উমা পর্ব-৫১+৫২

0
369

#উমা [কপি করা নিষেধ]
#৫১তম_পর্ব

দীপঙ্কর অপ্রাসঙ্গিক কথায় বিরক্ত হলেন অভিনব বাবু। হুংকার ছেড়ে বললেন,
“খলসা করে বলো দীপঙ্কর”

এবার দীপঙ্কর বললো,
“শাশ্বত একা আপনাকে ফাঁসায় নি, রুদ্রদাদা ছিলো পেছনে। আমি ভেবে পাই না, ছেলে হয়ে নিজের বাবাকে এভাবে ফাঁসাতে পারে?”

দীপঙ্করের হেয়ালী কথা ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে এলো অভিনব সিংহের। গম্ভীর সন্দিহান কন্ঠে সে প্রশ্ন ছুড়লো,
“তোমার মাথা কি ঠিক আছে? রুদ্র আমার ছেলে, আমার রক্ত। নিজের বাবার পেছনো ছোরাঘাত সে করবে না।”
“আপনি বড্ড সরল মনের জ্যেঠু, কিন্তু রুদ্র দাদা তেমন নয়। আপনার মনে নেই! সে কিভাবে গত নির্বাচনের সময় আপনার শত্রুদের সাথে হাত মিলিয়ে আপনার বিরোধী দলে যোগ দিয়েছিলো। আপনার বিরুদ্ধে কত বড় ষড়যন্ত্র করেছিলো। কোন ছেলে নিজ পিতার সাথে এমনটা করে! আমাদের প্রতিটা ছেলে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিলো। ভোট চুরি তো দূরে থাক আমরা একটা ব্যালোট ছুতে ও পারি নি। রুদ্র সেখানে উপদথিত না থেকেও আমাদের সকল কাজ ভেস্তে দিয়েছিলো। জ্যেঠু, রুদ্রদাকে আপনি ভালোবাসলেও সে আপনাকে নিজের বাবা হিসেবে মানে না। আসলে ক্ষমতা জিনিসটাই এমন! শাহজাহান বলুন বা আওরঙ্গজেব সবাই এই গদির লোভে নিজের বাপকেও ছাড়ে নি। আর এতো আমাদের রুদ্র দাদা। সামনে ভোট, আপনি যেনো মনোনয়ন পত্র না পান সেটার পুরো ছক কষেছে রুদ্র দাদা। নয়তো গোপনীয় খবর গুলো শাশ্বত দাদা জানলো কি করে জ্যেঠু। সব রুদ্র দাদার পরিকল্পনা। ছেলে বেলা থেকে আপনার নুন খেয়েছি। আপনার প্রতি আমার দূর্বলতা আছে, যতই হোক বাপের জায়গায় আপনাকেই দেখে এসেছি। তাই বলছি, জ্যেঠু অন্ধবিশ্বাস পতনের মূল”

অভিনব সিংহের মুখশ্রীতে এক চিন্তার রেখা ভেসে উঠলো। উদ্বিগ্নতা তাকে গ্রাস করছে ধীরে ধীরে। বৃদ্ধ শরীরের ভেতরের মজিবুত হৃদয় টলোমলো হয়ে গেলো। বুকটা চেপে ধরে এলো তার। সন্তানের প্রতি প্রছন্ন ভালোবাসাটা মাথা তুলে দাঁড়ালো। চোখটা জ্বলছে, জ্বলছে কাঁচের মতো স্বপ্নগুলো ভেঙ্গে যাওয়ায়। অভিনব সিংহ ও দূর্বল হয়, তারও অদম্য প্রাচীর হাটু গেড়ে বসে। সেও সাধারণ মানুষের ন্যায় কাবু হয়। বিষাদ যন্ত্রণা তাকেও হানা দেয়। সে কিছু বললো না। এর মাঝেই কন্সটেবল এসে তীক্ষ্ণ অবহেলিত স্বরে বললো,
“সময় শেষ, চলেন”

