#ধারাবাহিক গল্প
#উপসংহার
পর্ব-আট
মাহবুবা বিথী
আমি আম্মার হাতে ব্যাগ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা বের করে দিলাম। টাকাটা হাতে নিয়ে আম্মা আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
—-এগুলো কিসের টাকা?
আম্মুর দিকে তাকিয়ে বললাম,
—মামলার খরচ আছে না? টাকা তো সামনে লাগবে। শাশুড়ী মা তোমাকে দিতে বলেছেন।
—-তুই কি আমাদের জন্য টাকা চেয়েছিলি?
—-এটা আবার কেমন প্রশ্ন? আর আমি কেন তোমাদের জন্য টাকা চাইতে যাবো? আমার আত্মসম্মানে বাঁধে।
—-তাতো ঠিক। তবে দেখ উনারা কতো ভালোমানুষ। নিজ থেকে আত্মীয়স্বজনের বিপদে এগিয়ে আসে। আর মুশফিকটাও কতো ভালো। আজ অবধি শ্বশুর বাড়িতে কোনো দাবী করলো না। আমাদের এখানে জামাইদের দাবী দাওয়ার শেষ নেই। ঘড়ি, হীরার আংটি,কিংবা হুন্ডা নয়তো জমি আরো কতকি? অথচ মুশফিক শ্বশুর বাড়িতে আজ অবদি বেরাতে আসলো না। আপ্যায়িত করার মতো আমাদের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ নেই। সেই কারনে হয়তো আসে না।
আম্মার কথাগুলো শুনে মনে মনে বললাম,
—-সে তো আমাকে স্ত্রী হিসাবে স্বীকৃত দেয়নি। সে কারনে শ্বশুর বাড়ি নিয়ে তার কোনো আদিখ্যাতা নেই। কিন্তু এই কথাগুলো আম্মাকে বলতে পারছি না। তবে আজ আম্মার মুখে মুশফিকের এতো প্রশংসা বাক্য শুনে ওর নষ্টামীর কাহিনী বলার জন্য আমার জবান যেন মুখ ফুটে বেরিয়ে আসতে চাইছে। কারণ মায়ের কাছে মুশফিক হচ্ছে ফেরেস্তাতুল্য। মাঝে মাঝে মায়ের একাউন্টে কিছু টাকা পাঠানো হয়। টাকাটা পাঠায় আমার শাশুড়ী। এটা আমি জানি। কিন্তু শাশুড়ী মা ছেলের সম্মান বাড়ানোর জন্য মুশফিকের নাম বলে প্রচার করে। নাহ্ এবার শাশুড়ী মায়ের কাছে জানতে চাইবো, মুশফিকের কীর্তিকলাপগুলো উনি জানেন কিনা। আমার ধারণা, উনি অবশ্যই জানেন।
—-কি অত ভাবছিস?
ভাবনার জগতে ছেদ পড়লো। নিজেকে স্বাভাবিক করতে বললাম,
—-আমার প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে।
—–ফ্রেস হয়ে আয়,খাবার বেড়ে দিচ্ছি।
বুবু এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে আমার আর আম্মার কথাগুলো শুনছিলো। আম্মা চলে যাবার পর বুবু এসে খাটের উপর আমার পাশে বসে বলে,
—-তুই অনেক ভাগ্যবান। একজন ভালো মানুষকে স্বামী
হিসাবে পেয়েছিস। একটা ভালো শ্বশুরবাড়ি পেয়েছিস।
আমি বুবুরদিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললাম,
—-ভাগ্য যার সাথে প্রতারণা করে তার কি কখনও ভালো হয়?
—-একথা কেন বলছিস? আর ভাগ্য তোর সাথে প্রতারণা কেন করবে? তোর তে রাজকপাল।
—-রাজকপাল হলে কি এমন সাততাড়াতাড়ি বিয়ে হয়? অকালে আমাদের বাবা চলে গেলেন।
আমার কথাগুলো শুনে বুবুর মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
—-শুধু শুধু ভাগ্যকে কেন দোষারোপ করছিস। এজন্য তো আমি দায়ী।
—-বুবু নিজের ঘাড়ে দায় নিয়ে কেন মন খারাপ করছো?
