#উষসী_হাসবে_বলে (৭)
লিখা- Sidratul Muntaz
আজকে ভার্সিটির ফাংশনে উষসী নীল শাড়ি পরেছে। তাকে নীল রঙে বরাবরই খুব মানায়। মায়ের ভাষায় নীল শাড়ি পরলে তাকে লাগে নীল অপরাজিতা ফুল! উষসী সেজে-গুজে মঞ্চে উঠেছে। সে রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতা আবৃত্তি করেছে। তার কবিতা শুনে অভিভূত হয়েছে শ্রোতারা।
ইদানীং গান-কবিতার প্রতি খুব ঝোঁক তৈরী হয়েছে তার৷ কারণে-অকারণে হারমোনিয়াম নিয়ে বসে পড়ে। গুগল ঘেঁটে বিভিন্ন গানের লিরিক্স অনুশীলন করে। তার ভায়োলিন বাজানোরও শখ হয়েছে। সে চিন্তা করছে সুইজারল্যান্ড থেকে ফিরেই একটা ভায়োলিন কিনবে। গতরাতে স্বপ্ন দেখেছে ইয়ামিন ইব্রাহীম তাকে ভায়োলিন বাজানো শেখাচ্ছে। কি অদ্ভুত স্বপ্ন! মাথাটা মনে হয় পুরোপুরিই গেছে।
বন্ধুদের সাথে আড্ডা শেষে উষসী বের হয়েছে দুপুর দু’টোয়। মেইনরাস্তা পার হয়ে গাড়িতে উঠবে ঠিক সেই সময় পেছন থেকে ডাকল প্রীতম,” উষু।”
উষসী সামান্য চমকাল। অতঃপর পানসে মুখে শুধাল,” কিছু বলবি?”
” লিফট লাগবে। বাস পাচ্ছি না আমি।”
উষসী আশ্চর্য হয়ে ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করল,” তুই আমার কাছে লিফট চাইছিস? কিন্তু তোর বাসা আর আমার বাসা তো বিপরীত দিকে।”
” আমি ডিরেক্ট বাসায় যাচ্ছি না৷ অন্য একটা জায়গায় যাচ্ছি। তোদের ওদিকেই।”
” ঠিকাছে। আয় তাহলে।”
উষসী ড্রাইভিং সিটে বসল। প্রীতম বসল তার পাশে। আজ-কাল সে আশেপাশে থাকলে উষসী অস্বস্তিবোধ করে। কিন্তু ব্যাপারটা সে কাটাতে চায়। বন্ধুত্ব নষ্ট করার ইচ্ছে তার নেই। উষসী সহজ- স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল,” কোথায় যাচ্ছিস?”
” দূর সম্পর্কের এক মামার বাসায়৷ শুনলাম তুই নাকি সুইজারল্যান্ড যাচ্ছিস?”
উষসী হেসে মাথা নাড়ল,” হুম।”
” পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দেশ নাকি সুইজারল্যান্ড।”
” দুইবছর আগেও একবার গিয়েছিলাম। সুন্দর তো বটেই। মনোমুগ্ধকর। ”
” কবে ফিরবি?”
” বলতে পারছি না। কমপক্ষে দশ-বারো দিন তো লাগবেই।”
” আর কেউ যাচ্ছে?”
” আমি, তৃষ্ণা, ডোনা আন্টি আর আহমেদ ভাইও যাবে। তৃষাণ ভাই যেহেতু যাচ্ছে না তাই বিশ্বাসযোগ্য কাউকে পাঠাচ্ছে আমাদের সাথে।”
” ফ্লাইট কখন তোদের?”
” কেন জানতে চাইছিস?”
” ভাবছি তোকে বিদায় জানাতে এয়ারপোর্টে আসব।”
” দরকার নেই। তৃষাণ ভাইও থাকবে এয়ারপোর্টে। ”
কথাটা বলার পর উষসী কেমন বিব্রত হলো। আসলে সে প্রীতমের মুখোমুখি হতে চায় না খুব বেশি। আগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অবিরাম গল্প করতো তারা। অথচ এখন কত মেপে মেপে কথা বলতে হয়। প্রীতমের অনুভূতি জানার পর থেকে উষসীর মধ্যে একটা অপরাধবোধ তৈরী হয়েছে। প্রীতম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,” রাখ এখানে।”
উষসী বিস্ময় নিয়ে বলল,” কেন? মাঝরাস্তায় নেমে কি করবি?”
” এখানেই নামব আমি।”
উষসী গাড়ি থামিয়ে দিল৷ প্রীতম বের হওয়ার আগে বলল,” আমি নিজেকে তৈরী করব উষু। যতদিন না তোর যোগ্য হতে পারছি ততদিন তোর সামনে আর আসব না। ভালো থাকিস।”
প্রীতম বের হয়ে যায়। উষসী কিছু বলতে পারে না হঠাৎ। শব্দেরা গলার কাছে জমাট বেঁধে যায়। কেমন একটা বিষণ্ণবোধ আঁকড়ে ধরে ভেতর থেকে। প্রীতম কি ভাবছে? সে যোগ্যতার কথা কেন বলল? আর্থিকভাবে উষসীদের অবস্থান উচ্চবিত্ত। আর প্রীতম মধ্যবিত্ত বলেই কি হীনমন্যতায় ভুগছে? ভাবছে সামাজিক অবস্থানের পার্থক্যের কারণে উষসী তার প্রেম প্রত্যাখ্যান করেছে? কিন্তু সত্যিটা হলো উষসী মন থেকে কখনও প্রীতমের জন্য ভালোবাসা অনুভব করেনি।
মিসেস শিমলাকে সুইজারল্যান্ড পাঠিয়ে প্যারিসে চলে এসেছে ইয়ামিন। এখানে তার গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। যাবতীয় সব কাজ-কর্ম সেড়ে একেবারে বিয়ের আগের দিন উপস্থিত হবে সুইজারল্যান্ডে। আপাতত সুপারস্টার ইউভান শেখের সাথে তিনদিন যাবৎ একটা রেডিসনে অবস্থান করছে। ইউভান শেখের নতুন মুভির কিছু গানের দৃশ্যের শুটিং হবে প্যারিসে। অতঃপর তারা সুইজারল্যান্ডেও যাবে। সেখানে হবে সিনেমার শ্যুটিং। ইয়ামিন সেই মুভির গানে কণ্ঠ মেলাবে। তাছাড়া তার নিজেরও কয়েকটা প্রয়োজনীয় শ্যুট আছে সিনেমায়। ডিরেক্টর আরমান জোহার এখনও উপস্থিত হোননি বলে শ্যুটিং শুরু করা যাচ্ছে না। মিউজিক ডিরেক্টর আওয়াল খান আজ সকালে প্যারিসে ল্যান্ড করবেন বলে কথা দিয়েছেন।
ইয়ামিন খুবই সমস্যায় পড়ে গেছে। ইউভান শেখের মতো কঠোর রুটিন মেনে চলা মানুষ জীবনে খুব কমই দেখেছে সে। দশটার মধ্যে শুয়ে পড়বেন তিনি। সূর্যোদয়ের আগেই বিছানা ছেড়ে উঠবেন। ভোরের মধ্যে তিনি সমুদ্রে চলে যাবেন। শীতকাল হওয়ায় পানিতে নামছেন না। গরম হলে দেড়ঘণ্টা সমুদ্রে সুইমিং করতেন। তার সঙ্গে পাশাপাশি রুমে থাকার সুবাদে একই নিয়ম অনুসরণ করতে হচ্ছে ইয়ামিনকেও। সে প্রতিদিন ভোরে দশ কিলোমিটার জগিং করে ক্লান্ত হয়ে যায়। জগিং থেকে ফিরে আবার ওয়ার্কআউট করতে হয়। মনে মনে সে শান্তি অনুভব করছে এই ভেবে যে এখন গ্রীষ্মকাল নয়। তাহলে দেড়ঘণ্টা তাকে সুইমিংও করতে হতো। কি ভয়ংকর ব্যাপার!