দীপঙ্করের মাঝে তীক্ষ্ণ অস্থিরতা, অস্থিরতা জ্যেঠুর প্রতিত্তোরের। সে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অভনব সিংহের দিকে। কিন্তু তাকে হতাশ করে অভিনব সিংহ বললো,
“তুমি আমার বেইলের ব্যবস্থা করো দীপঙ্কর। আর রুদ্রকে একবার দেখা করতে বলো”

বলেই সেই কন্সটেবলের সাথে চলে গেলো। চরম বিরক্তি এবং ক্রোধে দীপঙ্করের মুখ বিকৃত হয়ে এলো। মুখ খিঁচিয়ে বললো,
“শালা বুইড়া”

অভিনব সিংহের এলোমেলো পদক্ষেপ তাকে নিয়ে গেলো তার বর্তমান বাসস্থানে। চৌদ্দ শিকের এই ঘরটি ই তার আবাস্থল। চুন খোয়া নোংরা দেওয়ালটির দিকে চাইলে এই ইহজীবনের কর্মগুলো সিনেমার মতো চিত্রিত হতে লাগলো। নিজের সকল পাপ কাজ গুলো জীবন্ত হয়ে উঠলো অভিনব সিংহের চোখে। আজ নিজেকে পরাজিত এক সেনানায়ক লাগছে। মহাভারতের জমিতে থাকা সেই কৌরভ সেনানায়ক, যাকে পরাজিত করেছে নিজের আপনজন, হ্যা নিজের আপনজন_____

—————

উমা নিজের ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। হাতজোড়া উদর আগলে রয়েছে। হিনহিনে বাতাসে সাপের মতো প্যাচানো চুলগুলো উড়ছে। হাওয়া মুখশ্রী ছুয়ে যাচ্ছে পরম আদরে৷ আবার সেই বদ্ধ কারাগারেই তাকে ফিরতে হলো৷ প্রতিনিয়ত অসহ্য যন্ত্রণার অগ্নি ভেতরটাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়খার করে দিচ্ছে।নিখিলের মৃত্যুর পর রুদ্রকে আকড়েই তার দুনিয়াটা ছিলো৷ ছিলো তার নিবিড় ভালোবাসার উৎস। ছোট উমা জানতোই না ভালোবাসা কি! পরিবারের বাইরেও কারোর প্রতি আবেগের সঞ্চার হতে পারে! রুদ্র সেই মানুষটি যার প্রতি তার প্রথম আবেগ জন্মেছিলো, সেই পুরুষ তার আলিঙ্গনে অস্বস্থির বদলে স্বস্থির ছোয়া পেতো। সেই মানুষটির উষ্ণ হাসির ছাপে নিজেকে আবিষ্কার করতো উমা। ঢাল হয়ে সকল কন্টককে নিজের মাঝে সমাহিত তাকে এগিয়ে দিতো ধরণীর ফুলজড়িত পথে। সেই মানুষটি কি করে এতোটা নিষ্ঠুর হতে পারে! উমা সেদিন গভীর রাতে পুনরায় সেই পাতালের ঘরে গিয়েছিলো। কিন্তু কাউকে খুজে পায় নি। অর্থাৎ রুদ্র খুব নিপুন ভাবে তাদের সরিয়ে ফেলেছে। উমা যখন তাদের তন্নতন্ন করে খুজছিলো তখন রুদ্রের প্রবেশ ঘটে। ভারী গম্ভীর থমথমে কন্ঠে বলে,
“তারা এখানে নেই”

