উষসী হাসবে বলে পর্ব-০২

0
333

#উষসী_হাসবে_বলে (২)
লিখা- Sidratul Muntaz

সিএনজি’তে গাদাগাদি করে বসেছে তারা পাঁচজন। বাকি পাঁচজন দ্বিতীয় সিএনজিতে। ইফাত মজা করে গান ধরল,” আমায় বেবিওয়ালায় খাইছেরে সামনে বসায়া…”

প্রীতি চেঁচিয়ে উঠল,” ছি, তুই এই বাজে গানটাই ধরলি খুঁজে খুঁজে?”

জায়িন ঠাট্টার সুরে বলল,”মজাই তো লাগছে। পরের লাইন কি হবে দোস্ত?”

ইফাত দ্বিগুণ উৎসাহে আবার গাইল,” বারে বারে ব্রেক মারে নরম জায়গা পাইয়া…”

প্রীতি কান চেপে ধরল,”তোরা এতো চীপ! এই ইফাত আমি কিন্তু ধাক্কা মেরে ফেলে দিবো মুখ বন্ধ না করলে।”

ইফাত রুঢ় গলায় বলল,” ন্যাকামি কম কর। এই গান তোর চেয়েও পপুলার।”

” তোদের মতো কামলাদের জন্যই পপুলার হয় এসব গান।”

জায়িন আর ফয়সাল হাসছে। উষসী চুপ করে বসে আছে। তার মাথা ধরেছে। এখানে শুধু সে আর প্রীতি। যুঁথি আর শম্পা দ্বিতীয় সিএনজিতে। প্রীতমও তাদের সাথে। উষসী ইচ্ছে করেই প্রীতমদের সিএনজিতে ওঠেনি। সে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে প্রীতমকে এড়িয়ে চলার। তাদের গন্তব্য ‘বালিশিরা’ রিসোর্ট। সেখানকার ছাদে আজ কনসার্ট হবে। টিকিটের দাম খুব চড়া। তবুও সবাই কিনেছে। তাদের এবারের ট্যুরটা সবচেয়ে স্মরণীয় হতে যাচ্ছে।

খোলা আকাশের নিচে কার্পেটের উপর সারিবদ্ধভাবে সাজানো চেয়ারে বসে আছে শ্রোতারা। নিচেও মানুষের উপচে পড়া ভীড়। সবচেয়ে দামী টিকিট যারা কেটেছে তারাই রুফটপে স্থান পেয়েছে। উষসীরা সেখানে জায়গা পায়নি। তাই তারা বসেছে নিচে।

যুঁথি একরাশ আফসোস নিয়ে বলল,” এখান থেকে দেখতে তো ইয়ামিন ইব্রাহীমকে চাঁদের চেয়েও ছোট লাগবে।”

শম্পা বলল,” কিছু করার নেই। তবুও আমাদের ভাগ্য ভালো যে দুপুরে পারসোনালি মিট করতে পেরেছিলাম। তুই তো জড়িয়েও ধরেছিস।”

উষসী বলল,” ধূর, তোরা শোন এসব ছাইপাশ। আমার গান শুনতে ভালো লাগছে না। মাথা ধরে যাচ্ছে, এতো হৈচৈ এখানে!”

প্রীতম শান্ত গলায় বলল,” তুই চাইলে আমরা ওদিকে হাঁটতে যেতে পারি। জায়গাটা সুন্দর আছে। ঘুরে ঘুরে একটু দেখলাম!”

উষসী মুখ ভার করে বলল,” দরকার নেই।”

সে চুপচাপ বসে রইল নিজের জায়গায়। প্রীতম একটু হাসল। সে জানতো উষসী যেতে রাজি হবে না। তবু একটু বলে দেখল।

গিটার হাতে ইয়ামিন ইব্রাহীম উপস্থিত হতেই শোরগোল পড়ে যায় চারদিকে। তার গায়ে লেমন রঙের পাঞ্জাবী। স্টেজ অনেক উঁচুতে হওয়ায় নিচের মানুষেরাও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে তাকে। গান শোনার চেয়েও ছবি তোলায় আগ্রহ বেশি মানুষেরা ফোন তাঁক করে রেখেছে উপরে। যুঁথিরা একদম উঠে দাঁড়িয়ে যায়। ইয়ামিনের সাথে গলা মিলিয়ে গান গাইতে শুরু করে। সুরে সুরে হাত তালি বাজিয়ে যায় ভক্তকূল।

