#ধারাবাহিক গল্প
#উপসংহার
পর্ব-তিন
মাহবুবা বিথী
বৃষ্টি কেবল একটু থেমেছে। বুবু সে সময় দরজার সিটকিনিটা খুব সাবধানে খুললো। আমি চোখ পিট পিট করে দেখছিলাম, বুবু কি করে? বুবু একবার পিছন ফিরে তাকালো। আমার চোখ খোলা দেখে বললো,
—-তুই এখনও ঘুমাসনি?
আমি সে কথার উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বললাম,
—–তুমি এতো রাতে কোথায় যাচ্ছো?
—-ইউরিনের চাপ লেগেছে,ওয়াশরুমে যাবো।
—-আম্মু তো রাতে বের হতে নিষেধ করেছে। আম্মুকে ডাকবো?
—-না,আম্মুকে ডাকিস না। কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে গেলে মাথা ব্যথা করবে। আমি উঠোনেই কাজ সেরে আসছি।
বুবুর কথা আমার কাছে সন্দেহজনক লাগলো। আমি জেগে বুবুর অপেক্ষায় বসে থাকলাম। আমাদের উঠোন পেরিয়ে পিছনের দরজায় কাছে ভিতরবাড়ীর পুকুর রয়েছে। আমি পুকুর ঘাটে কথা বলার শব্দ আমার কানে এসে বাজছে। সাথে সাথে পায়ের শব্দ শুনতে পারছি। শুধু বুবুর পায়ের শব্দ নয়। সাথে আরো পায়ের শব্দ শুনতে পারছি। রাত গভীর হতে থাকলো। কিন্তু বুবুর ঘরে ফেরার নামগন্ধ নেই। আমার চোখটা কেবল লেগে এসেছে। ঘুমের মাঝে চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পেলাম। তড়াৎ করে বিছানা থেকে উঠে বসলাম। তাকিয়ে দেখি আম্মু বুবুর দুগালে চড় থাপ্পর মারতেছে। চুলের মুঠি ধরে পিঠের উপর দুম দুম করে কিল মারছে। বুবু আম্মুর পায়ে ধরে বলছে,
—-আম্মা,আমার খুব ব্যথা লাগছে। আমাকে ছেড়ে দিন।
—–নষ্টামী করার আগে মনে ছিলো না। এখন বদমায়েশী করার ফল ভোগ কর।
এরপর আম্মু বিছানা ঝাড়ার শলার ঝাড়ু দিয়ে বুবুকে শপাং শপাং করে মারতে লাগলো। বুবু সইতে না পেরে চিৎকার করে বললো,
—-আমি ফয়সলের সাথে আর কোনো সম্পর্ক রাখবো না। আমাকে এবারের মতো মাফ করে দাও।
আঘাত সইতে না পেরে বুবু নিস্তেজ হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ে। আম্মু ঝাড়ুটা রেখে পাশের রুমে চলে যায়। আমি বিছানা থেকে নেমে বুবুর পাশে গিয়ে বসি। বুবুর ফর্সা শরীরে মনে হলো কে যেন লাল রঙ দিয়ে আঁকি বুকি এঁকেছে। এরপর বুবুর শরীর কাঁপিয়ে জ্বর আসলো। জ্বরের ঘোরে বুবুর গোঙ্গানী শুরু হলো। আমি আম্মুকে ডেকে আনলাম। আমি আর আম্মু মিলে বুবুকে মেঝে থেকে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিলাম। আম্মু বুবুকে একটা নাপা ট্যাবলেট খাইয়ে দেয়। আমি সেদিন আম্মুকে দেখে অবাক হয়েছিলাম। বুবুর শরীরে এতো মারের দাগ দেখেও আম্মুর ভিতরে কোনো মায়ার উদ্রেক হয়নি। বুবুর সম্পূর্ণ সুস্থ হতে এক সপ্তাহ লাগলো। এরপর বুবু ঠিকভাবে পড়াশোনা করতে লাগলো। আমরা সবাই ভাবলাম বুবু হয়তো ফয়সল ভাইয়ের কাজ থেকে সরে এসেছে। ফয়সল ভাই আমাদের এলাকার আওয়ামী লিগের নেতা আকমল চেয়ারম্যানের একমাত্র ছেলে। উনি আমাদের উপজেলার চেয়ারম্যান। সবাই বলে রিলিফের মাল বেচে আর টেন্ডার বাজী করে অনেক টাকা বানিয়েছেন। ফয়সল ভাই অবশ্য তার বাবার এসব কর্মকান্ড সমর্থন করেন না। তারপরও আমার বাবা মায়ের ফয়সল ভাইয়ের সাথে বুবুর সম্পর্কের ব্যাপারে প্রবল আপত্তি। আম্মুর কথা হচ্ছে গাছ যেমন ফল তো তেমনই হবে। অপরদিকে আমার বাবাকে গ্রামের মানুষ খুব সম্মান করতো। সজ্জন মানুষ হিসাবে সবাই তাকে মান্য করে। আব্বা স্কুলে মাষ্টারী করতেন।