উমা চমকে উঠে পিছনে চাইলে রুদ্রের রুদ্রমূর্তি দেখতে পায় সে। চোখজোড়া রক্তিম বর্ণ ধারণ করে রয়েছে। সরু তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার পানে৷ উমার বুক কেঁপে উঠলো। কেনো যেনো সেই মূহুর্তে রুদ্রকে বড্ড অচেনা লাগছিলো তার। চেনা মুখের আদলে অচেনা মানুষটিকে দেখে অজানা ভয়ে হাত পা শীতল হয়ে এলো। রুদ্র ধীর এগিয়ে আসতে লাগলে উমা পেছাতে থাকে। পেছাতে পেছাতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে ঈষৎ চমকে উঠে উমা। তখন রুদ্র উমার সম্মুখে চলে আসে। তার উষ্ণ নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে; রুদ্র ধীর কন্ঠে বললো,
“ভয় পাচ্ছো?”

উমা রুদ্রের চোখে চোখ রাখে। কি উত্তর দিবে সে! এতো বছরের পরিচিত মুখখানা অপরিচিত যে বড্ড অপরিচিত ঠেকছে! উমাকে চুপ থাকতে থেকে রুদ্র বলে,
“চিন্তা করো না, তোমার কোনো ক্ষতি আমি করবো না। পারবো না, ভালোবাসি যে”
“নিষ্ঠুর পশুরাও কাউকে ভালোবাসতে পারে?”

উমার কথায় বাকা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে রুদ্র। তারপর বিদ্রুপের টানে বলে,
“পশুরাই ভালোবাসতে পারে। মুখোশধারী ভালোমানুষগুলোই সেই ভালোবাসার অপমান করে পদে পদে করে। উমা, সর্বদা চোখের দেখাটাই সত্য হয় না৷ সত্য অনেক গভীর। সেই গভীরত্ব মেনে নেওয়াটাই দুষ্কর”
“আমিও জানতে চাই। সেই সত্যকে আমিও অনুধাবন করতে চাই।”
“অহেতুক এসব এ জড়ানোর কি আদৌ কোনো মানে আছে? ভালোই তো আছো আমার মহলে। রাজরাণীর মতো রাখবো। আমাকে আমার কাজ করতে দাও। আমি চাই না তুমি আমর অবাধ্য হও”

রুদ্রের কথায় চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে উঠে উমার। এতোসময়ের ভীতু নারী নির্ভীক মূর্তিতে পরিণত হয়৷ নিজেকে সংযত রাখতে পারলো না সে। একজন মানুষের ভেতরটা সম্পূর্ণ নিঃস্ব হয়ে গেলে অন্তরের ভয়গুলো এক এক করে বাস্পীভূত হতে থাকে। আজ উমার নিজেকে নিঃস্ব মনে হচ্ছে। তীব্র ঝাঝালো স্বরে বললো,
“যদি বাধ্য হয়ে না থাকি তবে?”

উমার প্রশ্নে ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে আসে রুদ্রের। থমথমে স্বরে বলে,
“আমি প্রতারকদের সাথে কি করি তা হয়তো তোমাকে বুঝিয়ে বলতে হবে না। রুদ্র ভালোবাসলে যেমন সব উজার করে ভালোবাসে, ঘৃণা করার সময় ও সব ধ্বংস করতে দুবার ভাবে না।”

রুদ্র এবং উমার দৃষ্টি বদল হয়৷ কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজী নয়। নিজেদের মূল্যোবোধের কাছে বাঁধা তারা। উমার সেদিনের কথা মনে হতেই চোখ ঝাপসা হয়ে উঠে। বুকের ভেতরের চব্বিশ ঘন্টা জ্বলমান অগ্নিকুন্ড কিছুতেই নিভসে না। তার ভয় হয়, নিজের জন্য নয়। নিজের অনাগত সন্তানের জন্য৷ এই কেমন পরিবারে নিজের সন্তানকে আনতে চলেছে সে। সে কি আদৌ স্বাভাবিক জীবনটা পাবে? উমা পরমূহুর্তে চোখ মুছে নেয়। সত্যের সন্ধান সে করবে! রুদ্র যদি ভুল পথকে বেঁছে নেয় তবে স্ত্রী হিসেবে তাকে বাধা সে দিবে। শেষ একটা চেষ্টা করতে চায়! নিজের জন্য নয়, নিজের সন্তানের জন্য।