ব্রেকফাস্টে তাদের খেতে হচ্ছে তেঁতো নিমপাতা আর পালং শাকের স্মুথি। দুপুরে সালাদ ছাড়া অন্যকিছু না। একটু চিকেন পাওয়া গেলেও সেটা বয়েলড, একেবারে স্বাদহীন। হালকা ব্ল্যাক পিপার মিশিয়ে খেতে হয়। ভদ্রতার খাতিরে ইয়ামিন সব করছে যা সুপারস্টার করছেন। তিনি তাঁর চল্লিশ বছরের জীবনে কখনও মদ খাননি। দেখতে এখনও তাকে আঠাশ বছরের যুবক মনে হয়৷ তার ফিটনেস দেখে যে কেউ বয়স সম্পর্কে দ্বিধান্বিত হবে এবং একই সাথে ঈর্ষান্বিতও হবে। ইয়ামিন সপ্তাহে অন্তত একবার মদ খেয়েই থাকে। সিগারেট তার প্রতিদিনের অভ্যাস। আজ তিনদিন ধরে সিগারেট খেতে না পারায় তার মন কিঞ্চিৎ বিক্ষিপ্ত।
ঘড়িতে সকাল আটটা বাজছে। বিমান উড্ডয়নের উপযোগী সময় পৌনে নয়টা। তারা ইন্দিগো এয়ারলাইনস থেকে টিকিট কেটেছিল একমাস পনেরো দিন আগে। প্রথম ট্রানজিটে ঢাকা থেকে একটানে দুবাই যেতে হবে৷ রাতে এয়ারপোর্টেই থাকতে হবে। তারপর পুনরায় যাত্রা শুরু হবে স্বপ্নের দেশ সুইজারল্যান্ডের উদ্দেশ্যে। উষসী খুবই উত্তেজনা বোধ করছে। তাদের এয়ারপোর্টে ছাড়তে সবাই এসেছে৷ তৃষাণ তার সহকর্মী আহমেদের সাথে আধঘণ্টা যাবৎ কথা বলছে। কিভাবে কি করতে হবে সবকিছু বোঝাচ্ছে। তার চোখ-মুখে কেমন একটা গোবেচারা ভাব। দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে ব্যাপক দুশ্চিন্তায় আছে।
নিজের মা, ছেলে আর সুন্দরী শালিকাকে অন্যকারো ভরসায় ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে এখনও পুরোপুরি মানসিকভাবে প্রস্তুত নয় তৃষাণ। পারলে নিজেও টিকিট কেটে ফ্লাইটে চড়ে বসে। কিন্তু এখন সেই উপায় নেই বলে পারছে না।
উষ্ণতা তৃষ্ণার সাথে সময় কাটাচ্ছে। আর একটু পরেই ছেলের থেকে আলাদা হতে হবে বলে তার মনখারাপ। একটু পর পর সে ছেলের কপালে,গালে চুমু দিচ্ছে আর বলছে,” একদম দুষ্টমি করবে না আব্বু। এন্টসকে জ্বালাবে না কিন্তু। দাদুন আর এন্টস যা বলবে তাই শুনবে৷ ওখানে অনেক ঠান্ডা৷ সবসময় সোয়েটার পরে থাকবে। অপ্রয়োজনে বাইরে যাবে না। আর ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করবে। মনে থাকবে?”
তৃষ্ণা মাথা নাড়ে। পরমুহূর্তেই আবার জিজ্ঞেস করে,” আমার বোন কখন আসবে মাম্মাম?”
উষ্ণতা নিজের পেটে হাত রেখে বলল,” এখনও অনেক দেরি।”
” সে কি তোমাকে আমার মতো মাম্মাম ডাকবে?”
“হুম।”
” পাপাকে পাপা বলবে?”
“হুম। বলবে। আর তোমাকে বলবে ভাইয়া।”
তৃষ্ণা কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল,” আমার বোন দরকার নেই প্লিজ। বোনের অর্ডার ক্যান্সেল করে দাও।”
উষ্ণতা কি বলবে বুঝতে পারল না। পাশ থেকে উষসী উচ্চশব্দে হেসে উঠল। তৃষ্ণার মাথায় গাট্টা মেরে বলল,” গোবর, এটা কি অনলাইন প্রোডাক্ট যে অর্ডার ক্যান্সেল করবে?”
তৃষ্ণা দুই পাশে মাথা নেড়ে রুক্ষ গলায় বলল,” আই ডন্ট নীড এনি সিস্টার!”
ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ার সুবাদে ইংরেজিটা ভালোমতোই আয়ত্ত করেছে সে। তাই রেগে গেলেই ইংরেজি বলতে শুরু করে। হঠাৎ কিভাবে যেন তার মাথায় ঢুকে গেছে বোন এলে মা-বাবা তাকে আর আদর করবে না। এজন্যই বোনের প্রতি অনীহা জন্মেছে।
উষ্ণতাকে আগের চেয়ে অনেকটা গুলুমুলু দেখায়। কিন্তু হুট করে কেউ দেখলে বুঝবে না যে সে চারমাসের প্রেগন্যান্ট। মানুষ তো পাঁচ-ছয়মাসের প্রেগন্যান্সি নিয়েও বিদেশ যাত্রা করে। তবে তৃষাণ নিজের স্ত্রীর ব্যাপারে কোনো রিস্ক নিতে চাইছে না। তাছাড়া সুইজারল্যান্ডে এখন প্রচুর ঠান্ডা। উষ্ণতা শীত একদম সহ্য করতে পারে না। সেজন্যই তারা যাচ্ছে না।
উষসীর মা বললেন,” ধনী দেশে যাচ্ছিস, একটু বুঝে-শুনে খরচ করবি। ওখানে জিনিসপত্রের যা দাম! কার্ড আছে বলে বেফাঁসের মতো টাকা উড়িয়ে বেড়াস না আবার। আমার জামাইয়ের অনেক কষ্টের ইনকাম।”
উষসী হাসল। সে জানে মা তাকে এসব কেন বলছেন। গতবার যখন তারা সুইজারল্যান্ড গিয়েছিল, উষসী মাত্র দুইদিনেই সব টাকা-পয়সা শেষ করে ফেলেছিল। তারপর বাকি দিনগুলো উদাস মুখে ঘুরে বেরিয়েছে। সেখানকার একটা আইসক্রিমের দামও পাঁচ থেকে ছয় সুইস ফ্রাংক। যা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় সাতশো টাকার মতো। ভীষণ ধনী দেশ বলে কথা! সেখানে মন ভরে শপিং করতে গেলেও দেউলিয়া হতে হবে।
সাড়ে আটটার মধ্যে তারা বিমানে উঠে যায়। তৃষ্ণা তার আইপ্যাড বের করে গেইমস খেলতে শুরু করেছে। সুইজারল্যান্ড যাওয়া উপলক্ষে বাবার থেকে বায়না ধরে এটা কিনেছে সে। এরপর তাকে আর পায় কে? সারাক্ষণ আইপ্যাড নিয়েই একধ্যানে বসে থাকে। উষসী বলল,” এভাবে আইপ্যাড চালালে চোখে চশমা পরতে হবে।তারপর তোর বোন এসে দেখবে তুই কানা। সে তোকে ডাকবে কানা ভাই।”
” পাপাও তো চশমা পরে। কই তাকে তো ফুপস কানা ভাই ডাকে না।”
এই ছেলের সাথে কথায় পারা যাবে না। মায়ের চোখের আড়াল হতেই পাকনামি শুরু। অথচ উষ্ণতার সামনে এমনভাবে কথা বলছিল যেন ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না। শেয়ানা একটা! উষসী দুইহাতে তার গাল টিপে দিল। ডোনা বললেন,” প্রিয়কে একটা ফোন দিয়ে জানিয়ে দে যে আমরা ফ্লাইটে উঠেছি।”
উষসী হেসে বলল,” এখন ফোন ফ্লাইট মোডে রেখেছি ভালো আন্টি। ফোন দেওয়া যাবে না।”
” অনলাইনেও না?”
