেয়াদবি হবে?কিন্তু কোনো উত্তরও যে খুঁজে পাচ্ছে না। মোকলেস সাহেব বলে উঠলেন,
“আমি জনিরে বিদেশ পাঠানের ব্যবস্থা প্রায় কইরা ফালাইছি।এতে কইরা ওয়ও মানুষ হইবো।তোমরাও শান্তিতে থাকবা।”
অন্বেষা সময় নিয়ে ধীরে জবাব দিলো,
“জ্বি তার ভবিষ্যতের জন্য ভালো হবে।”
আবার নীরবতায় ডুবে গেলেন মোকলেস সাহেব। ক্ষণে ক্ষণে কি যেনো ভাবেন।আবার কথা বলেন।আনমনে ঠান্ডা হচ্ছে চা।আধ পাকা চোখের পাঁপড়ি পিটপিট করছে।শুষ্ক ঠোঁট ভিজিয়ে বলে উঠেন,
“বাঁচা মরার কোনো ঠিক নাই।তাই তোমারে কয়টা সত্য কইবার আইছি।আমি জানি বর্ণরে আমি এগুলি কোনোদিন কইতে পারুম না।কেমনে কমু? আমারতো মুখ নাই।”
অন্বেষা স্বাভাবিক স্বরে বলে উঠলো,
“বাঁচা মরা খোদা তায়ালার হাতে।কিন্তু আপনি চাইলে মনের কথা বলে নিজেকে হালকা করতে পারেন।আমি শুনবো।আপনাকে বিচার করবো না।”
এক প্রকার স্বস্তি অনুভব করলেন মোকলেস মাতবর।বলতে লাগলেন,
“বর্ণের মায়রে অল্প বয়সে বিয়া করছিলাম। তহন বয়স ওর ষোলো।বর্ণের নানায় ভ্যান চালাইতো।মায়ের পছন্দে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়া করি।আমার চেয়ে বেশি আমার আম্মাজানে বর্ণের মা রত্নারে ভালোবাসতো।নিজের মাইয়ার মত।গরীব ঘরের মাইয়ার প্রতি আমার মায়ের অনেক টান আছিলো।কিন্তু আমি?সংসারে শান্তি পাইতাছিলাম না।আমার এক বন্ধু পরিচয় করায় দিছিলো জনির মার লগে।পরিচয়ের এক বছরে গোপনে বিয়া করছিলাম জনির মায়রে। তহন বর্ণের বয়স চাইর হইবো।কেউ জানতো না এই খবর।জনির মায়ের বাড়ির কেউ আছিলো না।একটা ছোট বইন আছিলো।একটা ভাড়া বাড়িতে থাকতো ওরা তিনজন।আমি যাইতাম মাঝেমধ্যে। রত্নার যহন রোগ হইলো ডাক্তার কইছে বেশিদিন বাঁচবো না।এটা জনির মায় জানতে পাইরা আমারে জোর দিতে থাকে।আমার ওই বন্ধুর লগে আবার জনির খালার বিয়া হইছে।আমার মা এক পরিচিত মানুষের কাছে জানতে পারে আমি আরেকটা বিয়া করছি।আমার মাও অস্থির হইয়া যায়। অশান্তি শুরু করে জনির মায়রে ছাড়ার লেইগা।কিন্তু ততদিনে আমার ওই ঘরেও একটা পোলা আছে।…এই সংসারের ঝামেলায় আমার মাও হার্ট এ্যাটাক কইরা মরলো।আমি আমার মায়েরও দোষী। খুনী!”
