উমা পর্ব-২৯+৩০

0
423

#উমা [কপি করা নিষেধ]
#২৯তম_পর্ব

রুদ্ররা চলে গেলো, সেই মূহুর্তে দীপঙ্কর ছুটে এলো। হাফতে হাফতে বললো,
“জ্যেঠু, ফোন এসেছে গুদামে। ইউনিয়ন পড়িষদের অফিস থেকে।”

দীপঙ্করের কম্পিত কন্ঠে ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে আসে অভিনব সিংহ এর৷ এমন আন্দাজ তিনি করেছিলেন কিন্তু এতো দ্রুত তা বাস্তবে রুপান্তরিত হবে বুঝে উঠতে পারেন নি। অভিনব সিংহের কপালে চিন্তার রেখা ভাসমান। তাকে গভীর চিন্তায় মগ্ন দেখে লক্ষী দেবী প্রশ্ন করে উঠে,
“কিছু হয়েছে কি?”

অভিনব সিংহের স্বম্বিত ফিরে। শীতল কন্ঠে বলে,
” কিছু না, নির্বাচনের ব্যাপার। মেয়েছেলের না বুঝলেও চলবে।”

লক্ষীর কৌতুহল গ্যাস বেলুনের ন্যায় উড়ে যায়। হ্যা, সে মেয়ে মানুষ। তার স্থান কেবল মাত্র হেসেলে। এটাই সমাজের কট্টর নিকৃষ্ট সত্য।

রুদ্র এবং উমা কালীগঞ্জে পৌছে বারোটার দিকে। একটা কালো গেট দিয়ে তাদের ভ্যান প্রবেশ করে অট্টালিকায়। অট্টলিকাটি চেয়ারম্যান বাড়ির ন্যায় বৃহৎ নয়। দোতালা দালান। সামনে বৃহৎ আঙ্গিনা। তাতে একটি তুলসি গাছ বড্ড অবহেলায় পড়ে রয়েছে। উমা তার নিকট দাঁড়ালো। ছোট ছোট চোখে তার নতুন আবাসস্থল দেখতে লাগলো সে। এখন থেকে এই বাড়িতেই হবে উমার নিবাস। বাড়িটি পুরোনো, বেশ পুরোনো। শেষ মেরামত করা হয়েছে গত সপ্তাহে। তাড়াহুড়ো করে রুদ্র শুধু আবাস যোগ্য করেছে বাড়িটিকে। নিচতলা গোছানো হয়েছে থাকার জন্য। দুটি ঘর, বসার ঘর, হেসেল। দোতালাটা এখনো জঞ্জালে গাদা। দোতালার সিড়ি দিয়ে চিলেকোঠায় যাওয়া যায়। এর পর এক বৃহৎ ছাদ। ছাদে পা রেখেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে উমা। রাজশ্বী এবং গোপালের অসহায় মুখখানা বড্ড মনে পড়ছে। ভাইবোন দুটি আছে যে কি না উমার এই পৃথিবীতে আপন, যার সাথে তার রক্তের টান আছে। অনেকে বলবে, রুদ্র তার স্বামী। রুদ্রই এখন সবচেয়ে আপন। কথাটি সত্য, রুদ্র তার আপন বটে। তবে নিখিলের মৃত্যুর পর থেকে রুদ্রকে আপন বলে কাছে টানতে ভয় হচ্ছে উমার। যেই তার আপন ধীরে ধীরে সকলকেই কেড়ে নিচ্ছে কি না ঈশ্বর। উমার ভয় রুদ্র যদি হারিয়ে যায়। এই ব্যাপার নিয়ে বড্ড তর্কাতর্কি ও হয়েছিলো উমার সাথে তার। প্রথমত রতীদের কালীগঞ্জে আনা নিয়ে তুদ্রের সাথে কথা কাটাকাটি হলো৷ তারপর হলো গতকাল রাতে, রুদ্র যখন তাকে বললো সে এই বছরের নির্বাচনে নিজের নাম দিচ্ছে। অমনি উমা বাধ সাধলো,
“রাজনীতি না করলে কি নয়?”
“বলেছিলাম, এ আমার রক্তে মিশে আছে।”
“আজকাল অবস্থা খুব ভালো নয়। সরকার বদল হবে, দুসরকারের মাঝে দ্বন্দ হচ্ছে। মানুষ গায়েব হচ্ছে, কি দরকার এই ফাসাদে পড়ার!”