উষসী বসে আছে শান্ত হয়ে। প্রীতমও চুপচাপ। পরপর তিনটি জমজমাট গান শেষ করতেই শ্রোতাদের অনুরোধে ইয়ামিন একটা বাংলা গান ধরে। সাথে সাথেই যেন বদলে যায় পরিবেশ। হল্লা থামিয়ে নিশ্চুপ হয়ে যায় সকলে। ঝুপ করেই নেমে আসে নীরবতা। বাঁকা চাঁদের মায়াবী আলোয় সবুজ ঘেরা রিসোর্টটি সহসা আবেগময় রঙ ধারণ করে। প্রত্যেকেই বসে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে থাকে আবেগ ঝরা কণ্ঠে গাওয়া গান। বাংলা ভাষায় এমন এক মাধ্যুর্যতা আর মায়া আছে যা অন্যকোথাও নেই।

গানগুলো শুনতে শুনতে উষসীর চোখে জল চলে আসে। বন্ধুদের সামনে সে একটু লজ্জায় পড়ে যায়। প্রথমে তো কনসার্টে আসতেই চায়নি। অথচ এখন গান শুনে নিজেই কাঁদছে। যুঁথি দেখলে সাথে সাথে বলে বসবে,” দেখলি তো,ইয়ামিন ইব্রাহীমের কণ্ঠে জাদু আছে। তার গান শুনে তুইও কেঁদে ফেললি। ”

গান শোনায় সবাই এতো বিভোর যে কেউ কাউকে লক্ষ্য করছে না। এই ফাঁকে উষসী উঠে নির্জনে চলে আসে। ভীড় ভালো লাগছে না তার। এখান থেকেও গান স্পষ্ট শোনা যায়। অতীতের বিচ্ছিন্ন স্মৃতিগুলো একে একে হানা দেয় উষসীর মনে। সেটা আদৌ প্রেম ছিল কি-না সে জানে না। কিন্তু মানুষটা তার নরম মনে ক্ষত এঁকেছিল গভীরভাবে। সেই ঘা হয়তো আজও শুকায়নি। তাইতো উষসী স্মৃতিকাতরতায় কাঁদছে এখনও।

কনসার্ট শেষ হলো গভীর রাতে। প্রত্যেকেই ক্লান্ত। ইয়ামিন ভেতরে চলে যেতেই ভীড় কমতে শুরু করে। যুঁথি উল্লাস নিয়ে বলল,” লাইট গ্রীন পাঞ্জাবীতে কি জোস লাগছিল তাকে তাই না? আমি তো একদম ফিদাহ।”

প্রীতি বলল,” আমি তো গান শুনেই কাইত। লাস্ট গানটা কি অসাম ছিল নারে!”

শম্পা আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়ায়। হাই তুলে বলল,” এই ট্রিপটা বেস্ট এভার।”

হঠাৎ প্রীতম এসে উত্তেজিত গলায় জিজ্ঞাসা করল,” উষুকে দেখেছিস কেউ?”

মুহূর্তেই প্রত্যেকের চেহারায় অস্থিরতা খেলে যায়। আসলেই উষসীকে অনেকক্ষণ ধরে দেখা যাচ্ছে না। প্রীতি বলল,” ওয়াশরুমে নাকি? আমি চেক করে আসি।”

শম্পা বলল,” আমিও যাবো তোর সাথে।”

প্রীতম ব্যাকুল হয়ে যায়। সাতবন্ধু সাতদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ফয়সাল বুদ্ধি করে বলল,” ফোন দিলেই তো হয়।”

যুঁথি বলল,” কিন্তু উষুর ফোন আমার কাছে!”

