#ধারাবাহিক গল্প
#উপসংহার
পর্ব-দশ
মাহবুবা বিথী
সেদিন রাতে আমার আর ঘুম আসেনি। আমি শুধু সকাল হওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম। মুশফিককে সেসময় আমার কাছে জানোয়ারের মতন লেগেছে। আসলে ওর মনুষ্যত্ববোধ বলতে কিছু নেই। হা আমি মানছি ধর্মীয়মতে আমি ওর স্ত্রী। কিন্তু ওতো ওর ভালোবাসার মানুষের সাথে বেঈমানি করলো। আমার তখন বুবুর শ্বশুরের কথা মনে হলো। ঘরে তার একজন স্ত্রী ঠিকই ছিলো কিন্তু বাইরে তার একজন রক্ষিতা ছিলো। নিজের কলেমা পড়া বউকে সবসময় ঐ রক্ষিতার কাছে ছোটো করে রাখতো। ফয়সল ভাইয়ের আম্মা এটা মেনে সংসার করে গিয়েছে। কিন্তু আমার পক্ষে এটা মানা সম্ভব নয়। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে আমি এখান থেকে চলে যাবো। শাশুড়ী মায়ের কারণে এতোদিন চলে যেতে পারিনি। আজ যখন উনি এই পৃথিবীতে নাই আমারও আর এই সংসারে কারো কাছে দায়বদ্ধতা নেই।
কি বিচিত্র মানুষের জীবন! যাকে আমি এই জীবনে সবচেয়ে বেশী ঘৃণা করেছি তারই অংশকে আমি সবচেয়ে বেশী ভালোবেসেছি। আমার ছেলে আজ ওর বাবার কাছে চলে যেতে চায় এতে তো আমার সবচেয়ে বেশী খুশী হওয়ার কথা। কেননা ওর চেহারা যখনি দেখি তখনি ওর বাবার সেদিনের আচরনের কথা মনে পড়ে যায়। আমি অস্বীকার করবো না শাবাব যখন ছোটো ছিলো তখন আমার মনে হতো ও মনে হয় ওর বাবার মতো হবে। সে কারণে মাঝে মাঝে আমি ওকে দূরে সরিয়ে রাখতাম। আম্মা আর বুবুর কাছে ও তখন থাকতো। অথচ আজ ওর যাওয়ার কথা শুনে আমার শরীরের সব হাড়গোড় যেন ভেঙ্গে যাচ্ছে। অথচ ওকে জন্ম দিতে গিয়ে আমি কি কঠিন সময় পার করেছি।
আমি সেদিন রাতে ওয়াশরুমে গিয়ে নিজের শরীরটাকে সাবানের ফেনা দিয়ে পরিস্কার করতে লাগলাম। মনে হচ্ছে আমার শরীরে এমন এক নোংরা লেগেছে যা হাজারবার ধুইলেও পরিস্কার হবে না। ওয়াশরুমের আয়নায় নিজেকে দেখলাম,আমার গলায় বুকে লাল লাল দাগ হয়ে আছে। আমি সাবান দিয়ে সেই দাগগুলো ঘষতে লাগলাম। সে রাতে আমার মানসিক অবস্থা কেমন ছিলো তা ভাষায় বর্ণনা করার মতো নয়। সেই বিষাদের উপলব্ধি আমার একান্ত নিজস্ব। কারণ সে রাতে আমি ম্যারিটাল রেপের শিকার হয়েছে। মুশফিক তো আমাকে কখনও ভালোবাসেনি। ঘরে ঢুকেই ও আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওকে সেদিন মনে হয়েছিলো এক ক্ষুদার্থ পশু। আমি যন্ত্রণায় যত ছটফট করছি ওর আনন্দের পরিমান ততই বেড়ে যাচ্ছে। বাইরে ঝড়ের তান্ডপে আমার কষ্টের চিৎকারগুলো বিলীন হয়ে গিয়েছিলো। ভালোবাসা ছাড়া শারীরিক সম্পর্কটার মানে আর কি হতে পারে?
