উন্মুক্ত লাইব্রেরী পর্ব-০৭

0
67

#উন্মুক্ত_লাইব্রেরী
লেখা – আয্যাহ সূচনা

৭.

“আমার বাবা আত্মহত্যা করেছিলেন।সরকারি চাকরি করতেন তিনি। সচ্ছল পরিবার ছিলো।আমি ওই পরিবারের একমাত্র রাজকন্যা।তারপর একদিন তাকে জালিয়াতির অভিযোগে জেলে নেওয়া হয়।জড়িত ছিলেন তারই বন্ধুগন।আমি জানতাম, আমার মাও জানতো বাবা টাকা হেরফের করার মানুষ না। ভালো থাকার জন্য একটু আধটু টাকার লোভ সবারই থাকে। কিন্তু বিশ লক্ষ টাকা সরানোর মত সাহস ছিলো না।আমি এক বিশাল ইমারত ভাঙতে দেখেছি।একের পর এক অভিযোগ।এভাবেই মাস খানেক কেটেছে আমাদের।মুখ লুকিয়ে।একদিন বাবা একটি কাগজে লিখলেন ‘ আমি নির্দোষ!সত্যিই আমি নির্দোষ’ বলে চলে গেলেন।বাবা নেই এই খবর জানার এক ঘন্টার মাঝে আমার আমার মাও তার ভালোবাসার মানুষের সাথে একই রাস্তায় হাঁটা দিলো।”

নিঃসঙ্গতার নীলিমায় একাকীত্বের নিবিড় ছায়ায় ঘেরা সর্বদিক।মন খোঁজে কোনো অজানা মুগ্ধতার সুর।তবে বিষাদের অশ্রু কণিকা মুক্তোর মতন ঝরে পড়লো অন্বেষার চোখের কোণ বেয়ে।সাথে এক ভারী দীর্ঘশ্বাস।

নিজের চুল টানতে থাকা বর্ণের হাতজোড়া থামে।আড়চোখে চাইলো অন্বেষার দিকে। হৃদয়হীন এর মত বলে উঠলো,

“আমারে এসব কইয়া কি লাভ?আমার মনে কারো লেইগা একরত্তি মায়া হয়না”

“লাভ নেই তাই তো বললাম।”

স্মৃতিরা আসছে ভাসমান পবনে ভেসে।আজ এই বুড়িগঙ্গা অতীতের অনেক স্মৃতির দ্বার খুলে দাঁড়াচ্ছে।আধাঁর হৃদয়ের গভীরে জ্বলছে পুরোনো দিনের একটি প্রদীপ।ভাঙা হৃদয়ের রন্ধ্রে রন্ধ্রে চঞ্চলতা এলো। অন্বেষার মনের গভীরে ঝেঁকে দেখতে পারলো না বর্ণ। দৃষ্টিপাত হলো তার অশ্রু।বললো,

“তাইলে মুখের শব্দ অপচয় করলা কেন মাইয়া?”

শূন্যে চেয়ে অন্বেষা জবাব দিলো,

“আপনাকে বলে লাভ নেই।তাই বললাম।আপনি এই অনুভূতি অনুভব করতে পারবেন না।ভুলে যাবেন নয়তো উড়িয়ে দিবেন।আজ অনেক বছর পর বুড়িগঙ্গার তীরে এসে মনে পড়লো আমি এতিম।”

বর্ণ কোনো জবাব দিলো না।কপাল কুঁচকে চেয়ে রইলো চোখে অশ্রু নিয়ে অবলীলায় হাসতে থাকা মেয়েটার দিকে। অন্বেষা নিজ থেকেই বলে উঠলো,

“অনেকদিন পর আমার জমানো কিছু ফাউ কথা কেউ শুনলো।হোক সেটা অনিচ্ছায়,জোর করে।আমার ভালো লাগছে”

এসব শুনতে মোটেও আগ্রহী নয় বর্ণ।প্রসঙ্গ পাল্টে জানতে চাইলো,

“ঢাকা শহরে কি একলা থাকো?”