“ওহ শিট!” প্রীতম বেসামালের মতো এদিক-সেদিক যেতে থাকে। কিন্তু উষসীকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। মেয়েটা যেন হাওয়ায় মিশে গেছে। একটু পর শম্পা আর প্রীতি এসে জানায়, বাথরুমেও উষসী নেই। সকলের দুশ্চিন্তার মাত্রা গাঢ় হয়। প্রীতম দৌড়ে কোথাও যেতে থাকে। তার পক্ষে বসে থাকা সম্ভব না।

প্রেস থেকে সাংবাদিকরা এসেছে। যেই মেয়েটি ইয়ামিনের ইন্টারভ্যু নেবে তার নাম অথৈ। বেশ জমকালো সাজ দিয়েছে সে। প্রচন্ড উত্তেজনায় তার একটু নর্ভাস লাগছে। কারণ সে নিজেও কখনও ইয়ামিন ইব্রাহীমকে সামনা-সামনি দেখেনি। এয়ারকন্ডিশনের কাছে বসেও কিছুটা ঘামছে সে। মেকাপম্যান টিস্যু দিয়ে তার ঘাম মুছে দিচ্ছে।

ঘরে এসেই বিছানায় গা এলিয়ে দেয় ইয়ামিন। অবসন্নবোধ হচ্ছে তার। আগামীকাল খুব ভোরে উঠতে হবে। শ্রীমঙ্গল ঘুরে দেখার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সিলেট এসেছিল। শীতকালে শ্রীমঙ্গলের সৌন্দর্য্য অন্যরকম থাকে। অবশ্য বাংলাদেশের শীত মানে দিনে রোদ রাতে কুয়াশা! আর মাঝে মাঝে বৃষ্টি।

ডানপাশের ক্যানভাসের দিকে চোখ যেতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয় বুক চিড়ে। পানির মধ্যে ভাসমান একটা নারী অবয়ব দেখা যাচ্ছে। স্বচ্ছ জলের চেয়েও সুন্দর হবে নারীটির স্বচ্ছ মুখ। ছবিটা খুব অনন্য হতে পারতো যদি ইয়ামিন রমণীর ওই অপরূপ স্বচ্ছ মুখশ্রী কল্পনা করতে পারতো। গত আটমাস ধরে চমৎকার এই পেইন্টিংটি অসম্পূর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে। কিছুতেই উপযুক্ত সেই মুখ কল্পনায় আসছে না। দিঘীর জলের মতো সুন্দর, টলটলে, প্রাণবন্ত গভীর দুই চোখসহ একটা নারীমুখ কল্পনা করা কি এতোই কঠিন?

দরজায় ঠকঠক শব্দ হলো। হাতে শরবতের গ্লাস নিয়ে ঢুকল ইউনিফর্ম পরিহিত একটি মেয়ে। মাথা নত করে বেশ বিনয়ের সাথে বলল,” স্যার, প্রেস থেকে কিছু লোকজন এসেছে। আপনার ইন্টারভ্যু নিতে চায়।”

ইয়ামিন শরবতের গ্লাস নিতে নিতে বলল,” এখন তো খুব টায়ার্ড আমি। আপাতত আর বের হচ্ছি না। কাইন্ডলি উনাদের চলে যেতে বলুন।”

” ওকে স্যার। কিন্তু আপনার জন্য ভক্তরা অনেক গিফটস পাঠিয়েছে। সেগুলো কি রুফটপেই থাকবে নাকি লিভিংরুমে এনে রাখব?”

“আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। আমি আমার এসিসট্যান্টকে দিয়ে আনিয়ে নিবো সব।”

” ওকে।”

মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। ইয়ামিন প্রশ্ন করল” আর কিছু বলবেন?”

সে খুব ইতস্তত করে বলল,” স্যার আমি কি একটা অটোগ্রাফ পেতে পারি?”

তার হাত রীতিমতো কাঁপছে। সে লজ্জায় চোখ তুলে তাকাতেও পারছে না। ইয়ামিন মুচকি হেসে বলল,” নিশ্চয়ই পারেন।”

মেয়েটি সাথে সাথে খালি গ্লাস আর ডিশ টেবিলে রাখল। তারপর গা থেকে কোটিটা খুলে ফেলল। নিজের চুলগুলো সামনে এনে পিঠ বাড়িয়ে দিল। ইয়ামিন হতভম্ব হয়ে বলল,” কি ব্যাপার?”

