উমা পর্ব-৫৪

0
466

#উমা [কপি করা নিষেধ]
#৫৪তম_পর্ব

পানের বরজের ভেতরে হাটু গেড়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকাটা খুব সহজ কার্য নয়। তার কপালে ঘাম জমছে, ফাগুনের শীতল রাতেও ঘামছে সে। গলাটা শুকিয়ে আসছে ছুটার কারনে। এক এক জায়গায় তন্ন তন্ন করে খুজতে খুজতে এক পর্যায়ে একটি ছেলের চোখে পানের বরজে যায়। সে সিদ্ধান্ত নেয় পানের বরজে একবার দেখবে, সে টর্চ হাতে ঢুকে পড়ে বরজে। সমস্যাটি হয় আকারে, লোকটির স্বাস্থ্য অনুযায়ী পানের বরজটির আকার বেশ ছোট। যেকারণে শেষ পর্যন্ত যাওয়াটা মুশকিল হয়ে উঠে। লোকটির হাটুর ঘর্ষণ সন্নিকটে চলে এলো। ফলে রাজশ্বী এবং সুমনের হৃদস্পন্দন বাড়তে থাকে। মৃত্যু ভয়ে তাদের গলা শুকিয়ে যায়। পরমূহুর্তে কি ঘটতে চলেছে তার কোনো আন্দাজ নেই, ভয় হচ্ছে এই বুঝি যমের দর্শন হবে। রাজশ্বীর চোখে উমার প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠলো, অন্তরাত্না গ্লানিতে ভরে উঠলো। দিদির কাছে ক্ষমাটুকু চাওয়া হলো না তার। উমার কথা মনে পড়তেই হৃদয়ে শক্ত হয়ে উঠলো। নিজেই নিজেকে বুঝালো, এখন তার যমের দেখা পাবার সময় হয় নি, তার উপর হাজারো দায়িত্ব। শাশ্বত তাকে বিশ্বাস করে এতো বড় দায়িত্ব সপে দিয়েছে। সেই বিশ্বাসটুকুর মর্যাদা সে রাখবে। ভয় পেলে মস্তিষ্ক ধীর হয়ে যায়, ভয়ের মেঘ কাটলে উদ্দীপনার প্রভাত ফুটবে। রাজশ্বী কিছুক্ষণ চিন্তা করলো কিভাবে এই লোকদের ধ্যান অন্য দিকে নেওয়া যায়। তারপর মাটির খুচে কিছু নুড়ি, খোয়া কুড়িয়ে নিলো। তারপর ছুড়ে দিলো অনেক দূরে, গ্রামের মেয়ের নিশানা চুকলো না। শব্দ আসতেই সবার নজর গেলো দূরে। বাইরে থাকা ছেলেগুলো বললো,
“এই বের হো, ওদিকে গেছে হয়তো”

সময় নষ্ট না করে লোকটি বেড়িয়ে পড়লো পানের বরজ থেকে। হাফ ছাড়লো সুমন এবং রাজশ্বী। ভয়ে শ্বাসরোধ হয়ে আসছিলো তাদের। সুমন ধীর স্বরে বললো,
“তোমার তো সেই বুদ্ধি, কি সুন্দর করে ওদের দৃষ্টি সরিয়ে নিলে। কিন্তু আমরা এখান থেকে বের হবো কি করে?”