” ডেটা কানেক্ট না করতে পারলে অনলাইনে কিভাবে ফোন দিবো?”
” ও আচ্ছা।”
উষসীর সিট পড়েছে জানালার কাছে। তৃষ্ণা মাঝখানে। ডোনা তার পাশে। আহমেদ বসেছে তাদের থেকে একটু দূরে। উষসী মাথা কাত করে বাইরে তাকাল। সাদা মেঘগুলো কুন্ডলি পাকিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। মনে প্রশান্তি এনে দেওয়ার মতো দৃশ্য। বৃত্তাকার জানালার পাশে মাথা হেলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল উষসী। তার ঘুম ঘুম লাগছে।
পৃথিবীর ছোট একটি স্বর্গালোক সুইজারল্যান্ড। পশ্চিমে থুন হ্রদ আর পূর্বে ব্রিয়েঞ্জ হ্রদের কোলে অবস্থিত সুইজারল্যান্ডের একটি আকর্ষণীয় শহর ইন্টারলেকেন। এখান থেকে দেখা যায় আইগার, মঞ্চ, জাংফ্রাউয়ের মতো চমৎকার কিছু পর্বতশৃঙ্গ। এটি আল্পস পর্বতের বেসক্যাম্প হিসেবেও বিখ্যাত। পাহাড়ের কোলে টলটলে নীল পানির সুবিস্তৃত এক হ্রদ। হ্রদের পাশে চোখ জুড়ানো অমায়িক রাস্তা এবং ঐতিহাসিক ভবনে পরিপূর্ণ শহর।
এই শহরের একটি অত্যাশ্চর্য সুন্দর গ্রামের নাম লুটারব্রুনেন। তখন আবহাওয়া কনকনে ঠান্ডা। তাপমাত্রা মাইনাসে। লুটারব্রুনেনের পরিচ্ছন্ন রাস্তা স্বচ্ছ কাঁচের মতো দেখাচ্ছে। চারদিকে জমাট বাঁধা শ্বেত নক্ষত্রের মতো বরফ। নিষ্প্রাণ পাতাবিহীন গাছগুলো সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সিগ্ধতা, স্বচ্ছতা, শুভ্রতায় ভরা গ্রামটিতে প্রবেশ করতেই উষসী প্রকৃতির এক অন্যরকম মাধুর্য্য উপলব্ধি করল। যে মাধুর্য্যের সাথে বাঙালি জাতি খুব বেশি পরিচিত নয়। গতবার যখন সে এসেছিল তখন সুইজারল্যান্ডে গ্রীষ্মকাল। এখানকার মানুষ গরম উপভোগ করে। কারণ দেশটি শীতপ্রধান। কিন্তু উষসী শুভ্র বরফের সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে।
ট্রেন থেকে নামতেই তৃষ্ণা হৈহৈ শুরু করল। স্নো পেয়ে সে বেজায় খুশি। মুঠো ভরে স্নো নিয়ে এদিক-সেদিক ছুঁড়ে মারছে। তার বায়না স্নোম্যান বানাবে। আহমেদ হেসে বলল,” এখন না বাবা। আগে বাসা খুঁজে বের করি, তারপর।”
উষসী বলল,” বাসায় গিয়ে আমরা একসাথে বানাবো।”
তৃষ্ণা খুশি হয়ে মাথা নাড়ল। প্রিয়ন্তীর খামার বাড়ি খুঁজে পেতে বেশি সময় লাগল না। এখানে আনাচে-কানাচে প্রচুর খামার বাড়ি। সব কাঠের তৈরী। বেশ উন্নতমানের কাঠ। লালচে কাঠের উপর জমে আছে সাদা বরফ। কি সুন্দর দৃশ্য! সবাই কাঁপতে কাঁপতে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল। হিটারের কাছে বসে ক্ষান্ত হলো। প্রিয়ন্তী ডোনাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করেছে। উষসী মজা করে বলল,” হয়েছে এবার থামো। এখনই সব কান্না শেষ করে ফেললে বিদায়ের সময় তো কান্নাই আসবে না আপু।”
প্রিয়ন্তী চোখের জল মুছে হাসল। ডোনার চোখ দু’টিও অশ্রুতে টলমল করছে। মা আর মেয়ের মিলন দৃশ্য দেখে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে হেসে উঠলেন মিসেস শিমলাও। উষসীর চিনতে অসুবিধা হলো না৷ কয়েকবার ইন্সটাগ্রামে ভদ্রমহিলার ছবি দেখেছিল। প্রিয়ন্তী পরিচয় করাল,” চাচী, এটা আমার ভাইয়ের ছেলে, তৃষ্ণা।”
তৃষ্ণা নিজে থেকেই হাত উঠিয়ে সালাম দিল। শিমলা মিষ্টি হেসে সালামের উত্তর দিলেন। প্রিয়ন্তী বলল,” আর এটা হচ্ছে উষসী। আমার ভাইয়ের শালিকা কম ছোটবোন বেশি।”
শিমলা অবাক দৃষ্টিতে শুধালেন,” তুমি উষ্ণতার ছোটবোন?”
উষসী মাথা নাড়ল। তিনি আরও বিস্ময় নিয়ে বললেন,” সেই ছোট্ট মেয়েটা…কতবড় হয়ে গেছো এখন।মাশআল্লাহ। কিসে পড়ো মা তুমি?”
উষসী জবাব দিল,” অনার্স ফার্স্ট ইয়ার।”
শিমলা অভিভূত হয়ে আবার বললেন,” মাশআল্লাহ, মাশআল্লাহ।”
প্রিয়ন্তী বলল,” চিনতে পেরেছো আমার চাচীকে? উনার কিন্তু আরও একটা পরিচয় আছে। ইয়ামিন ইব্রাহীমের মা।”
উষসী ঠোঁটভরা হাসি নিয়ে বলল,” প্রথম দেখাতেই চিনতে পেরেছি আপু। বিখ্যাত পুত্রের গর্বিত মা।”
শিমলা খিলখিল করে হেসে উঠলেন। উষসী কিঞ্চিৎ আশ্চর্য হলো। এই বয়সেও কি সুন্দর করে হাসেন তিনি। চোখে-মুখে ফুটফুটে কিশোরীর মতো উচ্ছলতা! মিসেস শিমলার সাথে উষসীর ভালোই গল্প হলো। সবকিছু সুন্দর চলছিল। কিন্তু বিপত্তি ঘটল বিকেলবেলায়।
তৃষ্ণা বায়না করছে স্কেটিং-এ যাবে। সে স্কেট শ্যুজ পর্যন্ত কিনে এনেছে। আপাতত তাকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার মতো কেউ নেই। সবাই ক্লান্ত। এই ব্যাপারটা তৃষ্ণা বুঝতে চাইছে না।
উষসী বলল,” এখন না বাবা৷ আমরা কালকে যাবো প্লিজ। আজকে রেস্ট করো। তুমিও তো খুব টায়ার্ড। ”
” স্কেটিং-এ যাব, স্কেটিং-এ যাব।”
তৃষ্ণা একটা কথাই বার-বার বলে যাচ্ছে। সে একবার জেদ শুরু করলে তৃষাণের ধমক ছাড়া কেউ তাকে সামলাতে পারে না।
” নিশ্চয়ই যাবে৷ স্নোফলে স্কেটিং ছাড়া জমে নাকি?”
