উন্মুক্ত লাইব্রেরী পর্ব-০৫

0
69

#উন্মুক্ত_লাইব্রেরী
লেখা – আয্যাহ সূচনা

৫.

সাব্বির ছেলেটা বর্ণের চরম ভক্ত।বিনা কারণে বড় ভাইয়ের মতো ভালোবাসে।তার পিছু পিছু ঘুরে হাফ ফুট ছেলেটা।বয়সের তুলনায় উচ্চতা কম।অনেকটাই কম বর্ণ হতে।অথচ ভালোবাসার জেরে বর্ণকে জোর করে নিয়ে যাচ্ছে ফার্মেসিতে।অতিরিক্ত রক্ত ঝরছে তার কপাল হতে।এসব দেখে হয়রান সাব্বির। ‘ ভাই! ভাই’ বলে কাকুতি মিনতি করে অবশেষে রাজি করায় ব্যান্ডেজ করার জন্য।বর্ণ তার মুখের দিকে চেয়ে বারবার না করে শেষ পর্যন্ত রাজি হয়।বয়স আর উচ্চতার ব্যবধানকে বুড়ো আঙুল দেখানোর চেষ্টা।না বলা সত্ত্বেও বর্ণকে ধরে নিয়ে গেলো ফার্মেসিতে।বর্ণ বলে চলেছে বারবার ‘আরেহ ব্যাটা ঠিক আছি আমি’।কে শুনে কার কথা?

বাড়ি থেকে ফার্মেসির দূরত্ব অনেকটা দূরে।সকাল থেকে কান্না আর নির্ঘুম এক রাত কাটিয়ে পরিশ্রান্ত অন্বেষা।মাথা ব্যথার ট্যাবলেট প্রয়োজন। শুক্রবার হওয়াতে অফিস বন্ধ তবে রাতে এত এত রান্না করতে হবে সেটা কি আর বন্ধ করা যায়?

“আজকাল আপনার আর আমার কাকতালীয় দেখাগুলো আসলেই ভীষণ কাকতালীয়।”

কপালের ক্ষতে লেগে থাকা রক্ত তুলো দিয়ে পরিষ্কার করা হচ্ছিলো।এরপর ব্যান্ডেজ করা হবে। সং সেজে বসে থাকা বর্ণের কর্নে মেয়েলি কন্ঠস্বর পৌঁছায়।নড়চড় হলো দেহে।মাথা ঘুরিয়ে চাইলো।স্বয়ং অন্বেষা দাঁড়িয়ে।

অন্বেষা সামনে এসে দাঁড়িয়ে বুকে হাত বেঁধে প্রশ্ন করলো,

“এতো ব্যাথা পেলেন কি করে? নিশ্চয়ই মারামারি করেছেন?”

লোকটা ব্যান্ডেজের নামে ব্যথা দিচ্ছে।বিরক্তির ‘চ’ উচ্চারণ করে চোখ দিয়ে শাসালো তাকে। যিনি ব্যান্ডেজ করছেন তিনি এবারে হাতের গতি কমিয়ে নেন।বর্ণ ঘাড়ে হাত ঘষে বললো,

“যত না মাইর খাইছি এর চেয়ে বেশি দিয়া আইছি।”

দোকানে উপস্থিত আরো এক লোকের কাছে নাপা ট্যাবলেট এর একটি প্যাকেট চেয়ে অন্বেষা ব্যাগ থেকে টাকা বের করতে করতে বললো,

“কি লাভ এসব করে?”

“কলিজার মধ্যে ঠান্ডা ঠান্ডা লাগে”

অন্বেষা ব্যাঙ্গ করে বলে উঠে, “আর কপালে ব্যথা।”

বর্ণ গুরুত্ব দিলো না।কথার পিঠে উল্টো প্রশ্ন করলো,

“আপনি হেনে কি করেন?”

“মাথা ব্যথার ঔষধ নিতে এলাম।আর আপনার দর্শন এখানে।আরো একবার,হাহ!”

“আপনি আমার কপালে শনির দশার মতো লাইগাই আছেন। ছুটার নাম গন্ধ নাই।”

অন্বেষা মুখ বেঁকিয়ে বললো, “ঠিক আপনিও!”

বেপাত্তা শব। মাখে না এতে কিছুই।কথা আসে কানে বাজে এরপর হুট করে অন্য কানের সাহায্যে বেরিয়ে যায়।ব্যথা অনুভব হলেও মুখমণ্ডলের শমিত প্রতিক্রিয়ায় দমে যায়।

সাব্বিরকে কিছুটা চিন্তিত দেখালো।সর্বপ্রথম এই চিন্তার রেখায় নেত্রপাত করেছে অন্বেষা।কি মনে করে যেনো দাঁড়িয়ে আছে নিজের কাজ শেষেও।ব্যান্ডেজ করা দেখছে না কোনো শিল্পকর্ম।নজর ঘুরে সাব্বির এর সাথে চোখাচোখি হলে ভ্রু উঁচিয়ে জানতে চায়, ‘কি?’।সাব্বির কয়েকবার পকেটে হাত রাখলো।কপালের ভাজ আরো গাঢ় হয়। অন্বেষা ইশারা করে বললো তার সাথে আসতে।কিছুটা দূরত্বে বর্ণের দৃষ্টির আড়ালে এসে জিজ্ঞেস করলো,

“ফ্যানের নিচে দাঁড়িয়ে ঘামছো কেনো?”

