উপসংহার পর্ব-০৭

0
21

#ধারাবাহিক গল্প
#উপসংহার
পর্ব-সাত
মাহবুবা বিথী

না আমি সেদিন কোনো প্রতিবাদ করিনি। শুধু ভাবছিলাম মানুষ তার স্বার্থের জন্য কতটা নীচে নামতে পারে। তবে ঐ সময়ে মুশফিকের বদমায়েশীর থেকে আমি আমার মাকে নিয়ে খুব চিন্তায় ছিলাম। কেননা জামিন তো নিলাম। এখন তে কোর্ট কাছারী করতে হবে। আর সেতো ম্যালা টাকার ধাক্কা সামলাবো কি করে? তাছাড়া ফয়সলভাই এখনও আইসিইউ থেকে ফিরেনি। আর সে যদি মারা যায় তাহলে ওর শয়তান বাপ আমার মায়ের নামে হয়তো খুনের মামলা দিয়ে দিবে। তখন কি হবে? এসব ভাবনায় আমার তখন পাগল হবার যোগাড়।
এদিকে শাশুড়ী মা নাতি নাতনীর মুখ দেখবেন বলে বড় বেশী ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আর আমি ভাবছি হিলি গিয়ে দু’দিন বেড়িয়ে আসবো। শাশুড়ী মায়ের কাছে প্রস্তাব উত্থাপন করতেই উনি বললেন,
—-এই না ক’দিন আগে বেড়িয়ে আসলে?
—–মা আমি বেড়াতে যাইনি। আমার মাকে জেল থেকে ছাড়াতে গিয়েছিলাম।
—-ঐ একই হলো,কলা বেচা আর রথ দেখা।
আমার প্রচন্ড রাগ হলো। তাই একটু কঠিনভাবেই বললাম,
—-আব্বা যখন মারা গেলেন তখনও আপনি আমাকে মায়ের কাছে থাকতে দেননি। যে গাড়িতে গিয়েছি দাফন হওয়ার পর সেই গাড়িতেই চলে এসেছি।
—-কি করে থাকবে শুনি? আমিও তো তখন মৃত্যুশয্যায়। শোনো মেয়ে আমার কথায় কষ্ট পেয়ো না। বিয়ের একবছর পার হলো এখনও তো কনসিভ করতে পারলে না। আর পারবেই বা কি করে? তোমাকে তো দেখি কেমন ছাড়া ছাড়া ভাব। যৌবন দিয়ে যদি স্বামীকে আটকে রাখতে না পারো তাহলে তুমি কেমন মেয়ে মানুষ? শোনো মেয়ে, মন দিয়ে আমার কথা শোনো। স্বামীকে বেঁধে রাখা জানতে হয়।
শাশুড়ী মায়ের কথাগুলো শুনে আমার কান দুটো গরম হয়ে গেল। সে কারনে একটু রাগ দেখিয়ে বললাম,
—+মা,স্বামীরা কি গরুছাগল যে ওদেরকে বেঁধে রাখতে হবে?
—ধরে নাও তাই,তা,না হলে কার গোয়ালে ঢুকে পড়বে তার কোনো ঠিক ঠিকানা নাই।
এই বিষয়টা নিয়ে আমার আর কথা বলতে মন চাইছে না। সে কারণে প্রসঙ্গ এড়াতে বললাম,
—-মা,আমি কি হিলিতে যেতে পারবো?
—কি আর করা, যাবেই যখন ঠিক করেছো তাহলে আর এখানে থেকে কি হবে? তবে দুদিনের বেশী থাকতে পারবে না। আমি গাড়ি ভাড়া করে দিচ্ছে।
—না,মা তার দরকার হবে না। বাসের টিকিট কেটে দিলেই হবে।
—-তবে ঐ কথা থাকলো। দু’দিন থেকেই চলে আসবে। তাছাড়া____
—-তাছাড়া কি মা?
—+মুশফিককে বলেছিলাম তোমরা দুজনে একটু ডাক্তার দেখাও।
—+তা আপনার ছেলে কি বলেছে?
—-ডাক্তার দেখাতে রাজী হয়েছে।
একবার মনে হলো শাশুড়ী মাকে তার ছেলের কীর্তির কথা বলে দেই। শাশুড়ী মায়ের ডাকে ভাবনার জগতে ছেদ পড়লো।
—-কোন জগতে থাকো শুনি,কখন থেকে ডাকছি কানে তোমার কথা ঢুকছে না।
একথা বলেই আমার হাতে পঞ্চাশ হাজার টাকার একটা বান্ডিল তুলে দিয়ে বললেন,
—-টাকাটা তোমার মায়ের হাতে তুলে দিও। এই সময়ে টাকার খুব দরকার হয়।
একারনেই মুশফিকের কথাগুলো বলতে জিভে একটু আটকায়। কেননা বিষয়টা বেশী জানাজানি হলে সংসারে চরম অশান্তি বয়ে আসবে। হয়তো আমাকে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হতে পারে। তখন মাকে নিয়ে এই ধাক্কা আমি কিভাবে সামলে নিবো। আমার যা হবার তাতো হয়ে গিয়েছে। বাকিটা ভবিতব্যের উপর ছেড়ে দিলাম।