পুরুষ কণ্ঠ শুনে উষসী পেছনে ফিরতেই শিরদাঁড়ায় শীতল স্রোত অনুভব করল। শরীরের র*ক্ত গরম হয়ে উঠল তার। রিয়াসাত হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তৃষ্ণা উষসীর হাত ছেড়ে দৌড়ে ছুটে গেল তার কাছে। উষসী তাকে থামাতে পারল না৷ চোখ-মুখ শক্ত করে তাকাল রিয়াসাতের দিকে।
রিয়াসাত কোমল কণ্ঠে বলল,” কেমন আছেন, ম্যাডাম? আমাকে মনে পড়েছে? অবশ্য এতো সহজে ভুলে যাওয়ার মতো সম্পর্ক তো আমাদের ছিল না।”
উষসীর ঠোঁট ক্রোধে কাঁপছে। তৃষ্ণা বলল,” আমি বাইরে যেতে চাই আঙ্কেল, প্লিজ।”
রিয়াসাত তৃষ্ণার গাল টিপে আদর করে বলল,” হ্যাঁ যাব বাবা। এক্ষুণি যাব। যদি তোমার এন্টসও যায় আমাদের সাথে!”
তৃষ্ণা উষসীর দিকে চেয়ে অনুরোধ করল,” চলো না এন্টস।”
উষসী ক্ষোভ নিয়ে উচ্চারণ করল,” আমি কোথাও যাব না।”
রিয়াসাত তার ক্ষুব্ধ দৃষ্টি অবলোকন করে বলল,” কেন? ভয় পাচ্ছেন?”
ঘরে ঢুকে সপাটে দরজা আটকে দিল উষসী। রিয়াসাত এখানে আছে জানলে সে ম-রে গেলেও আসতো না। বিরাট ভুল হয়ে গেছে। আসার আগে প্রিয়ন্তীকে জিজ্ঞেস করা উচিৎ ছিল। হঠাৎ আয়নায় তাকাতেই খেয়াল করে তার শরীর মৃদু কাঁপছে। এই কম্পন ঠান্ডার জন্যে নয়। রাগ আর ঘৃণার সংমিশ্রণে সে দিশেহারা।
রিয়াসাত আর তৃষ্ণার সাথে প্রিয়ন্তী আর ডোনাও বের হয়ে গেছে। তারা যাবে প্রিয়ন্তীর হবু শ্বশুরবাড়ি। বরফে ঢাকা টয়োটা গাড়িটির কাঁচ পানির সাহায্যে ওয়াইপার দিয়ে পরিষ্কার করে নিচ্ছে আহমেদ। উষসীকেও যাওয়ার জন্য ডাকা হয়েছিল। কিন্তু সে নিষেধ করেছে। ঘরে শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছে সে। রিয়াসাতের মুখ দেখার ন্যূনতম ইচ্ছে তার নেই। কিছুক্ষণের মধ্যে সে ঘুমিয়ে গেল।
হঠাৎ কড়া রিংটোনে কান ঝাঁ করে ওঠে। ঘুম ভেঙে যায়। তার নিজের ফোনের রিংটোন এমন নয়। খুঁজে দেখল মিসেস শিমলার ফোনটা বাজছে। তাঁর মোবাইল এখানে কেন? হয়তো ভুলে ফেলে গেছেন। ফোনের স্ক্রিনে বড় বড় ইংরেজি অক্ষরে লেখা,” ABBU”
উষসী মোবাইল হাতে ঘর থেকে বের হলো। এদিক-সেদিক অনেক খুঁজেও শিমলা আন্টিকে পাওয়া গেল না। ফোন বাজতে বাজতে থেমে গেছে। পুনরায় বাজতে শুরু করেছে। তৃতীয়বার উষসী ফোনটা ধরল৷ জরুরী কিছু হতে পারে।
” হ্যালো।”
ওই পাশ থেকে সুপরিচিত কণ্ঠ শোনা গেল,” মা কোথায়? আপনি কে বলছেন?”
উষসী খেয়াল করল তার হার্টবিট বেড়ে গেছে। কোনমতে ঢোক গিলে বলল,” আপনার মা এখানে নেই। হয়তো বাইরে গেছেন। ফিরে এলে আমি কলব্যাক করতে বলব।”
” ঠিকাছে। কিন্তু আপনি কে সেটা তো বললেন না?”
” আপনি আমাকে চেনেন। কয়েকবার দেখাও হয়েছে আমাদের। এবার গেস করে যদি বলতে পারেন আমি কে তাহলে আপনার জন্য পুরষ্কার আছে।”
ইয়ামিন কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে শুধাল,” মিস রোজ? লামিয়া ইমরোজ!”
এক টুকরো নরম মেঘের স্পর্শ ছুঁয়ে গেল উষসীর মন। ঝরঝরে প্রাণবন্ত কণ্ঠে সে বলল,” কিভাবে বুঝলেন?”
” এতো ঝাঁঝ মেশানো কণ্ঠ আপনি ছাড়া আর কার হতে পারে?”
উষসী হেসে ফেলল। পরমুহূর্তেই ফোঁড়ন কাটল,” হুম। মেয়েরা তো আপনার সাথে অতি মিষ্টভাষায় কথা বলে। সেজন্য আমার স্বাভাবিক কণ্ঠও ঝাঁঝ মেশানো লাগছে। কিন্তু কি করব? এর চেয়ে নরমভাবে কথা বলতে পারি না আমি। আমার মুখে অতো মধু নেই।”
” আমি এখনও কনফিউজড। আপনি মায়ের ফোন কিভাবে ধরলেন?”
” এটা তো সিকরেট… বলা যাবে না।”
” মানে? কিসের সিকরেট?”
উষসী ধীরপায়ে ঘরে ঢুকল। ইয়ামিন বলল,” আমি কিন্তু আপনাকে চিনতে পেরেছি। এখন কি তাহলে পুরষ্কার পাবো?”
উষসী হাসল। দরজা আটকে পেছনে ফিরতেই তীব্র স্বরে চেঁচিয়ে উঠল আচমকা। রিয়াসাত বসে আছে বিছানায়। আতঙ্কে উষসীর হাত থেকে ফোন পড়ে যায়। ওই পাশ থেকে চিৎকার শুনে উদগ্রীব হয়ে চেঁচিয়ে ওঠে ইয়ামিনও।
” মিস রোজ… কি হয়েছে আপনার?”
কোনো জবাব আসে না। হাত থেকে পড়ে যাওয়ার কারণে মোবাইল সুইচড অফ হয়ে গেছে। ইয়ামিন আরও কয়েকবার ডায়াল করে। প্রতিবার ফোন সুইচড অফ দেখায়। বিপদের আশঙ্কায় গলা শুকিয়ে আসে তার। দুশ্চিন্তায় মাথায় দপদপ করতে থাকে। অস্থিরতায় এক মুহূর্ত টিকতে না পেরে গায়ে হুডি জড়িয়ে বেরিয়ে যায় রেডিসন থেকে। তারকাদের জন্য যে গাড়ি বরাদ্দ ছিল সেখান থেকে একটা নিয়ে পারি জমায় লুটারব্রুনেনের উদ্দেশ্যে। গুগল বলছে ব্যাস্টিল থেকে লুটারব্রুনেনের দূরত্ব দুইশো সাতষট্টি কিলোমিটার। পূর্ণ গতিতে ড্রাইভ করলে তিনঘণ্টায় পৌঁছানো অসম্ভব কিছু না!