মেয়েটি কাঁপা কণ্ঠে বলল,” অটোগ্রাফটা আমার পেছনে টি-শার্টের উপরে চাই।”

সে মার্কার পেন বের করল। ইয়ামিন বাধ্য হয়ে সেখানেই অটোগ্রাফ লিখল। একেক মানুষের একেক রকম চাহিদা। একবার তো এক মেয়ে এসে নিজের ঘাড়ের উপর অটোগ্রাফ চেয়ে বসেছিল।

” থ্যাঙ্কিউ সো মাচ স্যার।”

” মোস্ট ওয়েলকাম।”

অনম হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল। আরেকটু হলেই মেয়েটির সাথে ধাক্কা খেয়ে কাঁচের গ্লাস ভেঙে ফেলতে নিচ্ছিল সে। তার শরীর বেশ হাট্টাগোট্টা। উচ্চতায় একটু বেঁটেই বলা চলে। চলা-ফেরা দেখলে মনে হয় নিজের শরীরটা আগলাতে বেশ কষ্ট হয় তার।

ইয়ামিন বলল,” আস্তে চলো অনম, কি হয়েছে?”

অনম অস্থির ভঙ্গিতে বলল,” একটা বিরাট কান্ড হয়ে গেছে স্যার। এখনি বড় দূর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল। আমার গলা শুকিয়ে আসছে। মাথা ঘুরছে এখনও। হায় আল্লাহ… কি দেখলাম এটা? আপনি শুনলে তো অবাক হয়ে যাবেন।”

ইয়ামিন কঠিন চোখে তাকিয়ে আছে। অনম নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,” স্যরি স্যার।”

ইয়ামিন শীতল গলায় বলল,” ডিসক্লেমার বাদ দিয়ে মেইন পয়েন্ট বলো।”

অনম জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল একবার। তারপর বলল,” একটা মেয়ে স্যার। সু*ইসাইড করতে নিয়েছিল।”

” কোন মেয়ে?”

” ওইতো দুপুরে আপনার সাথে দেখা করতে এসেছিল যে… তাদের মধ্যেই একজন। আমি না ধরলে তো মেয়েটা উঁচু থেকে পড়েই যাচ্ছিল।”

” কোথায় সে এখন?”

” বাইরে আছে।”

” চলো তো গিয়ে দেখি কি ব্যাপার!”

ইয়ামিন এই কথা বলেই সামনে হাঁটতে লাগল। অনম আশা করেনি যে ইয়ামিন এই ঘটনার জন্য এখন ঘর থেকে বের হবে। আগে জানলে সে মেয়েটিকে ভেতরেই নিয়ে আসতো।

উষসী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশের মানুষ তার দিকে বড় বড় চোখে তাকাচ্ছে। বেশ অস্বস্তি লাগছে তার। অনম এসে বলল,” এক্সকিউজ মি ম্যাডাম, ভেতরে চলুন।”

” কেন?”

” স্যার আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।”

উষসী তীক্ষ্ণ গলায় বলল,” দেখুন… আপনি ভুল বুঝেছেন। ওইটা একটা ইন্সিডেন্ট ছিল। আমি সু*ইসাইড করতে যাইনি।”

” হুম। ধরা খেলে সবাই এমনই বলে।”

” আশ্চর্য তো! আমি আপনার সঙ্গে মিথ্যা কেন বলব? এতে আমার কি লাভ?”

” আচ্ছা মানলাম আপনি সত্যি বলছেন। তাও ভেতরে আসুন। স্যার আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছেন।”

লিভিংরুমের একটা সিঙ্গেল সোফায় বসে আছে ইয়ামিন। আগামীকাল কি কি করবে সেই নিয়ে একটা শিডিউল ফিক্সড করে ফেলছিল মনে মনেই। ঠিক তখনি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল উষসী। তার গায়ে কালো রঙের ভারী কাজ করা কামিজ। জর্জেটের ওরনা দিয়ে মাথা ঢাকা। তবুও কপালের উপর এলোমেলো চুল নজরে পড়ছে। ফরসা, নিখুঁত মুখ, চিকন নাক, থুতনির মাঝে খাঁজ, পাতলা আর মিষ্টি চেহারা।চোখের মণি ঘন কালো অথচ খুব স্বচ্ছ আর গভীর! ভ্রু কুঁচকে সে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন খুবই বিরক্ত।

ইয়ামিন গাঢ় দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছিল মেয়েটিকে। অনমের ডাকে তার ঘোর কা-টল,” স্যার, এটাই ওই মেয়ে।”