উমার ধীর, চিন্তিত কন্ঠে রুদ্র খানিকটা অবাক হলো৷ রুদ্রের মনে হলো উমা এখন সেই মানুষটি হয়ে গিয়েছে যে তার আপন মানুষকে আগলে রাখতে চাচ্ছে। প্রথমে রাজশ্বী এবং গোপাল। এখন রুদ্র। রুদ্র নিজেকে শান্ত রেখে বোঝানোর চেষ্টা করলো উমাকে,
“শুধু শুধু ভয় পাচ্ছো তুমি, কিছুই হবে না আমার। আর আমি খুব ক্ষমতাবান কোনো পদে যাই নি। সামান্য মেম্বার পদে কার কি সমস্যা?”
“শান্তির জীবনে থাকতে কি খুব সমস্যা? অহেতুক অশান্তিকে কান ধরে আনার প্রয়োজনীয়তা তো নেই। রাজনীতির নোংরামি আপনি ও জানেন। না প্রবেশ করতে চাইলেও করতে হয়। আমি চাই না, আবার কোনো পুলিশ এসে আপনাকে ধরে নিয়ে যাক৷ আপনি কিন্তু আমায় কথা দিয়েছিলেন।”
“কথা দিয়েছি, কথা রাখবো। তবে রাজনীতি আমি ছাড়ছি না। স্বচ্ছ রাজনীতিও করা যায়। শুধু মস্তিষ্ক শান দিলেই চলে। এতে তোমার আপত্তি হলেও আমার কিছু করার নেই।”

উমা কিছু বললো না। তবে রুদ্র তার বক্তব্যের প্রভাব খেয়াল করলো উমার কার্যে। মেয়েটি আরোও অধিক চুপ হয়ে গেলো। রুদ্র কিছু বললেই তাতে শুধু “হু” তে জবাব দিতে লাগলো। রুদ্রের বুঝতে বাকি রইলো না তার ষোড়শী অভিমান করেছে। তবে রুদ্রের তাতে রাগ হলো না। কারন রুদ্র জানে অভিমান তার ই সাজে যে ভালোবাসতে জানে। তাই ষোড়শীর মান ভাঙ্গানোর দায়িত্ব ও তার ই।

ছাঁদের এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে উমা। শীতটা এবার খুব জলদি ই পড়ে গিয়েছে। দুপুরেও হিনহিনে শীতল ছোয়ায় কম্পিত হয় শিরা উপশিরা গুলো। চাঁদরটা মুড়ে মিহি রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে ভালোই লাগছে তার। রুদ্র বলেছে খাবার মোড়ের “মায়ের দোয়া” হোটেল থেকে নিয়ে আসবে। তাই হেসেলে যাবার তাড়া নেই উমার। নিজের ঘরের মাঝে এক অন্যরকম টান রয়েছে। মস্তিষ্ক যখন বুঝতে পারে এই নিবাসটি তার একান্ত তখন ই তার স্নায়ুকোষ জুড়ে প্রশান্তির প্রলেপবয়ে যায়। উমার ক্ষেত্রেও সেটাই হলো। এই ভঙ্গুর দোতালা বাড়িতেও সে প্রশান্তি খুজে পাচ্ছে। ছাদের কর্নিশ দিয়ে বাড়ির চারপাশ টা দেখলো সে। অবসর সময়ে কাজ বেড়েছে। ভুতুড়ে বাড়িটাকে বাসস্থল করতে বেশ কাঠখড় পোহাতে হবে তাকে। উমা অনুভব করলো একজোড়া শীতল বেষ্টনী তাকে আগলে রেখেছে। কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে বললো,
“কেমন দেখলে বাড়ি? একটু নয় বেশ পুরোনো। স্বাধীনতার পূর্বে নায়েবের বাড়ি ছিলো। ব্যাটা ভারত পালালে ঠাকুরদা দখল করেছিলেন। কখনো এখানে থাকা হয় নি, প্রয়োজন হয় নি। সমস্যা নেই, আমি বাদলকে বলেছি। কিছুদিনের মধ্যে এটা থাকার যোগ্য হয়ে যাবে। ভালো লেগেছে?”
“হু”