“হুম….ঐযে চুন্নী মুন্নী?যাদের আপনি বিশাল জ্ঞান দিয়েছিলেন নীলক্ষেত মোড়ে?তাদের সাথেই আমার বসবাস।”

“ঘরের মধ্যে সাপ বিচ্ছু পালার শখ না?”

“হুম…”

“কাম কাজ করো নাকি অকর্মার ঢেঁকি?”

“একটা চাকরি করি আর পড়ালেখা”

“বাহ! কোন ভার্সিটি?”

“যে ভার্সিটির জাল আইডি কার্ড বানিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন আপনি সেই ভার্সিটির আসল আইডিকার্ডধারী আমি”

বলে হাসলো দুজনেই।অনেকটা সময়ের বিরতি নিয়ে বর্ণ ভারী গলায় বলতে শুরু করলো,

“শুনো মাইয়া!মানুষ মানুষের চরম শত্রু।মানুষের লগে সুখ দুঃখ ভাগাভাগি করতে নাই।আমি এসব বয়ান ঝাড়তে পছন্দ করি না।কিন্তু তোমার যেই হাল অন্তরাত্মা চিল্লায় কইতাছে তোমার জ্ঞান এর টনিক দরকার।”

“ক্ষতি হওয়ার ভয়ে লুকিয়ে ছাপিয়ে বেড়াবো?” ভার মুখ এবং শীতল দৃষ্টিতে চেয়ে প্রশ্ন করলো অন্বেষা।

“নাজুক মানুষরে ক্ষতিতে ধরে বেশি”

“আমার ভয় নেই,লুকানোর কিছু নেই।আমার চরিত্র উন্মুক্ত…অতীত,বর্তমান সবটাই…”

বর্ণ ত্যাড়া চোখে চেয়ে বলে, “ফিল্মি লাইন মারতাছো?নাকি কবি হওয়ার চেষ্টা?”

অনেকক্ষণ পর অন্বেষার মুখে হাসি ফুটে।পাশে রাখা ব্যাগ কাঁধে তুলে নিলো।যাবার প্রস্তুতি।সেও কথা ঘুরাতে পটু।বললো,

“আপনি অনুমতি ছাড়াই কেনো আমাকে তুমি বলে ডাকেন?”

বর্ণ একলাফে উঠে দাঁড়ালো।কাপড় ঝেড়ে অমনোযোগী সুরে বলে,

“কারণ আমি আমার মর্জির মালিক….তুই ডাকি নাই শুকরিয়া আদায় করো”

“অভদ্রতা বলে এটাকে”

“আমারে ভদ্রতা শিখাইও না ছেড়ি!তোমার মন চাইলে তুমিও ডাকো।আপনি ডাকে একটা সম্মান আছে।তোমার কি নিজেরে সম্মানীয় ব্যক্তি মনে হয়?”

অন্বেষা মাথা দুলিয়ে হেসে স্বল্প ভাষা ব্যয় করে জবাব দেয়,

“ঠিক আছে ডাকবো”

যাওয়ার উদ্দেশে পা বাড়িয়ে একবার ঘুরে তাকালো অন্বেষা।বাবার সাথে বুড়িগঙ্গায় নৌকা ভ্রমণ করেছিলো সে।লম্বা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুরে চলে যায়।নিঃশব্দে ঝরে পড়ে এক শুষ্ক পাতা বাতাসের মৃদু স্পর্শে।মৃত্তিকার গভীরে লুকিয়ে রাখা যেনো এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা।আশার আলো জ্বলুক পুনরায় এই তমসাচ্ছন্ন জীবনদশায়।নতুন ভোরের প্রতীক্ষায় সে।কেউ ভালোবাসার প্রদীপ নিয়ে এসে আলোকিত করুক।

_______

বাড়ির ভেতরে কদম রাখতেই জানতে পারলো অন্বেষা তাকে ঘর খালি করতে হবে দুইদিনের মধ্যে।বাড়ির মূল ফটক অব্দি পাড় করতে পারেনি অন্বেষা।বাড়িওয়ালা কেচি গেট এর সামনে দাঁড়িয়েই সরাসরি বলে উঠলেন।তার কণ্ঠে রাগের আভাস।কপাল কুঁচকে থাকে প্রায় সময়ই।হুট করে কি হলো?কেনো বাড়ি ছাড়বে সে?কিছুই বুঝতে পারছে না।শুধু কি সে একাই?নাকি বাকি দুইজনও ঘর ছাড়া হবে। নিশ্চিত হতে প্রশ্ন করে,

“আংকেল রুম্পা আর ঝুমা ওরা কি বলেছে এই ব্যাপারে?”