খুব ভোরে আমি বাসা থেকে বেরিয়ে বাসস্ট্যান্ডে চলে যাই। তারপর দিনাজপুরগামী বাসের টিকিট কেটে উঠে পড়ি।
দুপুর দুটায় আমি বাসায় পৌঁছে যাই। আমাকে এরকম বিদ্ধস্ত অবস্থায় দেখে আম্মা চমকে উঠে। পরে আমার কাছে সব বৃত্তান্ত শুনে আম্মা মুশফিকের সাথে কথা বলতে চেয়েছিলো। আমি দেইনি। আমার কেন যেন মনে হয়েছিলো আম্মা বুঝিয়ে শুনিয়ে আমাকে আবার ও বাড়িতে পাঠাতে চায়। কিন্তু আমার মন উঠে গিয়েছিলো। সেসময় বুবু আমার পাশে দাঁড়ায়। তবে সে রাতে সেঁজুতি ফোন দিয়ে ওর ভাইয়ের হয়ে আমার কাছে মাফ চায়। আমাকে ফিরে যেতে বলেছিলো। কিন্তু আমার যেতে ইচ্ছা হয়নি। আমি সেসময় আর একটা কাজ করেছিলাম। মুশফিকের ডিভোর্সের অপেক্ষায় থাকিনি। আম্মার নিষেধ সত্বেও আমিই ওকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিয়েছিলাম।
সমস্যা শুরু হলো একমাস পর। আমার পিরিয়ড বন্ধ হয়ে গেল। ইউরিন পরীক্ষা করে দেখি আমি কনসিভ করেছি। আম্মা আমার উপর রেগে গেলেন। আমাকে মুশফিকের কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য তাগিদ দিতে লাগলেন। কারণ তিনমাসের আগে ডিভোর্স কমপ্লিট হবে না। আমি চাইলে এর মধ্যে ফিরে যেতে পারি। কিন্তু আম্মাকে আমি সাফ জানিয়ে দিলাম,মরে গেলেও আমি আর কোনোদিন মুশফিকের কাছে ফিরে যাবো না। বরং আম্মাকে জানিয়ে দিলাম আমি যে সন্তান সম্ভবা এখবর যেন ও বাড়িতে না যায়। তাহলে আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো। আম্মা অবশ্য আমার কথা রেখেছিলেন। শুরু হলো আমার নতুন জীবন। আমি আবার পড়াশোনা শুরু করলাম। বুবুও প্রাইভেটে এইচএসসি পরীক্ষা দিলো। এদিকে আর একটা খবর আসলো। ফয়সল ভাইয়ের আব্বার লাশ ভারতের একটা হোটেলে পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু লাশ পুরোটা ছিলো না। লাশের মাঝখানের অংশটা ছিলো। মাথা আর পায়ের অংশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। অগত্যা ফয়সল ভাইকে এসব পুলিশী ঝামেলা মেটাতে নিজের বাড়িতে ফিরে যেতে হলো। তবে আমি মনে মনে খুশী হয়েছিলাম। সমাজ থেকে একটা দুষ্ট রাহুর পতন হলো। উনার মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে সাইফুলের বউ আমাদের বাসায় এসেছিলো। বুবুকে ডেকে বললো,
—তোমার শ্বশুর আমার নিরপরাধ স্বামীকে মেরেছে। আমি তাও পুরো লাশটা পেয়েছি। কিন্তু তোমার শ্বশুর লাশের তিনভাগের একভাগ পেয়েছো। বাকিটার খবর নেই। হয়তো শিয়াল কিংবা কুত্তায় খেয়েছে। এরকম শয়তান মানুষের অবস্থা এমনই হয়।