এতোগুলো কথার বিপরীতে উমা শুধু ছোট করে “হু” বলে৷ খানিকটা ব্যথিত হয় রুদ্র। উমা ভেতরে যেতে নিলে রুদ্র হাতটা টেনে ধরে। রুদ্রের এমন আচারণে অবাক হয় উমা। সরু দৃষ্টিতে তাকালে দেখতে পায়, রুদ্র কাতর দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছে। উমা স্বাভাবিক চিত্তে জিজ্ঞেস করে,
“কি হলো, হাত টেনে ধরলেন যে?”
“কেনো এমন করছো বলতো? এখনো তোমার রাগ করে নি?”
“আমি তো রাগ করি নি”
“তাহলে এড়িয়ে যাচ্ছো কেনো?”
“এড়ালাম কোথায়? সম্মতি জানালাম।”
“এমন তো তুমি নও। তুমি কি জানো আমি তোমাকে পড়তে পারি?”

রুদ্রের কথায় মলিন হাসি হাসে সে। এই হাসর মাঝে এক রাশ তাচ্ছিল্যের ছাপ ছিলো। তারপর শান্ত গলায় বলে,
“পড়তে পারেন বুঝি?”
“পাড়ি”
“তাহলে আমাকে কেনো বুঝেন না বলুন তো?”
“বুঝি উমা, কিন্তু এই পথে আমি অনেক দূর এগিয়ে গেছি। এখন ফেরার পথ নেই। যুদ্ধে যোগদানকারী সৈনিক ফিরতে পারে না। হয় সে মৃত্যবরন করে নয় বিজয়ী হয়। কথাটা জানা আছে নিশ্চয়।”

উমার ঠোঁটজোড়া ঈষৎ কেঁপে উঠলো। বুকের বা পাশে চিনচিনে ব্যাথা করছে। রুদ্রের কথা শুনে চোখটা জ্বলে উঠে উঠে। কথাগুলো দলা পাকিয়ে যাচ্ছে তার। নিখিলের মৃত্যুকে মানিয়ে নিলেও কেনো যেনো রুদ্রের কথাটা তার হজম হলো না। রুদ্র এবার এগিয়ে এলো। ষোড়শীর মুখশ্রী আলতো হাতে তুললো। তার রক্তিম ঝাপসা আখিজোড়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
“অহেতুক ভয় পাচ্ছো।”
“আমার আপন জনের পরিমান স্বল্প। আমি এই তিনটে মানুষকে হারাতে চাই না। এই বিশাল ধরণীতে একা থাকার সাহস আমার নেই।”
“এতো ভীতু হলে চলে, প্রতিটা মানুষ একাই আসে, তাকে একাই যেতে হয়।”
“এসব বইবাক্য না বললে নয়?”
“সত্য বললাম”
“ভালো লাগে না এই সত্য শুনতে।”