চলবে
#উষসী_হাসবে_বলে (৮)
লিখা- Sidratul Muntaz
সুইট চেস্টনাট গাছের পাতাগুলো বরফের শুভ্র চাদরে ঢেকে আছে। পাতাহীন বরফে আবৃত ম্যাপল ট্রিগুলো নিষ্প্রাণ। একান্তরভাবে কয়েকটি টিচিনো গাছ দাঁড়ানো। এগুলো নাকি সুইজারল্যান্ডের জাতীয় গাছ।
মিসেস শিমলার মোটা ল্যাপেল উল কোট ভেদ করে অনায়াসে ঠান্ডা বাতাস ঢুকে যাচ্ছে শরীরে।তিনি মাফলারটা গলায় ভালোভাবে জড়িয়ে খামার বাড়ির দিকে পা বাড়াতে নিলেই দৈবাৎ চিৎকার শুনতে পেলেন। ধ্বক করে উঠল বুকটা।
রিয়াসাতকে ঘরে দেখে ঘাবড়ে গেছে উষসী। মুখ ছিটকে বেরিয়ে এসেছে চিৎকার।অনাকাঙ্ক্ষিত এই ঘটনায় হাত থেকে ফোনটাও পড়ে গেছে। উষসী ফোন তোলার জন্য ঝুঁকল। তখন রিয়াসাত কাছে এসে বলল,” আমি তুলে দিচ্ছি।”
ফোনের ডিসপ্লেতে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। মেজাজ চটে যায় তার। রাগান্বিত দৃষ্টিতে রিয়াসাতের দিকে তাকায়। রিয়াসাত বুকের বামপাশে হাত রেখে চোখ নিভিয়ে বলল,” এভাবে তাকিয়ো না প্লিজ৷ পুড়ে যাবো তো।”
উষসী ফট করে রিয়াসাতের গালে চ-ড় মেরে দেয়। এতে রিয়াসাতের মুখের হাসি আরও বিস্তৃত হয়। শীতল আবহাওয়ায় এমন কড়া চড় খেয়ে গালটা গরম হয়ে গেছে তার। সে গালে হাত রেখে বলল,” তোমার মতো তোমার স্ল্যাপটাও হট। হিটারের আর প্রয়োজন নেই।”
তারপর অন্য গাল এগিয়ে বলল,”চাইলে আরেকটা দিতে পারো। আমি মাইন্ড করব না। বরং আমার ভালো লাগবে। তোমার নরম হাতের গরম ছোঁয়া পাবো।”
উষসী চিড়বিড় করা রাগটা গিলে দরজা খুলে বাইরে আসে। তারা দুইতলায় ছিল। সিঁড়ি ভেঙে নামতে গিয়ে সে দেখে মিসেস শিমলা উপরে উঠে আসছেন। উষসী সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ে।
” কি হয়েছে উষসী?”
উষসী একটু লজ্জিত গলায় বলল,” স্যরি আন্টি। আপনার ফোন এসেছিল। কিন্তু আপনাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তাই আমিই ধরেছিলাম ফোনটা। তখন আমার হাত থেকে পড়ে ডিসপ্লে ফেটে গেছে মনে হয়।”
মিসেস শিমলা মোবাইলের বিষয়ে ভ্রুক্ষেপ করলেন না। উৎকণ্ঠা নিয়ে জানতে চাইলেন,” তোমার কি হয়েছে? আমি বাইরে থেকে চিৎকার শুনলাম।”
উষসী মুখে হাসি আনার চেষ্টা করল,” কিছুই হয়নি।আমি হঠাৎ রিয়াসাত ভাইয়াকে দেখে ভয় পেয়ে গেছিলাম৷ ”
” রিয়াসাতকে দেখে তুমি ভয় পেয়ে চিৎকার করেছো?”
উষসীর মুখটা অস্বস্তিতে ছেঁয়ে যায়। কোনরকমে মাথা নাড়ল,” হ্যাঁ। বাসায় কেউ ছিল না তো…নিচে চলুন আন্টি। আমার কফি খেতে ইচ্ছে করছে। আচ্ছা সবাই কখন ফিরবে?”
” ঠিক নেই। প্রিয়ন্তীর শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে গেছে সবাই।”
” আপনি যাননি?”
” তোমাকে একা রেখে যেতে চাইনি।”
উষসী মলিন মুখে বলল,” তাহলে তো আমার জন্য আপনার যাওয়াটা ক্যান্সেল হলো। স্যরি।”
সিঁড়ির গোঁড়ায় এসে শিমলা উপরে তাকালেন। রিয়াসাত এদিকে আসতে নিয়েও আসেনি। শিমলাকে দেখেই ভেতরে ঢুকে গেছে। ছেলেটা চোরের মতো আচরণ করছে কেন? আর ঘরেই বা সে কিভাবে ঢুকল? শিমলা বাইরেই ছিলেন। তবুও তাকে ঢুকতে দেখেননি।
” কি হয়েছে উষসী? রিয়াসাত হঠাৎ বাসায় কেন এলো? সেও তো প্রিয়ন্তীদের সাথে বের হয়েছিল।”
উষসী এড়িয়ে যাওয়ার মতো বলল,” আমি জানি না আন্টি। জিজ্ঞেস করিনি।”
সে কফির মেশিন হাতে নিয়েছে। মনোযোগ দিয়ে কফি বানানোর চেষ্টা করছে। একটু পর রিয়াসাতও নিচে নামে। শিমলা বললেন,” এখানে কি রিয়াসাত? তুমি না সবার সাথে বের হয়েছিলে?”
” আমি আমার ওয়ালেট ফেলে গেছিলাম মামী। সেটাই নিতে এসেছি।”
এই কথা বলেই সে সোফায় বসে যায়। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে উষসীর দিকে তাকায়। তখনি উষসীর কফি খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। ব্যাপারটা খেয়াল করেন শিমলা। তিনি সহজ গলায় বললেন,”কফি খাবে? উষু বানিয়েছে।”
রিয়াসাত চোখ বড় করে উষসীর দিকে চেয়ে থেকেই বলল,” আপনি বানিয়েছেন নাকি?”
উষসী জবাব দিল না৷ রিয়াসাত আলতো হেসে বলল,” তাহলে তো খেতেই হয় এক কাপ!”
শিমলা উঠতে উঠতে বললেন,” আমি কফি গরম করে আনছি। পাঁচমিনিটের মধ্যে শরবত হয়ে গেছে নিশ্চয়ই।”
শিমলা কিচেনে চলে যেতেই উষসী কফির কাপটা শব্দ করে নামিয়ে রাখল সেন্টার টেবিলের উপর। কটমট করে বলল,” বাড়াবাড়িটা বন্ধ করো। নাহলে আমি শিমলা আন্টিকে সব বলে দিবো।”
রিয়াসাত ভ্রু নাচিয়ে শুধাল,” সেই সাহস আছে তোমার? বলার হলে তো আরও আগেই বলতে।”
” তোমার উদ্দেশ্য কি রিয়াসাত? তুমি আমার থেকে আর কি চাও?”
” আমি শুধু তোমাকে চাই। তোমার সাথে কাটানো তিনমাস আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ তিনমাস। আমি আমার সেই সুন্দর অতীতে ফিরে যেতে চাই।”
উষসী বাঁকা হেসে বলল,” দিবাস্বপ্ন দেখারও লিমিট থাকে। তুমি ভাবলে কিভাবে এতোকিছুর পর আমি তোমাকে আবার চান্স দিবো? চেহারা দেখে কি আমাকে নির্বোধ মনে হয়?”
