উষসী হাসবে বলে পর্ব-২৯+৩০

0
262

#উষসী_হাসবে_বলে (২৯)
লিখা- Sidratul Muntaz

ইয়ামিনের ফোন সারারাত বন্ধই ছিল। এদিকে বৃষ্টিতে ভেজার কারণে উষসীর জ্বর চলে এসেছে। তার উপর ঘুম হয়নি রাতে। মাথাটা প্রচন্ড ধরে আছে এজন্য। এই অবস্থায় ভার্সিটিও যেতে ইচ্ছে করেনি। সে ভোর পর্যন্ত জেগেছিল। তারপর কিছুক্ষণের জন্য একটু চোখ লেগে আসে। তখনি দরজায় করাঘাত হয়।

” উষু, দরজা খোল মা। এখনও ঘুমাচ্ছিস? ভার্সিটিও তো গেলি না।”

আড়মোড়া ভেঙে দরজা খুলল উষসী। মা দাঁড়িয়ে আছেন হাতে গরম রুটি আর ডিম পোচ নিয়ে। উষসী হাই তুলে বলল,” ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে মা। তার উপর শরীরটাও আজ ভালো নেই। তাই যেতে ইচ্ছে করছে না।”

যুঁথি বেগম বিচলিত হয়ে বললেন,” শরীর ভালো নেই মানে? জ্বর এলো নাকি আবার? দেখি!”

কপালে হাত রেখেই আৎকে উঠলেন যুঁথি। আসলেই উষসীর শরীরটা গরম অনুভূত হচ্ছে। তিনি ব্যস্ত হয়ে বললেন,” দাঁড়া, থার্মোমিটার নিয়ে আসছি। চিন্তা করিস না, এটা ঠান্ডা জ্বর। নাপা খেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”

উষসী তাকিয়ে দেখল মা হন্তদন্ত হয়ে উষ্ণতাদের ঘরের দিকে ছুটছেন। তাকে চিন্তা করতে নিষেধ করে নিজেই চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠেছেন!

” ছোট আপামণি, আপনার জন্য পার্সেল আসছে।”

উষ্ণতার দেখা-শুনার জন্য একজন আয়া রাখা হয়েছে। সে পনেরো দিন হলো গ্রাম থেকে এখানে এসেছেন। নাম ফারজানা বানু। প্রতিদিন সকালের নাস্তাটাও এখন সে বানায়। উষসী অবাক হয়ে বলল,” পার্সেল মানে?”

” একটা লোক বাইরে খাড়ায় আছে। আমারে কইল আপনেরে ডাকতে।”

” আমার নাম বলেছে?”

” হ কইল তো। লামিয়া ইম্পরুজ উশুসি।”

উষসী খুব মর্মাহত হলো। তার এতো সাধের নামটাকে কি ভ’য়ংকর ভাবেই না ধর্ষণ করা হলো! সে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,” ফারজানা আপা, আপনি আর কখনও আমার নাম উচ্চারণ করবেন না প্লিজ। আমাকে ছোট আপা বলেই ডাকবেন।”

“হ, হেডাই তো ডাকি।”

মুখ ভেংচিয়ে চলে গেল ফারজানা। উষসী কৌতুহল নিয়ে দরজার কাছে এগোলো। অনলাইনে সে কিছুই অর্ডার করেনি। তাহলে পার্সেল কিভাবে এলো? গতকাল থেকেই তার সাথে আজব আজব ঘটনা ঘটছে। রাতে ওই রিকশাওয়ালা বিরক্ত করছিল। আর আজ সকাল সকাল এসেছে কোন পার্সেলওয়ালা! চোরের মতো নাক-মুখ ঢাকা লম্বাদেহী একটা লোক। গায়ের উপর ময়লা একটা চাদর। অদ্ভুত তার দাঁড়ানোর ভঙ্গি। উষসী বলল,” এক্সকিউজ মি, আমার জন্য কিসের পার্সেল?”

লোকটি চাপা স্বরে বলল,” ম্যাডাম, একটু বাইরে আসবেন?”

” স্যরি? বাইরে আসব মানে? আপনার যা দেওয়ার এখান থেকেই দিন।”

” ম্যাডাম… প্লিজ!”

উষসী দরজা ভেজিয়ে এক কদম বাইরে এগিয়ে এলো। তখনি ছেলেটি মুখ থেকে চাদর ওঠাল। আগন্তুকের চেহারা দেখে বিস্ময়ে চিৎকার দিতে নিচ্ছিল উষসী। ইয়ামিন তুমুল বেগে তার মুখ চেপে ধরে তাকে দূরে এনে দেয়ালের সাথে চেপে ধরল। কয়েক মুহূর্ত ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল তারা একে-অপরের দিকে। উষসীর মনে হলো সে স্বপ্ন দেখছে! এটা কোনোভাবেই সত্যি হতে পারে না।

ইয়ামিন রাগী গলায় প্রশ্ন করল,” আজ ভার্সিটি যাওনি কেন?”

ধমক খেয়ে সম্বিৎ ফিরল উষসীর। সে একটু ঝেড়ে কেশে গলা পরিষ্কার করে নিল। তারপর আপ্লুত গলায় বলল,” কেন? আপনি আমার সাথে দেখা করতে আমার ভার্সিটি গিয়েছিলেন বুঝি?”

” না, সারারাত তোমার বাসার নিচে হেঁটেছি আর মশার কামড় খেয়েছি।” ইয়ামিনের গলায় উত্তাপ।

উষসী চরম বিস্মিত হয়ে আওড়াল,” কি? সত্যি?”

ইয়ামিন হতাশাগ্রস্তের মতো বলল,” গাজীপুর যেতে নিয়েও ব্যাক করেছি। তোমাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়ার পর থেকে কিচ্ছু ভালো লাগছিল না৷ তার উপর আমার জন্য তুমি বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাড়ি ফিরেছো। জ্বর এসেছে নাকি চিন্তা হচ্ছিল। দেখি! ইশ, আসলেই তো গা খুব গরম।”

লজ্জা আর ভালোলাগায় উষসীর মন ভরে গেল। সে লাজুক গলায় বলল,” আপনি আমাকে সারা রাস্তা ফলো করেছেন তাই না? আর সারারাত বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন কেন? যদি কেউ দেখে ফেলতো?