পরনে বিধ্বস্ত শার্ট আর ট্রি কোয়াটার প্যান্ট। মুখও জীর্ণশীর্ণ।হাত দিয়ে ঘষে ঘষে কপালের ঘাম মুছে বললো,

“আপা ভাইজানরে লৌড় পাইড়া ফার্মেসিতে আনছি। এহন পকেটে হাত দিয়া দেহি দশ ট্যাকার পুরান নোট। ব্যান্ডেজ আর ওষুধের ট্যাকা নাই।”

অন্বেষা শুনলো এবং বুঝলো।প্রশ্ন করলো, “তোমার ভাইয়ের কাছে নেই?”

“না ভাইজানে মানিব্যাগ আনে নাই।”

বয়সে অন্বেষার ছোট হবে সাব্বির। কাঁধে হাত রেখে হাসি মুখে বললো,

“আমি সাহায্য করবো?”

সাব্বির ভ্রু উচু করে প্রশ্ন করে,

“আপনি ট্যাকা দিবেন?….না আপা ভাই চেতবো।”

“ভাইকে জানানো লাগবে না।এটা তোমার আর আমার মধ্যকার কথা।টাকা দিচ্ছি তার চোখের আড়ালে ফুরুৎ করে বিল দিয়ে এসো যাও।”

“নাহ আপা”

“এই চুপ থাকোতো!বড়দের মুখে মুখে কথা বলবে না।”

বলে টাকা বের করে দিলো অন্বেষা।মাসের শেষ।হাতে বাকি ছিলো দুইশত টাকা।এরমধ্যে একশত টাকা সাব্বিরকে দিয়ে ভাবতে লাগলো আর তিনদিন কি করে চলবে বাকি একশো টাকায়?

সাব্বির টাকা পরিশোধ করে বেঁচে যাওয়া দশ টাকা এনে সাধলো অন্বেষাকে।এই দেখে অন্বেষা হেসে উঠে।বাহিরে হাত বাড়িয়ে দেখালো আর হলো,

“ওই দেখো ঝালমুড়ি বিক্রি করছে। দশ টাকার ঝালমুড়ি কিনে দুই ভাই মিলে খেতে খেতে বাড়ি যাও।আমি আসি”

________

“ধড় কাটা মুরগীর মত ছটফট করতাছে, দম ফুরাইবার নাকি আর কয়েকক্ষণ?তারপরও শরীরে বিন্দাস তেজ!”

কথাটি বলে হাসি মুখে কনস্টেবল এর দিকে হাত এগিয়ে দেয়। হ্যান্ডকাফ সাদরে গ্রহণ করলো মোকলেস সাহেবের দিকে ব্যাঙ্গাত্মক হাসি দিয়ে।কথার অর্থ তাকে ধরতে আসা পুলিশের কাছে বোধগম্য না হলেও মোকলেস সাহেব ঠিকই বুঝেছেন।ছেলে হাসপাতালে ভর্তি।বেধড়ক মেরেছে তাকে।পাঁজরের নিচের দিকের হাড় মচকে গেছে কিছুটা।সেই প্রতিশোধ নিতেই পুলিশে ধরানো হলো বর্ণকে।দুহাতে হ্যান্ডকাফ পড়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বর্ণ কনস্টেবলকে প্রশ্ন করে,

“আমি যদি পাল্টা মামলা দেই তাইলে কেমন হইবো চাচ্চা?”

কনস্টেবল বুঝলো না।প্রশ্ন করলো, “কি?”

“হের পুতে আমারে আগে মারছে।এই দেহেন কপালে ব্যান্ডেজ।আমি কি মামলা দিতে পারমু?”

“তুমি কি হাসপাতালে ভর্তি?”

“যাহ শালা!আগে কইলে ভর্তি হইয়া যাইতাম!”

রাগী দৃষ্টি ছুঁড়েন কনস্টেবল।বর্ণের তরফ থেকে পেলো এক গাল হাসি।পুলিশের গাড়িতে তুলে নেওয়া হয় তাকে।বর্ণ চেঁচায় আর বললো,

“মোকলেস মাতবর!হিসাব বাকি কিন্তু!”

গাড়ি চলছে।বর্ণ মাথা এলিয়ে ভাবতে লাগলো।হুট করে মাথার ব্যান্ডেজ এর কথা মনে পড়ে।ভাবলো এই ব্যান্ডেজ আর ওষুধের টাকা কে দিলো?সাব্বিরের কাছে কোনোদিন পাঁচ টাকার বেশি থাকেনা।তাহলে?কনস্টেবল তখন বলে উঠে,

“এই পোলা পা ঠিক কইরা বও।তোমার বাপের বাড়ি না এটা পুলিশের গাড়ি।”

“আমার বাপের কোনো বাড়ি নাই”

“ভালো কথা!”