উমার চোখ দিয়ে এক বিন্দু অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। রুদ্র, আলতো ঠোঁটের পরশ ছোয়ালো চক্ষুজোড়ায়। আবেশ বুঝে গেলো পল্লব৷ কপালে কপাল ছুয়ে বললো,
“রাগ করো না লক্ষীটি, আমি তোমার মনোঃবস্থা বুঝি। আমি জানি তুমি রাজশ্বী এবং গোপালের জন্য চিন্তিত। ভয় পাচ্ছো, কেউ তাদের ক্ষতি করে দিবে। কিন্তু বিশ্বাস করো এমন কিছু হবে না। তোমার ভাই বোনকে কেউ ছুবে না। আমি সেই ব্যাবস্থা করে দিয়েছি।”

উমা অবাক নয়নে তাকালো রুদ্রের দিকে। যে ভয়টা সে পাচ্ছিলো সেটা আন্দাজ করে নিয়েছে রুদ্র। রুদ্র মুচকি হেসে বলে,
“বলেছিলাম না, তোমাকে পড়তে পারি আমি।”
“সেদিনের জন্য ক্ষমা করে দিবেন। একটু বেশি বলে ফেলেছিলাম।”
“যাও ক্ষমা করলাম। চলো এবার ক্ষেতে চলো। আমার বের হতে হবে।”
“চলুন”

উমা স্মিত হাসি হাসলো। রুদ্রের মনে প্রশান্তির ঢেউ খেলে গেলো। যার হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা তার মনে শান্তির দ্বীপ জ্বালে তাকে কিভাবে বলি দিবে রুদ্র?

দু দিন পর,
শাশ্বত চেয়ারে বসে রয়েছে। সামনে থাকা গোলাকার পেপার ওয়েটটির দিকে তার নজর। ঠোঁটের কোনায় বিস্মিত হাসি। আজ সকালে খবর পেয়েছে এবার ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে অভিনব সিংহ দাঁড়াচ্ছে না। অথচ রুদ্র মেম্বারের পদে দাঁড়িয়েছে। ব্যাপারটা তাকে শুধু বিস্মিত ই করে নি, বিনোদন ও দিয়েছে। বাপ ছেলে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়ছে কিন্তু সংগোপনে। এখন তার সামনে একটা প্রশ্ন, প্রশ্ন টা সহজ। সে কার হয়ে লড়বে এবং কার বিপক্ষে লড়বে! নাকি সে সমাজবাদী পার্টির মতো দুজনের বিরুদ্ধে লড়বে। শাশ্বত গভীর চিন্তায় মগ্ন ঠিক সেই সময় একখানা খাম দিয়ে যায় পিয়ন। খাদি খামটা দেখে খানিকটা অবাক হয় শাশ্বত। অবাক কন্ঠে বলে,
“কে পাঠিয়েছে মন্সুর মিয়া?”
“জানি না স্যার”

পিয়ন চলে গেলে খামটি খুলে শাশ্বত। খামটি খুলতেই হাসির প্রলেপ বিস্তৃত হয় তার। সে বুঝে গেছে কার পাল্লা ভারি………

চলবে

#উমা [কপি করা নিষেধ]
#৩০তম_পর্ব

দু দিন পর,
শাশ্বত চেয়ারে বসে রয়েছে। সামনে থাকা গোলাকার পেপার ওয়েটটির দিকে তার নজর। ঠোঁটের কোনায় বিস্মিত হাসি। আজ সকালে খবর পেয়েছে এবার ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে অভিনব সিংহ দাঁড়াচ্ছে না। অথচ রুদ্র মেম্বারের পদে দাঁড়িয়েছে। ব্যাপারটা তাকে শুধু বিস্মিত ই করে নি, বিনোদন ও দিয়েছে। বাপ ছেলে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়ছে কিন্তু সংগোপনে। এখন তার সামনে একটা প্রশ্ন, প্রশ্ন টা সহজ। সে কার হয়ে লড়বে এবং কার বিপক্ষে লড়বে! নাকি সে সমাজবাদী পার্টির মতো দুজনের বিরুদ্ধে লড়বে। শাশ্বত গভীর চিন্তায় মগ্ন ঠিক সেই সময় একখানা খাম দিয়ে যায় পিয়ন। খাদি খামটা দেখে খানিকটা অবাক হয় শাশ্বত। অবাক কন্ঠে বলে,
“কে পাঠিয়েছে মন্সুর মিয়া?”
“জানি না স্যার”