” এতোকিছু মাথায় আসেনি তখন। আর আমি কাউকে ভ’য় পাই না। তোমার মাঁকড়সা দুলাভাইকে তো একদমই না! ভেবেছিলাম তুমি ভার্সিটির জন্য বের হলে দেখা হবে। কিন্তু সকাল নয়টার পরেও বের হচ্ছিলে না। তাই বাধ্য হয়ে ডেলিভারি বয় সেজে আমাকেই উপরে আসতে হলো।”

উষসী মায়া মায়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বরফের মতো শক্ত মনটা এখন বিগলিত হয়ে পানির ন্যায় ভাসছে। সে তন্ময় হয়ে ইয়ামিনের কথাগুলো শুনছে আর আবেগে কাতর হয়ে উঠছে। ইশ, ইয়ামিন কি তাকে সত্যি এতো ভালোবাসে? নিজেকে সামলে বলল,”এই চাদর কোথা থেকে এনেছেন? দেখে তো মনে হচ্ছে এক সপ্তাহ ধোঁয়া হয় না।”

” নিচের দারোয়ান থেকে এনেছি।”

উষসী মুখ টিপে হেসে ফেলল। ইয়ামিন চোখ সরু করে বলল,” তুমি হাসছো? আমার অবস্থা দেখে মজা লাগছে তোমার?”

” স্যরি।”

ইয়ামিন অনুযোগের স্বরে বলল,”কতবড় রিস্ক নিলাম তোমার জন্য! এরপরেও কি বলবে কাওয়ার্ড?”

উষসীর চোখ ভিজে উঠল। কান্না পেয়ে যাচ্ছে। সে অনুতাপ নিয়ে বলল,” আই এম স্যরি।আপনি সারারাত অনেক কষ্ট করেছেন তাই না? কিন্তু ফোন কেন বন্ধ ছিল?”

” তুমি ফোন ধরছিলে না। তাই রাগ করে আছাড় মেরেছিলাম। তারপর থেকেই বন্ধ। আর খুলছে না।”

উষসী এই কথা শুনে হাসবে না কাঁদবে ভেবে পেল না। কেবল শক্ত করে জড়িয়ে ধরল ইয়ামিনকে। এবার শান্তি লাগছে অনেকটা! সে আবেশপূর্ণ গলায় বলল,” জানেন, সারারাত আপনার চিন্তায় আমার ঘুম হয়নি।”

ইয়ামিন উষসীকে টেনে ওঠাল। তার চিবুক ছুঁয়ে ঠোঁটের দিকে তাকাল। নেশালো গলায় বলল,” আমারও ঘুম হয়নি। খুব অশান্তি লাগছিল। এবার একটু প্রশান্তি লাগবে।”

উষসীর ভ’য় লাগছে। যদি কেউ চলে আসে! কিন্তু এই মুহূর্তে ইয়ামিনকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা তার নেই!

ভেতর থেকে যুঁথি বেগমের আওয়াজ শোনা গেল,” উষু, এতোক্ষণ ধরে বাইরে কি করছিস? ভেতরে আয়।”

ছিটকে সরে গেল ইয়ামিন। পুনরায় চাদর দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল। যুঁথি বাইরে এসে শুধালেন,” কিরে, পার্সেল নিয়েছিস?”

উষসী হকচকিয়ে তাকাল। ইয়ামিন চাদরের নিচ থেকে একটা প্যাকেট বের করে বলল,” ম্যাডাম আপনার পার্সেল।”

উষসী হাসি হাসি মুখ করে প্যাকেট হাতে নিল। তারপর দেখিয়ে বলল,” এইতো মা, নিয়েছি পার্সেল।”

” ঠিকাছে। টাকা দিয়েছিস?”

” হুম।”

” তাহলে চলে আয়। দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”

উষসী বিব্রত নজরে একটু ইয়ামিনকে দেখল। ইয়ামিন চোখ মারল তাকে। উষসীর হার্টবীট বেড়ে গেল। ভেতরে ঢুকে তৃষাণকে দেখেই ভ’য়ে ছোটখাটো একটা চিৎকার দিয়ে ফেলল সে। তৃষাণ তখন বের হচ্ছে অফিসের জন্য। জুতো পরে তৈরী সে। এই মুহূর্তে বের হলেই তো ইয়ামিনের সাথে দেখা হবে! যুঁথি আশ্চর্য হয়ে বললেন,” কি হয়েছে?”

উষসী মুখভঙ্গি স্বাভাবিক রেখে বলল,” কিছু না৷ সকাল থেকে কিছু খাইনি তো। তাই মাথা ঘুরছে মা। ভাইয়া, তুমি কি এখনি বের হবে?”

তৃষাণ প্রশ্ন নিয়ে তাকাল,” হুম কেন?”

” মানে… একটু পরে বের হও!”

” অসম্ভব। আমি অলরেডি লেইট।” উষসীর বুক ধড়াস ধড়াস করছে। যুঁথি কাছে এসে বললেন,” তোর না মাথা ঘুরছে? তাড়াতাড়ি খেতে আয়! নাস্তা খেয়ে নাপা খাবি।”

তৃষাণ লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশেই চাদরে মুখ ঢেকে দাঁড়ানো ইয়ামিন। আঁড়চোখে বার-বার তার দিকেই তাকাচ্ছে তৃষাণ। লোকটাকে রহস্যময় লাগছে। লিফট খুললে দু’জনে একসাথেই ঢুকতে নিয়ে ধাক্কা খেল। তারপর ইয়ামিন দাঁড়িয়ে পড়ল। তৃষাণ বলল,” সমস্যা নেই। আপনি আগে যান।”

ইয়ামিন ঢুকল। এবার তৃষাণ আস্তে-ধীরে ঢুকল। দু’জনে একই সময় বাটনে ক্লিক করতে গেল। তখন তৃষাণ হাত সরিয়ে নিল। ইয়ামিন গ্রাউন্ড ফ্লোরে ক্লিক করল। দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তৃষাণ বলল,” আপনি কয়তলায় থাকেন?”

ইয়ামিন চুপ করে রইল। কথা বলতে গেলেই হয়তো ধরা পড়ে যাবে। তৃষাণ আবার ডাকল,” হ্যালো ভাই, শুনছেন?”

ইয়ামিন একটু নাটক করার ভঙ্গিতে বলল,” আমাকে বলছেন?”

” লিফটে তো আমরা ছাড়া কেউ নেই।”

” ও। আমি ভেবেছিলাম আপনি ফোনে কথা বলছেন!”