শাশ্বতের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে সুমন এবং রাজশ্বী। শিবপুরের জমিদখলের কান্ডের বিবরণ দিয়েছে সুমন। সুমনের কথাগুলো শুনে কিছুসময় চুপ করে থাকে শাশ্বত। এতোবড় অরাজকতা চলছে অথচ তারা কেউ জানেও না। শাশ্বতকে চুপ করে থাকতে দেখে রাজশ্বী প্রশ্ন ছুড়ে দেয়,
“দিনের পর দিন এমন হয়ে চলেছে স্যার, আমরা কি কিছুই করতে পারি না?”
“কিন্তু আমাদের কাছে প্রমাণ নেই রাজশ্বী”
“প্রমাণ নেই বলে কি হাতের উপর হাত রেখে বসে রইবো আমরা? কিছুই করবো না? আমরা তো সাংবাদিক, সমাজের দর্পন আমরা। ওখানের থানার পুলিশেরা প্রচুর টাকা গিলে বসে আছে। ওদের কাছে গেলে বলে, আমরা নাকি তিলকে তাল করি। এভাবে আর কতোদিন অরাজকতা চলবে?”

শাশ্বতের মুখ থমথমে হয়ে যায়। কিন্তু সে ইতিমধ্যে অন্য খবর কভার করছে এই জমি দখলের খবরে হাত দিতে পারছে না। গম্ভীর স্বরে বলে,
“স্ট্রিং অপারেশন করতে পারবে?”

শাশ্বতের কন্ঠে এক সুপ্ত ভয় লুকায়িত৷ সুমনের মুখখানা লম্বাটে হয়ে যায়। কিন্তু সকলকে অবাক করে রাজশ্বী বলে উঠে,
“আমি রাজী”

শাশ্বতের ঠোঁটে স্মিত হাসি ফুটে উঠে। রাজশ্বীকে দেখে তার উমার কথা মনে পড়ে গেলো। সেই একই মুখের আদল, সেই একই তেজ, সেই একই উদ্যমী মনোভাব। শাশ্বত পুনরায় বললো,
“তুমি সত্যি রাজী?”
“জ্বী স্যার, আমি রাজী”
“বেশ, কাল তবে তোমরা এই অপারেশনটি করবে। অপারেশনটি হবে। আমি ঢাকা থেকে কিছু ভালো ক্যামেরা এবং ভয়েস রেকর্ডিং পেন এনে দিবো। মনে থাকে যেনো, সাবধানে। প্রচুর রিস্কি একটা কাজ। এরা কিন্তু মানুষ রুপী হিংস্র জানোয়ার।”

রাজশ্বী সম্মতি প্রদান করলো। কিন্তু সুমনের মুখখানা চুপসে গেলো। তার ভয় হচ্ছে। সে মানুষ রাতারাতি মানুষের গলা কেটে দেয় তারা কতটা ভয়ংকর ধারনার অতীত………

চলবে

#উমা [কপি করা নিষেধ]
#৫২তম_পর্ব

রাজশ্বী সম্মতি প্রদান করলো। কিন্তু সুমনের মুখখানা চুপসে গেলো। তার ভয় হচ্ছে। সে মানুষ রাতারাতি মানুষের গলা কেটে দেয় তারা কতটা ভয়ংকর ধারনার অতীত। নিকষকৃষ্ণ মৃত্যুর ভয় তার হৃদয়কে কাবু করছে, না জানি কি অপেক্ষা করছে তাদের জন্য____