সুমনের প্রশ্নের উত্তর নিজের জানা নেই রাজশ্বীর। এভাবে কেটে যায় বহু সময়, রাতের গভীরতা বাড়তে থাকে। রাজশ্বীর হাটুতে টান লাগছে, একটু নড়ে বসলে হয়ত ভালো হতো। তাই একটু নড়ে আসন গেড়ে বসে সে। পানের ফাঁকে আকাশের দিকে চায়, এখান থেকে বের হবার কি আদৌ ও কোনো উপায় আছে। নিঝুম রাতে ঝিঝিদের মনোরম ধ্বনি কানে আসছে, সেই সাথে এক থমথমে গরম হাওয়া বইছে। বিপদের গুমোট বাণী যেনো ধেয়ে আসছে। সকালের সূর্য না উঠলে হয়তো এখান থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়। তীব্র প্রতিকূল পরিবেশে মস্তিষ্কের স্নায়ু শ্লথ গতিতে কাজ করে, সামনে উপায় থাকা সত্ত্বেও নজরে পড়ে না। এর মাঝে সুমন নিজের মোবাইলখানা বের করে। নেটওয়ার্কের একটি ডান্ডা মাথা উঁচিয়ে আছে। এই এক মাত্রা নিয়েই সে শাশ্বতকে ফোন দেবার চেষ্টা চালায়। যদি শাশ্বত কোনো উপায় বের করে। কিন্তু কোনো ভাবেই তার ফোনটিতে সংযোগ পায় না। সেই সময়ে রাজশ্বীর স্মরণ হয়, রুদ্রের কথাটি। বিপদের এই নিকষকৃষ্ণ আধারে আশার এক কুসুমপ্রভা দেখতে পায় রাজশ্বী। কাঁপা হস্তে ফোন লাগায় রুদ্রকে। বেশ কবার বাজার পর রুদ্র ফোনটি তুলে, ক্লান্ত কন্ঠে বলে,
“নমস্কার কে বলছেন?”
“জামাইবাবু, আমি রাজশ্বী”

রাজশ্বীর ভীত কন্ঠ কর্ণপাত হতেই রুদ্র নড়ে চড়ে উঠে,
“কি হয়েছে রাজশ্বী? তোমার কন্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেনো?”
“জামাইবাবু, মহাবিপদে পড়েছি। খুব ভয়ঙ্কর কিছু লোক আমাদের পিছনে লেগেছে। কোনো মতে একটা পানের বরজে লুকিয়ে রয়েছি। উপায়ন্তর না পেয়ে ফোন করেছি। দয়া করে আমাদের বাঁচান”
“শাশ্বত কোথায়?”
“স্যার, এখানে নেই। অনেক কথা জামাইবাবু। এতো কথা বলার সময় নেই। দয়া করে আমাদের বাঁচান”
“কোথায় আছো এখন?”
“শিবপুরের এখানে। মন্দিরের কাছাকাছি একটা জায়গায়”
“ওখানেই লুকিয়ে থাকো। আমি আসছি”

বলেই রুদ্র ফোন রেখে দিলো। নিজের গাড়ির চাবিটা নিয়ে গুদাম থেকে বের হতে নিলে রক্তিমের সাথে দেখা হয়। রক্তিম এতো রাতে রুদ্রকে বেড়িয়ে যেতে দেখে প্রশ্ন করে উঠে,
“বাড়ি যাচ্ছিস নাকি রুদ্র?”
“শাবীব কোথায় রে?”
“ও তো বাড়ি গিয়েছে, আসবে রাতে। তুই কোথায় যাচ্ছিস?”
“আমার সাথে চল, যেতে যেতে বলছি”

রক্তিম আর প্রশ্ন করলো না। সাথে সাথেই বেড়িয়ে গেলো। গাড়ির বেগ বাড়ালো রুদ্র। আধারের পথ চিরে গাড়ি ছুটলো শিবপুরের দিকে__________


