উষসী হাসবে বলে পর্ব-১১+১২

0
273

#উষসী_হাসবে_বলে (১১)
লিখা- Sidratul Muntaz

মেয়েটি হাসছে প্রাণখুলে। তার হাসির শব্দ আর বাতাসের কলতানে মুখরিত হয়ে উঠল চারপাশ। কি স্নিগ্ধ আর প্রাণবন্ত তার মুখশ্রী! মনে ঢেউ তুলে যায়। রঙতুলির আঁচড়ে সেই অলীক সৌন্দর্য্য ফুটিয়ে তোলার ক্ষুদ্র চেষ্টা করে ইয়ামিন।

ইউভান শেখ ইয়ামিনের রুমের দরজা বরাবর দাঁড়িয়ে আছেন। তার সামনেই মাথা নত অবস্থায় রাফি বলল,” ভেতরে যাবেন না স্যার, ইয়ামিন ইব্রাহীম এখন ব্যস্ত আছেন।”

” ব্যস্ত মানে? কি করছে?”

রাফি বিনয়ের সুরে বলল,” তা আমি জানি না স্যার। আমাকে বলা হয়নি।”

ইউভান শেখ হাসলেন। আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন,” তাহলে কি বলা হয়েছে তোমাকে?”

রাফি একটু মাথা চুলকে বলল,” স্যার বলেছেন আগামী পাঁচঘণ্টা তাকে যাতে কেউ বিরক্ত না করে। আমি এখানে সাড়ে চারঘণ্টা যাবৎ দাঁড়িয়ে আছি স্যার। আর মাত্র আধঘণ্টা পার হলেই আপনি ভেতরে যেতে পারবেন।”

” আশ্চর্য কথা!”

ইউভান ভ্রু কুঁচকে হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর মতো রাফিকে তাড়িয়ে বললেন,” সরো! ”

” স্যার আমি সিরিয়াস! ইয়ামিন স্যার নিষে… ”

ইউভান গরম চোখে তাকানো মাত্রই রাফি সরে যায় ঝট করে। আফসোস হয় তার। পাঁচঘণ্টা কাজ করলে এক হাজার ডলার পেতো। মাত্র আধঘণ্টার জন্য তা হাতছাড়া হয়ে গেল বুঝি!

ইউভান ভেতরে ঢুকে আরেকবার রাফির দিকে চাইলেন। রাফির করুণ দৃষ্টি ভেজা ভেজা। একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলেন ইউভান৷ ইয়ামিনের মতিগতি কিছুই তার বোধগম্য হচ্ছে না।

গতকাল বিনা কারণে শ্যুটিং প্যাকআপ করেছে। তারপর রাতে একটা মেয়েকে নিয়ে কোথায় বের হয়ে গেছে। তার মদ-সিগারেটের প্রতি ঝোঁক আছে, তা জানা ছিল। কিন্তু নারী নেশাও যে আছে তা তো জানা ছিল না! ছেলেটা খুব বিগড়ে যাচ্ছে দিন দিন। আফসোসের বিষয়, ক্যারিয়ার নিয়ে এতোটুকু সিরিয়াস না। ফ্রী-তে জনপ্রিয়তা পেয়ে গেছে তো, তাই দাম দিচ্ছে না!

ইউভানের ধারণা ইয়ামিনের গানের কণ্ঠ ভালো হলেও সে জনপ্রিয়তা পেয়েছে চেহারার জন্য৷ তার সত্তর শতাংশ ভক্তরাই অল্পবয়স্কা তরুণী। যারা শিল্পের মান বোঝে না, শুধু লুকস দেখে দাপাদাপি করে। এদের মাতম বেশি বলেই ইয়ামিনের তার শিল্পীসত্তার দাম এতো সহজে পেয়ে গেছে। যেখানে শিল্পীদের ক্যারিয়ার গড়তে জীবন-যৌবন পেরিয়ে যায় সেখানে ইয়ামিন মাত্র অল্প কয়েক বছরেই তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।

সুপারস্টার হিসেবে ইউভানের চেয়েও ইয়ামিনের নামের কারণে সিনেমা বেশি হিট হচ্ছে। ব্যাপারটা খানিক অপমানজনক তো বটেই। তার মতো কণ্ঠ নিয়ে হাজার হাজার গাতক লাইন লাগিয়ে রেখেছে। তবে তাকেই কেন এতো তোষামোদ! এই ভাবনা মনে মনে পোষণ করলেও প্রকাশ করার দুঃসাহস করেন না ইউভান। সুপারস্টার হিসেবে তাকে উদার হতে হবে। তিনি হাঁটুর বয়সী ছেলেকে ঈর্ষা করলে ব্যাপারটা বড় বেমানান দেখায়।

ইয়ামিন কালরাতের মেয়েটাকে নিয়ে ফিরেছে আজ সকালে। ব্যাপারটা নিয়ে রেডিসনে অনেক গসিপ হচ্ছে।এখন আবার দরজা আটকে ঘরে বসে আছে সে। কারো সাথে দেখাও করছে না, কথাও বলছে না। তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটা শ্যুট পর্যন্ত থেমে আছে৷ এতো দায়সারা হলে কিভাবে চলবে? ডিরেক্টর আরমান জোহার নিজে না এসে সরাসরি ইউভানকে পাঠিয়ে দিয়েছেন ইয়ামিনের কাছে। তাঁর বিশ্বাস, ইউভানের কথা ইয়ামিন ফেরাবে না।

গোলাপি রঙা মোটা পর্দা সরিয়ে ভেতরে উঁকি দিলেন ইউভান৷ হাস্যমুখে জানতে চাইলেন,” কি অবস্থা, সিংগার!”

ইয়ামিন ঘুরে তাকায়। সামান্য বিব্রত হয়। চটজলদি ক্যানভাসের উপর একটা কাপড় ফেলে দেয়। রঙ এখনও শুকোয়নি। কিন্তু চাদোয়ার মতো কাপড়টা এমনভাবে দেওয়া হয়েছে যাতে পেইন্টিং এর ক্ষতি না হয়।

ইউভান ধীরপায়ে ভেতরে ঢুকে ইয়ামিনের পাশে বসেন। ইয়ামিন তার হতভম্ব ভাব কাটাতে ব্যস্ত হয়। ছবি তার জন্য খুব ব্যক্তিগত একটা বিষয়। ছবি আঁকার সময় কেউ তাকে বিরক্ত করতে পারবে না।

ইউভান শক্ত করে কাঁধ চাপড়ে দিলেন তার৷ খোশ মেজাজে জানতে চাইলেন,” কি করছিলে?”

ইয়ামিন জবাব দেয় না। হাসার ভাণ করে।ইউভান দুম করে ক্যানভাসের চাদোয়া সরিয়ে ফেললেন। ইয়ামিন চোখ বড় করে তাকায়। চোয়াল শক্ত হয় তার। নিজেকে সামলাতে চেয়ারের হাতল চেপে ধরে। ওদিকে পেইন্টিংটি দেখা মাত্রই মুগ্ধতায় বুদ হয়ে গেলেন ইউভান শেখ। হা করে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে বললেন,” ট্রিমেন্ডাস বিউটি… কে এই মেয়ে?”

ইয়ামিন দাঁতে দাঁত পিষে। অনুমতি ছাড়া পেইন্টিং-এ হাত দেওয়ায় প্রচন্ড রেগে গেছে সে। অথচ কিছু বলতেও পারছে না। ইউভান ঝুঁকে বললেন,” প্রশ্নের জবাব দে বেটা।”

ইয়ামিনের মন চাইল গম্ভীরমুখে বলতে,” কেন রে বেটা? তুই কোথাকার কোন সম্রাট যে প্রশ্ন করা মাত্রই জবাব দিতে হবে?”

ইউভান এবারও জবাব না পেয়ে ক্যানভাসের দিকে এগিয়ে যান৷ গাঢ় চোখে তাকান। ইয়ামিন সাথে সাথে সাবধান করল,” খবরদার, ওদিকে হাত বাড়াবি না। হাত ভেঙে ফেলব।”

রাগটা মুখে প্রকাশ করা যাচ্ছে না বলে সে মনে মনেই ইউভানকে গাল-মন্দ করে যায়। এতে মনের মধ্যে বুদবুদ করা রূঢ় মেজাজটা শান্ত হয় ধীরে ধীরে।

চকচক করছে ইউভানের দৃষ্টি। খানিকক্ষণ চুপ থেকে মুগ্ধতা নিয়ে বলে উঠলেন,” তোমার তো গায়ক না হয়ে চিত্রকর হওয়া উচিৎ ছিল ইয়ামিন ইব্রাহীম! ফার্স্ট ক্লাস পেইন্টিং এঁকেছো একদম। এতো সুন্দর হাসি আমি জীবনেও দেখিনি। মোনালিসার পেইন্টিংকেও হা’র মানাবে এই সুন্দর হাসি।”

ইয়ামিন এমন প্রশংসা নিতে পারে না৷ দগদগে ঘায়ের মতো টনটন করে ওঠে তার অন্তঃস্থ সত্তা। সে তার আঁকা ব্যক্তিগত রমণীর ছবি কাউকে দেখাতে ইচ্ছুক নয়। এই ছবির দিকে মুগ্ধ চোখে তাকানোর অধিকারও তার একান্ত। ইউভান শেখ সেখানে অনধিকারচর্চা করছেন। তিনি গা দুলিয়ে হাসলেন। ইয়ামিন কটমট করে বলল,” ভাগ শা’লা!”