আসলে আমাকে যখন বউ করে এ বাড়িতে আনা হলো তখন কিছুটা খটকা লেগেছিলো। আমাদের মতো গরীব পরিবারে কেন মুশফিক বিয়ে করলো? আমি প্রথমে ভেবেছিলাম,শাশুড়ী মা হয়তো আমার বাবাকে কন্যা দায় থেকে মুক্তি দিতে চাইছেন। তবে দিন যত গড়াতে লাগলো আমার কাছেও পুরো বিষয়টা পরিস্কার হয়ে গেল। আমি এখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি।কেন আমাদের মতো সাধারণ ঘর থেকে আমার শাশুড়ী মা আমাকে বউ করে এনেছেন। যাকে মারলে কিংবা কুঁটলে সব নিরবে হজম করে যাবে। মুখ তুলে প্রতিবাদ করার সাহস পাবে না কিংবা টাকা পয়সা দিয়ে মুখ বন্ধ করে রাখা যাবে। তবে আমি আর কতদিন হজম করতে পারবো সেটাই এখন দেখার বিষয়। তাছাড়া মুশফিকের মিথ্যা বউয়ের অভিনয় করতে করতে আমি যেন ক্রমশ ক্লান্ত হয়ে পড়ছি। কবে যে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবো আমি জানি না। আমি তো মুশফিকের কাগজে বউ হয়ে একবছর সময় পার করে দিলাম। সেখানে আমার সন্তান কি করে হবে। আদৌ সন্তান হওয়ার কোনো লক্ষণ ও অদূর ভবিষ্যতে দেখা যাবে বলে মনে হয় না। যাই হোক সেঁজুতিকে ফোন দিয়ে দুদিনের জন্য আসতে বললাম। আমি আমার সুটকেস রাতেই গুছিয়ে রাখলাম। কাল সকাল আটটার বাসে হিলির উদ্দেশ্য রওয়ানা দিবো। সেঁজুতি অবশ্য বলেছে,ও সকাল সাতটার মধ্যে পৌঁছে যাবে।
কলিং বেলের শব্দে পরদিন খুব ভোরে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ছ’টা বাজে। এতো সকালে আবার কে আসলো? আমি বিছানা থেকে নেমে হন্ত দন্ত হয়ে দরজা খুলে দেখি সেঁজুতি দাঁড়িয়ে আছে। ওকে একা আসতে দেখে বললাম,
—-+তুমি একা এলে? সাথে তোমার বর আসেনি?
—-ঐ তো আমাকে নামিয়ে দিয়ে অফিসের পথে রওয়ানা দিলো। তুমি রেডী হওনি? আজ তো রবিবার। সকালে অনেক জ্যাম হবে। তাড়াতাড়ি রেডী হয়ে নাও।
কলিং বেলের শব্দে শাশুড়ী মায়ের ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। আমাকে ডেকে বললেন,
—-এতো সকালে কে এলো বৌমা?
—-সেঁজুতি চলে এসেছে।
—ভালোই হলো। আমাদের মা মেয়ের খুব সুন্দর সময় কাটবে। তুমি দ্রুত রেডী হয়ে রওয়ানা দাও।
আমি বাথরুমে গিয়ে দাঁত ব্রাশ করে মুখ হাত ধুয়ে ওজু করে নিলাম। রুমে এসে ফজরের নামাজ আদায় করে নিলাম। এরপর দ্রুত রেডী হয়ে ট্রলি ব্যগটা নিয়ে বের হলাম। শাশুড়ী মায়ের রুমে যেতেই সেঁজুতি আমার হাতে চা আর বিস্কুট ধরিয়ে দিয়ে খেয়ে নিতে বললো। আমি দ্রুত খেয়ে শাশুড়ী আর ননদের কাছে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসতেই ড্রাইভার আমাকে মহাখালি বাসস্ট্যান্ডে নামিয়ে দিয়ে বাসে উঠিয়ে দিলো।
স্ক্যানিয়া এসি বাসে উঠেছি। এখানে সিঙ্গেল সীট রয়েছে। আমি এ ওয়ান সিঙ্গেল সীটে বসে পড়লাম। বাস চলতে শুরু করলো। আমার পাশেই কাপল যুগল বসেছে। ওদেরকে দেখছি নানারকম খুনশুঁটিতে মেতে উঠতে। পাশাপাশি আমার নিজের জীবনের কথা মনে পড়লো। কি ভাগ্য নিয়ে আমি পৃথিবীতে এসেছি। স্বামী পেলাম বটে তবে কপালে জুটলো না স্বামীর আদরভালোবাসা। অভিমান, স্বামীকে কাছে পাওয়ার আকুলতা কিংবা বিরহ বেদনায় কষ্ট পাওয়া কোনো কিছুই আমার জীবনে ঘটলো না।