গুদামের চেয়ারে বসে রয়েছে রুদ্র। টেবিলে এলোমেলো হয়ে রয়েছে কিছু জমির মাঠ পর্চা রয়েছে৷ সামনে আধ খাওয়া র’চায়ের কাপ এবং খোলা সিগারেটের প্যাকেট। আঙ্গুলের ফাঁকে অর্ধজ্বলন্ত সিগারেট৷ শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে সে সিলিং এর পানে। চোখ জোড়া বসে গিয়েছে তার। ঘুম নামক শব্দটি হারিয়ে গেছে চোখ থেকে। এই ক দিন ঘুম হচ্ছে না; গুদামের চৌকিতে ঘুম আসে না রুদ্রের। সেদিনের পর থেকে বাড়ি যাওয়া হয় নি। ইচ্ছে করেই যায় নি রুদ্র। উমার শীতল দৃষ্টি তাকে গ্রাস করে, বুকের যন্ত্রণা কমার বদলে বৃদ্ধি হয়৷ এক মূহুর্ত সব কিছু এলো মেলো করে দিয়েছে যেনো। সাজানো দুনিয়াটা কাঁচের মতো ভেঙ্গে গিয়েছে। এতোদিনের সব পরিকল্পনা মূহুর্তেই ফাস হয়ে গিয়েছিলো। চারটা বছর ভালোবাসার উষ্ণ চাঁদরে ঢেকে রেখেছিলো উমাকে। নিজের পশুপ্রবৃত্তিকে নিপুণভাবে ঢেকে রেখেছিলো রুদ্র। চায় নি উমা জানুক এই নোংরা বাস্তবতা। এই নির্মম ধরাতে ভালো মানুষের অস্তিত্ব নেই, এখানে টাকা, ক্ষমতা, বলের রাজত্ব। রুদ্র এই নোংরামি থেকে নিজেকে কখনোই পৃথক করতে পারে নি। যত উপরে উঠেছে তত রক্তাক্ত হয়েছে তার জমিন, এখন রক্তকে ভয় পায় না সে। একটা সময় ছিলো মানুষের মৃত্যু সহ্য করতে পারতো না সে, কিন্তু এখন নিজ হাতে কাউকে মারতেও হয়তো হাত কাঁপবে না। উমার কাছে প্রতীজ্ঞা করেছিলো এই হাতে কখনো কারোর রক্তে রক্তিম করবে না। কিন্তু সেই প্রতীজ্ঞা সেদিন ই ভেঙ্গে গিয়েছে যখন নিজ হাতে বাদলকে শাস্তি দিয়েছে। যমের দোয়ারে ফেলে এসেছিলো তাকে। এই তো বছর দেড়েক আগে তার মৃত্যুর খবর কানে এলো রুদ্রের। অথচ এক ফোঁটা জল গড়ায় নি। বরং এক পৈচাশিক আনন্দ অনুভব করেছে রুদ্র। বাদলের পর ঠিক কয়জনকে এভাবে শাস্তি দিয়েছে তার কোনো ঠিক নেই। শত্রু বা প্রতারক; যারা তার ক্ষতি করতে এসেছে তাদের ই যমের দোয়ারে পচার জন্য ফেলে দিয়েছে রুদ্র। এর মাঝেই শাবীবের আগমণ ঘটে। রুদ্রকে চোখ বুঝে থাকতে দেখে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। রুদ্রের শুকনো মুখখানা দেখে তার মায়া হয়। নিজের বন্ধুকে এভাবে দেখতে ভালো লাগছে না তার। শুকনো চোখ, বিক্ষিপ্ত হৃদয় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে। খাওয়ার ঠিক নেই, না আছে ঘুমের ঠিক। ময়লা শার্টটা বদলায় নি অবধি। যার দাপটে মানুষ ভয়ে কুকড়ে উঠে তার এমন অবস্থা দেখে ব্যথিত হয় শাবীব। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুদ্রের কাছে যায় সে। গলা খাকাড়ি দয়ে লাফিয়ে উঠে রুদ্র। শাবীবকে দেখে নড়ে চড়ে উঠে সে। কাগজগুছাতে গুছাতে শাবীব বললো,
“বাড়ি গেলেই তো পারিশ, এখানে ঝিমুনির থেকে বাড়ি গিয়ে একটু জিরিয়ে আয়”
“বেশি বকিস না, আরেক কাপ চা দিতে বলিস তো। চা টা বিস্বাদ লাগছে। এতো অখাদ্য কেউ চা বানায়?”
“চায়ের কি দোষ? চা তো চায়ের মতোই হবে। বিগত বিশ বছর ধরে এভাবেই চা খাও তুমি। এখন অখাদ্য লাগার কারণ চা নয়, কারণ তোমার বুকের অশান্তি। এভাবে আর কতোদিন রুদ্র? তুই এখানে কষ্ট পাচ্ছিস, উমা ওখানে! সত্যিটা ওকে বলে দিলে হয় না?”
“কি লাভ? কি লাভ হবে তাতে?”
“উমা তোকে ভালোবাসে, তোকে বুঝবে। তোকে ঘৃণা তো করবে না। শুধু শুধু মেয়েটির চোখে নিজের ঘৃণার পাত্র কেনো করতেছিস!”