পিয়ন চলে গেলে খামটি খুলে শাশ্বত। খামটি খুলতেই হাসির প্রলেপ বিস্তৃত হয় তার। সে বুঝে গেছে কার পাল্লা ভারী। শাশ্বতের মামা মশাই অর্থাৎ অভিনব সিংহ এতোকাল নিজের এক অভেদ্য প্রাচীর গড়েছিলেন। আজ সেই অভেদ্য প্রাচীরে ফাটল ধরেছে। আর এই সূক্ষ্ণ ফাটলের নাম রুদ্র। খামটিতে সেই নীলনকশা রয়েছে যাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে অভিনব সিংহের লংকায় আগুন জ্বলতে বেশি সময় বাকি নেই। কিন্তু রুদ্র এতোটাই ধূর্ত সে ঠিক নিজেকে সেই আগুনের তাপ থেকে বাঁচিইয়ে নিবে। ইতিহাস জানে, নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে ইংরেজ হারালেও সেখানে ঘি ঢেলেছিলো মীর জাফর। অভিনব সিংহের ক্ষেত্রে সেই মীর জাফরটি তার আপন পুত্র রুদ্র। কিন্তু প্রশ্নটি একটি খামটি কে পাঠালো! সে কি চায়! শাশ্বত মনে মনে স্থির করলো সে এখন রুদ্রের সাথে থাকবে, কারণ পরিষদে রুদ্র নিজের এক চ্যানেল বানিয়ে ফেলেছে, সেই চ্যানেল অনুসারে আসছে ভোটে সে শুধু বিজয়ী ই হবে না, আগামী নির্বাচনে তাকে চেয়ারম্যানের পদে দাঁড় করানো হবে। রুদ্র এই রাজনীতিতে এসেছে মাত্র এক মাস, অথচ সে অভিনব সিংহের বিরুদ্ধে বিষাক্ত জাল বুনেছে, যে জালে অভিনব সিংহ পা রাখলেই চোরাবালির ন্যায় তলিয়ে যাবে। তবে শাশ্বতের একটি ব্যাপার কিছতেই মাথায় ঢুকছে না, ছেলে হয়ে নিজের পিতার বিরুদ্ধে এতো ভয়ংকর ষড়যন্ত্র রুদ্র কেনো করছে! কি এমন কারন রয়েছে যার জন্য রুদ্র ই অভিনব সিংহ এর সবচেয়ে বড় শত্রুতে পরিণত হয়েছে, রকিবুল মাস্টার এবার আবারো সাহস করে নির্বাচনে দাঁড়াবেন। এবার তার চেয়ারম্যান হবার সম্ভাবনা অধিক। কিন্তু রাজনীতির চালটি দাবার মতো, ঘোড়ার আড়াই চাল কখন কিভাবে সব এলোমেলো করে দেয় সেটা আন্দাজ করা দুষ্কর। এবার খেলা জমেছে, দেখা যাক এই খেলায় কে বাজীমাত করে!

