#ধারাবাহিক গল্প
#উপসংহার
পর্ব-এক
মাহবুবা বিথী
পাশের রুমে আমার ছেলে তার ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত। সে এখন আমেরিকার গ্রীন কার্ড হোল্ডার। ওর বাবা সব কাগজ পত্র পাঠিয়ে দিয়েছে। গ্রীন কার্ড পেয়ে ছেলে আমার বিশ বছরের সংগ্রামকে এক লহমায় ভুলে গিয়েছে। ওর দু’চোখ আমেরিকা যাবার স্বপ্নে বিভোর। আমার খুব জানতে ইচ্ছে হয় কি সেই স্বপ্ন? যার কারনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে স্বপ্ন সারথিরা এসে আটলান্টিকের পাড়ে আবাস গড়ে। গৃহহীনতা,সামাজিক বৈষম্য,গনহারে কারাগারে প্রেরণ,নির্বিচারে গোলাগুলি তারপর ও প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মানুষ আমেরিকা যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর থাকে। ক’দিন ধরেই দেখছি তার বিশাল ব্যস্ততা। কতো কেনাকাটা করছে। প্রেসিডেন্ট ব্রান্ডের একটা বড় সুটকেস কিনে এনেছে। তাতে সোয়েটার জ্যাকেট মাফলার প্যান্ট শার্ট গুছিয়ে রাখছে। অথচ নিজের ক্লসেটটা কোনোদিন গুছিয়ে রাখেনি। আমি সবসময় গুছিয়ে রেখেছি। অফিস থেকে কখন আসি কখন চলে যাই ওর এখন দেখার সময় নেই। অথচ মাসখানিক আগেও আমার সাথে খেতে বসার জন্য ও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতো। ওতো আমার রান্না ছাড়া খেতে পারে না। তাহলে কিভাবে ও আমেরিকায় থাকবে? যতটুকু মনে পড়ে জন্মের পর থেকে ওর বাবার সাথে ওর দুতিনবার দেখা হয়েছে।আজ আমেরিকার গ্রীন কার্ড পেয়ে মায়ের হাতের রান্নার স্বাদ ও ভুলে গেল। এখন ওর জীবনে বাবাকেই যেন বেশী দরকার হয়ে পড়েছে। মাতো পারবে না আমেরিকার যাবার স্বপ্ন পূরণ করে দিতে। অথচ শাবাব নিজেই লেখাপড়া শেষ করে পিএইচডি প্রোগ্রামে আমেরিকা চলে যেতে পারতো। ছেলেটা আমার ভীষণ মেধাবী।
রাহাতকে ব্যবসার কাজে প্রচন্ড ব্যস্ত থাকতে হয়।তাই শাবাবের সন্ধার চা,রাতের ডিনার আমার সাথে না করলে রাতে নাকি ওর চোখে ঘুম আসে না। শাবাব আমেরিকার একটা নামকরা ইউনিভার্সিটিতে আন্ডার গ্রাজুয়েটে ভর্তি হয়েছে। ওর বাবা আমেরিকার সিটিজেন হওয়াতে খুব সহজেই ভর্তির আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে পেরেছে। অথচ ও ঢাকা ভার্সিটিতে এপ্লাই ফিজিক্সে চান্স পেয়েছিলো। ওকি পারতো না এখান থেকে ক্যারিয়ার গড়ে নিতে? এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে কতজন প্রথিতযশা হয়েছে। কিন্তু একথা ওকে এখন কে বোঝাবে? আমেরিকার ভুত ওর ঘাড়ের উপর বসে আছে। দিন পনেরো আগে আমি একবার বলার চেষ্টা করেছিলাম। “গ্রাজুয়েশনটা এখান থেকে করলে হতো না।”
ও আমায় বললো,
—-তুমি কি চাওনা আম্মু আমার ক্যারিয়ারটা হাই প্রোফাইলের হোক?
ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি আর কিছু বলতে পারিনি। অনিচ্ছাসত্ত্বেও মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম। কিন্তু বুকের ভিতরটা সহস্রখন্ডে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। অথচ জন্মের পর থেকে এই আমি ওকে একা হাতে বড় করেছি। এমনকি ও যখন আমার গর্ভে এসেছে ওর বাবা জানতো না। জানলে ডিভোর্সটা হয়তো হতো না কিংবা হতো এনিয়ে আমি আর কোনো বিতর্কে যাবো না। আমি বিশ্বাস করি আল্লাহপাক যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন। আচ্ছা একেই কি রক্তের টান বলে!যেখানে গর্ভের টান ফিকে হয়ে যায়। আমি ভাবছি রাহাতের কাছে আমি মুখ দেখাবো কি করে? যে ওকে পিতৃস্নেহে আঠারো বছর ধরে লালন করলো। হ্যা রাহাত আমার স্বামী। মুশফিকের সাথে ডিভোর্স হওয়ার পর রাহাতের সাথে আমার বিয়ে হয়। না,এরপর আমাদের আর সন্তান হয়নি। সত্যি বলতে কি আমিও আর সম্তান চাইনি। কেন যেন মনে হতো রাহাত আর আমার সন্তান হলে শাবাবের আদর যত্ন হবে না। রাহাত হয়তো ওকে অবহেলা করতে পারে। সে কারনে আমি আর নিতে চাইনি। রাহাত যদিও চেয়েছিলো কিন্তু আমার আপত্তির কারনে ওর ইচ্ছাটা অপূর্ণই থেকে যায়। তবে আজ মনে হচ্ছে আমি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। জীবনে কিছু কিছু ভুল একবার হয়ে গেলে তাকে আর পুনরায় শোধরানো যায় না। যেমন আমার সাথে মুশফিকের বিয়েটা একটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিলো। প্রতিটি মানুষকে তার নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছাকে গুরুত্ব দিতে হয়। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমাকে মুশফিককে বিয়ে করতে হয়েছিলো। সম্পর্কে মুশফিক আমার ফুফাতো ভাই। আমার বাবার দূর সম্পর্কের চাচাতো বোনের ছেলে। ঢাকায় মুসফিকদের নিজেদের বাড়ী। আমাদের থেকে ওদের আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো।দেখতে আমি বেশ সুন্দরী ছিলাম। মুশফিকের আম্মার মিষ্টি কথায় ভুলে আমার বাবা আমাকে বিয়ে দিলো।বিয়ের আগে আমার শাশুড়ী নামক ফুফু বাবাকে বলেছিলো,বিয়ের পার ঢাকায় নিয়ে আমাকে পড়াশোনা করাবে। তার বাড়িতে আমাকে কোনো কাজ করতে হবে না। দুটো তিনটে কাজের লোক আছে। কিন্তু বাস্তবতা ছিলো ভিন্ন। সে গল্পে আমি পরে আসছি।
আসলে আপন মানুষেরা সবার আগে বুকে ছুঁড়ি মারে। মুশফিকও এর ব্যাতিক্রম নয়। দ্বিতীয় ভুলটা করলাম রাহাতের সাথে বিয়ের পর। আমার একটা বেবি নেওয়ার দরকার ছিলো। আসলে আমি স্বপ্নেও কোনোদিন ভাবিনি শাবাব আমাকে ফেলে চিরজীবনের মতো চলে যাবে। যদিও সে আমাকে বলেছে ও পুরোপুরি আমেরিকার সিটিজেনের কাগজ পেয়ে গেলে আমার নাগরিকত্বের জন্য এপ্লাই করবে। তবে আমি ওকে মুখে কিছু বলি নাই। কিন্তু মনের দিক থেকে পুরোপুরি ডিটারমাইন্ড। আমি