রুদ্র মলিন হাসি হাসে। বুকের যন্ত্রণা ফুটে উঠে সেই হাসিতে। আজ প্রথমবার রুদ্র নিজের খোলস ছেড়েছে, স্পষ্ট দর্পনের মতো তার হৃদয়ের আঙ্গিনা দেখতে পারছে শাবীব। রুদ্রের স্বচ্ছ চোখে মনের কোনে জমা কষ্টের ঘড়াটি উপছে পরছে। রুদ্র ধীর স্বরে বললো,
“উমা একটি নিস্কলুষ ফুল শাবীব, আমি চাই না সে আমার মতো কলুষিত ফুলের সাথে মিশে কলুষিত হোক। হ্যা, হয়তো ভালোবাসে বিধায় আমার সব কিছু সে মুখ বুজে মেনে নিবে। কিন্তু প্রতিনিয়ত নিজের অন্তরাত্মার সাথে ওকে লড়াই করতে হবে। যেমনটা আমাকে করতে হয়। আমি প্রতি প্রভাতে ভাবি, আমি সাধারণ জীবন কাটাবো। যেখানে আমাকে কারোর রক্তের হলি খেলতে হবে না। কিন্তু হয় না জানিস তো। নোংরা কাঁদায় নেমে বলবো হাত ময়লা করবো না; তা কি হয়! একটা সময় এই হাত নোংরা হবেই। আমরা যে নোংরার মধ্যেই থাকি রে”

রুদ্রের চোখ চিকচিক করছে। তার শুকনো ঠোঁট জোড়ায় বিষাদের এক চিলতে হাসি। শাবীব এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রুদ্রের দিকে। মানুষ এক বার যে পথ বেঁছে নেয় সেই পথ থেকে ফেরা সত্যি কঠিন_______