বাড়িওয়ালা ভদ্রলোক বললেন, “ওরা কি বলবে?তোমার হয়ে সাফাই গাইবে?”

অন্বেষা মাথা নাড়িয়ে বললো, “সাফাই কেনো গাইবে আংকেল?ওরা কি রাজি হয়েছে দুইদিনে বাড়ি ছাড়তে?আর কেনো আমাদের বের করে দিতে চাইছেন?”

ভদ্রলোক আবার কপাল কুঁচকে নেন।মুখ ভঙ্গি এমন যেনো আকাশ থেকে পড়লেন কথা শুনে।বললেন,

“আমাদের মানে?আমাদের কি?তুমি একলা বাড়ি ছাড়বা।ওরা দুইজন না”

স্পষ্ট শুনেছে অন্বেষা। বিস্ময়ভরা দু চোখে চেয়ে।মনের প্রশ্নটা মুখে প্রকাশ করলো,

“কেনো আংকেল আমি কি করেছি?”

“কি করছো জানো না?তোমার নামে কমপ্লেইন আছে।তুমি পোলা নিয়া ঘুইরা বেড়াও।রাত কইরা বাড়ি ফিরো।তোমার রুমমেটরা ওই পোলারে বাড়ির আশপাশে ঘোরাফেরা করতে দেখছে।আমি আমার বাড়ির সম্মান নষ্ট হইতে দিতে পারমু না।দুইদিনে অন্য জায়গা দেখো”

“আংকেল আমার কথা শুনুন”

ভদ্রলোক হাত খাড়া করে দিলেন।শুনতে চান না সে কিছু।অন্বেষা তারপরও বলে উঠে,

“আপনি জব্বার চাচাকে জিজ্ঞেস করুন। উনিতো সবসময় ডিউটিতে থাকেন।কোনো ছেলেকে দেখেছেন কি এখানে?নিশ্চিত হয়ে নিন আংকেল।”

বাড়িওয়ালা আরো তেঁতে উঠেন।বাজখাই গলায় বলে উঠলেন,

“আমার বাড়ির দারোয়ানকেও তুমিই হাত করে রেখেছো। অবশ্যই তোমার বিপক্ষে কিছু বলবে না।শুধু ঝুমা আর রুম্পাই নয় আশপাশের অনেক ফ্ল্যাটের লোকজন বলেছেন তোমার এই কান্ড কারখানার কথা।সবাই কি ভুল?”

বাড়ি ছেড়ে কোথায় যাবে?এই চিন্তায় ভীতিগ্রস্ত মুখভঙ্গি বদলে গেলো অন্বেষার।খুব ভালো করেই জানা আছে ঝুমা আর রুম্পার কত খাতির আশপাশের ফ্ল্যাটের মানুষের সাথে।প্রতিদিন এ ঘর ও ঘর গিয়ে গল্প জুড়ে।কিছুটা কঠিন গলায় অন্বেষা জবাব দিলো,

“যদি আমি জব্বার চাচাকে হাত করে রাখি তাহলে ঝুমা আর রুম্পাও আশপাশের ফ্ল্যাটের সবাইকে হাত করে রেখেছে।আমারতো অত সময় যেই আংকেল।আমি জাতের মানুষের সাথে মিশি। অজাত কুজাত মানুষের সাথে রসালাপ করার মতো সময় ইচ্ছা আমার কোনোটাই নেই।”

অন্বেষার তেজষ্মী রূপে বাড়িওয়ালা আরো চটে গেলেন।তার মতে অন্বেষা ভুল।ঝুমা এবং রুম্পা যা বলেছে সেটাই সঠিক।জবাব দিলো বাজখাই সুরে,