ইয়ামিন সামান্য চমকে বলল,” ও আচ্ছা। বসুন প্লিজ।”

উষসী যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে একটা সোফায় বসল। আঁড়চোখে একবার ইয়ামিনের মুখের দিকে তাকিয়েই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। ইয়ামিন বলল,” দুপুরের মেয়েগুলোর সাথে তো উনাকে দেখিনি।”

” জ্বী স্যার। ম্যাডাম অন্যপাশে ছিলেন। ভেতরে আসেননি। তাই হয়তো আপনি দেখেননি।”

ইয়ামিন একটু অবাকই হলো। তার সঙ্গে দেখা করতে এসেও কেউ ভেতরে ঢোকেনি, অটোগ্রাফ চায়নি, ছবি তোলেনি… ব্যাপারগুলো যেন অস্বাভাবিক। অবশ্য মেয়েটাকে দেখে কেমন বিষণ্ণ লাগছে। চট করেই ইয়ামিনের মনে হলো… এই মুখটা সে আগেও দেখেছে। ভীষণ চেনা!

” নাম কি আপনার?” কোমল গলায় জানতে চাইল ইয়ামিন।

উষসী ঝাঁজালো উত্তর দিল,” আমার নাম জানতে চাইছেন কেন? ”

” আপনি রাগ করছেন নাকি?”

” রাগার মতোই ব্যাপার। আপনার এই এসিস্ট্যান্ট একটু বেশিই বোঝে। আমি শুধু নিজের মতো একা একা হাঁটছিলাম। সু*ইসাইড করতে যাইনি। উনি উল্টো কথা বলায় সবাই এখন আমার দিকে অন্যভাবে তাকাচ্ছে।”

ইয়ামিন অনমের দিকে চাইল। অনম বিপর্যস্ত গলায় বলল,” স্যার, বিশ্বাস করুন। আমি নিজের হাতে ম্যাডামকে থামিয়েছি। নাহলে এতোক্ষণে…”

হাত দিয়ে উপরে ইশারা করল অনম। তার চোখ-মুখ হতাশায় ছেয়ে গেল। ইয়ামিন বলল,” তাহলে অনম যে বলছে আপনি উঁচু থেকে পড়ে যেতে নিচ্ছিলেন?”

” ওটা জাস্ট একটা ইন্সিডেন্ট। আমি অন্ধকারে ঠিক দেখতে পাইনি।”

” দেখেছেন স্যার? দূর্ঘটনা তো একটা ঘটতেই নিচ্ছিল আজকে। আমি ভুল কিছু করিনি।” নিজের হয়ে সাফাই গাইল অনম। ইয়ামিন তাকে থামিয়ে বলল,” তাহলে তো আমার এসিস্ট্যান্ট আপনার উপকারই করেছে। আপনার উচিৎ তাকে ধন্যবাদ দেওয়া। সেটা না করে উল্টা ব্লেইম করছেন কেন?”

উষসী অনমের দিকে তাকিয়ে বলল,” ধন্যবাদ। এবার কি আমি যেতে পারি?”

” জ্বী না।” খুব শান্ত গলায় বলল ইয়ামিন।

” কেন?”উষসী চোখ বড় করে তাকাল। ইয়ামিন মৃদু স্বরে বলল,” আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে এখনও কিছুটা আনস্টেবল। একটু বসুন। অনম আপনাকে পৌঁছে দিবে।”

” তার কোনো দরকার নাই। বাইরে আমার ফ্রেন্ডরা অপেক্ষায় আছে।”

” কনসার্ট অনেকক্ষণ আগে শেষ। হতে পারে তারা চলে গেছে।”

” অসম্ভব। আমাকে রেখে তারা কেন যাবে?”

ইয়ামিন অনমের দিকে চেয়ে বলল,” দেখোতো অনম… বাইরে কেউ আছে নাকি?”

উষসীর এবার একটু ভয় করতে লাগল। সত্যিই যদি তারা চলে গিয়ে থাকে? পরমুহূর্তেই আবার ভাবল এটা অসম্ভব। উষসীকে এখানে ফেলে তারা কেন যাবে? অনম বাইরে গেল। কিন্তু সে কাউকে খোঁজার চেষ্টা করল না। ভেতরের কথা শোনার অভিলাষে দরজার কাছেই কান পেতে দাঁড়িয়ে রইল।

ইয়ামিন গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,” আমার এসিস্ট্যান্ট আপনার জীবন বাঁচিয়েছে। বলা যায় আপনি এখন আমার কাছে দায়গ্রস্ত। জীবনের চেয়ে বড় দায় আর কি হতে পারে বলুন?”