২৬.
সংগঠনে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে উমা। বহুদিন পর সে সংগঠনে যাচ্ছে। শেষ গিয়েছিলো বহু দিন পূর্বে। গতরাতে শিউলি তাকে ফোন করেছিলো। হুট করে অনেক মহিলা এখন তাদের সংঘটনের কাজের সন্ধানে আসছে। গত সম্মেলনটি বেশ সফল হয়েছে। শুধু তাই নয় বাহিরের একজন এজেন্সিও তাদের সাথে যোগাযোগ করেছে। বেশ মোটা অংকের একটি ডোনেশন আসতে চলেছে। তাই আজ উমার সেখানে যাওয়া খুব ই দরকার। বর্তমানে সাড়ে চার মাস চলে উমার। পেটটা ভারী হয়েছে। খানিকটা বেড়েছে, এখন হাটাহাটি করলেই ক্লান্ত হয়ে যায় সে। কিন্তু তবুও আজ বের হবে। কারণ শিউলীকে নিয়ে একবার স্বাস্থ্য কেন্দ্রের দিকে যাবে সে। সাথে রুদ্রের নতুন জমিগুলোর ব্যাপারেও তার খোঁজ নিতে হবে। মনের মাঝে এক গভীর সন্দেহ দলা পাঁকাচ্ছে, শিবপুরের ভূমিদস্যুতায় রুদ্র জড়িত কি না! রুদ্রকে প্রশ্ন করলে সে কখনোই উত্তর দিবে না। কিন্তু উমার সত্যটা জানার খুব প্রয়োজন। দরজায় কড়া নাড়লে তার চিন্তায় ছেদ পড়ে। আয়না দিয়ে তাকালে রাজশ্বীকে দেখতে পায় সে। স্মিত হেসে বলে,
“কিছু বলবি রাজী?”
“তুমি কি কোথাও বের হচ্ছো?”
“হ্যা, সংঘটনের অফিসে যেতাম। কিছু বলবি?”

রাজশ্বী কিছু একটা ভেবে বলে,
“তোকে বহুদিন ধরে একটা কথা বলতাম দিদি, তোর সময় থাকলে একটু বসবি?”

উমা পেছনে ফিরে মনোযোগ দিয়ে তাকায় রাজশ্বীর দিকে। রাজশ্বী হাতের সাথে গাত ঘষছে। তার মুখখানা ফ্যাকাসে লাগছে। উমা গম্ভীর কন্ঠে বলে,
“আয়, বস।”

রাজশ্বী খাটে বসে। তার ভয় হচ্ছে। খুব বড় মিথ্যে বলতে যাচ্ছে সে। আজ রাতের স্ট্রিং অপারেশনের কথা শুনলে উমা কখনোই রাজি হবে না। তাই বাধ্য হয়ে মিথ্যে বলতে হবে তাকে। রাজশ্বী কিছু বলছে না বিধায় উমা বলে উঠে,
“কি হলো বলবি কিছু?”
“আসলে আজ আমার বান্ধবীর বাসায় থাকবো। তোমার কাছে অনুমতি চাইতে এলাম”

উমার ভ্রু কুচকে আসে। সে গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়,
“বান্ধবীর বাড়ি কেনো? আর কোন বান্ধবী?
” সুপ্তি, আমি সুপ্তির বাড়ি থাকবো। আগামী সপ্তাহে আমাদের পরীক্ষা আছে। কিছু সমস্যা ছিলো। একসাথে পড়লে সেই সমস্যাগুলোও সমাধান হবে। আর ইংলিশ লিটারেচার। জানোই তো কতটা কঠিন”
“কাল কখন আসবি?”
“সকাল ১০টা নাগাদ, চলে আসবো”
“ঠিক আছে আমি প্রদ্যুত দা কে পাঠিয়ে দিবো”
“লাগবে না, আমি নিজেই এসে যাবো”

প্রদ্যুতের কথায় অতি দ্রুত বাঁধ সাধে রাজশ্বী। উমার মন খচখচ করছে৷ কেনো যেনো মনে হলো রাজশ্বী মিথ্যে বলছে। কিন্তু পরমূহুর্তে নিজের ভ্রম ভেবে দমে গেলো সে। রাজশ্বীর মাথায় হাত বুলিয়ে বেড়িয়ে পড়লো সে। রাজশ্বীর মাঝে এক অপরাধ বোধ কাজ করছে কিন্তু দিদিকে চিন্তায় ফেলতে চায় না সে। আর এই প্রথম এতোবড়ো একটা কাজে যাচ্ছে সে। কোনো ভাবেই সেটিকে ভেস্তদিতে চায় না। সে দৃঢ় পণ করেছে এই ভূমিদস্যুতায় কে কে জড়িত তাদের বের করবেই!!!