রাত গভীর হয়েছে, মিনু এবং ফুলির মা খেয়ে শুয়ে পড়েছে। উমা গোপালের ঘরের বাতি বন্ধ করে দিলো। সে বই বুকে নিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। ছেলেটার একটা সমস্যা পড়ার সময় ঘুম আসে। আজও তাই হলো। বাংলা ব্যাকরণের বই বুকে নিয়েই ঘুমোচ্ছে সে। উমা কাঁথা টেনে দিলো তাকে। তারপর সে চলে গেলো রুদ্রের কাজের ঘরে। একে একে সব ফাইল কাগজ বের করতে লাগলো সে। শ্রাবণের কাছে আজ যা যা শুনেছে তার পর কাধ ঝেড়ে হাতে হাত রেখে বসে থাকাটা সম্ভব নয় উমার পক্ষে, সত্যটা বের করতেই হবে। রুদ্রের টেবিলের ডেস্কের মোট দু খানা চাবি, যার একটি সর্বদা তার কাছেই থাকে, আরেকটি থাকে কার্পেটের নিচে। খুব কষ্টে নিচু হয় উমা। ভারী পেট ছেপে চাবিটা বের করে। তারপর রুদ্রের ডেস্ক খুলে সে। এক এক করে রুদ্রের সকল কাগজ বের করে সে। বেশ কিছু দালানের নকশা পায় উমা। প্রতিটি দালানের নিচেই কোনো না কোনো সুরঙ্গ রয়েছে। চেয়ারম্যান বাড়ির পাতালঘরের মতই এই সুরঙ্গগুলো। বেশ কিছু বের করে উমা। প্রতিটি দলিলের ক্রয়কারী রুদ্র সিংহ রায় এবং উমা রায়। বেশ কিছু নকশা করা, স্কুল, কলেজ, কারখানার। উমার মস্তিষ্ক কাজ করছে না। যদি রুদ্র জমি দখল করে নেয় তবে কেনো তার নাম এবং উমার নাম ক্রয়কারীর স্থানে। এর মাঝেই তিনটি খাদি খাম হাতে পড়ে উমার। খামগুলো খুলতেই বেশ কিছু ব্যাক্তির ছবি সহ তথ্য বেড়য়ে যায়। তার মাঝে বেশ কিছু লোকের মুখে ক্রস চিহ্ণ দেওয়া, বেশ কিছু লোকের মুখে গোল চিহ্ন দেওয়া। পাতা সরা্তে সরাতে ডাক্তার রকিবের ছবিও ভেসে উঠে। তার মুখে ক্রস দেওয়া। বহু সময় ধরে খোঁজার পর অর্গান স্মাগলিং এর কিছুই পায় নি। তখন ঘরের বেল বেজে উঠে। উমার মনে হয় রুদ্র বুঝি এসেছে। তাড়াতাড়ি খামগুলো ব্যাতীত সব কিছু গুছিয়ে নিলো উমা। তারপর দরজাটি খুলে সে। দরজা খুলতে শাবীবকে দেখে ভ্রু কুচকে আসে উমার। অবাক কন্ঠে সে প্রশ্ন করে,
“শাবীব দা, আপনি এত রাতে?”
“রুদ্র বাড়িতে এসেছে?”
“না, আপনার বন্ধু তো বাড়িতে নেই।“
“ওহ, না আসলে ও গুদামেও নেই। ফোনটাও ধরছে না। তাই ভাবলাম ও বাড়িতে এসেছে কিনা। উমা তোমার কিছু কথা বলতাম?”

উমা দরজা আকড়েই দাঁড়িয়ে রইলো। তার চোখে হিংস্র দৃষ্টি। শাবীব দৃষ্টির কারণটা বুঝতে পেরে বললো,
“ভয় পেও না, আমি কিছু করবো না। শুধু রুদ্রের ব্যাপারে কিছু কথা বলতাম।“

উমা কিছু ভেবে বললো,
“বেশ আসুন, আমার ও আপনার সাথে কথা রয়েছে। বসুন”