তৃষাণ মৃদু হেসে বলল,” কিন্তু আপনি দেখতেই পাচ্ছেন।আমার হাতে কোনো ফোন নেই।”

” স্যরি, আমি নোটিশ করিনি।”

লিফটের দরজা খুলে গেল। ইয়ামিন দ্রুত বের হয়ে যেতে লাগল। এমন সময় তৃষাণ আবারও ডাকল,” শুনুন।”

ইয়ামিন অনেকটা সামনে চলে গেছে। চাইলেই এখন সে দৌড়ে পালাতে পারে। কিন্তু সেটা করা বোধ হয় ঠিক হবে না। সে থামল। তৃষান কাছে এসে বলল,” আপনার ওয়ালেট। নিচে পড়ে গেছিল।”

ইয়ামিন ওয়ালেট নেওয়ার জন্য হাত বাড়াল। তখনি তৃষাণের নজরে পড়ল ইয়ামিনের হাতের ঘড়িটা। এই একই ঘড়ি গতকালও দেখেছিল সে। অফিসে ইয়ামিনের সাথে করমর্দন করার সময়। এর মানে তার সন্দেহ ভুল নয়। তৃষাণ ওয়ালেট গুটিয়ে বলল,” ওয়েট, আগে আপনার মুখ দেখি। তারপর দেবো।”

ইয়ামিন বিনা দ্বিধায় মুখ থেকে চাদর সরালো। তারপর পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল তৃষাণের দিকে। অবিব্রত গলায় বলল,” মুখ দেখা হয়েছে? এবার দিন।”

তৃষাণ দাঁতে দাঁত ঘঁষল। চোয়াল শক্ত করে বলল,” মনে হয় তোমার ম’রার অনেক শখ।”

ইয়ামিন এমনভাবে হাসল যেন তৃষাণের কথায় সে মজা পেয়েছে। রাগে ব্রক্ষতালু জ্বলে উঠল তৃষাণের। সহসা কলার চেপে ধরে বলল,” নিজেকে কি ভাবো তুমি?”

” ভাইয়া প্লিজ ছাড়ো ওকে!”

সিঁড়ির গোঁড়ায় দাঁড়িয়ে আছে উষসী। তার দুই চোখ ভর্তি অশ্রু। কণ্ঠে আর্তনাদ। শরীর মৃদু কাঁপছে। তৃষাণ ধাক্কা মারল ইয়ামিনকে। তারপর দারোয়ানের উদ্দেশ্যে বলল,” চাচা, এই রাস্কেলকে যদি আর কখনও বাড়ির আশেপাশে দেখি তাহলে কিন্তু তোমার চাকরি আমি খাবো। বুইঝো।”

দারোয়ানের মুখ চুপসে গেল। ইয়ামিন তার গায়ের চাদরটা খুলে দারোয়ানের হাতে তুলে দিয়ে বলল,” থ্যাঙ্কিউ চাচা। নেক্সট টাইম যদি তোমার চাকরি যায় তাহলে আমার কাছে এসো। আমি ফার্স্ট ক্লাস চাকরির ব্যবস্থা করে দেবো।”

তৃষাণ আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে ছুটে এসে ইয়ামিনকে আঘাত করল। পেছন থেকে উষসী চেঁচিয়ে উঠল। তৃষাণ ঘাড় ধাক্কা মারার ভঙ্গিতে বলল,” গেট লস্ট।”

ইয়ামিন তার হাত সরিয়ে বলল,” আমি নিজেই যাচ্ছি। কিন্তু আবার আসব।”

শেষ কথাটা সে উষসীর দিকে চেয়ে বলল। তৃষাণ রেগে-মেগে আবার তেড়ে যেতে নিলেই পেছন থেকে অনুনয় করল উষসী,” ভাইয়া প্লিজ, দোহাই তোমার। কিছু কোর না!”

তৃষাণ থামল তবে কটমট করে তাকিয়ে রইল। ইয়ামিন সেই জ্বলন্ত অগ্নিদৃষ্টির তোয়াক্কা না করেই উষসীর দিকে চেয়ে নরম স্বরে বলল,” বায়।”

উষসী চোখের জল মুছে মৃদু হাসল। তারপর ইয়ামিন চোখের পলকে গাড়ি নিয়ে হাওয়া হয়ে গেল। তৃষাণ উষসীর সাথে একটাও কথা না বলে চলে গেল। উষসী শুধু মনে মনে দোয়া করতে লাগল আর যাতে কোনো ঝামেলা না হয়!

” মাঁকড়সা, মাঁকড়সা, মাঁকড়সা!”

অনম চোখ বড় বড় করে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে। আটপায়ের মস্তবড় একটা মাঁকড়সার ছবি আঁকা হয়েছে সেখানে। মাঁকড়সার দেহে মানুষের মুখ বসানো। চশমা পরা এক ভদ্রলোকের মুখের চারপাশে মাঁকড়সার আটপা! কি বিদঘুটে পেইন্টিং! এর আগে অনম তার স্যারকে কখনোই এমন উদ্ভট জিনিস আঁকতে দেখেনি।

ইয়ামিন যে শুধু এই উদ্ভট ছবিটি এঁকেছে তা নয়। একই সঙ্গে উদ্ভট কাজ-কর্মও করছে। নিজের হাতে ছবিটি এঁকে এখন নিজেই ছু’রির সাহায্যে আঁকিবুঁকি করে নষ্ট করছে। থুথু দিচ্ছে ছবিতে। আবার মাঝে মাঝে উঠে লাথিও মারছে। শক্ত দেয়ালে লাথি মেরে লাভটা কি? উল্টো নিজেই আহত হচ্ছে।

অবশ্য মাতালকে এসব কে বোঝাবে? ইয়ামিন এখন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। অনেক বেশি ড্রিংক করে ফেলেছে সে। তাই খুব আবোলতাবোল বকছে। ছবিটির দিকে চেয়ে একমনে আওড়াচ্ছে,” মাঁকড়সা শালা, মাঁকড়সা। ম’র, শালা মাঁকড়সা!”

আরও ভ’য়ানক আর বীভৎস গালি দিচ্ছে। আচ্ছা, ছবির এই লোকটি কে? অনম ভ’য়ে ভ’য়ে একবার বলল,”স্যার, এইভাবে দেয়াল নষ্ট করলে ওরা আমাদের রিসোর্ট থেকে বের করে দিবে। প্লিজ স্যার, এবার থামুন।”

ইয়ামিন একটা কাঁচের বোতল তুলে ছুঁড়ে মারল দেয়াল বরাবর। ঝনঝন শব্দ করে ভেঙে গেল বোতলটি। অনম ভ’য়ে এক চিৎকার দিয়ে বাইরে বের হয়ে গেল। স্যার মনে হয় পাগল হয়ে গেছে। আজকে মনে হয় দেয়াল না ভেঙে ক্ষান্ত হবে না! ওই ঘরে ঢোকাও এখন রিস্ক। কি করা যায়?