__________
প্রিয়ন্তী বিরক্ত গলায় বলল,” আমরা এখানে এসেছিলাম কেন? শপিং-এর জন্য! কিন্তু সেটা ছাড়া বাদ-বাকি সব হচ্ছে।”

তৃষ্ণা আইপ্যাডে গেইমস খেলতে খেলতে বলল,” আমার পায়ে ব্যথা হচ্ছে। তাই আজকে আমি কোথাও যাব না।”

জানালায় নিষ্পলক তাকিয়ে আছে উষসী। আজকে স্নোফল অনেক কম। খুব ঝকঝক করছে কংক্রিট আর পাথরের রাস্তাগুলো। যেন স্বচ্ছ কাঁচের আয়না! প্রিয়ন্তী তার পাশে এসে বলল,” ঘুরতে বের হওয়ার জন্য আজকের চেয়ে ভালো দিন আর হয় না।”

উষসী উদাস মুখে বলল,” আমি কোথাও যাব না আপু, প্লিজ। ঠান্ডায় আমার মাথা ব্যথা করছে!”

প্রিয়ন্তী এবার পরাজিত,” বাহ, বেশ ভালো। একজনের পায়ে ব্যথা.. অন্যজনের মাথাব্যথা। বলি এখানে কি আমরা ঘাস কাটতে এসেছি?বাইরে না গেলে ঘরের ভেতর বসে থেকে কি করবি তোরা?”

তৃষ্ণা চোখ তুলে, ভ্রু কুঁচকে, নির্বিকার গলায় বলল,” কেন, রেস্ট করব!”

প্রিয়ন্তী চোখ বড় করে তাকাল৷ অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

” তুমি ভাইয়ার সাথে বের হয়ে গেলেই তো পারো। তোমাদের এখন একটু আলাদা স্পেস দরকার আছে, বুঝেছো!” উষসী এক চোখ টিপল।

” আমি বের হয়ে গেলে তুই কি করবি?”

” তৃষ্ণার সাথে বসে থাকব, ওর খেয়াল রাখব।”

তৃষ্ণা গুমোট কণ্ঠে বলল,” নো নীড। আমার খেয়াল আমি নিজে রাখতে পারি। বাচ্চা না আমি।”

কথাটুকু বলেই অন্যদিকে ঘুরে বসল সে। যেন বিরক্ত হয়েছে। উষসী হাসিমুখে প্রিয়ন্তীর দিকে তাকাল। প্রিয়ন্তী চিন্তিতবোধ করছে। তার মুখের সামনে চুটকি বাজিয়ে উষসী বলল,” এই..কি ভাবছো?”

” কিছু না।” নিজের মনের অহেতুক ভাবনাটাকে তাড়িয়ে দেয় প্রিয়ন্তী। হাসিমুখে বলল,” তোরা তাহলে সাবধানে থাকিস। আমরা বের হচ্ছি।”

এই কথা বলেই সে মোবাইল হাতে নিয়ে চলে যায় ফারদিনকে ফোন করতে। উষসী এই সুযোগে তৃষ্ণার উদ্দেশ্যে বলল,” তৃষ, আমি বাইরে যাচ্ছি বাবু। তোর ফুপস জিজ্ঞেস করলে বলবি হাঁটতে বের হয়েছি।”

” প্লিজ এন্টস, ডন্ট কল মি বাবু।”

” ও… আমি তো ভুলেই গেছিলাম। পাকনা বুড়া তুই।”

আদর করে তৃষ্ণার পেটে কাতুকুতু দেয় সে। তৃষ্ণা একটুও হাসে না। প্রথম কোনো বাচ্চা হিসেবে উষসী নিজের ভাগ্নেকেই দেখেছে যে কাতুকুতু খেয়েও হাসি আটকে রাখে। কি অদ্ভুত স্বভাব ছেলেটার!

________
ইউভান ঠান্ডা মাথায় বোঝানোর চেষ্টা করলেন,” তোমার এখন উঠতি ক্যারিয়ার। মানলাম তুমি পেইন্টিং-এও ভালো। কিন্তু এসব মেয়েদের ছবি এঁকে সময় নষ্ট করার সময় এখন না!”

ইয়ামিন অসহ্য হয়ে কথা শুনে যাচ্ছে। কারণ তাকে কেউ উপদেশ দিলে সে প্রচন্ড বিরক্ত হয়৷ আপাতত ভদ্রতার খাতিরে চুপ করে আছে। কিন্তু ইউভানকে তার সহ্য হচ্ছে না। কে বলবে, গতকালও যে তাদের মধ্যে ছিল গলায় গলায় ভাব! একটু পরেই রাফি ভেতরে এসে বলল,” স্যার, একজন এসেছে। আপনার সঙ্গে দেখা করবে।”

ইউভান শেখ কপালে ভাঁজ ফেলে উঠে দাঁড়ান। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে উষসী। তার ঠোঁটভর্তি হাসি। ইউভান শেখকে দেখেই সেই হাসি মিলিয়ে গেল। তীক্ষ্ণ নজরে উষসীকে পরখ করলেন ইউভান। তার হঠাৎ করে মনে হলো, কিছুক্ষণ আগে এই চমৎকার হাসিটাই পেইন্টিং-এ দেখেছিলেন। ওই ছবি প্রকাশ হলে এই হাসি বিখ্যাত হতে বেশি সময় লাগবে না! কারণ এই মেয়েটির হাসি মাধুরী দিক্ষিতের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।

উষসী সামান্য ইতস্তত হয়ে চোখ বড় করে বলল,” ইয়ামিন ভাইয়া কোথায়?”

ইউভান বিস্ময় ভরা কণ্ঠে বললেন,” ইয়ামিন তোমার ভাইয়া হয় নাকি?”

উষসী কপালের চুল কানে গুঁজল। ইউভান শেখ এখানে আছেন জানলে সে আসতো না। এখন কেমন অস্বস্তি লাগছে। সে বলল,” আসলে সম্পর্কে উনি ভাইয়াই হোন।”

” তোমাদের মধ্যে সম্পর্কটা ঠিক কেমন?” ইউভান প্রবল কৌতুহল প্রকাশ করলেন। হাতের ইশারায় সোফা দেখিয়ে বললেন,” বসো তো.. কথা বলি একটু?”

উষসী বাধ্য হয়ে বসল। তার চোখ জোড়া খুঁজছে ইয়ামিনকে। কোথায় সে? প্রশ্ন করার ফুরসত সে পাচ্ছে না কারণ ইউভান শেখ নিজেই তাকে একের পর এক প্রশ্ন করেই চলেছেন। তিনি ব্যাপক আগ্রহ অনুভব করছেন উষসীর প্রতি। ইয়ামিন অতি যত্নে এই মেয়েটির ছবি এঁকেছে, এর মানে নিশ্চয়ই সে খুব বিশেষ কেউ!

মিনিট পাঁচেক পর ইয়ামিন তার রুম থেকে বের হয়। করিডোরের সোফায় উষসী আর ইউভান শেখকে বসে থাকতে দেখে ওখানেই মূর্তির মতো স্থির হয়ে আটকে যায় সে। উষসী মাথা নুইয়ে, ঠোঁটে আলতো হাসি নিয়ে কথা বলছে লোকটির সাথে। অবশ্য বলবেই তো… ইউভান শেখের অন্ধ ভক্ত বলে কথা! এতোবড় অন্ধ ভক্ত যে রিয়াসাতের প্রতারণাও ধরতে পারেনি। ইয়ামিন বুঝলই না, তার ভেতরে আগ্নে*য়গিরি শুরু হয়েছে!

ফুডশপ থেকে চীজ বার্গার আর কোল্ড্রিংক কিনে নেয় সে। অনেকক্ষণ না খেয়ে আছে। কাউন্টার থেকে খাবার রিসিভ করে দূরে দাঁড়ায়। কিন্তু পরখ করতে থাকে উষসী আর ইউভানকে। এতোক্ষণ ধরে কি কথা বলছে ওরা? ইয়ামিন সেই কথার বিষয়-বস্তু শুনতে পাচ্ছে না। তবে উষসীকে খুব খুশি মনে হচ্ছে। ইয়ামিন থমথমে মুখে কিয়ৎক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ মোবাইল বের করে প্রিয়ন্তীকে ফোন দেয়।

” হ্যালো, ইয়ামিন!”