১৭.
মাঘের মাঝামাঝি, নিন্মচাপের আবির্ভাব বাড়ছে। দুদিন ধরে কেমন নরম আবহাওয়া, মেঘলা আকাশ, সূর্যের প্রভা যেনো কালো মেঘের আধারে কোথাও ঢেকে গেছে। ক্ষণে ক্ষণে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে, শীত ও বেড়েছে। চাদরেও শীত কাটছে না। অনেকে বলছে তাকি ঘূর্নিঝড় হবে, হলেও হতে পারে। বঙ্গোপসাগরের সন্নিকটে এই সাতক্ষীরা জেলার উপর তো কম ঝড় যায় না। আর সবথেকে বেশি ঝুকিতে থাকে গ্রামাঞ্চল। উমার ঘুম প্রতিদিনের ন্যায় আপনাআপনি ভেঙ্গে যায়। শাড়িখান জড়িয়ে স্নানে যায় সে। শীতে স্নান করার পর গায়ে কাটা দেয় ফলে চেয়ারের উপর থাকা লাল কার্টিগানটি গায়ে জড়ায় উমা। ভোরের সূর্য ঢাকা পড়েছে কালো মেঘের আধারে। রুদ্র তখন ও লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুম। উমা আয়নার সামনে দাঁড়ালো ভেজা চুলটা ছেড়ে দিতেই সাপের মতো নেমে এলো কাধ বেয়ে। আয়না দিয়ে রুদ্রের ঘুমন্ত স্নিগ্ধ মুখখানা দেখতে পাচ্ছে সে। কাল রাতের মূহুর্তগুলো জীবন্ত হয়ে যায় উমার চোখে। উমা খেয়াল করো রুদ্রের সান্নিধ্য পেতেই কেমন যেনো নেতিয়ে পরে উমা। মোম যেমন অগ্নির কাছে যেতেই গলে যায়, তার অবস্থাটিও তাই হয়েছে। যে মানুষটির স্পর্শ তাকে বিষিয়ে তুলতো আজ সেই মানুষটির বেষ্টনিতে থাকতে মন আকুল হয়ে উঠে। এ বাড়িতে আসার পর যেনো তা বহুগুনে বেড়ে গিয়েছে। উমার মনে হুট করেই একখানা দুষ্টুমি খেলে গেলো, সে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো রুদ্রের দিকে; ভেজা চুলের মাথা থেকে শীতল জলবিন্দু গড়াচ্ছে, সেই চুলগুলো ঝাড়তেই রুদ্রের মুখে পানি ছিটা পড়লো। পৌষের ঠান্ডায় গায়ে কাটা দিলো রুদ্রের। কপাল কুঞ্চিত করে চোখ মেলতেই উমা খিলখিল করে হেসে উঠলো। রুদ্রের রাগ যেনো বাস্পীভূত্ হলো উমার কোমল কল্লোলে, হবে না কেনো ষোড়শী মুক্তদানা হাসি যে তার হৃদয় ভেদ করে। ভোরের উমার স্নিগ্ধতা তার শীতলে হৃদয়ে উষ্ণতার ওম দেয়। রুদ্র ও কম যায় না, হাত টেনে নিজের কাছে টেনে নেয় উমাকে। উমা ভীত কন্ঠে বললো,
“কি করছেন?”

উত্তর দেয় না বরং বাঁকা হাসি হাসে রুদ্র। তারপর শক্ত করে নিজ বেশ বেস্টনীতে নিয়ে অধর ছোয়ায় উমার কোমল অধরে। রুদ্রের এমন কার্যে লজ্জায় লাল হয়ে উঠে উমা। কোমল গালে রক্ত জমে। অধর আলাদা হতেই উমা লজ্জায় বুক গুজে রুদ্রের বুকে। তার হৃদস্পন্দন ক্রমশ বেড়েই চলেছে। নিশ্বাস ঘন হচ্ছে। রুদ্র ভাবে তার ষোড়শী হার মেনেছে। কিন্তু তার ষোড়শী তাকে অবাক করে দু হাত মেলে জড়িয়ে ধরে তাকে। উমার এমন কার্যে অবাক হয় রুদ্র। কাছে তো আগেও এসেছে সে। প্রতি রাতে আসে, কিন্তু উমা নিজ থেকে কখনোই তার আবেশে নেয় নি রুদ্রকে। বরং সর্বদা একটা ভীত নজরে তার দিকে চাইতো সে। উমার এমন কার্যে অবাক কন্ঠে রুদ্র প্রশ্ন করে,
“কি হয়েছে উমা?”