হঠাৎ অনমের মাথায় বুদ্ধি এলো। মিসেস শিমলাকে একবার ফোন করলেই হয়। ইয়ামিন ইব্রাহীম খুব মা-ভক্ত ছেলে। এই মুহূর্তে মা ছাড়া তাকে কেউ সামলাতে পারবে না। শিমলা খবর পেয়ে আধঘণ্টার মধ্যে ছুটে এলেন। সাথে আপদ হিসেবে নিয়ে এলেন ফাবিয়াহকেও। তাকে দেখে ইয়ামিন আরও বেশি ক্ষেপে গেল। উত্তাল ভাঙচুর শুরু করল। মিসেস শিমলা বহু কষ্টে ছেলেকে শান্ত করলেন।

” বাবা, প্লিজ আমার সাথে বাড়ি চল।”

ইয়ামিন গম্ভীর মুখে বলল,” ইম্পসিবল। আপনার হাজব্যান্ডের বাড়িতে আমি যাবো না মিসেস শিমলা!”

” তুই আমাকে আপনি, আপনি করছিস কেন? আমি তোর মা!”

” আপনি ইহতেশাম চৌধুরীর ওয়াইফ।”

” বুঝলাম, উষসীকে মেনে নিচ্ছি না বলে এসব করছিস? কিন্তু আমার কি দোষ? তোর বাবা তো কারো কথা শোনে না। তবে এবার আমি তোকে কথা দিলাম। তুই একবার আমার সাথে বাড়ি চল। আমি সব ঠিক করে দিবো। উষুকে ডিনারে ডাকব আমাদের সাথে।”

“প্রমিস!”

” প্রমিস বাবা,প্রমিস!”

ইয়ামিন শিমলার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেল। ভেতরের থেকে ফাবিয়াহ তাদের সব কথোপকথন শুনছিল। তার মুখে অমাবস্যার রাতের মতো আঁধার নেমে এলো।

অনম এক পর্যায়ে এসে জিজ্ঞেস করল,” আচ্ছা ম্যাডাম,ছবির এই লোকটি কে? আপনি চেনেন? স্যার খুব ক্ষেপে আছে এনার উপর। বার-বার থুথু আর লাথি মারছে।”

মিসেস শিমলা মনোযোগ দিয়ে তাকালেন দেয়ালের ছবিটির দিকে। কিন্তু চিনতে পারলেন না।

ভার্সিটি থেকে বাসায় ফেরার পথে উষসী ভাবল, ইয়ামিনের সাথে দেখা করতে যাবে৷ বাড়ির পরিবেশ এখন অনেক গুমোট। সবাই ইয়ামিনের কথা জেনে গেছে। উষসী কাউকে ফেইস করতে চায় না। তাই গাড়ি ঘুরিয়ে রিসোর্টের দিকে যেতে লাগল। ইয়ামিন সকালে যে পার্সেল এনেছিল সেখানে তার রিসোর্টের একটা কার্ড, কিছু ফুল আর চকলেট ছিল। আপাতত সেই কার্ড দেখেই উষসী গুগল ম্যাপ খুঁজে রিসোর্টের ঠিকানা বের করেছে। ইয়ামিনকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য আগে থেকে কিছু জানায়নি।

মিসেস শিমলা শপিং-এ গেছেন। আজরাতে তিনি ছেলের সাথে এখানেই থাকবেন। তাই প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস নিতে বের হয়েছেন। ইয়ামিন এলোমেলোভাবে ঘুমাচ্ছে বিছানায়। ফাবিয়াহ তার পাশেই বসে আছে। গালে হাত রেখে একমনে সে দেখছে ইয়ামিনকে। ঘুমন্ত রাজকন্যার গল্প সে ছোটবেলায় শুনেছিল। কিন্তু ঘুমন্ত রাজপুত্রের গল্প শোনেনি। এইতো, তার স্বপ্নের ঘুমন্ত রাজপুত্র! ঘুমালে তাকে কত সুন্দর দেখায়! আচ্ছা, শেষমেষ তাদের বিয়েটা কি হবে?

লুকিয়ে মা-ছেলের কথোপকথন শুনছিল ফাবিয়াহ। শিমলা আন্টি ইয়ামিমের জেদের কাছে হার মেনে বলেছেন উষসীকে স্বীকার করবেন৷ যদি সত্যিই তাই হয়, তাহলে ফাবিয়াহর কি হবে? এতোদিন সে যার জন্য এতো স্বপ্ন দেখল সেসব কিছুই কি পূরণ হবে না? এতোবড় ঘটনাও৷ কি তাদের বিয়ের জন্য যথেষ্ট না?

আচ্ছা, তাদের মধ্যে যদি এমন কিছু হয়ে যায় যাতে করে ইয়ামিন তাকে বিয়ে করতে বাধ্য হবে, তাহলে কেমন হয়? ভালোবাসা তো বিয়ের পরেও সম্ভব। কিন্তু যদি বিয়েই না হয় তাহলে ভালোবাসা হবে কি করে? কথাটা ভেবেই ফাবিয়াহর ঠোঁটে মিষ্টি রোদের মতো এক চিলতে মুচকি হাসি ফুটল।

অনম করিডোরে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে৷ হঠাৎ দরজা বন্ধ করার শব্দ শুনে সে চমকে উঠল। ভেতরে ইয়ামিন একা শুয়ে আছে। ফাবিয়াহ ঢুকে দরজা বন্ধ করল কেন? এই মেয়ের মতলব কি? অনম করাঘাত করতে লাগল,” ম্যাডাম, এক্সকিউজ মি। দরজা খুলুন ম্যাডাম।”

কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। অনম ঘামতে লাগল। কি আশ্চর্য!