” হুম আপু, কোথায় তুমি?”

” আমি এইতো… ফারদিনের সাথে শপিং-এ বের হবো। তাই রেডি হচ্ছি। কেন? তোর কিছু লাগবে ভাই?”

” হুম। উষসী।”

” মানে?”

ইয়ামিন রোষ মেশানো গলায় বলল,” মানে ওকে এখান থেকে নিয়ে যাও। খুব বিরক্ত করছে ও।”

” ও এখন কোথায়?”

” আমার রুমের সামনের করিডোরে ইউভান শেখের সাথে বসে আছে।”

” বলিস কি? দাঁড়া, এখনি আসছি আমি।”

” আর শোনো, ও যাতে ঘর থেকে আর বের না হয়। বুঝতেই পারছো… এখানে অনেক ধরণের মানুষ। যত মানুষ তত গসিপ।”

” হুম, ঠিকাছে। আমি ওকে বুঝিয়ে বলব তুই চিন্তা করিস না।”

প্রিয়ন্তী মিনিট বাদেই ছুটে এলো। উষসীকে ইশারায় ডাকল। ইউভান শেখের থেকে বিদায় নিয়ে এগিয়ে আসে উষসী। প্রিয়ন্তী খপ করে তার হাত ধরে বলল,” রুমে চল।”

” কিন্তু কেন? আমি ইয়ামিন ভাইয়ের সাথে দেখা করতে এসেছিলাম। এখনও দেখা হয়নি।”

প্রিয়ন্তী আশেপাশে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,” ইয়ামিনই আমাকে ফোন করেছে। ও বলেছে তোকে ঘরের ভেতর নিয়ে আটকে রাখতে।”

উষসী এই কথা শুনে তব্দা খেল,” হোয়াট?”

” চল, ঘরে চল। তারপর বলছি।”

যাওয়ার পথে উষসী দেখল ফুডশপের এক কোণে দাঁড়িয়ে এদিকেই চেয়ে আছে ইয়ামিন। সগৌরবে কোল্ড্রিংকের বোতলে চুমুক দিচ্ছে আর তাদের দেখছে। রাগে মুখ অন্ধকার হয়ে এলো উষসীর। কটমটি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে যায় সে। কিন্তু তার ওই দৃষ্টি ইয়ামিনের ভেতরে ভাবান্তর ঘটায়। সে কি বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলল? তাও ভালো, অন্তত ইউভান শা’লার সামনে উষসী আর না আসুক!

ঘরের ভেতরে এসেই নিজের হাত ছাড়িয়ে বাজখাঁই গলায় চেঁচালো উষসী,” আমাকে কেন ঘরে আটকে রাখতে হবে এর মানে কি? আমি কি কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি?”

প্রিয়ন্তী বোঝানোর উদ্দেশ্যে বলল,”এটা ইয়ামিন ইব্রাহীমের রেপুটেশনের ব্যাপার।”

” মানে? উনার রেপুটেশনের সাথে আমি কিভাবে জড়িত?”

” তোদের নিয়ে অনেক গসিপ হচ্ছে সকাল থেকে। তাই এভাবে হুটহাট ওর রুমে না যাওয়াই ভালো। ও পাবলিক ফিগার। মিডিয়ার নজর সারাক্ষণ ওর দিকে তাক করা থাকে। তোকে ব্যাপারটা বুঝতে হবে উষু। বাড়াবাড়ি করিস না প্লিজ।”

উষসী চুপ হয়ে যায়। আসলেই তার ভুল হয়েছে। সে আর জীবনেও ওই ঘরমুখো হবে না৷ এজন্যই সেলিব্রিটিদের সে দুই চোখে দেখতে পারে না। এদের ব্যক্তিগত জীবন বলতে কিছুই নেই। এরা আগা-গোড়া পুরোটাই পাবলিক প্রোপার্টি। কি আশ্চর্য! রাগে গজগজ করতে থাকে সে। প্রিয়ন্তীর ফোন বেজে ওঠে। ফারদিন গাড়ি ঠিক করে নিচে দাঁড়িয়ে আছে। সে ‘বাই-বাই’ বলে দ্রুত চলে যায়।

উষসী মুখ ভার করে জানালার কাছে বসে। প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে তার। কখন ফিরবে সে নিজের দেশে? আর ভালো লাগছে না এখানে। মন উঠে গেছে একদম। কিছুক্ষণ পরেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো। তৃষ্ণা মাথা তুলে বলল,” এন্টস, কেউ মনে হয় এসেছে।”

উষসীর সম্বিৎ ফিরল। তুমুল বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলতেই হতবাক সে। দরজার ওই পাশে দাঁড়িয়ে আছে ইয়ামিন। নিজের ঘরে যেতে নিষেধ করে এখন আবার এসেছে কেন? লোকটা নাটকবাজ কেন এতো? সে এক্সাক্টলি কি চায়? ইয়ামিন অবশ্য তার দিকেই চেয়ে আছে। কিছু বলতে নিলেই উষসী ফট করে দরজা থেকে সরে গেল। ইয়ামিন তার পেছনে এসে ডাকল,” উষু।”

থামল উষসী। পেছনে না ঘুরে ঝাঁঝ নিয়ে বলল,” যা বলার ওখানে দাঁড়িয়ে থেকেই বলুন তারপর চলে যান। আফটার অল, আপনার রেপুটেশনের ব্যাপার! বলা তো যায় না, কোথায় কোন ক্যামেরা তাক করা আছে! হুট করেই শুরু হবে শাট- শাট! তখন আপনার রেপুটেশনের বারোটা বেজে যাবে।”

ইয়ামিন মৃদু হাসল৷ তাই দেখে আরও জ্বলে উঠল উষসী। থমথমে মুখে বিছানায় এসে বসল। অভিযোগ করে বলল,” কাল আমার সাথে সুইজারল্যান্ডে যেতে আমি তো বলিনি! করিডোরে সবার সামনে আমার হাত ধরে জোর করে আমাকে গাড়িতে উঠিয়েছেন আপনি৷ অথচ এখন আমাকেই ঘরে বন্দী থাকতে হবে! মানে সব দোষ আমার হয়ে গেল?”

ইয়ামিন আরও দুই কদম এগিয়ে এসে কোমল গলায় বলল,” দোষ তোমার না, দোষ আমারই। সব দোষ ইয়ামিন ইব্রাহীমের৷ এজন্যই সে স্যরি বলতে এসেছে। আই এম স্যরি।”

এই কথা বলেই কানে হাত গুজল ইয়ামিন। তার কানে ধরা কাঁচুমাচু মুখটি দেখে হেসে ফেলে উষসী। তবে সবচেয়ে বেশি মজা পায় তৃষ্ণা। সে একেবারে হাত তালি বাজিয়ে উল্লাসিত গলায় বলল,” ওয়াও…এন্টস, এবার তুমি আঙ্কেলকে জড়িয়ে ধরে পাপ্পা দাও প্লিজ।”

উষসী বিষম খেয়ে উঠল। ইয়ামিনও হকচকাল। কয়েক মুহূর্ত সবাই নীরব। তৃষ্ণা বেচারা নিজেও জানে না কত ভয়ংকর কথা বলে ফেলেছে! মাসুম দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে। উষসী চাপা গলায় ধমক দিয়ে উঠল,” এগুলো কি কথা? ছি!”

তৃষ্ণা সরল মুখে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,” পাপাও মাম্মামের কাছে ঠিক এভাবে কানে ধরে স্যরি বলে। তখন মাম্মাম কি করে..”

উষসী সজোরে তৃষ্ণার মুখ চেপে ধরল। ইয়ামিন হা করে তাকিয়ে আছে। ভীষণ লজ্জা আর অস্বস্তিতে মিশে যেতে যেতে উষসী উচ্চারণ করল,” আমি তোমার মাম্মাম না। আর উনিও তোমার পাপা না তৃষ্ণা! বুঝেছো?”

তৃষ্ণা ঝটিতে নিজ মুখ থেকে উষসীর হাত সরিয়ে শুধাল,” তাতে কি? তোমরা তো কাপল তাই না?”

উষসী চোখ কপালে তুলে তাকাল,” মানে? আমরা কাপল কেন হবো?”

” তাহলে আঙ্কেল এভাবে স্যরি কেন বলল তোমাকে? পাপা তো মাম্মাম ছাড়া কারো সামনে কান ধরে না। তারা কাপল হলে তোমরা না কেন? আঙ্কেলও তো পাপার মতোই করল।”

তৃষ্ণার কথাগুলো ধাম ধাম করে বজ্রপাত ফেলে মাথায়৷ কোনো উত্তর খুঁজে পায় না উষসী। বহু কষ্টে ঠোঁট নেড়ে শাসনের সুরে জানতে চায়,” তুই কয়টা কাপলকে দেখেছিস শুনি?”