আম্মার ডাকে বুবু চলে গেল। আসলে আমার বুবুর উপর ও ভীষণ রাগ হয়। তবে ওর জীবনের ভোগান্তি দেখে আর রাগ করতে পারি না।
সন্ধা ঘণিয়ে আসছে। চারিদিকে গোধুলীর আবীর ছড়িয়ে পড়েছে। জানালা দিয়ে আমার চোখটা পুকুর পাড়ে নিবদ্ধ হলো। কেমন একটা আবছায়া ভাব। এখন শ্রাবন মাস। পুকুর পাড়ের কদম গাছটায় কদম ফুল ফুটেছে। তারই একটা মিষ্টি সুবাস আমার নাকে এসে লাগছে। এমনিতেই এই মুহুর্তে জীবনটাকে আমার কাছে বিষাদের মতো লাগছে। তার উপর সন্ধাবেলায় মনটা যেন বড় বেশী বিষন্ন হয়ে যায়। প্রতিটি নরনারী বিয়ের পর মধুর স্বপ্নে বিভোর থাকে। আর আমি ডিভোর্সের স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছি। কেন যেন মন বলছে মুশফিকের সাথে ডিভোর্স হয়ে গেলে আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচবো। কিংবা এরকম একটা দমবন্ধ পরিবেশ থেকে মুক্তি পাবো।
—কিরে জবা,এরকম ভর সন্ধাবেলায় পুকুর পাড়ের দিকে তাকিয়ে কি ভাবছিস?
—-সে রকম কিছু না।
—-আম্মা খাবার রেডী করেছে। তোকে খেতে ডাকছে?
—-মাগরিবের আযান দিয়েছে। নামাজ পড়ে খাবো।
বুবুর দিকে তাকিয়ে বললাম,
—-বুবু লেখাপড়াটা আবার শুরু করলে কেমন হয়?
—-আমিও তাই ভাবছিলাম। কিন্তু আম্মাকে বলতে সাহস পাচ্ছি না।
—-ঠিক আছে তোমার হয়ে আমি আম্মাকে বুঝিয়ে বলবো।
মাগরিবের নামাজ আদায় করে আমি আম্মা আর বুবু রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। আমাদের বাথরুম যেহেতু এটাচ নয় তাই রাত ন,টার মধ্যেই বাথরুমের যাবতীয় কাজ সেরে ঘরে ঢুকলাম। আম্মা আর বুবু রান্না ঘরের সব কিছু গুছিয়ে দরজায় তালা দিয়ে ঘরে চলে আসলো। আম্মা দরজা লাগিয়ে দিয়ে আলমারী থেকে একটা বড় ধারালো চকচকে দা বের করে খাটের পাশে রাখলো। আম্মার হাতে এতো বড় দা দেখে প্রথমে খুব ভয় পেয়ে গেলাম। আম্মা মনে হয় বুঝতে পারছিলো আমি একটু ঘাবড়ে গিয়েছি। তাই আমার দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে বললো,
—-দাওটা সাথেই রাখলাম। কারণ কিছু শিয়াল কুকুর ঘরের আশে পাশে ঘুরঘুর করে। বলা যায় না কখন আবার হামলে পড়ে। সেই দোয়াদরুদ পড়ে নেই। আর অস্ত্র হিসাবে এই দাওটাকে সাথেই রাখি।
পরে বুঝলাম,চেয়ারম্যানের লোকেরা আম্মাকে ভয় দেখানোর জন্য রাতের বেলা বাড়ীর চারপাশে ঘোরাফেরা করে। কখনও বা ঘরের চালে ঢিল মারে।
সে রাতেই দশটার দিকে আমাদের দরজায় কে যেন আস্তে আস্তে নক করতে লাগলো। আমরা যদিও গুরুত্ব দিতে চাইছিলাম না কিন্তু দরজার ওপাশে থাকা মানুষটা ফিসফিস করে বললো,
—-ফয়সল ভাইয়ের জ্ঞান ফিরেছে। আপনাদের সাথে একটু কথা আছে। দরজাটা দয়া করে খুলুন।
আম্মা খাট থেকে নেমে দাওটা হাতে নিয়ে দরজা খুলে বললো,
—-কি বলবে বলো?