ইয়ামিনের পাশে এসে শুয়ে পড়ল ফাবিয়াহ। আলতো করে তার গালের উপর হাত রাখল। মন-প্রাণ আবেশিত হলো সুখময় শীহরণে। এই শীহরণ বিচ্ছিন্ন করে তীক্ষ্ণ শব্দে বেজে উঠল ইয়ামিনের মোবাইল ফোন। ফাবিয়াহ বিরক্ত হয়ে মোবাইলটা হাতে নিতেই দেখল উষসী ফোন করছে। ফাবিয়াহ ফোনটা কেটে সুইচড অফ করে দিল।

ইয়ামিন এতো গভীর নিদ্রায় তলিয়ে আছে যে ফোনের শব্দেও উঠল না। তবে সামান্য নড়ল। তার লম্বাটে ভারী হাতটা ফাবিয়াহর গায়ের উপর উঠে গেল। নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসার উপক্রম হলো ফাবিয়াহর। সে ইয়ামিনের আরও কাছে এলো। নিজের মোবাইল বের করে কয়েকটা অন্তরঙ্গ ছবি তুলে ফেলল দ্রুত। এই ছবিগুলোও আগের মতো ভাইরাল হবে নিশ্চয়ই। সবাই খুব আগ্রহ নিয়ে আলোচনা করবে।

তুমুল উৎসাহে ফাবিয়াহর চোখ জ্বলজ্বল করছে। সে ইয়ামিনের ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে বলল,” আ’ম স্যরি। কিন্তু সারাজীবন তোমার সাথে থাকার জন্য আমি সব করতে প্রস্তুত।”

ইয়ামিন ফোন কেটে দিল কেন? আবার সুইচড অফ দেখাচ্ছে। সে কি রাগের মাথায় আবার ফোন আছাড় মেরেছে? আশ্চর্য লোক! হঠাৎ করিডোরে অনমকে দেখা মাত্রই উষসী ছুটে গেল সেদিকে। হাস্যোজ্জ্বল কণ্ঠে বলল,” অনম ভাই, কেমন আছেন?”

উষসীকে দেখে র’ক্তশূন্য হয়ে গেল অনমের মুখটা। সে কাঁপা গলায় বলল,” ম্যাডাম, আপনি এখানে?”

উষসী ভ্রু কুঁচকে বলল,” এতো অবাক হওয়ার কি আছে? আমার কি আসা নিষেধ? ডাকুন আপনার স্যারকে। উনি কোথায়?”

অনম কপালের ঘাম মুছল। নর্ভাসনেসে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।

“স্যার তো ঘরে। ঘুমাচ্ছেন।”

” ও। এজন্যই তাহলে ফোন সুইচড অফ! আচ্ছা তাহলে উনাকে ঘুম থেকে তুলুন। বলুন যে আমি এসেছি।”

ভ’য়ে আর আতঙ্কে শুকিয়ে গেল অনমের গলা। উষসী তার দিকে তাকিয়ে বলল,” কি হয়েছে আপনার? এমন করছেন কেন? উনি কি অসুস্থ?”

” না, না, স্যার একদম সুস্থ। আসলে হয়েছে কি… দরজা ভেতর থেকে লক। ”

” তো কি হয়েছে? নক করলেই তো হয়।”

” স্যার অনেক ড্রিংক করেছেন। তাই হাজার ডাকলেও এখন উঠবেন না।”

উষসী এই কথা শুনে রেগে গেল। ড্রিংক করেছে মানে? সে জোরে জোরে দরজায় আঘাত করতে লাগল। উচ্চশব্দে ডাকতে লাগল,” মিস্টার সিংগার, দরজা খুলুন।”

ফাবিয়াহ তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নামল। দরজার শব্দে ইয়ামিন যে-কোনো সময় জেগে যেতে পারে। তখন তাকে এভাবে দেখলে কেলেংকারি হবে। তাই সে কোনমতে উঠে বাথরুমে চলে গেল। কিন্তু তার ওরনা ইয়ামিনের বিছানাতেই রয়ে গেল।

চলবে

#উষসী_হাসবে_বলে (৩০)
লিখা- Sidratul Muntaz

বাথরুমে আসার পর ফাবিয়াহ হঠাৎ খেয়াল করল তার ওরনাটা এখনও বিছানাতেই রয়ে গেছে। কি সর্বনাশ!এখন তো বের হওয়াও সম্ভব না। ইয়ামিনের ঘুম ভেঙে গেছে। দরজার ফাঁকা দিয়ে উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করল ফাবিয়াহ। ইয়ামিন হেলেদুলে দরজা খুলতে এগিয়ে যাচ্ছে। ফাবিয়াহ দরজায় পিঠ ঠেঁকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

দরজা খুলে মাথা বের করল ইয়ামিন। উষসীকে দেখে তার মুখ ভরে উঠল হাসিতে। খোশমেজাজে বলল,” হাইইই, কেমন আছো?”

উষসী কটমটে দৃষ্টিতে ইয়ামিনকে পরোখ করছে। এই শীতের মধ্যেও সে দিব্যি খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছে। অবশ্য ঠিক করে দাঁড়াতেও পারছে না। খানিকটা টলছে। মুখ ভর্তি অদ্ভুত হাসি।

উষসী খরখরে গলায় বলল,” আপনি ড্রিংক করেছেন?”

ইয়ামিন অবাক হওয়া দৃষ্টিতে তাকাল৷ দুই পাশে মাথা নেড়ে সরাসরি অস্বীকার করল,” না তো!”

“তাহলে অনম ভাই কি মিথ্যা বলছে?”

ইয়ামিন ক্রুর দৃষ্টিতে অনমের দিকে তাকাল। অনম জিভ কেটে দ্রুত সংশোধন করার মতো বলল,” ভুল বলেছি ম্যাডাম। স্যার তো ওসব ছুঁয়েও দেখেন না। খাওয়া তো দূর!”

উষসী আহত মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল। এখন দু’জনেই তাকে মিথ্যা বলতে থাকবে। কিন্তু সে একটাও মিথ্যা শুনতে চায় না। ইয়ামিনকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল উষসী। অনমও তার সাথে ঢুকতে নিচ্ছিল কিন্তু ইয়ামিন হাত ঠেঁকিয়ে বাঁধা দিল তাকে। অনম বলল,” স্যার, ভেতরে..”

ইয়ামিন বলল,” শশশ, ইটস মাই প্রাইভেট টাইম।”

অনম উঁকি মেরে ভেতরে খুঁজছে ফাবিয়াহকে। ইয়ামিন সেই মুহূর্তে তাকে ধা’ক্কা মেরে বলল,”গেট লস্ট।”

” কিন্তু স্যার ফাবি…” অনম তার কথা সম্পূর্ণ করতে পারল না। এর আগেই ইয়ামিন তাকে ঠেলে বের করে দরজা আটকে দিল। অনম মুখে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে।ফাবিয়াহ ম্যাডামকে সে বের হতে দেখেনি। এর মানে ভেতরে এই মুহূর্তে তারা তিনজন! কিন্তু এই কথা তো মনে হয় ইয়ামিন জানে না।

” স্যার, একটা জরুরী বিষয় স্যার। একটু দরজা খুলুন।”

অনম প্রাণপনে দরজায় আঘাত করছে। সরাসরি ফাবিয়াহর নামটা সে নিতে পারছে না কারণ উষসী শুনে ফেলবে।

উষসী উপহাস করে বলল,” বাহ, চমৎকার! আমি এদিকে আমাদের রিলেশনের কমপ্লিকেশনস নিয়ে টেনশনে ম’রছি। আর আপনি বসে বসে ড্রিংক করছেন?”