তৃষ্ণা উত্তর দেওয়ার আগেই ইয়ামিন প্রসঙ্গ বদলে ফেলল,” আচ্ছা, একটু আগে কি তুমি আমার সাথেই দেখা করতে গিয়েছিলে?”

উষসী নিজেকে সামলে নিয়ে উত্তর দিল,”আপনার রুমে আমি আপনি ছাড়া আর কার সাথে দেখা করতে যাব? কিন্তু আপনি সেখানে ছিলেন না। দেখা হয়ে গেল ইউভান শেখের সাথে। তিনি অবশ্য আমাকে ইনভাইট করেছেন। আজ সন্ধ্যায় নাকি আপনাদের এ্যাওয়ার্ড শো আছে?”

” তুমি যেতে চাও?”

” নিশ্চয়ই চাই।” উষসীর উত্তেজনা মিশ্র কণ্ঠ। ইয়ামিন ভেবেছিল সে নিজেই যাবে না। তবে এখন উষসীর আগ্রহ দেখে মনস্থির করল যাবে।

” তখন কি বলতে এসেছিলে?” ইয়ামিন আবার প্রশ্ন করল। এই প্রশ্নে মিষ্টি হাসল উষসী৷ মাথা নিচু করে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বলল,”সিলেটে আপনি আমার পোর্ট্রেট আঁকতে চেয়েছিলেন। মনে আছে?”

” হুম….”

পরবর্তী কথা শোনার জন্য উদ্বেগ নিয়ে তাকিয়ে রইল ইয়ামিন। উষসী মেঝের মোটা কার্পেটে নখ খুঁটে বলল,” আমি রাজি।”

ইয়ামিনের ঠোঁট দু’টো হেসে উঠল, সেই হাসি পৌঁছে গেল চোখ অবধি। মুখে আনন্দের ঝিলিক নিয়ে শুধাল,” সত্যি?”

” কিন্তু শর্ত আছে।”

” কি?”

উষসী লাজুক স্বরে আবদার করল,” আমাকে ভায়োলিন বাজিয়ে শোনাতে হবে।”

ইয়ামিন আবারও হাসল। তারা একে-অপরের দিকে অযথাই তাকিয়ে রইল হাসি মুখে। তৃষ্ণা গালে হাত গুজে তাদের দু’জনকে দেখতে লাগল নিষ্পাপ দৃষ্টিতে।

চলবে

#উষসী_হাসবে_বলে (১২)
লিখা- Sidratul Muntaz

ঝকঝকে সাদা তুষারাচ্ছন্ন প্যারিসে এখন স্নিগ্ধতা নেমেছে। হিম বর্ষণ কমে আসায় সোনালী রোদের উত্তাপে রুক্ষ বরফ মেঘের মতো গলছে। টলটলে শীতল পানির ছটায় পাথর আর কংক্রিটের রাস্তাগুলো দেখাচ্ছে নিখুঁত, পরিচ্ছন্ন।প্রতিটি বড় গাছ থেকে বরফকুচি সরে উঁকি দিচ্ছে টকটকে গাঢ় সবুজ পাতা। স্নোফলের পরবর্তী রূপ চারদিকে চমৎকার স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে দিয়েছে।

হিমবাহের এই দেশে মোটা মোটা হুডি, জ্যাকেট, মাফলারে শরীর মুড়িয়ে চলতে খুব একটা কষ্ট হয় না উষসীর। আসলে প্রকৃতির এমন আশ্চর্য বৈচিত্র্যতা অবলোকন করাও এক সৌভাগ্য!

প্রিয়ন্তী ভ্রু কুঁচকে কৌতুহল প্রকাশ করল,” সকাল থেকেই শুনছিলাম এ্যাওয়ার্ড শো এর ব্যাপারে। কিসের এ্যাওয়ার্ড শো এটা?”

উষসী বিশাল জানালা থেকে নজর সরিয়ে বলল,” আমি নিজেও জানি না আসলে। ইয়ামিন ভাইয়া আমাকে বলেছে রেডি হতে। আমি আর তৃষ্ণা তার গাড়িতে যাবো। তুমিও কি যাবে?”

সন্ধ্যা নামতেই রেডিসনে উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে৷ এ্যাওয়ার্ড শো-এর আয়োজনে সকলে উত্তেজিত। করিডোরে ফটোশ্যুট করছেন যশস্বী ব্যক্তিরা। একটু পরেই রওনা হবে সবাই। সারি সারি গাড়ির হিড়িক পড়ে গেছে সড়কে।প্রাইভেট কারে যেতে সময় লাগবে একঘণ্টার মতোন! ভেন্যু এতো দূরে সিলেক্ট করার নির্দিষ্ট কারণ ছিল। গতবারও এ্যাওয়ার্ড শো প্যারিসে হয়েছিল। তখনও একই ভেন্যু সিলেক্ট করা হয়। সবাই স্মৃতি রোমন্থন করতে আবার সেখানেই যাচ্ছে।

উষসীর গায়ে একটা টকটকে লাল রঙের শাড়ি। প্রিয়ন্তী তাকে শাড়িটা পরিয়ে দিচ্ছে। অথচ সে এটা কিনেছিল নিজের জন্য।

” আমার পছন্দের শাড়ি তোকে পরালাম। ফারদিন খুব শখ করে আমাকে নিতে বলেছিল এটা। হুহ…” মনখারাপের সুর প্রিয়ন্তীর গলায়।

” তাহলে আমাকে কেন পরালে আপু?”

” এতো বড় একটা অনুষ্ঠানে যাচ্ছিস, ক্যামেরায় আসবি… দেখতে সুন্দর লাগতে হবে না?”

তারপর কি একটা ভেবে চিন্তায় বুদ হয়ে গেল প্রিয়ন্তী। উষসীর মাথাতেও তখন একই চিন্তা কড়া নাড়ছে। বাংলাদেশ থেকে যদি কেউ ওই এ্যাওয়ার্ড শো দেখে? ইউটিউবে আপ্লোড হবে নিশ্চয়ই। আর সে যেহেতু ইয়ামিনের সাথে যাচ্ছে, অবশ্যই তাকে ফোকাস করা হবে। ব্যাপারটা কি ঠিক? তৃষাণ জানতে পারলে কি হবে!

প্রিয়ন্তী হঠাৎ করে উষসীর হাত আঁকড়ে ধরে বলল,” আচ্ছা, তোর যাওয়া কি বেশি জরুরী উষু?”

উষসী আমতা-আমতা করল একটু,” আমি তো এখন বলে ফেলেছি। নিষেধ কিভাবে করব?”

অর্থাৎ সে নিজেই যেতে চাইছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল প্রিয়ন্তী। তার কাঁধে হাত রেখে বলল,” আচ্ছা, ক্যামেরা থেকে দূরে থাকিস।”

একটু পরেই ইয়ামিন এসে দরজায় ঠকঠক শব্দ করে। আলতো হাতে দরজাটা খুলে দেয় তৃষ্ণা৷ সে তৈরী হয়েছে ফিটফাট। ছোট্ট ব্লেজার পরেছে গায়ে। গলায় লাল রঙের বো টাই। তাকে পুরোপুরি তৈরী দেখে ইয়ামিন হেসে গালে হাত দিয়ে আদর করল। তারপর ভেতরে মাথা ঝুঁকিয়ে বলল,” আসতে পারি?”

প্রিয়ন্তী নিরস কণ্ঠে বলল,” আয়…”

ইয়ামিন ভেতরে ঢুকে উষসীকে দেখেই কেমন একটা হোচট খেল। থমকে গেল, লাল শাড়িতে মোড়ানো মেয়েটিকে তাজা লাল টিউলিপ ফুলের মতো লাগছে! সে হা করে তাকিয়ে রইল এমনভাবে যেন ওইটুকু সময় সে জানেই না কোথায় হারিয়ে গেছিল! প্রিয়ন্তী পুরো ব্যাপারটা খেয়াল করেছে, তার মুখ ইস্পাতের মতো শক্ত, থমথমে হয়ে যায়। অনাকাঙ্ক্ষিত আশঙ্কায় বুক কাঁপে। এই কথা আগে কেন চিন্তা করেনি সে?

ইয়ামিন মুচকি হেসে জানতে চাইল,” রেডি?”