বুবু মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করতে লাগলো। এরমাঝে ফয়সল ভাই ঘটকের মাধ্যমে বুবুর জন্য প্রস্তাব পাঠালো।কিন্তু আব্বা আম্মা রাজী হলেন না। তাদের ঐ এক কথা ঐ নিকৃষ্ট চেয়ারম্যানের ছেলের সাথে কিছুতেই তারা তাদের মেয়ের বিয়ে দিবেন না। এরমাঝে বছর দেড়েক সময় গড়িয়ে যায়। আমি তখন কেবল ক্লাস টেন এ উঠেছি। বুবুর তখন সামনে এইচএসসি পরীক্ষা। রাত জেগে বুবু পড়াশোনা করতে লাগলো। বুবুর পরীক্ষাশুরু হলো। প্রতিটি পরীক্ষা বেশ ভালোই হচ্ছে। শেষ পরীক্ষা দিয়ে এসে বুবু খুব ফুরফুরে মেজাজে আছে।সেদিন ছিলো পূর্ণিমা। জৈষ্ট মাসের গরম পড়েছে। বুবু আর আমি অনেক রাত জেগে গল্প করতে লাগলাম। আমি একসময় ঘুমের কোলে ঢলে পড়লাম। হঠাৎ মাঝ রাতে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। পাশে তাকিয়ে দেখি বুবু বিছানায় নেই। আমার রুমের দরজাটা পুরোটা খোলা। বাইরের চাঁদের আলো আমাার রুমে ভিতর প্রবেশ করেছে। আমি বিছানা থেকে নেমে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। বুবু বলে ডাক দিলাম। কিন্তু রাত্রীর নিস্তদ্ধতায় আমার কথাগুলো প্রতিধ্বনিত হয়ে যেন আমার কাছে ফিরে আসল।। পূর্ণিমার চাঁদের আলো পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে পড়েছে। সেই রোশনাইতে পৃথিবীটাকে ভীষণ মায়াময় লাগছে। চাঁদের ফকফকা আলোয় উঠোনে কোথাও বুবুকে দেখতে পেলাম না। কেমন যেন একটা ভয়ের শিরশিরে অনুভূতী আমার পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। আমি আম্মুকে ডাকতে লাগলাম। একবার ডাকতেই আম্মু পাশের রুম থেকে হন্ত দন্ত হয়ে ছুটে আসলো। এরপর আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
—-এভাবে রাত দুপুরে চিৎকার করছিস কেন? ঘরে কি ডাকাত পড়েছে?
—-আম্মু,বুবু তো ঘরে নেই।
—–ঘরে নেই মানে কি? কখন বের হয়েছে?
—-ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বুবু কখন ঘর থেকে বের হয়েছে আমি জানি না।
—-কি বলিস তুই?
আম্মু আমাকে কিছু না বলে সাথে সাথে পাশের রুমে গিয়ে আব্বাকে ঘুম থেকে ডেকে তুললো। এরপর একটা টর্চ লাইট সাথে নিয়ে ঘর থেকে বের হয় আমাদের বাড়ীর আশে পাশে সব জায়গায় খোঁজ করতে লাগলো। কিন্তু বুবুকে খুঁজে না পেয়ে ব্যর্থ মনোরথে বাড়ী ফিরে আসলো। আম্মু খুব চুপচাপ হয়ে গেল। আর আব্বু আর আমার দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে বললো,
—রুবার বিষয়টা যেন আমাদের তিনজনের কাছেই সীমাবদ্ধ থাকে। বেশী লোক জানাজানি হলে আমাদের অসম্মান হবে।
আব্বু রেগে গিয়ে বললো,
—-কি পাগলের মতো কথা বলছো? আমাদের মেয়ে মিসিং হয়েছে এটা পুলিশকে জানাতে হবে না?