—-খালাম্মা,আমি ফয়সলের ঘণিষ্ট বন্ধু সোহেল। ভাবী আমাকে খুব ভালো করে চিনে।
আম্মা একটু রেগে গিয়ে বললো,
—-এখন আজাইরা প্যাঁচাল বাদ দিয়ে কি বলতে আসছো বলো।
—-ফয়সল ভাই আপনার আর ভাবীর সাথে দেখা করতে চেয়েছে। আপনি যদি রাজী থাকেন তাহলে খুব ভোরে এসে আপনাকে আর ভাবীকে সাথে করে নিয়ে যাবো।
—-ভাবী যাবে না। শুধু আমি একাই যাবো।
আম্মার দিকে তাকিয়ে সোহেল ভাইয়ার দ্বিতীয়বার আর বুবুকে নিয়ে যাবার কথা বলার সাহস হয়নি। সে রাতে আমাদের কারোর চোখে আর ঘুম এলো না।সারা রাত একরকম জেগেই কাটিয়ে দিলাম। ফজরের আযানের পর আম্মা নামাজ পড়ে রেডী হয়ে বসে থাকলো। সোহেলভাই হুন্ডা নিয়ে এসেছিলো। আম্মা সোহেল ভাইয়ের হুন্ডায় ফয়সল ভাইয়ের সাথে দেখা করতে গেল। এদিকে আমরা সবাই টেনশনে অস্থির হয়ে আছি। আম্মা না ফিরে আসা অবদি আমরা দুবোনের প্রচন্ড টেনশন হতে লাগলো। বুবু একবার আমার দিকে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—-আমি আমার বাবা মায়ের কুলাঙ্গার সম্তান। আমার কর্মের জন্য তাদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে আম্মা ফিরে আসলো। আমি আম্মার দিকে তাকিয়ে বললাম,
—-সব ঠিক আছে আম্মা।
—-হুম,
—–,ফয়সল ভাইয়া কি জন্য ডেকেছিলো?
—–ও বললো ওকে যারা মেরেছে তাদের একজনকে ও চিনতে পেরেছে। কাল হয়তো ওর জবানবন্দী নেওয়া হবে।
—-এখানে তোমার কি করার আছে?
—-ও আমার সামনে জবানবন্দী দিতে চায়।
—-তাহলে তো ভালোই হলো। তারমানে সন্দেহের তালিকা থেকে তুমি বাদ।
—–দেখা যাক কি হয়?
পরদিন ওসি সাহেব আম্মাকে ডাকলেন। আমি আর বুবুও আম্মার সাথে গেলাম। আশ্চর্যের বিষয় ফয়সল ভাই পুলিশের কাছে ওর বাবার বিরুদ্ধে অভিযোগ করলো। ওর বাবা নাকি আম্মাকে বিপদে ফেলার জন্য ওকে এভাবে মেরেছে। আমি সত্যিই খুব অবাক হলাম। মানুষ কতোটা জঘন্য প্রকৃতির হতে পারে। নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য একমাত্র ছেলেকে ব্যবহার করতে আকমল চেয়ারম্যান দ্বিধা করলেন না। এদিকে ফয়সল ভাইয়ের প্রতি আমার শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। আম্মা ফয়সল ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিলেন। অগত্যা ধরা পড়ে আকমল চেয়ারম্যান আম্মার বিরুদ্ধে করা মামলা তুলে নিলেন। কিন্তু ফয়সলভাইকে ত্যাজ্য করবেন বলে হুমকি দিলেন। যাক ওরা বাপ বেটা যা ইচ্ছে তা করুক সেটা নিয়ে আমার কোনো ভাবনা নেই। আম্মার উপর থেকে কেস উঠে গেল এতেই আমি মহাখুশী।
চলবে