“জীবনে প্রথমবার জেলে যাইতাছি।কি কি আছে জেলের ভিতরে কইতে পারবেন?ফ্যান? ফ্যান আছেতো?আর খানাপিনার কি ব্যবস্থা?আমি মোটা তোষক ছাড়া ঘুমাইবার পারিনা কিন্তু!একটু দেইখ্যা লইয়েন।”

কনস্টেবল শাসনোর ভঙ্গিতে বলে উঠলেন,

“মামার বাড়ির আবদার পাইছো নি?”

“আমার তো মামার বাড়িও নাইক্কা।আপনি হইবেন মামা?”

“এক থাপ্পড়ে দাঁত ফালায়া দিবো তোমার।”

“আমার দাঁতের লগে আপনার কি দুশমনি?”

“এই ছেমড়া একদম চুপ!গুলি দেখছোস?একদম উড়ায় দিমু বেশি কথা কইলে?”

“গুলি খাইলে মানুষ মরে?”

“তোর কি মরার ডর ভয় নাইরে?”

“থাকলে আপনার লগে ঠাট্টা করি?….আপনার বেতন কত?”

“জেনে কি করবি?”

“পুলিশে জয়েন দিতাম”

কনস্টেবল হেসে বললেন, “পুলিশের জুতা পরিষ্কার করার চাকরিও পাবি না।”

“আমিতো ঐটা করুমও না।আমি পুলিশ হইলে আপনারে জুতা পরিষ্কার করার কাম দিমু নে”

যেনো রসিকতা করছে।আরেকদফা চটে গেলেন কনস্টেবল।পায়ে আঘাত করলেন হাতের লাঠি দিয়ে।বেশি কথার ফল রূপে দিয়েছেন।বর্ণ চেয়ে রইলো।রহস্যময় হাসলো।অনেক সময় বাদে কনস্টেবল এর মনোযোগ করলে আবার হরণ করে মনোযোগ রাশভারী গলায় বললো,

“আমি এমন আঘাতে বরং শান্তি পাই”

________

তিনদিন বর্ণকে লাইব্রেরীতে না পেয়ে অবাক প্রায় অন্বেষা। নিয়মমাফিক আসতো সে এখানে।কিন্তু বিগত তিনদিন যাবত আসেনি। যতক্ষণ লাইব্রেরীতে থেকেছে অন্বেষা খুঁজেছে তাকে।অদ্ভুত রকমের লোকটা হারিয়ে গেলো কোথায় সেই চিন্তা ভর করলো। সাথেসাথে যোগ হয় আরো একটি চিন্তা সেদিন আঘাতপ্রাপ্ত ছিলো।কোনো সমস্যা হলো নাতো আবার?উতলা হলো অন্বেষা।হুটহাট মাথায় এমন ভূত চাপে।এখন ইচ্ছে হচ্ছে সেই ফার্মেসির দ্বারে গিয়ে দাঁড়াতে।সেখানে পাবে নিশ্চয়তা কি?আবার মনে হলো পেতেও পারে?আরেক মন বলছে সেখানে গেলে অফিসে কে যাবে?তবে তাদের সাক্ষাতগুলো কিন্তু কাকতালীয়।এবার যে হবে না নিশ্চয়তা কি?

তখনি ফোন বাজে।কমদামী স্মার্টফোনের কাঁচের অবস্থা নাজেহাল।তারপরও চালিয়ে নেয়ার মত চলছে। বস ফোন করেছে।ফোন রিসিভ করতেই রাগারাগি শুরু করলো।কাজ তার কখনোই পছন্দ হয়না।নিজের ভুলগুলো চাপিয়ে দেয় কর্মচারীর উপর।কেনা দাস দাসী রেখেছে যে।

অন্বেষা “আসছি” বলে ফোন রেখে দিলো।কয়েকবার চেয়ে দেখেছে।নাহ!আসেনি বখাটেটা।

অন্বেষাকে বেরিয়ে যেতে দেখে ঝুমা বলে উঠলো,

“ওকে যে করেই হোক আমাদের ফ্ল্যাট থেকে বের করতে হবে। বস্তিটা সারাদিন বস্তিগিরি করে।”

রুম্পা ভাবনা চিন্তা করলো কিছুক্ষন।জবাবে বললো,

“কি চাকরি করে জানিস?”

“যতটুকু জানি রিসিপশনিস্টের কাজ।”

“আচ্ছা আচ্ছা!”

“তুই কি ওর চাকরি ছাড়ানোর চিন্তায় আছিস?” ঝুমা প্রশ্ন করলো।

“এমনই কিছু”

“আমরা মনে হয়না এই কাজ করতে পারবো।এর চেয়ে ভালো বাড়িওয়ালার কাছে ছেলে কেলেংকারী হলে এমনেতেই ওকে লাথি দিয়ে বের করবে।”

রুম্পা উৎসাহী গলায় জানতে চাইলো,

“ওই ছেলেটার কথা বলছিস?”

“হুম…সেদিন দেখিসনি দুজনের কি ভাব?বিরিয়ানি খাওয়ানো হচ্ছিলো লাইব্রেরীতে বসে”

চলবে….