—–না,হবে না। আগে পুরো বিষয়টা আমাকে বুঝতে দাও। আর তোমার মেয়েও দুধে ধোওয়া তুলশী পাতা নয়।
বুবুর এভাবে অন্তর্ধান হওয়াটা আব্বু মানতে পারেননি। কেননা এলাকার মানুষ নানাজনে নানা কথা বলতে লাগলো। কেউ কেউ বললো,এমন সন্তানকে আঁতুর ঘরে মুখে লবন দিয়ে মারা উচিত। আসলে আম্মু লুকাতে চাইলেও এতোবড় ঘটনা লুকাতে পারেনি। কেননা বুবু ফয়সল ভাইয়ের সাথে পালিয়েছে। তাই মুহুর্তে আমাদের পুরো এলাকায় এ খবর রটে যায়। বুবু চলে যাবার পরদিন এই ধাক্কা সামলাতে না পেরে আব্বু স্ট্রোক করে বসলেন। আম্মু সাথে সাথে আব্বুকে নিয়ে হাসপাতালে গেলেন। আমিও আম্মুর সাথে হাসপাতালে গেলাম। সাতদিন পর আব্বুকে কিছুটা সুস্থ করে আমরা বাসায় ফিরে আসলাম। আব্বুর বা হাত আর বা পা টা অবশ হয়ে আছে। ডাক্তার বলেছে ফিজিওথেরাপী করলে আব্বু আস্তে আস্তে সেরে উঠবে। আব্বু ফিরে আসার পরদিন বুবু আর ফয়সলভাই আমাদের বাসায় আসে। কিন্তু আম্মু বুবুকে ঘরে ঢুকতে দেয়নি। বরং ওদের দু’জনকে সাফ জানিয়ে দিলেন,
ওরা যেন কোনোদিন এবাড়িতে ফিরে না আসে। কারণ রুবা নামের উনার মেয়েটা মারা গিয়েছে। বুবু এ কথা শুনে কাঁদতে কাঁদতে ফয়সল ভাইয়ের সাথে চলে যায়। আম্মু সত্যিই বুবুকে মেনে নেয়নি। এরমাঝে আমার এসএসসি পরীক্ষা শেষ হলো। সে সময় আব্বুকে দেখতে আমার শাশুড়ী নামক ফুফু আমাদের বাসায় বেড়াতে আসেন। উনি আমার বাবার দূর সম্পর্কের চাচাতো বোন হন। সে সময় উনি আমাকে দেখে পছন্দ করেন। পরবর্তীতে তার ছেলের জন্য প্রস্তাব পাঠান। আম্মু আব্বু রাজী হয়ে যায়। আসলে বুবু এরকম কাজ করাতে আব্বু আম্মু মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। সে কারনে উনারা আমাকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে চান।
বুবুর জন্য আমার খুব মন খারাপ হতো। কেননা বুবুর শ্বশুর চেয়ারম্যান আকমল বুবুকে পুত্রবধু হিসাবে মেনে নিতে নারাজ। এদিকে ফয়সল ভাইও কোনো চাকরি যোগাড় করতে পারছিলেন না। অবশেষে বুবুকে নিয়ে তার বাপের দরজায় গিয়ে দাঁড়ান। নিজের ছেলেকে মেনে নিলেন বটে কিন্তু বুবুর কপালে জুটলো অশান্তি। মাঝে মাঝে ফয়সল ভাইও বুবুর গায়ে হাত তুলতেন। এসব কথা কানে আসলে আমি আম্মুকে কাঁদতে কাঁদতে বলি,
—-আম্মু বুবু না হয় একটা ভুল করে ফেলেছে। তাই বলে তাকে এভাবে শাস্তি দেওয়া তোমাদের ঠিক হচ্ছে না। শ্বশুর বাড়িতে বুবু খুব কষ্টে আছে।
আম্মু সাথে সাথে রেগে গিয়ে বললেন,
—যেমন কর্ম করেছে তেমন ফল ভোগ করছে।
আমাকেও আম্মু সাবধান করে বলেছিলেন,আমি যেন কখনও বুবুর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা না করি। তাহলে আমাকেও বাড়ী থেকে বের করে দিবেন। দুষ্ট গরুর চেয়ে তার কাছে শুন্য গোয়াল অনেক ভালো।
চলবে