উষসী পলক ঝাঁকিয়ে মাথা নাড়ল। যেন লজ্জা পাচ্ছে। ইয়ামিন হাত বাড়িয়ে ইশারা করল বাইরে। উষসী প্রিয়ন্তীর দিকে চেয়ে বলল,” বায়।”

প্রিয়ন্তী জোরপূর্বক মুখে হাসি আনতে চায়। কিন্তু তার দুশ্চিন্তায় মাথা চক্কর দিতে শুরু করেছে তখন৷ এতো বড় সর্বনাশ না হোক! কখনও না হোক! ইয়ামিনের মন দ্বিতীয়বার ভাঙুক তা প্রিয়ন্তী কখনও চায় না। ছেলেটা এবার আর সহ্য করতে পারবে না।

তারা চলে যাওয়ার পরে দুশ্চিন্তায় কিছুই ভালো লাগছিল না প্রিয়ন্তীর। ফারদিনের কাছে গিয়ে বলল,” চলো, একটু হেঁটে আসি বাইরে থেকে।”

ফারদিন খুশিমনে রাজি হলো,” নিশ্চয়ই। ”

সারাদিন ফারদিন প্রিয়ন্তীর সাথে থাকে৷ রাতে শুধু ইয়ামিনের সাথে গিয়ে ঘুমায়। তারা সন্ধ্যার রাস্তায় ঘুরতে বের হলো। একটা খোলা রেস্তোরাঁয় বসল। তার দুশ্চিন্তা গ্রস্ত মুখ দেখে ফারদিন হাতের উপর হাত রেখে জানতে চাইল,” কি হয়েছে আমার প্রিয়তমার?”

প্রিয়ন্তী হঠাৎ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল৷ তার ওমন কান্না দেখে থতমত খেয়ে থমকে গেল ফারদিন। বুঝতেই পারল না কি বলে সান্ত্বনা দিবে! কিংবা কারণ জিজ্ঞেস করবে কিভাবে? তবে তার মনে হলো, এই মুহূর্তে প্রিয়ন্তী কথা বলতে চায় না। শুধু একটু ভরসার আশ্রয় চায়। তার ছটফট করা বিচলিত মুখটি দেখে সেটাই মনে হলো।তাই সে শুধু প্রিয়ন্তীর মাথাটা নিজের কাছে এনে বুকে চেপে ধরল।

ইয়ামিন ড্রাইভিং সিটে বসেছে। তার পাশে তৃষ্ণা৷ কারণ সে সামনেই বসতে চায়। গাড়িতে সবসময় বাবার সাথে সামনে বসে অভ্যাস। এজন্যই জেদ ধরেছে। সুতরাং উষসীর আর ইয়ামিনের পাশে বসা হলো না। পেছনেই যেতে হলো। এতেই যেন একটু স্বস্তি পেল ইয়ামিন। ভালো হয়েছে, এবার সে উষসীকে মন-প্রাণ ভরে দেখতে পারবে ভিউ মিররে। পাশে বসলে তো বার-বার ফিরে দেখা যেতো না৷ কি আশ্চর্য, উষসীকে দেখতে পাবে এতে এমন খুশি লাগার কি আছে? ওই লাল শাড়িতে কিছু তো আছেই, উষসীর গায়ের সাথে মিশে জাদু সৃষ্টি করেছে। সেই জাদুময় মায়াজালে আষ্টেপৃষ্টে যাচ্ছে ইয়ামিন।

সাদা গাউন পরিহিত একটি মেয়ে গাড়ির জানালায় ঠকঠক করল। ইয়ামিন গ্লাস নামাতেই সে হাস্যমুখে বলল,” এখানে কয়জন আছে? আমি কি বসতে পারি?”

উষসী মেয়েটিকে চেনে। মোটামুটি জনপ্রিয় মুখ। ইউভান শেখের সাথে ভবিষ্যৎ সিনেমার নায়িকা হবে সে এমন গুঞ্জন আছে। উষসী বলতে চাইল,” আচ্ছা আসুন।”

কিন্তু বলতেই পারল না, এর আগেই সামনে থেকে ইয়ামিন বলল,” না।”

মেয়েটির মুখ আঁধার হয়ে গেল সরাসরি প্রত্যাখ্যানে। ইয়ামিন ভদ্রতার হাসি দিয়ে বলল,” আসলে জায়গা নেই। ইন্সট্রুমেন্টস দিয়ে সিট ভরে গেছে। ”

এই কথা বলেই ইয়ামিন গাড়িতে লাইট জ্বালল। তখন দেখা গেল উষসীর বসার জন্যই এক টুকরো জায়গা খালি। বাকি জায়গা ক্যানভাস, কালার বক্স, বাদ্যযন্ত্রে ভর্তি। এর মধ্যে ভায়োলিন দেখে উষসীর ভেতর দামামা বেজে উঠল। মেয়েটি আফসোস নিয়ে বলল,” ওপসস, তাহলে ঠিকাছে। আমি অন্য গাড়িতে যাচ্ছি। ”

” হুম।”

” বাই ইয়ামিন।”

সে ঘুরে গিয়ে ইয়ামিনকে আলতো করে জড়িয়ে ধরল। এয়ার কিস করল। উষসী বুঝতে পারে না এসব করার কি দরকার! সে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকল। হঠাৎ ভিউ মিররে নজর যেতেই দেখল ইয়ামিন তাকেই দেখছে। শরীর কেমন হালকা অবশ হয়ে ওঠে তার। নিজেকে ধাতস্থ করতে অযথাই ফোন টিপতে শুরু করে৷ তারপর আবার আঁড়চোখে তাকায়। এইতো ইয়ামিন নজর ফিরিয়েছে.. ড্রাইভিং-এ ব্যস্ত হওয়ার জন্য। তাই এবার উষসী তাকিয়ে রইল ওর দিকে।

ইয়ামিন সম্পূর্ণ ভিন্ন রাস্তা অবলম্বন করেছে। এখান থেকেও ভেন্যুতে পৌঁছাতে দুই-তিন ঘণ্টার মতো লেগে যাবে। উষসী বলল,” কোনো গাড়ি দেখা যাচ্ছে না কেন আশেপাশে? আমরা কি বেশি দ্রুত চলে যাচ্ছি?”

ইয়ামিন বলল,” উহুম, আমরাই সবচেয়ে লেইট হবো।”

আর কিছু জানতে চায় না উষসী৷ দেরি হলেই ভালো। গাড়ির ভেতরে শুধু তারা, এই পথ কখনও শেষ না হোক! পাশের জিনিসগুলোতে হাত রেখে উষসী বলল,” এতোকিছু কেন নিচ্ছেন? ওখানে গিয়েও কি ছবি আঁকবেন আপনি?”

ইয়ামিন হেসে বলল,” না, এগুলো জাস্ট সিট ব্লক করার জন্য। ”

উষসী নীরব হাসল। এর মানে ইয়ামিন চায়নি এই গাড়িতে অন্যকেউ আসুক। গাড়িতে উষ্ণ পরিবেশ পেয়ে আরামে ঘুমের হাই তুলছে তৃষ্ণা। ইয়ামিন পাশ ফিরে জিজ্ঞেস করল,” আর ইউ স্লিপ্লি?”

তৃষ্ণা হাত ভাঁজ করে দায়সারা জবাব দিল,” নো, আই এম বোরড। ”

উষসী বলল,” পেছনে চলে আমার কাছে চলে আয় বাবা। আমি তোকে ঘুম পাড়িয়ে দেই।”

” কেন? আমি ঘুমিয়ে কি করব?”

তারপর একটু থেমে বলল,” তোমার জন্যই এসেছি.. নাহলে তো আসতামই না।”

উষসী একটু ভ্যাবাচেকা খেল। তারপর হেসে বলল,” আমার জন্য মানে কি? আমিই তো তোর জন্য এসেছি। তুই একটু ঘুরতে যেতে চাইছিলি। নাহলে এতো রাতে আমিও বের হতাম না।”

তৃষ্ণা বিরক্তির সাথে বলল,” কিন্তু তুমিই আমাকে শিখিয়ে দিয়েছো ফুপসকে ম্যানেজ করার জন্য৷ আমি তো ঘুমাতে চেয়েছিলাম। জোর করে আমাকে উঠিয়ে এনেছ। ইয়ামিন আঙ্কেলের সাথে তোমাকে নিয়ে গেলে নাকি আমি চকলেট পাবো৷ ডন্ট লাই। পাপা বলেছে মিথ্যা কথা বললে দাঁতে কেভিটি হয়।”

কথাটা বলেই দায়সারাভাবে আবার হাই তুলল তৃষ্ণা। এবার আড়ষ্ট হয়ে চুপসে গেল উষসী। লজ্জায় হা করে রইল। ভিউ মিররে তাকাতেই দেখল ইয়ামিনের ঠোঁটে একবিন্দু শিশিরকণার মতো মুচকি হাসি। সেই একবিন্দু হাসি উষসীর বুকে হাজার বিন্দু লজ্জায়ময় ফেনীল ঢেউ তুলে দিল!আজকে সে তৃষ্ণাকে চুপচাপ দেখে একটু অবাকই হয়েছিল। কিন্তু এই ছেলে তো চুপচাপ থাকার বস্তু না। এখন ঠিকই একটা বেফাঁস কথা বলে উষসীকে বিপদে ফেলে দিল। সে এবার এই মুখ কোথায় লুকাবে? ওইতো ইয়ামিন এখনও হাসছে। দেখে মনে হলো মনের সব কথা জেনে ফেলছে সে। শিট! শিট!

