#ধারাবাহিক গল্প
#উপসংহার
পর্ব-তেরো
মাহবুবা বিথী
সামনে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা। খুব মনোযোগ দিয়ে লেখা পড়া করছি। ওদিকে বুবুর মেয়েটার বয়স দুবছর পেরিয়ে তিন এ পা দিলো অথচ আমি দেখতে যেতে পারিনি। কিভাবে সম্ভব? একদিকে টিউশন অন্যদিকে নিজের পড়াশোনা তার পাশাপাশি শাবাবকে সামলাতে হয় আবার আম্মার বয়স হয়েছে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হয়। সব মিলিয়ে আমি একদম সময় বের করতে পারি না। আমার কাছে ঐ সময় লেখাপড়া ছাড়া নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার আর কোনো উপায় ছিলো না। সেজন্য খুব গুরুত্ব দিয়ে লেখাপড়া করছিলাম। কিম্তু শাবাবকে নিয়ে একটা সমস্যা শুরু হলো। ও আস্তে আস্তে রাহাতের উপর দুর্বল হতে থাকে। শাবাবের উপর যেন মুশফিকের কোনো প্রভাব না পড়ে সেটাকে রুখতে গিয়ে রাহাতের সাথে মিশতে দিয়েছিলাম। আর এখন শাবাব রাহাতের উপর দুর্বল হয়ে পড়েছে।
দুদিন আগে রাহাত এসে শাবাবের হোমওয়ার্কগুলো দেখছিলো। দেরী হচ্ছিলো দেখে রাহাতকে রাতে ডিনার করে যেতে বললাম। তখন শাবাব রুমে এসে এমন একটা কথা বললো আমি চমকে উঠলাম। ও আমাকে বললো,
—- আম্মু আজ রাহাত আঙ্কেল থেকে গেলে কেমন হয়?
আমি বুঝিনি ছেলে আমার এই উত্তর দিবে। সে কারনে স্বাভাবিক সহজ সরল ভঙ্গিতে বললাম,
—–আমাদের বাসায় দুটো মাত্র খাট। একটিতে নানী ঘুমায় আর একটিতে তুমি আমি ঘুমাই। আঙ্কেল কোথায় ঘুমাবে?
—-কেন,আমাদের খাটে ঘুমাবে। তুমি আমি আঙ্কেল এক খাটে ঘুমাবো।
ওর কথা শোনার সাথে সাথে আমার কান দুটো দিয়ে যেন গরম ধোয়া বের হতে লাগলো। ভাগ্যিস ও কথাগুলো আমার রুমে এসে বলেছে। যদি রাহাতের সামনে বলতো তাহলে কেমন হতো? আমরা দুজনেই অপ্রস্তুত হয়ে যেতাম। আমি শাবাবকে কাছে ডেকে বললাম,
—এমন কথা আর কখনও বলবে না। লোকে খারাপ বলবে।
—- কেন খারাপ বলবে আম্মু?
—রাহাত আঙ্কেল তোমার আম্মুর ফ্রেন্ড হয়। এছাড়া উনার সাথে আমাদের আর কোনো সম্পর্ক নেই। খবরদার তুমি এই কথা আর কাউকে বলবে না।
আমার কথাগুলো শুনতে শাবাবের একটুও ভালো লাগেনি। ও মুখ গম্ভীর করে আমার রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আমি ওর বিষয়টা বুঝতে পেরেছি। ও ইতিমধ্যে রাহাতকে ওর বাবার জায়গায় বসিয়ে দিয়েছে। আমি বুঝি রাহাত ও আমার উপর অনেকটা দুর্বল।নারী হয়ে জন্মেছি এটুকু বুঝার ক্ষমতা আল্লাহপাক দিয়েছেন। কিন্তু আমি খুবই নির্বিকার থাকি। তাছাড়া বিবাহ বর্হিভূত প্রেমের পক্ষে আমি বিশ্বাসী না। কারণ এই সম্পর্ক যদি বিয়ে পর্যন্ত না গড়ায় সেটাও একটা যন্ত্রণা। বিশেষ করে আমার মতো যারা পোড় খাওয়া মানুষ। চুন খেয়ে মুখ পুড়লে মানুষ দই দেখে চমকায়। সে কারনে আমি একটু দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করি। সম্পর্কটা যেন বন্ধুত্বের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। তবে রাহাত হয়তো আমার কিছু আচরনে ভাবে, আমিও ওকে পছন্দ করি। যেমন ও তো হলে থাকে। আমরা যারা হলে থেকে পড়াশোনা