উষসীর কপালে ভাঁজ সৃষ্টি হলো। সূচালো দৃষ্টিতে শুধাল,” মানে? কি বলতে চান?”

“বলতে চাই আপনি জীবনের দায়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে গেলেন আমার কাছে।”

উষসী ভ্রু উঁচু করে বলল,” তাহলে কি এখন আপনি ঋণের শোধ চাইছেন?”

” চাইতেই পারি।”

আশ্চর্য হলো উষসী। ইয়ামিন ইব্রাহীমের মতো একজন মানুষ তার মতো সাধারণ মেয়ের কাছে কি চাইতে পারে? তাকে দেওয়ার মতো কিইবা আছে উষসীর? কৌতুহল মেটাতেই সে প্রশ্ন করল,” কি চান আপনি আমার কাছে?”

“ঘণ্টাখানেক সময়।”

উষসী হতবাক। ইয়ামিন বলল,” যদি কিছু মনে না করেন…আমি আপনার একটা পোর্ট্রেট আঁকতে চাই।”

উষসী হাঁ করে তাকিয়ে আছে। মনে হলো লোকটা তার সঙ্গে তামাশা করছে। ইয়ামিন মৃদু হেসে বলল,” চিন্তার কিছু নেই। আমি বেশি সময় নেবো না। মাত্র এক ঘণ্টা!”

সে উত্তরের আশায় উষসীর দিকে তাকিয়ে আছে মুখে হাসি নিয়ে। উষসীর মেজাজ চড়ে গেল। সে রাগান্বিত ভঙ্গিতে বলে উঠল,” আপনি নিজেকে কি মনে করেন? সেলিব্রিটি বলেই আপনাকে সবাই ভাউ দিবে? আপনার আলতু-ফালতু কথা শুনে চলবে? আপনি যা বলবেন তাই করবে? আমি অন্যদের মতো না যে আপনার কথায় নাচব।”

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেই তড়াক করে উঠে দাঁড়াল সে। ইয়ামিনের উত্তরের তোয়াক্কাও না করে বেরিয়ে গেল কটেজ থেকে। বাইরে দাঁড়িয়ে এতোক্ষণ সব শুনছিল অনম। উষসী বের হতেই সে তড়বড় করে ভেতরে ঢুকল। ইয়ামিন মেয়েটার যাওয়ার পথে তাকিয়ে আনমনে হাসছে। মনে হয় এই প্রথম কেউ তার সাথে এতো রুক্ষভাবে কথা বলেছে। এই অভিজ্ঞতা তার কাছে নতুন।

অনমের হঠাৎ মনে হলো, তার স্যার কি এই অদ্ভুত মেয়েটার প্রেমে পড়ে গেল নাকি? মেয়েটা এমন বেয়াদবের মতো কথা বলে গেল অথচ স্যার হাসছেন! সর্বনাশ! সে কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলল,” বাইরে তো কেউ নেই স্যার। ম্যাডামকে যেতে দিলেন কেন?”

অনমের কথা শুনে ইয়ামিনের হাসি উজ্জ্বল হলো। সে ঘরে যেতে যেতে বলল,” দ্যাটস গুড। কাউকে খুঁজে না পেয়ে সে এখানেই ব্যাক করবে। কীপ এন আই অন হার।”

” প্রেসের লোকদের কি বলব স্যার?”

” যা মন চায় বলে দিও।”

এটুকু বলেই ঘরে ঢুকে যায় ইয়ামিন। অনম দ্রুত বাইরে বের হয়। উষসীর পেছন পেছন যেতে হবে তাকে।করিডোরের প্রবেশমুখে ইয়ামিনের বিশাল বড় একটা সাইনবোর্ড লাগানো। ছবিতে তার হাতে একটা মাইক। মুখে মৃদু হাসি। উষসী সেখানে এসেই থামল। রাগে শরীর ঘামছে। লোকটা তার পোর্ট্রেট আঁকতে চায় মানে! সে কি বলিউড কুইন ঐশ্বরিয়া? আশ্চর্য ব্যাপার তো!