চলবে

#উষসী_হাসবে_বলে (১২-বাকি অংশ)
লিখা- Sidratul Muntaz

টপটপ করে তুষার পড়ার দৃশ্য। থমথমে নীরবতা। বাতাসে স্নিগ্ধ ছন্দ, ঘ্রাণ। মন কেমন করা সৌন্দর্য্য চারদিকে!

তৃষ্ণা ঘুমিয়ে পড়েছে। বার-বার তার মাথা হেলে পড়ে যাচ্ছিল। গাড়ির সিটের থেকে তার শরীরের আয়তন নগন্য হওয়ায় পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তাই তাকে পেছনে আনা হয়েছে। উষসী কোলে নিয়ে রেখেছে তৃষ্ণাকে। পাশে জিনিসপত্রের জন্য বসার জায়গা নেই।

ভীষণ সুন্দর চাঁদমুখো একটা আট বছরের বাচ্চা ছেলে গুটিশুটি হয়ে ঘুমাচ্ছে উষসীর কোলে। অনবরত তার মাথায় হাত বোলাচ্ছে উষসী। কি ভীষণ নিষ্পাপ তার ছোট্ট বাবাটা! আলতো করে উষসী তৃষ্ণার গালে আর কপালে চুমু দেয়। দৃশ্যটা ভিউ মিররে দেখতে থাকে ইয়ামিন।ড্রাইভিং এর ফাঁকে বারংবার চোখ তুলে তাকায় সে।

উষসী ঝাপসা জানালা দিয়ে মুগ্ধ চোখে দেখে তুষারপাতের নৈসর্গিক রূপ। ছোট ছোট পাফবলের মতো সাদা তুষার… কি সুন্দর! সে হিমবাহের দেশে এসে তুষারফুলের এই অনিন্দ্য সৌন্দর্য্যের প্রেমে পড়ে গেছে! তবে, শুধু কি তুষারের প্রেমেই পড়েছে? আর কারো নয়? কথাটা ভেবেই একবার চোখ তুলে তাকাল ইয়ামিনের দিকে। মুহূর্তেই চোখাচোখি হয় তাদের। দুইজনেই অপ্রস্তুত হয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়। প্রতিটি মুহূর্ত এতো ভালো লাগছে কেন? বুকের বামপাশ অবশ হয়ে আসছে কেন? এতো নীরবতাও সহ্য হচ্ছে না আর। কেমন ব্যাকুলতা বেড়ে যাচ্ছে।

নিজের বুকের কম্পন স্বাভাবিক করতে উষসী কথা শুরু করল,” এই জায়গাটা অনেক সুন্দর। আমি আগে কখনও নিজ চোখে এমন তুষারপাত দেখিনি। ভাগ্যিস আজ দেখতে পাচ্ছি! নাহলে রহস্যময় পৃথিবীর এই অলীক সৌন্দর্য্য অজানাই রয়ে যেতো।”

” ভালো করে দেখতে চাও? গাড়ি থামাব?” আদুরে কণ্ঠে প্রশ্ন করে ইয়ামিন।

উষসীর মন দুলে ওঠে মুগ্ধতার আবেশে। মাথা নাড়ে সে।ইয়ামিন একটা সুন্দর নিরাপদ জায়গা দেখে গাড়ি থামাল। উষসী এখন গাড়ি থেকে নেমে হাত দিয়ে তুষার স্পর্শ করবে। পাশে থাকবে ইয়ামিন। কি সুমধুর মুহূর্ত,
সারাজীবন মনে রাখার মতো ঐশ্বরিক স্মৃতি! ভেবেই বিবশ হয় দেহ। ছেয়ে যায় মন-প্রাণ উথাল পাথাল সুখের আলোড়নে।

ইয়ামিন ঘুরে এসে দরজা খুলে দিল। উষসী একটু ইতস্তত করে বলল,”কিন্তু… তৃষ্ণা?”

ইয়ামিন হাত বাড়িয়ে বলল,” আমার কোলে দাও।”

ঠিক তখনি একটা পাতলা তুষার বিন্দু এসে ইয়ামিনের চোখের পাতায় লেপ্টে যায়। এক চোখ বুজে হালকা হাসে ইয়ামিন। কি সুন্দর লাগে সেই দৃশ্য!

উষসী মোহাবিষ্ট গলায় বলল,” এই সুন্দর জায়গা ছেড়ে আমাকে আটদিন পরেই চলে যেতে হবে। কি আশ্চর্য তাই না? অন্যদিকে প্রিয়ন্তী আপু এমন সুন্দর জায়গায় সারাজীবন কাটাবে। আমার খুব ঈর্ষা হচ্ছে তাকে এই মুহূর্তে।”

ইয়ামিন চোখটা মুছে তাকায় তৃষ্ণার দিকে। পরক্ষণেই মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,” আমারও। ”

” আপনারও?”

উষসী অবাক হয়ে অচিরেই শুধাল আবার,” প্রিয়ন্তী আপুকে আপনি ঈর্ষা করছেন ?আপনিও তো চাইলেই থাকতে পারেন এখানে যতদিন ইচ্ছা।”

” প্রিয়ন্তী না, তৃষ্ণা।”

ইয়ামিন তার দৃষ্টি তখনও তৃষ্ণার উপর নিবদ্ধ রেখেছে। উষসী তাকাল তৃষ্ণার দিকে। ছেলেটা দুইহাতে তার গলা জড়িয়ে ধরে আছে। মাথা লেপ্টে রেখেছে তার বুকে। উষসীর আঙুলগুলো বিচরণ করছে তৃষ্ণার মাথায়। ইয়ামিনের বাক্য শুনে আঙুলের সেই বিচরণ থেমে যায়। সে অবাক দৃষ্টিতে তাকায়।

” কি?”

ইয়ামিনের ঘোর কাটে। “কিছু না” বলেই সে ছো মেরে তৃষ্ণাকে কেড়ে নেয় উষসীর কোল থেকে। যেন তৃষ্ণার ওখানে বসে থাকাটাই তার সহ্য হচ্ছে না কোনমতে! উষসী হাঁ করে থাকে। লজ্জার উষ্ণ পরশ এসে ছড়িয়ে যায় চোখ-মুখে। শরীরে বয়ে যায় তীক্ষ্ণ স্রোত। কেমন অদ্ভুত এক অস্থির অনুভূতি টাল-মাটাল করে দেয় ভেতর থেকে…নিবিষ্ট হয়ে পড়ে সে।

কখনও কি ভেবেছিল কারো কথার দ্বারাই এইভাবে ভেতর থেকে এলোমেলো হবে সে! অনুভূতির সমুদ্রে ভেসে কিনারা হারাবে; তাও আবার কে সেই মানুষটা? ইয়ামিন ইব্রাহীম! ভাবতেই অবাক লাগে!

দু’জন পাশাপাশি দাঁড়ায়৷ উষসী হাত বাড়িয়ে শীতল, শুভ্র তুষার স্পর্শ করে। গালে মাখে। তারপর মুগ্ধতায় চোখ বুজে হেসে ওঠে। ঠিক সেই মুহূর্তে পৃথিবীর কোনো সৌন্দর্য্যে আর মন বসে না ইয়ামিনের। সেলোটেপের মতো মনটা আটকে যায় রূপসীর হাসি মাখা জাদুতে।

উষসী যখন তৃপ্তিমাখা কণ্ঠে বলল,” আমি এতো সুন্দর দৃশ্য কখনও দেখিনি।”

তখন ইয়ামিন তার বুকের বামপাশে হাত রেখে বলল,” আমি তো দেখছি।”

ফোন বেজে ওঠে হঠাৎ। উষসী ঘুরে তাকায়। দেখে, ইয়ামিন তৃষ্ণাকে গাড়ির সিটে রেখে ফোন রিসিভ করছে। তারপর যত দ্রুত সম্ভব কথোপকথন শেষ করে ফোন রেখে দেয়। তবে কথার বিষয়-বস্তু শুনে মনে হয় জরুরী ব্যাপার। উষসী জানতে চাইল,” কি হয়েছে? ভেন্যু থেকে কেউ ফোন করেছিল?”

ইয়ামিন দায়সারাভাবে বলল,” ওরা পৌঁছে গেছে। অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। এটাই। ”

” আপনাকে দ্রুত যাওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছে তাই না?”