অন্বেষার চোখ ছলছল করছে। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে মোকলেস মাতবরের অনুশোচনায় ঘেরা মুখের দিকে। হৃদপিন্ড লাফাচ্ছে অবিরত।ঢোক গিলে মোকলেস মাতবর আবার বলতে শুরু করেন,
“সত্যি কইতে আমার রত্না আর বর্ণের লেইগা কোনো টান আছিলো না।আমি আছিলাম অমানুষ।ভালো মতো দুইটা কথা কই নাই মা পোলার লগে।কোনো আবদার পূরণ করি নাই।মা পোলা কোনার ঘরে পইড়া থাকতো সারাদিন। হাসতো, খেলতো।ঐটা আর বেশীদিন টিকে নাই।হুট কইরা রত্নাও মইরা গেলো।আমি ভাবছিলাম বর্ণ কানবো মায়ের লেইগা।ওয় উল্টা হাসছে।পাগলের মত হাসছে মায়ের লাশের সামনে।তহন পাঁচ বছরের পোলা ওয়।রত্না মরার তিনদিনের দিন বাধ্য হইয়া জনির মায়রে ঘরে তুললাম।বর্ণ সবার আগে বুকে জড়ায় গেলো।কিন্তু সৎ মা কি আপন হয়?খাইতে দিতো না।কাপড় দিতো না।ঘরের কাম কাজ করাইতো।হাড্ডি বাইর হইয়া গেছিলো শরীরের।আমিও একটা পশু আছিলাম।নতুন বউয়ের আঁচলে বান্ধা।আমিও জুলুম করছি।অনেক জুলুম করছি।আর ওই শাস্তি পাইছি আমি।এর লেইগাই তোমার কাছে মাফ চাইতে আইলাম।তুমিতো ওর বউ।”
বলে হাত জোড় করলেন মোকলেস মাতবর। অন্বেষা এক দৌঁড়ে এক গ্লাস পানি এনে এগিয়ে দিলো তার দিকে।তার চোখের এক কোণ বেয়ে পানি পড়ছে। অন্বেষা নিজেকে দমাতে পারেনি।বললো,
“আমি ওর স্ত্রী হয়ে বলছি আপনি আপনার ভুল বুঝতে পেরেছেন।নিজে থেকে ক্ষমা চাইতে এসেছেন এটাই অনেক।আসলে মানুষ মানুষের বাহ্যিক রূপ দেখেই বিচার করে ফেলে।ভালো মানুষ ভালো।খারাপ মানুষ কেনো খারাপ?কি কারণে?সেটা কেউ জানতে চায় না। বর্ণের ক্ষেত্রেও তাই।আর হ্যাঁ আপনি বর্ণের জন্য একদম চিন্তা করবেন না।আগের চেয়ে ও এখন অনেক ভালো আছে।অনেক।”
“আমার উপরে কি অনেক জিদ ওর?”
“ও এখন আর এসব নিয়ে ভাবেনা। ও সংসারে ব্যস্ত।আমি ওকে বুঝিয়ে বলবো।আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।নিজের যত্ন নিন।”
চা ঠান্ডা হয়ে গেছে। অন্বেষা গরম করে দিতে চাইলেও মোকলেস মাতবর বারণ করলেন।বর্ণ আসার সময় হচ্ছে।এখানে বেশিক্ষণ থাকা যাবেনা।তাই দ্রুত চলে গেলেন। অন্বেষা সাব্বিরকে ডেকে বললো,
“ওনাকে দেখে বাড়ি অব্দি পৌঁছে দিয়ে এসো।আর হ্যাঁ উনি যে এখানে এসেছিলেন তোমার ভাইজান যেনো না জানে।”
সাব্বির মাথা দোলায় এবং জবাবে বলে, “ঠিক আছে ভাবি।”
বর্ণ রাত আটটার কিছু আগে ফিরেছে।বাড়ি ফিরেই চোখ পড়লো আধ খাওয়া চায়ের কাপের দিকে। লক্ষ্য করেও কিছু বললো না। অন্বেষা কাগজ ছড়িয়ে এসাইনমেন্ট লিখছে।বর্ণকে দেখে উঠে চা দিলো চুলোয়। পলিথিনে মোড়ানো কাগজের প্যাকেট খুলে গরম গরম পুরি দেখতে পায়।প্লেটে নিয়ে বিছানার উপরে রাখতেই বর্ণ বেরিয়ে আসে হাত মুখ ধুয়ে।বিছানায় পা গুটিয়ে বসে প্রশ্ন করলো,
“কেউ আইছিলো নাকি?”
আচমকা আতংকিত হয়ে পড়লো অন্বেষা।ভয় তার। সাব্বির কি বলে দিলো তাহলে?তারপরও মাথা নাড়িয়ে বলে,
“নাতো”
“তো চায়ের কাপ?”
“কেনো আমি খেতে পারি না?”