উত্তরে কেমন ছলছল নয়নে তার দিকে যায় উমা। সেই চাহনী যেনো অনেক কিছু ব্যাক্ত করছিলো। তবুও কন্ঠের তৃষ্ণা রুদ্রকে উতলা করে তুললো, রুদ্র ব্যাগ্র কন্ঠে বলল,
“কাঁদছো কেনো?”

উমা উত্তর দিলো না, শুধু চোখের কোনা দিয়ে এক বিন্দু জল গড়িয়ে পড়লো। রুদ্র গভীর চুম্বন দিলো তার চোখে, পুনরায় বলল,
“বললে না যে কাঁদছো কেনো?”
“আমার ভয় হয়”

এবার মুখ খুললো উমা, রুদ্র আকুল কন্ঠে বললো,
“কিসের ভয়?”
“হারানোর ভয়”
“আমায় হারানোর ভয়? আমি তো জানতাম আমার মত নিষ্ঠুর মানুষটিকে কেবল ঘৃণা করো তুমি। তাহলে এই ভয়টা কেনো?”

রুদ্রের প্রশ্নে থমকে যায় উমা, হ্যা লোকটিকে ঘৃণা করতো। খুব ঘৃণা করতো। এই বিয়ের প্রথম রাত থেকে ঘৃণা করতো। কিন্তু এখন সেই ঘৃণাটি যেনো কোথাও মিলিয়ে গেছে। মনমন্দিরের দ্বারে প্রবল বেগে এই মানুষটি করা নেড়েছে। যা উপেক্ষা করাটা ছোট্ট উমার পক্ষে সম্ভব নয়। লোকোটি খারাপ উমাও জানে, রাগ উঠলে কিছুই মনে থাকে না। কিন্তু এই লো্কটিই তার পেছনে ঢাল হয়ে থাকে। তার জীবনের নিভু দীপখানা জ্বালিয়ে নিকষকৃষ্ণ পথে আলোর কীরন দিয়েছে। এই লোককে কিভাবে ঘৃণা করবে সে। তার জানা নেই ভালোবাসা কি, তার জানা নেই প্রেম কি। তবে এটুকু জানে রুদ্র ছাড়া জীবনটা তার বৃথা। তার মস্তিষ্ক, হৃদয়, সর্বত্র কেবল একজন পুরুষের রাজত্ব, সে কেবল রুদ্র। রুদ্র হাল ছেড়ে দিলো, ভাবলো উমা তাকে কখনোই আপন করে নিবে না। উমার নরম মনে তার বাজে প্রভাব ফেলেছে সে, জোর করেছে ইচ্ছের বিরুদ্ধে। এই মেয়েটি কেনো তাকে ভালোবাসবে। কম অত্যাচার তো করে নি সে। রুদ্রের হৃদয় আহত হয়। সে উমাকে ছেড়ে দিতে নিলেই উমা তাকে অবাক করে আরোও নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ধরে। ধীর স্বরে বলে,
“যাকে মনে ঠায় দিয়েছি, তাকে ঘৃণা কিভাবে করি”

ষোড়শীর শান্ত বাক্যে কি জানি ছিলো। কঠিন রুদ্রের চোখের কোনায় আবেগ জমলো। আপ্লুত হৃদয় যেনো আজ বাধ মানছে না। হাতের খোলা বাধন হলো শক্ত, সুগভীর। কাঁপা কন্ঠে বললো,
“সর্বগ্রাসী অগ্নির ন্যায় তুমি
যতবার ছুয়ে যাও
ততবার পুড়ি
ছারখার হই
তবুও খেই হারা পথিকের ন্যায় বারে বারে তোমার কাছে আসি
চরম অবহেলায় বুজে আসা আখির নেত্রে শুধু তোমাকেই রাখি
ভঙ্গুর হৃদয়ের শুধু একটাই বুলি
ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি” ………………………

চলবে।