রিয়াসাত তীর্যকভাবে হাসল,” তুমি নির্বোধ না উষসী। কিন্তু তুমি বাধ্য। আমার দিবাস্বপ্ন সত্যি না করলে তোমার জীবনটা আমি দুঃস্বপ্ন বানিয়ে দিতে পারি।”
কথা শেষ করেই উষসীর আধখাওয়া কফির কাপটা টেবিল থেকে নিল রিয়াসাত। যেই জায়গায় উষসীর লিপবাম লেগে আছে সেখানে চুমুক দিল।
রাগে শরীর রী রী করে উঠল উষসীর। হিম হয়ে গেল গায়ের র’ক্ত। হ্যাঁ সে ভয় পায়। তবে নিজের জন্য না। পরিবারের কথা ভেবে তার ভয় লাগে। মা এসব জানতে পারলে ম’রেই যাবেন হয়তো। কিচেন থেকে সবকিছু আড়ি পেতে অস্পষ্ট শুনলেন শিমলা।
ঘণ্টাখানেক পর ফিরে আসে প্রিয়ন্তীরা। তৃষ্ণার হাতে অনেকগুলো চকলেট। এসব তাকে ফারদিন কিনে দিয়েছে। চকলেট পেয়ে সে ভীষণ খুশি। উৎফুল্ল চিত্তে উষসীর সাথে গল্প করল,” জানো এন্টস, আঙ্কেল খুব ভালো। আমরা একসাথে স্কেটিং করেছি। এত্তোবড় স্নোম্যান বানিয়েছি৷ আঙ্কেল বলেছে সকালে এখানে আসবে। তখন আমরা একসাথে স্নো প্যালেস বানাবো। তুমি কেন গেলে না? খুব মজা হতো।”
তৃষ্ণার চোখ-মুখ উজ্জ্বল। নতুন ফুপা হিসেবে প্রিয়ন্তীর উডবি ফারদিন সাহেবকে তার বেশ পছন্দ হয়েছে তা বোঝা যাচ্ছে। উষসী আর শিমলার জন্য খাবার কিনে আনা হয়েছে।সুইজারল্যান্ডের বিখ্যাত খাবার ফঁদু। শিমলা খুব আগ্রহ নিয়ে খেয়েছেন। কিন্তু উষসী বেশি খেতে পারেনি। কোনমতে খাওয়া শেষ করে সে বারান্দায় যায়। সেখানে কাঠের টেবিল আর চেয়ার পাতা।
তুষারাচ্ছন্ন গাছ, কালো আকাশ, ঝলমলে ভেজা রাস্তা, দূর-দূরান্তে দেখা যাচ্ছে উঁচু উঁচু সাদা-কালো আলপস( বরফে ঢাকা পর্বতশৃঙ্গ)। এক কথায় চোখ ধাঁধানো সুন্দর! নীলচে হৃদের পানি শুকিয়ে সাদাটে বর্ণ ধারণ করেছে। এখানে নাকি প্রতি ষোল কিলোমিটার পর একটা করে হ্রদ দেখা যায়। এই হ্রদ আর পর্বতের অতুলনীয় সৌন্দর্য্যই দেশটিকে অনন্য করে তুলেছে। এতো মোহনীয় দৃশ্য দেখেও উষসীর মনের বিষণ্ণতা কাটছে না।
রিয়াসাতের মাথায় একটা বদ মতলব ঘুরছে। উষসী চাইলেও তাকে অবহেলা করতে পারবে না। আবার ব্যাপারটা কাউকে বলাও যাবে না। শিমলা আন্টি নিশ্চয়ই কিছু আঁচ করতে পেরেছেন। এজন্যই আরও ভ-য়ে আছে উষসী৷ এমন অবস্থায় তার কি করা উচিৎ? বাংলাদেশে ফিরে যাবে?
নিচে হঠাৎ খুব হট্টগোল শুরু হলো। প্রিয়ন্তীর কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। মিসেস শিমলাও জোরেসোরে চেঁচাচ্ছেন৷ হঠাৎ হলোটা কি? কৌতুহল মেটাতে উষসী নিচে নামে আর হতবাক হয়ে যায়। ইয়ামিন এসেছে। তাকে ঘিরেই হৈচৈ শুরু হয়েছে বাড়িতে। তৃষ্ণা তার দাদুনের সাথে ঘুমিয়ে গেছে। আহমেদও একটা বিছানা দখল করে ঘুমে বিভোর। দীর্ঘসময়ের জার্নির কারণে ক্লান্ত ছিল সকলে। শুধু উষসীর চোখে ঘুম নেই। রিয়াসাতকে দেখে তার ঘুম উঁবে গেছে।
ইয়ামিন রিয়াসাতের উদ্দেশ্যে বলল,” কিরে তুই যে এখানে আছিস জানতাম না তো।”
রিয়াসাত বলল,” অটোগ্রাফ নিতে এসেছি তোমার। পপুলারিটি পেয়ে আমাদের তো একদম ভুলেই গেছো।”
” ইয়ার্কি করিস?”
প্রিয়ন্তী মুখে ভেংচি কেটে বলল,” বেহায়া একটা। আমি ইনভাইট করিনি তাও এসেছে। বলা নেই কওয়া নেই… হঠাৎ হাজির। আমি তো ওকে দেখে অবাক!”
ইয়ামিন মাকে প্রশ্ন করল,” তোমার ফোনে কি হয়েছিল মা? সুইচড অফ কেন?”
শিমলা অবাক হয়ে ফোন হাতে তুললেন। তারপর জীভ কেটে বললেন,”আসলেই সুইচড অফ হয়ে আছে দেখি। আমি একদম খেয়াল করিনি। তুই বুঝি অনেক বার ফোন করেছিলি? স্যরি বাবা।”
ইয়ামিন বিচলিত গলায় জানতে চাইল,” ওই মেয়েটা কোথায়? কেমন আছে?”
” কোন মেয়ে?” প্রিয়ন্তী অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল। ইয়ামিনের মুখে ইতস্তত ভাব,” ফোন কে ধরেছিল?”
” উষুর কথা বলছিস নাকি?”
উষসী সিঁড়ির কাছে এসে থেমে যায়। শিমলা তাকে লক্ষ্য করে বললেন,” ওইতো, যার কথা বলছি সে এসে গেছে। নিচে এসো মা।”
সবাই উপরে তাকায় তখন। উষসী কেমন গুটিয়ে যায়।ইয়ামিন বুক ভরে একটা ভারী শ্বাস নেয়। উষসীকে দেখে অপরিমিত শান্তি অনুভব হয়। তিনঘণ্টার দীর্ঘ পথ পারি দিয়ে এতোদূর আসার কষ্টটা মুছে যায়।
উষসী উশখুশ করে নিচে নামল। আজকেই তার মিথ্যা ধরা পড়ে যাবে। বিবর্ণ দেখায় তার মুখ-চোখ। শিমলা পরিচয় করানোর উদ্দেশ্য বললেন,” চিনতে পারছিস ওকে? বলতো কে?”
ইয়ামিন হাসার ভাণ করে জানতে চায়,”কে?” উষসী শুকনো মুখ নিয়ে মাথা নত করে। প্রিয়ন্তী বলল,” ও চিনবে কিভাবে চাচী? সেই ছোটবেলায় দেখেছিল!”
শিমলা রহস্য করে হাসলেন। ইয়ামিন কৌতুহল নিয়ে প্রশ্ন করল,” আমি সত্যিই চিনতে পারছি না। কে ও?”
” উষ্ণতাকে মনে আছে? তোর মিস? ও হচ্ছে উষ্ণতার ছোটবোন।” শিমলা হাসি মুখে কথাটা বললেও সেই কথা শুনে ইয়ামিনের মুখের হাসি বিলীন হয়ে গেল। প্রিয়ন্তী ব্যাপারটা খোলাশা করার জন্য বলল,” তৃষাণ আর উষ্ণতা আসেনি। মায়ের সাথে উষসী আর তৃষ্ণা এসেছে শুধু। তুই ওকে ছোটবেলায় দেখেছিলি। মনে আছে ওর কথা? ”
রিয়াসাত ফিসফিস করে বলল,” ওকে কি কেউ ভুলতে পারে এতো সহজে?”
ইয়ামিন অবাক হয়ে উষসীর দিকে তাকায়। তার কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ সৃষ্টি হয়। মনে আছে অবশ্যই। সেই ছোট্ট মেয়েটা। যে ফরফর করে কথা বলতো। এজন্যই প্রথম দেখায় তাকে খুব চেনা মনে হয়েছিল৷ কিন্তু উষসী নিজের পরিচয় কেন গোপন করল এতোদিন?
ইয়ামিনের তীক্ষ্ণ নজরের চাপে পড়ে উষসীর খুব হাঁসফাস লাগছে। সে বিব্রত মুখে বলল,” আমার ঘুম পাচ্ছে আপু। আমি উপরে যাই?”