আসলেই কি ভয়ঙ্কর! ভাবলেই গায়ের পশমগুলো কাঁটা দিয়ে উঠে। এই জন্য বলা হয় আল্লাহপাক ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না। আমাদের এলাকার চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় বহু মানুষের উপর অত্যাচার করেছেন। তবে আমি দোয়া করি ঐ লাশের খন্ডটা ফয়সল ভাইয়ার বাবার না হোক। আমার শত্রুরও আমি এমন অবস্থা দেখতে চাই না। তবে ভাইয়াকে অনেক ঝামেলা পোহাতে হলো। প্রথমে ডিএনএ টেস্ট করিয়ে দেখা হলো আসলেই লাশের খন্ডটা ফয়সল ভাইয়ের আব্বার কিনা। ঢাকা থেকে টেস্ট করিয়ে ভাইয়ার ডিএনএ রিপোর্ট ভারতে পাঠানো হলো। ঐ লাশের ডিএনএ রিপোর্টের সাথে ভাইয়ার রিপোর্ট মিলে গেল। যদিও ভাইয়াও জানতো মানুষ হিসাবে উনার বাবা ভালো মানুষ ছিলেন না। তারপরও উনি ভেঙ্গে পড়েছেন। বুবুও ভাইয়ার সাথে শ্বশুর বাড়িতে চলে গেল। বুবুর শাশুড়ীও মানসিকভাবে অনেক ভেঙ্গে পড়েছেন। আমি সত্যি খুব অবাক হলাম। যে মানুষটার কাছে সারাজীবন স্ত্রীর অধিকার বুঝে পেলেন না তার জন্য উনি কিভাবে শোকার্ত হন।
বুবু এইচএসসি জিপিএ ফোর পেয়ে পাশ করলো। আমিও খুব মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা শুরু করলাম। এদিকে আমার ডেলিভারীর সময় ঘণিয়ে এলো। নিদিষ্ট সময় পর আমি পুত্র সন্তানের জন্ম দিলাম। তবে আমার চেয়ে মনে হয় আমার বুবু ভীষণ খুশী হলো। বুবুর শ্বশুর বাড়ি কাছাকাছি হওয়াতে শাবাবের সাথে সময় কাটাতে বুবু প্রতিদিন আমাদের বাসায় আসতো। শাবাবকে নিয়ে আমার কোনো চিন্তা নেই। আম্মা আর বুবু মিলে শাবাবকে সামলাতে লাগলো। আর আমি মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করতে লাগলাম। কিন্তু শাবাবের জন্মের খবরটা আর চাপা থাকলো না। ও বাড়িতে পৌঁছে গেল। যারফলে শাবাবের বয়স যখন একবছর তখন সেঁজুতি আর জাবেদভাই একদিন হঠাৎ করেই আমাদের বাসায় এসে হাজির হলো। শাবাবকে দেখেই খুশিতে কোলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলো। ওর কাছেই খবর পেলাম আমি ডিভোর্স লেটার পাঠানোর ছয় মাসের মধ্যে মুশফিক আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছে। আমার আর জানতে ইচ্ছা হলো না ওর সাথে রত্নার বিয়ে হয়েছে কিনা। তবে সেঁজুতি নিজ থেকেই বললো,মুশফিকের সাথে রত্নার বিয়ে হয়েছে। গ্রীন কার্ড পেয়েছে। সামনে হয়তো পাসপোর্ট পেয়ে যাবে। প্রসঙ্গ এড়াতে বললাম,
—-তোমরা কবে বেবি নিবে?
—-নিজেরা চাইলে তো আর হবে না আল্লাহপাকের হুকুম লাগবে।
জাবেদ ভাইকে আবারও ধন্যবাদ দিলাম। আমার মায়ের জামিনের ব্যাপারে উনি অনেক সাহায্য করেছেন। উনিও বিনয়ের সাথে বললেন,
—-আত্মীয় হিসাবে এটা করা আমার দায়িত্ব ছিলো।
সারাদিন থেকে রাতে এয়ারে করে উনারা ঢাকায় ফিরে গেলেন। সেঁজুতি শাবাবের জন্য অনেক জামা খেলনা কিনে এনেছিলো। এর কিছুদিন পর একটা খবর পেলাম। আমার সন্তান হওয়ার খবর পেয়ে রত্না মুশফিককে ডিভোর্স দিয়েছে। আমি সেঁজুতি জিজ্ঞাসা করলাম রত্না এই কাজটা কেন করলো? সেঁজুতি বলেছিলো,মুশফিক নাকি ওর বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে। আমার কেন জানি সেদিন মুশফিকের ডিভোর্সের কথা শুনে ভীষণ খুশী লেগেছিলো। মনে হয়েছিলো আমার গোপন ক্ষতটায় মলম লাগানো হলো। মনে মনে রত্নাকে ধন্যবাদ দিয়েছিলাম।
চলবে