” আমি সত্যি ড্রিংক করিনি।আই সুয়্যার!”

” একটা চ’ড় দিবো আরেকটা মিথ্যা বললে। এসব কি?”

টেবিলে রাখা কাঁচের বোতল গুলো ইশারা করল উষসী।ইয়ামিন নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল,” পানির বোতল। বিশ্বাস করো, আমি কখনও মদ খাই না। তবে মদের বোতলে করে পানি খাই।”

” আমার চেহারায় কি বলদ লেখা আছে যে আপনার ফালতু কথা বিশ্বাস করব? মদ খেয়ে পুরো মাতাল হয়ে আছেন আর এখন অস্বীকার করছেন?”

উষসী থেমে গেল। তার নজর চলে গেছে দেয়ালের সেই বিখ্যাত ছবিটিতে। সে প্রায় আৎকে উঠে বলল,” ও মাই গড, এটা আবার কি?”

ইয়ামিন দ্রুত উষসীর চোখের উপর হাত রাখল। তারপর তাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলল,” কিছু না। এটা তোমার দেখার দরকার নেই।”

” কিন্তু আমি দেখব৷ ছাড়ুন আমাকে। ওটা কি তৃষাণ ভাইয়ের মুখ?”

” মোটেও না।”

“তাহলে আমাকে দেখতে দিচ্ছেন না কেন?”

” দেখলে তুমি ভ*য় পাবে। খুব বাজে পেইন্টিং। সত্যি বলছি। হুম!”

উষসী ইয়ামিনকে সজোরে ধাক্কা মেরে সরালো। তারপর ভালো করে দেখল দেয়ালের ছবিটি। চারপাশে ইংরেজি শব্দে কিছু গালা-গালও লেখা। উষসী এসব দেখতে দেখতে মুখে হাত ঠেঁকাল। করুণ গলায় বলল,” ছি, আপনি এসব লিখে রেখেছেন আমার তৃষাণ ভাইয়ের নামে?”

ইয়ামিন মুখ গোঁজ করে বলল” তৃষাণ না, তৃষাণ না, বলো মাঁকড়সা ভাই। মাঁকড়সার মতো লেগে আছে আমার পেছনে। তার মুখে একগাদা মাঁকড়সা ছুঁড়ে দিতে পারলে শান্তি লাগতো। ফুসস!”

ইয়ামিন হাত দিয়ে দেয়ালে কাল্পনিক মাঁকড়সা ছুঁড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করল। উষসী এবার সম্পূর্ণ হতাশ। না, এই মুহূর্তে ইয়ামিনের সাথে রাগ করার কোনো মানেই হয় না। কেমন বেফাঁসের মতো আচরণ করছে সে। সে যে একেবারেই হুশে নেই তা এক দেখাতেই বলে দেওয়া যায়।

উষসী কাছে এসে তার বাহুতে হাত রাখল। নরম গলায় বলল,” কিন্তু এসব করে কি লাভ হচ্ছে বলুন? আপনি নিজের অবস্থা দেখেছেন! এভাবে তো অসুস্থ হয়ে যাবেন। আপনাকে নিয়ে আমার খুব টেনশন হচ্ছে। প্লিজ, নিজের যত্ন করুন। এসব আর কখনও খাবেন না কথা দিন।”

ইয়ামিন ঘোরগ্রস্তের মতো তাকাল। কি অদ্ভুত মায়াময় কণ্ঠে কথা বলছে উষসী! কি নেশালো তার চুলের ঘ্রাণ, পারফিউমের সুবাস। ঘরটা যেন ফুলের বাগান হয়ে উঠেছে তার আগমনে। ইয়ামিন আশেপাশে অনেক উড়ন্ত প্রজাপতি দেখতে পাচ্ছে। সবগুলো প্রজাপতি গোল হয়ে ঘিরে আছে তার উষসী ফুলকে। ইয়ামিন সেগুলো সরিয়ে দিতে দিতে বলল,” ডন্ট টাচ হার। শী ইজ মাইন। ডন্ট টাচ।”

উষসী আশ্চর্য হয়ে বলল,” মাথাটা গেছে আপনার।”

ইয়ামিন তাকাল উষসীর মুখের দিকে। তার ডাগর চোখ দু’টো যেন স্বচ্ছ টলটলে দিঘী। আর ঠোঁট দু’টো প্রশান্তির উৎস। ইয়ামিন খানিকটা নিচু হয়ে উষসীর ঠোঁট আঁকড়ে ধরল। বিকেলের নরম রোদ জানালা গলে এসে পড়েছে বিছানায়। চোখের পলকেই বদলে গেল পরিবেশ। মিষ্টি নীরবতা ঘিরে ধরল চারদিকে।

ফাবিয়াহ দরজার ফাঁকা দিয়ে তখনও তাদের দেখছিল। তার দমবন্ধ হয়ে আসছে এখন। একবার ভাবল এই অবস্থাতেই বের হয়ে যাবে। কিন্তু সেটা করা উচিৎ হবে না৷ এতে তার অসৎ উদ্দেশ্য ধরা পড়ার সম্ভাবনা আছে।

অনম দরজায় কড়া নাড়ছে,” স্যার, প্লিজ স্যার। একটু শুনুন। জরুরী কথা!”

ইয়ামিন ভারী গলায় বলল,” অনম, তুমি যদি আরেকবার ডিস্টার্ব করো তাহলে স্যালারী কেটে রাখব।”

ওই পাশ থেকে আর কোনো শব্দ শোনা গেল না। ইয়ামিন পুনরায় উষসীকে কিস করতে নিল। উষসী এই পর্যায় বাঁধা দিয়ে বলল,” আমি একটা জরুরী কথা বলতে চাই।”

ইয়ামিন ফিসফিস করে বলল,” কোনো কথা না,চুপপ!”