“ভুল কইরা আবার দেমাগ দেখাও!দুইদিনে ঘর থেকে বের হইবা।নইলে তোমার জব্বার চাচারও চাকরি যাইবো”

“জ্বি ছেড়ে দিবো।খুব ভালোই পারেন আপনারা অন্যের ঘাড়ে বন্দুক রেখে চালাতে।সত্যতা যাচাই করতে আসেন না।এমন মানুষের ভিড়ে আমার না থাকাই শ্রেয়।”

বলে বাড়িতে ঢুকে যায় অন্বেষা।পেছন থেকে চেঁচিয়ে বলছেন, “হ হ যাও।তোমার মত একজন না থাকলে আমি ভাইসা যামু না।”

________

“কি খবর মোকলেস মাতবর?”

অভদ্রের মত আচরণ।খালি গায়ে হাফ প্যান্ট পরে বসে আছে বর্ণ।দেহের ভঙ্গি রাজকীয়। পা জোড়া বাদশাহী ভঙ্গিতে রাখা।চোখে আগ্রাসন।কপালের আঘাত সচক্ষে দেখা যাচ্ছে।কালো বর্ণ ধারণ করেছে। মোকলেস সাহেব অনুমতি নিলেন না।বর্ণের ঘরে এসে নিজে থেকেই বসলেন।যেনো তারই ভিটা।

খুব শান্ত স্বরে বলে উঠলেন, “জনির লগে তোর দাঙ্গা কি করলে থামবো?”

বর্ণ তৎক্ষনাৎ উত্তর দেয়, “ঐটা আমার চেয়ে আপনে ভালো জানেন”

“আমি জানি আর আমি চাই।তুই তোর পক্ষ রাখ!”

“আপনার পোলারে গলা আর চোখ দুইটাই নামায় রাখবার কইবেন আমার সামনে।”

“কেন তুই কোন জায়গার মাস্তান?”

বর্ণ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো ছোট কৌটায় ধনিয়া রাখা।হাত বাড়িয়ে কিছুটা হাতের মুঠোয় নিয়ে মুখে পুরে দিলো।কৌটা এগিয়ে সাধলো মোকলেস সাহেবকে।কথার জবাব না দেওয়ার ভারী অসন্তুষ্ট চোখে চাইলেন মোকলেস সাহেব।বর্ণ ধনিয়া চিবুতে চিবুতে বললো,

“পুরান ঢাকার”

“মাস্তানি অন্য জায়গায় কর এই এলাকা ছাড়।”

বর্ণ তুচ্ছ হেসে মাথা দোলায়।বলে, “সম্ভব না।”

“তোর অকালে মারা পড়ার অনেক শখ!”

“মরার কোনো কাল হয়না।যহন আইবো তহনই সই।”

“কলিজার পাটা অনেক বড় হইছে না?”

“আপনে জানেন না?”

মোকলেস সাহেব জানতেন কথার জবাব দিতে হিমশিম খাবেন।তারপরও এসেছিলেন।ছেলের জন্য।তিনি এটাও জানেন একবার মেরে যে হাসপাতালে পাঠাতে পেরেছে সে আরো কিছু করতে পারবে।

“আপনার পোলার আগে জন্ম আমার।এই মহল্লার ধুলাবালি পর্যন্ত আমার পরিচিত।হাসি আহে আমার মহলের মত বাড়িতে থাকা এক ব্যাটা আমার পুরান ঘরে আয়া মিনমিন করতাছে।এই দিন আইলো আপনার? এতো অধঃপতন কেমনে মোকলেস মাতবর?”

বর্ণ উঠে গিয়ে স্টিলের গ্লাসে নল হতে এক গ্লাস পানি এনে এগিয়ে দিলো।বললো,

“জিততে পারলেন না,পারবেন না।আপনের দুর্বলতা আমার পায়ের তলানিতে। জোরে চাপ দিলেই শেষ।সান্ত্বনা পুরস্কার হিসেবে কলের কাঁচা পানি খাইয়া গলা ভিজান”

চলবে……