ইয়ামিন মাথা নেড়ে বলল,” না গেলেও অসুবিধা নেই। এটা এমন কোনো জরুরী বিষয় না।”

উষসী হাসে। ইয়ামিনের না বলা অদৃশ্য বাক্যটিও শুনতে পায়। এই মুহূর্তে উষসীর খুশির থেকে কিছুই জরুরী নয় তার কাছে। এটাই তো!

তার পাগলের মতো খুশি লাগে। তবুও একটু পর বলল,” অনেক হয়েছে। চলুন এবার আমরা যাই। নাহলে আপনার ফ্যানরা আমাকে অভিশাপ দিবে।”

ইয়ামিন উষসীর দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে ছিল। এবার মুখ ফিরিয়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল,” আমার যেতে মন চাইছে না।”

” কেন? তাহলে কি করতে মন চাইছে?”

ইয়ামিন আবার তাকাল তার দিকে। ওই দৃষ্টি ঘায়েল করে দেয়। দম আটকে আসে প্রচন্ড ভালো-লাগায়৷ উষসী নিজেকে সামলে নিল। ইয়ামিন ঠান্ডা স্বরে বলল,” ভায়োলিন বাজাতে।”

এইটুকু বলেই গাড়ির ভেতর থেকে বের করে আনে বাদ্যযন্ত্র। কি ভয়ংকর সুখে উষসীর হৃদয়টা যে আন্দোলিত হচ্ছে তা সে বোঝাতে পারবে না কাউকে। কেবল গাঁট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এই অনুভূতি প্রকাশের ভাষা তার শব্দ ভান্ডারে নেই। তাই কিছু বলতেও পারে না মুখে। চুপচাপ শুনে যায় শ্রুতিমধুর সুর।

ইয়ামিন একটু দূরে গিয়ে কাঁধের উপর ভায়োলিন নিয়ে বাজাতে শুরু করে। চোখ বন্ধ করতেই স্মৃতিপটে নেচে বেড়ায় উষসীর হাসি মাখা মুখ। সে আবিষ্ট হয়ে বাজায়। নিজের সমস্ত আবেগ-অনুভূতি ঢেলে দেয়। উষসীর মনে হয়, এর চেয়ে সুন্দর সুর পৃথিবীতে আর কোথাও নেই।

বেশ কিছুক্ষণ ভায়োলিন শোনে সে। হঠাৎ চোখ তুলে তাকাতেই বুকের ভেতর দুম করে উঠল। ইয়ামিন যেখানে দাঁড়ানো ঠিক তার উল্টো পাশ থেকে আসছে একটা গাড়ি। বড় বড় হেডলাইটের আলো আসছে। ইয়ামিনের চোখ বন্ধ তাই সে দেখছে না। ভায়োলিনের শব্দে গাড়ির আওয়াজটাও শুনছে না। উষসী এক দৌড়ে ছুটে যায়।

গায়ের সমস্ত শক্তি একত্র করে ইয়ামিনকে ধাক্কা মারে কিন্তু নিজেই পিছলে যায়। মাত্র কয়েক মুহূর্তের আকস্মিক ব্যাপারটায় তাল সামলাতে পারে না ইয়ামিন। ঠাস করে নিচে পড়ে যায়। উষসীও পড়ে তার পাশে। দু’জনেই শীতল বরফের উপর গড়াগড়ি খেয়ে ভিজে ওঠে।

ইয়ামিন কি মনে করে যেন হেসে দেয়। উষসী বড় বড় চোখে তাকায়। গাড়িটা কোথায় গেল? ইয়ামিন হাসি মুখে প্রশ্ন করল,” কি ব্যাপার? তুমি এক্সাক্টলি কি করতে চাচ্ছিলে? বরফে সাতার?”

উষসী গাড়িটা আর খুঁজে পায় না৷ গায়েব হয়ে গেল নাকি? সে উঠতে নিলেই ইয়ামিন হাত টেনে পুনরায় শুয়িয়ে দেয় তাকে। উপরে তাকাতে বলে। উষসী দেখে কালো আকাশ থেকে অঝোরে নক্ষত্র ঝরে পড়ছে। লক্ষ-কোটি তারা ঝলমলে বিশাল আকাশটার অন্যরকম সৌন্দর্য্যের রহস্য সে আবিষ্কার করে আজ। যে ভয়ানক সৌন্দর্য্য আগে কখনও দেখা হয়নি। হাঁ করে চেয়ে থাকে উষসী। ইয়ামিন নিজের মাথার পেছনে হাত রেখে হাসি মুখে ভাবে, আজ তার জীবনের শ্রেষ্ঠতম রাত। শুধু এমন একটা স্বপ্নময় রাতের আশাতেই জীবনের গত ছাব্বিশটি শীতকাল পার করেছিল। আজ এই সাতাশতম শীতে স্বার্থক হলো! ” হ্যাপি উইন্টার সিজন ইন ইউর ইন্টায়ার লাইফ… কংগ্রাচুলেশনস, ইয়ামিন ইব্রাহীম।” বিড়বিড় করে ইয়ামিন।

উষসী হঠাৎ অস্থিরতা ভরা কণ্ঠে বলল,” কিন্তু গাড়িটা কই গেল? আমাদের দিকেই আসছিল একটু আগে।”

ইয়ামিন উঠে বসল। শ্বাস ছেড়ে বলল,” কোথায় গাড়ি?”

” ওইতো, ওইদিক থেকে। ”

উষসীও উঠল৷ তার হাতের ইশারাকে অনুসরণ করে সেদিকে তাকায় ইয়ামিন৷ তারপর ছোট্ট করে দম নিয়ে বলল,” এটা ওয়ান ওয়ে রোড। ওদিক থেকে কোনো গাড়ি আসবে না এখানে। যদি আসেও তো এইদিক থেকে আসবে।”

” তাহলে আমি যে দেখলাম…”

” তুমি মনে হয় ওই পাশের রোড দেখেছো। অন্ধকার তো, তাই আই ইলিউসান হয়েছে তোমার।”

নিজের করা বোকামিতে লজ্জা পায় উষসী৷ মাথা নিচু করে বলল,” স্যরি, আপনাকে ফেলে দিলাম। ব্যথা পেয়েছেন?”

” আমার কিছু হয়নি। কিন্তু তুমি তো কাঁপছো।”

উষসী নিজের দিকে তাকায়। পাতলা শাড়িতে ঠান্ডায় মরে যাচ্ছে সে। গায়ে ওভারকোট ছিল কিন্তু গাড়িতে ওঠার পর সেটা খুলে রেখেছিল৷ আর পরা হয়নি। এই মুহূর্তে গা ভিজে ওঠা মারাত্মক ঠান্ডায় হাত-পা অবশ হয়ে আসছে। উষসী নড়তেও পারছে না। কথা বলতে নিলেও দাঁতে দাঁত লেগে আসছে। ইয়ামিন তাকে হাত ধরে ওঠাল। তার ওই স্পর্শ এতো উষ্ণ!

ইয়ামিন তার গায়ে হাত রেখে বলল,” শাড়ি অনেকটাই ভিজে গেছে দেখছি। এটা খুলে ফেলা উচিৎ। ”

” কিন্তু…”

” গাড়িতে গিয়ে চেঞ্জ করো। শাড়িটা খুলে আমার জ্যাকেটটা পরো। তারপর তোমার ওভারকোট পরো। তাহলেই হবে।”

নিজের জ্যাকেট খুলে বাড়িয়ে দেয় ইয়ামিন। উষসী দ্বিধাজড়িত হয়ে বলল,” কিন্তু আমি আপনার জ্যাকেট নিলে আপনার তো ঠান্ডা লাগবে।”

” আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। তোমার চেয়ে আমার অবস্থা ভালো। ”

উষসী আর কিছু বলে না। ইয়ামিনের গায়ে ল্যাদারের জ্যাকেট। তাই সেটা ভেজেনি। তার কথামতোই কাজ করে উষসী। ততক্ষণ ইয়ামিন তৃষ্ণাকে কোলে নিয়ে দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এতোকিছুর মাঝে তৃষ্ণার ঘুম ভেঙে গেছে। তবে সে উঠতে চাইছে না৷ চোখ বন্ধ করে কোলে পড়ে থাকতেই তার ভালো লাগছে।

উষসীর চেঞ্জ করা হয়ে গেলে ডাকল। ইয়ামিন এসে তৃষ্ণাকে উষসীর কোলে দিতে নিলেই সে ক্ষেপে উঠল। সে কি বাচ্চা যে কারো কোলে শুবে? নিজের মতো পেছনের পেছনের সিটে এসে লম্বালম্বিভাবে শুয়ে পড়ল। তারপর ঘন হাই তুলল। গভীর ঘুম পাচ্ছে তার। ইয়ামিন জিনিসপত্র গুলো প্রয়োজনে সরাল। উষসী তখন বলল,” আপনি ঠান্ডায় কাঁপছেন।”

ইয়ামিন সামনে যেতে যেতে দুইহাত ভাঁজ করে শরীর গুটিয়ে বলল,” অসুবিধা নেই। আই উইল ম্যানেজ।”

” আপনি চাইলে আমার শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে রাখতে পারেন।”

এই কথা বলে উষসী জীভ কাটে। ধূর, কি বলল? ইয়ামিন হাসে আর শুধায়,” ভেজা শাড়ি?”