শাবীব বসতেই খাম গুলো তার সামনে রাখে উমা। কঠিন জড়তাহীন কন্ঠে বলে উঠে,
“এসব কি শাবীব দা? উনি কেনো এমন পশুর মতো কাজগুলো করেন? উনি কি কোনো সংস্থার সাথে জড়িত? আমার উত্তর চাই। সে তো আমাকে উত্তর দিবে না কখনো, আপনি দিন। নয়তো এই সব নিয়ে আমি পুলিশের কাছে যাবো। অন্যায়ের সাথে আপোশ আমি করি নি, করবোও না। যদি সে অন্যায় করে থাকে সেই শাস্তি সে পাবে।“
“তোমার পুলিশেরা কিছুই করবে না। আইন শুধু ক্ষমতার কাছেই নত হয়। তাই সেই ক্ষমতা অর্জনের প্রতিযোগীতায় নেমেছে রুদ্র। যাদের ছবি দেখছো, তারা সবাই সেই ক্ষমতাশীল মানুষের কজন, যাদের টাকা এবং ক্ষমতার জোড়ে তাদের টিকিটিও ধরতে পারে না পুলিশ। হ্যা, এই রুদ্র অন্যায় করে। কিন্তু সেই অন্যায়কে কি আদৌ অন্যায়ের কাতারে ফেলা যায় উমা? আমার বোনের এপেনডিসাইটের ব্যাথা হয়েছিলো। আমি তাকে ওই ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। ডাক্তার অপারেশনের কথা বলে। আমরা রাজীও হই, বেশ কিছু বন্ডে সাইন ও করি। বোনের অবস্থার কারণে আমরা এতোকিছু ভাবিও নি। কিন্তু ওই জানোয়ার অপারেশন করে আমার বোনের একটি কিডনী খুলে নিয়ে যায়। যখন বোনের স্বাস্থের কোনো উন্নতি হয় নি তখন রুদ্র ভালো একটি ডাক্তার দেখায় তাকে। সেই ডাক্তার জানায় আমার বোনের একটি কিডনী নেই। পুলিশের কাছে গেলে ডাক্তার আমাদের বন্ড দেখায়। আমরা নাকি স্বেচ্ছায় আমার বোনের কিডনীর ডোনেশনের জন্য সাইন করেছি। এবার বলো, তাকে কিভাবে শাস্তি দেওয়া উচিত? হ্যা রুদ্র কখনো সোজা পথে চলে না। নিজের পরিবারকে বাঁচাতে তাকে অসুর হতে হলেও সে হতে ভয় পায় না। নিজের বাবাকেও সে ছাড়ে নি। অভিনব সিংহ আজ জেলের ভেতর একমাত্র রুদ্রের জন্য। আর ওই শিবপুরের জমি, সেটা ভূমিদস্যুদের কাছ থেকে তোমার নামে জমিগুলো নিয়েছে রুদ্র। তোমাদের সন্তানের কথা ভেবে এই কাজগুলো করেছে সে। তোমার হাতে সেই চাষের জমি সে বিতরণ করার কথা চিন্তা করেছিলো। হ্যা, রুদ্র ভালো নয়। তোমাদের মহাভারতেও তো অর্জুন নিজের হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলো। সে কি খুনী ছিলো উমা? এটা রাজনীতি উমা, হয় তুমি তাকে হারাবে, নয়তো অপর মানুষ তোমাকে পায়ে তলিয়ে দিবে। রুদ্রের শত্রুর অভাব নেই, তোমাদের বাঁচাতেই সে এমন। আশাকরি উত্তর টা পেয়েছো”

উমা চুপ করে আছে, তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। অনুভব করলো তার গালটা ভিজে এসেছে। ঠিক সেই সময় রুদ্র এবং রাজশ্বী দরজা ঠেলে ঘরে প্রবেশ করে। উমা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় তাদের দিকে, রুদ্র এবং রাজশ্বীর অবস্থা দেখে কৌতুহলী হয়ে উঠে উমা। এগিয়ে যায় তাদের কাছে। রাজশ্বীর সালোয়ার কাঁদায় ভরে গিয়েছে। ময়লা জামাটা নিচের দিকে হালকা ছিড়ে গেছে। রুদ্রের গায়ে রক্তের ছিটা স্পষ্ট। বা হাত থেকে তরতর করে রজত পড়ছে। উমা তখন……………

চলবে।