আচমকা তাকে অপ্রত্যাশিত ভাবে কোলে তুলে নিল ইয়ামিন। আৎকে উঠল উষসী। সারাদেহ থরথর করে কাঁপছে। গলায় জমাট বেঁধে গেছে শব্দ। বুকের ভেতরটা যেন ফেটে যাবে। সে কোনমতে উচ্চারণ করল,” আপনি একদম হুশে নেই। আমার এখান থেকে চলে যাওয়া উচিৎ।”

উষসীর গলা কাঁপছে। ইয়ামিন বলল,” কোথাও যাবে না তুমি। আমি যেতে দিবো না।”

“এটা ঠিক না। আপনি নেশাগ্রস্ত। ভুল হয়ে যেতে পারে।”

ইয়ামিন তাকে বিছানায় এনে শোয়ালো। ঘোরের কণ্ঠে বলল,” মাঝে মাঝে ভুল করতে হয় উষসী।”

” সবসময় ভুল করা উচিৎ না। কিছু ভুলের মাশুল অনেক দাম দিয়ে শোধ করতে হয়। আপনিই বলেছিলেন। সুইজারল্যান্ডে…মনে আছে?”

“আর তুমি কি বলেছিলে সেটা মনে আছে?”

উষসী করুণ কণ্ঠে বলল,” আমি মনে করতে চাই না। না!”

ইয়ামিন উষসীর ঠোঁটের উপর নিজের একটা আঙুল চেপে ধরল। তারপর প্রশ্ন করল,” তুমি কি চাও উষু? আমি থেমে যাই?”

উষসী চোখ বন্ধ করে মাথা ঝাঁকাল। ইয়ামিন বলল,” আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলো যে তুমি চাও না। তাহলে আমি এখানেই থেমে যাবো। প্রমিস।”

উষসী নিশ্চুপ। তার মস্তিষ্ক ভীষণ ফাঁকা, শব্দভান্ডার শূন্য। শুধু বুকের মধ্যে বেসামাল অনুভূতিদের প্রলয়!তার নীরবতায় মৃদু হাসল ইয়ামিন। কপালে চুমু দিয়ে বলল,” সাইলেন্স ইজ দ্যা সাইন অফ কনসেন্ট।”

উষসী রা করার আগেই ইয়ামিন তাকে একনাগাড়ে চু’মু দিতে লাগল। আবৃত করে ফেলল পুরোপুরি। ঠিক এই সময় ফাবিয়াহর হাত থেকে ফোনটা পড়ে যায়। নীরব পরিবেশে ওইটুকু শব্দই তীক্ষ্ণ আলোড়ন তুলে যেন। উষসী কেঁপে উঠে বলল,” বাথরুমে মনে হয় কেউ আছে।”

” শশশ, কোথাও কেউ নেই।”

” আপনি পরে এসবের জন্য আফসোস করবেন। ”

ইয়ামিন কথা বলল না। উষসী এক ধাক্কায় তাকে সরিয়ে উঠে বসে গেল। ইয়ামিন চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। হাসতে লাগল শব্দ করে। উষসী উঠে দাঁড়িয়ে বলল,” আমি চলে যাচ্ছি।”

ইয়ামিন উঠে বসে বলল,” ভ*য় পেয়েছো?”

“না। আমি আপনাকে ভরসা করি। নাহলে এখানে আসতামই না।”

ইয়ামিন কাছে এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল উষসীকে। কাঁধে মুখ গুজে বলল,” আই লভ ইউ।”

উষসীর মন সিক্ত হয়ে উঠল। হালকা হেসে বলল,” আই লভ ইউ টু। ”

ইয়ামিন যেই হাত দিয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরে আছে সেই হাতে চু’মু দিল উষসী। তারপর বলল,”এখন আমাকে যেতে হবে। নাহলে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে।”

” চলো, তোমাকে পৌঁছে দেই?”

” আপনি এই অবস্থায় ড্রাইভ করবেন? পাগল! রেস্ট করুন প্লিজ। আমি একাই চলে যেতে পারব।”

ইয়ামিন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,” সাবধানে যেও।”

” আপনিও সাবধানে থাকবেন। বায়।”

” বায়।”

উষসী চলে যাওয়ার পর ইয়ামিন বিছানায় এসে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। গায়ে কমফোর্টার টানার সময় খেয়াল করল সবুজ রঙের একটা ওরনা নিচে চাপা পড়ে আছে। এটা নিশ্চয়ই উষসী ফেলে গেছে! ইয়ামিন মৃদু হাসল। ভীষণ ক্লান্ত সে।নেশার কারণে একটুও চোখ খুলে রাখা যাচ্ছে না। ওরনাটা হাতে জড়িয়েই সে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ল।

বেশ কিছুক্ষণ পর ফাবিয়াহ বাথরুম থেকে বের হয়। খুব সাবধানে ধীরপায়ে ঘরের বাইরে চলে আসে। অনম তাকে দেখে ছুটে এসে বলল,” ম্যাডাম, আপনি কি এতোক্ষণ ভেতরেই ছিলেন?”

ফাবিয়াহ থতমত খেয়ে উঠল। তারপর রাগী কণ্ঠে বলল,” আপনার তাতে কি? অয়েল ইউর অউন মেশিন।”

ফাবিয়াহ অপ্রস্তত পায়ে দ্রুত হাঁটতে লাগল। অনম তার পেছন পেছন আসছে। ফাবিয়াহ ক্ষেপে উঠে পেছনে ঘুরতেই তার হাতের ফোনটা ছিটকে পড়ে গেল দূরে। আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠল ফাবিয়াহ,” আহ… আমার ফোন!”

” আমি এনে দিচ্ছি ম্যাডাম। এক্ষুণি এনে দিচ্ছি।”

ঝোঁপের মধ্যে ফোনটা পড়েছে। তখন সন্ধ্যা নামার সময়। চারদিক অন্ধকারে তলিয়ে আসছে ক্রমশ। অনম ফ্ল্যাশ লাইট দিয়ে ফোন খোঁজার চেষ্টা করল। কিন্তু পাচ্ছে না। তারপর বলল,” ম্যাডাম, আপনার নাম্বারটা বলুন। ফোন দিয়ে দেখি।”

ফাবিয়াহ চিন্তিত মুখে নাম্বার বলল৷ এই ফোন খুঁজে না পাওয়া গেলে ভারী মুশকিল হয়ে যাবে। অনম ডায়াল করে বলল,” নাম্বার তো বন্ধ!”

” ওহ শিট!”