উপজেলার স্বাস্থ্যে কেন্দ্রে পৌছালো উমা এবং শিউলী। হুট করে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে আসার কারণটি জানতে অনেকবার প্রশ্ন করেছিলো শিউলী। কিন্তু উমা উত্তর দেয় না। সেউত্তরে শুধু বলে,
“সময় হলে ঠিক জানতে পারবে।”

স্বাস্থ্য কেন্দ্রে পৌছাতেই শ্রাবণের সাথে দেখা হয় উমার। শ্রাবণও তদন্তের জন্যই এসেছিলো এখানে। শ্রাবণকে দেখতেই উমার মুখোভাব বদলে যায়৷ শ্রাবণ উমাকে দেখেই এগিয়ে আসে।৷ নমস্কার দিয়ে বলে,
“এ কি উমা দেবী যে, আপনাকে এখানে পারো কল্পনা করি নি, আমি আপনাকেই ফোন করতাম। কেমন আছেন?”
“ভালো আপনি কেমন আছেন?”
“আর কেমন, ডাক্তার রাকিবের কেসেই এখানে আসা।”
“ডাক্তার রাকিব?”
“যে আপনার গাড়ির সামনে পড়েছিলো। উনার নাম রাকিবুল আহমেদ”

ডাক্তারের কথায় উমার চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। উমা জানে লোকটিকে কারা উধাও করেছে। কিন্তু সেটা বলতে পারবে না। কারণ রুদ্র তাকে সঅরিয়ে ফেলেছে। সে জানেও না লোকগুলোকে কোথায় রেখেছে রুদ্র। শ্রাবণ এর মাঝেই বলে উঠে,
“নতুন যে কতো পর্দা খুলছে এই কেসের বলবেন না। ডা. রাকিব একজন অপভ্রষ্ট ডাক্তার ছিলেন। তার ক্লেমের তো অভাব নেই। অর্গান স্মাগলিং এর সাথে জড়িত সে। আমার তো মনে হয় তাদের সংস্থার ই কেউ ধরে নিয়ে গেছে।”

শ্রাবণের কথায় ঈষৎ কেঁপে উঠে উমা। মুখটি কেঁপে উঠে নিকষকৃষ্ণ ভয়ে। তবে কি রুদ্র এই সংস্থার সাথে জড়িত!!!

রাত ১০টা,
সুমন এবং রাজশ্বী লুকিয়ে রয়েছে কাঠের দোকানের পাশের ঝোঁপের আড়ালে। জানালা দিয়ে একটি কলম সুতোর মাধ্যমে ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। যারা দখল করেছে তারা দোকান তুলেছে বেশ কটা। তার মধ্যেই বিকেল হলে তাশের আড্ডা চলে। এরা জমি দখল করে চরা দামে বেঁচে দেয়। ভালো ভালো পার্টি কিনে নেয় সেই জমি। হাটু অবধি পানির জমির ও দাম আগুনের মতো। সুমনের খেচরের মতে আজ রাতে জমি বেঁচা কেনার কাজ চলবে। এদের আসল লিডার অনেকেই রয়েছে। কেউ দখল করে, কেউ মানুষকে ভয় দেখায়, তো কেউ বিক্রি করে। সুমনের দুজন জুনিয়ার খরিদ্দার সেজে আসবে। সেই ফাঁকে সুমন এবং রাজশ্বী তাদের সব কথাগুলো রেকর্ড এবং ছবি তুলে নিবে। ছক পাতা হয়ে গিয়েছে। এখন শুধু মূল চরিত্রের আগমণ বাকি। ক্যামেরা হাতে অপেক্ষা করছে রাজশ্বী। হঠাৎ চার পাঁচ জন লোক ঘরে ঢুকলো। জানালার শিক দিয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তাদের মাঝে একজনকে দেখে রাজশ্বীর চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। ধীর স্বরে বেড়িয়ে এলো,
” দীপঙ্কর দা……….

চলবে।