প্রিয়ন্তী মৃদু হেসে বলল,” ঠিকাছে।”
উষসী দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ভাঙতে থাকে। একবার পেছনে ফিরতেই খেয়াল করে ইয়ামিন তাকে দেখছে। তার চোখ-মুখ অন্যরকম। উষসীর ভেতরটা অবশ হয়ে আসে।
নীরবতায় ছেয়ে আছে তুষারাবৃত গ্রাম। এখানে কোনো দূষণ নেই। ছবির মতো পরিচ্ছন্ন সবকিছু। একটা প্রাকৃতিক ফ্রেশ ভাব সবসময় অনুভব হয়। শ্বাস নিয়ে আরাম পাওয়া যায়। উষসী নরম তুলতুলে বিছানায় শুয়ে আছে। তার পাশেই প্রিয়ন্তী। মৃদু কণ্ঠে এতোক্ষণ ফারদিনের সাথে কথা বলছিল৷ এখন অবশ্য ঘুম।
উষসীর চোখে ঘুম নেই। রিয়াসাতের বিষয়টা মাথা থেকে তাড়ানো গেলেও নতুন করে মাথায় চড়ে বসেছে অন্য চিন্তা। ইয়ামিন! কি ভাবছে সে? তখন ওইভাবে কেন তাকিয়ে ছিল? নিশ্চয়ই পরিচয় গোপন করার ব্যাপারটা সে ভালোভাবে নেয়নি! উষসীর চিন্তা করেও অস্বস্তি লাগছে।
হঠাৎ ভায়োলিনের শ্রুতিমধুর শব্দ কর্ণগোচর হতেই তড়াক করে উঠে বসল সে। এই রাতের বেলা ভায়োলিন কে বাজাবে? উষসী ল্যাপের আয়েশ পায়ে ঠেলে গায়ে ওভারকোট জড়িয়ে বের হলো। তার ধারণা শব্দটা বাইরে থেকে আসছে। কারণ শব্দটা একটু অস্পষ্ট। উচ্ছ্বাস নিয়ে ঘরের বাইরে এসে এদিক-ওদিক খুঁজল সে। কিন্তু পেল না কাউকে।
একজন ট্রাক নিয়ে বরফে ভেজা সড়কপথে রোড সল্ট ছিটিয়ে দিচ্ছে৷ রোড সল্ট একটা বড় ক্রিস্টাল রক লবণ৷ রাস্তার বরফ অপসারণে ব্যবহৃত হয়। চারদিকে এখন কনকনে ঠান্ডা। স্বচ্ছ কাঁচের মতো সড়ক ভয়াবহ নীরব। উষসীর হালকা ভয় হচ্ছে। সে উদাস মুখে ঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পেছন থেকে ডাক শুনল।
” উষসী।”
উষসী পেছনে ঘুরে হতভম্ব। রিয়াসাত দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে ফোন। মুখে শয়তানের মতো হাসি। প্রচন্ড রোষে অন্তর জ্বলে উঠল উষসীর। চোখ সরু করে বলল,” তুমি মোবাইলে মিউজিক প্লে করেছো?”
রিয়াসাত অবলীলায় শ্রাগ( দুই কাঁধ ঝাঁকানো) করল। ঘাড় নাড়িয়ে বলল,” আমি জানতাম এই সুর শুনলেই তুমি নিচে নামবে। আমার ধারণা ঠিক। দেখেছো, তোমাকে আমি অস্থি-মজ্জায় চিনি উষসী।”
উষসীর মন চাইল আবার একটা চড় মে-রে দিতে।কিন্তু তাতে আদতে কোনো লাভ হবে না। রিয়াসাত তার হাতের বাহু বাড়িয়ে বলল,” লেটস হ্যাভ আ ওয়াক। লেকের পাশ থেকে কিছুক্ষণ হেঁটে আসি চলো।”
উষসীর চোখে ক্রোধের আগুন জ্বলছে। সে খুব ঠান্ডা স্বরে বলল,” বাড়াবাড়ি করছো রিয়াসাত। নিজের সীমার মধ্যে থাকো।”
এই কথা বলে সামনে ঘুরতেই রিয়াসাত দরাজ গলায় তাকে থামাল,” আমার সীমা তুমি এখনও জানো না। তৃষাণ ভাইয়ের মেইল আইডি, মেসেঞ্জার সবকিছু আমার কাছে আছে। যদি বলো তো এখনি পাঠিয়ে দিবো স্ক্রিনশট। নাকি তোমার আপুকে পাঠাবো?”
উষসীর টানা চোখ দু’টি করুণ হয়ে আসে। রিয়াসাত আলতো কণ্ঠে বলল,” আমার কথা শুনলে আমি তোমার কোনো ক্ষতি করব না, ট্রাস্ট মি।”
” তুমি আমার কাছে যত টাকা চাও আমি দিবো।”
” টাকা তোমার অনেক আছে সেটা আমি জানি। কিন্তু আপাতত আমার নিজেরই টাকার অভাব নেই। আমি টাকা নিয়ে কি করব? আমার যেটা দরকার সেটা হচ্ছে মানসিক শান্তি৷ যা একমাত্র তুমি দিতে পারবে। কামঅন।”
রিয়াসাত উষসীর হাত ধরে তাকে টানে। উষসী বাধ্যের মতো হাঁটতে থাকে। একসময় রিয়াসাত তার কোমড় স্পর্শ করলেই সে ধমকে উঠে,” এই বাড়াবাড়িটা তুমি করবে না খবরদার। আমার গা থেকে হাত সরাও।”
রিয়াসাত সাথে সাথে হাত সরিয়ে বলল,” স্যরি ডার্লিং। আর বাড়াবাড়ি করব না, প্রমিস।”
এই কথা বলেই ফিচেল হাসে সে। উষসী ঘৃণায় অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। খোলা জানালা থেকে তাদের হাঁটার দৃশ্য অবলোকন করে ইয়ামিন৷ কিন্তু উষসীর কান্নাভেজা চোখ তার নজর এড়িয়ে যায়। দূর থেকে দেখে মনে হয়, একজোড়া প্রেমিকযুগল মনের সুখে জোছনা বিলাসে বের হয়েছে!
হাসির শব্দে মুখরিত চারপাশ। গল্পে গল্পে মেতে উঠেছে মহল। তৃষ্ণার হৈ-হুল্লোড় কানে আসছে। সকাল সকাল ফারদিন এসে হাজির। আজকে তাদের পরিকল্পনা অন্যরকম। বিয়ের জন্য কেনাকাটা এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। প্রিয়ন্তী ঠিক করেছে প্যারিসে যাবে শপিং-এর জন্য। এসবের কোনো কিছুতে উষসী নেই। সে উদাসমুখে দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। তার দৃষ্টি শূন্যে। মন চাইছে প্যারাস্যুটে করে আলপসের উপরে চড়ে ঝাঁপ দিতে।তবেই মনের শান্তি মিলবে।
হঠাৎ পাশে এসে দাঁড়াল তার অশান্তির উৎস। উষসী ভারী নিঃশ্বাস ছেড়ে শুধাল,” আবার কি চাও?”
” আমি একটু পর বের হচ্ছি। তুমিও আমার সাথে যাবে। আমরা ট্রেনে করে ইন্টারলেকেন ঘুরব।” রিয়াসাত এমনভাবে বলছে যেন উষসী তার বিয়ে করা বউ। আর তারা হানিমুনে এসেছে! রাগে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাল উষসী৷ রিয়াসাত ঠোঁটে হাসি মেখে বলল,” এতো শীতল পরিবেশ, তবুও তোমার উত্তাপ কমছে না৷ ইউ আর সো হট উষসী! ”
উষসী উচ্চগলায় কিছু বলতে উদ্যত হয়। তখনি ইয়ামিন এসে দাঁড়ায় তাদের সামনে। তাকে হঠাৎ দেখে থমকায় উষসী। মুখের কাঠিন্য সরিয়ে হাসার ভাণ করে কোমল স্বরে বলল,” ঠিকাছে।”
রিয়াসাত উষসীর গাল টেনে বলল,” দ্যাটস লাইক আ সুইট গার্ল।”
ইয়ামিন চোখ-মুখ শক্ত করে দেখে সবটা। রিয়াসাত খোশমেজাজে ভেতরে চলে যায়। উষসী হাত দিয়ে নিজের গাল মুছে নেয়। তারপর একটা চাপা নিঃশ্বাস ছাড়ে। তার বুক ঢিপঢিপ করছে। ইয়ামিন শান্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে আসে তার কাছে। ঠান্ডা স্বরে প্রশ্ন করল,” তোমাকে কি বলছিল ও?”