বর্ণ পুরি মুখে দিয়ে বললো,
“তুমিতো তোমার সোয়ামীরে ছাড়া খাও না।”
“ওহ…. না আমিই খেয়েছি। এসাইনমেন্ট করতে করতে মাথা ধরেছিলো।”
বর্ণ তেমন ভ্রুক্ষেপ না করে জবাব দেয়,
“যহন যা খাইতে মন চাইবো খাইয়া লইবা।আমার লেইগা অপেক্ষা করার দরকার নাই।এই লও পুরি খাও।”
কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে অন্বেষা। বললো,
“তুমি খাও।আমি কাগজগুলো গুছিয়ে নেই।”
কাজ শেষে এসে বসলো বর্ণের পাশে।বর্ণ অন্বেষার ফোন পাশে রেখে অন্বেষার কোলে মাথা রেখে অকপটে।হাত টেনে নিজের মাথার উপরে রেখে বললো,
“কালনাগিনী আমার চুল টাইনা দাও।আজকা অনেক খাটাখাটনি গেছে।”
“তেল দিয়ে দেই?”
“না না।অস্থির লাগে।তুমি চুল টানো।”
অন্বেষা কথা না বাড়িয়ে চুল টেনে দিতে শুরু করে।আচমকা উঠে গেলো বর্ণ।এক মিনিট ঠাঁয় রইলো না নিজের জায়গায়।প্যান্টের পকেট থেকে একটি কাগজ বের করে বললো,
“এটা তোমার লেইগা আনছি। দেহো।আমারে একজন কইলো কম্পিউটার কোর্সের কথা।শিখা ফালাও।তোমার ভবিষ্যতের লেইগা ভালো।বেশি টাকা লাগবো না।আমি দিমু নে।তুমি আমার লেইগা রক্ত পানি করতাছো।আমি এট্টুক করতেই পারি।”
আজকাল বর্ণের ছোটখাটো চিন্তাগুলো বড্ড ভালো লাগে অন্বেষার।যেনো তার ভাবনার সমস্তটা ঘিরে শুধু অন্বেষার বসবাস। অন্বেষা বললো,
“আপনি শিখবেন না?শুধু আমি ভালো চাকরি করলেই হবে।”
“আরেহ ব্যাটা!এক ঢিলে দুই পাখি মারুম।তুমি শিখবা।আমারে শিখাইবা।”
“আচ্ছা আপনি সার্টিফিকেটটা কোথায় পাবেন শুনি?”
বর্ণ চোখ টিপে বললো, “জাল বানামু।”
বর্ণের কাঁধে চাপড় দিয়ে অন্বেষা বলে উঠে,
“শুধু বাটপারি করার চিন্তা!”
বর্ণ আবারো মাথা এলিয়ে দেয় অন্বেষার কোলে।চোখ বুঝলো অবলীলায়।ভারী নিঃশ্বাসে উঠা নামা করছে বক্ষ। যতনের দুহাত অগোছালো চুলের গভীরে।
“আমি ভালো কথা কওয়ার মানুষ না।কিন্ত আজকা মন চাইলো কয়টা কথা তোমারে কই। আজকা তুমি অনেক বড় একটা ভুল করছো।যেটা আমি জানি।কিন্তু তোমারে বকমু না।কি ভুল করছো? কারে চা খাওয়াইছো বুইঝা লও।দ্বিতীয়বার ভুলটা জানি না হয় সাবধান করলাম।”
অন্বেষা ঢোক গিলে।ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়।বর্ণ আবার বললো,
“আমি দুনিয়ার সব মানুষের মতো বড়লোক হইবার চিন্তা করিনা।করতে চাই না।আমি ফকির থাইকা আধিপত্য বিস্তার করতে চাই।এটা আমার জিন্দেগীর আজব শখ।আমার লগে যেহেতু চিপকায় গেছো তাইলে তোমারে কই।আমরা আজকা থিকা পাঁচ বছর পরও এই ঘরেই থাকুম।এমনেই জীবন কাটামু।প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কোনো শখ আহ্লাদ আমগো থাকা চলবো না।বাইরের জগতের লগে আমগো কোনো মিল থাকবো না।আমারে বদলাইতে চাইবা না।আমি তোমার উপরে কোনো জুলুম করমু না।এতটা মাস যেমনে জীবন কাটছে ওমনেই কাটবো।মরার আগ পর্যন্ত।আমি নিজেরে রাজা ভাবি।তুমিও নিজেরে ভাবা শুরু করো রানী।”
চলবো…..