অনম হাসার ভঙ্গি করে বলল,” মনে হয় পড়ে যাওয়ার কারণে বন্ধ হয়ে গেছে।”

” ফোনটা খুঁজে দিন প্লিজ। এই ফোন বের করে দিলে আমি আপনাকে দশহাজার টাকা দিবো।”

” দেখছি ম্যাম, চিন্তা করবেন না।”

অনম দেড়ঘণ্টা ধরে মোবাইল খুঁজল। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না। সে হতাশ স্বরে বলল,” এখানে ছোট্ট একটা কূপ আছে ম্যাডাম। মনে হয় ওখানেই পড়ে গেছে। নাহলে পাচ্ছি না কেন?”

ফাবিয়াহ দিশেহারার মতো হয়ে গেল। এবার কি হবে? ফোনের ছবিগুলো যে তার ভীষণ দরকার ছিল!

অনম বলল,” মশা কামড়াচ্ছে ম্যাডাম। আপনি ভেতরে যান। আমি আরও কিছুক্ষণ খুঁজে দেখি।”

ফাবিয়াহ হঠাৎ বলল,” আমাকে একটা সাহায্য করতে পারবেন? অনেক টাকা দিবো আপনাকে!”

_______________
মিসেস শিমলা এতোবার করে ইয়ামিনের নাম্বারে ফোন করছেন কিন্তু ছেলেটা ধরছে না। তার ফোন বন্ধ। ফাবিয়াহরও একই অবস্থা। দু’জনই একই সময় মোবাইল বন্ধ করে রেখেছে। কি অদ্ভুত ব্যাপার! অনমের মোবাইল নাম্বার নেই বলে কোনো খোঁজ নিতে পারছেন না তিনি।

সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় শিমলা রিসোর্টে ফিরলেন। তখন অনম অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারী করছে করিডোরে। শিমলা তীক্ষ্ণ মেজাজ নিয়ে বললেন,” ফায়া আর ইয়ামিন কোথায় অনম? ওদের এতোবার ফোন করলাম তাও কোনো খোঁজ নেই।”

” ইয়ে মানে… ম্যাডাম..” অনম ভীষণ অস্বস্তিবোধ করছে।

শিমলা দরাজ গলায় বললেন,” ব্যাগ গুলো ধরো। আর আমার পেছনে আসো।”

” জ্বী ম্যাডাম। ধরছি।”

দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। শিমলা অবাক হয়ে বললেন,” ভেতরে কে?”

” ফাবিয়াহ ম্যাডাম আর স্যার।”

শিমলা চোখ বড় করে তাকালেন। অনম আর কিছু বলতে পারছে না। মাথা নিচু করে আছে। শিমলা বিব্রত স্বরে বললন,” ঠিকাছে৷ তুমি যাও।”

অনম ব্যাগ গুলো মেঝেতে রেখে চলে গেল। শিমলা দরজায় করাঘাত করলেন। একটু পর ফাবিয়াহ এসে খুলল দরজা। তার মাথা নত। চোখ দু’টো লালচে। চেহারা ফ্যাকাশে। দেখে মনে হচ্ছে কেঁদেছে!

শিমলা ভীষণ বিস্মিত হয়ে গেলেন। উৎকণ্ঠা নিয়ে শুধালেন,” কি হয়েছে মা?”

ফাবিয়াহ শিমলাকে জড়িয়ে ধরল। পাথরের মতো স্তম্ভিত হয়ে গেলেন শিমলা। কথা বলার শক্তি খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। ইয়ামিনের কিছু হয়ে যায়নি তো? নাহলে ফাবিয়াহ এইভাবে কেন কাঁদবে? তিনি কোনমতে ফাবিয়াহকে সরিয়ে ছেলের ঘরে এগোলেন। ফাবিয়াহ একটা কথাও বলল না। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ছবিগুলো হারিয়ে খুব বেশি ক্ষ’তি হয়নি। বরং এই পরিকল্পনা আরও বেশি কাজে লাগবে!

ইয়ামিন বিছানায় শুয়ে আছে। সে ঘুমন্ত। তার হাতে প্যাঁচানো ফাবিয়াহর ওরনা। শিমলা আবার ড্রয়িংরুমে এলেন। ফাবিয়াহ কেঁপে কেঁপে কাঁদছে। শিমলা হতভম্ব গলায় বললেন,” ফায়া, কি হয়েছে আমাকে বলবে প্লিজ?”

ফাবিয়াহ চোখ মুছে বলল,” আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না আন্টি, প্লিজ।”

শিমলা নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। তাঁর ছেলে কখনও কোনো মেয়েকে অসম্মান করেনি। তাহলে এসব কি? মাথাটা ঘুরে আসছে। শিমলা কাউচের উপর বসলেন। বেশ কিছুক্ষণের নীরবতা। হঠাৎ শিমলা বললেন,” ইয়ামিন এতোবড় অন্যায় কিভাবে করল? ওকে এই ভুলের মাশুল দিতে হবে। নিজের ছেলের অন্যায় প্রশ্রয় দেওয়ার মতো খারাপ মা আমি না। তুমি নির্দ্বিধায় বলো ফাবিয়াহ, কি হয়েছিল?”

ফাবিয়াহ মাথা নিচু করে বলল,” বলে কি হবে আন্টি? আমি তো সব হা’রিয়ে ফেলেছি…”

হু হু করে কেঁদে উঠল সে। শিমলা কি করবেন বুঝতে পারছেন না। তাঁর দুনিয়া ঘুরছে। ব্যাগ থেকে বোতল বের করে একটু পানি খেয়ে ধাতস্থ হলেন। তারপর কাছে এসে বললেন,” এই কথা শুধু আমরা দু’জন ছাড়া কেউ জানবে না। আমি কথা দিলাম, ইয়ামিনের সাথেই তোমার বিয়ে হবে।”

” এটা সম্ভব না আন্টি। ইয়ামিন অন্যকাউকে ভালোবাসে।”

” তাহলে ও তোমার সাথে এটা কেন করল?”

ফাবিয়াহ নিশ্চুপ। শিমলা কঠিন গলায় বললেন,” যাই হয়ে যাক, ও তোমাকেই বিয়ে করবে।”

ফাবিয়াহ অসহায়ের মতো পুনরায় জড়িয়ে ধরল শিমলাকে। শিমলা হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন ফাবিয়াহর চুলে। ফাবিয়াহ কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল,” আপনি খুব ভালো আন্টি৷ আপনাকে দেখলে আমার মায়ের কথা মনে পড়ে যায়।”

চলবে