কোনোদিন আমেরিকার মাটিতে পা রাখবো না। কারণ আমেরিকা যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে মুশফিক আমার স্বপ্নকে ধুলিস্যাৎ করে দিয়েছিলো। আমাকে এক অনিশ্চিত জীবনের দিকে ঠেলে দিয়েছিলো। সেই আমেরিকার ভুমিতে বসত গড়ার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। শাবাবের ফোনটা বেজে উঠলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত বারোটা বাজে। মুশফিক এসময়টাতেই ইদানিং ফোন দেয়। এখন ছেলের জন্য তার কতো মায়া। অথচ এতোদিন এই মায়া কোথায় ছিলো? দিনরাত্রীর ব্যাবধানের কারনে হয়তো এই সময়টাতে ফোন দেয়। মানুষ আসলেই বহুরুপী প্রাণি। শাবাবের জন্মের পাঁচ বছর পর মুশফিক প্রথম শাবাবের খবর নিয়েছিলো। অথচ ঐ পাঁচটা বছর আমার জীবনের উপর দিয়ে কি গিয়েছে তা একমাত্র আমি জানি। তবে জীবন কখনও থেমে থাকে না। আপন গতীতে এগিয়ে চলে। শাবাব যদিও জানে রাহাত ওর বাবা নয় তারপরও ওদের রসায়নটা বেশ গভীর। খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। রাহাত বাসায় থাকলে শাবাব ওর সাথে বেশী সময় কাটায়। আর কাটাবে না কেন? রাহাত তো ওকে চোখে হারায়। গালে তুলে খাইয়ে দেওয়া জ্বর হলে রাত জেগে শাবাবের পাশে বসে থেকে কপালে জলপট্টি দেয়। সাতসকালে ছুটতে ছুটতে ওকে স্কুলে পৌঁছে দেয়। এগুলো নিয়ে আমাকে কখনও ভাবতে হয়নি। আমার সকালে অফিস করতে হয় বলে রাহাত আমাকে রাত জাগতে দেয় না। শাবাবের পায়ের আওয়াজ শুনতে পারছি। মনে হয় এঘরে আসছে।
—-আম্মু তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি।
আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে সেই না বলা কথা শুনতে চাইলাম।
—-আব্বু আমার জন্য অ্যামিরাটসের বিজনেস ক্লাসের টিকিট পাঠিয়েছে।
মুখটা বেশ খুশী করে ও আরো বললো,
—-জানো মা,আমার অনেকদিনের ইচ্ছা ছিলো, বিজনেজ ক্লাসে করে প্লেনে ভ্রমন করবো। বাবার কারণে আজ আমার সে ইচ্ছা পূরণ হলো। আম্মু তুমি আমার এয়ারের টিকিটটা দেখবে না? আমার মোবাইলে রাখা আছে।
আমার ছেলে বুঝতে পারছে না আমার বুকের ভিতর কি চলছে। হাতুড়ি পেটা শুরু হয়ে গেছে। জন্মের পর থেকে আজ অবদি শরীরের রক্ত পানি করে ওকে আমি বড় করে তুলেছি। অথচ একটা বিজনেজ ক্লাসের টিকিট আমার সব শ্রমকে ছাড়িয়ে গেল। কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,
—-অবশ্যই দেখবো। তবে এখন তো অনেক রাত তুমি ঘুমোবে না? ক’দিন পরে তোমার জার্ণি করতে হবে। শরীরটা ভালো রাখতে হবে তো।
—-তা অবশ্য ঠিক বলেছো। প্লেনের টিকিটটা হাতে পাওয়াতে আজ নিশ্চিন্ত হলাম। এ ক’দিন টেনশনে রাতে ঘুমাতে পারিনি।
—-এইজন্য তোমাকে ঘুমাতে বললাম।
—-ঠিক আছে। গুড নাইট আম্মু।
আমি ওর গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম আর নিজের ফেলে আসা বিষন্ন অতীতে ফিরে গেলাম।
চলবে