” স্যরি।” উষসী বার-বার লজ্জা পাচ্ছে। তার মাথা কাজ করছে না কেন আজকে? ইয়ামিন ড্রাইভিং সিটে বসলে সেও বসে পাশে। তারপর হঠাৎ চোখে চোখ রেখে আবেগপ্রবণ কণ্ঠে বলল,” আপনার ভায়োলিনের সুর আমার হৃদয় হরণ করেছে।”

এইটুকু বলেই ঝুঁকে আসে উষসী। নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে। ইয়ামিন বিমোহিত হয়ে দেখে, উষসীর গাঢ় দৃষ্টি, গায়ের সুবাস ভীষণ মিষ্টি। এতো নেশা জাগে! কয়েক মুহূর্তে কি হয়ে যায় তা সে জানে না। উষসী অনেক কাছে তার।

ইয়ামিন ঘাড়ের উপর হাত রেখে আরও কাছে টেনে আনে। উষসী চোখ বুজে ফেলে লজ্জায়। ইয়ামিন বিবশ হয়ে জাদুময় হাসি তৈরীর ওই চমৎকার ঠোঁটজোড়ায় চুমু বসাতে নিলেই চেঁচিয়ে ওঠে তৃষ্ণা। তার প্রস্রাবের প্রবল বেগ চেপেছে।

” টয়লেট, টয়লেট” বলে অস্থির হয়ে ওঠে! ইয়ামিন ব্যস্ত ভঙ্গিতে পেছনে যায়। উষসীর হাত-পা কাঁপতে থাকে। দুই হাতে মাথা চেপে ধরে মুখ গুটিয়ে নেয় সে।

ঘাসের উপর তুষারের টুকরো গুলো মেঘের মতো দেখাচ্ছে। সাদা মেঘ যেন গলে পড়ছে আকাশ থেকে। ফারদিনের কাঁধে মাথা রেখে উদাস ভঙ্গিতে সেদিকেই চেয়ে থাকে প্রিয়ন্তী। একটু পর ফারদিন তার কাঁধে হাত রাখে। প্রিয়ন্তী চোখ তুলে তাকালেই সে আঙুল তুলে দেখায় একটা ছোট্ট বাচ্চা কেমন বরফ ধরতে পেরে আনন্দে নেচে নেচে হাসছে। দৃশ্যটা দেখেই হেসে উঠে প্রিয়।মন ভালো হয় তার। ফারদিন ফিসফিস করে বলল,” বিয়ের পর আমাদের একমাত্র মিশন এমন ফুটফুটে বাচ্চা দিয়ে ঘর ভরে ফেলা।”

প্রিয়ন্তী এবার শব্দ করে হেসে উঠল। সেই হাসির দিকে চেয়ে থেকে ফারদিন সময় নিয়ে জানতে চাইল,” এবার কি বলা যায়, কেন মনখারাপ ছিল আমার প্রিন্সেসদের আম্মুর?”

প্রিয়ন্তীর মুখের হাসি ম্লান হয় খানিক। তখন ফারদিন তাকে কাছে টেনে বলল,” থাক, বলতে হবে না৷ তাও আবার মনখারাপ কোর না।”

প্রিয়ন্তী এবার বলল,” আমি ভালোবাসি তোমাকে, ফারদিন।”

” আমিও ভালোবাসি।”

কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হঠাৎ শঙ্কা নিয়ে সে উচ্চারণ করল,” ইয়ামিন উষসীর প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েছে।”

ফারদিনের ভ্রু কুঁচকে আসে। অবাক হয়ে বলল,” এই কথা কোথ থেকে এলো?”

” আমি আজকে সন্ধ্যায় ওদের দেখেছি। আমার আর কিছু বুঝতে বাকি নেই। আমি নিশ্চিত যে ওদের মধ্যে কিছু হয়ে গেছে।”

” কি হয়েছে?” ফারদিনের কণ্ঠ ভীত শোনায়। প্রিয়ন্তী নিজেকে সামলে বলল,” যা ভাবছো তা না৷ আমি জাস্ট মন আদান-প্রদানের কথা বলছি। উষু খুব ভালো মেয়ে। আর আমার ভাই ইয়ামিনও খুব ভালো। তারা কখনও ভুল কিছু করবে না। কিন্তু মনের উপর তো আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই, তাই না?

করুণ দেখায় প্রিয়ন্তীর দৃষ্টি। ফারদিন হেসে ফেলে বলল,” এতে এতো টেনশনের কি আছে? আর মনখারাপ করার মতোই বা কি হলো? বরং আমার তো মনে হচ্ছে ব্যাপারটা সুন্দর। ওদের দু’জনকে দারুণ মানাবে।”

প্রিয়ন্তী কঠিন দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,” তুমি যতটা সুন্দর ভাবছো, এই ব্যাপারটা তার চেয়েও অসুন্দর, বীভৎস, নিষ্ঠুর!”

ফারদিন অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে ঠোঁট উল্টায়। কিছুই বোঝে না। প্রিয়ন্তীও আর কিছু বলতে চায় না। মাথায় হাত চেপে ধরে রাখে। তাদের বিয়ের প্রোগ্রাম দ্রুত এগিয়ে আনা উচিৎ। কোনো অঘটন ঘটার আগেই উষসীকে বাংলাদেশে পাঠাতে হবে।

তৃষ্ণা টয়লেটে ঢুকেছে। পাবলিক টয়লেট তাই ইয়ামিনও ভেতরে যেতে চেয়েছিল৷ কিন্তু তৃষ্ণা রাজি হয়নি। সে কারো সামনে টয়লেট করবে না। জানাল সে নাকি একাই সব সামলাতে পারবে। সত্যি তাই হলো। সুন্দরভাবে কাজ সেড়ে টিস্যু দিয়ে হাত মুছে বেরিয়ে এলো। কপালে সামান্য কুঞ্চন। ঘুম ভাঙার পর তার মেজাজটা একটু খারাপ থাকে। অল্পতেই অধৈর্য্য লাগে। ইয়ামিন হাসি মুখে বলল,” ডান?”

তৃষ্ণা বলল,” ইয়েস.. ডান।”

এই কথা বলেই হাত দিয়ে থাম্বস আপ দেখাল। ইয়ামিন হেসে ফেলল। তার হাসি দেখে কিছুক্ষণ পর হেসে ফেলল তৃষ্ণা নিজেও৷ মিষ্টি মুখের দুষ্ট ছেলেটার হাসি এতো সুন্দর! দীর্ঘ হাসির সাথে বেরিয়ে এলো তার গেজ দাঁত। হঠাৎ করেই চিলিক দিয়ে উঠল ইয়ামিনের বুক।

এই প্রথম তৃষ্ণাকে হাসতে দেখেছে। এই হাসি দেখেই মনে পড়ে যায় উষ্ণতার কথা। উষ্ণতার মুখেও গেজ দাঁত ছিল। সেও এভাবেই হাসতো। সবসময় গোমরা মুখে থাকা মেয়েটি যখন হাসতো, দেখতে কি যে ভালো লাগতো! তাদের শেষবার দেখা হওয়ার মুহূর্তটি মনে পড়ে। সেদিন ইয়ামিন উষ্ণতাকে কথা দিয়েছিল, আর কোনোদিন মুখোমুখি হবে না!

সব কেমন এলোমেলো হয়ে আসে। হুট করেই জীবনের বিষাক্ততা অনুভব হয়। তৃষ্ণা হেঁটে চলে যাচ্ছে দূরে। ইয়ামিন দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে। ওদিকে কদম বাড়ানোর বল পায় না আর। একটু পর বাচ্চা ছেলেটা গাড়িতে উঠে গেলেই ইয়ামিন বিপরীত দিকে হাঁটতে শুরু করে। কোথায় যাচ্ছে তা সে জানে না। শুধু জানে, তার সুন্দর স্বপ্নটা ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে। বাস্তবতার নিকষ অন্ধকারে আছড়ে পড়েছে সে৷ এবার তাকে ওই সুন্দর স্বপ্ন থেকে বের হতেই হবে! ইয়ামিন হঠাৎ হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয়। একসময় ছুটতে শুরু করে।

চলবে