বাসের জানালা দিয়ে দৃশ্য দেখতে আমার ভালোই লাগে। ফোনটা বেজে উঠলো। ব্যগ থেকে ফোনটা বের করে দেখি আম্মা ফোন দিয়েছে।
—কিরে, বাস এখন কোথায়?
—-যমুনা ব্রীজ পার হয়েছে।
—-ঠিক আছে। আয়াতুল কুরছি পড়ে নিস।
ফোনটা রেখে ভাবলাম,মায়েদের কতো চিম্তা। আম্মাকে আমি মুশফিকের বিষয়ে কিছু বলিনি। কিংবা বলতে ইচ্ছে হয়নি। তবে আমি জানি মুশফিকের সাথে আমার সংসার করা হবে না। হয়তো ডিভোর্সটা হয়েই যাবে। এরপর আমার জীবনটাকে আমি কিভাবে সাজাবো তার একটা ছক মনে মনে কষে নিলাম। সবার আগে লেখাপড়াটা শুরু করতে হবে। নানা ভাবনায় বাস একসময় হিলি বাস স্টেশনে পৌঁছে যায়। বাস থেকে নেমে একটা রিকশা নিয়ে বাড়ির পথে রওয়ানা দিলাম। এখানে আসলে আমার একটা অন্যরকম অনুভূতী হয়। প্রাণ ভরে শুধু নিঃশ্বাস নিতে মন চায়। এই গ্রাম, ইট বিছানো রাস্তা সব কেমন প্রচন্ড আপন মনে হয়। বাড়ির গেটে পৌছানো মাত্রই বুবু এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আম্মা কাছে এসে বললেন,
—-মুশফিক আসেনি?
—-না,উনার পরীক্ষা শুরু হয়েছে।
—-,তাহলে তোমার এখন আসার দরকার কি ছিলো? পরীক্ষা শেষ হলে ওকে নিয়ে একসাথেই আসতে। তাছাড়া তুমি তো আমাকে ফোনে জানাওনি,যে তুমি একা আসছো?
—জানালে তো আসতে নিষেধ করতে।
—-তা করতাম,তবে পরীক্ষা শেষ হলে ওকে সাথে করে আসতে বলতাম।

চলবে