করেছি তারা কমবেশী সবাই জানি হলের ডাইনিং এর কথা। সেটা আর এখানে না বলি। সে কারনে মাঝে মাঝে আমি ওর জন্য খাবার রান্না করে নিয়ে যেতাম। আসলে বাজারটা ও করে দিতো বলে আমার থেকে আম্মাই বেশী উদ্যেগী হয়ে ওর জন্য খাবার রেডী করতো। আমার দায়িত্ব ছিলো শুধু ওর কাছে পৌঁছে দেওয়া। তাছাড়া আমার ভাই ছিলো না বলে আম্মাও ওকে খুব পছন্দ করতো। রাহাতও অবশ্য পছন্দ করার মতো ছেলে। বাবার আর্থিক স্বাচ্ছন্দ থাকা সত্বেও টিউশনি করে নিজের পড়ার খরচ নিজেই যোগাড় করে নিতো।
তবে সে রাতে রাহাত ডিনার সেরে চলে যাওয়ার পর আমার সাথে খুব একটা যোগাযোগ রাখেনি। আমি ভেবেছি পরীক্ষা সামনে সে কারনে হয়তো পড়াশোনা নিয়ে খুব ব্যস্ত আছে। আমিও ব্যস্ত। মাঝে মাঝে রাহাতের সাথে ম্যাসেজে কথা হতো। আসলে আমিও মিস করতাম। কিন্তু ফোন করতে ইচ্ছে হতো না। এদিকে ছুটির দিনে আম্মা শাবাবও ওর জন্য অপেক্ষা করতো। কারণ ছুটির দিনে ও হল থেকে আমার বাসায় চলে আসতো। আমি যদিও বাসায় উনাদের বুঝানোর চেষ্টা করতাম পরীক্ষার কারনে রাহাত আসতে পারছে না। পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত আছে। তখন মেনে নিলেও সমস্যা হলো পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবার পর। রাহাত যেন হঠাৎ ডুমুরের ফুল হয়ে গেল। আমি বুঝে পেলাম না হঠাৎ কি হলো। এদিকে শাবাবকে স্কুল থেকে আনা হোমওয়ার্ক করানো, সংসারের কাজ নিয়ে হিমশিম খেতে লাগলাম। আসলে শাবাবের লেখা পড়ার ক্ষেত্রে আমি নিজের অজান্তেই রাহাতের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। এখন সবটুকু আমায় দেখতে হচ্ছে। মনে হচ্ছে খুব চাপের মাঝে আছি।
দু’তিম মাস সময় পার হয়ে গেল। আমি বিভিন্ন জায়গায় চাকরির ইন্টারভিউ দিয়ে যাচ্ছি। দুএক জায়গায় কথা এগুচ্ছে দেখা যাক কি হয়? আমার আর রাহাতের সম্পর্কটাকে প্রেম বলা যাবে না। কিন্তু আমি বুঝতাম রিফাত আমার দিকে মাঝে মাঝে ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো। আমার চোখে চোখ পড়তেই দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নিতো। এবং প্রতি সপ্তাহে আমার বাসায় ওর আসা চাই। সেটা যে শুধু আম্মা আর শাবাবকে সময় দেওয়া তা নয়। আমার সাথে সময় কাটানোর জন্য ও আসতো। সেই মানুষ এভাবে হাওয়ায় মিশে গেল। খুবই অবাক লাগছে। আম্মা ওর মোবাইলে ফোন দিতে বলেছিলো। আমিও বহুবার দিয়েছি। কিন্তু প্রতিবার বলেছে সুইচস্টপ। যাইহোক মাঝে মাঝে মনে হতো আমি হয়তো ওর প্রয়োজনের প্রিয়জন ছিলাম।
তারিখটা আমার এখনও মনে আছে। জুন মাসের ষোলো তারিখ। আষাঢ়ের প্রথম কিংবা দ্বিতীয় দিন হতে পারে কিংবা কম বেশী হতে পারে। যাইহোক সেই তর্কে না যাই। মুল কথায় আসি। দিনটা ছিলো বৃহস্পতিবার। রাতের খাবার খেয়ে বিছানায় কেবল শুয়েছি। ফোনটা বেজে উঠলো। স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে দেখি অপরিচিত নাম্বার। আমি সাধারনত অপরিচিত নাম্বারের ফোনকল রিসিভ করি না। সে কারনে বেজে বেজে ফোনটা একসময় নিজেই থেমে গেল। কিন্তু আবারো দু,তিনবার