সাইনবোর্ডের কাছে দাঁড়িয়ে ক্যামেরার সামনে কথা বলছে এক লাস্যময়ী সুন্দরী উপস্থাপিকা,” ইয়ামিন ইব্রাহীম, দ্যা মোস্ট চার্মিং এন্ড হ্যান্ডসাম ম্যান। যাকে বলা হয় এ যুগের তরুণীদের হার্টথ্রব। এবার বাংলাদেশে আলোড়ন জাগিয়েছেন নিজের অপূর্ব জাদুময়ী কণ্ঠ দিয়ে। কি মনে করে শ্রীমঙ্গলে কনসার্ট? হঠাৎ বাংলাদেশী ভক্তদের সাথে তার এই প্রগাঢ় আলিঙ্গনের পেছনে রহস্যটা কি? দীর্ঘদিন ভিনদেশে বাস করে তিনি কি নিজের দেশকে মিস করেছেন? শ্রীমঙ্গলের ‘বালিশিরা’ রিসোর্ট থেকে লাইভে আছি আমি অথৈ মির্জা।”

উষসীর নজর যায় পোস্টারের দিকে । সেখানে নামটা জ্বলজ্বল করছে-“Rockstar Yamin Ibrahim.” সেদিকে চেয়ে থেকে ফিসফিসিয়ে বলল,” রকস্টার না ছাই। যত্তসব ফাজিল, কুমতলবি, অসভ্য!”

” উষু, কাকে গালি দিচ্ছিস তুই?”

যুঁথি তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। উষসী থতমত খেয়ে বলল,” কই? কাউকে না!”

বন্ধুরা তাকে হন্যি হয়ে খুঁজছিল। করিডোরে এসেই দেখা হয় সবার সাথে। প্রীতি আর শম্পাসহ সব ছেলেরাও দৌড়ে আসে। যুঁথি ধমক দিয়ে প্রশ্ন করল,” কোথায় ছিলি এতোক্ষণ? খুঁজতে খুঁজতে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম আমরা।”

উষসী নিচু গলায় বলল,” আশেপাশে হাঁটছিলাম৷ জায়গাটা সুন্দর। তাই দেখছিলাম ঘুরে।”

তার উত্তর শুনে কপালে হাত ঠেঁকায় সবাই। শম্পা বলল,” আর এদিকে আমরা ভাবলাম তুই বুঝি হারিয়েই গেছিস। প্রীতম তো এখনও তোকে খুঁজছে। ”

অনম প্রেসের লোকজনের উদ্দেশ্যে বলতে লাগল,” স্যার এখন অনেক টায়ার্ড। উনি রেস্টে আছেন। তাই আজকে কোনো ইন্টারভ্যু হবে না। আপনারা চলে যান।”

সবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। কত আশা নিয়ে ক্যামেরা হাতে দাঁড়িয়ে ছিল সবাই। এতো অপেক্ষার পর এখন এই কথা? উষসী মনে মনে ভাবল, ইন্টারভ্যু দেওয়ার সময় থাকবে কেন তার? সে তো মেয়েদের প্রতিকৃতি অঙ্কনে ব্যস্ত!

যুঁথি ছেলেদের দিকে ঘুরে বলল,” এই তোরা কেউ একটা ফোন লাগা তো প্রীতমকে। জানা যে উষুকে পাওয়া গেছে। বেচারা যেভাবে ছুটোছুটি করছিল। যেন ওর গার্লফ্রেন্ডই হারিয়ে গেছে।”

যুঁথির কথায় হেসে উঠল বাকিরা। উষসী মুখ শক্ত করে বলল,” ফ্রেন্ডরা আমার কাছে ভাই-বোনের মতো। তাদের নিয়ে এমন ফাজলামি আমার মোটেও পছন্দ না যুঁথি।”

হৃদয় বলল,” রাগ করিস না উষু। প্রীতম সবাইকে নিয়েই একটু বেশি সেন্সিটিভ। এটা পারসোনালি নেওয়ার কিছু নেই। ”

উষসী হাত ভাঁজ করে সবার উদ্দেশ্যে জানতে চাইল,” কখন বের হচ্ছি আমরা?”

চলবে