পরিচয় জানার পরেই ‘ আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে নেমেছে ইয়ামিন। ছোটবেলায় তো তুমি করেই বলতো! উষসী নতমুখে বলল,” তেমন কিছু না। বের হওয়ার জন্য বলছিল।ট্রেনে করে ইন্টারলেকেন ঘুরব।”
কথাটা বলে উষসী মৃদু হাসল। হাসিতে অস্বস্তি। ইয়ামিন তাকে পরিচয় গোপন করার বিষয়টা নিয়ে কিছুই বলছে না। অথচ উষসী মনে মনে জবাব তৈরী করে রেখেছিল।
ইয়ামিন বলল,” ভালো। ” তারপর হৃদয় কাঁপিয়ে দেওয়ার মতো সরাসরি প্রশ্ন করল,” রিয়াসাতের সাথে তোমার সম্পর্ক কয় বছরের?”
আচমকা এমন প্রশ্নে থতমত খেয়ে তাকায় উষসী। বিস্ময়ে তার ঠোঁটদ্বয় আলাদা হয়ে যায়। ইয়ামিন অবশ্য উত্তরের অপেক্ষা করে না। অন্যদিকে চেয়ে সহজ- স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে,” তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে। ছোটবোন মনে করে একটা এডভাইজ দিচ্ছি শোনো, রিয়াসাত ভালো ছেলে না। ওর পাল্লায় পড়লে জীবন ধ্বংস হবে তোমার। তাই সাবধানে থেকো। বাকিটা তোমার উইশ।”
ইয়ামিন চলে যায় ভেতরে। উষসী অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে জড়পদার্থের মতো।
ইয়ামিনকে আজই ফিরতে হবে। সে রেডিসন থেকে গাড়ি নিয়ে এসেছে। মিউজিক ডিরেক্টর উপস্থিত। সন্ধ্যায়ই রেকর্ডিং তার। এজন্য সকালে উঠেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বের হবে।শিমলা মুখ ভার করে বললেন,” চলেই যদি যাবি, তাহলে এলি কেন?”
ইয়ামিন একটা হতাশ নিঃশ্বাস ছাড়ে। রাতের দৃশ্যটি চোখে লেগে আছে এখনও। কিছুক্ষণ আগে রিয়াসাত আর উষসীর কথোপকথন কানে বাজছে। কেমন একটা চাপা ক্রোধ কাজ করছে তার ভেতরে। সে ধৈর্য্য নিয়ে বলল,” তোমাকে দেখতে এসেছিলাম মা। দেখা শেষ, তাই চলে যাচ্ছি।”
” কোনো মানে হয় এসবের? ” শিমলা খুবই মনখারাপ করছেন। ইয়ামিন তাঁর গলা জড়িয়ে ধরে বলল,” আবার আসব তো মা। এতো আপসেট হওয়ার কি আছে?”
” কবে আসবি?”
“বিয়ের দিন।”
” কি বলছিস এসব? একেবারে বিয়ের দিন?”
ইয়ামিন চুপ করে থাকে। পারলে সে আসতোই না আর এখানে।প্রিয়ন্তীও ফারদিনকে নিয়ে প্যারিস যাচ্ছে। ইয়ামিনের গাড়িতেই যাবে তারা। তৃষ্ণার ফারদিনের সাথে বেশ ভাব হয়েছে। দু’জন সকালে দাবা খেলেছে। বরফ ছোঁড়াছুড়ি খেলেছে। এখন তৃষ্ণা বায়না করছে সেও প্যারিস যাবে। এই কথা শুনে ডোনা নিষেধ করলেন। প্রিয়ন্তী বলল,” থাক না মা। বাচ্চা মানুষ আবদার করছে।”
ডোনা বিরক্তি নিয়ে বললেন,” তোরা যাচ্ছিস কাজে। ও শুধু শুধু গিয়ে বিরক্ত করবে।”
তৃষ্ণা নরম গলায় বলল,” আমি বিরক্ত করব না। শুধু আঙ্কেলের হাত ধরে বসে থাকব। প্রমিস দাদুন।”
প্রিয়ন্তী আহ্লাদে গলে গিয়ে বলল,” আহারে, আমার জানবাচ্চাটা। প্লিজ মা, ওকে যেতে দাও। আচ্ছা, উষুও আমাদের সাথে চলুক!ও না হয় উষুর কাছে থাকবে।”
” উষু আবার কেন যাবে?”
” আমি শপিং করতে গেলে ওকে লাগবে না? ও তো এসব শপিং-টপিং এর ব্যাপারে এক্সপার্ট। আমার এসিস্ট্যান্ট হয়ে ও যাবে। আর তৃষ্ণাও যাবে।”
তৃষ্ণা আনন্দে চিৎকার করে উঠল,” ইস্ট অর ওয়েস্ট, ফুপস ইজ দ্যা বেস্ট।”
প্রিয়ন্তী জড়িয়ে ধরে চুমু দিল তৃষ্ণার গালে। ডোনা স্মিত হেসে বললেন,” ঠিকাছে তবে। দ্রুত ফেরার চেষ্টা করিস।”
ইয়ামিন লিভিংরুমে প্রবেশ করতেই প্রিয়ন্তী জানিয়ে দিল,” দু’জন বেড়েছে ইয়ামিন। তৃষ্ণা আর উষুও যাচ্ছে আমাদের সাথে। তুই কি হোটেল বুক করে ফেলেছিস?”
ইয়ামিন অবাক হয়ে তাকায়,” উষসী যাবে?”
“এখনও ওকে জিজ্ঞেস করিনি যাবে কি-না। তবে আমি বললে নিশ্চয়ই যাবে।”
ইয়ামিন তাচ্ছিল্য হাসে। বয়ফ্রেন্ডের সাথে ট্রেনে ঘোরার প্ল্যান করেছে সে। তাদের সাথে প্যারিস যেতে কেন রাজি হবে? ঠিক ওই সময়ই উষসী ঢুকল। প্রিয়ন্তী জিজ্ঞেস করল,” এইতো উষু, আমাদের সাথে যাবি? প্যারিস!”
উষসী খুব আনন্দের সাথে মাথা নাড়ে। নিশ্চয়ই যাবে সে। প্রিয়ন্তী তাকে ব্যাগ গোছাতে বলে। উষসী আগ্রহ নিয়ে দুইতলায় ছুটে যায়৷ ইয়ামিনের মনে হলো কাল থেকে মেয়েটার মনখারাপ ছিল। প্যারিস যাওয়ার কথা শুনে এই প্রথম হেসেছে সে৷ ইয়ামিনও ধীরে-সুস্থে তার পেছনে যায়। তাকে দেখে উষসী সিঁড়ির কাছে থামল,” কিছু বলবেন?”
ইয়ামিন একটু আমতা-আমতা করে বলল,” তুমি তো রিয়াসাতের সাথে ঘুরতে যাচ্ছিলে।”
উষসী মুখ ভোঁতা করে বলল,” আমার ঘুরাঘুরির থেকেও আপুর বিয়ের শপিংটা বেশি জরুরী না?”
” তাহলে রিয়াসাতকেও বলি যাওয়ার জন্য? ঘুরাঘুরিও হলো, শপিং-ও হলো।”
ইয়ামিন কথাটা বলেছে উষসীকে বাজিয়ে দেখতে। কিন্তু উষসী ক্ষেপে গেল। রুঢ় কণ্ঠে বলল,” না। ও যদি চায় তাহলে আমি যাবো না।”
ইয়ামিন বিস্মিত হয়ে জানতে চাইল,” কেন? আমার এক কথায় ব্রেকাপ করে ফেললে নাকি?”
উষসী জবাব না দিয়ে গটগট করে উপরে চলে যায়। ইয়ামিন সেদিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ হেসে ফেলে।
চলবে