বেজে উঠলো। পাশে শাবাব ঘুমাচ্ছে। কখন আবার ওর ঘুম ভেঙ্গে যায়। কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে গেলে ছেলেটা খুব যন্ত্রণা দেয় । সেই কারনে একসময় বিরক্ত হয়ে যখনি মোবাইলটা সুইচস্টপ করতে যাবো তখনি ম্যাসেঞ্জারে টুং করে শব্দ হলো। আমি ম্যাসেঞ্জার ওপেন করে দেখি রাহাত মেসেজ পাঠিয়েছে। প্রথমে মনে হলো ভুল দেখছি। পরে ভালোমতো আবারও তাকিয়ে দেখি হা রাহাত। ওর নামটাই তো অন্ধকার ঘরে মোবাইলে জ্বলজ্বল করছে।
জবা,
কেমন আছো? জানি আমার উপর হয়তো অনেক অভিমান জমিয়ে রেখেছো। সাক্ষাতে সবটা পুষিয়ে নিও। ট্রেনে করে ঢাকার পথে আসছি। একটা অনুরোধ করবো। কাল টিএসসিতে বিকাল সকাল দশটায় এসো। প্লিজ এসো কিন্তু। অনেক কথা বলার আছে। আমি অপেক্ষায় থাকবো।
রাহাত,
ম্যাসেজটা দেখে কেন যেন আমার খুব কান্না পেলো। কেন কাঁদছি নিজেই বুঝতে পারছি না। আবার নিজেকে নিজে প্রশ্ন করছি,রিফাত আমার কে যে আমি ওর সাথে অভিমান করবো। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম যাবো না।
কিন্তু পারলাম না। আমার সে রাতে আর ঘুম এলো না। আধোঘুম আধো জাগরনে পুরোটা রাত পার হয়ে গেল। খুব ভোরে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে কিচেনে গেলাম।চুলায় খিচুড়ী বসিয়ে দিলাম। রিফাত আমার হাতের খিচুড়ী,বেগুনভাজি আর ডিম ভুনা খুব পছন্দ করে। খাবারগুলো একটা বক্সে ভরে আম্মার চোখ এড়িয়ে ব্যাগে ভরে নিলাম। অ্যাশ কালারের জমিনে সাদা সুতো দিয়ে লখনৌ স্টিচের শাড়ি পরে নিলাম। সাথে সাদা ব্লাউজ আর মাথায় হেজাব পরে নিলাম। আমি কখনও খুব একটা সাজগোজ করি না। সেদিন কি মনে করে চোখে মোটা করে কাজলের রেখা এঁকেছিলাম। আম্মাকে বললাম চাকরির প্রয়োজনে আমাকে একজনের সাথে দেখা করতে হবে। একথা বলেই নটার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে রিকশা নিয়ে নিলাম। সমস্যা হলো আষাঢ়ের সময়। আকাশের মেজাজ মর্জি বোঝা মুশকিল। হঠাৎ আকাশ কালো করে মুষলধারে বৃষ্টি নামলো। বেশীক্ষণ স্থায়ী হলো না। আধঘন্টার মধ্যে থেমে গেল। এতে আমার যা হবার তাই হলো। ভিজে চুপসে গেলাম। শাড়ি পরে ভিজলে খুব বিরক্ত লাগে। টিএসসি পৌঁছে ভাড়া মিটিয়ে আমাদের সেই পুরোনো জায়গাটায় চলে গেলাম। দূর থেকে দেখতে পারছি রাহাতকে। সেই আগের মতোই আছে। সাদা পাঞ্জাবি সাথে জিন্স প্যান্ট। পায়ে একজোড়া চটির স্যান্ডেল। রাহাতের এই সাদাসিধা বেশভুষা আমার ভীষণ ভালো লাগে। দূর থেকে দেখে ও আমার দিয়ে এগিয়ে আসতে শুরু করলো। একদম কাছে এসে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
—বৃষ্টিতে তোমার চোখের কাজলটা লেপ্টে গিয়েছে। তারপরও তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। এই ক’মাসে তোমার সৌন্দর্য আগের থেকে বহুগুন বেড়েছে।
আমার শুনতে বেশ ভালোই লাগছিলো। তারপরও কপট রাগ দেখিয়ে বললাম,
—-থাক,এতো আদিখ্যাতা করে আমার সৌন্দর্যের কদর দেখাতে হবে না। এই ক’মাস কোথায় ডুব দিয়েছো সেটা বলো। নাকি বিয়ে করে ফেলেছো? আর আমাকে হঠাৎ ডাকলে কেন?
চলবে